2 of 2

ছায়াসঙ্গিনী – প্রণব রায়

ছায়াসঙ্গিনী – প্রণব রায়

প্রণব রায়ের এই গল্পটির একটু ইতিহাস আছে। মৃত্যুর মাস-পাঁচেক আগে, উনিশশো পঁচাত্তরের মার্চে, একদিন সকালে একটি নতুন টেপরেকর্ডার মেশিন নিয়ে হাজির হই তাঁর সামনে। অনুরোধ জানাই, ‘আপনার গলা টেপ করব—একটা কিছু বলুন।’

সেদিনই রেকর্ডিং হবে, এমন একখানি গান রচনায় তিনি তখন খুবই ব্যস্ত। তবু কাগজের পাতা থেকে মুখ তুলে তাঁর সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটি হেসে কৌতুকের সুরে বললেন, ‘আজ্ঞা করুন, কী বলতে হবে?’

বললাম, ‘একটা গল্প।’

আশ্চর্য হলেন তিনি ‘গল্প! সে যে অনেক সময় নেবে, বাবা। গান বলো, কবিতা বলো, দু-চার লাইন চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু গল্প তো ভাবতে হবে, সাজাতে হবে—।’

‘সে-সময় আপনাকে আমি দেব না।’ হাতঘড়িতে তাকিয়ে বললাম, ‘এখন দশটা তিন। আমি চাই দশটা পনেরোর মধ্যে টেপ শেষ করে চলে যেতে। নীচে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে এসেছি—।’

ঠোঁটের কোণে একটু হেসে মিনিটখানেক চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘নে, মেশিন চালু কর।’

মেশিন চালু হল। সেইসঙ্গে শুরু হল তাঁর গল্প বলাও। ঠিক যেন বই দেখে পড়ে যাচ্ছেন, এমনিভাবে গড়গড় করে তিনি চার মিনিট সাতাশ সেকেন্ডে শেষ করলেন তাঁর গল্প। গল্পাংশের জন্যে নয়, রচনাটি তাঁর বলার ভঙ্গি এবং সাবলীলতার জন্যে আমাদের কাছে একটি স্মরণীয় সম্পদ। বর্তমান সংখ্যায় টেপ-মেশিন থেকে আমরা হুবহু সেই রচনাটির অনুলিখন মুদ্রিত করলাম।

সম্পাদক, মাসিক রোমাঞ্চ

.

ছুটতে-ছুটতে ট্রেনখানার দম ফুরিয়ে গেল হঠাৎ।

জানলা দিয়ে দেখলাম, কোনও স্টেশন নয়, একটা আঘাটায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। উঁচু-নিচু জংলা মাঠ, ঝোপঝাড়, খানিক দূরে জঙ্গল। একসময়ে এ-লাইনে আসা-যাওয়া ছিল তাই চিনতে পারলাম। জায়গাটার নাম শিয়ালমারি মাঠ। এর একদিকে কাঁকনদীঘি গ্রাম, অন্য দিকে নয়নপুর।

ট্রেন থামল তো থামলই। গার্ডসাহেবের কাছে জানা গেল, লাইন ক্লিয়ার নেই। কখন ক্লিয়ার হবে, তারও ঠিক নেই। অতএব ঘুমের চেষ্টা করাই ভালো। আমার কামরায় আমি একা। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।

বাইরে শিয়ালমারি মাঠ নির্জন। চৈত্রের রাত নিথর নিঝুম।

তন্দ্রা আসব-আসব, এমনসময় খুট করে একটা শব্দ। চোখ খুলে দেখি, দরজা খুলে কামরায় উঠে আসছে—না, স্টেনগানধারী কোনও ছোকরা-ডাকাত নয়, অল্পবয়েসি একটি গ্রাম্য মেয়ে। জীবনে যাকে আর কখনও দেখতে পাব বলে স্বপ্নেও ভাবিনি।

মেয়েটি বললে, দেখছ কী? চিনতে পারছ না বুঝি?

আমার মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে এল, ঝুনু তুই!

যাক, তবু ভালো যে চিনতে পেরেছ!—খিলখিল করে হেসে উঠল ঝুনু।

স্মৃতি যেন হাজার বাতির ঝাড়। এক নিমেষে অন্ধকার অতীতকে আলোকিত করে। কাঁকনদীঘি গ্রামে ছিল আমার মামার বাড়ি। প্রত্যেক বছর সেখানে যেতাম। সেখানে আমার সঙ্গিনী ছিল পড়শিদের মেয়ে ঝুনু। সঙ্গিনী না বলে ছায়াসঙ্গিনী বলাই ভালো। সবসময় ঝুনু আমার পাশে-পাশে।

দুজনে একইসঙ্গে যৌবনে পা দিলাম, ভালোও বাসলাম। কিন্তু ওই পর্যন্ত! নাটক এগোল না, যবনিকা পড়ে গেল। সে-বছর মামার বাড়ি গিয়ে শুনলাম, অন্য পাত্রে ঝুনুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের রাত্রেই ঝুনু নিখোঁজ।

সে আজ এগারো বছর আগের কথা।

অবাক হয়ে বললাম, শুনেছিলাম, মাতলা নদীতে তুই নাকি ডুবে মরেছিস!

মুচকি হেসে ঝুনু বললে, তোমায় ছেড়ে মরেও কি শান্তি আছে আমার? নাও, ওঠো—চলো—।

কোথায়?

আমার ঘরে, আমার কাছে।

বললাম, না। এগারো বছর আগে যা সম্ভব ছিল, আজ আর তা হয় না, ঝুনু।

কেন হয় না, অরুণদা?—আশ্চর্য মধুর গলায় ঝুনু বলতে লাগল, তুমিও সেই অরুণ, আমিও সেই ঝুনু! এগারো বছর অপেক্ষা করছি। আমার বুক-ভরা অপূর্ণ সাধ আজ তুমি মিটিয়ে দাও। চলো আমার ঘরে—বলো যাবে?

ঝুনুর চোখে চোখ রেখে এক অদ্ভুত মোহ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। মনে হল, এ-মেয়ের হাত ধরে আজও চলে যাওয়া যায় স্বর্গ থেকে নরক অবধি। বললাম, যাব ঝুনু—যাব তোর সঙ্গে। বল, কোথায় তোর ঘর?

ওই জঙ্গলটার ঠিক পেছনে। এসো না, এসো।—খিলখিল করে হাসতে-হাসতে ঝুনু দরজা খুলে নেমে গেল।

কিন্তু তার জবাব শুনে হঠাৎ আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল, শিয়ালমারি মাঠের ওই জঙ্গলের পেছনে কোনও বসতি নেই, রয়েছে প্রকাণ্ড একটা শ্মশান! শ্মশানের কোলে মাতলা নদী।

বাইরে থেকে ঝুনুর ডাক শোনা গেল, এসো, অরুণদা, নেমে এসো—।

আবার সেই অদ্ভুত মোহ আমায় পেয়ে বসল। একটা দুর্বার আকর্ষণ আমাকে ঠেলে নিয়ে গেল দরজা অবধি।

হঠাৎ দপ করে নিভে গেল কামরার সব ক’টা বাতি। দূরে কোথায় কেঁদে উঠল একটা কুকুর। নামবার জন্যে আমি পাদানিতে পা রাখলাম, আর সেই মুহূর্তে—ঠিক সেই মুহূর্তে নড়ে উঠল কামরাটা। চলছে—ট্রেন আবার চলছে!

নামা আর হল না। শিয়ালমারি মাঠে দাঁড়িয়ে ঝুনু তখনও ডাকছে, এসো—এসো—আমার কাছে এসো—।

কিন্তু মরা চাঁদের আলোয় কাকে দেখলাম আমি? সে কি ঝুনুর মুখ? না একটা কঙ্কালের মুখ?

ভালো করে দেখার আগেই আমাকে নিয়ে ট্রেন চলে গেল অনেকটা দূরে।

মাসিক রোমাঞ্চ

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *