ছয়
এইরূপে আরও দিন দুই-চার কাটিয়া গেল। নগরের একপ্রান্তে অতিথিশালা, সেযুগে বিত্তবান গৃহস্থদিগের অনুদানে এইসব অতিথিশালা চলিত, সেইরকমই এক অতিথিশালায় কমলনয়নের আশ্রয় মিলিয়াছে। মন নিতান্তই বিষণ্ণ, নগর ঘুরিয়া দেখিবার ইচ্ছাও আর নাই। প্রভাতবেলায় ইতস্ততঃ লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে কমলনয়ন গঙ্গার এক ঘাটে আসিয়া উদাস মনে ঘাটপার্শ্বস্থ গোলাকার এক বুরুজের উপর বসিয়া পড়িল। প্রাতঃকাল। স্নিগ্ধ সমীরণ গঙ্গা হইতে উঠিয়া আসিয়া ঘাটের উপর দিয়া বহিয়া যাইতেছে। কতিপয় স্নানার্থী, স্নানার্থিনী গঙ্গাজলে অর্ধনিমজ্জিত হইয়া জপার্চনা, সূর্যবন্দনাদি করিতেছে। মৎস্যজীবীদের নাওগুলি অনুকূল পবন পাইয়া সুদূরে ভাসিয়া যাইতেছে। স্রোতের উপর সূর্যের দীপ্তি পড়িয়া উজ্জ্বল রজতচূর্ণের ন্যায় প্রতিভাত হইতেছে।
কমলনয়নের দৃষ্টি এসব কিছুই গ্রহণ করিতেছিল না। তাহার মন শান্ত, উদাস হইয়া আছে। সে ভাবিতেছিল, অতঃপর কী করিবে। কী করা কর্তব্য। চন্দ্রদ্বীপে রাজদরবারে কবিযশোপ্রার্থী হইয়া গিয়াছিল, রাজা তাহার কাব্যপ্রতিভার সমাদর করিলেন না। তখন সে স্থির করিয়াছিল, গৃহত্যাগ করিয়া শ্রীগৌরাঙ্গের চরণাশ্রয়ী হইয়া ভক্তের জীবন কাটাইবে। কিন্তু হায়, বিধি বাম! মহাপ্রভুর সহিত তাহার দেখা হইল না। কতদূর হইতে হাঁটিয়া আসিল, সকল পথশ্রম বিফল হইল। এখন কি সে গৃহে ফিরিয়া যাইবে? পিতা বলিয়াছিলেন, ভালো না লাগিলে গৃহে ফিরিয়া যাইতে। তাহার মনে পড়িল, পিতা আরও বলিয়াছিলেন, কোনো মত অনুসরণ করিবার পূর্বে উহা ভালোমতো পরীক্ষা করিয়া লইতে; প্রথমে শিক্ষালাভ করিয়া কৃতবিদ্য হইয়া তৎপশ্চাৎ পরীক্ষাপূর্বক কোনো মত বা পথের শরণ লইতে। কিন্তু যাঁহাকে আশ্রয় করিয়া, যাঁহাকে জীবনের ধ্রুবলক্ষ্য স্থির করিয়া এইসব করিবে ভাবিয়াছিল, তিনিই যে অন্তর্হিত হইয়া গেলেন। এখন উপায়? গঙ্গার দিগন্তরেখার নিকট উড্ডীন একটি বিহঙ্গমের আলস্যমন্থর গতির দিকে শূন্যচোখে তাকাইয়া কমলনয়ন তাহার মনের এইসব চিন্তা ও উদ্বেগ লইয়া তোলাপাড়া করিতেছিল।
সহসা মনুষ্যশব্দে কমলনয়ন ইত্যাকার চিন্তা হইতে ক্ষণতরে স্খলিত হইয়া পড়িল। একজন শীর্ণকায় দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ স্নানান্তে ঘাটের সোপান বাহিয়া উঠিয়া আসিতেছেন। পরনে শান্তিপুরী ধুতি, নগ্ন বক্ষের উপর উপবীত সূত্র বিলম্বিত আছে, হস্তে ঘট ও গামছা। শিরোদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেশগুচ্ছ, নাতিবৃহৎ শিখা, মস্তকের সম্মুখভাগ সামান্য কামানো। আর-এক স্থূলোদর গৌরবর্ণ ব্যক্তি বিপরীত দিক হইতে ঘাটে নামিতে নামিতে সামান্য পরিহাস করিয়া বলিতেছে, “ও কী, তর্কবাগীশ মহাশয়, আপনার ঘটটি শূন্য কেন? গঙ্গা হইতে জল সংগ্রহ করেন নাই? এই জোয়ারের সময়ে ভরা গঙ্গায় কি জলের অভাব হইল?”
ব্রাহ্মণ উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন, “অরে মূর্খ! গঙ্গায় জলের অভাব হইয়াছে কি না তাহা বুঝিবার পূর্বে ‘অভাব’ বস্তুত কী পদার্থ, তাহাই তো বুঝিতে হইবে!”
স্থূলোদর ব্যক্তি সম্ভবত ব্রাহ্মণের পূর্বপরিচিত, বয়স্যস্থানীয়। সে এই প্রকার গালি, ‘মূর্খ’ সম্বোধন গায়ে মাখিল না। হাসিয়া বলিল, “তা আপনাদিগের ‘ন্যায়শাস্ত্র’ আমিও কিঞ্চিৎ পড়িয়াছি। ‘অভাব’-কে যে আপনারা একটি স্বতন্ত্র পদার্থ বলিয়া স্বীকার করেন, তাহা আমি জানি…”
ব্রাহ্মণ বলিলেন, “জানো? তবে কী জানো, তাহার পরীক্ষা দাও!”
স্থূলোদর বলিল, “এই পথিমধ্যে ন্যায়শাস্ত্রের কী পরীক্ষা দিতে হইবে, বলুন।”
ব্রাহ্মণ ঘাটের রানার উপর মাটির ঘটটি নামাইয়া রাখিলেন। ঠক্ করিয়া শব্দ হইল। জিজ্ঞাসা করিলেন, “এক্ষণে কী দেখিতেছ, বলো।”
স্থূলোদর ব্যক্তিটি উত্তর দিল, “কী আবার? একটি ঘট!” ব্রাহ্মণ বলিলেন, “উত্তম। এই ঘটের আশ্রয় কী?”
স্থূলোদর বলিল, “ঘটের আশ্রয় ভূতল! ভূতলে ঘট আছে।”
“চমৎকার!” এই বলিয়া ব্রাহ্মণ মাটি হইতে ঘট তুলিয়া লইলেন। প্রশ্ন করিলেন, “এইবার কী দেখিতেছ?”
“ভূতলে এখন আর ঘট নাই।”
“ঘট নাই। বেশ। তবে ভূতলে এক্ষণে কী আছে?”
স্থূলোদর ব্যক্তি বলিল, “ঘট নাই। কিন্তু ভূতলে ঘটের অভাব আছে। ঘটাভাব আছে।”
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এইবার চক্ষু ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি অভাবের ‘অনুযোগী’, ‘প্রতিযোগী’ কাহাকে বলে জানো?”
স্থূল ব্যক্তি সহাস্যে বলিল, “তর্কবাগীশ মহাশয়! নবদ্বীপ এখন নব্য ন্যায়শাস্ত্রের তীর্থ। আপনাদিগের ন্যায়ের পরিভাষা আমরা সাধারণ নাগরিকগণও শুনিয়া শুনিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। ইহা কি আর একটা নূতন কথা? অভাব যে-আধারে থাকে, সেই আধারকে ওই অভাবের ‘অনুযোগী’ বলা হয়। এক্ষণে ভূতলে ঘটের অভাব আছে। অতএব, ভূতল হইল ঘটাভাবের আধার বা ‘অনুযোগী’। আর যে-বস্তুটির অভাব, সেই বস্তুটিকে অভাবের ‘প্রতিযোগী’ বলা হয়। ভূতলে ঘটের অভাব। সুতরাং, ঘট হইল ঘটাভাবের ‘প্রতিযোগী’। কেমন কি না?”
ব্রাহ্মণ চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিলেন, “বাহ। তবে তোমাকে যত মূৰ্খ ভাবিয়াছিলাম, তত মূর্খ তুমি নও! ন্যায়শাস্ত্রের পরিভাষা তুমি জানো।”
স্থূলোদর বলিল, “এসকল তো প্রাথমিক কথা। কিন্তু গতকাল এই ঘাটে দুইজন পণ্ডিত এক বিষয় লইয়া তর্ক করিতেছিলেন। তাহা শুনিতেছিলাম, কিন্তু ভালো বুঝিতে পারি নাই।”
ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সাগ্রহে বলিলেন, “কী লইয়া তর্ক হইতেছিল?”
স্থূল ব্যক্তি বলিল, “শুনিয়া যাহা বুঝিলাম, আপনাদিগের ন্যায়শাস্ত্রের একটি প্রাচীন মত ও আর-একটি নব্য মত আছে। নানা বিষয়ে উভয় মতে ভিন্নতা আছে। তাহারই ভিতর ‘অন্যোন্যাভাব’ না কী একটি বিষয় লইয়া উভয় পণ্ডিতের ভিতর প্রচুর তর্ক হইতেছিল। অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী কোনটি এই লইয়া সে কী বিতর্ক!”
কিশোর কমলনয়ন উৎকর্ণ হইয়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও স্থূলোদর ব্যক্তির কথোপকথন শুনিতেছিল। সে পিতার নিকট ন্যায়শাস্ত্র কিছু কিছু পড়িয়াছে। এক্ষণে স্থূল ব্যক্তির কথার উত্তরে ব্রাহ্মণ কী বলেন, শুনিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিল।
ব্রাহ্মণ চক্ষু মুদিয়া কম্পিত কণ্ঠে সুর করিয়া গাহিয়া উঠিলেন, “রাই ধৈরজং, রহু ধৈরজং…” তাহার পর শান্ত স্বাভাবিক স্বরে কহিলেন, “অত দ্রুত অগ্রসর হইলে কি কোনো বিষয় উত্তমরূপে অনুধাবন করা যায়? প্রথমে জানিতে হইবে, অভাব— দুই প্রকার। এক, সংসর্গাভাব। দুই, অন্যোন্যাভাব। প্রথমটি অর্থাৎ সংসর্গাভাব আবার তিন প্রকার। প্রাগভাব, ধ্বংসাভাব ও অত্যন্তাভাব।”
স্থূল ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, “সে কীরূপ?”
ব্রাহ্মণ মাটির ঘটটিকে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া বলিলেন, “এই ঘটটি সৃষ্টি হইবার পূর্বে কী ছিল?”
“মাটির খাপরা বা কপাল!”
“ঠিক। কিন্তু ঘট নির্মিত হইবার পূর্বে তো আর ওই মাটির খাপরায় ঘটের অস্তিত্ব ছিল না। ঘট নির্মাণের পূর্বে মাটির খাপরায় যে-ঘটাভাব ছিল, তাহাকে ঘটের প্রাগভাব কহে। আর ঘট ভাঙিয়া গেলে সেই মাটির খাপরাই তো পড়িয়া থাকিবে। ঘট ধ্বংস হইলে মাটির খাপরায় আর ঘটের অস্তিত্ব থাকিবে না। তখন, অর্থাৎ ঘট ভাঙিবার পর মাটির খাপরায় ঘটের যে-অভাব হইবে, তাহাকে ঘটের ধ্বংসাভাব বলে।”
“বুঝিলাম। আর অত্যন্তাভাব?”
“কোনো একটি বস্তুতে অন্য একটি বস্তুর যদি চিরকালীন অভাব দেখা যায়,
তবে ওই প্রকারের অভাবকে অত্যন্তাভাব বলে। যেমন বায়ুতে কোনো রূপ বা আকার নাই। কোনোকালেও ছিল না। কোনোদিনও থাকিবে না। অতএব, বায়ুতে রূপের অত্যন্তাভাব আছে।”
স্থূল ব্যক্তি বলিল, “এই তো গেল সংসর্গাভাবের তিনটি বিভাগ। এখন অন্যোন্যাভাব কী বস্তু?”
ব্রাহ্মণ বলিলেন, “বলিতেছি। মন দিয়া শুন। ‘অন্যোন্য’ শব্দের অর্থ হইল পরস্পর। দুটি বস্তুর পারস্পরিক ভেদকে ‘অন্যোন্যাভাব’ বলে। একটি অন্যটি হইতে ভিন্ন। যেমন গোরু অশ্ব নহে; অশ্বও গোরু নহে। এস্থলে গোরুতে অশ্ব নিষেধ করা হইতেছে। পুনরায় অশ্বেও গোরু নিষেধ করা হইতেছে। গোরু এবং অশ্ব–পরস্পর পরস্পরকে নিষেধ করিতেছে। ‘গোরু অশ্ব নহে’– এই বাক্যে অনুযোগী হইল গোরু, আর প্রতিযোগী হইল অশ্ব। কারণ, গোরুর সহিত অশ্বের ভেদ বলা হইতেছে। আবার অশ্ব গোরু নহে’—এই বাক্যে অনুযোগী হইল অশ্ব, আর প্রতিযোগী হইল গোরু। কারণ, পরের বাক্যটির দ্বারা অশ্বের সহিত গোরুর ভেদ বলা হইতেছে। ইহাই নব্য ন্যায় মত। এই মত অনুসারে, যে-বস্তুর নিষেধ করা হইতেছে, সেই বস্তুই হইল অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী।”
“আর প্রাচীন মত?”
স্থূলোদর ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে ব্রাহ্মণ চলিতে চলিতে বলিলেন, “প্রাচীন মত অনুযায়ী, ‘গোরু অশ্ব নহে’- এই বাক্যের দ্বারা যাহা নিষেধ করা হইতেছে, তাহা হইল গোরুর সহিত অশ্বের তাদাত্ম্য বা অভেদ কিংবা একাত্মতা। গোরুর সহিত অশ্ব অভিন্ন— এইরূপ চিন্তাকেই নিষেধ করা হইতেছে। অতএব, প্রাচীন মতে অন্যোন্যাভাবের প্রতিযোগী হইল অশ্ব-তাদাত্ম্য বা গোরুর সহিত অশ্বের একাত্মতা। বুঝিলে, বাপু?”
স্থূল ব্যক্তি বলিল, “বুঝিলাম। আপনি আমার নমস্কার গ্রহণ করুন,” এই বলিয়া সে-ব্যক্তি দ্রুতপদে স্নানার্থে অগ্রসর হইল। ব্রাহ্মণ আপন মনে ঈষৎ হাসিয়া পথ চলিতে লাগিলেন।
এত কঠিন বিষয়ের এমন সরল ব্যাখ্যা শুনিয়া কমলনয়ন মুগ্ধ হইয়া গেল। শীর্ণকায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের এইরূপ শাস্ত্রমগ্নতা, দৃষ্টান্ত সহকারে তাঁহার এইরূপ বুঝাইবার প্রণালী কমলনয়নের চিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করিতে লাগিল। স্থূলোদর ব্যক্তি কখন স্নান সারিয়া উঠিয়া আসে, তাহারই জন্য সে অপেক্ষা করিতেছিল। স্নানান্তে স্থূলোদর ব্যক্তি গৃহগমনে উদ্যত হইলে কমলনয়ন তাহার নিকটে সরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয়। সামান্যক্ষণ পূর্বে যে-ব্রাহ্মণের সহিত আপনার কথা হইতেছিল, উহার পরিচয় কী?”
স্থূল ব্যক্তি অবাক হইয়া বলিল, “তুমি কি নবদ্বীপে নবাগত? উহাকে চিনে না,
এরূপ ব্যক্তি অত্রদেশে বিরল। উনি মথুরানাথ তর্কবাগীশ। নব্যন্যায়শাস্ত্রে ইঁহার দক্ষতা প্রবাদপ্রতিম। অবশ্য কৃষ্ণদাস সার্বভৌম, ভবানন্দ সিদ্ধান্তবাগীশ, জগদীশ তর্কালংকার ও গদাধর ভট্টাচার্যও প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক। কিন্তু মথুরানাথ তাঁহাদিগের মধ্যে অগ্রগণ্য। তুমি এখানে কী উদ্দেশে আসিয়াছ?”
কমলনয়ন নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, “আমি—আমি একজন বিদ্যার্থী। ন্যায়শাস্ত্র শিক্ষা করিতে চাই। আচ্ছা, ইনি কি আমাকে অন্ত্যেবাসীরূপে গ্রহণ করিবেন?”
ব্যক্তি কহিল, “চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারো। এই পথ ধরিয়া উত্তরাভিমুখে গমন করিলে এক বৃহৎ অশ্বত্থ বৃক্ষের নিম্নে মথুরানাথ তর্কবাগীশের বিদ্যাশ্রম পাইবে। বহু দেশ হইতে নানা বয়সের বিদ্যার্থিবৃন্দ মথুরানাথের চতুষ্পাঠী বা টোলে অধ্যয়ন করিতে আসে। সেস্থলে গমন করিয়া তুমিও তোমার পরিচয় দিতে পারো। তর্কবাগীশ মহাশয় প্রীত হইলে তাঁহার টোলে তুমিও স্থান পাইবে।”