পঁচিশ
পথ দীর্ঘ; টোডরমলের ব্যবস্থাপনায় কমলনয়ন যথাকালে কাশী হইতে একটি ভুলিতে বাহিত হইয়া আগ্রায় উপনীত হইল। সঙ্গে ভুলিবাহক ব্যতীত আরও কয়েকজন রক্ষী টোডরমল নিয়োগ করিয়াছিলেন। টোডরমল স্বয়ং কিছুদিনের মধ্যেই আগ্রায় উপস্থিত হইবেন। ততদিন ফতেহপুর সিক্রির বহির্দেশে এক শিশোদিয়া রাজপুত পরিবারে কমলনয়ন অতিথি হইল। পরিবারটি কৃষিজীবী, বর্ধিষ্ণু হইলেও তাহাদের জীবনধারা অকৃত্রিম। সিক্রির সন্নিবিষ্ট এই জনপদ বস্তুত একটি গ্রাম—চারিপাশে চাষের ক্ষেত সবুজ হইয়া আছে। গ্রামের মধ্য দিয়া একটি পায়ে-চলা পথ, পথেরই একপার্শ্বে শস্যের মরাই, গোশালা, তুলসীমঞ্চ সমেত এই নয়নাভিরাম গৃহস্থলী একটি দীর্ঘ ও জটিল বাক্যের অন্তে যতিচিহ্নের ন্যায় চিত্রার্পিত, সুস্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। এইখানেই কমলনয়নের থাকিবার ব্যবস্থা হইল।
গৃহস্বামী বড়ো অতিথিবৎসল ও ভক্তিপরায়ণ; তাহার গৃহে একটি ক্ষুদ্রাকার ঠাকুরঘর ছিল। সেখানে বংশীধর কৃষ্ণকিশোর নিত্য পূজিত হইতেন। কালো কষ্টিপাথরে গড়া বিগ্রহ অপরূপ—বঙ্কিম ঠাটে ত্রিভঙ্গমুরারি বাঁশি বাজাইতেছেন। চক্ষু দুটি আয়ত ও বর্ষাকালের সান্দ্র মেঘভারের ন্যায় সজল। সর্বোপরি তাঁহার জীবন্ত দৃষ্টি কমলনয়নকে এক অবাঞ্ছিত আবেশে জড়াইয়া ফেলিতে লাগিল। কমলনয়ন যতই মনকে কঠোর করিয়া তুলে, যতই সে নিজেকে তাহার বর্তমান কর্তব্যকর্মের কথা মনে করায়, ততই মন বাঁকেবিহারীর আকর্ষণে বাঁকিয়া বসে— ইহা তো বড়ো মুশকিল হইল! অখণ্ড অদ্বৈতসত্য সমরস, তাহাতেই এ জগৎ আরোপিত মিথ্যা একটা বিভ্রম। সাকার বিগ্রহ, তদর্পিত প্রেমাভক্তি—এসকল নীচের থাকের কথা এবং উহারাও এই স্বপ্নাবিষ্ট জগতের অন্তর্গত একটা মধুর স্বপ্নমাত্র— ইহা কি আর কমলনয়ন জানে না? তবু সব জানিয়াও কেন যে ভুল হইয়া যায়, বিশেষত এই কৃষকপরিবারের এক গৃহকোণে স্থাপিত হরিচন্দন-অনুলিপ্ত শ্যামশিলার মূর্তিটি কেন যে তাহাকে বারবার ডাকিয়া ফিরে, কেন যে বারংবার সমাধির উচ্চ কোটি হইতে লীলাচঞ্চল ধরিত্রীধূসরতায় মনকে টানিয়া নামাইয়া দেয়, অনেক ভাবিয়াও কমলনয়ন তাহা স্থির করিতে পারিল না।
ইতোমধ্যে সংবাদ পাইল, টোডরমল আসিয়া পৌঁছাইয়াছেন। দিবসত্রয় পরে সময় ধার্য হইল; কমলনয়ন বাদশাহের সহিত দেখা করিতে যাইবে। আপাতত কৃষ্ণকিশোরের আকর্ষণ সরাইয়া রাখিয়া আসন্ন কার্য সম্পাদন করিবার নিমিত্ত কমলনয়ন মনকে প্রস্তুত করিতে লাগিল।
যথাদিনে ক্রোশখানেক পথ অতিক্রম করিয়া কমলনয়ন ফতেহপুর সিক্রির বিশাল প্রবেশপথ বুলন্দ দরওয়াজার সমীপে উপস্থিত হইল। দেখিল, টোডরমল স্বয়ং তাহাকে স্বাগত-অভিবাদন জানাইবার জন্য তথায় উপস্থিত। দীর্ঘ সোপান অতিক্রম করিয়া কমলনয়ন ধীরে ধীরে দরওয়াজার নিকটে আসিল। দ্বারপথ অতিক্রম করিয়া এক অতি বিস্তৃত প্রাঙ্গণ পড়িল। বামপার্শ্বে একটি মসজিদ এবং সম্মুখে একটি শ্বেতপাথরের সমাধিগৃহ। টোডরমল বলিলেন, “ইহা সুফি স্লপ্ত হজরত সেলিম চিস্তির খানকা। ইহারই আশীর্বাদে সম্রাট আকবর তাঁহার রাজপুত বেগম মরিয়ম উজ্ জামানী বা হরখা বাই হইতে পুত্রমুখ দর্শন করেন। তাই, সম্ভের নামানুযায়ী নবজাত পুত্রের নাম দেন ‘সেলিম।”
কমলনয়ন মস্তক অবনত করিয়া অজ্ঞাত সুফি সন্তের উদ্দেশে অভিবাদন জানাইল। ইহাতে টোডরমলের মুখমণ্ডলে বিস্ময়ের ভাব জাগিয়া উঠিল। প্রাঙ্গণের উপর দিয়া নমাজি মুসলমানগণ জামা মসজিদের দিকে সারিবদ্ধভাবে যাইতেছে। তাহাদের একপার্শ্বে রাখিয়া প্রাঙ্গণের পূর্বদিকের বৃহৎ শাহি দরওয়াজা দিয়া টোডরমল ও কমলনয়ন আর-একটি পথের উপর আসিয়া পড়িল। এই পথ উন্নত প্রাকার পরিবেষ্টিত শাবিস্তান-ই-ইকবাল বা জেনানার পাশ দিয়া গিয়াছে। টোডরমল বলিলেন, “ইহাই মরিয়ম্ উজ জামানী বা হরখাবাইয়ের প্রাসাদ। ইহারই একপার্শ্বে বাদশাহের ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মাবলম্বী বেগমেরও আবাসস্থল।” তাহার পর আরও উত্তরে আর-এক দ্বার দিয়া প্রবেশ করিয়া বিস্তৃত প্রাঙ্গণ ও শান্তনীর এক হ্রদের তীরে আসিয়া উপস্থিত হওয়া গেল।
“ইহাই অনুপ তালাও, ইহারই তীরে বসিয়া সংগীতসম্রাট মিয়াঁ তানসেন ভারতসম্রাট বাদশাহ আকবরকে সংগীত নিবেদন করেন, আমাদের আরও উত্তরে যাইতে হইবে… ইহাই পাঁচমহল,” টোডরমল বলিতে লাগিলেন। চারিদিক খোলা পাঁচতালা পাঁচমহলের স্থাপত্যে কমলনয়ন মুগ্ধ হইল।
কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “পাঁচমহলের পূর্বদিকে ও বৃহৎ আকারের প্রাসাদটি কী?”
টোডরমল বলিলেন, “উহা দিওয়ান-ই-আম। ওইখানে আমজনতা অর্থাৎ সাধারণ প্রজাদিগের অভাব-অভিযোগ-আর্জি বাদশাহ শ্রবণ ও প্রতিবিধান করেন। আর সম্মুখে উত্তরদিক বরাবর এই প্রাসাদটি দিওয়ান-ই-খাস অর্থাৎ রাজ্যের বিশিষ্ট পদাধিকারী ব্যক্তি বা খাস ব্যক্তিদিগের সহিত বাদশাহের মন্ত্রণালয়। বাদশাহ এখন ওইখানেই আছেন। আমরাও ওইখানেই যাইব।”
চারিপাশে লোক চলিতেছে, স্থানটি নানা রুচি ও বিচিত্র ব্যক্তিবর্গের সমাবেশে সরগরম হইয়া আছে। কমলনয়ন দেখিল, দিওয়ান-ই-খাস একটি বৃহৎ প্রাসাদ। প্রায় বর্গাকার হর্ম্যটি দ্বিতল বিশিষ্ট, ছাদের উপর চারি কোণে চারিটি প্রস্তরনির্মিত বিশালকায় রাজছত্র শোভমান। দ্বিতলে প্রাসাদটি চারিপার্শ্বে অলিন্দ দ্বারা পরিবেষ্টিত। চারিদিকের দেওয়াল ভেদিয়া চারিটি দ্বারপথ রহিয়াছে। উহারই একটি দিয়া টোডরমল কমলনয়নকে লইয়া প্রবেশ করিলেন।
কমলনয়ন দেখিয়া অবাক হইল, দিওয়ান-ই-খাসের একতলায় কেন্দ্রে একটি অলংকৃত স্তম্ভ রহিয়াছে। উহা নানা ধর্মের প্রতীক ও বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করিতেছে। স্তম্ভটি মাটি হইতে উপরে উঠিয়া গিয়াছে। “ইহারই উপর বাদশাহের তখত্ বা সিংহাসন দ্বিতলের সমান উচ্চতায় স্থাপিত রহিয়াছে,” টোডরমল বলিলেন।
কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “কেন্দ্রস্থ বিন্দু, যাহার উপর সম্রাট বসিয়া আছেন বলিতেছেন, তাহা হইতে কক্ষের এই চারি কোণের দিকে প্রসারিত এইগুলি কী?”
“উহারা কেন্দ্র হইতে কক্ষের চারি কোণের সহিত সংযোগ রাখিবার পথ। চলুন, আমরা উপরে যাই, তাহা হইলেই সব বুঝিতে পারিবেন,” টোডরমল উত্তর দিলেন। টোডরমলের সহিত সোপান বাহিয়া দিওয়ান-ই খাসের দ্বিতলে আসিয়া উপস্থিত হইলে উপরিতলের দৃশ্য দেখিয়া কমলনয়নের একেবারে তাক লাগিয়া গেল।
সত্যই কেন্দ্রস্থ স্তম্ভের উপর অলংকৃত আসনে সম্রাট বসিয়া আছেন। সেই আসন হইতে চারিদিকে চারিটি পথ বাহির হইয়া চারি কোণে প্রাসাদের গাত্রে আসিয়া লাগিয়াছে। প্রাসাদগাত্রের ভিতর দিকে চারিটি অলিন্দ কক্ষের দেওয়াল বেষ্টিয়া আছে। সেই অলিন্দের উপর রাজবেশে সুশোভিত আমির-ওমরাহ্ণ, আলখাল্লা পরিহিত শ্বেতশ্মশ্রুধারী মৌলানার দল, ধুতি-উত্তরীয়-আবৃত উপবীতধারী ব্রাহ্মণ পুরোহিতবর্গ, শস্ত্রধারী রক্ষীকুল ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ স্ব-স্ব স্থানে কেহ উপবিষ্ট, কেহ দণ্ডায়মান হইয়া রহিয়াছেন।
টোডরমল অপেক্ষাকৃত নিম্নস্বরে কহিলেন, “কক্ষের চার কোণের দিকে লক্ষ করুন। ইনি খানখানা, উনি বীরবল, ওইদিকে আবুল ফজল এবং দূরতম প্রান্তে ফৈজি দাঁড়াইয়া আছেন। ইঁহারাই সম্রাটের প্রধান চার মন্ত্রী।”
সেইদিকে এক পলক দেখিয়া কমলনয়ন বাদশাহর পানে তাকাইল। উচ্চাসনে বাদশাহ বসিয়া আছেন। পরনে রক্তবর্ণের পায়জামা, গাত্রে পীতবর্ণের একটি ঢিলা চোগা হাঁটু হইতে আরও নিম্নে নামিয়া আসিয়াছে, কটিদেশে মেঘবর্ণের একটি অলংকৃত, রত্নখচিত কটিবন্ধনী বা পটকা। কটিবন্ধনীতে একটি সংক্ষিপ্ত ছুরিকা গ্রন্থিবদ্ধ আছে। শিরোদেশে গৈরিক বর্ণের মুঘলসুলভ পাগড়ি। গণ্ডদেশ ও চিবুক সযত্নে ক্ষৌরিত, ললিত ওষ্ঠাধরের উপর প্রবর্ধিত গুম্ফ। পাগড়ির ভিতর হইতে কর্ণের পাশ দিয়া জুলফি লম্বিত আছে। মুখমণ্ডল চতুষ্কোণ, চক্ষু চাঘতাই বংশের অনুরূপ সূক্ষ্ম, দৃষ্টি শান্তভাবপূর্ণ—স্থিতধী। মুখভাব গভীর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হইলেও কোথাও যেন বালকের ন্যায় প্রফুল্লতাযুক্ত। দক্ষিণহস্ত দিয়া আসনের একটি দণ্ডকে অবলম্বন করিয়া ধরিয়া আছেন, বামহস্ত ক্রোড়ের উপর সংন্যস্ত। বামপদ গোটানো, দক্ষিণপদ আসন হইতে নিম্নবর্তী পাদপীঠের উপর স্থাপিত। চরণদ্বয় মোজ্হ বা জাওরাব আবৃত, ফলত চরণাঙ্গুলিসমূহ দেখা যাইতেছে না। করাঙ্গুলিবল্লী দীর্ঘ ও শিল্পীসুলভ ললিত, যদিও বলদৃপ্ত স্কন্ধ এবং দুই বাহুতে প্রবল পরাক্রান্ত যোদ্ধার অমিতবিক্রম ফুটিয়া বাহির হইতেছে। ইনিই হিন্দুস্থানের মালিক-উল-মুলক মহামতি সম্রাট আকবর।
টোডরমল সম্রাটের নিকটবর্তী হইয়া অভিবাদন জানাইলেন। সম্রাট কেবল দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করিলেন। তাহার পর তাঁহাদের ভিতর কী যেন কথাবার্তা হইতে লাগিল। মনে হইল, কমলনয়নকে লইয়াই কথা হইতেছে। মধ্যে বাদশাহ একবার চক্ষু তুলিয়া কমলনয়নকে দেখিলেন। তাহারই এক মুহূর্ত পরে দুই হাত তুলিয়া কমলনয়নের উদ্দেশে করজোড়ে নমস্কার করিলেন। ইহাতে বাদশাহের বিনয় ও ভিন্নধর্মী হইয়াও হিন্দুদের রীতিনীতি সম্বন্ধে তাঁহার সচেতনতা এবং সহমর্মিতার ভাব কমলনয়নকে মুগ্ধ করিল। কমলনয়নও বাদশাহের উদ্দেশে প্রতিনমস্কার জানাইল। টোডরমল তাহাকে বাদশাহের সমীপে আসিতে অনুরোধ করিলেন।
কথাবার্তা ফারসিতে হইতেছে, টোডরমল তাহা অনুবাদ না করিয়া দিলে কমলনয়ন কিছুই বুঝিতে পারিত না। বাদশাহ বলিলেন: “আপনার অলৌকিক প্রতিভা ও প্রতিপত্তির কথা আমি পূর্বেই শুনিয়াছি। বহু বৎসর পূর্বে আমার বেগম মরিয়ম্ উজ্ জামানীর শূলবেদনা আপনারই আশীর্বাদে সারিয়া যায়। কিন্তু তখন আপনার দর্শন পাইবার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। আজ আপনার দেখা পাইয়া আমি সাতিশয় আহ্লাদিত। আপনি আমাদের সকলের সশ্রদ্ধ অভিবাদন গ্রহণ করুন।”
ইহার পরই উচ্চৈঃস্বরে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগের উদ্দেশে বাদশাহ কী যেন বলিলেন। টোডরমল তর্জমা করিয়া দিলেন। বাদশাহ বলিতেছেন : “এই হিন্দু মুসাফির মধুসুদন সরস্বতী সম্পর্কে এই তো আমার সমুচ্চ ধারণা! এক্ষণে হে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতবর্গ! আপনাদের ইঁহার সম্পর্কে কী ধারণা?”
পণ্ডিতদিগের ভিতর একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি দাঁড়াইয়া সুললিত সংস্কৃত ভাষায় বলিলেন—
“বেত্তি পারং সরস্বত্যাঃ মধুসূদনসরস্বতী।
মধুসূদনসরস্বত্যাঃ পারং বেত্তি সরস্বতী।।
অস্যার্থ : মধুসূদন সরস্বতীর জ্ঞানের সীমানা যে কোথায়, তাহা একমাত্র বিদ্যার দেবী সরস্বতী জানেন। আর সরস্বতীর সীমা কোথায়, তাহা মধুসুদন সরস্বতীই জানেন।”
ইহা শুনিয়া কমলনয়ন বড়ো লজ্জা বোধ করিতে লাগিল। ইহা তো অতিশয়োক্তি; তাহা না হইলে দেবী সরস্বতীর প্রজ্ঞাপারের সংবাদ কে রাখিতে পারে? সে নিজেই বা কী এমন জ্ঞানী? যাহাই হউক; টোডরমল যে বলিয়াছিলেন, কাশীর বাহিরেও সমগ্র উত্তর ভারত ব্যাপিয়া তাহার কীর্তি প্রসারিত হইয়াছে, ইহা সত্যই বটে। কিন্তু ইহাতে তাহার নিজ কৃতিত্ব কিছুই নাই, সকলই গুরুকৃপায় সম্ভব হইয়াছে।
সম্রাট আকবর এইবার বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন : “এই মহাত্মার কীরূপে আমি সেবা করিতে পারি? বর্তমানে তাঁহার এ সভায় আসিবার উদ্দেশ্য কী?”
টোডরমল সম্রাটের কথা তর্জমা করিয়া দিলে কমলনয়ন বলিল, “আমার অত্র আগমনের উদ্দেশ্য টোডরমলের ক্ষত্রিয়ত্ব প্রমাণ করা। টোডরমল টণ্ডনক্ষত্রী পরিবারে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। ইহারা কায়স্থ ও কায়স্থরা ক্ষত্রিয়। ইহার প্রমাণ পুরাণমধ্যে আছে।”
বাদশাহ অনুবাদে সকল কথা শুনিয়া বলিলেন: “বেশ, কী প্রমাণ, তাহা দাখিল করুন।”
কমলনয়ন বলিল, “পুরাকালে ভগবান যখন পরশুরাম অবতার হইয়া আসিয়াছিলেন, তখন ত্রিভুবনকে ক্ষত্রিয়শূন্য করিবার মানসে তিনি কুঠার হস্তে ত্রিলোক ভ্রমণ করিয়াছিলেন। পরশুরামের আক্রমণে বিধ্বস্ত একশ্রেণীর ক্ষত্রিয় রাজা ‘অসিজীবী’ হইতে ‘মসীজীবী’ হইয়া যান। এই মসীজীবী রাজগণই পরবর্তীকলে কায়স্থ পরিচয়ে পরিচিত হন। অতএব, এই কায়স্থরা শূদ্র নহে; তাহারা ব্রাত্য ক্ষত্রিয়। ইহা আমাদিগের পুরাণে সম্যক লিখিত আছে।”
বাদশাহ বলিলেন : “কায়স্থরা যে উচ্চবর্ণের, তাহার আর কোনো প্রমাণ আছে?”
“আছে। প্রত্যেক ব্রাহ্মণ তর্পণ করিতে বসিয়া প্রথমেই যমরাজ ও চিত্রগুপ্তের উদ্দেশে হিন্দুদের সুপ্রাচীন গরুড় পুরাণ হইতে মন্ত্র উচ্চারণ করেন— মায় নমঃ। ধর্মরাজায় নমঃ। …চিত্রগুপ্তায় নমঃ ইত্যাদি। ইহা গরুড় পুরাণের পঞ্চদশোত্তর দ্বিশতসংখ্যক অধ্যায়ে বিন্যস্ত আছে। এই যম, চিত্রগুপ্ত প্রভৃতি কায়স্থদিগের আদিপুরুষরূপে খ্যাত এবং ব্রাহ্মণদিগেরও পূজ্য। তাহা হইলে, কায়স্থ হীনভাবাপন্ন হইল কী প্রকারে?”
বাদশাহ চক্ষু ঈষৎ কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন : “কিন্তু পুরাণে তো প্রচুর কল্পনাও মিশ্রিত থাকে, সেক্ষেত্রে…”
কমলনয়ন উত্তর দিল: “এই বর্ণাশ্রমবিভাগ—ইহাও তো একপ্রকার বিশ্বাস। ইহাকেও কেহ কল্পনা বলিতে পারে। পুরাণে যে পরশুরামের আক্রমণে বিধ্বস্ত অসিজীবীদিগের মসীজীবীতে রূপান্তরিত হইবার কথা আছে, যদি উহা কল্পনাও হয়, তবুও ওইপ্রকার কল্পনার বাস্তব ভিত্তি সমাজের কোনোপ্রকার বিবর্তনকেই সূচিত করিতেছে। কোনো একটা সামাজিক পরিস্থিতিতে একদল ক্ষত্রিয় বাধ্য হইয়াই ভিন্ন পেশা গ্রহণ করিয়াছিলেন। কায়স্থরাই সেই ব্রাত্য ক্ষত্রিয়গোষ্ঠী। এতদ্ব্যতীত টোডরমল যে ক্ষত্রিয়, তাহার সমর্থনে আমি একটি শাস্ত্রীয় সন্দর্ভ প্রস্তুত করিয়াছি এবং তাহাতে কাশীর প্রধান প্রধান ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণ স্বাক্ষর প্রদান করিয়াছেন।”
“উহা কি আপনার সহিত বর্তমানে আছে?” বাদশাহ প্রশ্ন করিলেন।
কমলনয়ন বস্তাভ্যন্তর হইতে তুলট কাগজে লিখিত একটি পুথি টোডরমলের হস্তে প্রদান করিল। টোডরমল উহা বাদশাহের নিকট পেশ করিলেন। বাদশাহ সাহ্লাদে বলিলেন : “বেশ। ইহা আমি আমার সভাপণ্ডিতদিগকে দেখিতে দিব। তাঁহারা ইহার প্রতিপাদ্য যুক্তিযুক্ত কি না বিবেচনা করিবেন। এখন বলুন, আমরা আপনার কী প্রত্যুপকার করিতে পারি?”
কমলনয়ন বলিল, “সম্প্রতি কাশীক্ষেত্রে আমরা এক বিষম বিপদের মধ্য দিয়া যাইতেছি। যখনতখন যত্রতত্র হিন্দু তীর্থযাত্রীদিগের উপর একদল মুসলমান আক্রমণকারী চড়াও হইতেছে। নির্বিচারে হত্যা, লুণ্ঠন, দস্যুতা চলিতেছে। ইহাদের অত্যাচারে গঙ্গার ঘাট বধ্যভূমিতে পরিণত ও নদীর স্রোত রক্তে লাল হইয়া উঠিতেছে। আপনি সম্রাট, আপনি ইহার প্রতিবিধান করুন—এই আমার ইচ্ছা!”
টোডরমল কমলনয়নের বক্তব্য আরও বিস্তার করিয়া ফারসিভাষায় সম্রাটের নিকট নিবেদন করিতে লাগিলেন। শুনিতে শুনিতে বাদশাহর কঠিন মুখমণ্ডল করুণায় দ্রব হইয়া গেল। সকল শুনিয়া আকবর উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন : “বেশ। আজ হইতে আমি কাশীতে শাহি সিপাহীদের প্রেরণ করিব। ইহারা ওই মুসলমান আক্রমণকারীদিগের এরূপ চেষ্টা করিতে দেখিলেই উহাদিগকে কোতল করিবে। বস্তুত, আমার দৃষ্টিতে হিন্দু বা মুসলমান বিবেচ্য নহে, যে অন্যায় করিবে, আমাকে তাহারই প্রতিরোধ করিতে হইবে। কারণ, ইহাই রাজধর্ম!”
এই কথা বলামাত্রই একজন সম্ভ্রান্ত মৌলানা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বাদশাহর উদ্দেশে কদমবুসি করিয়া বলিল: “বন্দেগী হুজৌর। বান্দার গোস্তাকি মাফ করিবেন। আপনি এইরূপ আদেশ প্রদান করিলে আপনার মুসলমান প্রজাগণ আপনার প্রতি বিশ্বাস হারাইবে। তাহারা নিজেদের বিপন্ন বোধ করিবে।”
টোডরমল নিম্নস্বরে কমলনয়নের কানে কানে বলিলেন, “সর্বনাশ হইল! ইনি যে গোঁড়া ধর্মধ্বজী মোল্লা বদায়ুনী। ইঁহারই জ্বালায় বাদশাহর দরবারে আমরা হিন্দুরা বিশেষ জ্বলিতেছি। সম্রাটও ইহার গোঁড়ামিতে অত্যন্ত বিরক্ত।” তাহার পর টোডরমল বাদশাহ ও বদায়ূনীর ভিতর কী কথোপকথন হইতেছে, তাহা তর্জমা করিয়া কমলনয়নকে বুঝাইতে লাগিলেন।
কমলনয়ন দেখিল, মোল্লার সহিত সম্রাটের বিশেষ বাদানুবাদ হইতেছে। মোল্লার সানুনাসিক সুর ক্রমাগত চড়িতেছে এবং বাদশাহের মন্ত্র স্বর ক্রমশ উচ্চগ্রামে আরোহণ করিতেছে। শেষে যেন বাদশাহ বিরক্ত হইয়া বদায়ুনীকে বুঝাইবার চেষ্টা ছাড়িয়া দিলেন। কিছুক্ষণ উভয়পক্ষ নীরব। তাহার পর বাদশাহ গম্ভীর কণ্ঠে বলিলেন: “ঠিক আছে। আমি শাহি সিপাহী প্রেরণ করিব না। কিন্তু আপনারা হিন্দুরা যদি আপনাদিগের সম্প্রদায়মধ্যে একদল সশস্ত্র সৈন্য গঠন করিতে পারেন এবং সেই হিন্দু সৈন্যদল যদি এইসব অরাজকতা সৃষ্টিকারী মোল্লাদিগকে শাসন করে, আমি তাহা সমৰ্থন করিব। এই সৈন্যদল গঠন করিবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আমি প্রাথমিকভাবে আমার কোষাগার হইতে প্রেরণ করিব। আশা করি, ইহাতে কাহারও কোনো আপত্তি হইবে না।”
টোডরমলের নিকট বাদশাহর এই কথার অনুবাদ শুনিয়া কমলনয়ন বিস্মিত হইয়া গেল। হিন্দু সৈন্যদল গঠন? ইহা কি সম্ভব? কিন্তু সম্ভব করিতেই হইবে।
বেলা পড়িয়া আসিলে সভাভঙ্গ হইল। কমলনয়ন টোডরমল ও বাদশাহের নিকট হইতে বিদায় লইল। টোডরমল কমলনয়নকে বুলন্দ দরওয়াজা পর্যন্ত আগাইয়া দিলেন। আসিতে আসিতে কমলনয়ন দেখিল, একটি ময়ূর শাবিস্তান-ই-ইকবাল বা জেনানার উন্মুক্ত ছাদের উপর ইতিউতি ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহার পায়ে বেড়ি নাই, তথাপি এই জেনানামহল হইতে সে আর কোথাও যায় না।
কমলনয়ন পুনরায় এক ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া শিশোদিয়া রাজপুতগৃহে ফিরিয়া আসিল। সন্ধ্যা হইয়াছে। গৃহস্থের ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলিয়াছে। হস্তমুখ প্রক্ষালন করিয়া কমলনয়ন ঠাকুরঘরে আসিয়া বসিল। প্রদীপের শিখায় কৃষ্ণকিশোরের নয়নকোণে হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছে।
সেইদিন রাত্রে খুব ঝড়বৃষ্টি হইল। প্রভাতবেলায় বৃষ্টি ধরিয়াছে, এমন সময়ে গৃহস্বামী কমলনয়নের নিকটে আসিয়া বলিল, “আপনাকে আমার কিছু বলিবার আছে।”
কমলনয়ন বলিল, “বলুন। কী হইয়াছে?”
“কল্য রাত্রিতে তিনবার উপর্যুপরি কৃষ্ণকিশোরকে স্বপ্নে দেখিলাম। কৃষ্ণ আসিয়াছে, বলিতেছে….”
“কী বলিতেছে?”
“বলিতেছে, সন্ন্যাসীর সঙ্গে কাশী যাইব। তুমি বাধা দিও না,” গৃহস্বামীর চক্ষু সজল হইয়া উঠিল।
“সে কী? ইহা আপনার চিত্তবিভ্রম নয় তো?”
“না, চিত্তবিভ্রম নহে। স্পষ্ট দেখিলাম যে! আমি বলিলাম, এতদিন তোমাকে লইয়া আছি। তোমার পূজা না করিয়া জলগ্রহণ করি না। এক্ষণে কী করিব?”
“মুরলীধর কী বলিল?”
“বলিল, শালগ্রামে আমার পূজা করিও। তাহাতেই হইবে। আমি সন্ন্যাসীর সহিত কাশী যাইব। তুমি বাধা দিও না…”
কমলনয়ন কিছু না-বলিয়া গম্ভীর ভাব ধারণ করিল। সে নির্মুক্ত সন্ন্যাসী। তাহার কি এই কৃষ্ণ বুকে লইয়া ঘুরিয়া বেড়ানো সম্ভব? এক নামরূপাতীত ব্রহ্মই তাহার স্বরূপ! এসব ভাবখেয়াল করিবার অবকাশ আছে? এসব কীসের ভিতর সে জড়াইয়া পড়িতেছে!
কমলনয়নের মুখভাব দেখিয়া গৃহস্বামী ভীত মনে আত্মসংবরণ করিল। কিছু পরে সে চলিয়া গেল।
সেদিন রাত্রেও ঘন বরিষণ নামিল। কমলনয়ন প্রাকৃতজনের ন্যায় সুখে নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিল। নিদ্রার ভিতরও যেন বৃষ্টি পড়িতেছে। শাওন মেঘ আকাশ আকুল করিয়া আসিয়াছে। সজল বাতাসে শিহরিত কদম্ববনে আলোড়ন উঠিয়াছে। পথ পিছল। বিদ্যুতের আলোয় সেই সংকীর্ণ পথ বাহিয়া সে পা টিপিয়া টিপিয়া কোথায় যেন চলিতেছে। যেখানে যেখানে পা ফেলিতেছে মাটি ফুঁড়িয়া এক-একটি নাগকেশরের ফুল ফুটিয়া উঠিতেছে… তাহার পর কী এক ময়ূরকণ্ঠী স্বপ্ন আসিয়া দেখা দিল। কে এক শ্যামল কিশোর কমলনয়নের গাত্রে তাহার কচি কচি হাত বুলাইয়া চক্ষু ঘুরাইয়া বলিতেছে, “আমাকে লইবে না? আমি যে তোমার সঙ্গে কাশী যাইব। তোমার সঙ্গে থাকিব। আমাকে ফিরাইয়া দিও না।”
কমলনয়নের মনে হইল, এসব তাহার চিত্তবিকার নয়তো! এসব সে কী দেখিতেছে?
কমলনয়ন বলিয়া উঠিল, “আমি মায়াবাদী কঠোর সন্ন্যাসী। আমার সঙ্গে যাইবে কেন?”
কিশোর কহিল, “ও কমল! তোমার কঠোরভাব যে আমার বড়ো ভালো লাগে। তুমি যত বাধা দাও, আমার তত বাধা ভাঙিতে ইচ্ছা করে।”
কমলনয়ন বলিল, “কাশী গিয়া তুমি কী করিবে?”
“তোমাকে বাঁশি শুনাইব। সুর দিয়া তোমাকে পাগল করিব। প্রেম দিয়া তোমার মাথা খাইব। আমার গায়ে হাত দিয়া বলো, আমাকে লইয়া যাইবে তো?”
“কিন্তু আমি তো তোমাকে চাহি নাই!”
“চাহিয়াছিলে…সেই যে তোমার কিশোরকাল…উনসিয়া হইতে পাগলের মতো নবদ্বীপে আসিয়াছিলে…মনে নাই?”
কমলনয়ন ধড়মড় করিয়া শয্যার উপর উঠিয়া বসিল। দেখিল প্রভাত হইয়া গিয়াছে… বাতায়নপথে নুতন দিবসের আলোক ….