চব্বিশ
শেষ রাত্রির দিকে চন্দ্রোদয় হইবে। এখন দ্বিতীয় প্রহরের নৈশ তমসা ও স্তব্ধতা নগরীর শ্রান্ত শিরা-উপশিরায় ছড়াইয়া পড়িয়াছে। ইহারই ভিতর শিষ্য বলভদ্রকে অনুসরণ করিয়া কমলনয়ন চলিতেছিল। কোথায় যাইতেছে, জানা নাই। পথের দুই পার্শ্ব হইতে সুপ্তপ্রায় হর্ম্যসমূহের বাতায়ন বাহিয়া বিকিরিত দীপরশ্মি আসিয়া মাৰ্গটিকে আলোআঁধারে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে।
হাঁটিতে হাঁটিতে একটি সংকীর্ণ মহল্লায় আসিয়া পড়িল। দেহলীসমূহের গঠন দেখিয়া মনে হয়, এ স্থান মুসলমান অধ্যুষিত। নগরীর এই অংশ রাত্রিকালে হিন্দুদের পক্ষে বিপদসংকুল। বলভদ্র তাহাকে এ কোথায় লইয়া আসিল? সংকীর্ণ গলির পার্শ্বস্থ একটি অন্ধকার হর্মের ভিতর হইতে কে যেন মন্দ্রস্বরে অজানা কোনো নৈশ রাগে আলাপ করিতেছে। নগরীর নির্জনতা মধ্যরাত্রির সেই সুরে গম্ভীর হইয়া উঠিয়াছে।
স্থানটি অতিক্রম করিয়া আসিয়া সম্মুখে একটি নিস্তব্ধ সুবৃহৎ প্রাসাদের সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত প্রশস্ত প্রবেশপথ পড়িল। দরওয়াজার স্থাপত্যে মুঘল শৈলীর স্পষ্ট প্রভাব। কপাট বন্ধ ছিল, দ্বারের উপর একটি উগ্র কণ্ঠস্বর হাঁকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সং-কে-ত?”
বলভদ্র উত্তর দিল, “ও-য়া-জি-র!”
সঙ্গে সঙ্গে সশব্দে দরওয়াজা খুলিয়া গেল। সম্মুখে একটা প্রশস্ত চবুতরা অন্ধকারের ভিতর জড়ীভূত হইয়া পড়িয়া আছে। চতুষ্পার্শ্বে দীর্ঘ বারান্দাযুক্ত নির্জন প্রাসাদ, তাহার উপর বিশাল আকারের গম্বুজ তমসাবৃত গগনে মাথা তুলিয়াছে, বারান্দার কোণ বরাবর সুদৃশ্য মিনার উঠিয়া গিয়াছে। অলিন্দে ছাদ হইতে মধ্যে মধ্যে শীর্ণ লৌহময় শৃঙ্খল নামিয়া আসিয়া ক্ষুদ্রাকার দীপাধার ধরিয়া আছে, তাহাতে স্তিমিত প্রদীপের আলোক বারান্দাটিকে স্বপ্নময় পরিরাজ্য করিয়া রাখিয়াছে। সমস্ত বারান্দা পারস্য গালিচায় আবৃত। বারান্দার পার্শ্বে একের পর এক দালান, ঘরগুলির দুয়ার বন্ধ, কপাটের উপর চিত্রিত কাচের জানালা। প্রাসাদের এক ভৃত্য ও বলভদ্র সম্মুখে চলিতেছিল। তাহাদিগকে অনুসরণ করিয়া কমলনয়ন সেই অলিন্দপথে কক্ষ হইতে কক্ষান্তর, কত অপরূপ গম্বুজ ও খিলান পার হইয়া গেল। ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দা রাতের বাতাসে কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে।
অনেক পথ অতিক্রম করিয়া কমলনয়ন দেখিল, বারান্দাঘেরা প্রাঙ্গণের ভিতর একটি সুন্দর মন্দির। চারিপাশের জমকালো ঐস্লামিক স্থাপত্যকলার ভিতর মন্দিরটিই ব্যতিক্রম। উহা রাজপুত শৈলীর—–সংকীর্ণ গর্ভগৃহ, বিমান, গর্ভগৃহের উপর বর্তুলাকার শিখরদেশ, তাহাতে স্বর্ণকলসের উপর আমলক বা গোলাকার প্রস্তরখণ্ড। মন্দিরগাত্রে শঙ্খ, পদ্ম প্রভৃতি অঙ্কিত। সম্মুখে একটি সভামণ্ডপ, যাহাতে ভক্তবৃন্দ ধ্যান, উপাসনা কিংবা শাস্ত্রালোচনা উপলক্ষে সমবেত হইতে পারে। তাহার বড়ো অদ্ভুত লাগিল এবং এ প্রাসাদের অধিপতির সম্পর্কে কৌতূহল বাড়িয়াই চলিল।
ভৃত্য এক প্রশস্ত কক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলভদ্র ও কমলনয়নকে ভিতরে প্রবেশ করিতে বলিল। তাহারা প্রবিষ্ট হইয়া দেখিল, দেওয়ালে বহু আলেখ্য লম্বিত হইয়া আছে, কক্ষটি অতি সুন্দররূপে সজ্জীকৃত ও বহুমূল্য গালিচায় কুট্টিম আবৃত, কক্ষের কেন্দ্রে একটি উলম্ব দীপদণ্ডের উপর প্রদীপ্ত দীপাধার ও তাহারই একপার্শ্বে একটি চিত্রিত উচ্চাসনে গদির উপর এক প্রৌঢ় ব্যক্তি বসিয়া চিন্তিত মুখে আলবোলা সহযোগে তাম্রকূট সেবন করিতেছেন। কমলনয়ন ও বলভদ্রকে দেখিয়া প্রৌঢ় ব্যক্তিটি শশব্যস্ত হইয়া উঠিয়া আলবোলার নল ফেলিয়া দিয়া তাহাদিগকে অন্য দিকের বহুমূল্য আসনের উপর বসাইলেন।
কমলনয়ন প্রৌঢ়কে উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। শিরোদেশে রাজপুতদিগের ন্যায় পাগড়ি ও ললাটে বিভূতিচন্দনের ত্রিপুণ্ড্রক, অথচ পরনে হিন্দুসুলভ ধুতি- মেরজাই নাই, পরিবর্তে বরজু পায়জামা পরিয়া তাহার উপর চোগা ও চরণে মোহ্ ধারণ করিয়াছেন। চিন্তামগ্ন মুখমণ্ডলের প্রতিটি রেখা কঠিন ও গভীর, বহু অভিজ্ঞতায় দগ্ধ না হইলে এমন মুখ হয় না। চক্ষে দক্ষ রাজনীতিজ্ঞের স্থিরকাঠিন্যের পাশাপাশি রণকুশল সেনানায়কের আক্রমণাত্মক ভাব। উভয়পক্ষে অভিবাদন-বিনিময় হইবার পর গৃহস্বামীই প্রথম মুখ খুলিলেন, বিনীত স্বরে বলিলেন, “আমি মুঘল সম্রাট আকবরের ওয়াকালত মুস্তাকিল বা দীওয়ান টোডরমল। আপনার ন্যায় মহামনীষীর নিকট স্বয়ং উপস্থিত না হইয়া আপনার শিষ্যের মুখে খবর দিয়া আপনাকে এখানে টানিয়া আনিয়াছি, এজন্য আমার অপরাধ ক্ষমা করিবেন। কিন্তু আমার অন্য উপায় ছিল না। খুন হইয়া যাইতাম!”
কমলনয়ন বলিল, “আমি তো ইহা ভালো বুঝিতে পারিতেছি না। মহাশয় বিস্তার করিয়া বলুন!”
টোডরমল বলিলেন, “তাহা হইলে পূর্বকথা কহিতে হয়। আওধের সীতাপুরে এক হিন্দু টণ্ডনক্ষত্রী পরিবারে আমার জন্ম।”
কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “সাক্ষাৎ সীতাপুরেই —?”
“না, সীতাপুর সরকারের লহরপুর গ্রামে। শৈশবেই আমার পিতৃবিয়োগ হয়। বিধবা মাতা অতি কষ্ট স্বীকার করিয়া আমাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন। কৈশোরেই আমি জামিনী ভাখা অর্থাৎ ফারসি শিখিয়া লই। ইহাই আমার কর্মসংস্থানের পথ খুলিয়া দেয়।”
“সীতাপুরেই কর্মজীবন আরম্ভ করেন?”
“প্রথমে সীতাপুরে একটা মামুলি দফ্তরে মুন্সীর কাজ করিতাম। পরে আমির মুজফ্ফর খাঁর দফতরে যোগদান করি। প্রথমে শেরশাহের পদানুগ ছিলাম ঠিকই, কিন্তু পরে মুঘল সম্রাটের দফ্তরে প্রবেশ করি।”
“দপ্তরের একজন সাধারণ মুন্সীর কাজ হইতে সম্রাটের ওয়াকলত মুস্তাকিলের পদে উপনীত হওয়া তো সহজ কথা নয়।” বলভদ্র বলিয়া উঠিল।
“সহজ ছিলও না,” টোডরমল বলিলেন, “মুন্সীর কর্মের পাশাপাশি চিতোর, রণথৌম্ভর ও সুরাটের যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করি। তাহাতে খুশি হইয়া সম্রাট আমাকে গুজরাতের দফতর ও রাজস্বের বন্দোবস্ত করার জন্য প্রেরণ করেন। এই কাজেও আমি বিশেষভাবে সফল হই। তাহারই পরবৎসর আমি বিহারে প্রেরিত হই। সেখানে তখন পাঠানদের সহিত বাদশার যুদ্ধ চলিতেছিল। সিপাহশালার ছিলেন খানখানা মুনায়ম্ খাঁ।” বলিতে বলিতে টোডরমল যেন স্মৃতির ভিতর সহসা তলাইয়া গেলেন।
তাঁহার চেতনা বাহিরে টানিয়া আনিবার উদ্দেশ্যে কিছুক্ষণ পর কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারে কী হইল?”
টোডরমল যেন স্মৃতিতন্দ্রা হইতে জাগিয়া উঠিলেন। ধীরে ধীরে বলিলেন, “সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখি, তুর্কি সেনাপতিরা যুদ্ধ অপেক্ষা আরাম করারই পক্ষপাতী। আমি তাঁহাদিগকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করিতে চাহিলাম। কিন্তু তাঁহারা অভিজ্ঞ ও প্রবীণ। আমার ন্যায় এক কলমপেষা অখ্যাত মুৎসদ্দীর খবরদারি কি আর পছন্দ করেন? কিন্তু আমি হাল ছাড়িলাম না। যুদ্ধ হইল। যুদ্ধে পরাস্ত হইয়া পাঠানসৈন্য পলায়ন করিতে বাধ্য হইল। পাটনায় বাদশাহর পতাকা উড়িল।”
বলভদ্র প্রশ্ন করিল, “তাহা হইলে সমস্যা তো মিটিয়া গেল, না কি?”
টোডরমল দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “সমস্যা কি আর অত সহজে মিটে? বিহার বাংলার অধিপতি, পাঠানদের সর্বাধিক শক্তিশালী রণনায়ক দাউদ খাঁ হার স্বীকার করিবার পাত্র ছিলেন না। তাঁহার পরিবারবর্গকে রোহটাস দুর্গে রাখিয়া তিনি সসৈন্যে বাদশাহী সেনার উপর এককালে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন। সে এক ভয়ংকর প্রাণঘাতী যুদ্ধ। যুদ্ধের পরিণামে হার হইবে ভাবিয়া মুঘল সেনাপতি স্বয়ং মুনায়ম্ খাঁ পর্যন্ত হতোদ্যম হইয়া পড়িলেন। একবার তো শত্রুসৈন্য রটাইয়া দিল, মুনায়ম্ খাঁর প্রাণবধ হইয়াছে।”
কমলনয়ন বলিয়া উঠিল, “সে কী! এরূপ হইলে তো মুঘল সৈন্যের মনোবল ভাঙিয়া যাইবার কথা…” যুদ্ধের উত্তেজক বর্ণনায় সে মগ্ন হইয়া গিয়াছে।
“ঠিক তাহাই হইয়াছিল, মুঘল সৈন্য নিরাশ হইয়া পলায়ন করিতেছিল, আমি তাহাদের ফিরাইলাম। বলিলাম, খানখানা না-থাকিল তো কী হইল? আমরা মহামান্য সম্রাট পরাক্রমশালী আকবরের সৈন্য; তাঁহারই নির্দেশে যুদ্ধ করিতেছি। এই কথা বলায় সংঘর্ষ অক্ষুণ্ণ রহিল। সেনাপতি গুজর খাঁ নিহত হইলেন। পাঠান সৈন্য পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।”
“তাহার পর?”
“এতক্ষণে দাউদ খাঁ সন্ধি করিতে চাহিলেন। মুনায়ম্ খাঁ সন্ধির পক্ষে মত দিলেন। আমি কিন্তু সন্ধির বিপক্ষতা করি। আমি কহিলাম, শত্রুর শিকড় কাটা পড়িয়াছে, আর এক আঘাত দিইলেই একেবারে নির্মূল হইয়া যাইবে। যুদ্ধ চলুক। কিন্তু কেহ আমার কথায় কর্ণপাতও করিল না। হতাশ হইয়া আমি বাদশাহের নির্দেশে দিল্লি চলিয়া আসিলাম। আমার রণনিপুণতায় মুগ্ধ হইয়া বাদশাহ আমাকে ফতেহপুর সিক্রিতে প্রত্যাবর্তন করামাত্রই ওয়াকালত মুস্তাকিল-এর পদ প্রদান করিয়া রাজ্যের অর্থমন্ত্রী পদে নিয়োগ করিয়া দিলেন। সেই হইতে এই পদেই আছি।”
“কিন্তু সমস্যার কথা কী বলিতেছিলেন?”
“যেদিন হইতে এই ওয়াকালত মুস্তাকিল পদে বসিয়াছি, সেই দিন হইতেই সমস্যার সূত্রপাত। প্রথমত, আমাকে এত দায়িত্বপূর্ণ পদ দেওয়াতে মুসলমান আমির- ওমরাহের দল অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হইলেন। তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, একজন হিন্দুকে মুসলমানদের উপর বসাইয়া এত অধিক ক্ষমতা দেওয়া হইয়াছে। কথাটা একদিন বাদশাহের কানে উঠিল। ইহার উত্তরে মহামতি আকবর যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা ফতেপুর সিক্রিতে বিখ্যাত হইয়া আছে।”
“কী বলিয়াছিলেন?”
“বাদশাহ বলিয়াছিলেন, হর কুদাম শুমা দর্-সরকারে-খুদ হিন্দুয়ে দারদ্! আগার মাহম হিন্দুয়ে দাস্তাহ্ ওয়াশীম, চিরা আজ-ও-বদ বায়দ বুদ!”
“ইহার অর্থ?”
“আপনারা প্রতেকেই আপনাদের কারবারে হিন্দু মুন্সী রাখেন। আর আমি যদি হিন্দু রাখি, তাহাতে মন্দ কী হইবে?”
“সম্রাট সমদর্শী!” বলভদ্র উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল।
“সত্যই সমদর্শী। কিন্তু সম্রাটকে লইয়া তো কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা হইল তাঁহার বংশবদ ভৃত্যদের লইয়া!” টোডরমল পুনরায় চিন্তাসমুদ্রে ডুবিয়া গেলেন।
“তথাপি সম্রাট যেখানে আপনার পক্ষাবলম্বন করিয়াছে, সেস্থলে অধস্তনবৃন্দ আর কী ক্ষতি করিতে পারে?”
“কী ক্ষতি করিতে পারে নয়, ক্ষতি করিয়াছে। শুধু ক্ষতি করিয়াছে নহে, ভয়ংকররূপে ক্ষতি করিতেছে। আমি জীবনে কখনও এইরূপ অপমানিত হই নাই।”
“কী হইয়াছে?”
“কী আর, মুসলমানরা চুপ করিল তো রক্ষণশীল ব্রাহ্মণগণ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিতে লাগিল। আমার দফ্তরে বহু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রহিয়াছেন। তাঁহারা বাদশাহের নিকট নালিশ করিয়াছেন, আমি নাকি শূদ্র। দফ্তরে আসিয়া প্রত্যহ প্রথমেই তাঁহাদের আমার ন্যায় এক শূদ্রের মুখদর্শন করিতে হইতেছে। ইহাতে নাকি তাঁহাদের জাত-ধর্ম সব রসাতলে গেল!”
কমলনয়ন বলিল, “কিন্তু টণ্ডনক্ষত্রীরা কি শূদ্র? তাঁহাদের কায়স্থ জাতিভুক্ত জানিতাম।”
“আমি সে-কথা বলিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, আমি কায়স্থ। কায়স্থরা ক্ষত্রিয়, শূদ্র নহে। কিন্তু তাঁহারা আমার যুক্তিতে কর্ণপাতও করেন নাই। স্বয়ং সম্রাট পর্যন্ত এই ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদিগকে বুঝাইতে পারেন নাই। শেষে আমাকে বলিলেন, আমি যদি কোনো ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের দ্বারা ইহা শাস্ত্রপ্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ করিতে পারি যে, কায়স্থরা ক্ষত্রিয়, তাহা হইলে তিনি আমাকে এই উচ্চপদে বহাল রাখিবেন। অন্যথায় ব্রাহ্মণদিগের চাপে পড়িয়া আমাকে অন্য কোনো পদে নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইবেন। এই প্রৌঢ় বয়সে ইহা আমার এক সংকটে পরিণত হইয়াছে।”
তাহার পর টোডরমল আত্মগত স্বরে বলিতে লাগিলেন, “শূদ্র বলিয়া বিবেচিত হইয়াই আমি যে দুঃখসাগরে ভাসিতেছি, তাহা নহে। শূদ্র হইয়া জন্মাইলেই বা কী ক্ষতি হইত? দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম, মদায়ত্তং হি পৌরূষম্! আমার কর্মই আমার পরিচয়, কোন্ বংশে জন্মিয়াছি, তাহা আমার পরিচয় নহে। কিন্তু ইহা যে আত্মসম্মানের প্রশ্ন! ব্রাহ্মণ পারিষদদিগের অন্যায় অভিযোগের ফলে আমি পদচ্যুত হইব, ইহা আমি কোনোমতেই মানিয়া লইতে পারিতেছি না।”
“সমস্যার সামাধান কিছু খুঁজিয়া পাইলেন? কায়স্থ জাতি যে শূদ্র নহে, ক্ষত্রিয়- ইহার কিছু শাস্ত্রপ্রমাণ মিলিল?” কমলনয়ন প্রশ্ন করিল।
“সেই উদ্দেশ্যেই আমি গোপনে বারাণসী আসিয়াছি এবং বাদশাহ-নির্মিত এই প্রাসাদে সঙ্গুপ্ত হইয়া আছি। কোনো-না-কোনো উদারহৃদয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সন্ধান করিতেছি, যিনি ইহার মীমাংসা করিয়া দিবেন। কিন্তু এখানেও আমার চলাফিরা বিপজ্জনক। ইহারই মধ্যে একবার গুপ্তঘাতকের কবলে পড়িয়াছিলাম। সঙ্গে অস্ত্র ছিল, তাই বাঁচিয়া ফিরিয়াছি।”
“এই কারণেই কি আপনি আমাকে গোপনে বার্তা প্রেরণ করিয়া ডাকাইয়া আনিয়াছেন?” কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল।
“ঠিক তাহাই,” টোডরমল বলিয়া উঠিলেন, “আপনি যদি আমার দাবি শাস্ত্রসমর্থিত কি না বলিতে পারেন…. কায়স্থরা যে ক্ষত্রিয়, শূদ্র নহে ইহার পক্ষে কোনো শাস্ত্ৰ প্ৰমাণ আছে?”
“অবশ্য শাস্ত্রপ্রমাণ আছে। ইহা আমি দেখাইয়া দিতে পারিব।”
টোডরমল তৎক্ষণাৎ আসন হইতে উঠিয়া আসিয়া কমলনয়নের দুটি হাত ধরিয়া বলিলেন, “তাহা যদি করিতে পারেন, তবে আমি আপনার নিকটে চিরকৃতজ্ঞ থাকিব। আপনি আমার সহিত আগ্রা চলুন। সম্রাটের নিকটে আপনি আপনার বক্তব্য সপ্রমাণ করিবেন। যাহাতে আপনার যাত্রা সুখকর হয়, আমি তাহার সব ব্যবস্থা, সুবন্দোবস্ত করিব।”
“আগ্রা?”
“হাঁ, ফতেহপুর সিক্রি। বর্তমানে সেইখানেই রাজধানী।”
“কিন্তু সম্রাট আমার ন্যায় অর্বাচীনের কথা শুনিবেন কেন?”
কমলনয়নের এই কথা শুনিয়া টোডরমল হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আপনি অর্বাচীন? দীর্ঘকাল কাশীর বাহিরে যান নাই বলিয়া আপনি জানেন না, আপনার কী বিপুল প্রভাব সমগ্র উত্তর ভারত ব্যাপিয়া বিস্তৃত হইয়াছে। আপনার রচিত ‘গূঢ়ার্থদীপিকা’ শাস্ত্রসেবীদিগের ভিতর অহোরাত্র আলোচিত হইতেছে। আপনার ‘অদ্বৈতসিদ্ধি’ পাঠ না করিয়া কেহ আজ আর পণ্ডিত অভিধায় পরিচিত হইতে পারে না। তাহা ব্যতীত, সম্রাট আকবর আপনার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও কৃতজ্ঞ!”
“কৃতজ্ঞ? আমার প্রতি? কীরূপে?” কমলনয়ন অবাক হইয়া প্রশ্ন করিল।
“কেন? যুবাবয়সেই আপনি তো সম্রাট আকবরের বেগম হরখাবাই বা মরিয়ম্- উজ-জামানির দীর্ঘস্থায়ী শূলপীড়া আরোগ্য করিয়া দিয়াছিলেন। সেই হইতেই সম্রাট আপনাকে অতি মান্য করেন।”
কমলনয়ন কী যেন আকাশ-পাতাল ভাবিতেছিল। টোডরমল অতি দ্রুত বলিয়া উঠিলেন, “আর ভাবিবেন না। আপনি আগ্রা চলুন। আমি সব ব্যবস্থা করিয়া দিব।” কমলনয়ন চিন্তাগত স্বরে ধীরে ধীরে বলিল, “বেশ! আমি যাইব। কিন্তু এই কার্যের বিনিময়ে আপনাকেও আমাদের নিমিত্ত কিছু করিতে হইবে।”
টোডরমল বলিলেন, “বলুন, কী প্রত্যুপকার করিতে পারি?”
বলভদ্র যেন এই মুহূর্তেরই অপেক্ষা করিতেছিল। সে সাগ্রহে কমলনয়নের উত্তরের জন্য তাকাইয়া রহিল।
কমলনয়ন বলিল, “অসহায় হিন্দু তীর্থযাত্রীরা বারাণসীতে যখন তখন যত্রতত্র মুসলমান সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হইতেছে। নির্বিচারে লুণ্ঠন ও নির্মম হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হইতেছে। আপনাদের ইহা প্রতিবিধান করিতে হইবে। হিন্দুদিগকে সুরক্ষা দিইতে হইবে।”
“বেশ তো! আপনি বাদশাহর সকাশে ইহা নিবেদন করিবেন। আমিও আপনার সহায়ক হইব। বাদশাহ নিশ্চয়ই ইহার সুষ্ঠু সমাধান করিতে পারিবেন।”
কমলনয়ন কহিল, “উত্তম! আমি আগ্রা যাইতে প্রস্তুত। আমার এদিককার কাজ সারিতে এক পক্ষকাল লাগিবে। তাহার পরই আমি যাত্রা করিতে পারিব।”
টোডরমল সম্মত হইলেন। কমলনয়ন ও বলভদ্র টোডরমলকে বিদায়-অভিবাদন জানাইয়া বাহির হইয়া আসিল।
ফিরিতে ফিরিতে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া কমলনয়ন ভাবিতেছিল, জীবনের এ আবার কোন্ অসমাপ্ত অধ্যায় রচিত হইতে চলিল? সুদূর ওই নিঃশব্দ তমসাবৃত গগন কি ইহার উত্তর জানে?