উনত্রিশ
ক্লান্ত, বড়ো ক্লান্ত আজ। শুধু আজ নহে, কতদিন ধরিয়া এই ক্লান্তি, এই অবসাদ চলিতেছে। হরিশচন্দ্র ঘাটের সেই মর্মান্তিক দৃশ্যের অভিঘাত সমস্ত মনকে যেন পঙ্গু করিয়া দিয়াছে। বাঁচিবার ইচ্ছা যেন আর নাই। সমস্ত জীবন, জীবনের সমস্ত প্রয়াস শূন্যে পর্যবসিত হইয়া গিয়াছে। মনে আজ ক্ষোভ জন্মে, কেন সে এই সাম্প্রদায়িক বিভেদের সমস্যার কথা ভাবিতে বসিয়াছিল? কেন নিজেকে ইহার ভিতর জড়াইয়াছিল? তাহার প্রয়াস নিষ্ফল হইয়াছে। শূন্য ঘরের ভিতর বাতাস হা-হা করিয়া বহিয়া যাইতেছে। হৃদয় বধির হইয়া গিয়াছে।
অথচ কী আশ্চর্য! সেই ঘটনার পর অপরাপর হিন্দু ব্যক্তিবর্গের সহিত ইহা লইয়া আলোচনা করিতে গিয়া সে অবাক হইয়া দেখিল, সকলেই হৃষ্ট, আনন্দিত। মুসলমান আততায়ীদের উপর হিন্দু নাগা সন্ন্যাসীদের এই বিজয়ে সকলেই উল্লসিত। হায়! ইহারা ভবিষ্যৎ দেখিতে পাইতেছে না। কেহ কেহ আবার কমলনয়নকে ইত্যাকার প্রয়াসের প্রধান অধিনায়ক হিসাবে অভিনন্দনও জানাইয়া গেল! তাহাদের সেই নন্দন-সংবাদ শুনিতে শুনিতে কমলনয়নের মাথা লজ্জায় হেঁট হইয়া যাইতেছে।
জীবন বিস্বাদ হইয়া গিয়াছে। মৃত্যু আসিতে আর কত বিলম্ব? রক্তের কণিকারা হৃৎপিণ্ডে আসিয়া প্রতি মুহূর্তে করাঘাত করিয়া নির্লজ্জের মতো বলিয়া যায়, সে এখনও বাঁচিয়া আছে। অধ্যয়ন ব্যর্থ, অধ্যাপনা ব্যর্থ, গ্রন্থরচনা ব্যর্থ, সন্ন্যাস ব্যর্থ। কোন্ আশা, জীবনের কোন্ ইতিবাচক বোধ লইয়া ইহার পর সে আর বাঁচিয়া থাকিবে?
আজ প্রভাতে সে গঙ্গাস্নানে যাইতেছিল। খররৌদ্র উঠিতেছে। যেন জীবনের সমস্ত প্রত্যয়কে শুষিয়া লইবে। কমলনয়ন দ্রুতপদে চলিতেছিল। কয়দিন পূর্বে নাগাসন্ন্যাসীদিগের প্রধান আসিয়া বলিয়াছিল, প্রাথমিক ভাবে সম্রাট আকবরের দিক হইতে যে-অর্থসাহায্য আসিয়াছিল, অস্ত্র ও অশ্ব ক্রয় করিবার জন্য তাহা সমস্তই ব্যয় হইয়া গিয়াছে। ফতেহপুর সিক্রি হইতে অর্থসাহায্য আসিতে বিলম্ব হইবে। কিন্তু এদিকে চলিবে কী প্রকারে? কমলনয়ন এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারে নাই। এসকল কথা ভাবিতেও তাহার এখন বিবমিষা হইতেছে!
রৌদ্র প্রখর হইল। কোথাও কোনো শান্তি নাই। চৌষট্টি ঘাটের সোপান বাহিয়া নামিয়া কমলনয়ন তাহার খড়ম ঘাটের উপর খুলিয়া রাখিল। পা পুড়িয়া যাইতেছে, ঘাটের ধাপগুলি এতদূর উত্তপ্ত। ধীরে ধীরে সে গঙ্গায় নামিল। ঊর্ধ্বে দৃষ্টিপাত করিল। নীলাকাশ নিষ্করুণ হইয়া তাকাইয়া আছে। গঙ্গায় কিছুদূর অবধি গেল। তাহার পর দুই হস্তে জলতল সরাইয়া নদীর সেই অপার্থিব শীতলতার ভিতর ডুব দিল। আর উঠিতে ইচ্ছা করিতেছে না।
দমবন্ধ হইয়া আসিতেছে। আর না-উঠিলে কেমন হয়? কী হইবে জীবনের ভিতর ফিরিয়া গিয়া? কোলাহলের ভিতর, অবসাদের ভিতর, জীবনের অক্লান্ত রক্তপাতের ভিতর ফিরিয়া গিয়া কী লাভ? যেখানে কোনো জ্ঞান নাই, প্রেম নাই, যেখানে নিষ্ঠুরতার অমোঘ চক্র ঘুরিতেছে, সে-অলাতচক্রের সহিত নিজের শিরোদেশ জুড়িয়া পুনরায় রক্তাক্ত হইবার কী প্রয়োজন? এই ত্রিপথগা কলুষনাশিনী ভাগীরথীর বক্ষের ভিতর নিভৃত শীতলতার ভিতর ডুবিয়া গেলে কেমন হয়?
পারিল না। ফুসফুস ফাটিয়া যাইবার উপক্রম। কমলনয়ন স্রোতের উপর মাথা তুলিল। ভয়ানকভাবে শ্বাস লইল। চারিদিক অন্ধকার দেখাইতেছে। ঘাটের দিকে ফিরিল। কে একজন ঘাট বাহিয়া জলের উপর নামিয়া আসিতেছে। কমলনয়ন ধীরে ধীরে সাঁতার দিয়া ঘাটের নিকটে আসিল।
একজন বৃদ্ধ। তিনি যে বৃদ্ধ, তাহা তাঁহার মস্তকের ও বক্ষের পলিতকেশ দেখিয়াই মাত্র অনুমিত হয়, নতুবা তাঁহার স্কন্ধে ও বাহুতে যুবাসুলভ তেজ ও বিক্রম প্রকাশ পাইতেছে। মুখাবয়ব গম্ভীর, চক্ষুদুইটি জবাফুলের মতো লাল; ভ্রুযুগ পাকিয়া গিয়াছে। ওষ্ঠ অধর দৃঢ়সংবদ্ধ, চিবুকে লালিত্য কিছুমাত্র নাই। জলের ভিতর কটিদেশ পর্যন্ত মগ্ন হইয়া আছেন। কমলনয়নকে দেখিয়া তিনি পূর্বপরিচিতের ন্যায় হাসিলেন। এ ব্যক্তি কে?
“আচার্য মধুসূদন সরস্বতী না? ঠিক চিনিয়াছি?” বৃদ্ধ সহাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন।
“হাঁ। আমিই মধুসূদন। কিন্তু আপনকে তো চিনিলাম না!”
“চিনিবার কথাও নয়। আমি গোরক্ষনাথ!”
গোরক্ষনাথ? যোগিসম্প্রদায়ের সেই অলৌকিক শক্তিধর গুরু গোরক্ষনাথ? ইঁহার কথা সে যে কতমুখে শুনিয়াছে। ইনি নাকি শতসহস্র বৎসর ধরিয়া যোগবলে বাঁচিয়া আছেন! গুপ্তদেহে অবস্থান করেন, নিজে প্রকট না হইলে কেহ তাঁহাকে দেখিতে পায় না। এইসব লোকশ্রুতি! সত্য কি মিথ্যা কে বলিতে পারে—তবে ইনি যে দীর্ঘকাল ধরিয়া যোগ সাধনার সযত্নলালিত সৎকারসেবিত ধারাটিকে বহন করিয়া ফিরিতেছেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।
“আপনার দর্শন পাইয়া আমি কৃতকৃতার্থ হইলাম। আপনি আমাকে দেখা দিয়াছেন, ইহা আমার পরম সৌভাগ্য।”
দুই হস্তে জল অপসারিত করিয়া গোরক্ষনাথ আরও সম্মুখে অগ্রসর হইয়া আসিলেন। বলিলেন, “না। আমি নিজের প্রয়োজনেই আমার এ অন্তিম সময়ে তোমার সহিত দেখা করিলাম।”
“অন্তিম সময়? কেন এই কথা বলিতেছেন?”
“যোগবলে দীর্ঘকাল বাঁচিয়া আছি, মধুসূদন। কিন্তু আর বাঁচিতে ইচ্ছা করি না। কলিকালের পাপের সরা ভরিয়া আসিয়াছে। আমাকে এইবার যাইতে হইবে; আর সহ্য করিতে পারিতেছি না।”
“কিন্তু আপনার ন্যায় মহাত্মার এখনই তো সর্বাধিক প্রয়োজন। যাহারা শুভবোধ লইয়া কোনোক্রমে এ যুগে বাঁচিয়া থাকিতে চায়, আপনারাই তো তাহাদের অবলম্বন।”
“হইতে পারে। কিন্তু আমার এ শরীর যোগসঞ্জাত দেহ। ইহা পাপস্পর্শে আর টিকিতেছে না। অসুখে ভুগিয়া মরিবার পূর্বেই আমি ইহা জলাঞ্জলি দিব। গঙ্গাগর্ভে কিছুক্ষণ কুম্ভক করিয়া বসিয়া থাকিলেই শ্বাসরোধ হইয়া যাইবে।”
এমন দৃঢ়তার সহিত বৃদ্ধ কথা কটি কহিলেন, যেন ইহা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তথাপি, কমলনয়ন তাঁহার এ অভীপ্সার প্রতিরোধ করিতে চাহিল। বলিল,
“আমার একটি প্রশ্ন আছে, যদি উত্তর দিয়া কৃতার্থ করেন।”
গোরক্ষনাথ বলিলেন, “বেশ। কী প্রশ্ন বলো।”
“শুনিয়াছি, আত্মহত্যা পাপ। আপনি গঙ্গায় দেহ-বিসর্জন দিলে কি সে পাপ আপনাকে স্পর্শ করিবে না?”
“দেখ মধুসূদন। যে-ব্যক্তি নিজেকে দেহ বলিয়া মনে করে, সে স্বেচ্ছায় দেহনাশ করিলে আত্মহত্যা করা হয়। কিন্তু আমি তো দেহকে ‘আমি’ বলিয়া মনে করি না। আমি নিশ্চিত জানিয়াছি, আমি দেহ নই, আমি আত্মা। গ্রন্থপাঠ করিয়া বা বিচার করিয়া জানা নয়, ইহা আমার সাক্ষাৎ অনুভূতি। দেহ আমার আত্ম নয়, তবে কেমন করিয়া ইহা আত্মহত্যা হইবে?”
“তথাপি বলিব, আপনি জল হইতে উঠিয়া আসুন। আমি আপনার জীবনভোর সেবা করিব।”
বৃদ্ধ হাসিয়া বলিলেন, “তুমি মহানুভব, মধুসূদন। কিন্তু সত্যই আমার আয়ুষ্কাল শেষ হইয়া আসিয়াছে। আর ফিরিব না। শুধু যাইবার পূর্বে আমার একটি দ্রব্য তোমার হস্তে তুলিয়া দিতে চাই।”
“কী দ্রব্য?”
“একটি রত্ন। ইহার নাম চিন্তামণি রত্ন। তোমাপেক্ষা যোগ্যতর অধিকারী ইহার আমি আর দেখিতেছি না।”
“উহা কী বস্তু?”
“ইহা আমি যোগসাধনার দ্বারা অর্জন করিয়াছিলাম। ইহা এমন এক রত্ন যে, ইহা হাতে লইয়া যে যাহা চায়, সে তাহাই লাভ করে। অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, খ্যাতি— যাহা চাও, ইহা হস্তে লইয়া প্রার্থনা করিলে অচিরেই তাহা লাভ করিবে।”
চিন্তামণি রত্নের এবংবিধ গুণ শুনিয়া কমলনয়ন বিস্মিত বোধ করিল। তাহার পর সে নির্বিঘ্ন স্বরে কহিল, “কিন্তু ইহার তো কোনো প্রয়োজন আমার নাই। ওই সকল অর্থ, বিত্তাদি লইয়া আমি কী করিব? আমার বাঁচিবার ইচ্ছাই চলিয়া গিয়াছে যে!”
বৃদ্ধ করুণাপূর্ণ স্বরে বলিলেন, “জানি। তোমার অন্তরে কী যন্ত্রণা হইতেছে, যোগবলে আমি তাহা জানিতে পারিয়াছি। কিন্তু কী করিবে? ইহাই ভবিতব্য ছিল। ইহা সমগ্র মানবজাতির সমষ্টি-কর্মফল। সেই সমষ্টি-কর্ম তোমাকে আশ্রয় করিয়া ফল দিতেছে। তুমি নিজেকে দোষী ভাবিতেছ কেন?”
“আমি—আমিই নাগাদের হস্তে অস্ত্র তুলিয়া দিয়াছিলাম!”
“তুমি না তুলিয়া দিলে অন্য কেহ দিত, এই ভাবিয়া সান্ত্বনা লাভ করো। এই সমাজ হইল তোমার ছায়া। তুমি ইহাকে পা দেখাইয়াছ, এক্ষণে তাই ইহা তোমাকে পা দেখাইতেছে। এই কথা ভবিয়া শান্ত হও। এই চিন্তামণি রত্ন দিতেছি, ইহার সদুপযোগ করিয়া জগতে কল্যাণকর ভাবের প্রচার করো। তাহা হইলেই যথেষ্ট হইবে।”
“না, ইহা আমি চাহি না। ইহার প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নাই।”
“সমস্যা হইল। তোমাপেক্ষা যোগ্য ব্যক্তি আর নাই। তুমি ইহা না গ্রহণ করিলে, আমারই সহিত ইহা গঙ্গাগর্ভে চলিয়া যাইবে।”
কমলনয়ন দেখিল, গোরক্ষনাথ ইহা তাহার হস্তে প্রদান করিবেনই। সে যেন এক মুহূর্ত কী ভাবিয়া বলিল, “বেশ। আমি ইহা গ্রহণ করিব। কিন্তু তাহা হইলে আমি ইহার যেরূপ ব্যবহার করিব, তাহাতে আপনার কোনো আপত্তি থাকিবে না?”
গোরক্ষনাথ বলিলেন, “না। কোনো আপত্তি নাই।”
ইহা শুনিয়া কমলনয়ন হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ করিল। গোরক্ষনাথ তাঁহার কটিদেশ হইতে কী একটি দ্রব্য গ্রন্থিমুক্ত করিয়া কমলনয়নের হস্তে অর্পণ করিলেন। কমলনয়ন দেখিল, একটি বহুদ্যুতিময় রত্নই বটে। সূর্যালোকে সেই রত্ন ঝলমল করিয়া উঠিল। কমলনয়ন পুনর্বার জিজ্ঞাসা করিল, “ভগবন! তবে ইহা লইয়া আমি যাহা ইচ্ছা তাহা করিতে পারি?”
গোরক্ষনাথ বলিলেন, “হাঁ, যাহা ইচ্ছা, তাহাই করিতে পারো।”
কমলনয়ন তৎক্ষণাৎ রত্নটি মুষ্টিতে ধরিয়া সবেগে গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিল। রত্ন স্রোতকে সামান্য বিক্ষুদ্ধ করিয়া জলের অতলে ডুবিয়া গেল। গোরক্ষনাথ ঈষৎ হাসিয়া কমলনয়নের উদ্দেশে বলিলেন, “দেখ দেখি, চিন্তামণি রত্নটি আমি যোগ্য পাত্রে দিয়াছি কি না?”
কমলনয়নও বৃদ্ধের সহিত হাস্যে যোগ দিল। পরে গোরক্ষনাথ গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “এইবার আমি আসিব।”
কমলনয়নের পাশ দিয়া ধীর অবিকম্পিত পদক্ষেপে বৃদ্ধ অগ্রসর হইতে লাগিলেন। ভরা গঙ্গায় আকণ্ঠ নামিয়া গেলেন। তাহার পর ডুব দিলেন। কমলনয়ন অপেক্ষা করিতে লাগিল। কয়েক দণ্ড অতিক্রান্ত হইয়া গেল। কিন্তু বৃদ্ধ আর উঠিলেন না। কমলনয়ন দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগকরতঃ জল হইতে উঠিয়া বিষণ্ণ চিত্তে মঠাভিমুখে চলিতে লাগিল।
সমস্ত দিন গোরক্ষনাথের এই আত্মবিসর্জনের দৃশ্য মনের ভিতর ফিরিয়া ফিরিয়া আসিতে লাগিল। কোনোমতে তাঁহাকে ফিরাইতে পারিল না? যে-যুগে মহাত্মাগণ স্বেচ্ছায় এইরূপে বিদায় লইয়া চলিয়া যান, সে-যুগ বড়ো হতভাগ্য। তাহার অসুস্থ শয্যার শিয়রে কোনো স্নেহব্রতী সুধীর উপস্থিতি নাই। কোনো সান্ত্বনা নাই, ক্ষতস্থানে প্রলেপ দিবার কেউ নাই, আরোগ্য নাই। জটাপিঙ্গল মধ্যাহ্ন ধীরে ধীরে দিনান্তের দিকে ঢলিয়া পড়িতেছে। প্রভাতের প্রসূন খরতাপে শুষ্ক হইল। কী উদ্দেশ্য এই জীবনের? এই প্রাণান্ত যাপনের? কী অর্থ এই ইন্দ্ৰধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজনের?
অপরাহ্ণ আসিল। কমলনয়ন ক্ষুদ্র কক্ষটির ভিতর কৃষ্ণকিশোরের সম্মুখে আসিয়া বসিল। কাঠগোলাপ ফুল দিয়া মালা গাঁথিয়া কৃষ্ণকিশোরকে পরাইল। কিশোর হাসিতেছে। আবার সেই বাঁশির সুরটা ফিরিয়া আসিতেছে।
“কমল! ও কমল! চলো আমরা কাশী হইতে চলিয়া যাই।”
“কোথায় যাইব?”
“কেন? সেই যে নদীতীর… সেই অবারিত মাঠ… বৃক্ষলতায় পরিপূর্ণ কান্তার…. সেই অনাবৃত আকাশ… সেই তোমাদের উনসিয়া গ্রাম…”
“আর বুঝি এখানে থাকিতে ইচ্ছা হইতেছে না?”
“না। আর ভালো লাগিতেছে না। এখানে আমার বাঁশি থামিয়া থামিয়া যায়। “ “আমারই দুইটা হাত রুধিরাক্ত হইয়া গিয়াছে!”
“ও আমি সুর দিয়া মুছিয়া দিব। চলো, আমাকে লইয়া চলো। তোমাদের সেই গ্রামে তোমার জন্য আশ্চর্য এক বোধ অপেক্ষা করিয়া আছে।”
“বেশ যাইব। কিন্তু পথিমধ্যে তোমার কত কষ্ট হইবে যে?”
“কিছু কষ্ট নয়। তুমি যাহা খাইবে, আমিও তাহাই খাইব। তোমার সহিত পথ চলিব। উনসিয়া যাইবার পূর্বে একবার নবদ্বীপ হইয়া ঘুরিয়া যাইব।”
“নবদ্বীপ? সেই নবদ্বীপ, যেখানে আমার কৈশোর কাটিয়াছে?”
“সেখানেই। দেখ-না, ফিরিয়া গিয়া কেমন লাগে। তোমার সেই টোল, সেই যে গৌরপদরজপবিত্র ধূলিকণা…”
“সেসব দেখিয়া যদি আবার মন খারাপ হয়?”
“হইলই-বা। এখানকার মনখারাপ অপেক্ষা সেখানকার মনখারাপ অনেক ভালো। সেই বিষাদ যে মধুর!”
“তুমি বড়ো কঠিন, কৃষ্ণকিশোর! তুমি শুধু মানুষকে এক মনোবেদনা হইতে অন্য মনোবেদনায় লইয়া যাও।”
“বেদনাই যে আমার চিরবিরহের সুর! কেন, তোমার কি আর সে-বেদনামায়া মধুর লাগে না?”
.
কথা থামিয়া গেল। কেবল বাঁশির সুরে হৃদয়পুর ভরিয়া উঠিতেছে। সন্ধ্যা হইয়া আসিল।