ছায়া

ছায়া

তাসজোড়া বাক্সে পুরতে পুরতে ডাক্তারবাবু বললেন, “তা বললে তো আর হবে না, গোপেনবাবু, সব জিনিস যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এত লোকে দেখেছে, সবাই কি আর মিথ্যে কথা বলে?”

গোপেনবাবু নরম গলায় বললেন, “না, ঠিক তা বলছি নে, তবে কী জানেন, আত্মার যদি অসীম স্বভাব হয় তবে তার একটি সীমাবদ্ধ রূপ কী করে দেখা যাবে?”

চৌধুরীমশাই বললেন, “সীমাবদ্ধ রূপ আবার কী? আত্মার বিস্তার যেমন অসীম তার ক্ষমতাও তেমনি অসীম, একটা সীমাবদ্ধ রূপ নেওয়া তার পক্ষে কিছু শক্ত কাজ নয়।”

দানু বললে, “আর রূপও নিচ্ছে না এক্ষেত্রে, শুধু একটা ছায়া নিচ্ছে, ধরাও যায় না ছোঁয়াও যায় না, ভেতর দিয়ে গঙ্গার ওপারের গাছ দেখা যায়, চাই কী ওর মধ্যে দিয়ে হেঁটেও চলে যাওয়া যায়।”

চৌধুরীমশাই শিউরে উঠে, গায়ের চাদরটা একটু ভালো করে জড়িয়ে নিলেন।

“আসলে কী জানেন গোপেনবাবু বিয়েথা তো আর করলেন না, তাই সব জিনিস যুক্তি দিয়ে বুঝতে চান। পৃথিবীতে যে এমন বহু জিনিস আছে যার সামনে যুক্তিতর্ক খাটে না, এ অভিজ্ঞতা আপনার হবে কোত্থেকে?”

ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন।

“চলি, গোপেনবাবু, আমার বাড়িতেও কেউ রাত করার যুক্তি মানতে চায় না। কিন্তু আপনার ঐ অসীমের কথাটার মধ্যে যে কিছু নেই তাই বা বলি কী করে। তবে কী জানেন, ছ’ফুট লম্বা মানুষটার ফটোও তো চার ইঞ্চি বাই চার ইঞ্চি কাগজে ধরে যায়। অবিশ্যি সে ছবিটা কিছু আর আসল মানুষটা নয়, তার হুবহু ছায়াটুকু ছাড়া আর কিছু নয়। তেমনি কালের পটেও হয়তো বিশেষ অবস্থায় ঘটনার আর পাত্র-পাত্রীর ছাপ পড়ে যায়, আবার সেই বিশেষ অবস্থা ঘটলে ফটোর মতো সেগুলো দেখা যায়। বলা যায় না কিছুই। চল দানু।”

দানু গলায় কম্ফর্টর জড়াচ্ছিল, পাড়ায় ভালো গাইয়ে বলে তার সুনাম, পুজোর সময় সখের থিয়েটারে তাকে গাইতে হবে, কাজে কাজেই সাবধানের মার নেই। তাছাড়া এদের যা কথাবার্তা এমনিতেই কেমন গাটা শিরশির করতে আরম্ভ করছে। জোর করে হেসে দানু বললে, “ভূত নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ে কী হবে বলুন গোপেনবাবু? তার চেয়ে স্মাগলারদের সম্বন্ধে সাবধান হোন, দেখেছেন তো কাগজে কী লিখেছে, মেয়েও লাগিয়েছে নাকি আর এইসব জায়গাতেই কোথাও স্মাগলারদের আড়ত। মাঝ-গঙ্গায় জাহাজ নোঙর করে সোনাদানাগুলোকে জলে ডুবিয়ে দিলেই হল। গভীর রাতে সাঙ্গাতরা নৌকা করে গিয়ে জল থেকে সেগুলো উঠিয়ে এনে পাচার করে দেয়। ব্যস্ আর কী চাই!”

চৌধুরীমশাইও খুব হাসতে লাগলেন।

“আরে, জলেও ফেলে না; এই তো শীতের হাওয়া দিতে শুরু হল বলে, ওরা এখন জলে ডুব দিল আর কী, তুমিও যেমন! আমি বিশ্বস্ত সূত্রে শুনেছি, বয়ার তলায় শেকলের সঙ্গে বেঁধে রেখে দেয়। গিঁট খুলে নিয়ে গেলেই হল। তবে পুলিশও এতদিনে শুঁকে শুঁকে সব বের করেছে; তারাও এখানে ওখানে ঘাপটি মেরে যাচ্ছে, হাতে-নাতে এক ব্যাটাকে ধরতে পারলেই হল, জেরা করে তার কাছ থেকে সব কথা বের করে নিতে পারবে।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “এদের যেমন কথা! কিন্তু বাস্তবিকই একটু সাবধানে থাকবেন গোপেনবাবু, দুষ্টু লোকের কথা কিছুই বলা যায় না। বে-আইনি কাজ করে শেষটা ওদের মনটা এমন হয়ে যায় যে দুটো-একটা খুনখারাপিতে কিছুই বাধে না। তার ওপর একেবারে একা থাকেন তো। আপনার কি মশাই এক-আধটা পুরোনো চাকরও থাকতে নেই? এখানকার লোক যে মরে গেলেও এ বাড়িতে রাত কাটাবে না সেটা মানি।”

গোপেনবাবু আস্তে আস্তে বললেন, “পুরোনো চাকর তো সঙ্গেই এনেছিলাম, তা সে কিছুতেই গঙ্গার এতটা কাছে থাকতে রাজি হল না। গঙ্গার গন্ধে নাকি তার হাঁপানি বাড়ে। একটা রাত মোটে ছিল।”

চৌধুরীমশাই বললেন, “গঙ্গার গন্ধ-ফন্দ কোনো কাজের কথা নয়, আসলে আপনার ঐ মালী-মজুররা স্রেফ তাকে ভূতের ভয় দেখিয়ে ভাগিয়েছে। বুদ্ধির কাজ করেছে। আপনি তো আর ভালো কথা শুনবেন না। পই-পই করে বলেছি, আমার ছোট বাড়িটাতে উঠে আসুন, ওই রাঁধুনেই রাঁধবে, গঙ্গার ঐ স্যাঁতসেঁতে হাওয়া থেকেও রেহাই পাবেন, চাই কী পরোনো চাকরটাও ফিরে আসতে পারে। মোটে ত্রিশ টাকা ভাড়া। তা ভালো কথা কে শোনে?”

ওরা বিদায় নিয়ে চলে গেলে পর, ছোট ফটকে তালা দিয়ে, মোটা আমেরিকান তারের জাল ঘেরা বারান্দায় তালা দিয়ে গোপেনবাবু গঙ্গার ধারের বারান্দাতে এসে দাঁড়ালেন। আসলে ঐ একই বারান্দা, গোটা বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে, আগাগোড়া তারের জালে মোড়া। আগে নাকি জোয়ারের সময় দু-একবার মানুষখেকো কুমিরকে একেবারে বাড়ির সীমানা পর্যন্ত উঠে আসতে দেখা যেত, তাই এই ব্যবস্থা। গোপেনবাবু কেনবার আগে ত্রিশ-চল্লিশ বছর নাকি বাড়িতে বড় একটা কেউ বাস করেনি। বড় জোর একটা রাত কি দুটো রাত।

বারান্দার বাইরে রং-বেরঙের ভাঙা চিনেমাটির বাসনের টুকরো বসানো সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চাতাল। এক কালে এখানে ফোয়ারা থেকে জল বেরুত, ফোয়ারার চারধার বাঁধানো, গোটা দুই পাথরের বেঞ্চিও রয়েছে।

বারান্দা থেকে গোপেনবাবুর মনে হতে লাগল ফিকে তারার আলোয় একটা বেঞ্চির কোনায় কে বসে রয়েছে। সারা গায়ে সবুজ কাপড় জড়িয়ে, পাৎলা ছিপছিপে একটি মেয়ে যেন গঙ্গার দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে।

গোপেনবাবুর ছাপ্পান্ন বছরের জীবনে এই প্রথম তাঁর সারা গায়ে কাঁটা দিল। মনে হচ্ছে যেন এক ঢাল ভিজে চুল মাথার ওপর জড়ো করে রেখেছে, কানে গলায় গয়না চিকচিক করছে, গায়ের রং যেন কাঁচা হলুদ। তারার আলোতে সত্যি কতখানি দেখছেন আর কতখানি কল্পনা করে নিচ্ছেন নিজেই বুঝতে পারছেন না। মেয়েটির পাশে বেঞ্চির ওপরে রাখা আধ হাত লম্বা একটা কালো বাক্সও চোখে পড়ল।

এতক্ষণে গোপেনবাবুর চৈতন্য হল। তাই তো, চোরাকারবারীরা তো এই রকম সব সুন্দর মেয়েদেরই কাজে লাগায়। কথাটা তো তাঁর অজানা নয়; সত্যিই তো এ মেয়েকে কখনো কেউ সন্দেহ করতে পারে না, একটা কোমল শ্যামল লতার মতো বেঞ্চির ওপর হালকা শরীরটা কেমন এলিয়ে রয়েছে। এতখানি দূর থেকে তার মাধুরী টের পাচ্ছেন গোপেনবাবু, কীসের একটা মৃদু সুগন্ধও যেন নাকে আসছে।

হাতে একটা বন্দুক নেই, লাঠি নেই, অমনি বারান্দার জাল-বসানো ছোট দরজাটির ছিটকিনি খুলে গোপেনবাবু বাইরে এলেন। মোটাসোটা ফরসা মানুষটি মাথার চুল পাৎলা হয়ে এসেছে, নাকের ওপর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা বসানো, চোখটা দিন দিন যেন আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কে জানে কাছে গিয়ে হয়তো দেখবেন সব ভুল, কী দেখছেন আর পাঁচ রকম গল্প শুনে কী মনে করে বসে আছেন! ওখানে সত্যি কারো থাকার সম্ভাবনা কম, পথ তো শুধু গঙ্গা, নয়তো দু’ফুট উঁচু পাঁচিল টপকানো। তাছাড়া এ এলাকার কেউ রাত এগারোটার সময় যে এ বাড়িতে আসবে না সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই। তবে এ এলাকাতে যারা থাকে তারা হল সব আটপৌরে মানুষ। অমন মেয়ে এখানকার হবে কেন?

বারান্দা থেকে চার ধাপ সিঁড়ি নেমে, চাতালে বসানো এক-মানুষ উঁচু লাল গোলাপের গাছের সারি পার হয়ে শুকনো ফোয়ারার ধারে এসে দেখেন যা মনে করেছিলেন ঠিক তাই, বেঞ্চিতে কেউ বসে নেই।

কেমন একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুক থেকে বেরিয়ে এল। তবে কি গোপেনবাবু মনে মনে চেয়েছিলেন যে, ঐখানে ঐরকম একটি মেয়ে সত্যি থাকুক? ওরকম মেয়ে হয় কখনো? ও তো চল্লিশ-বছর ধরে দেশি-বিদেশি কাব্যে পড়া যত সুন্দরী তাদের রূপরস দিয়ে মনগড়া একটা ছবি, একটা ছায়া, কী যেন বলছিল দানু, ওর মধ্যে দিয়ে চাই কী হেঁটেও চলে যাওয়া যায়।

কিন্তু কী একটা অনভ্যস্ত সুগন্ধে, বাতাসটা তবে কেন ভারী হয়ে আছে? গোপেনবাবু চারদিক চেয়ে দেখলেন গন্ধরাজের ঝোপের গাঢ় সবুজ ছায়া থেকে খানিকটা ফিকে সবুজ যেন আলগা হয়ে বেরিয়ে এল। হঠাৎ তাকে এতটা কাছে দেখে গোপেনবাবু কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন।

মেয়েটি একটু ম্লান হেসে বললেন, “বড় বিপদে পড়েছি, আমাকে সাহায্য করুন। এটা লুকিয়ে রাখুন।” বলে বুকে আঁকড়ে-ধরা কালো বাক্সটি পরম নিশ্চিন্তভাবে গোপেনবাবুর দিকে এগিয়ে দিলে।

গোপেনবাবুর কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরোয় না, অস্বাভাবিক হেঁড়ে গলায় বললে, “কী—কী আছে ওতে?”

সে খিলখিল করে হেসে উঠল, সে হাসি গাছে গাছে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে গঙ্গার বুকের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটার কি এতটুকু বুদ্ধি নেই, কে জানে পুলিসেরা কোথায় ওর সন্ধানে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। চোরাকারবারী গোপেনবাবু আগে কখনো চোখে দেখেননি, তাই ভালো করে তাকে দেখলেন। ইস, এরা এত রূপসীও হয়! চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কপাল ঘিরে বেঁটে বেঁটে ভিজে কোঁকড়া চুলের গুছি, দুকানে দুটি সবুজ পাথর, তারার আলোয় ঝিকমিক করছে, পাৎলা পাখির ডানার মতো ভুরু, কী যে সূক্ষ্ম কী যে মসৃণ, জোরে কথা বলতে ভয় করে। অথচ ওরই ওই আধাভিজে কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে কোথাও একটা মুখকাটা ভোঁতা বন্দুক লুকিয়ে আছে। অব্যর্থ টিপও নাকি চোরাকারবারী মেয়েদের, দানু কোন কাগজে নাকি পড়েছে। এর হাতের আঙুলগুলো সত্যি সত্যি চাঁপার কলির মতো, একটা আঙুলে এই বড় একটা সবুজ পাথর-বসানো আংটি।

খুসি হয়ে কেন লোকে পাপ করে, কীসের জন্য নরকে যাওয়া সার্থক মনে হয়, সে রহস্য হঠাৎ গোপেনবাবু বুঝে ফেললেন। হাত বাড়িয়ে বাক্সটি ধরলেন। এত ভারী যে আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিল।

মেয়েটি খুব কাছে এসে হেসে বললে, “খুব ভারী, না? খুলেই দেখুন না এত ভারী কেন?”

বলে বাক্সের ডালা নিজেই তুলে দিল। বাক্সভরা সোনার মোহর। সে বললে, “একটা ভালো জায়গায় লুকিয়ে রাখুন, কেমন?” বলে এক মুহূর্তের জন্য গোপেনবাবুর হাতের কব্জির ওপর নরম কচি আঙুল রাখলে।

গোপেনবাবুর কান ঝিমঝিম করতে লাগল, ভাবলেন একেই বোধহয় সুখমৃত্যু বলে। পর মুহূর্তেই মেয়েটি অনেকখানি দূরে সরে গেল। বলল, “ওগুলো আমার নয়। পরে গোলমাল চুকে গেলে— বনানী দেবী, বনহুগলী— এই নামে পাঠিয়ে দেবেন, কেমন?” কিছু বলতে পারলেন না গোপেনবাবু। একদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলেন। সে একটু একটু করে সরে যেতে লাগল, দেখতে দেখতে এতটা তফাতে চলে গেল যে, এই তার সবুজ শাড়ি গাছের সারির সঙ্গে মিশে যায়, আবার এই যেন ঝিকমিকিয়ে ওঠে। তারপর গঙ্গার ধারের সবুজ ঘাসে ঢাকা পাড়ের সঙ্গে একেবারে মিলিয়ে গেল, আর তাকে আলাদা করে দেখা গেল না।

গোপেনবাবু বাক্স নিয়ে ঘরে এলেন। মাথার ভিতরটা একেবারে পরিষ্কার, কোথায় লুকোতে হবে আর বলে দিতে হল না। চাতালের সিঁড়ির পাশেই পাতাবাহারের চীনেমাটির টব সরিয়ে ছোট্ট খুপরি দিয়ে গভীর একটি গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে বাক্স পুঁতে যত্ন করে মাটি চাপা দিয়ে, টবটি আবার যথাস্থানে রেখে, নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে শুয়ে পুলিসের লোকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এল তারা ঠিকই, ঘণ্টা দুই পরেই, সঙ্গে তাদের চৌধুরীমশাই, গ্রাম-পঞ্চায়েতের পাণ্ডা তিনি, এসব ব্যাপারে বাদ পড়েন না। বড় ফটকের ঘণ্টা দিয়ে একটু লজ্জিতভাবে এসে দুটো একটা মামুলি প্রশ্ন করল শুধু।

“জিজ্ঞেস করতে হয় বলে কচ্ছি স্যার, নইলে এদিকে যে কারো নদীর দিক থেকে আসা সম্ভব নয়, সেটা আমরা খুব জানি। নদীতেও আমাদের লোক আছে যে। তবে মেয়েছেলেরা কত্তে পারে না এমন কাজ নেই, তাই একবার খোঁজ কত্তে আসা। আপনি নিশ্চিন্ত হোয়ে ঘুমুন গে। জালের দরজায় তালা দেন আশা করি? এ গাঁয়েরই কারো কারো সঙ্গে ওদের সড় আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনভাবে সোনাদানা চালান হয় যে, বে-আইনি বলে ধরে কার সাধ্যি! চলি স্যার।”

তারা গেলে পর দরজায় তালা দিয়ে গোপেনবাবু শয্যা নেবামাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি লেগে থাকল।

পরদিন সকালে রাধেশ্যাম এসে চা টোস্ট নিয়ে গোপেনবাবুকে ডেকে তুলল। তার কাছে খিড়কি দোরের চাবি থাকে। চোখের কোলে তার কালি।

“কী হল রাধেশ্যাম?”

সে বললে, “কাল রাতে গাঁয়ে কেউ ঘুমোয়নি বাবু, সারারাত খানাতল্লাসি চলেছে। আমিনদের বাড়িতে মেয়েছেলেটি ধরা পড়ে গেছে। তক্তাপোষের নীচে সোনা। তাই দেখতে গেলাম, কী সোঁদর, মাইরি। কাঁদতে ইচ্ছে কচ্ছিল।”

গোপেনবাবুর হাতখানি কাঁপছিল, অনেক যত্নে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে বললেন, “সোনা হয়তো আর কেউ এনেছে? ও মেয়ে আনবে কেন?”

“সে তো তাই বলছে। সে নাকি কিচ্ছুটি জানে না। এমনি বেড়াতে এসেছিল, আমিনের ঠাকুমা ওর ধাইমা ছিল, হেনাতেনা কত কী। খুব কাঁদছিল মেয়েটা। ঐ দেখুন লরি এলো, ওকে থানায় নিয়ে যাবে। কী হল গো, বাবু?”

গোপেনবাবু পেয়ালা ফেলে আথালি-পাথালি ছুটে চললেন। কাঁদছে মেয়েটা? হয়তো ভাবছে গোপেনবাবুই খোঁজ দিয়েছেন। কেমন অসহ্য লাগল ভাবনাটা। লরির কাছে পৌঁছে দেখেন লাল নীল কাপড়-পরা, এক গা সোনার গয়না পরে, ঠোঁটে গালে রং মেখে লম্বা চওড়া এ কোন মেয়েকে তোলা হচ্ছে? আঃ, বাঁচা গেল।

রুমাল দিয়ে হাসি চেপে গোপেনবাবু ঘরে ফিরে রাধেশ্যামকে নতুন করে চা আনতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে দানুকে নিয়ে চৌধুরীমশাইও এসে উপস্থিত, চুল সব উসকোখুসকো, উত্তেজনায় ফেটে পড়ছেন। দানু বসে পড়েই বললে, “শেষটা গেলি তো বাছা ফটকে? মেয়েছেলে হয়ে এসবে ঢাকা কেন! চা খাওয়ান গোপেনদা।” চৌধুরীমশাই পা দু’খানি মেলে দিয়ে বসলেন।

দানু বললে, “যাক, আপনার একটা বিপদ ঘুচল। চোরাকারবারী মেয়ে ধরা পড়ল। এবার ভূত হতে সাবধান।”

চৌধুরীমশাই বললেন, “না, ঠাট্টা নয়, রাত্রে এমনিতেই গা ছমছম করে, তাই কাল আর কিছু বলিনি, কিন্তু এ বাড়ির দুর্নাম কি একেবারে মিছিমিছি হয়েছে ভেবেছেন? এটা জগু বোসের বাগানবাড়ি ছিল তা জানেন? দেউলে হোয়ে জগু বোসও মল, কে এক সুন্দরী বাইজি বাক্সভরা মোহর নিয়ে নিখোঁজ হল, সেও প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ বছর হোতে চলল। জগু বোসের বউ বনানী দেবী এখনো বেঁচে। নাকি বনহুগলীতে বুড়ো বয়সে একরকম না খেয়ে দিন গুনছে।”

শিরার মধ্যে রক্ত-চলাচল বুঝি থেমে যায়। নাকি, ছবি, নাকি ছায়া, ওদের মধ্যে দিয়ে নাকি হেঁটে চলে যাওয়া যায়।

নিঝুম দুপুরে নির্জন চাতালের ধার থেকে টব সরিয়ে বাক্স তুলে তুলে দিয়ে এঁটে প্যাক করে, চটে সেলাই করে, গোপেনবাবু কলকাতায় এসে বড় পোস্টাপিস থেকে নিজের নাম ভাঁড়িয়ে বনহুগলীতে রেজিস্টার্ড পার্সেল পাঠালেন। ফিরবার সময় তিনটে বেকার উড়নচণ্ড ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। কাজকর্ম না শিখলে চলে কখনো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *