1 of 2

ছুঁচো

ছুঁচো

ওদিকে কাজ ছিল না। কিন্তু ট্রামটা যে পার্ক সার্কাস ট্রাম-ডিপোর দিকেই বাঁ-দিকে ঘুরে যাবে, বালিগঞ্জ স্টেশান অবধি যাবে না, তা জানা না-থাকায় সুজনকে বাধ্য হয়েই নেমে পড়তে হল পার্কসার্কাস ময়দানের কাছে।

ও লম্বা বলে মিনিবাসে চড়তেই পারে না। এমনি বাসেও চড়তে ভালো লাগে না। কেন, তা ব্যাখ্যা করে বলতে পারবে না। পকেটে যেদিন রেস্ত থাকে সেদিন ট্যাক্সি চড়ে। যেদিন থাকে না, সেদিন হয় ট্রাম। নয় হণ্টন।

নেমে পড়ে, ঠিক করল বালিগঞ্জের ট্রামের জন্যে ‘হাঁ’ করে স্টপেজে দাঁড়িয়ে না থেকে, পায়ে হেঁটে এগিয়েই যাবে গড়িয়াহাটের দিকে।

যাঁরা ট্রাম কি বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকেন পনেরো মিনিট আধঘণ্টা এমনকী একঘণ্টাও তাঁদের মধ্যে অনেককেই এক আশ্চর্য মানসিকতার মানুষ বলে মনে হয় সুজনের। স্ববেগে, সম্ভবত তাঁরা কোথাওই যেতে চান না। কী শহরে, কী জীবনে, গন্তব্য বলতে কিছুই থাকে না তাঁদের। অন্যের ইচ্ছাতেই, নির্দেশেই নড়া-চড়া করেন সম্ভবত তাঁরা। মালিকের ইচ্ছাতে অফিস যান, স্ত্রীর ইচ্ছাতে বাজারে, প্রেমিকার ইচ্ছাতে নাটক দেখতে। যদি স্বেচ্ছাতেই যেতেন কোথাও তবে যানবাহনের অপেক্ষাতে অনির্দিষ্টকাল দাঁড়িয়ে না থেকে পায়ে হেঁটেই গন্তব্যের দিকে অন্তত কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।

একবার ভাবল ও পরি আর সৌম্যদের বাড়িতে যায়। চেহারাই ভুলে গেছে প্রায়। এই অঞ্চলেই পাম অ্যাভিনিউ না কোথায় যেন নতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে ওরা মানিকতলা ছেড়ে। মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নাকি ওদের পাড়াতেই থাকেন। মিনিস্টারের পাড়াতে থাকে, সে-জন্যেই হয়তো শ্লাঘা বোধ করে এক ধরনের ওরা। মিনিস্টারের কলমের একখোঁচায় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাধের চাকরিটি যেকোনো মুহূর্তেই সৌম্যর যেতে পারে, এ সম্বন্ধে পরি কোনো খোঁজই রাখে না। রাখা উচিত ছিল। কারণ বুদ্ধদেববাবু সৎ এবং সৌম্য আপাদমস্তক অসৎ।

পথের ডান দিকের ফুটপাথে একটি সুন্দর ও সম্ভ্রান্ত চেহারার বাড়ির সামনে অনেক স্ত্রী-পুরুষকে জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সুজন। বাড়ির ভেতরের বাগানের সামনে এবং গাড়ি-বারান্দার নীচেও অনেক মানুষ। কিন্তু কারো মুখেই কোনো কথা নেই। সকলেই নিস্তব্ধ। মুখ গম্ভীর। থমথমে। ফিসফিস করে কথা বলছেন যখন কেউ বলছেন আদৌ।

সুজন ভাবল, নিশ্চয়ই কোনো নামি, বিখ্যাত এবং যশস্বী মানুষ দেহ রেখেছেন। কোনো কোনো লেখক, শিল্পী এবং গায়ক সিম্পলি ‘মারা যাবেন’ কারা ‘প্রয়াণ’ করবেন এবং অন্য কারা ‘মহাপ্রয়াণ’ তা ঠিক করার জন্যে গণতান্ত্রিক লেখক ও শিল্পী সংঘের কর্তা, হাঁটা-চলা-হাব-ভাবে জ্যোতিবাবুকে নকল-করা ইন্দ্রনাথবাবুর উচিত অবিলম্বে একটি mandate দেওয়া, যাতে কখনোই ভবিষ্যতে মৃত্যুতে, প্রয়াণে আর মহাপ্রয়াণে সুজনদের মতো সাধারণদের বা জনগণের মনে কোনো বিভ্রম না ঘটে। mandate-এর সঙ্গে একটি Schedule-ও থাকবে। তাতেই ‘মৃত্যু’, ‘প্রয়াণ’ এবং ‘মহাপ্রয়াণ’-এর Entitlements-ও দেওয়া থাকবে। মাঝে মাঝে ইন্দ্রনাথবাবু সেই তালিকা আপডেটও করবেন। তবে ‘প্রয়াণ’ অথবা ‘মহাপ্রয়াণ’ করতে হলে ‘মৃত্যু’-কে অবশ্যই ‘গণতান্ত্রিক’ হতে হবে।

যদিও আজকাল সম্ভ্রান্ত দর্শন অ্যানিমেট অথবা ইনঅ্যানিমেট কোনো প্রাণী বা বস্তুকেই প্রকৃত সম্ভ্রান্ত বলে মেনে নেওয়ার মতন ভুল আর দুটি হয় না তবু এত মানুষ যখন কারো মৃত্যুতে জমায়েত হন, তখন ধরেই নিতে হয় যে, তিনি বড়োমানুষ। অথবা, নিদেনপক্ষে বড়োলোক। অথবা, জনগণের নেতা। জনগণ তাঁকে নেতা বলে মানুন আর নাই মানুন।

সুজন ভাবছিল।

একবার ভাবল, ওই সমবেত জনমন্ডলীকে জিজ্ঞেস করে যে, কে গেলেন! এটি কি নিছক সাধারণ একটি ‘মৃত্যু’? না ‘প্রয়াণ’? না কোনো ‘মহাপ্রয়াণ’-ই?

এমন সময়ে গাড়ি-বারান্দার নীচে, সুজনের মনে হল সৌম্যর স্ত্রী পরিকেই দেখতে পেল যেন। সৌম্যর অফিশিয়াল স্ত্রীকে। ‘অফিশিয়াল’ বলছে এইজন্যে যে, সল্টলেক-এও সৌম্যর একটি ফ্ল্যাট আছে। যেখানে খবরের কাগজের ভাষায় যাকে ‘মধুচক্র’ বলে তা নিয়মিত বসে। একটি কম সার্কুলেশনের কাগজে, সৌম্যর নাম না করে, সৌম্যর দফতরের মন্ত্রীর যে সে অত্যন্তই প্রিয়ভাজন, এই কথা উল্লেখ করেই সেই মধুচক্রের খবরটি কিছুদিন আগেই ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল। দেখেছিল, সুজন।

বেরিয়েছিল তো বেরিয়েছিল! কলকাতার খবরের কাগজগুলোর বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এই যে, সেদিনের মতন পাতা ভরে গেলে, বিজ্ঞাপন এসে গেলেই, তারা তাঁদের গণতন্ত্রের মহান প্রহরীর কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হয়ে গেছে বলে মনে করেন। নিউজ-প্রিন্ট ব্ল্যাকে বিক্রি করা, কাগজের বা অন্যান্য জিনিসের সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে কাট-মানি নেওয়া, কোনো অধমকে অতিউত্তম অথবা মধ্যম করা, আবার কোনো উত্তমকে অধম, এসবই গণতন্ত্রের মহান প্রহরীদের এখন প্রধান কাজ। কোনো খবরের গভীরে যাওয়া বা কোনো অন্যায়ের প্রকৃত প্রতিকার করা তাঁদের কর্তব্যের মধ্যে আদৌ পড়ে না। খবরের কাগজও ভেলিগুড় অথবা সরষের খোল-এর ব্যাবসার মতনই একটা ব্যাবসা। অর্থোপার্জনই যে ব্যাবসার মূল অনুপ্রেরণা। তবে ব্যতিক্রম কি নেই? আছে। কথায়ই বলে ‘Exception proves the rule.’

রগরগে খবরটি মাত্র একদিন প্রকাশিত হয়েই বিদ্যুৎ-চমকের মতনই মিলিয়ে গিয়েছিল। মানে সৌম্যর খবর।

তার পর ভাবল সৌম্যর জ্যাঠতুতো শ্বশুর, যাঁর দৌলতে সৌম্যর প্রতিপত্তি বেড়েছে, সেই তালেবর মিডিয়া-মালিকই কি মারা গেলেন?

যিনি কর্পোরেশানকে পয়সা দিয়ে তাঁর বাড়ির রাস্তার নাম ‘হাকিম গুগুলু বাই লেন’ বদলে ‘বঙ্কুবাবু স্ট্রিট’ করে নিয়েছেন?

নাকি কারোকে কি জিজ্ঞেসই করবে ও যে, ওই বাড়িটি কার?

এমন সময়ে ভিড়ের মধ্যে থেকে সৌম্যই সুজনকে দেখতে পেয়ে ভিড় কাটিয়ে এগিয়ে এল।

বাইরে অনেকই গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। যেগুলো সোফার-ড্রিভন সেগুলোর ড্রাইভারেরাও চুপচাপ। দরজা যদিও খুলছে বা বন্ধ করছে তাও খুবই আস্তে। মালিকদের দেখাদেখি তাদের প্রত্যেকের মুখগুলোও থমথমে। চমৎকার চাকর। বুঝল সুজন। এদের উন্নতি না-হয়েই যায় না!

সুজন একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সৌম্যর আসার অপেক্ষা করতে লাগল।

সৌম্য কাছে এলে, চোখের ইশারাতে জিজ্ঞেস করল, কে?

কে মানে?

কে মারা গেলেন?

মারা গেলেন! কী ইয়ার্কি করছিস সুজন?

আজ কেনেডির বাংলা পরীক্ষা। গতকাল থেকে আই সি এস ই পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। কোনো খোঁজই কি রাখিস না?

এমন করে কথাটা বলল সৌম্য, যেন কাল থেকে ট্রামের ভাড়া একেবারেই উঠে গেছে অথবা বাজারের সব মাছের দরের ঊর্ধ্বসীমা দশ টাকা কেজি ধার্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের জনগণের সরকার। কাল একবিঘত ট্যাংরা মাছ দর করতে গিয়ে সর্পদ্রংষ্ট হয়েছিল। এক-শো কুড়ি টাকা কেজি। এরই কাছাকাছি টাকাতে একটি ‘মাধুকরী’ বা ‘পার্থিব’ বা ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ কিনতে পারা যায়, যা, সারাজীবনের সঙ্গী হতে পারে।

ইণ্ডিয়ান স্কুল-লিভিং সার্টিফিকেটের পরীক্ষা শুরু হওয়ার জন্যে যতটা নয়, তার চেয়েও অনেক বেশি স্তম্ভিত হল মাও বাবাদের পরীক্ষার্থীদের ওই পরীক্ষাকে এমন অভাবনীয় প্রাধান্য ও ইম্পর্ট্যান্স দেওয়ায়।

সুজনের মনে পড়ল যে, ওর স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল বেলগাছিয়ার স্কুলে। ওদের যৌথ পরিবারের আবাস টালার বাড়িতে পুঁটিপিসির (বাবার পিসতুতো বোন) বিয়ে ছিল পরদিনই। ‘বিয়ে-বাড়ি’ বলে ব্যাপার। অত সকালে রান্না পর্যন্ত হয়নি। মানদার মাকে হাতে-পায়ে ধরে, খাওয়ার ঘরের মেঝেতে বসে, ডাল-ভাত আর কুমড়ো-পুঁইশাকের লাবড়া দিয়ে কোনোক্রমে খেয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে গিয়ে বাস ধরেছিল পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে।

পড়াশুনোতে সুজন মারাত্মক কিছু ভালো ছিল না। পড়াশুনোতে ভালো হওয়ার বা মেধাবী হওয়ার পরিবেশ বা দৃষ্টান্তও ছিল না কোনো তার পরিবারে। কিন্তু তাতে তো তার জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়নি!

কেনেডি যে কে, তা প্রথমে বুঝতেই পারেনি সুজন।

পরে মনে পড়েছিল যে, চোয়াড়ে চেহারার, চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলা, চালিয়াত, রোগা, নতুন মডেলের সব মোটরগাড়ির এবং মিউজিক সিস্টেমস-এর বিভিন্নতা নিয়ে আলোচনা-করা সৌম্য ও পরির ছেলে কেনেডিকে শেষ দেখেছিল ও বছর চারেক আগে খাঁদুমামার ছোটোমেয়ে মিনুর বিয়েতে। ওর আদৌ ভালো লাগেনি সৌম্য আর পরির একমাত্র সন্তানকে। একেবারে এঁচড়ে-পাকা। ভাব দেখে মনে হয়েছিল, ও সুজনদের টালার বাড়ির যৌথ পরিবারের সৌম্যর ছেলে নয়, জে আর ডি টাটা বা জন কেনেডিরই ছেলে।

সৌম্য হয়তো জানে না যে, ‘টাটা’ পরিবারের ছেলেদেরও প্রথম জীবন আরম্ভ করতে হয় শ্রমিক হিসেবেই। সাইকেলে করে প্ল্যান্ট-এ যেতে হয়। তাদের মা-বাবা আই সি এস ইপরীক্ষার সময়ে ছেলে পরীক্ষাতে বসছে বলে ঘুসের টাকাতে কেনা মারুতি গাড়িতে ঠাণ্ডা-চিকেন-স্যাণ্ডউইচ আর গরম কফি নিয়ে উদবিগ্ন হয়ে বসে ছেলের ভবিষ্যৎ-এর চিন্তাতে জীবনপাত করেন না।

সৌম্য বলল, চা খাবি সুজন? এত টেনশান না! খাবি তো বল। গাড়িতেই আছে।

না:। একেবারে বাড়ি গিয়েই ভাত খাব। মা বসে থাকবেন।

কেমন আছেন কাকিমা?

এখনও আছেন।

আজ তোর অফিস নেই?

সৌম্য জিজ্ঞেস করল।

না:। ছুটিতে আছি। প্রতিবছর এই সময়ে আমি ছুটি নিই।

বেশ কাটিয়ে দিলি জীবনটা! বিয়েও করলি না। নো ওয়ারি—নো অ্যাংজাইটি।

সুজন কিছু না বলে সৌম্যর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তোর অফিস নেই? এবার সুজনকে সৌম্য শুধোল।

আছে। তবে ম্যানেজ করেছি। দিন দশেক যেতে পারব না, কেনেডির পরীক্ষা চলাকালীন।

ছুটি নিয়েছিস?

এত ছুটি দেবে কে?

তবে?

বললাম না ম্যানেজ করেছি।

সৌম্য ‘ইণ্ডিয়া কিংস’-এর প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আর একটা বের করল। সুজনকে অফার করল।

আছে আমার।

বলে ‘চার্মস’-এর প্যাকেটটা বের করে সুজন একটা ধরাল।

না:। এবারে ভাবছি সিগারেট সত্যিই ছেড়ে দেব।

সৌম্য স্বগতোক্তির মতন বলল।

তার পর বলল, সুজন, কিছু মনে করিস না। তোর নানারকম কমপ্লেক্স ডেভেলাপ করে গেছে দেখছি।

হঠাৎ এই কথা? কমপ্লেক্স? আমার?

সুজন বলল।

কমপ্লেক্স নয়? আমার একটা ‘ইণ্ডিয়া-কিংস’ খেলে কী হত?

কিছুই হত না। তুই একটা ‘চার্মস’ খা-না! যার যা ব্র্যাণ্ড। আমার ব্র্যাণ্ডের দামটা কম, তাই তুই ভাবলি কমপ্লেক্স হয়ে গেছে! ফানি!

সুজন ঠিক করল তখনই চলে যাবে। তার পর ভাবল, সৌম্য কিছু মনে করতে পারে। একটু দাঁড়িয়েই না-হয় যাবে।

সিগারেটটা ধরিয়ে ও বলল, কেনেডির ভালো নাম কী?

ভালো নামই কেনেডি। আলটিমেটলি পড়াশুনো করতে তো স্টেটসে যেতেই হবে। মানে, মানুষ যদি হতে চায়। তাই ভাবলাম, নামটাও…

তাই? আর খারাপ নাম? মানে, বাড়ির নাম?

কেনেডিই।

কী পড়াবি ঠিক করেছিস ওকে?

সেইটেই তো সমস্যা!

কেন?

ওর এতদিকে ন্যাক যে, পরি তো ডিসাইডই করে উঠতে পারছে না।

ও নিজে কী বলে?

কে?

মানে কেনেডি?

ও বলে, ভালোভাবে মানুষ হয়েছে, মানে প্রাচুর্যের মধ্যে, যে-লাইনে বেশি রোজগার সেই লাইনেই যাবে। টাকা চাই। টাকা। অঢেল টাকা না থাকলে বেঁচে সুখ নেই।

বলে? মানে, কেনেডি নিজেই বলে একথা?

অবাক হয়ে বলল সুজন।

হ্যাঁ। বলে বই কী? ওরা তো আমাদের মতন নয়, অনেক প্র্যাকটিক্যাল, প্র্যাগম্যাটিক।

তাই?

নিশ্চয়ই। তবে আমার ইচ্ছে ও ম্যানেজমেন্টই পড়ুক। গ্র্যাজুয়েশানের পর যদি জোকা কি আহমেদাবাদ থেকে পাস করে আসতে পারে, নাথিং লাইক ইট। আরও অনেক জায়গাতেই তো হয়েছে এখন ম্যানেজমেন্ট ইন্সস্টিটিউট। তার পর স্টেটসে যাবে।

শুধু টাকা যদি লক্ষ্য হয় ম্যানেজমেন্ট পড়ে কী হবে? ক্রিকেট খেলা শেখা তার চেয়ে। টাকার ওপর দিয়ে হেঁটে যাবে। যাত্রার নায়কও করতে পারিস। লেখাপড়া শেখে আজকাল ইডিয়টসরা।

তা যা-বলেছিস।

ওর ন্যাক কোন কোন দিকে?

আরে কোন দিকে নয় তাই বল? সাউথ ক্লাবে বি এল টি-এর টেনিস কোচিং-এ যায়, ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিক-এ, সানি পার্কে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক শিখতে যায়, ময়দানের জুডোক্লাবে জুডো শেখে, ওর অ্যাম্বিশান ব্ল্যাক-বেল্ট পাওয়ার। গাড়ি নিয়ে দুবে ড্রাইভার তো সর্বক্ষণ ওরই ডিউটিতে থাকে। পরি আর আমি তো ট্যাক্সি করেই ঘোরাফেরা করি।

তার পর বলল, কী বুঝলি?

কীসের কী?

মানে, কেনেডির কথা বলছি।

কী আর বলব বল, তুই যা বললি, তাতে তো বোঝার কিছুই নেই। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছাড়া আর কারো মধ্যে এমন বহুমুখী প্রতিভার কথা তো আমি শুনিনি।

এও সব নয়। বড়া হাড্ডু খাঁর কাছে শনি-রবিবার সকালে সেতারও শিখতে যায়। ঝালা যা তোলে না! কী বলব তোকে। নিজের ছেলে তো! বলতে লজ্জাও করে। কিন্তু হি ইজ আ প্রডিজি!

কথাকলি বা ভারতনাট্যম কিছু শেখাস না? নাচ-টাচ? সুজন বলল।

তুই কি ঠাট্টা করছিস নাকি?

হঠাৎ চটে উঠে বলল সৌম্য।

তার পর সুজনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আরও রেগে কিন্তু গলা নামিয়েই, ভদ্রলোকেরা যেমন করে কথা বলেন, তেমন করে বলল, তুই বরাবরই এইরকম।

কীরকম?

অবাক হয়ে বলল সুজন।

ওলওয়েজ গ্রিন উইথ জেলাসি। আমার সঙ্গে করিস, করিস। তা-বলে আমার ছেলের সঙ্গেও?

তোর সঙ্গে কী করলাম আমি?

অবাক হয়ে, আহত গলাতে বলল সুজন।

আমি যে সব দিক দিয়ে ভালো হয়েছি, ওয়েল-অফফ, ভালো চাকরি পেয়েছি, হেভি উপরি রোজগারের স্কোপওয়ালা চাকরি করি। পরির মতন সুন্দরী অ্যাকমপ্লিশড ওয়েল-কানেক্টেড মেয়েকে বিয়ে করেছি, নিজের ফ্ল্যাট করেছি, গাড়ি করেছি, আমাদের একমাত্র ছেলে যে ভালো স্কুলে পড়ে, সে যে ভার্সেটাইল হয়েছে তুই এসবের কিছুই সহ্য করতে পারিস না, পারছিস না। তুই অবশ্য একা নোস, অনেকেই…

সুজন সিগারেটটা তর্জনী আর মধ্যমার ডগা দিয়ে পথে নর্দমার দিকে ছুড়ে ফেলে বলল, তোকে কে বলল? তোরা তিরিশ বছর আগে যখন টালা ছেড়ে চলে এলি, তখন তোর বয়স বারো, আমার তেরো। তার পরে তোর সঙ্গে বিভিন্ন বিয়ে ও শ্রাদ্ধবাড়িতে বার দশেক মাত্র দেখা হয়েছে। তুই আমার মানসিকতা সম্বন্ধে এত জানলি কী করে? কার কাছ থেকে?

অনেকের কাছ থেকেই শুনেছি। তুই পড়াশোনোয় ভালো বলে ছাত্রাবস্থাতেও আমাদের কারোকেই পাত্তা দিতিস না। এখন লেখক হিসেবে একটু পরিচিতি হয়েছে বলে মাটিতে পা পড়ে না তোর। কোনো আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাস না, খোঁজখবর করিস না কারোরই। এগুলো কি চালবাজি নয়?

সুজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, দেখ সৌম্য, তোর জগৎ আর আমার জগৎ একেবারেই আলাদা। আমরা ভিন্ন গ্রহের জীব। আমাদের পক্ষে একে অন্যকে বোঝা হয়তো অসম্ভব। তাই বোঝার চেষ্টা না করাই ভালো। ভুল বোঝার চেয়ে না বোঝা অনেকই সহনীয়। তবে আমি তোকে বুঝি। হান্ড্রেড পার্সেন্ট বুঝি।

কী বুঝিস? আমি কি অ্যাবনর্মাল? নিজেদের একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে কনসার্নড হওয়াটা কি দোষের? তোর ছেলে-মেয়ে হয়নি তাই তুই বেঁচে গেছিস।

তা আর বলতে!

সুজন বলল।

তার পর হেসে বলল, অনেকেই যখন আমাকে বলেন, আমার ছেলেকে একটু সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভরতি করে দিতে পারবেন? বা মেয়েকে লোরেটো বা মডার্ন হাই স্কুল? তখন আমি বলি, তাই যদি পারতাম তবে তো নিজেরই ছেলে-মেয়ে হতে পারত। বিয়ে করলে ছেলে-মেয়ে হবে, ছেলে-মেয়ে হলেই স্কুলে ভরতি করতে হবে সেই ভয়েই তো ও পথই মাড়ালাম না। কে জানে! বিয়ে করলে হয়তো তোর মতনই ঝামেলাতে পড়তাম!

তুই একটি এসকেপিস্ট।

সৌম্য বলল।

হয়তো তাই। ছেলেকে সেইন্ট জেভিয়ার্স স্কুল আর মেয়েকে লোরেটো বা মডার্ন-এ না পড়ালে যে তারা বনমানুষ-বনমানুষি হয়ে যাবে তা আমি মনে করি না। মানে, আমার ছেলে-মেয়ে থাকলেও মনে করতাম না।

তুই মনে না করলে কী হবে? এই যুগে আমার মতন বেণ্ড অব মাইণ্ড হওয়াটাই ন্যাচারাল, মানে, নর্মাল। তুই-ই অ্যাবনর্মাল।

অবশ্যই!

আবার ও বলল, অবশ্যই! মাঝে মাঝে মনে হয়, পাগল হয়ে যাব।

যাব কী? আমার তো মনে হয় তুই পাগল হয়ে গেছিস অলরেডি। পাগলের পক্ষে এমন ছাড়া থাকা মানে, I mean ‘At large’ ভালো নয়। সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক তা।

সৌম্য বলল।

সুজন হেসে বলল, পথে-ঘাটে যারা হেঁটে-চলে বেড়ায় তাদের চোখের দিকে চেয়ে দেখেছিস কখনো সৌম্য? চেয়ে দেখলে, দেখতে পাবি, সবাই পাগল। উপরে স্যানিটির একটা পাতলা ফিলম আছে যদিও। জিরো-নাম্বারের শিরীষ কাগজ দিয়ে একটু ঘষে দিলেই দেখবি মেন্টাল হসপিটালের কেস। হবে নাই-বা কেন! চিংড়ি মাছের কেজি সাড়ে তিন-শো টাকা। ইলিশ মাছের কেজি দু-শো টাকা, ট্যাক্সির মিনিমাম ভাড়া আট টাকা, ইলেকট্রিসিটির বিল আবারও বাড়ছে, কোনো বাঙালিরাই আর কলকাতাতে পাগল না-হয়ে থাকতে পারে না, সিলিণ্ডারের দাম…

সৌম্যর মুখে বিদ্রূপ ফুটে উঠল।

ও বলল, তুই দেখছি খুব জনদরদি হয়ে উঠেছিস?

আমি? না, জনদরদি নই, আমি নিছক আমি-দরদি হয়ে উঠেছি। আর আমি যদি জনগণের একজন বলে গণ্য হই, তাহলে আমাকে জনদরদিও বলতে পারিস। তুই কী করে বুঝবি, কেন পাগলে দেশ ভরে গেছে? তোর তো পয়সা রোজগার করতে খাটতে হয় না। তোর পয়সাও মেহনতের পয়সা নয়।

মানে?

এবার সৌম্যর মুখ-চোখ হিংস্র হয় উঠল।

সুজন বলল, বেশি কথা বলিস না সৌম্য। তোর লজ্জাবোধ থাকলে চুপ করে যা। তোর প্রিন্স অব ওয়েলস-এর চিন্তা কর।

তুই একটা শিশুকেও ঈর্ষা করিস?

আবারও শুরু করলি তুই! তোর কেনেডি কি শিশু নাকি?

শিশু নয়?

তাহলে শিশুই! এবং চিরদিন শিশুই থাকবে। আমি তাহলে আসি। আই অ্যাম স্যরি সৌম্য। তোদের এই উদবিগ্ন অভিভাবক-অভিভাবিকাদের ভিড়ের মধ্যে সংসারহীন, পুত্রহীন, পাগল আমাকে মানায় না। তোদের এমনিতেই অনেক চিন্তা। সেই চিন্তা আরও অ্যাগ্রাভেট করতে চাই না আমি। চলি রে।

সুজন পা বাড়াল গড়িয়াহাটের দিকে। সেই সময়েই একটা ট্রামও এসে গেল। চড়ে পড়ল সুজন সেকেণ্ড ক্লাসে। না। গরিব বলে নয়। অত গরিব নয় যে সে ট্রামের ফাস্ট-ক্লাসে চড়তে পারে না। কিন্তু ও সেকেণ্ড ক্লাস-ই পছন্দ করে। সেকেণ্ড ক্লাসে চেনা মানুষজন থাকেই না বলতে গেলে। কথা বলতে হয় না কারো সঙ্গেই। তা ছাড়া ক্রমশই দিনকে দিন ও ওর তথাকথিত আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিতদের সঙ্গে মিশতে পারার পুরোপুরিই অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। খাপ খাওয়াতে পারছে না। তাদের অধিকাংশের চাওয়া-পাওয়া, তাদের মানসিকতা, জীবনের উদ্দেশ্য, জীবনযাত্রা কোনো কিছুর সঙ্গেই তার আর কোনোই মিল নেই।

স্টেটসে না গেলে কি সত্যিই কারো ছেলে-মেয়ে মানুষ হয় না?

সেদিন বুইদা কাকার বাড়ি গেছিল। কাকা বললেন, পিন্টুর ছেলে দেশে ফিরেছে রে!

সুজন জিজ্ঞেস করেছিল, কী পড়ে এল?

কী পড়ে এল তা তো জানি না সুজন! তবে দেখলাম একটা প্যান্ট পরে এসেছে, তার ডান পা-টা লাল আর বাঁ পা-টা নীল।

সুজন হেসে ফেলেছিল বুইদা কাকার কথা শুনে।

বলেছিল, তাই?

তাই!

ও কি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছে? না, ইতিমধ্যেই গেছে? চলন্ত ট্রামের পেছনের সিটে বসে ওর রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছে পড়া ‘ঘোড়া’ নামক ছোটোগল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্ম যখন প্রায় শেষ করে এনেছেন, মাল-মশলা সব প্রায় শেষ—ক্ষিতি, মরুৎ, ব্যোম, অপ, তেজ ইত্যাদি যে-পাত্রে যতটুকু তলানি ছিল সেইসব দিয়ে তখন একটি জীব তৈরি করলেন তিনি। সেই জীবটিই ঘোড়া। তারমধ্যে ব্যোম-এর অনুপাত অত্যন্ত বেশি হয়ে যাওয়াতে সেই জীব আকাশপানে মুখ তুলে কেবলই ছুটে বেড়াতে লাগল। শুধু ছোটারই আনন্দে। পরে অবশ্য তাঁর সৃষ্টির Imbalance কী করে শুধরেছিলেন ব্রহ্মা স্বয়ং, তাও আছে সেই গল্পে।

সেদিন আলিপুরদুয়ার থেকে ফেরার পথে সুশান্ত ট্রেনে ওকে একটা গল্প বলেছিল। গল্পটা মনে পড়ে গেল সুজনের। ব্রহ্মার ছেলের গল্প। ব্রহ্মা একদিন তাঁর নিজের ছেলে নিজেই তৈরি করতে বসলেন নিখুঁত করে, মানে প্রায় সৌম্য আর পরির ছেলে কেনেডিরই মতন করে। তাঁর সব পসরা নিয়ে, তাকে সর্বগুণসম্পন্ন করে গড়ে তোলবার চেষ্টার ত্রুটি করলেন না। করবেনই বা কেন? ব্রহ্মার ছেলে বলে কথা! সৌম্যরাই তো এখন আধুনিক ব্রহ্মা।

কিন্তু গড়তে বসে দেখলেন, তেজ একবার বেশি হয় যায় তো অপ কম হয়ে যায়, ক্ষিতি কম তো মরুৎ বেশি হয়ে যায়, মরুৎ কমাতে গিয়ে দেখা যায় ব্যোম বেশি হয়ে গেছে। এমনি করে বারংবার ঘষামাজা করতে করতে কিছুতেই ব্রহ্মার মনঃপূত আর হয় না সেই ছেলে। সৃষ্টির সব উজাড় করে ঢেলে দিয়েও দিনের পর দিন ঘষে-মেজেও স্বয়ং ব্রহ্মাও যখন অবশেষে একদিন হাল ছেড়ে দিয়ে ক্ষান্ত দিলেন তখন গভীর হতাশার সঙ্গে দেখলেন যে, যে-প্রাণীটি তিনি সৃষ্টি করলেন সেটি একটি ছুঁচো হয়েছে।

ছুঁচো?

ইয়েস।

ছুঁচো।

ব্রহ্মার ছেলে, ছুঁচো।

সুজন ভাবল একদিন সৌম্যকে এই গল্পটা বলবে।

তার পরই ভাবল কী লাভ? সৌম্যই তো স্বয়ং ব্রহ্মা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *