ছায়া শহর

ছায়া শহর

ভেতর ঘরে ফোন বাজছে। বাড়ির সবাই এখন খাবার টেবিলে। রাত দশটার পর বেশিরভাগ কল আমার আসে। তাই কেউ যাচ্ছে না ধরতে। রাতে সবার সঙ্গে খেতে বসার সময় ফোন এলে ভীষণ বিরক্ত হই আমি। এই একটা টাইমেই পরিবারের সবাই আড্ডার মুডে থাকি।

ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে থেমে গেছে বাবা, জানে আমাকে উঠতে হবে। আমি গড়িমসি করছি। ফোনটা থেমে যায়। মা মাছের বাটি এগিয়ে দিয়ে বলে, তুই এবার একটা কর্ডলেস সেট কেন। ওটা নিয়েই খেতে বসবি। একবার পাত থেকে উঠে গেলে, ইচ্ছেটাই চলে যায় খাওয়ার।

আমি চুপচাপ খেয়ে যাই। সুযোগ বুঝে আমার ব্যাঙ্ক চাকুরে দাদা পিছনে লাগে, মা, তুমি ওকে একটা ল্যাপটপও কিনতে বলো। বেচারার তো নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। খাবার টেবিলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করবে। তুমি ছোটবেলার মতো খাইয়ে দেবে।

দাদার কথায় বাবা ছাড়া সবাই হেসে ওঠে, এমনকী ছ’বছরের ভাইপো অন্তু পর্যন্ত। কী বুঝেছে কে জানে? আমি সবে দাদাকে বলতে শুরু করেছি, তোমার মতো যদি দশটাপাঁচটার সুখের চাকরি হত…

ফোন আবার বাজতে শুরু করে। অন্ত চেয়ার থেকে নেমে ফোন ধরতে ছোটে। বউদি আমার পক্ষ নিয়ে বলতে শুরু করে, সত্যি বাবা, সাংবাদিকতা যে এত ঝামেলার কাজ, এ বাড়িতে বিয়ে না হয়ে এলে জানতেই পারতাম না। বাইরের লোক কত কীই না ভাবে। আমিও তো চান্স পেলেই বাপের বাড়ির আত্মীয়দের কাছে আবিরকে নিয়ে খুব গর্ব করি।

বউদি খুব ব্যালান্সড মেয়ে, একই সঙ্গে আমার কাজের হ্যাজার্ডস এবং মাহাত্ম্য দুটোই বুঝিয়ে দিল। দাদা একটু যেন ডাউন।

কিন্তু অন্তু যে এখনও ফিরছে না। কার ফোন? এতক্ষণ কী কথা বলছে! বউদি গলা তোলে, কী রে অন্তু, কে ফোন করেছে?

পরদা সরিয়ে হাসিমুখে ডাইনিং-এ ফেরত আসছে অন্তু। বলে, কাকুনের ফোন। অর্থাৎ আমার। জিজ্ঞেস করি, কে?

তোমার গার্লফ্রেন্ড।

নিপাট বাঙালি পরিবারের ছেলেকে ইংরেজি স্কুলে পড়ানোর এই এক সমস্যা। বেচারা কত সরলভাবে কথাটা বলল, মুহূর্তে সবার মুখে অপ্রস্তুত ভাব।

খাবার ছেড়ে উঠতেই হল। বউদি অন্তুকে জিজ্ঞেস করছে, তুই এত সময় কী বকবক করছিলি?

জানো মা, আন্টিটা খুব সুইট। আমার সঙ্গে কত কথা বলল। নাম জানতে চাইল, কোন ক্লাসে পড়ি, স্কুল কোথায়…

ফোনটা অন্তুকে খুব ইমপ্রেস করেছে। মন্দিরা নিশ্চয়ই নয়, গলা চেনে অন্তু, তা হলে কে? যেসব প্রশ্ন করেছে, মনে হয় এ বাড়ির সঙ্গে পরিচিত নয়, অথবা অনেকদিন পর ফোন করছে। ক্রেডলের পাশে রাখা নিঃসঙ্গ রিসিভারটাকে মনে মনে বলি, কে মা, এত রাতে? কানে তুলে বলি, আবির বলছি।

অপর প্রান্তে মহিলা কণ্ঠ বলে ওঠে, কাল সকালে ফ্রি আছ?

একদম অচেনা গলা। গেস করতে পারছি না। কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, কেন?

একটু যেন চাপা অথচ স্পষ্ট উচ্চারণে অপর প্রান্ত বলে, আমার সঙ্গে একটা জায়গায় যেতে হবে।

কোথায়?

কাল মিট করে বলব। সকাল সাতটায় হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ির নীচে থেকো।

এবার একটু থমকালাম। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না? মেয়েটাকে না জেনেই ডেট করে ফেলছি। এমনও হতে পারে মন্দিরা গলা পালটে ফোন করছে। তবে মন্দিরা এত উঁচু জাতের অভিনেত্রী নয়, কোনও বন্ধুকে দিয়ে আমার সততা টেস্ট করাচ্ছে না তো? এরকমটা করানো উচিত হচ্ছে না মন্দিরার। ও আমার কলেজ লাইফ থেকে পার্টনার। ও প্রান্তের মেয়েটির গলা বেশ ভাল। আর একটু খেলতে চেয়ে বলি, কোথায় যাব, কেন যাব, না বললে প্রিপেয়ার্ড হব কী করে!

প্রিপারেশন বলতে তোমার সঙ্গে যা থাকে, নোটবুক আর পেন। ও দুটো সঙ্গে নিলেই চলবে।

তার মানে মেয়েটা ভুল নাম্বারে ফোন করেনি। আমি যে রিপোর্টার সেটা জানে। এবং যেখানে নিয়ে যেতে চাইছে, তার সঙ্গে খবরের কোনও সম্পর্ক আছে। কোনও স্কুপ দিতে চাইছে সম্ভবত। অর্থাৎ মেয়েটি আমার অযাচিত সোর্স। এতদিন পর্যন্ত একটি মেয়েই সোর্স ছিল আমার, রামবাগানের ঝিলিক। তার উচ্চারণ আর সহবতের ঠেলায় আমি বেশিক্ষণ তাকে সহ্য করতে পারি না। সে এখন বেশ কিছুদিন ধরে লালবাজার সেন্ট্রাল লক আপে। সাংবাদিকদের কত কিছুই না সহ্য করতে হয়! তুলনায় এই মেয়েটি সোর্স হিসেবে বেশ ভালই হবে মনে হচ্ছে।

নীরবতা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে দেখে ও প্রান্ত বলে, কী, ভয় পেয়ে গেলে ইয়াং রিপোর্টার? তুমি তো আবার লালবাজার রিপোর্টিং-এ আছ। এই সাহস সম্বল করে কাজ করো কী করে?

এবার একটু বিরক্তই লাগে। এ কে অচেনা মেয়ে, তারপর আবার তখন থেকে তুমি তুমি করে যাচ্ছে, সারাদিন খাটাখাটনির পর, এসব আর ভাল লাগে? বাধ্যত রুক্ষ গলায় বললাম, তুমি মানে আপনি… আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। হেঁয়ালি বন্ধ করে আপনার নাম এবং প্রয়োজনটা স্পষ্ট করে বলুন।

খাবার টেবিলে ফিরে এসেছি। মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। আমার ছোট্ট সাংবাদিক জীবনে এই ফোনটার গুরুত্ব অসীম। কাজটা যদি ঠিকমতো নামাতে পারি, কেরিয়ারের পথ মসৃণ হবেই। কলিগদের কাছে বেশ একটা ঘ্যাম নেওয়া যাবে।

সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে। শুধু বউদি নিজের শূন্য থালায় আঁক কাটছে আমার প্রতীক্ষায়। বিশেষ ভ্রূ ভঙ্গি করে বউদি জিজ্ঞেস করে, কার ফোন গো? এত রাতে মেয়ের ফোন আসা, এত গল্প করা মোটেই সুবিধের ঠেকছে না আমার।

কথার উত্তর না দিয়ে হাসিহাসি মুখে খাওয়া শেষ করতে লাগলাম। বউদি আর একবার খোঁচাল, কী হল, কিছু বলছ না যে! ফোনটা পেয়ে বেশ খুশি হয়েছ মনে হচ্ছে।

বাধ্য হয়ে বলতে হল, সাংবাদিকদের কিছু জিজ্ঞেস করতে নেই, পড়ে নিতে হয়।

বউদি হয়তো বুঝতে পারল ফোনটা নেহাতই ‘নিউজ’ সংক্রান্ত, তাই আর কথা না বাড়িয়ে টেবিলের থালা বাটি তোলায় মন দিল।

খাওয়া সেরে, হাত-মুখ ধুয়ে ফোনের কাছে এলাম। আমার সেকশন বসকে ফোন করতে হবে। ডায়াল করতেই পাওয়া গেল। ও প্রান্ত থেকে বলে ওঠেন, ফোন তুললাম সুমিত ঘোষ।

খুব মুডে থাকলেই রিসিভার তুলে এরকম উদ্ভট কথা বলেন বস। বললাম, আবির বলছি সুমিতদা।

বুঝলাম, নেক্সট।

এইমাত্র একটা ফোন পেলাম। গণসংগ্রাম গোষ্ঠী কাল প্রেস মিট করতে চায়। আমাকে ডাকছে।

তোকে কেন?

না, আসলে ডাকছে আমাদের কাগজকে। মুখপাত্র হিসেবে বাছল আমাকে।

প্রেসের সঙ্গে কোথায় কথা বলবে?— গলা শুনে বোঝা যাচ্ছে আধশোয়া থেকে উঠে বসলেন সুমিতদা। বললাম, এখনও জানায়নি মিটিংটা কোথায় হবে। কাল সকালে কলকাতার একটা জায়গায় দাঁড়াতে বলেছে, তখনই হয়তো বলবে।

একটু সময় নিলেন সুমিতদা। তারপর চিন্তান্বিত গলায় বললেন, তুই পারবি একা হ্যান্ডেল করতে! সঙ্গে শিশিরকে দেব?

ওরা ক্যামেরা আনতে বারণ করছে, আপনি ফটোগ্রাফার দিচ্ছেন!

ও প্রান্ত আবার চুপ। আমি মনশ্চক্ষে সুমিতদার মুখটা দেখতে পাচ্ছি, এখন তাঁর কপালে অসংখ্য ভাঁজ। চিন্তারই কথা। ‘গণসংগ্রাম গোষ্ঠী’ নিষিদ্ধ পার্টি। প্রশাসন আর প্রেসের নাগালের বাইরে। এদের সঙ্গে চিত্রা কী করে জড়িয়ে পড়ল, সেটাই সব থেকে আশ্চর্যের! ফোনটা করেছিল চিত্রা, আমার কলেজ-বান্ধবী। আবার বস-এর গলা, ভাবছি, ফোনটা কোনও ট্র্যাপ নয়তো, বিপদে না পড়ে যাস!

আমাকে কেন ট্র্যাপে ফেলবে ওরা? বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চাই। ফোনের ওপারে সুমিতদা বলেন, ওরা নয়, হয়তো অন্য কেউ ওদের নাম করে তোকে ডাকছে। রিসেন্টলি কারও পিছনে লেগে কোনও স্টোরি করেছিস কি?

করলে তো আপনিই প্রথমে দেখতে পেতেন।

তা ঠিক। হয়তো করতে যাচ্ছিলি। যাই হোক সাবধানে যাস। মোবাইল ফোন ফুল চার্জ করে নিবি। যখনই কোনও অসুবিধেয় পড়বি, ফোন করবি আমাকে।

ঠিক আছে। বলে বস-এর কাছে জানতে চাইলাম, আচ্ছা এদের গ্রুপটা ওয়েস্ট বেঙ্গলের কোন জায়গায় বেস করে মোটামুটি কাজ করছে আপনার জানা আছে? আমার কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে, এত ক’টা টেররিস্ট গ্রুপ হয়ে গেছে এখন, কারা কোন বেল্টে অ্যাকটিভ খেয়াল করতে পারছি না। আসলে এসব বিট-এ আগে কখনও যাইনি তো…

অজ্ঞানতাটা অজুহাতে ঢাকতে চাইছি, ধরতে পেরে সুমিতদা বলেন, নিজেদের কাগজটাও বোধহয় পুরো পড়িস না, তোরা করবি সাংবাদিকতা! শোন, ওদের নিয়ে বেশ ক’টা স্টোরি হয়েছে আমাদের কাগজে। ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরের ইন্টিরিয়ারে ওদের ঘাঁটি। অন্য যেসব গ্রুপ আছে, তাদের মধ্যে ওরাই সবথেকে খতরনাক। হিউজ আর্মস আছে ওদের হাতে। বছর খানেকের ভেতরেই বড় চার-পাঁচটা অপারেশন চালিয়েছে। দুটো জোতদার মেরেছে, পুলিশের জিপ উড়িয়েছে ল্যান্ডমাইন দিয়ে। লাস্ট অপারেশন, এসডিও নাকি বিডিও কাকে যেন চিঠি ধরিয়েছে, তাড়াতাড়ি শুধরে যান, নয়তো— একটু দম নিয়ে সুমিতদা বলেন, ওসব কথা এখন থাক, তোকে কলকাতায় যেখানে মিট করতে বলেছে, গিয়ে যদি দেখিস অন্য কাগজের লোক নেই, ফিরে আসবি।

কেন? ওরা যদি শুধু আমাদের কাগজকেই ইন্টারভিউ দেয়, তাতে আমাদেরই তো লাভ। এক্সক্লুসিভ স্টোরি করতে পারব।

বোকা ছেলে। ওরা তা করে না। ডাকলে, একসঙ্গে দু’-তিনটে লিডিং কাগজকে ডাকে। একটা কাগজ হলে, ইচ্ছেমতো কথা বসিয়ে দেবে ওদের মুখে। বলে, ফের খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন সুমিতদা। একটু পরে গভীর সংশয়ে বলে উঠলেন, আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আমাদের কাগজের কোনও সিনিয়র রিপোর্টারকে না ডেকে, তোকে কেন ডাকল !

একেই বলে পোড় খাওয়া সাংবাদিক, আসল পয়েন্ট থেকে নড়ছেন না। কিন্তু আমিও চিত্রার প্রসঙ্গ বলে দিতে পারি না। সজ্ঞানে কোনও সাংবাদিক নিজের সোর্সের কথা কাউকে জানায় না। নিজের বসকেও না। ফোনটা কাটতে হবে, নইলে খুঁচিয়ে নামটা বার করে নেবেন সুমিতদা। বলতেই হয়, এখন তা হলে রাখছি সুমিতদা। কাল সকালে একবার ফোন করব।

বেশ চিন্তান্বিত গলায় সুমিতদা বলেন, ও কে, বেস্ট অফ লাক।

ফোন নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে। একটা জিনিস ভেবে অবাক হচ্ছি, ওরকম একটা চরমপন্থী দলের সঙ্গে চিত্রার কী করে যোগাযোগ হল! চিত্রার সঙ্গে আমাদের, মানে আমার আর মন্দিরার নিয়মিত যোগাযোগ নেই প্রায় চার-পাঁচ বছর। এর মধ্যেই এতটা পালটে গেল মেয়েটা! কলেজে বাম রাজনীতি করত। খুব অ্যাকটিভ ছিল, তা নয়। তবে অবশ্যই একটু অন্য ধরনের মেয়ে ছিল। যথেষ্ট প্রতিবাদী, একটু রুক্ষ প্রকৃতির। প্রথমদিকে কারণ হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম, গ্রাম থেকে আসে কলেজ করতে, পথেঘাটের

ঝামেলায় মেজাজটা বশে থাকে না, ফার্স্ট ইয়ার কলেজ করার পর চিত্রা বেহালার এক আত্মীয়র বাড়িতে থাকা শুরু করল। স্বভাব কিন্তু পরিবর্তন হল না।

চিত্রা মূলত মন্দিরার বন্ধু ছিল। ওরা দু’জনেই আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র, সাবজেক্ট একই, হিস্ট্রি অনার্স। বিদ্যাসাগর কলেজ। আমার পরের বছর ওরা ইউনিভার্সিটিতেও চলে এল। এত ক’টা বছরের সম্পর্ক, তবু আমার, চিত্রার মধ্যে কোথাও যেন একটা গ্যাপ থেকে গিয়েছিল। সেই ফাঁকটা সম্ভবত মন্দিরার কারণেই রেখেছিল চিত্রা। এমনও হয়েছে, আমরা তিনজন হয়তো কোনও পার্কে অথবা সংস্কৃত কলেজের সিঁড়িতে বসে গল্প করছি, কখন যেন চুপ করে গেছে চিত্রা। হঠাৎ খেয়াল পড়তে বলি, কী হল চিত্রা, তুমি কিছু বলছ না যে!

উত্তরে বলত, ভাবছি। তোমরা কথা বলো না।

বুঝতে পারতাম ইচ্ছে থাকলেও, উঠে যেতে পারছে না চিত্রা। মন্দিরা খেপে যাবে। মন্দিরা চিত্রাকে বাচ্চাদের মতো ভালবাসত। চিত্রার একটা আলাদা অ্যাসোসিয়েশন ছিল, লিটল ম্যাগাজিনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশত, কবিতা, প্রবন্ধ লিখত। আমাকে দু’-চারটে কবিতা পড়িয়েছে, খুব একটা উৎসাহ দেখাতে পারিনি, কারণ, আধুনিক কবিতা আমি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারি না। মন্দিরা ওর কবিতা নিয়ে খুব লাফাত, ভাবটা এমন, চিত্রা একদিন বিখ্যাত কবি হবেই। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! চিত্রা কিন্তু সে রাস্তায় হাঁটল না। কলকাতার সঙ্গে এত জড়িয়ে পড়া সত্ত্বেও, ইউনিভার্সিটির ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার পর আচমকাই ফিরে গেল পাণ্ডুয়ায়। ওর নিজের বাড়িতে। আগের দিনও আমাদের কিছু জানায়নি। কেন এরকমটা করেছিল এখনও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। খুব আহত হয়েছিল মন্দিরা। পরে এক-দু’বার মন্দিরাকে ফোন করেছিল চিত্রা, তারপর দীর্ঘদিন কোনও যোগাযোগ রাখেনি। আমার সঙ্গে অবশ্য বছর দুয়েক আগে হঠাৎই একবার ঘণ্টা খানেকের জন্য দেখা হয়ে গিয়েছিল। খবর করতে গিয়েছিলাম অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ। কোনও এক সংস্থা একদল গ্রামীণ শিল্পী নিয়ে কর্মশালা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। আমাদের কাগজকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল স্ট্রং কোনও চ্যানেলে, অ্যাসাইনমেন্টটা ধরিয়ে দেওয়া হল আমাকে। সদ্য অফিসে ঢুকেছি, নানান ছুটকো ছাটকা কাজে পাঠিয়ে আমাকে টেস্ট নেওয়া হচ্ছিল। একজিবিশনে গিয়ে দেখা হয়ে গেল চিত্রার সঙ্গে। ওই সংস্থার ও একজন হোতা। আমাকে দেখতে পেয়ে ওর মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তাড়াতাড়ি সামনে এসে জানতে চাইল, মন্দিরা কোথায়? আমি খুব একটা উৎসাহ দেখাইনি। মন্দিরার অভিমান বহন করে নির্বিকারভাবে বলেছিলাম, আমি কাজে এসেছি।

জানি। তুমি তো এখন বড় কাগজের ছোট সাংবাদিক। আমাদের হয়ে একটু জায়গা নিয়ে লিখো। মন্দিরা থাকলে ওকেই বলতাম তোমাকে ফোর্স করতে।

সূত্র ধরে বলেছিলাম, তুমি তো অনায়াসে মন্দিরাকে ইনভাইট করতে পারতে, করলে না কেন?

ক্ষণিকের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলে চিত্রা। বলেছিল, মন্দিরার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভয় লাগে জানো, একবার যদি আমাকে পায়, কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না। জোর

করে নিয়ে যাবে ওর বাড়িতে। সর্বক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে ঘুরবে। কোনও কাজই মন দিয়ে করতে দেবে না আমায়। ও আমায় এত ভালবাসে, অথচ আমার কাজকে একটুও গুরুত্ব দেয় না। কাজ ছাড়া আমার মধ্যে যে কী পায়, কে জানে! ওকে কিন্তু খুব মিস করি, আমার কথা বলে আজকাল?

…এইরকম নানান কথাবার্তায় অভিমানটা কখন যেন হাওয়ায় মিশে যায়। চিত্রা আমায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এগজিবিশন দেখাল। আলাপ করিয়ে দিল শিল্পীদের সঙ্গে। নিত্য অভাব অনটনের সঙ্গে যুঝতে থাকা ওইসব শিল্পীদের জীবনযাপন শোনাল, বুঝতে পেরেছিলাম কাজটা যথেষ্ট সিরিয়াসলি করছে। একটু মজা করে বলেছিলাম, আর কত কী করবে, সাহিত্যসেবা ছেড়ে এখন এদের সেবা। এরপর? কবে বিয়ে থা করে থিতু হবে? চাকরির চেষ্টা করছ কিছু?

চিত্রা বলেছিল, চাকরি যদি দিতে পারো, দাও না একটা জোগাড় করে। বিয়ে থা আমি করতে পারব না। কিছু একটা মনে পড়তে থেমেছিল চিত্রা। তারপর হাসতে হাসতে বলে, কেন, তুমিই তো বলতে, কিছু মেয়ে আছে, যাদের বউ হিসেবে একদম মানায় না। অলওয়েজ প্রতিবাদী মুখচোখ, ঘুমন্ত অবস্থাতেও তাদের এক্সপ্রেশন পালটায় না। আমি নাকি তাদের মতো একজন। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম, সেটা ছিল আমার ট্যাক্সফুল অ্যাপ্রোচ। যাতে রেগে গিয়ে তুমি আমার প্রেমে পড়ে যাও। ফল উলটোটা হয়ে গেছে, তুমি আমার মিথ্যেটাকেই বিশ্বাস করে ফেলেছ।

নাও, আর ছ্যাবলামি করতে হবে না। তুমি সেই একইরকম রয়ে গেলে। বলে, অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিল চিত্রা। তখনই হয়তো কথায় কথায় আমার বাড়ির ফোন নম্বরটা দিয়েছিলাম। সেই নম্বরেই ফোন করল আজ। ও কি আমার সঙ্গে মজা করল?

কী তখন থেকে ফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ভেবে যাচ্ছ, বলো তো?

বউদির কথায় মন ফিরে আসে। বলি, তেমন কিছু না। কাল একটা এক্সক্লুসিভ খবর করতে যাব, প্ল্যানটা একটু গুছিয়ে নিচ্ছি।

ঠিক আছে বাবা, এখন তো শুতে যাও। মশারি টাঙিয়ে দিয়েছি।

নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বউদিকে বলি, কাল ভোরে বেরোতে হবে, ছ’টায় চা করে ডেকে দিয়ো।

বউদি পিছন থেকে টিটকিরি মারে, যথা আজ্ঞা ছোটকত্তা।

বিছানায় শুয়ে আছি অনেকক্ষণ। ঘুম আসছে না। ঘুরে ফিরে চলে আসছে চিত্রার কথা। মনে পড়ছে প্রথম আলাপের দিন, আমার সঙ্গে মন্দিরার প্রেম সবে চারদিন গড়িয়েছে, কফিহাউসে বসে আছি, শ্যামলা ছিপছিপে চেহারার এক বান্ধবীকে নিয়ে মন্দিরা এল, এই দেখো, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড চিত্রা। পাণ্ডুয়া থেকে রোজ ক্লাস করতে আসে। গত চারদিন আসেনি, আলাপ করাতে পারিনি তোমার সঙ্গে।

শুকনো নমস্কার বিনিময় করে সেই যে কালো কফি নিয়ে বসেছিল চিত্রা, হুঁ, হ্যা ছাড়া বিশেষ কোনও কথা বলেনি। যে-কোনও মানুষই ওই আচরণে অপমানিত হবে, আমি

হচ্ছিলাম না। সাঁওতালদের নিকোনো দেওয়ালের মতো ওর ত্বক, মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, গ্রাম বাংলাই একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে উঠে এসেছে কলকাতায়। নিজের অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতেই পরেছে উদাসীনতার পোশাক।

কফিহাউস থেকে বেরিয়ে আমরা বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট ধরে হাঁটছি। আমি মন্দিরা পাশাপাশি, চিত্রা সামনে। মন্দিরা কনস্ট্যান্টলি ওর বন্ধুর হয়ে সাফাই গেয়ে যাচ্ছে, তুমি কিছু মনে কোরো না, ও একটু কমই কথা বলে। আর কিছুদিন যাক, দেখবে কী ভীষণ ভাল মেয়ে। ওর মতো অনেস্ট বন্ধু আমি কখনও পাইনি। মন্দিরার কথা শুনতে শুনতে আমার চোখ আটকে গিয়েছিল সামনে হাঁটতে থাকা চিত্রার পিঠের ওপর। সাদা ব্লাউজের ভেতর থেকে একফোঁটা ঘাম নেমে আসছে বেতের মতো ছিপছিপে কোমরে। কী দুর্নিবার আকর্ষণ সেই স্বেদবিন্দুর চলনে! চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। আমি ডিজঅনেস্ট হয়ে পড়ছিলাম।

এখন বুঝতে পারছি, আমি ভুল মানে করেছিলাম ওই স্বেদবিন্দুর। চিত্রা একই চলনে মারাত্মক পথে হেঁটে পৌঁছে গেছে মেদিনীপুরের গভীর প্রত্যন্তে। কেন এই চরমপথ বেছে নিল চিত্রা? এমনও হতে পারে, এত বছর দেখা নেই, এর মাঝে হয়তো সাংঘাতিক কোনো বঞ্চনার শিকার হয়েছে চিত্রা। সেই ঘটনার পর থেকে বদলে গেছে আমূল।

ওর ফোনের পর আমার কি একবার মন্দিরাকে ফোন করা উচিত ছিল? মন্দিরাই একমাত্র পারে চিত্রাকে ফিরিয়ে আনতে। যদিও আমি জানি না এইসব ছোটখাটো আবেগ, বিহ্বলতা থেকে কতদূরে চলে গেছে চিত্রা। তবে মন্দিরাকে জানানোটা রিস্ক হয়ে যেত। কাল সকালেই সঙ্গ নিত আমার। ভাবতে ভাবতে অন্য একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসে আমার, কাল হয়তো বড় ঘড়ির নীচে গিয়ে দেখব, চিত্রা, মন্দিরা দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। আমাকে বোকা বানাতে পেরে খুব হাসছে। সবটাই ওদের গটআপ। তারপর আমরা ট্রেন ধরে দূরে কোথাও বেড়াতে যাব।

ভাল বা শুভ চিন্তাগুলো মাথায় আসতেই ঘুমও চলে এল।

বউদি ঠিক সময়মতো ডেকে দিয়েছিল। আমি এখন মিনিবাসের জানলার পাশে বসে হাওড়ার উদ্দেশে যাচ্ছি। ভোর থেকে সকালটুকুই কলকাতা নিজের প্রাইভেসি বজায় রাখতে পারে। তারপর লাখে লাখে মানুষ এসে কলকাতার চেহারাটাই বদলে দেয়। অনেকদিন পর ভোরের কলকাতাটাকে দেখে আমার বেশ ভালই লাগছে। মেঘলা আকাশ, এখনও দোকান-পাট খোলেনি। রাস্তার কলে এক-দু’জন করে মানুষ জমছে। বিশাল ঝাঁকড়া গাছগুলো যেন বেলা বাড়লে উধাও হয়ে যায়, এখন সেখানে পাখিদের হইচই। পুরনো এবং আচমকা গজানো মন্দিরগুলো থেকে কখনও সখনও ঘণ্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষকে দেখা গেল রাস্তায় খাবার ছুড়ে কাক পায়রাদের খাওয়াচ্ছেন। গাড়ি এলেই অলস

উড়ান দিচ্ছে পাখিগুলো। সেই মুহূর্তে কলকাতাকে আর পাঁচটা বিদেশি প্রাচীন শহরের সঙ্গে তুলনা করতে অসুবিধে হচ্ছে না।

মানিকতলা থেকে মাত্র কুড়ি মিনিটে পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে। হাওড়া ব্রিজ পেরোনোর সময় জানলা দিয়ে শরীর জুড়োনো ঠান্ডা হাওয়া এল, গঙ্গার মৃদু ঢেউয়ে ভাসছিল দু’-চারটে নৌকা। কী নিরুত্তাপ, শান্ত মনে হচ্ছিল চারপাশটাকে! ভাবাই যায় না বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কত অসন্তোষ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, কাজিয়া এই রাস্তা ধরে জমা হবে কলকাতায়। অজস্র খবর তৈরি হবে। আচ্ছা, বড়সড় দুটো গেট বানানো যায় না, হাওড়া শিয়ালদার জন্য? ইচ্ছেমতন দু’-একটা দিন কলকাতা নিজের মতো থাকতে পারত। অবাস্তব, স্বার্থপর চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে আমি এখন স্টেশন চত্বরে। প্রথমেই মিনারেল ওয়াটার কিনতে হবে। কতক্ষণের জন্য, কোথায় থাকব কে জানে! সুমিতদা বলেন, আর্সেনিক জন্ডিসকে খবরে নিয়ে আসবি, শরীরে নয়।

কাঁধ-ব্যাগে জলের বোতল নিয়ে সাতটা বাজার দু’ মিনিট আগে বড়ঘড়ির কাছে এসে দাঁড়ালাম। না, ঠাট্টা করেনি চিত্রা। ওকে দেখা না গেলেও, তিনটে বাংলা, দুটো ইংরেজি ডেলির রিপোর্টারকে দেখা গেল। এরা সবাই আমার পরিচিত। আমাকে দেখে ‘মুক্তকণ্ঠে’র দিব্যেন্দু এগিয়ে এল, এসো বস্। এতক্ষণ সেই কথাই হচ্ছিল। ‘প্রহরবার্তা’ থেকে কেউ এল না কেন!

আমি প্রথমেই জানতে চাইলাম, ফোনটা কি কোনও মেয়ে করেছিল? হ্যাঁ বস্, সেইজন্যেই বেশ একটা এনথু পেয়ে গেছি। মেয়েটাই বাকি সবাইকে ফোন করেছে।

দেখা গেছে মেয়েটাকে?

না না, এত সহজে আসবে না। আড়াল থেকে বুঝে নেবে, পুলিশ বা অন্য কাউকে খবর করেছি কিনা। সব ব্যাপারে শিয়োর হয়ে তবেই আসবে। ধরে নাও এখনও আধঘণ্টা। চলো চা-ফা খাই। বলে, দিব্যেন্দু আমার কনুই ধরে নিয়ে এল সবার মাঝে। বেশি সার্কুলেশনের কাগজে কাজ করি বলে, এরা আমাকে খাতির এবং হিংসে দুটো সমানভাবে করে। ‘গুড মর্নিং-এর সুভাষদা কাঁধে হাত রেখে বললেন, কোথায় যেতে হবে জানিস তো? সবিস্ময়ে মাথা নেড়ে বলি, না, আপনারা জানেন?

হতাশ ভাবের অ্যাক্টিং করে সুভাষদা বলেন, না রে, আমরাও জানি না। ভাবলাম, তোদের হাই প্রোফাইল কাগজকে নিশ্চয়ই বলেছে।

কেন সকাল সকাল লেগপুল করছেন সুভাষদা? কতক্ষণ একসঙ্গে থাকতে হবে কোনও ঠিক আছে! পরে অনেক সময় পাবেন।

অভিনয় ভেঙে হাসতে হাসতে আমায় জড়িয়ে ধরলেন সুভাষদা। বললেন, তোর দেখছি একটুও ঘ্যাম নেই। এটাই রাখার চেষ্টা করিস।

সামান্য তফাতে চায়ের স্টল থেকে দেবাশিস ডাকছে, চলে এসো সবাই, একটু গলা ভিজিয়ে নাও।

এইসময় তড়িঘড়ি পায়ে চিত্রা এসে পৌঁছোল। পরনে একদম অর্ডিনারি সাদাটে সালোয়ার কামিজ, কাঁধে সুতির ঝোলা ব্যাগ। বয়স বাড়েনি। রিফ্লেক্স অ্যাকশনে আমি হয়তো ওর সঙ্গে কথা বলে ফেলতাম। ওর হাবভাবের কারণে সেটা ঘটল না। খুব সিরিয়াস মুখে সবার উদ্দেশে বলল, সাতটা পঁয়তাল্লিশের মেদিনীপুর লোকালটা ধরতে হবে। সবাই রেডি তো?

সুভাষদা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যেতে হবে আমাদের?

আপাতত মেদিনীপুর।

মে-দি-নী-পু-র! টেনে টেনে বললেন, সুভাষদা। চিত্রা অল্প ধমক মিশিয়ে বলে, এমন করছেন, যেন অন্ধ্রপ্রদেশে যেতে বলেছি আপনাদের!

চিত্রা এবার নিজের কাঁধ ঝোলাটা ফাঁক করে বলে, আপনাদের মোবাইল ফোন, ক্যামেরা সব আমার কাছে রাখুন, সময় মতো ফেরত পাবেন। ফোনের সুইচ অফ করবেন।

সবাই একে একে গিয়ে অফ করা ফোন সেট, ক্যামেরা চিত্রার ঝোলায় ফেলে। আমি অবাক হই, ক্যামেরা আনতে বারণ করা সত্ত্বেও অনেকেই এনেছে। আমার ফোন সেট চিত্রার ঝোলায় ফেলে, চোখে চোখ রেখে দাঁড়াই। ওর দৃষ্টির গভীরে কোনও স্মৃতিই নেই কলেজবেলার!

ফের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চিত্রা আমার হাতে কম্পিউটার টিকিট ধরিয়ে দেয়। বলে, এতেই আপনাদের সবার টিকিট আছে। সবাই একসঙ্গে বসবেন। আমি অন্য কামরায় থাকব। মেদিনীপুরে দেখা হবে। কথাটা বলে, দ্রুত ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল চিত্রা। ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দিব্যেন্দু বলল, দেখে একদম বোঝার উপায় নেই, এরকম একটা ডেঞ্জারাস পার্টি করে। কী শার্প, ইন্টেলিজেন্ট দেখতে, যে-কোনও বড় চাকরিতে দারুণ মানাত। পাশ থেকে দেবাশিস বলল, এয়ার হোস্টেসও হতে পারত অনায়াসে…

মেয়েটি কী কী হতে পারত, এই গবেষণায় মশগুল থেকে আমার সঙ্গীসাথীরা মেদিনীপুর লোকালে গিয়ে উঠল। আমি ওদের আলোচনায় যোগ দিতে পারিনি; তবে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকা যাবে না, ওদের খটকা লাগতে পারে।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। কমপার্টমেন্ট মোটামুটি ফাঁকাই। বাকিরা এখনও চিত্রার প্রসঙ্গ থেকে সরতে পারেনি। বোঝাই যাচ্ছে, চিত্রার পার্সোনালিটি ওদের মনে গভীর রেখাপাত করেছে। ‘ক্যাচলাইন’ পেপারের রাজর্ষি বলছে, কথাবার্তা, অ্যাটিটিউড দেখে তো মনে হল কলকাতার মেয়ে, ওদের গ্রুপটা তার মানে কলকাতা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে।

কথার পিঠে সুভাষদা বললেন, তোমরা আর কী দেখছ, আমি বাহাত্তর সাল কভার করেছি। অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগা, কাঠিসার মেয়েগুলোর মধ্যে বারুদ ঠাসা। ওদের দিয়েই আর্মস, মেসেজ আদানপ্রদান হত। ধরা পড়লেই ব্যস, পুলিশ দিত একেবারে থেঁতলে। তবু ওইসব মেয়ের মুখ থেকে একটা কথাও বার করা যেত না।

সুভাষদার কথন ভঙ্গি এমন নিদারুণ, নিখুঁত। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম, কোনও এক প্রায়ান্ধকার থানার বারান্দায় থেঁতলে পড়ে আছে চিত্রা।

বুকের মধ্যে ধুকপুকানি শুরু হল। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে। চিত্রার হয়েই ভয়টা পাচ্ছি আমি, কিন্তু ও কী করে এত নির্ভীক হল! আমরা একই পরিবেশে পড়াশোনা করেছি, আর কোনও বন্ধু তো ওই পথ মাড়ায়নি। নাকি তলে তলে দু’-একজন এরকমই কোনও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছে, আমি জানি না। পরশুদিনও তো জানতাম না চিত্রার অ্যাক্টিভিটি।

টিকিয়াপাড়া, দাশনগর, রামরাজাতলা… একের পর এক স্টেশনে থেমে ট্রেন চলেছে মেদিনীপুরের দিকে। আমাদের হাতে চায়ের প্লাস্টিক কাপ। খাওয়াচ্ছে দেবাশিস। আমার মুখোমুখি সিটে সুভাষদা এখনও বাহাত্তরের নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। মাঝপথে আমি বলি, আচ্ছা সুভাষদা, এরা আমাদের ঠিক কোথায় নিয়ে যেতে পারে?

কোনও ঠিক নেই রে ভাই। এরা কখন কোথায় ডেরা বাঁধে বলা খুব মুশকিল। তবে ওয়েস্ট মেদিনীপুরের কোথাও হবে। শালবনী, বেলিয়াতোড়… আরও কত অজানা গ্রাম। ওরা ওখানে অ্যাকটিভ বলেই গ্রামের নামগুলো আমরা জানতে পারছি।

এদের কাজের ধরনটা কীরকম? জানতে চাই আমি। সুভাষদা বলেন, অন্য উগ্রপন্থী দলগুলোর থেকে আলাদা কিছু নয়। এরাও সশস্ত্র কৃষিবিপ্লবে বিশ্বাস করে। বাহাত্তরের লাইন। তবে এদের গ্রুপটা খুব ফেরোশাস, প্রচুর আর্মস আছে হাতে।

এত আর্মস এরা পায় কোথায়? বাইরের দেশ থেকে পাঠায় নাকি? এই প্রশ্নটা করে দিব্যেন্দু। সুভাষদা বলেন, আমি যতদূর জানি, বাইরের দেশের অস্ত্রশস্ত্র এখানে এসে পৌঁছোয়নি। এইসব মাওবাদী এক্সট্রিমিস্টরা নীতিগতভাবে ধনী দেশগুলোর থেকে সাহায্য নেবে না। এরা যেটা করে, মিলিটারির যেসব গোলা, বারুদ, বন্দুক একটা সময়ের পর অকাজের বলে নষ্ট করে দেওয়া হয়, অনেকটা ডেট এক্সপায়ার মেডিসিনের মতন, ওই নষ্ট করার নামে কিছু অসৎ কর্মী জিনিসগুলো চোরাবাজারে পাঠিয়ে দেয়। ওখান থেকেই কিনে আনে এইসব দল। তারপর কান্ট্রিমেড ওয়ান শাটার তো আছেই। বোমাও বাঁধে নিজেরা।

এত টাকা পায় কোথায়? জানতে চাই আমি। সুভাষদা বলেন, ভেরি সিম্পল, জোতদার, ঠিকাদার, বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা তোলে। কিছুদিন আগেই তো টাকা দেয়নি বলে দুটো ঠিকাদারের বডি ফেলে দিয়েছে। এসব অঞ্চলে যারা ব্যাবসা করে খায়, কিছু টাকা পার্টির জন্য তুলেই রাখে। পুলিশ টুলিশের ঝামেলায় যেতে চায় না। ওইসব টাকা দিয়ে যে ওরা শুধু গোলা-বারুদ কেনে তা নয়, গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলোর মধ্যে বেশ কিছুটা বিলিয়ে দেয়।

গ্রামগুলোর মধ্যে তা হলে বেশ ভালই প্রভাব বিস্তার করেছে বলুন। বলে দিব্যেন্দু। সুভাষদা বলেন, প্রভাব বিস্তার বা বিশ্বাস তৈরি না করতে পারলে এতদিনে গ্রামের মানুষরাই ওদের ধরিয়ে দিত। এই তো গত মে দিবসে বেশ ক’টা গ্রামের যেসব শ্রমিক কেন্দুপাতা প্রসেস করে, একদিনের রোজগার তুলে দিল ওদের হাতে। কুড়ি টাকা না কত যেন রোজ পেত আগে, ওই এক্সট্রিমিস্টদের আন্দোলনে সেটা এখন একশো ছাড়িয়েছে।… আরও কী সব বলে যাচ্ছেন সুভাষদা। আমার ভীষণ কুণ্ঠা হচ্ছে, শুধু কলকাতার খবর করি বলে, বাইরের কোনও খোঁজই রাখি না। একটা প্রশ্ন হঠাৎ মাথায় আসে। জিজ্ঞেস করি

সুভাষদাকে, আচ্ছা, এরা যে এত ক’টা দল, একই বিশ্বাসে কাজ করে যাচ্ছে, একটাই দল হয়ে যাচ্ছে না কেন?

ভ্রূ কুঁচকে চিন্তিত মুখে সুভাষদা বলেন, এটা নিয়ে আমারও একটা খটকা আছে। হতে পারে বিভিন্ন সময়, ভিন্ন পরিবেশ, পরিস্থিতিতে দল গড়ে উঠেছে, একসময় সবাই এক হয়ে যাবে। অথবা আলাদা আলাদা নামে কাজ করাটাই ওদের স্ট্র্যাটেজি। কেন্দ্ৰীয় মাথা দু’একজনই। আসলে নকশাল আন্দোলনে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল, হায়ার কমিটির সঙ্গে জেনারেল মেম্বারদের মানে যারা গ্রামে-গঞ্জে কাজ করছে, প্রায়ই বিচ্ছিন্নতা ঘটে যেত। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এরা হয়তো অন্যরকম কিছু ভাবছে। এতক্ষণে আমি নিশ্চিত হয়েছি, চিত্রা চলে গেছে আমাদের থেকে বহুদূরে, জটিল এক রাজনীতির আবর্তে। ফেরার রাস্তা হয়তো আর কোনওদিনই খুঁজে পাবে না।

বাগনান স্টেশনে থেমেছে ট্রেন। আমাদের সামনে হঠাৎ এক চপ-মুড়িওলা এসে দাঁড়াল। ঠোঙা রেডি করাই ছিল। ধরিয়ে দিল এক একজনের হাতে। সুভাষদা বললেন, নিয়ে নাও। সংগ্রামী আতিথেয়তা।

মুড়িওলা পয়সা না নিয়ে চলে গেল। চিত্রা তার মানে উঠেছে সামনে অথবা পেছনের কম্পার্টমেন্টে। ওর সঙ্গে নিশ্চয়ই আরও সঙ্গীসাথী আছে।

মুড়ি চপ খেতে খেতে জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকি৷ সজোরে পিছিয়ে যাচ্ছে মাঠ, ঘাট, খেত, সরু নদী। এই অনাবিল প্রকৃতির মধ্যে কোথাও কোনও সন্ত্রাসের গন্ধ নেই। এই একই দৃশ্য হয়তো পাশের কামরায় বসে চিত্রাও দেখছে। এর কোনও প্রভাব কি ওর মস্তিষ্কে পৌঁছোচ্ছে না?

আমি আর মন্দিরা একবারই ওদের পাণ্ডুয়ার বাড়িতে গেছি। ওর পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে কোনও রাজনীতির আবহাওয়া দেখিনি। বরং বেশ তৃপ্ত, সুখী পরিবার। প্রচুর জমিজমা, দুটো ইটখোলা। ওর দাদা ডাক্তারি পড়ত। এখন বোধহয় প্র্যাকটিস করছে। ওদের বাড়ির সমস্ত আসবাব থেকে শুরু করে খাবার প্লেট অবধি আভিজাত্যের ছাপ। কলেজে বাম রাজনীতি করাটাকে আমরা ওর শৌখিনতা হিসেবেই ধরতাম। পার্টিতে যে খুব টাইম দিত তা নয়। তুলনায় সাহিত্যসেবার দিকেই ঝোঁক ছিল বেশি। তবে কলকাতায় একটানা বেশিদিন থাকতে পারত না, হাঁপিয়ে উঠত। প্রায়ই পালিয়ে যেত দেশের বাড়ি। প্রকৃতির সঙ্গে ওর একটা নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সেটা টের পেয়েছিলাম ওর দেশের বাড়ি গিয়ে। মাত্র ওই ক’ঘণ্টায় কত গাছপালা, পাখি, ফুল চিনিয়েছিল আমাদের। এখনও দু’-একটার নাম মনে আছে। ঝাঁটি ধনচে, ওখানকার লোকে বলে ডাকাতে পাতা। বনতুলসী, বনকর্পূর। পাতা ছিঁড়ে গন্ধ শুঁকিয়েছিল আমাদের। সৃষ্টিকলা পাখি চিনিয়েছিল। ওইদিনের আর একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে, দুটো সাইকেলে চেপে আমরা প্রকৃতি চিনতে বেরিয়েছিলাম। আমি মন্দিরাকে ক্যারি করছি, চিত্রা একাই সাইকেলে। মাইল চারেক ঘুরে আমরা ফিরে আসছি ওদের বাড়ি। ফেরার সময় ধরেছি অন্য মেঠো রাস্তা। বিকেল নিভে আসছে ক্রমশ। চিত্রা তখন বেশ কিছুটা দূরে, হঠাৎ দেখি একটা গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাইকেল স্ট্যান্ড করে গাছটার দিকে চেয়েই আছে।

আমরা যখন ওর কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম, দেখি কাঁদছে।

এ কী রে, তুই হঠাৎ কাঁদছিস কেন রে? অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল মন্দিরা। চিত্রা আঙুল তুলে গাছটাকে দেখায়। প্রথমটায় আমার চোখেও ভীষণ ধাক্কা লাগে, গাছটার কাণ্ডের সমস্ত বাকল কারা যেন তুলে নিয়েছে। কাণ্ডের কিছু সজীব অংশে তখনও ছুরির দাগ স্পষ্ট। কান্নাভেজা গলায় চিত্রা বলে যাচ্ছিল, এটা অর্জুন গাছ, নানারকম ওষুধপত্তর নাকি হয়। তা বলে, বারবার গা থেকে ছালচামড়া তুলে নিয়ে যাবে! ওর লাগে না!

এরকম নরম মনের মেয়ে, সচ্ছল পরিবেশে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কখন, কীভাবে ওর মাথায় বিপ্লবের বীজ ঢুকে গেল কে জানে! যদিও বিপ্লব একটু বড় কথা হয়ে গেল। অ্যাডভেঞ্চারিজম? তীব্র হতাশা আর রোম্যান্টিকতা থেকে হয় এই অ্যাডভেঞ্চারিজমের জন্ম। চিত্রার হতাশার দিকটা তো ধরতে পারছি না। বরং চিরকাল ওকে সামান্য অহংকারী মনে হয়েছে। এতদিন কাছাকাছি থেকেও ঠিক চিনতে পারিনি। মন্দিরাও নিশ্চয়ই খোঁজ পায়নি চিত্রার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হতাশার অস্তিত্ব। কিন্তু যে রাস্তা চিত্রা বেছে নিয়েছে, এ তো আত্মহত্যার সামিল। এই মুহূর্তে সমাজে সশস্ত্র বিপ্লবের কোনও পরিবেশই নেই। গত তিরিশ বছরে প্রবলভাবে পালটে গেছে সমাজ। বিশ্বায়নের ফলে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা আন্তর্জাতিকতার নিরিখে মাপামাপি হচ্ছে। যদি ধরেও নিই আবেগ নয় চিত্রাদের সত্যিই যুক্তিসম্মত কোনও মহৎ উদ্দেশ্য আছে, তবু স্বীকৃতি পাবে না। বিপজ্জনক কোনও টেররিস্ট দল বলে প্রশাসন ওদের দাগিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে দিয়েওছে। রাইফেলের নল খুঁজছে চিত্রাকে। একজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মী এবং কবি থেকে চিত্রা এখন গেরিলা হয়ে গেছে। এই অনুশীলন ও কখন নিল, টেরই পেলাম না।

কী রে ভাই, তখন থেকে কী ভেবে যাচ্ছিস? দে একটা সিগারেট দে। সুভাষদার কথায় সংবিৎ ফেরে। আশপাশের যাত্রীরা বদলে গেছে। জানলার বাইরে প্রাকৃতিক দৃশ্যও অনেক অন্যরকম। সুভাষদাকে বলি, ট্রেনে সিগারেট খাবেন, এখন কিন্তু খুব কড়াকড়ি।

খোকা ভোলানো কথা বলিস না। যে দেশে ট্রেনে গোলা, বন্দুক পাচার হয়ে যাচ্ছে, সেখানে সিগারেট, ছোঃ। তুই কি ভাবছিস আমাদের নিয়ে যে মেয়েটা যাচ্ছে, তার কাছে ফায়ার আর্মস নেই?

এরপর আর কথা হয় না। সিগারেট বার করে সুভাষদাকে দিয়ে, নিজেও একটা ধরাই। চা তেষ্টা পাচ্ছে আবার। মাথাটাও টিপটিপ করছে। দিব্যেন্দুরা আড্ডা জমিয়েছে দিব্যি। কী একটা ব্যাপারে হাসাহাসি করছে। আমরা সাংবাদিকরা অদ্ভুত জীব। এরকম সাংঘাতিক একটা খবর-অভিযানে যাচ্ছি, অথচ কী নির্বিকার ভাব! যেন ফিস্ট করতে যাচ্ছি।

রাজর্ষি হঠাৎ হাসতে হাসতে আমার কনুই টেনে ধরল। বলল, দেবাশিস কী বলছে, শুনেছ?

কী ?

ব্যাটা বলে কিনা, এই দলটার আবার সেরকম প্ল্যান নেই তো, বুর্জোয়া কাগজের কিছু রিপোর্টারকে খতম করে একদম হেডলাইনে চলে আসবে?

কথাটা শুনে আমিও হাসিহাসি মুখ করলাম। কিন্তু মনের ভেতরে চোরা আতঙ্ক খেলে

গেল। এবং পরক্ষণেই মনে হল, আমি চিত্রার পুরনো বন্ধু, আমাকে নিশ্চয়ই মারার জন্য ডেকে আনেনি। অমূলক ভয় চাড়া দিয়ে উঠছে দেখে, নড়েচড়ে বসলাম। ট্রেন অনেক ফাঁকা হয়ে এসেছে। মেদিনীপুর এসে গেল মনে হয়। অবশেষে মেদিনীপুর। ট্রেন থেকে নেমে চিত্রাকে খুঁজি। এদিক ওদিক কোথাও দেখা যাচ্ছে না। প্ল্যাটফর্মের ভিড় ক্রমশ পাতলা হচ্ছে। সুভাষদা বলেন, যাচ্চলে, গেল কোথায় মেয়েটা?

সবাই বেশ চিন্তায়। দিব্যেন্দু বলে, পুলিশ পেছনে লেগে যায়নি তো আমাদের? টের পেয়ে মেয়েটা হয়তো কেটে গেছে।

তা কী করে হবে, পুলিশকে খবর দিলে তো আমরাই দেব। আশা করি আমাদের মধ্যে রিপোর্টারদের এথিক্স কেউ ভাঙবে না। বলল দেবাশিস। সুভাষদা বললেন, পুলিশ আমাদের খবরের জন্য বসে নেই। দেখ হয়তো আগেই মেয়েটাকে সন্দেহ করেছিল, তারপর ফোন ট্যাপ করে আমাদের পেছন পেছন চলে এসেছে। মেয়েটাকে ধরার থেকেও বেশি ইমপর্টেন্ট ওদের আস্তানাটা জানা। কথাগুলো শুনে কেন জানি না মনে হল, আমার সঙ্গীদের মধ্যে একধরনের অনীহা নাকি পলায়নের ইচ্ছে দেখা দিচ্ছে। তাই বেশি বেশি ভাবছে সবাই। বুকপকেট থেকে চিত্রার দেওয়া টিকিটটা বার করে বললাম, প্ল্যাটফর্মের বাইরে তো যাই, চা-ফা খেয়ে ফেরার ট্রেন ধরা যাবে। তা ছাড়া যতদূর মনে পড়ছে, মেয়েটা একবারও আমাদের বলেনি প্ল্যাটফর্মেই দেখা হবে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।

‘মেয়েটা’ বলার আগে আমি চিত্রা বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম, জোর সামলেছি। আমার প্রস্তাব মেনে নিল সবাই। আমরা এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে।

স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে আসতেই টের পেলাম আমাদের দলটাকে তিনটে ইয়াং ছেলে এসকর্ট করছে। ছেলেগুলো আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না, বুঝিয়ে দিয়েছে ওরা আছে। ওদের চেহারায় রুক্ষ গ্রামের ছাপ। আমাদের মাথার ওপর এখন খটখটে রোদ।

একটু এগোতেই দেখতে পেলাম চিত্রাকে। দূরে ঝাঁকড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে হাত নেড়ে কথা বলছে। উনিশ-কুড়ির মেয়েটা অবশ্যই গণসংগ্রাম গোষ্ঠীর সদস্য। সৈনিকের আনুগত্যে চিত্রার কথা শুনছে।

আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি। পাশ থেকে সরে গেছে আগের তিনটে ছেলে। চিত্রার কাছে নির্দেশ নিয়ে কনিষ্ঠ সদস্যা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। গায়ের রং মিশকালো, মুখের আদল দেখে বোঝা যাচ্ছে আদিবাসী মেয়ে। পরনে জংলা সবুজ শাড়ি, পায়ে হাওয়াই চটি। সামনে এসে ঝরঝরে বাংলায় বলে, আপনারা কিছু খেয়েদেয়ে নিন। আমরা গাড়ি নিয়ে আসছি। রাস্তার ওপারে মিষ্টির দোকানের দিকে হাত তোলে মেয়েটা। ফের বলে, কোথায় যাচ্ছেন, এসব নিয়ে ওখানে কোনও আলোচনা করবেন না। যেন বেড়াতে এসেছেন। আর খাবারের বিলটা আপনারাই দেবেন।

চলে যাচ্ছিল মেয়েটা। রাজর্ষি বলে ওঠে, এক্সকিউজ মি, আমাদের মিটিংটা সেরে ফিরতে ফিরতে ক’টা হবে?

মেয়েটা ঘুরে এমনভাবে রাজর্ষির দিকে তাকাল, যে-কোনও ধারালো অস্ত্রের থেকেও

সেই চাউনি তীক্ষ্ণ। স্কুল পড়ুয়ার মতো আমতা আমতা করে রাজর্ষি বলে, আসলে বাড়িতে বলে আসিনি তো কতক্ষণ লাগবে…

পাত্তা না দিয়ে মেয়েটা এগিয়ে যায়। ঝাঁকড়া গাছটার নীচে চিত্রাকে আর দেখা যায় না।

মিষ্টির দোকান থেকে খেয়েদেয়ে বাইরে দাঁড়িয়েছি। একটা সাদা অ্যামবাসাডার আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভারের পাশে সেই মেয়েটা। ডাকল, চলে আসুন।

তা হলে কি চিত্রার ডিউটি শেষ? আমাদের মেদিনীপুর অবদি পৌঁছে দেওয়া ওর দায়িত্ব ছিল। এরপর চলে যাবে অন্য কোথাও অথবা কলকাতায় ফিরবে? আর দেখা হবে না এই যাত্রায়?

মেয়েটি আবার ডাকে, কী হল দাঁড়িয়ে রইলেন কেন!

আসলে আমাদের পাঁচজনকে গাড়িতে ঠিকমতো বসতে হলে, একজনকে আগুনে মেয়েটির পাশে বসতেই হবে। মেয়েটি যদি শহুরে দুলালি হত, এতক্ষণে হুটোপাটি লেগে যেত আমাদের মধ্যে। এখন সবাই ইতস্তত করছে। দিব্যেন্দু কায়দা করে সুভাষদাকে ঠেলে দিল সামনে। বলল, আপনি বড়, সামনে থেকে আমাদের লিড করুন। জুনিয়ররা পেছনে বসছি।

সুভাষদা শহিদ শহিদ মুখ করে সেটাই মেনে নিলেন।

শহরের রাস্তা ছাড়িয়ে হাইওয়েতে ওঠার মুখে চোখে পড়ল পুলিশ পেট্রোলিং জিপ। অফিসার বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন। কী পরিতৃপ্ত মুখ! অবিকল ‘ফিল গুড’-এর বিজ্ঞাপন। আমাদের গাড়ির দিকে ঘুরেও দেখলেন না। হাইওয়ে ধরে সজোরে ছুটছে গাড়ি। দু’পাশের ফসল ভরা খেতজমি থেকে উঠে আসা হাওয়া ঝাপট মারছে আমাদের মুখে। আশপাশের গ্রামগুলো মোটামুটি সমৃদ্ধই মনে হচ্ছে। অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ। জার্নিতে আড্ডার মুড আনতে সুভাষদাকে খোঁচাই, আচ্ছা, সুভাষদা এটা কোন হাই রোড?

জানি না। সামনের সিট থেকে সংক্ষিপ্ত জবাব দেন সুভাষদা। রাজর্ষি বলে, আপনি জানেন, বলছেন না।

হতে পারে। এই ধরনের এক্সপিডিশনে গোপনীয়তা রক্ষা করা ফার্স্ট কন্ডিশন। বলে চুপ করে গেলেন সুভাষদা। এবার দিব্যেন্দু পিছনে লাগে সুভাষদার। বলে ওঠে, এই গাড়িতে ওঠার পর থেকেই দেখছি আপনি খুব সিরিয়াস। আগে তো অনেক কথা বলছিলেন। এখন কি নার্ভাস লাগছে?

আমি মনে মনে প্রমাদ গুনি, গণসংগ্রামের মেয়েটার সামনে এ ধরনের ইয়ারকি মারা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। ওর মনে হতে পারে ওদের প্রেসমিটকে আমরা ততটা গুরুত্ব দিচ্ছি না।

সুভাষদা বলে যাচ্ছে, নার্ভাসের কিছু নেই ভাই। এই ধরনের মিটিং আমি আগেও অনেক করেছি। যেমন আমি এক্ষুনি বলে দিতে পারি, এই রাস্তা ধরে আমরা আর দশ মিনিটের বেশি যাব না। গাড়ি রাস্তার ধারে দাঁড়াবে। আমরা নেমে আসব। আমার পাশের বন্ধুটি এবং ড্রাইভার আমাদের চোখ বেঁধে দেবে, তারপর তুলবে অন্য কোনও গাড়িতে। বড় রাস্তা

ছেড়ে সে-গাড়ি চলবে মেঠো রাস্তায়। ধরেই নেওয়া যেতে পারে সেটা জিপগাড়ি হবে।

সুভাষদার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে, মেয়েটি সুভাষদাকে একবার দেখে নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে সহপাঠীর মতো হাসে। আমরা রীতিমতো ক্যাবলা বনে যাই। মেয়েটির হাসি দেখেই বোঝা যায়, কোনও একসময় সুখী পারিবারিক পরিবেশে মানুষ হয়েছে। সেখান থেকেই সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছে হাসিটা। বিশ্বসুন্দরীকে ম্লান করে দেওয়া হাসিটার জন্যই বোধহয় আমাদের যাত্রাপথের সমস্ত টেনশন উধাও হয়ে গেল।

করছে দশ মিনিট নয়, আরও আধঘণ্টা চলার পর গাড়ি থামে। আমরা নেমে আসি। না, আমাদের চোখ বাঁধা হয় না। ড্রাইভার গাড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে। পার্টির মেয়েটিকে অনুসরণ করে হাইওয়ের ঢালু বেয়ে নেমে আসি মাঠে। শুকনো পাথুরে মাটি। চরাচর জুড়ে ঠीঠা রোদ। বেশ কিছুটা দূরে সামান্য অঞ্চল জুড়ে লম্বা লম্বা গাছ। সম্ভবত শাল। ওই জঙ্গল লক্ষ্য করে হাঁটতে থাকি। দরদর করে ঘামছি আমরা। দু’-এক ফোঁটা রুক্ষ জমিতে পড়ে মুহূর্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। মিছিমিছি আমাদের এ-গ্রামে নিয়ে এসেছে চিত্রারা, বদলে যদি বৃষ্টি আনতে পারত…

শালবনে গিয়ে আর এক প্রস্ত অবাক হওয়ার পালা, সুভাষদার ভবিষ্যদ্বাণী মতো জিপ আছে, কিন্তু সেই জিপে চিত্রাকে আবার দেখা যাবে, এ সম্ভাবনার কথা সুভাষদাও নিশ্চয়ই ভাবতে পারেনি। চিত্রাকে দেখে আমার ভাল এবং খারাপ দুটো একসঙ্গে লাগে। খারাপ এই কারণে, আমি ভেবেছিলাম চিত্রার সীমানা বুঝি মেদিনীপুর অবধি বাঁধা আছে, এখনও দলের গভীর ঢোকেনি। অর্থাৎ গ্রাম থেকে যেসব উগ্র ক্রিয়াকলাপ ঘটছে, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ নেই চিত্রার। প্রশাসনের চোখে তুলনায় কম অপরাধী সে। এখন দেখা যাচ্ছে তা নয়। আর ওকে দেখে ভাল লাগার কারণ, আমি ট্রেনে আসতে আসতে কখন যেন ঠিক করে নিয়েছিলাম, আজ যদি মিনিট খানেকের জন্যেও চিত্রাকে একা পাই, উপযুক্ত কিছু বাক্যবন্ধে ওর এই অ্যাডভেঞ্চারের ঘোর কিছুটা কাটাবই। ওকে হঠাৎ উধাও হতে দেখে একটু হতাশ হয়েছিলাম। এখন আবার সে সুযোগ ফিরে এসেছে।

আমরা এখন চলন্ত জিপে। আগের মেয়েটি আমাদের শালবন অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরে গেছে। এবড়োখেবড়ো জমি, কখনও সখনও একটা-দুটো শাল সেগুনের পাশ দিয়ে চলেছে আমাদের জিপ। ভীষণ ঝাঁকুনি লাগছে। এত ঝাঁকুনিতেও চিত্রার মুখের সিরিয়াসনেসটা টাল খাচ্ছে না।

হঠাৎ আমাদের গাড়ির দু’পাশে তিন বাইক আরোহীকে দেখা গেল। চিনতে পারলাম। এরাই আমাদের স্টেশন থেকে বেরোনোর পর এসকর্ট করেছিল। সহজেই আন্দাজ করা যায় বাইকে চেপে ঘুরপথে চিত্রা এখানে এসে পৌঁছেছে। এদের আত্মগোপনের নিখুঁত পরিকল্পনা দেখে, কেন জানি মনে হচ্ছে খুব দ্রুত কোনও বড় জঙ্গি আন্দোলন সংঘটিত হতে চলেছে।

আমরা ক্রমশ রুক্ষ থেকে রুক্ষতর উঁচু-নিচু জমি, ছিরিছাঁদহীন বনজঙ্গল ধরে চলেছি।

শুধু গাড়ির শব্দ। যখন খুব একঘেয়ে লাগছে, সুভাষদা হঠাৎ যেন মনে পড়েছে এইভাবে বলে ওঠেন, আমাদের চোখ বাঁধা হল না তো!

উত্তরে চিত্রা বলে, না হল না, আপনি কি এই জায়গাটা চিনতে পারছেন?

মাথা নাড়েন সুভাষদা। চিত্রা বলে, তা হলে আর বেঁধে কী হবে বলুন! আমরা এই গ্রামের চেহারাটাও আপনাদের দেখাতে চাইছি।

চিত্রার কথামতো গ্রামটাকে দেখতে থাকি। গ্রাম না বলে গ্রামের কঙ্কাল বলাই ভাল। দু’চারটে ভাঙা কুঁড়ে চোখে পড়ছে, দালানে বসে আছে হাড্ডিসার মানুষ। আমাদের জিপের দিকে দেখছে, চোখে কোনও কৌতূহল নেই। আশপাশে চাষাবাদের চিহ্ন নেই কোথাও। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভাঙা বাড়ি, কাঁচা রাস্তারও কোনও গল্প নেই। একটা বাড়ির ছাদ উধাও অথচ বোর্ডে স্কুলের নাম লেখা আছে। কোনও ফলবান গাছ নেই, ফুল নেই, সভ্যতার স্নেহ পায়নি এ অঞ্চল। আমরা ক্রমশ যেন ইতিহাসের কোনও খরাক্লিষ্ট বছরের দিকে এগিয়ে চলেছি।

মিনিট চল্লিশেকের মধ্যে প্রেসমিট শেষ হল। আমরা এখন গণসংগ্রাম গোষ্ঠীর দালানে বসে চা খাচ্ছি। আস্তানা বলতে মাটির পোড়ো বাড়ি। আমাদের মিটিং হয়েছে ঘরে। এদের লিডারকে দেখে প্রথম চোটে ভীষণ অবাক হই। সদ্য তিরিশ পেরোনো, পাঁচ ফুট পাঁচছ’ইঞ্চি হাইটের যুবক। এত কমন ফেস, মনে হবে কালই এসপ্ল্যানেডে দেখা হয়েছিল। কিন্তু যেই উনি কথা শুরু করলেন, ব্যক্তিত্বটাই সম্পূর্ণ পালটে গেল। প্রচুর পড়াশোনা করেছেন। সম্ভবত কলকাতার নামী কোনও কলেজের ভাল স্টুডেন্ট। তবে মূল বক্তব্যে বিশেষ কিছু নতুনত্ব নেই। মাওবাদীরা যা বলে থাকেন, তাই বললেন, আমরা সশস্ত্র আন্দোলনের পথ ধরে গণ আন্দোলনের লক্ষ্যে এগোচ্ছি। গ্রামের পশ্চাদপদ কৃষক, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষ হবেন আমাদের যোদ্ধা। আমাদের কর্মসূচি… ঝড়ের গতিতে আমরা সব টুকে নিলাম। মাঝে দিব্যেন্দু একটা কাজের কাজ করেছে, অতি বিনয়ে অনুমতি চেয়েছে ছবি তোলার। উনি না করেননি। বলেছেন, আমাদের ব্যাকপোর্শন তুলুন।

তখনই ক্যামেরাটা একবার ফেরত পেয়েছিল দিব্যেন্দু। পিছন ফেরা, অস্ত্র কোলে পিঠে, গণসংগ্রাম গোষ্ঠীর গ্রুপ ছবি তুলেছে। ক্যামেরা জমা করে আবার আমরা মিটিং-এ ফিরে যাই। মিটিং-এর সেকেন্ড হাফে দুটি ব্লান্ডার করেছি আমি আর সুভাষদা। সুভাষদা একসময় বলে ওঠেন, তার মানে যেসব গ্রাম অবহেলিত, সেসব জায়গাগুলোকে ক্যাশ করছেন আপনারা।

মুহূর্তে নেতার মুখচোখ বদলে গিয়েছিল। শাণিত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে

বলেন, আপনি বলতে চাইছেন, দারিদ্র্য হচ্ছে মৌমাছির চাক, আমরা মধু খেতে এসেছি? তারপর থেকে সুভাষদা আর ঢুঁ শব্দটি করেননি। আমি গন্ডগোল পাকালাম শরবত নিয়ে। মিটিং শুরু হওয়ার সময় কাঁধে বন্দুক ঝোলানো একটা মেয়ে ট্রে-তে করে আমাদের জন্য শরবত নিয়ে এসেছিল। সবাই খেয়ে নিলেও, আমি সাইড করে রেখেছিলাম সন্তর্পণে। একসময় তেষ্টা পেতে, ব্যাগ থেকে নিজের বোতলের জল বার করে খেতে যাচ্ছি, লিডারের

চোখ আটকে যায় আমার দিকে। বলেন, কী হল, শরবতটা খেলেন না! ওটা তো আপনারই দেশের জল। এই জল খেয়ে আমরা দিব্যি আছি। এ গ্রামের মানুষও খায়…

আমি তখন আড়চোখে চিত্রাকে খুঁজছি, শোনেনি তো? শুনলে আরও অপমানজনক হবে ব্যাপারটা।

না, চিত্রাকে মিটিং-এর আশেপাশে দেখা যায়নি। এখন দেখা যাচ্ছে, উঠোনের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে যুবক নেতার সঙ্গে আলোচনা করতে। এবার আমাদের ফেরার পালা। এরা আমাদের দুপুরে খেয়ে যেতে বলেছিল, অনেক কষ্টে নিরস্ত করেছি। উঠোনের আর একপ্রান্তে ছিটেবেড়ার রান্নাঘর, ধোঁয়া বেরোচ্ছে বেড়ার ফুটো দিয়ে। উনুন ধরিয়েছে। যে মেয়েটা আমাদের শরবত দিয়েছিল, কাঁধে বন্দুক নিয়ে সে এখন রান্নার জোগাড় করছে। ভিটে ঘিরে টহল দিচ্ছে পাঁচ-ছ’জন নির্বাক যোদ্ধা। ওদের প্রত্যেকের হাতেই রাইফেল। ওরা যেন দুর্গের চলমান প্রাচীর। তবু এখানে পাখি ডাকছে মিষ্টি সুরে। উঁচু শালগাছগুলো থেকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে শুকনো পাতা।

শূন্য চায়ের কাপ দালানে নামিয়ে সুভাষদা বললেন, চলো, ফেরার ব্যবস্থা করতে বলি।

আমরা উঠে দাঁড়াতেই লিডার এগিয়ে এলেন। দেবাশিস আধো-নমস্কারের ভঙ্গিতে বলে, আমরা তা হলে ফিরি। আবার দেখা হবে।

এই প্রথম যুবক নেতার মুখে বিষাদ-হাসি ফুটে ওঠে। বলেন, আসলে রণাঙ্গনে আছি তো, আমার সঙ্গে দেখা না-ও হতে পারে, তবে কথা দিতে পারি আমাদের আন্দোলন আরও বড় আকারে আপনাদের সামনে দেখা দেবে। দূরে মাঠের ওপর দাঁড় করানো আছে জিপ। লিডারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমাদের দলটা চলেছে জিপের দিকে। ওদের কোনও কথাই আমার কানে ঢুকছে না। মাথায় এখন একটাই চিন্তা, চিত্রা কি ফিরবে আমাদের সঙ্গে? যদি না ফেরে, আমি হয়তো আর সুযোগই পাব না ওর সঙ্গে কথা বলার। চিত্রাও তো একজন অসম যুদ্ধের যোদ্ধা।

আমরা আবার ট্রেনে। ফিরছি কলকাতায়। লাইনের দু’পাশে ফিরে এসেছে সবুজ। হাওয়ায় জল, ফসলের গন্ধ। এখানে বসে ভাবাই যায় না, মাত্র ঘণ্টা দেড়েক পেছনে পড়ে আছে শ্মশান নির্জন একটা গ্রাম। ওই রুক্ষ, তপ্ত গ্রামের গভীরে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে আশ্চর্য স্বপনে বিভোর হয়ে আছে। স্বপ্নটা ভীষণভাবে জাগ্রত এটাই যা ভয়ের। এর মধ্যে একটাই যা সুখবর, চিত্রা আমাদের সঙ্গেই ফিরেছে, আছে এই ট্রেনেই। এখন অবধি ওর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইনি আমি।

ওদের আস্তানা থেকে ফেরার সময় জিপ যখন স্টার্ট নিল, চিত্রা কোথা থেকে তড়িঘড়ি পায়ে এগিয়ে আসে। আমিই ওর হাত ধরে তুলে নিয়েছিলাম। ওর হাত এখনও নরম আছে। এবং এ-ও জানি, ওর স্পর্শে আমার হাতে উঠে এসেছে বনকর্পূরের গন্ধ। যে পাতার সুবাস চিনিয়েছিল ওদের দেশের বাড়ি নিয়ে গিয়ে।

অন্য রাস্তা দিয়ে জিপটাই আমাদের নিয়ে আসে মেদিনীপুর স্টেশনে। গাড়ি থেকে নেমে

চিত্রা আমাদের ফোনসেট, ক্যামেরা ফেরত দেয়। তারপর ফের মিশে যায় ভিড়ে। আমি কিন্তু দেখে নিয়েছি ও উঠেছে আমাদের একটা কামরা পরে। এই জার্নিতেই ওর সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে।

আমার সাংবাদিক বন্ধুরা এখন একদম রিল্যাক্সড। মোবাইল সেট ফেরত পেয়ে যে যার বাড়ি, অফিসে ফোন করে ফেলেছে। আমি এখনও সুমিতদাকে ফোন করিনি। অন-ই করা হয়নি সেটটা। পাঁশকুড়া পেরোতেই উঠে পড়লাম সিট ছেড়ে। দিব্যেন্দু বলল, কোথায় চললে বস্?

বলতেই হল, মেয়েটা বোধহয় আশপাশের কামরায় আছে। যদি ছোট্ট করে একটা ইন্টারভিউ নেওয়া যায়…

রাজর্ষি বলে ওঠে, যাই বলো, বস্, আমি কিন্তু ওয়াচ করেছি, মেয়েটা সামনে এলেই তুমি একটু বেশি অ্যাটেনটিভ হয়ে পড়ছ। ভাল কথা বলছি, রিস্ক নিয়ো না, হাই ভোল্টেজ মেয়ে। ফালতু ঝাড় খেয়ে যাবে।

রাজর্ষি কি কিছু সন্দেহ করেছে? খুব একটা মাথা না ঘামিয়ে আমি দরজার কাছে যাই।

পরের স্টেশনে ট্রেন থামতেই দৌড়ে এসে উঠলাম চিত্রার কামরায়। ওপারের দরজার কোণে দাঁড়িয়ে আছে একাই। আমি সামনে যেতে অবাক না কি বিরক্ত হয়ে তাকায়? ট্রেন ফের চলতে শুরু করেছে, চিত্রাকে বলি, এসব কী চিত্রা? কেন এ পথ তুমি বেছে নিলে? চোখে চোখ রেখে চিত্রা বলে, আমি তো বাছিনি। আমার শিক্ষা দীক্ষা, বোধ, বিশ্বাস আমাকে এ পথে নিয়ে এসেছে।

কিন্তু এ পথ তো খুব সংক্ষিপ্ত। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি মোটেই তোমাদের আন্দোলনের উপযুক্ত নয়।

উত্তর না দিয়ে দরজার বাইরে চলমান দৃশ্যপট দেখতে থাকে চিত্রা। আবার বলি, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, কী কারণে তুমি এরকম একটা মারাত্মক দলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে! এর মাঝে তোমার জীবনে কোনও অঘটন, পারিবারিক কোনও বিপর্যয়?

দৃষ্টি ফিরিয়ে চিত্রা বলে, না। তুমি যা ভাবছ, তেমন কিছুই হয়নি। আসলে ব্যক্তিগত পর্যায় ছাড়া তোমরা তো ভাবতেই পারো না।

রাগ হয়ে যায় আমার। বলি, বাজে কথা বোলো না। তুমি চিরকালই ইমোশনাল মেয়ে, কেউ ভাল করে ব্রেন ওয়াশ করেছে, তাই বেছে নিয়েছ এই অবাস্তব জীবন।

অবাস্তব জীবন যাপন করছ তোমরা। দেখে এলে তো গ্রামটা। এরকম হাজার হাজার গ্রাম ছড়িয়ে আছে ভারতে। সেখানে লক্ষ কোটি নিঃসহায় মানুষ। তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া কি অবাস্তবতা?

উত্তরে বলি, তোমাদের জঙ্গি আন্দোলনে বেশিরভাগ নিরীহ মানুষ, সাধারণ পুলিশকর্মীই মারা যায়। তাদের বাড়ির কথা ভাবো না কেন?

ম্লান হাসে চিত্রা। বলে, এসব আলোচনা ট্রেনে হয় না। তোমার সঙ্গে একদিন দেখা করে খুব তর্ক করব।

কোলাঘাট ব্রিজ এসে যায়। আমাদের মাঝে এখন শুধুই ঝমঝম শব্দ। আমিও বুঝতে পারি কথা বেশিদূর এগোবে না। এতদিন খোঁজখবর নিইনি চিত্রার, অনেক বদলে গেছে। সামান্য তিন-চার ঘণ্টার দূরত্বের গ্রামকে কত অচেনা লাগে।

ব্রিজ পার হতে বলি, তুমি এখন থাকছ কোথায়? – কথাটা নিজের কানেই লাগে। এরা কখনওই কোনও স্থায়ী ঠিকানায় থাকে না।

চিত্রা সেরকমই একটা উত্তর দেয়, কোনও ঠিক নেই। মাঝেমধ্যে দেশের বাড়িতে থাকি। খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে, বাবার শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। বেহালার পিসির বাড়িতেও থাকি কখনও সখনও। অথবা কলকাতার কোনও মেসে।

তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?

তোমায় কিছু করতে হবে না। আমিই সময় সুযোগ বুঝে তোমাকে ফোন করব। এখন কেটে পড়ো। পুলিশ সর্বক্ষণ ওত পেতে আছে। তোমার জন্য না আমি ধরা পড়ে যাই!

ট্রেনের গতি কমছে। স্টেশন আসছে সম্ভবত। নেমে যাওয়ার আগে অনেক সময় ধরে চেপে রাখা পুরনো প্রশ্নটা করি, আচ্ছা চিত্রা, আমার একটা কথার উত্তর দেবে? আমাদের কাগজের আর সব রিপোর্টারকে ছেড়ে আমাকেই কেন বেছে নিলে প্রেস মিট-এ?

সেই কবেকার কলেজবেলার বিরল হাসিটা হেসে চিত্রা বলে, এরকম একটা দুঃসাহসিক কাজ করছি, বন্ধুকে দেখাতে লোভ হয় না!

কথাটার ভেতরে কোনও শ্লেষ আছে, নাকি সরলভাবেই বলল, ঠিক ধরতে পারলাম না। ট্রেন থামতেই নেমে এলাম।

আজ আমার অফ ডে। বেলা করে বিছানা ছাড়ব। অন্তু সেটা হতে দেবে না। দু’বার ঘুরে গেছে, কাকুন তোমার কাগজ, কাকুন তোমার ফোন এসেছে।… ঘুম ভাঙিয়ে আমার সঙ্গে বাজার যাবে। ওদের এখন গরমের ছুটি।

চিত্রাদের ওখান থেকে ঘুরে এসেছি তিনদিন হয়ে গেল। গণসংগ্রাম গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রেসমিট-এর বেশ বড় করেই অ্যাঙ্কার স্টোরি হয়েছে আমাদের কাগজে। দিব্যেন্দুর থেকে নেওয়া ছবিটাও গেছে। ভেবেছিলাম যতটা আলোড়ন সৃষ্টি হবে, তার কিছুই ঘটেনি। সুমিতদা আলতো পিঠ চাপড়েছেন। মন্দিরা ফোন করে বলেছে, দারুণ হয়েছে স্টোরি। দেখা হলে ডিটেল শুনব।

আজ মন্দিরার সঙ্গে দেখা হবে। তখনই ভাবছি চিত্রার প্রসঙ্গটা তুলব। কথাটা আমি একাই বইছি ক’দিন ধরে। চিত্রা আর ফোন করেনি। হয়তো করবে না, কথার কথা বলেছিল। ক্রমাগত ঠিকানা বদলে ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে চিত্রা। যেমন আমাদের প্রেসমিটের দু’ঘণ্টার মধ্যে ওই ওদের দল নিশ্চয়ই ডেরা পালটে ফেলেছে। ওরা সবসময়ই সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যাবে। কলকাতার আলোকোজ্জ্বল বিপণি, উৎসবে কোথাও

এতটুকু ছাপ ফেলতে পারেনি ওরা। চিত্রার নিশ্চয়ই ভুল ভাঙবে একদিন।

অন্তু বোধহয় আবার আমায় ডাকতে আসছিল, ওকে ধমকাল বউদি। আর শুয়ে থাকা উচিত হবে না। বিছানায় উঠে বসে বালিশের তলা থেকে সেলফোন বার করি। অন করতেই রিং হতে লাগল। নাম্বারটা চেক করলাম, অচেনা। সকালবেলা এ-ধরনের অচেনা নাম্বার সাধারণত কেটে দিই, যদি চিত্রা করে থাকে, এই ভেবে কাটলাম না। ফোন কানে নিয়ে ‘বলছি’ বলতেই, ও প্রান্তের পুরুষকণ্ঠ বলে ওঠে, সকালের কাগজটা পড়েছেন?

কে বলছেন আপনি? জানতে চাইলাম। অপর প্রান্ত বলে, গণসংগ্রাম গোষ্ঠীর একজন যোদ্ধা। আমাদের কমরেড চিত্রা ধরা পড়েছে কলকাতা পুলিশের হাতে। ওকে ধরিয়ে দিতে পারে এমন দু’-তিনজন সন্দেহভাজনের মধ্যে আপনার নামটা সবার প্রথমে। আপনি ওকে অনেকদিন ধরে চেনেন, ও কোথায় কোথায় থাকতে পারে তাও জানেন। যখনই আমরা নিশ্চিত হব, আপনিই পুলিশকে খবর করেছেন, এক ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে খতম করা হবে। ফোনটা কেটে গেল। এমনভাবে বন্ধ হল যেন আর কোনওদিনই বাজবে না। ভীষণ একটা অস্থিরতা শুরু হল শরীর জুড়ে। ‘মেরে ফেলব’ এরকম ফোন আমি আগেও পেয়েছি, রিপোর্টাররা প্রায়ই পায়। ওগুলো শুধুই ভয় দেখানো। কিন্তু এক্ষুনি আসা ফোনটা অন্যরকম। এত অমোঘ, যেন নিয়তির গলা।

বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে যাই। দ্রুত ভাবতে থাকি ফোনটার ব্যাপারে কার সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। কে আমাকে হেল্প করতে পারবে। প্রথমেই সুমিতদার কথা মনে পড়ে, অনেক চেনাজানা। কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে কি ওদের রোখা যাবে? তা হলে তো ওরকম অবাধে ওরা গ্রাম দখল করতে পারত না। কীরকম অনায়াসে পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে আমাদের প্রেসমিটে নিয়ে গেল।

আরও খানিক ভাবতেই আমি বুঝতে পারলাম, আমাকে সাহায্য করতে পারে একমাত্র চিত্রাই। এদিকে, ওর কাছে পৌঁছোনো দুষ্কর ব্যাপার। পুলিশ ওকে পুরোপুরি সিল করে রাখবে। কোর্টে তোলার আগে পর্যন্ত কারুর সঙ্গে দেখা করতে দেবে না। ডিসি হেডকোয়ার্টারের কথা মনে পড়ল, সুমিতদাকে দিয়ে যদি বলানো যায়, হয়তো দেখা করতে দেবেন। কথা দিতে হবে উলটো পালটা খবর করলে চলবে না। কিন্তু কেন দেখা করতে চাই, এই প্রশ্নের কী উত্তর দেব? বলব, ও আমার বন্ধু ছিল, এক কলেজে পড়েছি। সে তো আর এক হুজ্জোত, চিত্রার সম্বন্ধে তথ্য নিতে পুলিশ আমার পেছনে পড়ে যাবে। তা হলে কি ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে ধরব, যিনি চিত্রাকে অ্যারেস্ট করেছেন, হয়তো ভদ্রলোক আমার চেনা হতে পারেন। এসব ভাবনার মাঝে খেয়াল হয় আমি শুধু ভাবছি আমাকে নিয়েই, চিত্রার যে কী অবস্থা হবে… হঠাৎ মনে হয় ফোন মিথ্যে, কেউ মজা করল আমার সঙ্গে। আগে কাগজটা দেখা উচিত।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম কাগজে। থার্ড পেজের মাঝামাঝি ছোট্ট বক্সে নানান খবরের ভিড়ে বন্দি হয়ে আছে চিত্রা।

আমি এখন লালবাজার ফিমেল লকআপের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে একজন কনস্টেবল।

অনেক বুদ্ধি করে লকআপ অবধি পৌঁছোনো গেছে। কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা এসে ধরেছি সেন্ট্রাল লকআপের ওসিকে, সমর জোয়ারদার। লালবাজার রিপোর্টিং করি, ভদ্রলোকের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। এসে বললাম, স্যার, লকআপে অনেকদিন ধরে আমার একজন সোর্সকে আটকে রেখেছেন, রামবাগানের ঝিলিক। কিছু খবর নেওয়ার আছে, যাব?

যান না, আজ আবার লকআপে একজন বিশেষ অতিথি আছেন। ওদিকে তাকাবেন না। যেন কিছুই জানি না ভাব করে বলেছিলাম, কে স্যার?

সেসব কথা পরে হবে। আপনি ঘুরে আসুন। চা খেতে খেতে বলব।

একজন কনস্টেবল ডেকে আমায় হ্যান্ডওভার করলেন।

ফিমেল লকআপের সামনে এসে দাঁড়াই। আলো-অন্ধকার সেলে দু’-একজন বাদে বেশিরভাগ কয়েদিরাই এখনও ঘুমিয়ে আছে। এদের মধ্যে ঝিলিকও আছে নিশ্চয়ই। আমাকে দেখলেই চেঁচামেচি শুরু করে দিত। কিন্তু আমার যাকে দরকার সে কোথায়? একজন মোটামতো মহিলা বেশ বড় করে আড়মোড়া ভাঙছিল, সে উঠে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল চিত্রাকে। হাঁটুতে চিবুক রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঘাড় ঘুরিয়ে আমার আশপাশটা দেখে নিলাম। যে কনস্টেবল আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, আপাতত নেই। চাপা স্বরে ডাকলাম, চিত্রা।

এক ডাকেই ঘাড় ফেরাল। তারপর উঠে এল ধীরে ধীরে। শীর্ণ শালিকের মতো চেহারা হয়েছে, এক রাতেই! এরা কি মেরেছে চিত্রাকে? সামনে এসে দাঁড়াতেই চোখের ওপর ভেসে উঠল চিত্রাদের দেশের বাড়ির বাকল ছাড়ানো অর্জুন গাছটার ছবি। অবিকল গাছটার মতোই দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা।

কী বলতে এসেছিলাম, ভুলেই গেলাম। গারদে রাখা চিত্রার হাত ধরে শুধু বলি, দেখি, কী করা যায়!

লালবাজার থেকে বেরিয়ে আসতেই লক্ষ করি, সকালের কলকাতায় কেমন যেন ছায়া ছায়া ভাব। অথচ আকাশ পরিষ্কার। দু’পা হাঁটতেই নিজেকে ভীষণ অরক্ষিত মনে হয়। যে-কোনও মুহূর্তে ভুল সন্দেহে ছুটে আসতে পারে বুলেট। আসুক। কী আর করা যাবে! চিত্রাকে বলতে এসেছিলাম, তোমার কমরেডদের বলো, আমি নই, আমি তোমাকে ধরিয়ে দিতে পারি না। তুমি আমাকে অনেকদিন…

কিছুই বলতে পারিনি। মৃত্যুকে শিয়রে নিয়ে থাকা বন্ধুকে কী করে বলি, আমাকে বাঁচাও।

সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি ২০০৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *