ছিদামের পাদুকা-পুরাণ
১
বেচারি ছিদাম! ভগবান তাকে রূপও দেননি৷ জাতে ছিল সে কুমোর, সারাদিন বসে বসে হাঁড়ি-কুড়ি গড়াই ছিল তার ব্যাবসা৷
ছিদামের বউ থাকোমণির মুখ যদি একটু মিষ্টি হত, তাহলেও ছিদাম বরং কতকটা খোশমেজাজে থাকতে পারত৷ কিন্তু ভগবান তার কপালে সে আরামটুকুও লেখেননি৷
গায়ে গয়না পরতে পায় না বলে থাকোমণি উঠতে বসতে বরের সঙ্গে গায়ে পড়ে কোঁদল করে৷ যখন তখন গঞ্জনা দিয়ে বলে, ‘যার এক পয়সা ট্যাঁকে নেই, তার আবার বিয়ে করার আম্বা কেন?’
ছিদামও বুঝত, তার মতন লোকের পক্ষে, বিয়ে করার আম্বাটা হচ্ছে কাঙালের ঘোড়ারোগের মতো৷ তাই সে ঘাড় হেঁট করে, বোবা-কালা ইস্কুলের ছেলের মতন একেবারে চুপ হয়ে বসে থাকত৷
কিন্তু সেদিন তার ভালোমানুষিও থাকোমণির ধারে আর সইল না৷ মুখ বেঁকিয়ে হাত নেড়ে সে বলল, ‘দেখো, তুমি এই লক্ষ্মীছাড়া ব্যাবসাটা ছাড়বে কি না আমাকে আজ স্পষ্ট করে খুলে বলো!’
ছিদাম আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সে কী বউ, জাত ব্যাবসা ছাড়লে যে পেটে দুটো ভাতও জুটবে না! তখন করব কী? ভিক্ষে?’
থাকো বলল, ‘বুদ্ধির ছিরি দেখো না! পোড়া কপাল, ভিক্ষে করতে যাবে কেন? তুমি জ্যোতিষী হবে-লোকের হাত দেখে টাকা আনবে৷’
ছিদাম ভয়ানক চমকে উঠে, কপালে চোখদুটো তুলে বলল, ‘জ্যোতিষী? আমি কুমোরের ছেলে, আমি হব জ্যোতিষী? সে যে দুর্বোঘাসে পাকা লাঠি! বউ, তুমি বলো কী? তোমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?’
থাকো বলল, ‘আমি ঠিক কথাই বলছি৷ ওই দেখো না কেন, পাড়ায় হরি মুকুয্যে জ্যোতিষী হয়ে কত টাকা রোজগার করে, আর তার বউ গায়ে কত গয়না পরে!’
ছিদাম বলল, ‘কিন্তু আমি মোটেই গুনতে শিখিনি যে৷’
থাকো এবার রেগে চেঁচিয়ে বাড়ি মাত করে বলল, ‘দেখো, তুমি আর আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না৷ যদি জ্যোতিষী না হও, আমি তাহলে আজকেই বাপের বাড়ি চলে যাব৷ তখন কে তোমাকে ডাল-ভাত ছত্রিশ তরকারি রেঁধে খাওয়ায়, তা দেখে নেব৷’
ছিদাম বউকে ভারি ভয় করত৷ কাজেই সে তখন কাঁচুমাচু মুখে আস্তে আস্তে বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে আমি না-হয় জ্যোতিষীই হব! কিন্তু গিন্নি, এর চেয়ে মানুষ খুন করাও ঢের সহজ বলে মনে হচ্ছে৷’
২
জ্যোতিষীরা যে পুথি বগলে করে পথের ধারে বসে থাকে, ছিদাম তা দেখেছিল৷ কিন্তু ছিদাম হচ্ছে জাত কুমোরের ছেলে৷ তার কোনো পুরুষে বই কেনেওনি, পড়েওনি-কাজেই তার ঘরে বই-টই কিচ্ছুই ছিল না৷
ছিদাম তখন বুদ্ধি খাটিয়ে, নিজের ছেঁড়া চটিজুতো জোড়া বেশ করে প্রথমে কাপড়ে জড়িয়ে নিল৷ তারপর পুথির মতন করে সেই জুতোজোড়া বগলে পুরল৷ সেই সঙ্গে কপালে একটা মস্ত তিলকও কাটতে ভুলল না৷
কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোতে তার বুকটা ভয়ে দমে গেল৷ শহরের সবাই তাকে চেনে৷ তার এই ভোল ফেরানো দেখলে লোকে বলবে কী?
যাহোক, অনেক করে মনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শেষটা সে মরিয়া হয়ে, যা থাকে কপালে বলে পথে বেরিয়ে পড়ল৷ তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘আমি জ্যোতিষী! আমি জ্যোতিষী! চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের নাড়ির খবর সমস্তই আমার এই পুথিতে লেখা আছে৷’
রাস্তার লোকজনরা সবাই তো হতভম্ব!
কেউ বলল, ‘ছিদামের মাথা খারাপ হয়ে গেছে!’
কেউ বলল, ‘ছিদাম বোধ হয় ঠাট্টা করছে!’
কেউ বলল, ‘ছিদাম, হাঁড়ি-কুড়ি গড়ায় তোমার কি অরুচি ধরে গেছে ভায়া?’
ছিদাম কিন্তু কারুর কথাই আমলে আনল না৷ সে নিজের মনেই গড়গড় করে হেঁকে যেতে লাগল, ‘আমি জ্যোতিষী! আমি জ্যোতিষী!’
ঠিক সেই সময়ে রাজার জহুরি পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ প্রথমে তিনি রাস্তার গোলমালে কান পাতলেন না,-কারণ সেদিন তিনি ভারি একটা বিপদে পড়ে অন্যমনস্ক হয়েছিলেন৷ তাঁর ঘরে রাজার একখানা দামি মানিক ছিল, কাল সেখানা চুরি গেছে! এখন রাজা যদি সে-কথা জানতে পারেন, তাহলে তাঁর দশা কী হবে?’
হঠাৎ ছিদামের চিৎকার তাঁর কানে গেল! তিনি অমনি তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে বললেন, ‘সত্যিই কি তুমি জ্যোতিষী?’
ছিদাম বুকে ভয়, মুখে সাহস নিয়ে বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর! আমার এই পাদুকা-পুরাণে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানে একেবারে হাতে ধরা আছে৷’
জহুরি চুপিচুপি বললেন, ‘দেখো আমার ঘর থেকে রাজার মানিক চুরি গেছে৷ সেই মানিক এখন কোথায় আছে যদি তুমি তা বলতে পারো, তাহলে পাঁচ হাজার টাকা বকশিশ পাবে৷ না পারলে জোচ্চোর বলে রাজার কাছে তোমাকে ধরিয়ে দেব৷ কাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা করে, তোমাকে সকল কথা বলতে হবে৷’
ছিদামের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়ল৷ সে বুঝল থাকোমণির কথায় জাল-জ্যোতিষী সেজেই আজ তাকে এই বিষম মুশকিলে ঠেকতে হল৷ আপনাকে সামলাতে না পেরে সে বলে বসল, ‘ছি ছি, মেয়েমানুষ কী ভয়ানক জাত! নিজের স্বামীকে বিপদে ফেলতেও তাদের মনে দয়া হয় না৷ ধিক!’
আসল ব্যাপারটা কী জানো? স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে তাঁকে জব্দ করবার জন্যেই জহুরির স্ত্রী মানিকখানা লুকিয়ে রেখেছিল৷ জহুরি ভুলেও একবার সে সন্দেহ করেননি! কিন্তু চোরের মন কিনা! তাই জহুরি যখন বাইরে বেরিয়ে গেলেন, তখন তিনি থানায় খবর দেন কি না জানবার জন্যে জহুরির স্ত্রী নিজের এক বিশ্বাসী দাসীকে স্বামীর পিছনে পিছনে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ দাসী এতক্ষণ ভিড়ের ভিতরে লুকিয়ে থেকে ছিদাম আর জহুরির কথাবার্তা শুনছিল৷ কিন্তু ছিদাম যখন বলল, ‘ছি ছি! মেয়েমানুষ কী ভয়ানক জাত’,-দাসী তখন মনে করল, ছিদাম আসল চোরের কথা নিশ্চয়ই জানতে পেরেছে৷ সে আর দাঁড়াল না, একছুটে বাড়িতে ফিরে জহুরির বউকে সব কথা খুলে বলল৷
জহুরির স্ত্রীর বুকের রক্ত যেন শুকিয়ে গেল৷ ভয়ে শিউরে সে বলে উঠল, ‘দাসী, উনি জানতে পারলে যে আর রক্ষে রাখবেন না! জ্যোতিষী নিশ্চয়ই কাল সকালে এসে সব কথা ওঁকে বলে দেবে৷ যা, যা-তুই শিগগির একখানা পালকি ডেকে আন, আমি এখনই জ্যোতিষীর বাড়ি যাব৷’
ছিদাম ততক্ষণে বাড়ি ফিরে এসে, দাওয়ার উপরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে৷ কাল তাকে জেলে যেতে হবে, এই ভাবনায় এখন থেকেই সে অস্থির হয়ে উঠেছে৷
এমন সময় জহুরির স্ত্রী এসে পালকি থেকে নেমে ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল৷
ছিদাম ভারি আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘কে আপনি?’
জহুরির স্ত্রী তখন তাকে সব কথা খুলে বলল৷
শুনে ছিদামের ধড়ে প্রাণ যেন আস্তে আস্তে আবার ফিরে এল৷ সে মস্ত ওস্তাদের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘হুঁ, আমি সব কথা জানতে পেরেছি বটে৷ আপনি আমার কাছে না এলে কাল সকালেই আমি জহুরিমশায়ের কাছে গিয়ে সমস্ত বলে দিতাম৷ আপনি যদি বাঁচতে চান, তবে এখুনি বাড়ি গিয়ে আপনার স্বামীর মাথার বালিশের নীচে মানিকখানা রেখে দিন গে যান৷ নইলে আপনাকে আমি ধরিয়ে দেব৷’
জহুরির স্ত্রী তখন ছিদামকে অনেক টাকা বকশিশ দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল৷
পরের দিন সকালে ছিদাম জহুরির বাড়ি গিয়ে হাজির৷
জহুরি বললেন, ‘কী হে, খবর কী?’
ছিদাম ‘পাদুকা-পুরাণে’র ওপরে হাত বোলাতে বোলাতে তিনবার ফুঁ দিয়ে বলল, ‘হুজুর, মানিক আপনার বালিশের নীচেই আছে৷’
জহুরি অবিশ্বাস করে বললেন, ‘কী! আমার সঙ্গে ঠাট্টা?’
ছিদাম আপনার কাপড়ে মোড়া জুতোজোড়া কপালে ছুঁইয়ে বলল, ‘হুজুর, ছি ছি পাদুকা-পুরাণের কথা মিথ্যে হবার জো কী! পেত্যয় না হয়, আপনি গিয়ে বরং স্বচক্ষে দেখে আসুন৷’
জহুরি অগত্যা বাড়ির ভেতরে গেলেন৷ খানিক পরে আহ্লাদে আটখানা হয়ে ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে বললেন, ‘ওঃ, অবাক কারখানা! ছিদাম, তোমার মতো জ্যোতিষী এ রাজ্যে আর কেউ নেই!’
ছিদাম আসল কথাটা তুলে বলল, ‘হুজুর, আমার বকশিশের পাঁচ হাজার টাকাটা-‘
জহুরি বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আলবত! এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি৷’
৩
দেশে দেশে জ্যোতিষী ছিদামের নাম ঢাক পিটে গেল৷ কিন্তু যত নাম-ডাক বাড়ে, ছিদামের ভয়ও ততই বাড়তে লাগল৷ কে জানে কোথায় দিয়ে কখন আবার কী বিপদ ঘাড়ের ওপরে এসে পড়বে, তখন কী হবে?
জ্যোতিষীর ব্যাবসাটা ছেড়ে দিতে পারলে ছিদাম হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে পারত৷ কিন্তু জহুরির কাছ থেকে বকশিশের টাকা পেয়ে, থাকোমণির লোভ আরও দশগুণ বেড়ে গেছে৷ তার গায়ে অনেক গয়না হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে তার আর মন উঠছে না৷ সে এখন প্রকাণ্ড সাতমহলা অট্টালিকায় দাস-দাসী নিয়ে বড়োলোকের গিন্নির মতো থাকতে চায়৷ কাজেই ছিদাম জ্যোতিষীর কাজ ছাড়তে চাইলেই সে-ও শাসিয়ে বলে, ‘তবে চললুম এই বাপের বাড়ি!’
এমনি সময়ে রাজবাড়িতে বিষম এক চুরি হয়ে গেল৷ রাজার মালখানায় চল্লিশ ঘড়া মোহর আর মণিমুক্তো জমা করা ছিল, হঠাৎ একদিন সকালে দেখা গেল ঘড়াগুলো আর ঘরের ভেতরে নেই৷ একদল চোর রাত্তিরে সিঁদ কেটে সেগুলো নিয়ে সরে পড়েছে৷
রাজ্যময় হুলুস্থুল! রাজার বাড়িতে চুরি-সে তো বড়ো সোজা কথা নয়! চারিদিকেই সেপাই-সান্ত্রি ছুটছে-ধর-পাকড় হচ্ছে৷ কিন্তু আসল চোর ধরা পড়ল না, রাজার মেজাজও রেগে চটাং৷ শহর-কোটাল, হাতে মাথা-কাটা যার কাজ, সে চোর ধরতে পারল না বলে রাজার হুকুমে তারই মাথা গেল ঘ্যাচ করে কাটা৷
তারপর মন্ত্রীরাও মাথাটি যখন যায় যায় হয়েছে মন্ত্রী তখন একবার শেষ চেষ্টা করে জোড়হাতে বললেন, ‘মহারাজ, শুনেছি শহরের ছিদাম জ্যোতিষীর ভারি হাতযশ৷ একবার তাকে আনিয়ে দেখলে হয় না?’
জ্যোতিষে-ফোতিষে রাজা একতিলও বিশ্বাস করত না৷ তবু তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, এও আর বাকি থাকে কেন? নিয়ে এসো ছিদামকে৷’
খানিক পরেই একদল পাইক ছিদামকে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এল৷ সারা পথ বলিদানের পাঁঠার মতো সে এমন ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এসেছে যে, তার বগল থেকে পাদুকা-পুরাণখানা কখন কোথায় খসে পড়ে গেছে, তা সে টেরও পায়নি৷
রাজার সুমুখে এসে ছিদামের ঘটে যেটুকু বুদ্ধি ছিল সেটুকুও গেল উবে৷ সে একেবারে রাজার দু-পা জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মহারাজ, আপনার পাইকরা বিনিদোষে আমাকে ধরে এনেছে৷’
রাজা বললেন, ‘আমার মালখানা থেকে চল্লিশ ঘড়া মোহর আর মণিমুক্তো চুরি গেছে, তার খবর রাখো কিছু?’
ছিদাম ঢোক গিলে বলল, ‘মহারাজ, আমি তো সেগুলো চুরি করিনি, আমাকে ছেড়ে দিতে আজ্ঞা হয়৷’
রাজা বললেন, ‘না, চুরি করনি বটে, কিন্তু তুমি জ্যোতিষী-তোমাকে গুণে চোর ধরে দিতে হবে৷ যাও, তোমাকে সাত দিন সময় দিলাম৷ এর মধ্যে চোর ধরতে পারলে তোমাকে লাখ টাকা বকশিশ দেব, না পারলে নেব গর্দান৷’
আর সাত দিন! তার পরে?-ওঃ, বাপ রে! ভাবতেও ছিদামের বুকটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল৷ সে ভেউভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে গেল৷
ছিদামকে কাঁদতে কাঁদতে আসতে দেখে থাকোমণি বলল, ‘ওকী, কাঁদছ কেন?’
ছিদাম চুপ করে দাওয়ায় বসে পড়ে বলল, ‘গর্দান যাবে শুনলে কার মুখে হাসি আসে?’ এই বলে সে নিজের বিপদের কথা বউকে সব জানাল৷
থাকো বলল, ‘তার জন্যে আবার কচি খোকার মতো কান্না কেন? গুনে-টুনে চোর ধরে দাও৷’
ছিদাম বলল, ‘ক খ পড়তে পারি না, আমি আবার গুনব? কুমোর যে গণক হয় না তা কি তুমি জানো না? না গিন্নি, আমি গুনবও না, গর্দানও দেব না-আমি এদেশ ছেড়েই দেব লম্বা৷’
থাকো খেঁকিয়ে উঠে বলল, ‘পালাবে? ভারি আবদার যে! জানো তাহলে আমি নিজেই রাজবাড়িতে গিয়ে তোমার পালানোর খবর দিয়ে আসব৷’
ছিদাম হাল ছেড়ে দিয়ে ফোঁশ করে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, ‘সিঁথের সিঁদুর যেদিন মুছবে, থানকাপড় যেদিন পরবে, মাছচচ্চড়ি যেদিন খেতে পাবে না, সেইদিন তুমি আমার দুঃখ বুঝবে-তার আগে না৷’
৫
এদিকে চোরের দল বেজায় মুশকিলে পড়ে গেছে৷ তারা মোহর আর মণিমুক্তো ভরা ঘড়াগুলো শহরের একটা পচা এঁদো পুকুরের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে বটে, কিন্তু ধরা পড়বার ভয়ে সেগুলো নিয়ে শহর থেকে আর পালাতে পারছে না৷
তারপর চোরেদের সর্দার যখন শুনল যে ছিদাম জ্যোতিষীর হাতে চোর ধরবার ভার পড়েছে তখন ভয়ে তার পেটের পিলে গেল চমকে৷ সে সাত-পাঁচ ভেবে দলের একটা লোককে ডেকে বলল, ‘ওহে আজ সন্ধের সময় তুমি ছিদামের ঘরের পাশে লুকিয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনবে- আমাদের কথা সে টের পেয়েছে কি না?’
সন্ধের সময় একটা চোর গিয়ে ছিদামের ঘরের জানলার পাশে জুজুবুড়ির মতন গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷
ছিদামের মাথায় তখন খালি এক কথাই ঘুরছে-ফিরছে-সাত দিন-মোটে সাত দিন- তারপরেই তার আশা-ভরসা সব ফরসা! বিশেষ সাত দিনই বা কোথায়? সাত দিনের এক দিন তো আজকেই ফুরিয়ে গেল বলে৷
থাকো তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী গো অতখানি মস্ত হাঁ করে ভাবছ কী? চুরির কথা?’
ছিদাম গুম হয়ে বলল, ‘হুঁ’৷ তার পর দিনগুলো মনে রাখবার জন্যে দেয়ালে সে খড়ি দিয়ে সাতটা দাগ কেটে একটা দাগ মুছে দিয়ে বলল, ‘সাতের এক যেতে আর দেরি নেই, বাকি রইল ছয়৷’
এখন দৈবগতিকে চোরের দলেও লোক ছিল মোট সাত জন৷ জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে চোরটা যখন শুনল, ছিদাম বলছে সাতের এক যেতে আর দেরি নেই, তখন সে ভাবল ছিদাম নিশ্চয়ই গণনা করে তার কথা জানতে পেরে তাকে ধরতে আসছে৷ তার মনে ভারি ভয় হল৷ সে একেবারে একদৌড়ে সর্দারের কাছে গিয়ে হাজির৷
সর্দার বলল, ‘কীরে হাপরের মতন হাঁপাচ্ছিস কেন?’
চোর বলল, ‘সর্দার, সর্দার! ছিদাম সব টের পেয়েছে! আর একটু হলেই আমি ধরা পড়েছিলাম আর কী?’
সর্দার বলল, ‘বলিস কীরে? সব কথা খুলে বল তো শুনি?’
চোর তখন সব কথা খুলে বলল৷
সর্দার বলল, ‘উহুঁ আমার বিশ্বেস হচ্ছে না! হয়তো তুই ভুল শুনেছিস৷ আচ্ছা, কাল তোরা সন্ধের সময় দুজনে গিয়ে ছিদামের ঘরের পাশে লুকিয়ে থাকবি৷’
পরের দিন সন্ধের সময়েও ছিদাম বিমর্ষ হয়ে এককোণে বসে ভাবছিল আকাশ-পাতাল কত কী!
থাকো বলল, ‘কীগো, এত যে ভাবছ কিনারা কিছু হল?’
ছিদাম দেয়ালের আর একটা খড়ির দাগ মুছে দিয়ে বলল, ‘কিনারা আর কী করব, সাতের দুই যেতে আর দেরি নেই, বাকি রইল পাঁচ৷’
যেমনি এই কথা শোনা, ছিদাম ধরতে আসছে ভেবে অমনি চোর দুজনও সে মুল্লুক ছেড়ে দে চম্পট৷
সেদিনও সর্দারের মনের ধোঁকা গেল না৷ বলল, ‘এতগুলো টাকা কি ফস করে ছাড়া যায়? আর একবার দেখা যাক৷ কাল তোরা তিন জনে যাবি৷’
সেদিনও ওই ব্যাপার৷ সর্দার শুনল যে, ছিদাম বলেছে, ‘সাতের তিন যেতে আর দেরি নেই, বাকি রইল চার৷’
আতঙ্কে সর্দারের অমন যে মোটাসোটা নাদুস-নুদুস ভুঁড়ি, তাও চুপসে হয়ে গেল এতটুকু৷ সে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘বাবা প্রাণ থাকলে অমন ঢের টাকা রোজগার করতে পারব৷ চলো ভাইসব, আমরা ছিদামের পায়ে ধরে মাফ চাইগে চলো৷’
ছিদাম সেইদিন থেকে শয্যা নিয়েছে-সে বুঝল আর তার বাঁচবার কোনোই আশা নেই৷
অনেক রাত্রে হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল৷
‘মরছি নিজের জ্বালায়, এত রাত্রে আবার কড়া নাড়ে কে রে বাপু!’ এই বলে ছিদাম বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে সদর দরজা খুলে দিল৷
কিন্তু দরজা খুলেই ছিদাম দেখে সামনেই কালো মুষ্ক সাত-সাতটা ষণ্ডা চেহারা৷
সে আঁতকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরে বাপ রে ডাকাত! চৌকিদার, চৌকিদার!’
কিন্তু চোরেরা সাত জনেই একসঙ্গে ছিদামের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ছিদামবাবু! দোহাই আপনার চৌকিদার ডেকে আমাদের ধরিয়ে দেবেন না৷ আমরা আপনার কাছে মাফ চাইতে এসেছি৷’
ছিদাম আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘মাফ? কেন?’
সর্দার একে একে সব কথা বলল৷
ছিদাম যেন আকাশ থেকে পড়ল৷ কিন্তু মনের ভাব লুকিয়ে বুক ফুলিয়ে সে কড়া সুরে বলল, ‘তবে রে শয়তানদের দল৷ আমি ছিদাম জ্যোতিষী-ছি ছি, পাদুকা-পুরাণের আগাগোড়া আমার মুখস্থ, আমার সঙ্গে চালাকি? বল শিগগির ঘড়াগুলো কোথায় লুকিয়ে রেখেছিস?’
সর্দার হাত জোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে চণ্ডীতলার ওই তালপুকুরের উত্তুর কোণে৷’
ছিদাম বলল, ‘এখন ভালো চাস তো এ-রাজ্যি ছেড়ে সরে পড়৷ কিন্তু খবরদার ফের যদি সে টাকার ওপরে লোভ করিস তবে তোদের ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াব৷’
৬
ভোর না হতেই ছিদাম গুটিগুটি রাজবাড়িতে গিয়ে উঠল৷
রাজা বললেন, ‘খবর ভালো?’
ছিদাম বলল, ‘আজ্ঞে না মহারাজ! এ কদিন অষ্টপহর ছি ছি পাদুকা-পুরাণ ঘেঁটে আমি বুঝলাম যে, এ-যাত্রা আপনি একসঙ্গে চোর আর চোরাই মাল দুই-ই পাবেন না৷ হয় চোর নয় ঘড়াগুলো-এ দুইয়ের কোনটা আপনি চান?’
রাজা বললেন, ‘চোর ধরতে পারি তো ভালোই-নইলে সেই মোহর আর মণিমুক্তো ভরা চল্লিশটা ঘড়াই আমি আগে চাই৷’
ছিদাম বিড়বিড় করে কী পড়তে লাগল, ‘ওঁ-ওঁ-ওং, হুসহুস-ভুসভুস-বোঁ বনবন সোঁ সনসন-হিং টিং ফট আয় চটপটে লাগে ভোজবাজি চোর ব্যাটাদের কারসাজি, ঠিক দুপুরে রোদ্দুরে তালপুকুরের উত্তুরে-কার আঁজ্ঞে না পাদুকা-পুরাণের আঁজ্ঞে-মহারাজ! শিগগির লোক পাঠান, চণ্ডীতলার তালপুকুরের উত্তুর কোণে আপনার চল্লিশটা ঘড়াই পাবেন৷’
তখনই দলে দলে সেপাই-সান্ত্রি চণ্ডীতলার তালপুকুরে ছুটল৷ খানিক পরেই তারা পুকুর থেকে সত্যিসত্যিই চল্লিশটা ঘড়া তুলে নিয়ে ফিরে এল৷
ছিদামও হাঁপ ছেড়ে লাখ টাকা বকশিশ নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরের দিকে চলল-তার মুখে হাসি আর ধরে না৷
গায়ে দু-সেট গয়না হল, সাতমহলা বাড়ি হল, দাসদাসী গাড়িঘোড়া হল, তবু কিন্তু থাকোমণির সাধ মিটল না৷ যতদিন না রাজরানি হয়, ততদিন তার মনে আর সুখ নেই৷
কাজেই দু-দিন না যেতে যেতেই সে আবার ছিদামকে গিয়ে বলল, ‘দেখো, তোমাকে আরও টাকা রোজগার করতে হবে৷’
ছিদাম বলল, ‘কেন বলো দেখি?’
থাকোমণি বলল, ‘সেই টাকায় তুমি একটা রাজ্য কিনবে৷ তখন তুমি হবে রাজা আর আমি হব রানি৷’
ছিদাম বলল, ‘একটা রাজ্য কেনবার মতো টাকা আমি পাব কেমন করে?’
থাকোমণি বলল, ‘কেন, আবার জ্যোতিষী হও৷’
ছিদাম সে-কথা হেসেই উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ঢের হয়েছে, গিন্নি, ও-সব কথা ভুলে যাও৷ জ্যোতিষী-টোতিষি এ জীবনে আর হচ্ছি না৷’
থাকোমণি চটে লাল হয়ে বলল, ‘হবে না কী, হতেই হবে৷ নইলে এখনই আমি বাপের বাড়ি চলে যাব৷’
ছিদাম হাঁক দিল, ‘গঙ্গাফড়িং শিং! গঙ্গাফড়িং শিং! গিন্নি বাপের বাড়ি যাবে, পালকি আনতে বলো৷’
গঙ্গাফড়িং শিং দারোয়ান উত্তর দিল, ‘জো হুকুম হুজুর৷’
ছিদাম আবার হাঁক দিল, ‘ওরে আর কে আছিস রে, শিগগির একটা ঘটক-টটক ডেকে আন৷’
থাকোমণি বলল, ‘কেন, ঘটক আবার কী হবে?’
রুপোর গড়গড়ার নলে ফুড়ুক করে একটা টান মেরে ছিদাম বলল, ‘তুমি তো বাপের বাড়ি চললে৷ কিন্তু আমি এত বড়ো বাড়িতে একলা থাকব কেমন করে? তাই তোমার বদলে আর একটা বিয়ে করব ভাবছি৷’
থাকোমণির মুখ শুকিয়ে গেল৷ তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, ‘না না, আমি ঘাট মানছি আর কখনো বাপের বাড়ি যেতে চাইব না৷’