ছারপোকার এপিটাফ
আমি যখন চাকরিতে ঢুকেছি, একটা জিনিস দেখে আমার খুবই অবাক লেগেছিল প্রথম প্রথম; সেটা হল আমার সহকর্মীরা দিনের কাজ শুরু করার আগে অফিসে ঢুকে নিজ নিজ চেয়ার শূন্যে তুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিতেন। কাজের প্রতি ঘোরতর বিতৃষ্ণা অথবা অফিসের উপর নিদারুণ রাগ, ঠিক কী কারণে এতগুলি শান্ত ভদ্র কর্মচারী প্রতিদিন কাজের প্রারম্ভে এই বিচিত্র আচরণ করতেন এটা আমি গোড়ায় দু’-একদিন বুঝতে পারিনি। কিন্তু তার পরেই আমি মজ্জায় মজ্জায় টের পেলাম। প্রত্যেকটি চেয়ারে অসংখ্য ছারপোকা, তাদের দংশন যেমন তীক্ষ্ণ তেমনই বিষাক্ত। প্রথম দিন বিকেলের দিকে গায়ে চাকা চাকা দাগ বেরল, ভাবলাম, অ্যালার্জি, অফিসের পরিবেশ সহ্য হচ্ছে না
কিন্তু গরিবের ছেলে, চাকরি ছাড়ার উপায় নেই, অফিসের সঙ্গে মানিয়ে নিতেই হবে, এ রকম মনের জোর করে দ্বিতীয় দিনেও অফিসে গেলাম। দুপুরবেলায় যখন চেয়ারে বসে পাগলের মতো ছটফট করছি, দরদি সহকর্মী ফাইল থেকে মুখ তুলে প্রশ্ন করল, ‘কী হল আপনার, সকালবেলা চেয়ার ছোড়েননি?’ আমি যখন জবাব দিলাম, ‘না’, তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘করেছেন কী মশায়? ছারপোকার কামড়ে মারা পড়বেন যে, যান, যান ওই প্যাসেজে গিয়ে চেয়ারটাকে ভাল করে আছড়িয়ে নিয়ে আসুন।’
একটু আছড়াতেই ছোট বড় অসংখ্য ছারপোকা বেতের চেয়ারের অন্ধিসন্ধি থেকে বৃষ্টির মতো ঝরতে লাগল। এর পর থেকে আমিও অফিসে গিয়েই প্রথমেই চেয়ার আছড়াতাম।
আমাদের অফিসে কেন, প্রায় প্রত্যেক অফিসেই সেই সময় চেয়ার আছড়ানোর ওই রীতি চালু ছিল। চেয়ার সারানো ছিল প্রায় নিয়মিত ঘটনা, অনেক অফিসেই বাঁধা কাঠ-মিস্ত্রি ছিল। নতুন চেয়ারও কিনতে হত হামেশা।
এই চেয়ার আছড়ানো ব্যাপারটা কিন্তু ছারপোকারা শেষের দিকে চমৎকার বুঝে গিয়েছিল। তখন আর চেয়ার আছড়িয়ে ছারপোকা বিশেষ বেরত না। ছারপোকার সংখ্যা যে কমে গিয়েছিল তা নয়। সালের দিকে ছারপোকার সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন দল বেঁধে যে যার চেয়ারের ডেরা ছেড়ে নিকটবর্তী টেবিলের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিত। তারপর চেয়ারের অধিবাসী অফিসে এসে বসলে তাও একে একে ধীরে সুস্থে রক্ত পান করতে চেয়ারে ফিরে আসত।
এই ফিরে আসার ব্যাপারটা আমি নিজেই আবিষ্কার করি। একদিন অফিসে গিয়ে টেবিলের নীচে তাকিয়ে কী একটা জটিল বিষয় নিয়ে একমনে ভাবছি, দেখলাম বহু ছারপোকা টেবিল ছেড়ে চেয়ারের দিকে এগিয়ে আসছে। এরই মধ্যে দু’-একটি উৎসাহী ও তরুণ ছারপোকার চেয়ারের পায়া পর্যন্ত এগিয়ে আসার তর সইছে না, মেজে থেকে ইঞ্চিখানেক উপরে আমার চটি খোলা ডান পা ঝুলছিল, রক্তপিপাসু কয়েকটি ছারপোকা সেখানে এসে লাফাতে লাগল পায়ের উপর উঠবে বলে। একটি ছারপোকার উচ্চতা দশমিক শূন্য এক (.০১) ইঞ্চির বেশি নয়, (এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইনসেক্টস ১৯৪৮ সংস্করণ, চতুর্থ খণ্ড, ৪৪৭ পষ্ঠা দ্রষ্টব্য); তার পক্ষে এক ইঞ্চি লাফানো মানে নিজের দৈর্ঘ্যের একশো গুণ উঁচুতে হাইজাম্প দেওয়া, চোখে না দেখলে আমি বিশ্বাস করতাম না, পর পর কয়েকটা ছারপোকা অবলীলাক্রমে দু’-একবার চেষ্টা করেই আমার পায়ের উপর উঠে পড়ল।
তখন আমার বয়েস কম, কোনও বিষয়ে উৎসাহের ঘাটতি ছিল না। ছারপোকার এই উচ্চলম্ফ-পরায়ণতা নিয়ে আমি অনেকের সঙ্গে, বিশেষ করে দু’-একজন জীববিজ্ঞানীর সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তাঁরা আমাকে বিশেষ পাত্তা দেননি। শেষে আমি ছারপোকার উচ্চলম্ফের বিষয়ে চিঠি লিখে বিখ্যাত গুইনেস বুক অফ রেকর্ডসের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তাঁরা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন এবং আমাকে অনুরোধ করেন মেজে থেকে পায়ের মধ্যে শূন্যে লাফরত অবস্থায় একটি ছারপোকার ছবি তুলে পাঠাতে। অফিসের মধ্যে অন্ধকারে টেবিলের নীচে একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটের লাফের ছবি নেওয়া, আমাদের দেশে এ রকম সম্ভব হবে না বলে বুক অফ রেকর্ডসকে জানালাম।
কিন্তু তাঁরা নাকি যাচাই না করে কোনও তথ্য তাঁদের রেকর্ড বুকে ছাপেন না। তবে তাঁদের একজন প্রতিনিধি কিছুদিনের মধ্যে উত্তর প্রদেশের এক গুম্ফবিলাসীর গোঁফের দৈর্ঘ্য এবং কলকাতার শহরতলির এক যুবকের হাতের নখের পরিমাপ করতে থাকবে, রেকর্ডস কর্তৃপক্ষ সে কথা জানিয়ে আমাকে তাঁদের সেই প্রতিনিধির সঙ্গে যথাস্থানে যথা সময়ে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। আমার অবশ্য সেটা করা আর হয়ে ওঠেনি।
ফলে আমারই গাফিলতিতে কলকাতার ছারপোকারা বুক অফ রেকর্ডসে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্থান পেল না। অবশ্য এখন আর সে সুযোগ নেই। কারণ সেসব ছারপোকা বহুদিন হল বিদায় নিয়েছে।
পঞ্চাশ দশকের শেষ, ষাটের দশকের আরম্ভ। সে ছিল কলকাতার ছারপোকাদের স্বর্ণযুগ। সেই উত্তপ্ত তাম্রবর্ণ, দ্রুত বিচরণশীল, ক্ষিপ্র ছন্দোময় জিঘাংসু ছারপোকাদের আজকাল আর দেখতেই পাওয়া যায় না। তখন অধিকাংশ লোক হাতে একটা পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে ঘুরতেন, যেখানে গিয়ে বসতেন হাতের পুরনো কাগজটি ভাল করে পেতে তার উপরে বসতেন, এতে ছারপোকাদের দ্রুত ও আকস্মিক আক্রমণ কিছুটা প্রতিরোধ হত।
টেবিল-চেয়ার, তোশক-বালিশ শুধু নয়, তখন সর্বত্র ছারপোকা। জামা-কাপড়ে, জুতোর মোজার মধ্যে, ট্রামে বাসে, সিনেমা হলে, সম্ভব-অসম্ভব এমন কোনও জায়গা ছিল না—যেখানে ছারপোকা ছিল না। আমার মনে আছে আমি দাড়ি কামানোর ভেজা বুরুশের মধ্যে, ঘুরন্ত টেবিল ফ্যানের ব্লেডে ছারপোকা দেখেছি। এমনকী ড্রেসিং সার্কেলের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে বসে থিয়েটার দেখতে দেখতে পরমাসুন্দরী নায়িকার কানের লতির নীচে, হাজার ওয়াটের জোরালো আলোয় স্পষ্ট দেখেছি, দুটি টুকটুকে ছারপোকা ঘুরছে। শেষ বয়েসে একবার ধনরাজ অসামান্য একটি গোল দিয়েছিলেন। খেলার শেষে ইস্টবেঙ্গলের তাঁবুতে ধনরাজের পদপ্রান্তে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসেছিলাম, ধনরাজ হাঁটুর উপর থেকে নিকাপ খুললেন, সেই প্রবল খেলার শেষে তখনও নিকাপের নীচে একটি চমৎকার ছারপোকা।
এই সুযোগে একজন অমর রসিকের কথাও বলি। মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে শিবরাম চক্রবর্তীর মেসে দেখেছি, ওঁর সেই বিখ্যাত তক্তপোশের ফাঁকে, উনি বলতেন মুক্তারামের তক্তারাম, দেখেছি নতুন চাদরের উপর নতুন চাদর, তার উপরে নতুন চাদর। কোনও চাদর তুলতেন না ছারপোকা বেরিয়ে আসবে বলে, শুধু কখনও ছারপোকার অত্যাচার বেশি হলে আবার একটি চাদর ফেলে দিতেন সবচেয়ে উপরে, অবশ্য প্রত্যেকটি নতুন চাদর পাতবার আগে চারদিকে ফিনাইল দিয়ে চাদরের চার প্রান্ত ভাল করে চুবিয়ে নিতেন যাতে ছারপোকারা ফিনাইলের দেয়াল লঙঘন করে চাদরের উপরে না উঠে আসতে পারে। এই প্রতিষেধক ব্যবস্থা কতটা কার্যকরী ছিল, ঈশ্বর জানেন, তিনি সত্যিই এটা করতেন কিনা সেটাও বলা কঠিন কিন্তু তিনি আমাকে এই রকমই বুঝিয়েছিলেন।
দুঃখের বিষয়, এই সব ছারপোকা, যাদের অত্যাচারে গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর আগেই লোকেরা ট্রাম থেকে নেমে যেত, সিনেমার ইন্টারভ্যালের সময় হল থেকে পালিয়ে যেত, অর্ধেক মোগলাই পরোটা খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে দৌড়ে উঠে যেত, আজকাল প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে।
কিন্তু কেন?
এইবার আমি একটি ঐতিহাসিক তথ্য নিবেদন করব। স্থিতধী পাঠক, একবার পিছনের দিকে ফিরে তাকান, মনে করে দেখুন একদা শ্যামবাজার থেকে কালীঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত আসল কলকাতায় কোনও মশা ছিল না। তার পর একদিন দলে দলে, লাখে লাখে মশার অনুপ্রবেশ ঘটল। তারা প্রথমে মানুষকে, তারপর কুকুর বিড়াল, গোরু-বাছুরকে কামড়াতে লাগল। তারপর ফলমূল, তরিতরকারি, টিকটিকি-ইঁদুর, অবশেষে ছারপোকাকে আক্রমণ করল। ছারপোকাকে আক্রমণ করার কারণটা সহজ, তার গায়ে মানুষের তৈরি রক্ত পাচ্ছে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি মশারির আনাচে-কানাচে, বালিশ-তোশকের নীচে মশা ছারপোকা ধরে শুষে খাচ্ছে। এবং শেষে এই মশার অত্যাচারেই কলকাতার ছারপোকা এখন প্রায় নির্বংশ হতে চলেছে। এর পর হয়তো একটি ছারপোকাও আর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না।