ছায়া পূর্বগামিনী – ভবানী মুখোপাধ্যায়
টেলিফোনের ঘন্টা আবার বেজে উঠল।
তোড়াতাড়ি কল-টা ধরার জন্য ওঠার উদ্যোগ করতে করতে হেমাঙ্গ বলে ওঠে, ‘আচ্ছা, ফোন এলেই তুমি অমন লাফিয়ে ওঠো কেন? কেন এই চঞ্চলতা?’
মাধবীর দিকে তির্যক দৃষ্টি হেনে ফোনটা ধরল হেমাঙ্গ। মাধবী কিন্তু নীরবে নিস্পন্দ ভঙ্গিতে স্থির হয়ে বসে রইল। ঠোট দুটি ঈষৎ খোলা, একাগ্রচিত্তে টেলিফোনের কথাসূত্র ধরার চেষ্টা করছে, অথচ জানে এইখানে বসে অপর প্রান্ত থেকে কি কথা আসছে তা জানা অসম্ভব।
হেমাঙ্গ ফিরে এসে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, ‘ঘড়ির দোকান থেকে ফোন করছিল। ওরা বলছে কাল শনি, পরশু রবি, তার পরদিন ঈদের ছুটি। সেই মঙ্গল বারের আগে আর ঘড়ি মেরামত হবে না।’
পরিপূর্ণ নিটোল স্বাস্থ্য হেমাঙ্গর, সাধারণ বাঙালী ঘরের পক্ষে কিঞ্চিৎ বে-মানান। সামনের মাথায় চুল কম, টাক পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু পিছন দিকের বাবরি দেখবার মতন।
মাধবীর দিকে যখন তাকাল হেমাঙ্গ তখন তার চোখ দুটি যেন জ্বলছে।
মাধবী বলে, ‘তোমাকে কিন্তু হেস্টিংস স্ত্রীটের অ্যাটর্নি বলে মনে হয় না, দেখায় যেন মাউন্টেড পুলিশ। কিংবা ওদের ঘোড়র মতন—তেমনই তেড়ে উঠতে পার, তবে অবশ্য হাঙ্গামা যদি বাধে।’
ওর মুখের দিকে সবিস্ময়ে তাকায় হেমাঙ্গ—কি অদ্ভুত তার ভঙ্গি, তেমনই বিচিত্র তার কথাবার্তা। সব কিছু লক্ষণ এবং ভঙ্গিমা দেখে কারো মনে হবে না যে মাধবী পরম প্রেমে আত্মহারা হয়ে আছে।
এইবার কর্কশ গলায় বলে হেমাঙ্গ, ‘তুমি কিন্তু আমাকে কিছুতেই বললে না টেলিফোন কেন তোমাকে চঞ্চল করছে। যেন কোন অজানা জনের সংবাদের প্রতীক্ষায় রয়েছে, ব্যাপার কি মাধবী?’
‘ছিঃ, পাগলামি করো না।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার রুক্ষ গলায় বলে হেমাঙ্গ, ‘নিশ্চয়ই কিছু কারণ আছে, আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না। আমাকে সব বলতেই হবে।’
দুই হাতে কপালটা চেপে কিছুক্ষণ বসে রইল মাধবী, তারপর মৃদু গলায় বলল, ‘তোমাকে আগে বলিনি—তুমি হয়তো কি ভাববে, আমাকে পাগল মনে করবে, কিন্তু স্বপ্নটা, উঃ—’
ধীর গলায় হেমাঙ্গ প্রশ্ন করে ‘কি জাতীয় স্বপ্ন?’
সেই ভাবেই গালে হাত রেখে বসে রইল ক্ষণকাল মাধবী, তারপর যেন আত্মকথনের ভঙ্গিতে টেবলের উপর দৃষ্টি রেখে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘হয়তো অদ্ভুত মনে হবে, কিন্তু ভোরের দিকে স্বপ্ন দেখলাম যেন আমার ছোটভাই নীলু আমার বিছানার ধারে এসে বসেছে, আমি বলছি—কিরে নীলু, এত রাত্তিরে কোথা থেকে? নীলু বললে—দিদিভাই আমি আর বেঁচে নেই। বারোটার সময় মারা গেছি—কথাটা শুনে আমার ভারি মন খারাপ হয়ে গেল, হয়তো নিছক কল্পনা, স্বপ্ন মাত্র, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি স্পষ্ট তাকে দেখেছি, এমনি যেন আমার চোখের সামনে এসে বসেছিল সে, ওদিকে দেখছি পাশে শুয়ে তুমি অঘোরে ঘুমোচ্ছ।’ কিছুক্ষণ থেমে মাধবী আবার বলতে শুরু করে, ‘নীলু একথাও বলল আমি আজ সকালের ভিতরই খবর পাবো যে এ স্বপ্ন সত্যি, দিল্লী থেকে ট্রাঙ্ককলে খবর আসবে যে নীলু কাল রাতে মারা গেছে।’
সোজা ওর মুখের দিকে তাকায় হেমাঙ্গ—সে একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে, মাধবী হঠাৎ এসব বলে কি, হল কি ওর! হেমাঙ্গ সান্ত্বনার সুরে বলে, ‘বেশ তো, এখন তো প্রায় দশটা বাজে, কেউ তো ফোন করেনি, আর ধর যদি—’ ইতস্তত করে হেমাঙ্গ, তারপর আবার বলে, ‘নীলু কিছুকাল ধরেই তো ভুগছিল, অবশ্য তোমরা দুজনে খুবই ঘনিষ্ঠ, কিন্তু তবু যা সত্য তাকে মেনে নিতে হবে, অনেক আগে থেকেই তো এই দুসংবাদের জন্য তৈরি হয়ে আছ। যদি সত্যই এই দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে—’
মাধবী যেন ঘুমের ঘোরে কথা বলছে, সেই ভাবেই টেবলের দিকে চোখ রেখে বলে, ‘তোমার কথাই সত্য, কিন্তু স্বপ্নের ভেতর নীলু আরো কিছু বলেছে। সে কি বলেছে জানো—?’ এইবার সোজা হেমাঙ্গর মুখের পানে তাকায় মাধবী। তার পর স্পষ্ট গলায় বলে, ‘আমাকে সাবধানে করেছে নীলু, বলেছে আজ রাত বারোটার পর আমারও সব শেষ হবে—’
বিস্মিত হেমাঙ্গ বলে ওঠে, ‘বল কি, আজই রাত বারোটা? যতসব গাঁজা, তোমাকে আমি কতদিন বলেছি ওই সব ভূত-প্রেত আর গোয়েন্দা কাহিনী পড়া ছাড়ো, তুমি কিছুতেই কথা শুনবে না।’
মাধবীর কণ্ঠস্বর ক্ষীণ কিন্তু তী, সে যেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘না, আমি আর বাঁচব না। আর বড়জোর চোদ্দ-পনের ঘন্টা!’ ঘড়ির দিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাধবী বলল, ‘আর ক’টা ঘণ্টা মাত্র।’
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে মাধবী।
এক মুহূর্তের জন্য হেমাঙ্গর মনে করুণা হয়েছিল, সান্ত্বনা দানের উদ্দেশ্যে মাধবীকে বুঝি স্পর্শ করার ইচ্ছা হয়েছিল, কিন্তু সে ইচ্ছা দমন করে পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বার করে নাড়াচাড়া করে, তারপর কণ্ঠস্বর ঈষৎ মোলায়েম করে বলে, ‘দেখ, এ সব তোমার বানানো গল্প কিনা কে জানে, যদি সত্যি বলেই ধরি তাহলেও স্বপ্ন। আর যদি স্বপ্ন হয় তাহলে দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্নকে মনে মনে রেখে বসে থেকেও কোন লাভ নেই তাকে ভুলতে হয়, ভুলতে শেখো। তা নিয়ে বৃথা মন খারাপ করে বসে থেকে লাভ কি?’
তন্দ্রাচ্ছন্ন ভঙ্গিতে বলে মাধবী, ‘নীলু বললে, যখন খবরটা পৌঁছবে তখন বুঝবে আমার কথা সবটুকু সত্যি। সে যে ভবিষ্যৎ-বাণী করছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।’
হেমাঙ্গ বললে, ‘ছাই প্রমাণ পাবে, কিছুই প্রমাণ হবে না। তুমি জানতে তোমার ভায়ের কঠিন অসুখ, সে অনেকদিন ধরে ভুগছিল,—মাধবী তুমি লেখাপড়া জানা মেয়ে, নিশ্চয়ই জানো মাঝে মাঝে ভাই-বোনের মধ্যে এই জাতীয় সংবাদ আদান প্রদান ঘটে থাকে। একে বলে টেলিপ্যাথি—কোথায় কি হচ্ছে ওরকম বোঝা যায়।’
জানলার কাছ থেকে সরে এসে পরম প্রীতিভরে মাধবীর মাথায় হাত রাখে হেমাঙ্গ। সান্তনার ভঙ্গিতে বেশ মোলায়েম কণ্ঠে বলে, ‘শোন মাধবী, ব্যাপারটা বেশ করে তলিয়ে ভাবো। আজ এই উনিশশো পঞ্চান্নয় তোমার এই ব্রাইট স্ট্রীটের বাড়িতে এই ধরনের ভৌতিক বাণী কি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, তার চেয়ে মাথাটা মাটির দিকে করে আর পা দুটি ওপরে করে হাঁটতে শেখা বরং সহজ। এসব কাণ্ড কখনও ঘটে না। তাছাড়া নীলু তোমাকে যেরকম ভালবাসে, সে কখনই এই ভাবে স্বপ্নে ভয় দেখাবে না। সুতরাং উঠে পড়, যা কাজ আছে কর, খাও, দাও ফুর্তি কর। শুনছ?’
হেমাঙ্গ লক্ষ্য করল মাধবী কাঁপছে, তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধটা সজোরে ধরে, সাহস ও শক্তি দেওয়াটাই তার উদ্দেশ্য। স্বপ্নের ব্যাপারটি নেহাৎ একটা মনগড়া ফাঁকা আওয়াজ যে নয় তা এতক্ষণে বিশ্বাস হয়েছে হেমাঙ্গর, একটু আগেও ভেবেছে মাধবী অভিনয় করছে, ওকে বিভ্রান্ত করাটাই হয়তো তার ফন্দি।
মাধবী একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে বলে, ‘আচ্ছা, তুমি যা বলছ তাই হয়তো ঠিক। আমারই কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। স্বপ্নটা হয়তো আমার মনোবিকার।’
একটু পরেই আবার টেলিফোন বেজে উঠল।
আবার মুখে হাত চেপে মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল মাধবী। অতি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল হেমাঙ্গ টেলিফোন রিসিভ করতে। ফিরে এল কিন্তু অনেক পরে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করল মাধবী, ‘কি, দিল্লী থেকে খবর এল তো? নীলু তাহলে নেই!’
মাথা নেড়ে সায় দেয় হেমাঙ্গ। সে একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এতক্ষণ পর্যন্ত যা হাসি ঠাট্টার বিষয় ছিল, এখন তা নিষ্ঠুর সত্য হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।
কি যেন বলার চেষ্টা করল হেমাঙ্গ, কিন্তু তার মুখে কথা যোগায় না, বিষয়টির ভয়ঙ্করত্বে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সান্ত্বনা দিয়ে তবু আর একবার টেলিপ্যাথির কথা উচ্চারণ করে হেমাঙ্গ।
সব কাজকর্ম ছেড়ে সারাদিনটা মাধবীর সঙ্গে কাটাবে স্থির করল হেমাঙ্গ। মাধবী কিন্তু ভীষণ আপত্তি জানাল। অবশেষে বলল, ‘একা থাকলে বু একটু শান্তি পাব, অনেক ভাল থাকব হয়তো, একটু আমাকে না হয় একা থাকতে দাও।’
বেরিয়ে যাওয়ার সময় হেমাঙ্গ গম্ভীর গলায় বলল, ‘সত্যি বলছি, তখন তোমাকে ঠাট্টা করেছি বলে এখন মনে কষ্ট হচ্ছে, ওই টেলিফোনের কথাটি বলা উচিত হয়নি আমার।’
মাধবী বেশ ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠে, ‘তাতে কি, বেশ করেছ, সংসারে এমন ঘটেই থাকে।‘
হেমাঙ্গর গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই মাধবী তাড়াতাড়ি গিয়ে টেলিফোনটা ধরে, ওপার থেকে সাড়া আসতেই কান্নায় আকুল হয়ে উঠল মাধবী। অপর পক্ষ কোমল গলায় প্রশ্ন করে, ‘হল কি তোমার? বলতেই হবে সব খুলে।’
অতিকষ্টে, মাঝেমাঝে চাপা কান্নায় বাধা পেয়ে, ওপার থেকে শোনা কথায় আঘাত পেয়ে কোন রকমে সমগ্ৰ কাহিনী শেষ করলে মাধবী। কিন্তু স্বপ্নের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে এমন কতকগুলি নতুন কথা বলল যা হেমাঙ্গ বলেনি।
‘প্রতুলদা, আমার বিছানায় নীলু যখন বসেছিল, তখন আমি ওকে প্রশ্ন করলাম যা ঘটবার তা ঘটবেই, তবু আমাকে সাবধান করার হেতু কি! আমি জানতে চাইলাম, কোন উপায় আছে কি বাঁচবার? নীলু বলল—একেবারে নেই বলে কোন কথা নেই, পালাবার পথ নিশ্চয়ই আছে, ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচার রাস্তা হল অতিশয় সাবধানে থাকা। তাহলে হয়তো পরিত্রাণ পেতে পার। কিন্তু প্রতুলদা, তারপর আমার মুখের দিকে অতি বিষণ্ণ চোখ মেলে বলল—কিন্তু মাধুদি তোমার যেরকম কাণ্ড, প্রতুলদাকে নিয়ে যেভাবে মেতে আছ তাতে যে তুমি অত সহজে নিষ্কৃতি পাবে মনে হয় না।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, অপর প্রান্ত থেকে যে কথা ভেসে আসছে অতিশয় আগ্রহ ভরে তাই শুনছে মাধবী। তারপর অতি ক্ষীণ গলায় বলে, ‘প্রতুলদা, আমি বেশ বুঝতে পারছি এ যাত্রা আর নিস্তার নেই, স্বপ্নের একাংশ যখন ফলে গেছে তখন অপর দিকটাও নিশ্চয়ই ফলে যাবে। কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। প্রতুলদা আমাদের…’
অপর প্রান্ত থেকে প্রতুলদা বলে ওঠে, ‘ননসেন্স, কি সব বাজে বকছ, একটু শক্ত হও, লক্ষ্মীটি, এই সময়ে মনটাকে অত দুর্বল করতে নেই।’
এবার জোর গলায় বলে মাধবী, ‘না প্রতুলদা, ব্যাপারটা সবটুকু একেবারে ননসেন্স নয়। আজ সকালেই লক্ষ্য করেছি উনি আমাকে বেশ সন্দেহ করছেন, বেশ বাঁকা বাঁকা কথাও বলেছেন, আমি সব সয়ে গেছি। এমন কি এই ইঙ্গিতও করেছেন যে কোন ভালবাসার জনের ফোন পাওয়ার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আছি। এরপর আর কি বলবে?’
‘ও বাবা, এত সব কাণ্ড ঘটেছে?’
‘হ্যা, সেই জন্যেই আমি বিশ্বাস করছি যে নীলুর ব্যাপারটা নিছক উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়।’
প্রতুল বলল, ‘কিন্তু মাধবী, আমি না হয় ধরছি নীলুর কথাই ঠিক, তবু জিনিসটা অবিশ্বাস্য। ধর, আমাদের এই ব্যাপার হেমাঙ্গ জানল, তা সে কি তোমাকে খুন করবে, অন্তত তুমি তো সেই কথাই বলছ?’
‘জানি না কি করবে না করবে। শুধু এইটুকু বুঝছি আমার ভয় হয়েছে, ভীষণ ভয়। আজ আর আমাদের দেখা করার দরকার নেই। অন্তত বিপদটুকু না কাটা পর্যন্ত দেখা না করাই ভাল। আজ যদি দেখা না হয় আমাদের, তাহলে হয়তো নীলুর কথাটা বিফল হতে পারে। খানিকটা আত্মত্যাগ বলা যেতে পারে। নীলু বলেছিল তোমার যা অবস্থা তাতে হয়তো তুমি সামলাতে পারবে না। তাহলে আর যাচ্ছি না….।’
অনেক বিতর্কের পর প্রতুলের কণ্ঠস্বর রাজী হল, তারপর শান্ত গলায় সান্ত্বনা দিয়ে বলে, ‘কিন্তু মাধবী, কথা দাও তুমি এসব কথা নিয়ে মোটে চিন্তা করবে না। এতটুকু মাথা ঘামাবে না। আমি আবার তোমাকে রাত বারটার পর ফোন করব।’
‘আচ্ছা, তাই করো প্রতুলদা, আমাকে তুমি ঠিক রাত বারটার পর ফোন করবে, স’বারোটার ভেতর। …তাহলে বুঝব বিপদ কাটল আর তুমিও জানবে কি খবর!’
কিন্তু—’ প্রতুল কি প্রশ্ন করতে যায়।
মাধবী তাড়াতাড়ি বলে, ‘কোন ভয় নেই, একবার শুলেই ওর জ্ঞান থাকে না, একেবারে পাথর হয়ে যায়। এমনিতেই এত ঘুম, তায় আজ আবার শনিবার, ক্লাব হয়ে ফিরবে, বুঝতেই পারছ এতটুকু জ্ঞান থাকবে না। ঠিক তাহলে বারটার পর ফোন করবে। তুমিই ফোন করো, যদি বুঝতে পারে, বলব রঙ নাম্বার।’
খাওয়া দাওয়া অনেকক্ষণ শেষ হয়েছে, হেমাঙ্গ শুতে গেছে অনেক আগে। আয়নার দিকে তাকিয়ে ড্রেসিং টেবলে চুপ করে বসে আছে মাধবী। হেমাঙ্গকে অনেক বুঝিয়ে শুতে পাঠানো হয়েছে। কিছুতেই সে শোবে না, বলেছিল, ‘তুমিও বরং শুয়ে পড়, আজ আর সেলাই করে কাজ নেই, সারাদিন ধরে মনটা ক্লান্ত হয়ে আছে, বিশ্রামের প্রয়োজন।’
মাধবী চুপ করেছিল।
তবু বারবার বলেছে হেমাঙ্গ, ‘ঠিক বলছ তোমার শরীর ভাল আছে?’
মাধবীর চোখের কোণে জল দেখে হেমাঙ্গ শুতে গেছে। এতক্ষণে মাধবী একটু স্বস্তি বোধ করছে, শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি, আর কতটুকুই বা বাকি, এর মধ্যে কি আর ঘটতে পারে? স্বপ্নের প্রথম দিকটা মিলেছে, তাই শেষটাও মিলবে এমন কথা নেই। কাল শরীর বুঝে না হয় প্লেনে চলে যাবে দিল্লী। নীলুর কথাটাও তো মোছা যায় না মন থেকে। জানলার ধারে গিয়ে পরদাগুলি ঠিকমত টেনে দেয় মাধবী। জানলার নিচেই ছোট্ট বাগান, কত বিচিত্র মরসুমী ফুল ফুটে আছে, এই ম্লান আলোয় অস্পষ্ট কার্পেটের মত মনে হয়।
কত কাছে অথচ কত দূরে। জানলায় কোন পরদা নেই, নতুন ফ্যাশান, যদি এই জানলার ফাঁকে উড়ে যাওয়া যেত, সত্যি যদি পাখনা থাকত, কত মজাই না হত, হেমাঙ্গর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ডানা মেলে উড়ে চলে যেত মাধবী, কত দূর-দিগন্তের পারে মেঘের সঙ্গে গিয়ে মিশত।
কিন্তু কি সব কথা ভাবছে মাধবী, পাগলের মত। ডানাই বা মেলবে কেন, কলহ যদি হয় সামনের দরজাও খোলা রয়েছে—তারপর প্রশস্ত রাজপথ।
এখন সে অনেক ভাল আছে, এত ভাল আছে যে এই উদ্দাম চিন্তার উদ্ভট সম্ভাবনায় সে হাসতে পারছে।
এই স্তব্ধতার মধ্যে কিসের যেন একটা অদ্ভুত শব্দ শোনা গেল, অপূর্ব তার ঝঙ্কার! প্রথমটা কিছুতেই বুঝতে পারে না মাধবী শব্দটা কিসের। পরে মনে পড়ল সিঁড়ির ওপরকার ঘড়িটার ঘণ্টা বাজার আগে এমনই শব্দ হয়। তারপর ঘণ্টা বাজল, এক, দুই, তিন—
ভাল করে কান পেতে শোনে মাধবী। বারটাই বাজল শেষ পর্যন্ত। তবু কিছুক্ষণ সেইভাবে বসে রইল মাধবী। বারটা যে বেজেছে সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া চাই।
অনেকক্ষণ চুপ করে কপালে হাত রেখে বসে রইল মাধবী। সেই অশুভ মুহূর্ত পার হয়ে সে এসেছে নবীন জীবনে, সঙ্কটের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে। বারবার ভাবে বিপদ কাটল।
পা টিপে একবার হেমাঙ্গর বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল, মুখে তার বিজয়িনীর দীপ্ত ভঙ্গিমা। তারপর পাশের ঘরে টেলিফোনটির সামনে বসে পড়ল। টেলিফোনটা বাজলেই সেটা যাতে ধরতে পারে। মনে মনে এক দুই করে সাত মিনিট, আট মিনিট পর্যন্ত সময় গুণলো। তারপর আর তার এতটুকু অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকে না। চোরের মত অতি সন্তর্পণে সে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে প্রতুল লাহিড়ীর ফোন নাম্বারটা উচ্চারণ করে।
অনেক পরে ওপার থেকে প্রতুলের কণ্ঠ শোনা যায়, ‘হ্যালো।’
অনুযোগের সুরে মাধবী বলে, ‘কি হল তোমার? কখন বারটা বেজে গেছে, স’বারোটাও হয়ে গেল, তোমার সাড়া নেই কেন?’
‘সেকি! এর মধ্যে বারটা পনের, হতেই পারে না, এখন তো পৌনে বারটা, তোমাদের ঘড়ি নিশ্চয়ই ভীষণ ফাস্ট চলছে।’
হঠাৎ পিছনে কি যেন খসখস করে উঠল। সচকিত মাধবী সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে পিছনে তাকিয়ে দেখে রবারের শ্লিপার পায়ে হেমাঙ্গ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের চাউনিটা কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মত।
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাধবী বলে, ‘ওঃ, তুমি বুঝি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছ—’
তারপর সহসা রিসিভারটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উদ্দাম গতিতে মাধবী ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। পিছনে যেন হেমাঙ্গও দৌড়ে আসছে, তার পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা সেই জানলার ধারে এসে পৌঁছায় মাধবী। ভীষণ আতঙ্কে তার সারা শরীর কম্পমান। তারপর হঠাৎ জানালার উপরে উঠেই শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হয়তো তখনও ডানা মেলে দেওয়ার স্বপ্নের ঘোর তার কাটেনি।
‘মাধবী, মাধবী!’ চিৎকার করে ওঠে হেমাঙ্গ, কিন্তু কাছে আসার অনেক আগেই মাধবীর অচেতন দেহ মরসুমী ফুলের ওপর লুটিয়ে পড়েছে।
অনেক দূরে থানার ঘড়িতে বারটা বাজল।