ছায়ার সঙ্গে – শেখর বসু
ট্রেনের বাথরুম থেকে ঘুরে এসে কুপের দরজা লক করে দিলাম। নীচের বার্থে অকাতরে ঘুমোচ্ছে নবেন্দু। ওপরের বার্থে আমি শোব। শোওয়ার কথা ভাবতেই রাজ্যের ক্লান্তি ভেঙে পড়ল সারা শরীরে।
কাল সারা রাত দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ডাক্তার বলেছিল, জেগে থাকবেন, সেবা-শুশ্রূষা করা দরকার। কিন্তু ওকে সেবা-শুশ্রূষা না বলে, পাহারাদারিই বলা উচিত। বিকারের ঘোরে নবেন্দু তিন-চারবার দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। কোনওরকমে আটকেছিলাম। শেষকালে ভেতর থেকে তালা দিতে হয়েছিল।
ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে নবেন্দু কথা বলছিল অনর্গল। কী বলছিল বুঝতে পারিনি, তবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, স্বপ্নে ও ওর খুব ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে গল্প করছিল।
আজ সারা দিনটা ও ভালোই ছিল, তবে আচ্ছন্ন ভাবটা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। ডাক্তার বলেছে, আর কোনও ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু ভয়ের কারণটা কেন দেখা দিয়েছিল? ডাক্তার শুধু এইটুকু বলেছে, কোনও একটা ব্যাপারে ও খুব শকড হয়েছে। কী সেটা!
এখন যা ভাবছি, কালকেও ঠিক তাই ভেবেছি—একবার নয়, অসংখ্যবার। তবে ভেবে কোনও কূলকিনারা পাইনি। অবশ্য দুশ্চিন্তার ভার কমেছে অনেকখানি। নবেন্দু এখন আগের চাইতে ভালো আছে। আর, এই রাতটা কাটলেই আমি দায়মুক্ত হয়ে যাব। সকালবেলায় হাওড়া স্টেশনে পৌঁছবে ট্রেনটা। তারপর ট্যাক্সি—আধঘণ্টার মধ্যে আমি ওর বাড়ি পৌঁছে যাব।
ঘড়ি দেখলাম। এগারোটা দশ। ট্রেনের মধ্যে এগারোটা দশ কম না বেশি রাত্তির! ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। চলন্ত ট্রেনে রাত বোধহয় আলাদা কোনও নিয়মে বাড়ে। হুড়মুড় করে ট্রেন ছুটছে, জানলার বাইরে চাঁদনি রাতের মাঠ, গাছ আর জঙ্গল। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে দুলতে-দুলতে ঘুমোচ্ছে নবেন্দু। ওর স্বাভাবিক ঘুমন্ত মুখটা একবার দেখে নিয়ে আমি আপার বার্থে উঠে পড়লাম। বড় আলোটা নিবিয়ে ছোট নীল আলোটা জ্বাললাম, তারপর শুয়ে পড়লাম টানটান হয়ে।
একটানা বসে-বসে কোমর-পিঠে বেশ ব্যথা হয়ে গেছে। মাথাটা ভার-ভার। সারা শরীর ঠেলে বিরাট-বিরাট দুটো হাই উঠে এল। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ার সমস্ত চিহ্ন আমার শরীরে, কিন্তু ঘুম আসছে না কিছুতেই। যা-যা ভাবব না বলে একটু আগেই প্রতিজ্ঞা করেছি, ঠিক সেই-সেই চিন্তাগুলো মাথার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত। চিন্তা তাড়াবার জন্যে আমি পাশ ফিরে শুলাম।
ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, কিন্তু খটখট শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল একসময়। আচমকা ঘুম ভাঙার জন্যে কিছুই বুঝতে পারলাম না প্রথমে। এমনকী, আমি যে বাড়িতে নয়, ট্রেনে ঘুমোচ্ছি—এটা বুঝতেই লেগে গেল কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই একসঙ্গে মনে পড়ে গেল সব কথা। আমি লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। মৃদু নীলচে আলোয় দেখলাম, নবেন্দু হাতড়ে-হাতড়ে কুপের দরজা খোলার চেষ্টা করছে। শব্দ উঠছে খট-খট-খটাস।
হাত বাড়িয়ে বড় আলোটা জ্বেলে দিলাম। আলো জ্বলতেই নবেন্দু ঘুরে তাকাল। কিন্তু দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়, কেমন যেন ঘোর লাগা। আগের রাতেও ওর ঠিক এইরকম চাউনি দেখেছিলাম। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘নবেন্দু, নব—!’
নবেন্দু চাইল আমার দিকে, কিন্তু ও আমাকে চিনতে পেরেছে বলে মনে হল না।
‘বাইরে যাবি? বাথরুম?’
নবেন্দু আমার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতে লাগল আগের মতো। চেষ্টার মধ্যে কোনও স্বাভাবিকতা ছিল না—দরজার ওপরের লকটা ও এলোপাতাড়িভাবে টানাটানি করছিল।
কাছে গিয়ে ওর কাঁধের ওপর হাত রেখে বললাম, ‘কী রে!’
বলার সঙ্গে-সঙ্গে ও চমকে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। দৃষ্টি আগের মতোই আচ্ছন্ন। মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভাঙার একটু পরে চোখের সামনে এইরকম ঘোলাটে দৃষ্টি দেখে আমি কেমন যেন ঘাবড়ে গেলাম। আর, সেইজন্যেই বোধহয় ওর দুটো কাঁধ খামচে ধরে প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বললাম, ‘কী রে! কী হল তোর?’
ঝাঁকুনি খেতে-খেতে নবেন্দুর ঘোলাটে মণির ওপর চোখের পাতা নেমে এল—তারপর ওর মাথাটা এলিয়ে পড়ল আস্তে-আস্তে।
আমি ওকে ধরে-ধরে বেঞ্চের ওপর হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলাম। ওর মাথাটা কাঁধের ওপর ঝুঁকে আছে। ওর হাত আমার হাতের মধ্যে। কী করব এবার!
ট্রেন আগের মতোই প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলেছে। জানলার বাইরে আগের মতোই দৃশ্য, তবে চাঁদের আলোর রং পালটে গেছে। ঘড়িটা খুলে রেখেছি আপার বার্থে। এখন কত রাত কে জানে! জানলা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া আসছে, মাথার ওপর ফুল স্পিডে পাখা খোলা, কিন্তু ঘামে সারা শরীর ভিজে গিয়েছিল। নবেন্দুর হাতও ভেজা-ভেজা, ও বোধহয় আমার চাইতেও বেশি ঘেমেছে। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ বসে থাকার পরে বললাম, ‘নবেন্দু, জল খাবি? জল?’
একই কথা আবার বললাম, তবে এবার বেশ জোরে, আর ওর হাতটা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে। নবেন্দু যেন বহুদূর থেকে উত্তর দিল, ‘হুঁ।’
আমি ওয়াটার বটল থেকে একগ্লাস জল ভরে ওর হাতে দিলাম। নবেন্দু চোঁ-চোঁ করে পুরো গ্লাসের জলটা খেয়ে নিল। ওকে জল খেতে দেখে আমি বেশ আশ্বস্ত হয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কফি খাবি?’
নবেন্দু এবার স্পষ্ট গলায় উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
ফ্লাস্ক থেকে দু-কাপ কফি ঢাললাম। এককাপ ওকে দিয়ে আর-এককাপ নিজে নিলাম। শান্ত, গম্ভীর মুখে কাপে কয়েকটা চুমুক দেওয়ার পরে নবেন্দু খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগল আমাকে। তারপর ও কেমন যেন চমকে গিয়ে জিগ্যেস করল, ‘আরে, তুই! তুই কবে এলি?’
ওর দৃষ্টি দেখে আমার বেশ অস্বস্তি হতে শুরু হয়েছিল, কিন্তু প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলে বললাম, ‘একেই বলে সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে…। আরে বাবা, দু-দিন ধরে তোর সেবা-শুশ্রূষা করলাম, তুই আমার সঙ্গে বেশ কয়েকটা কথাও বলেছিস, আর এখন কিনা জিগ্যেস করছিস, তুই কবে এলি!’
কথাগুলো শুনে নবেন্দুর কপালে ভাঁজ পড়ল অনেকগুলো! ওর চোখ-মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, ও পেছনের কথা ভাবছে।
আমি ওকে খেই ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে বললাম, ‘আমার বাড়িতে তোর অফিসের সেনগুপ্ত টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল—নবেন্দু ভীষণ অসুস্থ, শীগগির চলে আসুন। আমি এসে দেখলাম, তুই জ্বরে পড়েছিস। একটু সুস্থ হতেই ডাক্তারের পরামর্শে তোকে তোর বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। এবার মনে পড়েছে?’
মনে হল না, নবেন্দু সব কথা মনে করতে পেরেছে। ও শুধু অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘বাড়ি যাচ্ছি? কেন?’
‘কেন আবার, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে শরীরটা ঠিকঠাক করে নিবি। তা ছাড়া, বাড়িতেও তো যাসনি বহুকাল, তা প্রায় বছরতিনেক হবে। একা-একা এভাবে পাহাড়ের মাথায় পড়ে থাকতে ভালো লাগে?’
‘একা? একা কোথায়! আমি তো একা থাকি না।’ নবেন্দু কেমন যেন অস্বাভাবিক চোখ-মুখ করে প্রতিবাদ করল।
আমি একটা বদ রসিকতা করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ওর চোখ-মুখের চেহারা দেখে সাহস পেলাম না। মিনমিন করে বললাম, ‘একা না? তুই কি লুকিয়ে-লুকিয়ে বিয়ে করেছিস?’
নবেন্দুর অস্বাভাবিক মুখে হাসির রেখা খেলে গেল ‘না, বিয়ে করিনি, তবে ও সবসময় আমার সঙ্গে থাকে, সবসময়। এই তো একটু আগেই ও আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে চাইছিল, বন্ধ জায়গায় ওর থাকতে ভালো লাগে না।’
আমি অবাক হয়ে নবেন্দুর দিকে তাকালাম। ওর প্রত্যেকটি কথাই আমার কাছে কেমন যেন ধোঁয়াটে ঠেকল।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পরে নবেন্দু বলল, ‘সিগারেট আছে?’
আমি প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম। ও একটা সিগারেট ধরাল, আমিও ধরালাম। নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে নবেন্দু বলল, ‘আলোটা নিবিয়ে দিবি? চোখে লাগছে।’
বড় আলোটা নিবিয়ে দিলাম। নীল আলো জ্বলছে, কিন্তু ওটা থাকা না-থাকা সমান। কাচের ঘেরাটোপটা শুধু নীল হয়ে আছে। জানলা দিয়ে চাঁদের আলো খাপছাড়াভাবে এসে পড়েছে বেঞ্চ আর মেঝের ওপর। ট্রেনের নির্দিষ্ট তালের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ কোথাও নেই। এখন কত রাত কে জানে!
অস্বস্তিকর রকমের চুপচাপ হয়ে বসে আছি আমরা দুজনেই। সিগারেটের দুটো জ্বলন্ত বিন্দু মাঝে-মধ্যে জোরালো হয়ে উঠছে। ঘুম, ক্লান্তির কোনও চিহ্ন নেই আমার শরীরে। বারবার মনে হচ্ছিল, বিচিত্র এক অভিজ্ঞতার সামনে এক্ষুনি পড়তে হবে আমাকে।
নবেন্দু হঠাৎ চাপা গলায় কী যেন বলল। বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করলাম, ‘কী বলছিস?’
ও কোনও উত্তর দিল না। তারপর কিছুক্ষণ বাদে ও হেসে উঠল, কারও রসিকতা শুনে হেসে ফেলার মতো হাসি। আমি চমকে উঠে বললাম, ‘হাসছিস কেন?’
নবেন্দু এবারও কোনও জবাব দিল না। কয়েক মুহূর্ত পরে ও আবার নিচু গলায় কী যেন বলল। আমি প্রশ্ন করতে গিয়েও করতে পারলাম না। কেন জানি না, আমার মনে হল, ও আমি নয়, আর কারও সঙ্গে কথা বলছে। কিন্তু আমি ছাড়া তো এই কুপেতে আর কেউ নেই! আর, এটা মনে হতেই আমার গা-শিরশির করে উঠল। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘নবেন্দু, কী বলছিস কী? তোর ব্যাপারটা কী বল তো? শরীর খারাপ লাগছে?’
নবেন্দু হেসে উঠল। মনে হল, এ-হাসিটা আমার কথা শুনে। কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। একটু থেমে ও থমথমে গলায় বলল, ‘তোর কাছে পুরো ব্যাপারটাই উদ্ভট লাগছে, তাই না? অবশ্য লাগাটাই স্বাভাবিক। তবে, আমার কাছে নয়। আমার কাছে তুই যতটা সত্যি, ও-ও ততটা। কে বিশ্বাস করল, না-করল—আমার কিছু এসে যায় না। তুই যদি শুনতে চাস, আমি বলতে পারি।’
আমি শুনতে চাই, কিন্তু ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়ে আমার মুখ দিয়ে বিচিত্র একটা শব্দ বেরোল।
আবছা অন্ধকারের মধ্যে চুপচাপ কিছুক্ষণ সিগারেট টানার পরে নবেন্দু বলল, ‘পাহাড়ে চাকরি নিয়ে যাওয়ার পরে প্রথম-প্রথম খুব খারাপ লাগত। অসম্ভব নির্জন জায়গা, তারপর আমার কোয়ার্টার্স এমনই জায়গায়, যার আশেপাশে আর কোনও বাড়িঘর নেই। অফিসের কাজকর্মের অবস্থাও সেইরকম, সারা সপ্তাহে দু-ঘণ্টা কাজ করলেই যথেষ্ট। প্রায়ই মনে হত, চাকরি-বাকরি ছেড়ে চলে আসি, এভাবে থাকলে বোধহয় পাগল হয়ে যাব। কিন্তু নির্জনতার একটা অদ্ভুত টান আছে। কীরকম নির্জনতা জানিস—?’
আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘তোর তখনকার একটা চিঠির কথা আমার মনে আছে। রাত্রে গরম কফিতে চিনি মেশাবার পরে চমকে উঠতিস প্রথম-প্রথম। এত নির্জন এলাকা যে, কফিতে চিনি গুলবার শব্দ পর্যন্ত উঠত।’
নবেন্দু ওর চিঠি নিয়ে একটুও আগ্রহ না দেখিয়ে বলল, ‘ঠিক এইসময় একটা বই এসে গেল আমার হাতে। বইটার নাম ”ডকটিন অব দ্য মিস্টিকস”। অদ্ভুত ইন্টারেস্টিং বই। ওই নির্জন পাহাড়ের পরিবেশে বইটা আমার ওপর দারুণ প্রভাব ফেলল। আমি লক্ষ্নৌ থেকে এই ধরনের আরও বই আনালাম। তারপর দিনরাত ডুবে থাকলাম বইগুলোর মধ্যে। একটা বইতে অশরীরীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার বিচিত্র সব সাধনপদ্ধতির উল্লেখ আছে। আমি সেগুলোর চর্চা আরম্ভ করে দিলাম। প্রথমেই মনঃসংযোগ। মনঃসংযোগ করার অদ্ভুত একটা কায়দা আছে—কীরকম জানিস—?’
কেন জানি না আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল, ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘বড় আলোটা জ্বালব?’
‘না।’ নবেন্দু গম্ভীরভাবে উত্তর দিল। তারপর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, ‘সাধনার অনেকগুলো স্টেজ আছে। মনে হল, এখন আমি অনেকখানি তৈরি, এবার আমার পরীক্ষা করা দরকার।’
‘কী পরীক্ষা?’ আমার গলার স্বর আমার কাছেই কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত ঠেকল।
নবেন্দু বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বলল, ‘আত্মার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা।’
আমার হঠাৎ মনে হল, গলার ভেতরটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। একটু কফি খেতে পারলে হত! ফ্লাস্কটা ব্র্যাকেটে দুলছে, কিন্তু উঠে গিয়ে নামিয়ে আনতে পারলাম না। আমার শরীরের ওপর আমার যেন পুরোপুরি দখল নেই। চাঁদের ওপর দিয়ে বোধহয় মেঘ ভেসে যাচ্ছে, আবছা আলোছায়া দুলছে কুপের ভেতর। হুড়মুড় করে ছুটে-যাওয়া ট্রেনটা থেকে-থেকে কেমন যেন নিঃশব্দ হয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি তাই…নাকি…!
নবেন্দু খুকখুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘মাঝরাত, কেউ কোথাও নেই, চারদিক অসম্ভব নির্জন। আমি মনঃসংযোগ করে পরীক্ষায় বসলাম। একটু পরেই জানলা কাঁপিয়ে ঝোড়ো হাওয়া ঢুকে ঘরের মোমবাতিটা নিবিয়ে দিল। বুঝলাম, কেউ এসেছে। কিন্তু কে সে? জিগ্যেস করলাম, কোনও উত্তর পেলাম না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে সে তার উপস্থিতি আমাকে টের পাইয়ে দিচ্ছিল।’
জোর করে হেসে বললাম, ‘কী উলটোপালটা বকছিস?’
নবেন্দু আমার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলল, ‘একটুও উলটোপালটা নয়, যা বলছি সত্যি কথা বলছি।’
আবছা অন্ধকারের মধ্যে নবেন্দুর চোখের মণি দুটো অদ্ভুতভাবে জ্বলছিল। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম।
নবেন্দু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অশরীরিণী ওই মেয়েটিকে আমি কিন্তু ডাকিনি, ও নিজে থেকে এসেছিল। এসেছিল আমার ক্ষতি করতে, কিন্তু করেনি। পরদিন এল, তার পরের দিনও এল। তারপর থেকে ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ও আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যায় না। সবসময় থাকে আমার মনে। এখনও আছে।’
‘নবেন্দু!’ আমি কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠলাম।
ও অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে মৃদু হেসে বলল, ‘এই তো আমার পাশেই বসে আছে, আলাপ কর না, ভালো লাগবে।’
নবেন্দু বেঞ্চের একধারে বসে আছে। ওর আর আমার মধ্যে একহাত শূন্য জায়গা। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ নেই সেখানে। শূন্য জায়গায় আবছা অন্ধকার। কেউ নেই জেনেও আমি কেমন যেন নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম ওই শূন্য স্থানটা। এমনসময় জানলা দিয়ে একতাল অন্ধকার লাফিয়ে ঢুকল ঘরের মধ্যে। আঁতকে উঠলাম। অন্ধকারটা কুপের মধ্যে ঘুরতে-ঘুরতে আমার আর নবেন্দুর ভেতরের ফাঁকা জায়গায় জমাট হয়ে গেল। আমি প্রাণপণ ভাববার চেষ্টা করলাম, চাঁদের ওপর দিয়ে নির্ঘাত কালো মেঘের টুকরো ভেসে যাচ্ছে।
কিন্তু নবেন্দু নিচু গলায় কার সঙ্গে গল্প করছে?
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৭৯