ছায়া পড়ে
০১.
আড়াইশো বছরের ঠান্ডা কামানটার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে কল্পনা গাইড বুকের পাতা ওল্টাচ্ছিল। সামনে শীতের শান্ত নীল গঙ্গা। বালির চরে কয়েকটা লেজনাচানো পাখি। ওপারে রোশনিবাগের কবরখানায় যেখানে সুবে বাংলা-বেহার-উড়িষ্যার এক পরাক্রান্ত নবাব সুজাউদ্দীন অবাধ ঘুমে মগ্ন, সেখানে দীর্ঘ উদ্ধত শিমুলের শীর্ষ লাল ফুলে ভরা। ওদিকেই কোথায় যেন ছিল ভাগ্যহত সিরাজদৌলার সাধের হীরাঝিল। অজস্র গাছ আর ঝোঁপ-জঙ্গলে সবুজের দুর্ভেদ্য দুর্গ ওপারে। বড় রহস্যময় লাগে। সামনে কয়েক পা হাঁটলে মিয়ানো কাতর ঘাসে টাকা প্যালেস চত্বরের শেষ প্রান্তে সাদা পাথরে বাঁধানো ঘাট। ঘাটের ওপর মণ্ডপাকৃতি ছাউনি। সেখানে একটা থামে হেলান দিয়ে বসে আছে নীরেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত-মুখ নেড়ে কী আওড়ে চলেছে শুভ। অবাধ উত্তরে-হাওয়ার বেগে তার রুক্ষ চুল উড়ছে। পাঞ্জাবি উড়ছে। ধুতিও ওড়াউড়ি করছে। অত রোগা অত ঢ্যাঙা শুভ! হাওয়ার তাড়ায় এক্ষুনি সোজা গঙ্গার ঠান্ডা জলে গিয়ে না পড়ে! কবিতা শোনাচ্ছে নির্ঘাৎ। কল্পনা মাঝে মাঝে মুখ তুলে দৃশ্যটা দেখছিল আর মুখ টিপে হাসছিল। কিন্তু নীরেনের আজ হল কী? দিব্যি সুবোধ বালকটি বনে শুভর কবিতা গিলছে নিঃশব্দে,–এমন তো হবার কথা নয়!
স্বাতীকে এতক্ষণে ইমামবাড়ির ফটক পেরিয়ে আসতে দেখা গেল। পাশে যথারীতি দিব্যেন্দু। দুজনেরই চোখে গগলস। রোদে অবশ্য তত বেশি উজ্জ্বলতা নেই। একটু ভিজে ভাব থাকায় উষ্ণতাটুকু যে ওম জোগাচ্ছে, তা চোখের পক্ষে স্নিগ্ধ। আকাশের এখানে-ওখানে ছিটেফোঁটা মেঘ রয়েছে। ঘুম ভাঙবার পরই স্বাতীর মুখে খবর জানা গিয়েছিল, আবহাওয়া প্রতিকূল। দারুণ কুয়াশা। সারা আকাশ হাল্কা মেঘে ঢাকা। স্বাতীর খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস। উঠে বাইরে কিছুক্ষণ ঘুরে এসেছিল। ও পাক্কা অ্যাথলেট মেয়ে। ওর পক্ষে এটা সম্ভব। বিদেশে-বিভুয়ে বেড়াতে এসেও অভ্যাস বা বিধি বদলায় না। তাতে নাকি হঠাৎ স্বাস্থ্যহানি ঘটতে পারে এবং একা রামে রক্ষে নেই, দোসর লক্ষ্মণ সঙ্গে। ওই দিব্যেন্দু। সেও জাত অ্যাথলেট। দুটিতে যা সব কথাবার্তা বা তর্ক-বিতর্ক চলে, সবই খেলাধুলোর রাজ্যের। কল্পনার তাতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ বা কৌতূহল নেই। সে মনে মনে বিরক্ত হয়। তেঁকি স্বর্গে গিয়েও যে ধান ভানে, তার জলজ্যান্ত নমুনা ওরা দুটিতে। অবশ্য এবার মুরশিদাবাদ বেড়াতে এসে দিব্যেন্দু সম্ভবত একটু অন্যরকম হতে চাচ্ছিল, হতে পারছে না স্বাতীর জন্যে। দিব্যেন্দু যদি বা ইতিহাসের প্রসঙ্গ তোলে, স্বাতী সঙ্গে সঙ্গে তার মোড় ফিরিয়ে দেয়। সে কি স্বাতীর বাজি জিতে নেওয়ার চেষ্টা? কল্পনা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না। দিব্যেন্দুকে সব সময়–অন্তত বাইরে কোথাও গেলে, স্বাতী যে এমনি করে আটকে রাখতে চায়। বাহুবন্ধনে? হয়তো তাই।কল্পনা মুখ টিপে হাসে, কিন্তু খারাপও লাগে। কত কী আছে জীবনে, কত ছোট-বড় সূক্ষ্ম বা গভীর লক্ষ করার বস্তু। ওই সব গাছপালায়, বাতাসে, রোদে, জলে, আকাশে! কল্পনা কবিতা লিখতে পারে না। শুভ পারে। এখানে আসাঅব্দি শুভর প্রতি সে মনোযোগী হয়ে পড়েছে। কিন্তু সংকোচ-সংকোচ সে ওই স্বাতীর জন্যে। বাইরে বাইরে যা দেখার মতো ব্যাপার, তা হচ্ছে আপাতত স্বাতীর গারজেন দিব্যেন্দু আর কল্পনার গারজেন স্বাতী।
পোশাকে স্বাতী সবসময় বিদেশিনী অর্থাৎ পশ্চিমি। খুব সফিসটিকেটেড ধরনের মেয়ে। স্বাতীর মতো খেলোয়াড় মেয়ের পক্ষে এটা বেমানান লাগে। সচরাচর খেলোয়াড়েরা-কল্পনার যা ধারণা, একটু বোকাসোকা, সরল, অন-সফিসটিকেটেড হবে। স্বাতী তার উল্টো। গত রাতে নীরেন একটা তর্ক তুলেছিল–যা কিছু ওয়েস্টার্নাইজেশন, তাই মডার্নিজম কি না। কল্পনা টের পাচ্ছিল এ আক্রমণের লক্ষ স্বাতী। হোটেলের ডাইনিং হলে কাল রাতে স্বাতীর অমন আঁটো প্যান্ট আর ক্ষুদে কোট সবার চোখেই হয়তো বিসদৃশ ঠেকছিল। তর্ক জমতে দেরি হয়নি। সেই প্রৌঢ় অধ্যাপকও যোগ দিলেন টেবিলে। কী নাম যেন–দেবতোষ ব্যানার্জি। খুব চেনা লাগে নামটা। কবে যেন শুনেছিল নামটা, মনে পড়ে না। তর্করাত বারোটা অব্দি গড়াচ্ছিল। হঠাৎ ওপর থেকে নেমে এলেন অধ্যাপকের জাঁদরেল জেনারেল গিনিটি। অধ্যাপক নত মস্তকে ত্রাহি ত্রাহি গোন আর্তনাদ তুলে বিদায় নিলেন।……
বেলা বাড়লে কল্পনারা যখন বেরিয়েছে, অধ্যাপক দম্পতিকে দেখা গেছে নহবতখানার ওদিকে। রিকশা চেপে কোথায় চলেছেন দুটিতে। স্বাতী হাসতে হাসতে বলেছিল, শূর্পনখা ব্যানার্জি! অদ্ভুত নাম দিয়েছে নীরেন। কী নাম যেন ভদ্রমহিলার এই শুভ, বলো না নামটা? তুমি তো কাল বিকেলে ওঁর সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে ফেলেছ মনে হচ্ছিল।
শুভ বলেছিল, সুদেষ্ণা। তা তোমরা যাই ভাবো ওঁকে, ওঁর হৃদয় আছে।
নীরেন চাঁটি তুলে বলেছিল, থাম ব্যাটা কবি। হৃদয় আবিষ্কার করে বেড়াচ্ছে সেই থেকে। এখন হৃদয়ের বাসস্থান মগজে।তার খবর রাখিস?
প্রকারান্তরে নীরেনের কথাটা যথার্থ হতে পারে। কল্পনার ধারণা–কেন এ ধারণা হল সে জানে না, ভদ্রমহিলা সম্ভবত বুদ্ধিমতী। সব দিকে লক্ষ তীক্ষ্ণ। তা না হলে কল্পনার টুথব্রাশ হারানোর ব্যাপারটা নিয়ে সবাই যখন হাসাহাসি করছে, নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলেন, বিদেশে এসেছ মেয়েরা, সাবধানে থাকো না কেন? এর পর আস্ত মুখের দাঁত চুরি যাবে, দেখে নিও। ছ্যা-ছ্যা, কী জায়গায় না আসা গেছে!
কে জানে কেন, কথাটা শুনে গা শিউরে উঠেছিল কল্পনার। তবে মজার কথা দাঁত যাবার আগেই স্বাতীর এক পাটি কেডস জুতো গেছে। কুকুর-টুকুর নয় তো? প্যালেস হোটেলের মধ্যে কুকুর নেওয়া নিষেধ। তাছাড়া বাইরের লোকেরা কেউ কুকুর নিয়ে বেড়াতে আসেন না এখানে। এক সম্ভাবনা, স্থানীয় নেড়ি কুত্তা। কিন্তু হোটেলের ম্যানেজারটি ভীষণ উঁদে। ভদ্রলোকের চোখ এড়িয়ে নীচের লনটুকু পার হওয়া কুকুর কেন ছুঁচোর পক্ষেও অসম্ভব। সুতরাং সবাই ধরে নিয়েছে নির্ঘাৎ দলের কারও তামাশা।……।
অন্যমনস্কভাবে কল্পনা গাইডবুকের পাতা ওল্টাচ্ছিল। পড়ছিল না কিছু। স্বাতী আর দিব্যেন্দুকে এদিকে আসতে দেখে তাদের দিকেই তাকিয়ে রইল এবার। বিভাসের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। ওদের সঙ্গে ইমামবাড়ির ভিতর ঢুকেছিলেন ভদ্রলোক। এখনও বেরোলেন না যে!
গলায় ঝুলন্ত ভিউফাইন্ডারটা তুলে চোখে রাখল কল্পনা। এদিক ওদিক দেখতে দেখতে দূরে নহবতখানার ওপরতলায় দৃষ্টি পৌঁছল। আরে! থামে হেলান দিয়ে বুকে দুটো হাত বেঁধে বিভাসবাবু তাকিয়ে আছেন ভাঙা কেল্লাবাড়িটার দিকে। শুভর মতো ভাব লেগেছে বুঝি মনে! কল্পনা মুখ টিপে একটু হাসল। ওঁর গানের কলিটা মনে পড়ছে।
আমরা সবাই এসেছিলাম হারিয়ে যাবার খেলায়…..
নিশীথ রাতে পাতাঝরা বনে……
অন্ধকারের ভেলায়…..
বেশ গায় বিভাস। কাটরা মসজিদদের মিনারের ওপরতলায় উঠে জমিয়ে তুলেছিলেন ভদ্রলোক। কেবল বেরসিক নীরেনটা আচমকা ডি এল রায়ের বুড়ো বাদশা শাহজাহান সেজে চেঁচিয়ে উঠেছিল, দিই লাফ, দেবো লাফ…এবং গানটা আকাশের শূন্যে অকালে মারা পড়েছিল কাল বিকেলে।
ভিউফাইন্ডারে বিভাসকে তন্ময় হয়ে দেখছিল কল্পনা। ফরসা রং টানা চোখ নায়কোচিত মুখশ্রী। বড় বড় চুল বাতাসে উড়ছে। একটুখানি অন্যমনস্ক শৌখিনতার ছাপ আছে বেশ-ভুষায়। পলি-সিলকের পাঞ্জাবি, বাদামি স্ট্রাইপড জহর কোট, চওড়া পাড় তাঁতের ধুতি, বিচিত্র কোলাপুরী চপ্পল। সব মিলিয়ে কিছুটা সেকেলে জমিদারি ছাঁদ। নিজেকে ভবঘুরে বলা অভ্যাস আছে বিভাসবাবুর। এখানে এসে আলাপ হয়েছে। কিন্তু মনে হয় কতকালের চেনা। খুব সহজেই কল্পনাদের দলের সঙ্গে মিশে গেছেন।
স্বাতী এসে গেল।……অদ্ভুত মেয়ে যা হোক! চুপচাপ ওই ঠান্ডা কামানটায় বসে কী করছ? উঠে এসো।
কল্পনা হাসল।…তোমাদের দেখছিলাম স্বাতীদি। কাছের মানুষগুলো দূরে গেলে কী অদ্ভুত দেখায়, ভাবা যায় না।
দিব্যেন্দুর মুখটা গম্ভীর। সে বলল, আজকের বারোটা অব্দি প্রোগ্রাম মোতিঝিল আর কাঠগোলার বাগান। চলো, ওঠা যাক।
কল্পনা কামান থেকে উঠেছে। আড়মোড়া খেল। তারপর হাল্কা পায়ে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। বলল, কালকের মতো হাঁটতে পারব না বলে দিচ্ছি। রিকশা করতে হবে।
স্বাতী বলল, সেটা কর্তার ইচ্ছে।
দিব্যেন্দু হাসবার চেষ্টা করে বলল, আজ কর্তা-টর্তা যা কিছু, সব ওই নীরেন। বাপস! মেয়েদের ম্যানেজ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
কল্পনা ফুট কাটল।…পা ব্যথা করলে কাঁধে চাপতে চায় বুঝি?
পেলে ছাড়ে না কেউ। দিব্যেন্দু মন্তব্য করল। পরক্ষণে স্বাতীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিয়ে কল্পনার দিকে চোখ টিপল।
স্বাতী ফোঁস করে উঠল। থাকো! তোমারও কোনোদিন না কোনোদিন পা মচকাবে। তখন কার কাঁধে চাপবে দেখবোখন।
আগের রাতে নীচের ডাইনিং হলে খেতে আসবার সময় আচমকা সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছিল স্বাতী। হাঁটুতে লেগেছিল। এখনও পট্টি বেঁধে রেখেছে। কাল পথ হাঁটতে বেচারার খুবই কষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই। রিকশা নিচ্ছি-নিচ্ছি করে এক মাইল হাঁটিয়েছিল দিব্যেন্দু। বোঝা যাচ্ছে, রাগটা এখনও পড়েনি। দিব্যেন্দু বলল, আচ্ছা, বিভাসবাবু কোথায় গেলেন? ইমামবাড়ির ভিতর গিয়ে আর খুঁজে পেলাম না। ভদ্রলোককে। কী খামখেয়ালি লোক রে বাবা?
স্বাতী বলল, হারিয়ে গেছেন। হারিয়ে যাবার গান গেয়ে বেড়ান কিনা।
কল্পনা বলল, ওই দ্যাখো, নহবতখানায় নহবত বাজাচ্ছেন।
কল্পনার গলা থেকে ভিউফাইন্ডারটা নিল দিব্যেন্দু। চোখে রেখে বলল, স্ট্রেঞ্জ। একেবারে ধ্যান মূর্তি। ব্যাপার কী?
কল্পনা বলল, কাল ওঁর গানের সময় তোমরা বাধা দিলে। ভদ্রলোক নিশ্চয় রেগে গেছেন। সেন্টিমেন্টে লেগেছে নির্ঘাৎ! সকাল থেকে কেমন বিরস মুখ দেখছিলাম। এড়িয়ে যাচ্ছেন যেন।
স্বাতী বলল, তোর কল্পনার দৌড় অসামান্য। যা না, রাগ মানিয়ে নিয়ে আয়!
দায় পড়েছে। বলে কল্পনা হন হন করে এগিয়ে ঘাটের মণ্ডপটার কাছে পৌঁছল। শুভ আর নীরেন মুখ ফেরাল। কল্পনা গিয়ে ধুপ করে বসে পড়ল এক পাশে।
ততক্ষণে ইতস্তত কিছু কিছু মানুষের ভিড় শুরু হয়েছে। আগের দিনের তুলনায় অবশ্য কমই। সেদিন অন্তত ছ-সাত হাজার মানুষ এসেছিল এ ভূতের শহর দেখতে। প্যালেস হোটেলের ম্যানেজার সুরঞ্জনবাবুর হিসেব বা মন্তব্য এটা। বছরে-বছরে টুরিস্টের সংখ্যা বাড়ছে মুরশিদাবাদে। হরেক দেশের হরেকরকম মানুষ। হাজারদুয়ারির বিরাট প্রাঙ্গণটা গিজগিজ করে। কত সব রঙ-বেরঙের পোশাক আসাক হল্লা-হুল্লোড়। থাকবার জায়গা অপ্রচুর। দশ-বারোটি ঘণ্টা কাটিয়েই চলে যেতে হয়। তবে আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখলে কয়েকটা দিন কাটানো যায়। গঙ্গার ধারে পুরনো একটা প্রকাণ্ড দালানবাড়িতে সদ্য এ বছর নতুন হোটেল খোলা হয়েছে–ওই প্যালেস হোটেল। কোনো শিল্পী নবাবের বসতবাটি ছিল নাকি। ইটালিয়ান স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি দোতলা বাড়ি। ওপরে নীচে সর্বসাকুল্যে চোদ্দোটা ঘর। প্রকাণ্ড ডাইনিং হল আর কিচেন রয়েছে। টানা বারান্দা আর বড় বড় থাম আছে। দক্ষিণ দিকে লক আর একটা সুন্দর বাগিচা আছে। সুইমিং পুলটার সংস্কার করা হয়েছে। ওদিকে পূর্বে মস্ত উঁচু পাঁচিল। তার ওধারে প্রাইভেট রোড। নিজমত কেল্লা। বর্তমান নবাব পরিবারের লোকেরা থাকেন। উত্তরে-জানালার বাইরে বড় বড় গাছ আর ঝোঁপ-জঙ্গলে ঢাকা একটা পুরনো বাগান। বাগানে দেশি-বিদেশি গাছ যেমন আছে, তেমনি বুনো গাছের সংখ্যাও অগুনতি। দিনের বেলা হাঁটতেও গা ছমছম করে। ঘন ছায়া ঝোঁপ-ঝাড় বেজি-খাটাস-শেয়াল-সাপখোপের বাসা। ঠিক মাঝখানে গভীর একটা ডোবা আছে। ডোবার পাড়ে একটা ভাঙা মসজিদ। এ তিন দিনে শহরের অনেকখানি জায়গা চষে বেড়িয়েছে ওরা।
হোটেলের পশ্চিমটা পুরো ফাঁকা। গঙ্গা। তার ওপরে সবুজ গাছে ঢাকা শান্ত গ্রাম। রোশনিবাগ হীরাঝিল–আরও কত ঐতিহাসিক জায়গা। সিরাজদ্দৌলার আমলে নাকি ওপরেই রাজধানীর দফতরখানা ছিল। শুভ দিব্যেন্দু আর নীরেন পশ্চিমের ঘরখানা পেয়েছে। বড় ঘর। ডাবল সিটেড যাকে বলে। তার এ পাশেরটাও তাই স্বাতী আর কল্পনা থাকে। তার ওপারে বিভাসবাবু একা।
উত্তরপ্রান্তের ঘরের সামনে টানা বারান্দা। তারপর সমানা-সামনি দুটো ঘরের একটায় সেই অধ্যাপক দম্পতি। অন্যটায় কাল দুপুরে আরেক দম্পতি এসে ঢুকেছে। তার পাশেরটা এখনও খালি।
শুভ ভীষণ আলাপি। রাতারাতি ভাব জমিয়ে নিয়েছে। দীপেন বোস তার স্ত্রী ইরা বোস। ভদ্রলোকের বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। ব্যবসা আছে। স্ত্রীর বয়স খুব বেশি হলে পঁচিশ। দুটিতেই কিঞ্চিৎ অমিশুক প্রকৃতির। কিন্তু শুভটা বেহায়া। গায়ে পড়ে বউদি ডাকতে শুরু করলে কল্পনার যা রাগ হয়েছিল শুভর ওপর!
বারান্দার শেষপ্রান্তে পূর্বদিকে খাপছাড়া ছোট্ট একটা ঘর আছে। সম্ভবত সারভ্যান্টস রুম। ওটা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। কদিন আগে থেকে এক ভদ্রমহিলা নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নাকি। নাম চীনা মিত্র। খুবই আলাপি আর হুল্লোড়বাজ মেয়ে। ছবি আঁকা হবি। ভোরে তুলি ইজেল ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়েছে। আজ। কোথায় ছবি আঁকছে নিরিবিলি কে জানে। কল্পনার বেশ ভালো লাগে মেয়েটিকে। বয়সে কল্পনার চেয়ে অনেক বড়। তাহলেও সখী-সখী হাবভাব হুল্লোড়বাজি মিলিয়ে সমবয়সিই দেখায়। ছিমছাম পোশাক, হাল্কা গড়ন, মুখশ্রী আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা আছে, তা সাহস। একা চলে এসেছে বিভুঁয়ে!
কল্পনা হাঁটু ঘিরে দু-হাত জড়িয়ে বসেছে। শুভ বলল, একা বসেছিলে দেখছিলাম। কল্পনা হাসল।……কবিতা পড়ছিলে নাকি?
নীরেন উঠে দাঁড়াল।…রক্ষে করো বাবা। আর কবিতা নয়। দিব্যেন্দু, আজকের প্রোগ্রাম কী রে?
দিব্যেন্দু এসে বলল, মোতিঝিল। কিন্তু মাইন্ড দ্যাট, আমি আজ দলনেতার পার্ট করছি নে। সব ভোট তোকেই দিচ্ছি আমরা। কী বলো স্বাতী?
স্বাতী আনমনে বলল, হ্যাঁ।
কল্পনা বলল, বরং কবিবর নি না আজ। সোজা কবিতার রাজ্যে নিয়ে চলুক। নীরেন চোখ পাকিয়ে বলল, অসম্ভব। রাস্কেলটা আমার কান ব্যথা করিয়ে দিয়েছে।
শুভ বেজার মুখে বলল, এই! মেয়েদের সামনে অপমান করিস নে তো। ভাল্লাগে না।
সবাই হেসে উঠল এবার। নীরেন বলল, ঠিক আছে। আই এ্যাম দি লিডার। কিন্তু আগেভাগে বলে দিচ্ছি, প্রোগ্রাম যাই থাক–ইচ্ছে হলেই বদলাব। তখন কোনোরূপ আপত্তি চলিবে না। রাজি?
কল্পনা চোখ বুজে ঢোক গিলে বলল, রাজি হইলাম।
শুভ নতমস্তকে বলল, যথা ইচ্ছা তব যাইতে প্রস্তুত, অনুগামী দোসর লক্ষ্মণসম, বনে কিংবা শমনভবনে…..
কথা কাড়ল দিব্যেন্দু।….স্বাতীর কিন্তু পায়ে ব্যথা!
নীরেন তেড়ে এল।…… সেটা স্বাতীর বলার কথা। তুই কে রে ছোকরা? মনে রাখিস, এখন থেকে আমিই স্বাতীর গারজেন। স্বাতী, কী বলে?
স্বাতী আজ কেবলই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে। থতমত খেয়ে বলল, রাজি।
হুররে! নীরেন আর শুভ হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল।
দিব্যেন্দু হার মানার ভঙ্গিতে বলল, অল রাইট। চলো, জাহান্নামের দিকেই যাত্রা করা যাক্। বলে সে একবার দ্রুত আকাশটা দেখে নিল। মেঘ ছিটেফোঁটা আছে ইতস্তত। কিন্তু আপাতত সূর্যের চারপাশটা বেশ ফাঁকা। রোদ একটু খর হয়েছে। গাছপালার মাথায় কুয়াশার ধূসরতা মুছে গেছে সবার অলক্ষে। ফের সে পায়ে কাছাকাছি ও খানিক তফাতে মাটির ওপর কী যেন খুঁজল। তারপর…এক মিনিট যে যেখানে আছো নড়ো না, বলে দৌড়ে সিঁড়ির ধাপে গিয়ে দাঁড়াল।
কয়েক মুহূর্ত থ বনে গিয়েছিল সবাই। তারপর বুঝেছে। ক্যামেরা খুলছে দিব্যেন্দু। কিন্তু শাটার টেপার মুহূর্তে কল্পনা দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলেছে। দিব্যেন্দু হাঁ-হাঁ করে উঠেছিল। কল্পনা কাঁচুমাচু মুখে বলল, ধুৎ! আমার ফোটো ভালো হয় না। একে বারে পেত্নির মতো লাগে।
দিব্যেন্দুর খেয়াল হল এতক্ষণে, ক্যামেরা-ভীতি আছে। এখানে আসবার পর যতবারই ছবি তুলেছে কল্পনা হয় সরে গেছে চরম মুহূর্তে, নয়তো মুখে হাত ঢেকেছে। পরে স্বাতীর কাছে সে জেনেছে, কল্পনা ছেলেবেলা থেকে ওইরকম নার্ভাস হয়ে পড়ে ক্যামেরার সামনে। ওর ছবি নেওয়া এক সমস্যা। অন্যমনস্ক থাকলে তবেই ওর ছবি তোলার সুযোগ মেলে। কিন্তু কারই বা এত গরজ আছে ওর ছবি তোলার! বাড়িতে দুটোমাত্র মেয়ে–কল্পনা আর স্বাতী। কল্পনা নাকি স্বাতীর কীরকম বোন। ছেলেবেলায় বাবা-মার গিয়েছিল। স্বাতীর বড়লোক বাবা আত্মীয়-কন্যা কল্পনাকে মেয়ের মতো মানুষ করেছেন। ওরা দুটিতে সোদর দিদি-বোনের মতো বেড়ে উঠেছে। স্কুলে কলেজে গেছে। স্বাতীর বাবা বেঁচে নেই এখন। মা আছেন তিনি রুগণা। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। এদিকে স্বাতীর স্বাধীনতা অবাধ স্বভাবত। তবে খেলাধুলোয় তার যত গভীর আকর্ষণ, অন্য কিছুতে নয়। ক্যামেরায় শখ স্বাতীর নেই।
দিব্যেন্দুর অপ্রস্তুত চেহারা দেখে স্বাতী একটু হাসল মাত্র। কোনো মন্তব্য করল না। ছবি অবশ্য উঠবেই একটা। তাতে দেখা যাবে কল্পনার মুখটা দু-হাতে ঢাকা।
যেতে যেতে শুভ বলল, বুঝেছি। আমাহেন সব বাঁদরবর্গের মধ্যে কল্পনাসুন্দরী ছবি তুলবে কোনো দুঃখে?
ফের সবাই একচোট হেসে নিল। শুভ তারপর যথারীতি কবিতা আওড়ানো শুরু করেছে:
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মত তুমিও তখন।
আমার বুকের পরে শুয়ে রবে
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিয়ে কি মন
সেদিন তোমার।
নীরেন হাত তুলে গজাল।…স্টপ ইট আই সে। শুধু ঝরা আর মরা ছাড়া কথা নেই! ওই এক হিরো জুটেছেন কোত্থেকে! কাল গম্বুজের ওপর উঠে শুনি, তিনিও ঝরাঝরির গান জুড়েছেন। গজানোর চিন্তা নেই কিছু, শুধু মরা আর ঝরা!
দিব্যেন্দু বুঝতে না পেরে বলল, সংসারটাই ঝরার। লাইফ ইজ এ বিগ ট্রাজেডি!
শুভ সোৎসাহে ওর হাত ধরল পিছিয়ে এসে।…ইয়েস! বিশ্বজুড়ে ওই ঝরার গান বাজছে। ইটারন্যাল উইনটার। ঝরছে, ঝরছে, আর ঝরছে। বুঝলে স্বাতী?
আনমনা স্বাতী চমকে উঠে বলল, কী?
পাতা। বলে নীরেন হা-হা করে হেসে উঠল। আহাম্মক যত সব। দিব্যেন্দু একজন স্পোর্টসম্যান হয়েও জীবনকে ট্রাজেদি বলে ফেলল। আসলে এইসব বুঝভণ্ডুলগুলো জানে না, ইট ইজ নাথিং বাট এ কমেডি। জামপিং ফ্রম সিচুয়েশান টু সিচুয়েশান….
স্বাতী মৃদু হাসছিল। জামপিং রেস! কাল রাতে পায়ের স্টেপিং আর একটু গোলমাল হলে সে প্রাচীন নবাবী দালানের এত উঁচু থেকে নীচে গিয়ে পড়ত যে আপাতত কয়েক মাস সর্বাঙ্গে প্লাস্টার এঁটে শুয়ে থাকতে হত। সে অবশ্য স্বাতীর ক্ষেত্রে। কল্পনা কিংবা অন্য কেউ হলে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ভেঙে মারা পড়ত। সত্যি জীবন মানেই লাফ দিয়ে দিয়ে অক্ষত এগোনো-লোকসানো তামাশা ছাড়া আর কী? মনে মনে সে বলল, নীরেনদা ইজ কারেকট। কিন্তু অমন করে কলার খোসা সিঁড়ির মাথায় কে ফেলল? ম্যানেজার খুব বকাবকি করেছে চাকর-বাকরদের। বোর্ডাররাও একবাক্যে বলেছে, কাল থেকে আজ এখন অব্দি কেউ কলা খায় নি।….
নীরেন কিন্তু বিভাসবাবুর কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে সবার। শুভ দিব্যেন্দুর গলা থেকে ভিউফাইন্ডারটা নিয়ে চোখে রাখল। প্রাঙ্গণের দিকটা দেখতে দেখতে বলল, সেই মস্তানগুলো আজও যায় নি দেখছি। বেলেল্লাপনার আর জায়গা পায়নি–এসেছে পোড়ো শহরে বদমাহশি করতে। আরে! বিভাসবাবু ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন? ওটার নাম কী যেন নীরেন, ওই যে রাস্তার ওপর ফটকটা?
নীরেন বলল, নহবতখানা। আগের দিনে লোকেরা বেশ ছিলরে। কেমন রোমান্টিক, ভাব গদগদ জীবন। ভোরবেলা শহরের লোকের ঘুম ভাঙত নহবতের সুরে। খাসা!
শুভ বলল, বিভাসবাবু সানাই বাজাচ্ছে নাকি রে? চল, ওদিকেই যাই। ওঁকে না নিলে জমবে না।
স্বাতী বাদে সবাই সোল্লাসে বলল, ঠিক, ঠিক।
দলের গতি বাঁক নিল এবার। স্বাতী বলল, কোথায় যাওয়া হবে আজ?
নীরেন গম্ভীর হয়ে বলল মোতিঝিল। ঘসেটিবেগমের প্রাসাদে।
কেল্লাবাড়ির কাছে আসতেই দীপেন বোস সস্ত্রীক আবির্ভূত হলেন। শুভ চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাল্লো ইরাবউদি, হ্যাল্লো দীপেনদা!নমস্কার। আসুন, দলে ভিড়ে যান। দীপেন বোস সুটেড-বুটেড জেন্টলম্যানের গাম্ভীর্যে বললেন, কোথায় চলেছেন সব?
মোতিঝিল। শুভ জানাল
ইরা বোস এগিয়ে এসে নিঃসঙ্কোচে কল্পনার হাত ধরল।…… কাল অত রাত্রে বেরিয়ে গান গাইছিলেন। ভাবলুম, পা টিপে এগিয়ে চমকে দিই। দিলুম না। ভারি সুন্দর গাইতে পারেন তো!
স্বাতী চমকে উঠে বলল, কল্পনা! তাই নাকি?
কল্পনা অপরাধীর মতো হাসল মাত্র।
দীপেন বোস নীরেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন। দিব্যেন্দু আর শুভ পাশাপাশি। পিছনে কল্পনা স্বাতী আর ইরা। ইরা বলল, সেই ভদ্রমহিলা কই?
বুঝতে পেরে কল্পনা বলল, চীনাদি? কোথায় যেন ছবি আঁকছেন।
আরটিসট! ইরার ঠোঁটে একটু কুঞ্চন দেখা গেল।
শুভ প্রচণ্ড হাত নাড়ছে নহবতখানা লক্ষ করে। বিভাসকে না নামিয়ে ছাড়বে না। কাছাকাছি যেতেই বিভাসের দেখা পাওয়া গেল নীচের ফটকে। হাত তুলে নমস্কার করল সে।
কল্পনা কয়েক পা এগিয়ে বলল, ওখানে কী করছিলেন এতক্ষণ?
বিভাস সলজ্জ হাসল।…এমনি। বেশ ভালো লাগছিল চারপাশটা।
শুভ চাপা গলায় বলল, আসুন, আলাপ করিয়ে দিই ইরাবউদির সঙ্গে। ভীষণ গানের ভক্ত কিন্তু। এমন বিশুদ্ধচরিত্রের নারী সংসারে দুর্লভ। আসুন।
যেতে যেতে বিভাস বলল, এক মজার কাণ্ড হয়ে গেছে। সকালে বাথরুমের চৌবাচ্চায় আচ্ছাসে হাত-মুখ তো ধুয়ে নিচ্ছি, হঠাৎ দেখি জলের ভিতর এক পাটি কেডস জুতো….
কথাটা স্বাতী শুনতে পেয়েছিল। দৌড়ে এসে বলল, আমার, আমার!
আমার মানে? বিভাস অবাক।
শুভ বলল, আরে জানেন না বুঝি! স্বাতীর এক পাটি কেডস হারিয়ে গেছে যে। কী কাণ্ড দেখুন। নির্ঘাৎ নীরেনের রসিকতা।
বিভাস বলল, এ রসিকতার কিন্তু কোনো অর্থ হয় না! চৌবাচ্চার জলে..অবশ্য স্বাতী দেবীর জুতো…কাঁচুমাচু হাসছিল বিভাস, অন্য কারো নয়। তাহলেও জুতো তো। যাক গে, আমি সেজন্যে কিছু মনে করিনি স্বাতী দেবী। জুতোটা শুকোতে দিয়েছি জানালার ধারে।
কল্পনা খিলখিল করে হেসে উঠল। স্বাতীদি! ভদ্রলোককে তাহলে জুতো ধোওয়া জল খাইয়ে ছেড়েছ!
ইরা বলল, হাউ ফানি!
স্বাতী ধমকাল।…কী অসভ্যতা করছিস!
হাসাহাসিতে কান গেছে নীরেন আর দীপেন বোসের। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। নীরেন বলল, এ স্পিডে হাঁটলে মোতিঝিল পৌঁছতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। মনে রেখো, ফিরে এসে লাঞ্চ খাবো।
বাঁকের মুখে দেখা গেল অধ্যাপক দম্পতিকে। রিকশোওয়ালার সঙ্গে দরাদরি করছেন। নীরেনদের দেখেই অধ্যাপক দেবতোষ ব্যানারজি সোল্লাসে চেঁচালেন, আসুন আসুন নীরেনবাবু। জহ্বাদের খঙ্গা থেকে ত্রাণ করুন। সামান্য একটুখানি ঘুরিয়েই ভাড়া চায় তিন টাকা! বেশি দূর নয়–ওখানে রাধামাধবের মন্দিরটা দেখে থানার পাশে ঘাটে গেছি। সুদেষ্ণার স্নান করতে যা একটুখানি দেরি হয়েছে। তার জন্যে বলে। এক টাকা বেশি দিতে হবে।
নীরেন একবাক্যে বলে দিল, দিয়ে দিন।
কয়েক মুহূর্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে ব্যাগ খুললেন অধ্যাপক। সুদেষ্ণা ভাবগম্ভীর মূর্তিতে দাঁড়িয়েছিলেন। চওড়া লাল পেড়ে শাড়ি। সদ্য-স্নাতা। এখনও পিঠে ভিজে চুলের ছোপ রয়েছে। টাকা বের করতে দেখে বললেন সত্যি দিচ্ছ নাকি?
সত্যি বইকি। দেবতোষ হাসবার চেষ্টা করছিলেন।.এঁরা যখন বলছেন।
এবার রণচণ্ডীর আবির্ভাব ঘটল।…দুটাকার এক পয়সা বেশি নয়। একি মগের মুল্লুক পেয়েছে? চলল, চলো আভি থানা মে।
এরা চাপা হেসে এগোল। পিছনে বচসা সমানে চলেছে। স্বাতীর কানে কানে কল্পনা বলল, শূর্পনখা ব্যানারজির চেহারাটা কিন্তু ভারি সুন্দর।
হাতিশালার কাছে পৌঁছতেই দলসুদ্ধ অবাক। পাশ দিয়ে অধ্যাপক দম্পতি সেই একই রিকশোয় বোঁও করে চলে গেলেন। যাবার পথে অধ্যাপক পিছন ফিরে, স্ত্রীর অগোচরে সম্ভবত, হাড় নেড়ে কী বোঝাতে চাইলেন, সেটা বোঝা দুঃসাধ্য। কিন্তু শুভ চেঁচাল, ব্র্যাভো! মোতিঝিলেই দেখা হবে।
.
০২.
শুভ যা বলেছিল, ঠিক তাই। অধ্যাপক দম্পতি মোতিঝিলে অনেক আগেই হাজির। দরজা-জানালাবিহীন নিরেট একটা কক্ষসদৃশ পুরনো ইটের স্তূপ। তার সামনে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক স্ত্রীকে কী সব বোঝাচ্ছেন। সুদেষ্ণার মুখ দেখে কিছু অনুমান করা কঠিন। নির্বিকার তাকিয়ে আছেন মাত্র। আজ ভিড় সামান্যই। সেই রিকশাওলাটা দিব্যি আয়েশে বসে আছে রিকশোর ওপর। ওদের দেখে মুখ টিপে হাসল একটুখানি। শুভ। নিঃশব্দে ওকে দুহাতের সবগুলো আঙুল দেখাল। অর্থাৎ দশ টাকার কমে ছাড়বে না বলে দিচ্ছি। রিকশোওলা হাসল ফের। ঘাড় নাড়ল। দীপেন বোসকে অমিশুক ভেবেছিল। দেখা যাচ্ছে সেটা ভুল। অন্তত নীরেনের সঙ্গে দিব্যি জমিয়ে নিয়েছেন। Fথার উপলক্ষ রাজনীতি। গেটের পাশে একটা কবর। ফলকে লেখা আছে একটা নাম। সিরাজদ্দৌল্লার ভাই এক্রামুদ্দৌল্লার চিনদেশীয় গৃহশিক্ষকের কবর। দিব্যেন্দু কবরের পাশ কাটিয়ে ঝিলের দিকে এগোচ্ছে। শুভ দেখল, বটগাছের ঝুরির নীচে একা চলে গেছে কল্পনা। ইরা সামনের মসজিদের ভিতর ঢুকেছে। ইরাকে আজ উগ্র আধুনিকা দেখাচ্ছে। ই-করা চুড়োখোঁপা, ফিকে হলদে রঙের বিচ্ছিরি ঠোঁট, নাভির নীচে শাড়ির শুরু, পেটকাটা ব্লাউস।
শুভ এগিয়ে গেল। পাশে গিয়ে বলল, কবর দেখছেন? ভাবতে কেমন লাগে, তাই না? এমন মরা হয়তো খুব সুখের-কববে ফুল ঝরছে পাতা ঝরছে…এ্যান্ড!
ইরা হাসল।…এ বয়সে মরার কথা ভাবতে নেই। অবশ্যি, আপনি কবিতা লেখেন।…..শুভ বলল, কবিরা তো চিরদিনই ঠাট্টার পাত্র।
ইরা একটু সিরিয়াস হল হঠাৎ….বাট আই লাইক পোয়েটস। পরক্ষণে আঙুল তুলে পাঁচিলের দিকে এগোল সে।…আসুন আসুন। কী সুন্দর অর্কিড ঝুলছে গাছটায়।…..
নীরেন এবার ক্লান্তি বোধ করছিল।.এনাফ অফ ইট। মিস্টার বোস, আপনি ঘুরুন। আমি ওদের দেখি।
অধ্যাপক চেঁচিয়ে উঠেছেন এদিকে।…এই যে নীরেনবাবু। আসুন, আসুন। ব্যাটা ইংরেজদের কীর্তি দেখে যান। এই ইটের ঢিবিতে ঘসেটিবেগমের সোনাদানা লুকিয়ে আছে ভেবে এনতার গোলা চালিয়েছিল। ওই দেখুন সব গর্তমতো। ইস! কল্পনা। করতে পারেন, একদিন কী ছিল জায়গাটা? অশ্বক্ষুরাকৃতি ঝিল, সুন্দর প্রাসাদ, আঃ, আঃ।
সুদেষ্ণা কড়ামুখে বললেন, কী হল? কঁকাচ্ছ কেন?
অধ্যাপকের চোখে মৃদু ভৎর্সনা দেখা গেল। তারপর কপা এগোলেন।…জানেনা, ইতিহাস আর পুরাতত্ত্ব আমার সাবজেক্ট। যেখানে-যেখানে এমনি সব পোড়ো জায়গায় গেছি, কিছু না কিছু নতুন ব্যাপার আমার চোখ এড়ায়নি। সেবারে গেলাম পাণ্ডু রাজার ঢিবি…..
সুদেষ্ণা হনহন করে কবরখানার দিকে চলে গেলেন। নীরেন বিনয়ী ছাত্রের মতো বলল, এখানে নতুন কী আবিষ্কার করলেন স্যার?
স্যার শুনে যেন পুলকিত হলেন দেবতোষ।…..লক্ষ করেছেন? মুরশিদাবাদে ওরা সিরাজের কোনো চিহ্নই রাখতে চায়নি–এই কবর বাদে? কী প্রমাণ হয় এতে? ওর নাম মুছে দিতে চেয়েছিল ওরা। বাট হোয়াই? কেন? নিশ্চয়ই ভীষণ জনপ্রিয় ছিল সিরাজ। নিশ্চয়ই তার প্রতি অবিচার করা হয়েছিল–যার ফলে জনসাধারণ ক্ষুব্ধ। ছিল, এবং…
এদিক-ওদিক তাকিয়ে নীরেন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, স্বাতী, এই স্বাতী!
স্বাতী ঝিলের পাড়ে জঙ্গলের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে আছে। কী করছে এখানে? সাপটাপ থাকতে পারে। নীরেন লম্বা পায়ে এগোল স্বাতীর দিকে।
দেবতোষ দীপেন বোসকে নিয়ে পড়েছেন..আসুন মিস্টার বোস। রাত্রে ভালো করে আলাপের সুযোগই পাইনি। আসুন, রোদে গিয়ে দাঁড়াই। ওর সব তরুণ ছেলেমেয়ে, ছোটাছুটি করুক কিছুক্ষণ। অবশ্যি…ভুল বুঝতে পেরে কাঁচুমাচু হাসলেন তিনি।…অবশ্যি আপনিও তরুণ। কেবল আমিই যা বোঁটাছাড়বার দলে। ওই যে কী গাইছিলেন ভদ্রলোক–পাতাঝরার বনে!…….
দীপেন বোস হাসছিল না। বলল, আপনি তো অধ্যাপনা করেন। কোথায়?
দেবতোষ বললেন, কলকাতার দিকেই। আপনি?
আমি…মানে আমার একটা ট্রেডিং কনসার্ন আছে চৌরঙ্গিতে।
বাঃ! বাণিজ্যে বাঙালি মশাই ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। আপনাদের মতো নবীনেরই যা ভরসা। কীসের ট্রেড?
দীপেন বোস যেন বিরক্ত হল।…তেমন কিছু নয়। নিতান্ত ডিস্ট্রিবিউটার। কসমেটিকসের।…..
ওদিকে কয়েক পা গিয়েই নীরেন থমকে দাঁড়িয়েছে। দিব্যেন্দু আর কল্পনার এমন ঘনিষ্ঠতা সে ভাবতে পারেনি। গায়ে গা ঘেঁষে প্রকাণ্ড শেকড়ের ওপর ওরা বসে আছে। ঝুরির আড়ালে। স্বাতী কি তাই লক্ষ করছে এতক্ষণ?
নীরেন ওদের চোখ এড়িয়ে স্বাতীর কাছে গেল। এখানে যে একসময় দালান-কোঠা ছিল, তার প্রমাণ এইসব ইট আর ধ্বংসস্তূপ। তার ওপর ঘন ঘাস, আগাছার জঙ্গল আর নানারকম গাছপালা গজিয়েছে। নীরেন হাতের পাশের ঝোঁপ থেকে একটা বুনো ফুল তুলে নিল। তারপর বাঘের মতো চুপিচুপি গুঁড়ি মেরে স্বাতীর পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। এত তন্ময় হয়ে আছে স্বাতী, টের পেল না কিছু। পরক্ষণে ফুলটা ওর বিশৃঙ্খল পাখির বাসার মতো চুলে গুঁজে দিতে গেলে স্বাতী চমকে উঠল।
নীরেন চাপা হেসে ওর হাতটা ধরে বলল, বনকন্যার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপার কী?
স্বাতী একটু ঝুঁকে ওর হাতটা লক্ষ করে বলল, কী যেন ছিল তোমার হাতে। কই? দেখি।
ফুল। পরবে নাকি?
এত পুলক কেন আজ? স্বাতী মিটিমিটি হাসছে।…মেয়েদের একা দেখলে খুব বীরত্ব দেখাতে সাধ জাগে-তাই না?
ফুলটা ছুঁড়ে ফেলে নীরেন বলল, নাঃ এমনি। একটু চপল হতে চাচ্ছিলাম–ধুৎ আমার পোয় না। ওসব দিব্যেন্দুটা বেশ পারে। ওই দ্যাখো না। দেখতে পাচ্ছ?
স্বাতীর ঠোঁটের কোণে একটু কুঞ্চন ফুটে রইল কয়েক মুহূর্ত। একবার চোখ তুলে ঝিলের পাশে বিরাট ঝুরিওয়ালা বটগাছটার দিকে তাকাল সে। যেন শুধু গাছটাকেই দেখে নিল। তারপর বলল, কল্পনাটা মরবে।
এমন সুরে কথাটা বলল স্বাতী যে নীরেনকে চমকে উঠতে হল। সে বলল, বাগড়া দিচ্ছ কেন? ওরা যদি প্রেম করে তো করতে দাও। নাকি তোমার কিছু আশাটাশা ছিল ওর প্রতি!
নীরেনের কথায় এমন গোঁয়ার্তুমি স্পষ্টতা স্বাতীর গা সওয়া। সে একটু হাসল।.কে? ওই দিব্যেন্দু? রক্ষে করো বাবা। শৃঙ্গধারী জীবকে শতহস্ত দূর থেকে প্রণাম।
নীরেন স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, সবাই শৃঙ্গধারী। আমিও।
হয়েছে! তোমার প্রতি কোনো আশা নেই আমার। যাও, গেট আউট।
নীরেন হাসল।……ভাগিয়ে দিচ্ছ একেবারে।
ওখানে কবরখানার ভাঙা পাঁচিলে পা তুলে ইরা হাসছে। ওপাশে মাত্র দুফুট নীচে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মেখেস্ট, মেখেস্ট! চলে আসুন। হাতটা দিন, পড়বেন না।
ইরা বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদো-কাঁদো মুখে বলল, থাকগে। ও খুঁজবে আবার।
কী মুশকিল! আরে আমি তো আছি, পড়ে যাবেন না……নাছোড়বান্দা শুভ ক্রমাগত হাতটা সাপের ফণার মতো দোলাতে থাকল।
ইরা এদিক-ওদিক চঞ্চল চোখে তাকিয়ে বলল, কিন্তু যাব কোথায় শুনি? কী আছে ওদিকে?
শুভ বিরক্তমুখে বলল, ওই জঙ্গলের মধ্যে গম্বুজ। আসুন না, দেখে আসি! ধেৎ তখন যদি না বলতেন, আমি ঝাঁপ দিতাম না। এখন আমার ওঠার সমস্যা।
ইরা হাত বাড়াল।….হাত দিচ্ছি। ধরে উঠুন।
বাঃ! চমৎকার! শুভ হেসে উঠল।…..কিন্তু আমার ভার সইতে পারবেন না। পড়ে যাবেন। তখন মিস্টার বোস আমার নামে কেস ঠুকে দিক। ওপথে আমি নেই।
কিন্তু হাতটা ধরল সে। ধরামাত্র ইরা সামনে ঝুঁকেছে। তারপর কী যেন হল, শুভ প্রাণপণ চেষ্টায় ওকে সামলে নিতে বাধ্য হয়েছে। ওপাশে নীচেই নেমে গেছে ইরা। পর্বত অভিযান করা হল যেন। যান, ভীষণ জেদি আপনি।
দুজনে আমবাগানের নীচে পিটুলি আর কালকাসুন্দে ঝোঁপ ঠেলে গম্বুজটা লক্ষ করে এগোতে থাকল।
দীপেন বোস কেটেছে এক ফাঁকে। রাস্তা পেরিয়ে ওদিকের মসজিদের চত্বরে পৌঁছেছে। আসবার সময় লক্ষ করেছিল সে। উঁচু বারান্দায় একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে ইজেল। রাত্রে হোস্টেলে অল্প একটুখানি কথাবার্তা। চীনা মিত্র। নামটা বেশ লাগছে।
এলাকায় ইতস্তত জঙ্গলের ভিতর এমন মসজিদ খুব কম নেই। সবগুলোই পোভড়া। ধসে পড়ার মুখে পৌঁছেছে। গম্বুজে ফাটল, দেয়ালে ফাটল। অশথ-বট গজিয়েছে। বেশ নির্জন জায়গা বেছে নিয়েছেন ভদ্রমহিলা। কী আঁকছেন কে জানে!
দীপেন ফটকটা ভয়ে ভয়ে লক্ষ করল। ভেঙে পড়বে না তো? তারপর প্রায় লাফ দিয়ে সেটা পেরিয়ে গেল। একটু কাসল।
চীনা চমকে উঠে মুখ ফেরাল এদিকে। হাতে তুলি। ভ্রূ কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল দীপেনের দিকে। সম্ভবত চিনতে চেষ্টা করছে। দীপেন বলল, নমস্কার। কাল রাত্রে হোটেলে আলাপ হয়েছিল। আমার স্ত্রী ইরা আপনাদের পাড়ার। মেয়ে–আপনারা বেশ পরিচিত দেখলাম।…….
ও। হ্যাঁ। চীনা স্মিত হাসল।……বেড়াতে বেরিয়েছে? ইরা কোথায়?
দীপেন বলল, ওদিকে ঘুরছে। আমি এসেই আপনাকে লক্ষ করেছিলাম। কৌতূহল-হল, কী ছবি আঁকছেন দেখে আসি। কিছু মনে করছেন না তো? না, না। কী যে বলেন! চীনা জিভ কাটল সবিনয়ে।….তার ওপর পাড়ার জামাই।
হা-হা করে হেসে উঠল দীপেন।…অবশ্যই।…মাই গুডনেস। একি আঁকছেন?
তুলির গেড়া দাঁতে কামড়ে চীনা তাকিয়ে আছে ছবির দিকে। দীপেনের কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, কেন? বুঝতে পারছেন? অবশ্যি এখনও সামান্য কাজ বাকি। কয়েকটা পোচ।
দীপেন ছবির সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে যেন বোঝবার চেষ্টা করছে।..বড্ড জটিল। আমি আবার আর্টফার্ট একেবারে বুঝি নেতার ওপর এই অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট।
শান্ত চোখে তাকাল চীনা মিত্র।….ছবিটা দেখে কি কিছু মনে হচ্ছে না আপনার? এনি ইমপ্রেশন?
দীপেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টে ছবিটা লক্ষ করে বলল, একটা রিঅ্যাকশন ঘটছে আমারটু স্পিক দ্য টুথ।
বলুন।
কেমন যেন ভীষণভীষণ কিছু ঘটতে চলেছে…তার সামনে আমি অসহায়, একেবারে অন্ধের মতো। এ লিভিং স্টোন ইন দ্য এক্সপ্লোশান…ওই সব রং, ফ্লাডের মতো টানা কালের রেখা..
চীনা হাসল।…বানিয়ে বলছেন না তো?
না, না বিলিভ মি।
তাহলে আমার আঁকার ত্রুটি হয়নি।
এখানে কী প্রেরণা পেলেন এমন ছবি আঁকবার? ডোন্ট মাইন্ড মিস মিত্র, এটা নিতান্ত একটা প্রশ্ন।
চীনা কয়েক মুহূর্ত মসজিদের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকল। নাসারন্ধ্র কাঁপছিল একটু একটু। তারপর বলল, দেখুন। জীবন যার মধ্যে আশ্রয় নেয়, তার নাম সময়। সময়ের একটা চেহারাই মোটামুটি আমরা দেখি, সেটা জনপদে বা মানুষের ভিড়ে কিংবা সমাজে। সেটা আপাতদৃষ্টে যত উচ্ছল চঞ্চল মনে হোক, তার মোটামুটি রকমটা একই। সে সেখানে কাম্য, সুন্দর, ভদ্র–আইনের অধীন। কিন্তু এখানে এসে–এই পোডড়া ভূতের শহরে পা দিলেই সময়ের অন্য এক চেহারা দেখতে পাচ্ছি। অথচ এখানেও জীবন আজও আছে। আধার যেহেতু অন্য, তার রূপও অন্যরকম। ডু ইউ ফিল ইট? ওই দেয়ালের ওপর গাছপালার শিকড়গুলো লক্ষ। করুন। এবং…দীপেন মাথা দোলাচ্ছিল। এবার বাধা দিয়ে বলল, এনাফ! আই ফিল ইট।
চীনা পেটের কাছ থেকে রুমালটা টেনে নিয়ে মুখ মুছল। একটু হাসল।…..খুব বকছিলাম। ছবিটা আজ শেষ করব ভাবছি। কিন্তু বড্ড ক্লান্তি! আর একলা লাগছিল খুব। ভালো হল–আপনি এসেছেন। চা খাবেন? সঙ্গে আছে। আমি বড় একটা খাই
নে। খুব ক্লান্ত হলে তবেই একটু আধটু।
ফ্লাস্ক খুলতে থাকল সে। চত্বরে কিটব্যাগ পড়ে রয়েছে। অনেকগুলো রঙের কৌটো। তুলি। ছুরি। আরও সব টুকিটাকি।
দীপেন বলল, কাপ তো একটাই। সরি, জল আছে দেখছি। ধুয়ে নেবেন। আমার ভীষণ চা-পানের অভ্যাস আছে। কী অপূর্ব যোগাযোগ!
চা খেতে খেতে ছবির দিকে তাকাচ্ছিল দীপেন। চীনা সামনে ফের পায়চারি শুরু করেছে। মাঝে মাঝে তাকেও লক্ষ করছিল সে।
.
অধ্যাপক পাঁচিলে ভর দিয়ে ঝিলের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সুদেষ্ণার বাজখাই ডাক শুনে মুখ ফেরালেন। বড্ড বাড়াবাড়ি করছে সুদেষ্ণা। লোকের সামনে অকারণ চেঁচামেচি–কোনো মানে হয় না! ওকে সঙ্গে আনাই ভুল হয়েছে। আগামীকাল মাইল আষ্টেক দূরে রাঙামাটি চাঁদপাড়ায় রাজা শশাঙ্কের রাজধানী দেখতে যাবার ইচ্ছে আছে। কোনো অছিলায় ওকে রেখে যেতে হবে।
সরে এসে বললেন, কী ব্যাপার? ডাকছ কেন? চলে যাব?
সুদেষ্ণা বললেন, ধিঙ্গি ছোঁড়াছুঁড়িগুলো বনজঙ্গলে যা খুশি করে বেড়া। তোমার এত উঁকি মারা কেন বলো তো? ছিঃ! বয়স যত বাড়ছে, তত খোকাপনা বাড়ছে।
জিভ কাটলেন দেবতোষ..ছ্যা ছ্যা। কী সব যা-তা বলছ, দ্যাখ তো! আমি ওদের দেখব কেন? ওই ঝিলটা দেখছিলাম। জানো? ইতিহাসে আছে–ওটার আকার ছিল ঘোড়র ক্ষুরের মতো। ওতে নৌকা বেয়ে বেড়াত নবাব-নন্দিনীরা……
সুদেষ্ণা বিকৃত মুখে বললেন, তাই বুঝি দেখা হচ্ছিল এতক্ষণ?
কাঁচুমাচু হাসলেন দেবতোষ।…তা বলতে পারো। পুরাতাত্ত্বিকরা কল্পনার চোখেও কিছু দ্যাখেন বই কি। সত্যি সুদেষ্ণা, তুমি এত ডাল তো ছিলে না কোনোকালে।
সুদেষ্ণা বললেন, রাখো ওসব আদিখ্যেতা। বটতলায় কুঞ্জ বসিয়ে মানভঞ্জন পালা গাইছে–আর দিব্যি হাঁ করে গিলছে। এসব, আর ভাল্লাগে না। কই, তোমার সেই হাজার বছরের পুরনো গোপীবল্লভের মন্দির কোথায়? খুব যে চালাকি করে আনলে। সে কি এই কবর দেখাতে?
চলো। বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বয়স ক্রমশ গুরুভার হয়ে আসছে। মন হচ্ছে কোণঠাসা। চারপাশে এইসব সজীবতা, তারুণ্যের ছবি, এত প্রাণচঞ্চলতা, আর দেবতোষের সেখানে কোনো ভূমিকাই নেই। বড় অসহ্য লাগে জীবনটাকে। রাগ হয়। ক্ষোভে বুকের ভিতরটা ছটফট করে। কিছু পেয়েও পাওয়া গেল না। কিছু স্পষ্ট জানা গেল না। তাই পিছন ফিরে শুধু যা কিছু স্মৃতি–যা অতীত, তার মধ্যে উটের মতো নাক ডুবিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা। এত অসহায় দেবতোষ!
পাশে চলতে চলতে ফিসফিস করে দেবতোষ বললেন, দেখো, রিকশাওলার সঙ্গে ফের দরদস্তুর বাধিও না। বেশ দেরি করিয়ে দিলাম বেচারার।
সুদেষ্ণা উচ্চকণ্ঠে বললেন, সে হবে। কিন্তু গোপীবল্লভের মন্দির না দেখালে তোমার ছুটি নেই বলে দিচ্ছি। রিকশা থেকে নামব না।
সভয়ে দেবতোষ বললেন, সর্বনাশ! সারাদিন রিকশা করে ঘুরবে নাকি?…
ওদিকে বিভাস একা দাঁড়িয়েছিল। পাশের ভাঙা দালানবাড়িটার ভিতর দেখার মতো অবশ্য কিছু নেই। দেয়ালে অজস্র নাম আর ঠিকানা লেখা। একদল যুবক-যুবতী ওখানে ঢুকে ছবি তুলছিল এতক্ষণ। বিভাস তাদের শেষ ছবিটার জন্যে শাটার টিপে দিয়েছে। ওরা কলকণ্ঠে, ধন্যবাদ দাদা নমস্কার–বলে চলে গেলে চত্বরটা ভীষণ নির্জন হয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ সে আনমনে গুন গুন করছিল। তারপর দেখল, স্বাতী এসে তাকে ডাকছে।…বিভাসবাবু এই যে!
লাফ মেরে অত উঁচু স্তূপটা ডিঙিয়ে আসতে দেখে বিভাস অবাক। খেলোয়াড় মেয়ে। ওর পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। বিভাস বলল, ওরা সব কোথায়?
কে জানে! বলে স্বাতী পাঁচিলে পিঠ রেখে দাঁড়াল। মুখটা গম্ভীর।
বিভাস সামান্য সরে এল কাছে। মুখের দিকে স্থির তাকাল কয়েক মুহূর্ত। কিছুটা জোকারের ভাবভঙ্গি। তার ধারণা, যে কোনো কারণেই হোক স্বাতীর মন খারাপ। তাকে চাঙ্গা করার অনির্দিষ্ট দায়িত্বভার যেন সে গ্রহণ করে নিয়েছে। ঠোঁটে মৃদু হাসি, কপালে ভাঁজ, ভ্রূ কুঞ্চিত।
স্বাতী কটাক্ষ হানল।……কী দেখছেন?
যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বিভাস বলল, আপনার অসুখ।
আপনি কি ডাক্তার নাকি?
হতে সাধ যাচ্ছে খুব।
স্বাতী মুহূর্তে বিরসতার মুখোশটা ছিঁড়ে ফেলল। হাল্কা হেসে বলল, যান। আমার কি হয়নি। আসুন, ওই পাথরটার ওপর বসা যাক্। পায়ের ব্যথাটা ফের টের পাচ্ছি।
চত্বরের মাঝখানে বিজাতীয় ভাষায় খোদাই করা লিপিসমেত চৌকো একটা প্রকাণ্ড কালো পাথর। সেটার ওপর বসে পড়ল দুজনে। মধ্যে এক হাতের ব্যবধান। বিভাস টের পাচ্ছিল, স্বাতীর শ্বাসপ্রশ্বাস চাপা। উত্তেজনা সামলানোর প্রয়াস চলেছে। কীসের উত্তেজনা?
স্বাতী কিছু বলার আগেই বিভাস গুনগুনিয়ে উঠেছে।
আমরা যারা এসেছিলাম হারিয়ে যাবার খেলায়।
নিশীথ রাতে পাতাঝরা বনে……অন্ধকারের ভেলায়।
হঠাৎ গান থামাল সে। বলল, স্বাতী, আপনি গান গাইতে পারেন না?
স্বাতী সামনে একটু ঝুঁকে আছে। নীচের দিকে দৃষ্টি। ওই ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলল, না।
বিভাসের দুঃসাহসী হাতটা ওর পিঠে নামতে দেরি করল না।..স্বাতী, শুনছেন?
উঁ?
আমরা–আমরা যেন হঠাৎ দিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি। তাই না?…বিভাস বলতে থাকল।…মাত্র তিনটি দিন। এই তিনটি দিনেই কী সব ঘটে যাচ্ছে বা ঘটতে চলেছে–হ্যাঁ, আই স্মেল ইট। কাল বিকেলে কাটরা মসজিদের মিনারে ওঠবার সময় অন্ধকার সিঁড়িতে হঠাৎ আপনি আমার…..
স্বাতী সোজা হয়ে বসল। আস্তে আস্তে বলল, ও কিছু না। হঠাৎ ভয় পেয়েছিলাম।
.
কে, কে?…..বটতলার মোটা শেকড়টা থেকে দিব্যেন্দু ধুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়েছে।
কল্পনাও।
ঘেঁটুবনটা ভীষণ নড়ছে তখনও।
দিব্যেন্দু হাত দুটো মুঠো করে দু-পা এগোল। কল্পনা সরে এল। সে হন হন করে ঘাসের জঙ্গলটা পেরিয়ে ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়াল। উত্তরের আমবাগানে শুভ আর ইরা বোস পাখি তাড়াতে ব্যস্ত। একটু পরেই কল্পনাকে দেখতে পেল ওরা। ভাঙা পাঁচিলের কাছে এসে এক লাফে শুভ উঁচু চত্বরে উঠল। তারপর হাত বাড়াল। ইরা বোস তার হাতটা ধরে ওঠবার চেষ্টা করছে। দেখে ভীষণ হাসি পেল কল্পনার।
কাছে এসে শুভ বলল, এ গ্র্যান্ড ডিসকভারি! কী হারালে তা জানো না কল্পনা। ওই গম্বুজওয়ালা ঘরের দেয়ালে একটা মজার লেখা পড়লাম। চমৎকার কবিতা দুলাইন। অনবদ্য। এই দ্যাখো টুকে এনেছি।
মধ্যরাতে বনের মাথায় উঠলে চাঁদ।
ডোবার ধারে পাতাবো হরিণ ধরার ফাঁদ।
শুভ হো হো করে হেসে বলল, ব্যাটা নির্ঘাৎ মাতাল।
এবং কবিও।…..পিছন থেকে নীরেন বলল। নীরেনের হাতে এক গোছ ঘেঁটুপাতা। পাশে দিব্যেন্দু।
ইরা ইতি উতি তাকাচ্ছিল। দীপেন বোসকে খুঁজছে। টের পেয়ে শুভ বলল, আরে, ওরা সব কই? স্বাতী, বিভাসবাবু, দীপেনদা?
কল্পনা বলল, আর এখানে ভাল্লাগে না। নীরেনদা, নেক্সট প্রোগ্রাম কী?
নীরেন ঘড়ি দেখে নিয়ে জবাব দিল, আপাতত হাঁটতে হাঁটতে পথচলা।
রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াল ওরা। শুভ হাতে চোঙ বানিয়ে ডাকতে শুরু করেছে। স্বাতী। বিভাসবাবু! দীপেনদা!
স্বাতী আর বিভাস এসে গেল দক্ষিণের ভাঙা দালানবাড়ি থেকে। রাস্তার ওপারের পোডড়া মসজিদের ফটক পেরিয়ে দীপেন বোসকে আসতে দেখা গেল। তার পিছনে চীনা মিত্রকে দেখে শুভ চেঁচাল হ্যাল্লো চীনাদি!
.
০৩.
সবার অলক্ষে কখন আকাশ মেঘে ঢেকে গিয়েছিল। খোঁজাদের কবরখানার কাছাকাছি আসতেই আচমকা দুদ্দাড় বৃষ্টি। সবাই হুড়মুড় করে উঁচু ফটকের ভিতর ঢুকে পড়েছিল মাথা বাঁচাতে। ফটকের দু-পাশে দুটো অক্ষত ঘর। তার ওপাশটা মুসাফিরখানা ছিল একদা। সারবন্দি একতলা ঘরগুলো ভেঙে-চুরে একাকার। প্রাঙ্গণে সারবদ্ধ কবর। ফুলের গাছ। তবে কেউ কবর বা ফুলের গাছ দেখছিল না এটা ঠিক। আকাশ দেখছিল বিস্মিত চোখে। অকাল বর্ষণের এ চমক পুলকিত করেনি কাকেও–বরং দমিয়ে ফেলেছিল কিছুটা।
স্বাতী এবার রীতিমতো ল্যাংচাচ্ছে। পিছনে পড়ে গিয়ে ভিজতে হয়েছে তাকে। টাইট জামা-প্যান্ট আর পুলওভার ধরনের বিচিত্র কোটসমেত ওকে ভিজে বেড়ালের মতো দেখাচ্ছিল। শুভ দৌড়ে ওকে এগিয়ে আনতে যাবে ভাবছিল, কিন্তু বৃষ্টির ধার অনুভব করে শেষ অব্দি নিরস্ত হয়েছে। সে ঠোঁট চুক চুক করে বলেছিল, আঃ, ভেরি ভেরি স্যাড!
স্বাতী অবশ্য হাসতে হাসতে চীনা মিত্রের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। চীনা বলল, আপনার শীত করছে নিশ্চয়। ভিজে আলখেল্লাটা বদলাতে পারেন, আমার ব্যাগে একটা আছে দিতে পারি।
স্বাতী মাথা নাড়ল। দরকার নেই।
ইরা সবিস্ময়ে বলল, অত ভিজেছেন! আমি হলে কী যে করতাম!
শুভ বলল, আরে, আরে! কী হারে গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে দেখছ? উঃ, ভাবা যায় না।
ব্যাপারটা তাই। বৃষ্টির তীব্রতা ছিল। পথের ওপর বা ঘাসে ইতস্তত সবুজ ও হলুদ পাতার রাশি থরে বিথরে জমে উঠেছে ক্রমশ। পিচের রাস্তায় স্যাঁৎ স্যাঁৎ করে দু–একটা ট্যুরিস্ট বোঝাই রিকশা চলে যাচ্ছে। শুভ মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে উঠছিল।… দ্যাখ, দ্যাখ, সেই মস্তানগুলো! দিব্যি ভিজতে ভিজতে চলেছে।
শুধু ভিজতে ভিজতে নয়, কোমর ঘুরিয়ে নাচতে নাচতে যাচ্ছে। এদিকে চোখ পড়ামাত্র দলটা থেমেছিল কয়েক মুহূর্ত। হয়তো এখানে ঢুকে পড়বার মতলব করছিল। কিন্তু কী ভেবে এল না–সোজা রাস্তা ধরে হুল্লোড় করে এগোল।
কল্পনা নীরেনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অল্প জায়গা। গা ঘেঁষাঘেঁষি অপরিহার্য। কিন্তু নীরেন একটু চমকাল। কল্পনার ভিজে হাতটা তার হাতের ওপর ঝুলছে। সে মুখ ফেরাল কল্পনার দিকে। কল্পনা চোখ তুলল। চোখাচোখি হতেই নীরেন অন্য দিকে তাকাল। মুহূর্তে তার মনটা বিস্বাদে ভরে গেছে। এই মেয়েটিকে বুঝে ওঠা যায় না। কাল কাটরা মসজিদের মিনারে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় নীরেনের হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে ওঠার ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা কঠিন। কেমন নড়িয়ে দিয়েছিল তাকে–যেন দেহ মন অস্তিত্ব শুদ্ধ একটা আলোড়ন শুরু হয়েছিল কিছুক্ষণ। ছেষট্টিটা ধাপের পর ওপরতলা। নীরেন গুনে গুনে উঠছিল। তারপর–সম্ভবত বাইশের পর সব গোলমাল হয়ে যায়। আর সে মুহূর্তে হঠাৎ ইচ্ছে করছিল, দেয়ালে ঠেসে ধরে কল্পনাকে–চুমু খেয়ে ফেলে। অবশ্য সেটা হঠকারিতাই হত। কয়েক ধাপ নীচে স্বাতী আর বিভাস ছিল–সব দেখে ফেলত।
কিন্তু মনের ভিতর সেই কম্পনের রেশ সারাটি রাত এবং আজ কিছুক্ষণ অব্দি ছিল তার। মোতিঝিলের বটতলায় নির্জনে কল্পনা আর দিব্যেন্দুর ঘনিষ্ঠতা আবিষ্কার করে নীরেন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। বড় বোকামি থেকে বেঁচে গেছে।
অথচ কল্পনার মধ্যে কী একটা আছে। আছে, তা এখানে আসবার পর টের পাচ্ছে নীরেন। কলকাতার ছকবন্দি জীবনে সেটা কল্পনার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি সম্ভবত। কতদিন তো নিরিবিলি কল্পনার সঙ্গে আড্ডা দেবার সুযোগ ঘটেছে–এমনকী এক সন্ধ্যা লেকের ধারেও বসে থেকেছিল দুজনে, কল্পনাকে এত দূরের কিছু মনে হচ্ছিল, এত অস্পষ্ট আর জটিল-পা বাড়ানোর কথা ভাবতেই ক্লান্তি লাগছিল প্রচুর। এখানে কল্পনা এসে খুব সহজ আর সুন্দর হয়ে গেছে যেন। চোখে কীসের চঞ্চলতা, চলাফেরা আত্মপ্রচারের ভাবটা প্রবল, নিজের যা কিছু আছে–উজাড় করার মতলব যেন ঝিলিক দিচ্ছে সারাক্ষণ।
এসব নীরেনেরই নতুন ভাবনার প্রতিফলন নয়ত? মনে মনে নীরেন বলল, না– কদাচ নয়। খুব সহজে ছুঁতে পারার সুযোগ দিতে চাচ্ছিল কল্পনা, এটা ঠিকই। হয়তো ভাবতে ভাবতে দেরি করে ফেলেছে নীরেন। দিব্যেন্দু ওত পেতে ছিল। সে ছুঁয়ে ফেলেছে কল্পনার বুড়ি। কিন্তু একটুখানি বিসদৃশ ঠেকে। সকালে দিব্যেন্দু হয়তো কল্পনারই ছবি তুলতে চেয়েছিল, কল্পনা দুহাতে মুখ ঢাকল কেন? নীরেনের পাশে ছিল সে–তাই?…..
ঘৃণা হল মনে। কল্পনার দেহের স্পর্শ ভীষণ ঠান্ডা লাগল তার। একটু সরে আকাশ দেখতে গেল নীরেন। দেখে বলল, যা ব্বাবা! কান্নাকাটি কখন থামবে?
দীপেন বোস চীনার পাশে। তার পিছনে ইরা চীনার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। দীপেন স্ত্রীকে বলল, কী ব্যাপার! তোমরা পরস্পর আলাপ করছ না যে! কী হল হঠাৎ?
চীনা হাসল।…..ইরা কথা বলবে কী! যে হাঁটাচ্ছেন–বেচারি হাঁফিয়ে পড়েছে। ছেলেবেলায় ওকে আমরা পুতুল বলে ডাকতাম, জানেন? কী ফ্যাটি না ছিল!
দীপেন কপট গাম্ভীর্যে বলল, ফ্যাট শুকোনোর দায়িত্ব অবশ্য আমার নয়। কেউ যদি রোগা হবার জন্যে দুবেলা ডাক্তার দেখায়, আমি কী করতে পারি বলুন?
ওষুধ খেয়ে ফ্যাট কমানো যায়? কল্পনা প্রশ্ন করল।
দিব্যেন্দু বলল, কেন? ফ্যাট কমাবে তুমি?
সবাই হেসে উঠল এ কথায়। হাসবার কারণ ছিল। কল্পনার শরীরে ফ্যাটের কোনো রকম লক্ষণ নেই। ছিপছিপে হাল্কা গড়ন তার। কেবল মুখটাই যা ডিমালো আর ভরাট। প্রথম প্রথম দিব্যেন্দু ওকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিস্তর উপদেশ দিয়েছে। একটু ছোটাছুটি খেলাধুলো অল্পস্বল্প ব্যায়াম আর ভোরে শয্যা ত্যাগ। কল্পনা এর একেবারে উল্টো। আর স্বাতী-স্বাতীর সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে একত্র মানুষ হয়েছে কল্পনা; কিন্তু স্বাতীর জীবনযাত্রার সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
এখন অবশ্য স্বাতী কোনো মন্তব্য করল না। মজাও নেই। এইমাত্র সবার সঙ্গে হাসল বটে, কেউ যদি ওর হাসিটা লক্ষ করত, দেখত হাসিটা ঠিক হাসি নয়–ওষ্ঠাধরের একটা যান্ত্রিক আক্ষেপ মাত্র। এবং সে কথাই সে ভাবতে থাকল। এ কল্পনা সে-কল্পনা নয়। অন্তর দিয়ে কোনোমতে গ্রহণ করতে পারবে না তাকে আগের মতো। স্বাতী অবাক হয়েছে। এত দুঃসাহসী ভাবতে পারেনি কল্পনাকে। খেলার পুতুল হঠাৎ জীবন্ত হয়ে নিজের খুশিমতো চলতে থাকলে যেমন লাগে, তেমনি লাগছে ওকে। এটা অসহ্য।…ঠিক আছে। ফিরতে দাও–তারপর….
চীনা কী বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছিল। বলল না। দেখল দীপেন বোস কল্পনার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিটা খুব খারাপ লাগল তার। একটু আগে অব্দি ভদ্রলোককে অন্য কী রকম লেগেছিল–মানুষ হয়তো এই রকমই। মুহূর্তের সুযোগ তার কী জানা যায়। কল্পনার সঙ্গে সামান্য দুটি দিনের আলাপ। এরই মধ্যে মেয়েটিকে এত ভালো লেগে গেছে চীনার। খুব শান্ত আর বাধ্য মেয়ে। স্নেহ-ভালোবাসা সম্প্রীতি দিয়ে ওকে এত সহজে বশ করা যায়! ভরাট লম্বাটে গালের ওপর ভাঁজ-পড়া দুটো টানা চোখে সামান্য বিষণ্ণতার ছিট আছে কল্পনার–যা ওর সৌন্দর্যের একমাত্র উৎস। শিল্পের নিশা এবং মুখে শ্রাবস্তীর কারুকার্য।তবে পাখির নীড়ের মত পরম আশ্রয় বলে। ওর চোখ দুটোকে মেনে নিয়ে কোনো জলজ্যান্ত পুরুষ মানুষেরই সুখী হবার কথা নয়। চীনার শিল্পবোধ যা বলে, কল্পনার দুচোখে গভীর এবং পরম ঘুমের চিরধূসরতা আছে–যা মৃত্যুরই প্রতীক।……
চীনা একটা ছবির বিষয় পেয়ে যাচ্ছিল কল্পনার মধ্যে। অদ্ভুত কম্পোজিশন! শুধুমাত্র একটা রঙের ব্যবহার। সেটা হচ্ছে ধূসর কিংবা অতিধূসর। ছোট ছোট ভাঙচুর রেখা-ঝড়ে ওড়া পাখির বাসায় অবশেষে, ডিমের ভাঙা খোলসের মত কয়েকটা বৃত্তাংশ, শীতের নিষ্পত্র গাছের আভাস দেয় এমন কয়েকটা তির্যক রেখা–আর, আর…..।
চোয়াল শক্ত হয়ে এল চীনা মিত্রর। বুকের ভিতর ঢাক বাজতে লাগল হঠাৎ।
দিব্যেন্দু পরক্ষণে নীরেনের দিকে তাকিয়েছিল। নীরেন কল্পনার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ কেমন অপোগণ্ড সঙের মতো লাগছে নীরেনকে। বেঁটে চ্যাপ্টা শরীর ওর-নাকটাও থ্যাবড়ানো, নাকের নীচে গাঙফড়িংয়ের মতো গোঁফ, পুরু ভুরু, চৌকো চোয়াল। নবাবী আমলে জহ্রদ গুলোর চেহারা কি ওই রকম ছিল? ভূত একটা! জন্তু! ঘেঁটুবনের ভিতর কী করছিল ও? দিব্যেন্দুদের দেখছিল? আড়ি পেতেছিল? নিজেকে ইন্টেলেকচুয়াল বলে আবার জাহির করে বেড়ায়। বড় বড় কথা বলে!
কল্পনাকে দিব্যেন্দু যতটা বুঝেছে, আর কেউ নয়। বেচারা ছেলেবেলা থেকে আত্মীয় বাড়ি মানুষ হয়েছে, মা-বাবার কথা মনেও পড়ে না–যত স্নেহ-ভালোবাসাই পাক্, পর সব সময় পর। তাব ওপর স্বাতীর মতো দেমাকি মেয়ে গারজেনি চালচলন। বেচারা কল্পনা! সে সহজভাবে মেনে নিয়েছে নিজের জীবনকে। অথচ ভাবতে গেলে পৃথিবীতে কল্পনার মতো করুণার পাত্রী আর কেউ নয়।
আর এখানে এসে দিব্যেন্দুরও মনের জোর হঠাৎ বেড়ে গেল যেন। এইসব বন-জঙ্গল মাঠ-ঘাট ইতিহাসের ধূসর সমাধির মাঝখানে এসে পৌঁছলে হয়তে এইটেই স্বাভাবিক। সবাই নিজের নিজের দিকে তাকাতে শেখে। অখণ্ড খণ্ড হয়ে। পড়ে। দিব্যেন্দু নিজের দিকে তাকিয়ে দেখাবার সুযোগ পেয়েছিল। সে দেখেছিল, স্বাতী বড় বেশি আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তার ওপর-কল্পনার ওপর। সে জানতে পেরেছিল, স্বাতীর মতো দেহমনে শক্ত মেয়েকে তার কোনোদিনই ভালো লাগবার নয়। এবং কল্পনাই বেশি কাম্য, বেশি প্রিয় তার কাছে।
তবে শুভ এ-সব ব্যাপারের ঊর্ধ্বে। শুভ তার কবিতা নিয়েই ব্যস্ত। কবিতার বিষয় হিসেবেই তার সবকিছু মনোযোগ আকর্ষণ করে। কল্পনাকে সে মাঝে মাঝে ইতিহাসের কালের এক বিষণ্ণ নায়িকা বলে বর্ণনা করলেও কোনো বিশেষ মোহ আছে বলে জানে না দিব্যেন্দু। অন্তত প্রমাণ বলতে তেমন কিছু পায়নি আজ অব্দি। অবশ্য কাল সন্ধ্যার ব্যাপারটা একটু বিসদৃশ লাগে। শুভ কল্পনার হাত ধরে হাঁটছিল সবার অজানতে–সেকি নিজেরও অজানতে? আর কল্পনা এমন মেয়ে, তার অস্তিত্ব যেন গাছের মতো–গোড়ায় চোট লাগলে কাঁপবে মাত্র, কথা বলবে না!……
শুভ কবিতার সুরে আবৃত্তি করল:
মধ্যরাতে বনের মাথায় উঠলে চাঁদ
ডোবার ধারে পাতব হরিণ ধরার ফাঁদ।
পরক্ষণে হেসে উঠল সে। বলল, ব্যাটা কবির বরপুত্র। দৃশ্যটা ভাবতে আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে। মিস মিত্র, আপনার ছবির সাবজেকট কিন্তু। নোট করে নিন। মধ্যরাতে বনের মাথায় চাঁদ উঠেছে। মধ্যরাতে যে চঁদ ওঠে, তা কৃষ্ণপক্ষের। সুতরাং গোটা নয়, টুকরো চাঁদ। একটা গভীর ডোবা। গভীর কারণ,-এলাকায় যে কয়েকটা পুকুর বা ডোবা দেখেছি সবগুলোই বেশ গভীর। এর কারণও জেনেছি। গঙ্গার পলিমাটিতে ভরাট এলাকা। বালির ভাগ বেশি। সুতরাং জল শুষে নেয়। সুতরাং……
নীরেন তেঁতো মুখে বলল, ছেড়ে দে!
শুভ নিরস্ত হল না।…জাস্ট এ মিনিট। শুনুন মিস মিত্র। এবার ডোবাটার দিকে তাকান। ওই রকম বিচ্ছিরি জ্যোৎস্নায় গাছপালার ভিতর ডোবাটা ভীষণ কালো গর্ত দেখাচ্ছে–আহ মিন, মড়ার গর্ত যেমন। তার পাশে, কী বলব?…ইয়েস, মাকড়সার জালের মতো একটা ফাঁদ। তার উপর ব্যাটা বসে আছে ঘাপটি মেরে। চেহারাটা কেমন হবে বলুন তো? যক্ষরক্ষ টাইপ? সন্নেসীর মতো? বুড়ো বোধহয় নয় রীতিমতো জোয়ান….
চীনা হাসতে হাসতে বলল, জওয়ান বলুন!
শুভ কান করল না। বলতে থাকল, একটা আস্ত মমি খড়িপড়া চেহারা, একটু হলুদ, একটু ধূসর–
এবার কল্পনা হেসে বলল, গিরগিটির মতো?
তবু কান করল না শুভ।…এবং হরিণটাই এ ছবির মূল বিষয়। আত্মভোলা। অবোধ হরিণ। হরিণীই বলা ভালো। শিং-টিং নেই। চুপিচুপি আসছে কিছু না জেনে। তার চেহারায় মানুষের আদল আছে। ইয়েস,…শুভর শরীরটা কেমন শক্ত দেখাল এবার।……
বিভাস স্বাতীর কানে কানে বলল, ছিটগ্রস্ত।
স্বাতী চোখ তুলে তাকাল ওর দিকে। তারপর একটু হেসে নামাল। শুভকে দেখতে থাকল। শুভ কথা হাতড়াচ্ছে। লম্বা লিকলিকে একটা হাতের আঙুল কুঁকড়ে শূন্য থেকে কিছু ধরার চেষ্টা করছে। নীরেন হাত বাড়িয়ে তার হাতটা ধরে ফেলল। বলল, এই শুভ, থামবি?
শুভ নিরস্ত হয়ে কাচুমাচু হাসল। দীপেন বলল, কবির কল্পনা চমৎকার! বরং একটা কবিতা লিখে ফেলুন। একটু অন্য রকম! হরিণটাকে মানুষ করে দিন।
চীনা বলল, মানুষী বলুন।
স্বাতী বলল, বৃষ্টি কিন্তু কমেছে। একটা হয়ে এল। দুটোয় পৌঁছতে হবে।
নীরেন বলল, অতক্ষণ লাগবে না। জাস্ট হাফ অ্যান আওয়ার।…বলে সে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির অবস্থা বুঝে নিল। টিপ টিপ করে পড়ছে। শীত বেড়ে গেছে ইতিমধ্যে। সব আনন্দ মাঠে মারা গেল। এ মাটিতে প্যাঁচপেচে কাদা অবশ্য হবে না। তবে এখন সোজা হোটেলেই ফিরতে হবে। কাঠগোলার বাগান যাওয়ার প্রোগ্রামটা আপাতত বাতিল।
.
বিকেল থেকে সন্ধ্যা আকাশ একেবারে ঝকঝকে নীল। মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। শান্ত সরল লাজুক বালকের মতো রোদ। ভিজে পথঘাট, ছেঁড়াপাতার স্তূপ। তারপর কিন্তু ভীষণ রকমের ঠান্ডা এসে গেল আততায়ীর মতো। অন্ধকার নামলে যে-যার ঘরে অন্যমনস্ক বসে থেকেছে। আনন্দ-আরাম সব দিয়ে হঠাৎ কেড়ে নিলে এরকম বিষণ্ণতা স্বাভাবিক। ফের সেই সময় কিছুক্ষণের জন্যে ইলেকটিরি ফেল। মেজাজ আরও খারাপ, মন আরও হতাশ হতে দেরি হয়নি। প্রস্তুত না থাকার দরুন মোমবাতি ছিল না কারো কাছে। নীচের রিসেপশান চত্বরে সাত-তাড়াতাড়ি একটা হ্যাঁসাগ জ্বালা হয়েছিল। খানিক পরেই মোমবাতি এসে গেল। ম্যানেজার সুরঞ্জনবাবু অপরাধী মুখে নিজেই দরজায়-দরজায় এসে সেগুলো পৌঁছে দিয়ে গেছেন।
এখন টিমটিমে আলো জ্বলেছে স্বাতীদের ঘরে। কিন্তু কিছুক্ষণ বেশ দেখে নেওয়া গেছে এ ঐতিহাসিক পোড়ো শহরের রূপ। স্বাতী বিছানায় শুয়ে আছে চুপচাপ। কল্পনা ততক্ষণ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। দরজাটা বন্ধ ছিল না, সেটা পরে ম্যানেজারবাবু এলে বোঝা গেল। অন্ধকার দেখছিল কল্পনা। জানালার ধারে প্রচণ্ড ঠান্ডা। তা সত্ত্বেও কল্পনা কিছুক্ষণ অন্ধকারের স্বাদ নিবিড়ভাবে গ্রহণ করছিল। উত্তরে জঙ্গুলে বাগানের ছোট-বড় গাছপালার ঘন বুনোট। তার মধ্যে অন্ধকারের যে চেহারা, তা তার মতো ভিতু মেয়ের পক্ষে অসহনীয় হবার কথা। এ চেহারা তার অপরিচিত। কিন্তু কল্পনা তারিয়ে তারিয়ে তার আস্বাদ গ্রহণ করছিল যেন।
দিব্যেন্দু নয়, শুভর কথা ভাবছিল সে। শুভ এ শহরের নাম দিয়েছে গোস্ট টাউন-ভূতের শহর। সারারাত এর ধ্বংসস্তূপ আর পোড়ো বাড়ির মধ্যে নাকি অতীত সময় প্রতিবিম্বিত হতে থাকে। হাবসী খোঁজাদের চলাফেরা, তলোয়ারের ঝনাঝন, ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, নর্তকীদের ঘুঙুর বাজে, নকীব হাঁকে–নবাব মনসুর-উল-মুল্ক মীরজা মোহাম্মদ সিরাজদ্দৌল্লা হায়বক্তৃঙ্গ বাহাদুর! তখন হাসি পেয়েছে শুনে, এখন পাচ্ছিল না।…লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসে মোহাম্মদী বেগ, হাতে ধারালো খড়গ…আসে মীরজাফর, ইয়ারলতিফ রায়দুর্লভ……জগৎ শেঠের থলে থেকে মোহর পড়ে যায় ঝনাঝ…..কত কী ঘটে যায়…..সব স্পষ্ট হতে থাকে।
বাগানের ভিতরে কোথায় এক ঝলক আলো জ্বলে উঠেই নিভল। কল্পনা সরে এসেছিল জানালা থেকে। সেই মুহূর্তে স্বাৰ্ত অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠেছে, কে, কে।
দরজার ওদিকে সামান্য পায়ের শব্দ হল মাত্র। কল্পনা বলেছিল, কই কে?
স্বাতী আর কথা বলেনি। কল্পনা নিজের বিছানায় চলে এসেছিল। তখনই ম্যানেজারবাবু মোমবাতি নিয়ে এসে গেল। খুব অসুবিধে হল, বুঝতে পারছি। ভেরি সরি। আনএকসপেকটেড ব্যাপার। নিন, ভয় পাননি তো?
দুজনেই মাথা নেড়েছিল। সুরঞ্জন চলে যাবার সময় স্বাতী বলেছিল, দেখুন আমার খাবারটা এখানেই পাঠিয়ে দেবেন।
ফের স্তব্ধতা ঘরে। শুধু ঘরে নয়, সবখানে। পৃথিবী যে এত স্তব্ধ আর আবিষ্ট হতে পারে জানা ছিল না। কল্পনা মুখ তুলল। স্বাতীর পায়ের ব্যথা নিয়ে কিছু বলা দরকার ভাবল। বলল না। স্বাতী আজ তার সঙ্গে কথা বলছে না। না বলুক। অত রাগ মানাতে পারছে না কারো! কল্পনা গ্রাহ্য করল না ব্যাপারটা।
দিব্যেন্দু এল একটু পরে। বসল না। স্বাতীর পায়ের অবস্থাটা জেনেই চলে গেল। তারপর এল চীনা। হাসতে হাসতে এসে কল্পনার বিছানায় বসল সে।……কী ভূতুড়ে কাণ্ড রে বাবা! উঃ, যা ভয় না পেয়েছিলাম। আলো দিয়ে যেতেই পালিয়ে বেঁচেছি। সবে তুলি হাতে নিয়েছিলাম…
কল্পনা বলল, অন্ধকারে ছবি আঁকতে পারেন চীনাদি?
চীনা জবাব দিল, নাঃ তবে চেষ্টা করে দেখা উচিত। ঠিকই বলেছেন কিন্তু। দেখব নাকি?
দরজা খোলা। কপাটটা নড়তেই তিনজনে চমকে উঠেছে। দেখা গেল, ইরা বোস হন্তদন্ত ঢুকছে। মুখে আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট।……এই যে, আপনারা আছেন! কী সাংঘাতিক কাণ্ড ওদিকে। আমার..আমার এ কী হল দেখুন তো! হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল সে।
চীনা লাফিয়ে উঠেছে। কল্পন কয়েক মুহূর্তের জন্যে হতভম্ব তারপর সে মুখ ফেরাল। ভীষণ হাসি পেয়েছে তার। স্বাতী বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।
ইরার হাতে এক গোছা লম্বা চুল। চুলগুলো যে তারই মাথার, তা স্পষ্ট।
চীনা স্থির দৃষ্টে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, চুল খুলেছিলেন কখন?
ইরা কাঁপানো গলায় জবাব দিল, কিছুক্ষণ আগে। আলো নিভে গেল হঠাৎ। তখনও আমার হাতে চিরুনি……।
চীনা বলল, আশ্চর্য! তা চুল খোলার সাধ হল কেন হঠাৎ?
বৃষ্টিতে ভিজেছিল যে। ইরা বোস ফের ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।
কল্পনার রাগ হয়েছে চীনার ওপর। বাঃ, বেচারার চুলগুলো ভূতে এসে কেটে ফেলল, আর ওকে অবাস্তব প্রশ্ন করে জ্বালাতন করছে। সে বলল, দীপেনবাবু ঘরে ছিলেন না?
না। ইরা মাথা দোলাল।
স্বাতী বলল, অদ্ভুত ভদ্রলোক তো! স্ত্রীকে অন্ধকারে ফেলে কোথায় আড্ডা দিতে গেলেন!
ইরা বলল, ও অনেক আগে বেরিয়েছে। ফিরতে একটু রাত্রি হবে বলে গেছে।
চীনা বলল, কোথায় গেছেন, বলে যাননি?
ইরা জবাব দিল, বিজনেসের ব্যাপারে গেছে। কাল ফের জিয়াগঞ্জ, তারপর লালগোলা যাবে বলছিল। সর্বনাশ! আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারব না। ফিরে এলে বলব, এক্ষুণি রেখে এসো কলকাতায়।
স্বাতী বলল, ঠিক আছে। আপনি ততক্ষণ এখানে থাকুন। চীনাদি, প্লিজ, ম্যানেজারবাবুকে খবর দিন না।
চীনা বলল, কেন?
ব্যাপারটা ওঁকে জানানো দরকার। স্বাতী গম্ভীর মুখে বলল।…এ কি কাণ্ড চলেছে! ওর টুথব্রাশ হারাল। আমার একপাটি জুতো গেল বিভাসবাবুর বাথটাবে। ওঁর চুল কাটল……
ইরা লাফিয়ে উঠল।…..না, না! প্লিজ! এ সর্বনেশে ব্যাপারটি কাকেও বলবেন না। বড্ড লজ্জার কথা। ছেড়ে দিন। চুল গেছে যাক্, এ নিয়ে কেলেঙ্কারি করতে চাই নে। ভূতের শহরে এমন হবে জানতাম।
চীনা বলল, কিন্তু ভূতে আর যাই করুক, জলজ্যান্ত চুল কেটে রসিকতা করবে কেন? এ নিশ্চয় হোটেলের কোনো বদমাইশ লোকের কাজ।
কল্পনা বলল, আমাদের মধ্যে কেউ করছে না, তার ঠিক কী?
স্বাতী চড়া গলায় বলল, বোকার মতো বলো না। আমাদের মধ্যে এমন ইতর কেউ আছে বলে আমি মনে করি নে।
কল্পনা দমল না……ইতর নয়, স্রেফ রসিকতা হতে পারে।
চীনা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে এবার। মৃদু কণ্ঠে বলল, কে সে? ছেলে না মেয়ে?
কল্পনা বলল, মেয়েদের এত সাহস হবে না।
স্বাতী তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকাল ওর দিকে।…..তবে কে?
কল্পনা মাথা দোলাল। আমি জানি নে। আমার মনে যা হল, বললাম।
কাটা চুলের গোছাটা ইরা জানালা সামান্য ফাঁক করে ফেলে দিল। তারপর মাথার চুলগুলো কোনো রকমে জড়িয়ে খোঁপামতো করে ফেলল। বসে থাকল মুখ নীচু করে। তখনও সে ফোঁপাচ্ছে।
ইলেকটিরি আলো জ্বলবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। সারা শহরই অন্ধকার একেবারে। ঘরে চারটি মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। একটু পরে হোটেলের পরিচারিকা মানদা এল।……খাবার দেওয়া হচ্ছে নীচে।ওনারা সব গেছেন। আপনাদের ডাকতে বললেন দিদিমণিরা।
স্বাতী বাদে সবাই বেরল। স্বাতী বলল, আপনারা যান, আমার ভয় করবে না।
.
প্রকাণ্ড ডাইনিং হলটা আলো-অন্ধকারে রহস্যময় দেখাচ্ছে। অনেকগুলো মোমবাতি জ্বলছে টেবিলে-টেবিলে। সবাই এসে পড়েছে ততক্ষণে। একটা টেবিল ঘিরে যথারীতি শুভ নীরেন দিব্যেন্দু আর বিভাস। অন্যটায় একা দেবতোষ। সুদেষ্ণা স্বপাক খান। অন্য একটা টেবিলে চীনা, ইরা আর কল্পনা বসেছে।
সুরঞ্জন বলল, কিচেনের পাশের ঘরটা আজ ভরতি হল। এক ভদ্রলোক এসেছেন। আলাপ করিয়ে দেব–এক্ষুনি এসে পড়বেন। বেশ রসিক মানুষ কিন্তু। আমাদের পরিচিত–প্রায়ই আসেন এখানে।
বলতে বলতে সেই ভদ্রলোক হাজির হয়ে করজোড়ে নমস্কার করলেন। সুরঞ্জন বলার আগেই উনি আত্মপরিচয় দিলেন।…আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। পেশা পর্যটন, বাসস্থান কলকাতা।
মুখে একরাশ সাদা দাড়ি এবং মাথায় প্রশস্ত টাক, পরনে প্যান্ট-কোট-টাই-হাতে ছড়ি, মুখে চুরুট। প্রকাণ্ড শরীর। সবার দিকে বাও করে দেবতোষের সামনে বসে পড়লেন। বললেন, ইয়ংম্যানদের কাছ থেকে আজকাল দূরে থাকাই নিরাপদ। কী বললেন সুরঞ্জনবাবু?…পরক্ষণে প্রচণ্ড হো-হো হাসি।
দেবতোষও হেসে উঠেছেন। যা সঙ্গী পাওয়া গেছে মনোমতো।
শুভ নীরেনের কানে কানে বলল, মেয়েদের টেবিলে আজ কী হয়েছে রে? সব ভিজে দেখাচ্ছে।
নীরেন একটা আড়ামোড়া দিয়ে মন্তব্য করল, বৃষ্টিপাতের ফলাফল।
.
০৪.
হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে–শোবার সময় অ্যাসপিরিন জাতীয় একটা ট্যাবলেট খেয়েছিল স্বাতী–তাতেও কাজ হয়নি। ঘুম আসছিল না তার। নড়াচড়া করলে ব্যথাটা আরও টের পাচ্ছিল। চোখ দুটো বোজা। মাথার কাছের টেবিলে অধভুক্ত খাবারের থালা। মানদা কখন চলে গেছে নিজের বাড়ি। ম্যানেজার লোকটি এমন ভদ্র, বলছিল–আমি নিজেই নিয়ে যাবখন, ভাববেন না। স্বাতী এঁটো থালা তাকে ছুঁতে। দেয়নি। চাকরবাকরগুলো সবাই সকাল সকাল বাড়ি পালিয়েছে আজ। ভীষণ ঠান্ডা, তার ওপর অন্ধকার। বাবুর্চি নীচের ঘরে খিল এঁটে শুয়ে পড়েছে। হোটেলটা জনবিরল কেল্লাবাড়ির সুবিস্তীর্ণ চৌহদ্দিতে। সেকারণে এমনিতেই সন্ধ্যার পর স্তব্ধ আর নিরিবিলি হয়ে পড়ে। প্রশস্ত প্রাঙ্গণ আর প্রাইভেট রোড ধরে বেশ কিছুটা হাঁটলে তারপর প্রধান ফটক। দারোয়ান আছে সেখানে। রাত বারোটায় গেট বন্ধ হয়ে গেলে বাইরের কারুর কেল্লা এলাকায় প্রবেশের কোনো উপায় থাকে না। আসবার ইচ্ছে কোনো কারণে প্রবল হলে ওই পশ্চিম সীমান্তে গঙ্গার দহ পেরিয়ে আসা সম্ভব। এ শীতে সে সাধ কারো থাকলেও সম্বরণ করা ভালো।
মাথার কাছে টেবিল ল্যাম্পের ব্যবস্থা আছে। সেদিক থেকে বলতে গেলে আধুনিক কায়দায় জীবনযাত্রায় প্রায় সবরকম উপকরণ প্যালেস হোটেলে রয়েছে। স্বাতী হঠাৎ চমকে উঠল। মাথার কাছে যেন খুটখুট কী শব্দ হচ্ছিল। অভ্যাসবশে সে হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপল টেবিল ল্যাম্পের। বাঃ! ইলেকটিরি চালু হয়েছে কখন! ঢাকনার নীচে থালা আর জলের গ্লাসের ওপর আলো পড়েছে। বিড়াল সম্ভবত। পরক্ষণে তার মনে হল, বিড়াল আসবে কোনো পথে? দরজা বন্ধ।
অবশ্য প্রকাণ্ড জানালাটা মাথার দিকে খোলা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে। তাই এত শীত লাগছে! কিন্তু এটা স্বাতীর অভ্যাস। জানালা বন্ধ করে সে ঘুমোতে পারে না। সামান্য কাত হয়ে সে কয়েক মুহূর্ত জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। বাইরে ঠাসা অন্ধকার। গাছপালা আছে উত্তরে। তাই আকাশ দেখা অসম্ভব। কিন্তু এ পথে বিড়াল আসতে পারে না। নীচে খাড়া দেয়াল নেমে গেছে। তবে কি কানের ভুল? সম্ভবত তাই। আসলে আজ সন্ধ্যার পর ইরা বোসের এক গাছা চুল কাটা গেছে–এ ঘটনাটা কিছু ভৌতিক তাৎপর্য পেয়ে গেছে তার অবচেতনায়। স্বাতী ভূতপ্রেত বিশ্বাস করে না। সে ব্যাপারটা তলিয়ে বোঝবার চেষ্টা করেছে তখন থেকে। শেষে ধরে নিয়েছে, ইরা চালাকি করে এ ঘরে শুতে চায় আসলে। দীপেন বোস আজ ফিরছে না, সে জানে। বিদেশে এমন একটা পরিবেশে একা ঘরে ঘুমোবার সাহস তার নেই বলেই। এই চালাকিটুকু করেছে ইরা। চুল যতটুকু কাটা গেছে, গুনলে বড়জোড় পাঁচটা কি ছটা হবে–তার বেশি তো নয়ই। ও চুলের জন্যে ইরা বোসের মাথার সৌন্দর্য একটুও হানি হবে না। বোঝাই যায় না যে চুল কাটা গেছে। যত্তসব!
তবু মনটা কেমন ছমছম করে সেই থেকে। কল্পনার টুথব্রাশ, তার জুতো…শুধু কি নিতান্ত রসিকতা? সাহসের চেষ্টা সত্ত্বেও বুক টিপটিপ করে উঠল স্বাতীর। আচমকা হাত বাড়িয়ে নিজের ববছাঁট চুলগুলো ছুঁলে সে। তারপর আশ্বস্ত হয়ে ওপাশের দেয়াল ঘেঁষে পাতা কল্পনার খাটটার দিকে তাকাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে ওরা ঘুমোচ্ছে। ইরা বোস আর কল্পনা। দুটো মাথা ডুবে আছে কম্বলের নীচে। কী ভয়!
কতক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকল ফের। এখানে বেড়াতে আসার পর যা-যা ঘটেছে, মনে ভেসে উঠল একের পর এক। দিব্যেন্দু আর কল্পনা তার মনের ভিতর খুবই তীব্র হয়ে দেখা দিতে থাকল বারবার। দুটো পোকার মতো ওরা তার মগজটা কুরে খাচ্ছিল অজানতে। ঘুণ পোকার দাঁতের শব্দ এবার স্পষ্টতর হচ্ছে তার অস্তিত্বের গভীরে। অসহ্য! দাঁতে দাঁত চাপল সে।
.
বিভাসের ঘুম আসছিল না। অনেক কথা ভাবছিল সে। এত বড় একটা ঘর একা নিয়েছে বিভাস। আজ যেন ঘরটা প্রকাণ্ড মুখব্যাদান করে তাকে গিলে খেতে চাইছে। এক অভাবিত অগাধ শূন্যতা থমথম করছে তার চারপাশে। নিজের ভবঘুরে জীবনে আর এমনি করে কোনোদিন কিছু আশা করে বসেনি সে। আজ জাদুকরী আশা তার। ভ্রমণ বা পর্যটনের সব সুখে আগুন জ্বেলেছে। একটুখানি সাহসের দরকার শুধু। সব। কিছু হয়তো প্রস্তুত–বিপুল আয়োজন সামনে, সে হাত বাড়িয়ে সাহসের কচি চালিয়ে দ্বিধাসংকোচের ফিতেটা কাটলেই শুভ উদ্বোধন।
অন্ধকার মেঝেয় বদ্ধ ঘরে পায়চারি শুরু করল সে। নিজের অলক্ষে গুন-গুন। করে তার নতুন গানটা গাইতে থাকল। গানটা বানিয়েছে শুভ। ভারি সুন্দর কথা আসে ওর মাথায়। প্রথম পরিচয়ে সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলো উপহার দিয়েছিল সে।
……আমরা সবাই এসেছিলাম হারিয়ে যাবার খেলায়……
কিন্তু হারিয়ে যাবার খেলা কেন? এ তো পৌঁছে যাবার পাড়ি অন্ধকারের ভেলায় ভেসে! আস্তে আস্তে জানালা খুলে দিল সে। একটু ঝুঁকল। খুবই অকারণে সে অন্ধকার বাগানটা একবার দেখে নিতে গেল। তারপর চমকাল।
এইমাত্র নীচে দপ করে আলো জ্বলেই নিভে গেছে। দেশলাই জ্বেলে কে সিগ্রেট ধরাল। মুখটা খুবই পরিচিত বিভাসের; এত রাত্রে ওখানে কী করছে ও? ঘড়ি দেখল বিভাস-বারোটা পাঁচ।
বিভাস একটু হাসল। খেয়ালি মানুষ! অন্ধকার বাগানে দাঁড়িয়ে হয়তো রাত্রির রূপ দেখছে। চমকে দিলে জোর তামাশা জমে যায়। বিভাস সাবধানে দরজা খুলল। থামওয়ালা টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে–চীনা মিত্রর ঘরের পাশেই সরু একফালি ঘুরন্ত সিঁড়ি। দরজায় তালা নেই তো?
পা টিপে টিপে সে বেরুল। কপা যেতেই পিছন থেকে মেয়েলি বাজখাঁই ডাক– কে, কে যাচ্ছে?…বাঁপস্। শূর্পনখা ব্যানার্জি যে! থামের আড়ালে লুকোয় বিভাস।
অধ্যাপকগিন্নি বেরিয়েছেন এত রাত্রে! কী ব্যাপার কে জানে! কিন্তু আর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পা বাড়াল বিভাস চীনা মিত্রর ঘরে আলো জ্বলছে। কপাটের ফাঁকে আলোর ইশারা। তাহলে কি ইলেকটিরি চালু হয়েছে এতক্ষণে? ম্যানেজার হয়তো ঘুমোচ্ছে। তাই বারান্দায় বা সদর পথের সিঁড়িতে আলোগুলো জ্বালেনি প্রথামতো। বিভাস ভাবল, ফিরে এসে ম্যানেজারকে ডেকে ওঠাবে। আলোগুলো জ্বেলে দিতে বলবে।
চীনা মিত্রর ঘরের সামনে একটা জানালা আছে। খড়খড়ির ফাঁকে চোখ রাখল সে। অবাক হল। পাগলের মতো করছে কী চীনা? বাকসোপত্র সব ওলটপালট করেছে–বিছানা ওলটানো-ঘরের সব কিছু তছনছ। চুলে হাত বোলাচ্ছে। চোখ দুটো লাল। সম্ভবত এলোপাথাড়ি কী খুঁজছিল–না পেয়ে স্তম্ভিত। কী হারিয়েছে চীনা মিত্রর?
আর্টিস্টের কারবার! বিভাস মনে মনে হাসল। ইজেলে অসমাপ্ত ছবি–তার ওপর আলো পড়েছে টেবিল ল্যাম্পের। ছবিটা চেষ্টা করেও বোঝা গেল না। এলোমেলো সব রেখা আর চাপ চাপ রং। নাকি এই তছনছ ঘরটাকে মডেল করে কিছু আঁকতে চায় চীনা মিত্র? একটা ধ্বংসেব ছবি? ধ্বংসই কি ওর জীবনে সত্য?
পা টিপে টিপে বিভাস ছোট্ট দরজাটার সামনে গেল। এ পথে কেউ নামে না নীচে। নীচে বাগান। হয়তো কোনো সময় নামবার দরকার হত। বাগানটা তখন সাজানো-গোছানো সুন্দর ছিল, এখন জঙ্গল হয়ে গেছে।
দরজায় তালা নেই। একটা হুড়কো ঠাসা আছে মাত্র। সেটা খুলে বেরিয়ে পড়ল সে। সিঁড়িটা লোহার। কোনোরকমে একজন নামা চলে। বিকেলের বৃষ্টিতে বেশ পিছল হয়ে রয়েছে।
নীচে ঘাসের জঙ্গল গজিয়েছে। হুড়মুড় করে পেরিয়ে ফাঁকায় পৌঁছল সে। কিছু দেখা যায় না অন্ধকার। থমকে দাঁড়াল সে। জ্বলন্ত সিগ্রেটটা কোথায় গেল? শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার–আর প্রচণ্ড কনকনে ঠান্ডা। হাড় অব্দি নড়ে যাচ্ছে। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হল তার। কী বদখেয়ালে এ ছেলেমানুষি করতে এল। কোনোদিকে পা বাড়াতে সাহস হচ্ছে না। কোথায় পা ফেলতে কোথায় ফেলবে।
বিভাস নির্বোধের মতো দাঁড়িয়ে রইল। না পারছে এগোতে, না পিছোতে। সেই সিঁড়িটাও অনুমান করতে পারছে না। সদর পথে পৌঁছতে গেলে কাঁটাতারেব বেড়া পেরুতে হবে। কিন্তু সেটাই বা কোনোদিকে কে জানে! যাকে দেখে নেমে এসেছে, তাকে ডাকতেও সাহস হচ্ছে না। ওপরে বা নীচের ঘরে কেউ জেগে থাকলে কী ভেবে বসবে না জানি! রাগে ক্ষোভে নিজের নির্বুদ্ধিতাকে ধিক্কার দিচ্ছিল সে।
.
নীচের ত্রিকোণ বারান্দায় রিসেপশন টেবিল। রাতের দিকে টেবিল অর্থাৎ আপিসটা পাশের ঘরে ঢুকে যায়, দিনে বেরিয়ে আসে। ও ঘরে সুরঞ্জন থাকে। তার পাশেরটায় দারোয়ান। অবশ্য বারান্দায় একটা খাঁটিয়া আছে। ওটা দারোয়ানের লোকদেখানো কারবার। আজ যা শীত পড়েছে, তাতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। বেচারা মানুষ তো বটে!
শুনশান নির্জন নীচের তলা। জনপ্রাণীটি নেই। কী বিচিত্র ব্যবস্থা এদের! এ সময় যদি চোরডাকাত ঢুকে বোর্ডারদেব সর্বস্বান্ত করে যায়, কারো মাথাব্যথা নেই। অধ্যাপক দেবতোষ ব্যানারজি আগাগোড়া পশমি পোশাক ঢেকে বেরিয়ে। পড়েছিলেন। মাথায় টুপি, গায়ে ওভারকোট, পরনে ধুতি, পায়ে হাঁটু অব্দি মোজা। আর পাম্পসু। রবারের সোল বলে কোনো শব্দ হচ্ছিল না চলাফেরায়। সুদেষ্ণা নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ওঁকে না দেখতে পেলেই অবশ্য হইচই লাগবার কথা। লাগুক। অত আদিখ্যেতা আর সয় না দেবতোষের। সারাজীবন ধরে এই মহিলা তাঁকে জ্বালিয়ে আসছেন। জীবনে কত কী উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল–কোনোটাই মেটেনি। এ সব কিছু ব্যর্থতার জন্যে দায়ী সুদেষ্ণা। সবতাতেই তার নাকগলানো অভ্যাস। পুরাতত্ত্বের বিচিত্র বিষয়ে থিসিস লিখবার চেষ্টা করছেন কতদিন থেকে। তার জন্য কত জায়গায় যাওয়া দরকার–কত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাতেকলমে করা দরকার। সুদেষ্ণা তাকে স্বামীর কোনো গূঢ় অভিসন্ধি ধরে নিয়ে আবোলতাবোল অভিযোগে মাথা খারাপ করে দেন। এত অবিশ্বাস আর সন্দেহ কেন সুদেষ্ণার? বয়স হয়েছে–তা সত্ত্বেও……ধুৎ!
মনের ভিতর চাপা ক্ষোভ নিয়ে মানুষ কতদিন ঠিক থাকতে পারে লক্ষ্যে পথে? দেবতোষ বারান্দা থেকে নীচের লনে নামলেন। নামবাব সময় সুদেষ্ণার কথা ফের ভাবলেন। জাগে তো জাগুক পারা যায় না আর।
সবখানে অন্ধকার। অন্ধকার দরকারও। কিছুক্ষণ অন্ধকার থাক আরও। ফিরে এসে সুরঞ্জনকে জাগিয়ে দেবেন। ইলেকটিরি চালু হয়েছে। হোটেলের যে আগুলোলো সারারাত জ্বলে জ্বালিয়ে দিতে বলবেন। আপাতত অন্ধকার থাক সব।
ফটক পেরিয়ে সোজা হেঁটে গঙ্গার ধারে গেলেন দেবতোষ। বাঁধানো ঘাটের কাছে, মণ্ডপটার নীচে তাকে পৌঁছতে হবে। পকেটে টর্চ আছে। হাত পুরে টর্চটা বের করলেন। দাঁতে দাঁত চেপে, উত্তেজনায় অধীর দেবতোষ পা বাড়ালেন মণ্ডপটার দিকে।
ওখানে একটু ঘুরে মসজিদের পিছন দিয়ে গেলে আর কারও চোখে পড়বে না।……
.
স্বাতী দেখল, হঠাৎ আলোটা নিভে গেল। ফের কারেন্ট ফেল! কোনো মানে হয়? বড়িটা নিল সে। উঁচু হয়ে জলের গ্লাস নিল। অন্ধকারেই খেয়ে নিল বড়িটা। যন্ত্রণা। কেন এত! হাড়ে চোট লেগেছে সম্ভবত। কালই কোনো ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।…
সেই সময় বাইরে কে কাকে ডাকল যেন। কোথাও সামান্য শব্দ হল কীসের। ফের সব চুপচাপ।……
পাশ ফিরে শুল স্বাতী। কেন এখানে বেড়াতে এসেছিল? কী পেতে চেয়েছিল? ভাবতে ভাবতে ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল চোখের পাতা। হঠাৎ ফের অস্পষ্ট শব্দ। দরজার দিকে। স্বাতী অস্ফুট চেঁচিয়ে উঠল, কে, কে!
দিব্যেন্দুর হাসি শোনা গেল।…..আমি। ঘুমোওনি দেখছি!
স্বাতী উঠে বসবার চেষ্টা করে বলল, দরজা খোলা ছিল নাকি?
তাইতো দেখছি। বলে দিব্যেন্দু তার বিছানায় এসে বসল।
খোলা ছিল? স্বাতী অবাক।……বাঃ! কল্পনা যে দরজা বন্ধ করল তখন……কী আশ্চর্য! তোমার কাছে দেশলাই আছে?
না। এনে দিচ্ছি।
দিব্যেন্দু উঠতে যাচ্ছিল, স্বাতী তাকে নিবৃত্ত করে বলল, আনছ। কিন্তু এত রাত্রে কী ব্যাপার তোমার?
দিব্যেন্দু চুপ করে থাকল।
বলছ না যে? স্বাতী ধমকের সুরে বলল।…. এ ঘরে কাকে খুঁজতে এসেছ? চালাকি করো না।
চালাকি? কী বলছ স্বাতী? বিশ্বাস করো, শুভ নেই।
বাইরে কোথাও বেরিয়েছে তাহলে। গঙ্গার ধারে গিয়ে বসে আছে।
নাঃ বাইরে গিয়েছিলাম এইমাত্র। তার নাম ধরে ডাকলাম–সাড়া পেলাম না। তাছাড়া বাইরে কী প্রচণ্ড শীত, কল্পনা করতে পারবে না। এর মধ্যে শুভ বেরোবে কোনো সাহসে, এত ভিতু আর গোবেচারা ও।
নীরেন কী করছে? বলেছ তাকে?
বলেছি। হয়তো কানে যায়নি–বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
বিভাসবাবুর ঘরে যাও। সেখানে পেয়ে যাবে।
গিয়েছিলাম। বিভাসবাবুও ঘরে নেই।
সে কি!…স্বাতী চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পরে বলল, দীপকবাবু ফিরেছেন জানো?
না। দরজায় তালা ঝুলছে। তাকে ডাকতে গিয়েই, টের পেলাম। তারপর মনে পড়ল, ওঁর স্ত্রী তোমাদের ঘরেই রাত কাটাবেন বলেছিলেন……দিব্যেন্দু গলাটা খাটো করল, এখানেই আছেন নাকি?
আছেন কল্পনার পাশে।
দিব্যেন্দু একটু চুপ করে থেকে বলল, ভীষণ ঘুম তো! এতক্ষণ কথা বলছি, ঘুমের আবেশ কাটে না। বাস! এইসব মেয়েদের বাইরে আসা উচিত নয়। একটা বিপদ আপদ হলে…..
স্বাতী ওকে একটু ঠেলে দিয়ে বলল, ঘরে যাও তো। আপদ বিপদ কিছু হয়নি। কী যে জ্বালাতন করো সব।
দিব্যেন্দু যেন ঘাবড়ে গেল।…বা রে! দরজা খোলা রেখে ঘুমোচ্ছে, জানিয়ে দিয়ে যাওয়া খুব অপরাধ হল দেখছি!
স্বাতী বলল, সেজন্যে তুমি আসোনি।
ফের আজে-বাজে কথা!
যে জন্যে এসেছ, তা আজ অন্তত সম্ভব নয়–তা বুঝতেই পারছ।
স্বাতীর নির্বিকার কণ্ঠস্বর। দিব্যেন্দু ওর মুখে হাত দিতে চাইল।…..আঃ ছি, কী হচ্ছে! ওরা শুনতে পাবে যে। এত বিশ্রী কথা বলতে তোমার আটকায় না স্বাতী?
স্বাতী হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠল।……যাও, বেরোও দরজা আটকাবো। কী ভূতের দেশে আসা গেছে। যথেষ্ট হয়েছে। কাল সকালেই ফিরছি। জেনে রেখো।
দিব্যেন্দু বেরিয়ে গেল। বোঝা যায়, ভীষণ রেগেছে। রাগুক। দরজা আটকে স্বাতী কয়েক মুহূত দাঁড়িয়ে থাকল ঘরের মধ্যিখানে। তারপর বিছানার কাছে সাবধানে এগিয়ে ডাকল, বউদি! এই ইরাদি!
ইরার সাড়া পাওয়া গেল। চাপা হাসির ঝংকার আছে কণ্ঠস্বরে।……জেগে আছি। সব শুনছি। কান খোলা–আমায় দোষ দেবেন না কিন্তু।
স্বাতী বলল, কল্পনাকে ডাকুন তো।
ইরা জবাব দিল, ওর কথাই তো ভাবছি কতক্ষণ থেকে। জেগে থাকতে বলে কখন বেরিয়েছে। এখনও এল না।
বেরিয়েছে মানে? স্বাতী রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল।……। কী বলে বেরিয়েছে?
কিছু বলে তো যায়নি। ইয়া নির্বিকার জানাল।…এক্ষুনি আসছি বলে গেল তো গেলই। ভাবলাম, পাশের ঘরে দিব্যেন্দুবাবুদের কাছে আড্ডা দিতে গেল। তারপর দিব্যেন্দুবাবু এল দেখলাম বোঝা গেল, ওর ঘরে যায়নি। তাহলে..
স্বাতী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তাহলে কী ইরাদি?
ইরা হাসছিল খিল খিল করে।…অনুমান করে নিন। শুভবাবু নেই ঘরে, তাও শুনলেন। যান, শুয়ে পড়ুন। দরজা খোলা থাক। ঘরের স্ক্যান্ডাল নিজে থেকে ছড়িয়ে লাভ কী বলুন;
স্বাতী নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরোচ্ছে দেখে ইরা চেঁচিয়ে উঠল, আরে আরে! আপনিও বেরোচ্ছেন নাকি? কী বিপদ! এখন আমি কী করি, বলুন তো? মা গো! এ ভূতুড়ে হোটেলে কী সব কাণ্ড চলেছে রাতদুপুরে। স্বাতী, এই স্বাতী!
উঠে গিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দিল ইরা। তারপর বিছানা লক্ষ করে দৌড়ে এল। কম্বল ঢাকা দিয়ে শুয়ে পড়ল।…
.
নীরেন দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে ভয় পেয়ে জেগে উঠল। কিছুক্ষণ চুপচাপ অন্ধকারে তাকিয়ে থাকল সে। তারপর একটু কাশল। গলা শুকিয়ে গেছে। সে মাথার পাশে হাতড়াতে থাকল। টর্চটা কোথায় গেল? খুঁজে না পেয়ে দেশলাই জ্বালল সে। নীচে পড়ে গেছে নাকি? পর পর চারটে কাঠি জ্বেলেও পাত্তা পেল না টর্চটার। তখন সে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে উঠে বসল। জানালাগুলো বন্ধ। ঘরে শীত কম। প্রচুর ওম জমে আছে। সে খাট থেকে নেমে ফের দেশলাই জ্বেলে টেবিলের দিকে এগোল। ল্যাম্পের সুইচ টিপে দেখল এখনও কারেন্ট নেই। ঘড় ঘড় করে উঠল সে, টর্চটা কে নিল? দিব্যেন্দু, দিব্যেন্দু! শুভ! এই শুয়োর!
কোনো সাড়া নেই। টেবিল থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট নিল সে। সিগ্রেট বের করে জ্বালল। তারপর তারই মৃদু ছটায় জলের গ্লাসটা নিয়ে এল। বিছানায় পা দুলিয়ে বসে জল খেল ঢকঢক করে। গ্লাসটা নীচে রেখে দিল। সিগ্রেট টানতে থাকল চুপচাপ।
কী বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দুই শুয়োর! কোনো সাড়াশব্দ নেই একেবারে। নিজের ঘুম যখন ভেঙেছে, ওদের ঘুমোতে দেওয়া ঠিক নয়। নীরেন প্রথমে গেল শুভর বিছানায়। চাটি মারতেই, শুভর মাথা নয়, খাটের কিনারায় লাগল। ব্যথা পেয়ে অস্ফুট কণ্ঠে গাল দিল সে। ঠোঁটে সিগ্রেট রেখে সে ডাকাতি কায়দায় দুহাত বাড়িয়ে শুভর শরীরটা ধরতে চাইল। পরক্ষণে অবাক হয়ে জানল, তার দুহাতে শুভর কম্বল মাত্র। শুভ বিছানায় নেই!
দিব্যেন্দুর বিছানায় গেল সে। তারপর জানল, দিব্যেন্দুও বিছানায় নেই।
রাগে ক্ষোভে অস্বস্তিতে ছন্নছাড়া হচ্ছিল নীরেন। দিব্যেন্দু তাহলে কল্পনার সঙ্গে…বাঃ, চমৎকার অভিসার! কিন্তু শুভ? স্বাতীর সঙ্গে? খুবই সম্ভব। এখানে আসার পর কোনোটাই আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না তার।
দরজা খোলা। বারান্দায় অন্ধকার আর শীত। নীরেন প্রথমে গেল বিভাসের ঘরে। দরজায় টোকা দিল। কোনো সাড়া নেই। চাপা স্বরে ডাকল সে, বিভাসবাবু, বিভাসবাবু! পিছনে সুদেষ্ণার গলা শোনা গেল, কে, কে ওখানে?
এই রে! শূর্পনখার পাল্লায় পড়ে এবার হাজার কৈফিয়ত দিতে প্রাণান্ত হবে। একটু জোরে ধাক্কা দিল সে দরজায়। আশ্চর্য, দরজাটা খুলে গেল যে! পিছনে সুদেষ্ণা গজগজ করছে-কী সব কাণ্ডচলেছে রাতদুপুরে। কে কোথা আসছে যাচ্ছে, কী সব হচ্ছে! যত সব ভূত জুটেছে কোত্থেকে।
বিভাসবাবুর বিছানাও খালি। নীরেন তাজ্জব। গেল কোথায় সব? বেরিয়ে এসে সে থামের আড়ালে দাঁড়াল। কখন কী অবস্থায় ফেরে দেখা যাক। সকৌতুকে অপেক্ষা করতে থাকল সে।
ডাকাডাকিতে সুরঞ্জনের ঘুম ভেঙে গেল। ঘর অন্ধকার। সারারাত টেবিল ল্যাম্প জ্বলে। তবে কি ফের কারেন্ট ফেল করেছে? বাইরে অধ্যাপকের গলা শোনা যাচ্ছে। রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ির কাঁটা লক্ষ করল সে। রাত্রি সওয়া দুটো। এত রাত্রে কেন ডাকাডাকি?
সুরঞ্জন বেরল।
দেবতোষেব হাতে টর্চ।…..কী ব্যাপার মশাই? সব একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। আমার স্ত্রীর আলো ছাড়া ঘুম হয় না। ওদিকে জানালা খুলে দেখি, দিব্যি মিউনিসিপ্যালিটি এলাকায় আলো জ্বলছে–কেল্লাবাড়ির সবখানে জ্বলছে। আলো শুধু এখানেই নেই!
সুরঞ্জন ডাকাল, বাহাদুর, বাহাদুর!
বাহাদুরের সাড়া পাওয়া গেল। অনেক আগে সে নিঃশব্দে বেরিয়েছে। দেবতোষ টের পেয়ে বললেন, আস্ত ভূত যে বাবা! টেরও পাইনি।
বাহাদুর হাসল মাত্র। তার হাতেও টর্চ।
সুরঞ্জন বলল, মেন সুইচটা দ্যাখো তো! ফিউজ হল নাকি।
বাহাদুর এগিয়ে গেল। তারপরই কিন্তু আলো জ্বলে উঠেছে। শিউরে উঠে সুরঞ্জন বলল, কে মেন সুইচ অফ করে রেখেছিল তাহলে! আশ্চর্য তো! সরি, ভেরি সরি, প্রফেসর ব্যানারজি–এমন তো কখনও ঘটেনি।
দেবতোষ মৃদু হাসলেন।…..কেউ রসিকতা করেছিল আর কী! যাকগে। বাঁচা গেল। উঃ অন্ধকার যে এমন অসহ্য হয়, জানতাম না মশাই।
দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে গেল। দেবতোষ নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। সুরঞ্জন গেল দীপেন বোসের দরজায়। ভদ্রলোক ফেরেননি তাহলে। কিন্তু ওঁর স্ত্রী কোথায় গেলেন? সম্ভবত ওই মহিলাদের ঘরে। ফিরে আসছিল সুরঞ্জন। হঠাৎ চমকে উঠল। বিভাসবাবুর ঘর থেকে এত রাতে স্বাতী বেরিয়ে আসছে কেন? থামের আড়ালে সরে এল সে। স্বাতী ল্যাংচাচ্ছে। এমন চেহারা কেন?
নিজেদের ঘরের দরজায় স্বাতী ধাক্কা দিচ্ছিল। বেড়ে মজা চালাচ্ছে তো সব! সুরঞ্জন নিঃশব্দে সরে এল। আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাণ্ডকারখানাই আলাদা। কিন্তু এ হোটেলের একটা ইজ্জত আছে তো! সুরঞ্জন ভাবতে ভাবতে নেমে এল নীচে।
.
০৫.
আজকের সকালটা বেশ পরিচ্ছন্ন। বাইরে শীতের আকাশ ঝকমকে নীল। ভোরের দিকে সামান্য কুয়াশা ছিল। ভিজে মাটির ওপর, শান্তশীতল গঙ্গার জলে আর গাছপালার নীচে সবুজ ও হলুদ ঝরাপাতাগুলো ঘিরে হালকা চলে উড়ে বেড়াচ্ছিল কুয়াশার পরি। সূর্য ওঠার পরই সে উধাও। কিন্তু কী শীত, কী শীত!
মাথায় হনুমান টুপি, হাঁটুঅব্দি মোজা আর গায়ে আলোয়ান জড়িয়ে দেবতোষ একপাক ঘুরে এসেছেন গঙ্গার ধারে। সুদেষ্ণা তখনও ঘুমোচ্ছে। আজ এটা অবশ্য ব্যতিক্রম। ভোরবেলা থেকে ধর্মকর্মের হিড়িক লাগানো তার বাতিল। আজ বোধ করি, শরীরটা ভালো নয়। স্ত্রীকে ঘাঁটানোর সাহস না থাকায় দেবতোষ একা উঠেছিলেন এবং প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছেন। তারপর ডাইনিং হলে চা খাবার ছলে আড্ডা দিচ্ছেন কর্নেলের সঙ্গে।
স্বাতীর সঙ্গে নিত্যকার মতো গঙ্গার ধারে দেখা হয়নি দেবতোষের। ডাইনিং হলেও সে নেই। সম্ভবত বেচারা হাঁটুর ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েছে। ভাবছিলেন, ওর ঘরে গিয়ে দেখে আসবেন নাকি। কিন্তু কর্নেল ভদ্রলোককে দেখে কথাটা শেষঅব্দি ভুলে গেলেন।
এত সকালে নীচে চা খেতে আসার অভ্যাস ছিল কেবল স্বাতী আর দিব্যেন্দুর। বোস দম্পতি আসবার পর আড্ডার লোকসংখ্যা বেড়েছিল গতকাল। শুভ নীরেন আর বিভাস আটটায় ঘর ছেড়ে বেরোয়। ঘরেই তাদের প্রাতরাশের ব্যবস্থা। এবং কল্পনারও।
চীনা মিত্রের আবির্ভাব কদাচিৎ ঘটে এ আড্ডায়। শিল্পী মেয়ে, একটু খামখেয়ালি তো বটেই।
কর্নেল তার যুদ্ধের অভিজ্ঞত বলছেন। শেষ অব্দি দেখা গেল বর্মা ফ্রন্ট থেকে বর্মী বাঁশ–নিদানে বাঁশের কোঁড় এবং খাদ্য-সমস্যা এসে পড়েছে। দেবতোষ কিন্তু আলোচনার মোড় ঘোরাতে চাচ্ছেন পুরাতত্ত্বের দিকে। ভারত, ওপাশে চীন–দুটো প্রাচীন সভ্যতার দেশ। তার দুবাহুর মধ্যে যে ভূখণ্ড–এই বর্মা–সেখানে কিন্তু কোনোদিনই সেরকম দারুণ কিছু লক্ষ করা যায় না। এটা আশ্চর্য লাগে।
কর্নেল টোপ গিলছেন না। কেবল বললেন, তা কেন? বৌদ্ধযুগের কিছু কিছু পুরনো নমুনা জাপানিরা হস্তগত করতে চেয়েছিল। ওদের আত্মসমর্পণের পর সিঙ্গাপুরে একদল জাপানি বন্দির কাছে একটা অদ্ভুত জিনিস পাওয়া গিয়েছিল। তার আগে কী ঘটেছিল শুনুন।
দেবতোষের কানটা অবশ্য শুনছে, মনটা নয়। ডাইনিং হলের এককোণে জানালার ধারে বসে আছে শুভ আর কল্পনা। অবিশ্বাস্য ব্যাপার।…না, ওরা এত সকালে উঠেছে। বা নীচে নেমেছে, সে জন্যে নয়। কাল রাত্রে জঙ্গুলে বাগানের ভিতর হঠাৎ ভয় পেয়ে টর্চ জ্বেলেছিলেন দেবতোষ। সঙ্গে সঙ্গে শুভ যেন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে পালাল। এক মুহূর্তের আলো মাত্র। দ্বিতীয়বার আর জ্বালেননি। শুভ কবিতা লেখে। কাজেই ভীরু স্বভাবের ছেলে সম্ভবত। কিন্তু অন্য কেউ হলে সরাসরি চার্জ করে বসত। দেবতোষও বলা বাহুল্য, কেটে পড়েছিলেন। ধাঁধার মতো লাগছে ব্যাপারটা। ওখানে শুভ কী করছিল অত রাত্রে?
ধাঁধাটার সমাধান মিলেছে এতক্ষণে। কল্পনাকে ওর সঙ্গে সচরাচর এমন অন্তরঙ্গ ভাবে দেখা যায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে। তার মানে, কাল রাত্রে মেয়েটির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। এবং নির্ঘাৎ নিষিদ্ধ অ্যাপয়েন্টমেন্ট। উঃ আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো কী বেলেল্লা না হচ্ছে। সুদেষ্ণা ঠিকই বলে।
বিচিত্র ক্রোধে দেবতোষের শরীরটা তেতে উঠল ক্রমশ। শীতবোধ কমে গেল। বারবার আড়চোখে ওদের দিকে তাকাতে থাকলেন তিনি।
চতুর কর্নেলের দৃষ্টি এড়ায়নি। হঠাৎ ঝুঁকে ফিস ফিস করে বললেন, আর ইউ ডিসটার্বড প্রফেসর? কিন্তু আমরাও একদা যুবক ছিলাম–মাইন্ড দ্যাট।
এই বলে বুড়োমানুষটি চাপা খিক খিক করে হাসতে থাকলেন দেবতোষ অপ্রস্তুত।…না, না। সে কিছু দোষের নয়! আমি এমনি তাকাচ্ছি।
ম্যানেজার সুরঞ্জন এসে গেল।…গুড মর্নিং জেন্টলমেন!
সুরসিক কর্নেল আঙুল তুলে অদূরে থামের আড়ালে শুভ আর কল্পনাকে দেখিয়ে বললেন, দেয়ার ইজ এ লেডি। ফের চাপা হাসি। ফরসা মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছে।
সুরঞ্জন হাসিমুখে দুপা এগিয়ে শুভদের উদ্দেশ্যে বলল, গুডমর্নিং লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন!
শুভ তাকাল মাত্র। কল্পনা সামান্য হাসল এবং মাথা দোলাল।
সুরঞ্জন কর্নেলের টেবিলে এসে বলল, কাল রাত্রে সম্ভবত চোর ঢুকেছিল হোটেলে। মেইন সুইচ অফ করে কাজ সেরে গেছে।
দুজনেই চমকে উঠলেন।…বলেন কী!
…হ্যাঁ স্যার। তবে অন্য কিছু নয়–মিস মিত্র, ওই যে আর্টিস্ট ভদ্রমহিলা, ওঁর একখানা ছবি চুরি গেছে।
…ছবি! দুজনে হেসে ফেলেছেন।…হুঃ, যত্তসব!
..ভদ্রমহিলা খুব দুঃখ পেয়েছেন। সদ্য এঁকেছিলেন ছবিটা। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত কিন্তু। জাস্ট ফিনিশিং টাচ দেবার জন্যে ইজেলেই ছিল ছবিটা। রাত্রিবেলা একবার বাইরে বেরিয়েছিলেন উনি-ইলেকট্রিক কতক্ষণে চালু হবে জানতে এসেছিলেন আমার কাছে। ফিরে গিয়ে আলো অবশ্য পেলেন, পেলেন না ওঁর ছবিটা। দারুণ দামি ছবি নাকি। হাউএভার–আমি শিল্পটিল্প বুঝি না, কিন্তু এ কী বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটল দেখুন তো!
কর্নেল বললেন, কেউ রসিকতা করেছে হয়তো। কাল রাত্রে যা দেখলাম, অনেকের সঙ্গে ওঁর বেশ হৃদ্যতা রয়েছে।
শুভ আর কল্পনার কানে এসেছিল ব্যাপারটা। ওরা পরস্পর তাকাতাকি করে নিঃশব্দে হাসল। তারপর শুভ নীচের ঠোঁটটা বেঁকিয়ে চাপা মন্তব্য করল, মরুকগে।
কল্পনা বলল, ছবিটা আমি দেখেছিলাম কিন্তু।
শুভ তাকাল ওর দিকে। খুব একটা কৌতূহল নেই–তবে কল্পনা ইচ্ছে করলে তাকে ছবির বিষয়টা বলতে পারে। শুনতে আপত্তি নেই।
ওরা অবশ্য চাপাস্বরে কথা বলছিল। কল্পনা বলল, কী ভূতুড়ে সব দৃশ্য আঁকে চীনাদি, বোঝাই যায় না। কতকগুলো এলোপাথাড়ি মোটা দাগ–গাছের গুঁড়ির মতো। ছাইরঙা সেই দাগগুলোর ওপর চাপ চাপ কালো তার ওপর হলদে ধ্যাবড়া খানিকটা রং। একটা মাকড়সার জাল আর একটা বেটপ চাঁদ টাদ আছে যেন। আর নীচে ঝালরের মতো ফিকে সবুজ-নাঃ কী একটা অদ্ভুত রঙের ছড়াছড়ি। তারপর একটা বড় খোদল-কালো রঙের সেটা। ঠিক মড়ার চোখের সামনে রেখেছ দেখছি। মুখস্থের মতো–একেবারে চোখস্থ!
কল্পনা হাসল।……কতকটা। ছবিটার নীচের দিকে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। খুব স্পষ্ট নয় চেহারাটা–কিন্তু মেয়ে বলে চেনা যায়।
শুভ সিরিয়াস হয়ে বলল, কিসে চেনা যায়? দেহের কোনো অংশ দেখে?
কল্পনা ভুরু কুঁচকে কপট ধমক দিল।……ফের অসভ্যতা? আমি বলছি মেয়ে, ব্যস্, এই যথেষ্ট।
শুভ দমল না।……না–মানে, মেয়ে হলে চুলফুল বুকটুক বা শাড়িটাড়ি……
কল্পনা টেবিলের নীচে দিয়ে ওর পা মাড়িয়ে দিল।
শুভ একটু সরল। বলল, এই পায়ে ব্যথা আছে! লাগবে।
পায়ে ব্যথা! তোমারও? কল্পনার মুখ হাসিতে কাঁপছিল।……স্বাতীদির মতো কলার খোসা নাকি? না, ঢিল?
বেজার মুখে শুভ বলল, দেখ–চপলতা খুব ভালো নয়। কাল অব্দি আমি কী পরিমাণে চপল ছিলাম তুমি দেখেছ। কিন্তু আর নয়-প্রেসটিজ থাকে না। তা ছাড়া সবাই আমায় নিয়ে তামাশা করে, বেশ টের পেয়ে গেছি। যদি বরাবর সিরিয়াস থাকতুম, কেউ মজা করার সাহস পেত না।
কল্পনা গম্ভীর হবার চেষ্টা করে বলল, কেউ তোমায় নিয়ে মজা করেনি।
মজা করা নয়তো কী? শুভ আরও গম্ভীর হল।…মিছেমিছি রাতদুপুরে আমায় হয়রান করলে। একে ঠান্ডা, তার ওপর অন্ধকার-বাপস্ ওই ভূতুড়ে বাগানে গিয়ে আমার প্রাণ যাবার দাখিল পুলিশেরও তাড়া খেতে হল–উঃ!
কল্পনা বিরক্ত হয়ে বলল, এক কথা বারবার শুনতে ভালো লাগে না। থামো। কিন্তু ব্যথাটা তো থামছে না। শুভ পায়ের দিকে হাত নামাল। বোলাতে থাকল।
বোকার মতো দৌড়াচ্ছিলে কেন? বেশ হয়েছে।
তা তো বলবেই। হঠাৎ গায়ের ওপর টর্চের আলো পড়লে তুমি কী করতে দেখতাম।
কল্পনা কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর বলল, আলোটা আমিও দেখেছিলাম। এবং আমাকেও দৌড়তে দেখেছিলে নিশ্চয়!
হুঁউ!
দেখেছিলে? লাফিয়ে উঠল শুভ।…খুব হাসছিলে নিশ্চয়।
উঁহু। সে-সুযোগ পেলাম কই? পিছিয়ে আসবার সময় একজনের গায়ের ওপর পড়েছিলাম।
অ্যাঁ? এতক্ষণ তো তা বলনি! সে আবার কে? ওখানে কী করছিল? শুভ হুমড়ি খেয়ে পড়ল টেবিলের ওপর।
কল্পনা কণ্ঠস্বর আরও চাপা করে বলল, লোকটা অন্য কেউ নয়–স্বয়ং–
সেই মুহূর্তে সুদেষ্ণার চিৎকার শোনা গেল দরজায়। শুধু চিৎকার নয়, কান্না অর্থাৎ রীতিমতো চুলছেঁড়া আর্তনাদ।……ওগো, এ কী সর্বনাশ হল গো! আমার আমার গুরুদেব কোথায় গেলেন!
তক্ষুনি দেবতোষ দৌড়ে গেছেন। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়েছেন। বাবুর্চি-বয়-ঝি-চাকর সবাই ভিড় করেছে। সুরঞ্জন ভিতরে ঢোকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সুদেষ্ণা দরজার মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়াচ্ছেন। রীতিমতো দক্ষ-যজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে যেন।
সুদেষ্ণার ফোঁপানি ও খণ্ডোচ্চারিত বাক্যাংশগুলি থেকে সবাই ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করছিল। তারপর কর্নেলের মন্তব্য কানে এল: মাই গুডনেস! গুরুহরণ হয়ে গেল।
শুভ কাছে এসে প্রশ্ন করল, কী বললেন স্যার?
কর্নেল গোঁফের নীচে লুকানো হাসি রেখে জবাব দিলেন, গুরুপত্নী হরণের কথা জানেন তো? ওঁর হয়েছে গুরুহরণ। তার মানে, গুরুদেবের ছবিটি মাথার কাছ থেকে চুরি হয়ে গেছে। ব্যাট হাউ স্ট্রেঞ্জ! একই রাত্রে পর পর দুটো চুরি এবং দুটোই ছবি!
শুভ বিড় বিড় করল। ছবিচোর!
দেবতোষ ইতিমধ্যে বাহুবল প্রদর্শনে ব্রতী। স্ত্রীকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। সিঁড়ি বেয়ে সুদেষ্ণা বিলাপের করুণ রাগিণী ওপরতলায় গিয়ে ডুবল। সবাই মুখ। তাকাতাকি করছিল। এবার হাসল। সুরঞ্জন তাড়া দিয়ে বলল, যে যার কাজে যাও– ভিড় করো না এখানে।
কল্পনা দেবতোষদের অনুসরণ করেছিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে শুভ বেরোল। ওপরে গিয়ে সে দেখল, প্রফেসর দম্পতি ঘরে ঢুকে গেছেন। দরজা বন্ধ। বারান্দায় বিভাস নীরেন আর দিব্যেন্দু দাঁড়িয়ে আছে।
শুভ গিয়ে দাঁড়াতেই সামনের ঘর থেকে দীপেন বোস বেরিয়ে এল। পরনে ড্রেসিং গাউন। শুভ বাও করে বলল, ফিরেছেন দেখছি! কখন ফিরলেন?
দীপেন মৃদু হাসল। চোখ দুটো ঘোর লাল। বলল, অ্যাট অ্যাবাউট ফাইভ থারটি। ব্যাপার কী?
শুভ বলল, বড্ড মজার ব্যাপার দাদা! গতরাত্রে দু-খানা ছবি চুরি গেছে। একখানা চীনাদির, অন্যখানা মিসেস ব্যানার্জির। গুরুদেবের ফোটো নাকি।
নীরেন আর দিব্যেন্দু–দুজনেরই গাম্ভীর্য অস্বাভাবিক। কেবল বিভাস মিটিমিটি হাসছিল। দীপেন বোস ঘরে ঢুকে গেলে সে এগিয়ে এল শুভর দিকে। বলল, খুব সকাল সকাল উঠেছেন দেখছি। আপনিই ছিলেন সবার চেয়ে লেটরাইজার। ব্যাপার কী বলুন তো? ভোরবেলা জানলা খুলতেই দেখি সুইমিং পুলের ওদিকে পায়চারি করছেন। কবিতা খুঁজে বেড়াচ্ছেন না তো?
নিজের রসিকতায় নিজেই হো-হো করে হেসে উঠল বিভাস।
শুভ একটু চমকে উঠেছিল। বলল কতকটা।
বিভাস বলল, তাই বুঝি কাল….
শুভ চোখ টিপতেই বিভাস থামল। ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল কয়েকমুহূর্ত। তারপর হঠাৎ ওর হাতটা ধরে বলল, ওঃ হো! আপনার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। আমার ঘরে আসুন।
ওরা চলে গেলে দিব্যেন্দু নীরেনের দিকে তাকাল। কিছু কৌতূহল ছিল দৃষ্টিতে। নীরেন সেটা বুঝতে পেরে ঠোঁট কোঁচকাল মাত্র। অর্থাৎ ছেড়ে দেয়।
দিবেন্দু বলল, কী হচ্ছে সব! কাল রাত্রে একেবারে ঘুমোতে পারিনি। কে কোথায় যাচ্ছে, কী করছে। তার ওপর চীনাদির ছবি চুরি গেছে। উনি একেবারে পাগল হবার দাখিল। ওর ঘরে গিয়ে সব শুনে আমি অবাক। ফিরে এসে দেখি, তুইও নেই।
নীরেন হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠল যেন। একটু ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ। তোদের না দেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম। বেরিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম। বিভাসবাবু ঘরে নেই। তারপর যা ঘটল তোকে সেটা বলা দরকার। তুই তো স্বাতীর গারজেন এখন।
দিব্যেন্দু বলল, কে কার গারজেন। মরুক গে। কী লক্ষ করেছিলি?
স্বাতী বিভাসবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
অ্যাঁ!
সত্যি। আমি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে বিভাসবাবুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
দিব্যেন্দু পরক্ষণে অবিশ্বাসী হাসি হেসে বলল, যাঃ! অন্ধকার ছিল তো তখন। কী করে চিনলি–বাইরের মেয়ে নয়, স্বাতী?…বিভাসবাবুদেব মতো লোকের চরিত্রে বাইরের মেয়ে আসবার ব্যাপারটা খাপ খেয়ে যায়।
নীরেন মাথা নাড়ল।…নাঃ স্বাতীর পোশাক চিনতে ভুল হবার নয়। স্ন্যাকস পরে। এ জংলি শহরে কেউ হোটেলে আসবার কথা নয়।
দিব্যেন্দু স্বাতীর ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, স্বাতী এখনও ওঠেনি। গিয়ে দেখে এসেছি, বেঘোরে ঘুমোচ্ছ। উঠুক। তারপর জিগ্যেস করব ওকে।
নীরেন ওর হাতটা ধরে টানল…না।
না কেন?
আফটার অল স্বাতীর মতো মেয়ে তোর প্রশ্নটা খুব অপমানজনক মনে করবে। কী দরকার মিছেমিছি ওর পারসোনাল ব্যাপারে নাক গলিয়ে?…..নীরেন সকৌতুকে হাসল।……তাছাড়া তুই তো এখন কল্পনার সঙ্গে প্রেম করছিস!
দিব্যেন্দু একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল।……যাঃ কী বলছিস যা তা। কল্পনা একটু খেয়ালি ধরনের মেয়ে। যখন যাকে ভালো লাগে, তার সঙ্গে মেশে। তাছাড়া নীরেন, তুই ওকে কতটুকুই বা জানিস? আমি ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, কল্পনা ভীষণভীষণ বোকা।
থাক। ওকালতি করতে হবেনা। নীরেন ঘরের দিকে পা বাড়াল।
দিব্যেন্দু স্বাতীদের ঘরে ঢুকল।
স্বাতীর ঘুম ভেঙেছে ততক্ষণে। তার সামনে একটা চেয়ারে বসে আছে কল্পনা। সুদেষ্ণার গুরুহরণের কাহিনি শোনাচ্ছে। স্বাতী শুনছে কিনা বোঝা কঠিন। সে খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে।
দিব্যেন্দু বলল, চা দিয়ে যায়নি?
জবাব কল্পনা দিল।…না। এতবার বেল টিপলাম, পাত্তা নেই কারো।
যাই, বলে দিব্যেন্দু বেরোতে যাচ্ছিল–স্বাতী ডাকল, শোন।
দিব্যেন্দু ঘুরে দাঁড়াল। স্বাতীর দিকে তাকাতে পারছে না–বা তাকানোর ইচ্ছে নেই যেন। বলল, বলো।
স্টেশনে ফোন করে জেনে নাও, নেস্ট ট্রেন কটায়?
ট্রেন? অবাক হল দিব্যেন্দু।…..ট্রেনের কী হবে?
আমি ফিরব।
ফিরবে মানে? দিব্যেন্দু কয়েকপা এগিয়ে এল।
ফিরব। দ্যাটস অল।
দিব্যেন্দুর মুখটা বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। সে খাটে এসে বসে পড়ল। বলল, পায়ের ব্যথা বেড়েছে তো ডাক্তারের ব্যবস্থা করছি। এ অবস্থায় যাবে কী করে? তাছাড়া কোথাও তো বিশেষ ঘোরা হল না। পিকনিকের প্রোগ্রাম আছে। তারপর…
স্বাতীর মুখটা কঠিন। সে সাবধানে ব্যথা পাওয়া পাটা একপাশে সরিয়ে বলল, বেশ তো। তুমি এনজয় করো। আমাকে ফিরতে দাও।
ইতিমধ্যে কল্পনার মুখের রং ছাই-ছাই। সে মুখ নামিয়ে নখ খুঁটছিল। এবার শান্তস্বরে বলল, তাই হোক দিব্যদা। খুব তো ঘোরা হল–আমারও আর ভালো লাগছে না। কী সব ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটছে এখানে…
বাধা দিয়ে স্বাতী ঝংকৃত হল।…কেন ঘটছে, সে তুমি নিজেই ভালো জানো।
কল্পনা চমকাল।…আমি জানি!
স্বাতী ফুঁসে উঠল।……হা, ইউ আর ইন দি সেন্টার অফ দি রিং। তোমার এতটুকু শালীনতাবোধ নেই, আমি জানতাম না। কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে শুভর সঙ্গে? অস্বীকার করতে পারো এ কথা? কেন গিয়েছিলে?
কল্পনার পক্ষ থেকে যা স্বাভাবিক ছিল, তা হচ্ছে ভীরুতা এবং লজ্জা।
কিন্তু দুজনকেই অবাক করে সে পাল্টা কঠিন কণ্ঠে বলল, সব কাজের কৈফিয়ত সবাইকে যদি না দিই। আমায় আগের মতো কচি খুকিটি ভাবছ কেন?
স্বাতী গর্জাল।…চুপ অসভ্য মেয়ে কোথাকার!
দিব্যেন্দু অপ্রতিভভাবে এবং ঘাবড়ে গিয়ে ব্যস্তকণ্ঠে বলল, এই, কী করছ তোমরা! ছিঃ! শুনলে কী বলবে ওরা!
স্বাতী তেড়ে এল।…তুমি থামো। তোমারও কিছু জানতে বাকি নেই। আশ্চর্য তোমার সাহস, কল্পনা আমার সঙ্গে এসেছে, ওঁর সব দায়িত্ব আমার, আর তুমি……
কল্পনা কথা কাড়ল।…খুব বাড়াবাড়ি করছ স্বাতীদি।
স্বাতীর কি হিস্টরিয়া হয়ে গেল রাতারাতি? আর কিছু করতে না পেরে কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলল মেঝেয়। হাঁফাচ্ছিল সে।..বাড়াবাড়ি। কাল মোতিঝিলের ওখানে কী করছিলে দুজনে? অস্বীকার করতে পারো? কাওয়ার্ড, ননসেন্স, ফুলিশ!
দিব্যেন্দু সাহস সঞ্চয় করে বলল, কী করেছি আমরা?
স্বাতী নির্দ্বিধায় বলে দিল, ইউ কিল্ড ইচ আদার।
দিব্যেন্দু হো হো করে কেঠো হাসি হেসে উঠল। কল্পনা কাঁপতে কাঁপতে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। বলল, বেশ করেছি আমার খুশি।….
বলে সে হনহন করে বেরিয়ে গেল পর্দা তুলে। দিব্যেন্দু গতিক বুঝে বলল, স্বাতী, সিনক্রিয়েট করো না-প্লিজ। কিস-টিস ছেড়ে দাও। কল্পনা বখে গেছে আসলে। বিশ্বাস করো, আই ভিড় নটু কিস হার, বাট ইট ইজ শী…..তারপর তো কাল রাত্রের ব্যাপার তোমায় বলেছি। তুমিও দেখেছ। কল্পনা ঘরে ছিল না। আজ সকালেও একই ব্যাপার–শুভর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল নীচে।
মানদা এতক্ষণে চায়ের ট্রে হাতে এল। দুজনের মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে কিছু আঁচ করল সে। তারপর নিঃশব্দে টেবিলের ওপর ট্রেটা রেখে বেরিয়ে গেল।
.
চীনা মিত্র চেষ্টা সত্ত্বেও ঘুমোতে পারেনি। রাত্রে দিব্যেন্দু হঠাৎ এসে পড়েছিল তার ঘরে। সব শুনে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে। তারপরও কতক্ষণ সে জেগে বসেছিল। ঠিক বসে থাকা নয়, মাঝে মাঝে পায়চারি করেছে ঠোঁট কামড়ে। বিছানায় এসে চিৎ হয়ে শুয়ে থেকেছে। ফের উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়িয়েছে। দূরে নিজামতকেল্লার ফটকে ঘণ্টাঘড়ি তিনবার বাজলে সে শেষ অব্দি শুয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঘুম আর হল না। এক সময় ভোর হলে সে বাইরে বাইরে দক্ষিণের লনে অত শীতের মধ্যে পায়চারি করে এসেছে। একটু পরেই শুভর আবির্ভাব হয়েছিল সেখানে। শুভকে কথাটা বলা নিষ্প্রয়োজন মনে করেছিল সে। মাত্র দুএক কথা বলে পাশ কাটিয়ে চলে এসেছিল। শুভ বুকে হাত বেঁধে একা ঘুরছিল। ঘরে এসে জানালা খুলতেই চীনা দ্যাখে, শুভ একা নেই আরকল্পনা এসে জুটেছে।
তারপর ফের বিছানায় গড়াচ্ছিল। ঘুম এবার আসতই। কিন্তু মানদার আবির্ভাব হল বেডটি-নিয়ে। চা দিয়ে সে চলে গিয়েছিল। ফিরল খানিক পরে। তার মুখেই সুদেষ্ণা দেবীর গুরুদেবের ছবি চুরি যাওয়া খবর শুনল চীনা।
খুবই অবাক হয়েছিল সে। এবং সেই সঙ্গে কিছুটা হাল্কা হয়েছিল মনের ভাব। চীনার ছবি যে চুরি করেছে, সেই যদি এই গুরুহরণও করে থাকে তাহলে বেশ বোঝা যায়। শ্রীমান চোর ঠিক চোর নয়–নিতান্ত রসিকজন। সুতরাং ছবি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এবং কল্পনার টুথব্রাশ, স্বাতীর কেডস জুতো–সব একান্ত ভাবে তারই কীর্তি। কিন্তু এ তামাশার অর্থ কী? বিশেষ একজনের পিছনে লাগলে এসবের একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া সোজা। দুষ্টু ছেলে মায়ের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে এরকম করে থাকে। এখানে কিন্তু ভিকটিমের সংখ্যা কয়েকজন।…
পরমুহূর্তে চমকে উঠল চীনা। যাদের জিনিস চুরি যাচ্ছে, তারা সবাই কিন্তু মেয়ে! কোনো পুরুষের তো কিছু খোওয়া যাচ্ছে না।
আরও একটা কথা মনে পড়ল তার। স্বাতীর জুতো নাকি বিভাসবাবুর বাথটবে পাওয়া গেছে। এবং কল্পনার টুথব্রাশটা, বড় লজ্জার কথা, চীনারই ব্যাগের ভিতর কাল বেরিয়ে পড়ল। মোতিঝিলের কাছে ভাঙা মসজিদের উঠোনে ছবি আঁকবার সময় সে ওটা আবিষ্কার করেছে। কিন্তু পাছে ওরা কী ভেবে বসে, লজ্জায় কাকেও বলতে পারেনি কথাটা। ফেলে দেওয়া উচিত ছিল। দীপেন বোস এসে পড়ায় সে-সুযোগ হল না! হোটেলে ফেরার পর সে ঠিক করেছিল, ওটা জানালা গলিয়ে ফেলে দেবে। কিন্তু নতুন একটা থিম মাথায় শুয়াপোকার মতো জ্বালা দিচ্ছিল। খোঁজা কবরখানার ফটকে বৃষ্টির সময় শুভ যে কবিতাটি বারবার আওড়াচ্ছিল বর্ণনা দেবার চেষ্টা করছিল, সেই ছবিটা।
মধ্যরাতে বনের মাথায় উঠলে চাঁদ।
ডোবার ধারে পাতব হরিণ ধরার ফাঁদ।
বেশ চমৎকার থিম। অথচ সন্ধ্যা থেকে ইলেকটিরি ফেল। অগত্যা ম্যানেজারের কাছে মোমবাতি চেয়ে এনে কাজ শুরু করেছিল সে। কতক্ষণ পরে কল্পনা এসেছে। নিঃশব্দে বসে থাকার পর সেও চলে গেছে। দ্বিগুণ উদ্যমে হাত চালায় চীনা। কিন্তু হঠাৎ মোমবাতির আলো নিভে যায়। মোমবাতিটা অনেক আগে শেষ হয়েছিল লক্ষ করেনি সে। তখন ম্যানেজারের কাছে গিয়েছিল খবর জানতে, কখন ইলেকটিরি চালু হবে। চীনার দুর্ভাগ্য। ফিরে আসার পর যেই আলো জ্বলল, দেখল ছবিটা নেই।
তবে শুধু ওখানেই শেষ হয়নি ব্যাপারটা। ছবি চোর (!) তার ব্যাগটাও নিয়ে গেছে। ব্যাগটা–খখাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই। জিনিসপত্র নিয়মমত বের করে রেখেছিল। শুধু তার মধ্যে রয়ে গেছে কল্পনার সেই টুথব্রাশটা। তাই ব্যাগটার কথা বলেনি কাকেও।
চীনা মিত্র এতক্ষণে ঘড়ির দিকে তাকাল। সাতটা ত্রিশ। সে কলিং বেল টিপতেই মানদা এল। চীনা তাকে আরেক কাপ চায়ের কথা বলতে যাচ্ছিল, বলা হল না। মানদা চোখ দুটো বড় করে ফিসফিসিয়ে বলল, কী সব্বনেশে কাণ্ড দিদিমণি! কে বোস গিন্নির চুল কেটে নিয়েছে কাল রাত্তিরে-শোনেন নি?
হ্যাঁ, শুনেছে চীনা। সে তো তখন স্বাতীদের ঘরেই ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে চীনার একটা কথা মনে পড়ে গেছে। সে বিছানায় গড়িয়ে খিলখিল করে হেসে উঠেছে।
.
০৬.
শুভ আর বিভাস হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরোল। বারান্দার রেলিঙে ঝুঁকে সুইমিং পুলটার দিকে তাকিয়ে ছিল নীরেন। শুভ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, আজকের প্রোগ্রাম কী হবে রে?
নীরেন ঠোঁটে আঙুল রেখে যেন সকৌতুকে বলল, চুপ। তারপর স্বাতীদের ঘরের দিকে ইশারা করল।
শুভ ভ্রূ কুঁচকে সপ্রশ্ন এক মুহূর্ত তাকিয়েই মুখ ফেরাল ঘরটার দিকে। বিভাস বলল, সম্ভবত স্বাতী দেবী অসুস্থ। সকাল থেকে তো বেরোতে দেখলাম না।
নীরেনের ইচ্ছে নয় সে সদ্যপরিচিত মানুষকে স্বাতী-দিব্যেন্দুর ঝগড়ার ব্যাপারটা বলে। ততক্ষণে শুভ দরজার কাছে চলে গেছে এবং পর্দা তুলে দেখেছে দরজা ভিতর থেকে বন্ধু। সে কপাটে কান পেতে ভিতরের ব্যাপারটা আঁচ করার চেষ্টা করছিল।
হঠাৎ বিভাস বলল, আই সি! কিছুটা বুঝেছি মনে হচ্ছে।
নীরেন কড়া নজরে তাকাল ওর দিকে। কিন্তু কোনো কথা বলল না।
বিভাস দমল না। বলল, কাল মোতিঝিলেব বটতলায় অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা দৃশ্য চোখে পড়ে ছিল। তারপর স্বাতী এলেন আমার কাছে। ওঁর মনমেজাজ খুব ভালো মনে হচ্ছিল না। সেই নিয়ে কিছু ঘটেছে নিশ্চয়।
এবার নীরেন বিরক্ত মুখে বলল, ও সব তাদের পারসোনাল অ্যাফেয়ারস।
সে তো ঠিকই। বলে বিভাস সিগ্রেট বের করল। নীরেনের দিকে এগিয়ে দিল একটা।
নীরেন ভাবছিল, লোকটা ভীষণ গায়েপড়া আর বেহায়া তো! নীরস মুখে সিগ্রেটটা নিল সে। প্যান্টের পকেট থেকে নিজের দেশলাই বের করে জ্বালল। শুভ ফিরে এসে বলল, কিছু বুঝলাম না। কে-কে আছে ঘরে?
নীরেন সূক্ষ্ম হাসির রেখা ঠোঁটের কোণে রেখে জবাব দিল, ওরা তিনজন। তিনজন? মানে স্বাতী-কল্পনা-দিব্যেন্দু?
বিভাস হাসি চেপে মন্তব্য করল, দি ইন্টারন্যাল ট্র্যাঙ্গল। চিরন্তন ত্রিভুজ।
শুভ হেসে ফেলল। বলল, তাহলে তো প্রথামতো একজনকে মরতে হয়।
বিভাস বলল, তা কেন? একজন আত্মোৎসর্গ করতে পারে। তার মানে স্বেচ্ছায় সরে আসতে পারে দূরে।
নীরেন গম্ভীর। বলল, আজকাল কোনোকিছুর মীমাংসা সহজে হয় না।
শুভ বলল, এ কাহিনির লেখক যদি আমি হতাম, কী করতাম জানিস?
বিভাস বলল, কী করতেন? একজনকে টিবিতে মেরে—
নীরেন বাধা দিল, আজকাল টিবিতে মানুষ মরে না। সস্তা ওষুধ বেরিয়েছে।
বিভাস বলল, তাহলে ক্যান্সার! ধরুন–ব্লাড ক্যান্সার!
নীরেন বলল, সেও মরতে দেরি লাগে।
বিভাসকে চিন্তিত দেখাল–যেন সে একটা সূত্র খুঁজছে ব্যাকুল হয়ে। শুভ বলল, আমি যদি লেখক হতাম তাহলে–তাহলে ব্যাপারটা…ঠিক…হাতের আঙুলগুলো বেঁকিয়ে সে কিছু বোঝাতে চাচ্ছিল।
সেই সময় ম্যানেজার সুরঞ্জন আর কর্নেলকে সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল। সুরঞ্জন তাকে কী দেখাচ্ছিল–সম্ভবত ওপরের ঘরগুলো। এরা তিনজনে চুপ করেছে তক্ষুনি। কাছে এসে কর্নেল সোল্লাসে বললেন, হ্যাল্লো জেন্টলমেন! শুভ মরনিং।
বিভাস বাও করে বলল, গুড মরনিং কর্নেল। হা ডু ডু!
ওর ভঙ্গিতে অভিনেতার কায়দা লক্ষ করে শুভ মুখ টিপে হাসল। কর্নেল বললেন, খুব সিরিয়াস আলোচনা চলছে মনে হচ্ছিল। বাধা দিলাম না তো?
তিনজন মাথা দোলাল। সুরঞ্জন বলল, সাহেবকে হোটেলের ওপর-নীচটা দেখাতে বেরিয়েছি। খুব পুরনো বাড়ি। এর পিছনে একটা ইতিহাস রয়েছে কি না। আপনারা স্যার কল্পনাও করতে পারবেন না, যে-সব ঘরে বাস করছেন আপনারা–উঃ, কী কাণ্ড না চলত!
কর্নেল সকৌতুকে সুরঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। কাণ্ডটা যে ওর পক্ষে বর্ণনার অসাধ্য, তা স্পষ্ট। বললেন, যাক গে। ওপরের ঘরগুলো ভালোই। তবে নীচের গুলোই বা মন্দ কী! আমি যখনই আসি, সুরঞ্জন ওপরের ঘর অফার করে–কিন্তু নীচের তলাটাই বেছে নিই। বুড়োমানুষের পক্ষে সিঁড়িতে ওঠা-নামা বড্ড বিপজ্জনক। আচ্ছা সুরঞ্জন, ওই পশ্চিমমুখো শেষ ঘরটা তো তোমাদের সারভ্যান্টস রুম ছিল। পর্দা ঝুলছে দেখছি। ওটাও ব্যবসাতে খাটাচ্ছ! বাই জোভ!
সুরঞ্জন সলজ্জ বলল, হ্যাঁ স্যার। বোর্ডের কর্তাদের ইচ্ছে। তবে যাই বলুন স্যার, আমার মতে সবচেয়ে ভালো ঘর কিন্তু ওটাই। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সবই পাওয়া যায়। আর ওই পাশেরটাও মন্দ নয়। আপনার জন্যে ওখানেই ব্যবস্থা করছিলাম। আপনি আসতে চাইলেন না।
মাথা নেড়ে কর্নেল বললেন, ওই ঘরে বুঝি সেই আর্টিস্ট মেয়েটি থাকেন।
হ্যাঁ স্যার। চলুন না, আলাপ করিয়ে দিই। সোৎসাহে পা বাড়াল সুরঞ্জন! খুব চমৎকার স্বভাবের ভদ্রমহিলা। শিল্পী কি না! না–না, উনি কি মনে করবেন না স্যার।
কর্নেল এদের তিনজনের দিকে একটু বাও করে হাসতে হাসতে এগোলেন।
ওরা চলে গেলে বিভাস বলল, কর্নেল লোকটি খাসা। বুড়োর সঙ্গে আড্ডা দিতে হবে। তা নীরেনবাবু, আজ কোথাও যাওয়া যাক্। চুপচাপ ঘরে বসে থাকবার কোনো মানে হয় না।
শুভও বলল, হ্যাঁ। চল্ নীরেন, আমরা বেরোই।
নীরেন বলল, যাবো?
বিভাস ওর হাত ধরে টানল।…এ থমথমে আবহাওয়ায় বসে থাকার কোনো মানে হয় না। চলুন, বরং কোথাও ঘুরে আসি।
যেতে যেতে শুভ বলল, এক মিনিট। দেখি ইরাবউদিরা যাবেন নাকি।
নীরেন বাধা দিল।…ফোঁপরদালালি করিস না। দীপেন বোসের বউর চুল কেটেছে, ভূতে। তাই নিয়ে দুজনে দরজা বন্ধ করে মানভঞ্জন পালা গাচ্ছে।
সিঁড়ির কাছে যেতেই পাশের ঘরের দরজার পর্দার ভিতর কিছু ফঁক হতে দেখা গেল–সুদেষ্ণার চেঁচামেচি শোনা গেল, অধ্যাপকের করুণ মিনতি ও বলপ্রয়োগ পরিশেষে দড়াম করে কপাট বন্ধের আওয়াজ হল। তিনজনে হাসতে হাসতে নামল।
ডাইনিং হলে ঢুকে আরেক প্রস্থ চা খাবার ইচ্ছে শুভর। সে বলল, জাস্ট ফাইভ মিনিট প্লিজ!
এমন কাতর কণ্ঠে অনুনয় যে বাকি দুজনকে যেতে হল ওর সঙ্গে। বয় শম্ভু বলল, কাল রাত্রে স্যার ঘুম হয়েছিল আপনাদের?
বিভাস শুধোল, কেন বল তো?
…উঃ সারা রাত ওপর-নীচে কী হুটোপুটি যে চলছিল স্যার, ভয়ে চোখের পাতা বুজে পড়েছিলাম মাত্তর। শম্ভু বিরস কণ্ঠে জানাল।……আমি বরাবর বলছি, এ পুরনো বাড়ি, নবাব-টবাবের বসবাস ছিল। এখানে হোটেল চলে? ওনারা চালাতে দেবেনই বা কেন? একটা ইজ্জত আছে তো?
শুভ বলল, ভূতের উপদ্রব বলছ?
শম্ভু রহস্যময় হেসে টেবিল মুছতে থাকল। নীরেন মন্তব্য করল, হ্যাঁ, নবাবী ভূত।
ঝড়ে-ভেঙে পড়া গাছের মতো দেখাচ্ছিল সুদেষ্ণাকে। খাটে কোমর থেকে মাথা অব্দি, নিম্নঙ্গ মেঝেয় ঝুলছে, দু-পাশে দুটো হাত ছড়ানো। আলুথালু চুল, ফুলোফুলো মুখ, কপাল থেকে সিথি অব্দি ধ্যাবড়ানো সিঁদুর। পাশে বসে বুকে হাত বুলোচ্ছেন দেবতোষ।
দৃশ্যটা তার জীবনে নতুন নয়। সুদেষ্ণা বরাবরই একটু বদমেজাজি খটরাগী মেয়ে–যাকে বলে হিস্টেরিক টাইপের। মধ্যে মধ্যে ফিটমতো হয়, দাঁত কিড়মিড় করে–কখনও খিলখিল করে হেসে ওঠে। সারা জীবন এ নিয়ে অধ্যাপক কম উত্ত্যক্ত হচ্ছেন না। কিন্তু কালক্রমে সবই অভ্যাস হয়ে গেছে। কয়েক বছর হল, সজ্জনের পরামর্শে সুদেষ্ণার গুরুকরণ হবার পর ব্যাধিটা অনেকখানি প্রশমিত হয়েছিল। ওর গুরুদেবই বলেছিলেন, ওকে নিয়ে মাঝে মধ্যে ধর্মস্থান ইত্যাদি ঘুরে আসা দরকার। সে কারণে অধ্যাপককে প্রায়ই বেরিয়ে পড়তে হয় কলকাতার বাড়ি ছেড়ে। বাড়িতে থাকে সুদেষ্ণার এক ভাইপো আর তার বউ। অধ্যাপক জানেন, তাঁর এই পৈতৃক বাড়ি এবং সামান্য যা টাকাকড়ি রয়েছে, তা ওদেরকেই দিয়ে যেতে হবে মৃত্যুর সময়। ভাইপোটি মহা লক্কড় আর তেমনি ধুরন্ধর ছোকরা। দু-মাস কোথাও চাকরিতে টেকে না। মুখে বলে, ধুস ও কি ভদ্রলোকের জায়গা? দিয়ে এলাম ঠুকে একটা রেজিগনেশন। অধ্যাপক পরে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন, আসলে ওকে কর্তৃপক্ষ জবরদস্তি ছাঁটাই করেছেন। তারপর আর কী! ফের চাকরি জোগাড় করে দেওয়ার। জন্যে পিসিকে সাধাসাধি এবং পরিণামে পিসির হামলা-বেচারা অধ্যাপকের ফের ছুটোছুটি, বন্ধু-বান্ধবকে অনুরোধ, অবশেষে চাকরি সংগ্রহ। ভাগ্যিস তার ওপর। মহলে এ রকম বন্ধুত্ব বা চেনা-জানা ছিল। সুদেষ্ণার ভাইপো দুলালের চরিত্রদোষের সংখ্যা যে একটি নয়, তা তিনি টের পেয়ে গেছেন কবে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হারামজাদাটির বউ অর্থাৎ সুলেখাও স্বামীর ওপর এককাঠি সরেস যায়! অধ্যাপক তেমন কিছু প্রমাণ পাননি, কিন্তু তার ধারণা–সুলেখা তার স্বামীকে ঠকিয়ে চলেছে। দুলাল বেরোলে, সেও সেজেগুজে বাড়ি থেকে বেরোয়। সুদেষ্ণা তো দিবারাত্র গুরুদেবের জপতপে বিভোর–কোনো খবর রাখে না সংসারের। না–রাখে ঠিকই, তবে সে খবর অধ্যাপকের ট্যাকের। কথায়-কথায় একদিন সুলেখার ওই প্রসঙ্গটা তুললে সুদেষ্ণা বলেছিল, বা রে! একা-একা বেচারা হাঁফিয়ে উঠবে না? দুলাল থাকে না, তুমিও নেই, আমি ঠাকুরঘরে থাকিও কথা বলবে কার সঙ্গে?……অধ্যাপক বলেছিলেন তাহলেও মেয়েদের অমন করে একাদোকা বেড়ানো কি ঠিক? যা দিনকাল পড়েছে, খবর রাখো না তো! অমনি সুদেষ্ণা তিরিক্ষি মেজাজে বলেছিল, শনির মতো সবটাতেই তোমার দৃষ্টিটা কু। বউমা অমন বেলেল্লা নয়। কোথায় যাবে আর? যায় সিনেমা দেখতে। আমায় কিছু গোপন করে না সে।..
চুলোয় যাক্ সব। বাড়িতে না থাকতে পেলেই বেঁচে যান অধ্যাপক। কলেজে এমনিতে ছুটিছাটা প্রচুর-তার ওপর আজকাল প্রায়ই হুজ্জতহাঙ্গামা লেগে রয়েছে, তার ফলে বেরিয়ে পড়ার অবকাশ মেলে অঢেল। সুদেষ্ণাও খুশি হয়। তারও মন পড়ে রয়েছে ধর্মক্ষেত্রগুলিতে।
ফলে রথদেখা কলাবেচা দুইই হয় দেবতোষের। নিজের পুরাতত্ত্বের বাতিক-স্ত্রীর বাতিক ধর্মে। অতএব এমন জায়গা খুঁজতে হয়, যেখানে দুটি উদ্দেশ্যই দুপক্ষের একসঙ্গে চরিতার্থ হয়। অনেক ক্ষেত্রে সুদেষ্ণাকে ফাঁকি না দিয়েও উপায় থাকে না। যেমন এই মুরশিদাবাদ আসার ক্ষেত্রে।
তবে এবারে আসার উদ্দেশ্য যদি সার্থক হয়, এক তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এ যা অনর্থ ঘটে গেল হঠাৎ, সব আশা রসাতলে যেতে বসেছে। অধ্যাপক স্ত্রীকে মুখে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, এ নিতান্ত রসিকতা কারো কিংবা চোর ভুল করে ফেলেছে–ছবি ফেরত পাওয়া যাবেই। মনে মনে কিন্তু তিনি বেশ ভাবিত। ভাবিত আর উদ্বিগ্নও।
গত রাত্রে ওই বোস-ভদ্রলোকের স্ত্রীর চুল কাটা গেছে, সুদেষ্ণার মুখেই শুনেছেন–সুদেষ্ণা এত সব খবর রাখে তাহলে। সুদেষ্ণা এক্ষুনি দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ হয়নি। ওই ছোকরা শুভ সব ভণ্ডুল করে দিয়েছে। কাজেই আজ অন্তত একটি রাত্রি থাকা দরকার। যে কোনো মূল্য দিয়ে থাকতেই হবে। আপাতত সুদেষ্ণাকে আশ্বাস দিয়েছেন, ছবি শিগগির খুঁজে আনবার ব্যবস্থা করছি। না, পুলিশের দ্বারা একাজ সম্ভব নয়। তবে কীভাবে সম্ভব, কার দ্বারা সম্ভব, সেটা ভাবছেন। কর্নেল লোকটি খুব অভিজ্ঞ আর চতুর। অনেক বুদ্ধি রাখেন। ওঁর সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। অধ্যাপকের দৃঢ় বিশ্বাস, সাধারণ চোর যদি ভুল করে ছবিটা নিয়ে গিয়ে থাকে, কোথাও ফেলে দেবে। অবশ্য সেটা পরে খুঁজতে বেরোবেন। আর যদি রসিকতা হয়, তাহলে ওই ছোকরাদেরই কারো কীর্তি। বাতিকগ্রস্ত ধার্মিকদের উত্ত্যক্ত করা ওদের পক্ষে রীতিমতো স্বাভাবিক ব্যাপার।
দেবতোষ ঠিক করলেন, আগে কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে তারপর বেরোবেন। নবাবি মহাফেজখানার ওদিকে যেতে হবে। তারপর…
সুদেষ্ণা বিড়বিড় করে যেন ভুল বকছে। দেবতোষ ডাকলেন, ওগো শুনছ? সুদেষ্ণা!
সুদেষ্ণা সাড়া দিল না।
তোমার ছবির জন্যেই বেরচ্ছি। না নিয়ে ফিরব না। শুনছ?
তবু ওর সাড়া না পেয়ে দেবতোষ উঠে দাঁড়ালেন। পরক্ষণে দেখলেন, ওর চোখের পাতা বন্ধ। হাত দুটো বিছানা আঁকড়ে ধরে রয়েছে। নির্ঘাৎ ফিট। টেবিল থেকে গঙ্গাজলের পাত্রটা নিলেন দেবতোষ। একটুখানি ছিটিয়ে দিলেন মুখে। কাঁধে ভিজে হাতটা ভালোভাবে রগড়ালেন। তারপর পা দুটো অতিকষ্টে তুলে শুইয়ে দিলেন বিছানায়। এবার সুদেষ্ণাকে ঘুমন্ত মনে হল। দেবতোষ জানেন, এ ফিট ভাঙানোর সাধ্য আপাতত কোনো ডাক্তারের নেই। নিজে থেকে ভেঙে যাবে এক সময়। বরং মানদাকে বললে সে এসে একটু নজর রাখবে।
দেবতোষ সন্তর্পণে দরজা খুলে বেরোতে যাচ্ছেন, সেই সময় সুদেষ্ণার গলা শোনা গেল, যাচ্ছ যাও–কিন্তু ছবি না আনলে এই ঘরেই না খেয়ে মরব বলে দিলাম।
কোনো জবাব না দিয়ে দেবতোষ বেরোলেন। রোদ উজ্জ্বলতর হয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। আপাতত কর্নেলের ঘরে যেতে হবে।
.
সুরঞ্জন উদ্বিগ্ন মুখে রিসেপশনে বসে ছিল। একটু আগে দিব্যেন্দু এসেছিল বাইরে থেকে। তার মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছিল। স্বাতীর পায়ের ব্যথা ভীষণ বেড়েছে। তাই বুঝি দিব্যেন্দু এমন অস্থির হয়ে পড়েছে। ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিল সে। বলে গেছে, ডাক্তার এলে যেন পৌঁছে দিয়ে আসে।
সুরঞ্জন বলেছে, অবশ্যই। সে তো আমারই ডিউটি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
দিব্যেন্দু চলে গেলে সে ভাবছিল, চুরি-চামারির ঘটনা পুলিশে রিপোর্ট করবে কিনা। রিপোর্ট না করলে হয়তো কোনো ক্ষতি হতে পারে। আবার রিপোর্ট করলে পুলিশ আসবেই এবং বাইরে সব জানাজানি হবে। তখন হোটেলের দুর্নাম রটে যাবে। সেটা কোনোমতেই বাঞ্ছনীয় নয়। পরিচালক বোর্ড ওর চাকরি খেতে দ্বিধা করবে না। বিন্দুমাত্র।
সুরঞ্জন তাই ভীষণ উদ্বিগ্ন। কর্ণেলের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। কর্নেল সেই যে ওপরে গিয়ে চীনা মিত্রর ঘরে ঢুকেছেন, আর নামবার নাম নেই। যা আড্ডাবাজ মানুষ–আড্ডায় মজে গেলে সময়ের জ্ঞান থাকে না।
দেবতোষ নেমে এলেন। সুরঞ্জন উঠে দাঁড়াল, মর্নিং স্যার!
দেবতোষ মৃদু হেসে মাথা দোলালেন। বললেন, কর্নেলসাহেবের সঙ্গে দেখা করব সুরঞ্জনবাবু। প্লিজ, একটু খবর পাঠান।
সুরঞ্জন বলল, সায়েব ওপরে সেই আর্টিস্ট মহিলার সঙ্গে আলাপ করতে গেছেন। এখনও ফেরেননি।
তাই নাকি! ঠিক আছে। আমি একবার বেরোচ্ছি। লাঞ্চের আগেই ফিরব। আপনি ওঁকে একবার বলে রাখবেন কথাটা। কেমন?
সুরঞ্জন মাথা দোলাল। ভয়ে অধ্যাপক-গিন্নির খবর নিতে সাহস করল না। দেবতোষ চলে দেলেন প্রাঙ্গণ পেরিয়ে।
বয় শম্ভু এসে বলল, টাইপিস দিদি এই চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন। ওনার ভাই দিয়ে গেল। আপনি তখন সায়েবের সঙ্গে ওপরে ছিলেন।
চিঠি খুলে বিরক্তি সহকারে পড়ে নিল সুরঞ্জন। আজ সাত দিন অ্যাবসেন্ট মনীষা। অফিস-অ্যাসিস্ট্যান্ট-কাম-টাইপিস্ট সে। গতকাল ছুটির মেয়াদ শেষ–আজ জয়েন করার দিন। লিখেছে, আজ পারছে না–আগামীকাল আসছে।
মামাবাড়ির আব্দার সব! পরীক্ষা দেবে, দিয়ে হাতিঘোড়া পাশ করবে একেবারে। একট চিঠি লিখতে বললে হাজারটা বানান ভুল করে–এক কাজ একশোবার বোঝাতে হয়। হুঁঃ! সুরঞ্জন মেজাজে বলল, তুই আবার হাঁ করে কী দেখছিস? ভাগ।
শম্ভু এদিক-ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, স্যার, আজ ভোরবেলা এক মজার কাণ্ড দেখেছি!
সুরঞ্জন ট্যারা চোখে তাকাল মাত্র।
সাহস পেয়ে শম্ভু বলল, ওই যে রোগামতো ফরসা ধুতিপাঞ্জাবি পরা বাবুটি, আর ছোট দিদিমণি সুইমিং পুলের ওধারে গাছতলায় দাঁড়িয়ে……
সুরঞ্জন ধমক দিয়ে বলল, থাম্ ব্যাটা! নিজের কাজে যা।
শম্ভু পালিয়ে গেল হাসতে হাসতে। হ্যাঁ সুরঞ্জনও দেখেছে। সারভ্যান্টস রুমের ওদিকে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখেছে দৃশ্যটা। শুভ আর কল্পনা ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরকে টানাটানি করছে। এ ছ্যাবলামি ছাড়া কী? ওরা এক সময় এদিকে এগিয়ে এলে সুরঞ্জন হনহন করে রিসেপশনে চলে এসেছিল। সেই সময় ওর মনে পড়েছিল, মিঃ বোস কি এখনও ফেরেননি? ভোর ছটা থেকে সে বাইরে রয়েছে। এটা নিয়ম। তার আগে ফিরেছেন কিনা জানার জন্যে কৌতূহলী হয়েছিল সে। ওপরে যেতেই কিন্তু অবাক হল। বারান্দার শেষপ্রান্তে থামের আড়ালে কে দাঁড়িয়েছিল, শুধু একটা পাশ দেখা যাচ্ছিল। দীপেন বোসের ঘরে তালা নেই দেখে সুরঞ্জন ততক্ষণে আশ্বস্ত হয়েছিল। ভদ্রলোক ফিরেছেন তাহলে। কিন্তু দারোয়ানটা তো বলল না সে কথা! কোনো পথে ফিরলেন বোস সায়েব?
ততক্ষণে থামের আড়াল থেকে লোকটা সরে বারান্দায় হাঁটছে। সুরঞ্জন মনে মনে হাসল। নীরেন! নীরেনবাবুও তাহলে নীচের দৃশ্যটা উপভোগ করছিলেন!
নীরেনের উদ্দেশে সুরঞ্জন বলেছিল, গুড মর্নিং।
নীরেন মৃদু হেসে মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল।….
তাহলে যা দেখা যাচ্ছে, ওই মেয়ে দুটো নিয়ে এরা কয়েক বন্ধু মিলে ঘূর্তি করতেই এসেছে। করছে করুক–কিন্তু বাইরে রটলে হোটেলের বদনাম হবে। সুরঞ্জন একটু ক্রুদ্ধ হয়েছিল রাত্রির মতো। স্বাতীকেও তো বিভাসবাবুর ঘর থেকে বেরোতে দেখেছিল রাত্রে। বড়লোকের ছেলেপুলেরা বেশ আনন্দেই থাকে।
এতক্ষণে হন্তদন্ত ডাক্তারবাবু এলেন। রিকশো থেকে নেমে গেট খুলে প্রায় দৌড়চ্ছেন ভদ্রলোক। সুরঞ্জন এগিয়ে গেল।…আসুন স্যার। একটু কষ্ট করে ওপরে যেতে হবে। রুম নম্বর টু।
.
ওপরে মসজিদ, নীচে ভূগর্ভের অন্ধকারে গোরস্থান। গোরস্থান–কিন্তু গোলকধাঁধা বললে ভুল হয় না। দরজার সামনেই যে লোকটা ওদের আদাব দিল, সেই এখানের পাহারাদার। আবার গাইড বলতেও সে। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘরগুলো। সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় গা ছমছম করছিল শুভর। কিন্তু নীরেন আর বিভাস ছাড়ল না ও কে। তিনজনে নীচে নামল। আবছা আলো জ্বলছিল। একটা তাকে–রেড়ির তেলের পিদিম মাত্র। ঘরের ভিতর কোনো ছেলেখাকি নবাবনন্দিনীর কবর। শ্বেতপাথরে বাঁধানো। সামনে এবং ডাইনে বাঁয়ে দরজা রয়েছে। নীরেন সেদিকে এগোলে পাহারাদার ওরফে গাইড বলল, ভিতরে পনেরোখানা ঘর আর পনেরোটা গোর রয়েছে বাবুসাব। লেকিন, ভিতরে যাবেন না। বহৎ আঁধেরা!
নিষেধ শুনল না নীরেন। বলল, দেখে আসি। অন্তত ভূতের সঙ্গে মোলাকাত হলে ক্ষতি কী!
সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বিভাস ডাইনে দরজায় দাঁড়িয়েছিল। কোনো কথা বলে সেও সাঁৎ করে অদৃশ্য হল চোখের সামনে।
শুভ ঠিক করতে পারছিল না কাকে অনুসরণ করবে। পরক্ষণে তার যেন মনে হল ভিতরে নীরেন তাকে ডাকছে। সে নীরেনের উদ্দেশে সাড়া দিয়ে বলল, যাই! তারপর নীরেনের পথেই মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়ল।
কিন্তু কী ঘন অন্ধকার! শুভ ক্রমাগত ডাকতে থাকল, নীরেন নীরেন! কোনো সাড়া নেই। গায়ে কবর ঠেকছে সম্ভবত। ভয়ে সে পথ খুঁজে বেরিয়ে পড়ার জন্য দেয়াল ধরে এগোতে থাকল ফের ডাকল, নীরেন, এই নীরেন!
ভয়ঙ্কর স্তব্ধ অন্ধকার ঘরে গমগম করে প্রতিধ্বনি বেজে উঠল। শুভর বুক কাঁপছে। গলা শুকিয়ে গেছে। পা বাড়িয়ে ফের আরেকটা ঘরে–তারপর আরও ঘর, আরও কঠিন ঠান্ড কবর, নীরেন, নীরেন! এবং প্রতিধ্বনি। তার মনে হল, আর কোনোদিন পৃথিবীর আলোবাতাস সে পাবে না। হাঁফাতে হাঁফাতে সে দেয়াল আঁকড়ে ধরে পা বাড়াতে চেষ্টা করল! সামনে সোজা এগোতে হবে। এটা অনন্ত নয়–অন্ত একটা আছেই।…
কিন্তু একই জায়গায় ঘুরে মরছে না তো সে? শুভ এবার মাথাটা ঠান্ডা করতে চেষ্টা করল। পরমুহূতেই অস্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে। দ্রুত ঘুরল।
.
০৭.
ডাইনিং হলের প্রকাণ্ড সেকেলে ঘড়িতে রাত নটার ঘণ্টা বাজল। তারপর দূরে প্রধান ফটকখানার পেটাঘড়ির আওয়াজ শোনা গেল। সুরঞ্জন হাসতে হাসতে মন্তব্য করল, বারো সেকেন্ডের তফাত। কোনো ঘড়িটা যে ঠিক চলছে, সে আপনারা বুঝতেই পারলেন না স্যার। অবশ্যি আপনাদের ঘড়িতে কী সময়, জানিনে।
কর্নেল একপলক কব্জিতে চোখ ফেলে তারপর বললেন, ইওর ক্লক ইজ করে।
সবাই যে-যেখানে ছিল, নিজের নিজের কব্জিতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। আজ ইলেকটিরি ফেল করেনি। ঘরে-বাইরে সবগুলো রডলাইট আর বাল্ব জ্বালা হয়েছে। সুরঞ্জন গতরাত্রের ব্যাপার নিয়ে আজ বেশ সাবধানী। বারবার এদিক-ওদিক যাতায়াত করছে। বাহাদুর রিসেপশনের সামনে টহল দিচ্ছে। চাকর-বয়-বাবুর্চিও ম্যানেজারের তাগিদে সতর্ক। মানদা আজ সকাল সকাল কেটেছে। তার দরকার হবে না। স্বাতী দিব্যেন্দুর সাহায্যে নীচে নেমে এসেছে। ওরা দুজনে আজ আলাদা টেবিলে বসেছে। সেটা একেবারে কোণের দিকে।
আলাদা দীপেন বোস আর ইরা। একটা থামের পাশে মধ্যখানে তাদের টেবিল। কর্নেল-দেবতোষের সঙ্গে চীনা। নীরেন-বিভাস দূরে একটা টেবিলে বসেছে।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা একজোড়া করে লোক। হঠাৎ ঢুকেতাকালে মনে হয়। মস্ত হলঘরটা যেন লোকে ঠাসা। উজ্জ্বল আলো। কিন্তু গুটিকয় মোটা থামের দরুন অনেকটা ঘাড় ঘোরালে তবেই এক টেবিলের লোক অন্য টেবিলের লোককে দেখতে পাবে।
দেবতোষ আড়ামোড়া ছেড়ে ফের ঘড়ি দেখে বললেন, এরা খেতে দিতে বড্ড দেরি করে।
কর্নেল হাসলেন।…..সে তো ভালোই। ক্ষিদেটা বাড়তে দিন।
ক্ষিদে! দেবতোষের মুখটা কাঁচুমাচু দেখাল।…আজ সারাটা দিন যা গেছে না! দুপুরে খাওয়ার অবসরই পেলাম না। গিয়েছিলাম, মাইল চারেক দূরে একটা ঢিবি দেখতে। বনজঙ্গলের মধ্যে জায়গাটা। কর্নেল, আপনি তো এদিকে এসেছেন অনেকবার। গেছেন কখনও রামরামপুর? সুযোগ পেলে প্রমাণ করতাম যে মহেঞ্জোদরো-হরপ্পার জুটি একটা সভ্যতা এই বঙ্গদেশেও ছিল। এর পতনের কারণও এক। বর্বর বিদেশি আক্রমণ।
চীনা বলল, কোনো দেশের? কারা তারা? সোৎসাহে দেবতোষ বললেন, আবার কারা? আর্যরা।
কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। বললেন, বেদে ইন্দ্র কর্তৃক নগরধ্বংসের কথা অবশ্য আছে। তবে কী জানেন, নগর হল পুরোটাই কৃত্রিম–মানুষের প্রয়োজনবোধের সঙ্গে শিল্পবোধ মিশে তা সম্পূর্ণ তৈরি জিনিস। নগরবাদে যা লোকালয়, তা কোনো-রকমে ঝড়েবাদলে আত্মরক্ষার বা মাথা গোঁজবার আখড়ামাত্র। নেচারের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য আছে। অতি সহজে তা মিলেছে মানুষের জন্যে। কিন্তু নগরের পিছনে অনেক স্বপ্নসাধ পরিকল্পনা, অনেক শ্রম-যত্নের ব্যাপার আছে। এখন, মানুষের স্বভাব হল যা গড়বে, তা ভাঙবে। দেখুন না, সেই ট্রাডিশান সমানে চলেছে। লাস্ট গ্রেটওয়ারে আসামের অয়েল-ইন্ডাস্ট্রিটা…..
কর্নেলের যাত্রাপথ লক্ষ করে শশব্যস্তে দেবতোষ কথা কাড়লেন।……বাই দি বাই, কর্নেল, এ প্রবলেম ইজ সলভড়। ছবিটা পাওয়া গেছে।
চীনা লাফিয়ে উঠল, পাওয়া গেছে। কই, কোথায়?
দেবতোষ গম্ভীর মুখে বললেন, আপনারটা নয়। সেই গুরুদেবের ছবিটা। আমার কাঁধে ব্যাগে ছিল আজ। রামরামপুরে নোটবই বের করতে গিয়ে দেখি, দিব্যি তার ভেতর রয়ে গেছে। আশ্চর্য।
কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ব্যাগে?
হ্যাঁ। দেবতোষ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।…ব্যাগটা ছিল ড্রেসিং টেবিলের হুকে। যাবার সময় কাঁধে নিয়েছিলাম! তখন ভেতরটা দেখিনি।
চীনাও ফোঁস করে বলল, আমার ছবিটা যদি এমনি করে পাওয়া যেত।
কর্নের বললেন, হয়তো পাওয়া যাবে। যাক গে, প্রফেসর আপনার স্ত্রী তাহলে এখন আশা করি খুশি হয়েছেন?
খুশি? ঘরের ভিতর পুজোআচ্ছা হয়ে গেছে একদফা। সুরঞ্জন পুরুত এনে দিয়েছিল। ঘণ্টার শব্দ শোনেন কি? বলে হাসতে লাগলেন দেবতোষ।……
.
দিব্যেন্দুর টেবিলে স্তব্ধতা। স্তব্ধতা সকালের সেই কথাকাটাকাটির পর থেকেই। ভাব এসেছিল। স্বাতী এক্স-রে করে এসেছিল। বিকেলের মধ্যেই দিব্যেন্দু এক্সরে রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। তেমন কিছু নয়, সামান্য আঘাত। এক্সারসাইজে সেরে যাবে। গরম-ঠান্ডা কনট্রাস্ট বাথ ইত্যাদিই যথেষ্ট।
তবু এত করেও স্বাতীর মন পাচ্ছে না বেচারা। এখন বারকয় স্তব্ধতা ভাঙতে চেয়েছিল দিব্যেন্দু, স্বাতী শুধু চোখে-চোখে তাকিয়েছে! হঠাৎ দিব্যেন্দু বলল, ওদের এত সাহস হবে? আমার বিশ্বাস হয় না। তাছাড়া, তোমার দায়িত্বই বেশি ছিল আমার চেয়ে। একটা কিছু ঘটলে তোমার মা কী বলবেন?
স্বাতী অস্ফুটকণ্ঠে বলল, কী ঘটবে?
দিব্যেন্দু বলল, বিয়ে। সে না হয় ঘটল। কিন্তু ভেবে দ্যাখ, শুভর মতো বাউন্ডুলে ছোকরা-না আছে তেমন শিক্ষা-দীক্ষা, না আছে সঙ্গতি। কল্পনা তোমার সঙ্গে যেভাবে মানুষ হয়েছে, তাতে ওর ভবিষ্যতটা কী হতে পারে অনুমান করছ?
স্বাতী একটু চুপ করে থেকে বলল, ওরা বিয়ে করবে ভাবছ কেন?
দিব্যেন্দু আকাশ থেকে পড়ল।……মাই গুডনেস! তুমি কী ভেবেছ তাহলে? সকালে বেরিয়েছে দুটিতে। এখনও ফিরল না। পুলিশের কাছেও যেতে নিষেধ করছ।
স্বাতী বলল, দুজনে একসঙ্গে তো বেরোয়নি শুনলাম।
এসব ব্যাপারে একসঙ্গে ওরা বেরোতে পারে না। এটা বোঝাই যায়।…..দিব্যেন্দু বলল।….আগে-পরে বেরিয়েছে। নীরেন আর বিভাসের সঙ্গে শুভ বেরিয়েছিল। আঁধারমহল না কোথায় মাটির তলায় কবরখানা আছে। তার ভিতর তিনজনে ঢুকেছিল। তারপর নীরেন আর বিভাস একে একে বেরিয়ে আসে। শুভর পাত্তা নেই।
নীরেন বলল-দরোয়ান ওকে বলেছে–গঙ্গার পাড়ের দিকে সুড়ঙ্গ মতো একটা ভাঙা দরজা আছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ওরা ভেবেছিল–সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে শুভ চলে গেছে।
স্বাতী বলল, চলে যাবে কেন? ওদের জন্য অপেক্ষা করবে না?
দিব্যেন্দু বলল, অপেক্ষা করা উচিত ছিল। করে নি। তাতেই বোঝা যায়, ব্যাপারটা কী। নীরেনও সেইরকম আঁচ করেছিল। আজ ভোরে নাকি দুজনে সুইমিং পুলের ওখানে আপত্তিকর অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিল–নীরেন দেখেছে।
স্বাতী কড়াস্বরে বলল, স্টপ ইট!…..
ইরার মুখটা বিষণ্ণ আর গম্ভীর। চোখের নীচেটা কালচে দেখাচ্ছে। চাপা গলায় উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছিল সে…তুমি এখন থেকে যাচ্ছ কিনা বলো।
দীপেন হাসি দিয়ে প্রতিহত করছিল আক্রমণ। বলল, অত ভীত কেন তুমি? দ্যাখো তো, তোমাদের চীনাদি দিব্যি একা কাটাচ্ছেন, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।
ইরা বলল, নিজের কাজে এসেছ জানলে আমি আসতামই না। কেন আনলে আমাকে? যতসব ভূতুড়ে জায়গা আর নোংরা লোকের কারবার।
দীপেন হঠাৎ চমকে উঠল যেন।….নোংরা লোক মানে?
ইরা চাপা গলায় বলল, কেন, শোনননি, চোখেও পড়ছে না কিছু?
না তো? দীপেন মাথা দোলাল।…কারো সঙ্গে আজ কথাই বলিনি বিশেষ।
ইরা টেবিলে ঝুঁকে বলল, কাল রাত্রের সব ব্যাপার তো বলেছি তোমাকে। আজ দুপুর থেকে সেই মেয়েটি আর কবি ছেলেটির পাত্তা নেই। আশ্চর্য, ওরা দিব্যি নির্বিকার!
দীপেন সকৌতুকে বলল, কবির সঙ্গে কাল কিন্তু বিস্তর ঘোরাঘুরি করেছ! ইরা নাক কুঁচকে বলল, চেহারা-কথাবার্তা দেখে তো টের পাইনি, অমন লোফার! ছেড়ে দাও……দীপেন বলল।……আমার আর একটা সকাল লাগবে। ইচ্ছে হলে দুপুরের গাড়িতেই চলে যাবো আমরা।….
.
নীরেনদের টেবিলে কথাবার্তা চলেছে। বিভাস চিন্তিতমুখে বলছিল, একটা ভুল হয়ে গেছে। আঁধারমহলের ভিতরটা খুঁজে দেখা উচিত ছিল আমাদের।
নীরেন ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে বলল, চোখে তো কিছু দেখা যায় না। যা অন্ধকার।
বিভাস বলল, কাছেই বাজার। মোমবাতি কিনে আনতাম।
নীরেন হাতের আঙুলগুলো ছড়িয়ে একটা ভঙ্গি করল–মুখটা বিরক্ত।……ছেড়ে দিন। ও কচিশিশু নয়। একটা সামান্য জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না বুঝি। কল্পনার পাত্তা নেই দেখেও ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না আপনি?
তা ঠিক। বিভাস মাথা দোলাল….কী আশ্চর্য কারবার দেখুন তাহলে! বেশ ফাঁক বুঝে শুভবাবু কেটে পড়লেন। কল্পনা ওদিকে হয়তো স্টেশনে কথামতো অপেক্ষা করছেন। তারপর……ফিক-ফিক করে চুপি চুপি হাসতে লাগল বিভাস।……
রিসেপশনে সুরঞ্জন গম্ভীরমুখে হিসেবপত্র লিখছিল। শম্ভু এসে বলল, একটা কথা বলছিলাম স্যার। আজ আমার বাসায় না গেলেই নয়। বউর অসুখ–আপনার দিব্যি…..
সুরঞ্জন ধমকাল।…ফের সেই ঘ্যানঘ্যান। খাবার দেওয়া হয়েছে সব?
হয়েছে আজ্ঞে।
তবে ভাগ।
শম্ভু কাঁচুমাচু মুখে দুপা এগোল।
…..পাহারা দিয়ে কী হবে বলুন স্যার? আপনিও তো বুঝতে পারছেন–এসব হল ভেতরেরই ব্যাপার।
ধমকাতে গিয়ে সুরঞ্জন তার মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, হ্যাঁ রে শম্ভু, আজ কোনোকিছু চোখে পড়েছে তোর?
সাহস পেয়ে শম্ভু ঘনিষ্ঠ হল। ফিসফিস করে বলল, পড়েছে। রোগাদাদাবাবু আর ড্যাবডেবে দিদিমণিটি সকাল থেকে নেই। ভোরবেলা সুইমিং পুলের ধারে দুজনে। ব্যাপার-স্যাপার যা হয়েছিল, আপনাকে বলেছিতো। সকালে আর ওপরে আসিনি। বাবুর্চির কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি, পিছনের সিঁড়ি বেয়ে দিদিমণি নামছে। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে সাঁৎ করে বাগানের ভিতর চলে গেল। ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে আর দেখা গেল না ওনাকে। বাবুর্চিকে দেখলাম ব্যাপারটা। ভাবলাম, এবার নামবেন রোগাবাবু। কিন্তু কতক্ষণ হয়ে গেল, ওনার পাত্তা নেই। পরে দেখি তিন ছোকরাবাবু বেরোচ্ছেন এখান দিয়ে তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন রোগাবাবু।
সুরঞ্জন যেন মনশ্চক্ষে উপভোগ করছিল দৃশ্যটা। বলল, কিন্তু ওরা সবাই চেপে যাচ্ছে ঘটনাটা। লক্ষ করেছিস? কেউ বলছে না কিছু। আমি একবার জিগ্যেস করেছিলাম–ওই নীরেনবাবুকে। বলল, বাইরে কোথাও গেছে নাকি। এখন রাত নটা কুড়ি–এখনও ফিরল না দেখছি।
শম্ভু বলল, আপনারও স্যার একটা দায়িত্ব আছে কিন্তু।
সুরঞ্জন চমকাল।…যা বলেছিস। একটা ভালোমন্দ হলে তখন যত ঝমেলা আমার ঘাড়ে পড়বে। শম্ভু বলল, মন্দ আর কী হবে? ধরুন, যদি ওনারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন–সে একটা শুভকাজ।
সুরঞ্জন তেতোমুখে বলল, যা বুঝেছি মেয়ের বাবা বড়লোক। এদিকে পাত্রর অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হল না। বন্ধুদের সঙ্গে এসেছে মাত্র। এখন, বাবা যদি কেসফেস ঠুকে দেয়, পুলিশ এখানে এসে জিগ্যেস-পত্তর করবে বইকি।
শম্ভু সাহস দিয়ে বলল, আমাকে ডাকবেন। সাক্ষী যা দেবার দিয়ে দেব। তা স্যার, আমি আজ বাড়ি যাই?
যাবি?
হ্যাঁ স্যার। মাইরি বলছি, বউটার এখন-তখন অবস্থা।
হাসতে হাসতে সুরঞ্জন বলল, ভাগ ব্যাটা। কাল ভোর পাঁচটায় আসবি কিন্তু।
শম্ভু চলে গেল ডাইনিং হলের দিকে।…..
ডাইনিং হলে ভোজনপর্ব শুরু হয়েছে। দেবতোষের টেবিলে ফের প্রসঙ্গক্রমে যুদ্ধ এবং পুরাতত্ত্বের পালাবদল ঘটছে। জানালাগুলো বন্ধ থাকায় ভিতরে বেশ ওমের সঞ্চার হয়েছে। কর্নেল মাফলারটা খুলে হাঁটুর কাছে রেখেছিলেন। সেটা গড়িয়ে নীচে পড়তেই তিনি টেবিলের তলায় ঝুঁকলেন। সেই অবসরে চীনা চোখ টিপল দেবতোষের দিকে। দেবতোষ সে-মুহূর্তে চোখ টেপার কারণ বুঝতে পারেননি। পরমুহূর্তে টের পেলেন চীনা ওঁর টাক নিয়ে রসিকতা করল। দেবতোষ সায় দেবার ভঙ্গিতে হাসলেন। সত্যি, এমন ছাঁদের টাক মানুষের মাথায় জন্মায় কীভাবে?
কর্নেল মাফলারটা গলায় জড়িয়ে বললেন, এত বিচ্ছিরি ঠান্ডা পড়েছে। ভাবা যায় না। গলাটা ব্যথা করছে।
চীন হলের ভিতরটা একবার দেখে নিয়ে বলল, এত ঠান্ডায় এখনও শুভবাবু বাইরে কী করছেন? এখনও ফিরলেন না দেখছি।
দেবতোষ বললেন, দ্যাট পোয়েট?
চীনা মুখ নামিয়ে একটা মাংস ঠোঁটে রাখল। কামড় দিল না। ওই অবস্থাতেই বলল, কল্পনাও ফেরেনি।
কর্নেল বললেন, তাই নাকি?
চীনার মুখটা এবার গম্ভীর।…একটা কিছু ঘটেছে মনে হচ্ছে। ওরা থমথমে মুখে বেড়াচ্ছে। জিগ্যেস করেছিলাম, স্পষ্ট জবাব পাইনি।
দেবতোষ চাপা হাসলেন।…আজকাল এই তো চলেছে সবখানে। ইয়ং ম্যানদের যুগ। যে যা খুশি করবে, নিয়ম-টিয়ম নাস্তি। কিন্তু আমাদের ইয়ং এজেতে সব অন্যরকম ছিল। আমাদের গার্জেনরা–বিশেষ করে মেয়েদের এমনি করে বাইরে পাঠানো কল্পনাও করতেন না। কী বলেন কর্নেল?
কর্নেল কী যেন ভাবছিলেন। চীনার দিকে ঘুরে বললেন, আজ সকালে যখন ওপরে তোমার ঘরে বসেছিলাম–একটি মেয়েকে নেমে যেতে দেখছিলাম পিছনের সিঁড়িতে। হাল্কা গড়ন-ডিমালো মুখ, টানাটানা চোখ……ইয়েস-শাড়ির রং খয়েরি…… ভাবলাম, তোমাদেরই কেউ।
চীনা বলল, হ্যাঁ, কল্পনা। কিন্তু ওদিকে কোথায় যাচ্ছিল?
দেবতোষ পাংশুমুখে বললেন, ওদিকটা তো জঙ্গল। সাপখোপের রাজত্ব। সর্বনাশ! কোনো বিপদ ঘটেনি তো?
কর্নেল বললেন, রাত্রে আমার ভালো ঘুম হয় না গতরাত্রে একবার জানালা খুলেছিলাম। সেই সময় বেশ কিছুটা দূরে এক ঝলক আলো দেখলাম।……
দেবতোষ সাদা মুখে সোজা হয়ে বললেন, বাগানের ভিতরে?
হ্যাঁ। তারপর কারা যেন ধস্তাধস্তি করছিল। কিংবা দৌড়োদৌড়ি-ঠিক বুঝতে পারলাম না।..কর্নেল বললেন।…সকালে ওখানটা ঘুরেছি–মানে তখন জাস্ট ছটা। ভীষণ কুয়াশা ছিল। এসেছিলাম–তারপর চীনা, তোমার হারানো ছবির সাবজেক্ট এবং মোতিঝিলের মসজিদের দেয়ালে শুভবাবু যে কবিতা দেখেছিলেন–তুমিই তো বলছিলে আজ সকালে, কী যেন…মধ্যরাতে ডোবার ধারে…।
চীনা রুদ্ধশ্বাসে বলল, আমি ভাবিনি, আমি ভাবিনি! বড় অদ্ভুত তো।
দেবতোষ উৎকর্ণ হয়ে বললেন, কী কবিতা?
চীনা আওড়াল।…..মধ্যরাতে বনের মাথায় উঠলে চাঁদ। ডোবার ধারে পাতব হরিণ ধরার ফাঁদ…ওই থেকেই ছবিটা মাথায় এসেছিল আমার।
কর্নেল সস্নেহে তাকালেন চীনার দিকে।…..একটা তারিখ লেখা ছিল বলছিলে। কালকের তারিখ।
হ্যাঁ। চীনা জবাব দিল।
এবং কাল রাত্রেই ওইসব ব্যাপার ঘটেছে।…দেবতোষ শিউরে উঠলেন।
কর্নেল মাথা দোলাতে-দোলাতে থালায় ঝোল ঢেলে নিলেন। বললেন, দুপুরে ইচ্ছে হল ফের যাই একবার-ডোবাটা ভালো করে দেখে আসি, ব্যাপারটার মূলে সত্যি কোনো রহস্য আছে কি না! কিন্তু হঠাৎ ফোন এল–পুলিশ সুপার বর্মন এসে গেছে লালবাগে। আমার বন্ধুর ছেলে। যেতে হল সেখানে। এস ডি ওর বাসায় নেমন্তন্ন।
চীনা বলল, তাই দুপুরে আপনাকে দেখতে পাইনি। ভাবলাম, কোথায় গেলেন! একটু গল্পগুজব করার ইচ্ছে ছিল। কাল রাত্রি থেকে মনমেজাজ ভালো নেই। বেরোই নি।
দেবতোষ বললেন, আমার সঙ্গে গেলে দারুণ সব সাবজেক্ট পেতেন।
চীনা একটু হেসে বলল, আমি আপনার মেয়ের মতো। তুমি বলেই ডাকবেন।
দেবতোষ কী বলতে যাচ্ছেন, হঠাৎ সুরঞ্জন এল হন্তদন্ত হয়ে।……নীরেনবাবু! দিব্যেন্দুবাবু! শুভবাবুর খোঁজ পাওয়া গেছে। এই মাত্র ফোন করেছিল জাফরাগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে।
সবার আগে দিব্যেন্দু উঠে দাঁড়িয়েছিল। রুদ্ধশ্বাসে বলল, কী, কী হয়েছে শুভর?
ঝোড়োকাকের মতো চেহারা হয়ে গেছে সুরঞ্জনের। ভাঙা গলায় বলল, আঁধারমহলের ভিতর একটা লাস পাওয়া গেছে। যা বর্ণনা দিল, তাতে শুভবাবু ছাড়া কেউ নয়। পুলিশ অনুমান করে খোঁজ করছিল, হোটেলে কেউ অ্যাবসেন্ট আছে কি না। মাই গড! এ এক আজগুবি ঘটনা!
খাওয়া ছেড়ে সবাই এঁটোহাতে সুরঞ্জনকে ঘিরে ধরেছে ততক্ষণে স্বাতী অস্ফুট চিৎকার করল, আর কল্পনা?
কর্নেল আর দেবতোষ বাদে সবাই বেসিনের কাছে দৌড়ে গেল হাতমুখ ধুতে। দীপেন বোস আর ইরা থমথমে মুখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। দিব্যেন্দু স্বাতীর হাত ধরে রুদ্ধশ্বাসে বলল, তুমি চীনাদির সঙ্গে ওপরে চলে যাও। আমি আসছি। না-আসা অব্দি দরজা খুলল না।
স্বাতী কচিমেয়ের মতো কেঁদে উঠল এবার।…তাহলে কল্পনাও আর নেই! তাকে তোমরা খুঁজে বের করো।
.
০৮.
এমন শক্ত মেয়ে স্বাতী, এ অভাবিত বিপর্যয়ের আঘাত সামলানো তবু সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। তখন থেকে ফুলে ফুলে কেঁদেছে সে। বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশের দুটো কোণ আঁকড়ে ধরে অস্ফুট কণ্ঠে বারবার বলেছে, ইমপসিবল! অ্যাবসার্ড! এ হতে পারে না। পরক্ষণে ধুড়মুড় করে উঠেছে হিস্টিরিয়া রুগির মতো। চিৎকার করেছে–কল্পনা, কল্পনা কোথায়? আলুথালু চুল, লাল চোখ, অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তার চেহারাটা।
চীনা মিত্র তাকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। পাশে চেয়ার টেনে কর্নেল উদ্বিগ্ন মুখে বসে রয়েছেন। খবর পেয়েই দিব্যেন্দু নীরেন আর বিভাস জাফরাগঞ্জের দিকে চলে গেছে। কর্তব্যপরায়ণ ম্যানেজার সুরঞ্জনও গেছে। বোস দম্পতি–এ বড় আশ্চর্য লাগে, যেন ভয় পেয়ে নিজেদের ঘরে ঢুকে পড়েছেন। অধ্যাপক একবার এসেছিলেন স্বাতীর ঘরে। আশ্বাস দিয়ে গেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাববার কিছু নেই।……
কর্নেল বিরক্ত হতে গিয়ে লুকিয়ে হেসেছেন? ভদ্রলোক ছিটগ্রস্ত। সব ঠিক হয়ে যাবে মানে? আর–ভাববার কিছু নেই? সাধ করে বেড়াতে এসে একটি তাজা জলজ্যান্ত যুবক খুন হয়ে গেছে–ভাববার কিছু নেই? মাথা খারাপ আর কাকে বলে।
কল্পনার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না সকাল থেকে–এ খবরও দিব্যেন্দুরা পুলিশকে জানাবে। পুলিশ খোঁজাখুঁজি শুরু করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু কর্নেলের মাথার মধ্যে সেই থেকে একটা ব্যাপার পোকার মতো কুটকুট করছে। বাইরে শীতের প্রকোপ প্রচণ্ড। তা না হলে নিজেই একা বেরিয়ে পড়তেন। তাঁর কেমন যেন বিশ্বাস, কল্পনা…
গা শিউরে উঠল কর্নেলের। মাথা নাড়লেন কয়েক বার। তারপর বুকে ক্রস আঁকলেন। না, না, তা যেন সত্যি না হয়!
চীনা কর্নেলের চিন্তিত মুখটা দেখে নিচ্ছিল মাঝে মাঝে। বুকে ক্রস আঁকা লক্ষ করে সে এতক্ষণে চমকাল। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তাহলে খ্রিশ্চান! কিন্তু সে জন্যেও নয়, চীনা একটু চঞ্চল হল–তবে কি উনি কল্পনারও কোনো বিপদের আশঙ্কা করেছেন? সকালে মানদা যখন বোসগিন্নির ভূতে চুল কাটার কথা বলছিল, ভীষণ হাসি পেয়েছিল চীনার। হাসি পেয়েছিল একটা কথা মনে পড়ার দরুন। ইরা তার পাড়ার মেয়ে। অথচ ইরা প্রথমে এমন ভাব দেখাচ্ছিল যেন আদতে চেনেই না ওকে। আর শুভদের কাছে জানা গেছে, ইরা নাকি ওদের বলেছিল–উনি বুঝি আর্টিস্ট! যেন ন্যাকা খুকি, কিস্যু জানে না। তখন চীনার রাগ হয়েছিল প্রচণ্ড। কিন্তু মানদা সকালে ওই খবর দেবার সময় তার হাসি পেয়েছিল এই ভেবে যে ইরার মাথাটা আসলে টাকপড়া। সুতরাং মাথা-ভরতি ওই সুন্দর চুলের ঝাপিটি আগাগোড়া নকল। অথচ নিজের স্মরণ-শক্তির ওপর মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায় চীনা। গতরাত্রে ইলেকটিরি ফেল এবং ইরার চুল কাটার ঘটনা যখন ঘটে, সে স্বাতীদের ঘরে উপস্থিত ছিল। ঘটনাটার আকস্মিকতার দরুন তখন সবাই যেমন, তেমনি চীনাও এত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিল যে মনেই ছিল না ইরার চুলগুলো পরচুলো মাত্র! সকালের হাসির গূঢ় কারণ এইটাই। তবে যাই হোক, রাত্রে ওই কাণ্ডের সময় সে যে হেসে ফেলেনি অর্থাৎ বিস্মৃতি তাকে হাসির হাত থেকে রক্ষা করেছে। হাসলে নির্ঘাৎ ইরা অপমানিত বোধ করত এবং পাল্টা শোধ নিতে চাইত।
ঠোঁট একটু কুঞ্চিত হল চীনার। শোধ নিলেই বা কী? সবার জীবনেই কিছু না কিছু দুর্ঘটনার ব্যাপার থাকে। তারও আছে। আছে তো আছেই। তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। সে ব্যক্তিগত সব কিছুতে আজীবন নির্বিকার থাকতে পারে। এ ক্ষমতা তার আছে। মুর্শিদাবাদে এসেই চীনা প্রথমে চমক খেয়েছিল। প্যালেস হোটেলে আগে থেকে টাকা দিয়ে ঘর বুক না করা থাকলে তক্ষুনি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করত। কিন্তু অত পয়সা কোথায়? বাধ্য হয়ে চোখে নির্বিকারত্বের সহজাত দৃষ্টিটা ফুটিয়েছিল সে। তবু মাঝে মাঝে উন্মনা হতে হয়েছে তাকে। এত কাছে এত সামনা-সামনি অতীত জীবনের একটা কুশ্রী স্মৃতি সশরীরে আনাগোনা করবে এবং তাকে কেবলই অভিনয় করে যেতে হবে, এর কোনো মানে হয় না।
অবশেষে জেদ এসেছিল মাথায়। যা করতে এসেছে, তাই নিয়েই ডুবে থাকবে। সে অ্যান্টি-লাইফ বা প্রতি-জীবনের ছবি আঁকতে এসেছে মুরশিদাবাদ। যে প্রতি-জীবন প্রতি মুহূর্তে ছায়া ফেলে চলেছে জীবনের ওপর, তাকে সে প্রত্যক্ষ করবে এই ঐতিহাসিক পোডড়া রাজধানীর মাটিতে। লক্ষ করবে, কেমন করে জীবনের ওপর প্রতি-জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। ওই সব ধ্বংসস্তূপে, কবরখানায়, প্রাচীন মন্দির-মসজিদ-গির্জায় যে অবিচল ঘনকালো ছায়ার সত্তা, তা সে তার তুলিতে ফোঁটাবে।
আর আশ্চর্য, সত্যি সত্যি কখন সে এক সময় সবকিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিতে পিছনে ঠেলে দিয়ে এ নিস্পন্দ মৃতের শহরের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল–যা দেখতে এসেছে তাই স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। চারদিকে শুধু ছায়া পড়ে আর ছায়া পড়ে, কেবলই ছায়া পড়ে। নিসর্গের আনাচে-কানাচে সেই ছায়া পড়ার ধারাবাহিক দৃশ্য।…
হঠাৎ আরও চমকাল চীনা মিত্র। কী ভাবছে সে? তার ছবির সাবজেক্ট শুধু? গা। শিউরে উঠল তার। দেখল, কর্নেল তার দিকে তাকিয়ে আছেন। স্বাতী উপুড় আর নিস্পন্দ। কর্নেল কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করেছেন যেন। সেই মুহূর্তেই চীনা উঠে দাঁড়াল।…স্যার। আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে……
কর্নেল শুধু বললেন, ইয়েস?
চীনা স্পষ্টত কাঁপছিল। চোখ দুটো চঞ্চল। সে বলল, আমার সেই ছবিটা।….
ইয়েস?
ছবিটা ডোবার ধারে…….ক্রমশ দুর্বোধ্য হতে থাকল চীনার কথাগুলো। …..কৃষ্ণপক্ষ, মধ্যরাত, চাঁদ…..বিড় বিড় করছিল সে। তারপর রুদ্ধশ্বাসে ফের বলে উঠল, কর্নেল! এ আমি ভাবিনি, একটুও ভাবিনি! ডু উই বিলিভ মি, স্যার?
চীনা কেঁদে ফেলবে নাকি? তার চোখে জল দেখামাত্র কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। নিঃসঙ্কোচে তার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে বললেন, টেক ইট ইজি। কী বলতে চাও, আমি বুঝেছি। ওতে ভয় পাবার কিছু নেই। কারণ এখনও কল্পনার কোনো খবর আমরা পাইনি।
চীনা ধরা গলায় বলল, এক্ষুনি ওই জঙ্গলের ভিতর ডোবার কাছে খোঁজা দরকার কর্নেল! আমি জানি, ঠিক তাই ঘটেছে।
কর্নেল ওর দিকে একবার তাকিয়ে কলিং বেলটা টিপে দিলেন। ততক্ষণে স্বাতী উঠে বসেছে। সে অস্ফুট চিৎকার করে বলল, এ আমি জানতাম, আমি জানতাম! চীনাদি, কর্নেল! প্লিজ, প্লিজ আপনারা আমার সঙ্গে চলুন।
স্বাতী ধুড়মুড় করে নেমে আসতেই চীনা তাকে ধরল।……না না! আপনার পায়ে ব্যথা–আপনি কোথায় যাবেন? আমরা দেখছি, আপনি শুয়ে থাকুন চুপচাপ।
দরজায় টোকা দিচ্ছিল কে। দরজা খুলে দিলেন কর্নেল। অধ্যাপককে কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল।….বেল দিচ্ছেন শুনে আমিই এলাম স্যার। নীচে দাঁড়িয়েছিলাম ওদের অপেক্ষায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লাস শুভর নয়। অন্য কারো।
কর্নেল বললেন, নীচে চাকরগুলো কেউ নেই নাকি?
কই? কাকেও দেখলাম না তো! দেবতোষ বললেন।…রিসেপশনে বাহাদুর একা বসে রয়েছে। তার সঙ্গেই গল্প করছিলাম। যাক্ গে, কোনো দরকার থাকলে আমাকেই বলুন না! বিপদের রাত্রে পরস্পর একটুখানি কোঅপারেশন করা ছাড়া উপায় তো নেই।
কর্নেল বললেন, বাইরে মিঃ বোসকে দেখলেন না?
না তো। ওঁদের দরজা বন্ধ।
প্লিজ, যদি কিছু মনে না করেন, একবার ওঁকে ডাকুন না! ওঁর স্ত্রীকেও আসতে বলুন এ ঘরে। আপনার স্ত্রীকেও বলুন। কারণ, আমরা তিনজনে একবার বেরোব ভাবছি।
দেবতোষ আঁতকে উঠে বললেন, বেরোবেন? কোথায়?
ওই বাগানটা একবার খুঁজব।
বাগানে কী খুঁজবেন?
চীনা জবাব দিল, কল্পনাকেও তো পাওয়া যাচ্ছে না। তাই..
কথা কেড়ে দেবতোষ বললেন, কী মুশকিল! এই শীতের রাত দুপুরে ওই ভূতের বাগানে যাবেন কোনো দুঃখে? পাগল হয়েছেন? পুলিশে ঠিকই খুঁজে বের করবে, দেখবেন।
পিছনে বাজখাঁই আওয়াজ শোনা গেল।……কী কথার ছিরি! যত বয়স বাড়ছে, তত ন্যাকামি বাড়ছে।
সুদেষ্ণা পর্দা তুলে ঢুকে পড়ল ঘরে। চীনা সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল।
সুদেষ্ণা বলল, আমি রইলাম। দেখি কোনো খুনে গুন্ডার কী সাধ্য, কী ক্ষতি করে। তোমরা যাও–খুঁজে দ্যাখো মেয়েটাকে।…..এই মেয়ে! যাও তত বাছা সামনের ঘরে। ওই চুলকাটা বউটিকে ডেকে নিয়ে এসো। আর ওর বরকে বললো, ওনার সঙ্গে যাক।
কথাটা স্বাতীর উদ্দেশে বলা। স্বাতী নিঃশব্দে হুকুম তামিল করতে পা বাড়াল। পরক্ষণে চীনার দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সুদেষ্ণা চেঁচাল, আ মর! তুমি যাও না মেয়ে। ও ল্যাংচাচ্ছে দেখছ না? ফের আছাড় খেয়ে হাড়গোড় ভাঙবে নাকি? আবার প্যাটপ্যাট করে তাকাচ্ছে কেন? আজকালকার মেয়েগুলো যেন কী?
চীনা অবাক এবং অপ্রস্তুত। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে বেরিয়ে বেল। এসে বিছানায় বসল। দেবতোষ রাগে বিরক্তিতে কাঁপছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলার ক্ষমতা নেই। এই গ্রাম্য স্বভাবের স্ত্রীরত্নটি নিয়ে চিরদিন কম দুর্ভোগ তো ভুগতে হচ্ছে না।
কর্নেল গোপনে দেবতোষের দিকে কটাক্ষ করলেন। অর্থাৎ চলুন।
দুজনে বেরিয়ে গেলেন। সামনের ঘর থেকে দীপেন বোসকেও বেরোতে দেখা গেল। হাতে টর্চ নিয়েছে। চীনা আর ইরা বেরোল তার পিছনে। ওরা স্বাতীর ঘরে গিয়ে ঢুকল। দীপেন বোস লম্বা বারান্দার এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে বলল, অন্তত একজন পুরুষ মানুষ থাকা উচিত ছিল। আমরা সবাই যাচ্ছি!
দেবতোষ হাত নাড়লেন।……আমার গিন্নিকে চেনেন না। ও সব ম্যানেজ করবে। দীপেন বলল, কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়?
দেবতোষ জবাব দিলেন, কেন? ডোবার ধারে। পদ্যটা ভুলে গেছেন?
দেবতোষ দেখলেন না, কিন্তু কর্নেল দেখনেলন–দীপেন বোস যেন চমকে উঠল। চোয়াল আঁটো দেখাল তার।
দেবতোষের মুখে যেন এতক্ষণে গর্বের ভঙ্গিমা। স্ত্রীর ক্ষমতা জাহির করে একটু আগের ব্যাপারটা ঢাকতে চাইছেন হয়তো। অবশ্য সিঁড়িতে নামবার সময় বলেও ফেললেন, ও একটু গোঁড়া ধরনের সেকেলে মেয়ে। বুঝতেই পারছেন কর্নেল, যাকে বলে…
কর্নেল ফুট কাটলেন।…..যাকে বলে রায়বাঘিনি!
রাইট! দেবতোষ একটু হাসলেন।
দীপেন হঠাৎ বলল, সরি। দরজায় তালা দিয়ে আসিনি যে।
জাস্ট এ মিনিট।
সে চলে গেল ওপরে। এঁরা দুজনে রিসেপশনের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাহাদুর এক বিষণ্ণ মুখে বসে ছিল। উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল। তারপর বলল, আভি থানাসে ফোন আয়া সাব। পুলিশ লোক বোলা, কোই আদমিকো বাহার যানে না দো। আভি থানাসে পুলিশ আনা পড়ে গা।
কর্নেল বললেন, সে কি! আমরা একবার বেরোব বাহাদুর। জরুরি দরকার।
বাহাদুর কুতকুতে চোখে হাসল।…আপলোগ নেহি যানে সকতা সাহাব। মেরা। পর হুকুম হ্যায়।
তেড়েমেড়ে দেবতোষ বললেন, রাখো তোমার হুকুম! আমরা যাচ্ছি। তোমাদের পুলিশকে বলো, যা ইচ্ছে করবে। ইস! মামারবাড়ির আব্দার। মেয়েটা বেঁচে আছে না মরে গেছে, তার পাত্তা নেই এদিকে!
বাহাদুর দমল না। একগাল হাসল সে। মাফ কিজিয়ে। হামলাককা পর এইসা হুকুম হ্যায়।
দু-পা তেড়ে গেলেন দেবতোষ।…তুমি কি পুলিশ, না পুলিশের কর্তা। চুপসে বৈঠা রহে। হামলোক যাতা হ্যায়। আসুন কর্নেল!
কর্নেল দাঁতে ঠোঁট কামড়ে কী ভাবছিলেন। মুখ তুলে বললেন, বরং আমরা একটু দেরি করি প্রফেসর। মিছেমিছি হাঙ্গামা করে লাভ নেই। পুলিশের লোকেরা আসুক। তারপর ওদেরই ব্যাপারটা খুলে বলা যাবে।
অমনি সঙ্গে সঙ্গে দেবতোষ বললেন, রাইট, রাইট। আর কী শীত পড়েছে প্রচণ্ড দেখছেন? তার ওপর আমরা একেবারে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ। বিপদের ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়!
সিঁড়ির মাথায় দীপেনকে দেখা গেল। কর্নেল সেদিকে পা বাড়িয়ে বললেন, হল না মিঃ বোস। পুলিশ নাকি দারোয়ানকে কড়া হুকুম দিয়েছে, আমরা কেউ যেন বাইরে না যেতে পারি! ও, আচ্ছা! বলে দীপেন বোস অদৃশ্য হল।
এঁরা দুজনে আস্তে আস্তে উঠে গেলেন ওপরে। দীপেন বোসকে আর দেখতে পেলেন না। দেবতোষ ফিসফিস করে বললেন, আজকালকার এই ইয়ংম্যানগুলো বড্ড স্বার্থপর কিন্তু! দেখলেন মিঃ বোসের কাণ্ড? ও সঙ্গে থাকলে জোর ফাইট দেওয়া যেত বাহাদুরের সঙ্গে।
কর্নেল জবাব দিলেন না। তিনি কিন্তু অন্য কথা ভাবছিলেন। দীপেন বোসের কী হয়েছে? মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন? আর ডোবার ধারে যাবার প্রস্তাবে সে হঠাৎ চমকে উঠেছিল কেন?
স্বাতীর ঘরে টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল। খুলল চীনা। দেবতোষ ভিতরে ঢুকে বললেন, পুলিশ আমাদের যেতে দিচ্ছে না বাইরে। সুদেষ্ণা, তাহলে তুমি ওঁদের কাছেই থাকো। আমি কর্নেলের সঙ্গে কোথাও গিয়ে বসি।
সুদেষ্ণা ঝাঁজাল কণ্ঠস্বরে বলল, এরই মধ্যে পুলিশ এসে পড়েছে? নাকি ভয়ে। কাপুনি ধরে গেছে বুড়ো হাড়ে? ধিক্ তোমাকে!
দেবতোষ কিছু বলার আগেই কর্নেল বললেন, না মিসেস ব্যানার্জি, উনি ঠিকই বলছেন। আসুন প্রফেসর, আমরা বরং মিঃ বোসের ঘরে যাই।
সুদেষ্ণা তেড়ে এল।…কী কাণ্ড দেখ। ওরা স্বামী-স্ত্রী শাতের মধ্যে এখন আরাম করে শোবে–তা নয়, ওদের জ্বালাতন করতে যাবে।
ঘরের ভিতর চোখ বুলিয়ে দেখা গেল। ইরা নেই। কর্নেল দেবতোষ দুজনেই অবাক। মুখ তাকাতাকি করছিলেন পরস্পর। চীনা বলল, আপনারা যাবার পরই মিঃ বোস এসে ওকে ডেকে নিয়ে গেলেন! আমরা ওঁর আচরণে বড্ড অবাক হয়েছি। মিসেস ব্যানার্জিও হতভম্ব।
স্ট্রেঞ্জ! বলে কর্নেল পা বাড়ালেন। তাহলে ঘরে চাবি দেবার ছল করে গিয়ে। বউকে ডেকে নিয়েছিল দীপেন বোস। হ্যাঁ, তাই ওর নামতে দেরি হচ্ছিল তখন। ব্যাপারটা অদ্ভুত।…..পরক্ষণে কর্নেলের মনে হল, ভদ্রলোক ব্যবসায়ী। সম্ভবত ঘরে দামি কিছু আছে। তাই শেষ অবধি স্ত্রীকে ডাকতে বাধ্য হয়েছেন।
পিছনে সুদেষ্ণার কণ্ঠস্বর শোনা গেল।…তুমি আবার কোথায় যাচ্ছ? এখানে থাকো।
দেবতোষ বললেন, কেন? তুমি তো রইলে।
তর্ক করো না। সুদেষ্ণা ধমকাল।…এবাব বাপু আমার গা কাঁপছে। এইমাত্র একটা কাণ্ড হয়ে গেছে। উঃ, মাগো!
কর্নেল পর্দা তুলতে গিয়ে থমকে উৎকর্ণ দাঁড়ালেন। দেবতোষ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন, কী কী?
তোমরা তো ঘর থেকে বেরোলে। তারপর বোসবাবু এসে ওর বউকে ডেকে নিয়ে গেল। সুদেষ্ণা কাঁপানো গলায় জানাল।……তারপর তোমরা গেলে নাকি দেখবার জন্যে জানালার ধারে গিয়ে যেই দাঁড়িয়েছি…হঠাৎ থেমে গেল সুদেষ্ণা।
কর্নেল দেখলেন চীনা মুখ টিপে হাসবার চেষ্টা করছে। অবশ্য বড় ম্লান হাসি।
দেবতোষ অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, কী, কী দেখলে?
বিড়বিড় করে সম্ভবত গুরুমন্ত্র জপছে সুদেষ্ণা। উধ্বনেত্র যুক্তকর।
চীনার দিকে সপ্রশ্ন তাকালেন দেবতোষ। চীনা বলল, কই! বলেননি তো কিছু। তবে জানলা থেকে ওকে তাড়াতাড়ি সরে আসতে দেখেছি। কিছু দেখে হয়তো ভয় পেয়েছেন!
কর্নেল মন্তব্য করলেন, অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর কত কী দেখা সম্ভব। যাক্ গে। প্রফেসর, আপনি এখানে বসুন। আমি বরং নিচে বাহাদুরের কাছে যাই। পুলিশের লোকেরা হয়তো এসে পড়ল।
ধ্যানস্তব্ধ সুদেষ্ণার পাশে চেয়ার টেনে বসলেন দেবতোষ। গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেন, ওগো শুনছ?
.
স্বাতী শুয়ে আছে। চীনা তার মাথার কাছে গিয়ে বসল। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। কর্নেল বেরোলেন। ক-পা এগোলেন বারান্দায়। সেই সময় স্বাতীর ঘরের দরজা বন্ধ হবার শব্দ শোনা গেল। লম্বা প্রশস্ত বারান্দার দু-প্রান্তে দুটো আলো জ্বলছে। আলো উজ্জ্বল। হয়তো সে কারণেই শূন্যতা আর স্তব্ধতা এত অস্বাভাবিক। লাগছে। সিঁড়ির দিকে না এগিয়ে উল্টো দিকে অর্থাৎ চীনা মিত্রের ঘরের দিকে আস্তে আস্তে হাঁটছিলেন কর্নেল। ডাইনে দীপেন বোসের ঘর, বাঁয়ে স্বাতীদের। তারপর বাঁদিকে পড়ে বিভাসের ঘর, ডাইনে বড় বড় দুটো থাম–নিচে লন, তার ওদিকে ফুল-বাগিচা আর সুইমিং পুল। থামের সংলগ্ন সুদৃশ্য রেলিংয়ে ভর করে দক্ষিণের খোলা-মেলায় তাকালেন কর্নেল। প্রকাণ্ড দেউড়ির ওপর আলো জ্বলছে দূরে–বাকিটা প্রায় অন্ধকার। দক্ষিণের প্রাইভট রোডটা গাছের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। পূর্ব-দক্ষিণ অংশে গাছপালার ভিতর নিজামত কেল্লার কয়েকটা আলোর ঝিকিমিকি নজরে পড়ছে। ঘড়ি দেখলেন কর্নেল। পুরো দশটা। নির্জন ঠান্ডা রাতের দৃশ্যে স্নায়ুগুলো শুধু ভয়ের স্বাদেই আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। অজ্ঞাত ভয়ে বারবার গা শিউরে উঠতে থাকল তার। না, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সাহসী পুরুষ। ফ্রন্টে গিয়ে লড়াই করার অভিজ্ঞতা আছে। কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি পড়েছেন। কিন্তু সে-সাহস এ-সব ক্ষেত্রে বড় অকেজো মনে হচ্ছে। এ ভয় অলৌকিকের প্রতি ভয়। এবং এ ভয় মুরশিদাবাদের মতো ঐতিহাসিক পোড়ো রাজধানী কিংবা ভূতের শহরে রাত না কাটালে টের পাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কী, এর স্বাদ পেতেই বারবার তিনি এখানে। ছুটে আসেন। কেন এমন অনুভূতি তাঁর স্নায়ুকে আক্রমণ করে এখানে, তা তিনি বুঝতে পারেন না। ভারতবর্ষের প্রখ্যাত বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ তিনি দেখেছেন। কিন্তু এখানে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার বিলক্ষণ পার্থক্য আছে। এখানের রাতগুলো একেকটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা আনে। মনে হয়, জীবন আর মৃত্যুর এমন আশ্চর্য স্বার্থ আর কোথাও চোখে পড়েনি কোনোদিন। এ একটা অপরূপ মিথুন–জীবন আর মৃত্যুর, মৃত্যু আর জীবনের। এ শহরের প্রতিটি মানুষের মুখে এক গভীর ধূসরতার ছাপ। প্রতিটি বস্তুর ওপর সেই স্তিমিত পাণ্ডুর রং। সবখানে শুধু ছায়া, ওই গঙ্গার জলে প্রতিফলিত শহরের ঘর-বাড়ির মতো ছায়া। এ এক ধারাবাহিক ছায়া পড়ার ইতিহাস।……
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে এলেন কর্নেল। পরক্ষণে মাথায় এক মতলব খেলে গেল। দেবতোষের টর্চটা তার হাতে রয়েছে। চীনা মিত্রর ঘরের পাশে, বিভাসের ঘরের পিছনেই একটা ঘুরন্ত সরু লোহার সিঁড়ি আছে। কর্নেল পা টিপে টিপে এগোলেন।
সিঁড়ির মুখে দরজাটা খুলতে গিয়ে অবাক হলেন। খিল খোলা রয়েছে! কে খুলল? হয়তো কেউ খুলেছিল দিনের দিকে–আর আটকায়নি। আস্তে আস্তে দরজাটা ফাঁক করে কর্নেল নামতে থাকলেন। খুব সাবধানে ঘুরে ঘুরে নিচে নেমে গেলেন এক সময়।
তারপর গাছপালার শীর্ষে ভাঙা চাঁদটা দেখতে পেলেন মুহূর্তে অস্ফুট উচ্চারিত হল-স্ট্রেঞ্জ, এ ভেরি স্ট্রেঞ্জ পোয়েম!
মধ্যরাত্রে বনের মাথায় উঠলে চাঁদ
ডোবার ধারে পাতব হরিণ ধরার ফাঁদ।।
হ্যাঁ, চীনা মিত্রর ছবিটাও নাকি এ রকম ছিল। তাই চীনা তখন বিড় বিড় করছিল, ছবিটা ডোবার ধারে…..মধ্যরাত…..কৃষ্ণপক্ষ….চাঁদ….
এবং কর্নেল এমনটি অনুমান করছিলেন। সকাল হোক, তারপর মোতিঝিলের সেই মসজিদে যাওয়া যাবে। কবিতাটা পরীক্ষা করতে হবে। দেয়ালে এ অদ্ভুত কবিতা কে লিখেছিল? কর্নেল সাবধানে আগাছার ভিতর টর্চ জ্বালালেন। কাঁটা ঝোপ নেই, সেই এক রক্ষে। টর্চ বার বার জ্বালবার দরকার হবে না।
পোড়ো বাগানটা কর্নেলের মোটামুটি পরিচিত। কিছু দূর হাঁটবার পরই পেয়ে গেলেন ভাঙা গম্বুজ ঘরটা। তার নিচেই ডোবা। সিঁড়ি আছে। পিছন ঘুরে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখলেন এক ফালি সামান্য জ্যোৎস্না পড়েছে। টর্চ জ্বালাবার মুহূর্তে তার মনে হল, এইমাত্র কে যেন সাঁৎ করে সরে গেল গাছের আড়ালে। যেন শুকনো পাতায় পায়ের শব্দও শোনা গেল। ফের নীরবতা। কর্নেল সরকার পকেট থেকে এবার ক্ষুদে পিস্তলটা বের করে ডোবার পাড়ে উঠলেন। টর্চের আলো পড়তে থাকল চারপাশে। তারপরই একটা অদ্ভুত মূর্তির উদয় হল। খোঁচা-খোঁচা দাড়ি-গোঁফ, ছেঁড়া পাঞ্জাবি পাজামা। দাঁত মেলে বলল, এসেছেন স্যার?
.
০৯.
অধ্যাপক দম্পতির ওপর রাগে ফেটে পড়ছিল চীনা। কর্নেল চলে যাবার আধঘণ্টা পরেই হঠাৎ যেন ধ্যান ভাঙে সুদেষ্ণার।…..সর্বনাশ! আমার গুরুদেবের ছবি! তাড়াহুড়ো বেরিয়ে আসবার সময় এক্কেবারে ভুলে গেছি। ওগো, ওঠ, ওঠ। শিগগির চলো!….বলে অধ্যাপককে চাবির গোছ এগিয়ে দিয়ে ওরা চলে যায়। চীনা উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। স্বাতী মুখ তুলে ব্যাপারটা দেখেছে মাত্র। কোনো মন্তব্য করেনি।
ঘড়ি দেখল চীনা। এগারোটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি আছে। এখনও দিব্যেন্দুরা ফিরল না। সে বলল, নিচে গিয়ে একবার জাফরাগঞ্জ ফাঁড়িতে ফোন করলে হত। এত দেরি হচ্ছে কেন ওদের?
স্বাতী কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে ততক্ষণে। সে বলল, আপনি যান না নিচে। আমি থাকতে পারব।
চীনা দাঁতে ঠোঁট কামড়াল। একটুখানি ভাবল যেন। তারপর মাথা দুলিয়ে বলল, থাক গে।
কেন?
চীনা হাসবার চেষ্টা করে বলল, আমার ভয় করছে।
সেই সময় বাইরে কোথায় গাড়ির গর্জন শোনা গেল। দুজনে পরস্পর তাকাতাকি করল কয়েক মুহূর্ত। তারপর স্বাতী বলল, পুলিশ এল হয়তো। চলুন চীনাদি, আমরা নিচে যাই। বোধ হয় দিব্যেন্দুরাও এসে গেছে ওদের সঙ্গে।
দুজনে উঠে এসে দরজা খুলতেই জুতোর শব্দ শোনা যাচ্ছিল সিঁড়ির দিকে। দুজন কনস্টেবল এগিয়ে আসছিল। চীনাকে দেখে তাদের একজন বলল, আপনারা বেরোবেন না। ঘরে থাকুন। চীনা বলল, আমাদের লোকেরা কোথায়?
কনস্টেবলটি মাথা দোলাল।…বলতে পারছিনে। আমরা থানা থেকে আসছি। ওনারা হয়তো এখনও ফাঁড়িতে আছেন।
ওরা দুজনে থামের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। সিগ্রেট বের করে জ্বালল। চীনা আর স্বাতী দরজা বন্ধ করে দিল ফের। স্বাতী একবার বলল, আপনার দরজায় তালা দিয়েছিলেন তো?
চীনা একটু হেসে বলল, দিয়েছি মনে পড়ছে। ডাইনিং হলে যাবার সময়…হ্যাঁ, দিয়েছি।
দুজনে বিছানায় বসল। স্বাতী বলল, ঘুম পেলে শুয়ে পড়ুন বরং। ওই বিছানাটাতেও শুতে পারেন।
চীনার চোখদুটো লাল। হাই উঠছিল বারবার। সে কল্পনার বিছানায় চলে গেল। বলল, আপনিও ঘুমোন। ওরা এলে ডাকবে।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর স্বাতী উঠে টেবিলল্যাম্পটা জ্বেলে দিল এবং হাত বাড়িয়ে সিলিঙের উজ্জ্বল আলোটা নিবিয়ে দিল। হাল্কা নীলধূসর আবছায়ায় ঘরটা রহস্যময় হয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে।
কতক্ষণ পরে চীনা ডাকল, ঘুমোলেন?
স্বাতী ঘুমোয়নি। জবাব দিল, না।
একটা ব্যাপার আমার অদ্ভুত লাগছে কিন্তু।
কী?
জাফরাগঞ্জের আঁধারমহলে ঢুকেছিলেন শুভ নীরেন আর বিভাসবাবু। তারপর নীরেন আর ওই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, শুভ থেকে গেল। ওঁরা ভাবলেন, শুভ আগে বেরিয়ে চলে গেছে। এদিকে শুভকে পরে দেখা গেল মার্ডার হয়ে পড়ে রয়েছে। আমার অদ্ভুত লাগছে ঘটনাটা। সারা বিকেল গেল, সন্ধ্যা গেল, শুভ ফিরল না–অথচ নীরেনবাবুরা…..
স্বাতী সক্রোধে বলে উঠল, নীরেন চেপে যাচ্ছে আসলে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস চীনাদি, ও ছাড়া কেউ শুভকে খুন করেনি। ও গোঁয়ার যত, তত ধুরন্ধর। ওকে আমি চিনি।
চীনা বলল, কী চেনেন?
স্বাতী চাপা গলায় বলল, এক সময় নীরেনকে পুলিশ খুঁজত। কোথায় কী করেছিল নাকি। ওর এক বন্ধুর কাছে শুনেছি নীরেন রাজনীতি করে-টরে। আই মিন, সে রাজনীতি নয়–রীতিমতো বোমা ছোঁড়া স্ট্যাবিং গুন্ডাবাজি।
চীনা একটু চুপ করে থেকে বলল, হতে পারে। কিন্তু শুভকে সে কেন খুন করবে? সেইটেই অদ্ভুত লাগছে।
স্বাতী দৃঢ়কণ্ঠে বলল, করবে। কল্পনার জন্যে।
কল্পনার জন্যে মানে?
একটু ইতস্তত করে স্বাতী বলল, কল্পনা এত বয়ে গেছে জানতাম না। এখানে আসার পর হঠাৎ যেন পাগলের মতো যাচ্ছেতাই কাণ্ড শুরু করল। দিব্যেন্দুর সঙ্গে মাখামাখি দেখে ওকে বকছিলাম। অথচ দিব্যেন্দু বলল, নীরেনের সঙ্গেও নাকি খুব গলাগলি করেছে কখন। তারপর শেষে শুভর সঙ্গে শুরু করেছে। কাল রাত্রে শুভ আর কল্পনা হোটেল ছেড়ে বাইরে কোথায় ছিল। ফিরল রাত আড়াইটে তখন। এবার বুঝতে পারছেন?
চীনা বলল, হয়তো তাই। কিন্তু কল্পনা…
স্বাতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কল্পনাকেও খুন করেছে।
ফের কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর চীনা বলল, কী কুক্ষণে যে ছবিটা আঁকতে গেলাম। আমার বুক কাঁপছে।
ছবির সঙ্গে এর কী সম্পর্কে? স্বাতী প্রশ্ন করল।
চীনা বলল, প্রথমে ধরুন, মোতিঝিল মসজিদের দেয়ালে সেই দুলাইন কবিতা। মধ্যরাতে বনের মাথায় উঠলে চাঁদ, ডোবার ধারে পাতব হরিণ ধরার ফঁদ।…..তারিখ লেখা ছিল নিচে ৮.২.৭০ তার মানে গত কালকের তারিখ। শুভই কবিতাটা দেখেছিল। তারপর ওইদিন রাত্রে সে হোটেলের বাইরে ছিল অনেকটা সময়। কল্পনাও ছিল না। আমার মনে হচ্ছে কী জানেন?
স্বাতী কনুই ভর করে মাথাটা তুলল।……কী?
কিছু একটা আবিষ্কার করেছিল শুভ। হয়তো কল্পনাকেও বলেছিল সেটা। কিংবা হয়তো কল্পনাই কিছু টের পেয়েছিল। এবং শুভকে বলেছিল। তারপর ওরা কাল রাত্রে ডোবার ধারেই গিয়েছিল-না, আপনি যা ভেবেছেন তা নয়, সম্ভবত অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল ওদের যাওয়ার পিছনে।
তাহলে আমাদের বলল না কেন? বলাই স্বাভাবিক ছিল।
বলেনি–হয়তো নিছক তামাশার ব্যাপার ভেবেছিলে। হয়তো…
স্বাতী ফেস করে উঠল।…..আই কানটু আন্ডারস্ট্যান্ড ইত্তর হয়তো।
চীনা ফিসফিস করে বলল, আই সাসপেক্ট বিভাসবাবু। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেই খুন করেছে শুভকে। তাছাড়া কল্পনাকেও…..গড হেলপ আস্…বলে সে থেমে গেল হঠাৎ।
স্বাতী উঠে বসল বিছানায়।…..বিভাসবাবুর সঙ্গে কীসের শত্রুতা ছিল শুভর?
চীনা চুপ করে রইল।
বলুন?
চীনা তবুচুপ।
চীনাদি?
উঁ?
বিভাসবাবু কেন শুভকে খুন করবেন?
চীনা দুহাতে মুখ ঢেকে হঠাৎ পাশ ফিরল। স্বাতী দৌড়ে এল তার কাছে। সে রীতিমতো অবাক। পিঠ করে ডাকতে থাকল, চীনাদি, এই চীনাদি! আরে, কী হল বলবেন তো?
চীনা ঘুরল এবার। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।
তারপর আস্তে আস্তে বলল, কথাটা কাকেও বলবেন না তো?
না, না। বিলিভ মি। আপনার গা ছুঁয়ে বলছি।
বিভাসবাবু নীরেনের চেয়েও সাংঘাতিক লোক। আমি ওকে চিনি। একটা জুয়াড়ি। মদ আর মেয়েমানুষ ছাড়া জীবনে আর কিছু বোঝে না।
সে কি! আপনি চেনেন নাকি ওকে?
হ্যাঁ, চিনি।
বলেননি তো এতদিন! স্বাতী ফুঁসে উঠল।…অ্যাদ্দিন আমরা অমন একটা স্কাউন্ট্রেলের সঙ্গে মিশেছি–তার কিছু না জেনে! আশ্চর্য! আপনার সাবধান করা উচিত ছিল।
চীনা একটু ইতস্তত করে বলল, বলিনি। তার কারণ, তাতে আপনারা আমায় ভুল বুঝতেন।
কেন? ভুল বোঝবার কী আছে?
আছে। বলে হঠাৎ চীনা মিত্র হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাঁপতে থাকল।…জানেন? একসময় ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। বছর দুই আগে আমাদের ডিভোর্স চুকে গেছে। আমি একটুও ভাবিনি যে এখানে আমার এত কাছে ও এসে বসে রয়েছে। উঃ, আই আই কুড নট হেলপ ইট……আনএকসপেকটেড!
স্বাতী স্তম্ভিত হয়ে গেছে। বলল, বুঝলাম। তাই আপনারা পরস্পরকে এড়িয়ে চলতেন দেখেছি। কিন্তু চীনাদি, উনি কেন শুভকে খুন করবেন?
সেইটেই বুঝতে পারছি না। কিন্তু…চীনা বিড়বিড় করে বলল…কিন্তু আমার ক্রমাগত সন্দেহ হচ্ছে, আঁধারমহলে ও শুভদের সঙ্গে ছিল। ওর মতো লোকের অসাধ্য কিছু নেই। শুধু বুঝতে পারছি না, মোটিভটা কী!….আচ্ছা স্বাতী, শুভর অনেক খবর তো আপনি জানেন, শুভর কি জুয়াখেলায় নেশা ছিল জানেন?
স্বাতী মাথা দোলাল।……কই, শুনিনি তো!
চীনা কী বলতে যাচ্ছিল, দরজায় করাঘাতের শব্দ হল।……ওই ওরা এল বুঝি! বলে সে শশব্যস্তে গিয়ে দরজা খুলে দিল। তার পিছনে স্বাতীও ছুটে গেছে।
দরজা খুলতেই দিব্যেন্দুকে দেখা গেল। তার পিছনে একজন পুলিশ অফিসার। দিব্যেন্দুকে গাছের গুঁড়ির মতো খসখসে আর পাংশু দেখাচ্ছিল। সে নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে স্বাতীর বিছানায় গিয়ে ধুপ করে বসল। পুলিশ অফিসার ঘরের ভিতরটা উঁকি মেরে দেখলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে। আপনারা রাতের মতো নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন। সকাল আটটা-নটার মধ্যে আপনাদের একটু বিরক্ত করব। আর দেখুন, এই সময়ের মধ্যে প্লিজ হোটেল ছেড়ে কেউ বাইরে যাবার চেষ্টা করবেন না।
স্বাতী কতকটা কঁকিয়ে উঠল, কল্পনার খোঁজ পেয়েছেন আপনারা?
না। তবে আমরা চেষ্টা করছি। থ্যাঙ্কু, চলি!….
পুলিশ অফিসার চলে গেলে স্বাতী দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর কপাটে পিঠ রেখে সোজা দাঁড়াল। শান্ত অথচ ভিজে গলায় প্রশ্ন করল, শুভকে দেখলে?
দিব্যেন্দু মাথা দোলাল। খুব পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে তাকে। যেন কথা বলবার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে।
চীনা বলল, কীসে খুন হয়েছে? ওর ডেডবডিটা এখন কোথায়?
আর নীরেনবাবুরা?
দিব্যেন্দু হাতের ইশারায় জলের গ্লাস দেখাল। চীনা পাশের টেবিলে রাখা জলের কুঁজো থেকে গ্লাসে জল ঢেলে আনল। ঢকঢক করে জলটা খেয়ে গ্লাস চীনার হাতে দিল সে। চীনা গ্লাসটা হাতে রেখেই ফের প্রশ্ন করল, বলুন–কী সব দেখলেন?
বলছি।……দিব্যেন্দু স্বাতীকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বলল। স্বাতী এল না। দিব্যেন্দু মাথার চুলে একবার হাত বুলিয়ে নিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে বলতে থাকল, আমরা প্রথমে গেলাম ফাঁড়িতে। সেখান থেকে পুলিশ আমাদের সেই আঁধারমহলে নিয়ে গেল। সিঁড়ি নীয়ে নিচে নামলাম। টর্চলাইটের আলোয় আমরা এগোচ্ছিলাম। সে সাংঘাতিক অন্ধকার কল্পনা করতে পারবেন না। ওপরে মস্ত উঠোন। আর শেষপ্রান্তে মসজিদ আছে, নিচে তিন সারিতে মোট পনেরোটা ঘুপসি ঘর। একটু লম্বা হলে ছাদে মাথা ঠেকে যেত। প্রতিটি ঘরে একটা। করে কবর। যাক্ গে, এঁকেবেঁকে এদরজা ওদরজা পেরিয়ে একটা ঘরে পৌঁছলাম। আলোর ছটা আসছিল একটু আগে থেকে। গিয়ে দেখি, একটা হ্যাঁসাগ জ্বলছে মেঝেয়। আর কবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে রয়েছে শুভ।
দিব্যেন্দু হঠাৎ চুপ করলে চীনা বলল, তারপর?
লাশটা প্রথমে দেখতে পায় আঁধার-মহলের দারোয়ান–ঠিক দারোয়ান নয়, যাকে বলে সেবায়েত। তার কাজ হল, সন্ধ্যায় প্রতিটি ঘরে একটা করে মোমবাতি জ্বেলে দেওয়া। কড়ে আঙুলের সাইজ মোমবাতি।….. দিব্যেন্দু সাইজটা আঙুলের সাহায্যে দেখাল। ফের বলতে থাকল, কাজেই আলো খুব স্পষ্ট ছিল না। সেবায়েত লোকটি কবরের ওপর শুভকে দেখে চমকে ওঠে। প্রথমে ভেবেছিল, কোনো ট্যুরিস্টবাবু মাতাল হয়ে এখানে পড়ে রয়েছে। এমন ঘটনা আকছার ঘটে নাকি এখানে। যাই হোক, সে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দেয়। সঙ্গে সঙ্গে তার সন্দেহ হয়। আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করার পর সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়ে কাছের ফাঁড়িতে খবর দেয়। সকাল দশটায় যে তিনটি ট্যুরিস্টবাবু ভিতরে ঢুকেছিল, এ তাদেরই একজন। লোকটা ঠিক চিনতে পেরেছিল। তারপর পুলিশ আসে। পুলিশের ব্যাপার তো বুঝতেই পারছেন, খোঁজখবর নিতে নিতেই রাত নটা বেজে গিয়েছিল। সদর থানা থেকে অফিসার আসবার পর প্যালেস হোটেলে ওরা ফোন করে।
চীনা বলল, কী ভাবে খুন হয়েছে দেখলেন?
দিব্যেন্দু বলল, সকালে আরেক দফা সরজমিন তদন্ত করবে–তারপর মর্গে পাঠাবে। তখন জানা যাবে। তবে আপাতত যা মনে হল, গলা টিপে মারা হয়েছে ওকে। ওঁরাও তাই বলছেন। কারণ শুভর চোখ দুটো আর জিভ বেরিয়ে খুব ভয়ঙ্কর লাগছে। টর্চের আলোয় ওর গলায় আঙুলের দাগ অনুমান করা যাচ্ছিল। ওঃ, অমানুষিক! আমার বমি আসছিল দেখে।
চীনা বলল, নীরেনবাবুরা কোথায়?
দিব্যেন্দু মুখ নামাল।……ওদের দুজনকে সদর থানায় নিয়ে গেছে। জিজ্ঞেসপত্তর করবে।
এতক্ষণে স্বাতী এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। বলল, তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেনি?
করেছিল।…..দিব্যেন্দু একবার স্বাতীর দিকে তাকিয়েই ফের মুখ নামাল।…আমি এখানে আসার পর যা সব ঘটেছে বা জেনেছি সবই বলেছি পুলিশকে। সম্ভবত সেইজন্য ওরা হোটেলের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। সবাইকে জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করবে নিশ্চয়। আমার সঙ্গে আসামাত্র ওরা শুভর বিছানা জিনিসপত্র পরীক্ষা করেছে। দরজায় তালা এঁটে দিয়েছে। আমি বলেছি, পাশের ঘরে শোব। আমার এক আত্মীয়া ওঘরে আছেন।
চীনা পাংশুমুখে বলল, তাহলে তো যা ভেবেছিলাম, তাই হল!
স্বাতী তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকাল তার দিকে..কী ভেবেছিলেন চীনাদি?
চীনা মাথাটা সামান্য দোলাল।…তেমন কিছু না! এই–মানে-স্ক্যান্ডালগুলো ছড়িয়ে পড়বে। আমরা সবাই সাসপেক্ট হয়ে যাব। এবং…
স্বাতী একটু ঝুঁকল। এবং?
পুলিশের ব্যাপার।……চীনা বিমর্ষকণ্ঠে বলল। খুব শিগগির এখান থেকে নড়তে দেবে না ওরা। এদিকে, খুব বেশি ফান্ডও আমার নেই। খরচ জোগাবে কে?
স্বাতী নির্ভীক স্বরে বলল, সে দেখা যাবে। ভাববেন না। আর–পুলিশ যদি আমাদের আটকে রাখে, সে খরচ ওরা জোগাবে। আমার যত দায় শুধু কল্পনার জন্যে। ও পাত্তা পেলেই আমি নিশ্চিন্ত। জ্যান্ত হোক বা মড়া হোক, আই ওয়ান্ট হার।
দিব্যেন্দু আর চীনা দুজনেই বিস্মিত-দৃষ্টে তার দিকে তাকাল।…..
.
পেড়ো আমবাগান থেকে কর্নেল যখন ফিরে আসছেন, তখন কেল্লাবাড়ির প্রধান ফটকে দুবার ঘণ্টা বাজল। দূর থেকে প্যালেস হোটেলের একটা ঘরে আলো দেখা যাচ্ছিল। তার উত্তরের জানালাটা খোলা। আলো লক্ষ করে এগিয়ে আসছিলেন তিনি। মনে মনে হাসছিলেন, একটু আগের ঘটনাটি ভারি কৌতুককর। ওই অদ্ভুত লোকটি যে মুহূর্তে টের পেয়েছিল যে ইনি তিনি নন, সঙ্গে সঙ্গে আচমকা ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মতো পা-ঝাড়া দিয়ে বনবাদাড় ভেঙে দৌড়াল। হরি! এ দৃশ্যের কোনো তুলনা নেই।
কিন্তু ওখানে কোথাও তো কল্পনাকে আবিষ্কার করা গেল না। হোটেলের পেছনে দিকে এসে এবার সতর্ক হলেন কর্নেল। সম্ভবত দিব্যেন্দুরা পুলিশকে আগাগোড়া সব বলেছে। এবং পুলিশও যথারীতি এই বাগান আর হোটেলের চৌহদ্দি ঘিরে ফেলেছে। যা বোঝা গেল, রাত্রিবেলা ওরা তদন্তে নামছে না। সকাল হলেই খোঁজাখুঁজি শুরু করবে। কাটায় ছিঁড়ে যাবার দাখিল প্যান্টকোট, টুপিটা ঝোঁপের মাথায় আটকে যেতে চায়–তা সত্ত্বেও টর্চ না জ্বেলে অতিকষ্টে কর্নেল এগোচ্ছিলেন। পিছনের খিড়কিতে ঘুরন্ত সরু পাহারা দিচ্ছে না তো?
এ একটা সমস্যা। তবে ওরা বারান্দায় থাকলে সোজাসুজি খিড়কি দরজাটা নজরে পড়বে না ওদের। বরং সিঁড়ি থেকে পা বাড়িয়ে কার্নিশে উঠতে চীনা মিত্রর জানালায় পৌঁছনো যাবে। বিদেশি কায়দার গরাদবিহীন জানালা। খড়খড়ি আছে। সামান্য ফাঁক করে হাত গলালেই ছিটকিনি ভোলা যাবে। অবশ্য আরেক প্রস্থ কাঁচের বাধা থাকলে সমস্যা আছে। কাঁচের পাল্লা ছিল কি? আজ সকালে চীনা মিত্রর ঘরে অনেক সময় ধরে আড্ডা দিয়েছেন। তখন ঘরটার সবকিছু লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু কাঁচের পাল্লা?-কিছু মনে পড়ছে না তো।
তার ওপর এই প্রচণ্ড-শীত। বয়সও হয়েছে। সে জোর আর গায়ে নেই। তবে কর্নেল তাঁর জীবনে বহু দুঃসাহসিক কাণ্ড করেছেন। নার্ভ একটুও বেঠিক হবার কথা নয়। আস্তে খুবই সন্তর্পণে তিনি পা বাড়ালেন বাঁদিকে। কার্নিশ স্পর্শ করতেই সিঁড়ির রেলিং ধরে প্রায় শূন্যে ভেসে উঠলেন।
খড়খড়িওয়ালা কাঠের জানালাটা খুলে গেল। কী সর্বনাশ! কাঁচের পাল্লা যে! নাঃ, ভাগ্য ভালো। পাল্লাটা ভাঙা। বাইরে থেকে কবে কেউ ঢিল ছুঁড়ে ভেঙে ফেলেছে খানিকটা। হাত গলিয়ে ছিটকিনি খুললেন কর্নেল। তারপর প্রায় নিঃশব্দে ঘরের ভেতর গলিয়ে দিলেন। মাত্র চার ফুট নিচে মেঝে। কোনো আঘাতই লাগল না।
ভিতরে জিনিসপত্র বেশি কিছু নেই মনে হচ্ছে। সাবধানে টর্চ জ্বালতেই অগোছালো ছবি, ছবির কাগজ, ইজেল, অজস্র তুলি, রঙের টিউব, কতকিছু নজরে পড়ল। বিছানার ওপর আগাগোড়া কম্বল ঢাকা দিয়ে কে শুয়ে আছে দেখেই কর্নেল চমকে উঠলেন। সে কী! তাহলে চীনা স্বাতীকে ফেলে চলে এসেছে কখন?
আসবার কথা। বার্ধক্যে বুদ্ধিভ্রম ছাড়া কী! পুরো দুটো ঘণ্টা কর্নেল বাইরে ছিলেন। এর মধ্যে দিব্যেন্দুরা থানা থেকে ফিরে আসতেই পারে। কাজেই চীনাও নিজের ঘরে এসে ঘুমোতে পারে। ইস, কী বোকামিই না হয়ে গেল! চীনা সম্ভবত ক্লান্ত হয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। বেচারার শিল্পী নার্ভে কতখানি সইবে? জেগে থাকলে এক্ষুনি বিদঘুটে কাণ্ড শুরু হত। কর্নেল এক অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে যেতেন।
এবং এখনও যে কোনো মুহূর্তে চীনা জেগে উঠলে তেমনি সম্ভাবনা রয়েছে। থাক্ ওকে জাগিয়ে কাজ নেই। দরজা নিঃশব্দে বেরোলে যদি পুলিশের সামনে পড়েন, একটা কৈফিয়ৎ দেওয়া কঠিন হবে না। তিনি হোটেলের ভিতরে ছিলেন, এটা তো প্রমাণ করা যাবে।
দরজার কাছে আসতেই দ্বিতীয়বার চমকালেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। দরজা যে বাইরে থেকে বন্ধ!
মুহূর্তে বুকের ভিতর একঝলক রক্ত নেচে উঠল। হৃদপিণ্ড একবার কেঁপে উঠল। তারপর দ্রুত বিছানার দিকে এগিয়ে কম্বলটা একটানে তুলে ফেললেন।
কল্পনা শুয়ে রয়েছে। মুখটা পাশে ঘোরানো। নাকে ঠোকের পাশে জমাট কিছু রক্ত। হিম শরীর। আর তার বুকের ওপর সম্ভবত চীনা মিত্রর সেই হারানো ছবিটা!
কর্নেল কয়েক মুহূর্তে স্তম্ভিত–তারপর জানালার দিকে এগোলেন। পালাতে হবে এক্ষুনি। তা না হলে……।
কিন্তু সে সুযোগ নেবার আগেই আচমকা দরজা খুলে গেল। সুইচ টেপার শব্দ ও আলো জ্বলল। চীনা মিত্র দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়িয়েই কাঠ। অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল সে, কর্নেল!……পরক্ষণে বিছানার দিকে তাকিয়ে সে রুদ্ধশ্বাসে বলল, কল্পনা!
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ঠোঁটে আঙুল রেখে তার দিকে এগোলেন।
.
১০.
ফের সূর্য উঠেছে নিজামতকেল্লার শীর্ষদেশে। গাছগাছালির পাতায় কুয়াশার মলিনতা দূর করছে বিচ্ছুরিত রৌদ্ররশ্মি–তাকে নিঃসন্দেহে, বিশেষত এই অমল সকালে অলৌকিক সমার্জনী বলে ভ্রম হতে পারে। সারাটি রাতের আবর্জনা জড়ো করে যেন আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাই প্রতিটি সকালকে মনে হয়েছে এতদিন, একেকটি শুচিতার আয়োজন।
আজ অনুভূতি অন্য রকম। সূর্য উঠেছে। তবু যেন অশুচিতা থেকে গেল আজ। আলোর সকাল এল। তবু যেন অনেকখানি অন্ধকার থেকে গেল।
শুধু থেকে যাওয়া নয়,স্পষ্টতার পরিবর্তে আরও অস্পষ্টতা, আরও কিছু অন্ধকার, কিছু অশুচিতা জেগে উঠল। প্যালেস হোটেলের মুখে তার ছাপ পড়েছে। কোনো মুখে হাসি নেই। চপলতা নেই। প্রতিটি মুখে সন্দেহ অবিশ্বাস ও সতর্কতা। প্রত্যেকে প্রত্যেকের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে। কারো একা থাকতে ইচ্ছে করে না। অথচ সন্দেহ অবিশ্বাস ত্রাস–সুতরাং এসবের ফলাফল-স্বরূপ ঘৃণা ওদের একত্র থাকতে দিচ্ছে না।
এক্ষণে সারা হোটেল ঘিরে পুলিশের বেড়াজাল। ওখানে জাফরাগঞ্জের আঁধার মহলেও কড়া পাহারা। হোটেলের উত্তরে জঙ্গুলে বাগানের ভিতর ভাঙা মসজিদ আর ডোবাটাও ঘিরে রেখেছে ওরা। ঘিরে রেখেছে মোতিঝিলের পাশের জঙ্গলে সেই গম্বুজঘরটাও।
সবাই টের পেয়েছে, এত তৎপরতার মূলে আছেন কর্নেল এন সরকার। পুলিশ সুপার বর্মনের নাকি পিতৃবন্ধু উনি। বহরমপুরে ট্রাঙ্ককল করেছিলেন শোনা যাচ্ছে। স্পেশাল তদন্ত স্কোয়াড আর দুদে ডিটেকটিভ অফিসারেরা এসে গেছেন এক ঘণ্টার মধ্যে। আরও গুজব, কলকাতা থেকেও বিকেলের গাড়িতে বিশেষজ্ঞরা আসছেন। শহরের সবখানে ফিসফিস, কানাকানি, গুজব আর সতর্কতা। সদর-গেটের বাইরে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন অজস্র লোক। এ শহরে এমন ঘটনার নজির নেই। বৈচিত্র্যহীন শহরবাসীদের জীবনে এ একটা আশ্চর্য থ্রিল।
নিচের তলায় ডাইনিং হলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে রয়েছে সবাই। এটা পুলিশেরই আদেশ। দিব্যেন্দু আর স্বাতী, দীপেন বোস আর ইরা, অধ্যাপক আর সুদেষ্ণা জোড়া-জোড়া আলাদা টেবিলে বসেছে। চীনা একা একটা টেবিলে। কিছুক্ষণ আগে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে বিভাস আর নীরেনকে আনা হয়েছে। তারা একত্র পৃথক টেবিলে বসেছে। সবাই চুপচাপ। চিন্তিত। উদ্বিগ্ন। মনের দিক থেকে সবাই আশ্চর্য নিঃসঙ্গতা বোধ করছে।
সুরঞ্জনের ঘরের পাশে যে-ঘরটায় দারোয়ান থাকে, সেটা আসলে অতিথিদের ওয়েটিং রুম। তেমনি সাজানো গোছানো। কিন্তু কাজে লাগে না বলে একটা খাঁটিয়া পেতে বাহাদুর সেখানে রাত্রিযাপন করে। আজ খাঁটিয়াটা বের করতে হয়েছে তাকে। ওঘরে পুলিশ অফিসাররা বসেছেন। কর্নেলও আছেন তাদের সঙ্গে। ওখানে বসেই সবাইকে একে একে ডাকা হবে। জিজ্ঞেসপত্তর করা হবে।
সুরঞ্জন উদ্বিগ্ন মুখে রিসেপশনে বসে রয়েছে। বাবুর্চিখানায় তোরাপ হোসেন বাবুর্চি, গঙ্গারাম ঠাকুর (অর্থাৎ সংস্কৃতি-সমন্বয়ের অপূর্ব দৃষ্টান্ত!) রতন, শম্ভু আর মানদা গম্ভীরমুখে বসে আছে। ব্রেকফাস্ট পরিবেশন শেষ। নিত্য বরাদ্দ থাকে চারটে মাটন কিংবা ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ, জোড়া ডিমের মামলেট, আর পট চা কিংবা কফি। আজ চা-কফি ছাড়া কেউ ছোঁয়নি কিছু। না–কেবল নীরেনই বরাদ্দটা বর্জন। করেনি। সে ম্লান হেসে অস্ফুটকণ্ঠে বিভাসকে বলেছে, ভীষণ খিদে পেয়েছে–ডোন্ট মাইন্ড। বিভাস মাথা দুলিয়েছে মাত্র। ওদিকে সুদেষ্ণার তো এ ম্লেচ্ছতা অসহনীয় প্রত্যুষকালীন অভ্যাসমতো কিছু গঙ্গাজল পান করেই ক্ষান্ত রয়েছে। এখন তার মূর্তিটি ধ্যানস্তব্ধ। কিন্তু নাকের ডগা কুঞ্চিত। চোখ দুটি বোজা।
ওয়েটিং রুমের টেবিলে দুটো ম্যাপ। ডিটেকটিভ অফিসার সত্যজিৎ গুপ্ত, স্থানীয় পুলিশ অফিসার অপরেশ ভদ্র আর কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তিনদিন থেকে ঝুঁকে রয়েছেন ম্যাপের ওপর। মিঃ গুপ্ত বলছিলেন, প্রথমে এই ম্যাপটা দেখুন। জাফরাগঞ্জের আঁধার মহলের ম্যাপ।…..(৯০ পাতায়)
…স্বভাবত আমাদের যা মনে হবে বা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য যা পাচ্ছি, তাতে এটা স্পষ্ট যে বিভাস কিংবা নীরেন ছাড়া এ কাজ অন্য কারও হতে পারে না। সিঁড়ির নিচেই অর্থাৎ সামনের ঘরে প্রথমে ওরা তিনজন ঢুকেছিল। তারপর নীরেন ঢোকে বাঁদিকের দরজা দিয়ে, বিভাস ঢোকে ডাইনের দরজায়। আর শুভও ঢোকে বাঁদিকেরটায়। নীরেন বা বিভাস কেউ একজ্যাক্ট টাইম বলতে পারেনি–বলেছে আধ ঘণ্টা বা তার কিছু বেশি হতে পারে, তারা ভিতরে ঘুরেছে–অন্ধকারে ঘুপটি ঘর আর কবরে-কবরে ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্য কী? তার জবাবও আমরা পেয়েছি। ওরা নাকি বেরোনোর পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। সেটা অবশ্য খুব অস্বাভাবিক নয়। খাদিম অর্থাৎ সেবায়েত মহবুব খাঁ বলেছে, বাবুরা ঠিক সকাল দশটায় ভিতরে ঢোকেন। তারপর সে রাস্তার ওপারের একটা দোকানে মোমবাতি কিনতে যায়। সেখানে কয়েক মিনিট দেরি হয়েছিল। তারপর সে যায় আবগারিতে–দোকান থেকে জাস্ট পাঁচ মিনিটের পথ। সেখানে সে গাঁজা কেনে। তারপর যায় মখদুমপিরের আস্তানায়–ধরে নিচ্ছি দু মিনিটের পথ আবগারি থেকে। আস্তানার দরবেশের কাছে বসে অভ্যাসগত গাঁজা খাওয়া আর আড্ডা দেওয়ার সময়টাই সে সঠিক বলতে পারছে না। আমরা ধরে নিচ্ছি, পনেরো মিনিট–কিংবা কুড়ি মিনিট–তার বেশি কখনো নয়। কারণ, অতক্ষণ বাইরে থাকলে তার প্রতিপদে চাকরি হারানোর ভয় রয়েছে। সব সময় ট্যুরিস্ট আসছে–বিশেষত শীতের সময় এটা। কাজেই সম্ভবত আধ ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ। তখন কবরের ওপরতলায়–তার মানে মসজিদের প্রাঙ্গণে দেখতে পায় বেঁটেবাবু অর্থাৎ নীরেনকে। নীরেন সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে নেমে আসে তার কাছে। অন্যবাবুদের কথা জিজ্ঞেস করে। তার আন্দাজ এক মিনিট পরেই নিচে বাঁদিকের দরজা থেকে বিভাস বেরোয়। এখানে লক্ষ করুন ম্যাপটা। নীরেন নিচের তলা থেকে ওপর তলায় উঠেছিল যে সিঁড়ি বেয়ে–সেটা রয়েছে শেষ প্রান্তে। সেই ঘরেই শুভর লাশ পাওয়া গেছে। অথচ নীরেন নাকি কিস্যু দেখেনি। এটা হতে পারে না। মহবুব খাঁ বলেছে, দুজনের চেহারা বেশ পেরেশান (ক্লান্ত) দেখাচ্ছিল। মহবুবের মতে, এটা স্বাভাবিক। ভিতরে গেলে অতিবড় সাহসী আদমিও দুবলা হয়ে ওঠে সে বহুবার দেখেছে। যাই হোক, মিনিট পাঁচেক নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওরা শুভর অপেক্ষা করে। সিগ্রেট খায়। দুটো সিগ্রেটের টুকরোও আমরা পেয়েছি। দুটোই কিন্তু আধপোড়া অবস্থায় থামে ঘষে নিভানো-থামের গায়ে চিহ্ন রয়েছে। তারপর দুজনে পাশের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে যায়। শুভর নাম ধরে জোরে ডাকে। সাড়া পায় না। নেমে আসে দুজনে। সেই সময় কিন্তু দুজনে ভীষণ হাসাহাসি করছিল। মহবুব দেখেছে। ওরা হাসতে হাসতে খাদিমকে বখশিশ দিয়ে চলে যায়। সে-হাসির কারণ আমরা ওদের মুখে শুনেছি। ওরা ভেবেছিল, শুভ কৌশলে কেটে পড়েছে। সোজা কল্পনার কাছে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। হোটেলে ফিরে আসে ওরা জাস্ট একটায়। সেখানে কল্পনা শুভ নেই দেখে ওরা নাকি সন্দেহটা খাঁটি ধরে নেয়। এদিকে মহবুব আর শুভর সম্পর্কে মাথাব্যথা করেনি। কারণ ম্যাপটা লক্ষ করুন। নিচের তলায় শেষ প্রান্তে মাঝের ঘরটার একটা দরজা আছে সেটা প্রায় ভাঙা। ওখান দিয়ে বেরোলে গঙ্গার ধার। তাছাড়া মহবুব খাঁ অতক্ষণ ওখানে ছিল না। শুভ চলে গেলেও সে দেখতে পায়নি। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, তখন সে রীতিমতো গাঁজার নেশায় টইটুম্বুর। বারান্দার টুলে বসে অভ্যাসমতো ঝিমোতে শুরু করেছে।
সবাই হেসে উঠল। কর্নেল একটা চুরুট ধরালেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ বলুন।
মিঃ গুপ্তও একটা সিগ্রেট জ্বাললেন। এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে ধোঁয়ার কয়েকটা রিং তৈরি করার পর বললেন……তাহলে আমরা দেখছি, সাধারণ বিচারে বা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে ওয়ান অফ দেম ইজ দি মার্ডারার। দুজনেরই অ্যালিবাই অবশ্য খুবই স্বাভাবিক। তা হোক। খুনের মোডাস অপারেন্ডি, কিন্তু আমাদের ধারণার বিপক্ষে যায় না। দুর্বল রোগা একটি যুবককে নীরেন বা বিভাসের মতো শক্তসমর্থ যুবক অতি সহজেই গলা টিপে মারতে পারে। বাট মোটিভ? যে কোনো হোমিসাইডাল ইনসিডেন্টের পিছনেই যে নিশ্চিত মোটিভ থাকতে হবে, আমি অবশ্য তা বলছি না। ধরুন, মা ছেলেকে শাসন করতে গিয়ে চড় মারলেন, ছেলে বেঘোরে। মরে গেল। প্রেমিকা প্রেমিকাকে প্রেমাতিশয্যে এমন ঠেসে ধরল যে শ্বাসরোধ হয়ে প্রেমিক মারা পড়ল। এমন সব ক্ষেত্রে আমরা একে নিতান্ত অ্যাকসিডেন্ট বলতে পারি। অবশ্য চতুর খুনিরা এমন সুযোগ না নেয়, এমন নয়। যা গে। আমাদের প্রথমে দেখতে হবে, কোনো হোমিসাইডাল ইনসিডেন্ট আসলে ডেলিবারেট মার্ডার বা খুনের উদ্দেশ্যেই খুন কিনা! ভারতীয় দণ্ডবিধির তিনশো দুই ধারার কথাই বলছি আমি। শুভর মৃত্যু যে ডেলিবারেট মার্ডার, সেটা নিশ্চিত। বরং তা আরও নিশ্চিত হয়েছে আরেকটি মার্ডারের ঘটনায়–দ্যাট ইজ, দা পুওর গার্ল কল্পনা! ফের এবার। মোটিভের প্রশ্নে আসছি। এ সব মার্ডারে মোটিভ একটা থাকতেই হবে। রাইট?
কর্নেল অনুচ্চস্বরে বললেন, হুম্! মিঃ ভদ্র শুধু মাথা দোলালেন।…এক্ষেত্রে শুভর সম্ভাব্য খুনি যদি বিভাস কিংবা নীরেন হয়, অথবা তারা দুজনই একাজ করে থাকে, কল্পনাকেও তাদের একজন অথবা দুজনে একসঙ্গে খুন করেছে। কিন্তু কেন? অস্পষ্ট হলেও একটা মোটিভ আমরা টের পাচ্ছি। এখানে ওরা আসবার পর আগের দুদিন ও দুরাত্রির ঘটনা খুঁটিনাটি আমরা দিব্যেন্দুর কাছে শুনেছি-নীরেন-বিভাসও তা বলেছে। ওদের তিনজনের বর্ণনায় কোনো অসঙ্গতি নেই। এর একটা প্রসঙ্গে ধরুন। শুভ আর কল্পনা আগের রাত্রে হোটেলের বাইরে বেশ কিছুকাল সবার অজানতে কাটিয়েছিল। বিভাস বলেছে, ওরা পোড়ো বাগানে গিয়েছিল। বিভাস নেমে গিয়ে আর শুভকে দেখতে পায়নি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে টর্চ জ্বলেছিল কোথায় এবং কল্পনা আচমকা অন্ধকারে তার গায়ে এসে পড়েছিল। তারপর দুজনে হাসতে হাসতে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে হোটেলে ফেরে। কল্পনা নাকি বলেছিল, সে শুভকে হোটেলের জানালা দিয়ে দেখতে পেয়েছিল। তখন সে ভিতু শুভকে ভয় পাইয়ে দিতে নিচে নেমে যায়। বিভাস পরে সকালবেলা শুভকে ঘরে ডেকে কথাটা বলে। শুভ হেসে বলে, কল্পনাটা দারুণ সাহসী। কিন্তু শুভ কী করছিল ওখানে? শুভ বলে, একটা কবিতা লিখতে চেয়েছিল সে-অন্ধকার তার বিষয়। তাই সরেজমিনে গিয়ে নাকি অন্ধকারের রূপ দেখছিল। হরিবল্। যাক্ গে। এসব অজুহাত কারো বিশ্বাস্য নয়। ওদের প্রতি সবার সন্দেহ পড়ার কথা। এখন দেখা যাক, এতে কার ঈর্ষা হবে বেশি? পূর্বাপর যা শুনেছি, তাতে বোঝা যায়, এখানে আসবার পর পর কল্পনা বেহিসেবি মেলামেশা শুরু করেছিল। রীতিমতো ফ্লার্টিং। বিভাস মোতিঝিলের বটতলায় দিব্যেন্দু আর কল্পনাকে চুমু খেতে দেখেছে। স্বাতী তাতে ক্রুদ্ধ হয়েছিল। বিভাস এবং নীরেনের মতে স্বাতী দিব্যেন্দুকে ভালোবাসে। কাজেই কল্পনা শুভর সঙ্গে রাত্রিবেলা অভিসারে বেরোলে প্রথমে রাগ হবে দিব্যেন্দুর। কিন্তু দিব্যেন্দু আঁধারমহলে ছিল না। তাকে সবদিক বিবেচনা করেই বাদ দিচ্ছি। দ্বিতীয়জন খুঁজে দেখা যাক। কল্পনার নাকি দূর সম্পর্কের দিদি স্বাতী এবং স্বভাবত সে কল্পনার গারজেন। ব্যাকগ্রাউন্ড না জানলেও আমরা বেশ বুঝতে পারি, স্বাতীরও রাগ হতে পারে–যদিও এতে তার খুশি হবার কথা; কারণ তার প্রেমিককে ছেড়ে অন্যত্র ঝুঁকেছে কল্পনা। কিন্তু স্বাতীর পায়ে ব্যথা–সে আঁধারমহলেও যায়নি। এবার আসে নীরেনের প্রসঙ্গ। বিভাস বলেছে, প্রথমদিকে নীরেনের সঙ্গেও কল্পনা ঢলাঢলি করেছে। ম্যানেজার সুরঞ্জন আমাদের কাল রাত্রে বলেছে, গতকাল ভোরবেলা সুইমিং পুলের ওদিকে শুভ আর কল্পনা পরস্পরকে টানাটানি করছিল এবং নীরেন ওপরে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। আই সাসপেক্ট নীরেন।……
গম্ভীর মুখে থেকে গেলেন মিঃ গুপ্ত।
কর্নেল নিঃশব্দে চুরুট টানছেন। মিঃ ভদ্র শুধু বললেন, অ্যান্ড বিভাস?
সে কথায় কান না দিয়ে মিঃ গুপ্ত বললেন, অ্যান্ড নাও দি মার্ডার অফ কল্পনা। সকালে স্বাতীর ঘরে দরজা বন্ধ করে নাকি স্বাতী কল্পনা আর দিব্যেন্দু ঝগড়া করছিল। বিভাস-নীরেন দুজনেই বলেছে সে কথা। তারপর বিভাস-নীরেন আর শুভ এক সঙ্গে ডাইনিং হলে চা খেয়ে বেরোয়। আঁধারমহলে যায়। বাট হোয়াই আঁধারমহল? কে প্রথমে ওখানে যাবার কথা তোলে? বিভাস বলেছে, নীরেনই তুলেছিল কথাটা। নীরেন সম্ভবত প্রশ্নের গুরুত্ব না বুঝেই আমাদের বলেছে, হ্যাঁ, আমিই বলেছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল।……তাহলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হচ্ছে। সে ডেলিবারেটলি ওখানে গিয়ে ডেলিবারেটলি শুভকে খুন করেছে। আর দুজনেই বলেছে, এমনকী মহবুব খাও বলেছে প্রথমে নীরেনই নিষেধ অগ্রাহ্য করে ভিতরে ঢুকে যায়!
মিঃ ভদ্র বললেন, কিন্তু কল্পনাকে খুন করবে সে কীভাবে? টাইমফ্যাকটর তো আছেই–আছে প্লেসফ্যাকটর।
মিঃ গুপুত বললেন, নাথিং। হোটেলে থেকে আঁধারমহলের দূরত্ব হাফ কিলোমিটার। অবস্থান হল নর্থে। এখন উত্তর থেকে দক্ষিণে বাতাস বইছে। ফিরে আসতে মাত্র দুটো মিনিট সাইকেল-রিকশোর পক্ষে যথেষ্ট। সেখানে যাবার সময় সাইকেল-রিকশোর পক্ষে ধরুন চারগুণ কী পাঁচগুণ সময় লাগুক। দ্যাট ইজ ফিফটিট টু টোয়েন্টি মিনিটস। সময় আরও কম লাগবে, যদি সে হোটেলের লাগোয়া এই জঙ্গুলে বাগানের শেষ অর্থাৎ উত্তর সীমায় নামে। বুঝতে পারছি, তাই নেমেছিল সে। তা না হলে হোটেলের কেউ না কেউ তাকে দেখতে পেত। এবার একটা সঙ্গত প্রশ্ন ওঠে। তার এখানে আসার উদ্দেশ্য কী ছিল? কল্পনাকে একা না পেলে তো খুন করা যায় না। তা ছাড়া পিছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠলেও কারো চোখে পড়া সম্ভব। তা পড়েনি যখন, তখন ধরে নিচ্ছি, হোটেল অবধি সে আসেনি। ওই বাগানের ভিতরই কাজ শেষ করেছিল।
লাফিয়ে উঠলেন মিঃ ভদ্র।……কল্পনাকে ওখানে সে পেল কেমন করে? আর লাসটা চীনা মিত্রর ঘরের বিছানায় এল কীভাবে?
মিঃ গুপ্ত একটু হাসলেন।……কল্পনাকে ওখানে পাওয়া নিছক কো-ইনসিডেন্ট হতে পারত। তা হয়নি। কল্পনা তখন ওখানে কোথাও ছিল। এমন জায়গায় ছিল, যা নীরেনের জানা। এবারে মনে করুন সেই কবিতাটার কথা। মধ্যরাতে গাছের মাথায় উঠলে চাঁদ, ডোবার ধারে পাতব হরিণ ধরার ফাঁদ।…ডোবা ইজ দি ভাইটাল পয়েন্ট অব দি কেস।
কর্নেল এসময় তীক্ষ্ণদৃষ্টে মিঃ গুপ্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়েস!
সোৎসাহে গুপ্ত বললেন, নীরেন চেপে যাচ্ছে! কল্পনাকে সে কোনো ছলে ওই ডোবার ধারে উপস্থিত থাকতে বলেছিল। ওই কবিতাটার রহস্য আর কিছু নয়। এখনও হাতের লেখা শনাক্ত করা হয়নি। হলে আমরা অবশ্যই জানব–ও লেখা নীরেনেরই। আমার ধারণা, নীরেনের প্রথম লক্ষ্য ছিল কল্পনা। কারণ, সেও দিব্যেন্দুর সঙ্গে তার ফ্লাটিং–এমনকী চুমু-খাওয়ার ব্যাপারটা দেখেছিল। সে স্বীকার করছে। একথা। আমার অনুমান, কল্পনার মতো কৌতূহলী বোকা মেয়েকে নির্জনে ডাকবার ওই একটা ছল নীরেনের। গতকাল সকালে নীরেন কোনো এক সুযোগে কল্পনাকে ওখানে যেতে বলেছিল-ধরুন, কোনো মজার জিনিস দেখানোর অজুহাতে। দিব্যেন্দুর কাছে জেনেছি, কল্পনার মধ্যে হীনমন্যতা ছিল প্রচুর। ইনপ্যান্টাইল ব্যাপারও ছিল বিস্তর। ফোটো তুলতে চাইত না। তাছাড়া আরও অনেক প্রবণতার কথা আমরা শুনেছি তার মুখে। কাজেই কল্পনা ডোবার ধারে কথামতো গিয়েছিল এবং নীরেনের পাল্লায় পড়েছিল।
মিঃ ভদ্র বললেন, এটা নিতান্ত অনুমান।
নো। নেভার। মিঃ গুপ্ত ঝুঁকে এলেন ফের।……সুরঞ্জন বয় শম্ভু বলেছে, সে কাল সকালে তিন বাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর কল্পনাকে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেছে। তারপর সে জঙ্গলের ভিতর তাকে যেতেও দেখেছে।
কর্নেল সোজা হলেন। বললেন, দ্যাটস রাইট। আমিও দেখেছি।
হ্যাঁ। মিঃ গুপ্ত বললেন।…..তারপর যা ঘটেছে, তা স্পষ্ট। কাজ শেষ করে নীরেন আঁধারমহলে ফিরে যায়।
মিঃ ভদ্র কাঁচুমাচু মুখে বললেন, কিন্তু স্যার-লাসটা চীনা মিত্রর ঘরে এল কীভাবে?
মিঃ গুপ্ত একটু হেসে একটা ম্যাপ ধরলেন সামনে।…..এটা হোটেলের ম্যাপ। লেট আস চেক। (৯৬ পাতায়)
……কল্পনার লাস ডোবার ধারে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, তার প্রমাণও নিশ্চয় পাব আমরা। ভাঙা মসজিদের সিঁড়ির নিচে সুড়ঙ্গমতো রয়েছে। ভিতরে আগাছা গড়িয়েছে। সেখানেই রাখা সম্ভব। তারপর সন্ধ্যার দিকে চীনা মিত্র ঘর ছেড়ে বেরোয়। ঘরে ফেরে একেবারে রাত দুটোর কিছু পরে। নীরেন ফাড়িতে যাওয়ার আগেই সবার অলক্ষে পিছনের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়। লাসটা এনে চীনা মিত্রের ঘরে রাখে!….হাসতে হাসতে কর্নেলের দিকে কটাক্ষ করলেন মিঃ গুপ্ত।…আমাদের কর্নেল সায়েব যে পদ্ধতিতে ওঘরে ঢুকেছিলেন, ঠিক সেভাবেই ওকাজটা সম্ভব। বিশেষ করে নীরেনের গায়ে জোর আছে প্রচুর। ওর পারসোনাল ব্যাকগ্রাউন্ড শিগগির আমরা কলকাতা থেকে পেয়ে যাব। আমার ধারণা কখনও মিথ্যে হয় না, মিঃ ভদ্র।
কর্নেল বললেন, কিন্তু চীনা মিত্রর ঘরে কেন?
যেন একটু দমে গেলেন মিঃ গুপ্ত। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সম্ভবত চীনা মিত্রর আঁকা ছবিটাই তাকে একাজে প্রলুব্ধ করে। এমন রোমান্টিক টাইপের খুনির কথা আমরা অনেক জানি। রোমান্টিক–কিন্তু বড্ড নির্বিকার এরা। ঠান্ডা মাথায় যেমন খুন করতে এরা পটু, তেমনি রসিকতা করবার লোভও ছাড়ে না। আবার এমনও হতে পারে, নীরেন চীনা মিত্রর কাঁধে দায় চাপাতে চেয়েছিল। বোঝাতে চেয়েছিল–নিছক মডেলের জন্যই চীনা মিত্র একাজ করছে।
মিঃ ভদ্র নড়ে উঠলেন।……কোয়াইট অ্যাবসার্ড!
মিঃ গুপ্ত বললেন, সার্টেনলি নট। আমি একটা কেসের কথা জানি। এক আর্টিস্ট হত্যার দৃশ্য আঁকবার জন্যে আস্ত মানুষ খুন করাত তার সহকারীকে দিয়ে। হত্যাকালীন মার্ডারার আর তার হতভাগ্য শিকারের মুখে-চোখে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠতদ্রুত তুলি চালিয়ে সে তা এঁকে নিত।
মিঃ ভদ্র বললেন, বীভৎস!
বীভৎস। বাট দিস ইজ দি হিউম্যান লাইফ! মিঃ গুপ্ত বললেন।……এসব খুনিরা বড় রহস্যময় বিচিত্র জীব মিঃ ভদ্র।
কর্নেল সরকার মুখ তুলে বললেন, তাহলে ইউ আর কনভিনসড যে নীরেন খুনি? অবশ্যই। এবার শুধু প্রমাণগুলো গোছাতে হবে।
একটা কনস্টেবল হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বলল, স্যার, ডাইনিং হলের জানালা দিয়ে এই চাদরটা এক্ষুনি পড়েছে। রক্ত লেগে আছে স্যার। জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের সমাদ্দার। তার গায়ে পড়েছিল। লোকটাকেও সে দেখেছে।
তিনজনে একসঙ্গে বলে উঠলেন, কে, কে সে?
কনস্টেবলটি বলল, ওই যে বুড়ো মতো ভদ্রলোক–কলেজের মাস্টার না কী যেন।
কর্নেল হো-হো করে হেসে উঠলেন। সত্যজিৎ গুপ্ত হতভম্ব একেবারে।
.
১১.
হাসিটা মুখে নিয়েই ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়ে এলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। জিজ্ঞেসপত্তরের সময় তার উপস্থিতি পুলিশের বাঞ্ছনীয় না হতেও পারে।
এবং সেটা টেরও পেলেন যেন। তাঁকে বেরিয়ে আসতে দেখে ওঁরা কেউ কোনো ভ্রূক্ষেপও তো করলেন না।……ওয়েল। পুলিশ নোজ দেয়ার জবা–মনে মনে একথা ভাবলেন কর্নেল। আরও ভাবলেন গুপ্ত যেভাবে ঘটনাটা সাজিয়েছে, তার বাহাদুরি আছে বলতে হয়। উড়িয়ে দেবার মতো তথ্য তো কিছু নেই। অবশ্য পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আর ফেরেনসিক এক্সপার্টদের রিপোর্ট এখন হাতে নেই। পেলেই বা কী হবে! পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য অনুযায়ী নীরেন খুনি প্রতিপন্ন হয়েছে–কোর্টেও হবে। ওর বাঁচোয়া নেই। তবে হঠাৎ ওই অধ্যাপকের রক্তমাখা চাদর এসে গুপ্তকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দিয়েছে। এ আক্রমণ অভাবিত ছিল। শেষ অবধি সত্যজিৎ গুপ্ত এটা রুখে নিয়ে বলছিল, চাদরের রক্ত যে কল্পনার, সেটা আইনত প্রমাণ করার মতো জোর কোনো ডাক্তারের নেই। অধ্যাপক যদি এটাই সঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেন, তাহলেই আইন খুশি। বিছানার চাদরে রক্ত। তা নিজেদেরই রক্ত হতে পারে। অবশ্য রক্তের গ্রুপ রয়েছে। কিন্তু তা নিয়েও আইনত কোনো ডাইরেক্ট প্রমাণ হয় না। যে খুন হয়েছে। তার রক্ত যদি বি গ্রুপের হয়, যাকে খুনি বলে সন্দেহ করে তার কাপড়ে যে রক্ত পাওয়া গেছে তাও যদি বি গ্রুপের হয়–বড়জোর সেটা হবে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের অন্তর্গত মাত্র। চিকিৎসা-বিদ্যা এক্ষেত্রে নাচার। খুনি অ্যালিবাই দিতে পারে নানারকম। এবং অজস্র মানুষের গায়েও বি গ্রুপের রক্ত রয়েছে। তাছাড়া…..গুপ্ত আরও বলছিল, সম্প্রতি অ্যামেরিকান ফোরেনসিক এক্সপার্টরা আরও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। মানুষের সমজাতীয় প্রাণী-অর্থাৎ গরিলা বানর ইত্যাদি রক্তের সঙ্গে মানুষের রক্তের পার্থক্য টের পাওয়া কঠিন আছে। খুবই নিপুণ বিশ্লেষণের ফলে পুরুষ-নারীর রক্তের পার্থক্য নির্ণয় করাও কিছুটা সম্ভব–কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়; নানা বিষয় বা অবস্থার ওপর নিশ্চিত সিদ্ধান্তটা নির্ভর করছে। কাজেই আইনে এগুলো কোনোটাই ডাইরেক্ট এভিডেন্স নয়। প্রফেসর-ফ্যাক্টর ইজ নাথিং।
তা ঠিক। গুপ্তের মাথা আছে। অভিজ্ঞতা আছে। কর্নেল ভাবলেন।….. কিন্তু তা সত্ত্বেও একটা ধাঁধা থেকে যাচ্ছে তার নিজের মনে। তার একটা হচ্ছে, গত রাত্রে ডোবার ধারে সেই অদ্ভুত লোকটির আবির্ভাব এবং পলায়ন। তার হাতে একটা পুঁটলিমতো ছিল দেখেছেন। কী ছিল ওতে! দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, সেই কবিতাটা। ডোবা ইয়েস……গুপ্ত ঠিক বলেছেন, ডোবা ইজ দি ভাইটাল পয়েন্ট অব দিস কেস। তৃতীয় ব্যাপার: হোটেলে কতকগুলো অদ্ভুত চুরির ঘটনা। স্বাতীর একপাটি জুতো গেল বিভাসের বাথটাবে। কল্পনার টুথব্রাশ কে স্বাতীর ব্যাগে রেখে দিয়েছিল। পরে ছবি চুরির রাত্রে ব্যাগসুদ্ধ সেটা ফের খোওয়া গেছে। তারপর হল মিসেস ব্যানার্জির গুরুদেবের ছবি চুরি। সে ছবিটা পাওয়া গেল তাঁর স্বামীরই ব্যাগে। বিচিত্র সব ব্যাপার।
হঠাৎ কর্নেল চমকে উঠলেন।…মাই গুডনেস! সিঁড়ির মাথায় নাকি একটা কলার খোসা পড়েছিল-সাত তারিখ রাত্রে। স্বাতীর ধারণা, তার পিছন থেকে কে তক্ষুনি ওটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। তার ফলে তার পা স্লিপ করে গড়াতে গড়াতে সিঁড়িতে পড়ে যায়। কী উদ্দেশ্য ছিল এর পেছনে? স্বাতীকে ওই আশ্চর্য কৌশলে কি কেউ খুন করতে চেয়েছিল? খুন বইকি! স্বাতী খুব শক্তসমর্থ খেলোয়াড় মেয়ে–তা না হলে অত উঁচু থেকে গড়িয়ে নিচে পড়লে নির্ঘাৎ তার লাঙস বা হার্টে গুরুতর আঘাত লাগত। এই সেকেলে নবাবি বাড়িগুলোর প্রতিটি তলা দারুণ উঁচু-ইটালিয়ান স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি। দোতলা থেকে একতলায় পড়লে কারও হাড়গোড় আস্ত থাকবে না। কী উদ্দেশ্য এর? প্রণয়ঘটিত ঈর্ষা? কিন্তু তা যদি হয়, তাহলে ডোবা প্রসঙ্গ অবান্তর হয়ে পড়ে।
নাঃ, ডোবা ইজ দি ওনলি কু। ওখানেই সব ধাঁধার সমাধান লুকিয়ে রয়েছে।……
বারান্দার দু-প্রান্তে দুজন করে চারজন সেপাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। কর্নেল নিজের ঘরে গেলেন না। সোজা ডাইনিং হলে ঢুকলেন। দেখলেন অস্বাভাবিক থমথমে পরিবেশ সেখানে। অধ্যাপক মাথা ঝুলিয়ে দিয়ে নিবিষ্ট মনে ধুতির পাড় খুঁটছেন। জানালার পাশেই তার চেয়ার। ভদ্রলোক এখনও হয়তো টের পাননি–তাঁর কীর্তি পুলিশের করায়ত্ত। বেচারা!
থামের পাশে চীনা মিত্র একা। কর্নেল তার কাছেই গেলেন। অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, হ্যাল্লো গার্ল! ডোন্ট মাইন্ড। বসছি।
না, না। বসুন। চীনার উদ্বিগ্ন মুখটা বদলে গেল। প্রশান্ত হাসিতে ভরে উঠল আবার।…কফি বলছি। এক মিনিট।
চীনা উঠে গেল কিচেনের কাউন্টারে। কর্নেল চারপাশটা লক্ষ করছিলেন। বিভাস চাপা গলায় নীরেনকে কী বোঝানোর চেষ্টা করছে। নীরেনের মুখটা কুৎসিত দেখাচ্ছে। চোখদুটো লাল। মাথার চুল বিশৃঙ্খল। ওর চিবুকের সামান্য দাড়ি যেন রাতারাতি কাটার মতো খাড়া হয়ে গেছে; ওপাশে বোস-দম্পতিও বেজায় গম্ভীর। ইরা দীপেনের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। মুখ নিচু করে কী বলছে অনুচ্চকণ্ঠে। দীপেনের দৃষ্টি জানালার বাইরে। স্বাতী আর দিব্যেন্দুও চাপা গলায় কী বলাবলি করছে।
কী দুর্ভাগ্য বেচারাদের। প্রমোদ ভ্রমণে এসে বিপদে পড়ে গেছে।
কর্নেল ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠলেন, আরে, আরে! তুমি নিজে নিয়ে এলে যে! ওরা সব কোথায়?
চীনার হাতে ট্রে। কফির পট। কাপ। মৃদু হাসল সে।..
সামনাসামনি বসে দুজনে কফি খেতে থাকল। কর্নেল বললেন, এবার ওদের ডাক শুরু হবে। দেখা যাক, কার ঝুলি থেকে কী বেরোয়!
চীনা বলল, আপনাকে বলা দরকার–একটু আগে লক্ষ করলাম প্রফেসর কী একটা…
কর্নেল হাত তুলে বাধা দিলেন।…..জানি। একটা রক্তমাখা চাদর ফেলেছেন। সেটা পুলিশের হাতে চলে গেছে।
চীনা চমকে উঠল।…আশ্চর্য! প্রফেসর ব্যানার্জি…..সে নির্বাক হয়ে গেল হঠাৎ।
কর্নেল আরও চাপা গলায় বললেন, কাল রাত্রে ডোবার ধারে যে লোকটি এসেছিল তোমাকে তার কথা আগেই বলেছি। তুমি বলছিলে যে সে প্রফেসরের জন্যেই ওখানে এসেছিল। কেন একথা তোমার মাথায় এসেছিল?
চীনা তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকাল। একটু ঝুঁকে বলল, ওঁর মাথায় পুরাতত্ত্বের বাতিক আছে। সম্ভবত উনি মুর্শিদাবাদের নবাবি মহাফেজখানার কোনো বিশেষ দলিল হাতাতে চান।
কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, রাইট, রাইট।
দুজনেই অবশ্য খুব চাপা গলায় কথা বলছে। কাছের লোকদের পক্ষে তা শোনা বা বোঝা বেশ কঠিন। চীনা বলতে থাকল, আগের রাত্রে কে নিচে মেইন সুইচ অফ করে রেখেছিল। তারপর নাকি বাহাদুর দ্যাখে যে প্রফেসর ব্যানার্জি সুরঞ্জনবাবুর দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি বাহাদুরকে জিজ্ঞেস করেছি সব। বাহাদুরের ধারণা প্রফেসর বাইরে থেকে এসেছিলেন যেন তার মানে ওপরের সিঁড়ি বেয়ে নামেননি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। সেদিন তারিখ ছিল কিন্তু আট ফেব্রুয়ারি। সেই কবিতার নিচে লেখা তারিখ।
ইয়েস, ইয়েস!
যে কোনো কারণেই হোক, সে রাত্রে কার্যসিদ্ধি হয়নি। কাজেই পরের রাত্রে প্রফেসরের ওখানে পৌঁছনোর কথা ছিল। তার মানে গত রাত্রে।
হ্যাঁ, গতরাত্রে তার বদলে আমি গিয়ে হাজির হলাম। কর্নেল একটু হাসলেন।…..এদিকে শুভ খুন হবার সংবাদে প্রফেসর আর সাহস পেলেন না বেরোনোর।
চীনা দৃঢ়কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, উঁহু। আমার ধারণা, উনি বেরিয়েছিলেন। স্বাতীর ঘর থেকে স্ত্রীর সঙ্গে তো বেরিয়ে গেলেন। তারপর উনি কোথায় ছিলেন, আমরা জানি না। নিজের ঘরে ছিলেন কি না–ওঁর স্ত্রী কক্ষনো বলবেন না। স্বামীকে ফাসাতে চাইবেন কেন? যাই হোক বেরিয়ে ডোবার ধারে পৌঁছনোর পর কথামতো লোকটির দেখা পেলেন না। তখন…..
কর্নেল প্রশ্ন করলেন, কল্পনার লাশ এল কোত্থেকে? কে আনল।
বলছি। রক্তমাখা চাদরের সূত্রটা আমার সব ধাঁধার সমাধান করেছে এতক্ষণে। কল্পনা কাল কোনো সময় ওর ঘরে গিয়ে থাকবে কোনো উদ্দেশ্যে। দেবতোষ টের পেয়েছিলেন, শুভ আর কল্পনা কোনোভাবে তার দলিল হাতানোর ষড়যন্ত্রটা জানতে পেরেছে। ওই কবিতাটা শুভর ছাড়া কারো লেখা নয়। অধ্যাপককে নিয়ে এমন তামাশা শুভর মতো সরল বোকা ছেলের পক্ষে খুবই সম্ভব। শুভ যেন এই কবিতাটা রটিয়ে বলতে চেয়েছিল, অধ্যাপক মশাই, সব জানি আমরা! ব্যস, অধ্যাপক ভয় পেয়ে গেলেন। এবার পরপর সাজিয়ে যাচ্ছি ঘটনাটা। দেবতোষ শুভদের প্রায় পিছন-পিছনই বেরিয়ে যান গতকাল। পরে বলছিলেন, রামরামপুর গিয়েছিলেন। ওটা মিথ্যে। চতুর দেবতোষ ওদের ফলো করছিলেন। আঁধারমহল আমি দেখে এসেছি একদিন। প্রচুর জঙ্গল আছে চারপাশে। যে কোনো জায়গায় দাঁড়ালে কে ঢুকছে-বেরোচ্ছে লক্ষ করা যায়। দেবতোষ ওখানে যেভাবে হোক ঢুকে কাজ শেষ করে এই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ফিরে আসেন। খিড়কির সিঁড়ি হচ্ছে বেস্ট পথ। এক মিনিট–স্মরণ করে নিই, তখন কে কোথায় ছিলাম।…হ্যাঁ, আপনি ছিলেন আমার ঘরে। আমরা ছবি নিয়ে আলোচনা করছিলাম। দরজায় পর্দা আছে। বাইরের কিছু দেখা যায় না। ম্যানেজারের নিচে থাকবার কথা। দিব্যেন্দু স্বাতীর ঘরে। বোসবাবুরাও নিজের ঘরে। বারান্দা ফঁকা। কল্পনা……কল্পনাকে নিজের ঘরেই পেয়েছিলেন কারণ বারান্দায় খুন করা সম্ভব নয়। কেউ টের পেয়ে যাবে শুভদের ঘরে তালা দেওয়া ছিল নিশ্চয়–কারণ, ওরা বেরিয়ে গেছে। এদিকে অদ্ভুত চুরির ব্যাপার চলছে–যার ফলে ওরা সতর্ক হবেই। দিব্যেন্দুর কাছে আলাদা চাবি রয়েছে।…..চীনা কফিতে চুমুক দিয়ে ফের বলতে থাকল।……বলবেন, স্ত্রীর সামনে খুন করা কি সম্ভব হল? আমরা জানি, মিসেস ব্যানার্জির ফিটের অসুখ রয়েছে। গুরুদেবের ছবি চুরির ফলে ভয়ঙ্কর শক খেয়েছেন ভদ্রমহিলা। এ ধরনের ধর্মবাতিক যাদের আছে, তাদের স্বভাব আমরা জানি। যাই হোক, কল্পনাকে খুন করে দেবতোষ ওই চাদরে জড়িয়েধরুন, খাটের নিচে ঢুকিয়ে রাখলেন।…জাস্ট এ মিনিট! বলে চীনা কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ফের বলল, আমার ধারণা কল্পনাকে তার ঘরে আসতে বলেছিলেন দেবতোষই। আগে স্ত্রীর কাছে ব্যাপারটা গোপন করবার জন্যেই গুরুদেবের ছবি চুরি করেছিলেন নিজে। তিনি জানতেন, এ কাজ করলে মিসেস ব্যানার্জির ফিটের অসুখ বেড়ে যাবে। উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবেন।……
কর্নেল মৃদু মৃদু হাসছিলেন। এতক্ষণে বললেন, তোমার ছবি চুরি কে করল? কল্পনার টুথব্রাশ? স্বাতীর জুতো? কলার খোসা কে ছুঁড়েছিল স্বাতীর পায়ের সামনে? আর ওই মিসেস বোসের চুলই বা কে কাটল?
চীনা নির্দ্বিধায় জবাব দিল, সব–সবই প্রফেসরের কীর্তি।
বাট হোয়াই?…কর্নেল ঈষৎ ঝুঁকলেন টেবিলে। ফের বললেন, কেন?
চীনার সোজা জবাব।……আমাদের ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আইদার আমরা হোটেল ছেড়ে যাব চটপট, অর শেকি হয়ে পড়ব-সন্ধ্যার পরই যে-যার ঘরে ঢুকে খিল কপাট এঁটে বসে থাকব। চুল কাটার ব্যাপারেই মতলবটা স্পষ্ট হয়েছে। ভূত-প্রেতে নাকি এমনি কাণ্ড করে থাকে। মহিলাদের এমনি করে চুল কাটার ঘটনার সঙ্গে ভূত-প্রেতের কিংবদন্তি ওতপ্রোত জড়ানো। কাজেই নবাবি প্রাসাদের ভূতের ভয়ে আমরা পালাব–এই ছিল ওঁর ধারণা। জায়গাটাও তো বিশেষ করে ঐতিহাসিক–আই সে, ক্ষুধিত পাষাণ!
চীনা হাসল। কর্নেল চোখ বুজে শুনছিলেন। এবার বললেন, কিন্তু আমি কাল সকালে যখন তোমার ঘরে ছিলাম, কল্পনাকে খিড়কির সিঁড়িতে নামতে দেখেছিলাম। তোমাকে বলেছিও সেকথা!
চীনা সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাবাচ্যাকা খেল।…তাইতো! ভুলে গিয়েছিলাম কথাটা।
কর্নেল বললেন, তোমার কল্পনার বাহাদুরি দিচ্ছি চীনা। অযৌক্তিক বলছি না, কিন্তু প্রমাণ-সাপেক্ষ।
চীনা চিন্তিত মুখে বলল, ধরুন, কল্পনা কোনো কারণে নিচের বাগানে গিয়েছিল তারপর ফিরে এসেছিল। এবং প্রফেসরের কথামতো তার ঘরে গিয়েছিল।
দ্যাট ডিপেন্ডস। নো এভিডেন্স। কর্নেল মাথা দোলালেন।…..প্রমাণ কী?
চীনা মিত্রর মুখে অসহায়তার ছাপ। সে বলল, কিন্তু অধ্যাপককে সন্দেহ করার যথেষ্ট যুক্তি আছে কি না! তার মোডুস অপারেন্ডি আমরা জানি না বা ধরতে পারছি না, কিন্তু ওদের দুজনকে খুন করার পিছনে একমাত্র তারই যথেষ্ট মোটিভ রয়েছে। খুব সঙ্গত মোটিভ।
তা আছে। কিন্তু মোটিভ তো নীরেনেরও বেশ সঙ্গত।
কী সেটা?
প্রতিহিংসা চরিতার্থ!
চীনা বলল, আমিও ভেবেছিলাম সেটা। স্বাতীর মুখে শুনেছি, ও হচ্ছে দারুণ মস্তান টাইপ ছেলে। জাস্ট অ্যান ইনটেলেকচুয়াল মস্তান। পুলিশের খাতায় ওর নাম আছে। না করেছে, এমন জঘন্য কাজ নেই।
সর্বনাশ! কর্নেল আঁতকে উঠলেন।…..তাহলে তো পুলিশের সিদ্ধান্ত আরও শক্ত হল। মে গড সেভ দা পুওর বয়!
কিন্তু আমার বিশ্বাস, সে খুন করেনি। ওই ডোবাটিই হচ্ছে আসল রহস্যের উৎস।
কর্নেল তীক্ষ্ণদৃষ্টে ওর দিকে তাকালেন।…আমারও তাই মত।
কাল রাত্রে ডোবার ধারে আপনার ওই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার পরও আপনি নীরেনকে এর সঙ্গে জড়াতে চাইছেন?
না, না। আমি চাইছি না। পুলিশ। আমার ধারণা……
কথা শেষ করার আগেই চীনার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আর বিভাস?
কর্নেলের চোখের কোণে কৌতুকের বিদ্যুৎ খেলল।……গতরাত্রেই তোমাকে বলেছি, আই লাইক ইওর ডিভোর্সড় হাজব্যান্ড-বেচারা বিভাস। সেও তোমার মতো গুণী শিল্পী। আমি জানি, দুই শিল্পীর একঘরে জায়গা হয় না। এক্সকিউজ মি..বলে হেসে ফেললেন কর্নেল। উঠে দাঁড়ালেন এতক্ষণে।……ওরা সব কী ভাবছে হয়তো। আমরা এতক্ষণ ফিসফিস করছি।
চারপাশে তাকিয়ে নিলেন কর্নেল। এখনও ঘরে কারো ডাক পড়েনি। সম্ভবত হোটেল স্টাফ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন গুপ্ত।
না, ডাক এল। একজন কনস্টেবল এসে ডাকল, দিব্যেন্দুবাবু কে–আসুন।
দিব্যেন্দুর মুখটা হঠাৎ কেমন সাদা দেখাল। কর্নেল লক্ষ করলেন। দিব্যেন্দু স্বাতীর দিকে কটাক্ষ করে বেরিয়ে গেল। কর্নেল স্বাতীর টেবিলে গেলেন।…..এক্সকিউজ মি, আপনার সঙ্গে তো ভালো আলাপ হয়নি। দুর্দিনেই বন্ধু চেনা যায়। আমিও একজন বন্ধু আপনাদের–বাট ভেরি…ভেরি ওল্ড ফর মেকিং ফ্রেন্ডশিপ উইথ দা ইয়াং গার্লস।
হাসতে হাসতে বসে পড়লেন কর্নেল। স্বাতী সসঙ্কোচে নড়ে উঠল।……না, না। বসুন কর্নেল। আপনার সঙ্গে আলাপের এত ইচ্ছে করছিল। কিন্তু একে হাঁটুর ব্যথা, তারপর এইসব ভয়ঙ্কর কাণ্ড ….স্বাতীর চোখ ছলছল করে উঠল। চীনাদির কাছে আপনার কত প্রশংসা শুনছিলাম।
কর্নেল চুরুট বের করে ধরালেন। তারপর বললেন, হতভাগ্য মেয়েটির জন্যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে–যদিও পরিচয় হয়নি। জীবনের স্বাদ পাবার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল।
স্বাতী মুখ নামাল। স্পষ্টত, সে কান্না চাপছে।
কর্নেল বললেন, কিন্তু দিস ইজ লাইফ, মাই গার্ল। শক্ত হয়ে দাঁড়ান। ভেঙে পড়লে তো চলবে না মা।
কর্নেলের সম্বোধন শুনে স্বাতী মুখ তুলল। আবেগবিহ্বল কণ্ঠে বলল, আমাকে আপনি তুমি বলবেন।
রাইট। কর্নেল বললেন।…..আচ্ছা, কল্পনা তো তোমার বোন ছিল? কেমন বোন?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে স্বাতী জবাব দিল, সঠিক সম্পর্ক আমি জানি নে। মা জানেন। মার কাছে ও ছিল পেটের মেয়ের চেয়েও বেশি। কল্পনাকে একমুহূর্তও চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। আজই সকালে দিব্যেন্দু ট্রাঙ্ক কল করে খবর দিয়েছে মাকে। মা শয্যাশায়িনী একরকম–তবু খবর শুনেই আসবার জন্য ব্যস্ত হয়েছে নাকি। এসে পড়বে খুব সম্ভব। ভয়ে আমি তো ফোন ধরিনি। আমায় ধরতে বলছিল– দিব্যেন্দু বলল মায়ের মুখোমুখি আর দাঁড়ানোর সাহস আমার নেই। এসে পড়লে কী বলব, ভেবে পাচ্ছি না। কী কৈফিয়ৎ দেব তাকে? তার নিষেধ আমি শুনিনি। কল্পনাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম।…স্বাতী কেঁদে ফেলল।
কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, টেক ইট ইজি মাই গার্ল। তুমি কী করবে? তোমার তো হাত ছিল না এতে।
স্বাতী কম্পিতস্বরে বলল, কিন্তু এমন যে একটা মারাত্মক কিছু ঘটবে, আমি সন্দেহ করেছিলাম। কল্পনা যে নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনছে–আমার ইনটুইশন তা বলছিল।
বল কী? কর্নেল উৎকর্ণ হলেন।
হ্যাঁ। স্বাতী অনুচ্চকণ্ঠে বলতে থাকল। কল্পনা ছিল ভীষণ মুখচোরা মেয়ে। ছেলেবেলা থেকে দেখেছি, ও এত ভিতু আর বোকা ছিল। স্কুল-কলেজ রেজাল্টও খুব ভালো ছিল না। শেষ অবধি মা বলল, থাক, আর পড়াশুনোয় কাজ নেই! ডিগ্রিকোর্সের ফাইনাল ইয়ারেই ওকে কলেজ ছাড়ালেন। মা বলল, কল্পনা তো আর চাকরি করতে যাচ্ছে না। ওর নামে উনি যা দিয়ে গেছেন, তাই যথেষ্ট।
কর্নেল বাধা দিলেন।….এক মিনিট। কল্পনার নামে সম্পত্তি রয়েছে!
হ্যাঁ।
বেশ। বলে যাও।
কল্পনার মধ্যে অনেক ধরনের কমপ্লেক্স ছিল। হীনমন্যতা তো দারুণ ছিল। অথচ সেটা থাকবার কথা আমারই। ওর ওপর আমার যা হিংসে ছিল, বলার নয়। মায়ের যত আদর, যত লক্ষ্য তো ওর ওপর। ফলে আমার ভীষণ দুঃখ হত। মায়ের চোখের আড়ালে ওকে আমি কত নির্যাতন করেছি।…রুমালে চোখ মুছে স্বাতী বলতে থাকল।…ও যেন ছিল আমার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবটা নিজেই মুছে দিলাম মন থেকে। ও কে বন্ধু বলে ভাবতে শিখলাম। শুধু বন্ধু নয়-কতটা গারজেনগিরিও ফলাতে ব্যস্ত হলাম। ওকে পুরো মর্ডান গার্ল হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলাম। ওর বয়ফ্রেন্ড থাক্, এই ইচ্ছে আমায় পেয়ে বসেছিল। শুভর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। নীরেনের সঙ্গেও দিলাম। অবশ্য সবই মায়ের অজান্তে ঘটছিল। কিন্তু দেখলাম, কল্পনা যেন কিস্যু বোঝে না–কিংবা ইচ্ছে করেই ওসব এড়িয়ে থাকছে। এখানে আসবার পর হঠাৎ দেখি, ও কেমন বদলে গেছে। কী যে ঘটল কে জানে, কল্পনা রীতিমতো ফ্লার্টিং আরম্ভ করল সবার সঙ্গে। শেষ অবধি দিব্যেন্দুকেও ছাড়ল না।…
কর্নেল বললেন, বুঝেছি। দি ব্যাকগ্রাউন্ড ইজ ক্লিয়ার। এখন, একটা কথার জবাব দাও। আমি তোমার হিতাকাঙ্ক্ষী। দেবে তো?
বলুন। দেব না কেন?
খুনি বলে কাকে সন্দেহ করো তুমি?
স্বাতী ঝটপট জবাব দিল।……নীরেনকে।
কেন?
ও সব পারে। কল্পনার দিকে ওর বিচ্ছিরি টান ছিল লক্ষ করেছি।
রাইট। বলে কর্নেল উঠলেন।
কনস্টেবল ডাকছিল, দীপেন বোস কে? চলে আসুন।
দীপেন বোস স্ত্রীর দিকে কটাক্ষ করে উঠল। বেরিয়ে গেল। দিব্যেন্দুকে দেখা গেল না ফিরতে। সম্ভবত সবার জেরা শেষ না হলে কাকেও ফিরতে দেবে না। মিঃ গুপ্তর তদন্ত পদ্ধতি বেশ অদ্ভুত। ব্রিলিয়ান্ট!
ভাবতে ভাবতে কর্নেল গেলেন ইরা বোসের সামনে।
ইরা শশব্যস্তে বলল, আসুন কর্নেল। বসুন। কী কাণ্ড হল দেখুন তো! আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। অথচ ওরা যেতে দেবে না!
কর্নেলের চুরুটটা হাত থেকে পড়ে গেল।……বাই জোভ! বলে তিনি হেঁট হয়ে টেবিলের নিচে হাত বাড়ালেন।
ইরা বলল, আচ্ছা কর্নেল সায়েব, আপনি ভূত বিশ্বাস করেন?
অবশ্যই করি।
ইরা ভিতু গলায় বলল, আমার চুল কেটেছিল শুনেছেন?
শুনেছি।
মনে মনে অতি কষ্টে হাসি চাপছিলেন কর্নেল। কারণ, চীনার কথাটা মনে পড়ে গেছে। ইরার মাথার ওই সুদৃশ্য চুলের ঝাপিটি পুরো নকল। ওর মাথাজোড়া টাক।
কিন্তু এইমাত্র চুরুট কুড়োনোর ছলে দীপেন বোসের চেয়ারের নিচে থেকে যে জিনিসটি হাতস্থ করলেন, তা পরক্ষণে তার কৌতুককে বিনষ্ট করল। এক্ষুনি একবার নিজের ঘরে যাওয়া দরকার। জিনিসটা তাকে উত্তেজিত করছিল পলকে পলকে। আশ্চর্য, দীপেন বোস….
.
১২.
দীপেন বোস ঘরে ঢুকে নমস্কার করল। মিঃ গুপ্ত তীক্ষ্ণদৃষ্টে তার পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বললেন, বসুন। আপনার পুরো নাম প্লিজ?
দীপেন্দ্রকুমার বসু।
ঠিকানা বলুন।
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিল দীপেন। ঠোঁটে অনবদ্য হাসি।….. এই যে। এতেই সব পেয়ে যাবেন স্যার।
কার্ডটা পড়ে নিয়ে গুপ্ত বললেন, ব্যবসা করেন? কীসের?
কসমেটিকসের। আমি অবশ্য নিতান্ত সাপ্লাই এজেন্ট।
একটু ভেবে নিলেন সত্যজিৎ গুপ্ত। তারপর বললেন, আপনি একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক। সুতরাং আশা করছি, এ কেসে সব রকম সাহায্য আপনার কাছে পাব।
সোৎসাহে দীপেন বলল, নিশ্চয় স্যার।
আচ্ছা মিঃ বোস, ঠিক কী উদ্দেশ্যে মুরশিদাবাদ এসেছিলেন? বিজনেস না বেড়ানো?
দুই-ই স্যার। আমার স্ত্রী কখনো মুর্শিদাবাদ দ্যাখেনি। তাই ভাবলাম, ওকে সঙ্গে নিয়ে যাই।..হেসে উঠল দীপেন।… রথ দেখা কলা বেচা দুই-ই আর কী!
রাইট। এখানে আসবার পরই কি আপনার সঙ্গে নীরেনবাবুদের পরিচয় হয়? নাকি আগে থেকে ছিল?
না। এখানেই। আমি তো এসেছি সাত ফেব্রুয়ারি…..
সে আমরা জানি। আচ্ছা, বলুন তো মিঃ বোস, এখানে আসবার পর কিছু বিসদৃশ ব্যাপার আপনার চোখে পড়েছে কিনা?
দীপেন ভ্রূ কুঁচকে বলল, বিসদৃশ মানে?
মানে–জাস্ট…লক্ষ করার মতো অদ্ভুত কোনো ঘটনা?
না। তেমন কিছু পড়েনি চোখে। তবে কানে শুনেছি অনেক কিছু।
কী শুনেছেন?
ওই সব ভূতুড়ে কাণ্ড নাকি। টুথব্রাশ চুরি, জুতো হারানো, ছবি চুরি…..হেসে উঠল দীপেন।..শেষে আমার স্ত্রীর মাথার চুলও নাকি কাটল ভূতে!
অন্যগুলো থাক্। এ চুলকাটা সম্পর্কে আপনি কী বলেন?
দীপেন বোসকে একটু অপ্রতিভ দেখাল। সলজ্জকণ্ঠে সে বলল, সত্যি বলতে কী ঘটনাটার গুরুত্ব আমি দিইনি স্যার। ও একটু ভিতু মেয়ে। অন্ধকারে চুল আঁচড়াচ্ছিল–ইলেকট্রিক ফেল করেছে তখন। স্বভাবত চিরুনির টানেই যে দুল উপড়েছে, তা হয়তো অসাবধানে একটু বেশিমাত্রায় জড়িয়ে গেছে আঙুলে। তখন ভয় পেয়ে ঘর থেকে পালিয়েছে। আমি ওকে জানি তো! ও ভীষণ–ভীষণ রোমান্টিক টাইপের মেয়ে। তাছাড়া, ওর চুল কেটে কার কী লাভ হবে আমার মাথায় একটুও ঢুকছেনা!
আচ্ছা মিঃ বোস, আট তারিখে সন্ধ্যায় আপনি বেরিয়েছিলেন। ফিরে আসেন শেষ রাত্রে। কোথায় ছিলেন অতক্ষণ?
শহরেই ছিলাম। এখানে আমার এক মক্কেল কনসার্ন আছে–দীপশ্রী স্টোর্স। যখনই আসি, খুব আড্ডা জমে ওঠে। সে রাত্রে আমার নেমন্তন্ন ছিল ওখানে। আমারও আবার এদিকে একটু নেশা আছে। কাজেই…..
ন তারিখ–অর্থাৎ গতকাল সকাল দশটা থেকে রাত্রি দশটা অবধি কোথায় ছিলেন বা কী করেছেন, বলুন।
কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে দীপেন বলল, ঘরেই ছিলাম মোটামুটি। বিকেলে একবার সস্ত্রীক গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম। হোটেলের সামনের ঘাটে বসেছিলাম। জাস্ট পাঁচটায় হোটেলে ফিরি। খুব শীত করছিল। তারপর আর ওপরে উঠিনি। ডাইনিং হলেই আড্ডা দিচ্ছিলাম।
ওই বারো ঘণ্টার মধ্যে কার-কার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
দীপেন হাসল।…হোটেলের সবার সঙ্গেই বলতে পারেন–কেবল শুভবাবু আর ওই ভদ্রমহিলা বাদে।
ডু ইউ মিন হার কল্পনা?
ইয়েস। ওরা যে বিশেষ উদ্দেশ্যে দুজনে চলে গেছে, একথা জোর রটেছিল হোটেলে। হঠাৎ মিঃ গুপ্ত একটু ঝুঁকে প্রশ্ন করলেন, আট তারিখ রাত্রে দাবা খেলে ফিরেছিলেন কোনো পথে?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দীপেন বলল, কেন স্যার?
দারোয়ান জেগে ছিল। আপনাকে ফিরতে দ্যাখেনি।
দীপেন একটু ইতস্তত করল। তারপর বলল, ওই খিড়কির সিঁড়ি বেয়ে এসেছিলাম।
কেন?
ভেবেছিলাম সদর গেট বন্ধ হয়ে গেছে। তার ওপর হোটেল ভীষণ অন্ধকার। সদ্য কয়েকটা চুরি হয়ে গেছে। এ অবস্থায় সদর গেটে আমায় দারোয়ান দেখলে মেরে বসত। কাজেই……
ঠিক আছে। আপনি আসুন।……না, না, আপাতত ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে বসুন।
দীপেন যেন ক্ষুব্ধ হল একটু। গটগট করে ভিতরের দরজা দিয়ে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকল। মিঃ গুপ্ত বললেন, কী মনে হল মিঃ ভদ্র?
ভদ্রলোক অনেকটা কী সব গোপন করলেন যেন।
আই থিঙ্ক সো। যাক গে। নেস্ট ম্যান, দেবতোষ ব্যানার্জি।
কনস্টেবল বেরিয়ে গেল। একটু পরেই দেবতোষ প্রবেশ করলেন। করজোড়ে নমস্কার করলেন। উজ্জ্বল হাসিখুশি মুখ।…সব রকম কোঅপারেশনই আমি করতে রাজি আছি স্যার। যত খুশি প্রশ্ন আমায় করুন, আপত্তি নেই। যা জানি, পরিষ্কার বলব।
তীক্ষ্ণদৃষ্টে দেবতোষকে লক্ষ করছিলেন সত্যজিৎ গুপ্ত। লাজুক অধ্যাপক সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়েছেন। অভ্যাসমত ধুতির পাড় খুঁটছেন।…আচ্ছা প্রফেসর ব্যনার্জি, আপনি সাধারণত বিছানায় কী চাদর ব্যবহার করেন?
চাদর? মুখটা সাদা হয়ে গেল দেবতোষের। বিড়বিড় করে ফের বললেন, চাদর? হ্যাঁ। বিছানার চাদর।
কেন স্যার?
আগে জবাব দিন। তাঁত, না খদ্দর? নাকি মিলের?
খ-খদ্দর স্যার।
টেক ইট ইজি প্লিজ। হাত তুলে আশ্বস্ত করলেন মিঃ গুপ্ত। আমরা আপনার ঘর পরীক্ষা করেছি ইতিমধ্যে। ইড আর রাইট। খদ্দরের প্রতি আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর আসক্তি আছে।
অবশ্য, অবশ্য। আমার ফাদার ছিলেন সে আমলের প্রখ্যাত বিপ্লবী স্যার। আমি আজীবন খদ্দর পরি, আমার স্ত্রীও পরেন। আমাদের কাপড়-চোপড় বলতে সবই ওই।
হঠাৎ মিঃ গুপ্ত যেন নিজের পেট থেকে একটা শ্যাওলা রং চাদরের কিছু অংশ টেবিলে তুলে বললেন, এ চাদরটা কার আপনি বলতে পারেন?
নড়ে উঠেছিলেন দেবতোষ। মুখ ছাই-ছাই, ঠোঁট দুটো ফাঁক, চোখ ছানাবড়া। ঠোঁট কাঁপছিল। কী যেন বিড়বিড় করছেন ক্রমাগত।
মিঃ গুপ্ত কঠিন স্বরে বললেন, বলুন?
ও যে তাঁ-তাঁত স্যার।
এ চাদর কার আপনি জানেন?
কই, না তো!
কখন দ্যাখেননি এটা?
ম-মনে পড়ছে না স্যার।
অমায়িক হেসে মিঃ গুপ্ত বললেন, কী আশ্চর্য! আপনি অধ্যাপক মানুষ। শুনেছি পুরাতত্ত্বের গবেষণার আপনার খ্যাতি আছে। দেশ-বিদেশের কত প্রাচীন বিষয়ে আপনার পাণ্ডিত্যের তুলনা নেই। আর এ সামান্য চাদরটা কার স্মরণ করতে পারছেন না?
কিয়ৎক্ষণ রুদ্ধশ্বাস বসে রইলেন অধ্যাপক দেবতোষ ব্যানার্জি। ঠোঁট কাঁপছিল। তারপর দৃষ্টিটা নিজের পেটের দিকে রেখে বললেন, ওটা আমার নয়। বিশ্বাস করুন…
বার বার এক কথা পছন্দ করি না মিঃ ব্যানার্জি। ওটা কার?
আমি জানি না। সত্যি জানি না।
এবার মিঃ গুপ্ত মোক্ষম বাণ ছাড়লেন।…..কিন্তু মাত্র কিছুক্ষণ আগে আপনি এটা সবার অলক্ষে ডাইনিং হলের জানালা দিয়ে গড়িয়ে ফেলেছেন।
দেবতোষ নিষ্পলক কয়েক মুহূর্তে তাকিয়ে রইলেন গুপ্তর দিকে। তারপর গলা ঝেড়ে বললেন, চাদরটা আমার ঘরে কে রেখে গিয়েছিল খাটের নিচে। তাই আমি বিপদে পড়বার ভয়ে ওটা ব্যাগে ভরে নিচে নিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর…
দ্যাটস রাইট। মিঃ গুপ্ত সোৎসাহে মাথা দোলালেন। শুধু এটুকুই যথেষ্ট। অসংখ্য ধন্যবাদ প্রফেসর। আশা করি, মাননীয় বিচারকদের সামনে একথাই বলবেন। আচ্ছা, আসুন।
বলব। একশোবার বলব। সত্য ভাষণই আমার একমাত্র উত্তরাধিকার স্যার।……বলে ধুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালেন দেবতোষ। যেন এক্ষুনি পালাতে পারলে বেঁচে যান।
আপাতত ম্যানেজারের ঘরে একটু বসুন আপনি।… নেস্টক ম্যান নীরেন পালিত।
দেবতোষ চলে গেলে মিঃ ভদ্র বললেন, ওঁর কথা আপনি বিশ্বাস করলেন?
মিঃ গুপ্ত ঠোঁট কুঞ্চিত করে জবাব দিলেন, না করার কী আছে?
তাঁতের কোনো ছিঁটেফোঁটাও ওঁর ঘরে দেখিনি আমরা। তাছাড়া এ জোড়াখুনের কোনো সঙ্গত মোটিভ ওঁর দেখছি না।
নীরেন এল। অস্বাভাবিক চেহারা। দুপ করে বসে বিরক্তকণ্ঠে বলল, আবার কী জানতে-টানতে চান আপনারা? যা বলবার সব বলেছি। আর কিছু জানি নে বা বলার নেই আমার।
আছে, আছে নীরেনবাবু। উত্তেজিত হবেন না।
যা বলবেন, শিগগির বলুন। তারপর জাহান্নামে নিয়ে চলুন যাচ্ছি।
কোনো ভণিতা না করে মিঃ গুপ্ত চাদরটা টেবিলে রেখে বললেন, এটা চেনেন?
নীরেন ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকাল চারটার দিকে। তার দৃষ্টিতে বিস্ময় ছিল।
বলুন?
বলা কঠিন। একই রঙের একই চাদর অনেকগুলো বিছানায় থাকতে পারে। যতদূর জানি, কারখানায় একই ডিজাইনের মাত্র একটা চাদর কেউ বোনে না!
নীরেনের কণ্ঠস্বরে ঔদ্ধত্য প্রকট। মিঃ গুপ্ত একটু হাসলেন।…আপনার এমন একটা চাদর ছিল, তাই না নীরেনবাবু?
সম্ভবত ছিল। দরকার হলে কিনে ফেলি-তারপর আর লক্ষ করি না। মানুষের চিন্তার জন্য অসংখ্য বিরাট ব্যাপার রয়েছে।
আপাতত এই ক্ষুদ্র ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাববেন কি?
কী ভাবব? আমার হতেও পারে। কাল রাত্রে তো বিছানায় শুতে দেন নি। কেমন করে বলল, এটা আমার চাদর কিনা?
মিঃ গুপ্ত বাজি জেতার গর্বে বললেন, কাল রাত্রে আপনার বিছানায় কোনো চাদর ছিল না, এখনও নেই। তাহলে?
নীরেন অবহেলায় জবাব দিল, তাহলে ওটা আমারই।
চাদরে কিন্তু রক্ত লেগে রয়েছে।
নীরেন নিষ্পলক তাকাল। দৃষ্টিতে চমক ছিল। কিন্তু কোনো মন্তব্য করল না। সে ভ্রূ কুঞ্চিত করে মুখ ফেরাল দেয়ালের দিকে।
বলুন, এ রক্ত কোত্থেকে এল?
আমি জানি না।
আপনার বিছানার চাদরে রক্ত–আপনি জানেন না?
কেমন করে জানব? কাল সারাদিন সারারাত্রি আমি বিছানায় শুইনি। দিব্যেন্দু ছিল ঘরে। সে বলতে পারে। জিগ্যেস করেছেন তাকে?
করেছি। তিনি তাঁর আত্মীয়া মেয়েটির পায়ের ব্যথা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। লক্ষ করেননি।
তাকে বিশ্বাস করলেন?
করলাম।
তাহলে আমায় বিশ্বাস করছেন না কেন?
সে কথা আপনারই বোঝা উচিত নীরেনবাবু। তিন বন্ধু বেড়াতে গেলেন, দুজন ফিরলেন–একজন ফিরলেন না। পরে দেখা গেল সে খুন হয়েছে।
কথা কাড়ল নীরেন।…..খুন বিভাসও করতে পারে।
পারে না। তার কারণ, এ খুনের নিশ্চিত মোটিভ থাকে। বিভাসবাবুর কোনো মোটিভ আমরা খুঁজে পাইনি।
পাননি–সেটা আপনাদের বুদ্ধির অভাব হতে পারে। একসকিউজ মি–কিন্তু আমার কী মোটিভ পেলেন?
অপমানিত বোধ করছিলেন মিঃ গুপ্ত। কিন্তু সংযত কণ্ঠে বললেন, আপনি কল্পনাকে ভালোবাসতেন। কল্পনা শুভর সঙ্গে ফ্লার্টিং করছিল। তাই প্রতিহিংসা চরিতার্থ। করতে দুজনকেই খুন করে বসলেন।
হো হো করে পাগলের মতো হাসল নীরেন।…বাহাদুর! এই না হলে গোয়েন্দাগিরি কেন?
এবার সক্রোধ গর্জালেন মিঃ গুপ্ত।…..থামুন! আপনাকে আমরা ফাঁসিকাঠে ঝোলাব। মার্ডারার! জঘন্য জানোয়ার! লজ্জা করে না হাসতে?
নীরেন আদৌ দমল না। দ্যাট ডিপেন্ডস! চাদরের রক্ত ছাড়া আর কোনো প্রমাণ আপনাদের হাতে সেই স্যার। বাট মাইন্ড দ্যাট–চাদরের রক্ত যে শুভ বা কল্পনার, তা প্রমাণই বা করবেন কীভাবে? আবার এমনও তো হতে পারে কেউ আমার কাঁধে দায় চাপানোর জন্যে এ কর্ম করেছে। হয়তো কল্পনা বা শুভর রক্তই ওটা নয়–নিছক কোনো রং কিংবা জানোয়ারের রক্ত!
মিঃ গুপ্ত কটাক্ষ করলেন ভদ্রের দিকে। মিঃ ভদ্র দাঁড়িয়ে বললেন, নীরেনবাবু, এতক্ষণে আমরা অফিসিয়্যালি আপনাকে শুভ এবং কল্পনার খুনের চার্জে গ্রেপ্তার করলাম।..মুকুন্দ! মাথোলাল! ইধার আও।
দুজন সেপাই এসে নীরেনের দুপাশে দাঁড়াল। মিঃ ভদ্র বললেন, কই, উঠুন নীরেনবাবু।
নীরেনের নাসারন্ধ্র কাঁপছিল। সে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল। তারপর ওদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। মিঃ গুপ্ত বললেন, বাইরে গিয়ে হাতকড়াটা পরাবেন দয়া করে। ভ্যানে তুলে আপাতত থানায় নিয়ে যান। আমি জাস্ট বারোটা নাগাদ পৌঁছচ্ছি।
মিঃ ভদ্র বেরিয়ে গেলেন।
সত্যজিৎ গুপ্ত একটা সিগ্রেট ধরিয়ে ডাকলেন, নেকস্ট স্বাতী রায়।
কর্নেল তার ঘরে পায়চারি করছিলেন। খাঁচার বাঘের মতো ছটফটানি যেন। মাথার সাদা চুলগুলো বারবার খামচে ধরছিলেন। প্যান্টের পকেটে একটি হাত ভরে অনর্থক লাইটার বের করে দাঁতে কামড়াচ্ছিলেন। কখনও ধুপ করে হতাশভাবে বসে পড়ছিলেন আরামকেদারায়!
ডান হাতের মুঠোয় একটা ছোট জিনিস।
অন্য কিছু নয়, একটা লেডিজ রিস্টওয়াচ।
ইরা বোসের হাতেও ঘড়ি রয়েছে। সেটা বেঢপ পুরুষালি। ব্যান্ডটা চওড়া। আজকাল মেয়েরা ওইসব পরছে। কিন্তু এ ঘড়িটা যথার্থ লেডিজ ওনলি। স্বাতীরও ঘড়ি রয়েছে হাতে। সেটা ইরার মতো মোটা। আলট্রামডার্ন। চীনার হাতেও একই প্রকার মডার্নিজম! সুদেষ্ণার? কর্নেল তারা লক্ষ করে এসেছেন। ভদ্রমহিলা সম্ভবত ঘড়ি পরেন না। মাত্র দুগাছি মোটা সোনার বালা আর শাঁখা নোওয়া। ঘড়ি পরলে একটা হাত অবশ্যই শূন্য থাকত। না থাকলেও যতদূর মনে পড়ছে, ওঁর হাতে কোনো সময়ই ঘড়ি দ্যাখেননি কর্নেল। তা হলে বাকি রইল শুধু কল্পনা। কল্পনা……তার আধুনিকতা,……হীনমন্যতাবোধ……সাধাসিধে রুচি……হুম, দ্যাটস কারেকট। এ ঘড়ি কল্পনার।
তাছাড়া ঘড়িটার কাঁচ ভাঙা। কাটা চলছে না। সবচেয়ে অবাক লাগছে, ঘড়ির কাটা দুটোর অবস্থান। জাস্ট দশটা পঁয়ত্রিশ। তার মানে ঠিক তখনই ঘড়িটা থেমে যায়। নাঃ, তাহলে নীরেনই পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র খুনি।
ব্যাগ থেকে এবার আতস কাঁচ বের করলেন কর্নেল। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সাবধানে পরীক্ষা করতে থাকলেন ঘড়িটা। পরক্ষণে চমকে উঠলেন।.খয়েরি রঙের মিহি ব্যান্ডের এক জায়গায় ওই জমাট অংশটুকু কী? রক্ত? সম্ভবত তাই। আরও তীক্ষ্ণ করলেন দৃষ্টি। হ্যাঁ, কাঁচের ফাঁকেও জমাট বিন্দু-বিন্দু রক্তের দাগ। তাহলে?
হতাশ ক্লান্ত হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। এ ঘড়ি দীপেন বোস পেল কেমন করে? আর ওভাবে বোকার মতো পায়ের নিচেই বা ফেলল কেন?
নাকি অন্য কেউ তাকে ফাঁদে ফেলবার জন্যে তার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছিল। আশ্চর্য, নীরেন তো তখন দীপেন বোসের টেবিল থেকে বড়জোর দুগজ তফাতে বসে ছিল। নাঃ, ছোকরার উদ্ধার নেই।
অথচ কেবলই মনে হচ্ছে, এ কাজ নীরেনের নয়–এ অন্য কারও।
আর দেবতোষের কাণ্ড? ওই রক্তমাখা চাদরটা বোকার মতো ভদ্রলোক জানালার নিচে পুলিশের ঘাড়ের ওপর ফেললেন? একবারও দেখে নিলেন না–কেউ নিচে দাঁড়িয়ে আছে কি না? ধরা যাক, কিংকর্তব্যবিমূঢ় বা হতবুদ্ধি হয়ে একাজ তিনি করেছেন। কিন্তু চাদরে রক্ত এল কোত্থেকে? চীনার কথা মানলেও অনেক প্রশ্ন থেকে যায়–যার জবাব মেলে না। নবাবি দলিল হাতানো ওঁর উদ্দেশ্য ছিল–সেটা হয়তো স্পষ্ট। কিন্তু তার জন্যে দু-দুটো খুন করার দরকার কী, শুভ বা কল্পনাকে খুলে বললেই পারতেন–অনুরোধ করতেন কথাটা গোপন রাখতে। শুভ এখনও ছাত্র, কল্পনাও সদ্য কলেজ ছেড়েছে কিন্তু ছাত্রী জীবনের গন্ধ গায়ে থেকে গেছে। অতএব একজন অধ্যাপককে তারা কিছুতেই বিপদে ফেলত না। দেবতোষের মতো অভিজ্ঞ পণ্ডিত মানুষ এটুকু কি বুঝতে পারেননি? অবশ্যই বুঝেছিলেন।
দেবতোষের ওপর সন্দেহটা মূল বিস্তার করতে পারছে না। এবার রইল দিব্যেন্দু। স্বাতীর কাছে তাদের ফ্যামিলি ব্যাক গ্রাউন্ড যা জানা গেছে, তা যথেষ্ট নয়। তাহলেও এটা স্পষ্ট দিব্যেন্দু কল্পনাকে খুন করতে পারে না। প্রথম কারণ, কল্পনাকে অত তাড়াতাড়ি ঘৃণা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সি ইজ হিউম্যান সাইকোলজি। সে কল্পনাকে ভালোবেসেছিল–এটা সত্য। কাজেই তার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক ছিল যে আগের রাত্রে কল্পনা আর শুভর হোটেলে থেকে অন্তর্ধানের সম্পর্কে সে কল্পনার কাছে প্রথমে কৈফিয়ৎ চাইবে। নিছক হত্যাবিলাসী না হলে অমনি হত্যা করে বসবে না। কর্নেলের ধারণা, কল্পনার মতো সরল মেয়ে তখনই রহস্যটা ফাঁস করে দিত। হয়তো দিয়েছিলও। দিব্যেন্দুর কাছে সেটা জানা যাবে। আর শুভ তো পেটখোলা দিলদরিয়া ছেলে। ঠেসে ধরলে সে সব না বলে পারত না। সম্ভবত বলেছিলও।
কিন্তু রহস্যটা কী? না–অধ্যাপক মধ্যরাত্রে ডোবার ধারে দলিল হাতাতে যাচ্ছেন। তাকে নিয়ে একটু ছাত্রোচিত দুষ্টুমি করতে চেয়েছিল সে। এর সঙ্গে খুনোখুনির বিন্দুমাত্র সংশ্রব থাকতে পারে না।
তবু দেখা যাচ্ছে ওই উপলক্ষে শুভ আর কল্পনা খুন হল।……ক্লান্ত হয়ে চুরুট ধরালেন কর্নেল। পা নাচাতে থাকলেন।
দিব্যেন্দুর অ্যালিবাই মজবুত। সে প্রায় সারাক্ষণ স্বাতীর সঙ্গে ছিল। সকাল ও দুপুরের দিকে বার দুই সে বেরিয়েছিল। এক্সরে করতে গিয়েছিল স্বাতীকে নিয়ে। ফের একবার একা গিয়েছিল। সেটা বিকেলে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে ফিরে আসে। তাছাড়া কী উদ্দেশ্যে সে শুভ বা কল্পনাকে খুন করবে? প্রতিহিংসা চরিতার্থ? ডোবা-রহস্য সে জেনে থাকলে তো বটেই–স্বাভাবিক কারণে প্রতিহিংসার বিষ মনে জন্মানোর জন্যে একটা সঙ্গত পটভূমিকা আর প্রচুর সময়ের দরকার। নীরেনের পক্ষে যা সম্ভব, দিব্যেন্দুর পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাহলে? এবার রইল দীপেন বোস। নাঃ, তার কোনো মোটিভ থাকতে পারে না। কেন সে কিনা কারণে দুটি ছেলেমেয়েকে খুন করবে- বিশেষত সে ওদের সঙ্গে এখানে এসেই পরিচিত হয়েছে এবং এ কদিনে এমন কিছুশত্রুতার কাণ্ড ঘটেনি।
অথচ তার পায়ের কাছে কল্পনার ঘড়ি পাওয়া গেল।….হঠাৎ চমকে উঠলেন কর্নেল। হাউ ফানি! খুনির সন্ধান করছি শুধু পুরুষদের মধ্যে। মেয়েরা কি খুন করতে পারে না? রাইট রাইট। প্রথম ধরা যাক স্বাতীর কথা।…..
.
১৩.
জাফরাগঞ্জ আঁধারমহলের কাছে রিকশো থেকে নামলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। শীতের সূর্য দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রাচীন গির্জার চূড়াকে স্পর্শ করেছে। সূক্ষ্মাগ্র গির্জাচূড়ার শীর্ষ ঘিরে যেন দিব্যচ্ছটার বিকাশ। বুকে ক্রশ এঁকে কয়েক মুহূর্ত সেদিকে চেয়ে থাকলেন কর্নেল। অভিভূত দৃষ্টি।
…..দেখছেন স্যার? অপূর্ব দৃশ্য। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে আরমানি বণিকেরা এই গির্জাটা বানিয়েছিলেন সেন্ট ড্যানিয়েলের নামে। কে এই সেন্ট ড্যানিয়েল? খুবই সাধারণ একজন মানুষ স্যার। জাফরাগঞ্জের ওপারে একটা রেশমকুঠির ধ্বংসাবশেষ আছে। সাধুজি ছিলেন তারই এক কর্মী। এখনও এলাকায় তার সম্পর্কে বিস্তর কিংবদন্তি ছড়িয়ে রয়েছে। লক্ষ করবেন, এই গির্জায় হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান নির্বিশেষে মোমবাতি মানত করে যায়। এমনকী স্যার, আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জ থেকে জৈনরাও আসেন। আপনি কি মানত দেবেন স্যার? আসুন, আমার সঙ্গে আসুন……
কর্নেল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন লোকটার দিকে। ময়লাধুতি পরনে, গায়ে হাতা-গুটানো ছেঁড়া পপলিনের ফুলশার্ট, পায়ে ধ্যাবড়া বেঢপ মিলিটারি বুট। লোকটা ঢ্যাঙা, বোগা, মুন্ডুসার। প্রকাণ্ড নাক, সরু থুতনি। খোঁচা-খোঁচা গোঁফ-দাড়ি। তার কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলছে। ব্যাগের ভিতর সম্ভবত মোমবাতি রয়েছে এক গুচ্ছের। কারণ কথা বলতে বলতে কয়েকটা মোমবাতি সে বের করে বসল।
মৃদু হেসে মাথা দোলালেন কর্নেল।……লোকটা এখানের ট্যুরিস্ট শিকারি সন্দেহ নেই। আশ্চর্য, মুরশিদাবাদ শহরে দিনে দিনে নাকি ট্যুরিস্টের সংখ্যা বাড়ছে–বিশেষত শীতকালে। কিন্তু কোনো ট্রেনড় গাইডের ব্যবস্থা নেই। দ্রষ্টব্যস্থানের রক্ষক সেবায়েতরাই গাইডের ভূমিকা নেয়। দুচার পয়সা রোজগার করে। তারা বেশির ভাগই অশিক্ষিত লোক। বানিয়ে রং চড়িয়ে নানান হিস্ট্রি বর্ণনা করে। তাক লাগিয়ে দিতে চায় ট্যুরিস্টদের। অথচ স্থানটি প্রকৃত ইতিহাস হয়তো একেবারে উটো–সে পুরো অজ্ঞ এ-ব্যাপারে।
কর্নেলের অভিজ্ঞতা প্রচুর। সর্বত্রই এমন সব ভুয়ো গাইডের ছড়াছড়ি কন্যাকুমারিকা থেকে পামিরের মালভূমি অবধি। তবে এখানে গাইডবুক থাকা উচিত ছিল অন্তত। তাতেও ট্যুরিস্টরা উপকৃত হতেন। একটা ট্যুরিস্ট-লজ হল জেলায়– সেও কিনা এখান থেকে ছমাইল দূরে সদর শহরে।
স্যার! লোকটি ফের তাকে ডাকছিল।
কর্নেল ফের তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বললেন, হুম! আপনি এখানেই থাকেন?
আজ্ঞে স্যার। সারাদিনই আমাকে এখানে পাবেন।
কর্নেল মাথা দুলিয়ে বললেন, উঁহু। সব সময় আপনাকে এখানে পাওয়া যায় না।
লোকটি ব্যস্তকণ্ঠে বলল, না, না স্যার। এ একটা দেখবার মতো জায়গা। একদিকে ওই আঁধারমহল এদিকে গির্জা, সারাদিন কত বস আসছেন-যাচ্ছেন, মানত দিচ্ছেন। আমার না থাকলে চলে? ঘরে যে হাঁড়ি চড়বে না স্যার।
পরশু কিন্তু আপনি এখানে ছিলেন না!
ছিলাম না! ভ্রূ কুঞ্চিত করে লোকটা একটু ভেবে নিল যেন….কই, না স্যার! ছিলাম বইকি।
কতক্ষণ ছিলেন?
লোকটি হিসেব করে বলল, সকাল আটটায় বেরিয়েছিলাম। ওই সময় প্রতিদিন বেরিয়ে পড়ি বাড়ি থেকে। বুঝতেই পারছেন শীতের সময়, রোদ একটু চড়া না হলে ট্যুরিস্টবাবুরা তো আসেন না। হ্যাঁ, কতক্ষণ ছিলাম বলছেন? কেন স্যার? আপনি কি এসেছিলেন মানত দিতে?
কর্নেল মাথা দোলালেন।…দশটার সময় এসছিলাম। কেউ ছিল না তখন–শুধু আঁধারমহলের মহবুব খাঁ ছিল। আঁধারমহলেই ঢুকে গেলাম অগত্যা। গির্জাবাড়িতে তো কেউ নেই। তারপর ধরুন, এগারোটা নাগাদ এখান থেকে গেছি। বেরিয়েও কিন্তু আপনাকে লক্ষ করিনি।
লোকটি বিব্রতমুখে ব্যস্তকণ্ঠে বলল, না স্যার না স্যার। সে কী কথা!
আমি কি মিথ্যা বলছি তাহলে?
জিভ কাটল সে। করজোড়ে বলল, ওরে বাবা! আপনি আমার মা-বাবা। ছিঃ স্যার! মিথ্যে বলবেন কেন? এক মিনিট–আমি মনে করছি। হ্যাঁ স্যার, আমি পরশুদিন সারাক্ষণই ছিলাম। ওই ভাঙা পাঁচিলের ওপর বসেছিলাম। কে জানে কেন, ওইদিন এদিকটায় টুরিস্টরা বিশেষ কেউ আসেননি। মরশুমে এমন বাজে দিন আর। দেখিনি। ভাবছিলাম, আগের দিন বৃষ্টি হয়ে গেছে জোর। শীতটা তাই সাংঘাতিক বেড়ে গেছে। তার ওপর ভীষণ ঠান্ডা উত্তুরে হাওয়া বইছে–হাড় অবধি কনকন। করছিল। ওনারা আয়েসি মানুষ-দুপুর-টুপুরে বেরোবেন ডেরা ছেড়ে।
কর্নেল বিরক্ত মুখে বললেন, এখানে কাকেও দ্যাখেননি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে স্যার! দেখেছি। তিন বাবু ওই গেট দিয়ে মোজা আঁধার-মহলে গেলেন। ওনারা বেরুলেই আমি গিয়ে ধরব ঠিক করেছি, হঠাৎ দেখি আমার পিছনের রাস্তায় এক বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওনার চোখে একটা ছোট্ট দূরবিন! আঁতকে উঠেছিলাম স্যার!
কর্নেল রুদ্ধশ্বাসে বললেন, তিনজন ঢোকবার কতক্ষণ পরে আপনি ওকে দেখতে পেলেন?
মিনিট পাঁচেক হবে!
তারপর?
হাতের কাছে যা পেয়েছি, আমার ভাই ভালো। আমি ওনাকে গির্জাবাড়ি নিয়ে গেলাম। গির্জাবাড়ির ফটকটা দেখছেন? কত উঁচু। বাবু কিন্তু এক লাফে তার ওপর চড়ে বসলেন, দেখে আমি অবাক। বারে! এ যে দেখছি সার্কাসের রিং-মাস্টার!
হুম! তারপর?
বেশ কিছুক্ষণ বাদে উনি নেমে এলেন। আমাকে পয়সা দিলেন…..
কত?
এবার লোকটি সন্দেহাকূল দৃষ্টে তাকাল কর্নেলের দিকে।…কে-কেন স্যার?
কর্নেল হাসলেন।…আরে, আসল ব্যাপারটা আপনাকে বলাই হয়নি। আমার ছেলে গত পরশু রাগ করে পালিয়েছে। একমাত্র ছেলে। তারই খোঁজে বেরিয়ে পড়েছি।
লোকটি আশ্বস্ত হয়ে মাথা দোলাল।…যা বলেছেন স্যার। আজকালকার ছেলে পুলেরা এক দারুণ সমস্যা। আমার বড় ছেলের কথাই ধরুন। হারামজাদা জোয়ান মদ্দ থাকতে এ বয়সে আমার দুর্দশাটা দেখুন। নাঃ, ওনাদের কথা বলবেন না। এ হচ্ছে কলিধর্ম।৭ বাপদের জ্বালার শেষ নেই।
তারপর কী হল বলুন।
আপনার ছেলেই হবে স্যার। তা না হলে এত ডানপিটে আর দয়ালু হবে কেন? পুরো পাঁচটা টাকা গুঁজে দিলেন….হঠাৎ লোকটি ঘোড়ার মতো লাফ দিল।…আরে, তাইতো! মনে পড়ে গেছে উনি বললেন, পাঁচ টাকা দিচ্ছি। আমি যে এদিকে এসেছিলাম, কাকেও বলো না। কেমন? কয়েকদিন থাকব এখানে। যাবার দিন অবধি যদি দেখি, কাকেও বলোনি–ফের এসে তোমায় দশ টাকা দিয়ে যাব।…সত্যি বলতে কী, অবাক আমি কম হইনি। কিন্তু ওই যে বললাম, বাপের প্রাণ, সব বুঝতে পারি। ধরে নিয়েছিলাম, নির্ঘাৎ বড়লোকের ছেলে-বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে কোনো দুঃখে।
হুম। তারপর?
তারপর স্যার, আঁধারমহল থেকে দুজন বাবু বেরোলেন। আমি তখন ওই ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি। ওনাদের একজন মসজিদের ভেতর থেকে বেরিয়ে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমেছিলেন। একটু পরে দুজনকে চলে যেতে দেখলাম।
কিন্তু তিনজন ঢুকেছিল ওখানে!
সেটা মনে ছিল না স্যার। তখন আমি টাকার সুখে আত্মহারা। হেসে উঠল সে।
আমার ছেলে কী করল?
দুই বাবু চলে গেলে সে এক দৌড়ে আঁধারমহলের পিছনের দিকে পৌঁছল। ভাবলাম, গঙ্গা মায়ের শোভা দেখতে যাচ্ছে। আমার পকেটে টাকা-হঠাৎ খিদে বেড়ে গেছে। সোজা চলে গেলাম একটা মিষ্টির দোকানে।
ফিরলেন কখন?
ধরুন, আধ ঘণ্টা পরে।
কী দেখলেন?
কিছু না।
আমার ছেলেকে দেখতে পেলেন না?
হঠাৎ–আচম্বিতে লোকটি ভূতগ্রস্তের মতো চোখ ছানাবড়া করে পিছোতে থাকল। কর্নেল অবাক। পরক্ষণে পা বাড়িয়ে শক্ত করে ওর হাতটা ধরে ফেললেন। লোকটি অস্ফুট আর্তনাদ করল।……স্যা-স্যার…আমি, আমি কিস্য জানিনে। আপনার পায়ে ধরে বলছি স্যার। আমি একজন গরিব গাইড–ঘরে এক দঙ্গল পুষ্যি। প্রাণে মারা পড়ব স্যার। দোহাই আপনার…..
আরে আপনার হল কী? অমন করছেন কেন।
আপনি পু-পুলিশ স্যার। ওরে বাবা, আমার একটুও হুঁশ ছিল না। সদ্য কাল এখানে মানুষ খুন হয়েছে। সর্বনাশ! মাইরি স্যার, আমি আফিমখোর মানুষ……কী বলতে কী বলেছি……
আরে না, না, আমি পুলিশ নই। ছেলের খোঁজেই বেরিয়েছি।
লোকটা এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ও খুনে ছেলের আশা ছেড়ে দিন। ও আমাকেও খুন করে গেছে রে বাবা!…পরক্ষণে ঊধ্বশ্বাসে দৌড়। গাছপালার আড়ালে লোকটা মিলিয়ে গেল।
বেড়ে মজা! গির্জার গাইডটি আফিমখোর, কবরখানার উনি গেঁজেল! মানিক-জোড়!…কর্নেল হাসতে গিয়ে গুম হলেন। কে এসেছিল ভিউফাইন্ডার নিয়ে? তার চেহারার বর্ণনা নেবার অবকাশ হল না। ওই লোকটার কাছে আর সুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু সে চতুর্থ ব্যক্তিটি কে? এমনও হতে পারে, সে একজন টুরিস্ট মাত্র। তার সঙ্গে শুভ খুন হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ভিউফাইন্ডার প্রায় সব ট্যুরিস্টেরই আজ-কাল থাকে। ধরা যাক, তাই সে শুভদের অনুসরণ করে এসেছিল এখানে। কিন্তু শুভকে একলা পাওয়া তো নিছক ভাগ্যের বা দুর্ভাগ্যের কথা তার পক্ষে। শুভর সঙ্গীরা রয়েছে। কাজেই বোঝা যায়, সে শুভকে খুন করতে আসেনি এখানে।
তাহলে এসেছিল কেন? শুভদের অনুসরণ করার উদ্দেশ্য কী তার?..কর্নেল হঠাৎ চমকে উঠলেন।…তাহলে…ধরা যাক, সে শুভদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে চেয়েছিল। তার মানে, একটা কিছু দেখতে চেয়েছিল যা দেখলে তার কোনো ধারণা দৃঢ় হবে। কিন্তু এখানে আসা মাত্র পরিস্থিতি বুঝে হঠাৎ তার মাথায় অন্য একটা চিন্তা খেলে গেল। হত্যার চিন্তা। এ সুবর্ণ-সুযোগের সে সদ্ব্যবহার করে বসল। নাঃ, এ চিন্তা পদ্ধতি অ্যাবসার্ড হয়ে উঠেছে। যুক্তি মিলছে না।
কর্নেল চীনা মিত্রর কথা ভাবলেন। মেয়েটি বুদ্ধিমতী। ওকে সঙ্গে আনলে ভালো হত। কর্নেল মানুষ মোটামুটি চেনেন। চীনাকে বিশ্বাস করতে তাঁর বাধছে না।
একদল ট্যুরিস্ট এসে পড়েছে হইহল্লা করে। কর্নেল সেদিকে এগোলেন। আঁধারমহলের ভিতর থেকে পুলিশ পাহারা দুপুরেই তুলে দেওয়া হয়েছে। কেবল প্রধান গেটের বাইরে দুজন সেপাই লাঠি হাতে বসে রয়েছে। ট্যুরিস্টদের দলে ভিড়ে গেলেন কর্নেল। ওরা মহবুব খাঁকে খুনের ঘটনা নিয়ে উত্ত্যক্ত করছে দেখে আমোদ পাচ্ছিলেন কর্নেল। আজকালকার ছেলে-মেয়ে সব যেমন বেপরোয়া তেমনি সপ্রতিভ। কিন্তু আঁধারমহলের দরজায় তালা পড়েছে আপাতত কিছুদিন। ভিতরে যাওয়া নিষেধ। কর্তৃপক্ষ কনভেনশান মানছেন মাত্র।
ওরা অগত্যা ওপরতলার মসজিদের প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করছিল। কর্নেলও ওপরে উঠলেন। প্রথামতো জুতো খুলে মসজিদের ভিতরে ঢুকলেন। আশ্চর্য গাঁথুনি–তিনটে গম্বুজই অক্ষত আছে। ঠিক মধ্যিখানে–সামনের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে একটা কাঠের ধাপমতো। আন্দাজ মাপ তিন ফুট x তিন ফুট। দুফুট। তিনটে ধাপ! নিচে নামবার সিঁড়িটি খুঁজছিলেন কর্নেল। ট্যুরিস্টরা প্রাঙ্গণে চৌবাচ্চার ধারে বসে ফোটো তুলতে ব্যস্ত। কর্নেল এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাঠের ধাপটা সরালেন। খুব ভারী নয়। নীরেনের পক্ষে নিচে থেকে মাথা বা হাত দিয়ে ঠেলে সরানো সহজ ছিল।
এক মুহূর্তে বুক কাঁপল কর্নেলের। তারপর সাবধানে পা বাড়ালেন। দুর্ভেদ্য অন্ধকার। টর্চ জ্বেলে নিচেটা দেখলেন। কবর। ওখানেই শুভর লাশ পাওয়া গেছে। মাথার ওপর কাঠের ধাপটা টেনে সংকীর্ণ সিঁড়ির মুখ ঢেকে দিলেন কর্নেল।
ভ্যাপসা গন্ধ ঘরের ভিতর। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে যেন। আলো ফেলে মেঝেটা পরীক্ষা করছিলেন কর্নেল। কবরের ওপর ঝুঁকে পড়লেন। কষ্টি পাথরের কবর। ফলকে সম্ভবত ফারসি ভাষায় মৃতের পরিচয় লেখা রয়েছে। মাঝে লাইম-কংক্রিটের কিন্তু ঝকঝকে পরিষ্কার মেঝে। কোথাও একটুখানি আবর্জনা নেই। দেয়ালের তাকে নিভন্ত এক টুকরো মোমবাতি। তাকটা কালি-মলিন। চাপ-চাপ নোম পড়ে রয়েছে।
শুভ কি এখানেই খুন হয়েছিল? ধস্তাধস্তির কোনো চিহ্ন এখানে পাওয়া অবশ্য কঠিন। কর্নেল আলো ফেলে ডানদিকের দরজায় ঢুকলেন। প্রতিটি দরজা কপাটহীন। ডাইনের প্রথম ঘরও মসৃণ ও পরিষ্কার। বাঁদিকে ঢুকলেন। এটা পশ্চিম-প্রান্তের মধ্য সারির দ্বিতীয় ঘর। মেঝে একটু অপরিষ্কার মনে হল। কিছু ফাটল রয়েছে। এটা অবশ্যই ভূগর্ভে প্রাকৃতিক সংকোচনের ফলাফল। গঙ্গার একেবারে কিনারায় এ কবরখানাটা। কাজেই এমন ভূত্বক সংকোচন ঘটা স্বাভাবিক। ফাটলে আলো ফেললেন কর্নেল। হাঁটু গেড়ে বসলেন।
একটু পরেই চমকে উঠতে হল। কালো বাঁকা এক টুকরো প্লাস্টিক। কয়েক টুকরো কাঁচ। এত ক্ষুদে যে সহজে কাঁচগুলো নজরে পড়বে না। কেবল ওই প্লাস্টিকের টুকরোটা দেখতে পাওয়া সহজ। পুলিশ কি এগুলো লক্ষ করেনি, সম্ভবত তাই। সত্যজিৎ গুপ্ত নীরেন আর পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত ছিলেন খুঁটিনাটির দিকে দৃষ্টি দেওয়া অনাবশ্যক মনে করেছিলেন হয়তো। তারপর মহবুব খাঁ ঝাড়ু বুলিয়ে মেঝে সাফ করেছে।
ছুরির ডগায় কাঁচ আর প্লাস্টিকের টুকরোটা তুলে নিলেন কর্নেল। হাতের চেটোয় রেখে পরীক্ষা করলেন। কাঁচগুলো সাধারণ কাঁচ নয়। বেশ পুরু। স্তরবহুল। প্লাস্টিকটা সম্ভবত কোনো গোলাকার জিনিসের অংশ।
ভিউফাইন্ডার? রোমাঞ্চ খেলে গেল কর্নেলের শরীরে। রুমালে ওগুলো বেঁধে পকেটস্থ করলেন। তারপর শুরু হল একে একে প্রতিটি ঘর পর্যবেক্ষণের পালা।
.
ডাইনিং হলে আড্ডা দিচ্ছিল চীনা মিত্র, ইরা আর দীপেন বোস। পাশের টেবিলে সুদেষ্ণা আর দেবতোষ। সুদেষ্ণা যেন স্বামীকে চোখের আড়াল হতে দিচ্ছে না আর। হলে ঢুকেই কর্নেলের এই হল সিদ্ধান্ত।
সবে আলো জ্বলেছে। পাঁচটা ত্রিশ বাজছে দেয়াল-ঘড়িতে। কর্নেলকে দেখেই দেবতোষ সোৎসাহে বললেন, হ্যাল্লো কর্নেল। আসুন, আপনার অপেক্ষা করছিলাম আমরা। আমার টেবিলেই বসুন। সুদেষ্ণা, তোমার সঙ্গে তো এঁর পরিচয় করানোর সুযোগ পাইনি। কী বিদঘুটে অবস্থায় না পড়েছিলাম সব। যা বাবা, ভালোয় ভালোয় আপদ চুকল। হ্যাঁ, ইনিই কর্নেল এন সরকার।…..আমার স্ত্রী সুদেষ্ণা।
সুদেষ্ণা ও কর্নেল নমস্কার বিনিময় করলেন।
দেবতোষ বললেন, ইস! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। ওই বেঁটে ছোকরাটাকে দেখে তো মশাই প্রথমেই আমার কেমন সন্দেহ হয়েছিল। কুচুটে চেহারা–চোখ দুটো লক্ষ করেছেন? জীবনে এই প্রথম খুনি দেখলাম। বিলিভ মি।
কর্নেল হাসলেন মাত্র।
……কিন্তু কী বদমাইশ ছোকরা দেখুন। রক্তমাখা চাদরটা কখন আমার খাটের নিচে পাচার করে দিয়েছে! সুদেষ্ণার শরীর তো ভালো যাচ্ছে না। ও চোখ বুজে শুয়েছিল সন্ধেবেলা। আমি এলাম নিচে আপনাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। দরজা ভেজানো ছিল। সুদেষ্ণা, বাকিটা তুমিই বলো। আর লুকিয়ে লাভ কী?
কর্নেল উৎকর্ণ হলেন। সুদেষ্ণ বলল, ঠিক ঘুম তখনও আসেনি, তবে ঘোরমতো হয়েছিল। হঠাৎ খুট করে শব্দ হতেই দেখি কে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গুরুদেবের ছবি চুরি করেছিল-সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। ঘরে আলো জ্বালিনি। অন্ধকার আমার ভালো লাগে। ভাবলাম, মজা দেখাচ্ছি তোমায়। ফের কী চুরির মতলবে এসেছে। চুপচাপ পড়ে রইলাম। কাছে এলেই জাপটে ধরব……সুদেষ্ণা পুরুষালি ভঙ্গিতে হেসে উঠল। বিকট হাসি।……
তারপর? কর্নেল প্রশ্ন করলেন।
কিন্তু সে-সুযোগই পেলাম না। হতচ্ছাড়াটা দরজা খুলে পালিয়ে গেল।
আপনি কাকেও ডাকলেন না?
ডাকলাম না। আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলেছিল। মনে হল, আমি ঘুমের ভান। করে পড়ে থাকি–ফের ও আসবে। কার্যসিদ্ধি যখন হয়নি, আমিও চেঁচামেচি করলাম না–তখন ও ঠিকই আসবে। কিন্তু বাট পাড়টা আর এলই না।
আপনার স্বামীকে কথাটা বললেন না?
সুদেষ্ণা মুখ ঝামটা দিল।……ওকে বলা না-বলা সমান। সব কথা এক কান দিয়ে শোনে তো আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়।
দেবতোষ বললেন, আহা! তাহলেও বলা উচিত ছিল তক্ষুনি। কিছু হারাল কিনা খুঁজে দেখতাম। তক্ষুনি খাটের তলায় চাদরটা পাওয়া যেত।
সুদেষ্ণা বলল, থাক্, আর সাহস দেখিয়ে কাজ নেই। তোমার মতো বোকা মানুষ ভূ-ভারতে আছে কেউ? শুনুন কর্নেল সায়েব, আক্কেলের কথাটা শুনুন তবে। সকালবেলা আমিই প্রথম খাটের নিচে চাদরটা দেখতে পেলাম। ভাগ্যিস, তখনও ঝাড়ুদার আসেনি। এলে তো কুরুক্ষেত্র হয়ে যেত। পুলিশে সব পারে। কথায় বলে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। ওনারা বাঘ।
কর্নেল বললেন, তারপর কী করলেন?
করব আর কী। আপনার বন্ধুকে সব বললাম। আর বোকার মতো উনি সেটা থলেয় পুরে বেরোলেন। আমি বললাম, চলো–আমিও সঙ্গে যাই। যা বুদ্ধি তোমার, কোথায় ফেলতে কোথায় ফেলবে। আমার গঙ্গাস্নানের অভ্যাস আছে। ভাবলাম, এই। হচ্ছে সুযোগ। কিন্তু পুলিশগুলো কী নচ্ছার! বললে, ওদের অফিসার না এলে বাইরে যেতে দেবে না। ওনার অনুমতি চাই। অগত্যা অফিসার আসবার অপেক্ষায় এ ঘরে বসে রইলাম।…কপালে ছোট্ট করাঘাত করে, অবশ্য হাসতে হাসতে সুদেষ্ণা বলল, ছি ছি, কী বুদ্ধি আপনার বন্ধুর! কখন আচমকা জানালা গলিয়ে ফেলে দিয়েছে–আর পড়বি তো পড় সেই পুলিশের ঘাড়ে……হাসির চোটে মুখে আঁচল ঢাকা দিল সুদেষ্ণা।
কর্নেল বললেন, সেই লোকটাকে চিনতে পেরেছিলেন?
সুদেষ্ণা বলল, অন্ধকার যে। চিনব কেমন করে?
বেঁটে, না লম্বা?
বেঁটেই হবে। ওই ছোকরাটা। আবার কে?
কর্নেল একটু ঝুঁকে বললেন, দেখুন মিসেস ব্যানার্জি, মানুষের একটা ব্যাপার আছে অনেকটা আমরা যা দেখি, তাতে আমরা আমাদের পূর্বসিদ্ধান্ত আরোপ করি। খুলে বলি, ধরুন–এই হোটেলেই রটে গেল আমি চোর। আপনার ঘরে যদি ওই মিস মিত্রও ঢোকেন, আপনার মনে হবে…..।
বাধা দিল সুদেষ্ণা।…..অত কানা আমি নই যে পুরুষ না মেয়ে চিনতে পারব না।
তাহলে সে পুরুষ ছিল?
নিশ্চয়।……হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে কড়িকাঠের দিকে তাকাল সুদেষ্ণা।…..
কিন্তু…কিন্তু ওকে দেখামাত্র তো নীরেনের কথা আমার মনে হয়নি। এখন মনে হচ্ছে।
দেবতোষ সন্দেহাকুলদৃষ্টে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।
কর্নেল বললেন, কার কথা মনে হয়েছিল?…..আচ্ছা, ঠিক আছে পরে শুনব।
সুদেষ্ণা পাশের টেবিলটার দিকে চোখ বুলিয়ে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে কর্নেলের মুখের কাছে মুখ আনল…..
.
চীনা মিত্র ওপাশ থেকে বলল, ওদের ফিরতে দেরি হবে মনে হচ্ছে। দাহ শেষ করে তারপর আসবে। আমাদের কিন্তু যাওয়া উচিত ছিল ইরা।
ইরা বিরক্তকণ্ঠে বলল, অপমানিত হতে এত সাধ কেন তোমার? স্বাতী যে অমন ঠোঁটকাটা মেয়ে টেরই পাইনি। তাহলে মিশতামই না।
চীনা বলল, স্বাতীর মা কিন্তু ভারি ভালো।
কথাটা কানে গেছে দেবতোষের। বললেন, ওদের ফ্যামিলিটাই কেমন রহস্যময় যেন।
.
১৪.
এ রাত আগের মতোই ঠান্ডা, তেমনি অন্ধকার আর রহস্যময়। কিন্তু কিছু তফাত ছিল। অন্তত প্যালেসহোটেলের পরিবেশে এই ঠান্ডা অন্ধকার রাতটাকে মনে হচ্ছিল ভারমুক্ত অথচ ক্লান্ত, নিরুদ্বেগ অথচ নিস্পন্দ। আজ সবার চোখে ঘুমের বড় আদুরে ছোঁওয়া। শোক-দুঃখ বিপর্যয়ের ঝড় শেষ হলে তবেই এমন নৈঃশব্দ্য আর পবিত্র শান্তি নামে মানুষের মনে। শুধু মানুষের মনেই বা কেন, তার দুচ্ছেদ্য পটভূমি ওই নিসর্গও যেন শান্ত আর শুদ্ধ হয়ে ওঠে। হয়তো একেই বলে ট্রাজেডির দিব্য মহিমা।……
কর্নেল সরকার তার ঘরে আরামকেদারায় ঝিমোচ্ছিলেন। দূরে সদর গেটের ঘণ্টা ঘড়ি বেজেছে দশবার। শীতের রাতে এ মফঃস্বল শহরে রাত দশটা মানেই ঘোর নিশুতি। আজ নটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া শেষ। বাবুর্চি-ঠাকুর সবাই দরজায় খিল এঁটেছে। কর্নেলের পাশের ঘরে তারা থাকে। তার ওপাশে ডাইনিং হল। সেখানে তালাচাবি পড়ে গেছে। তার মুখোমুখি সুরঞ্জনের ঘর। বাবুর্চিঘরের সামনাসামনি ওয়েটিং রুমে বাহাদুর থাকে। সে আজ ঘরে ঢুকে পড়েছে। বেচারার গত দুতিন রাত ঘুম নেই। ঘুমোক। বারান্দায় আলো জ্বলছে। পূর্বপ্রান্তের সারভ্যান্টস রুমও নিস্পন্দ।
ওপরতলাটাও মনে মনে দেখছিলেন কর্নেল। একই নৈঃশব্দ্য আর নির্জনতা হয়তো। স্বাতীর ঘরে দিব্যেন্দু আর স্বাতীর মা শুয়েছেন। দিব্যেন্দুদের ঘরটা আজ শূন্য। বিভাসও হয়তো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। যা দুর্ভোগ না গেল বেচারার! অধ্যাপক-দম্পতি, বোস-দম্পতি সবাই আরামে নিশ্চিন্তে ঘুমোনোর আয়োজন করছে। আর চীনা? চীনা কী করছে? ওর ঘরে কল্পনার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। প্রত্যেকে ওকে নিষেধ করলে ওঘরে শুতে। সুরঞ্জন ওকে বোস-দম্পতির পাশের খালি ঘরটা দিতে চেয়েছিল, চীনা জেদ ধরল। বেচারার এক প্রস্থ বিছানা গেছে। ডোম এসে নিয়ে গেছে। তাই আরেক প্রস্থ বিছানা জোগাড় করে দিতে হয়েছে সুরঞ্জনকে। কিন্তু কর্নেলের উদ্বেগ যে ওঘরে ওই বিছানাতেই চীনা শোবে কেমন করে? কী দুঃসাহসী দুদে মেয়ে রে বাবা।……
এবার একটু বিস্মিত হলেন কর্নেল। চীনার এ অস্বাভাবিক জেদের কি কোনো গূঢ় কারণ আছে? আগামীকাল সকালে সবাই এ হোটেল ছেড়ে যে-যার জায়গায় চলে যাবে। পুলিশ অনুমতি দিয়েছে। সাক্ষীদের নামে কোর্টের সমন যাবে সুযোগমতো। সে যাই হোক, এ অভিশপ্ত জায়গায় আরা কারো একদণ্ড কাটানোর ইচ্ছে নেই। কলকাতা থেকে শুভর একমাত্র গারজেন–তার দাদা এসেছিল স্বাতীর মায়ের সঙ্গে। সে কিন্তু একবারও এদিকে আসেনি! শ্মশানঘাট থেকে ফিরে গেছে। হা, সবাই বড় ভয় পেয়েছে এ পুরনো শহরটাকে। সুরঞ্জন দুঃখ করছিল, মরশুমের জমাটিতেই এমন ভাঙন ধরে গেল! হয়তো হোটেলটা উঠে যাবে। কাল থেকে জনশূন্য হোটেলে কেমন করে দিন কাটাবে সে? কর্নেল আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, না না। দেখবে, ঠিকই কারা না কারা এসে যাবে। আজকাল খুনজখম সবার গা-সওয়া। তাছাড়াও সুরঞ্জন, আমি তো রইলাম।
….ফের একটু চঞ্চল হলেন কর্নেল। কেন চীনার এত জেদ ওঘরে রাত কাটাতে? দিনের দিকে বেচারা ঘরে ঢোকার সুযোগ পায়নি। পুলিশ পাহারা ছিল। বিশেষজ্ঞরা খুঁটি-নাটি পরীক্ষা করেছেন বিকেল অবধি। কারণ মর্গের রিপোর্টে বলা হয়েছে, কল্পনার মৃত্যুর কারণ শ্বাসরোধ নয়–কোনো ভোতা নিরেট জিনিস দিয়ে মাথার পিছনে আঘাত করা হয়েছিল। অবশ্য শুভরটা নিছক শ্বাসরোধ।
গুপ্তকে ফোন করেছিলেন কর্নেল। গুপ্ত বলেছেন, কল্পনার মৃত্যু ওঘরে হয়নি। অন্য কোথাও হয়েছিল! তারপর চাদর জড়িয়ে ওকে ওখানে নিয়ে গেছে খুনি। এবং দোষটা ঘাড়ে চাপানোর জন্য চাদরটা অধ্যাপকের ঘরে ফেলেছে। গুপ্তর ধারণা–যদিও এখনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ মেলেনি, খুন হয়েছে বাইরের ওই পোড়োবাগানে। আর রাইগর মরটিস এবং অন্যান্য দিক থেকে ডাক্তারের ধারণা, খুনটা প্রায় সামান্য আগে-পরে হয়েছে-বড়জোর একঘণ্টার ব্যবধানে। খুনের সময় সকাল দশটা থেকে বারোটার মধ্যে রাধা যেতে পারে!……ঘড়ির কথাটা আপাতত চেপে রেখেছেন কর্নেল। এটা অবশ্য বেআইনি। কিন্তু আর একটু জানবার বাকি আছে। তাহলেই ঘড়িটা পুলিশকে পৌঁছে দেবেন।……কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। একবার চীনার ঘরে যাওয়া জরুরি মনে হচ্ছে। কী করছে সে? যদি কোনো মতলব ছিল, লুকোল কেন তার কাছে?
কর্নেল সাবধানে দরজা খুলে বেরোলেন। বারান্দায় নির্জনতা থমথম করছে। জুতোর রবারসোল কোনো শব্দ হতে দিচ্ছিল না। সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, তিনি চীনা মিত্র ও বিভাসের ঘরের সঙ্গমে অর্থাৎ খিড়কি দরজার কপাট-দুটো সদ্য বন্ধ হতে দেখলেন।
রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে গেলেন কর্নেল! দরজায় কান পাতলেন। নিচের ঘুরন্ত সরু সিঁড়ি বেয়ে কে যেন নেমে যাচ্ছে। দরজার খিলও খোলা। কে গেল পোড়া বাগানে এত রাত্রে? কী উদ্দেশ্য তার?
পরক্ষণেই ডানদিকে চীনা মিত্রের দরজাটা খুলে গেল। চীনা ভাঙা গলায় বলছে, না, না–তুমি যাও…..এবং বিভাস প্রায় ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে এল এবং সশব্দে কপাট বন্ধ হল।
কর্নেল সকৌতুকে বলে উঠলেন, হ্যাল্লো, মাই বয়! গুডনাইট।
বিভাস অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। কোনো রকমে গুডনাইট বলে সে উভ্রান্তের মতো নিজের ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল।
কর্নেল একটু ইতস্তত করে চীনার দরজায় টোকা দিলেন। একবার, দুবার, বারবার। মুখ চাপা হাসি। কর্নেল ধৈর্যের পরীক্ষায় অবতীর্ণ যেন। ক্রমাগত টেলিগ্রামের শব্দ তুলছিলেন। অবশেষে দড়াম করে দরজা খুলে গেল। এবং পর্দার ভিতরেই চীনার কণ্ঠস্বর বাজল, আঃ কেন বারবার বিরক্ত করছ? এত জ্বালিয়েও তোমার আশা মেটেনি? ফের এসেছ এখানে……।
পর্দা তুলে কর্নেল বললেন, গুডনাইট মাই গার্ল।
চীনা ভূত দেখল। কয়েক মুহূর্ত তার মুখটা জ্বলে রইল। তারপরই আচমকা দৌড়ে গিয়ে বিছানায় ঝুঁকে পড়ল। তার পিঠ ফুলে ফুলে উঠছিল। নিঃশব্দে কাঁদছিল চীনা মিত্র।
কর্নেল দরজাটা বন্ধ করে আস্তে আস্তে তার কাছে গেলেন। পাশে বসে পিঠে হাত রেখে বললেন, চীনা, শোনো! জাস্ট এ মিনিট মাই গার্ল!……ও ইয়েস, ইয়েস। আই ফিল ফর ইউ। বাট চীনা……একটা ব্যাপার হয়েছে শোনো। ভেরি স্ট্রেঞ্জ।
চীনা মুখ তুলল।…..কী?
কর্নেল বললেন, এইমাত্র কেউ খিড়কির সিঁড়ি দিয়ে নামল।
কথাটা শোনামাত্র চমকে উঠল চীনা।
…..তাই নাকি?…..তাহলে দাঁতে ঠোঁট কামড়াল সে।……তাহলে কী? চীনা উঠে দাঁড়াল। চোখ মুছে নিয়ে বলল, ওকে একটু ডাকবেন?
বিভাসকে?
হ্যাঁ।
কেন?
ও আমায় একটা কথা বলছিল এইমাত্র। কান দিইনি তখন।…..চীনা সলজ্জ হাসবার চেষ্টা করল।…….ওর কতকগুলো পিকিউলিয়ার অভ্যেস আছে। একসময় আমি রাগ করলে ওইরকম অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প শোনাত। আমায় বড্ড ছেলেমানুষ ভাবে কি না!
তুমি সত্যি বড্ড ছেলেমানুষ!
চীনা এবার সত্যি হেসে ফেলল। হয়তো তাই। ও সুর ধরে শুভর কবিতাটা আবৃত্তি করছিল। তারপর বলছিল, চলুন ওই জানালার কাছে দাঁড়াই। এক অপূর্ব রহস্য দেখাব। সব রহস্যের অবসান হবে।
স্ট্রেঞ্জ! বলে কর্নেল হন্তদন্ত উঠলেন।
আধঘণ্টা পরে।
পোড়ো বাগানের ভিতর খুব সন্তর্পণে অপেক্ষা করছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার, বিভাস সিংহ আর সুরঞ্জন বসাক। ভাঙা মসজিদের পাঁচিলের এক পাশে ওঁরা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদটা উঠতে দেরি আছে। ডোবাটা গাছপালার ভিতর অন্ধকারে অদৃশ্য। তবু অন্ধকারের একটা বিচিত্র স্বচ্ছতা আছে। জল থিতিয়ে পড়ার পর গভীর স্বচ্ছতার মতো। মসজিদের চত্বরটা ঝকমক করছে। ওখানে যে একজন মানুষই বসে রয়েছে, তাতে কোনো ভুল নেই।
আশেপাশে কোথাও সত্যজিৎ গুপ্তরা রয়েছেন। হোটেল এবং জঙ্গুলে বাগানের প্রায় সারা বাউন্ডারি ঘিরে পুলিশ তৈরি। কেবল পূর্ব প্রান্তের প্রাইভেট রোড-যা কেল্লা-নিজামতের সমান্তরাল, সেখানে কোনো পুলিশ নেই। যেখানে-যেখানে আছে, তারাও গাছপালার আড়ালে ঝোপেঝাড়ে ওত পেতে সতর্ক। ভীষণ হিম। কিন্তু উত্তেজনায় সবাই যেন উষ্ণতা অনুভব করছে।
আট তারিখের মধ্যরাতে ডোবার ধারে যা ঘটবার কথা ছিল, তা আজ দশ তারিখে ঘটছে। বিভাস টের পেয়েছিল। সেই টুকরো কাগজটা এখন কর্নেলের পকেটে। ইংরেজি হরফে লেখা : ডোন্ট ফেল টুডে অ্যাট টেন-থারটি পি-এম। বিসাইড দ্যাট মস্ক–সেইম প্লেস। কাগজটা লনের ওদিকে জড়ানো পড়েছিল। একটা ঘরের জানালা দিয়ে না পড়তে দেখলে বিভাসের কৌতূহল হত না।
প্রথম আলোয় সংকেত দেবেন কর্নেল। রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। সেকেন্ড গোনার পালা শুধু। এক…দুই…তিন…চার…পাঁচ..সারা পৃথিবী ঘোরতর প্রতীক্ষায় স্তব্ধ।
হঠাৎ পিছনে একপাল শেয়াল ডেকে উঠল। কয়েকটা পেঁচা কাছে ও দূরে ডাকল। যেন কয়েক মিনিট ধরে স্তব্ধ নিঃঝুম হিমরাত্রির বনভূমি তোলপাড় হল। সবাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ কর্নেল লক্ষ করলেন, মূর্তি একটা নয়, দুটো। চাপাস্বরে কথা বলছে।
সঙ্গে সঙ্গে টর্চ জ্বাললেন কর্নেল। দুটো মূর্তি চকিতে স্থির। তারপরই চারদিক থেকে অজস্র টর্চের আলো। গম্ভীর গর্জন : খবরদার! যে-যেখানে আছেন, দাঁড়িয়ে থাকুন। নড়বার চেষ্টা করলেই আমরা গুলি ছুড়ব।
একটা স্যুটকেস প্রমাণ প্যাকেট হাতে নিয়ে দীপেন বোস নিশ্চল পাষাণ। পাশের লোকটি বয়সে প্রৌঢ়। পরনে ধুতি, গায়ে চাদর জড়ানো আষ্টেপৃষ্ঠে। মিঃ গুপ্ত লাফ দিয়ে চত্বরে উঠতেই সে হাউমাউ করে পায়ে জড়িয়ে ধরল।…..আমার কোনো দোষ নাই স্যার। মলয়বাবু আমাকে এই প্যাকেটটা পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। পাঁচটা টাকা মজুরি স্যার…..বাবা গো! বুটের লাথি খেয়ে চুপ করল।
উত্তরপ্রান্ত ঘুরে সবাই এল প্যালেস-হোটেলে।
ডাইনিং হলের দরজা খোলা হল। বাবুর্চি-ঠাকুররা সবাইকে জাগাতে হল। হিটার জ্বেলে চা-কফির আয়োজন। উত্তেজনা এসে বেচারাদের বিরক্তি দূর করেছে। ওপরে সবার ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণের মধ্যে। প্রতিটি ঘরের দরজা গেছে খুলে। সবগুলো আলো জ্বলছে প্যালেসহোটেলে। সামনাসামনি গঙ্গার ওপারে যে গ্রাম–সেখানে। গ্রামবাসীরা জেগে থাকলে তাদের চোখে বড় বিচিত্র দৃশ্য ভাসত।
প্রথমে দৌড়ে এল ইরা বোস। স্বামীর দিকে দৌড়ে যেতেই একজন সেপাই বাধা দিল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। থামে হেলান দিল। চীনা তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। এসেছে দিব্যেন্দু, স্বাতী, স্বাতীর মা এবং অধ্যাপক-দম্পতিও। দেবতোষের মুখটা গম্ভীর। সুদেষ্ণা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন দীপেন বোসের দিকে। তার দুপাশে মিঃ গুপ্ত আর ভদ্র। পিছনে আরও কয়েকজন অফিসার। সামান্য দূরে বসেছেন কর্নেল আর বিভাস। সুরঞ্জন কিচেনে ব্যস্ততা তুলেছে।
দীপেনের টেবিলে সেই প্যাকেটটা খোলা হয়েছে। অবিশ্বাস্য একরাশ সোনার বাট। বিদেশি ছাপ মারা। স্মাগল গোল্ড। পূর্ব-সীমান্ত থেকে প্যাকেটটা বয়ে এনেছিল দীপশ্রী স্টোর্সের মালিক। বরাবর এই কারবার চলে আসছে। সোনার বদলে এখান থেকে যায় ঘড়ির পার্টস কেমিক্যাল দ্রব্যাদি, নারকোটিক্স-কত কী!
সত্যজিৎ গুপ্ত একটু কেশে বললেন, কেসের এই দিকটা আমি অবশ্য ভাবিনি–যদিও মনে হয়েছিল, ডোবা ইজ দি ওনলি ভাইটাল পয়েন্ট! বেচারা নীরেনের জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে। কিন্তু অবস্থা বা প্রমাণের কাছে আমি তো অসহায়। কী করতে পারি! কেসের মডুস অপারেন্ডি আমায় এখন পুরো নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। যেসব পয়েন্ট পরিষ্কার হচ্ছিল না, এখন তা পরিষ্কার। আর কোনো অসুবিধে নেই। গোড়া থেকেই একটা ব্যাপার আমায় ভাবাচ্ছিল। নীরেন একজন। সুশিক্ষিত বুদ্ধিমান ছেলে। কিন্তু অত বোকার মতো কাজ করল কেন? সে পয়েন্ট এখন ক্লিয়ার। আঁধারমহলের একজন চতুর্থ ব্যক্তি থাকা যুক্তির দিক থেকে বাঞ্ছনীয়। সেই হচ্ছে খুনি।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, কে সেই চতুর্থ ব্যক্তি, আশা করি এতক্ষণে পরিষ্কার হয়েছে।
সারটেনলি। মিঃ গুপ্ত টেবিলে থাপ্পড় মারলেন।…গোড়া থেকে ব্যাপারটা সাজানো যাক। একদল ছেলেমেয়ে এখানে বেড়াতে এল। হোটেলে উঠল। সেই হোটেলে কিছু অদ্ভুত চুরি ঘটতে থাকল–যা ভৌতিক উপদ্রব মনে হতে পারে। বিশেষ করে শেষ অবধি চুল কাটার ঘটনা। এর অর্থ ছিল একটাই। বোর্ডারদের ভয় দেখানো অর্থাৎ যেন হোটেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। লক্ষ করুন দীপেন এসেছে সাত তারিখে সন্ধ্যায়। তারপর এসব ঘটতে শুরু হয়েছে।
ইরা ফোঁস করে উঠল। আমরা আসবার অনেক আগে কল্পনার টুথব্রাশ হারিয়েছিল। আমরা আসার পর ম্যানেজার বলল, একটু সাবধানে রাখবেন। জিনিসপত্র। ম্যানেজার, ম্যানেজারবাবু! ইরা সাক্ষী মানতে সুরঞ্জনকে ডাকছিল।
মিঃ গুপ্ত মুচকি হেসে বললেন, ওয়েট ওয়েট। টুথ ব্রাশটা ছোট জিনিস। ইঁদুর বেড়ালে নিয়ে যেতে পারে।
চীনা কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করল, কিন্তু কর্নেলের চোখের দিকে তাকিয়ে নিরস্ত হল।
গুপ্ত বললেন, যেই হোক। ধরে নিচ্ছি, ওই টুথব্রাশ হারানোর খবরই দীপেন বোসের মাথায় একটা আইডিয়া এনে দিল। ইজ ইট ই লজিকাল কর্নেল?
কর্নেল মাথা দোলালেন।
সে কাজ শুরু করল সঙ্গে সঙ্গে। তার স্ত্রীও যে স্বামীকে সাহায্য করেনি, এটা অসম্ভব। চুল কাটার ঘটনা লক্ষ করুন। অন্যের চুল কাটার রিস্ক আছে–যদিও অন্যের অলক্ষে জিনিসপত্র চুরি করা সহজ। তার আগে আট তারিখের সকাল থেকে রাত্রি অবধি ঘটনাগুলো বিচার করা যাক। মোতিঝিলের মসজিদের দেয়ালে লেখা কবিতাটা আশা করি আপনাদের মনে আছে। আমাদের একম্পার্ট প্রমাণ করেছেন, ও হস্তাক্ষর শুভরই।
ইরা হুড়মুড় করে বলে ফেলল, শুভ আমার সঙ্গে গিয়ে আমার সামনেই ওটা লিখেছিল। বলেছিল, কাকেও বলবেন না। বেশ জমিয়ে তুলব এবার।
মিঃ গুপ্ত বললেন, আর আপনি আপনার স্বামীর কানে কথাটা তুলে দিলেন। ব্যস, অমনি সে সতর্ক হয়ে ভাবল, তাহলে কি ওরা আমার প্ল্যান টের পেয়ে গেছে? এমন কী ওই তারিখ রাত্রিবেলা দীপেন বোস জঙ্গলে ডোবার কাছে কোথাও শুভ আর কল্পনার সামনে পড়ে যায়। ফলে তাকে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয়েছিল!
ইরা বাধা দিল।……আমি কিছু বলিনি। খোঁজাকবরখানার গেটে দাঁড়িয়ে শুভ নিজেই সব বলছিল। জিগ্যেস করুন না চীনাদিকে।
এনিওয়ে! গুপ্ত হাত তুললেন।……সে সতর্ক হয়েছিল। কিন্তু কথামতো ডোবায় যাবার সময় বাধা পেয়ে ক্ষেপে গেল দুজনের ওপর। ওরা যখন জেনেছে, আরও রটে গেলে সর্বনাশ হবে। কাজেই দুটিকেই সাবাড় করতে হবে। সে সুযোগ খুঁজতে থাকল। নয় তারিখ সকালে দিব্যেন্দু-স্বাতী-কল্পনার ঝগড়াঝাটির খবর হোটেলেই সবাই জেনেছিল। কল্পনা-শুভর রাত্রে উধাও হওয়া নিয়ে কানাকানি চলছিল। আমার ধারণা, নীরেন যে কল্পনার ব্যাপারে বেশি তৎপর, সে জেনে থাকবে। ন তারিখ ভোরে নীরেনকে থামের আড়ালে দাঁড়াতে দেখেছিল সে। তখন সুইমিং পুলের ওখানে কল্পনা-শুভ বেড়াচ্ছিল। তারপর সে সুযোগ খুঁজতে থাকল। নীরেন-শুভ-বিভাস বেরিয়ে যেতেই সে হয়তো খিড়কির দরজা দিয়ে নেমেছিল নিচে।
দীপেন গজগজ করল।……কোনো প্রমাণ নেই।
কান করলেন না মিঃ গুপ্ত।…বাগানে ঢুকেই লাকিলি সে পেয়ে যায় কল্পনাকে। অভাবিত সুযোগ। প্রশ্ন উঠবে, কল্পনা ওখানে কী করছিল?…..কল্পনা যে ওপথে নিচে নেমেছিল, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি কর্নেলের কাছে–বয় শম্ভুর কাছে। তাঁরা ওকে দেখেছিলেন। কিন্তু কল্পনার উদ্দেশ্যটা আপাতত জানা যাচ্ছে না।
কর্নেল পকেট থেকে আচমকা একটা লেডিজ হাতঘড়ি বের করে টেবিলে এগিয়ে দিলেন। বললেন, কল্পনা সম্ভবত এই ঘড়িটা খুঁজতে গিয়েছিল। ঘড়িটা রাত্রে দৌড়নোর সময় আছাড় খেয়ে হাত থেকে খুলে গিয়ে থাকবে। টাইম ইনডিকেশন ইজ জাস্ট টেন থারটিফাইভ। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম, এটা সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ-কল্পনার খুন হবার সময়! কিন্তু তা নয়, সেটা পরে বুঝলাম।
বাঘের মতো থাবা বাড়িয়ে ঘড়িটা নিলে মিঃ গুপ্ত। উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, এ ঘড়ি আপনি কোথায় পেলেন?
আজ সকালে এই ঘরে। দীপেনবাবুর পায়ের কাছে পড়েছিল।
আই সি! বলে মিঃ গুপ্ত দীপেনের মুখটা একবার দেখে দিলেন। দীপেন প্রতিবাদ করল, ও ঘড়ি আমি দেখিনি।
মিঃ গুপ্ত বললেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বাঘের সামনে শিকার নিজে থেকেই এসে গিয়েছিল। কল্পনাকে খুন করে সে ঝোপে কোথাও লুকিয়ে রাখে। তারপর চলে যায় শুভদের উদ্দেশে আঁধারমহলে গিয়ে কীভাবে শুভকে খুন করল সবার অলক্ষে–এটাই আপাতত ধাঁধা।
কর্নেল বললেন, সেও ধাঁধা নয়। আরমানি গির্জার গাইড আমায় আজ বলেছে, কে একজন সেই সময় ওখানে গিয়েছিল। তাকে পাঁচটাকা বখশিশ দিয়ে তার ওখানে থাকার কথা তাকেও বলতে নিষেধ করেছিল। তারপর….
মিঃ গুপ্ত ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন, প্লিজ কর্নেল। পরে শুনব।
কর্নেল হেসে উঠলেন।…লোকটার চোখে ভিউ ফাইন্ডার ছিল।
দীপেন বোস বলল, আমার কোনো ভিউ ফাইন্ডার নেই।
দেবতোষও শশব্যস্তে বলে উঠলেন, আমারও নেই কিন্তু।
দিব্যেন্দু একটু কেশে বলল, আমার একটা ছিল। সেটা আজ সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। সকালে জেরার সময় মিঃ গুপ্তকে সেকথা বলেছি।
ইয়েস। মিঃ গুপ্ত সায় দিলেন।
কর্নেল বললেন, শুভকে খুন করার সময় ধস্তাধস্তিতে সেটা ভেঙে যায়। প্রায় সবগুলো টুকরো খুনি কুড়িয়ে বাইরে কোথাও ফেলেছিল। শুধু ফাটলে কিছু রয়ে যায়। এই দেখুন।
পকেট থেকে মোড়ক বের করতেই গুপ্ত সেটা হাতিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, খুনি দীপেন বোস চলে এল কাজ সেরে। এখন দোষ চাপাতে হবে কারো কাঁধে। সে এমন লোক খুঁজল যার স্পষ্ট মোটিভ রয়েছে। এমন লোক রয়েছে মাত্র দুজন। নীরেন পালিত আর দিব্যেন্দু চৌধুরী। দিব্যেন্দু বলিষ্ঠ খেলোয়াড় ছেলে। কিন্তু তার অ্যালিবাই প্রত্যক্ষ–সে প্রায় সারাক্ষণ স্বাতীর কাছে রয়েছে। এদিকে নীরেনের ব্যাকগ্রাউন্ডও তার জানা–আমরাও সেটা আজ জেনেছি–সে খুনে মাস্তানটাইপ যুবক। সবচেয়ে মস্ত পয়েন্ট, সে শুভর সঙ্গে বেড়াতে গেছে। ব্যস! দীপেন বোস সন্ধ্যার পর আরও সুযোগ পেল। সবাই শুভ-কল্পনার উধাও হওয়া নিয়ে মশগুল। নিচে ডাইনিং হলে রয়েছে। সে তিনটে কাজ করল পর-পর। একটা হল, ডুপ্লিকেট চাবির সাহায্যে নীরেনের ঘর খুলে চাদর চুরি। পরেরটা হল সেই চাদর নিয়ে খিড়কি-পথে বাগানে গিয়ে কল্পনার লাশটা তাতে জড়িয়ে চীনার ঘরে পৌঁছে দেওয়া। তিন নম্বর হচ্ছে, রক্ত মাখিয়ে চাদরটা অধ্যাপকের ঘরে পাচার।……
সুদেষ্ণা কী বলতে যাচ্ছিল, কর্নেল হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে বললেন, মিসেস ব্যানার্জি তখন একা ছিলেন ঘরে। উনি কাকে ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেনও। সকালে চাদরটা পাওয়া গেল খাটের নিচে। ওঁরা বোকার মতো সেটা ওই জানালা গলিয়ে ফেলতে গেলেন।
সুদেষ্ণা সায় দিয়ে বলল হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু…..
কর্নেল তাকে থামালেন ফের।…..মিঃ গুপ্ত, তারপর কী হল বলুন?
আড়ামোড়া দিয়ে সত্যজিৎ গুপ্ত হাসতে হাসতে বললেন, আর কী। তামাম শোধ। দি এন্ড! দীপেন বোস নীরেনকে ফাঁদে ফেলে নেকস্ট প্ল্যান করেছিল আজ রাত্রে। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য!
কর্নেল মিটিমিটি হাসছিলেন। তাহলে নীরেনকে ছেড়ে দিচ্ছেন?
সারটেনলি।
দীপেন বোসের বিরুদ্ধে চার্জ আনছেন?
হোয়াই নট?
.
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, একটা কথা মিঃ গুপ্ত। আপনারাও শুনুন। দীপেন বোস গোল্ড স্মাগলার–এটা প্রত্যক্ষ। সে হাতেনাতে। ধরাও পড়েছে এবং এটা খুবই সত্য যে ওই ডোবা-প্রসঙ্গই ছিল এ কেসের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। একজন স্মাগলার তার নিরাপত্তার জন্য খুন করতে পিছপা হয় না–তাও অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমরা জানি, যা প্রতীয়মান তাই বাস্তব নয়। দুটো ঘটনার মধ্যে যতই যোগসূত্র থাক, কারণ যে একটাই থাকবে, তার মানে নেই। প্রখ্যাত কাকতালীয় যযাগের কথা আমরা জানি।…..
হলসুদ্ধ লোক রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছে কর্নেলের দিকে দূরে ঘন্টাঘড়ি বাজল এগারোবার। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ফের বলতে থাকলেন।……লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন!….
.
১৫.
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার শুরু করলেন।……
……কোনো হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমি যে তদন্ত পদ্ধতির পক্ষপাতী, আগে সেটা স্পষ্ট না করলে আপনারা আমার কোনো কথাই বুঝতে পারবেন না। তাই দিয়ে শুরু করছি।
..প্রতিটি মানুষের জীবনে দুটি আলাদা-আলাদা ক্ষেত্র আছে। একটি হচ্ছে তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ক্ষেত্র, অন্যটি তার পারিবারিক ক্ষেত্র। অর্থাৎ মানুষ একই সঙ্গে দুই জগতের বাসিন্দা। দুটি ব্যাকগ্রাউন্ডে তার গতিবিধি।
……তাই যখনই কোনো মানুষ খুন হয়, আমার পদ্ধতি বলে–অদৃশ্য খুনির পিছনে দৌড় দিও না, খুন হওয়া মানুষটির ব্যাকগ্রাউন্ড খোঁজো। সেখানেই খুনিকে পাওয়া যাবে। এবং এই ব্যাকগ্রাউন্ড দুটো।
…আমি হতভাগিনী কল্পনার কথায় আসছি। সে খুন হয়েছে। সুতরাং আমাদের দেখতে হবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড কী। প্রথমে ধরুন, তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা। কিছুটা স্বাতীর এবং অনেকটা স্বাতীর মায়ের কাছে আমি তার বর্ণনা পেয়েছি। স্বাতীর বাবা নিশিকান্ত রায় ছিলেন ধনী মানুষ। আনুষঙ্গিক চরিত্রগত দোষ তার বিস্তর ছিল। তাসত্ত্বেও মানুষটি হৃদয়বান ছিলেন সন্দেহ নেই। মৃত্যুর আগে স্বাতীর মায়ের কাছে একটি শিশুর খোঁজ দিয়ে যান–সে তখন তাঁর বিধবা দিদির কাছে পালিত হচ্ছে। নিশিকান্ত সে শিশুটির নামেও তার সম্পত্তির একটা বিশেষ অংশ রেখে গেছেন, স্বাতীর মা তখনও জানতেন না। যাই হোক, সাধ্বী স্ত্রী তার স্বামীর ইচ্ছেমতো শিশুটিকে নিয়ে এলেন এবং লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন। সেই শিশু আমাদের কল্পনা। কল্পনার চেহারা ও আচরণে কিছু ছিল। স্বাতীর মা তার প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে। পড়লেন। এমনকী নিজের মেয়ের প্রতিও অমনোযোগী দেখা গেল তাঁকে। বিষবৃক্ষের বীজ তখন রোপিত হল। স্বাতী স্বভাবত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ল কল্পনার প্রতি। সে মায়ের চোখের আড়ালে কল্পনাকে কষ্ট দিত বা উত্ত্যক্ত করত নানাভাবে। এমনকী একদিন ধাক্কা মেরে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে ফেলে দিয়েছিল। খুব অল্পের জন্যে বেঁচে যায় কল্পনা। তাছাড়া স্বাতীর চেয়ে কল্পনার চেহারা সুন্দর, স্বভাব মিষ্টি। স্বাতীর গড়নে ও স্বভাবে পুরুষালি রক্ষতা আছে। সবাই কল্পনার অনুরাগী, স্বাতীর নয়। প্রকৃতির নিয়মে স্বাতীর এই গূঢ় অন্তঃপ্রক্ষোভ বহির্জগতে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করল। সে কৃতী খেলোয়াড় হয়ে উঠল। আপনারা শুনলে অবাক হবেন, আমাদের সামনে যে স্বাতী উপস্থিত–সে খেলাধুলোর প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দক্ষ। সাঁতার, দৌড়, লাফ থেকে। শুরু করে তির বর্শা-রাইফেল ছোঁড়া, তলোয়ার চালনা–সব বিষয়ে তার খ্যাতি আছে।…..হলের সকলে স্বাতীর দিকে তাকল। স্বাতী চোখ নামিয়ে নখ খুঁটতে থাকল।
…..কল্পনার পারিবারিক জীবনের কথা বলতে গেলেই স্বাতীর প্রসঙ্গ অনিবার্য। স্বাতী তার সঙ্গে এক্ষেত্রে দুচ্ছেদ্য। স্বাতীর বহির্মুখীনতা কিন্তু তবু স্বাতীকে সেই ঈর্ষা ভুলতে দিল না। ওরা যুবতী হয়ে উঠছিল। স্বাতীর সঙ্গে বহু যুবকের মেলামেশার সুযোগ ঘটছিল। কিন্তু স্বাতীর বাড়ি আসবার সুযোগ পেলেই পরিণামে দেখা গেছে, তারা সবাই কল্পনার অনুরাগী হয়ে উঠেছে। স্বাতী অক্ষম ক্রোধে ছটফট করেছে নিরন্তর। শুনেছি, কোনো কোনো বিষাক্ত সাপ এমনি ক্রোধে নিজের লেজ দংশন করে। নিজেকে দংশন করেছে স্বাতী। একটা উদাহরণ দিই। কল্পনাকে মডার্ন গার্ল করে তুলবার অজুহাতে সেই শুভ বা নীরেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। স্বাতী সম্ভবত দূর থেকে ওদের মেলামেশা প্রত্যক্ষ করে নিজের ক্ষতস্থান খুঁটে রক্তপাতের অদ্ভুত সুখ পেত। কিন্তু সবচেয়ে আঘাত বেশি বাজল তার, যখন মাত্র মাসখানেক আগে সে মায়ের কাছে জানতে পারল যে কল্পনা ঠিক তার সমান সম্পত্তির মালিক! স্বাতীর মাও অবাক হয়েছিলেন। স্বাতীর আঠারো বছর পূর্ণ হলে নিশিকান্তবাবুর অ্যাটনি কথামতো উইল সমর্পণ করেছিলেন ওঁর কাছে। ব্যস, স্বাতী চরম আঘাত হানতে প্রস্তুত হল।……
হলে অস্ফুট গুঞ্জন শুরু হল। কর্নেল চুপ করেছেন। রুদ্ধশ্বাসে মিঃ গুপ্ত বলে উঠলেন, তাহলে স্বাতী ইজ দা মার্ডারার?
কর্নেল মৃদু হেসে হাত তুললেন।….লেট মি ফিনিশ প্লিজ। এবার দিব্যেন্দুর প্রসঙ্গে আসছি। কল্পনার ব্যাকগ্রাউন্ড স্পষ্ট করতে তাকেও আমাদের দরকার। দিব্যেন্দু নিশিকান্তবাবু ফার্মের এক কর্মচারীর ছেলে। দারিদ্রের মধ্যে সে মানুষ হয়েছে। নিশিকান্তবাবুর মৃত্যুর আগে থেকে সে স্বাতীদের বাড়ি যাতায়াত করত। স্বাতীর সঙ্গে তার একটা দিকে দারুণ মিল। সেও নিপুণ খেলোয়াড়। স্বাতী তার প্রেমে পড়ল খুব স্বাভাবিক নিয়মে নয়; কল্পনার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে। কল্পনাকে সে দেখাতে চাইল, তারও প্রেমিক রয়েছে। যে প্রেমিক সুপুরুষ, বলিষ্ঠ, খ্যাতিমান। এদিকে প্রেমের দেবতার দুষ্টুমি; একদা স্বাতী সত্যি সিত্য গভীর প্রেমে আসক্ত হল দিব্যেন্দুর।
….দিব্যেন্দু কিন্তু মনে মনে কল্পনারই অনুরাগী। দিব্যেন্দু উচ্চাকাঙ্ক্ষী। জীবনে শুধু মানের প্রতিষ্ঠা চায় না, চায় ধনের প্রতিষ্ঠাও। তাই সে দ্বন্দ্বে ভুগছিল–সে কল্পনাকে ভালোবাসে, কিন্তু কল্পনা নিতান্ত আশ্রিত মেয়ে। তাকে পেলে ধনের আশা নিষ্ফল। তারপর হঠাৎ একদিন সে যখন জানল, না-কল্পনাও স্বাতীর সমান সম্পত্তির মালিক তখন মনে মনে প্রস্তুত হল। স্বাতীর বর্তমানে কল্পনাকে পাওয়া বেশ কঠিন–তাছাড়া তার মাও চটে যাবেন। পাত্র হিসেবে ততদিনে দিব্যেন্দুকে স্বাতীর জন্যে তিনি নির্বাচিত করেছেন।
…..অবশ্য তাতেও পার পাওয়া যেত। কিন্তু মুশকিল বাধল উইলের শর্ত নিয়ে। নিশিকান্ত বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তিনি জানতেন, স্বাতী-কল্পনা বিরাট সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী জানলে বহু চতুর অজগর চোখে মায়া নিয়ে অগ্রসর হবে। তাছাড়া নিশিকান্ত সেকেলেপন্থী। এদিকে স্ত্রীর প্রতিও তার আস্থা ছিল গভীর। উইলে শর্ত রইল যে তাঁর স্ত্রীর নির্বাচিত পাত্রের সঙ্গে স্বাতী বা কল্পনার সামাজিক বিয়ে সুসম্পন্ন হলে তবেই ওরা তার সম্পত্তি পাবে। নয়ত সে সম্পত্তি যাবে তার স্ত্রীর অধিকারে। স্ত্রীর অবর্তমানে তা যাবে কোনো এক বিশেষ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের হাতে। স্বাতী-কল্পনার বিয়ের আগে তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে পাত্র নির্বাচন করবেন তার অ্যাটর্নি বন্ধু পরমেশ চাকলাদার।…উইলে আরও একটা উল্লেখযোগ্য শর্ত রয়েছে। বিয়ের। আগে স্বাতীর মৃত্যু হলে কল্পনা, কল্পনার মৃত্যু হলে স্বাতী এবং উভয়ের মৃত্যু হলে স্বাতীর মা তাদের সম্পত্তি পাবেন।……
মিঃ গুপ্ত মন্তব্য করলেন, পিকিউলিয়ার! বড্ড গোলমেলে দলিল!
কর্নেল বললেন, অতি সাবধানী বিষয়ী মানুষের পক্ষে এই উইল খুব স্বাভাবিক বলে মনে করি আমি। যাই হোক, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আশা করি পরিষ্কার হয়েছে। বলেছি স্বাতী চরম আঘাত হানতে প্রস্তুত হল। এবার সে কথায় আসছি। স্বাতী মনে মনে ষড়যন্ত্র করল। শুভ আর নীরেনের সঙ্গে কল্পনার কিছু মাখামাখি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে–অবশ্য কল্পনা তখনও তার হীনমন্যতার দরুন বেশ আড়ষ্ট। স্বাতী চাইল, ইত্যবসরে বাইরে কোথাও কল্পনাকে নিয়ে যাওয়া যাক–যেখানে শুভ-নীরেন দুজনেই সঙ্গে থাকবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ দেবে স্বাতী–যাতে কল্পনা ওদের একজনকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। মজার কথা, শুভ আর নীরেন–দুজনেই সাধারণ পরিবারের ছেলে। স্বাতীর মা পাত্র হিসেবে দুজনকেই দারুণ অপছন্দ করেন, সে জানত। তার ফলে কল্পনা সম্পত্তি হারাবে।……অবশেষে স্বাতী তার দলবল নিয়ে মুর্শিদাবাদ এল। এ প্রমোদযাত্রার সব খরচ তার।
….এবার তাহলে আমরা প্যালেস হোটেল অবধি পৌঁছে গেছি। কল্পনা-স্বাতী-দিব্যেন্দু-নীরেন-শুভ-অবশেষে বিভাস-বড় চমৎকার মেলামেশা। অপর্যাপ্ত সুযোগ। কিন্তু মানুষের মন বড় আজব জিনিস! প্রকৃতির খুব কাছে এসে এই দায়িত্বহীন নিঃসংকোচ পরিবেশে কল্পনা হঠাৎ বদলে গেল। তার আড়ষ্টতা কেটে গেল। সে রীতিমতো ফ্লার্টি শুরু করল। ব্যস, স্বাতী সঙ্গে সঙ্গে হতবুদ্ধি। সেই প্রাচীন। নিষ্ঠুর ঈর্ষাবোধ আরেক বিচিত্র চেহারায় তাকে গ্রাস করল। সে সইতে পারছিল না শুভ-নীরেন–এমন কী তার দিব্যেন্দুও কল্পনার গ্রাসে নিক্ষিপ্ত হবে! এ ঈর্ষা নারী। হৃদয়ে স্বাভাবিক ঈর্ষা। সে যা চেয়েছিল, তা সত্যি সত্যি ঘটতে দেখল যখন, অবস্থা দুঃসহ হল তার কাছে। কল্পনা শুভ বা নীরেনকে বিয়ে করে বসলে সম্পত্তি হারাবে ঠিকই, কিন্তু তাতে যেন স্বাতীরও বড্ড হার হবে। সে তখন কল্পনার গার্জেনের ভূমিকা নিল। অসহায় স্বাতীর পক্ষে এই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সবচেয়ে আঘাত লাগল তখন, যখন আট তারিখে মোতিঝিলের বটতলায় দিব্যেন্দুর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় সে দেখল কল্পনাকে। আগুন জ্বলে উঠল মগজে।… কিন্তু না, স্বাতী তার জন্যে কল্পনাকে হত্যা করার কথা ভাবেনি। সে এখান থেকে তাকে নিয়ে পালাতে চাইছিল। নয় তারিখেই সে পাততাড়ি গোটাত। কিন্তু হাঁটুর ব্যথা, দিব্যেন্দুর জেদ, তারপর কল্পনা সকাল থেকে উধাও……স্বাতীর যাওয়া হল না সেদিন।…..
মিঃ গুপ্ত বললেন, আট তারিখ রাত্রে শুভ আর কল্পনা হোটেলের বাইরে কাটিয়েছিল কয়েক ঘণ্টা।
কর্নেল জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তাতেও একই প্রতিক্রিয়া স্বাতীর মনে। অর্থাৎ কল্পনা সত্যি এবার বাজি জিতে নিয়েছে। দিব্যেন্দু হোক, শুভ হোক বা নীরেন হোক–স্বাতীর কাছে তখন সবই এক। তবে দিব্যেন্দুর সঙ্গে কল্পনা উধাও হলে সে বেশি আঘাত পেত, এই যা।
……যাই হোক। এবার আমরা আসছি হোটেলের কিছু অদ্ভুত ঘটনার প্রসঙ্গে। চীনা মিত্র আমায় একটা কথা বলেছিল। অন্যমনস্কা মায়ের মনোযোগ আকর্ষণের জন্যে উপেক্ষিত শিশু অনেক সময় কিছু অদ্ভুত কাজ করে বসে। গৃহস্থালীর নানা জিনিস বিশৃঙ্খল করে। যেমন ধরুন, হাতের কাছে খুন্তিটা মেলে না–দেখা গেল সেটা রয়েছে কাপড়ের বাক্সে। অফ কোর্স, এটা শিশু-মনস্তত্ত্বের ব্যাপার। কিন্তু অনেক বয়স্ক মানুষের মধ্যেও শিশু-মনস্তত্ত্ব রয়ে গেছে। প্রথমে ঘটল কল্পনার টুথব্রাশ চুরির ঘটনা। টুথব্রাশটা অবশেষে দেখা গেল চীনা মিত্রের ব্যাগের মধ্যে রয়েছে। এটা ইঁদুর-বেড়ালের কীর্তি নয়, মানুষেরই। এই হোটেলে একজোড়া ডিভোর্সড স্বামী ও স্ত্রী বাস করছে। অবশ্য কন্ডিশানাল ডিভোর্স। আর এক মাস পরেই তাদের লিগ্যাল সেপারেশনের কাল শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে যদি তাদের মিলমিশ না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে আইনত চরম ডিভোর্স চুকে যাবে। মজার কথা, সেই ক্ষুব্ধ কিন্তু আশাবাদী স্বামী করলেন কী, ক্ষুব্ধ কিন্তু হতাশ স্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে নিজের টুথব্রাশটি স্ত্রীর ব্যাগে পাচার করলেন। কিন্তু পরে বিলক্ষণ লজ্জা পেলেন, সাহসেরও অভাব ঘটল–ভাবলেন এতে যদি স্ত্রী আরও চটে যান, আশা নির্মূল হবে। সুতরাং তিনি চট করে কল্পনার টুথব্রাশটি সরিয়ে ফেললেন সুযোগ মতো। বিভাসবাবু! আশা করি, সমর্থন করছেন।
বিভাস সলজ্জ মুখে বলল, হ্যাঁ স্যার। কল্পনার ব্রাশটা এখনও আমার কাছে লুকানো রয়েছে।
চীনা মিত্র ফোঁস করে উঠল, বা রে! অদ্ভুত লোক তো!
কর্নেল শুরু করলেন।……এর পর যা সব হারাল, স্বাতীর কেডস বা ইরা বোসের চুল–সব কিন্তু এমনি পৃথক-পৃথক ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপ। খুলে বলি, স্বাতী কেডস পায়ে দিয়ে সুদেষ্ণা দেবীর ঘরে ঢুকেছিলেন। উনি তখন পুজোয় বসেছেন। এটা সাত তারিখ সন্ধ্যার ঘটনা। স্বাতী হয়তো নিতান্ত কৌতূহলী হয়েই গিয়েছিলেন ওঘরে….
স্বাতী মুখ তুলল এতক্ষণে। মৃদুকণ্ঠে বলল, কল্পনাকে খুঁজছিলাম।
…..যাই হোক, সুদেষ্ণা ভীষণ চটে গেলেন এবং সুযোগমতো ও কর্মটি করলেন। বিভাসকে তিনি সইতে পারছিলেন না। কারণ তাঁর স্বামীর আদরের ভাইপো দুলাল। চেহারায় বা চালচলনে অবিকল বিভাসের মতো। তাই বিভাসের বাথটবেই জুতোটা ডুবিয়ে রাখলেন মিসেস ব্যানার্জি।
সুদেষ্ণা নাক-মুখ সিঁটকে বললে, বেশ করেছি!
অস্পষ্ট হাসির গুঞ্জন উঠল ঘরে। কর্নেল বলতে থাকলেন।…এর পর ঘটে চুল কাটার ঘটনা। একাজ নীরেনের। সে আট তারিখ সন্ধ্যায় ইলেকটিরি ফেলের সময় একটু দুষ্টুমি করতে চেয়েছিল সুদেষ্ণার সঙ্গে। কিন্তু অন্ধকারে ভুল করে চুপি-চুপি পর্দা তুলে অবাক হল। ইরা বোসের ঘর! সে আরও অবাক হল, ইরা মোমবাতির আলোয় চুলের ঝাঁপি খুলেছে। তার মাথাজোড়া টাক। ইরা তন্ময় হয়ে চুল গোছাচ্ছিল। ব্যস, নীরেন পিছন থেকে ফুঁ দিয়ে একসঙ্গে মোমবাতি নিভাল এবং একগোছা চুল কেটে ফেলল। ইরা ওকে ভূত ভেবে দৌড়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কিছু গোপন রেখে কিছু বলল স্বাতীদের কাছে।……
ইরা বোস গর্জে উঠল, গুন্ডা, মস্তান! ইতর কোথাকার!
সুদেষ্ণাও জের টানল।….আমি হলে আঁতুড় ঘরে গলায় নুন ঢেলে মারতাম।
কর্নেল বললেন,…তারপর ছবি চুরি। চীনার ছবিটি চুরি করেছিল যে, সেই কল্পনার খুনি। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সুদেষ্ণার গুরুদেবের ছবিও সে চুরি করেছিল। কারণ সে জানত, সুদেষ্ণা হিস্টিরিয়ার রোগী এবং গুরু অন্ত প্রাণা। এবং সে আরও জানত, অধ্যাপক দেবতোষ ব্যানার্জি একটা প্রাচীন নবাবি দলিল হাতাতে ব্যস্ত। সুদেষ্ণার রোগ বেড়ে যাবে ছবি চুরির ফলে এবং ফিট হয়ে পড়ে থাকবেন তিনি। সেই সুযোগে খুনের কিছু চিহ্ন তার ঘরে পাচার করতে পারবে একেবারে দিনদুপুরেই। দেবতোষ দলিলের ব্যাপার গোপন রাখবার জন্যে এই খুন করেছেন–সেটা সে যেভাবে হোক প্রতিপন্ন করবেই, এই ছিল তার স্কিম। এই সঙ্গে। শুভ-কল্পনার ব্যাপার জড়িয়ে ছিল। শুভর সেই অদ্ভুত কবিতা, মধ্যরাত, ডোবা, শুভ-কল্পনার মধ্যরাত্রে অন্তর্ধান–সব মিলিয়ে দোষ পড়বে অধ্যাপকেরই কাঁধে। খুনের একটা সঙ্গত পটভূমি এবং মোটিভ মিলবে এতে।……
….কিন্তু একটা ক্রুটি ঘটল। ছবিটা তার ঘরেই হঠাৎ আবিষ্কার করল স্বাতী। সঙ্গে সঙ্গে সে কিছু না বলেই ফেরত দিতে গেল যথাস্থানে। সুদেষ্ণা তখন অচৈতন্য, দেবতোষ তাঁর পরিচর্যায় ব্যস্ত। সুযোগ পেল না সে। তখন মানদার শরণাপন্ন হল। ঝি মানদা কোনো এক ফাঁকে রেখে এল অধ্যাপকের ব্যাগে।
…এদিকে এ ছবিটা হাতছুট হওয়াতে খুনি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় ছবি অর্থাৎ চীনারটা সে এমন জায়গায় লুকোল–এটা আমার অনুমান অবশ্য, স্বাতী তার খোঁজ পাবে না। স্বাতী নিশ্চয় অবাক হয়েছিল। কিন্তু সে ভেবেছিল, এটা নিতান্ত দুষ্টুমি।
মিঃ গুপ্ত অধৈর্য হয়ে বললেন, এবার খুনির কথায় আসুন কর্নেল।
কর্নেল বললেন, ইয়েস! এসে পড়েছি। তবে শুধু মনে রাখবেন, দীপেন বোস বা তার গোল্ড স্মাগলিং আজ রাত দশটা অবধি আউট অফ পিকচার ছিল। কেউ এ ব্যাপার জানত না ঘুণাক্ষরেও। কিন্তু এটা ঠিক–একই ডোবার ধারে প্রফেসর বা দীপেন বোসের কারবার। প্রফেসর ভয় পেয়ে চেষ্টা ছাড়লেন। কারণ শুভ পদ্যফদ্য লিখে ছাত্রোচিতভেঁপোমি শুরু করল। কিন্তু দীপেন বোস দেখল, সে নিরাপদ। অবশ্য সে শেষরক্ষা করতে পারল না, এই যা দুঃখ……হেসে উঠলেন কর্নেল।
…..লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! খুনির প্রথম লক্ষ্য ছিল কিন্তু স্বাতী।
সবাই চমকে উঠেছে সঙ্গে-সঙ্গে। স্বাতী সোজা হয়ে বসেছে।
..হ্যাঁ। প্রথম চেষ্টা করল সে স্বাতীর ওপর। কিন্তু সে জানত, স্বাতী শক্তিমতী মেয়ে। গায়ের জোরে তাকে পারা কঠিন। অন্য প্রক্রিয়া–যথা স্ট্যাবিং বা থ্রোট কাট কিংবা অগত্যা পয়েজনিং করারও যথেষ্ট ঝক্কি রয়েছে। সুতরাং সে স্বাভাবিক কিন্তু অদ্ভুত একটা উপায় খুঁজল। সাত তারিখ সন্ধ্যায় স্বাতী যখন সবে সিঁড়িতে পা বাড়াতে যাচ্ছে। পিছন থেকে কলার খোসা ছুঁড়ে মারল। স্বাতী পা পিছলে গড়িয়ে পড়ল। খুনির উদ্দেশ্য ছিল, তাকে ওঠানোর ছলে গলা টিপে ধরবে কিংবা…..
…হ্যাঁ, এখানে যদিও গায়ের জোরের প্রশ্ন আসছে–আপনারা ভুলবেন না, মানুষ যত শক্তিমানই হোক, আকস্মিক পতনের মুহূর্তে সে সম্পূর্ণ অবশ্য হয়ে পড়ে এবং এই ছিল খুনির পক্ষে অভাবিত সুযোগ।
…কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে শব্দ শুনে সুরঞ্জন দৌড়ে আসায় সুযোগ ব্যর্থ হল। আট তারিখ সকাল থেকে দেখা গেল এক অভাবিত ব্যাপার। কল্পনা তার সঙ্গেও ফ্লার্টিং শুরু করেছে। সে কল্পনার প্রতিই বেশি আসক্ত ছিল। স্বাতীকে খুন করলে কল্পনা উইলের শর্তসম্মত তার অংশের মালিক হবে। অতএব কল্পনাকেই সে বিয়ে করবে। কিন্তু স্বাতী জীবিত থাকলে সেটা অসম্ভব। তার মাও চটে যাবেন।
…….অথচ স্বাতীকে কীভাবে খুন করবে সে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ শুভ একটা বিচিত্র পরিস্থিতির সৃষ্টি করল। একটা প্রবাদ আছে, সর্বনাশ সমুৎপন্ন হলে পণ্ডিত ব্যক্তি অর্ধেক ত্যাগ করেন। অগত্যা সে ভেবে দেখল, কল্পনাকে পাওয়া অসম্ভব স্বাতী বর্তমানে; কিন্তু স্বাতীকে পাওয়া খুবই সম্ভব কল্পনার অবর্তমানেও। কল্পনা মরলে তার সম্পত্তি স্বাতীকে বর্তাবে। ব্যস, সম্পত্তির লোভ তাকে গ্রাস করল–তার ব্যর্থতায় অন্য এক সান্ত্বনা আনল।
…পরিস্থিতি অনুকূল। ডোবা-রহস্য জমে উঠেছে। নয় তারিখ সকালে এক ফাঁকে সে বেরিয়ে পড়ল। বেরোনোর প্রধান কারণ, কল্পনা হোটেলে নেই। সে কল্পনাকে একা পেতে চাইছিল–অথচ কল্পনার পাত্তা নেই। তবে কি শুভদের সঙ্গে গেছে? সে ভিউফাউন্ডার নিয়ে বেরোল। ভিউফাইন্ডার নেওয়ার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। দূর থেকে দেখবে বা লক্ষ রাখবে। কিন্তু আঁধারমহলে গিয়ে যখন আবিষ্কার করল যে দুজনে বেরিয়ে এল, শুভ থেকে গেল–হয়তো সুযোগ মোক্ষম। শুধু কল্পনাকে খুন করলে তার ওপর কারও সন্দেহ হতে পারে, কিন্তু শুভকেও শেষ করলে দায়টা ডোবা-রহস্য এবং পরে অধ্যাপকের কাঁধে গিয়ে পড়বে।……
…খুনি কিন্তু একা পেল শুভকে। কাজ শেষ করে ফিরে এল রিকশোয়। মোট মিনিট দশেক সময় হতে লাগল। পথ এবং সময়সংক্ষেপের জন্যে সে পোড়া বাগানের ভিতর এল। আশ্চর্য, সেই সময় অভাবিত পেয়ে গেল কল্পনাকে–ঘড়ি খুঁজতে বেরিয়েছে সে। গলা টিপে মারার পরিশ্রম সে ঢের করেছে-নার্ভ শ্রান্ত। ফলে খুব সহজ পন্থা নিল সে। একটা ইটের সাহায্যে কল্পনার মাথার পিছনে সর্বশক্তিতে আঘাত করল। কল্পনা নিশ্চয় বিস্মিত, স্তম্ভিত হয়েছিল–অত সরল ভিতু মেয়ে…কর্নেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।……বাকি বর্ণনা অনাবশ্যক। আপনারা মিঃ গুপ্তের বর্ণনার সঙ্গে একমত হতে পারেন।…
হলঘরে অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র। তারপর স্বাতীই ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠল, কে–কে খুন করেছে কল্পনাকে?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আঙুল তুলে বজ্রনির্ঘোষে বললেন, দি মার্ডারার ইজ দেয়ার–দিব্যেন্দু রায়চৌধুরী।
দিব্যেন্দু পাল্টা চিৎকার করল, শাট আপ ইউ ওল্ডফুল!
ততক্ষণে তার দুপাশে পুলিশ। সামনে মিঃ গুপ্তের রিভলভারের নল।
.
পরদিন সকালে।
স্টেশনে গিয়ে ওদের বিদায় দিয়ে ফিরছিলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নীরেন, স্বাতী, স্বাতীর মা, অধ্যাপক-দম্পতি, সবাই ফিরে গেলেন। ইরা বোস একা গেল আলাদা কামরায়। দীপেন বোস ততক্ষণে প্রিজনভ্যানে বহরমপুরে পৌঁছেছে। দিব্যেন্দু মুরশিদাবাদ থানার হাজতে রয়েছে। চীনা আর বিভাস প্যালেস হোটেল আপাতত ছাড়েনি দেখা যাচ্ছে। কর্নেল গঙ্গার ধারে-ধারে ফিরে আসছিলেন পায়ে হেঁটে।
প্যালেস হোটেলের সামনে এসে গঙ্গার ধারে গম্বুজওয়ালা শ্বেতপাথরে বাঁধানো ঘাটের কাছে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। পাশাপাশি বসে রয়েছে বিভাস আর চীনা। হাতে হাত, আঙুলে আঙুল, করতলে করতল।
সামনে শীতের নীলাভ গঙ্গা। শিরশির করে বাতাস বইছে, জলে কপন। ঘাসের পাতায় কাঁপন। গাছপালায় কাঁপন। প্রকৃতি জগতে একটা অপরূপ শিহরন চলেছে যেন।
এবং নিজের শরীরেও সেই শিহরন অনুভব করছিলেন কর্নেল সরকার। যেন বা প্রকৃতির এই কাঁপনের প্রতিবিম্ব পড়েছে জলের নিচের ওই থরথর প্রতিবিম্বের মতো সারা জীবজগতেও।
বিভাস আর চীনা অস্ফুট হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কর্নেলের মনে হল, জীবনের ওপর শুধু কি মৃত্যুরই নিরন্তর ছায়া পড়ে চলেছে? মৃত্যুর ওপরেও তো জীবনের ছায়া পড়ছে ক্রমাগত। ওই তো ছায়া পড়েছে। বিভাস-চীনার এক বেদনাময় মৃত্যুর ওপর আজ এতদিনে তাদের জীবনের চঞ্চল ছায়া পড়ল। নতুন জীবনের ছায়া মুছে দিল একটি মৃত্যুর–একটি বিচ্ছেদের ক্ষণকালটিকে। পৃথিবী জুড়ে এই ধারাবাহিক ছায়া পড়ার ইতিহাস!
আজীবন নিঃসঙ্গ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার হয়তো গভীর দুঃখে কিংবা সুখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন। পিছনে বিভাস গান গেয়ে উঠেছে :
আমরা যারা এসেছিলাম
হারিয়ে যাবার খেলায়
নিশীথ রাতে পাতাঝরা বনে
অন্ধকারের ভেলায়
এবার যাব আলোর উপকূলে……