ছায়ানট
আমি কে? নিজেকে চিনতে শেখ। শুনে শুনে কান পচে গেল। আমি আবার কে? একটা পান্তা খ্যাঁচা, কাকতাড়ুয়া টাইপের লোক। বাহারী একটা নাম, বসন্ত। বসন্তকালে হয়েছিলুম বলে না বসন্ত হয়েছিল বলে, জানা নেই। বসন্ত আমার নাম। কিশোর থেকে যুবক। যুবক থেকে প্রৌঢ়। মহাকাল ঘাড় ধরে নিয়ে চলেছে। ঝরা পাতার স্তূপে বসে তাকিয়ে আছি নিষ্পত্র শাখার দিকে। এই শেষ বেলায় চিনেছি নিজেকে, আমি কে? বসন্তকুমার কে? বসন্ত এক ভিখিরি। অদৃশ্য ভিক্ষাপাত্র হাতে ঘুরছে। দাও, আমাকে দাও। দয়া দাও, মায়া দাও, প্রেম দাও। নিরাপত্তা দাও, অর্থ দাও, ভোগ দাও। দাও আর দাও। এ সেই শুরুর কাহিনি।
আমি তখন যুবক। ভেতরে বাজছে ফুলুট বাঁশি। একা লাগছে, ফাঁকা লাগছে, ঢিলে লাগছে। মানুষ ছাড়া জামার মতো লতরপতর অবস্থা। বই মিলিয়ে আবিষ্কার করলুম, এই অবস্থার নাম বিরহ। শ্রীরাধার হয়েছিল, শ্রীচৈতন্যের হয়েছিল। আহা! তাঁরা তো ছিলেন অন্য কোটির মানুষ, আমার কেন এমন হল। সে অন্য কারণ।
কারণটা হল, আমাদের পাড়ায় এক পরিবার গোঁসাইদের দোতলায় ভাড়া এলেন। এলেন তো এলেন। তাতে আমারই বা কি, তাঁদেরই বা কি? অনেক কিছু। তাঁদের কিছু না, আমার সাংঘাতিক কিছু। একদিন গুপীর দোকানে বসে গুটলে কচুরি আর মোহনভোগ খাচ্ছি বাজারের টাকা থেকে ম্যানেজ করে, হঠাৎ গোঁসাই বাড়ির সদর গলে বেরিয়ে এল একটি মেয়ে। দোকানের সামনে দিয়ে তরতর করে চলে গেল কে যায়? আমার অবস্থা কীর্তনের মতো, আঁখি ভ্রমর লেবড়ে গেল সেই চলমান শরীরে। সে যায়, আমার চোখও যায়। গুপীর চোখও যায়। অদৃশ্য হওয়ার পর গুপী একসপ্লেন করলে, নতুন এসেছে। লা জবাব। তারপর দু’চরণ শায়েরি ঠুকে দিলে। বলাটা কি ঠিক হবে? তা যখন জীবনের কথা তখন বলেই ফেলি, দুলিয়ে পাছা যাচ্ছ বাছা রাঙিয়ে আমার মন। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললুম, ছি: গুপীদা, ছি:। গুপী সামান্যতম লজ্জা না পেয়ে বললে, চোখের রসগোল্লা।
মেয়েটা কি ভাবে যে আমাকে ড্যামেজ করে গেল, কেউ বুঝল না। কেউ জানল না আমার অবুঝ ব্যথা। আমার মনের কথা। গুপীদা গ্রাম্য কবিতা দিয়ে সামাল দিতে পারে। তার ছানা আছে, সবেদা আছে। বারকোশে ফেলে চটকাবে। চোখের রসগোল্লা সাময়িক। আসল রসগোল্লা চিরকালের। তাছাড়া তার বউ আছে। ম্যানেজ করে নেবে। আমার ড্যামেজ কে রিপেয়ার করবে! হৃদয়ে শেল মেরেছে।
।। বাঁকা ভুরু মাঝে আঁকা টিপখানি ।।
সেই সময় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের যুগ চলছে। ভদ্রলোক বঙ্গ যুবক হৃদয় জয়ী ফাটাফাটি গায়ক। রেডিও খুললেই তাঁর গান। মিছরির মতো গলা। পশ্চিম বাঙলায় তখন জাগরণের কাল। দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। দুই বাঙলার সংস্কৃতির মিলন হচ্ছে। চায়ের লিকারের সঙ্গে দুধ আর চিনির মতো পশ্চিমবাংলার পেয়ালায়। সংস্কৃতির চামচের ঠুন ঠুন শব্দ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ডুবুরি। মনের অতলে নেমে অবচেতনা তুলে এনে সাহিত্য সাজাচ্ছেন। দুই বিভূতির মহা দাপট। বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে চলেছেন আরণ্যক লীলায়। ইছামতীর তীরে, নিশ্চিন্তপুরের গ্রামীণ জীবনে। মুখোপাধ্যায় পরিবেশন করছেন মুচমুচে রসের ভিয়েন। তারাশঙ্করে উড়ছে রাঢ়ের ধূলো। স্বৈরিণীর নৈশ অভিযান। কবির বেদনাতুর আর্তি, জীবন কেন এত ছোট। দেবব্রতের উদাত্ত গলা, আকাশ ভরা সূর্য তারা। হেমন্তের রানার ছুটেছে, তার হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন। সিনেমায় সত্যজিৎ বাঙলা ছবির পালাবদলে। সে এক ভয়ঙ্কর রোমান্টিক এজ। নেবার আগে বাঙালি প্রদীপ জ্বলছে। সেই সময়ে এক খনখনে, পাঁপরভাজা দুপুরে, ধনঞ্জয় ধরেছেন, ‘বাঁকা ভুরু মাঝে আঁকা টিপখানি, আঁখি হিল্লোলে মরি মরি, কি ছাঁদে বেঁধেছ কবরী।’ এ তো আমার গান। গাইছি গোঁসাই বাড়ির দোতলার দিকে তাকিয়ে। কি ছার কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স। স্বয়ংবর সভামাঝে তুমি যদি মোরে মাল্য দিতে। তবে তবে। তোমার নাম জানি না। একবারই দেখেছি পেছন থেকে। ভেতরে প্রেম যেন ক্যানেস্তারা পেটাচ্ছে ঢ্যাং-ঢ্যাং করে। হু-হু দুপুর। হু-হু প্রাণ। মনের পোড়া ভিটেতে যেন ঘুঘু ডাকছে। ঘরে থাকা অসম্ভব। তুমি ডাক দিয়েছ। তুমিটা কে? আমি কে, সে তো জানি। তুমি কি ওই গোঁসাই বাড়ির তুমি।
।। প্রেম হল ডোবার ব্যাং ।।
আকাশে মেঘ। গুড়ুগুড়ু গর্জন। যেখানে যত ব্যাং, কোটরে, ডোবায়, পুকুরে সব একসঙ্গে গ্যাঁঙোর গ্যাং করতে লাগল। বয়েস হল সেই মেঘ। মনে হল ডোবার ব্যাং। থামানো অসম্ভব। ব্যাং-এর ডাকে বসন্তকুমার উন্মাদ। দুটো হিট গানের কলি অষ্টপ্রহর গলায়, বাঁকা ভুরু আর মোর প্রিয়া হবে এসো রানি দেবো খোঁপায় তারার ফুল। আমার এই বিরহকাতর অবস্থা বড়দের কারোর চোখে পড়ল না। একটা বয়সের পর মানুষ বেঁচে থাকলেও মনের দিক থেকে ফিনিশ হয়ে যায়। সংসার, সংসার করে পচা কুমড়োর মতো ভ্যাটভেটিয়ে যায়। কাক যেমন কর্কশ গলায় কা কা করে, সংসারি সেইরকম টাকা, টাকা। কি ভাবে দুটো পয়সা পকেটে আসবে। একটা করে বউ, গোটাকতক অ্যান্ডাগ্যান্ডা, একটা চাকরি। স্বামী-স্ত্রী যেন চিনে খত্তাল; মুখোমুখি হল তো ঝাঁই ঝাঁই, ঝ্যাঁং ঝ্যাঁং। বউরা তো হাসেই না। মুখ যেন সব সময় তিজেল হাঁড়ি। একটা ছেলে, একটা মেয়ে, একটা পৃথিবী, একটা জন্ম, চুটিয়ে প্রেম করো।
।। প্রেম জিনিসটা কী? ।।
প্রশ্নটা মনে জাগা মাত্রই বড় সংশয়ে পড়ে গেলুম। একটা সংজ্ঞা, একটা ডেফিনিশান ছাড়া জিনিসটাকে বুঝি কি করে। মানুষের সঠিক কোনও সংজ্ঞা না থাকায়, মানুষ জিনিসটা কি আজও বোঝা গেল না, কোনওদিন বোঝাও যাবে না। শ’খানেক ডেফিনিশানের তলায় মানুষ তালগোল পাকিয়ে আছে। যেমন—
বাঁদর থেকে মানুষ। যে সব বাঁদর মানুষ হল আর যে সব বাঁদর মানুষ হল না, দু’দলই আজও গাছে গাছে লম্ভঝম্ভ করে বেড়াচ্ছে আর পরস্পর পরস্পরকে দাঁত খিঁচোচ্ছে। বললেন, লিঙ্কন। প্ল্যাটো বললেন, মানুষ হল পক্ষহীন দ্বিপদ প্রাণী। মার্ক টোয়েন বললেন, মানুষ হল একমাত্র জন্তু যার লজ্জা আছে। প্যাসকেল বললেন, মানুষ হল দুর্বোধ্য দানব। অনাতোল ফ্রান্স বললেন, মানুষের যত রকম সংজ্ঞা আছে, তার মধ্যে কুৎসিততম হল, মানুষ বিবেচক প্রাণী। গিলবার্ট বললেন, ডারউইনের মানুষ যতই সদাচারী হোক, আমার চোখে লোম কামানো বাঁদর। লাইবারম্যান বললেন, মানুষ যতই অস্বীকার করতে চায় সে বাঁদর ছিল না, ততই সে নিজেকে গাধা বলে প্রমাণিত করে। বারনার্ড শ’ বললেন, মেয়েমানুষ হল শায়া পরা মানুষ আর তা না হলে মানুষ হল শায়া ছাড়া মেয়েমানুষ। মানুষ যে কি জানা গেল না বলে কেউ মানুষই হতে পারল না। প্রেমের বেলায় ওই ভুল আর করতে চাই না। সংজ্ঞা বুঝে, আটঘাট বেঁধে নামব। প্রেম ভীষণ ফেল করে। প্রেম যেন চিলের ঠোঁটে মাছ। ঝাঁক-ঝাঁক কাক খা-খা করে তেড়ে আসবে, ঠোঁট থেকে খসে পড়ে যাবে। আমার শিক্ষকমশাই প্রায়ই বলেন, বেশ প্রেপারেশান নিয়ে পরীক্ষায় বসবে, তাহলে আর ভয় থাকবে না।
বইপত্তর ঠেলে সরিয়ে প্রেমের প্রেপারেশানে বসলুম। প্রেম মানে, একটা মেয়ে একটা ছেলে। এই হল উপাদান। তরকারির মতো, আলু পেঁয়াজ, বেগুন কাঁচকলা। সেইরকম একটা ছেলে একটা মেয়ে। তারপর দেখা সাক্ষাৎ, তাকা-তাকি, মুচকি হাসি। নিভৃতে ফিসফাস। প্রথমে হাতে হাত। পরের ধাপে কাঁধে হাত। সাহস বাড়ার পর হাতের ভ্রমণ। তারপর ঠোঁট। প্রথমে সর্প ছোবল। তারপর কচ্ছপের কামড়। প্রেমে হাত আর ঠোঁটের নির্বিচার ব্যবহার। এ তো হল বাইরের খেলা। ভেতরে? ভেতরে হৃদয় লাফাবে তিরতির করে। মানুষের হৃদয় হল দুটো। একটা রক্ত পাম্প করে, আর একটা অনুভূতি। একটা বুকের বাঁদিকে থলথল করছে। আর একটা কোথায় আছে কেউ জানে না। প্রেম হল দ্বিতীয় হৃদয়ের ব্যাপার।
।। ভূত হলে ভালো হয় ।।
প্রেমে দেহ ঢুকে গেলেই প্রেম বরবাদ। দ্বিতীয় হৃদয় নিয়ে প্রেম যমুনায় নামতে হবে। দেহটাকে পাট করে তুলে রাখ। নিজেকে ভূত ভাবতে পারলে ভালো হয়। শরীর আছে অস্তিত্ব নেই। শরীর আসবে অনেক পরে, ফাউয়ের মতো বা ফেউয়ের মতো, পেছন-পেছন ফেউ-ফেউ করে। প্রেমে মুখ্য ভূমিকা নেবে, কথা আর চিঠি। অজস্র কথা, অসংখ্য অক্ষর, বেপরোয়া কল্পনা। প্রেমের খোঁটা হল ভাবনা। শুধু ভেবে যাও। কল্পনার গাছতলায়, কল্পনার চাঁদের আলোয়, কল্প যমুনার তটে দুজনে পাশাপাশি, দুটো দেহ নয়, দুটো ইচ্ছে। ইচ্ছের পর ইচ্ছে। ইচ্ছে করবে, তোমাকে নিয়ে আমি প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে উঠে আকাশের চাঁদোয়া থেকে তারা খুলে তোমার ছোট্ট কপালে, টিকলো নাকের ওপর পরিয়ে দেব। সত্যি সত্যি প্যারিসে যেতে হলে ডলার চাই। ডলার পেতে হলে অর্থনীতির কুৎসিত জগতে ঢুকতে হবে। এই মোটা কোলা ব্যাঙের মতো শরীর। মদের পিপে। রেসের ঘোড়া ছুটছে। ও জগতে প্রেম নেই শুধুই প্রতিযোগিতা। প্রথম হৃদয়ের কারবার। প্রেমের চোখে সব সুন্দর। প্রেমিকার গড়ের মাঠের মতো কপালকে মনে হবে সমুদ্রের দূর তটরেখা। সিঙ্গাড়ার মতো নাক, সেও বাঁশি। ইঁদুরের মতো চোখ সেও সরোবর। ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরি। ধরবে না কিন্তু, তাহলে কাম এসে যাবে। কাম আর হাম এক জিনিস। প্রবল ছোঁয়াচে। ইচ্ছে করে ঠোঁটে ঠোঁট রাখি। এদিক ওদিক তাকিয়ে সামান্য একবার ছুঁইয়েই তুলে নেব। তারপর জলে কুলকুচো। অসুখ বিসুখের কথা কে বলতে পারে! সাবধানের মার নেই। শরীর মানেই ব্যাধিমন্দির। মন হল প্রেমের মঠ। প্রেমিক প্রেমিকার পৃথিবী হবে নির্জন নিরালা। পরীক্ষা নেই। ইন্টারভিউ নেই, চাকরি নেই, ব্যাঙ্ক নেই, রান্নাঘর নেই, অভিভাবক নেই, পাড়া প্রতিবেশি নেই। দুটো ফুলগাছ, একখণ্ড জমি, টলটলে জল, কিছু প্রজাপতি, কয়েকটা গানের পাখি। পেট নেই, পীলে নেই, হাঁচি নেই, কাশি নেই। মোটামুটি প্রেমের সংজ্ঞা একটা পাওয়া গেল। এইবার অভিযান। টার্গেট! গোঁসাই বাড়ি। প্রেমিকার একপিঠ দেখেছি আর এক পিঠ দেখতে হবে। পেছন থেকে প্রেম হয় না। প্রেম হবে সামনাসামনি। চোখে চোখ রেখে। চোখে চোখ কথা কয় মুখে কিছু বলে না।
।। কচুরি ।।
গুপীদা ধরেছে ঠিক, ‘বসন্ত তুমি যে রেটে কচুরি হাঁকাচ্ছ, সামনের বসন্তটা পার করতে পারাবে তো?’ সে কেন আসে না, আমার ঘরে। গুপীদা বললে, ‘বুঝেছি, ইনফ্লুয়েঞ্জা ক্যাচ করেছে। গোঁসাই বাড়ির মেয়ে। শোনো ছোকরা তোমার টাইমের গড়বড় হচ্ছে। কলেজে যায়। রোজ সাড়ে ন’টায়। সেই সময়টা যদি একটু লাট খেতে পারো। কচুরি আর জল মেরে-মেরে তো জালা হয়ে গেলে। এইবার কিছুদিন লাট মারো। তবে বলে রাখি অনেকেরই চোখ পড়েছে। চারে কিছু ভিড়েও গেছে। তবে মেয়েটা পাত্তা দিচ্ছে না। শাহেন শা ফিল্ডে নেমে গেছে। বাপের রেস্তো নিয়ে। দ্বোজপক্ষের ছেলে। ছোবল না মেরে ফণা নামাবে না। মা-টাকে চেনো তো, রানি রূপমতী! বাপ হল চাঁদ সদাগর!
শাহেন শা ফিল্ডে নেমে পড়েছে শুনে একটু ঘাবড়ে গেলুম। বিশাল বড়লোকের ছেলে। সাদা ট্রাউজার, নীল শার্ট, সাদা জুতো, চোখে গগলস, চুলে সিঙ্গাড়া, পকেটে সিল্কের রুমাল, গায়ে দামী সিগারেটের সুবাস বিশাল মটোর সাইকেলে চেপে পাড়া কাঁপিয়ে যাওয়া আসা করে। চিউয়িং গাম চিবোয়। মেয়েদের বুক দেখাবে বলে ষষ্ঠীতলা ক্লাবে বারবেল ভাঁজে। চেলার অভাব নেই। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। আসল নামে কেউ ডাকে না। শাহেন শা। চেলাদের নিয়ে যখন রেস্তোরাঁয় ঢোকে হই-হই ব্যাপার। একশো দেড়শো বিল। আমি নিজে দেখেছি, শাহেন শা রাস্তা দিয়ে গেলে মেয়েরা কেমন যেন হয়ে যায়। সাপুড়ে যেন সাপ খেলানো বাঁশি বাজাচ্ছে—তন দোলে রে, মন দোলে রে, দিলকা গয়া করা, কোন বাজায় বাঁশরিয়া। মেয়েরা মেয়েদের গায়ে ঢলে পড়ে। যেচে যেচে আবোল তাবোল কথা বলে। সুর করে ডাকে, ববিদা কোথায় যাচ্ছেন, ভালো আছেন? ববিদা অমনি দরজা কি বারান্দা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ট্রাউজারের পকেট থেকে সড়াক করে সিল্কের রুমালটা টেনে বের করে মুখটা আলতো-আলতো করে মুছে নিলেন। চোখের ভঙ্গি করে বললেন, এই তোমরা যেমন রেখেছ! রুমাল থেকে দামি সেন্টের খুশবু ছড়িয়ে পড়ল। মেয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন মেয়ের মা। ন্যাকা-ন্যাকা কথা। তোমার বোনের বিয়েতে না কি একশো ভারি সোনা দিয়েছ? তোমাদের কুকুরটা কি গো? কোন জাতের? ফকস টেরিয়ার! বারাসাতে বাগান কিনেছ তোমরা? কাল তোমাদের বাড়ি খাওয়া দাওয়া হল বুঝি। কেউ একবারও জিগ্যেস করবে না, শাহেন শা তিনবারের চেষ্টায় থার্ড ডিভিসানে বেরোলে, লেখাপড়া করছ, না ছেড়েছ। মেয়েদের কাছে ওসবের দাম নেই।
গুপীদা বললে, ‘ঘাবড়ে যেয়ো না, মেয়েদের কখন কাকে মনে ধরে যায় বলা শক্ত। তোমার ওই ভালো মানুষ, ভালো মানুষ মুখ ভালো লেগে যেতে পারে। মেয়েরা অনেক সময় বোকা-বোকা ছেলে পছন্দ করে। আচ্ছা বলতে পার কোন কোন জিনিস পায়ে-পায়ে ঘোরে?
বলতে পারলুম না। আমার কি ছাই অত জ্ঞান আছে।
।। পায়ে পায়ে ।।
এক নম্বর, পায়ে-পায়ে ঘোরে জুতো। দু নম্বর, পায়ে-পায়ে ঘোরে বাবুর কোঁচা। তিন নম্বর পায়ে-পায়ে ঘোরে ঘুঙুর। পায়ে-পায়ে ঘোরে বেড়াল। ঘোরে উমেদার, চামচা। পায়ে-পায়ে ঘোরে ধুলো। ঘোরে মেয়েদের শায়ার বাহারী লেস। পায়ে-পায়ে ঘোরে মানুষের ইচ্ছা। আর ঘোরে প্রেমিক। রসের কারবারী গুপীদা। সারাদিন কত কি ভাবে। গুপীদা বললে, তুমিও পায়ে-পায়ে ঘোর। মানুষের পেছনে-পেছনে যেমন মানুষের ছায়া ঘোরে, তুমিও সেইরকম ঘোর। ফিরে তাকালেই যেন তোমাকে দেখতে পায়। দেখতে দেখতেই অভ্যাস হয়ে যাবে। আয়নায় মুখ দেখার মতো। একদম হ্যাংলামো করবে না। মেয়েদের পছন্দ কি রকম জান?
জানব কি করে? এই তো আমার প্রথম হোঁচট।
।। পছন্দ ।।
ষাঁড়ের মতো ছেলে পছন্দ করে না। পাতলা ধারাল চেহারা। কোনও কোনও মেয়ে ভুঁড়ি দেখলে চেপে যায়। আলুভাতে মার্কা ডালিমকুমার দু’চক্ষের বিষ। যারা বেশি ভ্যাড় ভ্যাড় করে বাতেলা মারে মেয়েরা তাদের নিয়ে মজা করতে পারে, প্রেম করবে না কখনও। যারা কম কথা বলে, ধারাল চোখাচোখা, মেয়েরা মনে মনে তাদের বেশি পছন্দ করে। বড়লোক কাপ্তেনদের মেয়েরা ব্যবহার করতে চায় ভালোবাসতে চায় না। মেয়েরা সাহসী ছেলে পছন্দ করে। পছন্দ করে সংগ্রামী ছেলে। মেয়েদের কাছে ঘা খাওয়া পোড় খাওয়া ছেলেরা খুব প্রিয়। শিল্পীদের খুব পছন্দ করে। পছন্দ করে বদনামীদের। সংসার যাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় মেয়েরা তাদের তুলে নেয় আদর করে। হিসেবীর চেয়ে বেহিসেবীদের বেশি পছন্দ করে। মেয়েরা পছন্দ করে উপেক্ষা। ‘এইবার দেখো তুমি কোন রাস্তায় যাবে!’ গুপীদা হাসতে লাগল, ‘তোমার মতো নিরীহ ছেলেকে কেউ ভালোবাসবে না বসন্ত। প্রেমের বিয়ে তোমার হবে কি? তোমার বরাতে নাচছে সম্বন্ধের বিয়ে। হয় ভালো, না হয় সাংঘাতিক একটা খারাপ কিছু করতে না পারলে গোঁসাই বাড়ি তোমার দিকে ফিরেও তাকাবে না। এমন একটা কিছু করতে হবে যাতে পাড়ায় হই-হই পড়ে যায়।’
গুপীদা খুব হতাশ করে দিলে। আমি না ভালো, না খারাপ মাঝারি ধরনের একটা ছেলে। আমার তো তাহলে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। পরীক্ষা দেব, কোনওরকমে পাশ করব। চাকরি করব। একটা বিয়ে হবে। চ্যাঁ ভ্যাঁ। জীবন শেষ।
।। প্রেমপত্র ।।
অনেক ভেবেচিন্তে একটা প্রেমপত্র লিখে ফেললুম। সেও কি কম উত্তেজনা। লুকিয়ে-লুকিয়ে নির্জনে বসে লেখা। যেন দলিল জাল করছি। প্রেম না হোক সাহিত্য তো হবে। ভালো-ভালো কথা, কোটেসান সব মিলিয়ে দু’পাতার এক দীর্ঘ উচ্ছ্বাস নিজেই নিজের চিঠির প্রেমে পড়ে গেলুম। আমি যদি মেয়ে হতুম আর এমন চিঠি যদি কোনও ছেলে আমাকে লিখত, আমি মাঝরাতে বারান্দার রেলিং-এ শাড়ি বেঁধে সরসরিয়ে নেমে এসে চৌপাট দিতুম। পাঁজি খুলে একটা বিজ্ঞাপন পেলুম, চিঠিতে বশীকরণ। মহাপুরুষ থাকেন অনেক দূরে, কাটোয়ায়। কাছাকাছি থাকলে যত টাকাই লাগুক, জেনে আসতুম কৌশলটা। মনে হয়, আতর-টাতর লাগালে কাজ হতে পারে। কোণের দিকে একটু অগুরু লাগিয়ে দিলুম। হাতের কাছে আর কিছু ছিল না।
আমার এক কাকা বড় একটা ফার্মে চাকরি করতেন। তাঁর পকেটে সব সময় একটা রেজিগনেশান লেটার থাকত। সেইটা নিয়েই ঘুরতেন। বলতেন, আই উইল বি স্পিলিট সেকেন্ড ফাস্টার দ্যান দি ম্যানেজমেন্ট। ওরা আমাকে ছাড়াবার আগেই আমি ছেড়ে দেব।
আমিও সেইরকম প্রেমপত্রটা পকেটে নিয়ে ঘুরতে লাগলুম। শুভযোগে সটান ধরিয়ে দোব হাতে। একটু নির্জনে পেলে হয়। বোমার পলতেয় আগুন দেওয়ার মতো, দিয়েই পালাব। দে ছুট। চিঠির একেবারে শেষে লেখা আছে, বিশেষ দ্রষ্টব্য, যোগাযোগ ও প্রাথমিক মিলনের স্থান, গুপীদার মিষ্টির দোকান।
।। টিকটিকি ।।
দেওয়ালের টিকটিকি নই, ইংরেজ আমলের পুলিসের টিকটিকি, যারা বিপ্লবীদের পেছনে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়াত। আমি সেই টিকটিকি। গোঁসাইকন্যাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করি। বিপ্লবীদের সঙ্গে তফাৎ কোথায়? আমার জীবনে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। নর্মাল মানে, স্বাভাবিক নি:শ্বাস আর পড়ছেই না। সবই দীর্ঘশ্বাস। নাকের সামনে মোমবাতি ধরলে, এক ফোঁসেই ফস। সামনে দিয়ে কোনও মেয়ে হেঁটে গেলে মনে একটা হুহু ভাব। সাহারা মরুভূমি, উট, মরুদ্যান, বেদুইন মেয়ে এই সব ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কানে আসে শেয়ালের ডাক। অমাবস্যার রাতে তারাপীঠের মহাশ্মশানে সমস্বরে ডাকছে। গভীর রাতে ব্রিজের ওপর দিয়ে মালগাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ। প্রেমের গান শুনলে চোখ ফেটে জল আসে। ভেতরটা একেবারে খলখলে করে দিয়েছে মেয়েটা। একেই বলে মনের যক্ষা। যক্ষায় বিকেলের দিকেই জ্বর আসে, শীত-শীত করে, চোখ জ্বলে। মনের যক্ষারও একই লক্ষণ। যেই বেলা পড়ে আসে; ছায়া দীর্ঘ হয়, রোদ গিয়ে চড়ে গাছের মাথায়, মনের জ্বর আসে। খেতে না পাওয়া গোরুর মতো মনে হয় নিজেকে। তখন একা-একা চলে যাই কোনও সিনেমায়। দেওয়ালের ধারের আসনে বসি ঘাপটি মেরে ডানা ভাঙা শকুনের মতো। খুঁজে-খুঁজে বের করি বাঙলা দু:খের বই। একদিন এমন কান্না কাঁদলুম, পাশেই বসেছিলেন এক বৃদ্ধা, তাঁর পাশে তাঁর স্বাস্থ্যবতী ডাগরডুগুর নাতনীটি। প্রথমে অবশ্য নাতনীই বসেছিল, আমার পাশে, ‘হল’ অন্ধকার করে শো চালু হতেই, আমার কনুই দু-একবার তার হাত ছুঁয়েছিল, অমনি জায়গা বদল করে বৃদ্ধাকে ঠেলে দিল আমার পাশে। সে যাই হোক, মেয়েদের কাজ মেয়েটি করেছে পুরুষের ভাবা সাজে? তা আমার কুঁই-কুঁই কান্না শুনে বৃদ্ধা সান্ত্বনা দিলেন, ‘আর কিছুক্ষণ কষ্ট করো বাবা, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।’ আমার সিস্টেমে আবার একটু ডিফেক্ট আছে। চোখে জল এলেই নাকি সর্দি এসে যায়। শো শেষ না হওয়া পর্যন্ত এক নাগাড়ে ফ্যাঁস-ফোঁস ফোঁত-ফোঁত করে গেলুম। নাতনীটি কাঁদছিল মনে হয়। বৃদ্ধা শেষে বললেন, ‘এ ভারি জ্বালা হল বাপু। একপাশে ইনি, একপাশে উনি। পয়সা খরচ করে কাঁদতে আসা কেন বাপু?’
যে সব গানে, জীবন, পারাবার, মাঝি, দিতে হবে পাড়ি, খেলাঘর, ভেসে গেছে হায়, নয়ন, যমুনা, অভাগা, চাহিনি, চেয়েছ, তুমি আর আমি, মাধবী, স্মৃতি, জীবনপাতা, দিনগুলি সোনার খাঁচা, জানালা উড়ে গেল, যেতেই হবে, পড়বে না, পায়ের চিহ্ন, এই সব শব্দ আছে, একবার কানে ঢুকলেই হল, চোখে হাপুস জল, যেন এইমাত্র কোনও প্রিয়জনের চিতায় জল ঢেলে, জলের কলসী ভেঙে দাঁড়িয়ে আছি। যেন বিয়ের আগেই বউ গয়া বা চিতাতেই ফুলশয্যা হল। মনের সে কি অবস্থা! যেন রাজকাপুর ছেঁড়া প্যান্ট পরে ব্যাগপাইপ বাজাচ্ছেন, মুকেশ গান ধরেছেন, ম্যায় আওয়ারা হুঁ। বৈজয়ন্তীমালা নাচছেন আর গাইছেন, দাগাবাজ তেরা, দিলিপকুমারের কুর্তার পেছনে আটকে আছে কানের দুল। মানুষের হাড়ে কম্পাউন্ড ফ্রাকচার হয় আমার মনে। লেটার বক্সে চিঠি পোস্ট করতে গিয়ে চিঠির বদলে দশ টাকার তাগড়া একটা নোট ঢুকিয়ে দিয়ে এলুম। শেষে নিজের ভুলে নিজেই মরি। সারাদিন লেটার বক্সের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছি, কখন আসেন সেই রাগী চেহারার ভদ্রলোক ক্লিয়ার করতে। হাতে পায়ে ধরে টাকাটা যদি উদ্ধার করা যায়।
লোকে বলে, অন্যমনস্ক। মনই নেই তো অন্যমনস্ক। বরং বলা উচিত শূন্যমনস্ক। বাড়িতে বললে পুরোহিত মশাইকে ডাকতে, ডেকে নিয়ে এলেম ফ্যামিলি ফিজিসিয়ানকে। তিনি সুস্থ বুকে টেথিসকোপ বসিয়ে ভিজিট নিয়ে চলে গেলেন। বরাতে বিশেষণ জুটল, দামড়া।
।। বিরহ ।।
এই অবস্থার নাম বিরহ। এ আমি বৈষ্ণবশাস্ত্র পড়ে জেনেছি। মহাপ্রভু যে গাছের তলায় বসতেন, সেই গাছের সব পাতা ঝলসে যেত, বিরহের উত্তাপে। রোমকূপে রক্তোদগম দন্ত সব হালে। ক্ষণে অঙ্গ ক্ষীণ হয় ক্ষণে অঙ্গ ফুলে। মনেতে শূন্যতা বাক্যে হা হা হুতাস। এ একেবারে পরিপূর্ণ বিরহের লক্ষণ। শ্রীরাধিকারও এই একই হাল ধরেছিল। বিরহে সাধারণ মানুষের অতটা নাহলেও যা হয়, তা হল জ্বর, বদহজম, একটু ডিসপেপসিয়া, অম্বল, লস অফ মেমারি, ডিহাইড্রেসান। কলেরা আর ম্যালেরিয়ার মিকশ্চার। এটা বুঝতে হবে, মহাপ্রভু, শ্রীরাধিকার ব্যাপারটা আধ্যাত্মিক, যা নেই, যা হয়তো ছিলই না কোনওদিন, সেইরকম একটা কল্পনাকে ধরার চেষ্টা। সেই অধরা দেয় না ধরা। একটা নাম, একটা রূপকল্পনা। আমারটা একেবারে মানুষী লীলা। চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে দীঘল শরীর, সিপসিপ করে। চটির পেছনে সাদা, মসৃণ গোড়ালি। ক্যাঁক করে ধরা যায়। সঙ্গে-সঙ্গে হিংসুক হিতৈষীদের বেধড়ক ধোলাই। ভবসাগর তারণ কারণ হে! ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছু আছে না কি এই দেশে। প্রেমটাকে জীবন থেকে সিনেমায় চালান করে দিয়ে বসে আছেন বাবুরা।
।। অনুসরণ ।।
গুপীদার দোকানে ঘাপটি মেরে বসেছিলুম। হঠাৎ গোঁসাই বাড়ির মেয়ে। তির তির করে চলেছে, উপলখণ্ডের ওপর দিয়ে বহে চলা পাহাড়ি নদীর মতো। সঙ্গে-সঙ্গে ফলো। গুপীদা কচুরির ওপর তরকারি তুলেছিল আমাকে দেবে বলে। মন্তব্য কানে এল, ‘হয়ে গেল। বাপ মা এই ষাঁড়েদের কেন বিয়ে দেয় না।’
‘ফলো’ করার একটা নিয়ম আছে। আধপাগলা-আধপাগলা চেহারা নিয়ে, ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না, এইরকম মুখে, ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুর অনুসরণ। মনে-মনে ভাবতে হবে, আমি একটা ভোঁদড় বা ভাম। নেকড়ে ভাবলেও মন্দ হয় না, তবে তাতে বড় হিংসে। খাদ্য খাদক সম্পর্ক।
মেয়েটা বড় জোরে হাঁটে। রূপের অহঙ্কারে ধরাকে একেবারে সরা জ্ঞান করছে। এত অহঙ্কার কিসের! না হয় সুন্দরী। পৃথিবীতে এসেছিস, সকলের সঙ্গে মেলামেশা করবি। হেসে কথা বলবি। তা না, ঠেকারে, গুমোরে। ইউরোপ-আমেরিকায় তোর মতো মেয়ে পথে ঘাটে ফুটকড়াইয়ের মতো গড়াগড়ি যায়। বনগাঁয়ে শেয়াল রাজা!
এইসব ভাবছি আর গুটগুট করে এগোচ্ছি। সবসময় চেষ্টা করছি হাত দশেকের মতো দূরত্ব রাখতে। একবার এক ভদ্রমহিলার চটি পেছন দিক থেকে আচমকা মাড়িয়ে ফেলেছিলুম। ইচ্ছে করে নয়। অ্যাকসিডেন্ট। স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল। লোকে এই মারে তো সেই মারে। শেষে সেই মেয়েটিই আমাকে বাঁচিয়ে দিলে। বললে, ‘মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তেমন বাঁদর নয়। ইচ্ছে করে করেনি।’
বেশ চলছিল মেয়েটি ঘোঁত-ঘোঁত করে। হঠাৎ ঢুকে পড়ল পোস্ট অফিসে। রমণী আর আমাদের স্কুলের সেই অঙ্কের শামুক একই ধরনের অস্থির প্রাণী। বাঁশ বেয়ে ছ’ফুট উঠল, তো তিনফুট নেমে এল। বেশ বিপদে পড়ে গেলুম। বাইরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলে চেনা লোকের নজরে পড়ে যাব। সব ভেস্তে যাবে। বাধ্য হয়ে আমাকেও পোস্ট অফিসে ঢুকতে হল। মেয়েটি খাম পোস্টকার্ডের ঘুলঘুলিতে। কাউন্টার আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন দুর্গাপুজো হচ্ছে। পাশেই সেভিংস কাউন্টার। সর্বনাশটা সেইখানেই অপেক্ষা করে ছিল। আমার মাস্টারমশাইয়ের চেহারা ধরে। ‘আরে বসন্ত যে!’ বলে তিনি আমাকে ধরলেন, ‘কেমন হচ্ছে তোমার লেখাপড়া?’ শুরু করলেন যত অপ্রাসঙ্গিক কথা। লেখাপড়ার সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক? লেখাপড়া করে কে কবে বড়লোক হয়েছে? আপনি হয়েছেন? আমার একটা চোখ মেয়েটির দিকে, আর একটি চোখ মাস্টারমশাইয়ের দিকে। খুব ঘড়েল লোক। স্কুলেও জ্বালিয়েছিল এখানেও জ্বালাচ্ছেন। আমার উন্মনা ভাব দেখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে কোনও কারণে বেশ চঞ্চল হয়ে আছ। একটু অপ্রকৃতিস্থ। বাড়িতে সব শরীর-টরির ঠিক যাচ্ছে তো?’ বললুম, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, সবাই বেশ ভালোই আছেন।’ ‘তাহলে তোমাকে এমন ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন?’
মেয়েটি কাজ শেষ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি তো তার সঙ্গে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। আমিও বেরোতে যাচ্ছি, মাস্টারমশাই খপ করে হাত চেপে ধরলেন, ‘আরে যাচ্ছ কোথায়?’
মনে হল ঘ্যাঁক করে হাতে একটা কামড় বসিয়েদি। মেয়েটি বেরিয়ে গেল। আমি মাস্টারমশাইয়ের কলে ইঁদুরের মতো আটকে রইলুম। ঠোঁটকাটা সেই ভদ্রলোক হঠাৎ বললেন, ‘বুঝলে সবই হল বয়সের দোষ। এই বয়েসটাতো ভালো নয়। পধস্খলন এইসময়েই হয়। ছাত্রজীবনে ব্রহ্মচর্যই হল পালনীয় ধর্ম। চোখে ঠুলি বেঁধে, দাঁতে দাঁত চেপে পরীক্ষাগুলো সব টপকে যাও। তারপর ভালো একটা চাকরির পিঁড়েতে জমিয়ে বোস; তখন তোমার সুন্দরী বউ হবে, বাড়ি হবে, গাড়ি হবে। প্যাঁক-প্যাঁক করে ঘুরে বেড়াবে। এখন মনকে একেবারেই চঞ্চল হতে দেবে না। তোমাকে আমি একটা বই পড়তে দেব। তোমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, ব্রহ্মচর্যের শক্তি ও উজ্জ্বল জীবন।’
মনে মনে বললুম, ধ্যাততেরিকা। মুখে বললুম, ‘আমি তাহলে আসি মাস্টারমশাই।
এই দেখো, তোমার মনের কি অবস্থা! পোস্টাপিসে কেন এলে, সেইটাই ভুলে গেলে। খাম, পোস্টকার্ড, মানিঅর্ডার টাকা জমা, টাকা তোলা, রেজিস্ট্রি পার্সেল, কোনটা?’
‘আজ্ঞে আমি ভিড় দেখতে এসেছিলুম।’
‘ও, জনগণনার কাজ নিয়েছ বুঝি?’
‘আজ্ঞে না, ভিড়টা দেখে গেলুম আর কি। এইবার আসব। কাগজপত্র নিয়ে টাকা তুলব।’
‘তোমার বুদ্ধি তো বেশ সরস। আবার যাবে, আবার আসবে; ততক্ষণে ভিড় যদি বেড়ে যায়। অবশ্য হাঁটাহাঁটির একটা উপকারিতা আছে। হজম করায়।’
মাস্টারমশাই কংসের মতো হাসতে লাগলেন, গা জ্বলে গেল। বলতে পারছি না কিছু। সম্মানিত শিক্ষক। চেহারাটি এবোরে পাকা পেয়ারার মতো। প্রেমের দুষমন। মহব্বতের ‘ম’ বোঝেন না। বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা রেহেমান, সুচিত্রা সেনের নাম জানেন না। ছাত্র ঠেঙান আর নাকে নস্যি গোঁজেন। ব্রহ্মচর্যের ফেরিঅলা।
রাস্তায় নেমে এলুম। সব ভোঁ-ভোঁ। একটা লোক হাঁকতে-হাঁকতে চলেছে ‘শিল কুঠাও।’ ছেনি মেরে শিল নোড়ার দাঁত ফেলে। মেয়েদের বাটনাবাটায় সুবিধে হয়। মনে-মনে বললুম, ওই বুড়ো কার্তিকটাকে একটু কুটে দিয়ে আয় তো, গোটা পৃথিবীটাকে যে ইস্কুল ভাবে।
।। হাল ছেড় না মাঝি ।।
প্রেম আর বেল একই স্বভাবের। সময় হলে পড়বে। প্রেম কি যাচিলে মেলে, আপনি উদয় হয় শুভ যোগ পেলে। এ সেই অর্থে কুম্ভ, পূর্ণকুম্ভের মতো। গ্রহে-গ্রহে যোগ হবে তবেই হবে। তবেই ভক্তজন অর্ধনগ্ন হয়ে জলে ঝাঁপ মারবে।
আমি সেই পিওন, কোর্টের পেয়াদা। শমন আমি হাতে ধরাবই। চিঠি আমি গুঁজবই। যখন বাড়ি ফিরছে, তখন হবে না। ধোলাইয়ের ভয় আছে। যখন পাড়া ছেড়ে যাচ্ছে তখন পেছন-পেছন যেতে হবে। বেপাড়ায় গিয়ে নির্জনে কুটুস। প্রেমিক হলেও নির্বোধ তো নই। মারের ভয় তো আছে।
দ্বিতীয় সুযোগ এসে গেল। পালাবে কোথায় পরশুরাম। পথ দিয়ে তোমাকে যেতেই হবে; আর আমি এক জ্যান্ত ল্যাম্পপোস্ট। গুপীদার দোকান আমার পাদপীঠ। মারলুম ঝাঁপ। সে চলেছে আমি চলেছি। হাত কুড়ির নিরাপদ ব্যবধান। বেশ যাচ্ছিল, হঠাৎ ঘুরে গেল। আবার বাড়ি মুখো। আমার পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে বাড়ির দিকে ফিরে চলল। কিছু ভুলেটুলে গেছে হয়তো। এইরকম গোলমেলে মেয়েছেলে লাইফে দেখিনি। এসব মেয়ে সংসার করবে কি করে যার কোনও মতি স্থির নেই। আমার এক হাত দূর দিয়ে যখন চলে গেল বুকটা ধড়াস করে উঠল। মনে হল যা থাকে বরাতে, একবার হাত বাড়াই। ভয়েই মরে গেলুম। শুধু একটা লাইন এল মনে, আমারই বধুঁয়া আন বাড়ি যায় আমারই আঙ্গিনা দিয়া।
আমিও যদি হঠাৎ ফিরি লোকে সন্দেহ করতে পারে কুচক্রী লোকের তো অভাব নেই জগতে; তাই বেশ কিছু দূর সামনে হেঁটে গেলুম অকারণে। বাড়ির ভিত আর প্রেমের ভিত একই জাতের ব্যাপার। খেটে খুটে তৈরি করতে হয়। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে। বেকার একটা চক্কর মেরে ফিরে এলুম গুপীদার দোকানে। গুপীদা বললে, ‘মুখ দেখে মনে হচ্ছে ধেড়িয়েছ। তুমি গেলে ওদিকে, ও এল এদিকে। কেসটা কি?’
‘কি আর কেস? ন্যাজে খেলছে।’
‘মহা ধড়িবাজ। ওই জন্যে বলে মেয়েছেলে কী চিজ রে বাবা! শোন বসন্ত ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। বসুন্ধরা মানে মেয়ে। তুমি বীর হও।’
‘বীর হও! বীর হব কি করে? যুদ্ধ করব?’
‘শোনো, আমাদের পাড়ায় একটা গুঁতুন্তে ষাঁড় আছে জানো? রোজ ভোরে আমার দোকানে কচুরি খেতে আসে।’
‘খুব জানি, একবার আমার পেছনে শিং ঠেকিয়েছিল।’
‘তুমি একদিন ওই ষাঁড়টার পিঠে চেপে বসে পাড়া প্রদক্ষিণ করো। প্রমাণ করো তুমি বীর। তোমার খুব নাম হবে। সেই নামে নামে তোমার কাছে এসে যাবে, মার কাটারি বগল চাপ।’ আমি জানি এই সব রসিকতা আমাকে সহ্য করতে হবেই। পৃথিবীর প্রেমের ইতিহাসে এই সব কেস আছে, লায়লা মজনু, হীর রনঝা। এ দুনিয়া, এ মায়ফিল কুছ কামকা নেহি। মহম্মদ রফির গানটা শুনলেই তো বৈরাগ্য এসে যায়। এই গুপীদাই বলুক না, রস ছাড়া রসগোল্লা হয়? প্রেম ছাড়া পৃথিবী হয়! হয় না। নিরেট লাড্ডুতেও রস আছে, দানায়-দানায়। গুপীদা বললে, ‘তুমি এক কাজ করো, কিছুদিন শিবের মাথায় জল ঢাল। মেয়েরা ঢেলে যদি বর পায়, তুমি ঢেলে বউও পাবে। কথাটা হল, বউ যদি পেয়েও যাও খাওয়াবে কি? রোজগারপাতি তো নেই।’
লোকটার মাথায় কিছু নেই। বিয়ে আর প্রেম গুলিয়ে ফেলেছে। ওই জন্যেই বলে, এডুকেশানের প্রয়োজন আছে। টাটে বসে সারা জীবন পয়সা আর পয়সা, আর ধামার মতো একটা ভুঁড়ি। না পড়েছে কবিতা, না পড়েছে উপন্যাস। তারাশঙ্করের ‘কবি’টা তো বানান করে-করে পড়তে পারে, জীবন এত ছোট ক্যানে? কি প্রশ্ন? প্রেমিকের জীবন ফিতে দিয়ে মাপা যায়। এক চিলতে কাপড়। কোনওরকমে একটা ব্লাউজ হতে পারে। প্রেম, খুকখুক কাশি, মুখ দিয়ে রক্ত, সমাধি, আধুনিক গান, তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, প্রেম বলে নাই, তুমি নাই। প্রেমিক মরলে চিতায় পোড়ানো হয় না, সমাধি দেওয়া হয়, তারপাশে থাকে বকুল, শিউলি। প্রেমের ডায়ালগের মতো ফুসফুস ফুল ঝরে পড়ে। প্রেমের মতোই প্রেমিক-প্রেমিকা জুটি বেশি দিন একসঙ্গে বাঁচতে পারে না। যে কোনও একজনকে আগে যেতেই হবে। তা না হলে সমাধি হবে কি করে? কবির কবিতা, গীতিকারের গান! প্রেমের একটা অভিশাপ আছে। গুপে বেটা যতি রবীন্দ্রনাথের গানের দিকেও একটু কান দিত। পড়তে হবে না, শুধু কানটা রাখা। গানটা প্রায়ই হয় :
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
গান আমার একটু-একটু আসে। জানলা খুলে রাখলে যেমন উনুনের ধোঁয়া আসে, অটোমেটিক আসে। গুপীদাকে বললুম মন দিয়ে শোন গানটা। বিশ্বকবি কি বলছেন :
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
সুরটা বেশ লেগেছিল। গলা পরিষ্কার, কোনও খোঁজ নেই। গুপী পাঁঠা বললে, আত্মহত্যার কেস। বুঝে গেলুম, গুপী যে লেভেলের তাতে ওর বাবারও ক্ষমতা হবে না এই গানের মানে বোঝার। প্রেম যে একটা কত বড় কোর্স, কি দহন জ্বালা। গুপীর একটাই জ্বালা।—ধারের টাকা আদায়ের জ্বালা। পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার জ্বালা। একেবারে কোর্স ম্যাটিরিয়াল। নিজেই গাইতে লাগলুম।
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি পাণ।
যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারিনে দূরে যেতে, মরিতে আসি
লই গো বুক পেতে অনলবাণ।।
রবীন্দ্রনাথ ইজ রবীন্দ্রনাথ। কি বোধ! কি অনুভূতি! কি পারসেপসান, কনসেপসান, রিয়েলাইজেশান। সকলের মনে ঢুকে বসে আছেন ঈশ্বরের মতো। এ গান তো আমার জন্যেই লেখা। প্রেমের একটা ব্যাপার দেখছি, শরীরটাকে করে দেয় জলের ট্যাঙ্ক। কথায়-কথায় জল এসে যায় চোখে। লঙ্কা চিবোলে নাকের জল, প্রেমে পড়লে চোখের জল, সংসারে ঢুকলে নাকের জল চোখের জল দুটোই।
গুপীদা বললে, ‘এইবার গাত্রোৎপাটন করে গৃহে যাও। গান হল, কান্না হল, এখন মাথায় দু-এক মগ ঢেলে কিছু সেবা করো। মা জগদম্বা হাঁড়ি আগলে বসে আছেন।’
।। বার বার তিনবার ।।
তৃতীয় সুযোগ প্রায় না চাইতেই এসে গেল। তিড়িং করে এক লাফ মেরে বত্রিশ নম্বর বাসে উঠলুম। ফুটবোর্ডে ঝুলতে ভয় করে। ওই জায়গায় অনেক কালোয়াত লাট খায়। পাশেই লেডিজ সিট। জানালায় প্রায়শই সুন্দরী মুখ। সার্কাস দেখিয়ে যদি একটু মুচকি হাসির প্রসাদ পাওয়া যায়। বাঁদর হয়ে আমি প্রেম আদায় করতে চাই না। আমি ইন্টেলেকচ্যুয়াল গ্রুপের প্রাণী। আমি কলমের খোঁচা মেরে প্রেমের আঙুর পেড়ে খাব। সত্যি কথা বলতে কি জিমন্যাস্টিকস আমার তেমন রপ্ত নেই। একবারই ফুটবল খেলতে নেমেছিলুম স্কুলের ম্যাচে। দর্শকদের মধ্যে আমাদের স্কুলের সাঙ্ঘাতিক রাগী হেডমাস্টারমশাই ছিলেন। টেরিফিক খেলা হচ্ছে। বল নিয়ে ছুটছি, ল্যাং খেয়ে পড়ছি। মাথা একেবারে ভোম মেরে আছে। মাঝে-মাঝে মাঠ, পক্ষের, বিপক্ষের গোলপোস্ট সব একাকার। ভেতরে একটা অদম্য ইচ্ছে, খাঁচার বাঘের মতো ছটফট করছে, গোল একটা গোল। হঠাৎ দেখি সামনে ফাঁকা মাঠ, দূরে গোলপোস্ট, অসহায় গোলকীপার। হাতখানেক দূরে বলটা ড্রপ খেয়ে পড়ল। আর আমায় পায় কে! গণ্ডারের মতো ছুটলুম বল নিয়ে। সারা মাঠ চিৎকারে ফেটে পড়ছে। শরীরের যত শক্তি ছিল সব সংহত করে বদাম এক শট। গোওল, বলে নিজেই নাচছি দু’হাত তুলে। হঠাৎ একটা হাত এসে পড়ল কানে। হাতটা আমার কান ধরে টানতে-টানতে একেবারে মাঠের বাইরে। সেখানে গোল আর পিঠে আরও কিছু প্রাপ্তি হল। ওটা আমাদের দিকের গোলপোস্ট ছিল। গোলে দাঁড়িয়েছিল রতন। আমার দিক ভুল হয়ে গিয়েছিল। আমার গোলেই আমার টিম হেরে গেল এক শূন্য। আমাদের গেমটিচার আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের বড় ছেলে মরে গেলে লোক যেভাবে কাঁদে সেইভাবে ফেউ ফেউ করে কাঁদলেন। শেষে বললেন, ‘গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর, জীবনে আর বলে পা ঠেকাব না।’ সেই প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছি।
গুঁতোতে-গুঁতোতে ফুটবোর্ড ছেড়ে কোনও রকমে বাসের ভেতরে একটু জায়গা পেলুম। বাঁদিকে লেডিজ সিটের ধার ঘেঁষে। সুস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের কাঁধের ফাঁক দিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই একটা মাথায় নজর আটকে গেল। একমাথা ফুরফুরে সুন্দর চুল। ঢালু কপালের এক চিলতে। উঁচু নাকের ডগা। নাকছাবির পাথরের সামান্য ঝিলিক। দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। এইবার একটু ঝুঁকে পড়ে দেখলুম। সবেদা রঙের ফুল-ফুল শাড়ি, বিছানার মতো নরম কোল, পাশবালিশের মতো উরু। কোলের ওপর সাদা অজগরের মতো অলস দুটো হাত। বুকের ভেতর যেন জলাধার ফাটল। এই তো সেই! যাঁদের কাঁধে দাড়ির খোঁচা মেরে দেখছিলুম, তাঁরাও খুব অভিজ্ঞ। পশ্চাদ্দেশ দিয়ে আমাকে একটা ঠেলা মেরে বললেন, ‘রোগে ধরেছে ভাই। সোজা হয়ে খাড়া থাকার চেষ্টা কর। এখনই হেলে পড়লে চলে।’ আর কিছু বলতে পারলেন না। সকলেরই তখন মৌতাতের অবস্থা। ভ্রমর ততক্ষণই গুঞ্জন করে যতক্ষণ না চাকে বসছে। তারপর? তারপর তো মধুতে মুখ জুবড়ে গেল। তখন মাঝে-মাঝে আধো আধো গুঞ্জন, সামান্য একটু বুজুর-বুজুর শব্দ। আমার সামনের সারির মানুষের তখন সেইরকম এক বুঁদ অবস্থা। ঝগড়া আর বেশি দূর এগোবে কি করে! আমার ভেতরেও তখন হাপর চলছে। গোলপোস্ট সামনে। পায়ে বল। শর্টটা কেবল নিতে বাকি। এইবার তোমার গোল দেওয়া চাইই চাই বসন্ত। সেমসাইড করে বোস না।
বুকের ভেতর কি একটা হ্যাঁচোড় পাঁচোড় করছে। জোরে-জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে অনুরূপ জোরে নি:শ্বাস ফেললুম। স্বভাবতই উষ্ণ। বুকে আমার আগুন জ্বলে। সামনের ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘ইয়ারকি হচ্ছে তখন থেকে, ঘাড়ে অমন করে নি:শ্বাস ফেলছেন কেন? আপনি কি হাপর?’
উত্তর দিলেন আর একজন, ‘বাসে নি:শ্বাস ফেলাও বারণ না কি? ধূমপানটাই বারণ বলে শুনেছিলুম। অত সেনসিটিভ যখন তখন প্রাইভেট গাড়িতেই গেলে পারেন। বসন্ত, তুই লেডিজসিটের কাছে গুঁতোগুঁতি করছিস কেন? এদিকে এগিয়ে আয়।’
বাসের পেটে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছেন মানাদা। লক্ষ্য করিনি। আমাদের পাড়ার বিখ্যাত ব্যায়ামবীর। যার ঘাড়টা আমার উরুর মতো মোটা। পা দুটো স্তম্ভের মতো। হাত দুটো গাছের গুঁড়ির মতো।
যে ভদ্রলোক আমাকে খ্যাঁচোর-খ্যাঁচোর করছিলেন, তিনি না দেখেই উত্তর দিলেন, ‘সব কিছুর একটা লিমিট আছে। আপনাকে কে দালালি করেতে বলেছে?’
মানাদা মাথার ওপর যে রডটা ধরে ছিলেন সেইটাকে একবার ঝাঁকানি মারলেন। আমরা সবাই সেইটাই ধরেছিলুম। রডটা পুরো খুলে ঝুলে পড়ল। আমরা সবাই তালগোল পাকিয়ে পড়ে গেলুম। ভগবানের কি কৃপা। আমার মুখটা পড়ল সকলের ওপর দিয়ে মেয়েটির হাঁটুতে। হাঁটুও কি নরম! মসৃণ সিল্কের শাড়ির মধ্যে কুচুর-মুচুর। সঙ্গে-সঙ্গে উঠে পড়লুম। আসনে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের মাথা বাঁচাবার জন্যে মানাদা রডটাকে তুলে ধরে আছেন। অদ্ভুত ব্যলেনস। নিজে পড়েননি। এখনও টলমল করছেন না। আমরা অল্পবিস্তর আহত। বাস থামছে না। ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের মই কাঁধে করে যেভাবে কর্মীরা যায়, আমরাও সেইভাবে ডান্ডা কাঁধে চলেছি। বাস থামলে গেলো-গেলো করে এগোচ্ছি। ছাড়লে গেলো-গেলো করে পেছচ্ছি। মানাদার দিকে আর যাওয়া হল না। শ্যামবাজার এসে গেল। মেয়েটি নামবে। উঠে দাঁড়াল।
আমি ঝট করে এগিয়ে গিয়ে রডের দরজার দিকের আগাটা হাত দিয়ে চেপে ধরলুম। মাথায় কোনওক্রমে লাগলে রক্তারক্তি হয়ে যাবে। মেয়েটি আমার পাশ দিয়ে নেমে যেতেই আমিও নেমে পড়লুম। তার একেবারে মুখোমুখি। যা থাকে বরাতে। জুতো খাই খাব। তোতলা হয়ে গেছি। তাই তাই সই। সুযোগ একবারই আসে। প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে। বলে ফেললুম, কিছু মনে করবেন না, আমি আপনার কোলে পড়ে গিয়েছিলুম। বলতে সময় লাগল। কারণ প্রতিটা শব্দ ডবল-ডবল বেরোচ্ছে মামলেটের মতো। একটা চোখ একটু ছোট, আর একটা চোখ স্বাভাবিক। টানা ভুরুতে অল্প একটু ঢেউ। মেয়েটি তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মনে হল একটু কারেকসান প্রয়োজন। তখন বললুম, আমি পড়িনি আমার মুখটা পড়েছিল।
মেয়েটি বললে, দাঁত বসে গেছে।
ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়ে বললুম, ‘আমি কিন্তু কামড়াইনি।’
মেয়েটি এক ধমক লাগাল, ‘ষাঁড়ের মতো চেল্লাচ্ছেন কেন? কামড়াবেন কেন? আপনি কি কুকুর? দাঁত বের করেই মানুষ হাসে, দাঁত বের করেই মানুষ পড়ে।’
ফিস-ফিস করে বললুম, ‘তাহলে কি হবে?’
‘কি আবার হবে? আপনি তো আমাকে সেভ করেছেন। আপনি আগে পড়েছেন বলে রডটা আমার ঘাড়ে পড়েনি।’
কোনও কথা নয়, পকেট থেকে প্রেমপত্রটা বের করে সোজা তার হাতে। এমন আবেগের সঙ্গে দিলুম যেন সরস্বতী পূজোয় অঞ্জলি দিচ্ছি, জয় জয় দেবী চরাচর সারে কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে। আয়না নেই, মনের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছি। দাড়ি কামাবার সাবানের এক মুখ ফেনা দিয়ে দাঁত বের করে হাসলে যেমন দেখাবে আমার মুখের চেহারা সেইরকমই হয়েছে।
মেয়েটি বললে, ‘এ আবার কি? কাগজের দলাইমালাই!’
‘ওটা একটা চিঠি।’
‘কার চিঠি?’
‘আপনাকে দোব বলে পকেটে নিয়ে ঘুরছি একমাস।’
‘আমার নাম জানেন?’
‘না।’
‘নাম ছাড়া চিঠি হয়?’
আমাদের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন টুসটুসে এক বৃদ্ধ। তিনি বললেন, ‘আঁটি ছাড়া আম হয়! একসকিউজ মি। নাতনী আমার ঠিক বলেছে। নামটা জেনে নিয়ে বসিয়ে দাও না।’
মেয়েটি বলল, ‘আমার নাম নন্দিনী।’
বৃদ্ধ বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের চরিত্র।’
ট্রাম এসে গেল। মেয়েটি তাড়াতাড়ি বললে, ‘আমি যাই।’
নন্দিনীর পেছন-পেছন সেই আমুদে বৃদ্ধও ট্রামে উঠে পড়লেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলুম হাটের মাঝে। এই ছেলেটা ভেলভেলেটা হয়ে।
।। ভগবান আছেন ।।
গুপীদা বললে, ‘আগে একটু সুস্থির হয়ে বোস। এক ঘটি জল খাও। আর গালে যেটা লেগে আছে সেইটা খোল।’
‘কি লেগে আছে?’
‘কাছে এস।’
গুপীদা আমার ডানগাল থেকে গাঢ় নীল রঙের একটা টিপ তুলে হাতে দিলেন। দিয়ে বললেন, লটকে এনেছ। তোমার কেরামতি আছে।’
সেই টিপটাকে সাদা কাগজে সেঁটে আমার খুপরি ঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে সারাটা দুপুর ধ্যানস্থ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি, তাকিয়েই আছি। চোখে জল আসছে। চোখকে বিশ্রাম দিয়ে আবার তাকাচ্ছি। পরে জেনেছিলুম, এই প্রক্রিয়ায় না কি আমার নাটক সাধনা হয়ে গিয়েছিল। টিপ থেকে কপাল, কপাল থেকে চুল, চোখ, নাক মুখ গলা শরীর। পরে জেনেছিলুম, এইভাবেই পৌঁছতে হয়। এ বি সি ডি করতে-করতে অ্যাবসলিউটে।
।। জুতো ।।
রাত সাড়ে ন’টা। ফুরফুরে বসন্তের বাতাস ছেড়েছে। শীতলা মন্দিরে ঠ্যাং ঠ্যাং করে কাঁসর বাঁজছে। এই সময়টায় খুব পুজো হয়। মায়ের দয়ার ভয়ে। বাড়ির উঠোনের লাল রকে বসে বসে তাজমহলের কথা ভাবছিলুম। চাঁদিনী রাত। যমুনার জল। দখিনা বাতাস। রেডিয়োর ওস্তাদ ধরেছেন বসন্ত বাহার। হিট করেছে একটা গান, যমুনা কিনারে সাজাহানের স্বপ্ন শতদল, তাজমহল। মোট চারবার তাজমহল বলার পর, সোজা অন্তরায়, মমতাজ, সাজাহান। ওই গানটাই একটু রপ্ত করেছিলুম। মনে বড় ধরেছে। মাঝে-মাঝে আমি জাতিস্মর হয়ে যাই। আমিই সাজাহান ছিলুম। ময়ূর সিংহাসনে বসে রাজ্যশাসন করতুম।
হঠাৎ আমার মৌতাত ছিঁড়ে গেল। উগ্রমূর্তিতে ঢুকলেন পিতৃদেব। সটান আমার সামনে। ডান পা থেকে সদ্য কেনা নতুন জুতো খুলে পটাপট পেটাতে শুরু করলেন, রাস্কেল তুমি আমার অন্ন ধ্বংস করে, ধিঙ্গি মেয়ের পেছন-পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছ। পাড়ায় একেবারে ঢিঢি পড়ে গেছে। এদিকে লেখাপড়া সব ডকে। ইয়ারকি পেয়েছ? নতুন জুতোর কি টেস্ট। এক-এক ঘা পড়ছে আর গোটা শরীর চনমন করে উঠছে।
মা হাত খুন্তি ফেলে ছুটে এলেন। আমি কিন্তু তখনও গুনগুন করে চলেছি, যমুনা কিনারে সাজাহানের স্বপ্ন শতদল। মা আমার জন্যে যত না, তার চেয়ে বেশি ব্যাকুল হলেন বাবার জন্যে। আমাদের তিনজনের শুরু হল হটেনটট নৃত্য। মধ্যবয়সী ক্ষিপ্ত এক ভদ্রলোক, দু-পায়ে মাঝে-মাঝেই জড়িয়ে যাচ্ছে প্রলম্বিত কোঁচা, এক হাতে একতারার মতো উদ্যত একপাটি চিনে বাড়ির জুতো। তাঁকে নিরস্ত করার জন্যে আমার গর্ভধারিণী। তিনজনে যেন হরিনাম সংকীর্তনে মেতেছি। মা একনাগাড়ে বলে চলেছেন, ‘ওগো, তোমার হাইপ্রেসার।’ আর বাবা বলছেন, ‘এই বংশের ছেলে হয়ে তুমি মেয়েছেলের পা চাটতে গেছ হারামজাদা।’
পেটাপেটির শব্দে পাড়াপ্রতিবেশী সব ছুটে এল। আসবেই তো। এমন একটা রসাল ব্যাপার। কেউ-কেউ ফোড়ন দিলেন, দিনকাল কি হল? সকলের চোখের সামনে বেন্দাবন লীলা! বাপের এই অবস্থা, কোথায় ভালোভাবে পাশটাশ করে, চাকরিবাকরি করে একটু সাহায্য করবে, তা না প্রেম করছেন, রাসলীলা হচ্ছে!
যা ভাবা গিয়েছিল বাবার হাত থেকে জুতো খসে পড়ল। কাঁপতে-কাঁপতে পড়ে গেলেন।
।। খেলা ঘর মোর ।।
সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গেল। বাবা তো ভীষণ ভালোবাসতেন আমাকে। আমার আগে একটা বোন ছিল। সে হঠাৎ মারা গেল। আমি বংশের একমাত্র ছেলে। আমাকে ঘিরে অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা। গভীর এক বেদনা নিয়ে গভীরতর অচেতনায়, মহাসমুদ্রে একটা মুদ্রার মতো তিনি তলিয়ে গেলেন। এই অবস্থায় রইলেন পনেরো দিন। যিনিই আসেন তিনিই বলেন, ছি-ছি, তুমি তো খুনী। বাপটাকে মেরে ফেললে। মানুষটার মুখের দিকে একটু ফিরে তাকালে না।
প্রতিবেশিরা খুব করলেন। গোটা পরিবারটাকে তাঁরা একেবারে ঘিরে রাখলেন। আমার অপরাধবোধ আরও বেড়ে গেল। ঈশ্বর বলে যে কিছু নেই বেশ বুঝে গেলুম। ডেকে-ডেকে গলা চিরে গেল তবু ঈশ্বরের সাড়া পাওয়া গেল না। উন্মাদের মতো একবার ডাক্তারখানা, একবার ওষুধের দোকান, একবার ব্যাঙ্ক, শুধু ছোটাছুটি। পথে একদিন, দু’দিন নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হল। তাকাল না, হাসল না, পরিচয়ের কোনও রকম স্বীকৃতিই দিল না।
।। দুই নন্দিনী ।।
বরাত মন্দ হলে এইরকমই হয়। নন্দিনী আর মালিনী যমজ বোন। প্রায় একই রকম দেখতে। বোঝার উপায় নেই। আমি কাকে অনুসরণ করতে চেয়েছিলুম? নন্দিনী বা মালিনীকে? রাস্তায় যার মুখোমুখি হলে কোনওরকম পূর্ব পরিচিতির ভাব দেখাত না, আমার সেই ঘোর দুর্দিনে, সে কে নন্দিনী না মালিনী। আমার সেই প্রেমপত্রের জবাব নন্দিনী হয় তো দিতে চেয়েছিল, কিন্তু দেবে কি করে। তখন তো আমাদের বাড়িতে যমে মানুষে টানাটানি। যম বাবাকে টেনে নিয়ে চলে গেল। গলায় কাছা, ঝুলছে লোহার চাবি। রুক্ষ চুল, কোটরগত চোখ, দিশাহারা অবস্থা। বাজার থেকে প্যাঁকাটি বগলে পাড়ায় ঢুকছি। পিতার শ্রাদ্ধের অনেক উপকরণের একটি। দেখি মাল বোঝাই একটি লরি বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছনে একটি ট্যাক্সি। সামনের আসনে নন্দিনীর বাবা। ড্রাইভারের পাশে। পেছনের আসনে দু’পাশে দুই নন্দিনীকে নিয়ে বসে আছেন রাজ রাজেশ্বরীর মতো তাদের গর্ভধারিণী। আমি রাস্তার যে-দিকে সে-দিকের জানালায় নন্দিনী না মালিনী বোঝা গেল না। ওরা চলে গেল পাড়া ছেড়ে। চলে গেল আমার প্রেম, আমার প্রেমপত্র।
।। কাঙালের বেশে ।।
বাবা দেওয়ালের ছবি। সবই পুরোনো। খাট, চেয়ার, টেবিল, দেওয়াল। ছবির ফ্রেমটাই ঝকঝকে। মৃত্যু তখনও টাটকা। মালাটা তাজা। মাকে চিরকাল লাল পাড় শাড়িতে দেখেছি। কালো ফিতে পাড় সাদা শাড়িতে একটা হাহাকারের মতো, কান্নার মতো। বর্ষার সাদা আকাশের মতো। নিস্তব্ধ বাড়ি। গুপীদা বললে, ‘বুঝলে ম্যান, একেই বলে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়া। ছিলে পর্বতের আড়ালে তখন বোঝোনি, এইবার বুঝতে শেখ, কত ধানে কত চাল। তোমার বয়েসে আমারও বাবা মারা গিয়েছিলেন। চোখে সরষে ফুল দেখেছিলুম। তিন তিনটি বোন বিয়ে দিতে হবে। পৃথিবীটা কিসের ওপর ঘুরছে জানো? স্রেফ দুটো শব্দ। বিয়ে।
।। বিয়ে আর বিএ ।।
ন্যাড়া মাথা। বসে আছি গুপীদার নড়বড়ে, রঙচটা বেঞ্চে। বক্তৃতা শুনছি। গুপীদা বলছে, ‘ধরো আমার বাবা বিয়ে না করলে গুপী হত না। গুপীর ঘাড়ে গুপীর তিনটে বোন পড়ত না। তারও আগে যাও, গুপীর বাবার বাবা বিয়ে না করলে গুপীর বাবা হত না। তোমার বাবাও বিয়ে না করলে বসন্ত হত না। মানুষ কেন বিয়ে করে? বিয়ে তাকে করতেই হবে। কারণ, একটা বয়েস পেরোলেই মানুষের ইঁদুর হয়।’
।। ইঁদুর আর কল ।।
ইঁদুর কলে পড়ার জন্যে ছটফট করে। মেয়ে কলে পড়ার জন্যে হেদিয়ে মরে। তোমার অবস্থাটাই দেখলে না! একেবারে ম্যাড হয়ে গেলে। খাওয়া নেই দাওয়া নেই। চোখ দুটো পান্তুয়া। বোম্বাই লাট্টুর মতো, ভোম্বা ঘুড়ির মতো লাট খেয়ে বেড়াচ্ছ। সব ইঁদুরের খেলা। একটা বয়সে মেয়েরা কল হচ্ছে, ছেলেরা ইঁদুর। আমার তো ডবল নিমোনিয়া হয়ে গেল। পুকুরের জলে পড়ে থেকে-থেকে। ওই ইঁদুর। একই পুকুরের চার ঘাট। ওই ঘাটে নয়নতারা। আহা! কলের কি নাম! আর এই ঘাটে গুপে। নয়নতারা চুল খুলছে, নয়নতারা ঘাটের শানে গোড়ালি ঘষছে। নয়নতারা ভিজে কাপড়ে উঠছে, নামছে। দুলে-দুলে কলসী মাজছে। নয়নতারা সখীদের জল ছিটোচ্ছে। নয়নতারা পানকৌড়ির মতো ভাসছে। নয়নতারা ঘাটে বসে, পেয়ারা খাচ্ছে কুসুর কুসুর। গুপীর ইঁদুর লাফাচ্ছে। জেলেদের জালের হাঁড়ির মতো গুপী ভেসে আছে জলে। পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আছে ভিজে কাপড়ে নয়নতারা। তিনটে বোন নেই। হেঁপো রুগী মা নেই। নয়নতারা। গুপী ট্যারা। গুপী নিমোনিয়ায় কাত। বুকে পুলটিস। মাসকলাইয়ের সেঁক। মা সাঁসাঁ শ্বাস টানছে আর রাতের পর রাত জাগছে। আর ছেলে জ্বরের বিকারে ডুকরে-ডুকরে উঠছে, নয়ন তা আ রা, নয়ন তারা। লে হালুয়া। সেই নয়নতারা এখন নয়নসর্ষে। ইঁদুর ঘুমল শরীর জুড়লো ছানাপোনা নিয়ে / এখন ভেবে-ভেবে মরো তুমি ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে। মজা এই, ছেলেরাই বিয়ে করে, মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেদেরই বেশি হ্যাঁচোড়-প্যাচোড়। চুলবুল-চুলবুল করে। বিয়ের আগে এখন বিএটা করো। সংসারটাকে একটু ঠেলে ঠুলে তোল। তোমাদের তো আবার অনেক জ্বালা, ভদ্দরলোক ক্লাস। আমি তেলেভাজার দোকান দিয়ে ম্যাও সামলেছিলুম। কিছুকাল ঘরামির কাজও করেছি। চটকলের গেটের পাশে শস্তার মিষ্টি নিয়ে বসেছি। বাঙলা মদের দোকানের ধারে ড্রেনের পাশে বসে ডিমের মামলেট ভেজেছি। তুমি তো তা পারবে না ভাই। এইবার একটু পাঠে মন দাও। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে। তোমাকে মানুষ করবেন বলেই জলে ফেলে দিলেন, যাতে তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখে যাও। যত জল গিলবে, তত দম বাড়বে।
।। খুড়োর কল ।।
খুড়োমশাই উঠে পড়ে লাগলেন। পেছন থেকে দড়ি ধরে নাচালেন জাঁদরেল খুড়ী। ভদ্রাসন দু’ভাগ করতে হবে। সব সেপারেট-সেপারেট। যে যার নিজের মতো থাকব, শান্তিতে থাকব। খুড়োকে মানুষ করেছিলেন বাবা। চাকরি করে দিয়েছিলেন বাবা। বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। ভয় হল যদি দাদার সংসারে টাকা ঢুকে যায়! ছেলেরা খরচ করে শ্বশুর বাড়ির জন্যে। শালিকে শাড়ি দেবে বোনকে অভাবের কাঁদুনি গেয়ে শোনাবে। শাশুড়িকে দু’বেলা হাসপাতালে দেখতে ছুটবে, মাকে কাজের দোহাই দেবে। শালার চাকরির জন্যে রাতের ঘুম চলে যাবে, ভাইকে বলবে দামড়া। আমার খুড়োর ভীষণ ভয় হল, মেয়ে বড় হয়েছে। অ্যানিমিক সুন্দরী। গোটা শীত গলায় কম্ভার্টার। টনসিলের ট্রাবল। হাঁচির রাগ-রাগিণী। কাশির মালকোষ। দুটো কথায় সবাই মাত, ম্যাগগো, বিশ্রী। সবই সে শিখছে, নাচ, গান, ছবি আঁকা, স্পোকেন ইংলিশ, হাই সোসাইটির দিকে নজর। বিবিধভারতীতে চিঠি লিখে মুকেশের গান শোনে। একবার নাম বলেছিল, কলকাত্তাসে রাখী, কাবুল, টুনটুন। সেই থেকে রাখী বেতার শিল্পী। রাখীর মা যাকে দেখে তাকেই বলে, রেডিও শুনেছিলে? রাখীর নাম অ্যানাউনস করেছিল। দিদিরও দিদি আছে। এক দিদি বলে বসল, কেন পালিয়ে গিয়েছিল বুঝি! সেই দিদির সঙ্গে আড়ি। অসভ্য, পেতনী। যেমন দ্যাবা তেমনি দেবী। ঢাক আর ঢোল। খুড়ী ইংরিজি বলার খুব চেষ্টা করে। বলেও ভালো। তবে এক বলতে আর এক বলে ফেলে। সেই মহিলাকে ননসেনস বলতে গিয়ে বলে ফেললে, কমানসেনস। রাখী মাকে বললে, ইললিটারেট। মা মেয়েকে বললে, ডাংকেক। খুড়ো দুজনকেই বললে, বুলশিট। উত্তেজনায় রাখীর টনসিল বেড়ে গেল। সারারাত আমাদের কাশিবাস।
খুড়ো প্রচার করে বেড়াতে লাগল, চরিত্র ভালো নয়। মেয়ে বড় হয়েছে। বলা যায় না, যদি চুমুচামা খেয়ে ফেলে। নির্জনে জাপটে ধরে। বাপটাকে তো ভার্চুয়ালি মার্ডার করেছে। ওর জন্যে পাড়ার মেয়েরা পথে বেরোতে ভয় পায়। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। বাবার ব্যালেনস ভেঙে চলছে। এরপর চুরি ডাকাতি করবে।
মাতব্বররা এক জোট হলেন। কোর্ট থেকে একজন এলেন।
।। সিঁড়ির প্যাঁচ ।।
যে সিঁড়ি নেবে সে উত্তরের এঁদো দিকটা পাবে। যে সিঁড়ি করে নেবে সে পাবে দক্ষিণ। শুধু তাই নয়, একটু বেশি পাবে; কারণ তাকে গাঁটের কড়ি ফেলে সিঁড়ি তৈরি করাতে হবে। কাগজে কলমে বাড়ি দু’ভাগ। সামনে প্ল্যান। বলুন কে কোনদিকে নেবেন? আমাদের ভাঁড়ে মা ভবানী। আমরা উত্তরেই গেলুম। উঠোন বরাবর বিশাল পাঁচিল উঠে গেল। আমাদের দিকটা আরও অন্ধকার হয়ে গেল আমাদের বরাতের মতো। নিচের তলায় দিনের বেলাতেই আমাদের আলো জ্বালতে হয়। আরশোলার আড়ত।
খুড়োমশাই বড় সাবধানী। বলা তো যায় না, বসন্ত মাঝরাতে পাঁচিল টপকে এসে রাখীকে রেপ করতে পারে। নিজের অংশটা বেচে দিলেন এক রেশানের দেকানের মালিককে। তিনি এসেই ক্যানেস্তারা পেটাতে লাগলেন যাতে আমরা আমাদের অংশ তাঁকে বিক্রি করে দিয়ে যে-চুলোয় হোক চলে যাই। রাস্তার ওপর বাড়ি। তল্লাটে এক ছটাক জমি নেই। সম্পত্তি করতে হলে দখল করতে হয়। শুধু পয়সায় হয় না, কেরামতি জানা চাই। ওদের পরিবার পরিজনের সংখ্যা অনেক। জানা-অজানা নানা ধরনের উৎপাত শুরু হল। আমের আঁটি, কাঁঠালের ভুতি, যাবতীয় অশ্লীল নোংরা এসে পড়তে লাগল আমাদের উঠোনে।
।। কামড়ে থাকো ।।
জীবনে পোড় খাওয়া গুপীদাই আমার বন্ধু, যেন পিতা। গুপীদা বললে, ‘বসন্ত মহাভারত শেষ হয় না। জমি, জরু আর গোরু তিন নিয়েই লড়াই। সেই প্রবাদ, আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বন ভালো। একদম টলবে না। সহ্য করো। লড়ে যাও। আমার খুড়োও আমাকে ভিটে ছাড়া করেছেন পেঁদিয়ে। মাথার চাঁদিতে সাতটা সেলাই। চুল সরালেই একটা খাল দেখতে পাবে। চালাও বুদ্ধির লড়াই। মাধবদাস বাবাজীকে খবর দি। দেখি পাশা খেলায় এবার যুধিষ্ঠির জেতে কি না!
।। নাম ব্রহ্ম ।।
উঠোনে বসে গেল হরিসভা। রকের ওপর নারায়ণ। তিন দিন লাগাতার হরিনাম সংকীর্তন। নাম যাঁরা করেন, তাঁরা ইচ্ছে করেই বেসুরো হন। সুরে গাইলে মানুষের চেতনায় ঝিম ধরে যাবে। মাধবদাসবাবাজীর গলায় যেন সাতটা ষাঁড়। সাত সুরে চেল্লায়। মাঝে মাঝে যখন হুঙ্কার ছাড়েন ভাবে, মনে হয় মহিষাসুর মার্ডার হচ্ছে। দোয়ারকিরাও কম যান না। মৃদঙ্গধারী থেকে-থেকেই ক্ষেপে যান। খোল নিয়ে ঝটাপট। কেউ কারও কথা শুনতে পাচ্ছে না। ঝগড়াঝাঁটি সব নামের তলায়। শরীরে-শরীরে চনমনে রক্ত স্রোত। থেকে-থেকেই একটা ছুটকো দল খোল-করতাল নিয়ে পাড়া পরিক্রমায় বেরিয়ে যাচ্ছে। এরই মাঝে মাধবদাস বাবাজীর ভাবাবেশ হল। তিনি এই ওঠেন তো এই পড়ে যান টলে। ভাবের আবেশে আর্তনাদ করতে লাগলেন। সে কি করুণ চিৎকার যেন অ্যাপেন্ডিসাইটিস বাস্ট করেছে—ওরে জগাইরে, ওরে মাধাইরে! কীর্তনিয়ারা প্রবল সুরে গাইতে লাগলেন—ওরে জগাই মাধাই পাপী ছিল, নামের জোরে তরে গেল। রটে গেল, ভাবাবেশে মাধবদাস যার গায়ে পা ঠেকাবেন, তার ইচ্ছা সব পূর্ণ হবে। মাধবদাসের কৃপা। ভাবের ঘোরে মহুয়ামাতাল ভাল্লুকের মতো টলতে-টলতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কানে-কানে বললেন, ‘অজ্ঞান হয়ে যাও। লাথি না মারা পর্যন্ত হুঁশ হবে না।’ বলেই তিনি বৎসহারা গাভীর মতো গান ধরলেন, ‘মেরেছিস কলসীর কানা, ওরে জগাই রে! ওরে মাধাই রে! তা বলে কি প্রেম দোব না!’ একপাশে আমি পড়লুম। আর এক পাশে মাধবদাসজী। পড়তে-পড়তে দেখলুম রেশনের দোকানের মালিক কালোবাবু ঢুকছেন।
।। জর্দার কৌটো ।।
আমাদের এক চিলতে ছাতে পায়চারি করছি। ওপাশে কালোবাবুদের দিক থেকে ঠাঁই করে একটা জর্দার কৌটো আমার পায়ের কাছে এসে পড়ল। পার্টিশানের সময় ছাতেও একটা পাঁচিল উঠেছে। ওপাশ থেকে কে ছুঁড়ল দেখতে পেলুম না গোল কৌটো গড়িয়ে একধারে চলে গেছে। কৌটোটা বেশ রূপসী। কৌতূহলে তুললুম। খুলেও ফেললুম। ভেতরে একটা কাগজ। সাধারণ কাগজ নয়, একটা চিঠি, আমাকেই লেখা, বসন্তদা, তোমাকে আমি খুব চিনি। তোমাকে আমি ভালোবাসি। আই লাভ ইউ। ভীষণ-ভীষণ ভালোবাসি। শোন, তোমাকে একটা গোপন খবর দি। বাবা, তোমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। বন্ধুর মতো গিয়ে বলবে, তুমি যদি আমাকে পড়াও। সঙ্গে-সঙ্গে বলবে, না, আমি পারব না। খুব বড় একটা চক্রান্ত করেছে। ভীষণ একটা বদনাম দিয়ে, লোক জড় করে, তোমাকে মার খাইয়ে, থানাপুলিশ করে পাড়া ছাড়া করবে। নিজে নয় আর একটা লোককে দিয়ে তোমাদের অংশটা কেনাবে। তার কাছ থেকে আবার নিজে কিনে নেবে। রাস্তার দিকে দুটো দোকানঘর ফোটাবে। তোমাকে মারার জন্যে গুণ্ডাটুণ্ডা সব রেডি করে ফেলেছে। তুমি আমার কথা শুনে খুব সাবধান হবে। কেন জানি না আমি তোমাকে খুব-খুব ভালোবাসি। এমনি-এমনি। ইতি, তোমার সর্বাণী।।
প্রেম পত্র, বলে একটা লাফ মারতে ইচ্ছা করল। থাক না তাতে যতেক হুঁশিয়ারি। সর্বাণীকে রোজই দেখি। দৈত্যকুলে স্ত্রী-প্রল্হাদ। রাস্তা দিয়ে যখন স্কুলে যায় নেকড়ের পাল চনমন করে ওঠে। যাক, জীবনের প্রথম প্রেমপত্র। পরিষ্কার হাতের লেখা। একটাও বানান ভুল নেই। কি ভালো লাগছে! জলজ্যান্ত একটা মেয়ে, হোক সে শয়তান-দুহিতা আমাকে ভালোবাসে। ওরে বাবারে। বিশাল খড়খড়ে পাঁচিলটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল। মাত্র কুড়ি ইঞ্চি ব্যবধানে দাঁড়িয়ে সে এই কৌটো ছুঁড়ছে পিতার মৃত্যুশোক, সংসারের টালবাহনা সব ভুলে গেলুম। আমি ফুল হয়ে ফুটি / আমি ভ্রমর হয়ে উড়ি / আমি জেব্রা হয়ে ছুটি।। কবিতা এসে যাচ্ছে।
।। তিলকধারী ।।
তিলকসেবা করে, পরম বৈষ্ণবের রূপ ধারণ করে তিনি এলেন। হাতে মিঠাইয়ের বাক্স, ফুলের মালা। ‘জয় প্রভু’। যুগল মূর্তির সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম। বিষয়ীর মালা। বহরে ছোট। গলায় হল না। হল চরণের মালা। কালোবাবু প্রচুর মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলে, ‘আমার মেয়েটিকে যদি পড়াও, রোজ দরকার নেই, সপ্তাহে তিন দিন, পাশার দান ফেললেন, কচে বারো।’ মেয়ে তো আগেই আমাকে চাল শিখিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে, ‘কচে না।’ বিনীত প্রত্যাখ্যান। ‘আমার ফাইনাল ইয়ার। আমি যে পারব না কাকাবাবু। তা ছাড়া স্কুলের মেয়েকে স্কুলের টিচার পড়ালে রেজাল্ট ভালো হয়।’
প্রচুর লোভ দেখালেন। ধাপে-ধাপে মাইনে বাড়ালেন। চাল, চিনি গমের কোনও অভাব রাখলেন না। সারা ঘর বস্তায়-বস্তায় ভরে গেল। দান ফেলছেন, দান ফেলেই যাচ্ছেন। এক সময় আমার গর্ভধারিণীও লোভে নড়েচড়ে উঠলেন। আমার না আর হ্যাঁ হল না। তুমি নিজের কোটে টেনে নিয়ে গিয়ে আমার মাথা মুড়োতে চাও। কালোধন, তোমার শত্রু তোমার ঘরে বসে আছে। বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা। মাকে জয় রাধে, বলে, কালো কেটে গেল। ফুল আর মিষ্টিতে পাঁচ টাকা গচ্ছা।
।। আবার জর্দার কৌটো ।।
এইবার পাঁচিলের ওপর ক্ষণিকের জন্যে আঙুলের মাথা দেখা গেল। গোল নয় থ্যাবড়া ডিবে। টুং করে পড়ল। তাড়াতাড়ি তুলে নিলুম। চিঠিতে বেনারসী জর্দার গন্ধ। বসন্তদা, থ্যাঙ্ক ইউ। আমার কথা শুনেছো। সব সময় আমার কথা চলবে। লক্ষ্মী ছেলে, তাহলে তোমার কোনওদিন কষ্ট হবে না। তুমি ভীষণ-ভীষণ ভালো, সোনা ছেলে। তোমাকে ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছে। কোনও দিন কাছে পাই। শোনো মিঞা কাজের কথা। এইবার প্ল্যান আরও জোরদার। তোমাদের বাড়িতে যে অল্পবয়সী মেয়েটা বাসন মাজে, তাকে টাকা খাইয়ে হাত করেছে। তোমাকে বলে রাখি মেয়েটা একটু অন্যরকম। এইতেই বুঝতে পারবে। না পারলে মাথা মোটা। তুমিই মেয়েটাকে দরজা খুলে দাও। সাবধান! হঠাৎ দেখবে খুব গায়ে পড়া হয়ে যাবে। তোমাকে শরীরের লোভ দেখাবে। তোমাকে বাধ্য করবে খারাপ একটা কিছু করতে। ও আবার তোমার মায়ের খুব প্রিয়। খুব চটকদার। ফাঁদে পা দিও না। নানা ছল চাতুরি করবে। তারপর বস্তির মন্তানদের নিয়ে বাড়ি ঘেরাও। পেটে এসে গেছে বলে চিৎকারও করতে পারে। পারলে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়ে কোনও বয়স্কাকে রাখো। আমি আছি নো ফিয়ার। তোমার সর্বাণী। ভোম মেরে বসে রইলুম মায়ের তুলসী গাছের দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার হাতের লেখা সুন্দর। সুন্দর কম্পোজিসান। নির্ভুল ইংরিজি। মেয়েটা মানুষ হবে। মনে-মনে খুব আশীর্বাদ করলুম। একেই বলে প্রেম। আসল প্রেম মেয়েদের দিক থেকেই আসে। ছেলেদের দিক থেকে গেলে সেটা হয় পেপারওয়েটের মতো। ফড়ফড় উড়ে পালাতে চায়। সুযোগ পেলেই ফুড়ুত। ল্যাংল্যাং করে কার পেছনে ছুটছিলুম। অহঙ্কারী নন্দিনী!
।। বর্ণে বর্ণে ।।
ভোরবেলা যথারীতি দরজার কড়া নড়ল খুটুস খুটুস। রাতে মায়ের ঘুম হয় না। ভোরের দিকে একটু ঘুমোক। দরজা খুলে দিলুম। সামনেই শেফালি। পাকা গমের মতো গায়ের রং। টাইট লাল ব্লাউজ। বুকের একপাশ আজ একেবারেই খোলা। ভয়ঙ্কর। সচরাচর দেখা যায় না এমন। রাতের খোঁপা টাল খেয়েছে। শাড়ি একটু তুলে পরা। পেট দেখা যাচ্ছে। আমাকে দেখে দু’হাত তুলে আড়ামোড়া ভেঙে বলল, ‘শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। কেউ বেশ একটু টিপে দিন!’ চোখের অদ্ভুত ভঙ্গি। প্রায় আমার গায়ে পড়ে আর কি। বেশ অনুভব করলুম নারীদেহের কি শক্তি! সর্বাণীর কণ্ঠস্বর, মিলিয়ে নাও। খুব সাবধান!
আমি ইচ্ছে করে কাশলুম। খুক খুক। যেন শুকনো কাশি। তাড়াতাড়ি মুখে চাপা দেওয়ার ভান করে সরে গেলুম। একপাশে দেওয়াল একপাশে শেফালি। আমাকে প্রায় ঠেসেই ধরেছিল। কতই যেন আপনজন, ‘কাশি হয়েছে বুঝি! শরীর গরম হয়েছে।’
মুখ ঘুরিয়ে রেখে কাশতে কাশতেই বললুম, ‘সাধারণ কাশি হলে ভয় ছিল না। এমনই বরাত, ডাক্তার বলছেন টিবি। ভীষণ ছোঁয়াচে তো। এই কাশি থেকেই অন্যের শরীরে রোগটা চলে যায়। জ্বর হচ্ছিল ঘুসঘুসে। পাত্তা দিইনি। কাল একস রে করাতে ধরা পড়ল। তুমি বাসন মাজার পর ভালো করে হাতে সাবান দিয়ো। দেখো তোমার যেন না হয়। একটু-একটু রক্তও বেরোচ্ছে কাশির সঙ্গে। কলতলাটা আগে ভালো করে ধুয়ে নিয়ো। কোথায় কি ফেলেছি।’
সঙ্গে-সঙ্গে শেফালির স্বরূপ বেরিয়ে এল পুতনা রাক্ষুসীর মতো, ‘ওমা, সে কি কথা! টিবি কি গো! সে যে খুব হারামি রোগ। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে যায়। আমার জ্যাঠা মরল। তোমাদের কাজ কে করবে বাপু! কটা টাকার জন্যে আমার মরার স্বাদ নেই। কই মা তো কিছু বলেনি। চেপে গেছে। তোমরা অন্য লোক দেখে নাও। আমি আজই জবাব দিলুম।’
‘আর কটা দিন করে যাও শেফালি, মা তা না হলে মারা পড়বেন। তোমাকে দশটাকা বেশি দোব।’
‘মরণ আর কি! ওই টাকায় তুমি ওষুধ খেয়ো। আমার টাকার অভাব হবে না যতদিন গতর আছে।’
আবার আমি কেশে উঠলুম। পুতনা তিন লাফে রাস্তায়।
।। আবার আবার আবার জর্দার কৌটো ।।
এবারে গোল কৌটো। চিঠিটা একটু দীর্ঘ বসন্তদা, সাবাস। ভালো চাল চেলেছ। ওরা এইবার আমাকে একটু সন্দেহের চোখে দেখছে। তুমি ভুলেও আমাকে চিঠি লেখার চেষ্টা কোরো না। এবারের পরিকল্পনা আরও ঘোরাল। তোমার বন্ধু গোপেনকে ধরেছে। তোমার খুবই ঘনিষ্ঠ। সে তোমাকে মদ আর মেয়েছেলে ধরাবে। কায়দা করে। একটু একটু করে। তিন মাসের মধ্যে তোমাকে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবে, যাতে সব উড়ে পুড়ে যায়। খুবই কাঁচা পরিকল্পনা। তবু সাবধান। গোপেন থেকে দূরে থেকো। ওর অনেক গুণ। বলে রাখি, রাস্তায় বা কোনওখানে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলে কথা বলার চেষ্টা কোরো না। মনে রাখবে, তুমি আমাকে চেন না, আমিও তোমাকে চিনি না। আর এক মাস পরে আমি আঠারোয় পা দিচ্ছি। তারপর দেখা যাবে।
সর্বাণী আরও অনেক কিছু লিখেছে। পারিবারিক ইতিহাস। মানুষের যত নোংরামির কাহিনি। সব শেষে লিখেছে, নোংরামির পরিবেশে থাকার ফলেই নোংরার প্রতি আমার একটু ঘৃণা এসেছে।
।। আশীর্বাদ ।।
কেউ মানে। কেউ মানে না। ভেতরে একটা কান্না ছিল বাবার জন্যে। ঈশ্বরের আদালতে বিচার হলে পিতৃহত্যার জন্যে ফাঁসি হত আমার। গুপীদা বললে, ‘বাবার আশীর্বাদ তোমাকে ঘিরে আছে। যে ভাবে ফাঁকি মেরেছ তাতে তোমার পাশ করাই উচিত নয়, পেয়ে গেলে ফার্স্ট ক্লাস। অবশ্য শেষটা তুমি খুব চেপেছিলে। শরীরটা বেশ কাহিল করে ফেলেছ, খাওয়া দাওয়া কেমন জুটছে?’
‘ভাত, ডাল, একটা তরকারি।’
‘মাছ, মাংস, ঘি, দুধ?’
‘না।’
‘তাহলে শরীর হবে কি করে?’
‘হজমে। খেয়ে হজম করতে পারলে, যা খাব তাইতেই শরীর খুলবে। আমাশা ধরেছে।’
‘ভালোই। বাঙালির দুটো আশা, নিরাশা আর আমাশা। আর ওই দুটো সারা দুরাশা। একটু মাংস-টাংস খাও তা না হলে আমাশা সারবে না।’
‘তার মধ্যেই চাকরি পেয়ে যাবে।’
‘অতই সহজ।’
‘একবার সায়েব চ্যাটার্জিকে ধরো না।’
‘অনেকেই ধরে ঝুলে আছে। অনেকে হাত টাটিয়ে পড়েও গেছে। চ্যাটার্জি সায়েবকে ধরলে ঘোড়ার ডিম হবে। ধরতে হবে গোলাপীকে।’
‘সে আবার কে?’
।। গোলাপীকে ধর ।।
‘দক্ষিণেশ্বরে এক অবতার পুরুষ এসেছিলেন। জানেন কি।’
‘জানব না মানে? ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ।’
‘অতি বাস্তাববাদী, রসিক মহামানব। তাঁর একটা গল্প শুনুন, একজন উমেদার বড়বাবুর কাছে আনাগোনা করে হয়রান হয়েছে। কাজ আর হয় না। আফিসের বড়বাবু। তিনি বলেন, এখন খালি নেই, মাঝে-মাঝে এসে দেখা করো। কতকাল এইভাবে কেটে গেল। যায় আর আসে। জুতোর সুখতলা ক্ষয়ে গেল। উমেদার হতাশ। সে একদিন বন্ধুর কাছে দু:খ করছে। বন্ধু বললে, তোর যেমন বুদ্ধি। ওটার কাছে আনাগোনা করে পায়ের বাঁধন ছেঁড়া কেনে? তুই গোলাপীকে ধর, কালই তোর কাজ হবে। উমেদার বললে, বটে!—আমি এক্ষুনি চললুম। গোলাপী হল ঠাকুরের ভাষাতেই বলি, বড়বাবুর রাঁঢ়। উমেদার দেখা করে বললে, মা, তুমি এটি না করলে হবে না—আমি মহাবিপদে পড়েছি। ব্রাহ্মণের ছেলে আর কোথায় যাই! মা, অনেকদিন কাজকম নেই, ছেলেপুলে না খেতে পেয়ে মারা যায়। তুমি একটি কথা বলে দিলেই আমার একটি কাজ হয়। গোলাপী ব্রাহ্মণের ছেলেকে বললে, বাছা, কাকে বললে হয়? আর ভাবতে লাগল, আহা, ব্রাহ্মণের ছেলে বড় কষ্ট পাচ্ছে! উমেদার বললে, বড়বাবুকে একটি কথা বললে আমার নিশ্চয় একটা কাজ হয়। গোলাপী বললে, আমি আজই বড়বাবুকে বলে ঠিক করে রাখব। তার পরদিন সকালে উমেদারের কাছে একটি লোক গিয়ে উপস্থিত, সে বললে, তুমি আজ থেকেই বড়বাবুর আফিসে বেরুবে। বড়বাবু সাহেবকে বললে, এ ব্যক্তি বড় উপযুক্ত লোক। একে নিযুক্ত করা হয়েছে, এর দ্বারা আফিসের বিশেষ উপকার হবে।’ গুপীদা বললেন, ‘এর কোনও গোলাপী আছে?’
‘এক নয় গুপীদা, দু’দুটো গোলাপী। একজনের নাম আশা, থিয়েটারের হিরোইন। আর একজনের নাম রুমা, পরেশের বউ।’
‘কোন পরেশ! কাপ্তেন পরেশ। বউয়ের রোজগারে কাপ্তেনি করে।’
‘তা ধরো, ধরে ফেল। হাতের পাঁচ রুমাকেই ধরো।’
‘এ গোলাপী সে গোলাপী নয় গুপীদা। এরা আধুনিকা। এদের ধারে কাছেও এগোতে পারব না।’
‘তুমি তা হলে কি লেখাপড়া শিখলে? ফালতু। নিজে নিজেই যদি চাকরি জোগাড় করতে না পারলে!’
‘হত যদি এম এস সিটা করতে পারতুম।’
‘তা করে নাও।’
‘এই শুনলেন আর টানার মতো রেস্ত নেই। এখন একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়ে যাই। যবে লেগে যায় যাবে। ততদিন হরিদাসের বুলবুল ভাজা।’
।। কোথায় সীতা ।।
থিয়েটারে রামচন্দ্র গান গেয়েছিলেন, কোথায় সীতা, কোথায় সীতা, জ্বলছে বুকে স্মৃতির চিতা। আমি সারাদিন ফ্যা ফ্যা করে ঘুরি—কোথায় চাকরি কোথায় চাকরি। গোটাকতক ইন্টারভিউ হয়ে গেল। প্রশ্নের ধরন দেখেই বোঝা যায়, ভেতরে লোক আছে। হাতীবাগানের সিনেমাপাড়ায় গোপেনের সঙ্গে দেখা। সিনেমা হলের বাইরে কার জন্য অপেক্ষা করছে। ‘আরে বসন্ত যে।’ কপ করে হাত চেপে ধরল, ‘কি চেহারা হয়েছে মাইরি! তোর নাকি টিবি হয়েছে?’
‘সন্দেহ করেছিল। এখন বলছে হয়নি। ম্যালনিউট্রিসান।’
‘তুমি শালা বিধবা মেরে থাকবে। একটু খাও দাও ফূর্তি লোটো, যে বয়েসের যা।’
‘ওর জন্যে টাকা চাই রে?’
‘নিজের পয়সায় ফূর্তি করত জমিদাররা। ভালো মক্কেল পাকড়াতে পারলে সব রাতেই মাইফেল।’
‘মক্কেল পাব কোথায়, আমার কি তেমন এলেম আছে। উকিলরাই মক্কেল পাচ্ছে না।’
‘জমানা বদলে গেছে মক্কেলরা এখন চামচা ধরছে। তুই যে আজকাল আমাকে এড়িয়ে যাস। পরপর ভাবিস। আমার সঙ্গে থাক না, লাইফটা এনজয় করতে পারবি। মোড়ক খোলা মেয়ে দেখেছিস!’
‘না ভাই!’
‘একেবারে নালায়েক। বয়েস বাইশ পেরলো এখনও তোর চোখ ফুটল না। সেই কবে চাকরি পাবি। বিয়ে করবি। পুঁটুরানী আসবে, দয়া করে দেখতে দেবে, তবে তুমি আপেল খাবে! অচল, অচল। হয় মানুষের মতো বাঁচ, না হয় গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়। মায়ের আঁচল ধরা হয়ে আর কত বছর থাকবি? শেম শেম!’
হাঁপাতে-হাঁপাতে একটা মেয়ে এল। খুব কম বয়স নয়। ভালো ঘরের বলেও মনে হল না। উগ্র সাজপোশাক। তবে খুব চড়া যৌবন। দুপুরবেলায় ভোমরার মতো ঝিমধরানো নেশা। হাতে একটা পুঁচকে রুমাল। সেইটা দিয়ে সাবধানে কপাল মুছতে-মুছতে বললে, ‘কি দেরি হয়ে গেল!’ একটা খিস্তি করল। যার জন্য দেরি তাকে।
গোপেন আমার কাঁধে হাতে রেখে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কানে-কানে বলল, ‘চুমকি, পাড়ার মেয়ে। হেভি সেকস। আমাদের সঙ্গে যাবি সিনেমায়? অন্ধকারে একটু হাতটাত দিবি। তারপর আমরা আসল জায়গায় যাব। পাগল হয়ে যাবি মাইরি। একটু চড়িয়ে নেমে যাবি। তল পাবি না। সব খরচ আমার। দেখবি, দু:খ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা সব ভুল হয়ে যাবে। ওই গানটার সঙ্গে যা নাচে না মাইরি, গোরি গোরি মাকে ছোড়ি, গায়ে কিচ্ছ রাখে না।’
মেয়েটা ব্যবসাদারের গলায় দূর থেকে বলল, ‘আবার মাল ভেড়াচ্ছ না কি? ডবল লাগবে।’ মনে হল গদগদে গোবরে ভড়ভড় করে ডুবে যাচ্ছি। আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই যা থাকে বরাতে বলে ভিড়ে যাব। মানুষ, ডোবে কিসে? জলে, ঋণে, পাঁকে, প্রেমে, অহঙ্কারে, আবর্জনায়, স্নেহে, মদে, মেয়েমানুষ।
ভাবতে-ভাবতেই একটা ট্রাম এসে গেল, চলন্ত ট্রামেই উঠে পড়লুম লাফ মেরে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলুম, গোপেন বোকার মতো তাকিয়ে আছে। সামান্যই পথ। শ্যামবাজার আর কত দূর। একটা আসনে ধপাস করে বসে পড়লুম। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভাড়া দিতে গেলুম। কন্ডাক্টর নিলেন না। বললেন, ‘শ্যামবাজার গুমটি। ভাড়া লাগবে না।’ আমার উলটো দিকে বসে টিকিটের হিসেব মেলাচ্ছেন আর মাঝে-মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যে ভাবে ট্রামে উঠেছি, খুবই অস্বাভাবিক। যেন ছেলেধরার ঝোলা ফেঁড়ে পালিয়ে এসেছি। নিজের ভাবনায় তলিয়ে গেলুম। গোপেনটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে রুমা তো গোপেনের বোন! তা হলে! গোপেনের সঙ্গে একটু এদিক, সেদিক করতে পারলে রুমাকে ধরে সায়েব চ্যাটার্জিকে কব্জা করা যায়। চ্যাটার্জির হাতে অনেক চাকরি।
পরক্ষণেরই মনে হল, ভাই আর বোন দুজনেই চরিত্রহীন। তারপর মনে হল, চরিত্র কাকে বলে? এই যুগে চরিত্রের পুরোনো সংজ্ঞার কোনও দাম আছে! একের পর এক চিন্তা আসছে।
সবশেষে সর্বাণীর সাবধানবাণী, গোপেন তোমাকে ফাঁসাবে। খুব সাবধান! ট্রাম গুমটির ভেতর ঢুকছে। টুপ করে নেমে পড়লুম।
।। একটা রাত ।।
বেশ ঘন কালো মেঘ। মাঝে-মাঝেই বিদ্যুৎ গাছের শিকড়ের মতো হিল-হিল করে উঠছে আকাশে। ঠিক নটার সময় শুরু হল ঝড়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ওলটপালট করে শান্ত হল, নামল বিপর্যয় বৃষ্টি। অঝোর ধারা। ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে চলে গেল বিদ্যুৎ। ঘোর অন্ধকার। রাত এগারোটার সময় মায়ের ফুড পয়েজনিং। দুপুরে সত্যনারায়ণের সিন্নি খেয়েছিলেন এক ভাঁড়। দেখতে-দেখতে হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা। বাহ্যজ্ঞানশূন্য।
কোথায় যাই! কি করি! মায়ের কাছে কাকেই বা রেখে যাই। গুপীদার দোকান বন্ধ। পাশে কালোবাবুদের বাড়িতে ফোন আছে। মা মারা গেলেও যাওয়া যাবে না। নিচে দালানে নারায়ণের মূর্তি। সন্ধেবেলা পুজো হয়েছে। এখন চারপাশ জলে ভাসছে। অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে আছেন নারায়ণ। ঝড়ে গলার মালা উলটে গেছে। ধুনোর ছাই উড়ে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। প্রদীপ উলটে গেছে। নিচে নেমে এসেছিলুম বাইরে ঝাঁপ মারব বলে। পথে না পড়লে পথ পাওয়া যাবে না। এ যা কেস, অ্যাম্বুলেনস ডেকে মাকে বেলেঘাটা নিয়ে যেতে হবে। নারায়ণের সামনে অন্ধকারে একবার থমকে দাঁড়ালুম। আকাশ ছেঁদা হয়ে তোড়ে বৃষ্টি। নারায়ণের গায়ে ছাট লাগছে। একবার মনে হল ডেকে দেখি। তারপর ভাবলুম, অকারণ সময় নষ্ট। গড ইজ ডেড। গড ইজ কোল্ড। ঈশ্বর বড় মানুষ। গরিব দু:খীদের জন্যে কিছু করেন না। কোনও-কালেই করেননি। ঈশ্বর হলেন মানুষের ঠোঁটে সিগারেটের মতো। লোক অভ্যাসে টানে। পেটও ভরে না, পুষ্টিও হয় না। স্রেফ ধোঁয়া। সিগারেট খাওয়ার মতো ভগবানকে ডাকাও মানুষের একটা অভ্যাস। যুগ-যুগ ধরে ডেকেই যাচ্ছে। কেউ নেই। ছিল না কোনও কালে। শুধু একটা নাম। বেদী হল অসহায় মানুষের বিশ্বাস। নারায়ণ কি করবেন? করতে হবে আমাকেই। ঝমঝমে বৃষ্টিতে ঝাঁপ মারলুম উঠোনে। সামনেই সদর দরজা। দরজা খোলা মাত্রই বিদ্যুতের ঝিলিকে আকাশ ঝলসে গেল। দরজার বাইরে যেন ভূত দেখলুম। কালো একটা মূর্তি আমারই মতো উচ্চতা। একপাশে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে।
‘কে তুমি?’
মেয়ের গলা, ‘আমি সর্বাণী।’
‘আমি অনেকবার দরজার কড়া নেড়েছি, তুমি বৃষ্টির জন্যে শুনতে পাওনি।’
সর্বাণী ভিতরে এল, ভিজে একেবারে সপসপে। শাড়ি লেপটে গেছে শরীরে। সিক্ত শরীরে বাতাস লাগায় শীতে ঠোঁট দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে। আমিও ভিজেছি তবে সর্বাণীর মতো নয়। সর্বাণী একেবারে চান করে গেছে। কোথাও আলো নেই। ঘোর অন্ধকার। মাঝে-মাঝে আকাশ যখন বিদ্যুতে চমকে-চমকে উঠছে, তখনই চারপাশ নীল হয়ে যাচ্ছে। সর্বাণীকে এত কাছ থেকে আমি দেখিনি কখনও। দু:খ সুন্দর মুখ। অসম্ভব ধারালো। বয়সের তুলনায় একটু বেশি পোড় খাওয়া। গাল দুটো সামান্য ভাঙা। নাকটা অ্যালফ্যানসো আমের আঁটির মতো পাতলা। এক ঝলকে সব দেখে নিলুম।
।। ভয়ের ওপর ভয়।।
সর্বাণী হঠাৎ এই বৃষ্টির রাতে এখানে কেন? এ কি কালোবাবুর শেষ চাল! সেই চালের ঘুঁটি কি সর্বাণী! মেয়েদের কি সহজে বিশ্বাস করা যায়! কার-কার কাছ থেকে সাবধান হতে হয়! মনে পড়ে গেল শ্রীরামকৃষ্ণের সাবধানবাণী, ‘এই কয়েকটির কাছ থেকে সাবধান হতে হয়! প্রথম, বড় মানুষ। টাকা, লোকজন অনেক, মনে করলে তোমার অনিষ্ট করতে পারে, তাদের কাছে সাবধানে কথা কইতে হয়। হয়তো যা বলে সায় দিয়ে যেতে হয়। তারপর কুকুর। যখন কুকুর তেড়ে আসে কি ঘেউ-ঘেউ করে তখন দাঁড়িয়ে মুখের আওয়াজ করে তকে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর ষাঁড়। গুঁতুতে এলে তাকেও মুখের আওয়াজ করে ঠান্ডা করতে হয়। তারপর মাতাল। যদি রাগিয়ে দাও, তাহলে বলবে তোর চৌদ্দ পুরুষ, তোর হেনতেন, বলে গালাগালি দেবে। তাকে বলতে হয়, কি খুড়ো কেমন আছ? তাহলে খুব খুসি হবে। তোমার কাছে বসে তামাক খাবে। অসৎ লোক। খুব সাবধান। যদি এসে বলে হুকোটুকো আছে? সঙ্গে-সঙ্গে বলবে, আছে। কেউ-কেউ সাপের স্বভাব। তুমি জান না তোমায় ছোবল দেবে। ছোবল সামলাতে অনেক বিচার আনতে হয়। তা না হলে হয়তো এমন রাগ হয়ে গেল যে তার আবার উলটে অনিষ্ট করতে ইচ্ছা হল। আর কামিনী। কামিনী দাবানল স্বরূপ, কালসাপের স্বরূপ।’ নিমেষে ফোঁটা ফোঁটা। বড় বড় চোখের পাতা ভিজে। পায়ের কাছে ভিজে শাড়ির জল নামছে সিরসির করে। অন্ধকারে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সর্বাণী। মনে বেশ একটা বল পাচ্ছি, যাক আমি আর একা নই। আমার ভীষণ ভয়ও করছে, কি থেকে কি হয়। সর্বাণী কিছুই বলছে না দেখে প্রশ্ন করলুম, ‘তুমি হঠাৎ এই সময় এলে, যদি কেউ জানতে পারে।’
সর্বাণী বললে, ‘তোমার কাছে আমার খুব আসতে ইচ্ছে করল তাই এসেছি। মনে হল, আমাকে তোমার প্রয়োজন।’
‘তোমার বাড়ির সবাই?’
‘মা নেই। বাবা সন্ধে থেকেই খুব খেয়ে বেহুঁশ।’
‘বাকি সব?’
‘দাদা বউদিকে নিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে।’
‘জানো তো, মা খুব অসুস্থ। কলেরার মতো হয়েছে। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। কোথায় ডাক্তার! কোথায় অ্যাম্বুলেন্স, কোন হাসপাতাল! সর্বাণীর পুরো ভাবটাই পালটে গেল। গা ঝাড়া দিয়ে যেন সজাগ হল, ‘তুমি এখন ভাবছ! আমার ঠিক মনে হয়েছে, তুমি একটা সাঙ্ঘাতিক বিপদে পড়েছ।’
‘আজ রাতে আর আলো আসবে না।’
‘আলো-আলো করছ কেন? অন্ধকারেও মানুষ বাঁচে। চলো, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। সোজা থানায় গিয়ে অ্যাম্বুলেনসে ফোন করব।’
‘তাহলে আসবে।’
‘অবশ্যই আসবে।’
‘টাকা লাগবে।’
‘কিছু টাকা তো লাগবেই।’
‘সর্বাণী আমার কাছে মাত্র দশটা টাকা আছে।’
‘আমার কাছে হাজার টাকা আছে। গায়ে আছে বিশ ভরী গয়না।’
‘সে কি? তুমি এই রাতে এত গয়না পরে?’
‘আমার সম্পত্তি, যা ছিল সব পরে চলে এসেছি, যদি ফেরার দরজা বন্ধ হয়ে যায়।’
সর্বাণীর কথা শুনে শীতে নয়, ভয়ে কাঁপতে শুরু করলুম। সর্বাণী আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, ‘ও বাড়িতে আমি আর ফিরে যাব না বসন্তদা। আমি তোমার।’
‘সর্বাণী, আমার মা…।’
।। উপন্যাস ।।
সর্বাণী একে-একে সব গয়না খুলে একটা ব্যাগে রাখল। টাকার বাণ্ডিলটা একটু স্যাঁতসেঁতে হয়েছে। সেটাও ব্যাগে। ব্যাগটা আমারই। খুবই বিবর্ণ। এত মূল্যবান জিনিসের জন্য একেবারেই বেমানান। সর্বাণী যখন একে-একে খুলছে, আমি তখন দেখছি। আর ভাবছি হঠাৎ কাল সকালে পুলিস যদি আসে, আর যদি দেখে যাবতীয় অলঙ্কার আর অর্থ আমার পড়ার টেবিলে নিচের ড্রয়ারে মজুত তাহলে হাতে হাতকড়া।
কাগজ পুড়লে যেমন গন্ধ আসে নাকে, মনের নাকে সেইরকম একটা চক্রান্তের গন্ধ পেলুম। গোটা পটভূমিটাই রহস্য উপন্যাসের মতো। দুর্যোগের রাত। বিদ্যুতের নীল কঙ্কাল। মায়ের শিয়রে মৃত্যু। দালানে নারায়ণের মূর্তি অন্ধকারে হাসছেন। প্রদীপ উলটে গেছে। ঘট গড়াচ্ছে। ধুনোর ছাই উড়ছে শ্মশানচিতার মতো। বিদেশি চেহারার ভিজে একটা মেয়ে লণ্ঠনের আলোয় দেওয়ালে অজন্তা-গুহাচিত্রের মতো দীর্ঘ ছায়া ফেলে শরীর থেকে গহনা খুলছে। পাথর বসানো ভারি হার, বালা, চুড়ি, কটি-হার, চুন-চুন শব্দ। যেন কোনও যক্ষিণী। এমন কেন হবে! জীবন তো উপন্যাস নয়! আমি একটি মেয়েকে আমার টাটকা প্রেম নিবেদন করেছিলুম। সে আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে। আমার বেচাল, পিতার মৃত্যুর কারণ। চাতক কত ফুকারে! তবে মেঘ জল দেয়! এ না চাইতেই জল! এই হল কালোবাবুর তুরুপের চাল। পয়সাঅলার মেয়ে, তার কিসের দু:খ! ছোট মেয়ে। আদরের মেয়ে, যার বিয়ের আগেই এত গহনা। যার সঙ্গে আগে আমার সামান্যতম পরিচয় ছিল না, সে হঠাৎ আমার প্রেমে পড়ে গেল। শুধু গেল না, এই কাল-রাত্রে গৃহত্যাগ করে চলে এল। কামিনী কালসর্প। বসন্ত! সাবধান।
হঠাৎ ভেতরটা চাবুকের মতো হয়ে গেল। বেশ কড়া গলায় বললুম, ‘সর্বাণী, তুমি সব পরে নাও। সোজা নিজের বাড়ি চলে যাও। একটি মেয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে বাবাকে হারিয়েছি। তোমার চক্রান্তে মাকে হারানো আর জেলে যাওয়া, দুটো একসঙ্গে হতে দোব না। আমি যথেষ্ট চালাক হয়ে গেছি। সংসারের অসীম চক্রান্তের সবটা ধারণা করতে না পারলেও কিছুটা পেরেছি। তোমার বাবাকে বোল, এত কাণ্ড করার দরকার নেই, বাড়ির অংশটা তোমার বাবাকেই বেচে দেব। তোমার আজকের রাতের এই নাটক খুব কাঁচা। এর একটা অংশও আমি বিশ্বাস করি না। ব্যাপারটা সাজানো। পেছনে তোমার বাবা আছে, দাদা আছে। কেন, নিরীহ, ভদ্রলোকের ছেলেকে জেলে পাঠাতে চাইছ! তাছাড়া, মায়ের অনুমতি ছাড়া তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারব না। অসম্ভব। একটাও কথা নয়, এই মুহূর্তে তোমার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে বেরিয়ে যাও।
সর্বাণী পাথরের মতো হয়ে গেল। কি একটা বলতে চাইল, আমি উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলুম, ‘একটাও কথা নয়, গেট আউট।’
সে চলে গেল।
।। তারপর ।।
মাঝরাতের নিশ্চিদ্র অন্ধকারে অ্যাম্বুলেনস চলেছে। পাশাপাশি বসে আছি আমি আর গুপীদা। আর একপাশে সিস্টার, মা শুয়ে আছেন, মাঝখানে, সাদা একফালি ক্যানভাসের মতো। স্যালাইনের বোতল ঝুলছে। গুপীদা ধরে আছেন এক হাতে। মায়ের শরীরে নুনজল ঢুকছে ফোঁটা-ফোঁটা। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশে গোটা-গোটা ভিজে তারা। জানালার আলো জলজমা ভিজে পথের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছে দ্রুত পাখির মতো। মাঝে-মাঝে জল ছিটকে যাচ্ছে দু’পাশে। নিদ্রালু চালক, ঢুলুঢুলু সিস্টার, অচৈতন্য মা। ইঞ্জিন গর্জন করছে পেট্রোলের নি:শ্বাসে। আমার চোখ দুটো থেকে-থেকে পুকুর হয়ে যাচ্ছে। মায়ের জীবনমৃত্যু এখন আর আমার কাছে বড় কিছু নয়। মন এখন অন্য কথা বলছে। বলছে, জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটাই করে ফেললে। তুমি সামনে না গিয়ে পেছনে যাও। ক্ষমা চাও। বেশি হিসেবে লোক চার্টাড অ্যাকাউটেন্ট হয়। সুখী প্রেমিক হয় না। মা অসুস্থ না হলে ব্যাপারটা অন্য রকম হত। কোনও সন্দেহ নেই। গাড়ির পাশে আলোর চতুষ্কোণে সর্বাণীর দৃঢ় মুখ দেখতে পাচ্ছি। গেট আউট বলার পর তার চোখ দুটো পাথর হয়ে গিয়েছিল, ঠোঁট দুটো ইস্পাত।
।। সংবাদ।।
‘তরুণীর আত্মহত্যা’। নাম সর্বাণী সরকার। কারণ জানা যায়নি। মৃতের কাছে কোনও চিঠি ছিল না। বন্ধ ঘরে সিল্কের শাড়ির ফাঁস গলায় লাগিয়ে ঝুলছিল। না, কিছু নয়। কিছু হয়নি। মা বেঁচে আছেন, আমি বেঁচে আছি। কোনও ব্যাপারে আমি দায়ী নই। কেউ কোনও দিন জানবে না কি হয়েছে। ঝড়ের রাতের সেই অভিসার অন্ধকারের মলাটে চাপা পড়ে গেছে চিরতরে। মর্গ, মর্গ থেকে শ্মশান। বহু দূরের আকাশে আমি ধোঁয়া দেখার চেষ্টা করেছি। শ্মশানে যেতে পারিনি সাহস করে। চোখের জল পাথর হয়। জলের চোখ।
।। দেওয়াল ।।
ছাতের সেই দেওয়াল। এ-পাশ আর ও-পাশ। অকারণে ছেলেটা কেন ছাতে বসে থাকে! ওই পাঁচিল! জীবন আর মরণের সীমানা। জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে / বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে / স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মেমোরিয়ালের সামনে। এই বুঝি বিদ্যুৎ শিখার মতো পাঁচটা আঙুল জেগে উঠবে! ঠং করে খসে পড়বে একটা জর্দার কৌটো। আঙুলগুলো অদৃশ্য হওয়ার আগে অনামিকার আংটির পাথর ঝিলিক মেরে যাবে।
।। শেষ জর্দার কৌটো ।।
জ্ঞানী, গুণীজন কত কি আবিষ্কার করেন! রেনওয়াটার পাইপের একটু ভেতরে থেকে আমি আবিষ্কার করলুম সোনালি জর্দার কৌটো। পশ্চিমের পড়ন্ত রোদে চিকচিক করছিল। আর সেই কৌটোর ভেতর থেকে রাক্ষসের প্রাণভোমরা নয়, আবিষ্কার করলুম নিজেকে। মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে সর্বাণী লিখেছিল। বৃষ্টি ধোয়া আকাশে লণ্ঠনের মতো একটা চাঁদ। পৃথিবী নিদ্রিত। একটি মেয়ে। একেবারে একা একটি মেয়ে পাঁচিলের ওপাশে এসে দাঁড়াল। তার চুল ভিজে। ভিজে ছাতের স্পর্শ খালি পায়ে। এ ছাতে কেউ নেই। একটা অ্যাম্বুলেনস ছুটছে তখন শহরের অন্য প্রান্তে। এ-ছাতে কৌটোটা পড়ে গড়িয়ে গেল।
শেষ চিঠি : তোমাকে ভালোবেসেছিলুম। কেন, তা জানি না। তুমি যদি আমাকে সন্দেহ না করতে তাহলে হয় তো চলে যাওয়ার কথা ভাবতুম না। ভালোবাসা যে বেঁচে আছে আমি মরে তা প্রমাণ করে গেলুম, অন্তত একজনের কাছে। এবার হল না, দেখা যাক সামনের বার হয় কি না! তোমার কাছে ছুটে যাওয়ার কারণটা শোনো। পনেরো বছরে পা দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সপ্তাহে একদিন, সেদিন হল বৃহস্পতিবার, আমার বাবা আমাকে রেপ করার চেষ্টা করে। মা ওই দিনটায় বাপের বাড়ি যায় কীর্তন শুনতে। গত তিন বছর এই হয়ে আসছে। ওই যে অত গয়না সবই ওই লোকটার দেওয়া। আজ রাতে আর একটু হলে আমি লোকটাকে খুন করে ফেলতুম। মাতাল পারবে কেন আমার শক্তির সঙ্গে। নিজেকেই খুন করি তোমার সন্দেহের ছুরি দিয়ে। তুমি জীবনে উন্নতি করবে, কারণ তুমি মানুষকে বিশ্বাস করো না, স্বার্থপর। তোমার ওই ব্যাগটা একবার ঝেড়ে দেখো। তোমার জন্যে আমার একটা চিহ্ন রেখে এসেছি। এক টুকরো চোখের জল। এইবার যাই। ভোর হওয়ার আগেই শেষ রাতের ট্রেন। যতদিন যাবে, ততই আমি দূরে আরও চলে যাব। বিশ্বাস করো, সত্যি আমি তোমাকে ভালোবাসি। সেই ভালোবাসা নিয়েই যাচ্ছি। তোমার, সর্বাণী।
।। ব্যাগ ।।
আমার বিবর্ণ ব্যাগ থেকে বেরল ঝকঝকে একটা হীরের আংটি।
।। দরজা ।।
বেশি রাতে সদরের দরজা খুলতে এখনও কেন ভয় করে। মনে হয় কেউ দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারে এক পাশে। একটু থমকে দাঁড়াই। এবার যদি আস, আর ফেরাব না। সে এল না। কেউ এল না কোনওদিন। না প্রেম, না ভাগ্য, ফলহীন বৃক্ষের মতো পায়ের তলায় নিজেরই শুষ্ক ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর প্রান্তরে। কত কি চেয়েছিলুম, পাইনি কিছুই। সব পাওয়া এক পাওয়া হয়ে ফিরে চলে গেছে। একটা বিশাল আকৃতির লোক কাঁধে কুড়ুল নিয়ে রোজই ঘুরে যায়। কে তুমি? আমি মৃত্যু!