চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

ছুটির সকাল

ছুটির সকাল

ছুটির সকাল ভারী মজার। ভারী আনন্দের। আমার মনে হয় আজ আমি চব্বিশ ঘণ্টার মালিক। খুব সকালে ওঠা আমার অভ্যাস। তাড়াতাড়ি উঠে যতটা বেশি সময় নির্জনতা উপভোগ করা যায়, ঠিক ততখানিই আমি লাভবান। ছুটির সকালে বাড়ির মানুষরা একটু বেশি সময় শুয়ে থাকতে চায়। আমি তাতে সহযোগিতা করি। এটাও তো একটা দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে যায়। ছুটির সকালে আমি প্রথম কাছে পেতে চাই নিজেকে। তারপর চাই লেখাকে। তৃতীয় চাওয়া হল পড়া। এই তিনটি যদি পেয়ে যাই, তাহলে আমি খুব খুশি হই। কোনও কারণে যদি ব্যতিক্রম ঘটে যায়, তাহলে সমস্ত দিনটাই আমার কাছে হয়ে যায় মৃতবৎ। খুব সকালে উঠে আমি চলে আসি ছাদে। প্রকৃতিকে অত্যন্ত ভালোবাসি। আমার বন্ধু-বান্ধবের প্রয়োজন হয় না, নিজের কল্পনায় সৃষ্টি করি অজস্র চরিত্র। এমনও ঘটে যায়, মৃত কোনও মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলেও আমি সেই আশা পূরণ করি। কিংবা কথামৃতের একটা পৃষ্ঠা খুললেই আমি চলে যাই দক্ষিণেশ্বরে। শ্রীরামকৃষ্ণকে ঘিরে গোল হয়ে বসে-থাকা ভক্তবৃন্দদের দেখতে পাই। খুব সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাই। কী সুন্দর রংবদল হয়। কখনও নীল, কখনও ধূসর, কখনও-বা সাদা। কত পাখি উড়ে যায়। কী সুন্দর গান গায় তারা। সেই গান শুনতে শুনতে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। আস্তে-আস্তে সূর্য ওঠে। পুবের কোলটা চমৎকার লাল হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনটাও উজ্জীবিত হতে থাকে। চিলেকোঠার ঠিক পাশটায় যেখানে সন্ধ্যামালতী গাছটা ঝুঁকে থাকে। এক চিলতে ঘাস উঁকি মারে, সেখানে এক টুকরো নরম রোদ আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে আসে কিছু পরিচিত কাক। আমি তাদের কাছে ডেকে খেতে দিই। খেতে দিয়ে আবার খাওয়া দেখি। টবে লাগানো গাছ দেখি, ফুটে-থাকা ফুল দেখি, তাদের পরিচর্যা করি। এই সময়টা সব চেয়ে ভালো লাগে নির্জন থাকে বলে। আমি নির্জনতাপ্রিয় কিনা। সকালটা থাকে শান্ত। কোনও চেঁচামেছি থাকে না। শব্দ থাকে না। কেবল কলের জল পড়ার একটু যা শব্দ। তবে এই শব্দে একটা সুর থাকে। অদ্ভুত নির্জনতার সঙ্গে এই সুর মিশে সৃষ্টি হয় সুন্দর আমেজ। আমি প্রথম কাছে পেয়ে যাই নিজেকে। নিজের মধ্যে প্রকৃতির আলো ঢুকিয়ে নিয়ে হয়ে যেতে পারি তন্ময় শিল্পী। ছোট থেকেই আমি প্রকৃতি-প্রেমিক। তাই তো প্রকৃতিকে নিয়েই আমার নাড়াচাড়া। ভাবনা। বেঁচে থাকা। সৃষ্টির নেশায় মাতোয়ারা হয়ে পড়া। প্রকৃতিই আমার বন্ধু। প্রকৃতিই আমার একমাত্র সঙ্গী। এই নি:স্বার্থ নিরভিমান সঙ্গীর জন্য আমি গর্বিত। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে অনেকটা সময় নির্জনতার মধ্যে কাটানো একমাত্র ছুটির সকালেই সম্ভব। তাই তো ছুটি আমার কাছে চরম কাঙ্ক্ষিত। এমন বন্ধুকে দীর্ঘ সময় কাছে পাওয়া, এ তো সামান্য ব্যাপার নয়! এক সময় বাড়ির মানুষজন জেগে ওঠে। ক্রমশ নির্জন পরিবেশের পরিসমাপ্তি ঘটে। বাজার করা আমার প্রিয়। ঠিক আটটা বাজলেই আমায় বাজার টানে। সেখানেও অপেক্ষা করে থাকে আলাদা একটা জগৎ। পরিচিত কত মানুষের মুখের মেলা। কত কথা।

এই যেমন, লঞ্চ সার্ভিস পুনরায় চালু হল কিনা, টেলিভিশনে অমুক সিরিয়ালটা দেখছেন কিনা, বাজারের আগুন দর নিয়ে সে কতই-না কথার মালা। এ দোকান সে দোকান ঢুঁ মেরে অত:পর বাড়ি ফিরে আসা। এরপর খাওয়ার পালা। আমাদের যৌথ পরিবার যখন ছিল তখন সকালের খাবারদাবার তৈরি হত বাড়িতেই। এই চপ বেগুনি পেঁয়াজি ইত্যাদি। মুড়ি সহযোগে এই খাওয়াটারই রেওয়াজ ছিল, আমি দেখেছি। এখন আর ততটা নেই, আবার উচ্ছেদও ঘটে যায়নি। খাওয়া নিয়ে এখন বেশি সময় অপচয় করতে কেউই আর ঠিক তেমন রাজি নন। ছুটির সকালে ঘড়ির সময় বড় কথা নয়, কেন-না, ওই যে বলছি, চব্বিশ ঘণ্টার মালিক। কিন্তু সূর্য ওপরে ওঠাটা একটা ব্যাপার বটে। বেলা বাড়লেই সূর্য হেলে পড়ে। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ি বইপত্র নিয়ে কেবল লেখাপড়ার কাজই নয়, ছুটির দিনে প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলা। বইয়ের র‌্যাকসহ একটা একটা করে বই সুন্দর করে পরিস্কার করি। ছুটির সকাল নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অবশ্যই একটা থাকে। সারা সপ্তাহের বিভিন্ন কাজ অসমাপ্ত থাকে। বিশেষত লেখা বিষয়ক। হয়তো কোনও কিস্তির লেখা আটকে আছে, হয়তো রেকর্ডিং-এর কাজটা বাকি আছে, কিংবা সদ্য-শুরু-করা কোনও লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ। পূর্ব পরিকল্পনা মতো যদি কাজ ঠিকঠিক করে উঠতে পারি তো মঙ্গল, মনে খুব আনন্দ পাই, খুশি হতে পারি, হয়ে উঠতে পারি একজন সুখী মানুষ, কিন্তু যদি কোনও কারণে তা না হয়, তাহলে খুব কষ্ট পাই। মনে হয় চব্বিশ ঘণ্টার মালিক হয়েও ফকির হয়ে গেলাম। একটা গোটা দিনের অপমৃত্যু ঘটে গেল। সে যে কী বেদনা! কী ভীষণ একটা কষ্টে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া! ছুটির সকাল যদি রবিবার হয়, তাহলে একটু ব্যতিক্রম ঘটে। এই দিনটায় আমি আধ্যাত্মিক বইপত্র পড়তে ভালোবাসি নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। আর একটু আশ্রমে যাই। এই যাওয়াটা আমার ছকে বাঁধা ব্যাপার। এর ব্যতিক্রম সাধারণত ঘটে না। একটা কথা, ছুটির সকাল, সেটা যদি হয় শীতের ছুটির সকাল, তাহলে আমার খুব ভালো লাগে। শীতের সকালটাই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। তার কারণ, আমি একটু রোদ-প্রিয়। শীতের সকালে নিয়মিত পাওয়া যায়। গাছের পাতায় যখন রোদ পড়ে, রোদ গায়ে মেখে পাখিরা যখন উড়ে যায়, আকাশ যখন গাঢ়, নীল হয়ে ওঠে, রোদে পিঠ রেখে আমার মনে হয় এটাই একটা সুন্দর কবিতা। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, শীতের সকালটাকে অক্লেশে বেলা দুটো পর্যন্ত বাড়িয়ে নেওয়া যায়। নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সকালকে টেনে বাড়ানো তা একমাত্র শীতেই সম্ভব, তাই আমি শীতের সকালকে আমার গাঁথা প্রিয় মালাটা পরাতে পেরেছি। পক্ষান্তরে বর্ষার সকালকে দেখে আমার বড় ভয় হয়। বর্ষার সকাল মানেই সব কিছু স্তব্ধ অচল করে দেওয়ার অঘোম অস্ত্র। আমি তো ধনবান মানুষ নই, যে, বসে-বসে আয়াসে সময় কাটালে জীবন চলে যাবে গড়গড় করে। আমি একটা জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং খাটতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, তা না হলে অচল হয়ে যাবে জীবন। তাই তো জীবনের গতি, জীবনের সুখ, জীবনের শান্তি, ও স্বাভাবিকতা বজায় রাখার জন্য বর্ষার সকাল আমার কাছে মোটেই অভিপ্রেত নয়। সব কথার আসল কথা হল, শৈশবকে ফিরে পাওয়া। আমি ছুটির সকালে প্রকৃতির গায়ে হাত রেখে ধীরে ধীরে-শৈশবে পৌঁছে যাই। আমাদের পুরোনো বাড়ির ছাদে এককোণে ছিল চিলেকোঠা। সেই চিলেকোঠার ঠিক পাশটায় একটা মাদুর পেতে পড়তে বসতাম। পড়তাম—পড়তাম—অন্যমনস্ক হয়ে যেতাম। প্রায়ই আমি প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে দিতাম। ছাদের আলসেতে গজিয়ে-ওঠা এক টুকরো ঘাসের দিকে তাকিয়ে আমি সেই অল্প বয়েসেই হারিয়ে যেতাম। চোখের সামনে দিয়ে একটা রঙিন পাখি যখন উড়ে যেত, আহা কোথা থেকে একটা ফড়িং হঠাৎ উড়ে এসে যখন চোখের সামনে একটু নাচ দেখিয়ে যেত, আমি উন্মনা হয়ে সেই শৈশবেই ভাবতাম, প্রকৃতির কী অদ্ভুত লীলা। খুব মজা পেতাম, যখন দেখতাম একটা বেড়াল আধবোজা চোখে চুপচাপ বসে আছে কার্নিসের একপাশে। কেন না বেড়ালরাও জানি অত্যন্ত নির্জনতাপ্রিয়, ঠিক আমার মতন। তবে ছেলেবেলার ছুটির সকাল ছিল পড়া থেকে খেলায় ফেরা। যেমন, ঘুড়ি ওড়ানো, ডাংগুলি খেলা। ঘুড়ি ওড়ানো ছিল আমার সব চেয়ে প্রিয়। বাবার কাছে কত ধমকই না খেয়েছি। ভুল হয়ে যাচ্ছে, প্রিয় খেলার মধ্যে ছিল লাট্টু খেলা। লাল-নীল রঙের লাট্টুগুলোকে মনে হত আমার প্রাণ, আমার জীবন। কিন্তু সেই লাট্টুর ওপর যখন শাসন নেমে আসত, সেগুলিকে ভেঙে দেওয়া হত, তখন ভীষণ কষ্ট হত। মনে হত, আমিই যেন ভেঙে গেছি। আর সোজা হয়ে কোনও সময় ঘুরতে পারব না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ভেঙে পড়ার মুহূর্তে আবার জেগে উঠতাম। আমার ছিল অনেক ইনফরমার। তারা এসে শুধু খবর দিয়ে যেত, গঙ্গায় জোয়ার এসেছে। আমি তখন নতুন উদ্যমে ফেটে পড়তাম। কী সকাল, কী দুপুর, কী বিকেল, গঙ্গায় জোয়ার এসেছে এই সংবাদে আমি নেচে উঠতাম। শুধু খুঁজে বেড়াতাম একটু ফাঁক। একটু ফাঁক পেলেই আমি হাফ প্যান্টের ওপর কোনও রকমে একটা গামছা জড়িয়ে ছুটতাম গঙ্গার দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়তাম জলে। বেপরোয়াভাবে সাঁতরে বেড়াতাম। এ-ঘাট, ও-ঘাট, সে-ঘাট। এখন বড় হয়েছি। বড় মানে বৃদ্ধ, (যদিও কেউ বৃদ্ধ বলে না) তাই এখনকার ছুটি এক কাজ থেকে অন্য কাজে ফেরা। ছুটির সকালে কাজের চরিত্রটা বদল হয় শুধু, আর কিছু নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *