ছিন্নমস্তার অভিশাপ – ১১

॥ ১১ ॥

কৈলাসে ফিরে এসে ফেলুদা প্রথমে অরুণবাবুর অনুমতি নিয়ে একটা টেলিফোন করল, কাকে জানি না। তারপর বৈঠকখানায় এল, যেখানে আমরা সবাই বসেছি। নীলিমা দেবী চা পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওঁরা তিনজনে কালই কলকাতা ফিরে যাচ্ছেন। মহেশবাবুর শ্রাদ্ধ কলকাতাতেই হবে। অখিলবাবুকে বাঘের খবরটা দেওয়াতে তিনি ঘটনাটা দেখতে পেলেন না বলে খুব আপসোস করলেন।

‘আমিও ভাবছি কালই বেরিয়ে পড়ব,’ বললেন অরুণবাবু, ‘অবিশ্যি যদি আপনার তদন্ত শেষ হয়ে থাকে।’

ফেলুদা জানাল সব শেষ।—‘আপনার পিতৃদেবের শেষ ইচ্ছা পালনেও কোনো বাধা নেই। সে ব্যবস্থাও হয়ে গেছে।’

অরুণবাবু চায়ের কাপ থেকে দৃষ্টি তুললেন।

‘সে কি, বীরেনের খোঁজ পেয়ে গেছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনার বাবা ঠিকই অনুমান করেছিলেন।’

‘মানে?’

‘তিনি এখানেই আছেন।’

‘হাজারিবাগে?’

‘হাজারিবাগে।’

‘খুবই আশ্চর্য লাগছে আপনার কথাটা শুনে।’

আশ্চর্য লাগার সঙ্গে যে একটা অবিশ্বাসের ভাবও মিশে আছে সেটা অরুণবাবুর কথার সুরেই বোঝা গেল। ফেলুদা বলল, ‘আশ্চর্য ত হবারই কথা, কিন্তু আপনারও এরকম একটা সন্দেহ হয়েছিল, তাই নয় কি?’

অরুণবাবু হাতের কাপটা নামিয়ে সোজা ফেলুদার দিকে চাইলেন।

‘শুধু তাই নয়,’ ফেলুদা বলে চলল, ‘আপনার মনে এমনও ভয় ঢুকেছিল যে মহেশবাবু হয়ত আবার নতুন উইল করে আপনাকে বাদ দিয়ে বীরেনকে তাঁর সম্পত্তির ভাগ দেবেন।’

ঘরের মধ্যে একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব। লালমোহনবাবু আমার পাশে বসে সোফার একটা কুশন খামচে ধরেছেন। প্রীতীনবাবুর মাথায় হাত। অরুণবাবু উঠে দাঁড়িয়েছেন—তাঁর চোখ লাল, তাঁর কপালের রগ ফুলে উঠেছে।

‘শুনুন মিঃ মিত্তির,’ গর্জিয়ে উঠলেন অরুণবাবু, ‘আপনি নিজেকে যত বড়ই গোয়েন্দা ভাবুন না কেন, আপনার কাছ থেকে এমন মিথ্যে, অমূলক, ভিত্তিহীন অভিযোগ আমি বরদাস্ত করব না। —জগৎ সিং!’

পিছনের দরজা দিয়ে বেয়ারা এসে দাঁড়াল।

‘আর একটি পা এগোবে না তুমি!’—ফেলুদার হাতে রিভলবার, সেটার লক্ষ অরুণবাবুর পিছনে জগৎ সিং-এর দিকে।—‘ওর মাথার একগাছা চুলে কাল রাত্রে আমার হাতে উঠে এসেছিল। আমি জানি ও আপনারই আজ্ঞা পালন করতে এসেছিল আমার ঘরে। ওর মাথার খুলি উড়ে যাবে যদি ও এক পা এগোয় আমার দিকে!’

জগৎ সিং পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

অরুণবাবু কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়লেন সোফাতে।

‘আ-আপনি কি বলতে চাইছেন?’

‘শুনুন সেটা মন দিয়ে,’ বলল ফেলুদা, ‘আপনি উইল চেঞ্জ করার রাস্তা বন্ধ করার জন্য আপনার বাবার চাবি লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিবি দেখেছিল মহেশবাবুকে চাবি খুঁজতে। মহেশবাবু হেয়ালি করে তাঁর নাতনীকে বলেছিলেন তিনি কী হারিয়েছেন, কী খুঁজছেন। এই কী হল Key—অর্থাৎ চাবি। কিন্তু চাবি সরিয়েও আপনি নিশ্চিন্ত হননি। তাই আপনি সেদিন রাজরাপ্পায় সুযোগ পেয়ে আপনার মোক্ষম অস্ত্রটি প্রয়োগ করেন আপনার বাবার উপর। আপনি জানতেন সেই অস্ত্রে মত্যু হতে পারে—এবং সেটা হলেই আপনার কার্যসিদ্ধি হবে—’

‘পাগলের প্রলাপ! পাগলের প্রলাপ বকছেন আপনি!’

‘সাক্ষী আছে, অরুণবাবু—একজন নয়, তিনজন যদিও তাঁরা কেউই সাহস করে সেটা প্রকাশ করেননি। আপনার ভাই সাক্ষী—অখিলবাবু সাক্ষী—শঙ্করলাল সাক্ষী।’

‘সাক্ষী যেখানে নির্বাক, সেখানে আপনার অভিযোগ প্রমাণ করছেন কী করে, মিঃ মিত্তির?’

‘উপায় আছে, অরুণবাবু। তিনজন ছাড়াও আরেকজন আছে যে নির্দ্বিধায় সমস্ত সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করবে।’

কৈলাসের বৈঠকখানায় পাখির ডাক কেন? জলপ্রপাতের শব্দ কেন?

অবাক হয়ে দেখলাম ফেলুদা তার কোটের পকেট থেকে প্রীতীনবাবুর ক্যাসেট রেকর্ডার বার করেছে।

‘সেদিন একটি ঘটনা দেখে এবং কয়েকটি কথা শুনে বিহ্বল হয়ে প্রীতীনবাবু হাত থেকে এই যন্ত্রটা ফেলে দেন। নীলিমা দেবী এটা কুড়িয়ে নেন। এই যন্ত্রতে পাখির ডাক ছাড়াও আরো অনেক কিছ, রেকর্ড হয়ে গেছে, অরুণবাবু।’

এইবারে দেখলাম অরুণবাবুর মুখ ক্রমে লাল থেকে ফ্যাকাসের দিকে চলেছে। ফেলুদার ডান হাতে রিভলভার, বাঁ হাতে টেপ রেকর্ডার।

পাখির শব্দ ছাপিয়ে মানুষের গলা শোনা যাচ্ছে। ক্রমে এগিয়ে আসছে গলার স্বর, স্পষ্ট হয়ে আসছে। অরুণবাবুর গলা—

‘বাবা, বীরু ফিরে এসেছে এ ধারণা তোমার হল কী করে?’

তারপর মহেশবাবুর উত্তর—

‘বুড়ো বাপের যদি তেমন ধারণা হয়েই থাকে, তাতে তোমার কী?’

‘তোমার এ বিশ্বাস মন থেকে দূর করতে হবে। আমি জানি সে আসেনি, আসতে পারে না। অসম্ভব।’

‘আমার বিশ্বাসেও তুমি হস্তক্ষেপ করবে?’

‘হ্যাঁ, করব। কারণ বিশ্বাসের বশে একটা অন্যায় কিছু ঘটে যায় সেটা আমি চাই না।’

‘কী অন্যায়?’

‘আমার যা পাওনা তা থেকে বঞ্চিত করতে দেব না তোমাকে আমি।’

‘কী বলছ তুমি!’

‘ঠিকই বলছি। একবার উইল বদল করেছ তুমি বীরু আসবে না ভেবে। তারপর আবার—’

‘উইল আমি এমনিও চেঞ্জ করতাম!’—মহেশবাবুর গলার স্বর চড়ে গেছে; তার পুরোন রাগ যেন আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তিনি বলে চলেছেন—

‘তুমি আমার সম্পত্তির ভাগ পাবার আশা কর কি করে? তুমি অসৎ, তুমি জুয়াড়ী, তুমি চোর!—লজ্জা করে না? আমার আলমারি থেকে দোরাবজীর দেওয়া স্ট্যাম্প অ্যালবাম—’

মহেশবাবুর বাকি কথা অরুণবাবুর কথায় ঢাকা পড়ে গেল। তিনি উন্মাদের মতো চেঁচিয়ে উঠেছেন—

‘আর তুমি? আমি যদি চোর হই তবে তুমি কী? তুমি কি ভেবেছ আমি জানি না? দীনদয়ালের কী হয়েছিল আমি জানি না? তোমার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সব দেখেছিলাম আমি পর্দার ফাঁক দিয়ে। পঁয়ত্রিশ বছর আমি মুখ বন্ধ রেখেছি। তুমি দীনদয়ালের মাথায় বাড়ি মেরেছিলে পিতলের বুদ্ধমূর্তি দিয়ে। দীনদয়াল মরে যায়। তারপর নূর মহম্মদ আর ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়িতে করে তার লাশ—’

এর পরেই একটা ঝুপ শব্দ, আর কথা বন্ধ। তারপর শুধু, পাখির ডাক আর জলের শব্দ।

টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে সেটা প্রীতীনবাবুকে ফেরত দিয়ে দিল ফেলুদা।

মিনিটখানেক সকলেই চুপ, অরি সকলেই কাঠ, এক ফেলুদা ছাড়া।

ফেলুদা রিভলভার চালান দিল পকেটে। তারপর বলল, ‘আপনার বাবা গর্হিত কাজ করেছিলেন, সাংঘাতিক অন্যায় করেছিলেন, সেটা ঠিক, কিন্তু তার জন্য তিনি পঁয়ত্রিশ বছর যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, যত রকমে পেরেছেন প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। তবুও তিনি শান্তি পাননি। যেদিন সেই ঘটনা ঘটে, সেইদিন থেকেই তাঁর ধারণা হয়েছে যে, তাঁর জীবনটা অভিশপ্ত, তাঁর অন্যায়ের শাস্তি তাঁকে একদিন না একদিন পেতেই হবে। অবিশ্যি সেই শাস্তি এভাবে তাঁর নিজের ছেলের হাত থেকে আসবে, সেটা তিনি ভেবেছিলেন কিনা জানি না।’

অরুণবাবু পাথরের মতো বসে আছেন মেঝের বাঘছালটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। যখন কথা বললেন, তখন মনে হল তাঁর গলার স্বরটা আসছে অনেক দূর থেকে।

‘একটা কুকুর ছিল। আইরিশ টেরিয়ার। বাবার খুব প্রিয়। দীনদয়ালকে দেখতে পারত না কুকুরটা। একদিন কামড়াতে যায়। দীনদয়াল লাঠির বাড়ি মারে। কুকুরটা জখম হয়। বাবা ফেরেন রাত্তিরে—পার্টি থেকে। কুকুরটা ওঁর ঘরেই অপেক্ষা করত। সেদিন ছিল না। নূর মহম্মদ ঘটনাটা বলে। বাবা দীনদয়ালকে ডেকে পাঠান। রাগলে বাবা আর মানুষ থাকতেন না…’

ফেলুদার সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। অখিলবাবুও উঠছেন দেখে ফেলুদা বলল, ‘আপনি একটু আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন কি? কাজ ছিল।’

‘চলুন’, বললেন ভদ্রলোক, ‘মহেশ চলে গিয়ে আমার ত এখন অখণ্ড অবসর।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *