ছায়া

ছায়া

নিজেকে আমের মতো মনে হচ্ছে। গায়ের রং গাঢ় সবুজ। চেহারা নধর। মাথার কাছটা চকচকে। রসে টইটুম্বুর হয়ে আছি। শরীর থেকে টক-মিষ্টি গন্ধও বেরোচ্ছে। আমের গন্ধ। দুটো মাছি আমার নাকের কাছে ভনভন করছে। করবেই তো। পাকা আমের ওপর মাছি ভনভন করবে না তো কার ওপর করবে? আচ্ছা, আমি এখন কোন আম? ল্যাংড়া? ফজলি? নাকি চৌসা? অ্যালফানসো নয়তো? সবথেকে ভালো হত হিমসাগর হলে। আমার ওরিজিনাল নামটাও থাকবে, আবার আমও থাকবে। সবাইকে বলতে পারব, ‘আমি এখন শুধু সাগর নই। আমি এখন হিমসাগর।’ মজার হবে না?

নিজেকে আমের মতো মনে হওয়ার কারণ আছে। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। জ্যৈষ্ঠ মাসে আম পাকা গরম পড়ে। এবার খানিকটা বেশি পড়েছে। আমের সঙ্গে মানুষও পাকিয়ে দিচ্ছে। ভোর হতে না হতে ঠাঠা পোড়া রোদ। বেলা যত বাড়তে থাকে সেই রোদ নৃত্য শুরু করে। মিনমিনে নৃত্য নয়, দু-হাত তুলে ধেই-ধেই নৃত্য। সঙ্গে রবিঠাকুরের গান। দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে।। / রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন / আরাম নাহি যে জানে রে।।

রবিঠাকুরের এটাই সবথেকে বড় গুণ। তিনি সবার জন্য গান লিখেছেন। মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, ঝড়, জল, গরম কাউকে বঞ্চিত করেননি। ঝড়-বৃষ্টির মতো রোদ-গরমের নৃত্যগীতের সঙ্গে বাজনাও থাকে। ঝড়-বৃষ্টিরটা কানে শোনা যায়। শোঁ-শোঁ করে বাতাস বয়। ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে। রোদ-গরমের বাজনা ওরকম নয়। চট করে শোনা যায় না। কান পেতে শুনতে হয়। সেই কান পাতার কায়দা আছে। সবাই পারে না। আমার মতো যারা অলস, অকর্মণ্য এবং বেকার তারা পারে। কাজ পায়নি বলে ‘বেকার’ হলে চলবে না। মনের দিক থেকে বেকার হতে হবে।

এই কথা শুনে অনেকে বিরক্ত হবে। যারা কাজের মানুষ, এই গরমে পথে বেরোতে বাধ্য হচ্ছে, তারা বিরক্ত হবে সবথেকে বেশি। বলবে, অলসদের নানারকম ফন্দিফিকির থাকে। বড় বড় কথা বলে সেই সব ফন্দিফিকিরগুলোকে তারা সারাক্ষণ ‘মহৎ’ বানানোর চেষ্টা করে। এরা সবসময় ভান করে, আমি একজন বিরাট ভাবুক। বড় কথা ভাবতে ভাবতেই আমার সময় চলে যায়। আমি কাজ কখন করব? রোদ-গরমের গানবাজনা শোনাটাও সেরকম একটা ফন্দি। ফালতু কথা। কান ধরে গালে দুটো চড় লাগালে ভাবুকগিরি বেরিয়ে যাবে। আমি এই বিরক্তি, রাগ সমর্থন করি। আমি যদি ‘আমরা’ না হয়ে ‘ওরা’ হতাম একই কথা বলতাম। পারলে বেশি বলতাম। আমার মতো বেকার, অলস এবং অকর্মণ্য যুবকের গালে দুটো কেন দুটো দুটো চারটে চড় মারবার ব্যবস্থা করতাম।

এই ফাঁকে একটা গোপন কথা বলে রাখি। কিছুদিন হল আমি কেমন যেন একটু মারকুটে মারকুটে ধরনের হয়ে পড়ছি! বেশি নয়, হালকা। মনে হচ্ছে দু-ঘা দিতে পারলে বেশ হত। কাকে দিতে পারলে বেশ হত, কেন দিতে পারলে বেশ হত জানি না। অথচ মনে হচ্ছে! অদ্ভুত না? বিষয়টা নিয়ে আমি ভাবিনি এমন নয়, ভেবেছি। আমার ধারণা এটা একধরনের মনের খেলা। সে কবিতা, গান, প্রকৃতির সঙ্গে খানিকটা ভায়োলেন্স জট পাকিয়ে দিচ্ছে। ছোটরা যেমন উলের বল, সুতোর গোল্লা নিয়ে জট পাকায় অনেকটা সেরকম। আমি উলের বল বা সুতোর গোল্লা নই। আমাকে সতর্ক থাকতে হবে।

যাক, মূল ঘটনায় ফিরে আসি। এখন দুপুর বারোটার কাছাকাছি সময়। মিনিট পনেরো বাকি আছে। রোদের অবস্থা মারাত্মক। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছি। হাঁটছি হনহন করে। রাস্তা শুনশান। লোকজন নেই বললেই চলে, এমনকি গাড়িঘোড়াও কম। কেমন একটা কার্ফু কার্ফু ভাব। গরম কার্ফু। ছায়ার নামগন্ধ নেই। আশপাশের বাড়ি, দোকান, ইট, পাথর, কংক্রিট—কারও কোনও ছায়া নেই। এই যে আমি ফুটপাথ ধরে হাঁটছি, আমারও ছায়া পড়ছে না। এটাই স্বাভাবিক। মধ্যদুপুর ছায়াহীন একটা সময়। আমি ইচ্ছে করেই বেরোনোর জন্য এই সময়টা বেছেছি। ছায়াহীন জগতের একটা অন্যরকম মজা আছে। আমি আছি, সঙ্গে আমার ছায়া নেই ভাবতেই কেমন গা ছমছম করে। তা ছাড়া গরম ‘উপভোগ’ করবার এটাই ঠিক সময়। ‘ওরা’ যাই বলুক, আমি মনে করি, শীত, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, বসন্তের মতো গরমকেও উপভোগ করার প্রয়োজন আছে। এ ব্যাপারে আমার কাছে খুব বড় একজন মানুষের সার্টিফিকেট রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত মানুষ। তিনি গ্রীষ্মকাল নিয়ে যে কী কাণ্ড করেছেন…! থাক, এখন বেশি বলব না, বিতর্ক শুরু হলে আমি সেই সার্টিফিকেট আমার বইয়ের তাক থেকে বের করে দেখাব।

এটাও একটা বাজে কথা। আমার কোনও বইয়ের তাক নেই। বইয়ের তক্তাপোষ আছে। একটা ঘরে ভাড়া থাকি। তাও আবার তিন-চারমাস ধার বাকি পড়ে থাকে। কী করব? টিউশন আর প্রুফ দেখে রোজগার। টাকা ঠিক সময় পাওয়া যায় না। এতে আমার যে খুব সমস্যা হয় এমন নয়। ধারবাকি আরও বেড়ে যায় এইটুকুই যা ঝামেলা। তবে এই ধরনের কাজে কোনও-কোনও সময় ঠিক সময় টাকাপয়সা পেলেও ঝামেলায় পড়তে হয়। কথাটা কি অদ্ভুত মনে হচ্ছে? আচ্ছা, একটা উদাহরণ দিচ্ছি।

আমার এক ফুটফুটে ছাত্রী আছে। মুনি। মুনি শুধু দেখতে ফুটফুটে নয়, স্বভাবেও ফুটফুটে। ক্লাস সিক্সে পড়ে। অঙ্কে দারুণ, বাংলায় ফেলটু। আমি তাকে বাংলা শেখাই। কিছুতেই শিখবে না। বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা বানান, বাংলা বাক্য গঠন শিখতে হলেই তার নাকি হাত পায়ে ঝিঁঝি ধরে। প্রথমদিনই আমি মুনিকে বলেছি, অঙ্কেরবেলায় আমার এখনও এরকম হয়। হাতপায়ে ঝিম মেরে যায়। তখন ঠিক হল, আমি তাকে এক ঘণ্টা বাংলা শেখাব, সে আমাকে আধঘণ্টা অঙ্ক শেখাবে। এতে ঝিঁঝি আর ঝিম মারা কাটাকুটি হয়ে যাবে। এই পদ্ধতিতে টিউশন চলছে। আট মাস হল মিনুর বাবার অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। বেচারিরা খুবই দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। ওই বাড়িতে পড়াতে গেলে আমাকে বিকেলের টিফিন দেওয়া হত। মুনি যত্ন করে আমাকে সেই টিফিন খাওয়াত। টোস্ট, কলা, ওমলেট। পরে টোস্ট, কলা, ওমলেট বন্ধ হয়ে টিফিনে শুধু চা আর বিস্কুট আসতে লাগল। তখনও মুনি আমাকে যত্ন করে খাওয়াত। একসময় বিস্কুট বন্ধ হয়ে গেল। শুধু চা। মুনি আমাকে সেই চা-ই যত্ন করে খাওয়াতে লাগল।

‘আপনি আগে চা-টুকু খেয়ে নিন মাস্টারমশাই। ঠান্ডা হয়ে যাবে। দেখুন তো চায়ে চিনি আছে কিনা? আমার মা আবার মাঝেমধ্যে চায়ে চিনি দিতে ভুলে যায়। বাবা বলে চিনি কানা। হি হি।’

আমি কাপে চুমুক দিয়ে বললাম, ‘না চিনি বেশি হয়ে গেছে।’

কিছুদিন পরে চায়ে চিনি বন্ধ হয়ে গেল। তারপর চা-ও বন্ধ হয়ে গেল। এতে ঝামেলা ছিল না। ঝামেলা শুরু হল, মুনির বাবা যখন প্রতিমাসে আমাকে ঠিক সময়ে মাইনেটা দিয়ে যেতে লাগলেন। শুকনো হেসে হাতে খাম ধরিয়ে দেন। বুঝতে পারি খুব কষ্ট করে টাকাটা জোগাড় করেছেন। আমি যে কী লজ্জায় পড়তাম! মাথা নীচু করে টাকার খাম নিই। মনে হয় বিরাট অপরাধ করছি। মনে হয় কেন, অপরাধ তো করছিই। বন্ধ অফিসের কর্মীর কাছ থেকে মেয়ে পড়িয়ে টিউশন ফি নেওয়া অবশ্যই খুব বড় অপরাধ। ভেবেছিলাম, টিউশনটাই ছেড়ে দেব। কিন্তু মুনির জন্য পারিনি। গত তিন মাস হল একটা উপায় বের করেছি। মাইনের খামটা ভুল করে টেবিলের ওপর ফেলে আসছি। প্রথমবার ভয়ে ভয়ে ছিলাম। পরদিন ফেরত দিয়ে দেবে না তো? দেয়নি। আমি ঝামেলামুক্ত হয়েছি।

যাই হোক, টাকাপয়সার এই পরিস্থিতি নিয়ে ঘরে বইয়ের তাক তৈরি করা যায় না। বই রাখতে হয় নড়বড়ে তক্তাপোষের ওপরে এবং নীচে। গীতবিতান আছে তক্তাপোষের নীচে। মাথার দিকে। গীতবিতান মাথায় দিয়ে ঘুমোনোর মজাই আলাদা। স্বপ্নে গান পাওয়া যায়। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরতের গান।

অনেক ভাবুক মার্কা কথা হল। এবার আসল সত্যটা ফাঁস করি।

এই যে আমি চাঁদি ফাটা রোদে পাকা আম সেজে হাঁটছি তার পিছনে যতটা না প্রকৃতি প্রেম আছে, তার থেকে অনেক বেশি আছে অর্থ প্রেম। প্রেম না প্রয়োজন। তাও আবার একটা-দুটো টাকা নয়। পাক্কা দু-হাজার টাকা। এই মুহূর্তে দু-হাজার টাকা আমার কাছে বিরাট ব্যাপার। পাড়ার মোড়ের যে ছোট রেস্টুরেন্টে আমি দু-বেলা খাই তার মালিক বদলে গেছে। খাতায় কলমে বদলে গেছে কিনা জানি না, তবে কাকার বদলে ভাইপো এসেছে। সেই ছেলে এখন ক্যাশে বসছে। রেস্টুরেন্টের নাম ‘কাকার খাবার’। শুনেছি, ভাইপো ছোকরাটি টেঁটিয়া ধরনের। মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা। জ্যামিতির উপপাদ্যের মতো (আমার ছাত্রী মুনির কাছ থেকে শেখা) সব টেঁটিয়ারাই মুখে মিষ্টি কথা বলে। তবে সব মিষ্টি কথা বলা লোকেরাই টেঁটিয়া হয় না। পরশুদিন রাতে খাওয়া শেষ করে যখন হাত ধুচ্ছি তখন ভাইপো আমাকে তার টেবিলে ডাকল। টেবিলে মৌরির বাটি, বিল, ধারবাকির জাবদা খাতা, টাকা রাখার টিনের সুটকেস।

‘বসুন স্যার।’

আমি বসলাম। এটা আমি আজকাল করি। কেউ বসতে বললে সুযোগ ছাড়ি না। বসতে বলা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। ‘এসো কাজের কথা বলো এবং দ্রুত কেটে পড়ো’-তে চারপাশ ভরে যাচ্ছে।

ভাইপো বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘স্যার, খাওয়া কীরকম হল?’

খাওয়া বলতে ডাল, একটা তরকারি, ডিমের ডালনা, কাঁচা পেয়াজের দুটো টুকরো। বলতে নেই, ‘ভাইপো’ দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই এদের রান্নার মান উৎকৃষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘কাকার’ আমলে ডাল, তরকারি, ডিমের ঝোলের মধ্যে কোনও ফারাক ছিল না। দু-একদিন আমি ডাল ভেবে উচ্ছে ভাজা দিয়ে ডিমের ঝোল খেয়ে ফেলেছিলাম। এখন অবস্থা বেশ বদলে গেছে দেখছি। কিন্তু টেঁটিয়া ভাইপোকে সে-কথা বলা ঠিক হবে না। মাথায় চড়ে বসবে। তাকে ঘাবড়ে দিতে হবে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে রায়দানের ঢঙে বললাম, ‘খাওয়া ভালো হল না।’

ভাইপো উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘কেন স্যার! গোলমাল কোথায় হল?’

আমি হাত বাড়িয়ে ভাইপোর সামনে রাখা ভাঙা বাটি থেকে মৌরির গুঁড়ো তুললাম। মুখে ফেলে জ্ঞানী ভঙ্গিতে বললাম, ‘মনে হচ্ছে ফোড়নে গোলমাল হচ্ছে। মুসুর ডালের ফোড়ন আলুর তরকারিতে চলে গেছে। ডিমের ডালনা খেয়ে মনে হল, পুঁইশাক খাচ্ছি।’

ভাইপো আঁতকে ওঠে।

‘সেকী স্যার! আমি স্যার রাঁধুনি পালটেছি। কাকার আমলের রাঁধুনি ছিল বীরবল। বেটাকে দূর করে দিয়েছি। বীরবল ছিল মারু চোর। ক্রিমিনাল। তেল চুরি করে ফাঁক করে দিচ্ছিল।’

আমি আলতো হাইয়ের ভঙ্গি করে বললাম, ‘ওইটাই ভুল করেছ। বীরবল অভিশাপ দিয়ে গেছে।’

‘অভিশাপ!’

‘হ্যাঁ, ফোড়ন গোলমালের অভিশাপ।’

ভাইপো ভুরু কুঁচকে গলা নামিয়ে বলল, ‘ফোড়ন নিয়ে অভিশাপ হয় নাকি!’

আমি বললাম, ‘কেন হবে না? সব কিছু নিয়ে শাপ-অভিশাপ হতে পারলে ফোড়ন নিয়ে অভিশাপ হবে না কেন? তাছাড়া একজন রাঁধুনি মশলাপাতি, ফোড়ন ছাড়া আর কী নিয়েই বা অভিশাপ দিতে পারে? তাকে মানাবেই না।’

‘কিন্তু স্যার খদ্দেররা তো সকলেই খেয়ে প্রশংসা করছে।’ ভাইপোর গলায় সন্দেহ।

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘তুমি ছেলেমানুষ। তাই সবার কথাকে সত্য বলে মনে করছ। তোমার কাকা এই ভুলটা করতেন না। সবাই কী বলছে তাই দিয়ে আসল সত্য জানা যায় না। একসময় সবাই বলেছিল, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। আসল সত্য কি তাই?’

ভাইপো চোখ সরু করে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। কী দেখল কে জানে। তারপর ভক্তিভরা গলায় বলল, ‘স্যার, আপনার মতো জ্ঞানীগুণী মানুষ যে আমার এখানে খেতে আসে এটাই আমার চরম সৌভাগ্য।’

আমি সুন্দর করে হেসে বললাম, ‘ধন্যবাদ।’

‘একটা পরামর্শ যদি আমাকে দেন।’

‘বলো।’ আমি সিরিয়াস ভঙ্গি নিলাম।

‘এই রেস্টুরেন্টটা আমি একটু নতুন ভাবে সাজাতে চাইছি। পয়সাকড়ি খরচ করব।’

আমি স্মার্ট ভাবে বললাম, ‘এ তো খুব ভালো কথা। ব্যবসা বড় করতে গেলে নতুন ভাবে ভাবতে হয়। তুমি একেবারে নাম থেকে শুরু করো। দোকানের নতুন নাম দাও।’

ভাইপো চাপা অথচ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘নতুন নাম! বা:, দারুণ বলেছেন তো স্যার! কাকার খাবারের বদলে ভাইপোর খাবার করে দেব? খারাপ হবে?’

আমি মুহূর্তখানেক ভেবে বললাম, ‘ভালো হবে না। তুমি পুরো নামটা বদলিও না। খানিকটা বদলাও, খানিকটা রেখে দাও। কাকার খাবারের জায়গায় কাকা-ভাইপোর খাবারদাবার করে দাও। এতে পুরোনোটা রইল, আবার নতুনও এল। দুয়ের মেলবন্ধন ঘটল।’

ভাইপো আমার কথা শুনে আধখানা উঠে দাঁড়াল। হাত কচলে বলল, ‘এটা যে স্যার আপনি কী ভালো একটা পরামর্শ দিলেন! আহা! কাকা-ভাইপোর খাবারদাবার! আমি স্যার আজই নতুন সাইনবোর্ড বানাতে দিই?’

আমি অনুমতি দেওয়ার ঢঙে বললাম, ‘দিয়ে দাও। টাঙানোর আগে আমাকে একবার দেখিয়ে নিও।’

ভাইপো ঝুঁকে পড়ে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, ‘অবশ্যই নেব স্যার। একশোবার নেব। কাকার মতো কেতরে পড়া সাইনবোর্ড নয়। আলো লাগানো ঝলমলে সাইনবোর্ড হবে। একেবারে এই লম্বা। দোকানের এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত। নতুন সাইনবোর্ড উপলক্ষে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করব। আপনি থাকবেন। কাকাকেও ডাকব। কাকা দোকান ছেড়ে দিয়েছে তো কী হয়েছে? এই দোকান তো ওরই। তাই না স্যার?’

আমি মনে মনে প্রমাদ গুনতে লাগলাম। এই টেঁটিয়া ছোকরা অতি ভক্তি ভাব দেখায় কেন? নিশ্চয় কারণ আছে। নিজেকে সামলে আমি বললাম, ‘অবশ্যই তাই। তোমার ভালো হবে। তুমি তাড়িয়ে দেওয়া রাঁধুনি বেচারিকেও সেদিন ডেকো। বীরবলকে। মনে হয়, তাতে ফোড়ন অভিশাপ কেটে যাবে।’

ভাইপো চেয়ারে বসে খুশি খুশি মুখে বলল, ‘আপনি আশীর্বাদ করুন স্যার।’ বলতে বলতে ছোকরা দ্রুত হাতে টেবিলের ওপরে রাখা ধারের জাবদা খাতাটা ওলটাতে থাকে। আমি সতর্ক হলাম। ভাইপো খাতার মাঝামাঝি এসে থমকে গিয়ে বলল, ‘স্যার, হিসেব করে দেখেছি, নতুন সাইনবোর্ড বানাতে হাজার দুইয়ের মতো টাকা লেগে যাবে। টাকা কোনও সমস্যা নয়। আপনার কাছে আমাদের যা পাওনা আছে সেটা পেলেই হয়ে যায়। এই যে স্যার আমি হিসেব করে রেখেছি, সব মিলিয়ে বাইশশো টাকার মতো আপনি দেননি। দুশো টাকা বাদ দিন। জ্ঞানী মানুষের ছাড় আছে। আপনি দিন দুয়েকের মধ্যে দু-হাজার টাকা মিটিয়ে দিন। ঠিক আছে দুদিন নয়, তিনদিনই করুন। আপনি যদি নিজে দিয়ে যান তাহলে তো কথাই নেই। নইলে ঠিক তিনদিন বাদে আমি আপনার কাছে লোক পাঠাব।’ এই পর্যন্ত বলে একটু চুপ করল ভাইপো। তারপর মিটিমিটি হেসে বলল, ‘স্যার, সেই লোক কিন্তু টাকা না নিয়ে আপনার কাছ থেকে ফিরবে না। ক্রিমিনাল তো। লোকটাকে আপনি হয়তো চিনতে পারবেন। হয়তো কেন, নিশ্চয় চিনতে পারবেন। আমাদের পুরোনো রাঁধুনি। বীরবল। বীরবল দ্য গ্রেট। আপনার ফেভারিট। রাঁধুনির পোস্ট থেকে দূর করে দিয়ে আমি তাকে এখন পাওনা আদায়ের কাজে নিয়োগ করেছি। লোকটা ষন্ডা-গুন্ডা প্রকৃতির। মনে হয়, টাকা আদায়ের জন্য সে ভালোই ফোড়ন অ্যাপ্লাই করতে পারবে। আপনার পছন্দ হবে।’

কথা শেষ করে দাঁতের ফাঁকে বিশ্রি করে হাসল ছোকরা। আমিও হাসলাম। মলিন হাসি। ভাইপো হাত কচলে বলল, ‘স্যার : আজকের খাবারের দাম কিন্তু কিছুতেই নেব না। রেস্টুরেন্টের নাম দিয়ে আপনি আমার বড় উপকার করলেন। আহা! কাকা-ভাইপোর খাবারদাবার। কাকার খাবার খেয়ে এতদিন যারা পয়সা দেয়নি, ভাইপো এবার তাদের দাবার করবে। হা-হা।’

আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে চিন্তায় পড়লাম। ছোকরা সরাসরি হুমকি দিল। এমনি হুমকি নয়, পিছনে গুন্ডা লাগানো হুমকি। বীরবল গুন্ডা হয়ে গেল! যাক, যে যা হতে চায়। তবে গুন্ডাকে যে আমি ভয় পাই এমন নয়। কিন্তু টাকা না দিয়ে পালিয়ে বেড়ানোর লজ্জাকে ভয় পাই। লজ্জার ভয় গুন্ডার ভয়ের থেকে অনেক বেশি। গুন্ডা থেকে পালানো যায়, লজ্জা থেকে যায় না। আমি দু-হাজার টাকা কোথায় পাব? তমাল দেবে?

এই ফাঁকে তমাল সম্পর্কে দুটো কথা বলে নিই। যারা তাকে চেনেন তারা তো চেনেনই, যারা চেনেন না তাদের সুবিধে হবে। তমাল আমার অগতির গতি। সম্পর্কে বন্ধু হওয়ার কারণে ওর কাছ থেকে যখন খুশি টাকাপয়সা চাই। হাজার বায়ানাক্কা আর ফ্যাচাং করি। সে প্রথমে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে যায়, তারপর একসময় দিয়েও দেয়। অনেকে ভাববে বন্ধুর প্রতি বন্ধু প্রেম। মোটেই না। আমি আসল কারণ জানি। আমার এই অলস, অকর্মণ্য জীবনযাপনকে তমাল মনে মনে হিংসে করে। বেচারিকে দশটা-পাঁচটা অফিস করতে হয়। মাসের মধ্যে দশদিন ট্যুর। ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন মনে মনে আমার কথা ভাবে। ভাবে, হারামজাদা সাগরটার পয়সাকড়ি নেই ঠিকই কিন্তু অপার শান্তি আছে। স্বাধীনতা আছে। যাক, কালই ওর অফিসে চলে যাব।

তমাল খানিকক্ষণ চোখ বুঁজে ভাবল। চোখ বুজেই বলল, ‘কীসের জন্য তোর এত টাকা লাগবে?’

আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম, ‘দাবার আটকাব।’

তমাল চোখ খুলে বলল, ‘দাবার! সেটা কী?’

‘পিটুনি। রাঁধুনির পিটুনি।’

তমাল চোখ কটমট করে বলল, ‘ইয়ার্কি মারছিস?’

আমি পা দোলাতে দোলাতে বললাম, ‘নিজের দোষে ফেঁসে গেছি রে। দোকানের নাম বদলানোর অ্যাডভাইস দিতে গিয়ে যে কী ঝামেলায় পড়লাম।’

তমাল চোখ বড় করে বলল, ‘দোকানের নাম! তুই কি দোকান দিচ্ছিস সাগর?’

‘না, অন্য ব্যাপার। পরে বলব। তুই টাকা দে।’

তমাল আবার চোখ বুঁজল। বেশ খানিকটা সময় ধ্যানের মতো বসে রইল চুপটি করে। বলল, ‘এই ভাবে তুই অনেকবার টাকা নিয়েছিস। আমার উচিত তোকে এখনই অফিস থেকে বের করে দেওয়া। কিন্তু আমি তা করব না। আমি তোকে একটা চান্স দিতে চাই।’

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘কী চান্স?’

‘নিজের টাকা নিজে রোজগার করে নেওয়ার চান্স।’

‘চাকরি?’ ঢোঁক গিলে বললাম।

তমাল মাথা নাড়ল। আমি বললাম, ‘তাহলে কী?’

‘দুজন বুড়োবুড়িকে বাড়ি থেকে তুলে দিতে হবে।’

আমি চমকে উঠলাম। বললাম, ‘ভাড়াটে উচ্ছেদ?’

তমাল অফিসার মানুষ। ঘরে এসি মেশিনের ফিসফিসে ঠান্ডা। চেয়ারটা গদি মোড়া। দুপাশে নড়ে। তমাল সেই চেয়ার দুপাশে নাড়িয়ে বলল, ‘না উচ্ছেদ নয়। পুনর্বাসন। রিহ্যাবিলিটেশন।’

‘মানে?’

‘মানে ভেরি সিম্পল। তুই বুড়োবুড়ি দুজনকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিবি দু-হাজার টাকা পাবি।’

আমি হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললাম, ‘গুন্ডামি?’

তমাল চেয়ার নাড়া থামিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘নো। ভুজংভাজুং দিয়ে কাজটা করতে হবে। আমি লক্ষ করে দেখেছি, বয়স্ক মানুষদের ম্যানেজ করার ব্যাপারে তোর একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। কোনও এক রহস্যময় কারণে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা তোকে বিশ্বাস করে ফেলে। তোর নিশ্চয় মনে আছে, আমার বিয়ের সময় বাবা-মাকে তুই রাজি করিয়েছিলি? যাক তুই কাজটা করবি কিনা বল।’

কাঁপা গলায় বললাম, ‘নার্ভাস লাগছে তমাল। বিয়ে আর বাড়ি থেকে সরানো কি এক হল। সামান্য দু-হাজার টাকার জন্য বৃদ্ধ দম্পতিকে গৃহহীন করতে বলছিস?’

তমালের গলায় বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘উফ বলছি তো গৃহহীন নয়। জাস্ট শিফট।’

আমি আবার জলে পড়লাম। ডাল, তরকারি, ডিমের ডালনা নিয়ে চালবাজি করতে গিয়ে এ কোন বিপদে পড়লাম? বিপদ তো নয় পাপ। তমাল টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘দাঁড়া তোকে সবটা বলছি।’

তমালের কলেজের বন্ধু শিবশম্ভু। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে আমেরিকা। কলেজ না ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। সেখানে বাড়ি কিনেছে। বাড়িতে টেনিস কোর্ট, সুইমিং পুল। শিবশম্ভুর পৈতৃক বাড়ি কলকাতায়। হাতিবাগানের মদন মুখোটি লেনে। সেই বাড়ি বড়। দোতলা। বুড়ো বাবা-মা থাকে। বাবা ডাকে শিব, মা ডাকে শম্ভু। ডাকাডাকির অবশ্য সুযোগ তেমন পায় না। শিবশম্ভু আগে বছরে একবার বাবা-মায়ের কাছে আসত। তারপর দু’বছরে একবার। এবার আসছে পাঁচ বছর পর। আসছে বাড়ি বিক্রি করতে। টাকার দরকার। শিবশম্ভুর মেয়ের নাম সুন্দর। নয়ন। বন্ধুরা ডাকে আই। আইয়ের শখ আমেরিকার বাড়িতে একটা ঝোলানো বাগান করবে। গত উইনটারে সে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল। ব্যাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেন দেখে মুগ্ধ। ওই জিনিস তার বাড়িতেও চাই। ছোট হলেও চলবে কিন্তু চাই। মেয়ের আবদার শিবশম্ভু ফেলে দিতে পারছে না। কিন্তু শূন্যে বাগান বানাতে গাদাখানেক খরচ। সেখানে চেরি, টিউলিপ, গোলাপ ফোটাতে আরও খরচ। সেই খরচ আসবে কোথা থেকে? শিবশম্ভুর স্ত্রী অতি বুদ্ধিমতী। সে কলকাতার বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। উত্তম প্রস্তাব। কলকাতার বাড়ি রাখাও যা হাতি পোষাও তাই। শিবশম্ভু বুদ্ধিমতী স্ত্রীর প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। অশিক্ষিত স্বামীরা অনেক সময় স্ত্রীর প্রস্তাব মানতে চায় না। ইগোতে লাগে। শিক্ষিত স্বামীরা এই ভুল করে না। শিবশম্ভুও করল না। সে ঠিক করেছে, বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। সেই উদ্দেশ্যে তার কলকাতায় ছুটে আসা। কিন্তু সমস্যা করছে বুড়োবুড়ি। তারা বাড়ি ছাড়তে নারাজ। ছেলে মুখে, ছেলের বউ টেলিফোনে হাজার বোঝানোর চেষ্টা করেছে। তারা শুনছে না। শিবশম্ভুর বৃদ্ধ বাবা নাকি অবাক হয়ে বলেছে, ‘নিজের বাড়ি ছেড়ে মরতে অন্য জায়গায় যাব কেন?’

শিবশম্ভু বলল, ‘বাবা, জীবন অনেক সহজ হবে। নিজের বাড়ি মানে কত হ্যাজার্ড। ফ্যাকড়া। আজ জলের পাইপ ফাটছে। কাল ছাদের চাঙর খসে পড়ছে।’

‘তোর কী শিব? জলের পাইপ ফাটলে তো তোকে ডাকব না, কলের মিস্ত্রি ডাকব। ফ্যাকড়া তুই সামলাবি না, আমরা সামলাব।’

শিবশম্ভু মাথা নামিয়ে বলেছে, ‘বাপি চিন্তা হয়। একা থাকো। হঠাৎ যদি অসুখবিসুখ হয়…। ওল্ড এজ হোমে থাকলে আরও দশজনের সঙ্গে থাকবে। বুকে ব্যথা হলে তারাই ডক্টরকে কল করবে।’

শিবশম্ভুর মা ঘন ঘন পান খান। তিনি মুখে পান ফেলে জড়িয়ে মড়িয়ে বলেছেন, ‘আহারে বিরাট চিন্তাবিদ এসেছে রে। পাঁচ বছর বাদে বাপ-মাকে দেখতে এসেছে তার আবার বুকে ব্যথা নিয়ে চিন্তা! তোকে আমাদের নিয়ে ভাবতে হবে না শম্ভু। নিশ্চয় এর পিছনে কোনও বদবুদ্ধি আছে। আমরা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাব না।’

শিবশম্ভু বলল, ‘তুমি অকারণ বকাবকি করছ মামি। বি লজিকাল।’

শিবশম্ভুর মা বললেন, ‘লজিকালের গুষ্টি কিলাই। এসব তুই তোর ছাত্রদের বোঝা গিয়ে।’

শিবশম্ভু বলল, ‘বাবা, তুমি মাকে বোঝাও। তোমরা দুটো মাত্র মানুষ, এতবড় একটা বাড়িতে পড়ে আছ এক কোণে। যে-কোনওদিন চুরি-ডাকাতি হয়ে যাবে।’

শিবশম্ভুর বাবা গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘চুরি-ডাকাতি হলেও তোমাকে ডাকব না শিব। পুলিশ ডাকব।’

শিবশম্ভু এবার উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘ওহ বাবা, তোমরা ব্যাপারটা বুঝতে চাইছ না। কলকাতায় এখন রিয়েল এসটেটের বিজনেস বুম হয়ে আছে।’

তমাল বলেছে, শিবশম্ভুর নাকি এটা একটা সমস্যা। সম্বোধনে বাবা-বাপি, মা-মামি গুলিয়ে যায়। একটায় স্থির থাকতে পারে না। দীর্ঘদিন বাবা-মাকে ছেড়ে বাইরে থাকলে কি এই অসুবিধে হয়? কে জানে।

শিবশম্ভুর বাবা বললেন, ‘তুমি রিয়েল এসটেটের কী বোঝো? পড়াও তো ফিজিক্স।’

শিবশম্ভু লজ্জা পাওয়া মুখে বলল, ‘ফিজিক্সের টিচার হলেও আমি রিয়েল এস্টেট নিয়ে গবেষণা করছি। ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপ পেয়েছি। আমেরিকায় এরকম করা যায়। ধরো তুমি ভূগোলের লোক, তুমি ইচ্ছে করলে কিটসের কবিতা নিয়ে তিন বছরের কাজ করতে পারো। ওরাই খরচাপাতি দেবে।’

শিবশম্ভুর বাবা নাকে ফোঁস আওয়াজ করে বললেন, ‘গরিব দেশগুলোর টাকা নিয়ে বেটারা কোথায় ফেলবে বুঝতে পারে না।’

শিবশম্ভুর মা বললেন, ‘শম্ভু তুই যা খুশি নিয়ে গবেষণা কর। হাতি, ঘোড়া, ব্যাং যা পাবি। তোদের ওখানে টাকার যখন সমস্যা নেই, তখন ব্যাঙাচি নিয়েও করতে পারিস। আমাদের জ্বালাবি না। এই বাড়িতে তোর বাবা আর আমি মরব। বলতে পারিস ওটাই হবে আমাদের গবেষণা। নিজের বাড়িতে মরতে কেমন লাগে আমরা দেখব।’

শিবশম্ভু বলল, ‘আউচ মামি। তুমি জানো, এই বাড়ির ভ্যালুয়েশন এখন কত? এসো এই বাড়ি আমরা বিক্রি করে দিই।’

এই কথার পর শিবশম্ভুর বাবা নাকি ছেলেকে কঠিন অপমান করেছেন। মুখের ওপর বাসি খবরের কাগজ তুলে বলেছেন, ‘তুমি কবে তোমার দেশে ফিরবে শিব?’

অন্য কেউ হলে নিশ্চয় অভিমানাহত হত। শিবশম্ভু হয়নি। সম্ভবত আমেরিকার মতো বড় দেশে অভিমানের মতো ছোট জিনিসের ঠাঁই নেই। শিবশম্ভু হাল ছাড়েনি। সে যোগাযোগ করেছে তার কলেজের বন্ধু তমালের সঙ্গে। ঘটনা বলেছে। ডায়লগ টু ডায়লগ সব বলেছে। বলেছে, বাবা-মায়ের কথা শুনে দু:খ পাওয়ার কিছু নেই। এটা জেনারেশন গ্যাপ। চেনা পরিচিত কাউকে দিয়ে বাবা-মাকে বোঝানো যাবে না। একজন থার্ড পার্টি লাগবে। ঠান্ডা মাথায় সে বুড়োবুড়ির সঙ্গে কথা বলবে। বোঝাবে হাতিবাগানের স্যাঁতস্যাঁতে পুরোনো বাড়ির থেকে বৃদ্ধাশ্রম অনেক ভালো। অনেক সেফ। সেখানে ঝড়-বাদলা, ভূমিকম্প, বজ্রপাতে দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা নেই। সবথেকে বড় কথা সেখানে টুয়েন্টিফোর আওয়ারস রানিং হট এন্ড কোল্ড ওয়াটার আছে। মানকুণ্ডুতে ওল্ড এজ হোমের সঙ্গে কথাবার্তা পাকা হয়ে আছে। ওদের নিয়ে গিয়ে একবার ফেলতে পারলেই হবে। সব শুনে তমালের কেন জানি মনে হয়েছে, কাজটা আমি পারব।

আমি ভাবতে বেশি সময় নিইনি। শিবশম্ভুর বাবা-মায়ের যে ডায়লগ আমি শুনলাম তা যদি অর্ধেকটাও সত্যি হয় তাহলেই যথেষ্ট। মানুষ দুজন খুবই ইন্টারেস্টিং। ওনাদের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে। সেটাই আমার লাভ। আর সেই কথার জন্য যদি দু-হাজার টাকা পাই তাহলে লাভের ওপর লাভ। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘কাজটা আমি করব তমাল। তুই কিছু টাকা অ্যাডভান্স দে। ঘটনা শুনে যা বুঝলাম, শিবশম্ভুর বুড়ো বাবা-মাকে ম্যানেজ করা আমার পক্ষে মোটেই কঠিন হবে না। অলরেডি ওরা অনেকটাই ম্যানেজ হয়ে আছেন।’

তমাল সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলছিস?’

‘অবশ্যই বলছি। একটা ঝুলন্ত বাগানের জন্য এই পরিশ্রম করতেই হবে। ব্যাবিলনে যখন এই বাগান তৈরি হয়েছিল তখন কত মানুষ কত পরিশ্রম করেছিল বল তো?’

তমাল বিড়বিড় করে বলল, ‘ঠাট্টা করছিস?’

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘হাসিঠাট্টাই তো সাগরের অস্ত্র। তুই তোর বন্ধুকে একবার জিগ্যেস করিস তো ওই দেশে হাসিঠাট্টা নিয়ে গবেষণার কোনও সুযোগ আছে কিনা। স্কলারশিপ পাওয়া যাবে? ফুলব্রাইট স্কলারশিপ? নে, কথা না বাড়িয়ে টাকা ছাড়। আর তোর শিবশম্ভুকে পরশু দুপুর বারোটায় স্পটে চলে আসতে বলবি। হাতিবাগানের পৈতৃক ভিটেতে।’

আমি চেয়েছিলাম হাজার। তমাল দিয়েছে পাঁচশো টাকা। কাল বিকেলে আমি ‘কাকার খাবার’ দোকানে গিয়ে ভাইপোর সঙ্গে দেখা করেছি। কেন করেছি? পরে বলছি।

টাকার জন্য রোদে জলে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছি বলতে কেমন একটা প্রেস্টিজে লাগে। তাই নাচ, গান, বাজনা, রবীন্দ্রনাথ বলে বিষয়টাকে একটা ইমেজ দিতে চেষ্টা করছিলাম এতক্ষণ। একসময় হাতিবাগানের মদন মুখোটি লেনে পৌঁছে গেলাম ছায়াহীন পথ পেরিয়ে। বাড়িটাও পেয়ে গেছি। শিবশম্ভুর পিতামাতা কোন তলায় থাকেন? গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওই সাদা রঙের বড় গাড়িটাই নিশ্চয় শিবশম্ভুর। মনে হয় কলকাতায় এসেই গাড়ি ভাড়া করে নিয়েছে। স্বাভাবিক। অত বড় পণ্ডিত মানুষ। আমার মতো তো আর ‘হ্যা হ্যা, ফ্যা ফ্যা’ নয়। সে এই আম পাকা রোদে হেঁটে ঘুরবে কেন?

কিন্তু সে? সে কই? ভুলে গেল নাকি? কেন ভুলে যাবে? ‘ভাইপো’র কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আমি নিজে পরশু রাতে তার বাড়ি গিয়ে টাকা দিয়ে এসেছি। কড়কড়ে পাঁচশো টাকা। টাকা নিয়ে গায়েব হয়ে গেল?

না, হয়নি। ওই তো সরু গলির মাঝখান দিয়ে হেঁটে আসছে বীরবল। ষণ্ডামার্কা চেহারা নিয়ে আসছে হেলতে দুলতে। খাটো ধুতি, কালচিটে ফতুয়া। কাঁধে গামছা। দরদর করে ঘামছেও। ঘামে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না। দেওয়ার কথাও নয়। এতবছর ‘কাকার খাবার’ রেস্টুরেন্টে উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে রান্না করেছে। গরম তাকে কখনও কুপোকাত করতে পারে? গামছা দিয়ে আলগোছে মাঝেমধ্যে ঘাম মুছছে শুধু। আর আমি যেমনটি বলেছিলাম সেই মতো ডান হাতে নিয়েছে একটা লম্বা খুন্তি। তরবারির মতো ঝুলছে। জ্যৈষ্ঠ মাসের রোদ পড়ে ঝলসে উঠছে। ভারি সুন্দর লাগছে। ভাগ্যিস কড়া রোদ রয়েছে নইলে এমন একটা দৃশ্য দেখা হত না।

এর পরের ঘটনা অতি সামান্য। না বললেও চলত। শিবশম্ভুর বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে আমি খুব সহজেই ‘ম্যানেজ’ করে ফেললাম। ওরা দুজন ছিলেন একতলার ঘরে। হিমশীতল ঘর। মোটা মোটা দেয়াল। অনেক উঁচুতে কড়িবরগার ছাদ। এসব ভেদ করে ঘরে গরম ঢুকছেই না। সত্যি পুরোনো বাড়িগুলোতে এখনও কী শান্তি! মনে হয় মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমিয়ে পড়ি। বুড়োবুড়ি আমাকে যত্ন করে বসালেন। আমি শিবশম্ভুকে বললাম, ‘স্যার, আপনি যদি একটু বাইরে যান ভালো হয়। আমি ওনাদের সঙ্গে একা আলোচনা করতে চাই। সবথেকে ভালো হয়, আপনি যদি নীচে গিয়ে বীরবলকে একটু সঙ্গ দেন। বেচারি এই রোদে একা দাঁড়িয়ে আছে।’

কোট-প্যান্ট পরা শিবশম্ভু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘বীরবল! বীরবলটা কে?’

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘ওরিজিনাল বীরবল সম্রাট আকবরের সভাসদ ছিলেন। রসিকতায় বিশেষ পারদর্শী। সম্রাটকে কত গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। তবে নীচে যে বীরবল দাঁড়িয়ে আছে তিনি ওরিজিনাল নন। তিনি কাকার খাবার দোকানের বিতাড়িত রাঁধুনি। আপাতত ভাইপোর আন্ডারে গুন্ডামি করছেন। আপনার অসুবিধে হবে না স্যার। ওই লোকও ভালো রসিকতা জানে।’

খানিকটা ভ্যাবাচাকা খেয়েই গুটিগুটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল তমালের বন্ধু। না গিয়ে উপায় কী? আমিই তার ভরসা। আমি উঠে গিয়ে দরজায় ভারী খিল তুলে দিয়ে এলাম। বললাম, ‘মাসিমা, মেসোমশাই আপনারা কঠিন মানুষ। আর একটু টাইট মেরে বসে থাকুন। কিছুতেই বাড়ি ছাড়বেন না।’

শিবশম্ভুর মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে বললেন, ‘ছেলেটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। নিজের সন্তান হয়ে বাবা-মাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে।’

শিবশম্ভুর বাবা বললেন, ‘তুমি আসার আগে আমাদের ভয় দেখিয়েছে। বলেছে, ভালো কথায় না হলে আঙুল বেঁকাবে।’

আমি বললাম, ‘আপনার ছেলের কোনও দোষ নেই মেসোমশাই। ওর ওপর রাগ করবেন না। আমেরিকার মতো বড়লোক দেশে বুড়ো বাপ-মাকে লাথি মারবার কোর্স আছে। তিনমাসের কোর্স। আমার ধারণা শিবশম্ভু সেই কোর্স করছেন। ওদেশে থিওরি শেষ করে এখানে এসেছে হাতেকলমে অ্যাপ্লাই করতে। চিন্তা করবেন না। উনি আর আপনাদের জ্বালাবেন না।’

শিবশম্ভুর মা অবাক হয়ে বললেন, ‘কীভাবে?’

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘জানি না কীভাবে। মাসিমা ঘরে কি আম আছে? থাকলে দিন দু-টুকরো খেয়ে যাই। সবথেকে ভালো হয় যদি হিমসাগর থাকে।’

আমি ফিরে যাচ্ছি। বীরবল তার ডিউটি পালন করেছে। সামান্য ডিউটি। হাতের খুন্তি দিয়ে শিবশম্ভুর ইয়েতে চার ঘা বসিয়েছে। আমি বলেছিলাম, দু-ঘায়ের বেশি মারার দরকার নেই। যতই হোক পণ্ডিত মানুষ। শিবশম্ভুই গোলমাল করেছে। বীরবলকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানোর অপরাধে তাকে অতিরিক্ত দু-ঘা খেতে হয়েছে। সেই ঘা খেয়ে শিবশম্ভু তার গাড়িতে উঠে পালিয়েছে। আমি চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে দিয়েছি, এরপর বুড়ো বাবা-মাকে বাড়ি ছাড়া করতে গেলে জেলে পাঠাব। সেখানে খুন্তি পেটা নিয়ে গবেষণা করতে হবে।

রোদে রোদে কলকাতা ভেসে যাচ্ছে। আহা! কী চমৎকার! মনে হচ্ছে, আকাশের গভীর থেকে আমার ওপর সোনা ঝরে ঝরে পড়ছে। লম্বা ছায়া নিয়ে আমি হেঁটে চলেছি হনহন করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *