ছায়া—কায়া—মায়া
স্বীকার করছি, সেদিন শিকার করতে যাওয়াটা পাকা শিকারির মতো কাজ হয়নি।
সকাল থেকেই খেপে-খেপে আকাশের বুকে কালো মেঘ উঠছে এবং তার সাথী হয়ে আসছে উদ্দাম ঝোড়ো হাওয়া আর ঝমঝম বৃষ্টি, সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে মাঠ-ঘাট-বাট সমস্ত।
দুর্যোগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না বটে, কিন্তু সাঁওতাল পরগনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ব্যক্তি মাত্রই জানেন, এই অল্পক্ষণের দুর্যোগেই ঘাট-বাট-মাঠের অবস্থা হয় কতটা বিপদজনক এবং ছোটো ছোটো পাহাড়িয়া নদীগুলো পর্যন্ত ফুলে-ফেঁপে দু-কূল ভাসিয়ে হয়ে ওঠে কতটা দুর্দমনীয়! আর অরণ্য রাজ্য তো দুরধিগম্য হয়ে ওঠে বললেও অত্যুক্তি হয় না।
আমরা তিন বন্ধু, তিন সরকারি কর্মচারি এবং প্রত্যেকেরই হাতে ছুটি আছে আর মাত্র একদিন। ছুটি ফুরোলেই আবার পায়ে পরতে হবে কাজের শৃঙ্খল। অতএব ছুটি ফুরোবার আগের দিনটাকে যেনতেন প্রকারে কাজে লাগাবার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়ে বাংলো ছেড়ে বেরিয়ে পড়লুম। আমাদের হাতে ছিল তিনটে ছররা-ছোড়া বন্দুক, কারণ স্বপ্নেও কোনোদিন বাঘ-টাঘ মারিনি, তাই আমাদের পাখি-শিকার ছাড়া অন্য কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না। কিন্তু বেরুবার সময় ডাকবাংলোর খানসামার মুখে শোনা গেল একটা বেমক্কা কথা।
বললে, ‘হুজুর, বেলা পড়বার আগেই বাংলোয় ফিরে আসবেন।’
জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কেন?’
‘অন্ধকার পথে চলতে গেলে বিপদে পড়তে পারেন।’
‘বিপদ? বাঘ-ভাল্লুক?’
‘না।’
‘তবে?’
সে আর জবাব না দিয়ে বাংলোর ভেতর চলে গেল। তার মুখ দেখে মনে হল, এ সম্বন্ধে আর কোনো কথাই সে খোলসা করে বলতে রাজি নয়। অল্পক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করলুম, কিন্তু বিপদটা কী হতে পারে, কিছুই আন্দাজ করা গেল না। তারপরেই পড়লুম উত্তেজনার আবর্তে—শিকারের উত্তেজনা! ডাকবাংলো ও খানসামার স্মৃতি পর্যন্ত মন থেকে মুছে গেল।
অস্থায়ী ঝড়-ঝাপটা আর বৃষ্টির দাপটে মাঝে মাঝে কষ্ট পেয়েছিলুম, নিশ্চয়ই, তবে তা সত্ত্বেও তিনটে বালিহাঁস ও একটা চখা বা চক্রবাককে হস্তগত করবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলুম না। তারপরেও আমাদের উৎসাহ-বহ্নি নির্বাপিত হয়নি। কিন্তু হঠাৎ দুটো ব্যাপার উপলব্ধি করা গেল—আমরা ফেরবার পথ ভুলেছি এবং বেলাবেলি যথাস্থানে ফিরতে না পারলে আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারে আমাদের অবস্থা হবে কানামাছির মতো।
আমরা তখন একটা অরণ্যের ভেতর দিয়ে পদচালনা করেছি। মাথা তুললে জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায়, অস্তগত সূর্য তার সমস্ত আলো এখনও আকাশ থেকে মুছে দিতে পারেনি। কিন্তু এরই মধ্যে দলে দলে নানা জাতের পাখিরা বাসামুখো যাত্রা শুরু করেছে এবং কোনো কোনো দল নিরাপদ বাসায় ফিরে সমস্বরে আরম্ভ করে দিয়েছে দৈনিক সান্ধ্য সংগীতের সাধনা।
দীনেশ বললে, ‘তাড়াতাড়ি পা চালাও, নইলে বিপদ হবে ঘনীভূত! অন্ধকার নামলেই চাঙ্গা হয়ে ওঠে বনের বাঘ-ভাল্লুকরা।’
প্রমথ বললে, ‘তাড়াতাড়ি পা চালাতে তো বলছ, কিন্তু পা চালাব কোনদিকে? কে জানে এই বন থেকে বেরুবার পথ?’
আচম্বিতে অপরিচিত হেঁড়ে গলা শোনা গেল, ‘আমি জানি!’
সচমকে মুখ ফিরিয়ে চারিদিকে তাকিয়েও আবিষ্কার করা গেল না, কোথা থেকে সেই অভাবিত, আকস্মিক কণ্ঠস্বরের উৎপত্তি! সামান্য দুটি শব্দ—‘আমি জানি।’ কিন্তু শুনেই কেন জানি না, বুকটা কেমন ধড়মড় করে উঠল।
আগেই বলেছি, সূর্য অস্তমিত হলেও আকাশ তখনও গোধূলি আলোকের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়নি। বনের ফাঁকে ফাঁকে ও মাটির ঘাসের পাটি ধুয়ে যাচ্ছিল আলোকের করুণা-ধারায়। কিন্তু যেখানে পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গনে আবদ্ধ বনস্পতিদের বিরাট পত্রছত্র আলোর ধারাকে ঝোপঝাপের ওপরে নেমে আসতে দেয়নি সেসব জায়গায় জমজমাট হয়ে অন্ধকার তার চিরবান্ধবী রাত্রির জন্যে অপেক্ষা করছে।
কোথাও কোথাও অন্ধকারের প্রভাব কিছু অল্প বটে, কিন্তু সেখানেও জঙ্গল ক্রমেই বেশি ছায়াচ্ছন্ন ও অপ্রীতিকর হয়ে উঠছে। এইরকম একটা জায়গার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দীনেশ বলে উঠল, ‘ও কে ওখানে?’
ভালো করে চেয়ে দেখলুম একটা মনুষ্যমূর্তি ওখানে প্রতিমূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা সাদা ধবধবে আলখাল্লার মতো লম্বা জামা প্রায় তার পা পর্যন্ত ঝুলে পড়েছে এবং রহস্যময় ছায়ার ভেতর থেকে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করে দিচ্ছিল জামার সেই শুভ্রতাই।
আর একটা জিনিস লক্ষ করলুম। তার দুটো অতি-উজ্জ্বল চক্ষু মাছের চোখের মতো নিষ্পলক এবং তাদের দৃষ্টি যেন বনজঙ্গলের বাধা পার হয়ে চলে গিয়েছে দূর-দূরান্তরে!
আমরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম প্রায় মিনিট খানেক। এই লোকটাই কি কথা কইছিল? শুনলুম তো বাংলা কথা, কিন্তু লোকটাকে তো বাঙালি বলে মনে হল না। বোধ হয় বিহারি। এখানকার অনেক লোক বাংলায় বেশ কথা কইতে পারে।
বাঙালি হোক, বিহারি হোক, এমন অসময়ে প্রায়-অন্ধকারের সঙ্গে গা মিলিয়ে এই বিজন বনে লোকটা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে কী করছে? এটা বেড়াবার বা বিশ্রাম করবার জায়গা নয় এবং তাকে শিকারি বলেও সন্দেহ হল না, কারণ সে নিরস্ত্র।
কিন্তু একটা ব্যাপার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে। তার সাদা আলখাল্লায় নানা জায়গায় মাটির ছাপ এবং তার হাত দু-খানার ওপরেও কাদামাটির পুরু প্রলেপ। কেশপাশ, গোঁফদাড়িও মাটির লেপন থেকে মুক্ত নয়।
তার দেহের উচ্চতা ছয় ফুটের কম হবে না। মাথায় অযত্নবিন্যস্ত তুলোর মতো সাদা লম্বা চুল এবং রাশিকৃত পাকা গোঁফদাড়ি তার মুখের অধিকাংশ ঢেকে বুকের তলা পর্যন্ত ছেয়ে ফেলেছে। বয়স বোধ করি ষাট পার হয়েছে, কিন্তু তার দেহ এখনও রীতিমতো ঋজু ও বলিষ্ঠ।
আমরা যে তিন-তিনটে মানুষ তীক্ষ্ণ ও সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, সেদিকে সে ভ্রূক্ষেপও করল না দেখে শেষটা আবার আমি প্রশ্ন করলুম, ‘মশাই, এই বন থেকে বেরুবার পথ কোনদিকে, বলতে পারেন?’
তবু তার ভাবান্তর নেই। সে ফিরেও তাকাল না। তার মুখ দিয়ে বাক্যস্ফূর্তিও হল না। তার চোখ দুটো আরও চকচক করে উঠল। কেবল নীরবে দক্ষিণ বাহু তুলে সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তার ডান দিকটা।
‘ধন্যবাদ মশাই, ধন্যবাদ! দয়া করে বলতে পারেন আমাদের আর কতটা পথ চলতে হবে?’
কোনো জবাব না দিয়েই মূর্তিটা সাঁৎ করে সরে গেল ঝোপের ভেতর চোখের আড়ালে এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা বন্যবরাহ সভয়ে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ রবে চিৎকার করে সেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে প্রাণপণ দৌড় মেরে পালিয়ে গেল।
আমি বিস্মিত স্বরে বললুম, ‘বুনো বরাহ হচ্ছে দারুণ হিংস্র জীব, সে পালিয়ে গেল কার ভয়ে?’
দীনেশ শিউরে বলে উঠল, ‘উঃ! কী ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করেছে!’
প্রমথ বলল, ‘হাওয়াটা আসছে ওই ঝোপের দিক থেকেই! কী আশ্চর্য, হাওয়াটা হঠাৎ এতটা কনকনে হল কেন?’
কেবল হাড়-কাঁপানো বরফের মতো ঠান্ডা হাওয়া নয়, সেইসঙ্গে আমি পেলুম স্যাঁৎসেঁতে কাঁচা মাটির গন্ধ! মনে জাগল কেমন অমঙ্গলের আশঙ্কা এবং অজানা বিভীষিকার ইঙ্গিত। এ কী অকারণে?
ঝোপের ভিতর দিকে আর একবার সন্দিগ্ধ দৃষ্টি চালনা করলুম। সেখানে তখন আসর পেতেছে রাত্রির অন্ধকার এবং সেই অন্ধকার ভেদ করে ফুটে উঠেছে দুটো নীলাভ দীপ্তি— ঠিক যেন কোনো হিংস্র জন্তুর ক্ষুধিত চক্ষু! ওটা কী জন্তু হতে পারে? ওকে দেখেই কি চম্পট দিলে বন্যবরাহটা? কিন্তু সেই অদ্ভুত বুড়োটা তো ওই ঝোপেই ঢুকেছে। তার কি প্রাণের ভয় নেই?
তার ভয় না থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের আছে। ওই দীপ্ত চক্ষু জন্তুটা যে আমাদেরই লক্ষ করছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলুম, ‘চলো চলো, ধরো ওই ডানদিকের পথ! এই অলক্ষুণে বন থেকে বেরিয়ে পড়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি!’
বনের মধ্যে তখন আলো-আঁধারির খেলা! কাছাকাছি চোখ চলে, কিন্তু দূরের দিকটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। কোথাও ছাড়া-ছাড়া ঝোপঝাপ, কোথাও দুর্ভেদ্য জঙ্গলের প্রাচীর, কোথাও খণ্ড খণ্ড জমি। একাধিক জায়গায় বৃষ্টিভেজা নরম মাটির ওপরে নজরে পড়ল সন্দেহজনক ভয়াবহ হিংস্র জন্তুর পদচিহ্ন। বলাবাহুল্য আমাদের চলার গতি বেড়ে উঠল।
ব্যাপারটা কিছুই বুঝলুম না, কিন্তু আচম্বিতে চারিদিকে যেন মহা তোলপাড় পড়ে গেল। আমাদের পিছন দিক থেকে বেগে ছুটে এল একদল হরিণ, একদল বন্যবরাহ, অনেকগুলো হায়েনা, শেয়াল, খরগোশ প্রভৃতি। তারা কেউ আমাদের প্রতি দৃকপাতও করলে না। বেশ বোঝা গেল, দারুণ আতঙ্কের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তারা পলায়ন করছে। তারপর বিদ্যুৎ চমকের মতো দেখা দিয়েই পালিয়ে মিলিয়ে গেল একটা চিতাবাঘও!
শুনেছি অরণ্যে দাবানল জ্বললে সব জানোয়ার এইভাবে একত্রে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু এখানে তো দাবানলের উৎপাত নেই, আছে কেবল ঘন ঘন বর্ষার ঝরন। তবে এতগুলো জানোয়ারের এমন বিষম আতঙ্কের কারণ কী?
আর একটা ব্যাপারও লক্ষ না-করে পারলুম না। বিহঙ্গদের দিবান্তকালের গানের জলসা সমানে চলতে চলতে আচমকা থেমে গেল। যেন কী এক অস্বাভাবিক বিপদের সম্ভাবনা হঠাৎ তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিলে, একটা পাখিও আর টুঁ শব্দ পর্যন্ত করলে না।
তারপরেই আমাদের পিছন থেকে বইতে শুরু করলে হু-হু করে একটা প্রবল ও তুষার শীতল হাওয়া—একটু আগেই ঝোপের কাছে পেয়েছিলুম যার অভাবিত ও অসহনীয় স্পর্শ!
হতবুদ্ধির মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে একবার পিছন দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বাধ্য হলুম।
দূরে আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে চলন্ত শ্বেতবর্ণের একটা কিছু।
আরও নিকটস্থ হলে বোঝা গেল, সেটা আলখাল্লার মতো একটা সাদা ধবধবে লম্বা ঢিলা জামা। জামার ওপর দিকে ঝোড়ো বাতাসের তোড়ে লটপট করে উড়ছে রাশি রাশি তুলোর মতো শুভ্র লম্বা মাথার চুল ও মুখের শ্মশ্রু, এবং সেই রাশিকৃত চুলের শুভ্রতার মাঝখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আশ্চর্য দুটো নীলাভ দীপ্তি!
বুঝতে বিলম্ব হল না লম্বা জামা পরে হন হন করে এদিকে এগিয়ে আসছে সে কোন দীপ্তচক্ষু মূর্তি! কিন্তু কেন এগিয়ে আসছে?
মূর্তি যত এগিয়ে আসে, হাওয়ার কনকনানি তত বেড়ে ওঠে। মনে হয় সর্বাঙ্গে যেন তুষারপাত হচ্ছে! তারপরেই চারিদিক ভরে যায় স্যাঁৎসেঁতে কাঁচা মাটির গন্ধে। সদ্য-খোঁড়া ভিজে মাটি।
কে ওই বলিষ্ঠ বুড়ো? ওকে দেখেই কি দারুণ ভয়ে হিংস্র জন্তুরা দলে দলে ছুটে পালিয়ে যায় এবং স্তব্ধ হয়ে যায় গীতকারি পাখিদের কণ্ঠস্বর? এবং বইতে থাকে তুহীন-শীতল হাওয়া?
কিন্তু কেন, কেন, কেন?
দুটো নীলাভ দীপ্তি—দুটো জ্বলন্ত চক্ষু! ক্রুর, হিংস্র, বুভুক্ষু! মাছের চোখের মতো নিষ্পলক!
সহসা এক অজানিত বিপুল আতঙ্কে আমার সারা দেহ-মন সমাচ্ছন্ন হয়ে গেল। পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলুম, ‘প্রমথ! দীনেশ! পালাও, পালাও, পালাও!’
অল্পক্ষণ পরেই বনের সীমানা পার হয়ে আমরা খোলা জায়গায় এসে পড়লুম। আকাশে আলোর চোখ মুদে এসেছে বটে, কিন্তু রাত্রির কালিমা ভালো করে তখনও জমে ওঠেনি— সে হচ্ছে দিবানিশির রহস্যময় সন্ধিক্ষণ।
খানিক দূরে পশ্চিম দিকে দেখা যাচ্ছে ছায়া-রং মাখা একটা প্রকাণ্ড পাহাড়ের স্তূপ।
প্রমথ সানন্দে বলে উঠল, ‘ওই যে জাফরগঞ্জের নবাববাড়ির ধ্বংসস্তূপ! চেনা জায়গার এত কাছে এসে পড়েও আমরা পথ হারিয়ে বনে বনে অন্ধের মতো ঘুরে মরছিলুম!’
নেই আর সেই বরফের মতো ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শ, নেই আর সেই সদ্য-খোঁড়া কাঁচা মাটির গন্ধ।
দীনেশ সবিস্ময়ে হাত তুলে বলে উঠল, ‘দেখো, দেখো—ও আবার কী?’
ধ্বংসাবশেষের বুরুজের ওপরে আকাশের গায়ে জেগে রয়েছে আলখাল্লা পরা একটা দীর্ঘায়ত মূর্তি—ঝোড়ো হাওয়ায় লটপট করে উড়ছে তার মাথার লম্বা চুলগুলো! দীপ্তোজ্জ্বল নীলাভ চক্ষুর অস্তিত্ব এত দূর থেকে বোঝা গেল না।
সমস্ত শুনে ডাকবাংলোর খানসামা বললে, ‘আগেই তো আপনাদের বেলা পড়ে এলে বনের ভেতরে থাকতে মানা করেছিলুম।’
আমি বললুম, ‘কিন্তু কিছুই তো তুমি খুলে বলোনি!’
খানসামা মৃদু হেসে বললে, ‘খুলে বললে আপনারা কি তখন আমার কথায় বিশ্বাস করতেন?’
‘তোমার কথাটা কী?’
‘হুজুর, আপনারা মুবারক খাঁয়ের পাল্লায় পড়েছিলেন।’
‘কে সে?’
‘জাফরগঞ্জের নবাবদের শেষ বংশধর। নবাবীত্ব ঘুচে গেছে তার পূর্বপুরুষদের আমলেই। নবাববাড়িও এখন ভেঙে-চুরে একটা ইটের পাঁজার মতো অনেকখানি জায়গা জুড়ে পড়ে রয়েছে। মুবারক খাঁয়ের পেশা ছিল খুন-ডাকাতি-রাহাজানি। শেষটা সে ধরা পড়ে আর বিচারে তার ফাঁসি হয়।’
‘ফাঁসি হয়? সে বেঁচে নেই?’
খানসামা বললে, ‘না হুজুর। কিন্তু নানাজনে নানা কথা বলে। সূর্য অস্ত গেলেই মুবারক নাকি নিজের হাতে কবরের মাটি খুঁড়ে রোজ বাইরে বেরিয়ে আসে। অনেকে নাকি সাঁঝের বেলায় বনের ভেতরে গিয়ে তাকে দেখে পালিয়ে এসেছে। আবার অনেকে নাকি পালিয়ে আসতে পারেনি, এমনকী তাদের লাশগুলো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
খানসামা আমাদের নৈশ ভোজের ব্যবস্থা করবার জন্যে বাংলোর ভেতরে চলে গেল। আমরা খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলুম।
তারপর দীনেশ হঠাৎ হো-হো রবে অট্টহাস্য করে বলে উঠল, ‘সব ঝুটা বাবা, সব ঝুটা! বনের ভিতরে গিয়ে আমরা পড়েছিলুম একটা পাগলের পাল্লায়!’
প্রমথ বললে, ‘আর সেই বরফের মতো ঠান্ডা হওয়ার ঝাপটা?’
‘সারাদিন ধরে ঝড়বৃষ্টি চলছে। মাঝে মাঝে কনকনে হাওয়ার প্রকোপ বেড়ে ওঠা একটুও অস্বাভাবিক নয়।’
‘কিন্তু সেই স্যাঁৎসেঁতে কাঁচা মাটির গন্ধ?’
‘বৃষ্টি পড়লেই মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ বেরুতে থাকে।’
‘কিন্তু কার ভয়ে জানোয়ারগুলো অমন করে পালিয়ে গেল?’
‘নিশ্চয়ই তারও কোনো সংগত কারণ আছে—আমরা যা জানি না।’
আমার মতামত উহ্য রইল।
—