৪. ছায়াপথগুলোর মাঝখানে
নবম শ্রেণি শেষ করার পর এক গ্রীষ্মে, একদল বাচ্চার সঙ্গে আমি একটা ভ্যানে চড়ে বসি। নিউইয়র্ক শহর থেকে সোজা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মোজাভ মরুভূমির দিকে ৫৩ ঘণ্টা ড্রাইভ করি আমরা। আমাদের গন্তব্য ছিল ক্যাম্প ওরানিবর্গ। বিজ্ঞানমনস্ক খুদেদের জন্য এক মাসব্যাপী সময় কাটানোর মতো একটা জায়গা। এর নাম রাখা হয়েছে ডেনিশ জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহের নামানুসারে। পিতলের নকল নাকওয়ালা এক মেধাবী পর্যবেক্ষক ছিলেন তিনি। তার সম্পর্কে পরে আরও কথা বলব।
আমি এর আগেও আকাশ দেখেছি। আগেই বলেছি, নক্ষত্র আর গ্রহ নিয়ে গবেষণা করতে মেঘমুক্ত পরিষ্কার রাতে আমি রুনক্স অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠে যেতাম। কাজটা সহজ ছিল না। মাঝে মাঝে সঙ্গে নিতাম আমার ছোট বোনকে। আমার টেলিস্কোপের বিভিন্ন অংশ বহনে সহযোগিতা করত সে। তাই দেখে বেশ কয়েকবার পুলিশ ডাকেন আমাদের প্রতিবেশী। তার সন্দেহ হয়েছিল, কোনো চোর ছাদ থেকে তাদের ঘরে উঁকি দিচ্ছে।
রক্ষাকর্তা শনি গ্রহ
আমি যে একজন তরুণ জ্যোতির্বিদ, কোনো ক্রিমিনাল নই, সে কথা পুলিশ অফিসারকে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হতো। তার অংশ হিসেবে, রাতের আকাশ দেখার প্রস্তাব দিতাম তাদের। শনি গ্রহ সব সময় জনপ্রিয় বলে পরিচিত। খুব সুন্দর গ্রহ এটা। এ রকম পরিস্থিতিতে পড়লে আমাকে গ্রেপ্তার হওয়া থেকে বাঁচাতে সাহায্য করত গ্রহটা।
শহরের আকাশেও আমরা নক্ষত্র দেখতে পাই। তবে তার পরিমাণ গড়ে কয়েক ডজন। কিংবা হয়তো এক শ।
মোজাভ মরুভূমিতে গিয়ে মহাবিশ্বে আরও বেশি নক্ষত্রের ভিড় আবিষ্কার করলাম আমি। গোটা আকাশটা খচিত থাকত লাখ লাখ তারায়। সেটা ছিল অনেকটা আমার প্রথমবার প্লানেটারিয়াম শো দেখার মতো। কিন্তু দুটির মধ্যে পার্থক্য একটাই, এই দৃশ্যটা ছিল জলজ্যান্ত। একদম বাস্তব। পরের এক মাসে চাঁদ, বিভিন্ন গ্রহ, নক্ষত্রব্যবস্থা, ছায়াপথ এবং আরও অনেক কিছুর ছবি তুললাম আমি 1 কিন্তু এখনো সবকিছু দেখে শেষ করে উঠতে পারিনি। দৃশ্যমান মহাবিশ্ব বা বিশ্বজগতের যে অংশটুকু আমরা দেখতে পাই, তাতে হয়তো এক শ বিলিয়ন গ্যালাক্সি আছে। উজ্জ্বল, সুন্দর আর ঠাসাঠাসি নক্ষত্র ও গ্যালাক্সিতে রাতের আকাশ সজ্জিত। বিশ্বাস করা সহজ যে গ্যালাক্সির বাইরের কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু গ্যালাক্সিদের মাঝখানে এমন কিছু বস্তু আছে, যেগুলো শনাক্ত করা কঠিন। কে জানে, সে বস্তুগুলো হয়তো খোদ গ্যালাক্সির চেয়েও অনেক বেশি চমকপ্রদ।
গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের মাঝখানের বিস্তৃত এই অন্ধকারকে আমরা বলি ইন্টারগ্যালাকটিক স্পেস বা আন্তছায়াপথীয় স্থান (ইন্টার অর্থ মাঝখানে বা আন্ত)। একটু সময়ের জন্য কল্পনা করো যে তুমি হুট করে সেখানে চলে গেছ। আপাতত ভুলে যাও, সেখানে তুমি ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে মারা যেতে পারো। কিংবা শ্বাসরোধ হওয়ার সময় তোমার রক্তকোষ বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কার কথাও ভুলে যাও।
ভুলেও মনে কোরো না যে তুমি অচেতন হয়ে যাবে। কিংবা কোনো শিশুর ভয়াবহ অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়ার মতো তুমিও ফুলে উঠতে শুরু করবে।
এগুলো হলো সাধারণ বিপদ।
তুমি হয়তো সুপারডুপার উচ্চ শক্তির, দ্রুতগতির, চার্জিত অতিপারমাণবিক কণায় আক্রান্ত হবে। এই কণাদের বলা হয় মহাজাগতিক রশ্মি বা কসমিক রে। এই রশ্মি কোথা থেকে আসে বা কার মাধ্যমে ওই রশ্মি তাদের যাত্রা শুরু করে, তা-ও আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই কণার বেশির ভাগটাই হলো প্রোটন। আবার এরা আলোর কাছাকাছি গতিতে চলাচল করছে। একটামাত্র কসমিক রের কণা যে পরিমাণ শক্তি বহন করে, তা দিয়ে একটা গলফ বলকে যেকোনো জায়গা থেকে একটা গর্তে ফেলা সম্ভব। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আশঙ্কা কসমিক রে হয়তো নভোচারীদের ক্ষতি করে। তাই ওই সব রশ্মি আটকাতে নভোচারীদের স্পেসস্যুটের ডিজাইনে বিশেষ ধরনের শিল্ড বা নিরোধক রেখেছে এ সংস্থা।
আমরা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বলি কেন?
বিশ্বজগৎ নিয়ে গবেষণা করতে গেলে বিভিন্ন গ্যালাক্সির দিকে মনোযোগ দেওয়ার প্রবণতা আছে আমাদের। কারণ, গ্যালাক্সি আসলেই নজর কেড়ে নেওয়ার মতো। আমাদের নিজেদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের নাম মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি (বাংলা আকাশগঙ্গা ছায়াপথ)। এর আকৃতি সর্পিলাকার বা স্পাইরাল। পৃথিবীর রাতের আকাশে একে দেখে মনে হয় যেন দুধ ছলকে পড়েছে। সে কারণে এ ছায়াপথের নাম এমন। আসলে গ্যালাক্সি শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ গ্যালাক্সিয়াস (Galaxias) থেকে, যার অর্থ মিল্কি বা দুধেল।
হ্যাঁ, আন্তছায়াপথীয় স্থান হলো এমন এক জায়গা, যেখানে এসব কর্মকাণ্ড আছে এবং চিরকাল থাকবে।
*
বিজ্ঞানীদের কাছে যদি উন্নত মানের টেলিস্কোপ না থাকত, তাহলে আমরা হয়তো এখনো ঘোষণা করে বসতাম যে গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানের জায়গাগুলো খালি। উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং প্রলেপলেপা, দুধেল গ্যালাক্সিগুলো রাতের আকাশে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। সেগুলোতে এত বেশি রহস্য লুকিয়ে আছে যে অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টদের কয়েক শতাব্দী ব্যস্ত রাখার জন্য তা যথেষ্ট।
কিন্তু আমরা আগেই আলোচনা করেছি, আলো বিভিন্ন রূপে আসে। আলোর দৃশ্যমান রূপের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু আলো অদৃশ্যও হতে পারে। চিকিৎসায় ও হাসপাতালে এক্স-রে ব্যবহার করে তোমার চামড়া ভেদ করে উঁকি দিয়ে দেখা হয় কোনো দুর্ঘটনায় তোমার হাড় ভেঙেছে কি না। সেটাও আসলে এক ধরনের আলো। কাজেই মহাবিশ্বের বহুদূরের কোনো জায়গা থেকে ধেয়ে আসা মাইক্রোওয়েভ বিশ্বজগতের জন্মরহস্যের পেছনের ব্লুর জোগান দেয়। এমনকি আমরা ওয়াই-ফাই থেকে যে রেডিও ওয়েভ পাই, সেটাও দৃশ্যমান আলোর দূরবর্তী, নিম্নশক্তির জাতভাই। এসব অদৃশ্য আলোয় আমাদের চারপাশ প্লাবিত হচ্ছে এবং আমাদের চারপাশের বিশ্বজগৎ এরা রাঙিয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন রঙে।
আধুনিক ডিটেক্টর ও অনুসন্ধানী নভোযান ব্যবহার করে আলোর এই অদৃশ্য রূপ নিয়ে গবেষণা করা যায়। এসব আলো আমাদের এমন সব মহাজাগতিক ঘটনার সন্ধান দেয়, যেগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। আমরা এসব ডিটেক্টর বা শনাক্তকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বিভিন্ন মহাজাগতিক পল্লি এলাকায় অনুসন্ধান চালাই।
এর মাধ্যমে উন্মোচিত হয় মহাকাশের চমৎকার অস্বাভাবিক বা অদ্ভুত ঘটনা।
এবার আমার প্রিয় এ রকম কিছু ঘটনার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই।
বামন ছায়াপথ
মহাকাশের কোনো একটা এলাকায় বড় একটি ছায়াপথের বিপরীতে ১০টি ছোট ছায়াপথ থাকতে পারে। এদের বলা হয় বামন ছায়াপথ বা ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি। আমাদের নিজেদের মিল্কিওয়ের আশপাশে ডজনখানেক বামন ছায়াপথ আছে। একটা স্বাভাবিক, বড় গ্যালাক্সিতে কয়েক শ বিলিয়ন নক্ষত্র থাকতে পারে। কিন্তু একটা বামন ছায়াপথে নক্ষত্র থাকে অনেক কম বা এক মিলিয়নের মতো। এটা বেশ বিস্ময়কর বলে মনে হয়। কিন্তু বামন ছায়াপথে অল্পসংখ্যক নক্ষত্র থাকার কারণে রাতের আকাশে এগুলো খুবই ক্ষীণ বা ম্লান দেখায়। তাই তাদের খুঁজে পাওয়াও বেশ কঠিন।
প্রায়ই আমরা নতুন নতুন বামন ছায়াপথ খুঁজে পাচ্ছি।
দেখা যাবে, আমাদের জানা বেশির ভাগ বামন ছায়াপথ বড় ছায়াপথগুলোর কাছে ঝুলে আছে। পাশাপাশি বড় ছায়াপথগুলোর চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে স্পেসশিপের মতো। শেষ পর্যন্ত বামন ছায়াপথগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর প্রধান গ্যালাক্সিটা তাদের গিলে খায়।
গত বিলিয়ন বছরে অন্তত এ রকম একটা বামন ছায়াপথ গিলে খেয়েছে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। ওই গ্যালাক্সির ছিন্নভিন্ন অংশকে একদল নক্ষত্রের স্রোতের মতো দেখা যায়, যারা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরছে। মহাজাগতিক এই ভুক্তাবশেষটা স্যাজিটারিয়াস ডোয়ার্ফ সিস্টেম নামে পরিচিত। কিন্তু তাদের এতই রূঢ়ভাবে গিলে ফেলা হয়েছে যে তাদের নাম হওয়া উচিত ছিল লাঞ্চ।
ভবঘুরে নক্ষত্র
কোনো দেশে পার্শ্ববর্তী শহরগুলো যেভাবে একত্রে কাছাকাছি জড়ো হয়, সেভাবে গ্যালাক্সিগুলো ক্লাস্টার বা গুচ্ছ গুচ্ছভাবে একত্রে দল বেঁধে থাকে। কিন্তু আমাদের শহর ও নগরগুলোর প্রবণতা হলো সেগুলো নট নড়নচড়ন। নিউইয়র্ক শহর কখনো উপকূলে ঘোরে না কিংবা শহরটা বোস্টনে গিয়ে ধাক্কা খায় না। কিন্তু বড় গ্যালাক্সিগুলো নিয়মিত সংঘর্ষের মুখে পড়ে। আর সেটি ঘটার সময় পেছনে রেখে যায় বিপুল পরিমাণ ধ্বংসাবশেষ। গ্যালাক্সিতে মহাকর্ষের কারণে নক্ষত্রগুলো সাধারণত নির্দিষ্ট কক্ষপথে বা জায়গায় আটকে থাকে। কিন্তু এ রকম কোনো সংঘর্ষের পর মহাকর্ষের প্রভাব থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় কয়েক শ মিলিয়ন নক্ষত্র। এসব নক্ষত্র আকাশের চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। কিছু নক্ষত্র গুচ্ছবদ্ধ হয়, যাদের বলা হয় বামন ছায়াপথ।
কিন্তু বাকি নক্ষত্রগুলো ভবঘুরের মতো ভাসমান রয়ে যায়। বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, গ্যালাক্সিগুলোতে যত সংখ্যক নক্ষত্র রয়েছে, প্রায় তেমন সংখ্যক গৃহহীন নক্ষত্রও রয়েছে আমাদের মহাবিশ্বে।
বিস্ফোরন্মুখ ভবঘুরে নক্ষত্র
কিছু অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের প্রিয় মহাজাগতিক ঘটনা হলো সুপারনোভা। অর্থাৎ যেসব নক্ষত্র একটা প্রক্রিয়ায় নিজেরাই ছিন্নভিন্ন হয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে এক বিলিয়ন গুণ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাকে, তাদের বলা হয় সুপারনোভা। উন্নত টেলিস্কোপ দিয়ে মহাবিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় সুপারনোভা দেখা যায়। এদের বেশির ভাগই সাধারণত ঘটে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ডজনখানেক সুপারনোভার সন্ধান পেয়েছেন, যেগুলো কোনো মহাজাগতিক প্রতিবেশী এলাকা থেকে অনেক অনেক দূরে বিস্ফোরিত হয়েছে। সাধারণত কিছু নক্ষত্র সুপারনোভায় পরিণত হয়। কিন্তু সুপারনোভায় পরিণত হওয়া প্রতিটি নক্ষত্রের বিপরীতে এক লাখ থেকে দশ লাখ নক্ষত্র সুপারনোভা পরিণত হয় না। কাজেই গ্যালাক্সিগুলোর বাইরের এই ডজনখানেক বিস্ফোরিত নক্ষত্র আরও অসংখ্য নক্ষত্রের অস্তিত্বের ব্লু হতে পারে, যেসব নক্ষত্র আমরা দেখতে পারি না।
অনাবিষ্কৃত এসব অবিস্ফোরিত নক্ষত্রের কোনো কোনোটা হয়তো আমাদের নিজেদের সূর্যের মতো।
কে জানে এসব নক্ষত্রের চারপাশে হয়তো কিছু গ্রহও ঘুরছে। এমনকি তার মধ্যে কয়েকটি হয়তো বুদ্ধিমান প্রাণের টিকে থাকার জন্য উপযোগীও হতে পারে।
১০ লাখ ডিগ্রির গ্যাস
মহাবিশ্ব যেসব পদার্থ বা উপাদান দিয়ে তৈরি, সেগুলোর অবস্থা সাধারণত তিনটি : কঠিন, তরল ও গ্যাস। সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হলো পানি। পানির কঠিন অবস্থা হলো বরফ, পরিষ্কার ও পানোপযোগী হলো তরল অবস্থা। আর পানি গ্যাসে পরিণত হলে বাষ্পীভূত হয়ে যায়।
কিছু টেলিস্কোপে এক ধরনের গ্যাস দেখা গেছে, যা গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানের জায়গায় বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে আছে। সেগুলো ১০ মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রায় উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। কিন্তু তারপরও সেগুলো একত্রে দানা বাঁধছে না। এই গ্যাসও পদার্থ দিয়ে তৈরি। এগুলো খুবই উত্তপ্ত।
গ্যালাক্সিগুলো যখন এই অতি-উত্তপ্ত গ্যাসের ভেতর দিয়ে চলাচল করে, তখন সেগুলো তাদের বাড়তি পদার্থগুলোকে সরিয়ে দেয়। কোনো লাঞ্চরুমে তুমি যদি চকলেট চিপ কুকির ট্রে ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সবাই যেমন খাবারগুলো ছোবল মেরে তুলে নেয়, অনেকটা সে রকম ব্যাপার। এই অতি-উত্তপ্ত গ্যাস একটা গ্যালাক্সির ক্ষতি করে। ওই সব অতিরিক্ত পদার্থ সরিয়ে এই গ্যাস গ্যালাক্সিকে নতুন নক্ষত্র তৈরিতে বাধা দেয়।
অনুজ্জ্বল নীল গ্যালাক্সি
প্রধান প্রধান ক্লাস্টারের বাইরেও একদল গ্যালাক্সি আছে, যারা অনেক আগে থেকে সমৃদ্ধ। আগেই বলেছি, মহাবিশ্বে উঁকি দেওয়া মানে হলো সময়ের পেছনে দেখা। টাইম ট্রাভেল করে আলো দূরবর্তী গ্যালাক্সি থেকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে পারে কয়েক মিলিয়ন বা কয়েক বিলিয়ন বছরে।
মহাবিশ্বের বয়স যখন বর্তমানের অর্ধেক ছিল, তখন এক ধরনের অতি নীল ও অতি অনুজ্জ্বল টাইপের মাঝারি আকারের গ্যালাক্সির আধিপত্য ছিল। এখনো আমরা তাদের দেখি। তাদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ, তাদের অবস্থান শুধু অনেক দূরেই নয়, সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক উজ্জ্বল নক্ষত্র থাকে। এসব অনুজ্জ্বল নীল গ্যালাক্সির অস্তিত্ব এখন আর নেই। তাদের ঠিক কী হয়েছিল, তা-ও এক মহাজাগতিক রহস্য। তাদের সব কটি নক্ষত্র কি নিঃশেষ হয়ে গেছে? নাকি মহাবিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের অদৃশ্য মৃতদেহ? তারা কি এখনকার দেখা বামন ছায়াপথে পরিণত হয়ে গেছে? নাকি তাদের সব কটিকে খপ করে গিলে খেয়েছে কোনো বড় গ্যালাক্সি?
তাদের সব কটিই কি কারও লাঞ্চে পরিণত হয়েছে?
আমরা জানি না।
শূন্যতার শক্তি
শূন্যস্থান আসলে খালি নয়। এসব এলাকাকে আমরা ভ্যাকুয়াম বা শূন্যস্থান বলি। না, ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নয় এটা। এই এলাকায় আসলে কোনো পদার্থ বা শক্তি থাকে না। কিন্তু এসব অনুমিত শূন্য এলাকায় আসলে ভার্চুয়াল কণার সমুদ্র অনবরত উদয় হচ্ছে এবং তারপর ধ্বংস হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারা যখন একত্রে মিলিত হয়, প্রায়ই তারা পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে ও শক্তি নিঃসরণ করে। এই ক্ষুদ্র সংঘর্ষের ফলে যা সৃষ্টি হয়, বিজ্ঞানীরা তাকে বলেন ভ্যাকুয়াম এনার্জি বা শূন্যস্থানের শক্তি। এটা একটা বহির্মুখী চাপ বা এই শক্তি বাইরের দিকে চাপ দেয়, যা মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে এবং হয়তো মহাবিশ্বের প্রসারণে সহায়তাও করে।
*
বড় বড় গ্যালাক্সির মাঝখানের এসব বস্তুর অনেকে হয়তো আমাদের দৃষ্টিসীমায় বাধার সৃষ্টি করছে। এ কারণে তাদের পেছনে কী আছে, তা দেখতে পারছি না আমরা। মহাবিশ্বের দূরবর্তী বস্তুগুলোর জন্য এটা সমস্যাজনক হয়ে উঠতে পারে। যেমন কোয়াসার। গ্যালাক্সিদের কেন্দ্রে কোয়াসার অবিশ্বাস্য রকম উজ্জ্বল হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় একে বলা হয়, সুপারলুমিনাস গ্যালাক্সি কোর বা অতি উজ্জ্বল গ্যালাক্সির কেন্দ্র। তাদের আলো আমাদের টেলিস্কোপে ধরা পড়ার আগে সাধারণত কয়েক বিলিয়ন বছরের পথ পাড়ি দেয়।
কোয়াসারের আলো গ্যাসীয় মেঘ ও অন্যান্য মহাকাশের আবর্জনার ভেতর দিয়ে চলাচল করে। তাই কোয়াসারের আলো মাঝে মাঝে কিছুটা বদলে যায়। জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানীরা এই আলো নিয়ে গবেষণা করে উদ্ঘাটন করতে পারেন, বিলিয়ন বছরের বেশি সময়ের যাত্রায় এ আলোর কী ঘটেছিল। যেমন কোয়াসারের আলো বিভিন্ন গ্যাসীয় মেঘের ভেতর দিয়ে এলে আমরা তা বলতে পারি। প্রতিটি জানা কোয়াসারই সময় ও স্থানজুড়ে বিস্তৃত বিভিন্ন রকম গ্যাসীয় মেঘের বৈশিষ্ট্য দেখায়। যে আকাশের যেখানেই তাকে পাওয়া যাক না কেন, সব কোয়াসারই এ রকম বিভিন্ন স্থান-কালজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্যাসমেঘের বৈশিষ্ট্য দেখায়, সব কোয়াসারের জন্যই এ কথা খাটে।
আমরা শূন্যতা অপছন্দ করি কেন
বিজ্ঞানের পুরোনো একটা প্রবাদ আছে, প্রকৃতি শূন্যতা পছন্দ করে না বা শূন্যতা ঘৃণা করে। এটাও প্রতিষ্ঠিত সত্য যে শিশুরাও ভ্যাকুয়াম পছন্দ করে না। কুকুরের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। কিন্তু এ কথাটা ঘরোয়া ময়লা পরিষ্কারক যন্ত্রের ইঙ্গিত করে। যা-ই হোক আন্তছায়াপথের ভ্যাকুয়াম তোমার কেমন লাগবে? আমার অনুমান, তুমিও কোনোভাবেই ওটা পছন্দ করতে পারবে না। এ অধ্যায়ে আগে বলেছি, সময় কাটানোর জন্য ওটা মোটেও খুব ভালো জায়গা নয়। কিন্তু প্রকৃতি শূন্যতা অপছন্দ করে কেন, আর অদ্ভুত সব কার্যকলাপের মাধ্যমে সেগুলো ভরাট করে ফেলে কেন, তার কিছুই আমরা এখনো জানি না।
সুতরাং ওই সব গ্যাসীয় মেঘ আমাদের চোখে ধরা না পড়লেও আমরা ঠিকই জানি ওগুলো ওখানেই আছে।
ক্ষুধার্ত গ্যালাক্সি, ভবঘুরে নক্ষত্র এবং অতি-উত্তপ্ত গ্যাসীয় মেঘ আসলে মিলিতভাবে এই চমকপ্রদ ইণ্টারগ্যালাকটিক স্পেস গঠন করে। এসব সুপারডুপার উচ্চশক্তির চার্জিত কণা এবং রহস্যময় ভ্যাকুয়াম শক্তি যোগ করে যুক্তি দেখানো যায় যে মহাবিশ্বের সব মজার ঘটনা ঘটে আসলে গ্যালাক্সির ভেতরে নয়, বরং গ্যালাক্সিগুলোর মাঝখানের ফাঁকা জায়গায়।
তবে তোমাকে আমি ওখানে ছুটি কাটানোর পরামর্শ দিচ্ছি না। কারণ, তোমার ভ্রমণটা প্রথমে হয়তো বেশ মজার হবে, কিন্তু সেটা শেষ হবে খুবই বাজেভাবে।