পঞ্চাশ
কেমন এক ঘোরের মধ্যে উত্তর দিকে চলেছে রানা। বুজে আসছে চোখ। আরও কিছুক্ষণ যাওয়ার পর জিপ থামিয়ে দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিল। তারপর আবারও এগোল। ভোরে সূর্যটা আকাশে ওঠার একটু পর মরুভূমি হলো ধিকিধিকি আগুনের কুণ্ড। বিছিয়ে আছে সুদানের সমতল বালির প্রান্তর। সারাদিন আগুনের মত রোদে পুড়ল রানা। এরপর এল রাতের আঁধার। একসময়ে বুঝল, সত্যিই পেরিয়ে গেছে সীমান্ত। যদিও স্পেশাল ফোর্সের পক্ষে ওকে খুঁজে বের করা কঠিন, তবুও আর্মির পেট্রলের ভয়ে লুকিয়ে এগোল পরের কয়েক ঘণ্টা।
পরের ভোরে অতিরিক্ত গরম হয়ে উঠল নিসানের ইঞ্জিন। ফুরিয়ে এসেছে ফিউয়েলও। তবে নিজের কাজ ঠিক ভাবেই শেষ করেছে জিপগাড়িটা। পাকা সড়কে তুমুল গতি তুলল রানা। একসময়ে বহু দূরে দেখল সবুজাভ রেখা। ওদিকেই নীল নদের উপত্যকা। আরও কিছুক্ষণ চলার পর বেঁকে বসল নিসানের ধোঁয়া ওঠা ইঞ্জিন। বাধ্য হয়ে গাড়িটা ফেলে হাঁটতে শুরু করল রানা।
মাঝে মাঝে সাঁই-সাঁই করে যাচ্ছে একটা দুটো লরি। কেউ থামছে না হিচ-হাইকারকে তুলে নেয়ার জন্যে। এসব ড্রাইভার কাঁধের ভাবতেও পারবে না, ধূলিধূসরিত পথচারীর হ্যাভারস্যাক ব্যাগের ভেতর রয়েছে প্রাচীন আমলের সোনার মূর্তি। অত সোনা সারাজীবনেও দেখেনি তারা। এটাও তারা জানল না, ওই যুবকের মোবাইল ফোনে রয়েছে লাখ-কোটি ডলারের গুপ্তধনের মানচিত্র, ছবি ও ভিডিয়ো।
বহুক্ষণ হাঁটার পর দূরে ছোট একটা শহর চোখে পড়ল রানার। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখল, আবারও পাচ্ছে সিগনাল। ভাল করেই মনে আছে, আজ অভিযানের সপ্তম দিন। দেরি না করে জন ব্রাউনের নাম্বারে কল দিল ও।
এরপর খুব দ্রুত ঘটল বাকি সব।
শহরে কাপড়ের একটা দোকানে ঢুকে সুতি শার্ট ও জিন্সের প্যান্ট কিনল রানা। উঠল ছোট এক আবাসিক হোটেলে। ঘণ্টাখানেক ধরে স্নান করল। দেহ থেকে ধুয়ে ফেলল ধুলো, ঘাম ও রক্তের শেষ চিহ্ন। পোশাক বদলে নিয়ে বিশ্রাম নিল অনেকক্ষণ। তারপর বিল মিটিয়ে কাঁধে হ্যাভারস্যাক তুলে আবারও বেরোল হোটেল থেকে। এখন আর ক্লান্ত নয়। পাত্তা দিল না রোদের গনগনে তাপ। ছাউনি দেয়া একটা খাবারের হোটেলে বসে সেরে নিল দুপুরের খাবার। ওখান থেকে বেরিয়ে এল শহরের প্রান্তে পাম গাছের সারির নিচে ছায়ার ভেতর। অপেক্ষা করছে ধৈর্য ধরে।
পনেরো মিনিট পর ওর পাশে থামল কালো রঙের এক লেক্সাস গাড়ি। ওটা থেকে নেমে পড়ল সুট পরা দুই লোক। তারা হাতের ইশারা দিতেই ডানদিকের লোকটার হাতে ওয়ালথারটা ধরিয়ে দিল রানা। এয়ার কণ্ডিশও লেক্সাসে ওঠার পর মনে পড়ল, গত ক’দিন কীভাবে কেটেছে মরুভূমির ভেতর। আরাম করে হেলান দিয়ে চোখ বুজল ও। উত্তর দিকে আশি মাইল দূরের এক ছোট্ট এয়ারফিল্ডে পৌছুতে প্রায় কোনও সময়ই লাগল না।
এবার রানাকে উঠতে হলো হালকা এক সেসনা মাস্টাং জেট বিমানে। ওটা নীল নদের ওপর দিয়ে গিয়ে পেরোল কায়রো শহর। চলেছে উত্তর-পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর তীর ও আলেক্যান্দ্রিয়া শহরের দিকে।
জন ব্রাউনের সংগঠনের দক্ষতা দেখে মনে মনে প্রশংসা না করে পারল না রানা। বিমান নেমে যাওয়ার পর শহরের ভেতর দিয়ে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো নতুন বিবলিয়োথেকা অ্যালেক্যান্দ্রিনায়। নতুন করে গড়ে তোলার পর দু’হাজার বছর আগে ওখানেই ছিল প্রাচীন আমলের সেরা লাইব্রেরি। দুর্ভাগ্য, আগুনে পুড়ে গিয়েছিল প্রতিটি বই। সরু একটা রাস্তা ধরে এগিয়ে পুবের বন্দরে লম্বা এক জেটির সামনে থামল গাড়ি। ওখানে নামিয়ে দেয়া হলো রানাকে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল ও, নীল জলের বুকে নানাদিকে চলেছে শত শত নৌযান।
কিছুক্ষণ পর ব্যস্ত বন্দরের ভিড় এড়িয়ে এল সাদা একটা লঞ্চ। ওটা থামল পিয়ারে। লঞ্চ থেকে নামল দোহারা গড়নের পাইলট। রানাকে জেটিতে দেখে ফোনে কাকে যেন কী বলল সে। তারপর এগিয়ে এল রানার দিকে।
ওই লোকই গ্যারি স্যাণ্ডার্স। গলা কেটেছে ইন্টারপোলের তিন এজেন্টের। রানার সামনে থেমে বিরস হাসল। ‘আপনার জন্যে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছেন মিস্টার ব্রাউন। আসুন।’
রানার ইচ্ছে হলো এক ঘুষিতে লোকটার কণ্ঠনালী ভেঙে দেয়। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে পাশ কাটিয়ে সোজা গিয়ে উঠল লঞ্চে। একটু পর আউটবোর্ড ইঞ্জিন চালু করে দক্ষতার সঙ্গে জেলে নৌকা এড়িয়ে বন্দর থেকে বেরোল গ্যারি স্যাণ্ডার্স। বিশাল সাগর নিস্তরঙ্গ ও সুনীল।
বিশ মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর দূরে ছোট একটা সাদা বিন্দু দেখল রানা। ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে ওটা। একটু পর পরিষ্কার চিনতে পারল দুই মাস্তুলের মেগা ইয়ট সেইবার। সাগরের ওঠা নামার সঙ্গে দুলছে-উঠছে-নামছে ওটা। পাঁচ শ’ গজ দূরে ছোট একটা লঞ্চ। ওটার বোতে বসে ছিপ ফেলেছে কুচকুচে কালো রঙের এক যুবক।
ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে ইয়টের ডেকে ক্রুদের কাউকে দেখল না রানা। ওর মনে হলো, জন ব্রাউন আর স্যাণ্ডার্স ছাড়া এখন আর কেউ নেই ইয়টে।
একটু পর সেইবার ইয়টের পেছনে ভিড়ল স্যাণ্ডার্সের লঞ্চ। রেলিং টপকে ডেকে উঠল রানা। ওর পেছনে বোলার্ডে লঞ্চের দড়ি বেঁধে উঠে এল খুনি লোকটা। হাতের ইশারা করল রানাকে। চোখে শীতল চাহনি। ‘আমার সঙ্গে আসুন।’
‘ব্রাউন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।
‘এখানে,’ বলল পরিচিত কণ্ঠ। ঘুরে তাকাল রানা। কমপ্যানিয়নওয়ে ধরে হেঁটে আসছে বিশ্বাসঘাতক ব্রিটিশ কর্নেল। হাতে ব্র্যাণ্ডির গ্লাস। চেহারা খুব শান্ত। ‘দেখে মনে হচ্ছে তোমার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গেছে, রানা।’
‘ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই,’ জানিয়ে দিল রানা। হাতের ব্যাগটা ডেকের ওপর রাখল। ধুপ্ করে একটা আওয়াজ হয়েছে।
এগিয়ে এসে ব্যাগটা তুলে ওজনটা বুঝে নিয়ে মৃদু হাসল ব্রাউন। চেইন খুলে ঘাঁটতে লাগল রানার বাসি পোশাক।
‘জিনিসটা সীসা নয়,’ বলল গম্ভীর রানা।
‘তা জানি,’ কাপড় সরাতেই রোদে ঝিলিক দিল সোনার মূর্তি। মুখ তুলে রানার চোখে তাকাল ব্রাউন। ‘ভাল, সত্যিই তা হলে গুপ্তধন আছে।’
চুপ করে থাকল রানা।
‘তা হলে এটাও মেনে নিতে হবে, জীবনে এই একটা ভাল কাজ করেছিল নষ্টা জেনির জারজ সন্তান মডাক। অন্যান্য আর্টিফ্যাক্ট কোথায়?’
প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে বাড়িয়ে দিল রানা। ‘ছবি তুলে এনেছি।’
স্মার্ট ফোন নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছবি ও ভিডিয়ো দেখল জন ব্রাউন। তার চোখে যে দৃষ্টি, সেটা আগে রানা দেখেছে উইলিয়াম কেন্সিংটনের চোখে। সেসময়ে স্বর্ণজ্বরে পাগল হয়ে গিয়েছিল লোকটা।
সাগরের হাওয়ার ফিসফিস বাদ দিলে নীরবতা নেমেছে ডেকে। রানাকে পেছনে ফেলে জন ব্রাউনের পাশে থামল গ্যারি স্যাণ্ডার্স। রানার দিকে তাকাল অনুভূতিহীন চোখে।
তাকে পাত্তা দিল না রানা।
স্ক্রল করে শেষ ছবিটা দেখল ব্রাউন। আবারও তাকাল রানার চোখে। ‘এটা কী?’
‘গুপ্তধনের ম্যাপ,’ সংক্ষেপে বলল রানা। ‘ওটা এঁকেছিলেন হাজার হাজার বছর আগে মিশরের এক প্ৰধান পুরোহিত। আমার মনে হয় না বিস্তারিত শোনার ধৈর্য তোমার আছে।’
ভুরু কুঁচকে গেল ব্রাউনের। ‘মনে তো হচ্ছে হায়ারোগ্লিফস।’
‘তোমাকে ভাবতে হবে না,’ প্যান্টের পকেট থেকে ভাঁজ করা নোট নিয়ে বাড়িয়ে দিল রানা। ‘এবার ছেড়ে দাও লিণ্ডাকে। ও কোথায়?’
কাগজগুলো ছোঁ দিয়ে নিয়ে কোমরের চামড়ার থলিতে রাখল প্রাক্তন কর্নেল। ওখানেই ঠাঁই পেল রানার মোবাইল ফোন। খুশি খুশি স্বরে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ, রানা। ভাল দেখালে। জানতাম, আমাকে ডুবিয়ে দেবে না। ঠিক লোকই বেছে নিয়েছি।’
‘লিণ্ডা কোথায়?’ দ্বিতীয়বারের মত জানতে চাইল রানা।
‘মানে আমার বউ?’ কপট নিরীহ সুরে বলল ব্রাউন।
তোমার মনে নেই চুক্তি করেছ?’ বলল রানা।
‘মনে আছে,’ বলল ব্রাউন। ‘কিন্তু সেটার শর্ত পূরণ করতে পারব না।’
‘কেন পারবে না?’
‘পারব না, তা নয়, কিন্তু কী কারণে শর্ত পূরণ করব? তোমার তো বোঝা উচিত এখানে ক্ষমতা কার হাতে।’
‘তার মানে লিণ্ডাকে ছেড়ে দেবে না?’ জানতে চাইল রানা।
‘সে আছে এমন এক জায়গায়, যেখানে তুমি যেতে পারবে না,’ বলল ব্রাউন।
নিষ্ঠুর হাসছে গ্যারি স্যাণ্ডার্স। প্রসারিত হয়েছে দুই ঠোঁট। হাতে বেরিয়ে এল সেমি-অটো ডেয়ার্ট ঈগল পিস্তল। সতর্ক হয়ে উঠেছে জন ব্রাউনও। কোমর থেকে নিল নাইন এমএম সিগ প্রো। প্যারিসে ওটাই ছিল তার হাতে। লঞ্চ পাইলটের পিস্তলের মাঘলের ফুটো রানার মনে হলো কামানের মুখের চেয়েও বড়।
‘তুমি এবার মরবে, রানা,’ শান্ত স্বরে বলল ব্রাউন। ‘শরীরটা কষ্ট করে খেয়ে নেবে হাঙরের পাল। তবে মরার আগে জেনে নাও, স্যাণ্ডার্সের হাতে কীভাবে মরল লিণ্ডা।’
নীরব থাকল রানা। খারাপ হয়ে গেছে মন। এত চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না মেয়েটাকে।
চকচক করছে স্যাণ্ডার্সের দুই চোখ। মুখ খুলল বর্ণনা দেয়ার জন্যে। কিন্তু পরক্ষণে খপ করে বন্ধ করল হাঁ। হঠাৎ করে বড় করে শ্বাস টেনেছে সে। থরথর করে কেঁপে উঠে ধুপ্ করে পড়ল ডেকে। বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকাল রানা। লোকটার দুই চোখের মাঝে কপালে গেঁথে আছে একটা তীর। ফলা বেরিয়ে গেছে মাথার পেছন দিক দিয়ে। তির তির করে কাঁপছে তীর।
ঘুরে তাকাল রানা।
কমপ্যানিয়ন হ্যাচের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লিণ্ডা, হাতে সেই তীরধনুক। পরনে সাদা একটা সুতির দামি পোশাক। ধনুকে জুড়ে নিয়েছে আরেকটা তীর।
হতবাক হয়ে গ্যারি স্যাণ্ডার্সের লাশ দেখছে জন ব্রাউন। ঝট করে ঘুরে তাকাল লিণ্ডার দিকে। ‘এটা কী করলে, লিণ্ডা? ও আমার সেরা অনুচর!’
জবাব দিল না লিণ্ডা। স্বামীর দিকে তাক করল তীরধনুক।
‘কী করছ, লিণ্ডা,’ সামান্য কেঁপে গেল ব্রাউনের কণ্ঠ।
রানা বুঝে গেল, পিস্তল ঘুরিয়ে লিণ্ডাকে গুলি করার আগেই ব্রাউনের বুকে বিঁধবে তীর।
হিস্ আওয়াজ পেল ও। ওর কানের পাশ দিয়ে গিয়ে জন ব্রাউনের ডান কাঁধে বিধল তীর। লোকটার হাত থেকে ডেকে পড়ে খটাস্ আওয়াজ তুলল পিস্তল। ঝড়ের বেগে এগিয়ে মেঝে থেকে অস্ত্রটা তুলল রানা। সরে গেল কয়েক ফুট দূরে। চাপা স্বরে বলল, ‘এবার তোমাকে হাতে পাবে ইন্টারপোল, জন ব্রাউন।’
কয়েক পা এগিয়ে এল লিণ্ডা। তূণ থেকে নিয়ে ধনুকে জুড়েছে আরেকটা তীর। আস্তে করে মাথা নাড়ল। ‘না, রানা, ওরা একে পাবে না।’
মৃদু বিস্ময় নিয়ে মেয়েটাকে দেখল রানা।
লিণ্ডার তৃতীয় তীর বিঁধল জন ব্রাউনের বাম কাঁধে
তীব্র ব্যথায় বিকৃত হয়েছে বেইমান কর্নেলের মুখ। কয়েক পা পেছালেও লিণ্ডার চতুর্থ তীর ভেদ করল তার ডান হাঁটুর বাটি। ঝুঁকে পড়ে আহত দুই হাতে পা চেপে ধরল ব্রাউন। গলা চিরে বেরোচ্ছে চাপা আর্তনাদ। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘এটা কী করছ, লিণ্ডা! আমরা না একই দলে! তুমি না আমাকে ভালবাসো?’
‘অনেক দিন তোমার অত্যাচার সহ্য করেছি, মুক্তি চেয়েছি,’ নরম সুরে বলল লিণ্ডা। ওর পঞ্চম তীর বিঁধল ব্রাউনের বাম হাঁটুর বাটিতে। ঠাস্ করে ডেকে পড়ল প্রতাপশালী, অস্ত্র ব্যবসায়ী, কোটিপতি কর্নেল।
মেয়েটার চোখ-মুখে বরফের মত শীতলতা ছাড়া আর কিছুই দেখছে না রানা। ভাল করে বুঝে গেছে, আন্দাজে তীর ছুঁড়ছে না লিণ্ডা। চ্যাম্পিয়ন ধনুর্বিদ হিসেবে খুব কাছ থেকে বড় টার্গেট পেয়ে দেখাচ্ছে চরম নিষ্ঠুরতা।
করুণ ভাবে কাতরে চলেছে রক্তাক্ত জন ব্রাউন। ভীষণ যন্ত্রণায় কুঁচকে ফেলেছে মুখ। চোখে মৃত্যুর ছায়া।
‘থামো, লিণ্ডা!’ ধমকের সুরে বলল রানা। পিস্তল তাক করেছে মেয়েটার বুকে।
‘না, ওকে মরতে হবে,’ কঠোর সুরে বলল লিণ্ডা। ষষ্ঠ তীর ডেকের সঙ্গে গেঁথে ফেলল জন ব্রাউনের ডান ঊরু। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বেসুরো আর্তনাদ ছেড়ে অচেতন হলো লোকটা। আবারও ধনুকে তীর জুড়ে নিল লিণ্ডা। কয়েক পা এগিয়ে রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ‘ওর থলেটা নিয়ে আমার হাতে দাও।’
এক পলকে বহু কিছুই বুঝল রানা। কোনও কালেই জিম্মি ছিল না মেয়েটা। ব্রাউনের মতই ওর লোভ ছিল গুপ্তধনের প্রতি। দ্বিধা কাটিয়ে বলল রানা, ‘তোমরা একসঙ্গে প্ল্যান করে বোকা বানিয়েছ আমাকে। তাই না?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিণ্ডা। ‘কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। আর সেজন্যে আমি লজ্জিতও নই।’
‘কিন্তু লিসা স্মিথ?’ প্যারিসের ওই ঘরে কাটা মুণ্ড তিনটে যেন চোখের সামনে দেখল রানা।
‘লিসার পরিচয় জেনে গিয়েছিল. ব্রাউন,’ বলল লিণ্ডা। ‘এরপর একসঙ্গে বসে প্ল্যান করেছি আমরা। বা বলা উচিত প্ল্যানটা গুছিয়ে দিয়েছি আমি। সবার সামনে ঝগড়া করেছি ব্রাউন আর আমি। রেস্টুরেন্টে আমার গালে চড় দিয়েছে সে। আর তার মুখে ওয়াইন ছুঁড়েছি আমি। এরপর ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেছি ওখান থেকে। তাতে ইন্টারপোলের এজেণ্ট বুঝল, আমাকে কাজে লাগাতে পারবে সে।’ নিষ্ঠুর হাসল লিণ্ডা। ‘আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল লিসা স্মিথ খুলে বলল, কীভাবে খুন হয়েছে তার বান্ধবী, বা আফ্রিকার বাচ্চারা কীভাবে মরছে ব্রাউনের দেয়া অস্ত্রে। শাস্তি হওয়া উচিত লোকটার। আমিও ভান করলাম, এসব শুনে চমকে গেছি।’
‘অথচ, অন্যের ভাল-মন্দে তোমার আসলে কিছুই যায়- আসে না,’ বলল রানা।
‘লিসা স্মিথের বিশ্বাস অর্জন করতেই হতো। নইলে তার দলের সবাইকে এক জায়গায় জড় করতে পারতাম না। ব্রাউনের ব্যবসা চালিয়ে নিতে হলে এ ছাড়া উপায় ছিল না।’
‘সে তো তোমার স্বামী। তাকে খুন করতে চাইছ কেন?’
‘খুন করব, কারণ ওকে ঘৃণা করি। কিন্তু ওর টাকা আমার দরকার ছিল। নইলে অনেক আগেই ওকে ছেড়ে চলে যেতাম।’
‘ডিভোর্স দেয়াই কি যথেষ্ট ছিল না?’
সে চেষ্টা করলে খুন হতাম ওর হাতে। আর ছেড়েও যদি দিত, বিয়ের চুক্তি অনুযায়ী ওর কাছ থেকে কিছুই পেতাম না।’
‘মুক্তি তো পেতে। পরে গুছিয়ে নিতে পারতে জীবনটা।’
‘আমিও তা-ই ভেবেছি। তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে। কী যেন হয়ে গেল আমার ভেতর। তোমার চোখে দেখলাম ভাল লাগার দৃষ্টি। ভাবতে লাগলাম, কীভাবে পথ থেকে সরাব ব্রাউনকে। খুব খারাপ লেগেছে তোমাকে মিথ্যা বলে। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায়ও ছিল না।’
চুপ করে থাকল রানা। ওর পিস্তলের নল এখনও লিণ্ডার বুকের দিকে তাক করা। নিষ্ঠুর মেয়েটার কথা শুনে শিরশির করছে মেরুদণ্ড।
‘ওই গুপ্তধন চাই, রানা। বোকা লোক ছিল মডাক। বাপের সঙ্গে প্রেমের প্রতিযোগিতায় নামতে চেয়েছিল। বাজে প্রস্তাবও দিয়েছিল আমাকে। যাতে রাতে ওর কেবিনে যাই। আসলে ব্রেসিয়ার খুললে পাগল হয়ে ওঠে সব পুরুষ। সেইবার ইয়টে সেরাতে মর্ডার্ক মাতাল হয়ে সব বলার পর থেকেই অপেক্ষা করেছি— একদিন হাতে আসবে আখেনাতেনের গুপ্তধন।’
‘তার মানে ছলনা করেছ সবার সঙ্গে। তোমার বেশিরভাগ কথা ছিল ডাহা মিথ্যা।’
মাথা নাড়ল লিণ্ডা। ‘সব মিথ্যা নয়, রানা। আমি যখন বলেছি, ভালবেসে ফেলেছি তোমাকে, তখন কোনও ভণিতা করিনি।’
‘তাই?’ তিক্ত হাসল রানা। ‘অভিনয় করেছ, তুমি জিম্মি। ভাল করেই জানতে, এর ফলে কীসের ভেতর দিয়ে যাব।’
‘এ ছাড়া উপায়ই বা কী ছিল? ওই গুপ্তধন হাতে পাওয়া ছিল খুব জরুরি।’
‘এখন কী পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ। প্রায়। ঠিকই পাব। এরপর চিরকাল স্বপ্নের মত জীবন কাটাব আমরা দু’জন।’
‘আমি খুন হলে তখন কী করতে?’
‘তুমি মরে যাওয়ার মত লোক নও, রানা। জানতাম, তুমি ঠিকই ফিরবে।’
‘এই এক সপ্তাহ আরাম করে রোদে বসে গা ট্যান করেছ, আর চুমুক দিয়েছ দামি মদে। তাই না, লিণ্ডা?’
আহত চেহারা করল লিণ্ডা। ‘আমার জন্যেও সময়টা সহজ ছিল না। যতবার দেখা হয়েছে, কুকুরের বাচ্চা ব্রাউনের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসেছি। খুশি রাখতে হয়েছে তাকে। এদিকে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করেছি, কবে ফিরবে তুমি। যাই হোক, শেষপর্যন্ত সফল হয়েছি আমরা। এবার আর টাকার কোনও অভাব থাকবে না। ওই গুপ্তধনের তুলনায় জন ব্রাউনের ব্যবসা ফকিরের পয়সার পুঁটলির মত। একবার ভাবো, বাকি জীবন কী মজা করে ফুর্তি করে বেড়াব দু’জন মিলে!’
‘কিন্তু তা হয়তো সম্ভব হবে না,’ বলল গম্ভীর রানা।
‘কেন হবে না?’ ভুরু কুঁচকে ফেলল লিণ্ডা। ‘কে ঠেকাবে আমাদেরকে?’
‘আমি রাজি হয়ে গেলেও ওরা ঠেকাবে,’ বলল রানা। এইমাত্র সুপারস্ট্রাকচার থেকে বেরিয়ে এসেছে সশস্ত্র ছয়জন যুবক ও এক সুন্দরী বাঙালি যুবতী।
পিস্তল নেড়ে তাদের দিকে দেখাল রানা।
ধনুক হাতে ঝট্ করে ঘুরে দাঁড়াল লিণ্ডা। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘তা হলে বেইমানি করলে!’ আবারও ঘুরেই ধনুক তুলল রানার বুকের দিকে। তিন আঙুলে তীর টেনে নিয়েছে কানের কাছে। আর ঘুরবে না ক্যাম হুইল। বাঁকা হয়েছে ফাইবারের ধনুক।
তিক্ত হাসল রানা। ‘তুমি না আমাকে ভালবাসো? পারবে আমাকে খুন করতে?’
লিণ্ডার ধনুক ধরা হাত রক্তশূন্য। একটু একটু কাঁপছে। আস্তে করে মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘হ্যাঁ, পারব। তুমি বেইমান। আমাকে পেতে যাচ্ছিলে, সুযোগ পেয়েও সব হারালে। তবে নিজেও বাঁচবে না।’
লিণ্ডা তীরটা ছোঁড়ার আগেই গর্জে উঠল রানার হাতের পিস্তল। বুলেট সরাসরি লাগল ধনুকের বাঁকা ফাইবার গ্লাসে। অস্ত্রটা দু’টুকরো হওয়ায় টুপ করে খসে পড়ল ডেকে তীর।
এদিকে নিঃশব্দে লিণ্ডার খুব কাছে পৌঁছে গেছে সোহানা। পরক্ষণে কাঁধের ওপর দিয়ে মেয়েটাকে নিখুঁত থ্রো করল ও। শূন্যে দুই ডিগবাজি দিয়ে ডেকের ওপর ধুপ করে পড়ল লিণ্ডা। ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গেল। কিন্তু সোহানার খালি পায়ের লাথি পড়ল ভ্রষ্টা মেয়েটার তলপেটে। পরক্ষণে ওর লাথি লাগল লিণ্ডার ঘাড়ের পাশে।
জ্ঞান হারিয়ে চিত হয়ে পড়ে থাকল লিণ্ডা ব্রাউন।
ক’পা সরে রানাকে দেখল সোহানা, চোখে অদ্ভুত স্বস্তি।
এগিয়ে এসেছে কায়রোর রানা এজেন্সির শাখা প্রধান শফিক রেহান। ‘মাসুদ ভাই, আপনি মোবাইল ফোনের ট্র্যান্সপণ্ডার চালু করতেই ট্র্যাক করি। ওই বিমানের গতিপথ বুঝে দ্রুত পৌঁছে যাই আলেকযান্দ্রিয়া শহরে। নানাদিকে ছড়িয়ে চোখ রেখেছি রেল স্টেশন আর বন্দরে।’
‘তুমি রেহানকে সব খুলে বলার পর ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোতে সতর্ক হয়ে ওঠে বিসিআই এজেন্ট ও রানা এজেন্সির অপারেটররা,’ বলল সোহানা। ‘আশপাশের যে- কোনও দেশে নামলেই বিমানবন্দর থেকে অনুসরণ করা হতো।’
‘তবুও আসতে গিয়ে দেরিই করে ফেলেছি,’ লজ্জিত কণ্ঠে বলল শফিক রেহান।
‘সাগরের তলা দিয়ে স্রোত ঠেলে ইয়টে উঠতে সময়টা গেছে,’ কৈফিয়ত দিল সোহানা।
‘জানতাম না তুমিও আসবে,’ মৃদু স্বরে বলল বিস্মিত রানা।
‘মন চায়নি রানা এজেন্সির অফিসে একা বসে থাকতে। ওদিকে শুনেছি তুমি একা…’ কাছেই জুনিয়রদের উপস্থিতির কথা মনে পড়তেই চুপ হয়ে গেল সোহানা।
‘সোহানা আপু দেশে ফেরার সময় থেমেছিলেন বৈরুতে। রানা এজেন্সির শাখায় আসতেই সব শুনলেন। সরাসরি এসেছেন ওখান থেকেই,’ জানাল শফিক রেহান। ‘আমরা তৈরি হয়ে বন্দরের দিকে রওনা দেব, এমন সময় পৌঁছে গেলেন। তাতে আমাদের অনেক লাভ হয়েছে। ভাল করে শিখে নিয়েছি কীভাবে জাহাজে উঠে ক্রুদের বন্দি করতে হয়।’
‘সোহানা আপু সত্যিই গ্রেট,’ সায় দিল নতুন এজেণ্ট বশির আল কবির।
মাথা দোলাল দলের অন্যরা।
‘প্রথম থেকে পুরো নাটক দেখতে পেলাম না,’ বলল সোহানা।
কোনও মন্তব্য না করে শফিক রেহানকে বলল রানা, ‘তোমাদের ডাইভিং ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করে নাও। একটু পর ইন্টারপোলের লোক পৌঁছুলেই বিদায় নেব।’
দূরের ছোট লঞ্চটা পৌঁছে গেছে ইয়টের এক শ’ ফুটের ভেতর। ওটার হুইল হাউসে ফরিদ আলীকে দেখল রানা। মন পরিষ্কার ছেলেটার, তবে ওর ধারণা আফ্রিকান সাজতে হলে হাত-পা ও সারা মুখে কালি মেখে ভূত হতে হবে।
যে যার কাজে গেল রানা এজেন্সির চৌকস ছেলেগুলো। তার আগে দড়ি দিয়ে কষে বেঁধে রেখে গেছে লোভী মেয়েটার হাত-পা।
জুনিয়ররা আশপাশে নেই দেখে রানার চোখে তাকাল সোহানা। ‘এবার?’
‘তীরে পৌঁছে যাওয়ার কথা ইন্টারপোলের লোকদের। যে-কোনও সময়ে লঞ্চ নিয়ে হাজির হবে।’
‘আর গুপ্তধন? সেটার কী হবে?’
‘আপাতত গুপ্তধনের বিষয়ে সব প্রমাণ তুলে দেব ইন্টারপোলের হাতে। পরে অন্য ব্যবস্থা হবে।’
‘ওগুলো তো সুদানে, অথচ আসল মালিকানা মিশরের, ‘ বলল সোহানা। ‘ইণ্টারপোল কী করবে আর্টিফ্যাক্ট বা গুপ্তধন নিয়ে?’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘তুমি যেমন আমেরিকা থেকে এলে, ওখান থেকেই আসছে ডক্টর লাবনী আলম। ইন্টারপোলের বড় ক’জন অফিসারকে অনুরোধ করেছি, তাঁরা যেন লাবনীর হাতে বুঝিয়ে দেন মানচিত্র, ছবি, ভিডিয়ো আর সোনার আর্টিফ্যাক্ট। এরপর ইউনাইটেড নেশনসের আইএইচএ, অর্থাৎ, ইন্টার-ন্যাশনাল হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশনের আর্কিওলজিস্টদেরকে সঙ্গে নিয়ে যা করার করবে লাবনী।’
মৃদু মাথা দোলাল সোহানা। ‘আর আমরা কী করব?’
দুষ্টুমি হাসি ফুটল রানার ঠোঁটে। ‘দরখাস্ত করলে আরও বেশ কিছু দিন ছুটি পেতে পারি। তুমি চাইলে আমরা ক’দিন বেড়িয়ে আসতে পারি কটেজের পাশেই নির্জন সৈকত আছে এমন কোথাও থেকে। অনেক দিন হলো কার যেন অধরের সুধা থেকে আমি বঞ্চিত।’
‘যাহ্!’ লজ্জায় লালচে মুখ নিচু করে নিল সোহানা। তবে কয়েক মুহূর্ত পর আয়ত চোখ রাখল রানার চোখে। ফিসফিস করে বলল, ‘চলো তা হলে!’
***