ছায়াচরাচর – ৩০

তিরিশ 

বলভদ্র, ময়ূখ প্রভৃতি দুই-একজন শিষ্য ব্যতীত আর কেহ জানে না, কমলনয়ন কাশী ছাড়িয়া নবদ্বীপ যাইতেছে। বস্তুত, সে অন্য কাহাকেও একথা জানায় নাই। সঙ্গে কৃষ্ণকিশোর আছে, আর দুই-একটা বস্ত্র, কয়েকটা পুথি—আর কিছুই নাই। 

বহু বহু বৎসর পূর্বে প্রথম যৌবনে সে এই পথ দিয়াই বিদ্যার্জনের উদ্দেশে নিতান্ত সহায়সম্বলহীন দশায় কাশী আসিয়াছিল। আজ আবার এত বৎসর পর সেই পথ দিয়াই বাহ্যদৃষ্টিতে একই রকম নিঃসহায় অবস্থায় নবদ্বীপে ফিরিতেছে। মধ্যে যেন কিছুই হয় নাই। কমলনয়ন ভাবিতেছিল, সেই দিন আর এই এক দিন। 

পথিমধ্যে অতিথিশালায় বিশ্রামস্থল। দিনান্তে সেসব অতিথিশালায় তণ্ডুলাদি যাহা ভিক্ষা করিয়া পায়, তাহাই পাক করিয়া প্রথমে কৃষ্ণকিশোরের উদ্দেশে নিবেদন করে। অতঃপর কৃষ্ণকিশোরের প্রসাদ গ্রহণ করে। কৃষ্ণকিশোরের নিকটে বসিলে দুইজনে কত গল্প হয়, কত আলাপ, কত মান-অভিমানের কথা চলিতে থাকে। সমস্ত দিনের পরিশ্রম কৃষ্ণকিশোরের সঙ্গে কথা কহিয়া অপগত হইয়া যায়। 

নবদ্বীপে উপনীত হইতে চারিমাসকাল কাটিয়া গেল। চৈত্রমাসের এক মধ্যাহ্নবেলায় সে নবদ্বীপে আসিয়া পৌঁছাইল। খুঁজিয়া পাতিয়া এক অতিথিশালায় স্থান করিয়া লইল। 

স্নান, ভিক্ষাগ্রহণ, পাক, কৃষ্ণকিশোরকে নিবেদন, তদনন্তর কিশোরের প্রসাদগ্রহণ সমাধা হইতে হইতে মধ্যাহ্ন অপরাহ্ণাভিমুখে চলিল। অতঃপর অতিথিশালার শয্যায় শুইয়া আছে, এমন সময়ে মনে হইল, বেলা থাকিতে থাকিতেই একবার মথুরানাথ তর্কবাগীশের সহিত দেখা করিয়া আসিলে কেমন হয়। শুনিয়াছে, তিনি এখনও বাঁচিয়া আছেন। যেই ভাবা, সেই কাজ! দুয়ারে অর্গল দিয়া কমলনয়ন মথুরানাথ তর্কবাগীশের চতুষ্পাঠীর অভিমুখে যাত্রা করিল। 

সেই পথঘাট সব একই আছে, স্থানে স্থানে নূতন হর্ম্য নির্মিত হইয়াছে মাত্র। কমলনয়নের মনে এক বিচিত্র ভাবনা উদিত হইতেছিল। সে এখানে এতদিন ছিল না, কিন্তু তাহার চিরপরিচিত পথঘাট সব একইরকম পড়িয়াছিল। বাহিরের পৃথিবী কাহারও জন্য অপেক্ষা করে না, নিজের নিয়মেই চলিতে থাকে। সেই আম্রবৃক্ষগুলিতে মুকুল আসিয়া ফলোদ্‌গম হইয়াছে। সেই সব অর্জুন গাছ নবপত্রে ভরিয়া গিয়াছে। জারুল গাছে নীল নীল ফুল ফুটিয়াছে। মানুষের জীবনও যথানিয়মেই চলিয়াছে। সে-ই শুধু এখানে নাই। আর নাই বলিয়াই, এসকল পরিবর্তনের মূল্যও তাহার কাছে কিছু ছিল না। ‘আমি’র মূল্যেই জগতের মূল্য; ‘আমি’ নাই, তো জগত্ত একরকম ‘নাই’ হইয়া যায়। 

মথুরানাথের টোলে যখন আসিয়া পহুঁছিল, তখন সায়াহ্নের আধোতন্দ্রামায়া নামিয়া আসিতেছে। টোলটি নির্জন; বোধহয় মথুরানাথ বৃদ্ধ হওয়াতে এখন আর ছাত্র পড়ান না, শিষ্যসংখ্যা তাই অপ্রতুল। সম্মুখে সে মথুরানাথের কক্ষটি দেখিতে পাইল। নিকটে ছায়াঘন তিন্তিড়ীবৃক্ষের ডালে কুলায়প্রত্যাবৃত পাখিগুলি কিকিচ্ করিয়া ডাকিতেছে। 

দ্বার উন্মুক্ত ছিল। কমলনয়ন দ্বারপথে আসিয়া দাঁড়াইল। দেখিল, বাতায়নের নিকট অতি বৃদ্ধ মথুরানাথ বসিয়া আছেন। হস্তে কী একটি পুঁথির পৃষ্ঠা। সেই পৃষ্ঠাটি লইয়া চক্ষুর অতি নিকটে স্থাপন করিয়া সায়াহ্নের স্বপ্নালোকে পড়িবার চেষ্টা করিতেছেন। চক্ষের জ্যোতি ক্ষীণ হইয়াছে। শিরাবহুল হস্তটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। 

কমলনয়নের পদশব্দে সচকিত হইয়া বৃদ্ধ চোখ তুলিয়া দ্বারের পানে চাহিলেন। দ্বারপথে সন্ন্যাসীর অপরূপ মূর্তি। অবাক হইয়া দেখিতেছেন। তাহার পর সহসা যেন চিনিতে পারিলেন। হাঁ, ঠিক চিনিয়াছেন! মথুরানাথের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। হাসিতেছেন। বৃদ্ধের দত্তহীন মুখবিবর শিশুর ন্যায় উৎফুল্ল দেখাইল। কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন, “কে ও? মধুসূদন না?” 

কমলনয়ন ভাবিতেছিল, এত বৃদ্ধ বয়সে এখনও ন্যায়শাস্ত্রে বৃদ্ধের কী নিষ্ঠা! চক্ষু স্বল্পজ্যোতি হইয়াছে, তথাপি পাঠ করিতেছেন। কিন্তু তর্কবহুল ন্যায়শাস্ত্র পড়িবার এই কি বয়স? এখন তো ধ্যানচিন্তন করিবার সময় হইয়াছে। এইসব কর্কশ তর্কবিচার, যাহাতে চিত্ত আকুল হইয়া উঠে, তাহা কি এই অন্তিম বয়সে চর্চা করিতে হয়? কমলনয়ন এই কথাই তৎক্ষণাৎ মুখে মুখে শ্লোক রচনা করিয়া বলিল : 

“তর্ককর্কশবিচারচাতুরী, আকুলীভবতি যত্র মানসম্
কিং তুরীয়বয়সা বিভাব্যতে?”

শ্লোকটি অসম্পূর্ণ ছিল। মথুরানাথ অবিলম্বে তাহার পাদপূরণ করিয়া বলিয়া উঠিলেন : 

“ধাতুরীপ্সিতম পাকরোতি কঃ?”— 

বিধাতার যাহা ইচ্ছা, তাহা খণ্ডাইবে কে? বিধাতার ইচ্ছায় আজ তুমি সর্বত্যাগী মোক্ষমার্গী সন্ন্যাসী, আর আমি সেই বিধাতার ইচ্ছাতেই এখনও তর্কবিচার লইয়াই পড়িয়া আছি। কে অন্যথা করিবে, বলো? 

তাহার পর মথুরানাথ বলিলেন, “আইস, ভিতরে আইস। তোমাকে কতদিন যে দেখি নাই!” 

কমলনয়ন কক্ষের অভ্যন্তরে বৃদ্ধের সমীপে গিয়া বসিল। বৃদ্ধ মথুরানাথ, জননী যেমন দীর্ঘকাল পর প্রবাসী পুত্রকে ফিরিয়া পাইয়া আনন্দিত হন, তেমনই সাহ্লাদে কমলনয়নকে দেখিতেছিলেন। কম্পিত হস্তে কমলনয়নের বক্ষ, স্কন্ধ, মুখে হাত বুলাইয়া বুলাইয়া বড়ো প্রীত হইতেছিলেন। বলিলেন, “কত বড়ো হইয়াছ! আমি সব শুনিয়াছি। তোমার পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দেশময় পরিব্যাপ্ত হইয়াছে!” 

কমলনয়ন অপরাধীর ন্যায় নতমস্তকে বলিল, “কিন্তু আপনার আদেশ পালন করিতে পারি নাই। আপনি আমাকে বেদান্ত শিখিয়া ন্যায়ের যুক্তি দিয়া বেদান্তকে কাটিয়া ফেলিতে আদেশ দিয়াছিলেন, কিন্তু আমি– “ 

“অদ্বৈত বেদান্ত পড়িতে পড়িতে নিজেই অদ্বৈতী হইয়া গিয়াছ! হাঃ হাঃ হাঃ! তাহাতে কী এমন হইয়াছে? পরিণত বুদ্ধিতে যাহা সত্য মনে হইয়াছে, তাহাই করিয়াছ। ইহাতে তোমার কোনো অপরাধ হয় নাই।” 

কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার শরীর এখন কেমন আছে?” 

“বৃদ্ধ হইয়াছি। শরীর তো দুর্বল হইবেই। মধ্যে মধ্যে জ্বর আসে। ইহা লইয়া তুমি ভাবিও না।” 

“আপনার দেখাশোনা করে কে?” 

“আমার পুত্র কৃতবিদ্য হইয়াছে। সে বিবাহ করিয়াছে। টোলের কার্য অতঃপর নেই-হ দেখে। উহারাই আমার সাধ্যমতো সেবা করিতেছে,” এই পর্যন্ত বলিয়াই মথুরানাথ বলিলেন, “উহা বিচার্য নহে। দেহ দুর্বল হইবে, একদিন দেহপাতও হইয়া যাইবে, কিন্তু আমি জীবনের যথার্থ উপযোগ করিয়া লইয়াছি। তোমার ন্যায় শিষ্য পাইয়াছি, তোমরা দিকে দিকে পাণ্ডিত্যের জয়ধ্বজা উত্তোলন করিয়াছ। আর কী চিন্তা? তোমরাই আমার গৌরব, আমার জীবনের সারবত্তা।” 

কমলনয়ন লক্ষ করিল, বৃদ্ধ বড়োই নিঃসঙ্গ হইয়া গিয়াছেন। সেবাযত্নের হয়তো ত্রুটি হইতেছে না; কিন্তু তাঁহার সহিত কথা কহিবার একটি লোকও নাই। জীবন চলিয়া গিয়াছে, পড়িয়া আছে শুধু একাকী জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের দুর্মর স্মৃতি। 

পুরানো দিনের অনেক কথা বহুক্ষণ ধরিয়া আলাপ করিয়া বৃদ্ধের আনন্দ বর্ধিত করিয়া কমলনয়ন রাত্রির প্রথম প্রহর গত হইলে অতিথিশালায় ফিরিয়া আসিল। ‘কী গো, এত রাত করিলে? আমাকে ছাড়িয়া এতক্ষণ থাকিতে হয়?”

“আমার বৃদ্ধ আচার্যদেবের সহিত কথা কহিতে কহিতে অধিক রাত্রি হইয়া গেল। আর তোমাকে ছাড়িয়া থাকিব কী? তুমি তো সবখানেই।” 

“কী এত কথা হইতেছিল?” 

“পুরানো দিনের কথা সব।” 

“তাঁহাকে কেমন দেখিলে?” 

“বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। একাকী কথা কহিবার কেহ নাই!” 

“ইহা তো অনিবার্য! সকলকেই একদিন ইহার সম্মুখীন হইতে হইবে।”

“ভাবিতেছিলাম, কঃ পন্থা? এ অবস্থায় কী সান্ত্বনা মিলিবে? এই একাকী জরাগ্রস্ত দশায়?” 

“কেন? আমি তো আছি! আমিই সকলের অন্তিম-বান্ধব!” 

“কিন্তু আমার বৃদ্ধ আচার্যদেব মথুরানাথ তো তোমাকে চিন্তা করেন না! কখনও করেন নাই। চিরকাল শুধু ন্যায়শাস্ত্রের পুথি লইয়াই কাল কাটিয়াছে।” 

“হইলই-বা! তিনি আমাকে না ভাবিলেও আমি তাঁহাকে ভাবি। তিনি তো আজীবন শাস্ত্রচর্চা করিয়াছেন।” 

“ভাবিতেছি, মৃত্যুর সময়ে কে থাকিবে?” 

“কেন? আমি তাঁহার শিয়রে থাকিব। তুমি আর কথা বাড়াইও না। আমার ক্ষুধা পাইয়াছে। খাইতে দাও।” 

“রোসো, ঠাকুর। রান্না করিয়া লই। এখনই হইয়া যাইবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করো।” 

“আমি তোমার সহিত রান্না করিব।” 

“না, তাহাতে তোমার মুখ লাল হইয়া যাইবে। কাঠের উনান।”

“না, আমি তোমার সহিত থাকিবই।” 

“তুমি বড়ো দুষ্ট হইয়াছ, কিশোর! একেবারে কথা শোনো না।” 

কমলনয়ন ভোগ রাঁধিতে বসিল। ভাত, মুগডালসিদ্ধ, কুষ্মাণ্ড-শাক-বার্তাকু দিয়া একটা ঘণ্ট। রাত্রি ঘন হইয়া আসিয়াছে। ঘরের ভিতর স্তিমিত শিখায় কুপী জ্বলিতেছে। অন্ধকারে ঝিঁঝি ডাকিতেছে। পাক করিতে করিতে কমলনয়ন অনেক কথা ভাবিতেছিল। 

“কমল, ও কমল, কী ভাবিতেছ?” 

“ভাবিতেছি সব ফেলিয়া আসা দিনের কথা। একদিন এমনই গ্রাম হইতে নবদ্বীপে আসিয়াছিলাম। তাঁহার সন্ধানে…” 

“এখন কি আর তাঁহার কথা মনে পড়ে?” 

“পড়ে না আবার? খুব পড়ে। কিন্তু তাঁহাকে তো পাইলাম না। রাধাভাবসুবলিততনু চৈতন্যচন্দ্র। তপ্তকাঞ্চনকায় প্রাণের গৌর…” 

“পাও নাই কি?” 

“কই পাইলাম আর?” 

“একবার আমার দিকে ভালো করিয়া তাকাইয়া দেখো তো… তাঁহাকে দেখিতে পাও কি না?” 

কমলনয়ন জলভরা দুই চোখ তুলিয়া কৃষ্ণকিশোরের দিকে তাকাইল। নিঠুর দরদী বাঁশিতে ফুঁ দিয়া জগৎকে তাঁহার দিকে আকর্ষণ করিতেছেন। নীলেন্দিবর সেই মেঘরূপের ভিতর যেন বিদ্যুতের কাঞ্চনপ্রভা ফুটিয়া উঠিতেছে। কমলনয়নের দুই গণ্ডদেশ বাহিয়া ধারাশ্রাবণ নামিতে লাগিল। 

পরদিন প্রভাতবেলায় গঙ্গাস্নান সারিয়া ঘাট দিয়া উঠিয়া আসিতে আসিতে মনে হইল, সে-লোক কি এখনও এখানে আছে? বিষ্ণু দামোদরের মন্দিরের পাশ দিয়া গলি। হাঁটিতে হাঁটিতে সেই গৃহটি দেখিতে পাইল। দ্বারে করাঘাত করিতেই হরিরাম বাহির হইয়া আসিল। কমলনয়ন দেখিল, হরিরামের কেশে পাক ধরিয়াছে। মুখশ্রীতে যৌবনের লাবণ্যমায়া আর নাই। 

প্রথমে হরিরাম চিনিতে পারে নাই। পরিচয় দিবার পর সে একটুখানি চুপ থাকিয়া পরমুহূর্তেই উল্লাসে ফাটিয়া পড়িল। “আরেঃ মধুসূদন! কত পরিণত হইয়া গিয়াছ। চিনিতেই পারি নাই। এখন কোথা হইতে আসা হইতেছে? কাশী হইতে? তোমার সব সংবাদই আমি পাইয়াছি। তুমি তো জব্বর পণ্ডিত হইয়াছ…” হরিরাম কলকল করিয়া কত কথাই বলিয়া চলিল। 

“আপনি কি সেই হইতেই এইখানে আছেন?” 

“কোথা-বা আর যাইব? আমাদিগের পাণ্ডিত্য তো তুমি জানো… হংসমধ্যে বকো যথা… হাঃ হাঃ হাঃ!” 

“আপনার টোল চলিতেছে?” 

“ওই দুই-একটি ছাত্র আছে। কাব্যশিক্ষা করিতে আসে। আরে, কাব্য কি কাহাকেও শেখানো যায়? কাব্যবোধ না থাকিলে সকলই বৃথা পণ্ডশ্রম! ওইসব কথা ছাড়ো। তুমি বলো, কেমন কী শিখিলে? অনেক শাস্ত্র শিখিয়াছ?” 

হরিরাম একইরকম আছে। সেই প্রভূত বিদ্যাবাসনা! কেবল বিদ্যার্জনের সুযোগ সে কখনও পাইল না। 

সহসা একটি নুতন পুথি বাহির করিয়া হরিরাম বলিল, “আরে দেখ, দেখ। এক নবীন কবির কাব্য। কাব্যের নাম — ছায়াচরাচর। সম্পূর্ণ নূতন ধরনের রচনা।” 

“কবির নাম কী?” 

“পুণ্ডরীক। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের রাজা কন্দর্পনারায়ণের সভায় নূতন নিযুক্ত হইয়াছেন। ইঁহার পিতাও ওই একই রাজার সভাকবি ছিলেন।” 

চন্দ্রদ্বীপ? কমলনয়নের হৃৎপিণ্ড যেন একবার টাল খাইয়া সোজা হইয়া দাঁড়াইল। সেই চন্দ্রদ্বীপ… যেখানে সে কৈশোরে কবি হইতে গিয়াছিল… কবি হইতে পারে নাই… 

কমলনয়ন প্রায় ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল, “পুণ্ডরীকের পিতার নাম কী?” 

হরিরাম বলিল, “পদ্মাক্ষ। তুমি তাঁহাকে চেনো নাকি?” 

কমলনয়ন কিছু বলিল না। তাহার অনেক কথা মনে পড়িতেছিল। এই গঙ্গার ঘাটেই এক সন্ধ্যাবেলায় আরতির পর পদ্মাক্ষের সহিত তাহার দেখা হইয়াছিল। কথা হইয়াছিল। একেবারে তাহারই ন্যায় দেখিতে। সেই পদ্মাক্ষ। তাহারই পুত্র পুণ্ডরীক! 

কাব্যটি হাতে লইয়া কমলনয়ন দেখিতেছিল। কথাকাব্য। কাহিনি চমৎকার! কে একজন কবি হইতে চাহিয়াছিল। হইতে পারিল না। ভক্ত হইতে চাহিল, তাহাও পারিল না। নৈয়ায়িক হইতে গেল, তাহাও হইল না… এ যে সব তাহার জীবনেরই ন্যায় অবিকল! কেমন করিয়া জানিল? কল্পনা করিয়াছে? 

ভাষাশৈলী ও কাব্যগুণও যথেষ্ট। পুথিটি নাড়িয়াচাড়িয়া দেখিয়া হরিরামকে ফিরাইয়া দিল। দুই-এক কথার পর হরিরামের নিকট বিদায় লইয়া চলিয়া আসিতেছে, হরিরাম জিজ্ঞাসা করিল, “আছ তো কয়েক দিন?” 

“হাঁ, কয়েক দিনই মাত্র। একবার দেশে যাইব, ভাবিতেছি।” 

ফিরিয়া আসিতেছে, সহসা পথিমধ্যে এক পণ্ডিতের সহিত দেখা হইল। ইনিই গদাধর। ন্যায়শাস্ত্রে ইনি সদ্যঃ উদীয়মান রবিসদৃশ। ইদানীং নবদ্বীপে ইনিই প্রবল পাণ্ডিত্য সহকারে ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপনা করিতেছেন। 

বলিলেন, “আমি আপনার পরিচয় জ্ঞাত আছি। আপনি কোথায় উঠিয়াছেন?” কমলনয়ন বলিল, “অতিথিশালায়।” 

“অতিথিশালায়? কেন? আমার গৃহে দয়া করিয়া আতিথ্য গ্রহণ করুন।”

তাঁহার অনুরোধে কমলনয়ন কৃষ্ণকিশোরকে লইয়া তাঁহার গৃহে আসিয়া উঠিল। এইবার কমলনয়নের উপস্থিতি-সংবাদ নবদ্বীপময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। সকলেই কাশী হইতে আগত সন্ন্যাসী মধুসূদন সরস্বতীর দর্শনার্থে গদাধর পণ্ডিতের গৃহে যাতায়াত করিতে লাগিল। গদাধরের গৃহ উৎসবক্ষেত্রে পরিণত হইল। 

অবসরমতো গদাধরের সহিত কমলনয়নের শাস্ত্রবিচার চলিতে লাগিল। গদাধর একে নৈয়ায়িক, তাহে দ্বৈতবাদী। কমলনয়নের সর্বশাস্ত্রে পারঙ্গমতা, বিশেষত ন্যায়শাস্ত্রে তাহার অসামান্য অধিকার দেখিয়া মুগ্ধ হইলেন। কিন্তু যতই কমলনয়নের অদ্বৈতসিদ্ধান্তের পরিচয় পান, গদাধর ততই ব্যাকুলতা অনুভব করেন। অপরাপর প্রবীণ নৈয়ায়িকগণও প্রায়শই বিচারার্থ আসিতেছিলেন, কিন্তু সকলেই দুই-চারি কথার পরই কমলনয়নের নিকট মস্তক অবনত করিতে বাধ্য হইতেছিলেন। ইহাতে গদাধরের কাতরতা দিন দিন বর্ধিত হইতে লাগিল। 

একদিন মহামতি জগদীশ গদাধরের গৃহে আসিলেন। জগদীশ বৃদ্ধ হইয়াছেন। পঠদ্দশায় তাঁহার কমলনয়নের সঙ্গে আলাপ ছিল। উভয়ে উভয়কে অভিবাদন জানাইবার পর কথাপ্রসঙ্গে বিচার আরম্ভ হইল। দীর্ঘকাল বিতর্ক-বিচার চলিল। অন্তে জগদীশ কমলনয়নের নিকট পরাস্ত হইলেন। অবশেষে কমলনয়নকে গুরুবৎ সম্মান করিয়া জগদীশ গৃহে ফিরিলেন। 

জগদীশ পরাস্ত হইয়াছেন শুনিয়া সকলেই বুঝিল, এই সন্ন্যাসী অজেয়, অপ্রতিম। কেহ তাঁহাকে পরাস্ত করিতে পারিবে না। এদিকে আবার কমলনয়নের সদ্গুণরাশিতে সকলেই মুগ্ধ। এইসব দেখিয়া কে যেন এক অদ্ভুত শ্লোক রচনা করিয়া বসিল : 

“নবদ্বীপে সমায়াতে মধুসূদনবাক্‌পতৌ। 
অনীশো জগদীশোহভূৎ কাতরোহভুদ্ গদাধরঃ।।” 

নবদ্বীপে পণ্ডিত মধুসূদন উপস্থিত হইলে তাঁহার প্রতিভায় জগদীশ অনীশ ও গদাধর কাতর হইয়া পড়িলেন। 

.

কিছুদিন পর কমলনয়ন কৃষ্ণকিশোরকে লইয়া উনসিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *