ছিঃ
[এই নামে কবিতার বই? এই প্রশ্নটাই উঠে এসেছিল সেদিন।
‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ৫০ বছরের ১০টি শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ বই হিসেবে উঠে আসে। প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়। এবং হতে থাকে সংস্করণ।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে মারাঠি ভাষার চারশো বছর আগের সন্ত কবি তুকারামকে যাঁর কবিতা ব্রাহ্মণেরা জলে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছিল। কিন্তু গল্প শোনা যায় তাঁর কবিতা নদী থেকে উঠে এসেছিল।
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৩। প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। প্রচ্ছদ: সুব্রত চৌধুরী। মূল্য: ২৫ টাকা।]
চাঁদ
বিহার থেকে পালিয়ে আসা শাঁখা পরা যোল বছরের মেয়েটি
পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে চাঁদ দেখতে পেয়ে বললো:
‘এ শালা আমার বরের মতো হারামি, পেছন ছাড়ে না দেখছি’
একজন মাতাল হাঁটছিল, চাঁদ সম্পর্কে মাতালদের মতামত পরিষ্কার
তারা কখনো আকাশে একটা চাঁদ দেখে না, তারা দেখে দুটো
মাতালকে যখন পুলিশ ধরতে এলো, মাতাল বললো, কেন আবার ধরপাকড়
একটা চাঁদ তোমাদের, একটা আমাদের।
কিন্তু কবিরা, বিশেষ করে আধুনিক কবিরা একটু বেশি আশাবাদী
তাদের ধারণা আগামী ৫০ বছরের মধ্যে চাঁদের মাটিতে
ছোট ছোট স্কুল খোলা হবে, সেখানে তাদের কবিতা সিলেবাসে রাখা হবে
চাঁদে কবি সম্মেলন হলে সেখানে তারা আমন্ত্রিত হয়ে কবিতা পড়তে যাবে
চাঁদে যারা কবিতা পড়তে যাবে তাদেরকে গালাগাল দেবে
চাঁদ-বিরোধী লিটল ম্যাগাজিন
চাঁদের নিজের কোন আলো নেই সেটা আমরা ভুলেই গিয়েছি
যেমন ভুলে গিয়েছি কমিউনিস্ট বাড়ির মেয়েদের কিছু অবদমিত ইচ্ছা থাকে
তাদের জীবন হল ওপরে সস্তা শাড়ি নীচে ভীষণ দামি ব্রা
যারা বড়লোক তারা চাঁদকে কেয়ার করে না
শজনে ডাঁটার মতো এক রাগী অধ্যাপিকা বললেন : চাঁদ আর মেয়ে
এই দুটো জিনিশ দেখলে আপনাদের মাথার ঠিক থাকে না।
সর্বহারা এক কৃষক গোধূলিবেলার পুকুরে এসে স্নান করছিল
চাঁদ সোজা নেমে এলো সর্বহারার পুকুরে, চাঁদ সর্বহারাকে জড়িয়ে ধরলো
সর্বহারা চাঁদকে জড়িয়ে ধরলো, তাহলে একেই বলে
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে?
চাঁদ নিয়ে যত ইয়ার্কিই আমরা করি না কেন
যার জীবনে একটুকরো চাঁদের আলো এখনো এসে পৌঁছয়নি
সে জীবন বড় দুঃখের,
সে জীবনে না আছে চাঁদের এপিঠ না ওপিঠ।
সবুজ কবিতা
পৃথিবীকে তোমরা ঠিক কোনদিক থেকে দেখতে চেয়েছিলে?
আমার জানা দরকার।
একজন বললো : আমার জুতোর কারখানা যেদিকে আমি সেদিক থেকে
পৃথিবীকে দেখি ।
একজন বললো : আমার মদের দোকান, কিন্তু আমি মদ খাই না
তবু পৃথিবীকে একটা বড়সড় ভাটিখানা ছাড়া কিছুই মনে হয় না।
আর একজন বললো : পৃথিবীতে আমি পিকনিক করতে এসেছি
কয়েকটা মেয়েছেলে নিয়ে এসেছিলাম, ফেরার সময় কয়েকটা নিয়ে যাবো
ভোগ করতে শিখুন।
আমি বললাম, পৃথিবী থেকে আমরা যত নিয়েছি তার কিছুটাও কি
ফেরত দিতে পারি না?
ঝুনঝুনঅলা বললেন, এ আপনার ছোট মুখে বড় কথা হয়ে গেল
আমার খৈনি ফ্যাকটরি বন্ধ হয়ে গেলে
বিহার, ইউ পি, এম পি, রাজস্থান সব বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি বললাম, এরপর গাছ এতো কমে যাবে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে
আমি বললাম, এরপর পাখি এতো কমে যাবে আকাশকে আর সুন্দর দেখাবে না
আমি বললাম, নদীর জল সারাক্ষণ গরম হয়ে থাকবে,
কেউ নদীতে যাবে না
যা আছে তাতে আমাদের আর মাত্র চল্লিশ বছর চলবে ।
গাছহীন পাখিহীন একটা মুমূর্ষু গ্রহ ঘুরে চলেছে শূন্যে
কেমন লাগবে সেই পৃথিবীকে?
ছিঃ
যারা এক পেগ খেয়ে ডিনার পার্টিতে মেয়েদের কাঁধে হাত রাখে
তারা একটা সন্ধ্যার জন্য অতিমানব হয়ে ওঠে।
এই অতিমানবেরা দু পেগ খেলে এরপর কোথায় হাত রাখবে আমরা জানি না।
হাতের ওপর হাত রাখা খুব সহজ নয়, বলেছেন শঙ্খ ঘোষ
সুতরাং কাঁধে হাত রাখতে রাখতে তারা ভাবে এরপর
ঠিক কোথায় হাত রাখলে খারাপ দেখাবে না।
মানুষের হাত এক অসামান্য অঙ্গ, গাছ থেকে ফুল পেড়ে
একজন আর একজনের দিকে এগিয়ে দিলো
সে কি হাত না থাকলে হতো? অন্ধকারে আমার হাত
খুঁজে বেড়াচ্ছিল একটা মুখ, খুঁজতে খুঁজতে
কান্নাভেজা চোখের কাছে এসে থেমে গেল আমার হাত
অন্ধকারে হাত দিয়ে না ধরলে আমি জানতে পারতাম না
মানুষ অন্ধকারে যত কাঁদে আলোয় তত কাঁদতে পারে না।
ডিনার পার্টিতে অচেনা একটি মেয়ের কাঁধে হাত রেখে কথা বলছেন অধ্যাপক
তাঁর এক হাতে হুইস্কি
কিন্তু যে হাত হুইস্কি ধরে থাকে সে হাত আমরা যেমন ফেলে দিই না।
তেমনি যে হাত অচেনা কাঁধ ধরে আছে সে হাত নষ্ট হয়ে যায় না।
বসন্তের আগে যেমন হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি
তেমনি জাগরণ ও ঘুমের মাঝখানে আমাদের দরকার ডিনার পার্টি
ছিঃ ! তৃতীয় বিশ্বের একটা গরিব দেশের লোক হয়ে
ডিনার পার্টি দেখাচ্ছো? লজ্জা করে না?
ফেমিনিস্টদের জন্য
পৃথিবীর অর্ধেক তোমাদের
অর্ধেক আমাদের।
চাঁদের এ পিঠ তোমাদের
আমাদের ও পিঠ।
দুহাজার বছর ছিল আমাদের
আগামী দুহাজার তবে তোমাদের হোক।
হাতে একটাই রুটি
অর্ধেক তোমার
অর্ধেক আমার
দ্বিতীয় রুটি না আসা পর্যন্ত এটাই নিয়ম।
১৫/১৬টা নারীপুরুষের হাত
১৫/১৬টা হুইস্কির গ্লাস
একসঙ্গে তুলে ধরা হল কিছুটা আকাশে
এসো, গ্রীক কোরাসের মতো বলি : চিয়ার্স, চিয়ার্স।
ছেলেরা তোমাদের জ্বালিয়ে মেরেছে
তারা তোমাদের স্বপ্ন দেখতে দেয়নি।
ওগো অভিমানী, ফুঁসে ওঠা মেয়েদের দল
কিন্তু তোমাদের ছাড়া ছেলেগুলো বাঁচবে কি করে?
শুধু রুটির ওপর
প্রথমে প্রয়োজন রুটি
রুটি খাওয়া হলে মনে হয় একটু মদ হলে ভালো হতো
মদের পর গলা পর্যন্ত উঠে আসে গরম দুঃখ
দুঃখ গরম থাকতে থাকতেই ঢেলে দেওয়া ভালো
সুতরাং দরকার একটি মেয়েকে।
কিন্তু প্রথমে দরকার রুটি
পৃথিবীতে এতো গমক্ষেত, এতো গম, গম থেকে উৎপাদিত আটা
তবু কেন এতো রুটির অভাব?
একটা গোটা রুটির জন্য আজও বসে আছে ইথিওপিয়া
একটা গোটা রুটির জন্য বসে আছে
পাঁচ বছরের বালক তার মা গিয়েছে পাশের গলিতে
এই পাঁচ বছরের বালকটিকে আমার বাবা দেখেছেন
একই গলির মুখে আমি তাকে প্রতিদিন দেখি
ভারতবর্ষ তবে এক ইঞ্চিও ওপরে ওঠেনি?
কিন্তু যারা রুটির সঙ্গে এক বোতল মদ কিনতে পারে
তাদের নাম স্বচ্ছল
মদের পর যারা ঘোড়ায় টানা গাড়ি নিয়ে
মেয়ে কিনতে বেরোয়
তাদের শনিবার দেখা যায় রেসকোর্সে
আমরা যারা মাঠে যাই না, আমরাও তাদের চিনি
পৃথিবীর সর্বত্র তাদের হাসি এবং সানগ্লাস একরকম।
কিন্তু আমাদের প্রথম প্রয়োজন রুটি
আমাদের দ্বিতীয় প্রয়োজন রুটি
তৃতীয় প্রয়োজন রুটি
পৃথিবীতে প্রতিদিন এতো রুটি তৈরি হয়, তবু আমরা রুটি পাই না?
কিন্তু কমরেড এটা তো আপনি মানবেন
মানুষ শুধু রুটির ওপর বেঁচে থাকে না?
বাইশটি পদ্ধতি
একটি মেয়েকে, সভ্যসমাজে, চুম্বন করার বাইশটি পদ্ধতি আছে
তার দু-একটা সবাইকে শিখতে হয়।
দরজা খুলে এগিয়ে আসছে মেঘের মতো ভাসতে ভাসতে—
একজন সুপুরুষ দু পা এগিয়ে তার গালে চুম্বন করলো
আর একজন সুপুরুষ মেয়েটির হাত উল্টে হাত চুম্বন করলো
একজন বয়স্ক ভদ্রলোক মেয়েটির ঠোঁট এবং স্তন স্পর্শ না করে
যেভাবে চুম্বন করলেন তা সত্যি এক বিস্ময়।
একটি কিশোর ছিল, সে মেয়েটির দুগালেই চুমু দিলো
ক্ষমতাবান কিন্তু খুব বেঁটে একজন পুরুষ পা উঁচু করে
মেয়েটির কপাল চুম্বন করলো
এক হাতে হুইস্কি অন্য হাতে মেয়েটির ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হাত, চিয়ার্স
মেয়েটির হাত নামিয়ে এনে ভদ্রলোক কব্জিতে চুমু খেলেন এবং বললেন :
‘অনিন্দিতা এবার একটা ফোকসঙ গাইবে’।
একটি মেয়েকে, সভ্যসমাজে, প্রকাশ্যে চুম্বন করার অন্তত বাইশটি পদ্ধতি আ
সবকটি আমি বলতে পারবো না, ক্লান্ত হয়ে পড়বো ।
মেঘের মতো ভাসমান সেই মেয়েটিকে একটি ছেলে
একটু দূর থেকে লক্ষ করছিলো
সে কোনো চুম্বন করে নি
ছেলেটির হাতে গ্লাস তবু কি সে এই মরপৃথিবীর কেউ না?
আমার মতো ছেলেটিও জানে প্রকাশ্যে বাইশটি
কিন্তু আড়ালে, সভ্যসমাজে, আরো বাইশটি পদ্ধতি আছে
মেয়েটিকে চুম্বন করার।
ডিনার পার্টিতে
একটা সকাল কতটা সুন্দর সেটা নির্ভর করে
আগের রাত কি রকম ছিল তার ওপর।
কি রকম ছিল আগের রাত্রি কাউকে থাপ্পড় মেরেছিলাম?
কার লো-কাট ব্লাউজ আঙুলে টেনে বমি করে দিয়েছিলাম?
কিন্তু আমি কেন থাপ্পড় মারবো আমি কেন বমি করতে যাবো?
কার কতটা লো-কাট সেটা কি আমার বিষয়?
মাননীয় বন্ধুগণ, গতরাত্রে আমি বলতে চেয়েছিলাম
পৃথিবীকে, এই মা-ভূমিকে অন্তত আর একটা সুযোগ দেওয়া হোক
সে তার ছেলেমেয়েদের আবার নতুন করে মানুষ করুক
দশ পেগ মদ খেয়ে একজন বুদ্ধিজীবী আমাকে বললেন :
জ্ঞান দেবেন না, আগে নিজের মাকে সামলান, তারপর
মা-ভূমির কথা বলবেন
আমি থাপ্পড়টা একেই মেরেছিলাম?
একটা সকাল কতটা সুন্দর সেটা নির্ভর করে
আগের রাত কি রকম ছিল তার ওপর।
মাননীয় বন্ধুগণ, গতরাত্রে আমি বলতে চেয়েছিলাম
আকাশকে, আমার পিতার মতো উদার আকাশকে আর একটা সুযোগ দেওয়া হোক
আরো মেঘ আরো বৃষ্টি আরো সবুজে আমাদের পাপ ধুয়ে যাক
ঝলমল করে উঠুক এশিয়া
এক পেগও মদ না খেয়ে উপচে ওঠা লো-কাট ব্লাউজ বললেন :
আপনার পিতা কবে আবার আকাশের মতো উদার হলেন?
তিনি আমার সঙ্গে এবং আমার বোনের সঙ্গে শুতে চেয়েছিলেন
আমি কি এরই ব্লাউজে বমি করে দিয়েছি?
একটা সকাল কতটা সুন্দর সেটা নির্ভর করে
আগের রাত কি রকম ছিল তার ওপর।
ধর্ষণ
মেয়েরা কেন রাস্তায় উত্তেজক পোশাক পরে বেরয়’?
আর পারলেন না মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, সপাটে জবাব দিলেন
তাহলে তো যারা বিকিনি পরে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ধর্ষিত হবার কথা’।
৭ বছরের বালিকাকে নদীর দিকে নিয়ে চলেছো তোমরা কারা?
অন্ধ নারীর হাতে মোমবাতি, সে তোমাদের আলো দিতে এসেছিল
তোমরা তিনজন অপেক্ষমান অন্ধকার ঘরে
সে তোমাদের আলো দিতে এসেছিল! তাহলে আলো ব্যর্থ, ব্যর্থ, ব্যর্থ?
কে যেন বললো : মেয়েদেরই দোষ
রাস্তায় বেরিয়ে মেয়েরা এতো হাসে কেন?ওতে পুরুষ আকৃষ্ট হয়।
হাযরে ! মেয়েরা হাসতেও পারবে না?
কে যেন বললো : ভরসন্ধেবেলায় মেয়েরা ছাদে দাঁড়ায় কেন?
শুনুন, একটি মেয়ে কি পরবে, কিভাবে হাসবে, কোথায় দাঁড়াবে
সেটা তাকেই ঠিক করতে দিলে ভালো হয়
পুরুষ যন্ত্রটি আপনার, আপনি নিজেই ওটার দায়িত্ব নিন।
কোন মেয়ের যদি সুন্দর দুটো পা থাকে, সে একশোবার
পা-খোলা পোশাক পরে রাস্তায় নামবে
আমরা যারা ভালোবাসতে পারলমা না, তারাই
হেমন্তের সন্ধ্যায় হাত ধরার নাম করে বুক ধরতে চেয়েছি ।
শিউলিতলায়, দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শরীর হিম হয়ে আসে
কারা যেন একদিন আমার ছোটবোনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, আবার
রেখেও গিয়েছিল, বোন লজ্জায় মরে যেতে যেতে শিউলিগাছকে
জড়িয়ে ধরতেই নিমেষে রূপান্তরিত হলো গাছে ।
পনেরো বছর বাদে, আজও, একটা দুটো শিউলি ঝরে পড়ে
শিউলির গন্ধ নয়, বোন, তোর সদ্যঃস্নাত চুলের গন্ধ ভেসে আসে।
কোথাও কি সেই পুরুষ আছে যে এই গাছকে ধর্ষণ করতে পারে?
ডিম
প্রথম ডাক্তার বললেন :‘আপনার বেবি তাহলে মাসে পড়লো
ডিম সেদ্ধ করে হলুদ কুসুম খেতে দেবেন’।
দ্বিতীয় ডাক্তার ভালো করে ওজন নিয়ে শান্ত স্বরে বললেন :
‘ডিমের যে অংশটা শাদা, প্রতিদিন দুচামচ করে খাওয়াবেন’ ।
প্রথম ডাক্তার বললেন :
‘ডিম সেদ্ধ করার নিয়ম আছে, গরম এক বাটি জলে
ডিমটা ছেড়ে দিয়ে তুলে নেবেন’।
দ্বিতীয় ডাক্তার বললেন :
‘ডিম সেদ্ধ করার নিয়ম আছে
দশ মিনিট ভালো করে ফোটাবেন’।
হামাগুড়ি দিয়ে উল্টোদিক থেকে ছুটে আসা
আমার ন মাসের পুত্রের দিকে
অসহায় তাকিয়েছিলাম,
সে আমাদের ভাষা বুঝতে শেখেনি, তবু বললাম :
ডিম সম্পর্কে মানবসভ্যতায় এখনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় নি
কিন্তু পরমুহূর্তেই আমার মনে হলো বাক্যটা ভুল
ডিম নয়, ডাক্তার সম্পর্কে মানবসভ্যতায় এখনো সঠিক সিদ্ধান্ত
আমরা নিতে পারি নি।
মাদারফাকার
এ কোন জগতে এসে পড়লাম, এখানে ভালো ভাষায় কেউ কথা বলে না
এতো আকাশ, পায়ের নীচে এতো সুন্দর মাটি, এসব কেউ আর
তোয়াক্কা করে না
মাল মাল আর মাল, ত্রিবেণী মালের কথা আর ভালো লাগে না
মাল মানে মদ, মাল মানে মেয়ে আর তিন নম্বর মাল টাকা
জ্যোৎস্নায় নদীর ধারে বসেও কি তোমরা মালের কথা বলবে?
এতো সুন্দর মাটি, পায়ে লাগছে দুব্বোঘাস, বিন্দু বিন্দু শিশির
যারা চল্লিশ বছর জুতো পরে আছে তারা হয়ত খুবই কাজের মানুষ
তারা জানলো না, এই ঘাস, চল্লিশ বছর বাদে আর জন্মাবে না
কোজাগরীর রাতে বাড়ির বউ নেশা করে অফিসের ফাইলে
বুঁদ হয়ে বসে থাকবে
চল্লিশ বছর বাদে কি আর লক্ষ্মী এসে দাঁড়াবেন
দাঁড়ানোর উঠোন কোথায়?
এ কোন জগতে এসে পড়লাম, একটু ভালো ভাষায় কথা বলে না কেউ
১৯ বছরের ছেলেমেয়েরা কি একটা শব্দ শিখেছে, মাদারফাকার
সেটাই যেখানে সেখানে বলছে, একজনকে যিশুর রক্তঝরা
পায়ের নীচে দাঁড়িয়েও বলতে শুনলাম।
নিজের ছেলেকে আদর করতে করতে চোখে জল চলে আসে
সে এখনো কথা বলতে শেখেনি
কিন্তু যখন শিখবে, তখন কি শিখবে? কোন ভাষায়
সে আমাকে ডাকবে?
১০ হাজার মাইল দূরে মরণাপন্ন বাবার টেলিগ্রাম পেয়ে কি বলে উঠবে :
‘মাদারফাকার’।
নদীর ওপারে
একটি মেয়েই বলেছিল, মেয়েরা মাটিতে পা রেখে দাঁড়াতে ভালবাসে
কদাচিৎ তাদের উনুনে দুধ চল্কে পড়ে।
অথচ আমি এখনো প্রতিদিন তোমাকে বুঝিয়ে চলেছি
নদীর ওপারে একটা ভালো জায়গা আছে।
‘নদীর ওপার বলে কিছু নেই’, একটা বাইশ বছরের মেয়ে
এই কথা বলে হাসতে হাসতে চলে গেল আমার জীবন থেকে।
গাড়ি থেকে নেমে হলুদ শাড়ি বলেছিল
ফেরত দাও আমার চিঠি।
মেয়েরা ঈষৎ উন্মাদ হলে চিঠি লেখে, কিন্তু বেশি উন্মাদ হয়ে গেলে
চিঠি ফেরত নিতে আসে।
মেয়েরা মাটিতে পা রেখে দাঁড়াতে ভালোবাসে
তবু তোমাকে প্রতিদিন বুঝিয়ে চলেছি নদীর ওপারে একটা ভালো জায়গা আছে।
সৃষ্টি
ব্রহ্মা প্রথমে পুরুষ সৃষ্টি করেছিলেন।
পুরুষ সৃষ্টি করার পর তার হাতে কোন উপাদান ছিলো না
যা দিয়ে নারী সৃষ্টি করা যায়।
সুতরাং তিনি বললেন : বাতাস থামো তোমাকে দরকার
বাতাস থামলো।
নদীকে বললেন, নদী দাঁড়াও, তোমার শরীর থেকে
দুটো ঢেউ আমাকে দাও।
ফুল থেকে পাপড়ি
পাপড়ি থেকে রঙ
মাটি থেকে সহ্যক্ষমতা
ময়ূরের থেকে অহংকার
সাপের থেকে ছোবল
মেঘের থেকে মনখারাপ—এইসব উপাদান সংগ্রহ করে
ব্রহ্মা নারী সৃষ্টি করলেন।
সৃষ্টি করে ব্রহ্মা পুরুষকে ডাকলেন, কি তোমার পছন্দ একে?
এতোদিন নিঃসঙ্গ নদীর তীরে বসেছিলে
একে সঙ্গে নিয়ে যাও।
অর্থাৎ আমি মেয়েটিকে নিয়ে চলে এলাম গহন অরণ্যে ।
মেয়েটির চুল স্পর্শ করতে গিয়ে দেখি হু হু করা বাতাস
নদী দিয়েছিল ঢেউ, কই সেই ঢেউ?
কোথায় পাপড়ি? কোথায় মাটি?
রাত্রিবেলায় আমি তাকে বললাম দেখি কোন অংশটা তোমার
ময়ূরের মতো? কোথায় ছোবল?
কোথায়, ঠিক কোথায় মনখারাপ?
আমি কিচ্ছু পেলাম না, সব মিথ্যা, সাতদিন বাদে
মেয়েটিকে ফেরত দিয়ে এলাম।
কিন্তু তিনটে রাতও কাটাতে পারলাম না একা,
মেয়েটিকে আবার নিয়ে এলাম
বন্ধুরা বললো, বৃষ্টির দিন আজ, ওকে ঝাউবনে নিয়ে যা
ময়ূরের মতো অহংকারী নৃত্যে মিলিয়ে গেল ঝাউবনে
আমাকে গ্রাহ্য করলো না।
দু’রাত্রি বাদে ফিরে এলো
আরো রহস্যময়ী হয়ে, চোখে তখন তার নতুন একটা ভাষা
দু’রাত্রি বাদে কোনো মেয়ে বাড়ি ফিরে এলে
কোন মেয়েকেই ভালো লাগে না।
কিন্তু মেয়েটিকে নিয়ে যেতে এলেন স্বয়ং ব্রহ্মা, বললেন,
একটি উপাদান ওর শরীরে নেই, বিষণ্ণতা
বিষণ্ণতাছাড়া কোন নারী সম্পূর্ণ হয় না।
আমি বললাম, এ কিরকম একটা মেয়ে তুমি আমাকে দিয়েছো
আমাকে ভালোবাসে না, হঠাৎ হঠাৎ আমাকে ছেড়ে চলে যায়
ফিরিয়ে নাও, আমি মুক্তি চাই।
মুক্তি চাই ঠিক, কিন্তু তুমি ওকে নিয়ে গেলে কথা বলবো কার সঙ্গে?
রাগ করবো কার ওপর, ঝাউবনে ঘুরে বেড়াবো কি নিয়ে?
আমি তবে কি নিয়ে থাকবো?
উপদেশ যা কিনা গির্জার দেয়ালে লেখা থাকে না
রাজনীতি করবেন না, মিডিওকার লোকেরা রাজনীতি করে
যেখানে সেখানে থুতু ফেলবেন না ওটা বদ অভ্যেস
পরস্ত্রীর সঙ্গে ঝাউবনে যাবেন না, জীবনেও ঝাউবন দেখা হবে না
সকাল সকাল উঠুন, একটু হেঁটে দুধের প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরুন
খবরের কাগজ পড়বেন না, খবর পড়ে পড়ে একটা জাতি পুরো নষ্ট হয়ে গেল।
বেশি খাওয়া ঠিক না, বহুলোক কম খায়
‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামে একটা শব্দ প্রায় শোনা যায় আজকাল
তৃতীয় বিশ্ব মানে আর কিছুই নয় যে সব দেশে
সাপখোপ বেশি আর গরিব লোক বেশি
সেগুলোকে তৃতীয় বিশ্ব বলে
যেমন বাংলাদেশ, ইণ্ডিয়া, ইথিওপিয়া
আমি তৃতীয় বিশ্বের লেখক, ওটা বলবেন না কখনো
ওটা ভুল অহংকার।
মেয়েরা দিকে দিকে প্রেমপত্র লিখুন, কিডনি ভালো থাকবে
সবসময় ধবধবে শাদা অন্তর্বাস পরুন মন ভালো থাকবে
মেয়েরা ভুলেও কখনো আর উচ্ছিষ্ট খাবেন না
স্বামী যদি অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়
সন্তান পালনের কাজে আপনারা পুরুষ বেবি-সিটারের জন্য
আবেদন করুন।
পকেট ভর্তি টাকা পয়সা দরকার
টাকা অনেকভাবে উপার্জন করা যায়
মদের লাইসেন্স না পেলে মাদার ডেয়ারীতে ঢুকে পড়ুন
ব্যবসা মানে ব্যবসা
ধানদুব্বো বিক্রি করলেও লোকে আপনাকে ব্যবসায়ী বলবে
কনডোম বিক্রি করলেও লোকে আপনাকে ব্যবসায়ী বলবে।
এইসব উপদেশ গির্জার দেয়ালে লেখা থাকে না
গির্জা বলছে হে পুত্র এইখানে শান্তি আছে, আলো আছে
তুমি অন্ধকার থেকে উঠে এসো
যিশু নামে যে ভদ্রলোককে গির্জা ভগবান বানিয়েছে, সে বেচারা
আমাদেরই মতো পাঁচ ছটা ভাইবোনের জোয়াল ঘাড়ে নিয়ে
সংসার চালিয়েছে, আর অন্যদিকে বড় বড় পণ্ডিত পুরোহিতরা
লোকটাকে মারার জন্য ষড়যন্ত্র করতো
এইসব পুরোহিতরা এখন আর বেঁচে নেই ভুলেও ভাববেন না
এদের কেউ হয়েছে আমলা কেউ রাজনীতিবিদ কেউ ভাইস চ্যান্সেলর
যারা ক্যারেকটর সার্টিফিকেট লিখে দেয়।
বন্ধুগণ, কাউকে বিশ্বাস করার আগে একটু ঝাঁকিয়ে নেবেন।
সাংকেতিক ভাষা
আমরা সকালবেলায় যতটা সৎ থাকি
সন্ধেবেলায় ততটা থাকতে পারি না
কেন পারি না?
সকালবেলায় যে আলো এসে পড়ে পৃথিবীতে
সে আলো মায়ের স্নেহের মতো
যত খুন হয়, ধর্ষণ হয়, তার বেশিটাই অন্যসময়ে হয়
সকালে হয় না।
আসলে গোধূলি থেকে মানুষ খারাপ হতে শুরু করে
সকালবেলার চোখ আর রাত্রিবেলার চোখ এক নয়, একটু অন্যরকম।
সকালে কয়েকটা সুন্দর ঘটনা ঘটে পরপর
হাঁটতে গেলে পায়ে বকুল এসেলাগে
দুধের প্যাকেট আনতে যেতে হয়, মেয়েকে স্কুলে দিয়ে ফেরত-পথে
কেউ কেউ দু’একটা বকুল কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে আসে
টবে রাখা গাছের পাতা মুছিয়ে দেয়
কেউ কেউ বৃদ্ধ বাবার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকে
রুটিতে মাখন লাগায়।
এরপর রোদ বাড়তে থাকে আর স্নায়ু হয়ে ওঠে গরম
দিনের সর্ব্বোচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছে গেলে আমরা কেউ কাউকে গ্রাহ্য করি না
অদ্ভুত সাংকেতিক ভাষা শোনা যায় চারপাশে
কেউ বলে মালতীলতা, কেউ বলে স্যান্ডউইচ, কেউ বলে পানের বোঁটা
এসব নাকি আজকের যৌন সংকেত, বুঝতে পারি না।
বাড়ি ফেরার পথে বকুল গাছের নীচে দাঁড়াই
যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসছে বকুলের গন্ধ
কিন্তু হঠাৎ ঘাড়ের কাছে একজন ফিসফিস করে বললো,
‘স্যান্ডউইচ না পানের বোঁটা’?
রাত্রি সাড়ে আটটা, ওগো পান, পানপাতা
মানুষ রাত্রি সাড়ে আটটা বাজতেই এতো খারাপ হয়ে যায়?
ছোট ষড়যন্ত্র
আমরা যারা খুব ছোট ছোট ষড়যন্ত্র করি
তারা বড় ষড়যন্ত্র কাকে বলে জানতে পারি না।
প্রেসিডেন্ট দ্য গল-কে প্রথম গুলিটা করা হলো
দ্য-গল ঠিক তখনই, দৈবক্রমে, ঝুঁকে একটি শিশুকে
কি যেন বলতে চাইছিলেন!
বড় ষড়যন্ত্র অনেক বড় ব্যাপার, ও আমরা বুঝবো না ।
ছোট ষড়যন্ত্র করে আমরা অনেক আনন্দ পেয়ে থাকি
ও বাড়ির ঝিকে ভাঙিয়ে আনি রঙিন টিভি দেখিয়ে
যাদের জীবনে রঙ নেই তারা তো রঙচঙে গল্প চাইবেই।
পঞ্চাশ টাকা বেশি দেখিয়ে আমরা অফিসের টি.এ.বিল জমা দিই
পঞ্চাশ টাকা দিয়ে কি হয়?
একজন প্রতিবেশীকে আমি চিনি যিনি তাঁর পাশের বাড়িতে গাড়ি আসার পর
মাঝরাতে উঠে গিয়ে গাড়ির হাওয়া খুলে দিতেন
অথচ পরের দিন সকালে গাড়ির মালিকের সঙ্গে বাজার যেতেন।
বড় ষড়যন্ত্র বুঝি না, কিন্তু ছোট ষড়যন্ত্র করে আনন্দ পাই
সুন্দরী কোনো মেয়ে যদি আমাদের পাত্তা না দেয়
পরিদিনই আমরা তাকে নিয়ে দার্শনিক প্রশ্ন তুলি,
মেয়েটা এতো সিনেমা দেখে কেন?
পরের প্রশ্নটি অবধারিত: সিনেমা কার সঙ্গে দেখে?
এরপরেও অনেক প্রশ্ন আছে, সেগুলো অনুমান করে নিন।
আমরা ছোট ছোট ষড়যন্ত্র করি, বড় ষড়যন্ত্র বুঝতে পারি না
দৈবক্রমে, দ্য-গল ঝুঁকে একটি শিশুকে কি যেন বলছিলেন
গুলিটা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল
কিন্তু বেরিয়ে কোথায় গেল?
আমাদের দিকে আসছে না তো?
নোংরা
নোংরা, আমি তোমাকে হাত দিয়ে ধরেছিলাম
ধরেই বুঝেছি এ আমি কি স্পর্শ করলাম!
জীবন সামলাতে গিয়ে অনেক কিছুই তো ধরে দেখতে হয়
জিভের আগায় নিয়ে জানলাম তুমি নোংরা।
আমি তোমার হাত ধরে বর্ষার রাতে একবার বলেছিলাম, দাও
কিন্তু কি দেবে তুমি আমাকে? বাইরে আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি
জীবনে বাঁচতে গেলে বৃষ্টি দরকার
সেই বৃষ্টি মাথায় করে রাতের খাবার নিয়ে
আমার দিকেই আসছো
তুমি কে? তুমি কে? থাক, নাই দেখলাম।
একটা ভালো ঘটনা ঘটুক যা আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচবো
পৃথিবীর সমস্ত কিছু নোংরা হয়ে যায়নি এখনো।
কিরকম হয়?
তোমার শরীরের কাছে এসে দাঁড়ালে কেন আমার এরকম হয়?
কিরকম হয়?
বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ করে আসে, মেঘের ভেতর থেকে নৌকো বেরিয়ে আসে
আর নৌকো পড়তে থাকে পৃথিবীর দিকে।
চলে এলাম তোমার শরীর থেকে শত ক্রোশ দূরে
এতো দূরেএসেও তবু কেন এরকম হয়?
কিরকম হয়?
সে কি করে বলবো; সব কি বলে বোঝানো যায়?
বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ করে আসে, মেঘের ভেতর থেকে নৌকো…
এবং নৌকো পড়তে থাকে পৃথিবীর দিকে।
মাস্টারমশাই
মাস্টারমশাইদের এই একটা দোষ
তাঁরা ধরেই নেন তাঁরা যা বলবেন সেটাই শেষ কথা।
ক্লাস যখন শুরু হয়েছিল, ভালোই শুরু হয়েছিল
কুড়ি মিনিট বাদে পেছনে দুটি ছাত্র কাটাকুটি খেলতে শুরু করলো।
তিরিশ মিনিট বাদে পেছন থেকে একটা কাগজের বল এসে পড়লো
একটি মেয়ের কোলে, লেখা আছে, ‘হনুমান তোমাকে ভালোবাসে’।
চল্লিশ মিনিট বাদে মাস্টারমশাই যখন বোর্ডে বানান লিখতে লাগলেন
ঘুরে দেখলেন পেছনের বেঞ্চ ফাঁকা, সামনে দুটো মেয়ে বসে আছে।
মাস্টারমশাইদের এই একটা দোষ, অর্ধেক একটা হাসি হেসে ভাবলেন :
দুটো মেয়ে তো শুনছে, আমি তো মরুভূমির ভেতর দাঁড়িয়ে নেই।
তঞ্চকনগর
তোমার গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত আমি চিনি, আমাকে মিথ্যা বলো না
পৃথিবীতে এখনো অসংখ্য নদী
নদীর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকার সময় এখনো আসেনি
মিথ্যা বলতে আমার খারাপ লাগে
মিথ্যা শুনতে আমার খারাপ লাগে
সুবর্ণরেখার পাড়ে দাঁড়িয়ে আমাকে মিথ্যা বলো না।
তঞ্চকনগর নামে এক আজব.জায়গা ছিল একদিন
সেখানে বাবা ছেলেকে বিশ্বাস করতো না
মা তার মেয়েকে কখনো পাশের বাড়ি পাঠাতো না
একই পুরুষের বাঁ কানে কথা বলতো মেয়ে
ডান কানে কথা বলতো মা
সেই আজব নগরে এলো এক সত্যভাষী বালক
এ কোন নগরে সে এলো?
যেখানে বালকের কথাও কেউ বিশ্বাস করে না।
সেই বালক দুপুররোদে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতো।
বহুদিন বাদে আমরা সুবর্ণরেখার তীরে এসে দাঁড়িয়েছি
আমি জানতে চাই না তোমার অতীত
আমি জানতে চাই না কোন্ তিন নাবিকের সঙ্গে তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে
যে আলো নদীর ওপারে এসে পড়েছে
সেই আলো এপারে আসবে না?
আমাদের আলো দরকার, আলো…আলো…
আমি তোমার ঠোঁট কামড়ে ধরি
আমি তোমার মুখগহ্বর কামড়ে ধরে বলি
বলো আর কোনদিন আমাকে মিথ্যা বলবে না, কোনদিন না?
বউ ছেড়ে যায় যাদের
তাদের কেউ যায় পাহাড়ে, কেউ সমুদ্রে, কেউ বেশ্যাখানায়
কেউ গহন অরণ্যে
পাহাড়ে, পাইন গাছের নীচে বসে চোখের জল ফেলে
সমুদ্রে, ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সাত দিন সাত রাত
বেশ্যাখানায়, দরজা ধরে কাঁদে
গহন অরণ্যে, তিমির বিলাসী পথ, পথের ওপর একদিন ঘুমিয়ে পড়ে।
অথচ বেশ কয়েক লাখ পুরুষ আছে যাদের বউ ছেড়ে গেছে
তবু তারা কোথাও যায় না।
পাহাড়ে যায় না
সমুদ্রে যায় না
বেশ্যাখানায় যায় না
তারা একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করে
কেউ কেউ মোমবাতি নিভিয়েও অপেক্ষা করে
এই জ্বালানো আর নেভানোর মাঝখানে তাদের চোখ ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে
খামচে ধরে মাটি, কিন্তু মাটি হলো মা
মা বলে, খোকা আমার চুল ছেড়ে দে, লাগছে
আর অপেক্ষা করিস না, তোর বউ কোনদিন ফিরবে না।
তিনটি উপাদান
সেটা ছিল একটা সাংঘাতিক রাত্রি
জঙ্গল এবং নদী এবং পাহাড় এবং আকাশ নিয়ে সে এক সাংঘাতিক রাত্রি।
আমরা তিনটি ছেলে নদী দেখতে এসে দেখতে পেলাম নদীর পাড়ে
বসে থাকা একটি মেয়েকে, সে মোজা সমেত পা ডুবিয়ে দিয়েছে জলে
আমরা তার খুব কাছে গেলাম, কিন্তু কথা বলতে সাহস পেলাম না
জলে ভেজা তার পায়ের মোজা দেখে মনে হলো সে এই পৃথিবীর কেউ না।
আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম মদ খেয়ে, কিন্তু মনে হলো
পুরোটা জঙ্গল যেন মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে
গাছের নীচে ঘুঙুরের আওয়াজ, গিয়ে দেখলাম সেই মেয়েটি
কাছে গেলাম তবু সাহস হলো না
তার পায়ের ঘুঙুর দেখে মনে হলো সে এই পৃথিবীর কেউ না।
ভোর রাত্রে আমরা এলাম আকাশ এবং পাহাড়ের ঠিক মাঝখানে
যেখানে মেয়েটি শেষ রাতের চাঁদকে ডাকছিল
জ্যোৎস্না জ্যোৎস্না এবং জ্যোৎস্না
মনে হলো মেয়েটির শরীরে মাত্র তিনটি উপাদান, জল বালি আর জ্যোৎস্না
জল ধরে রাখা যায় না
বালি তুমি শুধু বালি
জ্যোৎস্না এই আছে এই নেই
আমরা কাছে গেলাম কিন্তু সাহস হলো না।
টলতে টলতে ফিরে এলাম বাংলো
আমি বললাম, জলকে আদর করা যায় না
বাঁদিকের বন্ধু বললো, বালিকে জড়িয়ে ধরা যায় না
ডানদিকের বন্ধু বললো, জ্যোৎস্না কী সাংঘাতিক, ভালোবাসা যায় না।
আদর করা যায়, জড়িয়ে ধরা যায়, ভালোবাসা যায়
এরকম একটি মেয়েকেই আমরা চেয়েছিলাম
মুগ্ধ ভিখিরির মতো তাকিয়েছিলাম মেয়েটিরদিকে
যার শরীরে মাত্র তিনটি উপাদান—জল বালি আর জ্যোৎস্না।
কথা বলো তৃণমূল
এতোদিন আমরা কথা বলে এলাম
এবার তোমরা কথা বলে, তৃণমূল।
আটশো টাকার জুতো তুমিই কথা বলে এলে
তোমার নীচে পড়ে থাকা মানুষ এবার কথা বলবে ।
মরচে পড়া পেরেক, ভাই, কথা বলো
এতোদিন শুধু হাতুড়ি কথা বলে এসেছে।
এতোদিন দিকে দিকে ফর্সা মেয়েরা কথা বললো
এবার কালো মেয়েরা কথা বলবে।
কাঁটা-চামচ কথা বলেছে সারাপৃথিবীতে
এবার মানুষের আঙুল কথা বলবে।
গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে এসেছে যারা
তারাই এতোদিন কথা বলে এলো
এবার পোড়া গ্রামে পোড়া বাড়ি থেকে
পোড়া মানুষ বেরিয়ে এসে কথা বলবে।
রুমাল
গরিব হলো বড়লোকের পাপ মোছার রুমাল
কথাটা পনেরোশো বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের একটা লোক
বলে গিয়েছিল।
আমি ভুরু কুঁচকে ভাবছিলাম
তখনো পৃথিবীতে গরিবলোক এবং বড়লোক নিয়ে এতো
মেরুবিভেদ ছিল?
ছিল সেই দুই শ্রেণী
একটা মারতো আর একটা মার খেতো।
সেটা এখনো যে খুব একটা পালটেছে তা মনে হয় না।
ধুতি পরা মোটাসোটা একটা লোক চেয়ারে বসে বলছে:
যা ওর খেত থেকে ধান কেটে নিয়ে আয়
দশজন লোক ছুটলো ধান কাটতে
যা বস্তিতে আগুন দিয়ে আয়
দশজন ছুটলো কেরোসিন নিয়ে।
একজন জুতো পালিশ করে দেয়
অন্যজন সেটা পরে মচমচ করে হেঁটে বেড়ায়
একজন গাড়ি সারিয়ে দেয়
অন্যজন গাড়ি নিয়ে পানশালার দিকে ছুটে যায়।
এই দুই শ্রেণী আগেও ছিল এখনো আছে
কিন্তু মহম্মদ কি করে বুঝেছিলেন
গরিব হলো বড়লোকের পাপ মোছার রুমাল?
মারো আমায়
তোমাকে যখন সুন্দর লাগে, তখন আমার হাতে কোন নোংরা লাগে না।
একটি বালককে মারতে মারতে নিয়ে চলেছো, তোমরা কারা?
পৃথিবী তো এতো নিষ্ঠুর ছিল না
আমি আকন্ঠ ডুবে আছি হরিনাভির গন্ধে
একটা বাচ্চা ছেলের পিঠে চলেছে কিল চড় ঘুষি
এই নাও আমার পিঠ, মারো এখানে, আমার লাগবে না।
সহস্র এক ফণা ছিল আমার ভেতর, তুমি তাদের সহস্র এক চুমু খেলে
সহস্র এক বছর বাদে এই প্রথম তারা ঘুমোলো
কিন্তু আমি জেগে
পাশের বাড়ির জানলায় তোমরা কারা, পাশের বাড়ির ক্ষতি করো না
ক্ষতি যদি করতেই হয় করো আমার, আমার এখন গায়ে লাগবে না।
আমি এখন আকন্ঠ জলে, আকন্ঠ স্থলে, সুরায়
মাটি যেন আকন্ঠ উঠে এসেছেন
নদীর তলায় আমার জুতো, নদীর পাড়ে আমার জামা
গাছের মাথায় একটা মোজা, আর একটা মোজা আকাশ দিয়ে
চলেছে ছায়াপথে।
আমি কি কিছু বোঝাতে পারলাম? তার মানে আমি ন্যাংটো
ন্যাংটোর আবার ভয় কিসের?
বালকটিকে তোমরা মেরো না
মারো আমায়, এখন আমি যে কোন আঘাত সহ্য করতে পারবো।
জ্যোৎস্না
কোন মেয়ের কাছে আমার দুঃখ করতে ভালো লাগে না
মেয়েরা কয়েকশ’ বছরের দুঃখের বোঝা কাঁধে নিয়ে পৃথিবীতে আসে।
মা রাত জেগে বসে আছে, সারারাত কাশছে
আমার দুঃখের কথা তোমাকে বলতে চাই না মা, আমি ঠিক আছি
আমার বোন পথ চেয়ে বসে আছে তার স্বামীর অপেক্ষায়
আমি জানি তার স্বামী ফিরবে না
বোন, আমি তোকে কি করে বোঝাবো আমি তোর যোগ্য সহোদর
এখনো হতে পারিনি।
রিপন স্ট্রিটের চোদ্দ বছরের বাচ্চা মেয়েটা
সানগ্লাস পরে, আমার সামনে এসে দাঁড়ালো
বললো, ‘ফাক মি আংকেল’
আমি আর কোন্ ভাষায় তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো?
কয়েকশ বছরের দুঃখের বোঝা নিয়ে এই মেয়েটি এসেছে
বাবা অন্যনারী নিয়ে
মা আছে আরেক পুরুষ নিয়ে তারই পাশের ঘরে
যে ছেলেটির সে বন্ধুত্ব চেয়েছিল
সে তাকে দ্বিখণ্ড করে চলে গেছে মারুতি চালিয়ে।
কলাপাতার মতো ঝলমলে আর একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হলো
আমি তাকে সারা সকাল, সারা দুপুর, সারা বিকেল
আমার দুঃখের কথা বললাম, যা আমি বলি না
সূর্যাস্তের পর সে তার ব্লাউজ খুলে দেখালো
বাঁদিকের স্তন, একেবারে পোড়া, আমি মুখ সরিয়ে নিলাম
গত বিজয়া দশমীর রাতে স্বামী অ্যাসিড ঢেলে পালিয়ে গিয়েছে।
কয়েকশ’ বছরের বোঝা নিয়ে মেয়েরা জন্মায়
যে সব মেয়েরা জ্যোৎস্নায় নদীর দিকে বেড়াতে যেতে চেয়েছিল
এখন তারা কোথায়?
আমরা চন্দ্ৰভুক পুরুষ তাদের নদী দেখিয়ে এনেছি
কিন্তু জ্যোৎস্না দেখতে দিইনি এখনো।
দীর্ঘনিঃশ্বাস
মারুতির দরজার মতো একটা চকচকে জীবন তোমার
মারুতির ছুটে যাওয়ার মতো ক্ষিপ্রগতি জীবন তোমার
মারুতির দাঁড়িয়ে থাকার মতো ছিমছাম একটা জীবন
মারুতির চাকার মতো পরিষ্কার জীবনচক্র তোমার
দুপুরবেলায় হঠাৎ তুমি বেরিয়ে পড়েছো, ড্রাইভার জানে না কোথায় যাবে
তুমিও কি জানো? সামনে খোলা আগাথা ক্রিস্টি, তুমি পড়ছো?
না কি এই দুপুরবেলায় আগাথা ক্রিস্টি তোমাকে পড়ছেন?
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো, সেটা কার তোমার মা আগাথার?
দৃশ্য
গড়িয়াহাট রোডের একটা ঝকঝকে আধুনিক ফ্ল্যাট
সেখানে সুসজ্জিত দুটি নারী পুরুষ
একটা কমপিউটারের সামনে নিচু গলায় কথা বলছে
দৃশ্যটা এরকম ।
এইবার এই দৃশ্যটা থেকে আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়া হলো
কমপিউটারের জায়গায় এলো একটা গাছ
সরানো হলো চার দেয়াল, দেখা দিলো
গভীর জঙ্গল, নদী
নদীর ধারে দুটি নারী পুরুষ, সবেমাত্র বাকল পরতে শিখেছে
তারা একটা মাংসের হাড় নিয়ে লড়াই করছে
জঙ্গল ভেদ করে উঠে আসছে তাদের আদিম গোঙানি।
এই দুটো দৃশ্য—এর মাঝখানে কয়েক সহস্র বছর
শিলালিপির মতো স্তব্ধ হয়ে আছে।
দুটো দৃশ্য, ভুল বললাম, আসলে একটাই দৃশ্য
অলৌকিক কিন্তু সুন্দর নয়
একটা মাংসের হাড় নিয়ে আমাদের সাংঘাতিক লড়াই
এখনো থামেনি ।
কালো রবিবার
একটা সুন্দর ঝলমলে সবুজ রবিবার ছিল
আমি সেই রবিবারের জাতক।
একটা অসামান্য বাসন্তী রঙের রবিবার ছিল
আমার বাবা সেই রবিবারের ভোরে আমাদের নদীতে
স্নান করাতে নিয়ে যেতেন।
সে কি স্নান শুধু! সে এক অবগাহন!
ছিল একটা সুন্দর ঝলমলে গোলাপী রবিবার
সেই অসাধারণ রঙ আমাদের গায়ে লেগে আছে।
কিন্তু এই কদিন আগে, ৬ই ডিসেম্বর
আমরা যে রবিবার পেলাম
সেটা একটা কালো রবিবার
পৃথিবীতে এরপর সমস্ত রবিবার কালো হয়ে গেছে
কালো যে এতো নিষ্ঠুর রঙ, এতো সর্বগ্রাসী রঙ
এতো পরশ্রীকাতর রঙ আমি জানতাম না।
একটা মোমবাতি নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি, আমার ভাই ফিরবে
কিন্তু কালো রবিবার তোমার ভেতর দিয়ে
আমার ভাই কি আর ফিরতে পারবে?
ভাইবোন
ভাই এবং বোনের ভেতর, তখন, নদীর ধারে
কোন নদী নিষিদ্ধ ছিল না
কোন গাছ, গাছের ত্রিকোণ পাতা নিষিদ্ধ ছিল না
ভাইবোন কোথা থেকে ধরে আনলো একদিন
এক আশ্চর্য সাদা-কালো ঘোড়া
সেই ঘোড়ার পিঠে করে তারা পালিয়ে বাঁচলো।
ভাই বললো, ‘বোন, তোকে ছাড়া বাঁচবো না’
বোন বললো, ‘কপালে যা আছে থাক এবার লাগাম টেনে ধর’।
তিনজন পুরোহিত ভাইবোনকে একদিন থামালো
নদীর কাছে
‘এ ঘোড়া তোমার?’ ছেলেটি বললো ‘না’।
‘এ ঘোড়া কি তোমার?’ মেয়েটি বললো, ‘না’।
পুরোহিতরা সাধারণত মেয়েদের ব্যাপারে অসফল হয়,
তখনও তাই হতো
তারা তিনজন একসঙ্গে জানতে চাইলো :
এই ঘোড়ার পিঠে বসে তোমরা কতবার মিলিত হয়েছো?
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো ভাইবোন।
ঐ যে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো ভাইবোন, সেই প্রথম
পৃথিবীতে আর কোনদিন তারা মাথা উঁচু করতে পারেনি
ঘোড়াটিকে যেই নিষিদ্ধ করা হলো, সেই শুরু আধুনিক যুগ।
চাবুক ও মোমবাতি
চাবুকের মতো একটা ছেলের সঙ্গে মোমবাতির মতো একটা মেয়ের
ভালোবাসা হলো।
চাবুক বললো : মোমবাতি, তোমার থেকেও সুন্দর কয়েকটা
মোমবাতির সঙ্গে আমার আগেই আলাপ হয়েছে
কিন্তু তোমার তুলনা নেই।
মোমবাতি বললো : চাবুক, অনেক চাবুক আমি দেখলাম
কিন্তু তুমি অনন্য ।
এরপর সারা পৃথিবীতে মেঘ করে এলো, ঝড় এলো, বৃষ্টি নামলো।
মেঘ বললো : মোমবাতি, এসো তুমি আমার হারিয়ে যাওয়া বোন
ঝড় বললো : এসো চাবুক, তুমি আমার বন্ধু ছিলে ঈশান কোণে
বৃষ্টি বললো : মোমবাতি আর চাবুক, এসো তোমরা আমার নীচে দাঁড়াও
স্নান করিয়ে দিই।
মেয়েটি এবং ছেলেটি সেদিন ভিজলো, ভীষণ ভিজলো, এরপর
হিন্দি সিনেমায় যা ঘটে অর্থাৎ পোড়ো বাড়িতে দুজন গিয়ে উঠলো
‘তুমি এর আগে এখানে কটা মেয়ে নিয়ে এসেছো’? মেয়েটি বললো
উল্টে ছেলেটি জানতে চাইলো : তুমি কজনের সঙ্গে এখানে এসেছো?
‘মাত্র দুজন’
ঠাস করে একটা চড় কষালো মেয়েটিকে,
মেয়েটি থুতু ছিটিয়ে দিলো ছেলেটির মুখে, এবং এরপর
ছেলেটি লাথি মেরে মেয়েটিকে ফেলে দিলো বাথরুমের দরজায়।
কিন্তু মেঘ এসে বললো : মোমবাতি, দুঃখ পেয়ো না
ঝড় এসে বললো : চাবুক, জীবনকে সোজা ভাবে নিতে চেষ্টা করো
বৃষ্টি এসে ওদের দুজনের হাত ধরলো। দুজনেই হেসে উঠলো আবার ।
ছেলেটির বোতাম খোলা লোমশ বুকে মুখ ডুবিয়ে দিতে দিতে মেয়েটি বললো :
তুমি এতো নিষ্ঠুর, এতো জোরে আমাকে মারলে
আগে কোনো ছেলে এতো জোরে আমাকে মারেনি, তুমি ব্রুট ।
তুকারাম
মারাঠি ব্রাহ্মণেরা আপনার তিনশো কবিতা পাথর বেঁধে নদীর জলে
ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘শূদ্র, শূদ্রের মতন থাক্
কবিতা লেখার এতই যখন শখ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মালেই পারতিস’।
কিন্তু সারা মহারাষ্ট্রের মানুষ বিশ্বাস করে
আপনার তিনশো কবিতা
এক বছর বাদে জল থেকে উঠে এসেছিল।
একটি ব্রাহ্মণকন্যা একবার স্বপ্নে দেখেছিল আপনাকে
বিছানায় উঠে বসে সে তার স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলে ফেললো
‘জানো কে এসেছিল স্বপ্নে, তুকারাম’
সেই রাতে স্বামী নতুন বৌকে বেদম পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়
মেয়েটি কি পেরেছিল আপনার গ্রামে পৌঁছতে?
এই মেয়েটিই মারাঠি ভাষার প্রথম মহিলা কবি।
তুকারাম, আপনার কবিতা জল থেকে উঠে এসেছিল কিনা জানি না
তবে মেয়েটি স্বামীর হাতে মার খেয়ে বাড়ি ছেড়েছিল
সে চোখ বন্ধ করে মুখস্থ বলতো আপনার তিনশো কবিতা।
৩৮ বছর বয়সে, তুকারাম, আপনাকে হত্যা করা হলো
কিন্তু ব্রাহ্মণেরা একটা ছোট্ট সত্য বুঝতে পারেনি সেদিন
কবিতার পাণ্ডুলিপি জলে ফেলে দিলেই, কবিতা ডুবে যায় না।
জোড়াতালি
গতকালের রাগ আজ আর বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না
যা বিষ ছিল ঝেড়ে ফেলেছি, আজ আমাকে একটা ভালো দিন কাটাতে হবে।
গতকাল জোড়াতালি দেওয়া এক প্রেমিকার কাছে গিয়েছিলাম
আমি দেখতে পেলাম তার সুন্দর আঙুলগুলো যেন
অন্য কোনো মেয়ের আঙুল
আমি দেখতে পেলাম তার চোখ অন্য কারোর চোখ
তার কোমরের কাছে উল্কি, আমি জিজ্ঞেস করলাম : এটা কি?
সে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে হাসলো, বললো—
আমার নতুন প্রেমিক শিল্পী, উল্কি সে আমার পুরো শরীরে আঁকবে।
এটা গতকালের কথা, গতকালের গ্লানি, আজ আর
বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না
আজ আমার কোন যাবার জায়গা নেই,আজ আমি মুক্ত
আজ আমি সারাদিন একটা গাছের তলায় শুয়ে থাকতে পারি
আজ আমি প্রচুর ফুল কিনে বৃদ্ধ মায়ের কাছে যেতে পারি
মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি, মা!
গতকালের রাগ আজ আর বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে না
সারা বিকেল বসেছিলাম জলের ধারে, জল থেকে ডুবুরি উঠে এসে বললো :
একটা জোড়াতালি দেওয়া মেয়ে তোমাকে ভালোবাসলো না বলে
মন খারাপ করে আছো?
একরকম পাখির ডাক শোনাবো তোমাকে, এসো আমার সঙ্গে
তোমার মন ভালো হয়ে যাবে।
গতকালের কথা গতকাল মিটে গেছে, আজ আবার
কেন আমাকে মনে করিয়ে দিলে?
স্বপ্ন
স্বপ্নে দেখলাম তুমি এক দৈত্যের সঙ্গে দীঘার রাস্তায় মিলিয়ে গেলে
স্বপ্নে দেখলাম তুমি এক বেগবান অশ্বের পিঠে, কিন্তু অশ্বের মাথা নেই
স্বপ্নে দেখলাম তুমি নদী থেকে উঠে আসছো, কিন্তু জলের তলা থেকে
তোমার মৃত প্রেমিক পা টেনে ধরলো, স্বপ্নে দেখলাম হোটেলের ঘরে
তোমার পাশে ঘুমিয়ে আছে এক উলঙ্গ পুরুষ এবং তোমার হাতে খুর।
ওফ! কেন আমি এইসব ভয়াবহ স্বপ্ন দেখি কেন দেখি?
আমি জানি তুমি আমার জন্য ওষুধ আর খাবার কিনতে বেরিয়েছো
ফেরার পথে পথ থেকে হয়ত কুড়িয়ে আনবে দু’তিনটে বকুল
স্বপ্ন টপ্ন আমি মানি না কিন্তু খারাপ স্বপ্ন দেখতে খারাপ লাগে
ব্যাবিলন বলে একটা জায়গা এখনো আছে আমার বিশ্বাস, অপেক্ষা করে থাকি
তোমার সঙ্গে ব্যাবিলনে ঘুরে বেড়াবো
সেই ব্যাবিলনে কি একটাও বকুলগাছ নেই?
পারিবারিক কবিতা
বাড়ি থেকে পালিয়ে চার মাস বাদে মেজোভাই ফিরে এলো
সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন সঙ্গে নতুন ব্যাধি, কি সেই ব্যাধির নাম
ছোট বলে কেউ আমাকে বলেনি।
শুধু মা তার পুত্রকে জড়িয়ে ধরে বলতো:
ইচ্ছে করে পেট কেটে তোকে ফিরিয়ে নিই।
আমি থাকতাম আড়ালে, বৃষ্টির জন্য ছাদে উঠে দাঁড়াতাম
মাছ নয়, দুধ নয়, মাংস নয়, কুমডোর ডাঁটা সেদ্ধ খেয়ে
আমারও মনে হতো আমার শরীরে রাগ আছে, জোর আছে
একদিন মাঝরাত্তিরে হারে রেরে রেরে বলে চিৎকার করে উঠবো।
বাবা সব হতদরিদ্র ছেলেমেয়েদের ইংরেজি পড়াতেন
কি হলো তাদের পড়িয়ে? তারা কি ভারতবর্ষ পাল্টে ফেলেছে?
না কি মাথায় ইঁট নিয়ে চলেছে অযোধ্যার দিকে?
পাড়ার লোকেরা একদিন বাবাকে ডেকে বললো:
আপনার ছোট ছেলেটা খুব ভাবুক, ছাদে দাঁড়িয়ে থাকে
ওকে একটা চায়ের দোকান করে দিন।
সন্ধেবেলায় ছাদ থেকে নামিয়ে সে কি মার! জীবনে ভুলবো না ।
কোথা থেকে একদিন একটা ফুটফুটে মেয়ে এলো আমাদের বাড়িতে
আমরা তাকে কেউ চিনি না, কিন্তু সে আমাদের প্রত্যেকের নাম জানে
সে মাকে তসরের কাপড় পরালো, বাবাকে দামী সিগারেট দিলো
উচ্ছন্নে যাওয়া মেজোভাইকে ডাক্তার দেখিয়ে আনলো
আমাকে নিয়ে এলো নদীর কাছে, বললো, ‘চোখ বোঁজো
আমি সমস্ত পোশাক খুলে নদীতে নামবো’।
আজ পনেরো বছর বাদে সেই নদীর সামনে দাঁড়ালাম
কিন্তু সেই মেয়ে নদী থেকে আর কোনদিন উঠে আসেনি।
আমি তোকে মারবো
পাঁচ-ছজন লোক তো আছেই যারা আমাকে ঘৃণার চোখে দেখে
তাদেরই একটি মেয়ে ভোরবেলা পুরীতে বালির ওপর
আমার নাম লিখে জুতো দিয়ে মুছে দিলো।
মনে হলো তার হাত ধরে বলি, ‘চলো আমার সঙ্গে, কথা আছে’।
পাঁচ-ছজন লোক তো আছেই যারা আমাকে খারাপ চোখে দেখে
তাদেরই একজন রাত একটায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো
আমার ঘরের দিকে
দড়াম করে দরজায় লাথি মেরে চিৎকার করে উঠলো
লোকজন ছুটে এসে ধরে ফেললো, সে কিছু বললো না
শুধু আমাকে দেখিয়ে আঁ আঁ করে গোঙাতে লাগলো।
আমি সেই মধ্যরাতের গোঙানি আজও ভুলতে পারিনি।
পাঁচ-ছজন লোক তো আছেই যারা আমাকে ঘৃণার চোখে দেখে
কেন দেখে? নিশ্চয় আমি তাদের কোন ক্ষতি করেছি?
সামচি বলে ভুটানের একটা ছোট্ট জায়গায়
আমি মুগ্ধ হয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলাম
হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি আমার আবাল্য বন্ধু
হাতে খুর নিয়ে দাঁড়িয়ে
সে পাথরের চোখে বললো, ‘আমি তোকে মারবো’
আমি তার হাত থেকে খুর কেড়ে ফেলে দিলাম, সে বাধা দিলো না
কিন্তু দ্বিতীয়বার বললো, ‘আমি তোকে মারবো’।
পুরীর মেয়েটিকে আমি বলেছিলাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসতে
পারলাম না, অন্য কেউ তোমাকে ভালবাসবে’।
এ কথা যদি কেউ আমাকে বলতো?
মানুষ মাতৃশোক ভুলে যায় কিন্তু অপমান ভুলতে পারে না
একটা ভিখিরিকে চিনতাম
পাড়ার সব বাড়িতে ভিক্ষা চাইতো, শুধু একটা বাড়িতে ঢুকতো না
অপমান ফেরত দেবার ভাষা এক-একজনের এক-একরকম।
আমি সামচির সূর্যাস্ত ভুলে গেছি, কিন্তু ভুলতে পারিনি
তিনটে শব্দ, ‘আমি তোকে মারবো’ ।
মনে রেখো এই বান্দাকে
মনে রেখো এই বান্দাকে
দিল্লি যখন ব্যস্ত ছিল
প্রতীক চিহ্ন সামলাতে
কোথায় ছিল ম্যাজিসিয়ান
এ দেশে যখন বান ডাকে?
মনে রেখো এই বান্দাকে
ভিখিরিকে মেরে লাভ কি?
জঙ্গলে বাঘ, জলে কুমির
বিপদ সামলে মন্ত্রীমশাই
বিমানে উঠলে কি ধান্দাতে?
এ পাপ আমার
এ পাপ তোমার
কিন্তু এখনো হিসেব করোনি
কত ক্ষতি হলো দাঙ্গাতে?
যে দেশ আমার
সে দেশ তোমার
মরা গাঙে যদি বান ডাকে
ডেকে নিও এই বান্দাকে।
আঃ
একদিন
তোমার কোমরের কছে মাথা রেখে বলেছিলাম, আঃ
একদিন
চুপ করে তোমার পাশে শুয়েছিলাম, আঃ
একদিন, একদিন, একদিন
এইভাবে সত্যি সত্যি একদিন
আমি তোমাকে ভালোবাসলাম
আঃ যেন চাঁদের ওপিঠ।
কিন্তু তুমি আজ কোথায় কোন্ সমুদ্রের ধারে কার সঙ্গে শুয়ে আছো?
আমার বিছানায়
তোমার শাড়ি, গয়না, ব্রা, প্যান্টি, ছাতা, মানিব্যাগ
আমি সব জড়ো করে দুহাতে জড়িয়ে ধরলাম, আঃ
আঃ মানে জীবন এবং আঃ মানে মৃত্যু
এসো জীবন, দূরে দাঁড়িয়ে থেকো না।
বোতল
তোমাকে বোতলে ভরে যেখানে সেখানে পান করি
শতবার জন্ম নিই শতবার মরি
বোতল. অশেষ নয়, বোতল ফুরিয়ে এলো বলে
তুমি নিজে ভরে ওঠো আবার বোতলে।
হরে রেরে রেরে
হারে রেরে রেরে
আমাকে তোরা আকাশে তুলে দেরে
কী বোকা মেয়ে
মরেছে দেখো আমাকে ভালোবেসে
কালো মাটির দেশে
হুররে হারে রেরে
মাতাল ঘোড়া চলেছে দেশ ছেড়ে
কী বোকা মেয়ে
আয়রে বোকা ইল্লি
কোথায় যাবি অরুণাচল না দিল্লি?
অন্ধকারে উঠেছি আমি ভেসে
কিছু না, শুধু আঁচল ভালোবেসে
হুররে হারে রেরে
চলেছে ঘোড়া মাতৃভূমি ছেড়ে
ওভাবে যারা গিয়েছে
তারা কি আর ফেরে?
কার সঙ্গে থাকো?
বহুদিন বাড়ির বাইরে থাকলে নিজের বিছানার কথা মনে পড়ে
অন্যের সাবান অন্যের তোয়ালে ভালো লাগে না।
বহুদিন তোমাকে দেখিনি, কি হয়েছিল আমাদের?
চাপাডাঙার একটা চায়ের দোকানে ভোরবেলায়
রুটি পোড়ার গন্ধ নাকে এলো।
অল্প পোড়া রুটি, একটু আলুভাজা, একটু মাখন
তুমি কী ভীষণ ভালোবাসতে!
কিন্তু তুমি এখন কোথায়?
শুনেছি কাছেই থাকো, কিন্তু কার সঙ্গে থাকো?
কেন যে আমি গিয়েছিলাম
অজানা এক বনের মধ্যে তোমার সঙ্গে গিয়েছিলাম
আর যাবো না, আর যাবো না, আর যাবো না।
চিনি না, আমি জানি না, সব অজানা লোকজনের
সঙ্গে এক বিছানা পেতে বললে ‘ঘুমোও’।
ঘুমোনো যায়? অজানা এক জাহাজ এলো নিতে
তোমাকে এক নাবিক এসে জড়িয়ে ধরে কাঁদলো
নাকি হাসলো নাকি ভীষণ জোরে বকলো
কি চায় সব অজানা লোক তোমার কাছে কি চায়?
হাতির দাঁত, ময়ূর নাকি বিকেল বেলার সমর্থন?
কি চায় ওরা তোমার কাছে? মারুতি জিপে গোয়ালিয়র?
থাকো তোমার অজানা সব নাবিক আর জাহাজ নিয়ে
অজানা সেই বনের ধারে কেন যে আমি গিয়েছিলাম!
চালাক মেয়ে
এক একটা মেয়ে থাকে দারুণ চালাক
প্রথমে বিহঙ্গের মতো আকাশ দিয়ে উড়ে যায়
তারপর গাছের ডালে এসে বসে
গাছের ডাল থেকে টুক করে জানলা দিয়ে
পড়ার টেবিলে
পড়ার টেবিল থেকে পাঠরত ছেলেটিকে চুমু খাওয়ায় নাম করে
গলা দিয়ে পেটের ভেতর ঢুকে যায়।
কিন্তু পেট খুব একটা সহজ জায়গা নয়
পাখি বলে, ভোর হলো, খোকা ওঠো
পাখি বলে, জল পড়ে পাতা নড়ে পাখিদের মনে পড়ে
পাখি আরো বলে, হঠাও বইপত্র সিনেমা দেখতে চলো
কিন্তু পেটে পাখি থাকলেও
কথা থাকে না পেটে
পেট ফুলতে থাকে, প্রতিমাসে ফুলতে থাকে, পেটের কী দোষ
একটা গোটা জ্যান্ত মেয়েকে পেটের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায়?
রক্ত
হঠাৎ আঙুল কেটে রক্ত বেরুলে, আমি সেই রক্তকে বলি:
তুমি তো মানুষেরই রক্ত
তুমি কেন গরম হয়ে ওঠো? কি আছে তোমার ভেতরে?
তুমিই তো আমাকে ভালোবাসতে শেখাবে, শিখিয়েছিলে হয়ত
কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের সঞ্চয়ে
এতোছুরি, কাঁচি, খুর
ত্রিবেণী টিস্যুতে মোড়া বিষলাগানো ছোট্ট আলপিন।
রক্ত, কি আছে তোমার ভেতর?
কৃষ্ণাঙ্গ তোমার ভাই, কৃষ্ণাঙ্গ তোমার ভাই নয়
কিন্তু যে ভাই নয় তার প্রতি দায়িত্ব আরো বেশি
তুমি তো মানুষেরই রক্ত তুমি কেন এতো গরম হয়ে ওঠো?
চোখের জন্য
তোমার একটা চোখ আমি হঠাৎ চুম্বন করেছিলাম
আজ থেকে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে
সন্ধেবেলায়, মশালের আলোয়।
তারপর
আমি মিশরে জন্ম নিলাম
সাইপ্রাসে জন্ম নিলাম
সিন্ধুপ্রদেশে জন্ম নিলাম।
তারপর প্রাগজ্যোতিষপুর
তারপর নদীয়া বীরভূম বাসন্তি হরিণঘাটা চব্বিশপরগণায়
আমি বারবার জন্ম নিলাম।
কিন্তু তোমার আর একটা চোখ আমি আজও চুম্বন করতে পারি নি।
রবিবার
রবিবার কয়েকজন সফল লোকের সঙ্গে বাগানবাড়ি গিয়েছিলাম ।
যারা সফল তাদের একটা গন্ধ থাকে, সফলতার গন্ধ, অর্থাৎ
সেই নতুন ধানের গন্ধে টলতে টলতে একটা মেয়ে অনেকদূর এসেছিল
কিন্তু এখন তাকে আর দেখছি না।
যারা সফল তাদের একটা বর্ণ থাকে,হরিদ্রাভ সেই বর্ণের লোভে
একটা রবিবার, একটা ভীষণ জরুরি দিনকে ঝলমল করে তুলতে
সফল লোকেদের সঙ্গে চলে আসে কয়েকটি ব্যর্থ লোক।
ঐ তাদেরই একজন ছিলাম আমি
ছোটবেলায় ঘটিবাটি বিক্রি করে পোকায় কাটা চাল কিনেছি
আমার না আছে নতুন ধানের গন্ধ না হলুদ কলঙ্ক
পাঁচজন সফল মানুষের সঙ্গে সারাদুপুর ভদ্কা খেতে খেতে
আমারও মনে হলো, একটা জীবন দরকার, একটা রঙিন জীবন
শাদা বাংলায় যাকে বলে ‘ইস্টম্যানকালার’।
দুপুর তিনটে নাগাদ গাছের নীচে একজন সফল পুরুষের সঙ্গিনী
শশার টুকরো খেতে খেতে সানগ্লাস না খুলে আমাকে বললো:
‘আমি কিউকাম্বার ভালোবাসি’।
সফল পুরুষেরা যেমন সফল নারীরাও তেমনি নদী দেখতে ভালোবাসেন
চারখানা লাল মারুতি বেরিয়ে পড়লো জলঙ্গীর দিকে
কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে যাবার পর তিনটে মারুতি ফিরে এলো।
একটা জলজ্যান্ত মারুতি যে ফিরে এলোনা তা নিয়ে
কেউ কোন প্রশ্ন তোলেনি
ইংরেজি পড়া ছেলেমেয়েরানদী দেখতে গেলে ওরকম হয়
রাত্রে বাড়ি ফিরে আমি ঘুমোতে পারলাম না
চারপাঁচটা ছেলেমেয়ে সমেত একটা গোটা মারুতি হারিয়ে গেল!
সফল লোকেরা হয়ত তার উত্তর জানে, আমি এখনো জানি না
ভোররাতে জানলা খুলে দেখি চাঁদের ভেতর থেকে
একটা লাল মারুতি বেরিয়ে পৃথিবীর দিকে নেমে আসছে
ঠিক বিজ্ঞাপনের মতো
হুর্রে, আমরা আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম নতুন ধানের গন্ধ নেব বলে।
নিউ ইয়র্কের ১২৫তম অ্যাভিনিউ থেকে
আমার গায়ের রঙ কালো বলে সব কথা বলতে পারি নি।
আমার পাশের বাড়ির মেয়েটি শ্বেতাঙ্গ
কিন্তু আমার বিশ্বাস
শ্বেতাঙ্গ বলেই সব কথা ও খুলে বলতে পারে নি।
অথচ দিকে দিকে শাদা কালো ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে
তাতে কি কারোর ক্ষতি হয়ে গেল?
মার্টিন লুথার কিং এবং মেরিলিন মনরো, ইতিহাস থেকে উঠে এসে
আপনারা আর একটু ঘন হয়ে দাঁড়ান, একটা ছবি নেব।
কি লিখছিলাম?
আমি তার উন্মুক্ত স্তনের উপর আঙুল দিয়ে লিখছিলাম,
কি লিখছিলাম?
আমার দুঃখের কথা, বাবার মৃত্যুর কথা, আশ্বিনের আলোয়
ছেঁড়া শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে থাকা দিদির কথা
কি হয়েছিল দিদির? কার পথ চেয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকতো?
আমি তার উন্মুক্ত স্তনের ওপর আঙুল দিয়ে লিখছিলাম
কিন্তু কি লিখছিলাম?
আত্মহত্যার তারিখ? কার আত্মহত্যা? হিমানীশবাবুর?
যিনি আমাকে ইংরেজি পড়াতেন, আমাকে এক রাস্তা থেকে
আরেক রাস্তায় হাত ধরে হেঁটে বেড়াতেন, বলতেন, ‘তোকে বড় হতে হবে।’
কি হয়েছিল হিমানীশবাবুর? বড় হয়ে বুঝেছিলাম ওর স্ত্রী পালিয়ে গেছে
ভূগোল মাস্টারের সঙ্গে।
উন্মুক্ত স্তনের ওপর এসব আমি কি লিখছিলাম?
হে অলৌকিক কাঞ্চনবলয়, তোমাকে বারবার আমি উন্মুক্ত পাবো না
এখানেই লিখতে দাও আমার কথা, আমার লেখার কোন জায়গা নেই
তোমাকে স্পর্শ করে আমার আঙুল হয়ে উঠেছে মাতৃভাষালোভী
শিরা উপশিরা হয়েছে নদীমাতৃক
তুমিও যদি আমাকে সুযোগ না দাও, আমার আঙুল শুকিয়ে যাবে
আমি তবে কি করে লিখবো?
ডাকাত
ফিসফিস করে মেয়েটি তোমাকে কি কথা বললো?
ফিসফিস করে মেয়েটি আমাকে ডাকাত বললো।
হরিণ জরায়ু মেয়েটি তোমাকে কি কথা বললো?
হরিণ জরায়ু মেয়েটি আমাকে ডাকাত বললো।
রসাতলগামী মেয়েটি তোমাকে আর কি বললো?
রসাতলে নেমে মেয়েটি আমাকে ডাকাত বললো।
ম্যাডোনার ভারতদর্শন
একটা ঝড়-বৃষ্টির রাতে উড়ন্ত এক নারী নেমে এসেছিল এখানে।
সে বললো: বাতাস, ঝড়কে শান্ত হতে বলো
সে বললো: মেঘ, ফিরিয়ে নাও তোমার বৃষ্টি।
এসপ্লানেডে যেখানে লেনিন ছিল এতোদিন
সে দাঁড়ালো সেখানে, এক ফুঁয়ে সমস্ত ধুলোবালি, দারিদ্র্য
মেট্রোর জঞ্জাল সরিয়ে
ঝলমল করে উঠলো নিউ ইয়র্কের মতো একটা শহর।
সেই নারী এক এক করে পোশাক খুলে বললো, তাকাও ভারতবাসী
এই আমার জঙ্ঘা
এই আমার নাভি
এই আমার স্তন
এতো সুন্দর স্তন তোমরা কি আগে কখনো দেখেছো?
তাকাও ভারতবাসী
আমি দু’পা ফাঁক করে দাঁড়ালাম
এইখানে আমার হীরে
হীরে ঢেকে রাখা আধখাওয়া একটা আপেল
কয়েক সহস্র মানুষের দাঁত বসেছে এখানে
তবু পুরোটা আপেল কেউ খেতে পারেনি এখনো।
গরিব, কৃষ্ণাঙ্গ ভারতবাসী তাকাও
এই আমার বাঁ-হাত
সাপের পেটের মতো ঠাণ্ডা আমার তালু
হিব্রু ভাষায় অজস্র সংকেত লেখা আছে সারা হাতে
এই আমার ডান হাত
ডানহাতে লেখা কয়েকটা গরিব দেশের নাম, কয়েকটা টেলিফোন নম্বর
যারা আমার ন্যাংটো ছবি, পায়ুছিদ্রের ছবি
কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছিল।
কিন্তু তোমরা এতো টাকা পেলে কোথায়?
এতো বস্তি তোমাদের, আমার ছবি দিয়ে কি করবে তোমরা?
আমার পেছনে এসে দাঁড়াও
আমার পিঠ লক্ষ করো
এই পিঠ আপাতত শেষ চন্দ্রালোক
তোমাদের গণেশ পাইনকে নিয়ে এসো, উল্কি আঁকুক আমার পিঠে
আমি কোন দেবী নই, আমারও পাকস্থলী আছে, আমারও জ্বর হয়
অথচ অনেকেই আমাকে ডাইনি বলে আড়ালে
তারা আমার দু’পায়ের ফাঁকে
আধখাওয়া আপেল দেখে পালিয়ে গিয়েছে।
আমি কখনো কোন গরিব দেশ দেখিনি
এই প্রথম দেখছি
শুনেছি তোমরা ভলো করে খেতে পাও না
অথচ তোমাদের কাগজে কাগজে আমার ছবি
আমার বুকের মাপ
কোমরের তিল তোমাদের মুখস্থ
অথচ দিকে দিকে বস্তি পোড়ার গন্ধ, তিল পোড়ার গন্ধ।
কিন্তু আমাকে পুড়িয়ে ফেলার আগে
আমাকে দুচোখ দিয়ে দেখো
তাতে পাপ হবে না
এই আমার বুক,
আমার বুকের দুটি কৃষ্ণকালো বোঁটা
কিন্তু এখানে কোন মাতৃদুগ্ধ নেই
কেউ আমাকে কোনদিন মা বলে ডাকেনি
শিশুর চোখে আমি কোন মানবী না
আমার চোখ পাথরের
কিন্তু সূচঁ ফুটিয়ে দেখো
বেরিয়ে আসবে কয়েক বছরের জমে থাকা জল
হাত পা ইস্পাতের
নাভিমূল গন্ধক
মাথার চুল পারমাণবিক ভস্ম
বম্বেতে আমি দু মিনিটের জন্যে নেমেছিলাম
সেখানে একটি পথের শিশুকে
তুলে নিয়ে আমাকে ছবি তুলতে বলা হলো
কিন্তু শিশুটি আমাকে দেখে চিৎকার করে উঠলো
আমার এই সুন্দর শ্বেতাঙ্গ শরীরে
অসংখ্য কামড়ের দাগ
জিভের লালার দাগ
বাঁধানো দাঁতের দাগ
এমনকি চাবুকের দাগ, সুক্ষ ব্লেড দিয়ে চিরে দেওয়া
যা কোন ক্যামেরা ধরতে পারেনি
হয়ত বম্বের ওই পথের শিশুটি দেখতে পেয়েছিল
তা না হলে বেচারা ওরকম কেঁদে উঠলো কেন?
হে গরিব শিক্ষিত ভারতবাসী তাকাও
তোমরা আমার ছবি ছাপাও এতো, কেন ছাপাও?
এসো আমাকে ধরে দেখো, স্পর্শ করে দেখো
তোমরা ওভাবে দূরে দাঁড়িয়ে কেন
তোমরা কি এবার কেরোসিন ঢেলে দেবে আমার গায়ে?
পুড়ক, পুড়ে যাক আমার শ্রোণীদেশ
আমার বুক, আমার পিঠ, মাথার চুল
কিন্তু আমার দুপায়ের ফাঁকে
আধখাওয়া আপেল কখনো আগুনে পোড়েনি
তোমরাও পারবে না একে বিনাশ করতে।
ধন্যবাদ ভারতবর্ষ, ধন্যবাদ বোম্বাই কলকাতা, ধন্যবাদ
ঐ পথের শিশুটিকে
যে আমার প্রকৃত শরীর দেখে ভয়ে কেঁদে উঠেছিল।
ভালো মেয়ে, খারাপ মেয়ে
(তসলিমাকে)
ঠিক কাদের ভালো মেয়ে বলে আমি এখনো বুঝতে পারি না।
এই বাংলায়, যে সব মেয়ের দাদা লম্পট সে সব মেয়ের
সহজে বিয়ে হয় না।
মা-মাসীদের মতে যে সব মেয়েরা সারাদিন ঘরের কাজ করে
কোন ছেলের সঙ্গে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না
তারাই ভালো মেয়ে।
ভাই থাপ্পড় মারে, বাবা থাপ্পড় মারে, মা ঘরে আটকে রাখে
মামাবাড়ির লোকেরা স্নেহের নামে যেখানে সেখানে হাত দিয়ে যায়
অথচ মুখ খোলে না কখনো, সে মেয়েকেই আমরা ভালো বলি?
কাকে ভালো মেয়ে, কাকে খারাপ মেয়ে বলে সে এক রহস্য।
মাতাল স্বামী পরিত্যাগ করে যারা একা থাকতে চায়
তাদের বাড়িঅলা ঘর দিতে চায় না।
যে মেয়েটি বাসের মধ্যে ভদ্রলোকের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো
গণ্ডগোল থামাতে অফিস যাত্রীরা বললেন:
‘দিদি, পরের স্টপে নেমে একটা ট্যাক্সি ধরে নিন’
যে মেয়ে কারোর তোয়াক্কা করে না, নিজে আনে নিজে খায়
যে মেয়ে চাঁদপাল ঘাটে একা দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখে
তার দিকে আমরা ভুরু কুঁচকে তাকাই।
তাহলে মোদ্দাকথা কি দাঁড়ালো?
মুখ বুঁজে যারা সব অত্যাচার সহ্য করে তাদেরকে
ভালো মেয়ে বলে?
মুখ বুঁজে যারা সব অত্যাচার সহ্য করে না তাদেরকে
খারাপ মেয়ে বলে?
প্রাতঃস্মরণীয়
আমি তিনজন প্রাতঃস্মরণীয় লোকের কথা জানি যারা মেয়েদের
তিনদিক থেকে দেখেছেন
প্রথমজন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন: আমি হাজার খানেক
মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি, কিন্তু কাউকে ভালোবাসিনি।
দ্বিতীয়জন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন: আমি কোন মেয়ের জন্য
কখনো কাঁদিনি, কিন্তু মেয়েরা আমার জন্য কেঁদেছে।
তৃতীয়জন কোন আত্মজীবনী লেখেননি, কেননা তাঁর ধারণা
আত্মজীবনীতে বেশিটাই মিথ্যা লেখা হয়
একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন:
এক একটা মেয়ে চল্কে পড়া দুধ, যার দুধ সেও পায় না, অন্যেও পায় না।
কি কি কারণে একজন প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠেন আমি জানি না
আমার ক্যামাক স্ট্রিটের বন্ধু বললো:
যথেষ্ট স্ক্যাণ্ডাল না থাকলে বিখ্যাত হওয়া যায় না
যেমন পিকাসো
এবং যথেষ্ট পিকাসো না হয়ে উঠতে পারলে
প্রাতঃস্মরণীয় হওয়া যায় না।
টাকা নিয়ে স্ক্যান্ডাল, রাজনীতি নিয়ে স্ক্যান্ডাল
বিদেশযাত্রা নিয়ে স্ক্যান্ডাল ওসব বাদ দিন
যৌন কেলেঙ্কারি ছাড়া বিখ্যাত হওয়া যায় না
যারা হয়েছেন তারা একজন কি দু’জন
যেমন মাদার টেরিজা।
কি কারণে একজন প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে ওঠেন আমি জানি না
তবে শুধু প্রতিভাবান হলেই হয় না
একটা জমজমাট আত্মজীবনী লিখতে হয়
এবং আত্মজীবনীর শেষ অধ্যায়ে লিখে যেতে হয়
আমি হাজার খানেক মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি
কিন্তু কাউকে ভালোবাসিনি।
মাসিমা, আপনি বড্ড সেকেলে
যারা প্রতিভাবান তাদেরকে ভালোমানুষ হতে হবে সেকথা কোথাও লেখা নেই।