ছাব্বিশ
হৃদয় বিদ্ধ হইয়া আছে, কিন্তু রক্তক্ষরণ হইতেছে না। বেদনার নিখাদ স্নায়ুর কীর্ণ পথ বাহিয়া সমগ্র সত্তাকে মন্থন করিয়া ফিরিতেছে; কেহ জানিতে পারিতেছে না। অস্তিত্বের সে-যন্ত্রণা বড়ো সঙ্গোপনীয় মধুর! তাহার সুষুম্নাপথ দিয়া কে যেন সুধার অসি চালাইয়া দিতেছে, সত্তা দু-ভাগ হইয়া যাইতেছে। মনের ভিতর দুইজন কথা বলিতেছে। একজন বলিতেছে, কী করিতেছ, কমলনয়ন? একবার যাহা সত্য বলিয়া বুঝিয়াছ, আবার তাহা ভুলিয়া এ বংশীবাদকের প্রেমে মজিতেছ কেন? অন্যজন বলিতেছে, মিথ্যা মায়াকে লইয়া ইচ্ছামতো খেলা করিবারই নাম ‘লীলা’। তুমি শুধু নির্বিকল্প সত্তার সহিত একাকার হইতে চাও কেন? আমার লীলাচঞ্চল কৃষ্ণকিশোরকে চাও না? দ্বিখণ্ডিত সত্তার এবং প্রকার আলাপ ক্রমাগত শুনিতে শুনিতে কমলনয়ন যেন এক অনিবার্য দ্বন্দ্বের দোলায় দুলিতেছে। হৃদয় ও মস্তিষ্ক দ্বিমেরুবর্তী হইয়াছে। এ বেদনা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইবার বুঝি আর উপায় নাই।
ফতেহপুর সিক্রি হইতে প্রত্যাবর্তনের পর চারি মাস অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। পুনরায় সে তাহার চিরপরিচিত কক্ষে ফিরিয়া আসিয়াছে। ইতোমধ্যে অনেক আলোছায়া বাতায়নপথে খেলিয়াছে, মঠের পিছনে যে-কৃষ্ণচূড়া পাদপ বঙ্কিম ঠামে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার উদাত্ত শাখায় অনেক পাখি নীড় বাঁধিয়াছে। অনেক রাত্রি গতযামা হইয়া প্রভাতের পরিচিত আলোকের সহিত মিতালি করিয়াছে। আগ্রা হইতে টোডরমলের পত্র আসিয়াছে; ফতেহপুর সিক্রির সভাপণ্ডিতগণ কমলনয়নের সন্দর্ভে উত্থাপিত দাবি মানিয়া লইয়াছেন। তাঁহারা স্বীকার করিয়া লইয়াছেন যে, টোডরমল কায়স্থ এবং সেই হেতু ক্ষত্রিয়। এসকল ঘটনার বিবরণ ফারসি ভাষায় ‘কায়স্থবয়ান’ নামক বিবরণীতে লিখিত হইয়াছে।
অবিন্যস্ত চিন্তার রাশি ফেলিয়া কমলনয়ন উঠিয়া দাঁড়াইল। একবার দ্বারের নিকট আসিয়া অলিন্দপথে কেহ আসিতেছে কি না, দেখিয়া লইল। তাহার পর চুপিসাড়ে কক্ষের এক অন্ধকার কোণে সরিয়া আসিল। সেখানে একটি অতি ক্ষুদ্রাকার দ্বারপথ আছে। সচরাচর ইহা বাহিরের লোকের নয়নপথে পড়ে না। সে সন্তর্পণে দ্বারের অর্গল খুলিল। এইখানে একটি গোপন কক্ষ। পূর্বে এ কক্ষে দুষ্প্রাপ্য পুথির ভাণ্ডার ছিল। বর্তমানে কমলনয়ন সেসব পুথি অন্যত্র স্থানান্তরিত করিয়া কক্ষটি পরিষ্কার করিয়াছে।
কক্ষের ভিতর অন্ধকারে পিলসুজের উপর দীপাধারে ঘৃতপ্রদীপ জ্বলিতেছে। মুচকুন্দ চাঁপাফুলের ঘ্রাণ। সেই সুরভিমেদুরতার ভিতর একটি ক্ষুদ্র সিংহাসনে কৃষ্ণকিশোর বিরাজ করিতেছেন। মনে অনেক দ্বিধা থাকা সত্ত্বেও শিশোদিয়া রাজপুত পরিবারের ঠাকুরঘর হইতে কমলনয়ন কৃষ্ণকিশোরকে লইয়া আসিয়া এই গোপন কক্ষে স্থাপন করিয়াছে। চন্দনচর্চিত নীলকলেবর বনমালী বংশীধর তাঁহার রূপের বিভায় এ কক্ষ আলো করিয়া রাখিয়াছেন।
ইহা কি সে ঠিক করিল? সে অদ্বৈতপথের পথিক, তাহার এ কী ভাবখেয়ালের ধূলাখেলা? অনেক ভাবিয়াছে। ভাবিতেছে। মস্তিষ্ক বলে, ঠিক করো নাই। হৃদয় বলে, কেমন করিয়া এ আকর্ষণ ছাড়াইয়া যাও, দেখিব। মাঝে মাঝে মন কৃষ্ণাভিমুখী হয়। তখন সে ভক্তিভরে বাগান হইতে চাঁপাফুল তুলিয়া আনিয়া প্রাণ ভরিয়া পূজা করে। মনে হয়, তাহার নিভৃত বেদনার কথা এ কান্তাকাতর নীলমাধবই জানে। আবার কিছুদিন পর অদ্বৈত জ্ঞানের ভাব প্রবল হইয়া উঠে। এখন যেমন গত কয়দিন হইয়াছে। এ সময় পূজা পড়িয়াছিল। সে কৃষ্ণের পূজা করে নাই। অহোরাত্র বেদান্তের গ্রন্থ লইয়া গবেষণায় মত্ত ছিল। আজ আবার আসিয়াছে। কৃষ্ণকিশোরের সম্মুখে একটু বসিল। কেহ জানে না! এ তাহার গোপন প্রেম!
মনে হইল, বেণুধরের বড়ো অভিমান হইয়াছে। ঠোঁট ফুলিয়া আছে। চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু বেপথুমান।
“তুমি আমার পূজা করো নাই কেন? এ কয়দিন আমি কিছু খাই নাই, জানো? সে-কথা তোমার মনে পড়িল না? যাও, তোমার সহিত কথা বলিব না!”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কমলনয়ন ক্ষুদ্র কক্ষটির বাহিরে আসিল। এদিক-ওদিক তাকাইতে তাকাইতে একটা তুলট কাগজ চোখে পড়িল। উৎপীঠিকার উপর কাগজ রাখিয়া মসীপাত্রে লেখনী ডুবাইয়া গোটা গোটা সুছাঁদ অক্ষরে লিখিল-
হস্তমুৎক্ষিপ্য যাতোহসি বলাৎ কৃষ্ণ কিমদ্ভুতম্?
হৃদয়াৎ যদি নির্যাসি পৌরুষং গণয়ামি তে।।—
জোর করিয়া হাত ছাড়াইয়া চলিয়া যাইতেছ, কৃষ্ণ-ইহাতে আর আশ্চর্য কী? আমার হৃদয় হইতে যদি নিজেকে বাহির করিয়া লইয়া যাইতে পারিতে, তবে তো তোমার পৌরুষ বুঝিতাম!
একবার বাতায়নপথে চাহিল। বেলা হইয়াছে। এইরকম আধোমনস্ক সকালবেলায় সে কোথা হইতে একটা সুর শুনিতে পায়। বাঁশির সুর! কে যে বাজায়! এই সুর সারাদিন কানে লাগিয়া থাকে। মনে প্রশ্ন আসে, সে কি একাই এই সুর শুনিতেছে? যত শুনে, বুকের ভিতরটা ততই হুস্থ করিতে থাকে। এ যে কী জ্বালা হইয়াছে তাহার!
“বলভদ্র, তুমি কি একটা বাঁশির সুর শুনিতেছ?”
“কই, না তো! চরাচর এ মধ্যাহ্নবেলায় স্তব্ধ হইয়া আছে, আচার্যদেব!”
বলভদ্র শুনিতে পায় না। ময়ূখ শুনিতে পায় না। শুধু সে একাই শুনিতে পায়। কখনও মনে হয়, সুরটা তাহার বুকের ভিতর বাজিতেছে। চোখ বন্ধ করিলে একটা আশ্চর্য সুগন্ধ টের পায়। ধূপ পুড়িয়া শেষ হইবার ঘ্রাণ। সে নিজেই পুড়িতেছে তবে? বুকের ভিতর হোম হইতেছে? আহুতির সুগন্ধবিধুর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাথায় উঠিতেছে? কী যে হইতেছে তাহার!
ঘরের একপার্শ্বে যত্নরচিত পুঁথিগুলি সূত্রবদ্ধ হইয়া পড়িয়া আছে। বহু বৎসরের পরিশ্রম। অদ্বৈতসিদ্ধি, অদ্বৈতরত্নরক্ষণম্, গূঢ়ার্থদীপিকা, বেদান্তকল্পলতিকা, সংক্ষেপশারীরকটীকা, সিদ্ধান্তবিন্দু… কত নিগূঢ় চিন্তা, কত নিবিষ্ট পরীক্ষা, কত আলোচনা, কত বিতর্ক-বিচার! কত প্রভাতনিশা, কত বিনিদ্র রজনীর আয়াস! এখন সব বিস্বাদ বোধ হইতেছে। কী লাভ গ্রন্থ রচনা করিয়া? এসব লিখিয়া লিখিয়া সে কী পাইয়াছে? কী খুঁজিতেছিল? যাহা খুঁজিতেছিল, মিলিল? তাহার মৃত্যুর পর আবার কি কেউ সেইগুলি খুঁজিবে? আজন্ম এইভাবে পরিশ্রম করিবে? তাহার পর কী পাইবে? পুথির কতগুলা শুষ্ক পাতা?
কতদিন কাটিয়া গিয়াছে যে! সে শুধু ঘুরিয়া মরিতেছে, ঘুরিয়া মরিতেছে। কাচের আবরণে দীপালোক দেখিয়া পতঙ্গ যেমন সেই কাচাবরণের চারিপাশে ঘুরিয়া মরে, সেও কি ওইরূপ লুব্ধ পতঙ্গের ন্যায় প্রণয়ের অমিত বৈভবের আশায় সমস্ত জীবন ঘুরিয়া মরিল না?
সহসা মনে হইল, কয়দিন কৃষ্ণকিশোরের সেবাপূজা করা হয় নাই। বালকের বড়ো অভিমান হইয়াছে। মান ভাঙাইতে হইবে।
কিছুক্ষণ ধরিয়া পূজা চলিল। দীপ, ধূপ, নূতন করিয়া জ্বালিল। পুষ্প, চন্দনে কৃষ্ণকিশোরকে সাজাইল। পাদ্য, অর্ঘ্য, তুলসী দিল। চৌষট্টি ঘাটের সমীপবর্তী এক আপণ হইতে সরভাজা আনিয়াছিল। কৃষ্ণকিশোরকে নিবেদন করিল। কিশোরের অধরে হাসি স্ফুরিত হইতেছে।
“তোমাকে আমি নাওয়াই নাই, খাওয়াই নাই, কয়দিন ভুলিয়া ছিলাম। তুমি আমাকে মনে করাইয়া দিলে না কেন? আমি কঠোরহৃদয় পামর! তোমাকে ভুলিয়া যাই…”
“তোমার নিজেরই নাওয়াখাওয়ার ঠিক নাই, কমল! আমি আর কী বলিব?”
“তুমি মনে করাইতে পারো না?”
“তখন যে তুমি কঠিন কঠিন কথা ভাবিতেছিলে। আমি তো তোমার মনের দুয়ারে গিয়াছিলাম।”
“ডাকিলে না কেন?”
“ডাকিব কী? দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দেখিলাম, পুথির ভিতর একেবারে ডুবিয়া গিয়াছ। আমি যে দাঁড়াইয়া আছি, সেদিকে তোমার হুঁশ নাই। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসিলাম।”
“আচ্ছা, এই যে চর্চা করি, গবেষণা করি, আমার এ সকলই কি অর্থহীন?”
“বা রে! অর্থহীন হইবে কেন? উহা তো আমারই স্বরূপ, আমারই পরমার্থ!”
“তবে এই বেদান্তবেদ্য আত্মা আর এই তুমি—এই দুই কি আলাদা?”
কৃষ্ণকিশোর কিছু বলিল না। শুধু বাঁশিটিতে ফুঁ দিল। তাহার সুরের মূর্ছনা কমলনয়নকে মুহূর্তে আবার কোথায় ভাসাইয়া দিতেছে। ইন্দ্রিয়গ্রাম বাহিরের পৃথিবী হইতে স্ব স্ব স্থানে ফিরিয়া আসিতেছে। মন নিবাত-নিষ্কম্প। অতলে ডুব দিয়াছে।
এইরূপে বহুক্ষণ কাটিয়া গেল। ক্ষুদ্র কক্ষটি হইতে কমলনয়ন বাহির হইয়া আসিল। সযত্নে দ্বারে অর্গল দিল। এখন সে সুরের প্রভাবে টলিতেছে। পা পড়িতেছে, কি পড়িতেছে না। এই সুরের ক্রিয়া এখন চেতনার ভিতর সমস্ত দিনমান চলিতেই থাকিবে। কৃষ্ণকিশোর কি সত্যই এতক্ষণ কথা বলিতেছিল, নাকি ইহা তাহার মনের ভুল? কল্পনা? স্বপ্ন? আবেশ? কেন তাহার বিচার ডুবিয়া যাইতেছে সুরের অগাধ বারিধির ভিতর?
তবু এই সুর কখনো কখনো থামিয়া যায়। বাহিরের সমাজের দাবি আসিয়া, কর্তব্যের আহ্বান আসিয়া সুর ভুলাইয়া দেয়। সেই যে দুইমাস আগে কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে সত্তমণ্ডলী সমাবিষ্ট হইয়াছিল। সেসময় সেই সভার মধ্যে সুর কাটিয়া গিয়াছিল।
ফতেহপুর সিক্রিতে সম্রাট আকবর বলিয়াছিলেন, হিন্দুরা যদি নিজস্ব সৈন্যদল গঠন করে, তিনি তাহাতে সমর্থন ও সাহায্য করিবেন। আক্রমণকারী মুসলমান আততায়ীর উপর হিন্দুরা যদি আত্মরক্ষার নিমিত্ত অস্ত্রপ্রয়োগ করে, তবে তাহাতে হিন্দুদের দোষ ধরা হইবে না। কিন্তু সৈন্যদল গঠন, তাও হিন্দুদের ভিতর, এ কাজ কীরূপে সম্ভব?
হিন্দুরা সচরাচর অস্ত্র ধরে না, এই হইতে তাহাদের প্রতি করুণা করিয়া নিরীহ হিন্দু’ এই অভিধা প্রযুক্ত হয়। তাহাদের মধ্য হইতে সৈন্যদল গঠন?
কমলনয়ন কীরূপে কী করা যায়, আগ্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া, এই লইয়া খুব ভাবিতেছিল। একবার রাজা প্রতাপাদিত্যর কথা মনে পড়িয়াছিল। তিনি প্রয়োজনে সাহায্য করিবেন বলিয়াছিলেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়িয়াছিল, প্রতাপাদিত্য মুঘল-বিরোধী। এই সৈন্যদল গঠন করিয়া পরিশেষে প্রতাপাদিত্য যদি তাহাদের মুঘল বাদশাহর বিরুদ্ধেই চালনা করেন, তাহা হইলে আর তাহারা মুঘল রাজশক্তির আনুকূল্য পাইবে না। এতদ্ব্যতীত, আরও একটি কথা ভাবিবার মতো। সম্রাট আকবর হিন্দুদের মধ্য হইতে সৈন্যদল গঠন করিতে বলিয়াছেন অসহায় হিন্দু জনতাকে প্রতিরক্ষা দিবার নিমিত্ত। কিন্তু প্রতাপাদিত্যকে ইহার নেতৃত্ব দিলে প্রতাপ কেবল প্রতিরক্ষার নিমিত্ত ইহা ব্যবহার করিবেন না। কারণে-অকারণে মুসলমানদের উপর আঘাত হানিবার জন্যই এই সেনাবল ব্যবহার করিবেন। প্রতাপাদিত্যকে এ কার্যের ভার কোনোমতেই দেওয়া চলিবে না। অন্য কী উপায় আছে?
ভাবিতে ভাবিতে সহসা বিদ্যুচ্চমকের মতো নাগা সন্ন্যাসীদের কথা মনে পড়িল ঠিক, ইহারাই তো তাহার প্রধান সহায়ক হইতে পারে!
সন্ন্যাস মানবের ইতিহাসেরই ন্যায় প্রাচীন। সভ্যতার আদিম প্রত্যুষ হইতে মানুষ সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া ঈশ্বরের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। আদিতে সন্ন্যাসীরা নগ্ন থাকিতেন। লজ্জা-ঘৃণা-ভয়ের অতীত হইবার জন্যই সন্ন্যাসীরা কোনো বসন পরিতেন না। পরে প্রায় সকল সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ভিতরেই বস্ত্র পরিবার চল আসিল। শীততাপ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য, সমাজের ভিতর স্বচ্ছন্দে চলাফিরা করিবার নিমিত্ত। কেবল একটি সন্ন্যাসী সম্প্রদায় আজও নগ্নই থাকে। ইহারা নাগা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। নাগা সন্ন্যাসী কোনো বসন পরে না, বাহ্য আচার-আচরণেও বিধি-নিষেধের পার। তাহাদের অগম্য কোনো স্থান নাই, খাদ্য-পেয়ের কোনো বাছবিচার নাই। অন্যদিকে আবার তাহারা কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করে। এই নাগা-সন্ন্যাসীদের হস্তেই যদি অস্ত্র তুলিয়া দেওয়া হয় এবং প্রতিরক্ষার নিমিত্ত শস্ত্রব্যবহারে তাহাদের সুশিক্ষিত করিয়া তুলা যায়, তবে কেমন হয়?
কমলনয়ন কাশীর অন্যান্য মঠের সন্ন্যাসী ও মণ্ডলেশ্বরদের সহিত এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করিয়া দেখিল। সকলেই তাহার সহিত সহমত হইলেন। স্থির হইল, দশাশ্বমেধ ঘাটে নাগা সন্ন্যাসীদের আহ্বান করিয়া এ বিষয়ে আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হইবে।
যথানির্দিষ্ট দিনে দশাশ্বমেধ ঘাটে সন্ন্যাসীসভা বসিয়াছিল। সভার কেন্দ্রে নগ্নদেহ নাগারা ভিড় করিয়া বসিয়াছে। আর তাহাদের চারিপাশে গৈরিকবাসে সুশোভিত তেজঃপুঞ্জকলেবর সন্ন্যাসীরা বসিয়াছেন। প্রথমে জনৈক বৃদ্ধ সন্ন্যাসী অতি মর্মস্পর্শী ভাষায় হিন্দুদের উপর মুসলমান আক্রমণকারিদিগের প্রবল আক্রমণ ও নরমেধের বর্ণনা করিলেন। সকলে নীরব হইয়া শুনিতেছিল। বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর কথা শেষ হইয়া যাইবার পরেও কিছুক্ষণ সভা নিস্তব্ধ হইয়া ছিল। মাথার উপর শুধু এক দল কপোত চক্রাকারে ঘুরিয়া ফিরিতেছিল।
ইহার পর কমলনয়ন কথা শুরু করিল। আগ্রার ফতেহপুর সিক্রিতে গমন, তথায় মুঘল সম্রাট আকবরের দর্শন ইত্যাদি সকল কথা বিস্তারিত বলিবার পর কমলনয়ন বলিল, “আমি মুঘল সম্রাট আকবর সকাশে হিন্দুদের এই নিদারুণভাবে অত্যাচারিত হইবার ঘটনা অনুপুঙ্খ নিবেদন করিলাম। প্রথমে তিনি হিন্দুদের প্রতিরক্ষার নিমিত্ত শাহি সিপাহি নিয়োগ করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাতে তাঁহার মুসলমান সভাসদগণ একমত হন নাই। ফলত, সম্রাট এইমাত্র বলিলেন, হিন্দুরা যদি তাহাদের সম্প্রদায়ের ভিতর প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়িয়া তুলিতে পারে, তবে সেই কার্যে সম্রাটের অনুমোদন, সহায়তা ও সমর্থন সকলই পাওয়া যাইবে।”
জনৈক নাগা তখন বলিল, “বেশ। কিন্তু ইহাতে আমাদের কী ভূমিকা থাকিতে পারে?”
কমলনয়ন বলিল, “সম্রাটের আর্থিক সহায়তায় আমরা আপনাদিগকে অশ্ব ও অস্ত্রাদি দিব। অস্ত্রশিক্ষারও ব্যবস্থা যথাবিধ হইবে। আপনারা অসি, ভল্প প্রভৃতিতে সুসজ্জিত ও অশ্বারূঢ় হইয়া অসহায় হিন্দু সম্প্রদায়কে মুসলমান আক্রমণকারীদের হস্ত হইতে রক্ষা করুন।”
কমলনয়নের এই প্রস্তাবে বেশিরভাগ নাগা সন্ন্যাসীদের আনন্দোত্তেজিত দেখা গেল। যেন তাহাদের যুদ্ধজয় করিতে আহ্বান করা হইয়াছে।
শুধু এক বৃদ্ধ নাগা সন্ন্যাসী বলিলেন, “ইহাতে আমার আপত্তি আছে। আপনারা যেমন সন্ন্যাসী, আমরাও তেমনই সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসী নির্বের—তাঁহার কোনো শত্রু নাই। তবে কেন আমরা হিংসাকর কর্মে প্রবৃত্ত হইব? শুধু তাহাই নহে, সন্ন্যাসীর নিকট সকলেই সমান। কী মুসলিম, কী হিন্দু—সকলেই তাঁহার আত্মার প্রতিচ্ছবি। তবে কেন মুসলমানদিগকে শত্রু ভাবিব?”
কমলনয়ন চিন্তা করিয়া দেখিল, বৃদ্ধ নাগার কথায় যথেষ্ট যুক্তি আছে। কিন্তু এখন আর ফিরিবার উপায় নাই। পারিলে ইহারাই পারিবে। দেখা গেল, অধিকাংশ নাগাই বৃদ্ধের কথা মানিতেছে না। এই সুযোগ। অধিকাংশের এই মতকেই উৎসাহ দিতে হইবে।
সভার কলরোলের উপর গলা তুলিয়া কমলনয়ন অগ্নিবর্ষী ভাষায় বলিতে লাগিল, “কিন্তু এও ভাবিয়া দেখিবেন, ধর্ম হইল আমাদের জননীস্বরূপা। আজ আমাদের সেই সনাতন হিন্দুধর্ম আক্রান্ত। হিন্দুরা দলে দলে ধর্মান্তরিত হইতেছে। উপরন্তু নগরীর পথে পথে প্রকাশ্য দিবালোকে মুসলমান আততায়ীদিগের হস্তে হিন্দুরা সর্বস্বান্ত ও নিহত হইতেছে। ইহা তো আপনাদের মায়ের উপর অত্যাচার! ইহা আপনারা মুখ বুঝিয়া সহিবেন? উপায় থাকা সত্ত্বেও ইহার প্রতিকার করিবেন না?”
সকলে সমস্বরে গর্জন করিয়া উঠিল, “না, না আর সহিব না। কিছুতেই নয়।”
তথাপি সেই বৃদ্ধ নাগা অবিকম্পিত স্বরে বলিলেন, “প্রাজ্ঞ মধুসূদন! ইহাই সদি সত্য হয়, তবে আপনারা কেন অস্ত্রধারণ করিতেছেন না? কেবল নাগা সন্ন্যাসীরাই কেন অস্ত্রধারণ করিবেন?”
কিন্তু ইহার উত্তর কমলনয়নকে দিতে হইল না। কিছু বলিবার পূর্বেই জনৈক তরুণ নাগা বলিয়া উঠিল, “কারণ অন্যান্য সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসিগণ শাস্ত্ৰ লইয়া নিয়ত চর্চা করেন; অস্ত্রশিক্ষার তাঁহাদের অবকাশ নাই। আর আমরা নাগারা সিদ্ধান্ত লইয়া চর্চা করি। ধর্ম আমাদের জননী। আর সেই জননীকে আমরা মায়ের সুযোগ্য সন্তানবৃন্দ—এই নাগারাই রক্ষা করিব। অন্যান্য সন্ন্যাসীরা শাস্ত্রচর্চা করুন, আর আমরা নাগারা শস্ত্রচর্চা করিব।”
বৃদ্ধ নাগা বলিলেন, “ইহাতে আরও রক্তপাত হইতে পারে।”
তরুণ নাগা বৃদ্ধ নাগার উদ্দেশে ব্যঙ্গোক্তি করিল, “আপনি বৃদ্ধ হইয়াছেন, আপনার শরীরে তেজ কমিয়া গিয়াছে, তাই ভয় পাইতেছেন। আর আমরা তরুণ নাগা-সন্ন্যাসীরা অকুতোভয়। আমরা অস্ত্র ধরিতে চাই।”
সভার অন্য সকল নাগা উচ্চৈঃস্বরে সোল্লাসে বলিয়া উঠিল, “হাঁ, হাঁ, আমরা অস্ত্রধারণ করিতে চাই।”
তখন কমলনয়ন সভাস্থ সকলের অনুমতি লইয়া বলিল, “তবে এক কথা। যখন দেখিবেন কোথাও হিন্দুদের উপর মুসলমানরা আগে আঘাত হানিতে উদ্যত হইয়াছে, একমাত্র সেই ক্ষেত্রেই আপনারা অস্ত্রের প্রয়োগ করিতে পারিবেন। প্রতিরক্ষার উপলক্ষ ছাড়া অন্য কোনো কারণে আপনারা মুসলমানদিগের উপর অস্ত্রপ্রয়োগ করিতে পারিবেন না। ইহাতে আপনারা সম্মত কি না?”
নাগারা বলিল, “আমরা সম্মত।”
তখন গৈরিক বাস পরিহিত জনৈক মধ্যবয়স্ক সন্ন্যাসী উঠিয়া দাঁড়াইলেন। বলিলেন, “আমার একটি প্রস্তাব আছে।”
কমলনয়ন বলিল, “বেশ তো, বলুন।”
“দেশীয় রাজাদিগের রাজপুত সৈনিকদের মধ্যে সন্ন্যাসধর্মের উদ্দীপনা ছড়াইয়া দেওয়া হউক। উহারা সন্ন্যাসী হইলে আমরা অতি সহজে সৈনিক-সন্ন্যাসী পাইয়া যাইব।”
সকলেই বলিল, “উত্তম প্রস্তাব।”
শুধু এক অশীতিপর সন্ন্যাসী বলিলেন, “সন্ন্যাস তো স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত। কাহাকেও জোর করিয়া সন্ন্যাসের পথে টানিয়া আনা সমীচীন নহে।”
কমলনয়ন বলিল, “আহা! আমরা তো কেবল অনুপ্রেরণার কথা বলিতেছি। যে এই পথে আসিতে চায়, সে নিজের উদ্যমেই আসিবে। কাহাকেও জোর করার প্রশ্নই নাই।”
কিন্তু সেসকল কথা সভার গুঞ্জন-গর্জনের নিম্নে চাপা পড়িয়া গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হইল।
দশাশ্বমেধ ঘাট হইতে মঠে ফিরিতে ফিরিতে সেইদিন কমলনয়নের হঠাৎ মনে হইয়াছিল, সেই সুরটা…বাঁশির সেই সুমধুর সুর, যাহা তাহার ভিতর অনুক্ষণ বাজিতেছিল, তাহা যেন কখন সভার মধ্যে তাহার অজান্তেই থামিয়া গিয়াছে।