ছুটি
আমাদের ছেলেবেলায় ছুটি মানেই ছিল বেড়াতে যাওয়া।
পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়িতে যেতাম। ভারি আনন্দের ছিল সে—যাওয়া। সব আত্মীয়—স্বজনের সঙ্গেই সেখানে দেখা হয়ে যেত। আর গ্রীষ্মের ছুটিতে যেতাম একসকারশানে। বন্ধু বা সহপাঠীদের সঙ্গে। তা ছাড়া, ছেলেবেলায় আমি ‘বয়েজ স্কাউটস’—এর সদস্য ছিলাম। তাই, অনেক গ্রীষ্মে কত দূর দূর জায়গায় যে ক্যাম্প করতে গেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে পড়ার ব্যাপারে স্কুলের এইসব দীর্ঘ ছুটি ছিল দারুণ ভাল। আমি তো বহুবার বহু জায়গায় গেছি এই ছুটির সময়েই। সেসব জায়গাও যেমন রোমাঞ্চকর, সেসব যাত্রাও তেমনিই গা—শিরশিরে। ছুটিতে ঘুরে—আসা সেসব জায়গার কথা এখনও বেশ মনে আছে।
স্কুল জীবনে আমার শখ ছিল ট্রেনে চেপে কোথাও চলে যাওয়া। যেতে—যেতে আচেনা কোনও স্টেশনে নেমে পড়া। অবশ্য এমন হুট করে বেরিয়ে পড়ার একটা সুযোগও ছিল আমার। আমার এক বন্ধুর বাবা রেলে বড় কাজ করতেন এবং সেই বন্ধুটি আর তার ভাই, দু’জনেই রেলের ‘পাশ’ পেত। আমার, দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে বেরিয়ে পড়ার পয়সা ছিল না। তাই আমি বন্ধুটির ভাই সেজে রেলের পাস নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় কতবার যে চলে গেছি! তারপর কোনও সুন্দর জায়গা দেখলেই হঠাৎ নেমে পড়েছি।
মনে আছে একবার ঘুরতে হায়দরাবাদে চলে গিয়েছিলুম। হায়দরাবাদে নেমে সারাদিন শহরে টোটো কবে ঘুরেছি। সঙ্গে যে হ্যান্ডব্যাগ দুটি ছিল, তা জমা দিয়েছিলুম স্টেশনের ক্লোকরুমে। হায়দরাবাদ ও আশপাশের ঐতিহাসিক স্থানগুলি দেখে স্টেশনে ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। কী আর করি! হোটেলে থাকার তো আর পয়সা নেই। সারারাতই তাই কাটাতে হবে প্ল্যাটফর্মে। ক্লোকরুম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে আমরা আমাদের মালপত্র বার করতে পারিনি। উঃ, কী অসহ্য শীত! অনেক রাত পর্যন্ত বসে আমার ঠক ঠক করে কাঁপছিলুম। আমাদের কাছেই একটি ভিখিরি—পরিপার ছেঁড়া কম্বল গায়ে দিয়ে বেশ আরামে ঘুমোচ্ছে। আমরা শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারিনি, ওই ভিখিরিদের পাশেই শুয়ে পড়েছিলুম। তাদের ওই ছেঁড়া কম্বলের ভাগ নিয়েই সে—রাতে শীতের হাত থেকে নিস্তার পেয়েছিলুম। তারাও অবশ্য আপত্তি করেনি। সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও বেশ মজা লাগে।
আর একবার ছুটিতে কয়েক বন্ধুর সঙ্গে গিয়েছিলুম মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলার জঙ্গলে। আমাদের বাহন ছিল একটা ঝরঝরে জিপগাড়ি। পাহাড় আর জঙ্গলের মধ্যে খুবই ভাঙা একটা রাস্তা, সেখান দিয়ে অনেকদিন কোনও গাড়ি যায়নি বলে মনে হল। দূর—দূর গ্রামের আদিবাসীরা সেই রাস্তা দিয়ে দিনের বেলা হেঁটে—হেঁটে জঙ্গল পার হয়। তারা এক—একদিনে কুড়ি—পঁচিশ মাইল হাঁটে। রাত্তিরে কেউ সেই জঙ্গলে ঢোকে না। আমাদের জিপটা বিকেলের কাছাকাছি সময়ে খারাপ হয়ে গেল। আমাদের ড্রাইভার সেটাকে সারাবার চেষ্টা করে আরও বেশি খারাপ করে দিল। গাড়িটা তারপর আর শব্দই করে না! তখন আমরা জঙ্গলের এমন একটা জায়গায়, যার সামনে এবং পিছনে প্রায় পনেরো—ষোলো মাইলের মধ্যে কোনও জনবসতি নেই। সুতরাং ফিরতে গেলে হেঁটেই ফিরতে হবে। সেই পাহাড়—ডিঙোনো রাস্তায় মাত্র তিন মাইল হাঁটতেই আমাদের দেড় ঘণ্টা লেগে গেল। তখন বুঝতে পারলুম, আট—ন’ঘণ্টা না—হাঁটলে আমাদের কোনও নিরাপদ জাগায় পৌঁছবার আর আশা নেই। আর একটানা আট—ন’ঘণ্টা হাঁটার ক্ষমতাও আমাদের নেই। সুতরাং নেই জঙ্গলের মধ্যেই রাত কাটাতে হবে। আমরা চার বন্ধু এক জায়গায় গোল হয়ে বসলুম। একজন পথ—চলতি আদিবাসীকে খানিক আগে জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘এই জঙ্গলে কি বাঘ আছে?’ তাতে সে খুব অবাক হয়ে পালটা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘জঙ্গলে বাঘ না থাকলে কি শহরে থাকবে?’
জঙ্গলের রাত যে কত ভয়াবহ হয়, তা সেইদিনই প্রথম টের পেয়েছিলুম। চতুর্দিক থেকে অন্ধকার যেন আমাদের চেপে ধরবার চেষ্টা করছিল। আর মনে হচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে হিংস্র অনেক চোখ আমাদের লক্ষ করছে। যে—কোনও সময় তারা আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়বে। সামান্য একটা পাতা খসে পড়ার আওয়াজেও আমরা চমকে চমকে উঠছিলুম। বন্দুক, পিস্তল তো দূরের কথা, আমাদের কাছে সামান্য একটা ছুরিও ছিল না। তবে আশ্চর্যের কথা, সেই জঙ্গলে আমাদের শেষ পর্যন্ত রাত কাটাতে হয়নি। একজন পথচলতি আদিবাসীর মুখে খবর পেয়ে রায়পুরের পুলিশ—সাহেব তাঁর জিপগাড়ি নিয়ে মাঝরাত্তিরে আমাদের উদ্ধার করতে এসেছিলেন। তিনি আমাদের বকুনি দিয়েছিলেন খুব। কিন্তু তখন সেই বকুনিও খুব মিষ্টি শুনিয়েছিল।
একবার তো রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলুম সুন্দরবনে। রাস্তা হারানো না বলে ‘নদী হারানো’ বলা যায়। বড়—বড শহরে যেমন অনেক রাস্তা থাকে, সুন্দরবনে সে রকম অসংখ্য বড়—বড় নদী। আমরা একটা নৌকো নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলুম।
সুন্দরবনে জঙ্গলে নামা যায় না, বাঘের ভয়, কিন্তু নদী দিয়ে ঘুরলে অসংখ্য পাখি দেখা যায়। কখনও—কখনও দু’—একটা কুমিরও চোখে পড়ে। নৌকোর মাঝির ওপর পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমরা গান গাইছিলুম ও আড্ডা দিচ্ছিলুম। বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হবার মুখে হঠাৎ আমাদের খেয়াল হল, এখন তো ফিরে যাওয়া উচিত! সে—কথা মাঝিদের বলতেই তারা কাঁচুমাচু মুখে মাথা চুলকোতে লাগল। তারা নদীর রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছে। দু’পাশের জঙ্গল একই রকম দেখতে। নদীগুলিও চওড়া এবং মাঝে—মাঝেই বাঁক ঘুরে গেছে। কোনও নদীকেই আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই। তবে সন্ধের পর আমরা বুঝতে পারলুম, আমরা বোধহয় গোলাকধাঁধাব মতন একই জায়গায় ঘুরছি। ভাবলুম, মাঝিরা স্থানীয় লোক, তারা নিশ্চয়ই শেষ পর্যন্ত ঠিক পথটা খুঁজে বার করতে পারবে। আমরা আবার গানে—গল্পে মন দিলুম। ক্রমে রাত বাড়ল,একটা বেশ চমৎকার চাঁদ উঠল আকাশে। এরকম জ্যোৎস্নার মধ্যে কোনওরকম ভয়ের কথা মনে আসে না। তবে সুন্দরবনের বাঘ জঙ্গল থেকে লাফিয়ে কিংবা সাঁতরে এসে নৌকোয় মানুষ ধরে—এরকম শুনেছিলুম বলে আমাদের নৌকো সব সময় নদীর মাঝখানে রাখতে বলেছিলুম। নৌকো চলতেই লাগল এবং রাত বাড়তেই লাগল। আমাদের সঙ্গে কিছু খাবার—দাবার ছিল, তাই খিদের জ্বালা অনুভব করিনি। এক সময় দেখি ঘড়িতে রাত দেড়টা বাজে। একজন মাঝি মুখ ঢাকা দিয়ে বসে আছে, আর অন্যজন তখন জল থেকে বৈঠা তুলে ফেলেছে। তখন আমাদের মনে হল, সারারাত বোধহয় আমাদের নদীতেই কাটাতে হবে। হঠাৎ আমাদের একজন চে�চিয়ে বলে উঠল, ‘ওই যে দূরে আলো দেখা যাচ্ছে। আমার সকলেই তাকিয়ে দেখি, সত্যি, জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় বেশ উঁচুতে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। আলো মানেই আশা—ভরসা। তাড়াতাড়ি নৌকো চালানো হল সেই দিকে। গিয়ে দেখি, সেটা একটা ফরেস্ট চেক—পোস্ট। বনবিভাগের তিনজন কর্মচারী সেখানে থাকে। আমাদের হাঁকডাক শুনে তারা বাইরে এসে আমাদের দেখে ঠিক ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। সুন্দরবনের নদীতে রাত দেড়টার সময় এরকম জ্যান্ত লোকদের ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা নাকি বিশ্বাসই করা যায় না। আমরা ভয় পাচ্ছিলুম বাঘের, আসলে নাকি ওই নদী—অঞ্চলে ভীষণ ডাকাতের উপদ্রব। বাঘের থেকেও ওইসব ডাকাত আরও বেশি হিংস্র। ডাকাতেরা সন্ধের পর এরকম নৌকো দেখলে যাত্রীদের টাকা—পয়সা তো বটেই, এমন কী জামা—কাপড় পর্যন্ত খুলে নেয়। এবং নৌকোটা কেড়ে নিয়ে যাত্রীদের জঙ্গলে নামিয়ে দেয় তারপর তারা বাঘের পেটে যাবে কি না, সেটা তাদের ভাগ্য।
আমাদের যে এরকম কিছুই ঘটেনি, তার কারণ আমরা এই বিপদটার কথা জানতুমই না। ডাকাতরা বোধহয় ভাবতে পারেনি যে, রাত দেড়টার সময় কেউ ওইরকম নদীপথে গান গেয়ে গেয়ে ঘুরতে পারে! আমাদের গান শুনতে পেলেও তারা হয়তো ভেবেছিল অলৌকিক কোনও ব্যাপার।
যাই হোক, সে যাত্রার বনবিভাগের কর্মীদের আতিথ্যেই আমাদের আর ডাকাতের হাতে বা বাঘের পেটে যাত্রাভঙ্গ হয়নি।
সত্যি কথা বলতে কী, ছুটি পেতে তো সব সময়ই ভাল লাগে। বলতে গেলে, আমি সারা বছরই থাকতুম এই ছুটির অপেক্ষায়। গ্রীষ্মের ছুটি মানে, বেশ দীর্ঘ সময়। ছুটির আগে স্কুলের শেষ দিনটিতে মনটা পাখির মত হালকা হয়ে যেত।
বয়স্ক যেসব ব্যক্তির ছুটির মানে পালটে যায়, আমি তাঁদের দলে পড়ি না। এখনও আমার ‘ছুটি’ আগের মতোই ভাল লাগে। কী জানি, হয়তো আমি এখনও ততটা বড় হইনি। আমার কাছে চিরকালই ছুটির মানে হল, ইচ্ছে মতন সময় কাটানোর স্বাধীনতা।
ছেলেবেলায় ছুটির সময়ট আমার অনেকা কাজে লেগে গেছে। এই ছুটির সময়েই আমি সাইকেল—চড়া শিখেছি, সাঁতার শিখেছি, নৌকো চালানো শিখেছি। যেসব জায়গায় আমি আগে কখনও যাইনি, ছুটির সময়েই সেসব জায়গায় যাবার চেষ্টা করেছি।
তবে, কাজে ফাঁকি দিয়ে ছুটি পাবার আনন্দটা আরও অনেক বেশি বলে আমার মনে হয়। অবশ্য যদি না সেটা নিজের কাছেও ফাঁকি দেওয়া হয়। আর, ছুটির সময়, যা নিয়মে আসে, তা ভোগ করার আনন্দ তো আছেই।
আমার কিন্তু ছোটবেলার চেয়ে এখনই ছুটি পেতে বেশি ভাল লাগে। এখন অন্যরা ছুটি দিলেও অনেক সময়, নিজের কাজ থেকে ছুটি নিতে পারি না। তাই, এক—এক সময় সব ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
ছেলেবেলায় ছুটির সময় সবচেয়ে খারাপ লাগত পড়াশোনা। এদিক—ওদিক বেরিয়ে পড়ায় পড়াশোনাটা বেশ এড়িয়ে যাওয়া যেত। আমি অন্য সময়েই পড়াশোনা করতাম না তো, ছুটিতে পড়ব কী?