॥ ৭ ॥
ফেলুদা এখন মহেশ চৌধুরীর ডায়রি নিয়ে বসবে, তাকে ডিসটার্ব না করাই ভালো, তাই আমরা দুজনে চারটে নাগাদ চা খেয়ে একটু ঘুরব বলে গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়লাম। লালমোহনবাবুর ধারণা শহরের দিকে গেলে হয়ত সুলতানের লেটেস্ট খবর পাওয়া যেতে পারে।—‘মহেশ চৌধুরীর মৃত্যুর ব্যাপারে তোমার দাদা যতই রহস্যের গন্ধ পেয়ে থাকুন না কেন, আমার কাছে বাঘ পালানোর ঘটনাটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর।’
বাঘের খবর পেতে বেশি দূর যেতে হল না। পেট্রোল নেবার দরকার ছিল, মেন রোডে বৃজভূষণ তেওয়ারীর পেট্রোল পাম্পের সামনে ভীড় দেখেই বুঝলাম বাঘের আলোচনা হচ্ছে, কারণ একজন ভদ্রলোক থাবা মারার ভঙ্গী করলেন কথা বলতে বলতে।
লালমোহনবাবু গাড়ি থেকে নেমে সটান এগিয়ে গেলেন জটলার দিকে। ভদ্রলোক এককালে রাজস্থান যাবেন বলে বই পড়ে কিছুটা হিন্দি শিখেছিলেন, কিন্তু এখন সেটা ফেলুদার ভাষায় আবার শেয়ালের স্ট্যান্ডার্ডে নেমে গেছে। তার মানে কেয়া হুয়া-র বেশি এগোন মুশকিল হয়। তবু ভালো, ভিড়ের মধ্যে একজন বাঙালী বেরিয়ে গেল। তার কাছেই জানলাম যে হাজারিবাগের পূবে বিষ্ণুগড়ের দিকে একটা বনের মধ্যে নাকি সুলতানকে পাওয়া গিয়েছিল। ট্রেনার চন্দ্রনের সঙ্গে বনবিভাগের শিকারী নাকি বাঘটার দিকে এগিয়ে যায়। একটা সময় মনে হয়েছিল যে বাঘটা ধরা দেবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেটা চন্দ্রনকে একটা থাবা মেরে পালিয়ে যায়। গুলিও চলেছিল, কিন্তু বাঘটা জখম হয়েছে কিনা জানা যায়নি। চন্দ্রন অবিশ্যি জখম হয়েছে, তবে তেমন গুরুতরভাবে নয়। সে এখন হাসপাতালে।
লালমোহনবাবু বললেন, ‘কাণ্ডারিকারের কোনো খবর জানেন?’
এটা শুধরাতেই হল। বললাম, ‘কাণ্ডারিকার নয়, কারাণ্ডিকার—যিনি বাঘের আসল ট্রেনার।’
ভদ্রলোক বললেন তার খবর জানেন না, তবে এটা জানেন যে বাঘের অভাবে নাকি সার্কাসের বিক্ৰী কিছুটা কমেছে।
বাঘের দিকে গুলি চলেছে জেনে কারান্ডিকারের মনোভাব কী হল সেটা জানার জন্য ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল আমাদের দুজনেরই, তাই পেট্রোল নিয়ে সোজা চলে গেলাম গ্রেট ম্যাজেস্টিকে।
ফেলুদা সঙ্গে থাকলে দেখেছি লালমোহনবাবু নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে সাহস পান না; আজ দেখলাম সোজা গেটে গিয়ে বললেন, ‘পুট মি থ্রু টু মিস্টার কুট্টি প্লীজ।’ গেটের লোকটা কী বুঝল জানি না। হয়ত সেদিন আমাদের চিনে রেখেছিল, তাই আর কিছু জিগ্যেস না করে আমাদের ঢুকতে দিল, আর আমরাও সোজা গিয়ে হাজির হলাম মিঃ কুট্টির ক্যারাভ্যানে।
কুট্টির কাছে যে খবরটা পেলাম সেটাকেও একটা হেঁয়ালি বলা চলে।
কারাণ্ডিকার নাকি কাল রাত থেকে হাওয়া।
‘দুদিন থেকেই পাবলিক আবার বাঘের খেলা ডিমাণ্ড করতে শুরু করেছে,’ বললেন মিঃ কুট্টি। ‘আমি নিজে কারাণ্ডিকারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছি। বলেছি সে ছাড়া আর কেউ বাঘ ট্রেন করবে না। কিন্তু তাও সে বলে চলে গেল। এর মধ্যেও দু-একদিন বেরিয়েছে, কিন্তু ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু আজ সে এখনও ফিরল না।’
খবরটা শুনে সার্কাসের বাইরে বেরিয়ে এসে লালমোহনবাবু বললেন, ‘সুলতান-ক্যাপচারের দৃশ্য আর দেখা হল না, তপেশ। এমন সুযোগ আর আসবে না।’
আমারও মনটা খারাপ লাগছিল, তাই ঠিক করলাম গাড়িতে করে কোথাও একটু বেড়িয়ে আসব। উত্তরে যাব না দক্ষিণে যাব—অর্থাৎ কানারি হিলের দিকে যাব না রামগড়ের দিকে যাব—সেটা ঠিক করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত টস্ করলাম। দক্ষিণ পড়ল। লালমোহনবাবু বললেন, ‘ওদিকটাতেও একটা পাহাড় আছে, সেদিন যাবার পথে দেখেছি। খাসা দৃশ্য।’
দৃশ্য ভালো ঠিকই, কিন্তু এগারো কিলোমিটারের পোস্টটা পেরিয়ে কিছু দূর গিয়েই একটা কালভার্টের ধারে যে ঘটনাটা ঘটল, সেটাকে মোটেই ভালো বলা চলে না।
মাত্র ছ’মাস আগে কেনা লালমোহনবাবুর অ্যাম্বাসাডর বার তিনেক হেঁচকি তুলে মিনিট খানিক গো স্লো করে অবশেষে বেমালুম ধর্মঘটের দিকে চলে গেল। ‘বোধহয় তেল টানচে না,’ বললেন হরিপদবাবু।
ঘড়িতে পাঁচটা কুড়ি। সূর্য আকাশের নিচের দিকে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে না, কারণ পশ্চিমে দূরে শালবনের মাথার উপর মেঘ জমে আছে।
আমরা গাড়ি থেকে নেমে কালভার্টের উপর গিয়ে বসলাম, হরিপদবাবু গাড়ি নিয়ে পড়লেন। লালমোহনবাবুকে এ ব্যাপারে পুরোপুরি ড্রাইভারের উপর নির্ভর করতে হয়, কারণ উনি গাড়ি সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। উনি বলেন, ‘আমার নিজের পায়ের ভেতর কটা হাড় আছে কটা মাস্ল আছে না জেনে যখন দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছি, তখন গাড়ির ভেতর কী কলকব্জা আছে সেটা জানার কী নেসেসিটি ভাই?’
মেঘের গায়ে নিচের দিকে একটা খড়খড়ির মধ্যে দিয়ে একটিবার উঁকি দিয়ে সুর্যদেব যখন আজকের মতো ছুটি নিলেন, হরিপদবাবু সেই সময় জানালেন যে তিনি রেডি—‘চলে আসুন, স্যার।’
কালভার্ট থেকে উঠে আরেকবার ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখি পাঁচটা তেত্রিশ। সময়টা জরুরী, কারণ ঠিক তখনই আমরা দেখলাম সুলতানকে।
খবরটা আরো অনেক নাটকীয়ভাবে দিতে পারতাম, কিন্তু ফেলুদা বলে এটাই ঠিক।—‘গাদাগুচ্ছের মর্চে-ধরা বিশেষণ আর তথাকথিত লোম-খাড়া-করা শব্দ ব্যবহার না করে চোখে যা দেখলি সেইটে ঠিক ঠিক সোজাসুজি বলে গেলে কাজ দেবে ঢের বেশি।’ আমিও সেটাই করার চেষ্টা করছি।
খাঁচার বাইরে বাঘ এর আগেও একবার দেখেছি, যেটার কথা রয়েল বেঙ্গল রহস্যে আছে। কিন্তু সেখানে আমাদের সঙ্গে আরো অনেক লোক ছিল। শিকারী আর বন্দুক ত ছিলই, সবচেয়ে বড় কথা—ফেলুদা ছিল। তার উপরে আমি আর লালমোহনবাবু ছিলাম গাছের উপর, বাঘের নাগালের বাইরে। এখানে আমরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছি খোলা রাস্তায়, যার দুদিকে বন, অদূরে একটা পাহাড়, যাতে ভল্লুক আছেই, আর সময়টা সন্ধ্যে। এই সময় এই অবস্থায় আমাদের থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে পশ্চিম দিকের বন থেকে বেরিয়ে বাঘটা রাস্তার উপর উঠল। আমরা তিনজনে ঠিক একসঙ্গে একই সময় বাঘটা দেখেছি, কারণ আমার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দুজনও ঠিক সেইভাবেই কাঠ হয়ে গেল। হরিপদবাবুর বাঁ হাতটা গাড়ির দরজার দিকে বাড়িয়েছিলেন, সেই বাড়ানোই রয়ে গেল; লালমোহনবাবু নাক ঝাড়বেন বলে ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীটা নাকের দুপাশে ধরে শরীরটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকিয়েছিলেন, তিনি সেই ভাবেই রয়ে গেলেন; আমি ধুলো ঝাড়বার জন্য আমার ডান হাতটা আমার জীন্সের পিছন দিকে নিয়েছিলাম, তার ফলে শরীরটা একটু বেঁকে গিয়েছিল, বাঘটা দেখার ফলে শরীরটা সেইরকম বেঁকেই রইল।
রাস্তায় উঠে বাঘটা ঠিক চার পা গিয়ে থেমে গেল। তারপর মাথাটা ঘোরালো আমাদের দিকে।
আমার পা কাঁপতে শুরু করেছে, বুকের ভিতরে কে যেন হাতুড়ি পিটছে। অথচ আমার চোখ কিছুতেই বাঘের দিক থেকে সরছে না। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছি যে আমার ডান পাশে আবছা কালো জিনিসটা হচ্ছে লালমোহনবাবুর মাথা, আর সেটা ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। আন্দাজে বুঝলাম তাঁর পা অবশ হয়ে যাবার ফলে শরীরের ভার আর বইতে পারছে না। এটাও বুঝতে পারছিলাম যে আমার দৃষ্টিতে কী জানি গণ্ডগোল হচ্ছে, কারণ বাঘের আউটলাইনটা বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, আর গায়ের কালো ডোরাগুলো স্থির না থেকে ভাইব্রেট করছে।
সুলতান যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আমাদের দেখল সেটার আন্দাজ দেওয়া মুশকিল। মনে হচ্ছিল সময়টা অফুরন্ত। লালমোহনবাবু পরে বললেন কম করে আট-দশ মিনিট; আমার মতে আট-দশ সেকেণ্ড, কিন্তু সেটাও যথেষ্ট বেশি।
দেখা শেষ হলে পর মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে আরো চার পা ফেলে বাঘ রাস্তা পেরিয়ে গেল। সাহস একটু বাড়াতে ধীরে ধীরে ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম শাল সেগুন সরল শিশু শিমূল আর আরো অনেক সব শুকনো গাছের জঙ্গলে সুলতান অদৃশ্য হয়ে গেল।
আশ্চর্য এই যে, এর পরেও আমরা অন্তত মিনিটখানেক (লালমোহনবাবুর বর্ণনায় পনের মিনিট) প্রায় একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর তিনজনে কেবল তিনটে কথা বলে গাড়িতে উঠলাম—হরিপদবাবু ‘চলুন’, আমি ‘আসুন’ আর লালমোহনবাবু ‘ছঃ’। খুব বেশি ভয় নিয়ে কথা বলতে গেলে লালমোহনবাবুর এরকম হয় এটা আমি আগেই দেখেছি। ডুয়ার্সে মহীতোষ সিংহরায়ের বাড়িতে আমরা তিনজন একঘরে শুয়েছিলাম। একদিন রাত্রে ঘরের বন্ধ দরজাটা হাওয়াতে খট্ খট্ করায় উনি ‘কে’ না বলে ‘খে’ বলেছিলেন।
হরিপদবাবুর নার্ভটা দেখলাম মোটামুটি ভালো। ফেরার পথে স্টিয়ারিং হুইলে হাতটাত কাঁপেনি। উনি নাকি এর আগেও রাস্তায় বাঘ দেখেছেন, জামসেদপুরে ড্রাইভারি করার সময়।
বাড়ি ফিরে দেখি ফেলুদা তখনো মহেশবাবুর ডায়রিতে ডুবে আছে। আমার মনে হচ্ছিল সুলতানের খবরটা লালমোহনবাবু দিতে পারলে খুশি হবেন, তাই আমি আর কিছু বললাম না। ভদ্রলোক লেখেন-টেখেন বলেই বোধহয় সরাসরি খবরটা না দিয়ে একটু পাঁয়তারা কষে নিলেন। বার দু-তিন হুঁ হুঁ হুঁ করে কী একটা গানের সুর ভেজে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, তপেশ, বাঘের পায়ের তলায় বোধহয় প্যাডিং থাকে, তাই না?’
আমি মজা দেখছি; বললাম, ‘তাই ত শুনেছি।’
‘নিশ্চয়ই তাই; নইলে এত কাছ দিয়ে গেল আর কোন শব্দ হল না?’
লালমোহনবাবুর পাঁয়তারা কিন্তু মাঠে মারা গেল। ফেলুদা আমাদের দিকে চাইলও না, কেবল একটা ডায়রি সরিয়ে রেখে আরেকটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আপনারা যদি বাঘটাকে দেখে থাকেন, তাহলে ক’টার সময় কোন্খানে দেখেছেন সেটা বনবিভাগে ফোন করে জানিয়ে দেওয়া উচিত ইমিডিয়েটলি।’
লালমোহনবাবু বললেন, ‘টাইম পাঁচটা তেত্রিশ, লোকেশন রামগড়ের রাস্তায় এগারো কিলোমিটারের পোস্টের পরের কালভার্টের কাছে।
‘বেশ ত, পাশের ঘরে ডিরেকটরি রয়েছে, আপিসে এখন কেউ নেই, আপনি একেবারে ডি-এফ-এর বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিন। ওদের উপকার হবে।’
‘আচ্ছা, হুঁ, তাহলে…’ লালমোহনবাবু দেখলাম মাস্লগুলোকে টান করে নিচ্ছেন। —‘কী ভাবে পুট করা যায় ব্যাপারটা? ইংরিজিতেই বলব ত?’
‘হিন্দি ইংরিজি যেটায় বেশি দখল তাতেই বলবেন।’
‘দি টাইগার হুইচ এস্কেপ্ড ফ্রম দি…এস্কেপ্ডই বলব ত?’
‘সহজ করে নিয়ে র্যান অ্যাওয়ে বলতে পারেন।’
‘এসকেপটা বোধহয় ম্যানেজ করতে পারব।’
‘তাহলে তাই বলুন।’
নম্বর বার করে দিলাম আমি। ফোনটাও বোধহয় আমি করলেই ভাল হত, কারণ লালমোহনবাবু ‘দি সার্কাস হুইচ এসকেপ্ড ফ্রম দি গ্রেট ম্যাজেস্টিক টাইগার—থুড়ি’, বলে থেমে গেলেন। ভাগ্যিস ভদ্রলোক কথাটা খুব চেঁচিয়ে বলেছিলেন। ফেলুদা পাশের ঘর থেকে শুনতে পেয়ে দৌড়ে এসে টেলিফোনটা ওঁর হাত থেকে ছিনিয়ে খবরটা নিজেই দিয়ে দিল।