ছুরি

ছুরি

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে কলিকাতা শহরে এখানে ওখানে গুটিকয়েক লোন্-অফিস ছিল, যুদ্ধ আরম্ভ হইবার পর তাহাদের সংখ্যা অনেক বাড়িয়াছে। লোন্-অফিসের মহাজনী কারবার অতি সরল ও সহজ। অভাবগ্রস্ত মানুষ নিজের অস্থাবর সম্পত্তি—ঘটি বাটি ঘড়ি কলম আনিয়া বন্ধক রাখিয়া টাকা লয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টাকা শোধ হয় না, সময়ের মেয়াদ ফুরাইলে বন্ধকী মাল লোন্-অফিসের সম্পত্তি হইয়া যায়। তখন তাহারা ঐ মাল নিজেদের শো-কেসে সাজাইয়া রাখে এবং সন্ধানী খরিদ্দারের নিকট লাভে বিক্রয় করে।

নগেন যুদ্ধের মরশুমে একটি লোন্-অফিস খুলিয়া বেশ গুছাইয়া লইয়াছিল। দেশে অভাবগ্রস্থ মানুষের কোনও দিনই অভাব নাই, তাহার উপর সাদা-কালো বহুজাতীয় সৈনিকের শুভাগমনে নগেনের ব্যবসা জাপানী খেল্‌না-বেলুনের মতো অতি সহজেই ফুলিয়া ফাঁপিয়া উঠিয়াছিল। বীর যোদ্ধৃগণের দৈহিক ক্ষুধা-তৃষ্ণা যখন দুর্নিবার হইয়া ওঠে তখন তাঁহারা বন্ধক রাখিতে পারেন না এমন জিনিস নাই।

নগেনের বয়স বেশী নয়, ত্রিশের নীচেই। সদ্‌বংশে জন্মিবার ফলে সে কয়েকটি নৈতিক সংস্কার লইয়া জন্মিয়াছিল, যদিও অর্থোপার্জনের সদসৎ উপায় সম্বন্ধে বাঙালী ভদ্রলোক সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনও নৈতিক সংস্কারই নাই। জুতা সেলাই হইতে চণ্ডী-পাঠ পর্যন্ত সব কাজই আমরা নিন্দাভাজন না হইয়া করিতে পারি যদি তাহাতে অর্থলাভ হয়। এই জন্যই বোধ হয় দারোগা হওয়ার আশীর্বাদকে আমরা নিছক পরিহাস বলিয়া গ্রহণ করি না এবং কালো-বাজারের কালীয় নাগদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষও তেমন মারাত্মক হইয়া উঠিতে পারে নাই।

কিন্তু এসব অবান্তর কথা থাক। নগেনের সাফল্যমণ্ডিত বাহ্য জীবন হইতে তাহার অন্তৰ্জীবনে যে-বস্তু প্রবেশ করিয়াছিল তাহার কথাই বলিব। তৎপূর্বে আর একটি কথা বলিয়া লওয়া প্রয়োজন; ইহাও অবশ্য নগেনের অন্তলোকের কথা এবং অতিশয় গুহ্য।

বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হইলেও নগেন স্বাস্থ্যবান যুবক, তাহার রক্তের তাপ এখনও কমিতে আরম্ভ করে নাই। কিন্তু তাহার স্ত্রী ক্ষণিকা—সংক্ষেপে ক্ষণা—মাত্র তেইশ বছর বয়সেই তাহার ক্ষণযৌবনকে বিদায় দিয়াছিল। শুধু দেহের দিক দিয়া নয়, মনের দিক দিয়াও। ক্ষণা দেখিতে মন্দ নয়, নবযৌবনের আবির্ভাবে তাহার দেহে একটি শান্ত শ্রী দেখা দিয়াছিল; কিন্তু উপর্যুপরি দুইটি মৃত সন্তান প্রসব করিবার পর, তাহার দেহলাবণ্য তো গিয়াছিলই নারীত্বও যেন হঠাৎ নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল। যাহা রহিয়া গিয়াছিল তাহা গৃহকর্মনিপুণ সচল সবাক একটি যন্ত্র মাত্র।

নগেন চরিত্রবান যুবক কিন্তু সহজ স্বাস্থ্যবান পুরুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণা তাহার ছিল। তাই তাহার দাম্পত্য জীবনের এই অপ্রত্যাশিত অনাবৃষ্টি তাহার অন্তরের কাঁচা ফসলকে শুকাইয়া তুলিতেছিল। খাল কাটিয়া জলসিঞ্চনের কথা তাহার মনেই আসে না—তাহার মন সে ছাঁচে গঠিত নয় কিন্তু বঞ্চিত ব্যর্থ-যৌবনের ক্ষোভ তাহার নিভৃত অন্তরে সঞ্চিত হইয়া কোনও অনর্থের সৃষ্টি করিতেছিল কিনা তাহা কেবল বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরাই বলিতে পারেন।

হয়ত আমার এই কাহিনীর সহিত নগেনের নিরুদ্ধ ক্ষোভের কোনও সম্বন্ধ নাই। কিংবা—কে বলিতে পারে!

১৯৪২ সালের শেষের দিকে কলিকাতা শহরে নানা বিজাতীয় সৈনিকের আবির্ভাবে তিল ফেলিবার ঠাঁই ছিল না; এমন বিভিন্ন বর্ণের ও বিভিন্ন আকৃতির মানুষ একই স্থানে সমবেত হইতে পূর্বে কখনও দেখা যায় নাই। এই সময়ে নগেনের লোন্-অফিসে একটি লোক আসিল। মিলিটারি পোশাক পরা লম্বা জোয়ান; মাথার চুল কাফ্রির মতো কোঁকড়ানো, গায়ের রঙ নারিকেল ছোব্‌ড়ার ন্যায়, চোখের মণি নীল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলিল, ‘আমি একটি জিনিস বন্ধক রেখে টাকা চাই।’

সে পকেট হইতে একটি ছুরি বাহির করিল। ছুরি না বলিয়া ছোরা বলিলেই ভাল হয়, যদিও পেন্সিল-কাটা ছুরির মতো উহা ভাঁজ করিয়া বন্ধ করা যায়। হাড়ের বাঁট দীর্ঘকালের ব্যবহারে ও তামাকের রসে বাদামী হইয়া গিয়াছে কিন্তু ফলাটা সতেজ উগ্রতায় ঝকঝক করিতেছে। ফলাটা প্রায় ছয় ইঞ্চি লম্বা, কিন্তু এমন অদ্ভুত তাহার গঠন দেখিলেই চমকিয়া উঠিতে হয়। নগেন সম্মোহিতের মতো দেখিতে লাগিল। ছুরিটা যেন ছুরি নয়, বৃশ্চিকের মতো ক্রুর জীবন্ত একটা প্রাণী; তাহার ফলাটা বন্য পশুর দন্ত নিষ্কাশনের মতো বর্বরোচিত হিংস্রতায় হাসিতেছে।

ছুরি হইতে চোখ তুলিয়া নগেন দেখিল, ছুরির মালিকও পোকায়-খাওয়া ঘষা দাঁত বাহির করিয়া ব্যঙ্গভরে হাসিতেছে। নগেনের ব্যবসাবুদ্ধি ফিরিয়া আসিল, সে ছুরিটা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া বলিল, ‘তিন টাকা দিতে পারি।’

ছুরির মালিক বলিল, ‘আমার পাঁচ টাকা চাই।’

নগেন আর দ্বিরুক্তি না করিয়া রসিদ লিখিয়া তাহাকে পাঁচ টাকা দিল। সাত দিনের মেয়াদ, ইহার মধ্যে টাকা শোধ না করিতে পারিলে ছুরি বাজেয়াপ্ত হইয়া যাইবে। লোকটা রসিদ ও টাকা প্যান্টুলুনের পকেটে পুরিয়া বলিল, ‘ছুরি সাবধানে রেখো, আমার বড় আদরের জিনিস। শিগ্‌গিরই আমি খালাস করে নিয়ে যাব।’

লোকটা কেমন একরকম ভাবে নগেনের দিকে তাকাইয়া একটু নড্‌ করিয়া চলিয়া গেল। নগেন কিছুক্ষণ দ্বারের পানে চাহিয়া রহিল। অদ্ভুত চেহারা লোকটার! কাফ্রির মতো চুল, সাদা আদমির মতো চোখ, এসিয়াবাসীর মতো রঙ। যেন তিনটি মহাদেশের তিনজন মানুষকে একত্র করিয়া একটি মানুষ তৈয়ার হইয়াছে। কিংবা ঐ একটা মানুষ হইতেই তিন মহাদেশের তিনটি জাতি বাহির হইয়া আসিয়াছে। লোকটার বয়স অনুমান করা যায় না; ত্রিশ বছরও হইতে পারে, আবার তিন হাজার বছর বলিলেও অসম্ভব মনে হয় না।

ছুরিটা টেবিলের উপর ছিল, সেটা তুলিয়া লইয়া নগেন আবার নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিতে লাগিল। কি ধার! নগেন ছুরির ফলাটা নিজের রোমশ বাহুর উপর দিয়া একবার ক্ষুরের মতো টানিয়া লইয়া গেল, লোমগুলি ঝরিয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে একটা অপূর্ব হর্ষ তাহার দেহকে কন্টকিত করিয়া তুলিল। অনুভূতির প্রকৃতিটা অজানা নয়, কিন্তু আরও তীব্র আরও কুটিল—পরকীয়া প্রীতির মতো গোপন অপরাধের বিষ মেশানো।

সেদিন সমস্ত কাজকর্মের মধ্যে নগেনের মন ঐ ছুরির দিকেই পড়িয়া রহিল। তাহার মনে হইল, লোকটা যদি ছুরি উদ্ধার করিতে না আসে তো বেশ হয়। ছুরিটা তাহার হইয়া যাইবে; সে আর কাহাকেও বিক্রয় করিবে না।

ব্ল্যাক-আউটের কল্যাণে সন্ধ্যার সময়েই দোকান বন্ধ করিতে হয়। নগেন ছুরিটি সাবধানে সিন্দুকে বন্ধ করিয়া দোকানে তালা লাগাইয়া বাড়ি ফিরিল। কিছুদিন যাবৎ তাহার মনটা কেমন যেন নিঃসম্বল হইয়া ছিল, আজ তাহার মনে হইল সে হঠাৎ গুপ্তধন পাইয়াছে।

বাড়ি ফিরিয়া সে ক্ষণাকে ছুরির কথা বলিল না, দু’একবার বলি-বলি করিয়া থামিয়া গেল। ছুরিটা ব্যবহারিক জগতে এমন কিছু মহার্ঘ বস্তু নয়; তাছাড়া, নগেন নিজের মনের মধ্যে যে নূতন গুপ্তধন পাইয়াছে, ক্ষণাকে তাহার ভাগ দিতে রাজি নয়। একদিন ছিল যখন তাহারা মনের তুচ্ছতম আদানপ্রদান করিয়া সুখী হইত, কিন্তু এখন আর সেদিন নাই।

রাত্রির আহারাদি শেষ করিয়া নগেন শয়ন করিতে গেল। স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি ঘরে শয়ন করে, বছরখানেক হইতে এই ব্যবস্থাই চলিতেছে। বিছানায় শুইয়া কিছুক্ষণ বই পড়া নগেনের অভ্যাস, কিন্তু আজ আর বই পড়িতে ইচ্ছা হইল না। আলো নিভাইয়া সে শুইয়া পড়িল।

ঘুমাইয়া নগেন স্বপ্ন দেখিল, ছুরির মালিক হাতে ছুরি লইয়া দাঁড়াইয়া হাসিতেছে, তাহার নীল চোখে উৎকট উল্লাস… কতকগুলা নগ্ন নধর মনুষ্যদেহ তাহার চারিপাশে তাল পাকাইতেছে; লোকটা হাসিতে হাসিতে তাহাদের দেহে ছুরি মারিতেছে। কিন্তু ইহা হত্যার লীলা নয়, ভোগের ক্রীড়া। কি সহজে ছুরি ঐ নগ্ন জীবন্ত মাংসের মধ্যে আমূল প্রবেশ করিতেছে আর রক্তাক্ত মুখে বাহির হইয়া আসিতেছে। দেখিতে দেখিতে নগেনের শরীর উদ্দীপনায় আনচান করিতে লাগিল। নরম মাংসের উপর ছুরির ঐ পুনঃপুনঃ আঘাত তাহার ধমনীর রক্তে যেন আগুন ধরাইয়া দিল।

তীব্র উত্তেজনায় তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। এমন তীব্র উত্তেজনা সে অনেকদিন অনুভব করে নাই; তাহার দেহের ত্বক উত্তপ্ত হইয়া জ্বালা করিতেছে। সে কিছুক্ষণ বিছানায় বসিয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে নামিল, অন্ধকারে হাতড়াইয়া পাশের ঘরে ক্ষণার শয্যার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। ক্ষণা ঘুমাইতেছে, ঘুমের মধ্যে একটা বিশ্রী শব্দ করিয়া তাহার নিশ্বাস পড়িতেছে। শয্যায় প্রবেশ করিতে গিয়া নগেন সরিয়া আসিল; শয্যার চারিদিকের বাতাস ক্ষণার নিশ্বাসের দূষিত বাষ্পে ভারী হইয়া উঠিয়াছে। একটা দৈহিক বিকর্ষণ নগেনের শরীরের মধ্যে বিদ্রোহ করিয়া উঠিল। সে ফিরিয়া গিয়া এক গ্লাস জল পান করিয়া নিজের শয্যায় শুইয়া পড়িল।

পরদিন দোকানে গিয়া প্রথমেই নগেন সিন্দুক খুলিয়া ছুরির খবর লইল, ছুরি সিন্দুকের অন্ধকারের ভিতর হইতে চিকমিক করিয়া যেন তাহাকে অভিবাদন করিল। আশ্চর্য, ছুরিটা যেন কথা কয়। ফলা খুলিয়া বাঁটটা শক্ত করিয়া মুঠিতে ধরিতেই সে যেন সোল্লাসে বলিয়া উঠিল,—এই তো! এমনি করে আমায় ধরতে হয়। এবার কোথাও বিধিয়ে দাও—! নরম জীবন্ত মাংস নেই? আমার কাজই তো নরম মাংসের মধ্যে বিঁধে যাওয়া—!

ঘরের কোণে একটা উঁচু টুলের উপর একটি মখমলের মোটা তাকিয়া রাখা ছিল; কেহ বাঁধা দিয়া গিয়াছে। নগেনের দৃষ্টি পড়িল সেটার উপর। ঘরে তখন অন্য মানুষ নাই; নগেন ছুরি পিছনে লুকাইয়া তাহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল, তারপর সহসা ছুরি তুলিয়া সজোরে তাকিয়ার মধ্যে বসাইয়া দিল। একবার—দু’বার—তিনবার—দ্রুত পরম্পরায় আঘাত করিতে করিতে নগেন যেন উন্মত্ত হইয়া উঠিল; তারপর আবার অকস্মাৎ তাহার রক্ত ঠাণ্ডা হইয়া গেল, অবসাদে মুষ্টি শিথিল হইয়া পড়িল। না, এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাইবার চেষ্টা; মখমলের তাকিয়া নরম বটে কিন্তু রক্তমাংসের আস্বাদ তাহাতে নাই।

ছুরিটি সস্নেহে সিন্দুকে রাখিয়া দিয়া নগেন সমস্ত দিন লোন্-অফিসের কাজকর্ম করিল, কিন্তু তাহার মন একদণ্ডের তরেও নিরুদ্বেগ হইল না। প্রত্যেকটি নূতন খদ্দের তাহার দ্বার দিয়া প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তাহার বুকের ভিতরটা চম্‌কাইয়া ওঠে—ঐ বুঝি সেই লোকটা ছুরি ফিরাইয়া লইতে আসিল! লোকটা অবশ্য আসিল না; কিন্তু মাত্র পাঁচ টাকায় ছুরি বাঁধা রাখার জন্য তাহার অনুতাপ হইতে লাগিল, দশ টাকা কিংবা পনেরো টাকা দিলেই ভাল হইত, তাহা হইলে লোকটা সহজে ছুরি উদ্ধার করিতে পারিত না!

সন্ধ্যা হইতে না হইতে নগেন তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করিয়া ফেলিল, কি জানি লোকটা যদি আসিয়াই পড়ে! উপরন্তু ছুরিটা দোকানে রাখিয়া বাড়ি ফিরিতেও তাহার মন সরিল না। দোকানে রাত্রে কেহ থাকে না; যদি চোর ঢোকে? দিন কাল ভাল নয়; নগেন ছুরিটা পকেটে পুরিয়া লইল।

শীতের সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ জমিয়া একেবারে অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়িতেছিল। কলিকাতা শহরের আলো পর্দানশীন হইয়া ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হইয়াছে, বাহিরে এক ফোঁটা আসিবার অধিকার নাই। সুতরাং পথ দিয়া যে দু’একজন যাতায়াত করিতেছে তাহাদের অস্তিত্ব কেবল পদশব্দে অনুমান করা যায়। নগেনের অবশ্য বাড়ি বেশীদূর নয়, দশ মিনিটের রাস্তা, তার উপর পথও একান্ত পরিচিত। তবু নগেন সাবধানে হাঁটিতে লাগিল।

তিন-চার মিনিট হাঁটিবার পর তাহার মনে হইল, কে যেন তাহার পিছু লইয়াছে, পিছনে খসখস শব্দ হইতেছে। সে সতর্ক হইয়া ঘাড় ফিরাইল, কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখিতে পাইল না। পকেটে ছুরিটা শক্ত করিয়া ধরিয়া সে আরও দ্রুত পা চালাইল। পথ-ঘাট নিরাপদ নয়, এই ব্লাক-আউটের রাত্রে ঘাড়ের উপর গুণ্ডা লাফাইয়া পড়িলে মা বলিতেও নাই বাপ বলিতেও নাই।

পিছনে পায়ের শব্দ কিন্তু থামিল না, বরং আরও কাছে আসিয়াছে মনে হইল। নগেন চলিতে চলিতে ছুরিটা বাহির করিয়া ফলা খুলিয়া শক্তভাবে মুঠিতে ধরিল, তারপর হঠাৎ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া কড়া সুরে বলিয়া উঠিল—‘কে?’

পিছনে পদশব্দ খুব কাছে আসিয়া থামিয়া গিয়াছিল; নগেন কিন্তু কোনও মানুষ দেখিতে পাইল না। কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিবার পর তাহার মনে হইল, নীচে ফুটপাথের কাছে সাদা রঙের কী যেন একটা নড়িতেছে। সে তীব্র দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল; ক্রমশ ঐ সাদা বস্তুটা আকার ধারণ করিল। একটা সাদা কুকুর। নিতান্তই পথের কুকুর নির্জন পথে মানুষ দেখিয়া খাদ্যের আশায় তাহার সঙ্গ লইয়াছে।

নগেনের ঘনঘন নিশ্বাস পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল, কুকুর বুঝিতে পারিয়া তাহার ভয় কমিল। শক্ত মুঠিতে ধরা ছুরিটা সে মুড়িয়া আবার পকেটে রাখিবার উপক্রম করিল।

কুকুরটা অস্পষ্টভাবে কুঁই কুঁই শব্দ করিতেছে, ফুটপাথের উপর পেট রাখিয়া সশঙ্কভাবে একটু ল্যাজ নাড়িতেছে। নগেনের দুই চক্ষু হঠাৎ অন্ধকারে জ্বলিয়া উঠিল। সে সন্তর্পণে আবার ছুরির ফলা খুলিল; তাহার শরীরের মধ্যে রক্তের স্রোত প্রবল হর্ষোন্মাদনায় তোলপাড় করিয়া ছুটিতে লাগিল।

হাঁটু মুড়িয়া নগেন ফুটপাথের উপর অর্ধ-আনত হইয়া মুখে চুক্ চুক্ শব্দ করিল; কুকুরটা উৎসাহ পাইয়া প্রবল বেগে ল্যাজ নাড়িতে নাড়িতে হামাগুড়ি দিয়া তাহার কাছে আসিল। মানুষের কাছে এতখানি সমাদর সে কখনও পায় নাই।

হাতের নাগালের মধ্যে আসিতেই নগেন বিদ্যুদ্বেগে ছুরি চালাইল। ‘ঘেউ’ করিয়া একটা আর্ত চিৎকার—কুকুরটা বেশী দূর পালাইতে পারিল না, দু’পা সরিয়া গিয়া কাৎ হইয়া পড়িয়া গেল—

নগেন যখন বাড়ি পৌঁছিল তখন তৃপ্তি ও ক্লান্তিতে তাহার শরীর ভরিয়া উঠিতেছে। একটু হাসিয়া ক্ষণাকে বলিল, ‘ক্লান্ত বোধ হচ্ছে, আজ বড় খাটুনি গেছে। একটু শুয়ে থাকি গে, খাবার হলে ডেকো।’

লুকাইয়া ছুরিটাকে ধুইয়া নগেন উহা বালিশের তলায় রাখিয়া দিল, তারপর নিশ্চিন্ততার নিশ্বাস ফেলিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল। আঃ, কী আরাম! তাহার দেহমনে কোথাও এতটুকু অতৃপ্তি নাই।

পরের দিনটা একরকম নেশার ঝোঁকে কাটিয়া গেল। সকালে লোন্-অফিসে যাইবার পথে সে দেখিল, কুকুরটা ফুটপাথে মরিয়া পড়িয়া আছে, তাহার পাঁজরার সূক্ষ্ম কাটা দাগ হইতে রক্ত গড়াইয়া আছে। পথচারীরা তাহার সম্বন্ধে কোনও ঔৎসুক্য দেখাইতেছে না, পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতেছে। নগেনও মৃতদেহটা সম্বন্ধে কোনও ঔৎসুক্য অনুভব করিল না।

লোন্-অফিসে সমস্ত দিনটা আশঙ্কায় আশঙ্কায় কাটিল, কিন্তু সে লোকটা ছুরি উদ্ধার করিতে আসিল না। ছুরিটা আজ আর নগেন সিন্দুকে রাখে নাই, নিজের কোটের বুক-পকেটে রাখিয়াছিল। বুকের কাছে তার স্পর্শটাও যেন পরম তৃপ্তিকর।

সন্ধ্যার সময় দোকান বন্ধ করিয়া সে বাড়ি ফিরিল। আজ আর পথে কোনও ব্যাপার ঘটিল না। বাড়ি আসিয়া যথাসময় আহারাদি করিয়া সে শুইয়া পড়িল। এই কয়দিনে ক্ষণার সহিত তাহার সম্বন্ধ যেন আরও শিথিল হইয়া গিয়াছে, নেহাত প্রয়োজন না হইলে কথা কহিতেও ইচ্ছা হয় না। ক্ষণার মনও তাহার সম্বন্ধে এতই নিরুৎসুক যে, স্বামীর জীবনে যে প্রকাণ্ড এক নূতন বস্তুর আবিভাব হইয়াছে তাহা সে অনুভবেও জানিতে পারে নাই।

গভীর রাত্রে নগেনের ঘুম ভাঙিয়া গেল। সে অনুভব করিল, ছুরিটা বালিশের তলায় থাকিয়া কথা কহিতেছে,—ছি ছি, এমন রাত্রিটা ঘুমিয়ে কাটালে! ভোগের শুভক্ষণ জীবনে ক’বার আসে? আমি আর কতদিন থাকব তোমার কাছে? কালই হয়তো আমার মালিক এসে আমাকে নিয়ে যাবে। ওঠ, ওঠ, এখনও সময় আছে—অন্ধকার নিরালা শহরে কত ছুটোছাটা শিকার ঘুরে বেড়াচ্ছে—কত লোক ফুটপাথে শুয়ে আছে—

নগেন বিছানায় উঠিয়া বসিল। ছুরিটা বালিশের তলা হইতে বাহির করিতেই তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া তীব্র উত্তেজনার একটা শিহরণ বহিয়া গেল। সে শয্যা হইতে নামিয়া কোট পরিয়া গায়ে একটা র‍্যাপার জড়াইয়া লইল।

বাহিরে যাইতে হইলে ক্ষণার ঘর দিয়া যাইতে হয়, স্বতন্ত্র দ্বার নাই। নগেন নিঃশব্দ পদে ক্ষণার ঘরে গিয়া দেখিল, ক্ষণা লেপ গায়ে দিয়া ঘুমাইতেছে, তাহার মুখ দরজার দিকে। নিশ্বাস চাপিয়া নগেন দ্বারের দিকে গেল, কিন্তু হুড়কা খুলিতে গিয়া খুট করিয়া একটু শব্দ হইয়া গেলে।

চমকিয়া জাগিয়া ক্ষণা বলিয়া উঠিল, ‘কে?’

ঘরের কোণে তেলের রাত্রি-দীপ তখনও নিভিয়া যায় নাই, ক্ষণা ঘাড় তুলিয়া নগেনকে দেখিয়া বলিল, ‘ও—তুমি।’ বলিয়া আবার চোখ বুজিল।

নগেনের বুকের ভিতরটা ধক্ ধক্ করিয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু ক্ষণা যখন কিছু সন্দেহ না করিয়া নিশ্চিন্তভাবে চক্ষু মুদিল, তখন নগেন বেশ শব্দ করিয়া বাহিরে গেল। বাহিরের খোলা বারান্দায় দাঁড়াইয়া সে ক্ষণেক চিন্তা করিল, আর যাওয়া চলিবে না—ক্ষণা জাগিয়া উঠিয়াছে। তাহার বুকের মধ্যে অতৃপ্ত কামনা গুমরিয়া গুমরিয়া গর্জন করিতে লাগিল; ছুরিটাও যেন তাহার বদ্ধ মুষ্টির মধ্যে ফোঁস ফোঁস করিয়া নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল। নগেন ফিরিয়া গিয়া সশব্দে দ্বার বন্ধ করিয়া নিজের বিছানায় শয়ন করিল।

পরদিনটা নগেনের অসহ্য মানসিক অস্থিরতার মধ্যে কাটিল। কিছুই ভাল লাগে না, কোনও কাজেই মন নাই; দিন যেন কাটে না। থাকিয়া থাকিয়া একটা দুর্দম আকাঙক্ষা বুকের মধ্যে সাপের মতো ফণা তুলিয়া উঠিতে থাকে। এইভাবে দিন কাটিবার পর নগেন বাড়ি ফিরিল, আহারে বসিয়া ক্ষণাকে বলিল, ‘শোবার ঘরের দরজায় হুড়্‌কো লাগাবার কী দরকার? বাড়ি তো বন্ধই থাকে। কাল মিছিমিছি তোমার ঘুম ভেঙে গেল।’

ক্ষণা সরল মনে বলিল, ‘বেশ, আজ থেকে দরজা ভেজিয়ে রাখব।’

রাত্রি ঠিক বারোটার সময় নগেন বিড়ালের মতো নিঃশব্দপদে বাড়ি হইতে বাহির হইল। আজ আর ক্ষণা জাগিল না।

বাহিরে তখন নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে কম্বল মুড়ি দিয়া কলিকাতা শহর ঘুমাইতেছে। আকাশের তারাগুলা নগেনের মাথার আরও কাছে নামিয়া আসিয়া তাহার হাতের ছুরির মতোই নিষ্ঠুর হাসিতে লাগিল। নগেন নাসারন্ধ্র বিস্ফারিত করিয়া নিশ্বাস গ্রহণ করিল, তারপর ক্ষুধার্ত শ্বাপদের মতো এই অন্ধকারে অদৃশ্য হইয়া গেল।

পরদিন সকালবেলা খবরের কাগজ পড়িতে পড়িতে নগেন দেখিল, স্টপ প্রেসে ছাপা হইয়াছে—গত রাত্রে কলিকাতার অমুক গলিতে এক ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে; মৃতদেহে ছয় সাতটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। হত্যার কারণ বা হত্যাকারীর কোনও সন্ধান পাওয়া যায় নাই।

সংবাদ পাঠ করিয়াও নগেনের মনের ভিতরটা প্রশান্ত নিস্তরঙ্গ হইয়া রহিল, এতটুকু চাঞ্চল্য সেখানে দেখা দিল না। কেবল একটি বিষয়ে তাহার মন সতর্ক হইয়া রহিল—কেহ জানিতে না পারে।

সে-রাত্রিটা গভীর স্বপ্নহীন নিদ্রায় কাটিল। বাঘ মহিষ মারিয়া আকণ্ঠ উদর পূর্ণ করিবার পর যেমন ঘুমায়, তেমনি আলস্যভারাক্রান্ত জড়ত্বভরা ঘুম নগেন ঘুমাইল।

কিন্তু পরদিন আবার তাহার ক্ষুধা জাগিয়া উঠিল। দুপুর রাত্রে আবার সে বাহির হইল।

আবার খবরের কাগজে বাহির হইল, রাস্তায় ছুরিকাহত একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু এ লইয়া বিশেষ হৈ চৈ হইল না, সারা পৃথিবী জুড়িয়া হত্যার যে মত্ত তাণ্ডব চলিয়াছে তাহাতে এই সামান্য একটা মানুষের মৃত্যু কাহাকেও উত্তেজিত করিতে পারিল না।

এইভাবে সাত দিনের মেয়াদ ফুরাইল। প্রায় প্রত্যহই একটি করিয়া বলি পড়িল।

সপ্তম দিনে দোকানে যাইতে যাইতে নগেন মনে মনে মতলব করিল, আজ যদি লোকটা ছুরি উদ্ধার করিতে আসে, সে বলিবে ছুরি হারাইয়া গিয়াছে, তোমার যত ইচ্ছা দাম লও। ছুরি সে কিছুতেই ফেরত দিবে না।

কিন্তু লোকটা আসিল না। সন্ধ্যা পাঁচটা পর্যন্ত দেখিয়া নগেন তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করিয়া ফেলিল, তারপর ছুরি পকেটে লইয়া বাহির হইয়া পড়িল। তাহার যেন আনন্দ আর ধরিতেছে না—ছুরি এখন তাহার। আর ফেরত দিতে হইবে না। সে অনেকক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইল, তারপর অন্ধকার হইলে বাড়ি ফিরিল।

নিজের শয়নঘরের নির্জনতায় নগেন ছুরিটি খুলিয়া পরম স্নেহে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিল। কী সুন্দর জিনিস। এমন অপূর্ব বস্তু পৃথিবীতে আর আছে কি? ছুরিটিকে সে নিজের বুকে গলায় গালে স্পর্শ করিল। তাহার দেহ আনন্দে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তারপর হঠাৎ ঘরের বাহিরে ক্ষণার সাড়া পাইয়া সে ক্ষিপ্রহস্তে ছুরি বালিশের তলায় লুকাইয়া ফেলিল।

সে-রাত্রে ঠিক বারোটার সময় তাহার ঘুম ভাঙিল; ছুরি যেন খোঁচা দিয়া ঘুম ভাঙাইয়া দিল। নগেন সম্পূর্ণ সজাগ হইয়া উঠিয়া বসিল; ভিতর হইতে তাগিদ আসিয়াছে, আজও বাহির হইতে হইবে। আজ ছুরিটা প্রথম তাহার নিজস্ব হইয়াছে, আজিকার রাত্রি বৃথা না যায়।

ক্ষণার ঘর দিয়া যাইবার সময় ক্ষণার শয্যার দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল। দ্বারের দিকে যাইতে যাইতে সে থামিয়া গেল। ঈষদালোকিত ঘরে বিছানাটা অস্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছে…চুম্বক যেমন লোহাকে আকর্ষণ করে, তেমনি বিছানাটা নগেনকে টানিতে লাগিল। নগেন সতর্কভাবে শয্যার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল…ক্ষণাকে দেখা যাইতেছে, তাহার গায়ের লেপ সরিয়া গিয়াছে; ঘুমের মধ্যে তাহার দেহটা বিকলাঙ্গের মতো অদ্ভুত আকার ধারণ করিয়াছে, খোলা মুখ দিয়া সশব্দে নিশ্বাসপ্রশ্বাস বহিতেছে।

বিরাগ ও ঘৃণায় নগেনের মুখ বিকৃত হইয়া উঠিল। এই বীভৎস বিকলাঙ্গ মুর্তিটা তাহার স্ত্রী! ইহাকেই লইয়া সে জীবন কাটাইতেছে! ছুরিটা ফিসফিস করিয়া তাহার কানে বলিতে লাগিল—বাহিরে যাবার দরকার কি? একেই শেষ করে দাও। এই তো সুযোগ। দ্বিধা করছ? ছি ছি, সারা জীবন ধরে এই মড়া ঘাড়ে করে বেড়াবে! নাও নাও, আমি তো রয়েছি, বসিয়ে দাও ওর বুকে। জীবনের রঙ বদলে যাবে তোমার—আবার বিয়ে করতে পারবে—নতুন বৌ—

শুনিতে শুনিতে নগেন পাগল হইয়া গেল। তারপর কয়েক-মিনিটের কথা তাহার মনে নাই, যখন মাথাটা পরিষ্কার হইল তখন সে দেখিল, বিছানার উপর হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া সে ক্ষণার বুকের উপর ছুরি বসাইতেছে। ক্ষণা একটু নড়েও নাই, যেমন শুইয়াছিল তেমনি মরিয়াছে।

সমগ্র চেতনা ফিরিয়া পাইয়া নগেন সভয়ে একবার ঘরের চারিদিকে তাকাইল, তারপর খাট হইতে নামিয়া দাঁড়াইল। পাগল হইয়া এ কী করিল সে! নিজের ঘরে খুন করিল! এখন লাস সরাইবে কি করিয়া? পাড়ায় জানাজানি হইবে। পুলিস আসিবে। পুলিস নিশ্চয় বাড়ি খানাতল্লাস করিবে—তখন ছুরি বাহির হইবে।

মেঝেয় বসিয়া পড়িয়া দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা খুঁজিয়া নগেন ভাবিতে লাগিল… ছুরিটা রক্তলিপ্ত অধরে তাহার কানে কানে কথা বলিতে লাগিল। —

পাঁচ মিনিট পরে নগেন তড়াক করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। আছে—উপায় আছে। সে ক্ষণার হাত হইতে সোনার চুড়িগুলি খুলিয়া লইল, গলা হইতে হার টানিয়া ছিঁড়িয়া পকেটে পুরিল। তারপর নিঃশব্দে বাড়ি হইতে বাহির হইল। ছুরি ও গহনাগুলা সে লোন্-অফিসে লুকাইয়া রাখিয়া আসিবে। তারপর—

অবয়বহীন ছায়ার মতো সে পথ দিয়া ছুটিয়া চলিল। দশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে অতিক্রম করিয়া দোকানের রাস্তায় পড়িল।

দোকানের বন্ধ দরজায় ঠেস দিয়া কে একজন বসিয়া আছে। খুব কাছে না আসা পর্যন্ত নগেন তাহাকে দেখিতে পায় নাই, দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। লোকটার মুখের কাছে অঙ্গারের মতো চুরুটের আগুন জ্বলিতেছে; নগেনকে দেখিয়া সে উঠিয়া দাঁড়াইল, মুখের কাছে মুখ আনিয়া বলিল, ‘আহ!’

নগেন চিনিল, ছুরির মালিক। সে জড়বৎ দাঁড়াইয়া রহিল; তাহার মস্তিষ্ক আর কাজ করিতেছে, এই অভাবনীয় সংস্থিতির ফলে যেন অসাড় হইয়া গিয়াছে। লোকটা বলিল, ‘সন্ধ্যে থেকে এখানে বসে আছি; এত তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করেছিলে কেন? আমার ছুরি দাও।’

লোকটা হাত পাতিল। পকেটের মধ্যে ছুরি ও গহনাগুলা একসঙ্গে ছিল, নগেন যন্ত্রচালিতের মতো সব কিছু বাহির করিয়া তাহার হাতে দিল।

লোকটার মুখে চুরুটের আগুন একটু উজ্জ্বল হইল, সে সম্মুখে ঝুঁকিয়া সেই আলোতে হাতের জিনিসগুলা পরীক্ষা করিল; তাহার নীল চক্ষুদুটা ও মুখের খানিকটা দেখা গেল। একটা অমানুষী উল্লাস তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল, গলার মধ্যে চাপা হাসির খসখস শব্দ হইল; যেন সে সব জানে, সব বুঝিয়াছে। তারপর হঠাৎ সে পিছু ফিরিয়া চলিতে আরম্ভ করিল; অন্ধকারে তাহার বুটের খট্‌খট্‌ শব্দ দূরে মিলাইয়া গেল।

নগেনের মনে হইল, তাহার দেহমনের সমস্ত শক্তি ফুরাইয়া গিয়াছে; দুর্বহ অবসাদ ও ক্লান্তি তাহাকে চাপিয়া মাটিতে মিশাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে। এই কয়দিন সে একটা প্রবল নেশায় মত্ত হইয়া ছিল, তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারে নাই; আজ হঠাৎ ছুরিটা চলিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছে।

পা দু’টা অতিকষ্টে টানিয়া টানিয়া সে বাড়ি ফিরিল।

ক্ষণার শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া বিছানার উপর ক্ষণার রক্তমাখা মৃতদেহটা দেখিয়া সে ভয়ে আর্তনাদ করিয়া উঠিল। সে জানে সে নিজেই এ কাজ করিয়াছে; তবু যেন ইহার জন্য সে দায়ী নহে। কোথাকার এক ভোগ-লোলুপ রাক্ষস ঐ অভিশপ্ত ছুরিটা পাইয়া নিজের লালসা চরিতার্থ করিয়াছে।

ছুটিতে ছুটিতে বাড়ির বাহির হইয়া সে পাশের বাড়ির দরজায় গিয়া সজোরে ধাক্কা দিতে লাগিল, ‘ও মশায়, রমেশবাবু, শিগ্‌গির দরজা খুলুন—’

প্রতিবেশী ভদ্রলোক দরজা খুলিয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘এ কি, কী হয়েছে!’

হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া নগেন বলিল, ‘আমার স্ত্রীকে কারা খুন করে রেখে গেছে। ‘আঁ! ঢুকলে কি করে?’

‘জানি না। হয়তো আমার স্ত্রী সদর দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল—তার হাতের চুড়ি গলার হার সব নিয়ে গেছে। আসুন শিগ্‌গির—

ইহার পর প্রায় বছরখানেক কাটিয়া গিয়াছে। নগেন আবার বিবাহ করিয়াছে। নূতন বধূটি সুন্দরী নয়, কিন্তু উজ্জ্বল যৌবনবতী।

মাঝে মাঝে ছুরির কথা নগেনের মনে হয়। তখন তাহার শরীরের স্নায়ুপেশী শক্ত হইয়া ওঠে; সে দৃঢ়ভাবে চক্ষু বন্ধ করিয়া থাকে, প্রাণপণে ভুলিবার চেষ্টা করে। কিন্তু ছুরিটা তাহার জীবনে অভিশাপ কি আশীবাদ রূপে দেখা দিয়াছিল তাহা বুঝিতে পারে না।

নবীনা বধূ পিছন হইতে আসিয়া তাহার কাঁধের উপর হাত রাখে, জিজ্ঞাসা করে, ‘কিসের ধ্যান হচ্ছে?’

নগেনের স্নায়ুপেশীর কঠিনতা শিথিল হয়, ছুরির কথা আর তাহার মনে থাকে না। মন মাধুর্যে ভরিয়া ওঠে।

সে হাসিয়া বলে, ‘তোমার।’

৩০ মাঘ ১৩৫২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *