ছায়াচরাচর – ১১

এগারো 

নবদ্বীপে বিষ্ণু দামোদরের মন্দিরে সন্ধ্যারতি হইতেছিল। শঙ্খ, ঘণ্টা ও অন্যান্য তালবাদ্য সহকারে দীর্ঘক্ষণ ধরিয়া অগণিত জনতা ঠাকুরের নিকট তাহাদের প্রাণের আর্তি নিবেদন করিতেছিল। খুব ভিড় হইয়াছে। সেই ভিড়ের ভিতর একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া কমলনয়ন আরতি দেখিতেছিল। আরতির পর সংকীর্তন আরম্ভ হইল। খোল, খঞ্জনী, কাঁসরের মধুর ধ্বনির ভিতর সকলে আনন্দিত চিত্তে গীত, নৃত্য করিতে লাগিল। সে-আনন্দের প্রবাহ কমলনয়নের হৃদয়কেও প্লাবিত করিল। দুই চক্ষু দিয়া ধারাশ্রাবণ নামিল। 

কমলনয়নের প্রকৃতিটি বড়ো অদ্ভুত। তাহার মস্তিষ্ককে কর্কশ ন্যায়শাস্ত্র অধিকার করিয়া রাখিয়াছে, তথাপি তাহার হৃদয় প্রেমাভক্তির আলয়। বিশেষত, কীর্তনের এই করুণ সুর তাহার অন্তরে প্রবল যন্ত্রণার জন্ম দেয়। সে-যন্ত্রণা যত তীব্র, ততই মধুর। জীবনে তাহার যাঁহাকে পাওয়া হইল না, সেই নরদেবতার চরণে প্রাণ যেন নিজেকে বিকাইতে চাহিতেছে। কী করিয়া পাইবে, কোনো উপায় নাই। তিনি কোন্ পথে যে গেলেন, এক্ষণে কোথায় যে আছেন, তাহার আর কোনো হদিশ নাই। কমলনয়ন চিরবিরহের সেই মধুর যন্ত্রণায় আবিষ্ট হইয়া কাঁদিতেছিল। 

তাহার মনে হইতেছিল, আহা, আজিকার দিনে দাদা এমন সংকীর্তন দেখিল না; সন্ধ্যায় বিষ্ণু দামোদরের মন্দিরে আসিবার পূর্বে সে যাদবকে সঙ্গে আসিতে বলিয়াছিল। যাদব আসে নাই। তাহার ভীষণ অভিমান হইয়াছে। দিন দুয়েক আগে কমলনয়ন দাদাকে জানাইয়াছে যে, সে কাশী যাইবে। যাদব সব শুনিয়া ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হইয়া পড়িয়াছে। যাদব কহিল, “তোর এই নবদ্বীপে বিদ্যাবাসনা মিটিতেছে না? আবার কাশী যাইতে হইবে?” এই পর্যন্ত বলিয়াই যাদব অভিমানভরে কমলনয়নের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করিয়াছে। অজিকেও কমলনয়ন যখন দাদাকে মন্দিরে সন্ধ্যারতি দর্শন করিবার জন্য ডাকিল, সে কোনো উত্তর দেয় নাই। 

কীর্তন চলিতেছে, তাহারই মধ্যে হরির লুট আরম্ভ হইল। জনৈক পূজারী শালপত্রের দোন্নায় করিয়া বাতাসা আনিয়া নৃত্যরত জনতার মাথার উপর নানাদিকে নিক্ষেপ করিতেছে। আর তখনই ‘হরিবোল, হরিবোল’ ধ্বনি দিয়া লোকজন হুড়াহুড়ি করিয়া সেই নিক্ষিপ্ত প্রসাদের দিকে ধাবিত হইতেছে। কমলয়নেরও ইচ্ছা হইল, এই মাতনে মাতিবে। নিকটেই প্রসাদ আসিয়া পড়িল, বালকের উৎসাহে কমলনয়ন সেই নিক্ষিপ্ত বাতাসার দিকে ছুটিয়া গেল। কিন্তু ভিড়ের ধাক্কায় যথাস্থানে পৌঁছাইতে পরিল না। কাহার দেহের সহিত ধাক্কা খাইয়া একদিকে পড়িয়া তাহার মস্তক মন্দিরের একটা প্রকাণ্ড স্তম্ভে ঠুকিয়া গেল। 

কমলনয়ন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাঁদিয়া উঠিল। সে কোনোরকমে উঠিয়া দাঁড়াইল। মন্দিরের এই স্থান সামান্য অন্ধকার, সে ভালো দেখিতে পাইল না। কপালের যে- স্থানে আঘাত লাগিয়াছে, সেখানে সে হাত বুলাইতেছিল। কপাল ফুলিয়া উঠিয়াছে। 

এমন সময়ে কে এক ব্যক্তি অন্ধকারের ভিতর তাহাকে আসিয়া ধরিল। কমলনয়ন তাহার মুখ দেখিতে পাইল না। অপরিচিত ব্যক্তি তাহার শিরোদেশে হাত বুলাইয়া কহিল, “আহা, ফুলিয়া উঠিয়াছে যে! এখনই জল দিতে হইবে। চলুন, গঙ্গার ঘাট নিকটেই, সেখানে যাই।” 

কমলনয়ন তাহার সঙ্গে চলিল। গঙ্গার ঘাটে কপালে জল দিয়া কথঞ্চিৎ শান্ত হইল। তাহার পর অপরিচিত সেই ব্যক্তি তাহাকে ঘাটের রানার উপর আনিয়া বসাইল। এতক্ষণে কমলনয়ন কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া চাহিয়া দেখিতে পারিতেছে। নিকটস্থ এক রাজকীয় ভবনের দেউড়ির উপর স্থাপিত উজ্জ্বল প্রদীপমালার আলো ঘাটের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। কমলনয়ন সাহায্যকারী ব্যক্তিটির মুখপানে চোখ তুলিয়া দেখিবামাত্রই নিতান্ত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল। 

এ ব্যক্তি কে? কমলনয়নের মনে হইল, সে যেন দর্পণে নিজেকে দেখিতেছে। অবিকল তাহারই মতন আর-একজন মানুষ! অবিকল তাহারই প্রতিকৃতি! পার্থক্য যদি কিছু থাকে, তবে তাহা বেশবাসে এবং কেশপারিপাট্যে। কমলনয়নের বেশ অতি সাধারণ; সামান্য ধুতি ও উড়ানি গায়ে। এ ব্যক্তির পরনে সম্ভ্রান্ত বেশবাস; পট্টবস্ত্রের উপর গরদের উত্তরীয়, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি বাসন্তী রঙের অঙ্গরাখা। কমলনয়নের কেশ টোলের বিদ্যার্থীর ন্যায় সম্মুখে সামান্য কামানো এবং শিরোদেশে একটি শিখাও রহিয়াছে। আর আগন্তুক ব্যক্তির কাঁধ অবধি নামিয়া আসা কেশদাম বক্ষের উপর বেণীর ন্যায় প্রলম্বিত, কপালের উপর চূর্ণ কুন্তল আসিয়া পড়িয়াছে। এইগুলি ছাড়া দুইজনের ভিতর কোনো প্রভেদ নেই। সেই এক গৌরবর্ণ, সেই আয়ত লোচন, সেই প্রশস্ত স্কন্ধ, উদার বাহু— সব, সব এক! মুগ্ধ বিস্ময়ে আগন্তুক ব্যক্তিকে দেখিতে দেখিতে কমলনয়ন জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে, মহাশয়? আপনিই কি রাজীবলোচন?” 

আগন্তুক ব্যক্তিও নির্বাক হইয়া কমলনয়নকে দেখিতেছিল। পৃথিবীতে এও সম্ভব? দুইজন মানুষের ভিতর এতদূর সাদৃশ্য? সাদৃশ্য বলিলে ভুল হয়, একজন যেন অন্যজনের হুবহু অনুকৃতি! আগন্তুকের মনে হইল, সে নিজেই যেন অন্যপ্রকার বেশভূষা করিয়া নিজেরই সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে! বিস্ময়ের জড়তা ক্ষণপরে অপসারিত করিয়া আগন্তুক উত্তর দিল, “রাজীবলোচন? সে কে, তাহা তো জানি না। আমার নাম পদ্মাক্ষ।” 

কমলনয়নের শিরোদেশে অসহ্য যন্ত্রণা হইতেছিল। তাহার মাথার ভিতরে ‘কমলনয়ন’, ‘পদ্মাক্ষ’, ‘রাজীবলোচন’ ইত্যাকার নামগুলি যেন সব দলা পাকাইয়া প্রলয়কাণ্ড বাঁধাইতেছে। 

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “মহাশয় কি এ স্থানে নূতন? পূর্বে তো দেখি নাই?”

পদ্মাক্ষ উত্তর দিল, “সে অনেক কথা। সমুদ্রযাত্রা করিয়াছিলাম। ফিরিবার পথে সপ্তগ্রামের নিকট জলদস্যু আক্রমণ করিল। দস্যুদের হাত হইতে প্রাণরক্ষার নিমিত্ত অর্ণবপোতের পাটাতন হইতে সস্ত্রীক নদীস্রোতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিলাম। আমাদিগের জাহাজ হইতে পলায়নরত একটি ক্ষুদ্র ডিঙায় আশ্রয় পাইয়া এই নবদ্বীপে আসিয়া উঠিয়াছি। বর্তমানে অতিথিশালায় সস্ত্রীক বসবাস করিতেছি। সন্ধ্যাবেলায় কী করিব, অতিথিশালা বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছিলাম। বিষ্ণু দামোদরের মন্দিরে আরতি দর্শন করিতে আসিলাম। সন্ধ্যা হইয়াছে, তাই পত্নীকে অতিথিশালায় রাখিয়া আসিয়াছি। আপনি কি এখানেই থাকেন?” 

কমলনয়ন বলিল, “হাঁ। আপাতত এখানেই থাকি। কয়েকদিনের মধ্যেই কাশীযাত্রা করিব। আমি বিদ্যার্থী। নাম আমার মধুসূদন। আপনি…?” 

“আমি চন্দ্রদ্বীপের সভাকবি। সম্প্রতি দেশভ্রমণে বাহির হইয়াছি।” 

চন্দ্রদ্বীপ! সেই চন্দ্রদ্বীপ? যেখানে কমলনয়ন রাজাকে কবিতা শুনাইতে গিয়াছিল? এ ব্যক্তি বলে কী? কমলনয়ন বিস্ময়ে কাঠ হইয়া গেল। তাহার বিহ্বল অবস্থা দেখিয়া পদ্মাক্ষ প্রশ্ন করিল, “মহাশয়ের কি চন্দ্রদ্বীপে কখনও যাওয়া হইয়াছে?” 

কমলনয়ন সামান্য ইতস্তত করিয়া কহিল, “হাঁ। কৈশোরকালে একবার চন্দ্রদ্বীপ গিয়াছিলাম।” তাহার পর হাসিয়া যোগ করিল, “রাজাকে কবিতা শুনাইতে….” 

পদ্মাক্ষ উত্তেজিত হইয়া কহিল, “কী আশ্চর্য! আমিও তো ওই বয়সেই চন্দ্রদ্বীপের রাজা কন্দর্পনারায়ণকে কবিতা শুনাইতে গিয়াছিলাম!” 

কমলনয়ন বলিল, “রাজা কবিতা শুনিয়াছিলেন?” 

“হাঁ, শুনিয়াছিলেন। আমার কবিতা শুনিয়া রাজা অত্যন্ত প্রীত হইয়া আমাকে সভাকবিপদে বরণ করিয়া লইয়াছিলেন। সেই হইতে চন্দ্রদ্বীপেরই একপ্রান্তে বসবাস করিতেছি।” 

কমলনয়ন ভাবিতে লাগিল। এই ব্যক্তি পদ্মাক্ষ তাহারই ন্যায় কৈশোরে চন্দ্রদ্বীপের রাজদরবারে কবিতা পাঠ করিতে গিয়াছিল? রাজা এ ব্যক্তির কাব্যপ্রতিভায় মুগ্ধ হইয়া তাহাকে সভাকবিপদে নিয়োগ করেন। তাহার যাহা হয় নাই, তাহার যাহা হইতে পারিত, এ ব্যক্তির তাহাই হইয়াছে। আশ্চর্য! নিজেকে কমলনয়নের বড়ো অসহায়, বড়ো ব্যর্থ মনে হইতে লাগিল। তাহার নিজ জীবনে কী আর হইল? কবি হইতে পারিল না। ভক্তও হইতে পারিল না। শুনিয়াছে রাজীবলোচন নামক আর- এক ব্যক্তি তাহারই ন্যায় উনসিয়া হইতে নবদ্বীপে আসিয়াছিল। সেই রাজীবলোচন নাকি শ্রীমন্মহাপ্রভুর চরণাশ্রয় লভিয়াছে। ইহাদেরই সব হয়, তাহার কিছুই হয় না। বিফল রিক্ত জীবনের নিয়তি লইয়াই সে বুঝি জন্মগ্রহণ করিয়াছে। অন্ধকারের ভিতর কমলনয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। 

পদ্মাক্ষ কিন্তু কমলনয়নের মনের ভাব বুঝিতে পারিল না। জিজ্ঞাসা করিল, “মহাশয়ের আদি নিবাস কোথায়?” 

কমলনয়ন সংক্ষেপে বলিল, “বিক্রমণিপুর।” 

সৌভাগ্য যে, সে কেবল বিক্রমণিপুরের উল্লেখ করিয়াই ক্ষান্ত হইল। যদি কমলনয়ন বলিত, বিক্রমণিপুরের কোটালিয়ার অন্তঃপাতী উনসিয়া গ্রামের নিবাসী সে, তাহা হইলে কী যে বিষম কাণ্ড ঘটিত! পদ্মাক্ষ অবাক হইয়া ভাবিত, তাহা কী করিয়া হয়? সে নিজেও তো সেই একই গ্রামের অধিবাসী! তাহার মনে হইত, সে স্বপ্ন দেখিতেছে। তখন সে কী কাণ্ড করিয়া বসিত, কে বলিতে পারে? 

নৈঃশব্দ্য ভাঙিয়া কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “সম্প্রতি কী কাব্য রচনা করিতেছেন?” 

পদ্মাক্ষ একটু চিন্তা করিয়া কহিল, “একটি বালিকার কথা। বালিকাটি যখন সদ্যোকৈশোরে উপনীত হইয়াছিল, একদিন তাহাদের গ্রাম পাঠান সৈন্যের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ভয়ার্ত বালিকা ইক্ষুবনে আত্মরক্ষা করিবার নিমিত্ত সমস্ত রাত্রি লুকাইয়া থাকে। পরদিন গ্রামে ফিরিয়া দেখে, পাঠান সৈন্য সব তছনছ করিয়া চলিয়া গিয়াছে। গ্রামের সকলেই পলাতক। অসহায় বালিকার রোদনধ্বনি শুনিয়া এক পথিক সেই গৃহে প্রবেশ করে। বালিকাটি এই পথিকের সঙ্গে অপর এক গ্রামে চলিয়া আসে। সেখানেই কালক্রমে তাহাদের বিবাহ হয়। তাহারা এক নদীতীরে এক জীর্ণ কুটিরে বসবাস করিতে আরম্ভ করে। এই বালিকাটিই আমার কাব্যের নায়িকা, তাহার স্বামী নায়ক। কাব্যের বিষয়বস্তু তাহাদের সুগভীর প্রণয়।” 

কমলনয়নের মনে হইল, কী এমন কাব্যের বিষয়! ইহা অপেক্ষা সে নিজে কত ভালো কাব্য রচনা করিতে পারিত। এই লোকটা ফাঁকি দিয়া তাহার স্থান দখল করিয়া সামান্য কাহিনি অবলম্বনে কাব্য ফাঁদিয়া বসিয়াছে। কমলনয়ন কিঞ্চিৎ গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করিল, “কাব্যে ভগবদ্ভক্তির কথা কিছু আছে কি?” 

পদ্মাক্ষ নদীর স্রোতের দিকে তাকাইয়া কহিল, “তাহা নাই। কিন্তু মানুষের বেদনার কথা আছে।” কমলনয়ন বিজ্ঞের ন্যায় ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “ভালো। তা এই কাব্যে ওই আকাশ, এই নদী, এই চরাচরব্যাপী অন্ধকারের কথা আছে?” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “প্রচুর পরিমাণে আছে। কিন্তু ওইসব নিসর্গদৃশ্যের উপরে আমি মানুষের প্রেম, বিরহ, বেদনা, বিষাদকে স্থান দিয়াছি।” 

কমলনয়ন প্রশ্ন করিল, “এই জগৎকে কখনও জানিবার ইচ্ছা হয় না? ইচ্ছা হয় না তন্ন তন্ন করিয়া জগতের প্রতিটি বস্তুকে খণ্ডবিখণ্ডিত করিয়া তাহার অন্তর্নিহিত রহস্যকে খুঁজিবার? কেবল প্রণয়-বিষাদের ভিতরেই কি আর জীবনের সমগ্রতা?” 

পদ্মাক্ষ কোনো উত্তর দিল না, কেবল একটু হাসিল। তাহার পর বলিল, “ভাই! আপনি বিদ্যার্থী। আপনার এইরূপ ইচ্ছা হইতেই পারে। আমারও ওইরূপ ইচ্ছা যে মধ্যে মধ্যে হয় না, তাহা নহে। কিন্তু আমি অন্য পথ পাইয়াছি। যেদিন প্রথম হৈমবতীকে দেখিলাম…” 

“হৈমবতী কে?” কমলনয়ন প্রশ্ন করিল। 

“হৈম আমার স্ত্রী। আমার কাব্যে ওই যে-বালিকাটির কথা বলিতেছিলাম, হৈমই সেই বালিকা। আর আমিই সেই পথিক, যে হৈমর ক্রন্দনরোল শুনিয়া তাহাদের গৃহে প্রবেশ করিয়াছিলাম। তাহাকে প্রথম আমি পিছন হইতে দেখিয়াছিলাম, সে মাটির উপর বসিয়া হাঁটুর উপর মুখ রাখিয়া কাঁদিতেছিল। তখন প্রণয় নয়, কী বিপুল স্নেহের অনুভূতি হইয়াছিল যে! মনে হইয়াছিল, এই ক্রন্দনরতা বালিকার আমি ছাড়া এই ত্রিভুবনে কেহ কোথাও নাই। পৃথিবীর কোনো পিতা তাহার অসহায়া দুহিতাকে দেখিয়া যে-মমতা অনুভব করে, সেই আশ্চর্য মমতায় আমি উহাকে মাটি হইতে যেন বুকের মধ্যে তুলিয়া লইয়াছিলাম। তাহার পর সেই স্নেহের পথ ধরিয়া আমার হৃদয়ে প্রথম প্রণয় আসিল। ভাবিলাম, মানবের হৃদয়ে এত সুগভীর বেদনা, এত অতলান্ত স্নেহ, এমন দুকূলপ্লাবী করুণা, প্রেম ভরিয়া আছে, তাহাকে ফেলিয়া আমি কোন্ বিশ্বজগতের রহস্য উন্মোচন করিব?” এই বলিয়া পদ্মাক্ষ থামিল। আবেগের বশে সে অনেক কথা বলিয়া ফেলিয়াছে। 

কমলনয়ন তাহার কথা বুঝিবার চেষ্টা করিতেছিল। মনে হইল, পদ্মাক্ষ সত্যই বড়ো গম্ভীর কথা বলিয়াছে। এ জগতে এই ব্যাকুলতার তুলনা কোথায়? কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসিয়া থাকিয়া কমলনয়ন ধীরে ধীরে বলিল, “হাঁ, ঈশ্বরের প্রতিও এই ব্যাকুলতার পথেই প্রেম আসে। তবে সেক্ষেত্রে প্রথমে ‘আমি তোমার’, তাহার পর ‘তুমি আমার’ এবং পরিশেষে তুমিই আমি, আমিই তুমি’—এইপ্রকার ভাবের অনুক্রমে প্রেমের বিকাশ ঘটিয়া থাকে।” 

পদ্মাক্ষ বলিল, “আমি কি কোনোদিন সেই সমুচ্চ প্রেমের, ঈশ্বরভক্তির নাগাল পাইব?” 

কমলনয়ন শান্ত স্বরে বলিল, “নিশ্চয়ই পাইবেন। আপনার এমন হৃদয়বত্তা! আপনি পাইবেন না তো কে পাইবে? স্বচ্ছ কাচেই বিদ্যুৎ ঝলসিয়া উঠে। আমি নিশ্চিত, মানবের প্রতি আপনার এই প্রণয়ের পথ ধরিয়াই একদিন ঈশ্বর আপনাকে ধরা দিবেন।” 

পদ্মাক্ষ অন্য কথা পাড়িল, “কাশী যাইবেন কেন?” 

কমলনয়ন উত্তর দিল, “আরও পড়িতে। পড়িয়া পড়িয়া আমার আশ মিটিতেছে না। কাশীতে অদ্বৈত বেদান্ত শিক্ষা করিব।” 

পদ্মাক্ষ অবাক হইয়া বলিল, “সে কী! শুনিয়াছি, অদ্বৈতবাদীরা শুষ্ক জ্ঞানের কথা বলে। সেসব পড়িলে আপনার ভক্তি, প্রেমের হানি হইবে না তো?” 

কমলনয়ন সচকিত হইয়া একবার পদ্মাক্ষর দিকে তাকাইল। সত্যই, এই কথাই সে কয়দিন হইতে ভাবিতেছিল। যদি শুষ্ক জ্ঞানের পথে তাহার হৃদয় শুকাইয়া যায়! এ কেমন করিয়া তাহার মনোগত সংশয় ধরিয়া ফেলিয়াছে! পদ্মাক্ষকে তাহার বড়ো আপন মনে হইল। যেন কতকালের বন্ধু। পদ্মাক্ষর মন সপ্রেমে কমলনয়নকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। ইহাকে কি সে তাহার অভিপ্রায় বলিবে? বলিলেই বা! ইহার প্রতি তাহার কেমন আস্থা হইতেছে। 

কমলনয়ন বলিল, “অদ্বৈতবাদ শিক্ষা করার পশ্চাতে আমার একটি অভিপ্রায় আছে। তাহা হইল, অদ্বৈতবাদীদের নিগ্রহস্থান কোথায় তাহা আবিষ্কার করা। একবার যদি উহাদের দুর্বলতা খুঁজিয়া পাই, যুক্তি সহায়ে ওই শুষ্ক জ্ঞানের পথ আমি চূর্ণবিচূর্ণ করিয়া দিব। উহারা ভগবদ্ভক্তিকে বড়ো তুচ্ছ করিয়াছে, তাহার প্রতিশোধ লইতে হইবে।” 

পদ্মাক্ষ উচ্চহাস্য সহকারে বলিল, “সাবধান! অদ্বৈতবাদের দুর্বলতা খুঁজিতে গিয়া আপনি নিজেই না অদ্বৈতবাদী হইয়া পড়েন। তখন হয়তো আপনার আজিকার কথা আমূল পরিবর্তিত হইয়া যাইবে। যে-উৎসাহ লইয়া আপনি আজ অদ্বৈতবাদের দুর্বলতা সন্ধান করিতে যাইতেছেন, ততোধিক উৎসাহে আপনি হয়তো সেদিন দ্বৈতবাদী ভক্তদিগের ত্রুটি অনুসন্ধান করিবেন। কে বলিতে পারে?” 

পদ্মাক্ষর দ্বারা বর্ণিত অবস্থার কথা কল্পনা করিয়া কমলনয়ন শিহরিয়া উঠিল। অসহায়ভাবে বলিল, “কিন্তু আমার হৃদয়? আমার হৃদয় তখন আমি কোথায় রাখিব?” 

পদ্মাক্ষ কহিল, “সেই কথাই তো বলিতেছি। দার্শনিকগণ নানা মত মতান্তর লইয়া তর্ক বিতর্ক করেন। কিন্তু সত্যলাভ কোনো মতবাদের প্রতিষ্ঠা বা খণ্ডনের উপর নির্ভর করে না। কিছু মনে করিবেন না। সত্য পুথির পাতায় নাই।” 

কমলনয়ন তীক্ষ্ণভাবে বলিল, “তবে কি নারীর প্রণয়ের মধ্যে আছে?”

“না, মানিতেছি, তাহাতেও নাই। তবু নারীর প্রণয় একটা সজীব পদার্থ। নারীর হৃদয়, বস্তুত যে-কোনো মানুষের হৃদয়েই সত্যের ইঙ্গিত আছে। উহা পুথির পাতার ন্যায় নিষ্প্রাণ নহে। ভাবিয়া দেখুন, পুথির পাতায় কী আছে? রোমাঞ্চ আছে? ব্যাকুলতা আছে? কোনো সামান্যা নারীর হৃদয়কেও আবিষ্কার করিয়া অধিকার করা, কিংবা সেই হৃদয়ের নিকট আত্মসমর্পণ করিবার মধ্যে যে-আনন্দ আছে, আপনার পুথির পাতায় তাহা কোথায়? তখন তাহা তো আর সামান্য থাকে না, অসামান্য হইয়া উঠে। কবি যেমন বলিয়াছেন, “তিলে তিলে নূতন হোয়’! মানুষকে ভালোবাসিয়াই যদি এত সুখ থাকিতে পারে, তবে ঈশ্বরের ভালোবাসা উদিত হইলে কী অসামান্য আনন্দ ক্ষরিত হইবে, একবার ভাবিয়া দেখুন! সেই আনন্দকে পুথির পৃষ্ঠায় হারাইয়া ফেলিলে সমুদয় বিনষ্টি হইবে যে!” 

কমলনয়ন বালকের ন্যায় জেদ করিয়া বলিল, “তাহা হয়তো সত্য। কিন্তু কাশী আমাকে যাইতেই হইবে।” 

পদ্মাক্ষ, বালককে যেমন করিয়া জননী বুঝায়, তেমন করিয়াই বলিল, “বেশ তো, যান-না! এখন আপনার প্রাণ যাহা বলিতেছে, তাহাই অনুসরণ করুন। কিন্তু একদিন আসিবে, আমি জানি, নিশ্চিত আসিবে, যেদিন আপনি হৃদয়ের ভাষা না বুঝিয়া পারিবেন না। সেইদিন হয়তো আবার আমাদের দেখা হইবে!” 

কথা থামিয়া গেল। দুইজনে মৌন হইয়া বসিয়া আছে। সম্মুখে অন্ধকারের ভিতর কলস্বনা ভাগীরথী বহিয়া যাইতেছে। উপরে নিস্তব্ধ আকাশ তাহার তারাভরা রাত্রির মহিমা লইয়া চরাচরের উপর চিত্রার্পিত হইয়া আছে। কিছু পরে কমলনয়ন উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “নাঃ, রাত্রি হইয়া গিয়াছে। বিদ্যাশ্রমে ফিরিয়া যাই।” 

পদ্মাক্ষ কহিল, “আমিও উঠিব। অতিথিশালায় হৈম একা আছে।” 

তাহারা দুইজন একত্রে হাঁটিয়া আসিয়া এক গলিপথের সম্মুখে পরস্পর পরস্পরকে বিদায় জানাইয়া দুই দিকে চলিল। বস্তু ও সম্ভাবনা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। আবার কখনও মিলিবে কি? 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *