॥ ১২ ॥
গাড়িতে অখিলবাবু বললেন—‘আমার নাম লেখা পাথরটার পাশে দাঁড়িয়েই আমি ওদের কথা শুনতে পাই। তাকে অনেক সময় জিগ্যেস করেছি সে হঠাৎ হঠাৎ এত অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে কেন। সে ঠাট্টা করে বলত—তুমি গুণে বার কর, আমি বলব না। আশ্চর্য—তার জীবনের এত বড় একটা ঘটনা—সেটা কুষ্ঠীতে ধরা পড়ল না কেন বুঝতে পারছি না! হয়ত আমারই অক্ষমতা।’
বাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি তখন বুঝতে পারলাম ফেলুদা কাকে ফোন করেছিল।
ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন শঙ্করলাল মিশ্র।
‘আপনার মিশন সাকসেসফুল?’ গাড়ি থেকে নেমে জিগ্যেস করল ফেলুদা।
‘হ্যাঁ,’ বললেন শঙ্করলাল, ‘বীরেন এসেছে।’
আমরা বৈঠকখানায় ঢুকতে সেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করলেন। লম্বা চুল, রুক্ষ লম্বা দাড়ি, লম্বা বলিষ্ঠ চেহারা।
‘বাপের শেষ ইচ্ছার কথা শুনে বীরেন আসতে রাজি হল,’ বললেন শঙ্করলাল, ‘মহেশবাবুর উপর কোনো আক্রোশ নেই ওর।’
‘যেমন আক্রোশ নেই, তেমনি আকর্ষণও নেই,’ বললেন বীরেন-সন্ন্যাসী। ‘শঙ্কর এবার অনেক চেষ্টা করেছিল আমাকে ফিরিয়ে আনতে। বলেছিল—ওদের দেখলে তোমার টানটা হয়ত ফিরে আসবে। ওর কথাতেই আমি রাজরাপ্পায় গিয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু দূর থেকে দেখেই আমি বুঝেছিলাম আমার আত্মীয়দের উপর আমার কোনো টান নেই। বাবা তবু আমাকে কিছুটা বুঝেছিলেন, তাই প্রথম প্রথম ওঁকে চিঠিও লিখেছি। কিন্তু তারপর…’
‘কিন্তু সে চিঠি ত আপনি বিদেশ থেকে লেখেননি,’ বলল ফেলুদা, আমার বিশ্বাস আপনি দেশের বাইরে কোথাও যাননি কোনোদিন।
বীরেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ হেসে ফেললেন। আমি হতভম্ব, কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না।
‘শঙ্কর আমাকে বলেছিল আপনার বুদ্ধির কথা’ বললেন বীরেনবাবু ‘তাই আপনাকে একটু পরীক্ষা করছিলাম।’
‘তাহলে আর কি। খুলে ফেলুন আপনার অতিরিক্ত সাজ পোশাক। হাজারিবাগের রাস্তার লোকের পক্ষে ওটা যথেষ্ট হলেও আমার পক্ষে নয়।’
বীরেনবাবু, হাসতে হাসতে তাঁর দাড়ি আর পরচুলা খুলে ফেললেন। লালমোহনবাবু আমার পাশ থেকে চাপা গলায় ‘কান্…কান্…কান্’ বলে থেমে গেলেন। আমি জানি তিনি আবার ভুল নামটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এবার বললেও আর শুধরোতে পারতাম না, কারণ আমার মুখ দিয়েও কথা বেরোচ্ছে না। কথা বললেন অখিলবাবু, বীরেন বাইরে যায়নি মানে? ওর চিঠিগুলো তাহলে…?’
‘বাইরে না গিয়েও বিদেশ থেকে চিঠি লেখা যায় অখিলবাবু, যদি আপনার ছেলের মতো একজন কেউ বন্ধু থাকে বিদেশে, সাহায্য করার জন্য।’
‘আমার ছেলে!’
‘ঠিকই বলেছেন মিস্টার মিত্তির, বললেন বীরেন কারান্ডিকার, অধীর যখন ডুসেলডর্ফে, তখন ওকে চিঠি লিখে আমি বেশ কিছু ইউরোপীয় পোস্টকার্ড আনিয়ে নিই। সেগুলোতে ঠিকানা আর যা কিছু লিখবার লিখে খামের মধ্যে ভরে ওর কাছেই পাঠাতাম, আর ও টিকিট লাগিয়ে ডাকে ফেলে দিত। অবিশ্যি অধীর দেশে ফিরে আসার পর সে সুযোগটা বন্ধ হয়ে যায়।
‘কিন্তু এই লুকোচুরির প্রয়োজনটা হল কেন?’ জিগ্যেস করলেন অখিলবাবু।
‘কারণ আছে’ বলল ফেলুদা। ‘আমি বীরেনবাবুকে জিগ্যেস করতে চাই আমার অনুমান ঠিক কিনা।’
‘বলুন।’
‘বীরেনবাবু কর্নেল সুরেশ বিশ্বাসের জীবনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন, এবং তাঁর মতো হতে চেয়েছিলেন। সুরেশ বিশ্বাস যে ঘর ছেড়ে খালাসী হয়ে বিদেশে গিয়ে শেষে ব্রেজিলে যুদ্ধ করে নাম করেছিলেন সেটা আমার মনে ছিল। যেটা মনে ছিল না সেটা আমি কাল রাত্রে বাঙালীর সার্কাস বলে একটা বই থেকে জেনেছি। সেটা হল এই যে সুরেশ বিশ্বাস ছিলেন প্রথম বাঙালী যিনি বাঘ সিংহ ট্রেন করে সার্কাসের খেলা দেখিয়েছিলেন। তাঁর সবচেয়ে আশ্চর্য খেলা ছিল সিংহের মুখ ফাঁক করে তার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া।’
এখানে লালমোহনবাবু কেন জানি ভীষণ ছটফট করে উঠলেন।
‘ও মশাই! ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ এই সেদিন পড়লুম, তাও খেয়াল হল না, ছ্যাঃ ছ্যাঃ ছ্যাঃ…’
‘আপনি ছ্যাছ্যাটা পরে করবেন, আগে আমাকে বলতে দিন।’
ফেলুদার ধমকে লালমোহনবাবু ঠাণ্ডা হলেন। ফেলুদা বলে চলল, ‘বীরেনবাবুর অ্যাম্বিশন ছিল আসলে বাঘ সিংহ নিয়ে খেলা দেখানো। কিন্তু বাঙালী ভদ্রঘরের ছেলে আজকের দিনে ওদিকে যেতে চাইছে শুনলে কেউ কি সেটা ভালো চোখে দেখত? মহেশবাবুই কি খুশি মনে মত দিতেন? তাই বীরেনবাবুকে কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তাই নয় কি?’
‘সম্পূর্ণ ঠিক,’ বললেন বীরেনবাবু।
‘কিন্তু আশ্চর্য এই যে, অ্যাদ্দিন পরে ছেলেকে রিং-মাস্টার হিসেবে দেখেও মহেশবাবু তাকে চিনতে পেরেছিলেন, যদিও অরুণবাবু সামনে থেকে দেখেও চিনতে পারেননি। সেটার কারণ এই যে বীরেনবাবুর নাকে প্ল্যাস্টিক সার্জারি করানো হয়েছিল, যে কারণে ছেলেবেলার ছবির সঙ্গেও নাকের মিল সামান্যই।’
‘তাই বলুন।’ বলে উঠলেন অখিলবাবু, ‘তাই ভাবছি সবাই বীরেন বীরেন করছে, অথচ আমি সঠিক চিনতে পারছি না কেন!’
‘যাক্ গে,’ বলল ফেলুদা, ‘এখন আসল কাজে আসি।’
ফেলুদা পকেট থেকে মুক্তানন্দের ছবিটা বার করল। তারপর বীরেনবাবুর দিকে ফিরে বলল, আপনি বোধহয় জানেন না যে, আপনি আর ফিরবেন না ভেবে মহেশবাবু আপনাকে তাঁর উইল থেকে বাদ দিয়েছিলেন। সেই উইল আর বদল করার উপায় ছিল না। অথচ আপনি একেবারে বঞ্চিত হন সেটাও উনি চনিনি। তাই এই ছবিটা আপনাকে দিয়েছেন।’
ফেলুদা ছবিটা উলটে পিছনটা খুলে ফেলল। ভিতর থেকে বেরোল একটা ভাঁজ করা সেলোফেনের খাম, তার মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট কতগুলো রঙীন কাগজের টুকরো।
‘তিনটি মহাদেশের ন’টি দুষ্প্রাপ্য ডাক টিকিট আছে এখানে। অ্যালবাম চুরি যেতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান স্ট্যাম্প ক’টি এইভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন। গিবন্স ক্যাটালগের হিসেবে পঁচিশ বছর আগে এই ডাক টিকিটের দাম ছিল দু’ হাজার পাউণ্ড। আমার ধারণা আজকের দিনে প্রায় পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা।’
বীরেন্দ্র কারাণ্ডিকার খামটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন সেটার দিকে। তারপর বললেন, ‘সার্কাসের রিং-মাস্টারের হাতে এ জিনিস যে বড় বেমানান, মিঃ মিত্তির! আমি খুব অসহায় বোধ করছি। আমরা যাযাবর, ঘুরে ঘুরে খেলা দেখিয়ে বেড়াই, আমাদের কাছে এ জিনিস…?’
‘বুঝতে পারছি,’ বলল ফেলুদা, ‘এক কাজ করুন। ওটা আমাকেই দিন। কলকাতার কিছু স্ট্যাম্প ব্যবসায়ীর সঙ্গে চেনা আছে আমার। এর জন্য যা মূল্য পাওয়া যায় সেটা আমি আপনাকে পাঠিয়ে দেব। আমার উপর বিশ্বাস আছে ত আপনার?’
‘সম্পূর্ণ।’
‘কিন্তু আপনার ঠিকানাটা যে আমাকে দিতে হবে।’
‘গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাস,’ বললেন বীরেনবাবু, ‘কুট্টি বুঝেছে যে আমাকে ছাড়া তার চলবে না। আমি এখনো কিছুদিন আছি এই সার্কাসের সঙ্গে। আজ রাত্রে সুলতানকে নিয়ে খেলা দেখাব। আসবেন।’
*
রাত্রে গ্রেট ম্যাজেস্টিক সার্কাসে সুলতানের সঙ্গে কারান্ডিকারের আশ্চর্য খেলা দেখে বেরোবার আগে আমরা বীরেনবাবুকে থ্যাঙ্ক ইউ আর গুড বাই জানাতে তাঁর তাঁবুতে গেলাম। আইডিয়াটা লালমোহনবাবুর, আর কারণটা বুঝতে পারলাম তাঁর কথায়।
‘আপনার নামটার মধ্যে একটা আশ্চর্য কাণ্ডকারখানা রয়েছে,’ বললেন জটায়, ‘ডু ইউ মাইন্ড যদি আমি নামটা আমার সামনের উপন্যাসে ব্যবহার করি? সার্কাস নিয়েই গল্প, রিং-মাস্টার একটা প্রধান চরিত্র।’
বীরেন্দ্রবাবু হেসে বললেন, ‘নামটা ত আমার নিজের নয়! আপনি স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করতে পারেন।’
ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার পর ফেলুদা বলল, ‘তাহলে ইনজেকশন বাদ?’
‘বাদ কেন মশাই? ইনজেকশন দিচ্ছে বাঘকে। ভিলেন হচ্ছে সেকেণ্ড ট্রেনার। বাঘকে নিস্তেজ করে কারাণ্ডিকারকে ডাউন করবে দর্শকদের সামনে।’
‘আর ট্র্যাপীজ?’
‘ট্র্যাপীজ ইজ নাথিং,’ অবজ্ঞা আর বিরক্তি মেশানো সুরে বললেন লালমোহন গাঙ্গুলী।
ফেলুদা চরিত্রটা বড়ই চমকপ্রদ !
Feluda is great!
দারুন!