ছুটি

ছুটি

বৃদ্ধ প্রসন্নবাবু ধুঁকতে ধুঁকতে বিরাট অফিসবাড়ির লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চুল পেকে পাটের মতো চেহারা হয়েছে। চারপাশে ঝুলে আছে এলোমেলো, বহু ব্যবহৃত ঝুলঝাড়ুর মতো। চুলের আর অপরাধ কী? সারাজীবন মাথার ওপর দিয়ে কম ঝাড়ঝাপটা গেছে! জীবনটাকে দাঁড়িপাল্লায় ফেললে, সুখের দিকে পড়বে ছটাক খানেক, বাকিটা দুঃখ। যখন যেখানে পা ফেলেছেন, সবই পড়েছে বেতালে। একেই বলে মানুষের ভাগ্য। সেই কথায় বলে না, বরাতে নেইকো ঘি, ঠকঠকালে হবে কি?

বগলে রংচটা ছাতা। হাতে একটা মার্কিনের ব্যাগ। ব্যাগে কিছু দরকারি কাগজপত্র, আর একটা চশমার খাপ। খাপে ময়লা একটা দু-টাকার নোট, পথ-খরচ। আর ছোট্ট একটা ঠোঙায় গুটিকয় বাতাসা। রক্তে চিনি কমে গেছে। ডাক্তারের নির্দেশ, মাথা ঘুরলেই একটু চিনি খাবেন। চিনির যা দাম! ওই পথ চলতে চলতে মাঝেমধ্যে একটা দুটো বাতাসা ফেলে দেন মুখে।

লিফটের সামনে তেমন ভিড় নেই। অফিস অনেক আগেই বসে গেছে। লেটের বাবুরাও সব এসে গেছেন মনে হয়। আজকাল অফিস একটু কড়া হয়েছে। কাগজে পড়েছেন। সত্যি মিথ্যে জানেন না। লিফটের সামনে গন্ধটন্ধ মাখা একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন। ঘর্মাক্ত, রোদে পোড়া, সচল ঝুলঝাড়ু সদৃশ প্রসন্নবাবুকে দেখে তিনি একটু সরে দাঁড়ালেন। প্রসন্নবাবু মনে মনে হাসলেন। মা জননী, জীবনের বসন্ত বড়ো ক্ষণস্থায়ী। হেসে নাও হেসে নাও, দু-দিন বই তো নয়! ওই চুল পাকবে, গোলাপী গাল কোল্ড স্টোরে রাখা আপেলের মতো ধেসকে যাবে। সরু কোমরটি হবে হাতির গোদা পায়ের মতো।

ওপর থেকে লিফট নেমে এল নীচে, লাল আলোর অক্ষর কমাতে কমাতে। জীবনটা যদি লিফটের মতো হত! উলটো হাতল ঘুরিয়ে বয়েসটাকে কমাতে কমাতে শূন্যে নিয়ে আসতেন। আবার মাতৃজঠরে, আবার ভূমিষ্ঠ। অন্নপ্রাশন। তারপর বেশ হিসেব করে দুঁদে ছেলের মতো বড়ো হওয়া, ফার্স্ট ফ্লোর, টপ ফ্লোর। একেবারে টঙে উঠে, রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেন। সব ক্ষুদি ক্ষুদি মানুষ, পৃথিবীর পিঠে যেন পোকা ঘুরছে।

সাত নম্বর তলায় লিফট থেকে নেমে পড়লেন তিনি। সেই পুরোনো কর্মস্থল। সব এখন পালটে গেছে। বেশিরভাগই নতুন মুখ। কেউ তাঁকে চেনে না। যারা চেনে, তারাও যেন না চেনার ভান করে। একজন মানুষ রিটায়ার করে চলে গেলে, তাকে আর মনে রেখে লাভ কী! তার কাছ থেকে কী আর পাওয়া যাবে, দুঃখের কাঁদুনি ছাড়া। উলটে বরং যাবে। এক কাপ চা ভদ্রতা করে খাওয়াতে হলে, এ বাজারে তিরিশটা পয়সা। ওর সঙ্গে কুড়িটা পয়সা জুড়লে এক পিঠের বাসভাড়া।

লম্বা হলঘরে সেই পরিচিত অফিস এখন কত অপরিচিত। ঘিঞ্জি, নোংরা। কোনো যেন ছিরিছাঁদ নেই। ক্যাডাভ্যারাস। যে যেখানে পেরেছে, একটা করে টেবিল চেয়ার পেতে বসে পড়েছে। কিছু টেবিল নতুন। কিছু সেই ব্রিটিশ আমলের। আকার, আকৃতি দেখলেই ডায়ার কিংবা টেগার্টের কথা মনে পড়ে। যে অফিস দেখে এখন ঘৃণায় নাক সিঁটকোচ্ছেন, সেই অফিসেই সারাজীবন ফাইল নেড়ে অক্লেশে কাটিয়ে গেছেন। প্রথম দিকে এ অফিসও ছিল না। যুদ্ধের পর একটা ভাঙা টিনের চালার তলায় অফিস বসত। গ্রীষ্মে জীবন বেরিয়ে যেত। মাথার ওপর হাণ্ডা পাখা ক্যাঁচোর ক্যাঁচোর শব্দে গরম বাতাসের ন্যাজ নাড়ত। ছাতাধরা কুঁজোয় জল। নোংরা টুলের ওপর একপাশে কেতরে থাকত। মুখে একটা পিচবোর্ডের ঠুলি। সারাদিন কাজ করো, আর ঢোঁকর ঢোঁক জল খাও। সে সময় অফিসে তবু কাজ হত। ডাক্তার রায়ের আমল। নিজে স্বপ্ন দেখতেন, অন্যকেও সেই স্বপ্ন দেখাতে জানতেন। বড়ো বড়ো পদে বেশ কিছু স্বদেশি করা মানুষ ছিলেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের যোগ ছিল। কাজে গাফিলাতি হলে জবাবদিহি করতে হত। সাসপেনসান কিংবা ট্রানসফারের ভয় ছিল। কাগজে কোনো দফতরের সামান্যতম সমালোচনা হলে ফাটাফাটি হয়ে যেত। তুলকালাম কান্ড শুরু হয়ে যেত। তখন অফিসে অফিসে এত সুন্দরী মহিলা ছিল না। টেবিলে টেবিলে প্রেমালাপ ছিল না। প্রজাপতি উড়তে না ফুরফুস করে। ঘুসঘাস ছিল না, থাকলেও খুব সামান্য, খুব লুকিয়ে চুরিয়ে, জায়গা বিশেষে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে সব যেন কেমন হয়ে গেল! স্বাধীনতা যত পুরোনো হতে লাগল দেশটা যেন পচে ফুলে উঠল। চিকিৎসার বাইরে চলে গেল সব। নতুন বাড়িতে অফিস এল। কর্মচারীর সংখ্যা বাড়ল জোয়ারের জলের মতো। অসংখ্য কেতাদুরস্ত অফিসার। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা! ফাইলই বাড়ল। দেশ যে তিমিরে সেই তিমিরে।

দরজার মুখে দাঁড়িয়ে প্রসন্নবাবু দূর কোণের দিকে তাকালেন। তিনি যে চেয়ারে, যে জায়গায় শেষ বসে গেছেন সেখানে একজন হৃষ্টপুষ্ট মহিলা এসেছেন। খেঁকুরে প্রসন্নর জায়গায় ভরভরন্ত রমণী। কাঁধকাটা ব্লাউজ বেয়ে পাইথনের মতো হাত নেমেছে। যাকে যখন ধরবেন তার আর নিষ্কৃতি নেই। মুখটি যেন তিল ফুলের, নীল শাড়ি ফর্সা রং, কোণটা যেন আলো হয়ে আছে। বয়েস হয়েছে, চোখে চালসে, শরীর ঢকঢকে, দু-পা হাঁটলে হাঁপ ধরে, তবু মেয়েছেলে দেখার চোখ সরে না। মানুষ একটা জীব বটে! যত দুর্ভোগ বাড়ে, তত ভোগের আকাঙ্ক্ষাও বাড়ে। বাবু প্রসন্ন, স্থির হও।

প্রসন্নবাবু নিজেকে উপদেশ দিয়ে, সরাসরি টেবিলের মাঝখান দিয়ে অশোক বসুর আসনের দিকে এগোতে লাগলেন। অশোক বসুই এখন একমাত্র ভরসা। রিটায়ার করেছেন প্রায় তিন বছর হল, এখনও পেনসান পেপার তৈরি হল না, প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা ফেরত পেলেন না। আর কয়েক মাস পরেই মেজো মেয়ের বিয়ে। কথাবার্তা প্রায় পাকা হয়ে এসেছে। দর কষাকষি চলছে। রফা একটা হবেই। মেয়ে যখন, আইবুড়ো তো আর ফেলে রাখতে পারেন না। জীব-ধর্ম বলে কথা!

প্রসন্নবাবু অশোক বসুর টেবিলের সামনে এসে মৃদু গলায় ভয়ে ভয়ে ডাকলেন, ‘বাবা, অশোক’। বয়েসে অনেক ছোটো। ছেলের বয়সী। বাবা ছাড়া আর কী বলবেন। বড়ো স্নেহের ডাক। বয়ঃকনিষ্ঠদের আজকাল তিনি এইভাবেই ডাকেন। এর মধ্যে তেমন কোনো স্বার্থ নেই। যে বয়েসে এসে ঠেকেছেন সে বয়েসে স্বার্থের কথা আর তেমন করে ভাবা যায় না। এখন সব জিনিসই হলে হবে, না হলে না হবে। হিসেবের খাতার শেষ পাতায় দেনা-পাওনার অঙ্ক মেলাতে বসলে চোখ খুলে যায়। সারাজীবন পেতে হবে, পেতে হবে করে, কী পেয়েছেন। এ যেন আমবাগানে আম কুড়োতে গিয়ে কোঁচড় ভর্তি ইটের টুকরো নিয়ে ফেরা। সেই দেনেঅলা মালিক একজন। তিনি যাকে দেন তাকে ছপ্পর ভরে দেন। যাকে দেন না, তাকে কিছুই দেন না, এমনকী তার পাওনা টাকা, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনসান সব আটকে রেখে দেন। ঘুরে, ঘুরে, জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে যায়। কত অসহায় প্রাণী এই সামান্য জাগতিক আকর্ষণে ভূত হয়ে বড়ো বড়ো অফিসবাড়ির কার্নিশে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে আছে। সুযোগ পেলেই বড়োবাবুর কানের কাছে, খোনা খোনা গলায়, বাতাসের সুরে বলে যায়, বঁড়োঁবাঁবু, আঁমাঁর পেঁনসাঁন, আঁমাঁর ফঁভিঁডেন্ট ফাঁণ্ড। বড়োবাবু ভাবেন, কী যেন একটা শুনলুম। কানের পাশে হাত নেড়ে মাছি তাড়াবার মতো শব্দটাকে উড়িয়ে দেন, ও কিছু নয়, মনের ভুল। যারা মানুষ খুন করে, তারাও মাঝরাতে অনেক অশরীরী শব্দ শুনতে পায়, তুমি আমায় মারলে তুমি আমায় বিধবা করলে, শিশুর আর্তনাদ, নারীর আর্তনাদ, যুবকের মৃত্যুকালীন চিৎকার, কন্ঠনালীর উন্মুক্ত ভাগ দিয়ে বেরিয়ে আসা, বাতাস আর রক্তের ঘড় ঘড় শব্দ। তারা গ্রাহ্য করে না। শোনার মতো না শোনাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। সাধনায় কি না হয়?

একটা শতচ্ছিন্ন, পুরোনো কেস ফাইল খুলে, অশোক বসু ধ্যানস্থ ছিলেন। হয়তো লর্ড ক্লাইভের আমলের কোনো কেস। আজও যার ফয়সালা হয়নি। দু পক্ষে চিঠি-চাপাটি চলছে তো চলছেই। অনন্তকাল চলবে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ যুগের স্লোগানই হল, চলছে চলবে। অশোক বসু বিরক্তি-ভরা গম্ভীর মুখ তুলেই, প্রসন্নবাবুকে দেখে বিগলিত হাসিতে গলে একেবারে মাখমের মতো হয়ে গেলেন। প্রসন্নবাবু বড়ো অবাক হলেন। এখানকার আকাশে তো কোনোদিন সূর্যোদয় দেখেননি? আজ হঠাৎ কী হল! উনি যা শুনবেন ভেবেছিলেন, তা হল, অ, আবার এসেছেন? আপনার তাগাদায় মশাই অফিসে তিষ্ঠনোই দায় হল! ক-বছর হল মশাই? মাত্র তিন বছরেই হেদিয়ে গেলেন! পেনসান পেপার তৈরির ঝামেলা জানেন? আর প্রভিডেন্ট ফাণ্ড! সে মশাই আমাদের হাতে নেই। আমরা পাঠিয়েছি। ভাগ্যে থাকলে আজও হতে পারে, আবার দশবছর পরেও হতে পারে। আপনি এখন মনে করুন গর্ভাবস্থা চলছে। সময় হলে ডেলিভারি হবে। টানা হ্যাঁচড়া করলে, তিন তরফেরই বিপদ। প্রসূতি মরবে, বাচ্চা মরবে, জেলে যাবে গাইনি।

অশোক বললেন, বসুন বসুন। অঃ, বাইরে আজ ভীষণ রোদ। চোখ মুখ কালো হয়ে গেছে। আহা শরীরটা একেবারে ভেঙে গেছে। এ দেশে বৃদ্ধরা বড়ো অবহেলিত। হালের বলদের মতো। যতদিন শক্তি, ততদিন খাতির। যেই বসে গেল, টানতে টানতে নিয়ে যাও কষাইখানায়।

প্রসন্নবাবু সামনের চেয়ারে বসতে বসতে অবাক হয়ে পুত্রসম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই শুষ্ক পৃথিবী কী আবার জলসিক্ত, স্নেহসিক্ত, করুণাসিক্ত, বড়ো নির্ভর একটি স্থান হয়ে উঠল নাকি! মানুষ মানুষের কথা ভাবছে! চোখে জল এসে গেল। সকালেই পরিবারের সঙ্গে এক পক্কড় হয়ে গেছে। টাকার জোর না থাকলে সংসার এক বিতিকিচ্ছিরি জায়গা। এ যেন মুদিখানার দোকান। স্নেহের কিলো এক-শো টাকা, মমতা দেড়-শো টাকা, ভালোবাসা পাঁচ-শো টাকা। দাঁড়িপাল্লায় বাটখারা চাপিয়ে লেনা-দেনা। মানুষ তাই নিয়েই মেতে আছে। জুতো, ঝ্যাঁটা, লাথি খেয়েও মরার সময় হাতে পায়ে ধরাধরি, আরও কিছুকাল, আরও কিছুকাল।

অশোক বসু গলা চড়িয়ে কাকে যেন বললেন, এক গেলাস ঠাণ্ডা জল দিয়ে যাও।

প্রসন্নবাবু অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, ছেলেটা রাতারাতি অন্তর্যামী হয়ে গেল নাকি? তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ঠিক টের পেয়েছে তো?

শুধু জল নয়। জলের পর চা এসে গেল। কাপের দিকে হাত বাড়াতে ইতস্তত করছিলেন। কে জানে বাবা, কার জন্যে চা এসেছে? আগে তো কখনো এমন হয়নি।

চায়ের কাপটা প্রসন্নবাবুর দিকে সামান্য একটু ঠেলে দিয়ে অশোক বসু বললেন, নিন, চা খান। চা খান। গ্রীষ্মের তেষ্টা জলে যাবার নয়। গরম চা না খেলে মিটবে না।

প্রসন্নবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে ঠোঁটের কাছে কাপ তুললেন। পানসে চা। তবু চা তো। একচুমুক মেরেই থমকে গেলেন। পুরনো দিনের একটা ঘটনা মনে পড়ল:

সেন সাহেব বলে এক সাহেব এসেছিলেন এই অফিসে। বেশ মিহি চেহারা, মিহি গলা। অর্থনীতির এম. এ। মানুষকে বড়ো অদ্ভুত কায়দায় তিনি অপমান করতেন। জনৈক মন্ত্রীর এক আত্মীয়কে নিয়োগপত্র ছাড়তে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল। একদিন কি দু-দিন হলে কিছু বলার ছিল না। মাত্র বারো ঘণ্টা দেরি হয়েছিল। সেন সাহেব ডেকে পাঠালেন। ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘আসুন আসুন। কতদিন আপনাকে দেখিনি। কাজে ব্যস্ত থাকেন আপনি। বুঝতেই পারি নি:শ্বাস ফেলার অবকাশ থাকে না। আপনাদের মতো সিনসিয়ার কিছু কর্মী আছে বলেই প্রশাসন এখন ভেঙে পড়েনি। আরে দাঁড়িয়ে কেন, বসুন বসুন।’

বেল টিপে বেয়ারা ডেকে বললেন, এক কাপ চা নিয়ে এসো।’ চা এসে গেল। প্রসন্নবাবু ভয়ে ভয়ে একটি চুমুক মারলেন। খুব সাবধানে যাতে কোনো রকম শব্দ না হয়। দ্বিতীয় চুমুকের জন্যে কাপটাকে সবে ঠোঁটের কাছে এনেছেন সেন সাহেব পাইপ চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘কত বয়েস হল আপনার?’

কাপ থেকে ঠোঁট সরে এল, প্রসন্নবাবু বললেন, ‘আর বছর দুই বাকি আছে।’

‘তার মানে বুড়ো-হাবড়া হয়ে গেছেন। ভীমরতি ধরেছে।’

প্রসন্নবাবু আত্মরক্ষার জন্যে সামান্য প্রতিবাদের সুরে বললেন, ‘আজ্ঞে না ভীমরতি ধরবে কেন? এখনও বেশ শক্ত-সমর্থই আছি!’

‘বয়েস কত বছর কমিয়েছেন?’

‘এক বছরও না।’

‘ছেলে মেয়ে ক-টি?’

‘দুই ছেলে এক মেয়ে।’

‘সেদিকে হিসেব ঠিক রেখেছেন অ্যাঁ।’

‘তার মানে স্যার?’

‘এদিকে অপদার্থ হলেও ওদিকে বেশ পদার্থ আছে, কী বলেন?’

‘আপনি কী বলছেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘তা পারবেন কেন? ইনক্রিমেন্টটি বন্ধ করে দিলে বুঝতে পারবেন, কত ধানে কত চাল?’

‘আমার তো স্যার আর ইনক্রিমেন্ট নেই। স্কেলের শেষে বহুদিন হল পৌঁছে গেছি।’

‘এবার তা হলে দয়া করে ভেগে পড়ুন না। চেয়ার দখল করে বুড়ো হাবড়ারা আর কতকাল বসে থাকবে। কিছু ইয়ং ছেলে না এলে চাকায় যে জং ধরে গেল।’

অশোক বসুর পেছনে তামাটে আকাশে সন্ধানী চিল উড়ছে। রোদের প্রখর তাপে গাছপালা ঝিমিয়ে পড়েছে। পুরোনো দিনের কথা ভেবে চায়ে চুমুক দিতে সাহস হচ্ছে না। বলা যায় না অতীত আবার ফিরে আসতেও পারে।

ছেঁড়া ফাইলটা বাঁধতে বাঁধতে অশোক বসু বললেন, ‘সামনের মাসেই যাতে আপনি পেনসান ড্র করতে পারেন সে ব্যবস্থা আমি করব। আর এক মাসের মধ্যেই আপনি প্রভিডেন্ড ফান্ট আর গ্র্যাচুইটির টাকা অবশ্যই পাচ্ছেন। মেয়ের বিয়ের দিন পাকা হল?’

‘দর কষাকষি চলছে পাত্রপক্ষের সঙ্গে। ছেলেটি ভালো। যা বাজার দর তা দেবার ক্ষমতা আমার নেই।’

‘কিছু ভাববেন না। ঈশ্বরের ইচ্ছেয় সব হয়ে যাবে। আপনি সৎ মানুষ। আপনাকে কেউ আটকাতে পারবে না।’

প্রসন্নবাবু করুণ কন্ঠে বললেন, ‘বাবা অশোক, এসব কথার কথা নয় তো! সত্যিই হবে?’

‘আপনি দেখুন না, হয় কি না! আর আপনাকে ঘুরতে হবে না। আমারও মেয়ে আছে প্রসন্নদা, আমাকেও একদিন রিটায়ার করতে হবে। ঘুঁটে পুড়লে গোবরের হাসা উচিত নয়।’

বিবর্ণ ছাতাটি বগলে নিয়ে প্রসন্নবাবু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘ভগবান তোমার মঙ্গল করুন বাবা।’ অশোক বসু প্রবীণ মানুষটিকে সম্মান জানাবার জন্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমি ভালো করলে তবেই না আমার ভালো হবে? প্রসন্নদা, একদিন সকলকেই যেতে হবে। এখানকার বিচার এখানে না হলে ওখানে গিয়ে হবেই। সেখানে ঘুস চলে না। খুঁটি ধরে পার পাওয়া যায় না।’

চারপাশে তাকাতে তাকাতে প্রসন্নবাবু দরজার দিকে চললেন। চেনাজানা যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলেই যেচে যেচে কুশল প্রশ্ন করতে লাগলেন। প্রায় সমসাময়িক হরেনবাবু জড়িয়ে ধরে বললেন, আমারও যাবার সময় হল রে! আর এক মাস। বয়েসটা না ভাঁড়ালে তোর সঙ্গেই যেতে হত। তুই তো সাধু, তোর কথাই আলাদা। আমরা ছিলুম ম্যানেজমাস্টার। তা ভাই ম্যানেজ করে কী আর হল। বছর কয়েক দাসত্বের কাল বাড়ল। সেই তো মাথা হেঁট করে যেতেই হবে!’

সহকর্মী হরেন উদাস মুখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। বগলে বিবর্ণ ছাতাটি চেপে ধরে প্রসন্ন বললেন, ‘দাসত্বই আমাদের জীবন রে ভাই। এই বাড়ি যেদিন আমাদের ছুটি বলে বাইরে বের করে দিয়েছে, সেদিন থেকে আমরা জীবনেরও বাইরে চলে গেছি। কিছুই আর নেই, শুধু দিন গোনা। ক্যালেণ্ডারের পাতা ওলটানো।’

‘নতুন ভাবে বাঁচা শিখতে হবে। একটা কিছু করতে হবে।’

‘কিছুই করার নেই রে ভাই। ভাবনাটাই শেষে মরে যায়। জীবনটাই যে পুরোনো হয়ে গেছে। পৃথিবীতে শুধু যৌবনের আয়োজন। আমরা স্টেজের বাইরের চরিত্র এখন। দর্শকের আসনে বসে থাকা। আমরা তো তেমন বড়ো হতে পারিনি। একেবারেই মিডিয়কার। কীর্তনের দলের দোহার দেখেছিস? মূল গায়েন গাইলে, রাধার এ কী হল। দোহাররা অমনি গেয়ে উঠল, এ কী হোলো। আমরা হলুম সেই দোহার। এ কী হল করার জন্যেই জন্মেছি।’

প্রসন্ন অফিসের বাইরে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেন। শহর যেন রোদের উত্তাপে পরিশ্রান্ত বলদের মতো ধুঁকছে। ট্রাম চলেছে নড়বড়, নড়বড় করে। যৌবনে এই সময়টায় তিনি অফিসের বাইরে টিফিন করতে বেরোতেন। চারপাশে সবই রয়েছে। সেই কাটাফল, চিঁড়ে, মুড়ি, ছোলা, বাদাম ভাজা। আখের রস। তেলেভাজা, আলুর চপ, জিলিপি। সার সার মিষ্টির দোকান, পান, সিগারেট, ঠাণ্ডা জল। সবই সেই আগের মতো। নাটক চলছে, চলবে। এক প্রসন্ন যায়, তো শত প্রসন্ন আসে। জীবন অনেকটা পায়ের কড়ার মতো। যতই কাটো না কেন, আবার ঠিক গজাবে।

এই সব ভাবতে ভাবতে রাজভবনের সামনে দিয়ে বৃদ্ধ প্রসন্ন টুকটুক করে হেঁটে বাস রাস্তার দিকে এগোতে লাগলেন। আজ আর তেমন হতাশ বোধ করছেন না। টাকাক-টা পেলে মেয়েটাকে সামনের শীতেই পার করবেন! আর বহু দিনের ইচ্ছে, হরিদ্বারটা একবার ঘুরে আসবেন। সুষমারও যেমন বরাত!

সেই চড়চড়ে রোদে, পিচগলা রাস্তায় হঠাৎ বউয়ের কথা মনে পড়ল। কম সহ্য করেছে! বেচারা আর পারছে না। বয়েস বেড়েছে। নানারকম মেয়েলি রোগে ধরেছে। মেজাজ তো একটু খিটখিটে হবেই! আর কত খরচ হবে, হাজার, দু-হাজার! সস্ত্রীক ঘুরে আসব হরিদ্বার, দেরাদুন, মুসৌরী। শরীর নিলে কেদারনাথ। জীবনে একবার, মাত্র একবার সঞ্চিত অর্থের বেহিসেবি খরচ। বেহিসেবী কেন? এ তো আমার উপার্জন! মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে চোখের সামনে ভাসতে থাকবে তুষারপুত্র হিমালয়। সংসার নয়, জীবনের চাওয়া, পাওয়া না-পাওয়া নয়, স্যাঁতসেঁতে দেয়াল নয়, হিমালয় দেখতে দেখতে নি:শব্দে সরে পড়া।

হাওড়াগামী একটা ভিড় বাসে টুক করে লাফিয়ে উঠলেন। হিমালয়ের কথা ভেবেই বাতাক্রান্ত পায়ে কেমন জোর এসে গেছে। বগলের ছাতা কনড্যাক্টররের কোমরে খোঁচা মেরেছে। শঙ্কিত হলেন। এই সামান্য অসাবধানতার ফলে কত কথাই না শুনতে হবে। খিস্তি করে ভূত ভাগিয়ে দেবে। কেরানির কী যে অভ্যাস! সারাজীবন বগলে ছাতা, হাতে একটা নরম কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ! সাধে লোকে কেরানীকে ঘেন্না করে।

কনডাক্টর ছেলেটি কিন্তু কিছুই করল না। বরং ভেতরে এগিয়ে যেতে সাহায্য করল। অবাক হলেন। এমন তো আজকাল হবার নয়। এখন তো তেরিয়া-মেরিয়ার যুগ। ভেতরে ঢোকার সময় আর একপ্রস্থ অবাক হবার পালা। ঢুঁ মেরে, গোঁত্তা মেরে, পায়ে পায়ে জড়াজড়ি করে, এপাশ থেকে ওপাশ থেকে ছোঁড়া তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ সহ্য করতে করতে, বাসের মধ্যে নিরাপদ মধ্যাঞ্চলে যেতে হল না। যাত্রীব্যূহ মন্ত্রবলে যেন দু-ভাগ হয়ে গেল, যেন সেই যমুনা! বৃদ্ধ প্রসন্ন কৃষ্ণ-কোলে নন্দের মত অক্লেশে ঢুকে গেলেন। শুধু তাই নয়, বেশ রাগী রাগী চেহারার স্বাস্থ্যবান একটি যুবক সরে গিয়ে, সুন্দর এবং সুস্থভাবে দাঁড়াবার মতো জায়গা ছেড়ে দিলেন।

বাস চলেছে। প্রসন্নবাবু চলেছেন। একটা হাত ছাতা সামলাচ্ছে, আর একটা হাত টাল সামলাচ্ছে। অসুবিধে হচ্ছে। হলেও কিছু করার নেই। এই ভাবেই যেতে হবে। মধ্যবিত্ত মানুষকে কোন সরকার এর চেয়ে বেশি সুখে রাখবে। ইংরেজ রেখেছিল। সে সময় দেশ বড়ো ছিল। জনসংখ্যা কম ছিল। ভয়ও ছিল সমালোচনার। সামনের আসনের পাশের দিকে যে যুবকটি বসেছিল, সে হঠাৎ বললে, ‘আপনার ছাতা আর ঝোলাটা আমার হাতে দিয়ে, দু-হাতে ভালো করে ধরে দাঁড়ান।’

প্রসন্নবাবু নির্দেশ পালন করলেন। এ এমন কিছু অবাক প্রস্তাব নয়। শহরবাসী যত স্বার্থপরই হোক এটুকু এখনও করে। এতেও অবশ্য স্বার্থ আছে। মুখের কাছে, কাঁধের কাছে হাঁটুর কাছে কিছু ঠেকলে অস্বস্তি হয়। যুবকটি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললে, ‘আপনি বসুন।’

‘কেন বাবা! তুমি নামবে?’

‘না নামব কেন? আপনি বসুন। আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। গরমে ঘামাছেন। বসলে একটু বাতাস পাবেন।’

‘না, বাবা, না, তুমি বোসো আমি বেশ আছি।’ প্রসন্নবাবু কাতর কন্ঠে বললেন। কারুর দয়া তিনি চান না। নিজের জোরে বাঁচতে চান।

ছেলেটি শুনল না। জোর করে বসিয়ে দিল। ‘আমার দাঁড়াবার বয়েস। আপনি পিতৃতুল্য। আপনি বসলে আমার শান্তি।’

‘এসব আজকাল কেউ আর মানে না বাবা।’

‘আজ না মানুক একদিন আবার মানতে হবে। এখন সব নেশায় আছে। ঘোর একদিন কাটবেই।’ ছেলেটির কথা শুনে প্রসন্নবাবুর চোখে জল এসে যাবার উপক্রম হল। আজ পৃথিবীর হল কী। সিন্দুকের ডালো খুলে পুরোনো দিনের সব অলঙ্কার বেরিয়ে পড়ছে নাকি! জড়োয়ার কাজ করা সাহেব কালের বেনারসি, টায়রা, বাজুবন্ধ, চন্দনকাঠের জাফরি টানা ময়ূর পাখা। মানুষ মানুষে তা হলে আবার ফিরে ফিরে আসছে?

প্রসন্নবাবু যার পাশে বসলেন, তিনি একজন গোলগাল মধ্যবয়সী মানুষ। তিনি আরও অবাক করে দিলে বললেন, ‘জানালার ধারে বসবেন? আরও বেশি হাওয়া পাবেন।’

প্রসন্নবাবু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘না ভাই, এই বেশ আছি। আপনাকে ধন্যবাদ।’

‘যাবেন কতদূর?’

‘কদমতলা।’

বাস ব্রিজে উঠে পড়ল। গঙ্গার ফুরফুরে বাতাস আসছে। বাসের দুলুনিতে ঢুল ধরছে। একবার বোধ হয় পাশের ভদ্রলোকের ঘাড়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে গালাগালি খাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রইলেন। ভদ্রলোক কিছুই বললেন না। স্নেহমিশ্রিত দৃষ্টিতে শুধু একবার তাকালেন।

কদমতলায় নেমে দু-পা এগোতেই, পেছন থেকে একটা মটোর গাড়ি এসে দাঁড়াল। চালকের আসন থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন বললে, ‘জ্যাঠামশাই, উঠে পড়ুন।’

ছেলেটির নাম মোহর। বড়ো লোকের ছেলে। অসীম প্রভাব-প্রতিপত্তি। যেচে কোনোদিন কথাই বলেনি। এভাবে গাড়ি থামিয়ে লিফট দেওয়া তো দূরের কথা! প্রসন্নবাবু সামনের আসনে ভয়ে ভয়ে উঠে আড়ষ্ট হয়ে বসলেন। জীবনে একবার না দুবার মটোর চেপেছেন। মটোরে চাপারও কায়দা আছে। গুঁড়ি মেরে, শরীরটাকে সামনে ঠেলে, পাশে মোচড় মেরে আসনে ফেলতে হয়, তারপর পা-টিকে টুক করে ভেতরে তুলে নিতে হয়। দরজা বন্ধ করারও কায়দা আছে! প্রসন্নবাবুর মাথা ঠুকে গেল। ছাতি আটকে গেল। অনেকটা হুমড়ি খেয়ে ভেতরে এলেন। লজ্জার ব্যাপার! সারাজীবন বড়োলোক থেকে শতহস্ত দূরে থেকেছেন। আজ একেবারে পাশাপাশি। মোহরের অঙ্গ থেকে বেশ একটা সুবাস বেরোচ্ছে। পাশে পড়ে আছে দামি সিগারেটের প্যাকেট। সোনালী লাইটার। পেছনের আসনে কী একটা শুইয়ে রেখেছে টুংটাং শব্দ হচ্ছে।

রাস্তার দিকে চোখ রেখে গাড়ি চালাতে চালাতে মোহর বললে, ‘দু’-এক দিনের মধ্যে বাবা বোধ হয় আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।’

‘কেন বলো তো?’ প্রসন্নবাবু ভয় পেলেন। বড়োলোক তো অকারণে কিছু করেন না। তাঁদের সময়ের অনেক দাম। পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া কোনো দেনা নেই তো! এত দিনে হয়তো খুঁজে পেয়েছেন।

মোহর বললে, ‘যদ্দূর মনে হয়, বাবা একজন সৎ মানুষ খুঁজছেন। আমরা যে ব্যবসা করি, সেই ধরনের ব্যবসায়ীদের একটা সমিতি আছে। সেই সমিতিতে উনি অ্যাকাউন্টেন্ট হবার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করবেন। অনেক দিন ধরেই ভাবছেন, আপনার জন্যে একটা কিছু করার দরকার। আমাকে দু-তিন দিন বলেছেন। আজ আপনি বাড়ি আছেন?’

‘আমি তো সব সময়েই বাড়িতে। কোথায় আর যাব বাবা!’

‘তা হলে আজই আসবেন, ধরুন আটটা থেকে ন-টার মধ্যে।’

বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে মোহর চলে গেল। প্রসন্নবাবুর মনে হল, শরীরে বেশ বল পাচ্ছেন। যে মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, সে মাটি আর তেমন টলছে না। মোহরের পিতা জহরবাবু সত্যিই যদি একটা চাকরি দেন, তাহলে সেই ইচ্ছেটাকে মনের সুপ্ত কোণ থেকে আর একবার টেনে বের করে আনবেন। ছোট্ট একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই। জীবনে বড়ো বাগানের শখ ছিল। একটুকরো জমি পেলে ফুলের হাসি দেখতেন। দু-পাশে দুটি মন্দির ঝাউ। এক চিলতে পথ। নানা বর্ণের জবা। টগর। মল্লিকা। শীতে প্রজাপতি উড়বে।

বসার ঘরে এক প্রৌঢ় বসে আছেন। সামনে গেলাস। চায়ের কাপ। পেছন থেকে দেখে বুঝতে পারেননি। বেশ সম্পন্ন ব্যক্তি। আঙুলের আঙটিতে আলো খেলছে। সামনে এসে চিনতে পারলেন। শিশিরবাবু। সাঁতরাগাছির সেই শিল্পপতি। এঁরই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ের দুরাশা এখনও নাড়াচাড়া করছেন। বিজ্ঞাপন মারফত যোগাযোগ। মেয়ে পছন্দ হয়েছে। পছন্দ না হয়ে উপায় নেই। প্রসন্ন, তোমার মেয়েভাগ্যটি বড়ো ভালো! একথা সারাজীবন তিনি শুনে এলেন। মেয়েটিকে দেখে নিজেরও তাই মনে হয়। ভুল করে অথবা শখ করে এক রাজকুমারী এই দুঃখের সংসারে এসে পড়েছে।

‘কি সৌভাগ্য! কতক্ষণ এলেন?’ প্রসন্নবাবু হাত জোড় করলেন। মেয়ের পিতার যেমন করা উচিত।

শিশিরবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে বললেন, ‘আরে আসুন আসুন। বেশ কিছুক্ষণ এসেছি। বসুন, বসুন, খুব গুরুতর কথা আছে।’

প্রসন্নবাবু ছাতাটিকে মেঝেতে শুইয়ে রেখে ভয়ে ভয়ে চেয়ারে বসলেন। কী এমন কথা! একটা শুকনো ছোট্ট একটি পাতার কুঁড়ি মুখ তুলেছিল, আজ বোধহয় সেটিও শুকিয়ে গেল। গরিবের দুরাশায় যতই জল ঢাল, কিছুই হবার নয়।

শিশিরবাবু উল্লাসের গলায় বললেন, ‘প্রস্তুত!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ প্রস্তুত।’

‘কী বলুন তো?’

‘আজ্ঞে, হয়ে গেল। যা হবার নয়, তা হবার নয়।’

‘খুব বুঝেছেন যা হোক। বাড়িতে পাঁজি আছে? শুভস্য শীঘ্রং।’

‘পাঁজি? শুভ? কি বলছেন আপনি?’

‘সামনের শ্রাবণেই। শীতের জন্যে আমি আর অপেক্ষা করব না।’

‘তার মানে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি তো।’

‘হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছেন। আমার কোনো দাবি নেই। যা দেবেন। শাঁখা সিঁদুর হলেও আপত্তি নেই। ওই মেয়েই আমার পুত্রবধূ হবে।’

‘ভুল করছেন না তো?’

‘ভুল! কাল রাতে আমি কী স্বপ্ন দেখেছি জানেন। কোজাগরী পূর্ণিমার রাত। আপনার মেয়ে মা লক্ষ্মীর ঝাঁপি নিয়ে আমাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে। কী অপূর্ব তার রূপ! যেখানে তার পা পড়ছে, সেই জায়গাটাই স্বর্ণময় হয়ে যাচ্ছে। ভোর হতেই গুরুদেবের কাছে ছুটলুম। তিনি বললেন, মা আসতে চাইছেন, আর দেরি নয়।’

‘কী বলছেন আপনি?’

‘থেকে থেকে আপনি কী বলছেন, কী বলছেন করবেন না। বেয়ানকে ডাকুন। শাঁখ বাজান, শাঁখ বাজান। আজ বড়ো আনন্দের দিন।’

‘আমি যে বড়ো গরিব!’

‘সেইটাই তো আপনার সবচেয়ে বড়ো ঐশ্বর্য! সেইজন্যেই তো আপনি খাঁটি মানুষ। ধনী হলে আপনার মেয়ে হত আপস্টার্ট, আপনি হতেন দু-নম্বর কারবারি। পাঁজিটা একবার আনান না মশাই।’

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ সব পাকা করে শিশিরবাবু উঠে যেতে না যেতেই জহরবাবু এলেন। ছ-ফুট লম্বা। চোখে গোলড ফ্রেমের চশমা। পরনে ধবধবে ধুতি, পাঞ্জাবি। ধনী মানুষকে প্রসন্নবাবু ভয় পেতেন। তাঁরা সাধারণত অহঙ্কারী হন। বড়ো বড়ো কতা বলেন। পৃথিবীটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন। জহরবাবুকে দেখে তা মনে হল না। বিনীত, নিরহঙ্কার। চেয়ার টেনে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন আছেন?’

‘বয়েসের তুলনায় ভালোই।’

‘ভেরি গুড। রিটায়ার করার পর সাধারণত মানুষ বড়ো ভেঙে পড়ে। ছেলে কিছু বলেছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আপত্তি নেই তো?’

‘আজ্ঞে না।’

‘আপনাকে আমরা মাসে হাজার করে দোবো। তার বেশি আপাতত সম্ভব হবে না।’

‘হাজার!’ প্রসন্নবাবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন।

‘কেন কম হয়ে গেল?’

‘আজ্ঞে না, আমি ভাবতেই পারছি না।’

‘দিন কতক পরে, ধরুন পুজোর সময়, আরও একটু বাড়াতে পারব। কাল থেকে তা হলে লেগে পড়ুন।’

‘বেশ।’

‘গাড়ি এসে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে। গাড়িই আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। এই বয়েসে আর বাসট্রাম ঠ্যাঙাতে হবে না।’

‘আজ্ঞে।’ প্রসন্নবাবুর সব কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। যে পৃথিবীর সঙ্গে এতকালের পরিচয় তার চেহারা তো এরকম নয়! জহরবাবু কাজের মানুষ, ব্যস্ত মানুষ। কথা পাকা করে উঠে চলে গেলেন। প্রসন্নবাবুর মনে হতে লাগল, সংসারের ওপর দিয়ে ফুরফুর করে বসন্তের দখিনা বাতাস বইছে। সাবেক কালের আলমারির মাথায় বসে কোকিল ডাকছে মিহি সুরে। এ সুখ এতকাল ছিল কোথায়!

রাতের আহারে বসেছেন। রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট। সামনে বসে স্ত্রী সুষমা। এক সময় সুন্দরীই ছিলেন। এখন সংসারের আঁচে পিতলের প্রতিমার মতো ঝলসে গেছেন।

মুখে রুটি ঠুসে প্রসন্ন বললেন—

‘সবই তাহলে হল?’

‘ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।’

‘বড়ো দেরিতে, বুঝলে, বড়ো দেরিতে।’

‘তা হোক, কথায় বলে, সব ভালো যার শেষ ভালো।’

‘এখন হাজার দেবে বুঝলে! পুজো নাগাদ আর একটু বাড়বে। এবার থেকে কুমড়োর ঘ্যাঁটে তুমি একটু ছোলা দিও, আর নামাবার সময় এক চামচে ঘি দিয়ে সাঁতলে নিও। বেশ টেস্ট হবে।’

‘তুমি কুমড়োয় ছোলার কথা ভাবছ, আমি ভাবছি খান ছয়েক করে ফুলকো লুচির কথা। হাজারে আমাদের দু-জনের বেশ ভালোই চলে যাবে। রোজ একটু করে দুধ, এক টুকরো মাছ এ বয়েসে দরকার বুঝলে?’

‘আমি আবার একটু অন্যরকম ভাবছি। আর একটু দূর ভবিষ্যতের কথা। পঞ্চাননতলায় সিধুরা সেই বিশাল পুকুরটা বুজিয়ে প্লট প্লট করে বেচছে। পি এফ আর গ্র্যাচুইটির টাকাটা থেকেই যাবে। মেয়েটাকে তো ওঁরা এমনিই নিয়ে চললেন। ওই টাকাটায় ছোটোখাটো একটা একতলা বাড়ির কথা ভাবলে কেমন হয়! আমাদের অবর্তমানে তোমাকে দেখবে কে?’

‘আঃ, তুমি ওসব অলক্ষুণে কথা বোলো না বাপু। কে আগে যাবে, তোমার জানা আছে?’

‘বয়েসে তোমার চেয়ে অন্তত বছর দশেকের বড়ো আমি। গণিতের হিসেবে, চাকরির নিয়মে আমরাই ডাক আসবে আগে। অফিসে ছাঁটাইয়ের সময় বলত, লাস্ট কাম ফার্স্ট সার্ভড আর রিটায়ারের সময় বলত ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভড। যাক ওসব বাজে কথা। এতকাল আমরা যে। খাওয়ায় অভ্যস্ত সেটাকে আর পালটে দরকার নেই। শরীর ওই সুরেই বাঁধা হয়ে গেছে। বরং দেরিতে হলেও ভবিষ্যতের কথা ভাবা যাক। ধরো আমি যদি নব্বই বছর বাঁচি। হ্যাঁগা, একটু গুড় আছে নাকি? শেষ রুটিটা তা হলে!’

‘গুড় নেই গো, একটু চিনি নেবে? বোসো রস করে দিচ্ছি!’

‘না না, চিনির অনেক দাম।’

‘এখনও তুমি দামের কথা ভাবছ। সামনের মাস থেকে তো..’

‘এখনও সবই হাওয়ায় ভাসছে সুষমা, পৃথিবীকে আমি তেমন বিশ্বাস করতে পারি না। বড়ো বেশি নাটক এখানে। কাপে আর ঠোঁটের চুমুকে অনেক ফসকাফসকির ব্যাপার থাকে। দাও, আর এক গেলাস জল দাও। এখন কী আর আমাদের ভোগের বয়স আছে! ত্যাগের বয়েস।’

হাতমুখ ধুয়ে প্রসন্নবাবু চৌকিতে বসে স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমি তা হলে কোমর বেঁধে লেগে পড়ো। শ্রাবণ আর মাত্র দু-মাস। মৌ কোথায়? শুয়ে পড়েছে?’

‘শোবে কী গো? ও তোমার পাঞ্জাবির গলায় তালি মারছে, কাল তো তোমার বেরোনো! এ আর তোমার সেই সরকারি অফিস নয় যে ছেঁড়া ট্যানা পরে যাবে। যাবে গাড়িতে, আসবে গাড়িতে, তুমি বাপু সবার আগে দু-একটা ভালো ধুতি-পাঞ্জাবি করাও।’

‘হ্যাঁ সে তো করাতেই হবে। অনেক দিনের শখ, তোমাকে দু-একটা ভালো শাড়ি পরাই, মেয়েটাকে একটু সাজাই। মেয়ের ভাবনা অবশ্য আমাকে আর ভাবতে হচ্ছে না। জামাই বাবাজি ভাববে। আচ্ছা, আমি তাহলে শুয়ে পড়ি কী বল! আজ একটু বিশ্রাম নিই। অনেক দিন পরে, কাল থেকে আবার বেরোনো। হ্যাঁগা, রোজ দাড়ি কামাতে হবে নাকি?’

‘তা হবে না! মার্চেন্ট অফিসে চকচকে মুখ চাই।’

‘তা হলে, তুমি বাপু আমাকে সকাল সকাল ডেকে দিও। কেমন? সব অভ্যাস প্রায় ভুলে এসেছি।’

ছোটো খাটটিতে প্রসন্নবাবু মশারির একটি পাশ তুলে ঢুকে পড়লেন।

মহুয়া বড়ো হবার পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর শয্যা আলাদা হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম এই একক ব্যবস্থায় বড়ো নি:সঙ্গ বোধ করতেন। এখন সয়ে গেছে। কত কী ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুম এসে যায়। আজ মনে মনে ভাবলেন, বিছানা, বালিশ, মশারি সব কিছুর চেহারা এবার পালটে ফেলবেন। শয্যা মানুষের একটা বিলাস। অনেক বাড়িতে দেখেছেন, বিছানায় কি কায়দা। ছোবড়ার গদি, ফুলো তোশক, বাহারি চাদর, সুন্দর বালিশ। দেখলেই মনে হয় আঃ, বলে শুয়ে পড়ি।

বহুকালের তোশক। জায়গায় জায়গায় তুলো সব গুটিয়ে পাকিয়ে ড্যালা ড্যালা হয়ে গেছে। দাম্পত্য জীবনের কত দুঃখের, কত সুখের স্মৃতি জমে আছে এই রঙ্গভূমির মতো শয্যাভূমিতে। এখানে যৌবনের দিন ঝরে গিয়ে পড়ে আছে পত্রহীন শুষ্ক কঙ্কাল।

বালিশে মাথা রেখে আজ বেশ একটা সুখানুভূতি আসছে। ঘর অন্ধকার বলে আশেপাশের আলো, শব্দ এসে ঢুকছে। বেশ লাগছে! এমন ভালো বহুদিন লাগেনি। প্রসন্ন? নিজেকেই নিজে ডাকালেন। এতদিনে তা হলে একটু সুখের মুখ দেখবে! শুকনো ডালে আবার দু-একটি সবুজ পাতা আসবে! শরীরে আসবে চেকনাই। যা যা ভোগ করা হয়নি, একে একে ভোগ করব। মহুয়া শ্বশুর বাড়ি চলে গেলে, সুষমা আবার পাশে এসে শুতে পারবে!

‘তোমার জল চাপা রইল।’

সুষমা জলের গেলাস রেখে চলে গেল। বাইরে মা আর মেয়ে কথা বলছে। কানে ভেসে ভেসে আসছে। বেশ একটা পূর্ণতার অনুভূতি আসছে। আঃ, চোখের সামনে কত কী দৃশ্য ভেসে আসছে। বেনারসী পরে মহুয়া চলেছে শ্বশুরবাড়ি। হরিদ্বারে গঙ্গার ধারে বসে আছি, আমি আর সুষমা। পঞ্চাননতলার জমিতে বাড়ির ভিত উঠেছে। না:, তোশকটাকে ধুনিয়ে, নরম, সমতল একটা বিছানা তৈরি করাতেই হবে। তুলোধোনা দেখতে বেশ মজা লাগে। টংটং করে টঙ্কারের শব্দ। তুলো উড়ছে ফুরফুর করে। জীবনের দুঃখ আর সুখ টঙ্কারের শব্দে উড়ছে, আবার এসে জমা হচ্ছে একই জায়গায়। পাঁজা পাঁজা তুলো।

বুকের বাঁ-দিকে টং করে একটা শব্দ হল। মাথায় যেন বেজে উঠল স্কুল-ছুটির ঘণ্টা। সব যেন হই হই করে বেরিয়ে আসছে, ছুটি ছুটি। কানের কাছে জাহাজের ভোঁ বাজছে। পাটাতনে নোঙর তোলার শব্দ। ক্ষীণ কন্ঠে ডাকার চেষ্টা করলেন, সুষমা, তুমি কোথায়? এ যে ভীষণ অন্ধকার। তুমি আমার হাতটা ধরো। মহুয়া। ধুনুরির টঙ্কার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দিল। তুলো উড়ছে রাশি রাশি। আর কিছু মনে রইল না।

না থাকারই কথা। প্রসন্নবাবুর ছুটি হয়ে গেল। সুষমা তখনই কিছু জানতে পারল না। কাল যে মানুষটা বেরোবে, তার জন্যে পরিষ্কার ধুতি চাই, পাঞ্জাবি চাই, রুমাল চাই, একটা গেঞ্জি চাই, জুতোর চেহারাটা একটু ভালো না হলে চলে! ন-টার মধ্যে খেতে বসাতে হবে। সময়ে রান্নার অভ্যাস আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। মা আর মেয়েতে যখন টুকি-টাকিতে ব্যস্ত, প্রসন্নবাবু তখন নি:শব্দে চলে গেলেন। হৃদয়হীন হৃদয়ের কারসাজি।

সকালে মানুষটিকে কর্মস্থলে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি এল ঠিকই, তবে এ গাড়ি সে গাড়ি নয়। এ হল ছুটির পর ঘরে ফিরে যাবার গাড়ি। ফুলে ঢাকা প্রসন্ন সিদ্ধান্ত, যেদিকে যাবার কথা সেদিকে না গিয়ে বিপরীত দিকে চলে গেলেন।

পাখিরা চিরকালই কথা বলে। সেকালের মানুষ সে ভাষা বুঝত। একালের মানুষ বোঝে না। বুঝলে, শুনতে পেত, প্রসন্নবাবুর বাড়ির কারনিশে বসে দুটি পাখি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে:

‘লোকটি সুখ নিয়ে চলে গেল, দুঃখ নিয়ে আবার যেন ফিরে না আসে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *