ছায়াচরাচর – ৩

তিন 

রাজাকে স্বরচিত কবিতা শুনাইবার মানসে কমলনয়ন তাহার পিতার সহিত রাজদরবারের উদ্দেশে যাত্রা করিয়াছিল। রাজা তাহার কবিতা বড়ো মনোযোগ সহকারে শুনিলেন না, রাজার মানসিকতা সে-মুহূর্তে কবিতা শুনিবার অনুকূল ছিল না। কমলনয়নের ইহাতে বড়ো অভিমান হইল। তাহার কবি হইবার সাধ ঘুচিয়া গেল। সে স্থির করিল, গৃহত্যাগ করিয়া নবদ্বীপ যাত্রা করিবে। সেখানে গৌরাঙ্গ- পদাশ্রয়ী হইবে। সে ভক্ত হইবে। 

ইহার পর তাহার কী হইয়াছিল, সে প্রকৃতই ভক্ত হইতে পারিল কি না, সেসকল কথা আমরা পরে আলোচনা করিব। কিন্তু তাহার পূর্বে এইখানে থামিয়া আমরা আর-একপ্রকার সম্ভাবনার কথা চিন্তা করিয়া লই। ধরা যাক, চন্দ্রদ্বীপের উপর পাঠান আক্রমণের ঘটনা মাসাধিককাল পরে অনুষ্ঠিত হইল। যদি তাহাই হইত, তবে রাজার চিত্ত এইরূপ অশান্ত হইয়া পড়িত না। শান্ত মনে কবিতা শুনিবার অবকাশ তাঁহার থাকিত এবং তিনি কমলনয়নের কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হইতেন। কারণ, কন্দর্পনারায়ণ প্রকৃতই কাব্যসাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন, আর কমলনয়নেরও কাব্যপ্রতিভা উজ্জ্বল ছিল। এইরূপে রাজা ও কবির মণিকাঞ্চন সংযোগ ঘটিতে পারিত। 

যদি ধরিয়া লই, এইরূপ সত্যই হইয়াছিল? হয়তো আমাদিগের এ পৃথিবীতে নয়, হয়তো এ বিশ্বের সমান্তরাল অন্য কোনো বিশ্বে এইরূপ ঘটিয়াছে…। সেই অন্য বিশ্বে হয়তো কিশোরটির নাম কমলনয়ন নহে, তাহার নাম পদ্মাক্ষ। পিতার সহিত রাজদরবারে সেও কবিতা শুনাইতে আসিয়াছিল এবং রাজা তাহার কবিতা শুনিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। কিশোর পদ্মাক্ষের দ্বারা রচিত পদগুলি শুনিয়া রাজা অতি হৃষ্ট হইলেন, কিশোরকে রাজসভার সভাকবিরূপে বরণ করিয়া লইলেন। তাহার পিতার প্রার্থনাও তিনি পূরণ করিলেন, পিতাকে আর ফলকর দিবার জন্য এতদূরে আসিতে হইবে না; গ্রামে বসিয়াই রাজপ্রতিনিধির নিকট ফলকর প্রদান করিলেই চলিবে। কবিকিশোর পদ্মাক্ষ অবশ্য এখন হইতে চন্দ্রদ্বীপেই বসবাস করিয়া, সুললিত কাব্য রচনা করিয়া রাজার প্রীতিবিবর্ধন করিবে। যদি এমন হইত? যদি ধরিয়া লই, এমনই হইয়াছে? এ বিশ্বে নহে, অন্য কোনো বিকল্প বিশ্বে? 

কেহ জানিতে পারে না, কিন্তু এইরূপই ঘটিয়াছে। ভাবিতে বড়ো ভালো লাগিতেছে যে! যাহা ভাবিতে ভালো লাগে, তাহাই কোথাও-না-কোথাও অনুষ্ঠিত হয়। নিরেট বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন লোক ইহা বুঝিতে চাহিবে না। নিরেট বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন লোক বলিবে, “ইহা কি কখনও হইতে পারে? কমলনয়ন কবি হইতে পারে নাই, ভক্ত হইতে গিয়াছিল। এ পর্যন্ত বুঝি। কিন্তু এ পদ্মাক্ষ আবার কোথা হইতে আসিল?” 

আমরা উত্তর দিব, “পদ্মাক্ষ হইল কমলনয়নের অপর পিঠ, পদ্মাক্ষ হইল কমলনয়নের অলটারনেটিভ পসিবিলিটি বা বিকল্প সম্ভাবনা। কমলনয়ন যাহা হইতে পারে নাই, পদ্মাক্ষ তাহাই হইয়াছে।” 

নিরেট তথাপি বলিবে, “সম্ভাবনা সম্ভাবনাই। সকল সম্ভাবনা কি বাস্তব হয়?”

আমরা কহিব, “আমাদিগের পৃথিবীতে কোনো একটি সম্ভাবনা সত্য হইয়া যায়। কিন্তু তাই বলিয়া অন্য সম্ভাবনাগুলি হারাইয়া যায় না। অন্য সম্ভাবনাগুলিও অন্যান্য সমান্তরাল বিশ্বে বাস্তব হইয়া থাকে।” 

নিরেট প্রশ্ন করিবে, “কই? সেসকল সমান্তরাল বিশ্ব তো আমরা দেখিতে পাই না!” 

আমরা বলিব, “দেখিতে পাইতেছ না বলিয়াই কি নাই? চাঁদের অপর পিঠ দেখ নাই, তাই বলিয়া চাঁদের অপর পিঠ নাই?” 

নিরেট এখন চন্দ্রাভিযানের কথা উত্থাপন করিয়া বলিবে, “একটা নভোযান লইয়া চন্দ্রের অপর পৃষ্ঠে অবতরণ করিলেই চন্দ্রের উলটাপিঠ দেখা হইয়া যাইবে। কিন্তু তোমাদিগের সমান্তরাল বিশ্ব তো ওইভাবে দেখা যায় না।” 

আমরা উত্তর দিব, “অন্য সমান্তরাল বিশ্ব দেখা যায় না, তুমি কীরূপে নিশ্চিত হইলে? জীবন বড়ো রহস্যময়, কে বলিতে পারে, কোনো আচম্বিত মুহূর্তে এ বিশ্বের কোনো অধিবাসীর সহিত অন্য বিশ্বের কোনো অধিবাসীর দেখা হইয়া যাইতে পারে কি না!” 

নাহ, নিরেট আমাদের কথা মানিবে না। সে শুধু একপ্রকার সম্ভাবনা লইয়াই ভাবে। অন্য সম্ভাবনা লইয়া কালক্ষেপও করিতে চাহে না। 

না মানুক। আমরা যেরূপ ভাবিয়াছি, ঠিক সেইরূপই লিখিয়া যাইব। তাহাতে নিরেট চটিয়া যায়, চটুক। কমলনয়নের কথা বলিয়াছি। এক্ষণে কমলনয়নের অপর সম্ভাবনা পদ্মাক্ষের কথা বলিব। 

এ পরিচিত বিশ্বে কমলনয়ন কবি না হইতে পারিয়া ভক্ত হইতে চাহিল ঠিকই, কিন্তু অন্য কোনো সমান্তরাল বিশ্বে পদ্মাক্ষ কবিই হইয়াছিল। রাজসভার সভাকবি।

চন্দ্রদ্বীপের ঘাটে পরদিন প্রভাতবেলায় নৌকা লাগিয়াছিল। পদ্মাক্ষ পিতাকে বিদায় জানাইতে আসিয়াছিল। বিদায়কালে পিতা বলিলেন, “পুত্র! আমি গৃহে ফিরিয়া যাইতেছি। কিন্তু তোমার জন্য বড়ো চিন্তা হইতেছে।” 

পদ্মাক্ষ কহিল, “তাত! চিন্তা করিবেন না। নদীতীরে মাধবীবিতানের পার্শ্বে আমার জন্য রাজা একটি কুটির স্থির করিয়াছেন। আমি সেখানেই বসবাস করিব। কাব্যসরস্বতীর উপাসনা করিয়া আমার ক্ষুদ্র জীবন অতিবাহিত করিয়া দিব। জননীকে কহিবেন, আমি শীঘ্রই গৃহে ফিরিয়া তাঁহার চরণযুগল দর্শন করিয়া আসিব। তিনি যেন আমার জন্য অযথা চিন্তা না করেন,” এই বলিয়া পদ্মাক্ষ পিতাকে নতজানু হইয়া প্রণাম করিল। 

অনুকূল পবনে নৌকা ছাড়িয়া দিল। দেখিতে দেখিতে স্রোতোপথে সেই তরীখানি ভাসিতে ভাসিতে দিক্‌চক্রবালরেখার নিকট বিন্দুবৎ মিলাইয়া গেল। 

জীবনে প্রথম পদ্মাক্ষের মনে হইল, সে মুক্ত; কোনোদিকে তাহার আর কোনো বাধা নাই। নদীতীরে বালুচর প্রভাতের রৌদ্রে দীপ্তি দিতেছিল। গ্রামের সেই ক্ষুদ্র আবেষ্টনী আর নাই, এখন উন্মুক্ত আকাশ বিস্তীর্ণ নদীর উপর উদাস হইয়া পড়িয়া আছে। পিতামাতা, বন্ধু-স্বজন কেহ তাহাকে আর নিয়ন্ত্রণ করিতেছে না। পদ্মাক্ষ তাহার দুই বাহু দুই পার্শ্বে বিহঙ্গমের ডানার মতো প্রসারিত করিয়া নিজের স্বাধীনতা- সুখ অনুভব করিতেছিল। বালুচরের উপর সে সত্যই কিছুদূর ছুটিয়া গেল, নির্জন সৈকত বালকের কলহাস্য শুনিয়া যেন আনন্দে উচ্ছিত হইতেছিল। 

ইদানীং সে নদীতীরস্থ সেই কুটিরটিতেই বসবাস করিতেছে। প্রভাতে সূর্যোদয়কালে নদীতে প্রাতঃস্নান করিয়া লয়। তাহার পর গায়ত্রী-উপাসনা-বন্দনাদির পর কাব্যরচনায় মন দেয়। এখন সে এক নূতন কাব্য ধরিয়াছে। নাম—’হংসমিথুনকথা’। প্রতিদিন এই কাব্যের কিছু কিছু সে রাজসমীপে নিবেদন করে। রাজা গুণগ্রাহী, তিনি কাব্যের ললিতভাগ আস্বাদ করেন, কোথাও পরিবর্তনযোগ্য কিছু পাইলে, তাহাও নির্দেশ করেন। 

পদ্মাক্ষ স্বপাক আহার করে। রাজার অনুগ্রহে তাহাকে তণ্ডুল, শাকাদি, পাক করিবার ইন্ধন সকলই প্রদান করা হইয়াছে। রন্ধন সমাপ্ত করিয়া সে আহারে বসে। আহারান্তে রাজসভায় গমন করে। সভাস্থ সকলেই এই সুদর্শন কবিকিশোরের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকেন। 

দিনান্তে রাজসভা সমাপ্ত হইলে সে কুটিরে ফিরিয়া আসে, সন্ধ্যাবন্দনাদির পর প্রদীপের স্তিমিতালোকে পুথি খুলিয়া বসে, দুই-একটি পদ সংশোধন করে, কখনো বা নূতন দুই-একটি পদ রচনাও করে। তাহার পর নৈশাহার সমাপ্ত করিয়া প্রদীপ নিভাইয়া কুটিরের দ্বারপ্রান্তে বসিয়া থাকে। যে-রাত্রে বর্ষণ নামে, সেই রাত্রে খড়ের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনিতে শুনিতে নিদ্রার ক্রোড়ে আশ্রয় লয়। আর যে-রজনী বর্ষণহীনা, সেই রজনীতে সে কুটিরের বাহিরে নদীতীরে বালুকাময় সিকতায় অন্ধকারের ভিতর আসিয়া বসে, রাত্রির আকাশ এক-এক করিয়া অগণ্য নক্ষত্রপুঞ্জে ভরিয়া উঠে। পদ্মাক্ষ নৈশাকাশের দিকে অনন্যমনে চাহিয়া রয়, মনে হয় ওইসব নির্জন নক্ষত্রবীথি যেন সুদূর হইতে তাহার সহিত কী কথা বলিতে চাহিতেছে! সে কোন্ অজ্ঞাত রহস্যময় জগতের সংবেদনা, আকাশগঙ্গার সুদূর তীরে কোন্ অজানিত পৃথিবীর জীবনযাত্রার সংবাদ যেন এইমাত্র পদ্মাক্ষর নিকট আসিয়া পৌঁছিল। পদ্মাক্ষ ভাবে, ওই দূরে, এই জগতের ন্যায় ওখানেও কি আর-একটা জগৎ চলিতেছে? হয়তো সেখানেও গ্রাম আছে, নদীতীর আছে, রাজসভা আছে। সে-দেশের পথ বাহিয়া কত নরনারী, নদী বাহিয়া নৌকায় বা ডিঙায় কত যুবক, বৃদ্ধ, বালক- বালিকার দল হয়তো প্রতিদিন জীবনস্রোতের প্রবাহপথে শ্যাওলার মতো ভাসিয়া চলিতেছে… সেই ধাবমান জনযূথের ভিতর হয়তো তাহারই সদৃশ কোনো কিশোর আছে, যে কবি হইবার বাসনায় সুদূর সে-জগতেরই কোন্ এক ক্ষুদ্র রাজসভায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। হয়তো অন্য জগতের সেই কবিকিশোরের কবিতা তাহাদের দেশের রাজা মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করেন নাই, তাই অন্য পৃথিবীর সেই কুমারকিশোর অভিমানভরে কাব্যচর্চা পরিত্যাগ করিয়া স্বজন-স্বদেশ ছাড়িয়া কোন্ অজানিতের পথে এইমাত্র যাত্রা করিল। হইবেও বা! রাত্রির জ্যোৎস্নাধবলিত অন্ধকার এইসব কত কথা নদীর বাতাসের ভিতর পদ্মাক্ষর কানে কানে অস্ফুটস্বরে কহিয়া চলে…. 

একদিন দ্বিপ্রহরে রাজসভার কার্য দ্রুত নিষ্পত্তি হইয়া গেল। কুটিরে ফিরিয়া পদ্মাক্ষ কী করিবে ভাবিতেছে, উন্মুক্ত দ্বারপথ দিয়া নদীটিকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বেলাশেষে একটি সওদাগরি নৌকা নদীর স্রোতে কোথায় যেন যাত্রা করিয়াছে। দিচক্রের নিকট কী একটা পাখি মেঘের রেখার ভিতর দিয়া সুদূর নীলাকাশের পটে কাহার যেন স্বর্ণতুলিকার টানে হালকা পালকের ন্যায় ভাসিয়া যাইতেছে। পদ্মাক্ষর মনে হইল, কতদিন সে তার গ্রাম দেখে নাই, মায়ের মুখ দেখে নাই… গৃহাঙ্গনের চারিপাশে কলমিলতার বেড়ায় এসময় একপ্রকার সাদা ফুল ফুটে, সেই ফুলগুলির অমলধবল মুখশ্রী মনে পড়িতেছে… গ্রামপ্রান্তে বেতসকুঞ্জের নিম্নে সন্ধ্যায় যে-অন্ধকার জমিয়া থাকে, তাহার ভিতর জোনাকির জুলানেভা মনে উঠিতেছে… তাহাদের গোহালঘরে ‘পিঙ্গলা’ গাভীর চোখে যে শীতল ব্যাকুলতা দেখিয়াছে, তাহাই যেন পদ্মাক্ষর মনে মনে নীরবতার ভাষায় কথা বলিতে চাহিতেছে…. কতদিন হইল, সে গ্রাম ছাড়িয়া আসিয়াছে… উনসিয়া গ্রামে স্নানযাত্রার মেলা হয়, হয়তো এই বছরও হইতেছে, এ বছর আর তাহার মেলা দেখা হইল না… সে এইসব কীসের ভিতর আসিয়া পড়িয়াছে, তাহার একটিও খেলার সঙ্গী নাই… পুথির পৃষ্ঠায় একা একা শব্দ লইয়া আর খেলা করিতে ইচ্ছা হয় না… পিতা কেমন আছেন? জননী খুব কাঁদিয়াছিলেন? তাহার ভ্রাতাগণ, তাহাদের গ্রামের সেই বালকেরা—হরিনাথ, চন্দ্রচূড়, পীতাম্বর, মেধাতিথি—উহারা কেমন আছে? কতদিন পদ্মাক্ষর সহিত তাহাদের দেখা নাই… একবার রাজার অনুমতি লইয়া পক্ষকালের জন্য সে দেশে যাইবে… কতদিন সে এই নদীতীরে নির্জন কুটিরে একাকী বসবাস করিতেছে… 

রাজার অনুমতি মিলিল। একদিন মধ্যাহ্নবেলায় সত্যই সে এক পাটের নৌকায় দেশে যাইবার জন্য উঠিয়া বসিল। উনসিয়া পঁহুছিতে দিন চারেক লাগিয়া গেল। গ্রামের ঘাটে নৌকা ভিড়িয়াছে। 

ঊনসিয়া? পূর্বে যে বলা হইয়াছে, কমলনয়নের গ্রামের নাম উনসিয়া! এক্ষণে বলা হইল, পদ্মাক্ষর গ্রামের নামও উনসিয়া? হাঁ। পদ্মাক্ষর গ্রামের নামও উনসিয়া। শুধু তাহাই নহে, পদ্মাক্ষর পিতার নামও প্রমোদন পুরন্দর। পদ্মাক্ষও জনক-জননীর তৃতীয় পুত্র। কমলনয়নের বাল্যজীবনে যাহা যাহা ঘটিয়াছে, পদ্মাক্ষর জীবনেও তাহা তাহাই সমস্ত সংঘটিত হইয়াছে— কমলনয়ন ও পদ্মাক্ষ সর্বাংশে এক। কেবল প্রভেদ এই, কমলনয়ন রাজসভায় রাজাকে কবিতা শুনাইয়া রাজার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে পারে নাই; আর পদ্মাক্ষর কবিতায় মুগ্ধ হইয়া রাজা তাহাকে সভাকবিরূপে বরণ করিয়া লইয়াছেন। সময়ের ওই বিন্দু হইতেই কমলনয়ন ও পদ্মাক্ষ আলাদা হইয়া গিয়াছে। আমাদের পরিচিত পৃথিবীতে কবি না-হইতে-পারা কমলনয়নের জীবনস্রোত বহিয়া চলিয়াছে; আর এই পৃথিবীর গভীরে আর-একটা পৃথিবী আছে, এখানকার সকল না-হওয়া ঘটনাগুলি সেখানে সফল হইয়া যায়, এখানকার সকল ‘না’ সেখানে ‘হাঁ’ হইয়া উঠে—বিপরীত সম্ভাবনার সেই গভীরতর পৃথিবীতে কবি হইতে- পারা পদ্মাক্ষর জীবনলীলা অনুষ্ঠিত হইয়া চলিতেছে। 

গ্রামের ঘাট হইতেই পদ্মাক্ষর আগমন সংবাদ গ্রামময় রাষ্ট্র হইয়া গেল। পুত্ৰ এতদিন পর কৃতী হইয়া দেশে ফিরিয়াছে; জনক-জননী, পাড়াপ্রতিবেশীর আনন্দের অবধি নাই। পরিচিত ব্যক্তিবর্গের ভিড়ে প্রমোদন পুরন্দরের গৃহের উঠান লোকে লোকারণ্য হইয়া গেল। 

নদীর জল সামান্য নামিয়া গিয়াছে, খালপাড়ে বৈঁচি ফল পাকিয়াছে, আকাশে উদাসী মেঘের গতিবিধি। দুই-একটি কাশ ফুল দেখা দিয়াছে, কাহারা যেন পদ্মার তীর বাহিয়া বেতসতলার ছায়ায় ছায়ায় ঢাক বাজাইয়া চলিতেছে। কে এক পটুয়া পট খেলাইতে আসিয়াছে। মনসাগীত সুর তুলিয়া গাহিয়া গ্রামের বালক-বালিকাদের সম্মুখে পটের ছবিগুলি খুলিয়া খুলিয়া দেখাইতেছে; উজ্জ্বল সোনালি রঙের চিত্রপট ব্যাখ্যা করিয়া হাত-পা নাড়িয়া মেঠোসুরে বিভোর হইয়া পটুয়া নিজে মাতিতেছে, অন্যকে মাতাইতেছে। রং, সুর, রোদ, বাতাস, মেঘ সব মিলিয়া গঙ্গাহৃদি বঙ্গদেশ যেন আকুল হইয়া উঠিতেছে। কোথাও ঢেঁকিতে পাড় পড়িতেছে, তাহার শব্দের সহিত চিঁড়া, নাড়ু, খই, মোয়ার সুঘ্রাণ গৃহ হইতে গৃহান্তরে ভাসিয়া আসিতেছে। 

এইসব আনন্দদিনের ভিতর দিয়া এক পক্ষকাল যেন কয়েক দণ্ডে অতিবাহিত হইয়া গেল। পদ্মাক্ষর ফিরিয়া আসিবার সময় হইল। বিদায়কালে জননীর অশ্রুজলে পদ্মাক্ষর শিরোদেশ অভিসিঞ্চিত হইল, দেশগ্রামের সকল লোক নদীতীরে তাহাকে বিদায় জানাইতে আসিল। 

কয়েকদিন নদীযাত্রার পর নৌকার যাত্রীদল, মাঝিমাল্লা এক রাত্রে নিকটস্থ তীরভাগে নামিয়া রাত্রিযাপনের উদ্যোগ করিয়াছিল। সেস্থলে আরও একটি নৌকার যাত্রী একদল লোক নৌকা ভিড়াইয়াছিল। উভয় দলে মিলিয়া রন্ধনবণ্টনাদির ব্যবস্থা হইতেছে। এমন সময়ে পদ্মাক্ষ ও তাহার সহযাত্রীগণ অপর দলের সদস্যদের নিকট হইতে এক নিদারুণ সংবাদ পাইল। চন্দ্রদ্বীপ পাঠানের দ্বারা আক্রান্ত হইয়াছে। পাঠান সৈন্য সমস্ত নগরে লুঠতরাজ করিতেছে। চন্দ্রদ্বীপের ঘাটে নৌকা হইতে অবতরণ করা নিরাপদ নহে। অনেক আলোচনা করিয়া বাকি পথ পদব্ৰজেই যাইতে হইবে, পদ্মাক্ষ বুঝিতে পারিল। যে-স্থানে সেই রাত্রে নৌকা ভিড়ানো হইয়াছিল, সেখান হইতে চন্দ্রদ্বীপ পহুঁছিতে হাঁটাপথে দুইদিন লাগিবে। মধ্যে গঞ্জের হাট, ক্রোশতীর্থ, হরিরামপুর, নবগ্রাম, পুষ্পপুর, চরবান্ধিয়া নামক গ্রামসমূহ দূরে দূরে অবস্থিত। এইসব গ্রাম পদব্রজে পার হইয়া পদ্মাক্ষকে চন্দ্রদ্বীপে উপনীত হইতে হইবে। 

পরদিন প্রভাতে বস্ত্রপ্রান্তে পুথিগুলি বাঁধিয়া লইয়া, সঙ্গের পুঁটুলিটি স্কন্ধে লইয়া পদ্মাক্ষ যাত্রা আরম্ভ করিল। মধ্যবর্তী গ্রামগুলি পরস্পর সন্নিবিষ্ট নহে, মধ্যে মধ্যে দিগন্তবিথারিত ধানের খেত, পাটের খেত, আখের চাষ হইতেছে। কখনও আলপথ দিয়া, কখনও নদীর বাঁধের উপর দিয়া, কখনো বা গ্রামের ভিতর দিয়া পদ্মাক্ষ পন্থা অতিবাহন করিতে লাগিল। 

অপরাহুকালে হরিরামপুরে পহুঁছিয়া পদ্মাক্ষর বুঝিতে দেরি হইল না, পাঠান এই পথ দিয়াই গিয়াছে। গ্রামগুলি লুণ্ঠিত, লণ্ডভণ্ড হইয়া রহিয়াছে। পাঠানসৈন্য ধানের খেতের উপর দিয়া ধান দাবাইয়া গিয়াছে। গ্রামে গৃহস্থ বাটীগুলির প্রাকারসীমায় কবাট ভগ্ন হইয়া ঝুলিতেছে। কোনো কোনো গৃহাবাসের চাল দগ্ধ, কৃষ্ণধূম কটু গন্ধসহ বিনির্গত হইতেছে। হাটে একটিও লোক নাই। পথে একটা কুকুরও পর্যন্ত দেখা গেল না। পুষ্করিণীতে কেহ স্নান করিতেছে না। বিহগসকলও কূজন ভুলিয়াছে। 

ক্রমশ হরিরামপুর পার হইয়া নবগ্রাম অতিক্রম করিয়া পুষ্পপুরে উপনীত হইয়া এই চিত্র আরও প্রকট হইয়া উঠিল। এ গ্রামে মনুষ্যমাত্রেরই অভাব পরিলক্ষিত হইল। পাঠান সৈন্যের ভয়ে কে কোথায় পলাইয়াছে। গৃহদ্বার সকলই উন্মুক্ত খাঁ খাঁ করিতেছে। কেহ কোথাও নাই। গোশালায় অলস মধ্যাহ্নে শুষ্কতৃণচর্বণরত গাভীও নাই। হয় তাহাদের কেহ লইয়া পলাইয়াছে, নয় পাঠানসৈন্য গবাদিপশুগুলিকে জবাই করিয়াছে। 

পুষ্করিণী হইতে জল লইয়া চিঁড়ার উপর জলসিঞ্চন করিয়া পদ্মাক্ষ এক অশ্বত্থবৃক্ষের তলে আহার করিতে বসিল। একটা ছন্ন বাতাস নদীতীর হইতে উঠিয়া আসিয়া এই পরিত্যক্ত মৃত গ্রামের পথে পথে ঝুঁকিতে ঝুঁকিতে চলিতেছিল। একটা শুষ্ক অশ্বত্থের পাতা সেই মন্থর বায়ুবেগে একটি দীর্ঘশ্বাসের ন্যায় নিঃশব্দে খসিয়া পড়িল। পদ্মাক্ষ ভাবিতেছিল, চন্দ্রদ্বীপের না-জানি কী অবস্থা! নদীতীরে তাহার সেই নির্জন কুটিরটি কি আর আছে? হয়তো পাঠান সৈন্য তাহার সে-কুটির জ্বালাইয়া দিয়াছে! 

এমন সময়ে কোথা হইতে একটা অস্ফুট ক্রন্দনের শব্দ পদ্মাক্ষকে চমকিত করিয়া দিল। কেহ যেন ফুঁপাইয়া ফুঁপাইয়া কাঁদিতেছে। সে ত্বরিতে উঠিল। কান্নার শব্দ অনুসরণ করিয়া এক গৃহপ্রান্তে উপস্থিত হইল। 

এ গৃহেরও কবাট অগ্নিদগ্ধ ভগ্ন হইয়া আছে। উঠানে একটা গোযানের চাকা ভগ্ন রথচক্রের ন্যায় পড়িয়া রহিয়াছে। ঘরদ্বার ধুলামলিন, চালের খড় ছিন্নভিন্ন, বিধ্বস্ত। পদ্মাক্ষ কোনোমতে দাওয়ায় উঠিয়া এক অর্ধনিমীলিত দ্বারপথ দেখিতে পাইল। দ্বার ঠেলিয়া সে দেখিল, প্রায়ান্ধকার কক্ষে কে এক কিশোরী বালিকা হাঁটুর উপর মস্তক রাখিয়া আকুলস্বরে ক্রন্দন করিতেছে। 

কিছুক্ষণ পরে মনুষ্যপদশব্দে চমকিত বালিকা মুখ তুলিয়া তাকাইল। তাহার অশ্রুপরিপ্লুত মুখ অমনই আতঙ্কে নীল হইয়া উঠিল, সে সভয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, “আমাকে মারিও না গো, আমার কেহ নাই, সকলেই পলাইয়াছে, গৃহেও আর ধনসম্পদ কিছুমাত্র নাই। তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে ছাড়িয়া দাও!” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “ভয় নাই। আমি সামান্য পথিক, পাঠান সৈন্য নহি। তোমাদিগের গ্রামের পথ দিয়া যাইতেছিলাম। তোমার ক্রন্দনশব্দ শুনিয়া গৃহে প্রবেশ করিয়াছি। কী হইয়াছে?” 

কিশোরী অঞ্চলপ্রাপ্ত বক্ষের উপর টানিয়া বেশবাস সম্বৃত করিল। সামান্য আশ্বস্ত হইয়া সে ধীরে ধীরে বলিল, “পরশ্ব আমি ঘাটে গিয়াছিলাম। ফিরিতে বিলম্ব হইয়াছিল। ইতোমধ্যে পাঠান সৈন্য গ্রামে প্রবেশ করে। একের পর এক গৃহস্থ বাটী লুঠতরাজ করিয়া বহু গৃহে অগ্নি সংযোগ করিয়া চলিয়া যায়। ঘাট হইতে ফিরিবার পথে দূর হইতে এই তাণ্ডবলীলা দেখিয়া আমি ভয়ে সমস্ত দিন ইক্ষুখেতের ভিতর লুকাইয়া ছিলাম। তাহার পরদিন বাহির হইয়া আসিয়া গৃহে পৌঁছাই।” 

“আসিয়া কী দেখিলে?” 

“দেখিলাম, গৃহ লুণ্ঠিত, পিতা ভ্রাতা সকলেই কে কোথায় পলাইয়া গিয়াছে। পাঠানেরা গাভীগুলিকে বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে। গৃহে এক দানা শস্যও আর অবশিষ্ট রাখে নাই।” 

কিশোরী পুনরায় ক্রন্দন করিতে লাগিল। পদ্মাক্ষ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী?” 

সে কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “হৈমবতী।” 

পদ্মাক্ষ কহিল, “আমাকে ভয় করিও না। আমি ব্রাহ্মণ, চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সভাকবি, নাম— পদ্মাক্ষ। চন্দ্রদ্বীপেই যাইতেছিলাম। পথিমধ্যে এইরূপ বিপদ,” তাহার পর আরও গম্ভীর হইয়া পদ্মাক্ষ বলিল, “দেখ, এ স্থলে এইরূপে বসিয়া বসিয়া ক্ৰন্দন করিলে কোনো লাভ হইবে না। আপাতত, চরবান্ধিয়া যাত্রা করিব। তুমি চাহিলে আমার সহিত আসিতে পারো।” 

হৈমবতী অবোধ হরিণীর ন্যায় তাহার দুইটি বড়ো বড়ো চক্ষু তুলিয়া পদ্মাক্ষের মুখপানে চাহিল। তাহার চাহনিতে সরল বিশ্বাস ছায়া ফেলিতেছিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *