ছেলেটা

ছেলেটা

আমি এলিফেন্ট রোডের যে এ্যাপার্টমেন্ট হাউসে থাকি তার নিয়ম কানুন খুব কড়া। যে-কেউ ইচ্ছা করলেই ঢুকতে পারে না। গেটেই তাকে আটকানো হয়। রিসিপশনিস্ট (মহিলা নয়, পুরুষ) কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করেন–কোথায় যাবেন? কার কাছে যাবেন? কোত্থেকে এসেছেন? এখানেই শেষ না। যার কাছে যাওয়া হবে তাকে ইন্টারকমে ধরা হয়। তাকে বলা হয়–অমুক ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। পাঠাব? যদি পাঠানোর অনুমতি পাওয়া যায় তবেই দর্শনার্থী ঢুকতে পারেন।

ব্যবস্থা ভাল। উটকো লোকের ঝামেলা থাকে না।

আমি আবার এই ভাল ব্যবস্থার উপর এককাঠি। আমার দিক থেকে রিসিপশনিস্টকে নির্দেশ দেয়া আছে সকাল দশটার আগে কাউকেই যেত আসতে না দেয়া হয়। আমি রাত জেগে লেখালেখি করি,পড়াশোনা করি। ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়। হাত-মুখ ধুতে ধুতে দশটা বেজে যায়। বাসি মুখে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা। করে না।

রিসিপশনিস্ট আমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। একদিন তার ব্যতিক্রম হল। ভোর ছটায় ইন্টারকম বেজে উঠল। একজন ছেলে এসেছে। খুব কাঁদছে। একটা। জরুরী চিঠি সে নিয়ে এসেছে। নিজেই আমার হাতে দেবে। এক্ষুণি দিতে হবে।

আমি তাকে উপরে পাঠাতে বললাম। চেহারা দেখে মনে হল কলেজে পড়ে। ভদ্র চেহারা। মাথা নিচু করে আছে। হাতে রুমাল। মাঝে মাঝে রুমালে চোখ মুছছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার? সে একটা কাগজ বের করে দিল। একটা চিঠি। আমাকে সম্ভাষণ করে লেখা। চিঠির ভাষা হুবহু মনে নেই মোটামুটিভাবে এরকম–

হুমায়ূন সাহেব,

আপনার মেয়ে শীলা আমার ছাত্রী। আমি খুব বিপদে পড়ে আমার ছেলেকে আপনার কাছে পাঠালাম। আমার স্বামী গতকাল রাত তিনটায় মারা গেছেন। আমার হাত একেবারে খালি। মৃতদেহের সৎকারের জন্যে এই মুহূর্তে কিছু টাকা দরকার। আপনি কি ঋণ হিসেবে আমার ছেলের হাতে দুহাজার। টাকা পাঠাবেন? ছাত্রীর বাবার কাছে টাকার জন্যে হাত পাততে হল—এই লজ্জা আমার রাখার জায়গা নেই। ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুক। ইতি আমি আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম–মা,… এই নামে তোমার কোন টিচার আছেন?

শীলা বলল, হ্যাঁ, উনি আমাদের ক্লাস টিচার। খুব ভাল টিচার। আমি আর সময় নষ্ট করলাম না। ছেলেটির হাতে দুহাজার টাকা দিলাম। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু কথা বললাম। যদিও জানি, প্রবল শোকের সময়ে সান্ত্বনার কথা খুব হাস্যকর শোনায়। ছেলেটি চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল। আমার খানিকটা মন খারাপ হল এই ভেবে যে, মৃত্যুর প্রবল শোকের যন্ত্রণা ছাপিয়ে অর্থকষ্টের যন্ত্রণা এই সমাজে বড় হয়ে উঠছে।

হাত-মুখ ধুয়ে নাশতার টেবিলে বসেই মনে হল–একটা ভুল হয়েছে। ছেলেটি মিথ্যা কথা বলে টাকা নিয়েছে। চিঠির বক্তব্য অনুসারে ছেলেটির বাবা মারা গেছেন রাত তিনটায়—তার মাত্র তিন ঘণ্টা পরে সে টাকার সন্ধানে বের হয়েছে। এটা তো হতে পারে না। মৃত্যুর প্রাথমিক ধাক্কা সহ্য করতেও অনেক সময় লাগবে। টাকার কথা মনে হবে প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাবার পর।

আমার মন বেশ খারাপ হল। দুহাজার টাকা এমন কোন অর্থ না যার জন্যে মন এতটা খারাপ হবে। মন খারাপ হল ছেলেটির প্রতারণার কৌশলে। বাবার মৃত্যুর কথা বলে সে কাঁদছিল। ভান না, সত্যি সত্যি কাঁদছিল–চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছিল। আমরা নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করি–বাবা-মার মিথ্যা মৃত্যুর কথা বলে মানুষকে প্রতারিত করি না। তাছাড়া প্রতারকের চোখে কখনো অশ্রু টলমল করে না।

তাহলে কি ছেলেটি সত্যি কথাই বলেছে? ব্যাপারটা নিয়ে খোঁজ-খবর করতেও আমার লজ্জা লাগল। যদি ব্যাপারটা সত্যি হয় তাহলে ভদ্রমহিলা কি মনে করবেন? তিনি কি ভাববেন না সামান্য দুহাজার টাকা দিয়ে সে খোঁজ-খরব শুরু করেছে?

মনের ভেতর একটা কাটা খচখচ করতে লাগল। সেদিন সন্ধ্যায় শীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, আজ কি তোমাদের ক্লাস টিচার… এসেছিলেন?

সে বলল, হুঁ।

ক্লাস নিয়েছেন?

হুঁ। ক্লাস নেবেন না কেন?

হাসি-খুশি ছিলেন?

শিক্ষকরা কখনো হাসিখুশি থাকে না। শিক্ষকরা গম্ভীর থাকে।

আমার মনটা গ্লানিতে ভর্তি হয়ে গেল। একটা নষ্ট ছেলে আমাকে বোকা বানিয়ে চলে গেছে! সে ব্যবহার করেছে একজন শিক্ষিকার নাম। সেই শিক্ষিকাকেও ব্যাপারটা জানানো দরকার।

কাজেই আমি তাকে জানালাম। তিনি অসম্ভব ব্যথিত হলেন এবং বললেন–যে ছেলে আপনার কাছে গিয়েছিল সে বাইরের কেউ না। সে আমারই ছেলে।

সে কি?

সে ড্রাগ ধরেছে। ড্রাগের টাকার জন্যে নানান কৌশল বের করে। আমার ছাত্রীদের কাছে যায়…

ভদ্রমহিলার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। তিনি চোখ মুছে বললেন, আমি আপনার টাকা দিয়ে দিচ্ছি।

আমি বললাম, টাকা দিতে হবে না। আপনি ছেলেটির চিকিৎসা করান।

তিনি ক্লান্ত গলায় বললেন–অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। কিছুদিন ভাল থাকে তারপর আবার শুরু করে। আজ এই ড্রাগ আমার ছেলেকে ধরেছে–আস্তে আস্তে সবাইকে ধরবে। কি ভয়ংকর সময়ের দিকে যে দেশটা যাচ্ছে কেউ বুঝতে পারছে না! কেউ না! আপনি লেখক মানুষ, আপনিও বুঝছেন না। বুঝলে ড্রাগ বিষয়ে কিছু লিখতেন।

ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *