ছায়াময়

ছায়াময়

শেষ ভাদ্রের প্রভাতকাল শীতলতার আভাসে বড় মনোরম; ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর সিক্ত ঘ্রাণ, বাগানের এককোনে পারিজাত পুষ্পের বৃক্ষ ও তার বেদীমূল ছেয়ে থাকা ফুলের আস্তরণ কেমন যেন মায়া জাগায়; আসন্ন নবান্ন উৎসবের প্রাক্কালে এযেন প্রকৃতিদেবীর বিশেষ সজ্জা। দিবাভাগের প্রথম প্রহর, চারপাশের প্রকৃতি এখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন, যদিও বর্ধিষ্ণু গৃহটির গোশাল ইতিমধ্যেই কর্মচঞ্চল; গৃহসেবক ভূজঙ্গ সেখানে দুগ্ধ দোহনে ব্যস্ত। গৃহের পিছনভাগের যে অঙ্গন, তার এককোণে তুলসীমণ্ডপ, আর তার পাশে পাকশাল ও জলের কূপ; গৃহসংলগ্ন অলিন্দের একপাশে স্নান ও শৌচাগার। অঙ্গনের শেষে গৃহের পিছনভাগের সরু চলার পথ, সেখানে একটি বাঁশের দরজা মূলতঃ শৌচকর্মীদের যাতায়াতের জন্য নির্মিত। দ্বারের থেকে কিছুটা দূরত্বে অঙ্গনের দুইপাশে দুটি মাটির কুটির; ডানপাশের কুটিরটির পাশে গোশালা ও অশ্ব রাখার ছাউনি, এই কুটিরটি ভূজঙ্গের বাসস্থল। দ্বারের বামপাশের কুটিরটিতে থাকে চঞ্চলা, সে গৃহের একাধারে রাঁধুনি ও দাসী।

চঞ্চলা সুশ্রী ও বয়সে নবীনা, এই প্রভাতকালেও তার সাজ পোশাকে বিশেষ যত্নের ছাপ স্পষ্ট; সে নিজের কক্ষ থেকে দ্রুত মূল গৃহের দিকে যেতে যেতে, একবার কক্ষদ্বারের পানে চেয়ে দেখে, বিগত রজনীর কোনও মধুর স্মৃতিতে রক্তিমাভা দেখা দেয় তার দুই গালে। কবিরা বসন্তকে বলে থাকেন মধুমাস; কিন্তু ভাদরের নীরব আকিঞ্চন, সুন্দরী যুবতীর কাছে সেও কিছু কম মধুর নয়।

পাটলীপুত্রের এক সম্পন্ন পল্লীর নিভৃত পরিবেশে অবস্থিত গৃহটি শ্রেষ্ঠী বসুদত্তের, ফলের বাগান ঘেরা এই বসতবাটি অন্যান্য গৃহের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। মূলভবনটি কাঠের এবং দুইতলবিশিষ্ট; নীচের তলে সমুখের প্রবেশদ্বারের সংলগ্ন একটি বহির্কক্ষ এবং তার পাশে একটি বিশ্রামকক্ষ ও অতিথিশালা। এই তিনটি কক্ষই পিছনের অলিন্দের সাথে যুক্ত। দ্বিতলে দুটি শয়নকক্ষ যার একটিকে গৃহিনী নিজস্ব বিশ্রাম কক্ষ হিসাবে ব্যবহার করেন, সাথে একটি পূজাকক্ষ, সেখানে শ্রী জনার্দন নিত্যপূজা পান; দ্বিতলের সিঁড়ি অলিন্দ সংলগ্ন। গৃহটি আয়তনে বৃহৎ নাহলেও নিঃসন্তান দম্পতির একাকী সংসারের পক্ষে যথেষ্ট। বসুদত্ত মসলা ও গন্ধদ্রব্যের কারবারি, সুদূর প্রাচ্য থেকে সংগৃহিত উত্তম এলা, লবঙ্গ, দারুচিনি, গন্ধমরিচ, তার সাথে অগুরু, ও ধুনক ভৃগুকচ্ছ হয়ে সরবরাহ করেন সুদুর রোমক সাম্রাজ্যে। জলপথ যাত্রা ও বিদেশ ভ্রমণ তাঁর ব্যবসায়ের অঙ্গ; একাজে দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি ঘটে নগরী থেকে, কখনও তিনমাসকাল, কখনও বা তারও বেশী। বসুদত্ত মধ্যবয়স্ক বিষয়ী মানুষ, তবে তাঁর স্ত্রী শ্রীজয়া যুবতী ও সুন্দরী; এটি শ্রেষ্ঠীর দ্বিতীয়পক্ষ। প্রথম স্ত্রী গত হয়েছিলেন যৌবনকালেই, আর তার কিছুদিন পরে মৃত্যু হয় তাঁর পিতারও। সেই থেকে নিজেকে ব্যবসায়ে সঁপে দিয়ে মানুষ করেছিলেন দুটি ভগ্নী ও এক কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে। ভগিনীদের বিবাহ, ভ্রাতা সুদত্তকে ব্যবসায়ে সামিল করা এসবই করেছিলেন তিনি একে একে, এর মাঝে আর বিবাহের চিন্তা মাথায় আসেনি। বিবাহ না করলেও, শোনা যায় একটি উপপত্নী ছিল তাঁর গণিকা পল্লীতে, তবে সেসব বেশ কিছুকাল আগের কথা। সুদত্ত স্বাবলম্বী হতে, তার বিবাহ হয় নগরীর এক সম্ভ্রান্ত গৃহে; স্বামীর বিদেশযাত্রায় সুদত্তর স্ত্রী উপলার আপত্তি দেখা দেয়, ফলে ভ্রাতার থেকে পৃথক হয়ে নগরীতে নিজস্ব গন্ধদ্রব্যের বিপনি প্রতিষ্ঠা করেন সুদত্ত। ততদিনে, মাতারও মৃত্যু ঘটেছে। তিন বৎসর পূর্বে বসুদত্ত প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে, পুনরায় বিবাহ করেন; শোনা যায় মদন মহোৎসবে গঙ্গাতীরে উপাসনারতা শ্রীজয়াকে দেখে তিনি মুগ্ধ হন। শ্রীজয়া অনাথা বিধবার একমাত্র সন্তান, অর্থকৌলিন্যের অভাব পুরন করেছিল তার আলো করা রূপ। কিন্তু এ বিবাহে, পরিবার, বিশেষতঃ সুদত্তের শ্বশুরকুল বিশেষ অসন্তুষ্ট ছিলেন। উপলার বিরূপমনভাব লক্ষ্য করে, কিছুদিনের মধ্যে পৈতৃক গৃহের পাশের বাগানসহ জমিতে নিজস্ব গৃহ তৈরী করে পৃথক হন বসুদত্ত। এর ফলে, সম্পর্কের তিক্ততা দূর হয়ে শান্তি ফেরে, শ্রীজয়াও নিজস্ব সংসার পেয়ে সুখী হয়।

গৃহস্বামী বিগত তিনমাসকাল যাবৎ ব্যবসায় কার্যে গৃহের বাহিরে আছেন, গতকাল দুপুরে সংবাদ এসেছে, তাঁর দুখানি পণ্যতরণী বন্দরে ফিরেছে, সাথে শ্রেষ্ঠীও আছেন। বন্দরের কাজ মিটিয়ে আজ কালের মধ্যেই গৃহে ফিরবেন তিনি। আজকের দিনে সেকারণে চঞ্চলা অতিপ্রত্যুষেই কর্ত্রীকে জাগিয়ে তাঁর স্নানের ব্যবস্থা করতে মূলগৃহে চলেছে; শ্রেষ্ঠীর আবির্ভাবের আশায় বিশেষ ব্যঞ্জনের আয়োজন হবে অবশ্যই, সেবিষয়েও কর্ত্রীর নির্দেশ নেওয়া প্রয়োজন। চঞ্চলা দ্রুত পায়ে অলিন্দ পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরের শয়নকক্ষে পা বাড়ায়। দ্বিতলেও নীচতলের মতই কক্ষ সংলগ্ন একটি অলিন্দ আছে, শয়নকক্ষের দ্বার আবছা ভেজানো দেখে চঞ্চলা অপ্রস্তুত বোধ করে; স্বামিনী তার আসার পূর্বেই উঠে পড়েছেন নিশ্চয়। দীর্ঘ বিরহের অন্তে তরুণী স্ত্রীর উৎকন্ঠা মনে মনে অনুভব করে সে তার নারী হৃদয়ে।

দরজায় মৃদু করাঘাত করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় চঞ্চলা, কক্ষ থেকে আওয়াজ আসে না কোনও, কয়েক মূহুর্ত অপেক্ষা করে ভিতরে প্রবেশ করে সে।

দেওয়ালের পাশ ঘেঁষে রাখা সুদৃশ্য পালঙ্কটি শূন্য; কক্ষের অন্য পাশে খোলা মেঝেতে পড়ে আছে শ্রীজয়ার রক্তাক্ত দেহ, বিস্রস্ত তার কেশ বেশ, কিছু দূরে উল্টে পড়ে আছে একটি চন্দনকাষ্ঠের কারুকার্যমণ্ডিত পীঠক, ও আরো কয়েকটি ছোটখাটো আসবাব। এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে হাহাকার করে ওঠে চঞ্চলা বুদ্ধিভ্রষ্টের মত, তার আর্ত চিৎকারে সচকিত হয় নিস্তব্ধ পরিবেশ। সম্বিৎ ফিরে পেতে অলিন্দে বেরিয়ে ভূজঙ্গের নাম ধরে ডাকতে থাকে সে বারম্বার। ভূজঙ্গ দৌড়ে আসে দুর্ঘটনাস্থলে, কর্ত্রীর দেহের সমুখে গিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করে তিনি জীবিত কিনা; আপাত নিথর দেহতে প্রাণের স্পর্শ লক্ষিত হয়না। চঞ্চলাকে নাড়িস্পন্দন অনুভব করতে অনুরোধ করে ভূজঙ্গ, একটু ইতস্তত করে এগিয়ে যায় চঞ্চলা, শ্রীজয়া একখানি হাত নিজ হাতে নিয়ে ছিটকে পিছিয়ে যায় সে। কর্ত্রীর দেহ বরফের মত শীতল, তাঁর মৃত্যু ঘটেছে বেশকিছু সময় পূর্বেই।

‘আমি প্রভু সুদত্তকে ডেকে আনছি, তুমি কক্ষত্যাগ কোরনা চঞ্চলা’, ভূজঙ্গ পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়।

চঞ্চলা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেনে নেয় তার নির্দেশ, অপঘাত হলেও গৃহস্বামিনীর মৃতদেহ পরিত্যাগ করে যাওয়া চলেনা এই অবস্থায়।

অল্পক্ষণের মধ্যেই সুদত্ত ছুটে আসেন ভূজঙ্গের সাথে, ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব দেখায় তাঁকেও। ভাতৃবধূর এই করুণ পরিণতি কল্পনারও অতীত, অসীম মমতায় তার নিথর দেহটিকে ছুঁয়ে দেখেন সুদত্ত, বুঝিবা সামান্য প্রাণস্পন্দনের আশায়; দুচোখ বেয়ে নেমে আসা নীরব অশ্রু গোপন করতে চেষ্টা করেননা তিনি। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুকাল, ক্রমে নিজেকে সামলে নেন সুদত্ত, একখানি বস্ত্র দিয়ে শবটি ঢেকে দেন তিনি পরম যত্নে; অস্বাভাবিক মৃত্যু, গৃহস্বামী অনুপস্থিত, এক্ষেত্রে তাঁকেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। ভূজঙ্গকে পাটলীপুত্রের মহাদণ্ডনায়কের কার্যালয়ে পাঠান তিনি, চঞ্চলার চিৎকারে ইতিমধ্যেই দুএকটি পথচারী এসে ভীড় করেছে, সুদত্তের গৃহের দাস দাসীও উপস্থিত হয় সেইসঙ্গে।

এত প্রত্যুষে কার্যালয় তখনও সচল হয়নি, কয়েকজন প্রহরী ভিন্ন কেউ নেই সেখানে, তবু ভূজঙ্গের বক্তব্য শুনে তাদেরই একজন আধিকারিক ধর্মদাসকে সংবাদ দেয়। একে হত্যা, তায় সম্পন্ন ঘরের গৃহবধূ, ধর্মদাস কয়েকজন প্রহরীসহ তৎক্ষনাৎ রওয়ানা দেন ঘটনার তদন্তে।

‘কক্ষের দ্বার খোলা ছিল যখন মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়?’ ধর্মদাস ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণের পশ্চাতে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন সুদত্তকে।

‘চঞ্চলা যখন দ্বিতলে আসে, কক্ষের দ্বার আবছা ভেজানো ছিল।’

‘আর গৃহের মূল দরজা, সেও কি খোলা ছিল সেসময়ে?’

এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। চঞ্চলা জানায়, অঙ্গন থেকে দ্বিতলে আসতে সমুখ দ্বারের প্রয়োজন হয়না, ফলে সে এ ব্যাপারে কিছু জানেনা। এরপর ভূজঙ্গকে জিজ্ঞাসা করা হলে তাকে বিভ্রান্ত দেখায়, সে বিলক্ষণ সমুখের দরজা দিয়েই সদত্তকে ডাকতে গিয়েছিল, কিন্তু গোলমালে মনে করতে পারেনা সেটি উন্মুক্ত ছিল, না সে নিজে হাতে অর্গল মুক্ত করেছে।

‘গৃহিনী কি শয়নকালে আভরণ খুলে রাখতেন, তাঁর দেহে কোনও গহনা দেখছি না?’ ধর্মদাসের এ প্রশ্নটি চঞ্চলার উদ্দেশ্যে।

চঞ্চলা জানায়, গৃহিনী গহনায় বিশেষ আসক্ত ছিলেন, কখনওই নিরাভরণ থাকতেন না।

‘মনে হচ্ছে তস্করের কাজ, গহনার লোভেই এ হত্যা, মৃতার স্বামীকে সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করুন, আমি আধিকারিক চিত্রককে সংবাদ পাঠাচ্ছি, তিনি এসে শব পরীক্ষা করবেন’, ধর্মদাস জানান সুদত্তকে।

‘শব পরীক্ষা, সৎকার হবে না?’ হাহাকার করে ওঠেন সুদত্ত।

‘যত শীঘ্র সম্ভব পরীক্ষাকার্য সম্পন্ন করা হবে, নিশ্চিন্ত থাকুন ভদ্র। ততক্ষণে মৃতার স্বামীকে আনার ব্যবস্থা করুন; দাহকার্যে কোনও বাধাসৃষ্টি হবেনা।’ ধর্মদাস বিষবিজ্ঞান ও শরীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞ প্রবীণ আধিকারিক চিত্রককে সংবাদ পাঠান প্রহরীর মাধ্যমে।

***

বন্দর এলাকায় শ্রেষ্ঠী বসুদত্তের সুবিশাল ভাণ্ডার গৃহ, আর তার সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র অতিথিশালা; মূলতঃ শ্রেষ্ঠীর নিজের রাত্রিবাসের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়, তবে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যবসায়ের কার্যে আগত বণিকদেরও আতিথ্যের বন্দোবস্ত হয় সেখানে। গতকাল তরণীদুটির সাথে বসুদত্তও পাটলীপুত্রে ফিরেছেন সুদূর ভৃগুকচ্ছ থেকে, শুল্ক মিটিয়ে পণ্য ভাণ্ডারভুক্তীকরণ সময়সাপেক্ষ কাজ, অথচ এ কাজে নিজের তত্ত্বাবধান জরুরী; সেকারণে গৃহে পৌঁছ সংবাদ পাঠিয়ে অতিথিশালাতেই রাত্রিবাস করেন শ্রেষ্ঠী, আজ মধ্যাহ্নের পূর্বেই গৃহে ফিরবেন এরূপ ইচ্ছা ছিল তাঁর।

তিনি প্রাতঃরাশ সমাধা করে ভাণ্ডারের হিসাব বহি পরীক্ষা করছিলেন নিজস্ব কার্যালয়ে, প্রবীন কর্মচারী বিটঙ্ক তাঁকে সহায়তা করছিলেন এ কার্যে। ভাণ্ডারের আর এক কর্মী ঋভু উত্তেজিত হয়ে ছুটে আসে এসময়, সে ভাণ্ডারের কাজ ছাড়াও, অতিথিশালা দেখা শোনা ও অতিথিসেবার দায়িত্ব পালন করে থাকে। ভূজঙ্গ অতিথিশালায় এসে প্রভুকে না পেয়ে তার কাছেই গৃহঘটিত দুঃসংবাদটি দেয়।

‘প্রভু, ভূজঙ্গ এসেছে, আপনাকে গৃহে নিয়ে যেতে চায় সে এখনি’, ঋভু জানায়।

‘এখন কিরূপে সম্ভব! ভূজঙ্গ কোথায়?’ বসুদত্ত বিস্মিত বোধ করেন। ভূজঙ্গ দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষায় ছিল, ভিতরে এসে সবিস্তারে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সে। স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননা শ্রেষ্ঠী বেশ কিছু সময়। এ কি প্রকার পরিহাস? অবশেষে ভূজঙ্গের কান্না দেখে বুঝিবা দুঃসংবাদটির মর্ম অনুভব করেন তিনি। দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয় থাকেন শ্রেষ্ঠী এরপর, কর্মচারীরা বিচলিত বোধ করেন এই মর্মান্তিক নীরবতায়।

‘প্রভু অশ্বসকটের বন্দোবস্ত করি?’ ঋভু বলে ওঠে একসময়, শ্রেষ্ঠীর গৃহে ফেরা প্রয়োজন অবিলম্বে।

‘না, অশ্বপৃষ্ঠেই যাব আমি, বড় বেশী দেরী হয়ে গেল গৃহে ফিরতে।’ বুক ভাঙ্গা দীর্ঘশ্বাসের সাথে গড়িয়ে পরে দুফোঁটা অশ্রু চোখের কোল বেয়ে।

বসুদত্তের গৃহ নগর তোরণ থেকে বেশীদূরে নয়, ভদ্র চিত্রক সেখানে উপস্থিত হবার অল্প পরেই গৃহস্বামীও উপস্থিত হন নিজগৃহে। চিত্রক তাঁর অপেক্ষাতেই ছিলেন, অনুমতি ভিন্ন নারীর শব পরীক্ষা অনুচিত।

‘আমার স্ত্রীর দেহ স্পর্শ করার অনুমতি আমি দিতে পারিনা আপনাকে’, বসুদত্ত বিচলিত হয়ে পড়েন।

‘আপনার ও গৃহের কোনও নারী সদস্যের উপস্থিতিতেই মৃতার ক্ষত ও অন্যান্য লক্ষণ পরীক্ষা করব ভদ্র, প্রয়োজন না হলে অঙ্গস্পর্শও করব না, আপনি নিশ্চিত থাকুন। আপনার পত্নী আমার ভগিনীতুল্যা।’ চিত্রক শান্তভাবে ব্যাখ্যা করেন। বসুদত্ত বিরোধিতা করতে থাকেন, একে এই আকস্মাৎ শোক, তদুপোরি এই অবমাননা অসহ্য মনে হয় তাঁর। অবশেষে সুদত্তের মধ্যস্থতায় পরীক্ষাকার্য শুরু হয়, কক্ষে উপস্থিত থাকেন চিত্রক, বসুদত্ত ও চঞ্চলা।

মৃতার মাথার পিছনে একটি গভীর ক্ষত লক্ষিত হয়, রক্তপাত সেখান থেকেই ঘটেছে; আততায়ীকে প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করেছিলেন শ্রীজয়া, দেহে কালশিরা ও আঁচড়ের দাগ থেকে সে বিষয় স্পষ্ট হয়। মৃতদেহ কক্ষের যে অংশে পড়েছিল, তার পিছনের দেয়ালটিতে রয়েছে হাতির দাঁতের কারুকার্যমণ্ডিত একটি হস্তিমুখ, এই মূহুর্তে সেটির শুঁড় ও তীক্ষ্ণ দাঁত দুটি রক্তাক্ত। মৃতার মস্তকের ক্ষত এই বস্তুটির আঘাতেই ঘটেছে সন্দেহ থাকেনা।

‘আপনার কাজ শেষ হয়ে থাকলে, আমরা দাহকার্যের ব্যবস্থা করি ভদ্র। এমন হতভাগ্য আমি, যে শোক করার সুযোগটুকুও পেলাম না এই গোলযোগে’, বসুদত্ত আবেদন করেন, তাঁর আর্দ্র চোখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে বিব্রত বোধ করেন চিত্রক।

‘আর একটু সময় চেয়ে নেব ভদ্র, মৃতার মস্তক ও গলা একটু বিশেষ ভাবে পরীক্ষার প্রয়োজন। আপনি অনুমতি দিলে কার্য শুরু করি।’ এরপর, চিত্রক মস্তকের ক্ষত ও শবের মুখ চোখ ও গলা বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করেন। যদিও এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করেননা সেস্থানে।

‘সিন্দুকের তল্লিকা কি আপনার স্ত্রীর কাছেই থাকত?’ পরীক্ষা শেষে, পালঙ্কের অপর পার্শ্বে রাখা একটি লৌহ সিন্দুকের দিকে ইঙ্গিত করেন চিত্রক।

‘হ্যাঁ, এটিতে কিছু অর্থ ও তাঁর গহনার পেটিকা থাকত; ব্যবসায়গত মূলধন ও কাগজপত্রের জন্য ভাণ্ডারগৃহে আমার কার্যালয়ে একটি সিন্দুক আছে, সেটির তল্লিকা আমার কাছেই থাকে।’

‘সিন্দুকটি বন্ধ রয়েছে দেখছি। এটি খোলার ব্যবস্থা করা চলে কি? তস্কর সিন্দুক লুঠ করেছে কিনা জানা প্রয়োজন। অবশ্য সিন্দুক খোলা পেলে সেটি বন্ধ করে সে পালাতো না।’

চিত্রকের নির্দেশ মেনে শ্রেষ্ঠী তল্লিকার সন্ধান করেন পালঙ্কের উপাধানের নীচে, সেটি যথাস্থানেই পাওয়া যায়; সিন্দুকের খুলে চোখে পড়ে অর্থ ও গহনার পেটিকা যথারীতি অবস্থান করছে সেখানে।

‘সিন্দুকে তস্করের হাত পড়েনি, তবে আপনার স্ত্রীর গায়ের গহনা সে নিয়ে গেছে। এর একটি তালিকা আমাদের প্রয়োজন ভদ্র।’

‘কিন্তু সে তালিকা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব, তিনি কাল কি গহনা পরেছিলেন আমি তো দেখিনি।’

‘আপনি দেখেননি, কিন্তু গৃহের দাসীটি দেখেছে, সে নিশ্চয় বলতে পারবে; মেয়েরা গহনার বিষয়ে ভুল করেনা।’

এরপর কক্ষটি পরবর্তীকালে পরীক্ষার উদ্দেশ্যে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে চিত্রক স্থান ত্যাগ করেন।

***

সুপরিসর কক্ষটির উদ্যান সংলগ্ন জানালার পাশে রয়েছে একখানি সুদৃশ্য মন্দুরা; মন্দুরার একপাশে বসে এক অনিন্দ্যকান্তি তরুণ বীণাবাদনে মগ্ন। অপরাহ্নের নরম রোদের ছোঁয়ায় তাঁর কেশগুচ্ছ স্বর্ণাভ, অর্ধনীমিলিত চোখে স্বপ্নের ঘোর, ঠোঁটে লেগে আছে স্মিত হাসি। পাশে রাখা একটি থালিকায় একগুচ্ছ পারিজাতমালা, কুরুঙ্গীতে জ্বলছে চন্দনগন্ধী ধুপক। মন্দুরার অন্যপাশে উপাধানে ভর দিয়ে অর্ধশয়ান আর এক সুদর্শন নবযুবক, সুরময় এই মায়াবী পরিবেশে তিনিও আত্মমগ্ন।

কঙ্কণের মৃদু শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় যুবকের, নববিবাহিতা স্ত্রী চম্পাবতীর অলক্ষ্য উপস্থিতি অনুভব করে দ্বারের দিকে চেয়ে দেখেন তিনি, প্রশ্রয়ের হাসি ফুটে ওঠে তাঁর চোখে মুখে। ইতিমধ্যে বীণাবাদন বন্ধ হয়, যন্ত্রটি একপাশে রেখে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন কুমার পুষ্পকেতু।

‘দ্বারপ্রান্তে কিছু অনর্থ ঘটেছে নাকি, এমন উন্মনা হলে কিসে?’ বাল্যবন্ধু উল্মুককে প্রশ্ন করেন তিনি কৌতুকছলে।

‘তোমার সুরসন্ধান দীর্ঘক্ষণ চললে অনর্থ ঘটতেও পারে, সে-বিষয়েই চিন্তায় আছি’, কথাটি বলতে বলতে কক্ষের বাইরে চম্পাবতীর প্রতি ইঙ্গিত করেন উল্মুক। আচমকা ধরা পড়ে, অপ্রস্তুত দেখায় চম্পাকে; তার স্নিগ্ধ সুকুমার মুখখানি লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠে।

‘বাইরে থেকে কেন, এখানে বসে শোন বাজনা’, উল্মুক উৎসাহ দেন।

‘আপনি আসন গ্রহণ করুন দেবী, এ আমার সৌভাগ্য’, পুষ্পকেতু আপ্যায়ন করেন ভাতৃবধূসমা তরুণীকে।

আবার শুরু হয় বীণাবাদন, সুরের মায়াজালে ডুবে থাকেন তিনজন দীর্ঘক্ষণ। দিনের আলো কমে আসে, আর তারই সাথে একসময় বাজনা শেষ হয়, পুষ্পকেতু বিদায় নিতে চান বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর কাছে।

‘কি অপূর্ব আপনার বাজনা, আবার কবে আসবেন আর্য?’ চম্পার সরল উক্তি ছুঁয়ে যায় তাঁকে।

‘আপনার ভালো লেগেছে?’

‘অপূর্ব আপনার সুরসৃষ্টি, মনে হয় যেন আপনি শাপভ্রষ্ট গন্ধর্ব।’

‘উঁহুঁ, গন্ধর্ব নয়, ও যে কন্দর্প; সাবধানে থেকো’, উল্মুক পুষ্পকেতুর নামের প্রতি ইঙ্গিত করে স্ত্রীকে উত্যক্ত করার চেষ্টা করেন, চম্পাবতী কুপিতা হয়ে কক্ষ ছেড়ে চলে যান।

‘সত্যি কেতু, আজকের দিনটি বহূকাল মনে থাকবে। তুমি ছিলে, তাই পুস্তপালের দপ্তরে দিনপাত করা সহনীয় হয়েছে।’

‘চাও যদি, কয়েকটা দিন পুস্তপালের হাত থেকে রেহাই পেতে পারো’, পুষ্পকেতুর উত্তরে রহস্যের ইঙ্গিত পেয়ে কৌতুহলী হয়ে ওঠেন উল্মুক।

‘আজ প্রত্যুষে বৈশ্যপল্লীতে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, পিতা সেবিষয়ে অনুসন্ধানের ভার আমাকে দিতে চান। কাল প্রভাতে দণ্ডনায়কের কার্যালয়ে ভদ্র চিত্রকের সাথে আলোচনা আছে, আসতে চাও কি?’

‘অহোঃ! একারণেই তোমাকে এত ভালবাসি’, আগ্রহের আতিশয্যে মিত্রকে আলিঙ্গন করেন উল্মুক।

***

‘মস্তকের আঘাতে মৃত্যু ঘটেনি, এই আপনার মত?’ মহাদণ্ডনায়ক বিশাখগুপ্তের কার্যালয়ে বসেছে আলোচনা সভা, তিনি ছাড়াও সেখানে উপস্থিত তাঁর পুত্র পুষ্পকেতু, উল্মুক, ধর্মদাস ও অবশ্যই আধিকারিক চিত্রক। প্রশ্নটি করেন পুষ্পকেতু।

‘হ্যাঁ, মস্তকের আঘাতটি রক্তক্ষয়ের কারণ হলেও মৃত্যুর কারণ হয়নি, সে আঘাত তেমন গভীর ছিলনা। গলায় আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট, চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত, জিহবা অল্প বেরিয়ে এসেছিল। এথেকে প্রমান হয়, আততায়ী শ্রেষ্ঠীপত্নীকে গলা টিপে হত্যা করেছে।

‘কিন্তু, মস্তকে আঘাত করার পর কণ্ঠরোধের অর্থ কি? দ্বিতীয়বার মস্তকেই আঘাত করা স্বাভাবিক ছিল না কি?’

‘আমার ধারণা প্রথম আঘাতেই মৃত্যু ঘটেছে ভেবে আততায়ী নিশিন্ত ছিল, কিন্তু গা থেকে গহনা অপসারণ কালে প্রাণের লক্ষণ দেখা দেয়, হয়তো মৃতা প্রতিরোধ অথবা চিৎকারেরও চেষ্টা করে থাকবেন। সে অবস্থায়, ভয় পেয়ে তাঁকে শ্বাসরূদ্ধ করে হত্যাকারী।’

‘মৃত্যুকাল সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব হয়েছে কি ভদ্র?’

‘আমি যখন দেহ পরীক্ষা করি, তখন দিবা দ্বিতীয় প্রহর শুরু হয়েছে। দেহের তাপমান ও কাঠিন্যের মাত্রা লক্ষ্য করে মনে হয়েছে মৃত্যু ঘটেছে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরের শেষভাগ অথবা তৃতীয় প্রহরের শুরুতে।’

‘তৃতীয় প্রহর, অর্থাৎ রাত গভীর, কিন্তু নিশুতি নয়। সামান্য তস্কর গৃহস্থগৃহে সিঁধ কাটে রাত্রির শেষ প্রহরে, সেসময়ই নিদ্রা গভীরতম হয়।’পুষ্পকেতুকে কিছুটা বিস্মিত দেখায়।

‘তুমি কি অন্যপ্রকার কিছু আশঙ্কা করছ কেতু?’ বিশাখগুপ্ত প্রশ্ন করেন। নিজপুত্রের বিশ্লেষণী ক্ষমতার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা, তাই পুত্রের মন্তব্যে বিচলিত দেখায় তাঁকে। বিশাখগুপ্ত বিগত একযুগ ধরে পাটলীপুত্রের আইনরক্ষক; সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বৈমাত্রেয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা তিনি, ন্যায়নিষ্ঠতা ও নীতিজ্ঞানে অমিতবিক্রমী মগধেশ্বরের যোগ্য অনুজ। তাঁর দক্ষ পরিচালনায় পাটলীপুত্র শান্তিপূর্ণ নগরী, এখানে এরূপ অঘটন সচরাচর ঘটে না, এর যথাযথ প্রতিকার করতে তিনি দৃঢ়বদ্ধ।

‘হ্যাঁ, এইকাজ সামান্য তস্করের কিনা সে নিয়ে সন্দেহ জাগছে। এতবড় দুঃসাহসিক কাজ সে করবে গুটিকয় গহনার লোভে?’

‘গহনা কি সামান্য বস্তু? শ্রেষ্ঠীর তালিকা অনুযায়ী গৃহিনীর গাত্রে বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার ছিল, তার মূল্য নেহাত কম হবে না।’বিশাখগুপ্ত যুক্তি দেন।

‘এতখানি ঝুঁকি নিয়ে চৌর্যবৃত্তি করতে এসে, সিন্দুক খোলার চেষ্টা করল না আততায়ী, এটা কি আশ্চর্যের বিষয় নয়?’

‘এখন আমাদের করনীয় কি বলে তোমার মনে হয়?’

‘আমি ঘটনার বিষদ তদন্ত করতে চাই পিতা, আপনি অনুমতি দিন।’ বিশাখগুপ্তকে চিন্তিত দেখায় এ প্রস্তাবে।

‘বেশ, ন্যায় প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমি অনুমতি দিলাম, তবে শ্রেষ্ঠীর পরিবারের অনুভূতির কথা স্মরণে রেখে অনুসন্ধান কার্য চালনা কোর।’ তখনকার মত আলোচনা সভা ভঙ্গ হয় এই সাথে।

***

অগ্রীম সংবাদ পাঠিয়ে বসুদত্তের গৃহে উপস্থিত হন পুষ্পকেতু ও উল্মুক, সাথে থাকেন ধর্মদাস। বসুদত্ত আপাতত ভাইয়ের গৃহে রয়েছেন, শ্রাদ্ধক্রিয়ার ব্যবস্থা সেখান থেকেই সঙ্ঘিত হবে। তাঁর নির্দেশে ভূজঙ্গ সাথে করে নিয়ে যায় আধিকারিকদের বন্ধ রাখা শয়নকক্ষটিতে। কক্ষটির বদ্ধ আবহাওয়ায় শোণিতের মৃদু গন্ধ, ছড়িয়ে থাকা আসবাব ও দেওয়ালে গাঁথা রক্তাক্ত হস্তিমুখ যেন মৃত্যুর এক বিভৎস্য রূপের প্রতিভূ, সুদৃশ্য কক্ষের কমনীয় সজ্জার সাথে বড় বেমানান। শয্যাটি দেখে বোঝা যায় মৃতা দুর্ঘটনার রাত্রে শয়ন করেছিলেন সেখানে, পালঙ্কের পাশে রাখা একটি জলের কুম্ভিকা ও তার উপরে একখানি সুদৃশ্য রূপার পানপাত্র। এগুলি, শ্রীজয়া কক্ষের যেদিকে পড়ে ছিলেন তার অপর প্রান্তে রাখা, ফলে জিনিসগুলি স্থানচ্যূত হয়নি। পালঙ্কের নীচে দৃষ্টিপাত করেন পুষ্পকেতু, সেখানে একপাশে রাখা রয়েছে একটি কাষ্ঠ পেটিকা, আর পালঙ্কের প্রান্তে মাটিতে রয়েছে একটি রূপার থালিকা ও তার উপরে একটি পানপাত্র। থালিকায় তখনও পড়ে রয়েছে দু একটি অর্ধভুক্ত মিষ্টান্ন, পানপাত্রের তলানী শুকিয়ে গেছে, তবু ঘ্রাণ থেকে বোধ হয়, কোনও কর্পূর মিশ্রিত পানীয়। পেটিকাটি পালঙ্কের তল থেকে বের করে আনে ভূজঙ্গ পুষ্পকেতুর নির্দেশে, সেটির কপাটে তালযন্ত্র নেই। কপাট উন্মোচন করে দেখা যায় ভিতরে রয়েছে একরাশ রূপার বাসন, সম্ভবত বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তুলে রাখা তৈজসপত্র সেগুলি। পালঙ্কের শিয়রে দেওয়ালের দীপদণ্ডটিতে পিতলের প্রদীপগুলি জ্বলে যাওয়া সলিতার প্রভাবে কালিমালিপ্ত। সেগুলিকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করেন পুষ্পকেতু।

‘আততায়ী যখন কক্ষে আসে, গৃহিনী জাগ্রত ছিলেন। প্রদীপগুলিতে বিন্দুমাত্র তৈল অবশিষ্ট নেই, সলিতাও সম্পূর্নরূপে ভষ্মীভূত হয়েছে, এগুলি রাতভর জ্বলে আপনি নিভে গেছে। গৃহিনী নিদ্রিতা হলে প্রদীপে তেল থাকত।’ পুষ্পকেতু মন্তব্য করেন।

‘জাগ্রত ছিলেন, সেকারনেই প্রাণ দিতে হল বলছ?’ উল্মুক প্রশ্ন করেন। কেতু কোনও মন্তব্য করেননা এর উত্তরে।

শয়নকক্ষ পরিদর্শন শেষে সংলগ্ন কক্ষটিতে প্রবেশ করেন সকলে, এটি ছিল গৃহিনীর প্রসাধন কক্ষ। সারি সারি পেটিকা, ও প্রসাধন সামগ্রী দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়না, শ্রীজয়া অত্যন্ত সৌখিন ও প্রসাধন বিলাসিনী ছিলেন। কক্ষটিতে সবকিছু সুচারুভাবে সাজানো, যেন এখনই গৃহিনীর পদার্পন ঘটবে সেখানে। অলিন্দের শেষপ্রান্তে পূজাকক্ষ, অশৌচকালে পূজাকর্ম বন্ধ, তাই কক্ষটিও কপাটবদ্ধ।

‘গৃহের মূল দরজা বন্ধ হোত কোন সময়ে?’ প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ শেষ হতে ভূজঙ্গকে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘শ্রেষ্ঠী প্রবাসে থাকলে গৃহের মুল দরজা কপাটবদ্ধই থাকত সকলসময়, অতিথি এসে করাঘাত করলে, আমি খুলে দিতাম কপাট।’

‘হত্যার দিনেও কপাট বন্ধই ছিল সন্ধ্যাকালে?’

‘তাই ছিল নিশ্চয়’, ভূজঙ্গকে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত দেখায় এমূহূর্তে।

‘তুমি নিশ্চিত নও? কেন?’

‘সূর্যাস্তের পূর্বেই গৃহকর্ম শেষ করে আমি কুটিরে ফিরে যাই প্রতিদিন, সন্ধ্যাকালে চঞ্চলাই মূলগৃহে থাকত। সেসময়ে কেউ এসে থাকলে আমি বলতে পারব না।’

‘সন্ধ্যাকালেও অতিথি আসার সম্ভাবনা ছিল কি শ্রেষ্ঠীর অবর্তমানে?’

‘এবিষয়ে চঞ্চলা সঠিক বলতে পারবে প্রভু, আমি কিছু জানিনা’, ভূজঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইছে স্পষ্ট হয় সেকথা।

অতঃপর চঞ্চলার ডাক পড়ে প্রশ্নোত্তর পর্বের উদ্দেশ্যে। চঞ্চলার সংযত শান্তশ্রী দেখে বোধ হয়, স্বামিনীর মৃত্যর আঘাত কিছুটা হলেও সে কাটিয়ে উঠেছে। কথাবার্তা শুরু হয় নীচের তলের বিশ্রাম কক্ষটিতে।

‘তোমার প্রভুপত্নীর সাথে সাক্ষাৎ করতে কারা আসত?’

‘তাঁর মাতা আসতেন প্রায়শই, তবে কয়েকমাস পূর্বে তাঁর মৃত্যু ঘটেছে। ভাগ্যবতী, তাই এই দুর্ঘটনা দেখতে হলনা’, নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। ‘এছাড়া, প্রভু সুদত্ত আসতেন খোঁজখবর নিতে।’

‘সুদত্ত পত্নী আসতেন না?’

‘পালা পার্বনে আসতেন কখনও সখনও।’

‘দুর্ঘটনার দিন বিকালে কেউ এসেছিল কি?’

‘ভদ্র বারুনি এসেছিলেন, সন্ধ্যাকালে।’

‘বারুণি? তিনি কে? সন্ধ্যাকালে কি কারণে এসেছিলেন?’

‘তিনি একজন তরুন মূর্তিকার, ভারি সুন্দর পাথরের মূর্তি গড়েন; প্রভু ও প্রভুপত্নীর স্নেহধন্য। প্রভু গৃহে থাকলে প্রায়ই আসেন, তাঁর অবর্তমানেও আসেন মাঝে মাঝে। সেদিন কি কারণে এসেছিলেন বলতে পারিনা।’

‘কতক্ষণ ছিলেন বারুণি এই গৃহে সেদিন?’

‘সে আমার জানা নেই, প্রভু। তিনি আসার কিছু পরে, আমি তাঁর জন্য মিষ্টান্ন ও পানীয় নিয়ে আসি। রাতের আহার আগেই সম্পন্ন হয়েছিল, সেকারণে গৃহিনী আমাকে সেদিনকার মত কর্ম থেকে অব্যহতি দেন, আমি কুটিরে ফিরে যাই।’

‘তার মানে বারুণিকে গৃহ থেকে নিষ্কাষিত হতে তুমি দেখনি?’ চঞ্চলা সম্মতি জানায়।

‘শ্রেষ্ঠানী গৃহে একলা থাকতেন যখন, তুমি রাত্রিকালে তাঁর সাথে থাকতে না?’

‘সবসময় থাকতাম না।’

‘সে কিরকম?’

‘প্রভুপত্নী কখনও অসুস্থা হলে, বা একলা বোধ করলে থাকতে বলতেন আমায়, তাঁর শয়নকক্ষের মেঝেতে শয্যা পেতে রাত্রিবাস করতাম তখন। তবে, বাকীসময় নিজ কুটিরেই থাকি আমি।’

‘এখানে একাই থাক? পরিবার নেই তোমার?’

‘স্বামী আছে, বন্দরসংলগ্ন একটি পান্থশালায় সেবকের কর্ম করে সে, সেখানেই থাকে। সময়ে সময়ে, তার প্রভুর কাছে ছুটি নিয়ে আমার এখানে রাত্রিযাপন করে, আবার প্রভাতে ফিরে যায় কর্মক্ষেত্রে।’

‘দুর্ঘটনার রাত্রিতে এসেছিল সে তোমার কাছে?’

‘হ্যাঁ, এসেছিল, কিন্তু আমি মূলগৃহে আসবার পূর্বেই স্থান ত্যাগ করে সে।’ চঞ্চলা জানায় তার স্বামীর নাম অশ্বিন, বন্দরে তার কর্মস্থলের ঠিকানাও জানায় সে সেইসঙ্গে। এরপর বসুদত্তের গৃহ থেকে বিদায় নিয়ে সুদত্তের গৃহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তিনজনে।

***

সুদত্তের গৃহে শোকের আবহ, ভগ্নহৃদয় জ্যেষ্ঠ্যভ্রাতাকে সযত্নে আগলে রেখেছেন সুদত্ত ও তাঁর পত্নী। এই একদিবসেই বসুদত্তের বয়স যেন বৃদ্ধি পেয়েছে একযুগ, চোখের কোলে নিদ্রাহীনতার কালিমা, চিন্তার বলিরেখা কপালে। সুদত্তের গৃহের একটি বহির্কক্ষে তাঁর সাথে বাক্যালাপ শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপনাকে বিব্রত করতে হল ভদ্র, এরজন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী।’

‘আপনাদের সাহায্য করা আমার কর্তব্য; বলুন কি জানতে চান?’

‘বারুণি কে? আপনাদের সাথে তার কি আত্মীয়তার সম্পর্ক?’ বসুদত্তের মুখের ভাবে বিস্ময় ফুটে ওঠে, কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দেন তিনি।

‘ছেলেটি প্রতিভাবান শিল্পী, প্রার্জুন প্রদেশের একটি গ্রাম থেকে ভাগ্যের সন্ধানে এসেছিল পাটলীপুত্রে বছর দুয়েক আগে। প্রায় বৎসর খানেক অনেক চেষ্টা করেও যোগ্য সুযোগ পায়নি সে, ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে নগরীর পণ্যবিথীর পথে পথে নিজ শিল্পকর্ম সামান্য মূল্যে ফেরি করে ফিরত তখন। এরকমই একদিন, আমি তাকে দেখি, ছিন্ন বসন, রূক্ষচুল, অর্দ্ধাহারে শীর্ণ মুখশ্রী; দয়া পরবশ হয়ে তার পণ্য দেখতে চেয়েছিলাম, আর সেখানেই চমক লেগেছিল। কি অসধারণ সে সকল ক্ষুদ্র মূর্তির গঠনশৈলী, অপূর্ব তাদের মুখশ্রীর ব্যাঞ্জনা; ছেলেটির প্রতিভা সাধারণ নয়, বুঝেছিলাম আমার অভিজ্ঞতা থেকে। পরবর্তীকালে, তার উপযুক্ত বাসস্থান ও কর্মশালার ব্যবস্থা করি আমি, পরিচয় করিয়ে দেই স্থপতি বজ্রপানির সাথে। শুধু প্রতিভার কারণে নয়, তার সুদর্শন চেহারা ও মিষ্ট স্বভাবের গুণেও, আমার বিশেষ স্নেহভাজন হয়ে উঠেছে সে বিগত এক বৎসরে। দুঃখের কথা কি জানেন, ওই হস্তিমুখ, যা আমার স্ত্রীর মৃত্যর কারণ হয়েছে, সেটি বারুণিরই সৃষ্টি।’ কথাকটি বলে গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন শ্রেষ্ঠী।

‘আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পশ্চাতে সে দেখা করেছে আপনার সাথে?’

‘এত লোকের ভীড়ে সে এসেছিল কিনা বলতে পারিনা, তবে আমার সাথে সাক্ষাৎ করেনি এখনও।’

‘আপাততঃ আপনার কাছে আর কিছু জানবার নেই ভদ্র, আপনি বিশ্রাম করুন’, পুষ্পকেতুর সম্মতি পেয়ে স্থান ত্যাগ করেন বসুদত্ত। সুদত্তের সাথে কথোপকথন শুরু হয় এরপরে।

‘ওই অর্ধনারীশ্বর মূর্তিটি কি বারুণির শিল্পকর্ম?’ কক্ষের এককোণে রাখা একটি প্রায় তিনহাত উঁচু প্রস্তর মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘হ্যাঁ, ভ্রাতা উপহার দিয়েছিলেন গত মেষ সংক্রান্তিতে।’

‘অনন্য এর গঠনশৈলী! বারুণিকে আপনার ভ্রাতা সঠিক চিনেছেন সন্দেহ নেই।’

‘বারুণির প্রতিভাকে চিনেছেন সত্য’, সুদত্তের মন্তব্য যেন সুক্ষ্ম ইঙ্গিতবহ।

‘বারুণির সম্পর্কে আপনার কি মত ভদ্র? পুষ্পকেতু তাঁর মন্তব্যের সূত্র ধরে প্রশ্ন করেন।

‘প্রতিভাশালী হলেই অচেনা পুরুষকে গৃহে এনে প্রশ্রয় দেওয়া অনুচিত বলে আমি মনে করি। বারুণি অজ্ঞাতকুলশীল।’

‘ভদ্র বসুদত্তের অনুপস্থিতিতেও তার যাতায়াত ছিল আপনার ভ্রাতৃগৃহে, জানতেন সেকথা?’

‘এবিষয়ে আমি কিছু জানিনা।’ সুদত্ত এই প্রসঙ্গে অধিক কিছু বলতে আগ্রহী নন বোঝা যায়।

‘দুর্ঘটনার দিন আপনি গিয়েছিলেন সে-গৃহে?’

‘অপরাহ্নে বিপনি যাবার কালে গিয়েছিলাম অল্পক্ষণের জন্য। জ্যেষ্ঠ্য বন্দর হতে আগমনবার্তা পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে, সেই সংবাদ দিতে গিয়েছিলাম।’

‘দেখা হয়েছিল শ্রেষ্ঠানীর সাথে?’

‘হয়েছিল, তাঁকেই সংবাদ জানাই। জ্যেষ্ঠ্য দুএকদিন পরে গৃহে ফিরবেন জেনে বোধকরি আশাহত হয়েছিলেন তিনি।’

‘আপনার স্বর্গতা ভাতৃবধূর সাথে আপনাদের পরিবারের সম্পর্ক কিরূপ ছিল?’

‘তিনিও আমাদের পরিবারেরই একজন, কাজেই এ প্রশ্ন অর্থহীন’, সুদত্তের উত্তরে ঈষৎ উষ্মা প্রকাশ পায়।

‘পরিবারের অংশ হলে পৃথক গৃহে বাসের প্রয়োজন হয় কি ভদ্র? তদন্তের কারণে অনেক অপ্রিয় প্রশ্ন করতে হয় আমাদের, সহজ উত্তর দিলে ভ্রান্তধারণার সম্ভাবনা থাকেনা।’

‘একসাথে বাস করলে সমবয়স্কা নারীদের মধ্যে অনেক সময় ঈর্ষাজনিত জটিলতা ঘটে থাকে, সেকারণেই পৃথক ব্যবস্থা। কিন্তু আমি জ্যেষ্ঠাকে কখনও অসম্মান করিনি, ভ্রাতার প্রবাস যাপনকালে সাধ্যমত খেয়াল রাখতাম তাঁর।’

‘বুঝেছি। আপনার কাছে আমার শেষ প্রশ্ন, ভদ্র বসুদত্তের কোনও শত্রু আছে কি?’

‘সম্পন্ন ব্যাবসায়ী, বিদেশে বাণিজ্য করেন, ব্যাবসায়িক প্রতিদ্বন্দিতা দ্বেষ, রাগের কারণ হতে পারে, কিন্তু শত্রুতা? না আমার সেরকম কিছু বোধ হয় না।’ এরপরে পুষ্পকেতু সবান্ধব বিদায় নেন সুদত্তের গৃহ থেকে।

‘আপনি এখনি একবার বারুণির খোঁজে লোক পাঠান ভদ্র, আমি কার্যালয়ে অপেক্ষায় থাকব। ধর্মদাসকে নির্দেশ দিয়ে উল্মুকের সাথে কার্যালয়ে রওয়ানা দেন কুমার।

‘তুমি কি বারুণিকে সন্দেহ করছ কোনওভাবে?’ পথিমধ্যে প্রশ্ন করেন উল্মুক।

‘এইকাজ অর্থের লোভে ঘটেনি এ আমি নিশ্চিত। পালঙ্কের নীচের তৈজসের পেটিকা সামান্য তস্কর অবহেলা করতে পারত না। তাছাড়া এতবড় দুঃসংবাদ পেয়েও বারুণি বসুদত্তের কাছে এলো না কেন?’

‘কিন্তু বারুণিরই বা স্বার্থ কি? আশ্রয়দাতার স্ত্রীকে হত্যা করলে, তার নিজের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।’

‘কিছু বুঝতে পারছিনা বন্ধু, আগে তার সাথে বাক্যালাপ প্রয়োজন; সেই শ্রীজয়াকে শেষবারের মত জীবিত দেখেছিল।’

কিছুপরে ধর্মদাস সংবাদ আনেন, বারুণি গৃহ বা কর্মস্থল কোথাও নেই; প্রতিবেশীরা তাকে দুর্ঘটনার পরদিন থেকে আর দেখেনি।

***

বারুণির গৃহটি নগরবীথি সংলগ্ন গৃহস্থ পল্লীতে, একটি আম্রকুঞ্জের একপাশে। গৃহটি একতলবিশিষ্ট, তার একপাশে শয়ন ও বিশ্রামকক্ষ, অন্যপাশে কর্মশালা। আম্রকুঞ্জটি বসুদত্তের সম্পত্তি, গৃহটিও তিনিই নির্মাণ করিয়ে দিয়েছেন সন্দেহ থাকে না। বারুণি একাই থাকত সেখানে, রন্ধন ও গৃহকর্ম নিজেই করত সে।

গৃহের কপাটের অর্গল ভাঙ্গা হয় পুষ্পকেতুর নির্দেশে, এরপর ভিতরে প্রবেশ করেন পুষ্পকেতু, উল্মুক ও ধর্মদাস। শয়নকক্ষটি দেখে মনে হয়, বারুণি বিছানায় শয়ন করেনি নিরুদ্দেশ হবার পূর্বে, গভীর রাত্রে পলায়ন করেছে সে দ্রূত প্রস্তুতি নিয়ে। একটি ক্ষুদ্র পেটিকার ডালা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে আছে মাটিতে, তার তালযন্ত্রটি কিছুদূরে বিক্ষিপ্ত। সম্ভবতঃ এটি তার সঞ্চিত অর্থের কোষ, যাবার কালে তাড়াতাড়িতে ভিতরকার সম্পদ বের করতেই এরূপ ঘটেছে। দেওয়ালের একপাশে রাখা বস্ত্র রাখবার উদবন্ধকটিও শূণ্য। বিশ্রামকক্ষটিতে তিন চারখানি পিঠিকা ভিন্ন কিছু নেই, দেওয়ালের কুরুঙ্গীতে লক্ষীজনার্দনের মূর্তির সমুখে কয়েকদিনের বাসি ফুলের মালা শুকিয়ে আছে। এরপর, কর্মশালায় যান সকলে, সেখানে ঢুকতেই একখানি মাঝারি উচ্চতার পূর্নাঙ্গ যক্ষিণী মুর্তি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মূর্তির কাজ এখনও অসমাপ্ত, তবু তার দেহ বিভঙ্গ ও মুখশ্রী পূর্ণতা লাভ করেছে; মূর্তিটি একটি অনুপম ভাস্কর্য্যের নিদর্শন, মুগ্ধ চোখে সেইদিকে চেয়ে থাকেন তিনজনেই।

‘এই মূর্তি পরিণতি পাবে না ভেবে ক্ষেদ হচ্ছে মনে, ‘ মন্তব্য করেন উল্মুক।

‘যক্ষিনীর মুখশ্রী কোথাও যেন দেখেছি পূর্বে, পরিচিত ঠেকছে’, পুষ্পকেতু মূর্তিটি ভালোভাবে পরীক্ষা করতে করতে কতকটা স্বগোগক্তি করেন।

‘নটী সুরসেনী; এমূর্তি তারই’, ধর্মদাস পুষ্পকেতুর উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন।

‘আপনি কি নর্তকীশ্রেষ্ঠা সুরসেনীর কথা বলছেন ভদ্র? বিগত বসন্তোৎসবে রাজসভায় দেখেছিলাম তার নৃত্য। হতে পারে এ তারই মুখচ্ছবি, দেহভঙ্গিমাটিও অবিকল নৃত্যের আঙ্গিকে গঠিত হয়েছে।’

‘অর্থের বিনিময়ে মূর্তি গড়ার কাজ করত বারুণি, নটীর মূর্তি সেকারণেই হয়তো’, উল্মুক বলে ওঠেন।

এরপর, কক্ষের বাকি বস্তু পরীক্ষা শেষে গৃহের পিছন দিকের দ্বার পরীক্ষা করেন পুষ্পকেতু। সমুখের দ্বারটি ছিল ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ, কিন্তু পিছনকার দরজাটি বাইরে থেকে শেকল দিয়ে বাঁধা; বারুণি রাতের অন্ধকারে পিছনের দ্বার দিয়ে চুপিসাড়ে নিষ্ক্রান্ত হয়েহে সন্দেহ থাকেনা এথেকে। অতঃপর ধর্মদাসকে নিখোঁজ বারুণির সংবাদ সংগ্রহের নির্দেশ দিয়ে গৃহের ফেরার উদ্যোগ করেন কুমার। রহস্যভেদে বারুণির সন্ধান পাওয়া আবশ্যক, এবিষয়ে সন্দেহ থাকেনা কারও।

‘বারুণি হত্যা করে নিরুদ্দেশ হয়েছে একথা স্পষ্ট, কিন্তু হত্যার উদ্দেশ্য বুঝলে কিছু?’ পথে প্রশ্ন করেন উল্মুক।

‘হত্যা পূর্বপরিকল্পিত নয়, আচমকা মূহূর্ত্তের উত্তেজনায় ঘটে গেছে; সেকারণেই এত দ্রূত রাত্রির অন্ধকারে স্থান ত্যাগ করতে হয়েছে বারুণিকে।’

‘কিন্তু এই আকস্মাৎ কলহের পিছনে একটা যুক্তি তো থাকবে?’

‘নিশ্চিত করে কিছু বলা শক্ত, তবে ঈর্ষা একটি কারণ হলেও হতে পারে। অনৈতিক প্রেমের অনিশ্চয়তায় সন্দেহের কাঁটা থাকেই, বিশেষ করে প্রেমিকটি যদি বারুণির মত একজন আকর্ষণীয় পুরুষ হয়।’

‘বুঝলাম!’

‘কি বুঝলে?’

‘বুঝলাম, কেন তুমি নৈতিক, অনৈতিক সকল প্রকার প্রেমেরই ঘোর বিরোধী।’

‘বটে!’ তারুণ্যের স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায় হেসে ওঠেন দুই মিত্র।

বারুণির খোঁজে বিভিন্ন দিশার রাজমার্গের জলসত্রগুলিতে সংবাদ পাঠানো হয় অশ্বারোহী দূতের সাহায্যে, বন্দর সংলগ্ন পান্থশালাগুলিতেও শুরু হয় অনুসন্ধান। ধর্মদাস ইতিমধ্যে সুরসেনীর সাথে সাক্ষাৎ করে মূর্তি বিষয়ে সংবাদ আনেন; মহামাত্য জয়দ্রথের অর্থ আনুকুল্যে বারুণি কার্যটি গ্রহণ করেছিল, জয়দ্রথ নর্তকীর পৃষ্ঠপোষক। সেই সূত্রে নটীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল বারুণির গৃহে, পরবর্তীকালে বারুণিও যেত সুরসেনীর গৃহে। লোকমতে, নটী বিশেষ কৃপার চক্ষে দেখতে শুরু করেছিল তাকে বিগত কিছুদিন যাবৎ, সুদর্শন যুবক তায় প্রতিভাশালী, এবিষয়ে আশ্চর্যের কিছু নেই।

***

নবান্ন উৎসবের প্রথম দিন, নিকটবর্তী মন্দিরে দেবী অন্নপূর্ণার আরাধনা শেষে ঘন্টাধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠেছে বৈশ্যপল্লী। নূতন শস্য ফলন উপলক্ষে তিনদিন ব্যাপী এই উদযাপনে প্রতি বৎসরের মতই মেতে উঠেছে সমগ্র মগধ, পাটলীপুত্রও তার ব্যতিক্রম নয়। নূতন বস্ত্র, বিশেষ ব্যাঞ্জন, প্রীতি উপহার বিনিময়, এসবই উৎসবের অঙ্গ। অপরাহ্নের শেষ প্রহর, গোধূলির আবছায়া আলোকে সুপরিসর কক্ষটি কিছুটা নিষ্প্রভ, দ্বীপের আলো এনেও ভূজঙ্গ দ্বিধাভরে ফিরে গেছে কিছু আগে; কক্ষের একান্তে বসুদত্তের আত্মমগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি সে। গৃহদেবতা জনার্দনের পূজা সেরে সুদত্ত ও তাঁর পত্নী উপলা প্রসাদের মিষ্টান্ন সাথে বসুদত্তের গৃহে আসেন সৌজন্য বিনিময়ের উদ্দেশ্যে, ভূজঙ্গ তাঁদের অতিথি কক্ষে নিয়ে যায়, সেস্থানেই বসবাস করছেন বসুদত্ত দুর্ঘটনার পশ্চাতে। কক্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে থমকে দাঁড়ান সুদত্ত, হাতের ইশারায় ভূজঙ্গকে যেতে বলেন তিনি। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বসুদত্ত, অস্তগামী সূর্যের ম্লান আভায় বড় অসহায় প্রৌঢ়ের মুখখানি, জগতের সমস্ত আলোক শুষে নিয়ে বুঝি চলে গিয়েছে শ্রীজয়া, শ্রেষ্ঠীর জীবন এতদিনে সত্যিই সায়াহ্নঘন।

‘শুভদিনে অন্ধকারে কেন অগ্রজ?’ সুদত্তের কণ্ঠস্বর আবেগে আদ্র শোনায়।

‘কে? সুদত্ত? আমার জীবনে এখন শুধুই অন্ধকার, সকল দিবসই অশুভ।’

‘একথা বলবেননা দেব, দুর্দিন কেটে যাবে নিশ্চয়, যা গেছে তা ভুলে থাকাতেই মঙ্গল।’

‘জীবনের অধিকাংশ কাল একা ছিলাম, কিন্তু এত নিঃসঙ্গ বোধ করিনি কখনও। স্ত্রীর মৃত্যু হয়তো ভুলে থাকা যায়, কিন্তু এই মৃত্যুকে ঘিরে যে গুঞ্জন উঠেছে সমাজে, তাকে অগ্রাহ্য করি কেমন করে?’

সুদত্ত উত্তর দিতে পারেননা এই বাক্যের, বিব্রত দেখায় তাঁকে। কিছু সময় পরে অগ্রজকে একান্তে থাকার সুযোগ দিয়ে সস্ত্রীক প্রস্থান করেন তিনি।

***

কেটে গেছে দীর্ঘ একমাস, বারুণির সন্ধান পাওয়া যায়নি কোথাও। একদিন অপরাহ্নে, নগরীর এক মণিকার বাসুদেবের কাছে একটি দুর্মূল্য রত্নহার নিয়ে উপস্থিত হয় চঞ্চলার স্বামী অশ্বিন, হারটি বিক্রয় করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তার মত নগন্য ব্যক্তির কাছে দুষ্প্রাপ্য মারকতমণি খচিত মালা দেখে বাসুদেবের সন্দেহ জাগে; শ্রীজয়ার হত্যার পশ্চাতে নগরীর রত্নব্যবসায়ীদের গহনার তালিকা পাঠিয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছিল দণ্ডনায়কের কার্যালয় থেকে। অশ্বিনের মালাটি তালিকাভুক্ত সামগ্রীর থেকে ভিন্ন, তবুও শ্রেষ্ঠী দণ্ডালয়ে খবর পাঠানো উচিৎ মনে করেন। জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে অশ্বিন জানায়, পান্থশালায় এক বিদেশী বণিক তার সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে এই হারটি উপহার স্বরূপ দান করেছিলেন। বণিকের নাম চতুর্ভুজ, তিনি কলিঙ্গের অধিবাসী, পেশায় তৈজস ব্যবসায়ী; পান্থশালার অধিকর্তা্র কাছ থেকে জানা যায়, বণিক সত্যই পক্ষকাল অতিথি ছিলেন তার আলয়ে, সেসময়ে অশ্বিন তাঁর সেবার দায়িত্বে ছিল। অশ্বিন একজন দক্ষ কর্মচারী, সেকারণেই মানী অতথিদের দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়ে থাকে সে, সেবায় তুষ্ট হয়ে উপহার ও পারিতোষিক দেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা, তবে চতুর্ভুজ মনিহার উপহার দিয়েছিলেন কিনা, সেব্যাপারে পান্থশালাপতি কিছু জানেন না। এরপরে, কার্যালয়ে অশ্বিনকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন পুষ্পকেতু।

‘শ্রেষ্ঠী চুতুর্ভুজ খুশি হয়ে ওই মূল্যবান কণ্ঠহার দিলেন?’

‘হ্যাঁ প্রভু।’

‘এর পূর্বে এ জাতীয় উপহার পেয়েছ কখনও?’

‘উপহার পেয়েছি ছোটখাটো, তবে সেগুলি এত মূল্যবান কিছু নয়।’

‘তোমার মনে বিস্ময় জাগে নি শ্রেষ্ঠীর এরূপ আচরণে?’

‘বিস্মিত হয়েছিলাম প্রভু, কিন্তু এখানে এসে অবধি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি, উদরপীড়া, দাস্ত; আমি স্বহস্তে শুশ্রুষা করেছিলাম তাঁর, হয়তো সেকারণেই এই কৃপা। তিনি ধনবান ব্যক্তি।’

‘শুধু ধনবান নয়, হৃদয়বানও বটে; শুশ্রুষায় তুষ্ট হয়ে অর্থমূল্যে কৃতজ্ঞতা জানানোই স্বাভাবিক ছিল না কি? তুমি দরিদ্র, রত্নহারের চেয়ে মুদ্রা অধিক উপযোগী হোত।’

‘শ্রেষ্ঠী কি ভেবেছিলেন, আমি তা কিরূপে বলি প্রভু?’

‘তোমার একবারও মনে হয়নি, মালাটি বিক্রয় করতে গেলে বিপদে পড়তে পারো?’

‘না, আমার মনে পাপ নেই , সেকারণেই হয়নি।’

‘শ্রেষ্ঠী পাটলীপুত্র ত্যাগ করেছেন দশদিন পূর্বে, এতদিন বাদে হার বিক্রয়ে উদ্যোগী হলে কেন?’ এর উত্তরে চুপ করে থাকে অশ্বিন।

‘আমি যদি বলি, তুমি অপেক্ষায় ছিলে, শ্রেষ্ঠী দূরান্তে পাড়ি দিলে তোমার বাক্যের সত্যতা পরীক্ষার অবকাশ থাকবে না।’এতক্ষণে কুমারের স্বরে কাঠিন্য ফুটে ওঠে।

‘এ আপনি কি বলছেন প্রভু!’

‘বিস্মিত হবার ভান কোরনা অশ্বিন! মনিহারটির মারকত মণিগুলি মিশরীয় ছাঁদে কাটা, গহনাটি সেদেশে তৈয়ার হয়েছে নিঃসন্দেহে। এত মূল্যবান কণ্ঠহার, অনেক ধনবানের সংগ্রহেও থাকেনা, আর চতুর্ভুজ এরূপ দুর্লভ বস্তু তোমাকে পারিতোষিক দিলেন, আমাকে বিশ্বাস করতে বল সেকথা?’ গর্জে ওঠেন পুষ্পকেতু।

এর উত্তরে হাহাকারে ভেঙ্গে পড়ে আশ্বিন, কিন্তু নিজ বক্তব্যে অটল থাকে সে। আপাততঃ তাকে কারারূদ্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে পিতার সাথে আলোচনায় বসেন কুমার।

‘গহনার লোভে খুন করেছে অশ্বিন তুমি কি সেরকমই সন্দেহ করছ? সেক্ষেত্রে বারুণি পলায়ন করল কেন?’ বিশাখগুপ্তকে বিহবল দেখায়।

‘হতে পারে, বারুণির আগমনের পূর্বেই অশ্বিন হত্যা করেছিল শ্রীজয়াকে; বারুণি মৃতদেহ আবিষ্কার করে শঙ্কিত হয়ে পলায়ন করে। অভুক্ত মিষ্টান্নের থালিকা হয়তো চঞ্চলাই রেখেছিল শয়নকক্ষে, বারুণিকে দোষী সাব্যস্ত করতে।’

‘এক সামান্যা দাসীর এত বুদ্ধি হবে?’

‘দাসীর না হোক, পান্থশালার অভিজ্ঞ সেবকের সে বুদ্ধি থাকাই স্বাভাবিক। হারটি কখনও অশ্বিন সহজপথে লাভ করেনি, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’

‘কিন্তু এই হারটি যে শ্রীজয়ার, সেপ্রমাণও তো মেলেনি। চঞ্চলা, ভূজঙ্গ, সুদত্ত এবং বসুদত্ত, সকলেই এই হার পূর্বে দেখেনি বলে জানিয়েছে।’

‘এবিষয়ে বেশ কয়েকটি সম্ভাবনার কথা ভেবেছি আমি। বসুদত্তের অবর্তমানে কোনও গোপন প্রণয়ী হারটি উপহার দিয়ে থাকলে, বসুদত্ত সেকথা জানবেননা। সে গোপন প্রণয়ী বারুণি হতেই পারে, নটী সুরসেনীর আনুকুল্যে এই রত্নহার তার কাছে সুলভ হয়ে থাকবে। তবে, বারুণি ছাড়া অন্য কেউও দিয়ে থাকতে পারে এই হার। সুদত্ত বয়সে যুবক, সুদর্শন, অর্থবান, শ্রীজয়ার প্রতি তাঁরও আসক্তি থাকা সম্ভব, মনিহার সংগ্রহের সুযোগ ও সামর্থ দুইই তাঁর ছিল। সুদত্ত পত্নী যে শ্রীজয়ার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেননা, এথেকেই প্রমান হয়, দেবর-ভাতৃজায়ার সম্পর্ক নিয়ে তাঁর মনে সন্দেহের অবকাশ ছিল।

হত্যাটি যদি অশ্বিনই ঘটিয়ে থাকে, তবে খুব সম্ভব হারটি ওইদিনই শ্রীজয়াকে কেউ উপহার দিয়েছিল। মণিহারের অনুপম সৌন্দর্যের ব্যাখ্যান চঞ্চলাই করে থাকবে তার স্বামীর কাছে সেদিন সায়াহ্নে। আর তারপরেই, লোভের বশবর্তী হয়ে এই হত্যা। হয়তো বারুণির আচমকা আগমনে তার উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে চঞ্চলা অশ্বিনের পরামর্শে।’

‘কিন্তু এ সকলি তো তোমার অনুমান কেতু, প্রমাণ করবে কিরূপে?’ বিশাখগুপ্তকে চিন্তিত দেখায়।

‘আমাকে কয়েকদিন সময় দিন পিতা, আমার মন বলছে, সত্যের সন্ধান মিলবেই।’

***

পরদিন কণ্ঠহারটি ধর্মদাস সুরসেনীর কাছে নিয়ে যান, সুরসেনী সেটিকে কখনও দেখেনি বলে জানায়। সে সত্যই হার বিষয়ে কিছু জানে না অথবা হত্যার সাথে দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে অস্বীকার করছে, এব্যাপারে সংশয় থেকেই যায়।

‘জ্যেষ্ঠানীর সাথে আপনার সম্পর্ক কিরূপ ছিল?’ উপলাকে তাঁর গৃহের একান্তে প্রশ্ন করেন পুষ্পকেতু।

‘তেমন বিশেষ সখিত্ব কিছু ছিল না।’

‘কিন্তু কেন? আপনারা তো সমবয়সী, নিকট আত্মীয়া, অন্তরঙ্গতা থাকাই স্বাভাবিক ছিল না কি?’

‘তিনি নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, অপর নারীর বন্ধুতায় আগ্রহী ছিলেননা।’

‘আর অপর পুরুষের?’ কুমারের এই প্রশ্নে চমকে ওঠেন উপলা, ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর মুখ।

‘এপ্রশ্নের উত্তরে আমি কি বলব, আপনারাই অনুসন্ধান করে জেনেছেন সকল কথা।’

‘হ্যাঁ বারুণির কথা জেনেছি সত্য, কিন্তু আরও বেশী কিছু জানবার আশায় এসেছি আপনার কাছে। ভালো কথা, রত্নহারটি একবার পরীক্ষা করে দেখুন তো, পূর্বে দেখেছেন কি এটি? আমার সন্দেহ শ্রীজয়াকে উপহার দিয়েছিল কেউ এ হার, তবে সে বারুণি নয়’, হারটি উপলার সমুখে তুলে ধরে অর্থপূর্ণ ভাবে তাকান পুষ্পকেতু। দীর্ঘক্ষণ গহনাটির দিকে চেয়ে থাকেন উপলা, তাঁর মুখের ভাব কঠিন হয়ে ওঠে ক্রমে।

‘যে নারী গহনা ও স্বাচ্ছন্দের লোভে পিতৃতুল্য পুরুষকে প্রলুব্ধ করে বিবাহ করে, তার কাছে কোনও পুরুষই নিরাপদ নয়। এর বেশী আমার আর কিছু বলার নেই; এখন আমাকে একটু একলা থাকতে দিন আর্য।’ কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসে উপলার, পুষ্পকেতু নীরবে বিদায় নেন সেখান থেকে।

‘এই ভাণ্ডার গৃহে আপনি কতদিন কর্ম করছেন?’ বসুদত্তের অধীনস্থ কর্মী প্রবীণ বিটঙ্ককে প্রশ্ন করছেন পুষ্পকেতু, সাথে আছেন মিত্র উল্মুক। কথাবার্তা চলছে ভাণ্ডার গৃহের কার্যালয়ে, শ্রেষ্ঠী বসুদত্তের অনুপস্থিতিতে বিটঙ্কই কার্য নির্বাহ করছেন সেখানে।

‘কয়েকযুগ ধরেই আমি প্রভু বসুদত্তের অন্নদাস, তাঁর পিতা আমাকে কর্ম দিয়েছিলেন সেই তরুণ বয়সে।’

‘সেক্ষেত্রে, ব্যবসায় বিষয়ে আপনিই শ্রেষ্ঠীর ঘনিষ্ঠতম সহায়ক, তাঁর কোনও শত্রু আছে কিনা বলতে পারেন?’

‘ব্যবসায়িক শত্রুতা থাকলেও ব্যক্তিগত অনিষ্ট করার মত কাউকে মনে পড়ছে না। প্রভু অত্যন্ত সদাশয় ব্যক্তি, জ্ঞানে- অজ্ঞানে কারোকে আঘাত করার মানুষ নন তিনি। চিরকাল নিজ সুখের চিন্তা বর্জন করে পরিবার পালন করেছেন, প্রৌঢ় বয়সে এসে সংসারী হয়েছিলেন অবশেষে; সে সুখও কপালে সইল না।’ কথাকটি বলে চোখ মোছেন প্রভুভক্ত কর্মচারী।

‘বসুদত্তের ব্যবসায়িক অবস্থা কিরূপ?’

‘প্রভু, লক্ষীর বরপুত্র, অত্যন্ত সফল ব্যবসায়ী। বিশেষতঃ এবারের বাণিজ্যে প্রভূত ধনলাভ ঘটেছে, অথচ, দেখুন গৃহলক্ষীই গত হলেন।’

বিটঙ্কের কাছে বিদায় নিয়ে ঋভুকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অতিথিশালায় যান পুষ্পকেতু, ঋভু সেসময় সেখানেই ব্যস্ত ছিল। অতিথিশালার বহির্কক্ষটিতে বার্তালাপ শুরু হয়।

‘কতদিন কর্ম করছ এখানে?’

‘ছোটকাল থেকেই আছি, পিতাও এখানেই কর্ম করতেন।’

‘অতিথিশালায় কি প্রায়ই অতিথির আগমন ঘটে?’

‘হ্যাঁ, প্রভুর পাটলীপুত্রে অবস্থানকালে প্রায়ই অতিথি সমাগম হয়; বেশিরভাগই তাঁর বন্ধু স্থানীয় শ্রেষ্ঠী।’

‘সম্মানিত অতিথিদের গৃহে আতিথ্য না দিয়ে এখানে রাখেন কেন বসুদত্ত?’

‘সে বিষয়ে তো কিছু জানিনা দেব; তবে সচরাচর গৃহে কাউকে নিয়ে যেতে পছন্দ করেননা তিনি।’

‘এই ভাদ্রে যেদিন তিনি ফিরলেন, তাঁর আগমনবার্তা কে নিয়ে গিয়েছিল গৃহে?’

‘সংবাদ আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম দেব, তবে প্রভু সুদত্তের সাথে সাক্ষাৎ হয় গৃহের সমুখে, তখন তাঁকেই বার্তা দেই, আর ভূজঙ্গের সাহায্যে অশ্বশাল থেকে প্রভুর অশ্বটিকে তৈয়ার করে বন্দরে নিয়ে আসি।’

‘সুদত্ত সংবাদ পাবার পূর্বেই ভ্রাতার গৃহে চলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ, আমাকে দেখে কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হন তিনি, পরে সকল কথা শুনে, অশ্ব নিয়ে বন্দরে ফিরতে নির্দেশ দেন; গৃহস্বামিনীকে বার্তা তিনিই দিয়ে দেবেন বলে জানান।’

‘সে রাত্রে গৃহে ফেরার কোনও উদ্যোগ নেননি শ্রেষ্ঠী?’

‘হয়তো, সম্ভব হলে গৃহে ফেরার ইচ্ছে ছিল, সেকারণেই অশ্বটিকে আনিয়ে রেখেছিলেন পূর্বাহ্নেই। কিন্তু আগত পণ্যের বন্দোবস্ত করতেই দিন গত হল, সূর্যাস্তের পশ্চাতে তোরণদ্বার বন্ধ হয়ে যায়, তখন কিরূপে গৃহে যাবেন? আমাকে বললেন অশ্বটিকে অতিথিশালের আস্তাবলে বেঁধে রাখতে, পরদিন মধ্যাহ্নে, সব কাজ সাঙ্গ করে গৃহে ফিরবেন তিনি।’

‘সবই নিয়তি হে, বসুদত্ত যদি সময়মত গৃহে ফিরতে পারতেন সেদিন সন্ধ্যায়, হয়তো শ্রীজয়া রক্ষা পেতো’ নগরীতে ফেরার কালে উল্মুক মন্তব্য করেন।

‘তা ঠিক, কিন্তু একটা কথা জানা গেলো, সেদিন সুদত্ত ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যেই শ্রীজয়ার কাছে গিয়েছিলেন, জ্যেষ্ঠের আগমনবার্তা দিতে নয়।’

‘তুমি কি মনে কর, মনিহার দিতেই গিয়েছিল সে?’

‘অসম্ভব নয়!’ পুষ্পকেতু অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দেন।

‘বসুদত্ত ব্যক্তিটি সন্দেহপ্রবণ, তরুণী ভার্যাকে পরিচিত মহল থেকে দূরে রাখতে চাইতেন। অথচ, যুবক বারুণিকে গৃহে প্রবাশাধিকার দিতে বাধেনি; এটা আশ্চর্যের নয়?’

‘মনুষ্য চরিত্র বোঝা কঠিন বন্ধু; আমার ধারণা বারুণির প্রতি তিনি অপত্যস্নেহ পোষন করতেন, সঠিক সময়ে সংসারী হলে তার বয়সী পুত্র থাকা অসম্ভব ছিল না প্রৌঢ়ের। সেকারণেই তার দিক থেকে কোনও আশঙ্কার চিন্তা মনে আসেনি তাঁর।’

‘একটা কথা ভাবছি কেতু, বারুণি রাতের আঁধারে নগরী ত্যাগ করল কি উপায়ে? রাত্রে তোরণ দ্বার বন্ধ থাকে।’

‘একটি সম্ভাবনা হল, সে তোরণের কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে অপেক্ষায় ছিল, ভোর হতে দ্বার খোলা পেয়ে নগরী ত্যাগ করেছে। নতুবা, তার কাছে বিশেষ ছাড়পত্র আছে, সেটির বলে রাত্রেই পদব্রজে তোরণ পার হয়েছে সে। স্থপতি বজ্রপাণির অধীনস্থ কারুশিল্পী, উপরন্তু সুরসেনীর প্রেমিক; এদের দুজনের কেউই ছাড়পত্রের ব্যবস্থা করিয়ে থাকতে পারে তার জন্য। একবার তোরণ প্রহরীদের সাথে সাক্ষাৎ করা প্রয়োজন এব্যাপারে।’ চিন্তিত মুখে কথাগুলি বলেন পুষ্পকেতু, এরপর আর কথা এগোয় না, নীরবে অশ্বপৃষ্ঠে বাকি পথ সাঙ্গ করেন দুই বন্ধু।

***

সেদিন অপরাহ্নে তোরণ প্রতিহারির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করেন কুমার একাকী, প্রতিহারির সাহায্যে সেখানকার ভাদ্রমাসের দিনপুস্তটি পরীক্ষা করেন তিনি। রাত্রে ছাড়পত্রের সাহায্যে তোরণের ক্ষুদ্রদ্বার অতিক্রম করতে হলে, ওই দিনপুস্তে প্রহরী যাত্রীর নাম ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করে। পরীক্ষা শেষে নীরবে স্থান ত্যাগ করেন পুষ্পকেতু, রহস্য ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে সন্দেহ থাকেনা।

দুই দিন পরে বারুণির সংবাদ নিয়ে আসেন ধর্মদাস; নিজ পরিচয় গোপন রাখতে রাজপথ এড়িয়ে বনবীথি ও গ্রাম্য পথ বেয়ে পদব্রজে যাত্রা করেছিল সে উজ্জ্বয়িনীর পথে। কিন্তু পথে অনাহার ও অনিদ্রায় অসুস্থ হয়ে পড়ায়, বোধ করি প্রাণের মায়ায় রাজপথের একটি জলসত্রের কাছাকাছি গিয়ে সংজ্ঞা হারায় সে। এক বণিক দয়া পরবশ হয়ে তাকে জলসত্রের ভিতরে নিয়ে যান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সেখান থেকেই তার পরিচয় প্রকাশ পায় ও নিকটবর্তী দণ্ডাধিকারিক সংবাদ পাঠান পাটলীপুত্রে।

***

বারুণিকে আনা হয়েছে পাটলীপুত্রে, মহাদণ্ডনায়কের কার্যালয়ে; তার শীর্ণ রোগক্লিষ্ট চেহারা দেখে পূর্বের সুদর্শন যুবককে কল্পনা করতে কষ্ট হয়। স্বাস্থের সাথে তার মনবলও ভেঙ্গে পড়েছে সম্পূর্ণ ভাবে, আধিকারিকদের যে কোনো প্রশ্নের উত্তরেই কেবল ক্রন্দন করে চলেছে সে। পুষ্পকেতুর অনুরোধে তার জন্য উত্তম খাদ্য ও বিশ্রামের সুযোগ করে দেন বিশাখগুপ্ত; কয়েকদিন বিশ্রামের পশ্চাতে বিচারসভা বসে কার্যালয়ে।

বিচারসভার মধ্যমণি দণ্ডনায়ক বিশাখগুপ্ত, যদিও দোষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন কুমার পুষ্পকেতু। সভাস্থলে উপস্থিত রয়েছেন ধর্মদাস, চিত্রক সহ কয়েকজন বিশিষ্ট আধিকারিক; উল্মুকও দর্শকাসনে রয়েছেন একপাশে। এছাড়া রয়েছেন বসুদত্ত, সুদত্ত; সাক্ষ্যদানের উদ্দেশ্যে ডাকা হয়েছে ভূজঙ্গ ও চঞ্চলাকে। চঞ্চলার পূর্বের শ্রী আর নেই, তার চোখে মুখে নিদারুন আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। অভিযুক্ত দুইজন, বারুণি ও অশ্বিন, কারাগার থেকে একসাথেই আনা হয় তাদের সভাস্থলে।

‘অশ্বিন, শেষবারের মত জিজ্ঞাসা করছি, মনিহারটি কোথায় পেলে তুমি? সত্য গোপন করায় অশেষ দুর্ভোগ, এখনও সেকথা বুঝে না থাকলে পরিণাম কঠিন হবে তোমার।’ গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন শুরু করেন পুষ্পকেতু। অশ্বিন চুপ করে থাকে উত্তরে, তবে তার চোখে মুখে দ্বিধা ফুটে ওঠে।

‘বারুণির আগমনের পূর্বেই হত্যা করেছিলে গৃহস্বামিনীকে? চঞ্চলা সাথে ছিল, না একা কার্যসিদ্ধ করেছিলে?’ এবারের প্রশ্ন শুনে দুই বন্দীই চমকে ওঠে নিদারুণ ভাবে। অভিযোগ অস্বীকার করে হাহাকারে ভেঙ্গে পড়ে অশ্বিন, আর বারুণি বিহ্বল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে।

‘বেশ, মেনে নিলাম হত্যা তুমি করোনি, হত্যা করেছে বারুণি, কিন্তু মনিহার কি হত্যার পশ্চাতে নিয়েছিলে না পূর্বেই?’

কিছুটা সময় নিয়ে মনস্থির করে অশ্বিন ও তারপরে সে যা জানায় তা এই প্রকার।

দুর্ঘটনার পরদিন যথারীতি ভোর হতে কর্মস্থলে ফিরে গিয়েছিল সে, কিন্তু বেলা বাড়তে হত্যার সংবাদ কানে আসে; চঞ্চলা বিপদে আছে অনুমান করে পরদিন রাত্রেও সে ফিরে আসে আবার। সেসময় চঞ্চলা তাকে মনিহারটি দেখায়, সেটি সে মৃতদেহ থেকে কিছু দূরে দ্বারের পিছনে একটি রেশম থলিকায় কুড়িয়ে পেয়েছিল, যখন ভূজঙ্গ সুদত্তকে ডাকতে যায়। এই অসামান্য গহনাটি যে শ্রীজয়ার সম্ভারের নবতম সংযোজন, গোপন উপহার, সেকথা বুঝতে পেরে লোভ মাথা চাড়া দেয়, চঞ্চলা হস্তগত করে সেটি। অশ্বিন প্রথমে ভীত হয়ে গহনাটি পরিত্যাগ করতে বলে চঞ্চলাকে, কিন্তু অবশেষে লোভের কাছে পরাজিত হয় এবং কিছুকাল অপেক্ষা করে সেটি বিক্রয়ের চেষ্টা করে। মনিহার যে বিদেশ থেকে লব্ধ এবং অতি দুর্মূল্য, সেকথা বুঝতে পারেনি অশ্বিন, আর তাতেই এই বিপত্তি।

‘এবার তুমি বল, শ্রেষ্ঠাণীকে হত্যা করলে কিভাবে?’ বারুণির দিকে প্রশ্নবান ছুঁড়ে দেন পুষ্পকেতু। বারুণি অস্বীকার করেনা এই অভিযোগ, বরং নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে ধীরস্বরে বর্ণনা করে সেদিনকার ঘটনা।

‘শ্রেষ্ঠীর অনুপস্থিতিতে তাঁর গৃহে যাতায়াত ছিল আমার, প্রথম প্রথম আমি আগ্রহী ছিলাম না, প্রভু অনেক করেছেন আমার জন্য, তাঁর সাথে তঞ্চকতা করতে ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু শ্রীজয়া সর্বশক্তি দিয়ে আকর্ষণ করেছিল আমায়, ক্রমশঃ নির্বল হয়ে আত্মসমর্পন করি আমি তার আবেগের কাছে। দুর্ঘটনার দিন শ্রেষ্ঠীগৃহে যাব পূর্ব থেকে স্থির ছিল, সেইমত সায়াহ্নকালে উপস্থিত হই আমি যথারীতি; গিয়ে শুনি শ্রেষ্ঠী বন্দরে প্রত্যাবর্তন করেছেন, গৃহে ফিরবেন পরদিন। শুরু থেকেই সেদিন শ্রীজয়ার মনভাব ছিল অভিমানপূর্ণ, একেলা জীবন, বৃদ্ধ স্বামী, এসকল কিছু নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল সে। বেশ কিছুদিন থেকেই আমাকে উদ্বুদ্ধ করছিল সে, তাকে সঙ্গী করে দূরদেশে পলায়নের জন্য; আমি রাজী হতে চাইনি। ওইদিনও সেই প্রসঙ্গে আবার আলোচনা শুরু করে শ্রীজয়া, আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি, সে মানতে চায়না। অবশেষে, সে অনুযোগ করে সুরসেনীর কারণেই আমি তার প্রস্তাবে রাজী নই; এ অভিযোগ আমি অস্বীকার করি। এ নিয়ে তর্ক চলতে থাকে এবং ক্রমে তা কলহের রূপ নেয়। শ্রীজয়ার অবিশ্রান্ত অনুযোগে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ি আমি, ততক্ষণে রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর গতপ্রায়, আমি বিদায় নিতে চাই। শ্রীজয়া ক্রুদ্ধ হয়ে আমার পথ আটকাতে চায়, নানা কটুবাক্যে জর্জরিত করে সে আমাকে, আমিও ধৈর্য হারিয়ে তাকে সবলে পরিসারিত করি। আঘাত সামলাতে না পেরে দেওয়ালে আছড়ে পড়ে সে, আর সেইসঙ্গে দেওয়ালে সংযুক্ত হস্তিমুখে সজোরে বিদ্ধ হয় তার মস্তক। রক্তাক্ত হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে শ্রীজয়া নিষ্প্রাণ মূর্তির মত, আমি তাকে উজ্জিবীত করার চেষ্টা করি কয়েকবার, কিন্তু ফল হয়না কোনও। তখন প্রবল ভয় ও আশঙ্কায় বিভ্রান্ত হয়ে দ্রূত স্থান ত্যাগ করি; সেসময় পলায়ন ছাড়া আর কোনও উপায়ের কথা ভাবতে পারিনি। অন্ধকারে তস্করের মত নিজগৃহে ফিরে যা কিছু সম্বল একত্র করে পিছন দ্বার দিয়ে প্রস্থান করি; নগর তোরণ থেকে কিছু দূরে একটি বটবৃক্ষের আড়ালে রাত্রিযাপন করে ভোর হতে নগরী পরিত্যাগ করি এরপর। বাকি ইতিহাস সবই আপনারা জানেন।’ কথাগুলি বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বারুণি, যেন তার শেষ শক্তিটুকুও নিঃশেষিত হয়েছে এই স্বীকারোক্তি কালে। বক্তব্য শুনতে শুনতে বসুদত্তের চক্ষু শ্বাপদের মত জ্বলে ওঠে পত্নীর অপমানে, সুদত্তের মুখও অসম্মান ও ক্রোধে জলদগম্ভীর।

‘আশঙ্কা যতই তীব্র হোক, শ্রেষ্ঠাণীর মূল্যবান গহনা অপসারণ করতে ভুল হয়নি, কি বল?’ পুষ্পকেতু বারুণির প্রতি ব্যঙ্গোক্তি করে ওঠেন।

‘গহনা? কই নাতো? বিশ্বাস করুন আর্য, আমি কোনও গহনা চুরি করিনি। আমি কৃতঘ্ন, পাপী, কিন্তু তস্কর নই।’

‘তাহলে তোমার মতে, মস্তকে আঘাত নিয়ে ভূপতিত হন শ্রীজয়া, তাঁর মৃত্যু হয়েছে ধরে নিয়ে তুমি স্থান ত্যাগ কর এই তো?’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ এ যে নিছক দুর্ঘটনা, সেকথা কেউ মানবে না আমি জানতাম। আপনিও মানতে পারছেন না আর্য।’ প্রত্যুত্তোরের সময় করুণ হাসি দেখা দেয় বারুণির মুখে, চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে দুফোঁটা অশ্রু।

‘আমি জানি তুমি সত্যকথন করেছ বারুণি’, পুষ্পকেতুর এই মন্তব্যে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয় সমগ্র সভাস্থল।

‘এ তুমি কি বলছ কেতু?’ বিশাখগুপ্ত বিরোধিতা করেন।

‘শ্রীজয়ার হত্যা মস্তকের আঘাত থেকে হয়নি দেব, তার হত্যাকারী বারুণি নয়। যে মারকত হার উপহার এনেছিল, প্রকৃত হত্যাকারী সে।’

‘কিন্তু, অমূল্য গহনা উপহার এনে, শ্রেষ্ঠাণীর গায়ের গহনা চুরি করে, এ কিরূপ হত্যাকারী?’ বিশাখগুপ্ত বিভ্রান্ত বোধ করেন, পুত্রের এই হেঁয়ালিপূর্ণ বাক্যালাপে অস্বচ্ছন্দ দেখায় তাঁকে।

‘শ্রীজয়াকে হত্যা করেছেন তার স্বামী বসুদত্ত, গহনা চুরি দণ্ডাধিকারিকের চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা মাত্র। মারকত হারটি তিনি সম্ভবত কোনও রোমক বণিকের থেকে সংগ্রহ করেছিলেন ভৃগুকচ্ছে বসবাসকালে। কথাটা ঠিক বলেছি তো ভদ্র?’ এবার বসুদত্তের পানে চেয়ে ব্যাখ্যা করেন কুমার।

‘রসনা সংযত করুন আর্য, জ্যেষ্ঠ একজন বিশিষ্ট বণিক, পাটলীপুত্রের বৈশ্য সমিতির অন্যতম প্রধান! তাছাড়া, তিনি সেরাত্রে বন্দরে ছিলেন, আমরা সকলেই জানি সেকথা।’ গর্জে ওঠেন সুদত্ত।

‘না তিনি সেরাত্রে পদব্রজে গৃহে এসেছিলেন, তোরণ প্রতিহারির দিনপুস্ত সাক্ষ্য দেবে এ ঘটনার। বারুণিকে গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে দেখেন শ্রেষ্ঠী, কিন্তু অন্ধকারে চিনতে পারেননি। দরজা খোলা থাকায়, নিঃশব্দেই প্রবেশ করতে পেরেছিলেন তিনি। প্রথমে স্ত্রীকে ভূপতিত দেখে তস্করের কাজ মনে করে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শ্রেষ্ঠী, কিন্তু ততক্ষণে শ্রীজয়ার সংজ্ঞা ফিরতে শুরু করেছে, সম্ভবতঃ শ্রেষ্ঠীকে বারুণি জ্ঞান করে তিনি কিছু বলে থাকবেন। তাতেই জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয় তাঁর; ঈর্ষা ও ভীষণ ক্রোধে মত্ত হয়ে শ্বাসরূদ্ধ করে হত্যা করেন নিজ গৃহিণীকে। এই গোলমালে, কোমরবন্ধে রাখা থলিকাবদ্ধ হারটি ছিটকে পড়ে যায় তাঁর অজান্তে। গায়ের গহনাগুলি খুলে নিয়ে গিয়ে সম্ভবত গঙ্গা বক্ষে বিসর্জন দিয়েছিলেন, অবশ্য সঠিক রূপে সবকথা ভদ্রই বলতে পারবেন।’

পুষ্পকেতুর বক্তব্যের পশ্চাতে সুদত্ত প্রতিবাদ করতে উঠে দাঁড়ান, কিন্তু বসুদত্ত নিরস্ত করেন তাঁকে, এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন তিনি বিচার পতির সমুখে।

‘সেদিন দীর্ঘ তিনমাস প্রবাসে যাপনের পশ্চাতে দেশে ফিরেছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গৃহে ফিরতে উদ্গ্রীব ছিল মন; শ্রীজয়া……, আমার হৃদয় জুড়ে বিরাজ করত সে সর্বক্ষণ। লোকে বলবে বৃদ্ধ বয়সের মতিভ্রম, কিন্তু জীবনে প্রথমবার সত্যকার প্রেমের আস্বাদ পেয়েছিলাম তার কাছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুটা সময় নেন শ্রেষ্ঠী, তারপর পুনরায় শুরু করেন নিজের বক্তব্য।

‘ভৃগুকচ্ছে, একখানি দুর্লভ রত্নহার খরিদ করেছিলাম তার জন্যে, সেটি পেয়ে তার মুখে যে অনাবল হাসি ফুটে উঠবে, আর দীর্ঘ অদর্শনের অভিমান ঘুচে মধুর হবে মিলনক্ষণ, কতভাবে কল্পনা করেছি সেদৃশ্য। সেকারণেই, রাত্রির আহার সমাধা হতে নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি, সায়াহ্নের অন্ধকারেই পদব্রজে রওয়ানা দিয়েছিলাম গৃহের পথে। ছাড়পত্র থাকায় অসুবিধা তো কিছু ছিল না, চন্দ্রমার আলোক, ভাদ্রের মৃদু মলয়, পরিবেশ পথ চলার অনুকুল ছিল। গৃহের সমুখে পৌঁছিয়েছি তখন রাত্রি গভীর, হঠাতই কে যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো দ্বার খুলে, আর নিমেষেই মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে; দেখে বলিষ্ঠ যুবা বলে বোধ হয়েছিল, তস্কর নয়তো বুকে কেঁপে উঠল আমার, গৃহিনী একা রয়েছেন কক্ষে। আমি দ্রুত উপরে ছুটে যাই তার সন্ধানে, গিয়ে দেখি রক্তাক্ত শরীরে মাটিতে লুটিয়ে আছে সে, সংজ্ঞাহীনা। দিশেহারা হয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি, ধীরে ধীরে চোখ খুলে চায় সে; আর তারপর আমার মুখের পানে চেয়ে আকুতি করে ওঠে ‘বারুণি যেয়োনা, ছেড়ে যেয়োনা আমায়!’ আকুল হয়ে আমার উত্তরীয় চেপে ধরতে চায় সে, তার চোখের দৃষ্টি তখনো ঘোলাটে। মূহুর্তে এক প্রলয় ঘটে গেলো আমার সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীতে; কক্ষের জ্বলন্ত প্রদীপ, অবিন্যস্ত শয্যা, শ্রীজয়ার অবিন্যস্ত বেশবাস, আমার ভিতরকার পশুকে জাগিয়ে দিল পলকে নির্মম ঈর্ষায়। যেহাতে কণ্ঠহার পরাতে চেয়েছিলাম পরম স্নেহে, সেই হাত দিয়েই পিষে ধরেছিলাম তার কোমল গ্রীবা অন্ধ আবেগে, খানিক ছটফট করে নেতিয়ে পড়েছিল সে আমারই কোলে। সেসময়, বাস্তববুদ্ধি ফিরে আসে আমার, নিজেকে বাঁচাতে তার গায়ের গহনা খুলে সঙ্গে নিই, যাতে হত্যাটি তস্করের কার্য বলে প্রমাণ হয়; সর্বনাশী কুলটার জন্য নিজ জীবন বিপন্ন করার ইচ্ছা আমার ছিল না। কুমার ঠিকই বলেছেন, সে গহনা আমি গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিয়েছিলাম বন্দরে ফেরার কালে। তবে রত্নহারটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম গোলমালে, সেটি যে অদৃশ্য হয়েছে আমার কোমরবন্ধ থেকে, সেরাত্রে তা বুঝিনি।

হত্যার অপরাধ আজ নিজমুখে স্বীকার করছি আমি, শুধু একখানি আবেদন মহাদণ্ডনায়কের কাছে, বারুণিকে আপনি মুক্তি দিন, সে তার অপরাধের শাস্তি পেয়েছে।’ বসুদত্তের কণ্ঠস্বর হতাশায় ভঙ্গুর শোনায়; সমগ্র সভাস্থল স্তব্ধ হয়ে থাকে অবরূদ্ধ আবেগে।

বসুদত্তের আত্মসমর্পন ও বারুণির মুক্তির সাথে সভাভঙ্গ হয় সেদিনকার মত।

***

বিচারে বসুদত্তের প্রাণদণ্ড ও অশ্বিনের দুইবৎসর কারাদণ্ড ঘটেছে; চঞ্চলা নারী, সেকারণে কারাবাস হয়নি তার, কিন্তু পাটলীপুত্র ত্যাগ করতে হয়েছে তাকে, নগরে দাসীকর্ম জুটবে না তার আর।

‘শ্রেষ্ঠী যে স্ত্রীর হত্যাকারী এ ভাবনা মনে এলো কিভাবে?’ পুষ্পকেতুর সাথে গৃহের নিভৃত আলাপে প্রশ্ন করেন উল্মুক এক শীতের সকালে।

‘সে তো তুমি সাহায্য করলে তাই।’

‘আমি!’ উল্মুককে রীতিমত বিহ্বল দেখায়।

‘অবশ্য! তোমার কথাতেই তোরণদ্বারের দিনপুস্ত পরীক্ষার চিন্তা মাথায় আসে, আর সে থেকেই সমাধান ঘটল।’

‘বল কি হে! আমি যে এরূপ প্রতিভার খনি এতদিন জানতেই পারিনি!’ উল্মুকের পরিহাসে প্রাণখুলে হেসে ওঠেন দুজনেই। বাইরে অঘ্রানের নরম রোদে ঝলমল করে ওঠে প্রকৃতি।

*** ***

টিকা: দিনরাত মিলিয়ে আটটি প্রহর, রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরের শেষভাগ আনুমানিক রাত্রি দশটা থেকে এগারোটার সময়।

প্রার্জুন প্রদেশ গুপ্তযুগে মগধ সাম্রাজ্যের একটি ক্ষুদ্র অঙ্গরাজ্য যা বর্তমানের মধ্যপ্রদেশের কোনও একটি অঞ্চল।

পুষ্পকেতু কামদেবের এক নাম।

তল্লিকা – চাবি, মন্দুরা – নীচু ডিভান, উদবন্ধক – আলনা জাতীয় আসবাব, পরিসারিত করা – জোর করে সরিয়ে দেওয়া

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *