ছেলেমানুষি

ছেলেমানুষি

ব্যবধান টেকেনি। হাত দুই চওড়া সরু একটা বন্ধ প্যাসেজ বাড়ির সামনের দিকটা তফাত করে রেখেছে, দু-বাড়ির মুখোমুখি সদর দরজাও এই প্যাসেজটুকুর মধ্যে। পিছনে দু-বাড়ির ছাদ এক, মাঝখানে দেয়াল উঠে ভাগ হয়েছে, মানুষ-সমান উঁচু। টুল বা চেয়ার পেতে দাঁড়ালে বড়দের মাথা দেয়াল ছাড়িয়ে ওঠে।

ব্যবধান টেকেনি। কতটুকু আর পার্থক্য জীবন-যাপনের, সুখদুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আনন্দের, ঘৃণা ভালোবাসার। সকালে কাজে যায় তারাপদ আর নাসিরুদ্দীন, অপরাহ্নে ফিরে আসে অবসন্ন হয়ে। ব্যর্থ স্বপ্ন উৎসুক কল্পনা দিন দিন জমে ওঠে একই ধরনের, ক্ষোভ দিনে দিনে তীব্র হয় দুটি বুকে একই শক্তির বিরুদ্ধে। ইন্দিরা আর হালিমা যাপন করে বন্দি জীবন-রাধে-বাড়ে, বাসন মাজে, স্বপ্ন দেখে আর অকারণ আঘাত মুখ বুজে সয়ে চলে অবুঝ নিষ্ঠুর সংসারের। ইন্দিরার কোলে একদিন আসে গীতা। পরের বছর অবিকল তারই বেদনাকে নকল করে হালিমা পৃথিবীতে আনে হাবিবকে।

যদি-বা টিকতে পারত খানিক ব্যবধান, দুরন্ত দুটি ছেলেমেয়ে মানুষের তৈরি কোনো কৃত্রিম দূরত্ব মানতে অস্বীকার করে তা-ও ভেঙে দেয়। কাছে আনে পরিবার দুটিকে। অন্তরঙ্গ করে দেয় ইন্দিরা আর হালিমাকে।

একদিন একটি শুভ লগ্নে দুটি ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় পাড়ায়। গীতা পায় নতুন খেলা। মার শাড়ি ভাঁজ করে সে পরে, সিঁদুরের টিপ আর চন্দনের এলোমেলো ফোঁটা আঁকে কপালে আর গালে, পাড় দিয়ে বাবার লাল টুথব্রাশটির মুকুট এঁটে সে কনে সাজে হাবিবের। কপালে চন্দন লেপে গলায় গামছা-পাকানো উড়ুনি ঝুলিয়ে দিয়ে হাবিবকে বরবেশে সে-ই সাজিয়ে দেয়। শাশুড়ির অভিনয় করতে হয় ইন্দিরা আর হালিমা দু-জনকেই। উলু দিয়ে বরণ করতে হয় জামাইকে ইন্দিরার, বৌকে হালিমার। খাবার আনিয়ে জামাই-আদরে বৌ-আদরে দুজনকে খাওয়াতে হয় মুখে খাবার তুলে দিয়ে। নইলে নাকি খায় না নতুন বর-বৌ। থেকে থেকে দু-জনে তারা ফেটে পড়ে কৌতুকের হাসিতে। তাতে রাগতে রাগতে হঠাৎ বিয়ের কনের লজ্জা-শরম ভুলে গিয়ে মেঝেতে হাতপা ছুঁড়ে কান্না শুরু করে গীতা। তারপর থেকে থেকে তাদের হাসতে হয় মুখে আঁচল গুঁজে।

মাকে নকল করে গীতা হাবিবকে ডাকে, ওগো? ওগো শুনছ? জামাই। এই জামাই! ডাকছি যে?

হাবিব বলে, অ্যাঁ?

অ্যাঁ কী? অ্যাঁ না। বলে কী গো?

হালিমা আর ইন্দিরা ঢলে পড়ে পরস্পরের গায়ে। মুখ ভার করে থাকে পিসি। হালিমা বাড়ি ফিরে যাওয়ামাত্র বলে, এ সব কী কাণ্ড বৌমা?

কেন পিসিমা?

চা খাওয়ালে, বেশ করলে। তা চা যে খেয়ে গেল কাপে মুখ ঠেকিয়ে, কাপটা শুধু ধুয়ে তুলে রাখলে সব বাসনের সাথে? গঙ্গাজলের ছিটেও দিতে পারলে না? ভিন্ন একটা কাপ রাখলেই হয় ওর জন্যে। জাতধর্ম রইল না আর।

গঙ্গাজলে ধুয়েছি।–ইন্দিরা অনায়াসে বানিয়ে বলে।

এ বাড়িতে নাসিরুদ্দীনের মায়েরও মুখ ভার।

ও বাড়ি থাকলেই পারতে? এত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। ওরা পছন্দ করে কি না কে তা জানে।

হালিমাও হাসিমুখেই বলে, চা না খাইয়ে ছাড়লে। দেরি হয়ে গেল।

তুমি তো খেয়ে এলে চা খুশিমনে। তুমি দিও তো একদিন কেমন খায়?

চা তো খায়!

সব কাজ পড়ে থাকে সংসারের, সময়মতো শুরু হয়নি। নাসিরের র আসল রাগ কেন হালিমা জানে, তাই জবাব দিতে দিতে সে চটপট কাজে লেগে যায়। বিশেষ কিছুই আর শুনতে হয় না তাকে।

ঘণ্টাখানেক পরে দেখা যায় ছোট নাতনিকে কোলে নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে নাসিরুদ্দীনের মা আর ছোট নাতি কোলে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে তারাপদর পিসি গল্প। জুড়েছে সুখ-দুঃখের।

ব্যবধান টেকেনি।

কাজ সেরে দুপুরে হালিমা যেদিন একটু অপরাধিনীর মতোই এসে বসে, সেদিনও নয়। মৃদু অস্বস্তির সঙ্গে বলে হালিমা, একটা কাণ্ড হয়েছে ভাই।

ওমা, কী হয়েছে?

তোমার মেয়ে একটু গোসত খেয়ে ফেলেছে। আজ আমাদের খেতে হয় জান। হাবিব খেতে বসেছে, আমি কিছুতে দেব না, বেটি এমন নাছোড়। হঠাৎ পাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিলে।

কিছু হবে না তো?–ইন্দিরা বলে চমকে গিয়ে।

হালিমার মুখ দেখে তারপর ইন্দিরা হাসে, বলে, কী যে বলি আমি বোকার মতো। হাবিবের কিছু হবে না, ওর হবে! খেয়েছে তো কী আর হবে, ওইটুকু মেয়ে। কাউকে বোলো না কিন্তু ভাই।

তাই কি বলি? হালিমা স্বস্তি পায়–বাব্বা; আমি জানি না? ও রোজ আলি সাব আর তার বিবি এসে কী দাবড়ানি দিয়ে গেল। হাবিব তোমাদের সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছে, প্রসাদ খেয়েছে, এসব কে যেন কানে তুলে দিয়েছিল।

শোনো বলি তবে তোমায় কাণ্ডখানা।ঘরে কেউ নেই, তবু ইন্দিরা কাছে সরে নিচু গলায় বলে, হাবিব অঞ্জলি দিয়েছে বলে পিসির কী রাগ! উনি শেষে পঞ্জিকা খুলে আবোল-তাবোল খানিকটা সংস্কৃত আউড়ে পিসিকে বললেন, সরস্বতী পুজোয় দোষ হয় না, শাস্ত্রে লিখেছে! তখন পিসি ঠাণ্ডা হয়ে বললে, তাই নাকি!

শান্ত দুপুর। ফেরিওলা গলিতে হেঁকে যাচ্ছে, শাড়ি-সায়া-শেমিজ চাই। দুজনে তারা খড়ি নিয়ে মেঝেতে কাটাকাটি খেলতে বসে। হাই ওঠে, বুজে আসে চোখ। চোখে চোখে চেয়ে ক্ষীণ শ্রান্ত হাসি ফোটে দুজনের মুখে। আঁচল বিছিয়ে পাশাপাশি একটু শোয় তারা দুটি স্ত্রী, দুটি মা, দুটি রাঁধুনি, দুটি দাসী।

ঘুমোয় না। সে আরামের খানিক সুযোগ জোটে বেলা যখন আরো অনেক বড় হয় গরমের দিনে। আজকাল শুধু একটু ঝিমিয়ে নেবার অবসর মেলে। ঝিমানো। চেতনায় ঘা মারে স্তব্ধ দুপুরের ছাড়াছাড়া শব্দগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে থাকে ছাতে হাবিব আর গীতার দাপাদাপির শব্দ।

ব্যবধান টেকেনি। কেন যে সেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল আচমকা এমন ভয়ানক এমন বীভৎস রূপ নিয়ে, কেন এত হানাহানি খুনোখুনি চারদিকে বোঝে না তারা, থতমত খেয়ে ভড়কে যায়, দুরুদুরু করে বুক। সেবার মাঝে মাঝে বুক কেঁপেছিল সাইরেনের আওয়াজে জাপানি বোমার দিনগুলোতে, দূর থেকে হাওয়ায় ভর করে উড়ে আসা অনিশ্চিত বিদেশি বিপদের ভয়ে। তার চেয়ে ব্যাপক, ভয়ানক সর্বনাশ আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেশের বুকে, শহর জুড়ে, পাড়ায় ঘরের দুয়ারে। বুকের জোরালো ধড়ফড়ানি থামবার অবকাশ পায় না আজ, বাড়ে আর কমে, কমে আর বাড়ে।

তবে কথা এই যে, এটা মেশাল পাড়া। নিজেরাই বলাবলি করে নিজেদের মধ্যে যতটা নিরুপায় নয় তার চেয়ে অনেক বেশি মরিয়ার মতো। এতেই অনেকটা ভরসা খাড়া আছে মারাত্মক আতঙ্ক গুজব আর উসকানির সোজাসুজি প্যাচালো আর চোরাগোপ্তা আঘাত সয়ে, যে আঘাত চলেছেই। বাস্তব একটা অবলম্বনও পাওয়া গেছে সকলে মিলে গড়া পিস-কমিটিতে, বিভ্রান্ত না করে যার জন্মলাভের প্রক্রিয়াটাও জাগিয়েছে আস্থা। কারণ, বড় বড় কথা উথলায়নি সভার আদর্শমূলক ভাবোচ্ছ্বাস, মিলনকে আয়ত্ত করার চেষ্টা হয়নি শুধু মিলনের জয়গান গেয়ে, এই খাঁটি বাস্তব সত্যটার উপরেই বেশি জোর পড়েছে যে এ পাড়ায় হাঙ্গামা হলে সবার সমান বিপদ, এটা মেশাল পাড়া।

হয়তো এ পাড়ায় শুরু হবে না সে তাণ্ডব, কে জানে। চারদিকে যে আগুন জ্বলেছে। তার হলকাতে ছ্যাকা লেগে লেগেই মনে কি কম জ্বালা। সর্বহারা শোকাতুর দিশেহারা আপনজনেরা এসে অভিশাপ দিচ্ছে, বলছে : মারো, কাটো, জবাই করো, শেষ করে ফেলো। এ এসে ও এসে বুঝিয়ে যাচ্ছে মারা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই।

অনেক কালের মেশামিশি বসবাস। হয়তো তেমন ঘনিষ্ঠ নয় মেলামেশা সবার মধ্যে, সেটা আসলে কিন্তু এটা শহর বলেই। পাখা সবারই পঙ্গু, মানুষকে হাঁস-মুরগি করে রাখা মর্জি মালিকের। পাখা ঝাঁপটিয়ে চলতে হয় জীবনের পথে।

তাই তো বলি পাখি নাকি আমরা? হালিমা বলে মুখোমুখি জানালায় দাঁড়িয়ে, তাড়া খেয়ে খেয়ে আজ এখানে কাল সেখানে উড়ে বেড়াব? গাছের ডালে বাসা বানাব?

আর বোলো না ভাই, ইন্দিরা বলে, মাথা ঘুরচে কদিন থেকে। এসব কী কাণ্ড। এ্যাঁ কী রাঁধলে?

তেমন প্রাণখোলা আলাপ কিন্তু নয়, কদিন আগের মতো। গলায় মৃদু অস্বস্তির সুর দুজনেরই; চোখ এড়িয়ে সন্তর্পণে জানালা দুটির একটি করে পাট খুলে কথা কইছে, কাজটা যেন অনুচিত, আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ। দুজনের বাড়িতেই আচমকা আশ্রয় নিতে আত্মীয়স্বজনের আবির্ভাব ঘটেছে বলেই নয় শুধু, বাড়ির মানুষ। বারণ করে দিয়েছে মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতা–অন্তত সাময়িকভাবে।

কী যে হবে, ভাবছি।

দুধে নাকি বিষ মেশাচ্ছে গয়লারা। দুধ জ্বাল দিয়ে আগে বেড়ালটাকে খানিকটা খাওয়াতে হয়, ছেলেপিলেরা খিদেয় কাঁদে, দেওয়া বারণ। আধঘণ্টা বেড়ালটা কেমন থাকে দেখে তবে ওরা পায়। রুটি আনা বন্ধ করেছেন। রুটি যারা বানায় তাদের মধ্যে তোমরাই নাকি বেশি। এক টুকরো রুটি আর চা জুটত সকালে, এখন শুধু একটু গুড়ের চা খেয়ে থাকো সেই একটা-দুটো পর্যন্ত।

এত লোক বেড়েছে, ডাল তরকারি ছিটেফোঁটা এক রোজ থাকে, আর এক রোজ একদম সাফ। ভাতেও টান পড়ে।

আজ চিঁড়ে খেয়েছি নুন দিয়ে। গুড়ও নেই।

চোখে চোখে চেয়ে খানিক মাথা নিচু করে থাকে দুজন। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। জানালার পাট দুটি।

ছেলেমেয়ের সংখ্যাও বেড়ে গেছে দুবাড়িতে। অন্য অঞ্চল থেকে উৎখাত হয়ে তারা বড়দের সঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মুখ চেনাচিনিও হয়নি বড়দের মধ্যে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কে ঠেকিয়ে রাখবে? তাদের মেলামেশার দাবি রাজনীতির ধার ধারে না, আপস অনুমতির তোয়াক্কা রাখে না, জাতধর্মের বালাই মানে না। স্কুল নেই, লেখাপড়া নেই, বেড়ানো নেই, বাড়ির এলাকার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত বারণ। বড়দের মুখে অন্ধকার, বাড়িতে থমথমে ভাব, মুমূর্ষ রোগী থাকলে ঘন ঘন ডাক্তার আসবার সময় যেমন হয়। ওরা তাই করে কী, হাবিব আর গীতার নেতৃত্বে নিজেরাই আয়োজন করে মিলেমিশে খেলাধুলো করার। বাড়িতে ঠাঁই নেই, নিজেরাই তৈরি। করে নেয় খেলাঘর। হাঙ্গামা করতে হয় না বেশি, বাইরের প্যাসেজে দুপাশের দেয়ালে দুটো পেরেক পুঁতে একটা কাপড় টাঙিয়ে দিতেই প্যাসেজের শেষের অংশটুকু পরিণত হয়ে যায় চারপাশ ঘেরা ছোটখাটো একটি ঘরে। কিছু চাল ডাল উঁটাপাতা জোগাড় হয়েছে। গীতা এনে দিয়েছে ছোট তোলা উনুনটি আর তেলমশলা! তরকারির অনটনে সবার মন খুঁতখুঁত করতে থাকায় হাবিব এক ফাঁকে বাড়ির ভেতর থেকে সরিয়ে এনেছে কিছু আলু পেঁয়াজ আর একটা আস্ত বেগুন। জোরালো পরামর্শ চলছে, সবকিছু দিয়ে এক কড়া খিঁচুড়ি রাধা অথবা খিঁচুড়ি, ভাজা, তরকারি সবই রাধা হবে। রান্নার ভার নিয়েছে মেহের, তার বয়স ন-দশ বছর, এই বয়সেই বড়দের আসল রান্নার কাজে তাকে সাহায্য করতে হয় বলে তার অভিজ্ঞতার দাবি সবাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে।

কিন্তু উনুনে তাদের আঁচও পড়ে না, রান্নাও শুরু হতে পায় না। টের পেয়ে হা হা করে ছুটে আসে দুবাড়ির বড়রা। মেহেরের বাপের নিকা-বৌ নুরুন্নেসা মেয়ের বেণি ধরে মাথা টেনে গালে চড় বসায়। পুষ্পর মাসিমা এক ঠোনায় রক্ত বার করে দেয় ভাগ্নির ঠোঁটে। কান ছাড়াতে হাত-পা ছোড়ে গীতা, লাথি লাগে তারাপদর পেটে। হাবিব কামড় বসিয়ে দেয় নাসিরুদ্দীনের হাতে। বাচ্চাদের কাদাকাটা বড়দের হইচই মিলে সৃষ্টি হয় আওয়াজ। প্রতিবেশীরা ছুটে এসে কী হয়েছে জানতে চেয়ে বাধিয়ে নেয় রীতিমতো হুল্লোড়, প্যাসেজের মুখে গলিতে জমে ওঠে লাঠি রড ইট হাতে ছোটখাটো ভিড়।

কয়েক মুহূর্ত, আর কয়েক মুহূর্তে স্থির হয়ে যাবে মেশাল পাড়ার ভাগ্য-জিইয়ে রাখা শান্তি অথবা অকারণে ডেকে আনা সর্বনাশ। কান্না তুলে বড় বড় চোখ মেলে ছেলেমেয়েরা, চেয়ে দেখে বড়দের অর্থহীন কাণ্ড।

ভলান্টিয়ার সঙ্গে নিয়ে পিস-কমিটির যুগ্মসম্পাদক দুজন ছুটে আসায় অল্পের জন্য হাঙ্গামা ঠেকে যায়। সম্পাদক দুজন ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন।

ভিড়ে ভাঙন ধরে। দুচার মিনিটের মধ্যে ভলান্টিয়াররা ভিড় সাফ করে দেয়।

তখন যুগ্মসম্পাদক দুজন পরামর্শ করে ভলান্টিয়ারদের পাঠান পাড়ায় পাড়ায় সত্য ঘটনা প্রচার করতে। এমন স্পর্শকাতর হয়ে আছে মানুষের মন যে, এ রকম তুচ্ছ ঘটনাও দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়তে পারে মারাত্মক গুজব হয়ে।

বিকালে একটা লরি আসে পুলিশ ও সৈন্যের ছোট একটি দল নিয়ে। চারদিক তখন শান্ত। বুটের আওয়াজ তুলে কিছুক্ষণ তারা এদিক ওদিক টহল দেয়। এ বাড়ির দরজায় ঘা মেরে, এর ওর দোকানে ঢুকে, জিজ্ঞাসা করে কোথায় গোলমাল হয়েছিল। জবাব শোনে আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য, যে কোথাও গোলমাল হয়নি। ক্রুদ্ধ অসন্তুষ্ট মনে হয় তাদের, আগমন কি তাদের অনর্থক হবে? গলির মোড়ে নিতাইয়ের দোকানের একপাশে তক্তপোশ পেতে চারজন সশস্ত্র সৈন্যের ঘাঁটি বসিয়ে লরি ফিরে যায় বাকি সবাইকে নিয়ে। নতুন এক সশঙ্ক অস্বস্তিবোধ ছড়িয়ে পড়ে মেশাল পাড়ায়। সজবাতির আগেই বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট, মানুষ গিয়ে ঢোকে কোটরে, শূন্য হয়ে যায় পথ।

এ বাড়ি থেকে কথা শোনা যায় ও বাড়ির! কিন্তু কথার আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে। চুপিচুপি দু-এক মুহূর্তের জন্য মুখোমুখি জানালার পাটও একটু ফাঁক হয় না। এ বাড়ি ভাবে ও বাড়ির জন্য মিলিটারি এসে পাড়ায় গেড়ে বসেছে, কী জানি কখন কী হয়। ছেলেমেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। ঘরের জেলে তারা কয়েদ।

ছাত ভাগ করা দেয়ালের এপাশ থেকে গীতা বলে, আসবি হাবিব?

মারবে যে?

না, পিসির ঘরে চুপিচুপি খেলব।

পিসি বকবে তো?

দূর। রান্না করে নেয়ে আসতে পিসির বিকেল বেজে যাবে।

ছাতের সিঁড়ির মাঝে বাকের নিচু লম্বাটে কোটরটি পিসি বহুদিন দখল করে আছে, তার নিচে দোতলার কলঘর। লম্বা মানুষ এ ঘরে দাঁড়ালে ছাতে মাথা ঠেকবে। পিসির নিজস্ব হাঁড়িকুড়ি কাঠের বাক্স কাঁথা বিছানায় কোটরটি ভরা। কুশের আসন পেতে এ ঘরে পিসি আহ্নিক করে। আমিষ-রান্নাঘরে একবার ঢুকলে স্নান করে শুদ্ধ হবার আগে পিসি আর এ ঘরে আসে না।

ঘরের মধ্যে এভাবে লুকিয়ে চুপিচুপি কী খেলা করবে, হাবিবকে নিয়ে এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগ দেবার উপায় নেই, ওদেরও ডাকা যায় না এখানে। তাই। নতুন খেলা আবিষ্কার করে নিতে হয়।

দাঙ্গা দাঙ্গা খেলবি? গীতা বলে।

লাঠি কই? ছোরা কই? প্রশ্ন করে হাবিব।

গীতা বলে, দাঁড়া।

গীতা চুপিচুপি অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তারাপদর ক্ষুর আর ছুরি। ক্ষুরটি পুরনো, কামানো হয় না, কাগজ পেন্সিল দড়ি কাটার কাজেই লাগে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে গীতা ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি এঁটে দেয়। হাবিবের চেয়ে সে একটু ঢ্যাঙা।

তুই আকবর আমি পদ্মিনী। আয়!

খেলা, ছেলেখেলা। অসাবধানে কখন যে সামান্য কেটে যায় একজনের গা অপরের অস্ত্রে।

মারলি?

ব্যথা পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে সে প্রতিশোধ নেয় অপরের গায়ে। জেদি দুরন্ত ছেলেমেয়ে দুজন, ব্যথায় রাগে অভিমানে দিশেহারা হয়ে কাটাকাটি হানাহানি শুরু করে ভোতা ক্ষুর আর ভোতা ছুরি দিয়ে। সেই সঙ্গে চলে গলা ফাটিয়ে আর্ত কান্না। ইন্দিরা পিসিমারা ছুটে আসে কলরব করে। ছুটে আসে ও বাড়ির হালিমা নুরুন্নেসারা। তারা সিঁড়িতে উঠে পিসির কোটরের দরজার সামনে ভিড় করে থাকায় তারাপদ ও বাড়ির অন্য পুরুষদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সিঁড়ির নিচে।

সদর দরজায় বাড়ির অন্য পুরুষদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নাসিরুদ্দীন হাঁকে, তারাপদ!

দুটি মাত্র শিক বসানো ছোট্ট একটি খোপ আছে পিসির ঘরে, একসময় একজনের বেশি দেখতে পারে না ভেতরের কাণ্ড। একনজর ভেতরে তাকিয়ে ইন্দিরা আর্তনাদ করে ওঠে, মেরে ফেলল! মেয়েটাকে মেরে ফেলল গো।

দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে চেঁচায় : খোল! খোল! দরজা খোল! খুনে ছেঁড়া দরজা বন্ধ করে খুন করছে মেয়েটাকে! দরজা খোল!

হালিমাও একনজর তাকিয়ে অবিকল তেমনি সুরে আর্তনাদ করে ওঠে, মেরে ফেলল! ছেলেটাকে মেরে ফেলল!

দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে চেঁচায়! খোল! খোল! দরজা খোেল! খুনে ঘুড়ি দরজা বন্ধ করে খুন করছে ছেলেটাকে! দরজা খোল!

পিসি চেঁচায়, হায় হায় হায়! সব ছোঁয়াছুঁয়ি করে দিলে গো!

নিচে থেকে নাসিরুদ্দীন হাঁকে, তারাপদ! আমরা অন্দরে ঢুকব বলে দিচ্ছি।

পিসিকে ঠেলে সরিয়ে ইন্দিরা আর হালিমা একসঙ্গে পাগলিনীর মতো খোপের ফোকর দিয়ে ভেতরে তাকাতে চায়, মাথায় মাথায় ঠোকাঠেকি হয়ে যায় দুজনের। আক্রমণে উদ্যত বাঘিনীর মতো হিংস্র চোখে তারা পরস্পরের দিকে তাকায়।

ভেতরে ততক্ষণে গীতা আর হাবিবের হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়েছে। বাইরের হট্টগোলে চুপ হয়ে গেছে তারা। কিন্তু লড়াই থামায়নি, আগে কে হার মানবে অপরের কাছে! নিঃশব্দে মেঝেতে পড়ে জড়াজড়ি কামড়াকামড়ি করে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় পিসির হাঁড়িকুড়ি।

হায়, হায়! সব গেল গো, সব গেল!

নাসিরুদ্দীনকে ওপরে ডেকে আনে তারাপদ।

সে-ই লাথি মেরে দরজা ভাঙে। দরজাটা ঠিক ভাঙে না, ছিটকিনিটা খসে যায়।

ওপর ওপর চামড়া কাটাকুটি হয়েছে খানিকটা, কিছু রক্তপাত ঘটেছে। নিজের নিজের সন্তানকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ ইন্দিরা আর হালিমা ব্যাকুল দৃষ্টি বুলিয়ে যায় তাদের সর্বাঙ্গে। তারপর প্রায় একই সময় দুজনে মুখ তোলে চোখে অকথ্য হিংসার আগুন নিয়ে। দুজনেই যেন অবাক হয়ে যায় অপর কোলে আহত নির্জীব অপরের সন্তানটিকে দেখে, বহুকাল ভুলে থাকার পর দুজনেই যেন হঠাৎ আবিষ্কার করেছে অন্যজনও মা, তার সন্তানের গায়েও রক্ত।

বাইরে আবার ভিড় জমেছিল। আবার অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সংঘর্ষ। তারাপদ আর নাসিরুদ্দীন দু-বাড়ির এই দুই কর্তাকে পাশাপাশি সামনে হাজির করতে না পারলে পিস-কমিটি এবার কোনোমতেই ঠেকাতে পারত না সর্বনাশ।

আইডিন লাগিয়ে নাইয়ে খাইয়ে দুবাড়িতে শুইয়ে রাখা হয় হাবিব আর গীতাকে। ছুটির দিন, ঢিমেতালে সংসারের হাঙ্গামা চুকতে ঢুকতে এমনিই দুপুর গড়িয়ে যেত আগে, এখন আবার বাড়তি লোকের ভিড়। বিকালের দিকে কিছুক্ষণ আগে পরে। দু-বাড়িতে খোঁজ পড়ে ছেলেমেয়ে দুটির।

খোঁজ মেলে না একজনেরও।

আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা হয় বাড়ি, আনাচ কানাচ, চৌকির তলা। গীতা বাড়িতে নেই। হাবিব বাড়িতে নেই।

শঙ্কায় কালো হয়ে যায় দু-বাড়ির মুখ। কিছুক্ষণ গমগম করে স্তব্ধতা, তারপর ফেটে পড়ে মুখর গুঞ্জন।

এ বাড়ি বলে বুক চাপড়ে : শোধ নিয়েছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে হয় গুম করে রেখেছে, নয়–

ও বাড়ি প্রতিধ্বনি তোলে মাথা কপাল কুটে।

তারাপদ বলে, গীতা নিশ্চয় আছে তোমার বাড়িতে নাসির।

নাসিরুদ্দীন বলে, হাবিবকে তোমরা নিশ্চয় গুম করেছ তারাপদ।

এবার আর রোখা যায় না, আগুনের মতো গুজব আর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এত চেষ্টা করেও উসকানিদাতারা এ মেশাল পাড়ার শান্তিতে দাঁত ফোঁটাতে পারেনি, এমনি একটি সুযোগের জন্য তারা যেন ওত পেতে ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে বাড়ি দুটির সামনে জড়ো হয় দু-দল উন্মাদ মানুষ। এরা ও বাড়িতে চড়াও হবে, ওরা এ বাড়িতে। কিন্তু দল যখন দুটি তখন আগে বাইরে রাস্তায় লড়াই করে–অন্য দলকে হটিয়ে জয়ী হতে না পারলে কোনো দলের পক্ষেই বাড়ি চড়াও হওয়া সম্ভব নয়।

মারামারি হবেই। সেটা জানা কথা। আগেই বেঁধে যেত, পিস-কমিটির চেষ্টায় শুধু দু-দশ মিনিটের জন্য ঠেকে আছে।

যুগ্ম সম্পাদক বলেন, আমরা তল্লাশ করাচ্ছি বাড়ি।

জনতা সে কথা কানে তোলে না। তাদের শান্ত রাখতে গিয়ে গালাগালি শোনে, মারও খায় কয়েকজন ভলান্টিয়ার। তবু তারা চেষ্টা করে যায়। গলির মোড়ের সৈন্য চারজন চুপচাপ বসে আছে।

এমন সময় কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ওই যে হাবিব! ওই যে।

আরেকজন চেঁচায়, ওই তো গীতা!

সকলের দৃষ্টিই ছিল নিচের দিকে, এ অবস্থায় কে চোখ তুলে তাকাবে ওপরে। কারো নজরে পড়েনি যে, নাসিরুদ্দীন আর তারাপদর বাড়ির চিলেকুঠির ছাত থেকে। কিছুক্ষণ ধরে পাশাপাশি একটি ছেলে ও মেয়ে মুখ বাড়িয়ে নিচের কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছে। ছাত ভাগ করা দেয়ালের দুপাশে দুবাটীর ছাতের সিঁড়ির চিলেকুঠি একটাই। কখন যে তারা দুজন চুপিচুপি সকলের চোখ এড়িয়ে ওই নিরাপদ আশ্রয়ে খেলতে উঠেছিল! মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে কয়েকজন কলরব করে ওঠে, পাওয়া গেছে। দুজনকেই পাওয়া গেছে!

সবার চোখের সামনে হারানো ছেলেমেয়ে দুটোর অকাট্য জলজ্যান্ত আবির্ভাব হল বলেই যে মারামারি ঠেকানো যেত, তা নয়। হিংসায় উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়ে যারা খুনোখুনি করতে এসেছে, অনেকে তারা জানেও না ওদের দুটিকে নিয়েই আজকের মতো গণ্ডগোলের সূত্রপাত। হঠাৎ এই খাপছাড়া ঘটনায়, দু-দলেরই কিছু লোক চঞ্চল হয়ে সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠায়, ব্যাপারটি কী জানবার জন্য যে কৌতূহল জাগল জনতার মধ্যে; সঙ্গে সঙ্গে পিস-কমিটির সম্পাদক দুজন সেটা কাজে লাগিয়ে ফেলায় ঘটনার মোড় ঘুরে গেল।

জনতা সাফ হয়ে যাবার অনেক পরে আবার লরি বোঝাই মিলিটারি এল।

বহুক্ষণ সার্চ চলে নাসিরুদ্দীন আর তারাপদর বাড়িতে, গুম করা ছেলেমেয়ে দুটির সন্ধানে। হালিমা আর ইন্দিরার গা ঠেসে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাই দেখতে থাকে গীতা আর হাবিব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *