পাঁচ
রাজহংসীর মত সুন্দর ইয়টের পাশে কুঁজো এক বামন যেন রানাদের মোটর লঞ্চ। প্রকাণ্ড ভেসেলের পেছনে সাবধানে ডক করল গ্যারি স্যাণ্ডার্স। ফিসফিস শব্দ তোলা সাগরের দু’ফুট ওপরে বোর্ডিং প্ল্যাটফর্মে উঠতে অ্যানিকে সাহায্য করল রানা। সিঁড়ি বেয়ে নিচের অ্যাফ্ট ডেকে পা রাখতেই ওদেরকে স্বাগত জানল কয়েকজন ক্রু। রানার পাশে অ্যানিকে দেখে কৌতূহল ফুটল দু’একজনের চোখে।
চারপাশ দেখল রানা। দুনিয়ার সেরা সব হোটেলে থেকেছে, কিন্তু সেখানেও এতটা বিলাসিতা ছিল না। সেইবারের লোয়ার ডেকের প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে খরচ হয়েছে হাজার হাজার ডলার। চকচক করছে সিযন করা দামি কাঠের মেঝে। ডেকে বারোজনের জন্যে দীর্ঘ ডাইনিং টেবিল। একটু দূরেই জ্যাকুযি বেদিংপুল। ওপরের দুই ডেকে বা ভেতরে আরও কী আছে, কে জানে!
নিচের ডেকের ডাবল ডোর খুলে বেরিয়ে এল এক মহিলা। পরনে ইস্ত্রি করা সাদা ব্লাউস ও জিন্স। ‘হাই, মিস্টার রানা। আমার নাম মিলা ডওনি।’ উচ্চারণ থেকে রানা বুঝল, মহিলা কানাডিয়ান। ‘আমি মিস্টার ব্রাউনের অ্যাসিস্ট্যান্ট। আপনি ইয়টে পা রেখেছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যর।’
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ বলল রানা। ‘আমাকে রানা বলে ডাকতে পারেন।’
‘মিস্টার ব্রাউন এই মুহূর্তে ফোনে ব্যস্ত,’ বলল মহিলা। ‘আমাকে বলেছেন, যেন তাঁর হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিই। বিশ মিনিট পর আপনার সঙ্গে দেখা করবেন তিনি।’ হাতের ইশারায় কমপ্যানিয়নওয়ে দেখাল সে। একটু দূরেই ওপরে যাওয়ার হ্যাচ। ‘স্যর, অপেক্ষার সময়ে ড্রিঙ্ক নিতে পারেন। মিড ডেকে বার-এ পাবেন প্রায় সব ধরনের লিকার।’
‘অ্যানি অসুস্থ বোধ করছে, তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?’ জানতে চাইল রানা।
‘স্যান রেমোর সৈকতে আমার ওপর হামলা হয়েছিল, ‘ সাগরে আসার পর প্রথমবারের মত মুখ খুলল অ্যানি। তিক্ত স্মৃতি মনে পড়তেই লালচে হয়েছে চেহারা। ‘মিস্টার রানা আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। নইলে হয়তো…’
বিস্ফারিত চোখে অ্যানিকে দেখছে মিলা ডওনি। চট্ করে দেখল রানাকে। ‘এ তো ভয়ঙ্কর কথা! ঠিক আছে, মিস্টার রানা, আমি এখনই ওঁকে গোছানো একটা কেবিনে নিয়ে যাচ্ছি।’
মহিলাকে ধন্যবাদ জানাল রানা। ডাবল ডোর পার করে ইয়টের ভেতরে হারিয়ে গেল মিলা ডওনি ও অ্যানি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ডেকে উঠল রানা। দ্বিতীয় ডেক আরও বড় এবং দামি আসবাবপত্রে সাজানো। এক কোণে বার। ওখানে গিয়ে চোখ বোলাল রানা।
মিথ্যা বলেনি কর্নেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট। বার-এ রয়েছে দুনিয়ার সেরা সব সিঙ্গল মল্ট উইস্কি। ব্রিটিশ আর্মির এক প্রাক্তন কর্নেল কীভাবে এত ধনী হলেন?—আনমনে ভাবল রানা। তিনিই নাকি তৈরি করেছেন এই ইয়টের ডিযাইন!
এই ভেসেল তৈরিতে লেগেছে কমপক্ষে পনেরো মিলিয়ন ডলার। বা আরও বেশি। একটা ওঅটারফোর্ড কাট-ক্রিস্টাল গ্লাসে দুই পেগ ল্যাফ্রোইগ ঢালল রানা। একবার দেখল হাতঘড়ি। অন্তত আরও পনেরো মিনিট পরে দেখা করবেন ব্রাউন। এই ডেকের চারপাশে প্রাচুর্য। আরেকটা কমপ্যানিয়নওয়ে পেরিয়ে ওপরে ওঠার বৃত্তাকার সিঁড়ি। কৌতূহল মেটাতে ওপরের ডেকে উঠল রানা। এত ওপর থেকে মাইলের পর মাইল দেখা যাচ্ছে সাগর। ঝিরঝির করে বইছে হাওয়া। স্কচ উইস্কিতে চুমুক দিল রানা। বিড়বিড় করে বলল, ‘আপনার উত্থান অবিশ্বাস্য, কর্নেল!’
মৃদু স্ আওয়াজ পেল রানা। খুব দ্রুত বাতাস চিরে গেছে কিছু। ঘুরে তাকাল ও। সঙ্গে সঙ্গে ধক্ করে উঠল ওর বুক। রাফেলা! আপার ডেকে ত্রিশ গজ দূরে হেলিপ্যাডে যে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে খুব ভাল করেই চেনে ও। দেখা যাচ্ছে মুখের একটা দিক। অবাক হয়ে ভাবল রানা, হঠাৎ করে কীভাবে এখানে এল রাফেলা বার্ড!
এইমাত্র আবারও ছিলায় তীর জুড়েছে রাফেলা। অদ্ভুত দেখতে তীরধনুকের লিম-টিপে বড়সড় ক্যাম হুইল। বেশকিছু টান টান স্ট্রিং ছিটকে দেবে তীর। হ্যাণ্ডেল থেকে বাইরের দিকে রাইফেলের ব্যারেলের মত দীর্ঘ স্টেবিলাইযার আর্ম। দূরে দেখার জন্যে রয়েছে টেলিস্কোপিক সাইট।
ভাবছে রানা, রাফেলা কি কর্নেল জন ব্রাউনের আত্মীয়? বিপদটা কি কর্নেলের, না রাফেলার?
গোল কী যেন আটকে গেছে রানার গলার ভেতর। এত কাছে মেয়েটা, তবুও যেন বহু দূরে!
পনিটেইল করেছে রাফেলা। বাতাসে দুলছে চুল। পরনে শর্ট্স ও স্লিভলেস টপ। দেহের অনাবৃত অংশ ব্রোঞ্জ রঙের। ওকে দেখাচ্ছে গ্রিক দেবী ভেনাসের মত।
রাফেলার দিকে চেয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেছে রানা।
ওর উপস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানে না মেয়েটা।
ষাট গজ দূরে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে প্লাস্টিকের ছোট একটা দ্বীপ। ওটার স্ট্যাণ্ডে ঝুলছে ডিনার প্লেটের সমান সোনালি টার্গেট। ওদিকে পুরো মনোযোগ রাফেলার। টার্গেটের বাইরের দিকে লাল, নীল ও কালো কনসেন্ট্রিক রিং। মাঝে বুল্স্ আই। সাগরের সঙ্গে উঠছে-নামছে টার্গেট। অত্যন্ত কঠিন হবে লক্ষ্যভেদ করা।
স্ট্রিং টেনে কানের কাছে নিল রাফেলা। দুনিয়ার সেরা যত মিলিটারি মার্কস্ম্যান দেখেছে রানা, গুলির মুহূর্তে তারা হয়ে ওঠে পাথরের মত স্থির। একইভাবে মূর্তি হয়েছে রাফেলা। ওর পৃথিবীতে এখন রয়েছে শুধু ওই তীর আর দূরের টার্গেট।
তিন আঙুলে ধরে রাখা তীর ছেড়ে দিল রাফেলা। একপাশে কাত হলো ধনুক। চোখে দেখা গেল না, মাত্র দু’ সেকেণ্ডে টার্গেটে পৌঁছুল তীর। কপালে হাত রেখে ওদিকে তাকাল রানা। ঠিক মাঝে হলদে বৃত্তের ভেতর আরেকটা তীরের পাশে থরথর করে কাঁপছে নতুন তীরটা।
ঘুরে রাফেলার দিকে তাকাল রানা।
আনমনে মাথা দোলাল রাফেলা। মুখে তৃপ্তির হাসি। আরেকটা তীর নিতে গিয়ে সামান্য কাত হলো। তখনই বড় একটা হোঁচট খেল রানা। এই মেয়েটা দেখতে রাফেলার মত হলেও সামান্য তফাৎ আছে চেহারায়। এর নাক আরেকটু খাড়া।
‘ও আমার স্ত্রী লিণ্ডা ব্রাউন,’ হঠাৎ করেই রানার পেছন থেকে বলে উঠলেন কর্নেল জন ব্রাউন।
ঘুরে দাঁড়াল রানা। তিনবছর পর ওর সঙ্গে দেখা হলো কর্নেল জন ব্রাউনের। আগের মতই আছেন তিনি। বয়স এখন চুয়ান্ন বছর। হয়তো এক দৌড়ে ঘুরে আসতে পারবেন দশ মাইল। পরনে সাদা সুতির শার্ট ও নীল জিন্সের প্যান্ট। মিলিটারি কায়দায় ছেঁটেছেন মাথার চুল। কপালে অবশ্য বেড়েছে কয়েকটা ভাঁজ। কী যেন বদলে গেছে তাঁর ভেতর। চোখে কীসের এক কালো ছায়া ও অসীম শূন্যতা।
‘তীরধনুকে লিণ্ডা অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন, ‘ বললেন কর্নেল, ‘গত বছর ওই প্রতিযোগিতা দেখতে গিয়েই ওর সঙ্গে পরিচয়।’ মাথা তাক করে স্ত্রীকে দেখালেন তিনি। ঠোঁটে ফুটল দুঃখী হাসি। ‘এগারো মাস আগে ওকে বিয়ে করি।’
চট্ করে রাফেলার ডুপ্লিকেটকে দেখে নিয়ে কর্নেলের দিকে তাকাল রানা। ওর বাড়িয়ে দেয়া হাত ধরে ঝাঁকিয়ে দিলেন ব্রাউন। ‘রানা, কতদিন পর দেখা!’
‘অন্তত তিনবছর,’ বলল রানা।
‘বহুবার ভেবেছি তোমার কথা,’ বললেন কর্নেল। ‘কিন্তু তুমি ব্যস্ত বলে আর বিরক্ত করিনি।’
রানার মনে পড়ল জেনি ব্রাউনের কথা। তবে কর্নেলের নতুন স্ত্রী উপস্থিত রয়েছেন, তাই তাঁর মৃত্যু নিয়ে কিছুই বলল না।
‘বুঝতে পারছি, কত শত কাজ ফেলে আমার ডাকে এসেছ, সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ,’ কৃতজ্ঞ স্বরে বললেন ব্রাউন।
‘জানতাম আপনি ভাল নাবিক,’ বলল রানা। ‘তবে ভাবতে পারিনি ডিযাইন করেছেন এত বড় ইয়ট।’
‘আসলে হবিটা হয়ে গিয়েছিল পেশা,’ নরম সুরে বিনয়ের সঙ্গে বললেন ব্রাউন। ‘তরুণ বয়সে টের পেলাম, আমার মাথা খেলে ইয়ট ডিযাইন ও তৈরির বিষয়ে। তবে ব্যবসা শুরু করেছি রিটায়ারমেন্টের পর।’ হাতের ইশারায় বিস্তৃত ডেক দেখালেন। ‘আমার ছোট্ট বহরের সেরা ইয়ট সেইবার। ক্লায়েন্টদের জন্যে তৈরি করি ইয়ট। এ ছাড়া, ইয়টের চার্টার বিষনেসও করি।’
‘তা হলে ভাল ভাবেই চলছে সব,’ বলল রানা।
‘সব নয়,’ বললেন ব্রাউন, ‘ব্যবসায় কপাল ভাল ছিল। টাকার অভাব হয়নি।’ কালো এক ছায়া পড়ল মুখে। চোখে হঠাৎ করেই দেখা দিয়েছে গভীর দুঃখের ছাপ।
‘আপনি আসলে ব্যবসার কোনও কারণে আমাকে ডেকে আনেননি,’ বলল রানা।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কর্নেল। ‘ঠিকই বলেছ, রানা। তুমি এত দূর থেকে এসেছ বলে আমি কৃতজ্ঞ। একটা ব্যাখ্যা প্রাপ্য তোমার। একটু পর বলছি কী সাহায্য চাইছি। চলো, আমার স্টাডিতে গিয়ে বসি।’ কমপ্যানিয়নওয়ে দেখালেন তিনি।
রানার চোখে পড়ল, ওর দিকেই চেয়ে আছে লিণ্ডা ব্রাউন। মুখে দুর্দান্ত মিষ্টি একটুকরো হাসি।
প্রচুর মিল মেয়েটার সঙ্গে রাফেলা বার্ডের।
স্বাধীনচেতা।
রূপসী।
গুণী।
হয়তো রাফেলার মতই নিষ্ঠাবতী।
মুগ্ধ হবে যে-কোনও পুরুষ।
প্রাক্তন কর্নেলের পিছু নিয়ে নিচের ডেকে নামল রানা। দেখার মত সুন্দর ইয়টের ভেতরটা। চারপাশের দেয়ালে বার্নিশ করা দামি কাঠের প্যানেল। মেঝেতে পুরু কার্পেট। রানাকে কয়েকটা করিডোর ঘুরিয়ে একটা দরজা খুললেন ব্রাউন। ‘এটা আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। এখানে বিরক্ত করবে না কেউ। এসো, রানা।’
কর্নেলের পর প্রকাণ্ড ঘরে পা রাখল রানা। চার দেয়ালে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত বুকশেলফে দামি সব বই। কী নেই! শেকসপিয়ার, মিল্টন, ভার্জিল…
একদিকের বুকশেলফে সামরিক ইতিহাসের সারি সারি বই। আরেকদিকে প্রাচীন আমল থেকে বর্তমানে লেখা নৌচালনার ওপর বই। দেয়ালের যেসব জায়গায় বুকশেলফ নেই, সেখানে মেঝে থেকে স্কাইলাইট পর্যন্ত সোনাপানি করা ফ্রেমে বাঁধানো উনিশ শতকের রণতরীর তৈলচিত্র ঝুলছে।
ইশারায় দুটো বার্গাণ্ডি চেস্টারফিল্ড চেয়ার দেখালেন কর্নেল। ‘প্রিয়, বোসো, রানা।’
বসল ও। চেয়ারের চামড়াটা বরফের মত শীতল ঠেকল ওর পিঠে। ড্রিঙ্কে চুমুক দিয়ে তাকাল কর্নেলের দিকে। বুঝতে পারছে, বহু কথা জমেছে মানুষটার মনে। কিন্তু তিনি জানেন না কোথা থেকে শুরু করতে হবে।
‘বলুন, কর্নেল, যে কারণে ডেকেছেন,’ বলল রানা।
‘ফোনে কিছু জানাইনি বলে কিছু মনে কোরো না,’ বললেন কর্নেল। ‘আসলে চেয়েছি সামনা-সামনি কথাটা বলব।’ চকচকে অ্যান্টিক সাইডবোর্ডের সামনে গিয়ে থামলেন তিনি। ওখানে ফোটোর রুপালি সব ফ্রেম। রানা দেখল অপরূপ সাগরের ছবি। নীল জলে ভাসছে দুর্দান্ত সুন্দর সাদা ইয়ট। এ ছাড়াও সাইডবোর্ডে রয়েছে পারিবারিক কিছু ছবি। সেগুলোর ভেতর থেকে একটা তুলে নিলেন কর্নেল ব্রাউন। কয়েক মুহূর্ত দেখার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়িয়ে দিলেন রানার দিকে। ‘ছবিটা দেখো।’
ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ওদিকে মনোযোগ দিল রানা। এক লোকের ছবি। বয়স হবে ওর সমানই। সাতাশ কি আটাশ। হালকা শরীর। চোখে ভারী চশমা। পাতলা হয়েছে মাথার ধূসর চুল। এরই ভেতর গজিয়ে গেছে মাঝারি আকৃতির একটা নধর ভুঁড়ি। দু’কাঁধ অস্বাভাবিক সরু।
রানা বুঝে গেল, জীবনে বুক ডনের ধারকাছ দিয়েও যায়নি এ লোক।
‘আমার ছেলে মডাক,’ বিড়বিড় করে বললেন কর্নেল ব্রাউন।
বিস্ময় নিয়ে মুখ তুলে তাকাল রানা। শুনেছে কর্নেল ব্রাউনের ছেলে আছে, তবে সে যে এই লোক, ভাবতেও পারেনি।
যেন রানার মন পড়ছেন কর্নেল। ‘শারীরিকভাবে মায়ের মত হয়েছিল। আমার মত মিলিটারিতে সুযোগ হয়নি ওর। আসলে চায়নি কঠিন জীবন।’
‘আপনি মর্ডাকের বিষয়ে অতীত কাল ব্যবহার করেছেন,’ বলল রানা।
মৃদু মাথা দোলালেন কর্নেল। ‘সহজেই ধরে ফেলেছ, তাই না? আসলে ওর ব্যাপারেই কথা বলব।’ চাপা আবেগের প্রকাশ ঘটল তাঁর কণ্ঠে, ‘ও মারা গেছে। আর সেজন্যেই সাহায্য চাইছি তোমার কাছে।’
‘দুঃখিত,’ কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা। ‘ভয়ঙ্কর ভাবে খুন হয়েছে।’
কর্নেল ব্রাউনের চোখে তাকাল রানা। শুধু ব্যথা নয়, মানুষটার দৃষ্টিতে প্রচণ্ড রাগের ছাপ। নিজেকে সামলে রাখতে চাইছেন। বড় করে কাঁপা শ্বাস ফেললেন তিনি। অস্বাভাবিক শীতল কণ্ঠে বললেন, ‘আরেকটা ড্রিঙ্ক নাও, রানা। বরাবরের মতই স্কচ, তা-ই না?’ ফ্রেমটা নিয়ে সাইডবোর্ডে রাখলেন তিনি। স্কচ উইস্কির বোতল খুলে কানায় কানায় ভরে দিলেন রানার গ্লাসটা। নিজেও একটা গ্লাসে মদ ঢেলে দুই ঢোকে শেষ করলেন সোনালি তরল। অপেক্ষা করছে রানা, কথা শুরু করবেন কর্নেল।
সামনের চেস্টারফিল্ড চেয়ারে বসলেন ব্রাউন। ‘গত দু’মাস আগে মিশরে খুন হয় মডাক। লাশ পাওয়া গেছে ওর ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে। বারবার আঘাত করা হয় ছোরা দিয়ে। দেহে ছিল ছত্রিশটা ক্ষত।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে শক্ত করে ধরেছেন গ্লাস। সাদা হয়েছে আঙুল। আবারও বোতল থেকে ড্রিঙ্ক ঢেলে এক ঢোকে সেটা শেষ করলেন। ঠাস্ করে গ্লাস রাখলেন টেবিলে।
ভদ্রলোককে দেখছে রানা। বুঝতে দেরি হয়নি, কীসের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। একমাত্র ছেলেটা খুন হয়েছে ভিন দেশে। তবে তিনি ঠিক কী চাইছেন, তা এখনও বুঝতে পারেনি ও। নরম সুরে বলল, ‘মিশরে কী করছিল মর্ডাক? ওখানেই বাস করত?’
মাথা নাড়লেন ব্রাউন। ‘মর্ডাক… আসলে…’ চুপ হয়ে গেলেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, ‘মডাক ছিল লণ্ডন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ইতিহাস পড়াত। বিশেষ করে ওর আগ্রহ ছিল পুবের ইতিহাসের ব্যাপারে। সেজন্যেই গিয়েছিল কায়রোয়। একবছরের ছুটি পেয়েছিল ইউনিভার্সিটি থেকে। রিসার্চ করছিল প্রাচীন মিশরের ওপর।’
চুপ করে আছে রানা।
‘পুলিশের ধারণা, ডাকাতির সময় বাধা দেয়ায় খুন হয়েছে ও,’ বললেন ব্রাউন। ‘হয়তো ডাকাত বা চোরকে চমকে দেয়। বা বাড়ি ফিরেই পড়ে যায় তাদের কবলে। আসলে কী হয়েছে, কেউ বলতে পারেনি। খুনের ব্যাপারে কোন গুরুত্ব দেয়নি কেউ। কাউকে ধরতে পারেনি কায়রো পুলিশ। আসলে সে চেষ্টাই হয়তো করেনি তারা।’
‘শুনে খুব খারাপ লাগছে,’ বলল রানা, ‘আমার কিছু করার থাকলে…’
‘তুমি পারো আমার একটা কাজ করে দিতে,’ মাঝ থেকে বলে উঠলেন ব্রাউন। পরস্পরের চোখে চোখ রেখে চেয়ে আছে ওরা।
কর্নেলের চোখে এখন গভীর বেদনা। কিন্তু সেটাকে ছাপিয়ে উঠছে ক্রোধ। আরও কিছু আছে চোখে। পরিকল্পনা করছেন প্রতিভাবান ট্যাকটিশিয়ান। মনের কষ্ট চেপে ঝড়ের বেগে ভাবছেন কীভাবে প্রতিশোধ নেবেন।
তাঁর বক্তব্য শোনার জন্যে অপেক্ষা করে আছে রানা। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন ব্রাউন, ‘তুমি হয়তো ভাবছ, কেন তোমাকে ডেকেছি। সত্যি কথা বলতে, আমি চাই আমার হয়ে একটা কাজ করে দেবে তুমি।’
‘বলুন, শুনছি,’ বলল রানা।
‘তুমি তো নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ, পুলিশের তদন্তে আমি সন্তুষ্ট নই,’ বললেন ব্রাউন। ‘আমি চাই তুমি কায়রো যাও, খুঁজে বের করো কারা করেছে এই কাজ। তারপর খুন করো ওদের।’
ছয়
‘খুবই দুঃখজনক, ছিনতাইকারীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়াটা,’ অ্যানিকে বলল মিলা ডওনি। তারা আছে সেইবারের ভিআইপি স্টেটরুমে। প্রাক্তন কর্নেলের লাইব্রেরি থেকে কামরাটা অনেক দূরে। ‘স্যান রেমো এমনিতে খুবই শান্ত শহর। কখনও শুনিনি কোনও মহিলার ওপর হামলা করেছে কেউ।’
মহিলার ইশারায় বিশাল এক খাটে শুয়েছে অ্যানি রবার্ট। বিড়বিড় করল, ‘ভাবাই যায় না কীভাবে ওই দুই ছিনতাইকারীকে শায়েস্তা করলেন মাসুদ রানা। তিনি যেন স্বর্গের দেবতা।’ আস্তে করে চোখ বুজে ফেলল সে।
বেডের পায়ের দিক থেকে অ্যানিকে দেখল মিলা ডওনি। ‘এত বড় বিপদ থেকে রক্ষা করলে যে কাউকে দেবতা বলেই তো মনে হওয়ার কথা। ঠিক আছে, তুমি একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। অনেক ধকল গেছে তোমার ওপর দিয়ে। …আমার ভুল না হলে অন্তত একঘণ্টা আলাপ করবেন মিস্টার রানা আর কর্নেল ব্রাউন। ঘণ্টাখানেক পর একবার দেখে যাব তোমাকে।’
‘অনেক ধন্যবাদ,’ ঘুম-ঘুম স্বরে বলল অ্যানি।
‘তীরে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ো। শক জিনিসটা ভাল নয়। ঠিক আছে?’
‘ঠিক আছে।’
‘পরে দেখা হবে। বিশ্রাম নাও।’ আর্ম চেয়ার থেকে একটা কম্বল নিয়ে ভাঁজ খুলে অ্যানির ওপর বিছিয়ে দিল মিলা ডওনি। ‘শীত লাগলে চেয়ারে সোয়েটার পাবে। পরে নিয়ো।’
‘ধন্যবাদ,’ বিড়বিড় করল অ্যানি। ‘পরে দেখা হবে।’
প্রাচ্যের কার্পেট মাড়িয়ে স্টেটরুম থেকে বেরিয়ে গেল মিলা ডওনি। পেছনে আটকে দিল দরজা। দরকারি কাজ পড়ে আছে তার।
বিলাসবহুল বিশাল ঘরে চুপ করে শুয়ে আছে অ্যানি। দূরে হারিয়ে গেল মিলা ডওনির পায়ের আওয়াজ। তবে মহিলা চলে গেছে বুঝতেই চোখ মেলে উঠে বসল অ্যানি। গা থেকে সরিয়ে দিল কম্বল। সতর্ক চোখে দেখল ঘরটা। নেমে পড়ল বিছানা ছেড়ে। চলে গেল মিলা ডওনির রেখে যাওয়া ওর জুতো ও হ্যাণ্ড ব্যাগের কাছে। ব্যাগ থেকে নিল অ্যামার পাফার।
কয়েক মুহূর্ত নীল রঙের ছোট্ট প্লাস্টিকের পাম্পটা দেখল অ্যানি। পাম্প থেকে মুচড়ে খুলল নিচের অ্যালিউমিনিয়ামের টিউব। পাফারের ভেতরে সালবুটামল নেই। তর্জনী ভরে দিল টিউবের ভেতর। তিন সেকেণ্ড পর বুড়ো আঙুল ও তর্জনী দিয়ে বের করল ছোট্ট এক ইলেট্রনিক ডিভাইস। ওটার তারের আরেক প্রান্তে রয়েছে খুব খুদে ইয়ারপিস। কানে মাইক গুঁজে দিল অ্যানি। সাবধানে চালু করল ডিভাইস।
পৃথিবীর বহু মাইল ওপরে জিপিএস সিগনাল পৌঁছে সেখান থেকে চলে গেল তার গন্তব্যে। অ্যানি ভাল করেই জানে, ওর রিপোর্টের জন্যে অধীর অপেক্ষায় রয়েছে সঙ্গীরা। এখন পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক চলছে।
‘আমি সেইবার ইয়টে,’ ফিসফিস করল অ্যানি।
‘ঠিক আছে,’ বলল একটা পুরুষকণ্ঠ।
‘চারপাশ ঘুরে দেখতে বেরোব।’
‘সাবধান,’ বলল লোকটা। ‘ধরা পোড়ো না।’
‘চিন্তা কোরো না,’ বলল অ্যানি। ‘আউট।’
ডিভাইসের সুইচ অফ করে কান থেকে ইয়ারপিস সরাল অ্যানি। দু’আঙুলে পেঁচিয়ে নিল তার। ডিভাইস, ইয়ারপিস ও তার গেল অ্যালিউমিনিয়ামের টিউবের ভেতর। ওপরের প্লাস্টিকের অ্যাযমা পাম্প আটকে নিল সালবুটামল বটলে। ওটা গেল অ্যানির পকেটে। সাবধানে এগিয়ে সামান্য ফাঁক করল দরজা। উঁকি দিল বাইরে। ডানে-বামে দেখে নিয়ে বেরিয়ে এল নির্জন করিডোরে। ধক-ধক করছে হৃৎপিণ্ড। ও ভাল করেই জানে, যা করার করতে হবে খুব দ্রুত। তবে ভরসার কথা, জানা আছে ঠিক কোথায় কী খুঁজতে হবে ওকে।
.
নীরবে পরস্পরের দিকে চেয়ে আছে মাসুদ রানা এবং প্রাক্তন কর্নেল জন ব্রাউন। খালি হয়েছে রানার গ্লাস। ওটা রেখেছে হাঁটুর ওপর। ভাবছে, কীভাবে শুরু করবে কথা। আরও কয়েক মুহূর্ত পেরোবার পর বলল, ‘কর্নেল, আমি আসলে হিটম্যান নই।’
বোতল নিয়ে দু’জনের গ্লাসে আবার উইস্কি ঢাললেন ব্রাউন। ‘তা জানি। তবে আগেও কখনও কখনও প্রতিশোধ নিয়েছ তুমি।’
‘আমি বাউন্টি হান্টারও নই,’ বলল রানা। ‘মানুষ খুন করার জন্যে কোনও চুক্তি করি না।’
‘তবে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে তোমার হাতে খুন হয়েছে অনেকে,’ বললেন কর্নেল, ‘হয়নি?’
‘আত্মরক্ষার জন্যে খুন করেছি,’ বলল রানা।
‘আগে আমার কথা শুনে নাও, রানা,’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্রাউন, ‘তারপর না হয় …’
‘বেশ, বলুন, চেয়ারের পিঠে হেলান দিল রানা।
চেয়ার ছেড়ে দেয়ালে ঝুলন্ত এক তৈলচিত্রের সামনে গেলেন কর্নেল। সোনাপানি করা ফ্রেমের ভেতরে ঝড়ের সাগরে পাল তোলা দুই রণতরী মুখোমুখি হয়েছে যুদ্ধের জন্যে। ধূসর মেঘ থেকে ঝলসে উঠছে নীল বিদ্যুৎ। কামান থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে সাদা ধোঁয়া। ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে পাল। মনোযোগ দিয়ে দৃশ্যটা দেখছেন জন ব্রাউন। একটু পর বললেন, ‘আমার ছেলের ব্যাপারে তোমাকে কিছু কথা বলব, রানা। ও ছিল বুদ্ধিমান একজন দার্শনিক। লড়াকু মনের ছিল না। চেষ্টা করেছিল আমাকে অনুকরণ করে মিলিটারিতে যোগ দিতে। কিন্তু নরম মানুষ বলে ওখানে ওর ঠাঁই হয়নি। শারীরিক ভাবে দুর্বল হলেও বুদ্ধিহীন ছিল না। তবে কখনও সিরিয়াস হয়নি নিজের পেশায়। কখনও দেখিনি কোনও কিছু নিয়ে লেগে থাকতে। আর এ কারণে ওর ওপর ছিলাম খুব বিরক্ত। এটা হয়তো আমার দোষ। আর সেজন্যে চরম শাস্তি পেতে হয়েছে আমাকে।’
ঘুরে তাকালেন ব্রাউন। ‘কোনওদিনই বুঝিনি, আসলে কী চায় মডাক। কিন্তু অন্তর থেকে আমাকে ভালবাসত। চাইত, একদিন দারুণ কিছু করে দেখাবে। আর সত্যিই একদিন রিসার্চ করতে গিয়ে পেল পছন্দমত বিষয়।’ চুপ হয়ে গেলেন ব্রাউন।
‘কী ধরনের বিষয়?’ জানতে চাইল রানা। অপেক্ষা করছে নতুন তথ্যের জন্যে।
‘ওর মনটা ছিল অ্যাকাডেমিক,’ বললেন প্রাক্তন কর্নেল। ‘এ ধরনের মানুষ বিজয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। অল্প কিছু পেয়েই খুশি হয়। মর্ডাক মিশরে পেল প্রাচীন আমলের কিছু। কোনও ধরনের প্যাপাইরাস। ওটা হয়তো সেই সময়ের সামান্য কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় স্ক্রিপ্ট। তা-ও তিন হাজার বছর আগের। আমাকে খুলে বলতে চেয়েছিল, তবে মনোযোগ দিইনি বলে প্রায় কিছুই মনে নেই। অথচ, আমার ছেলেটার কাছে ওটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘তার মানে কায়রোয় গিয়ে রিসার্চ করছিল ওই বিষয়ে?’
মাথা দোলালেন ব্রাউন। ‘অনেক দিন ধরেই রিসার্চ করছিল ইংল্যাণ্ডে বসে। তারপর ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি পেয়েই চলে গেল কয়েক মাসের জন্যে। সঙ্গে ছিল ওর রিসার্চ করা সব মেটারিয়াল। কিন্তু তারপর যখন ওর লাশ পাওয়া গেল, রিসার্চের পেপার বা কিছুই ছিল না ওই অ্যাপার্টমেন্টে। ওর ঘড়ি নিয়ে গেছে। মানিব্যাগ আর ক্যামেরাও। কাপড়চোপড়, ব্রিফকেস, ল্যাপটপ- কিছুই পাওয়া যায়নি। ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, খামোকা মরল আমার ছেলেটা। সম্মান পেল না কোথাও। অথচ, ওর যোগ্যতা ছিল নাম করা প্রফেসর হওয়ার। চুরি-ডাকাতির সময় একদল খুনি শেষ করে দিল সুশিক্ষিত সম্ভাবনাময় এক যুবককে।’
কিছু বলার নেই, চুপ করে থাকল রানা।
‘মেনে নিতে পারিনি ছেলের মৃত্যু,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন জন ব্রাউন। ‘আরও বেশি কষ্ট পাচ্ছি, পৃথিবীর বুকে কোথাও থাকবে না ওর আবিষ্কার করা কোনও কীর্তি। আমার ছেলে যেন একটা মাছি। ইচ্ছে হলো, আর এক চাপড়ে মেরে ফেলল কেউ। আর সেজন্যেই চাই ওর কথা যেন মনে রাখে মানুষ। যা-ই আবিষ্কার করে থাকুক, সেটা নিয়ে যেন আলাপ করে অ্যাকাডেমিকরা। যেন নিজের সম্মানটা পায় মর্ডাক।’ আবারও ফ্রেমটা তুলে নিয়ে দেখলেন ব্রাউন। আবেগের ছাপ পড়ল চেহারায়। ‘আমরা কেউ মারা গেলে দলের আর সব সৈনিক তার কথা মনে রাখে। অথচ, কোথাও চিহ্ন নেই আমার ছেলের। রানা, আমি শুধু সেটুকুই চাইছি।’
‘বুঝতে পেরেছি কী বলেছেন, কর্নেল,’ কয়েক মুহূর্ত পর বলল রানা। ‘আপনি মর্ডাকের রিসার্চ মেটারিয়াল ফেরত চাইলে, সেক্ষেত্রে ওগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারি। তবে খুনের বদলা নেয়া আমার কাজ নয়।’
‘কিন্তু আগেও তো খুন করেছ, রানা,’ বললেন ব্রাউন।
‘সেটা করেছি আত্মরক্ষার জন্যে,’ বলল রানা। ‘গায়ে পড়ে কাউকে খুন করিনি।’
মুহূর্তের জন্যে জ্বলে উঠল প্রাক্তন কর্নেলের দু’চোখ। ‘একবার ভেবে দেখেছ, রানা, ওই খুনিরা আসলে কারা? আবর্জনা থেকে উঠে এসেছে। এদের নিকেশ করলে সেটা হবে পৃথিবীর উপকার করা। আমি কৃতজ্ঞ হব আমার কাজটা তুমি করে দিলে।’
কৃতজ্ঞ কথাটা যেন চাবুকের মত লাগল রানার বুকে। মুহূর্তে ফিরল কয়েক বছর আগে। সেই জঙ্গল। রাতের আঁধার। আগুন। চিৎকার। গুলি। মুখ তুলে তাকাল রানা। ‘কর্নেল, আমি ভুলে যাইনি ষোলো সালের এপ্রিল মাসের চার তারিখের কথা।’
‘তোমার কাছ থেকে পাল্টা উপকার চাইনি, রানা, ‘ বললেন ব্রাউন। ‘সেজন্যে তোমাকে ফোন দিইনি। মনে করি না যে আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকার কোনও কারণ আছে তোমার। আমার কথা কি বুঝতে পেরেছ, রানা? বিশ্বাস করতে পারো আমার কথা।’
চুপ করে থাকল রানা।
তোমাকে ফোন দিয়েছি, কারণ পৃথিবীতে তুমি একমাত্র মানুষ, যাকে বিশ্বাস করতে পারি,’ বললেন ব্রাউন। ‘এমন একজন, যে শেষ করতে পারবে এই গুরুদায়িত্ব। নিজে আমি পারব না। বয়স হয়ে গেছে। একদল পশুকে খুন করতে গিয়ে নিজেই খুন হব।’
কর্নেল থেমে যাওয়ার পরেও নীরব থাকল রানা।
‘খরচের টাকা বা পারিশ্রমিক দিতে কোনও সমস্যা নেই,’ বললেন ব্রাউন। ‘পয়সা এখানে কোনও বিষয় নয়। যে-কোনও অঙ্কের টাকার কথা বলতে পারো।’
দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকল রানা, তারপর বলল, ‘আমাকে একটু ভাবার সময় দিন, কর্নেল।’
‘তাতে সমস্যা নেই,’ বললেন ব্রাউন। ‘হঠাৎ করে তোমার কাঁধে কাজ চাপিয়ে দিতে চাইছি বলে দুঃখিত। আসলে আমার তো আর কিছুই করার নেই, তাই…’
একটা কথা পরিষ্কার করে বলছি,’ বলল রানা। ‘আমি যদি দায়িত্ব নিই, সেজন্যে কোনও পারিশ্রমিক নেব না।’
‘জানতাম এ কথাই বলবে,’ বললেন কর্নেল। ‘খরচের টাকা তো দেবই, তুমি চাইলে পারিশ্রমিক দিতেও দ্বিধা করব না।’
হাতঘড়ি দেখল রানা। দুপুর প্রায় দুটো বাজে। ‘বুঝতে পারছি, চট্ করে একটা জবাব চাইছেন আপনি। কিন্তু আমাকে বিকেল পর্যন্ত সময় দিন। ফোনে জানিয়ে দেব কী সিদ্ধান্ত নিলাম।’
মৃদু হাসলেন কর্নেল ব্রাউন। ‘ঠিক আছে, অনেক ধন্যবাদ। যে সিদ্ধান্তই তুমি নাও, আজ রাতে ডিনারে আসছ সেইবারে। কাজটা নেয়ার ব্যাপারে তুমি মানা করে দিলেও ক্ষোভ থাকবে না আমার মনে। আর যদি রাজি হও, হোটেল ছেড়ে এসে উঠবে এই ইয়টে। এরই ভেতর তোমার জন্যে একটা কেবিন গুছিয়ে রাখা হয়েছে। আজ রাত কাটাবে এখানে। হয়তো আমরা আলাপ করতে পারব তোমার কায়রো যাওয়ার ব্যাপারে।’
জবাব দিল না রানা। এরই মধ্যে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে কী করবে।
‘এসেছ বলে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ, রানা,’ বললেন কর্নেল। ‘অনেক দিন পর দেখা, খুবই খুশি হয়েছি।’ উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
তখনই টোকার আওয়াজ হলো দরজায়।
‘এক্সকিউয মি,’ গিয়ে দরজা খুললেন ব্রাউন। করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে পিএ মিলা ডওনি। হাতে মোবাইল ফোন। অন্য হাতে ভাঁজ করা সুতির নীল নেভি জ্যাকেট। ওটা নিজের বলে চিনতে পারল রানা।
‘বিরক্ত করেছি বলে দুঃখিত,’ বলল মহিলা। এবার নিচু স্বরে জানাল, ‘আপনাকে ফোন করেছেন মিস্টার হাসুনি কাযুহিরো।’
বিড়বিড় করে কাকে যেন অভিশাপ দিলেন ব্রাউন। মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে রানাকে বললেন, ‘আমার একটু সময় লাগবে, রানা। জাপানি টাইকুন। মহা মেজাজ। বিযনেস ডিল।’
ওপরের ডেকে দেখা হবে,’ বলল রানা।
স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেলেন কর্নেল। মিলা ডওনির সঙ্গে করিডোরে হাঁটতে শুরু করে বলল রানা, ‘অ্যানির কী খবর?’
‘বিশ্রাম নিচ্ছে,’ বলল কর্নেলের পিএ। ‘খুব শড়।’ রানার হাতে জ্যাকেট দিল সে। ‘জ্যাকেট আর লাগবে না ওর। ওকে নতুন পোশাক দিয়েছি।’
‘অনেক ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদের কিছু নেই। যা করার আপনিই করেছেন। উদ্ধার করেছেন মেয়েটাকে।’ হাসল মিলা ডওনি। ‘যাই, গিয়ে দেখি কী করছে। পাঠিয়ে দেব ডেকে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে।’
মৃদু মাথা দুলিয়ে বাইরের ডেকের দিকে চলল রানা। হাতের ভাঁজে ঝুলছে জ্যাকেট। ভারী হয়ে আছে মনটা। করিডোর পার হয়ে বেরিয়ে এল সোনালি রোদে। ঝিলমিল করছে নীল সাগর। পায়ের নিচে দুলছে ডেক। রেলিঙের পাশে গিয়ে থামল রানা। দূরে তাকাল দিগন্তের দিকে। উদাস লাগছে মন। পেছনে শুনতে পেল মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ: ‘হ্যালো?’
ঘুরে তাকাল রানা।
লিণ্ডা ব্রাউন। কাঁধে লুটিয়ে আছে এলো চুল। মৃদু হাওয়ায় উড়ছে। ঝিকিয়ে উঠছে রোদে। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল একগোছা চুল। মেয়েটার হাসি অপূর্ব। সাদা দাঁতগুলো নিখুঁত। চোখে কীসের এক ঝিলিক।
হঠাৎ করেই খুব সচেতন হয়ে উঠল রানা। যেন নতুন করে পরিচয় হচ্ছে রাফেলা বার্ডের সঙ্গে।
‘আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়নি কেউ,’ মিষ্টি হাসল মেয়েটা।
নরম কণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ান সুর টের পেল রানা। ‘মিসেস ব্রাউন,’ হাত বাড়িয়ে দিল ও।
হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল লিণ্ডা ব্রাউন।
রানা অনুভব করল, মেয়েটার ত্বক উষ্ণ এবং নরম। শক্ত হাতেই ধরেছিল ওর হাত।
‘প্লিয, আমাকে লিণ্ডা বলেই ডাকবেন।’
‘আমি মাসুদ রানা,’ বলল রানা।
‘আমার স্বামী আপনাকে রানা বলে ডাকেন।’
‘আপনিও আমাকে রানা বলে ডাকতে পারেন।’
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, রানা,’ খুশি হয়ে হাসল মেয়েটা।
রাফেলা বার্ডের কথা মন থেকে বিদায় করতে পারছে না রানা। ভাবতে শুরু করল, এবার কী বলবে। লিণ্ডা ব্রাউনের চোখে অদ্ভুত এক আলো, যেটা বহুদিন আগে দেখেছে রাফেলার চোখে। অস্বস্তিতে ভরে গেল রানার মন। কিছু বলতে হবে সেজন্যে জানাল, ‘ইয়টে এসেই আপনার টার্গেট প্র্যাকটিস দেখেছি। আশা করি কিছু মনে করেননি। লক্ষ্যভেদে আপনি খুবই ভাল।’
হাসল লিণ্ডা। ‘সাধ্যমত চেষ্টা করছি।’
‘আপনি তো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন।’
‘অসুস্থ ছিলাম বলে অলিম্পিকে অংশ নিতে পারিনি। আরও ভাল করতে হবে, নইলে যে-কোনও দিন প্রতিযোগিতায় হেরে যাব।’
মেয়েটা চুপ হয়ে যাওয়ায় দু’জনের মাঝে নামল নীরবতা।
‘আপনি জনের সঙ্গে এসএএস ফোর্সে ছিলেন?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘আগে কখনও ওর রেজিমেন্টের কারও সঙ্গে দেখা হয়নি আমার।’
কথা না বাড়িয়ে কাঁধ ঝাঁকাল রানা।
‘আপনি বোধহয় আর্মির ব্যাপারে আলাপ করতে পছন্দ করেন না?’
‘ঠিক তা নয়,’ বলল রানা। ‘আসলে আমি ছিলাম বাংলাদেশ আর্মিতে।’
‘জনের সঙ্গে পরিচয় হলো কী করে?’
‘প্রথমবার নাম করা এক মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তখন কর্নেল ব্রাউন ছিলেন এসএএস ফোর্সে। তাঁর নেতৃত্বে ছিল একটা গ্রুপ। তাদের সঙ্গে আমার ইউনিটের প্রতিযোগিতা চলছিল।’
‘তা-ই? কারা জিতেছিল?’
‘নানান ধরনের প্রতিযোগিতার ফলাফল বিচার করার পর যৌথভাবে পুরস্কার দেয়া হয় দুই ইউনিটকে।’
‘আপনাকে খুব সম্মানের চোখে দেখে জন, বলল লিণ্ডা। একটু থেমে জানতে চাইল, ‘ছেলের ব্যাপারে কিছু বলেছে ও?’ আস্তে করে মাথা নাড়ল মেয়েটা। ‘খুব দুঃখজনক মৃত্যু।’
‘মর্ডাককে চিনতেন আপনি?’
‘খুব ভাল ভাবে নয়,’ বলল লিণ্ডা। ‘মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে। পরস্পরকে এড়িয়ে চলত জন আর মডাক। নিজের চেয়ে বয়সে ছোট সত্মা নিয়ে আপত্তি ছিল মর্ডাকের।’
চুপ করে থাকল রানা।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর নিচু গলায় বলল লিণ্ডা, ‘আমি জানি, আপনার কাছ থেকে কী চাইছে জন।’
বিস্মিত হয়েছে রানা। নরম সুরে বলল, ‘জানেন?’
‘আমাকে সবই খুলে বলেছে। মিশরে গিয়ে আপনি যেন ওর হয়ে মর্ডাকের জিনিসপত্রগুলো সংগ্রহ করেন।’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা।
‘নিজের ছেলে যেখানে খুন হয়েছে, সেখানে হাজির হওয়াও বোধহয় খুব কঠিন,’ বলল লিণ্ডা ব্রাউন। ‘মর্ডাকের শেষ স্মৃতি হিসেবে ওর জিনিসপত্রগুলো ফেরত চাইছে জন।’ রানা বুঝে গেল, সব খুলে বলেননি কর্নেল। শুনলে মেয়েটা হয়তো ভাববে, তার স্বামী আসলে একজন খুনি।
‘লাশ শনাক্ত করার সময় কায়রোয় জনের পাশে ছিলাম,’ বলল লিণ্ডা। ‘কী ভয়ঙ্কর মৃত্যু! বেচারা জন। খুব খুশি হব আপনি ওকে সাহায্য করলে, রানা।
‘আমি এখনও জানি না কোনও কাজে আসব কি না,’ বলল রানা।
একবার ওর চোখ দেখে নিয়ে দূর সাগরে দৃষ্টি ফেলল লিণ্ডা।
আবারও বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিবেশ।
‘আপনাদের কোথায় প্রথম দেখা হয়?’ নীরবতা ভাঙল রানা।
‘বছরখানেক আগে সিডনিতে। তখন একটা দাতব্য সংগঠনের হয়ে কাজ করছিলাম। আমাদেরকে সাহায্যের জন্যে সেসময় সেইবার ইয়ট বিনে পয়সায় দেয় জন।’
‘আমি ভেবেছিলাম আপনি পেশাদার তীরন্দাজ।
হেসে ফেলল লিণ্ডা ব্রাউন। ‘না, তা নই। চাকরি করতাম একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে। আর তারপর তো বিয়ে হয়ে গেল ওর সাথে।’ ঘুরে রানাকে দেখল মেয়েটা। কী যেন বলতে গিয়েও চেপে গেল।
তখনই ডেকের আরেক পাশ থেকে জন ব্রাউনের গলা শুনল ওরা। অ্যানি রবার্টসকে নিয়ে এগিয়ে আসছেন তিনি। মেয়েটাকে আগের চেয়ে সুস্থ মনে হলো রানার। রঙ ফিরেছে অ্যানির গালে।
চট্ করে তাকে দেখল লিণ্ডা ব্রাউন। ঘুরে তাকাল রানার দিকে। ‘উনি কি আপনার স্ত্রী, রানা?’
‘না,’ বলল রানা।
‘তা হলে গার্ল ফ্রেণ্ড?’
‘তা-ও নয়। আমি আসলে ওকে চিনি না।’
ভুরু কুঁচকে গেল লিণ্ডার। ‘কিন্তু আপনার সঙ্গে না এসেছে এই ইয়টে?’
‘সে দীর্ঘ কাহিনী,’ বলল রানা। পেছনে শুনল পানিতে লঞ্চের ইঞ্জিনের তৈরি বগ-বগ আওয়াজ। বোর্ডিং প্ল্যাটফর্মে ভিড়েছে গ্যারি স্যাণ্ডার্স। লঞ্চে করে পৌঁছে দেবে তীরে।
রানার সামনে থেমে আরেকবার হ্যাণ্ডশেক করলেন ব্রাউন। নরম সুরে বললেন, ‘মনে রেখো, রানা, যে সিদ্ধান্তই তুমি নাও, আমাদের বন্ধুত্ব কখনও ম্লান হবে না। আশা করি, সন্ধ্যার পর দেখা হবে ডিনারে। অ্যানির দিকে ঘুরে বললেন তিনি, ‘খুশি হলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, মিস রবার্ট। আশা করি সাবধানে থাকবেন। এখন তো জানেন, খারাপ লোক আছে স্যান রেমো শহরে।’
লালচে হলো অ্যানি রবার্টসের দুই গাল। ‘বিপদের সময় আশ্রয় দিয়েছেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ, স্যর। কৃতজ্ঞ রইলাম মিলা ডওনির প্রতিও। আপনারা অনেক ভাল।’
‘এসব বলে লজ্জায় ফেলবেন না, মাই ডিয়ার,’ হাসলেন কর্নেল।
‘এবার যাওয়া যাক?’ বলল রানা। অ্যানির বাহু ধরে লঞ্চে নামতে সাহায্য করল। লিণ্ডা ব্রাউনের কাছ থেকে বিদায় নিতে ওপরে তাকাল। কিন্তু কেন যেন রেলিঙের কাছ থেকে সরে গেছে কর্নেলের অপরূপা স্ত্রী।
সাত
রানা ও অ্যানিকে জেটিতে পৌঁছে দিল গ্যারি স্যাণ্ডার্স। ট্যাক্সি ডাকার জন্যে মোবাইল ফোন বের করল রানা। তবে চোখে পড়ল এইমাত্র তীরবর্তী সড়কে থেমেছে হলদে এক ক্যাব।
‘ওটাতে চেপে’তোমার হোটেলে যেতে পারব,’ অ্যানিকে বলল রানা।
‘কর্নেল ব্রাউন সব দিকেই খেয়াল রাখেন, তাই না?’ বলল অ্যানি।
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
ক্যাবে চেপে স্যান রেমোর মাঝামাঝি পৌঁছল ওরা। ড্রাইভার ওদেরকে নামিয়ে দিল অ্যানির হোটেলের সামনে। মেয়েটার সঙ্গে লবি পর্যন্ত এল রানা।
‘জানি না কীভাবে আপনাকে ধন্যবাদ দেব,’ বলল অ্যানি। ‘আপনি না থাকলে সৈকতে আজ খুনই হয়ে যেতাম।’
মানিব্যাগ বের করে ওটা থেকে নিজের কার্ড নিয়ে মেয়েটার হাতে দিল রানা। ‘এখানে আমার মোবাইল ফোন নম্বর পাবে। মনে করি না দরকার পড়বে। তবে কোনও সাহায্য লাগলে দ্বিধা কোরো না।’
‘বেশ,’ লালচে হলো অ্যানির গাল। গোড়ালিতে ভর করে টুপ্ করে একটা চুমু দিল রানার গালে। ঘুরে দরজা পেরিয়ে ঢুকে পড়ল হোটেলে।
রাস্তায় বেরিয়ে নিজের হোটেলের দিকে চলল রানা। ভাবছে, কী জবাব দেবে কর্নেলকে? ওর পেশা খুন করা নয়। ওদিকে চিরকালের জন্যে মানুষটার কাছে ও কৃতজ্ঞ। কেন যেন নিজেকে খাঁচায় বন্দি অসহায় জানোয়ার বলে মনে হলো ওর।
সোজা হোটেলে ফিরে নিজের কামরায় গেল রানা। শুয়ে পড়ল বিছানায়। মনে ভিড় করল ষোলো সালের এপ্রিল মাসের চার তারিখের স্মৃতি। কর্নেল জঙ্গলে সাহসিকতার সঙ্গে না লড়লে আজ বেঁচে থাকত না ও।
ওই রাতের কথা কখনও ভুলবে না রানা। মাঝে মাঝেই ঘুমের ভেতর আসে সেই দুঃস্বপ্ন।
চোখ বুজতেই রানা দেখল সেসব দৃশ্য।
যেন মাত্র গতকাল রাতে ঘটেছে ওই মৃত্যু বিভীষিকা।
.
চলছে কঙ্গোর কিভু এলাকায় বিদ্রোহী সৈনিকদের সঙ্গে সরকারী আর্মির বিরোধ। খুন হচ্ছে শত শত নিরপরাধ মানুষ।
ওই অঞ্চলে মেডিকেল সাহায্য দেয়ার জন্যে ইউএন থেকে পাঠানো হয়েছিল বেশ কয়েকজন বাঙালি ও ব্রিটিশ ডাক্তার ও নার্সকে।
ক’দিন পর দৈনিক পত্রিকার পাতায় এল: কিডন্যাপ করা হয়েছে মানুষগুলোকে।
মুক্তিপণ হিসেবে বিদ্রোহী সৈনিকদল ইউএন-এর কাছ থেকে চাইল এক বিলিয়ন ডলার
কিন্তু ইউএন থেকে জানানো হলো, টাকার বিনিময়ে জিম্মিদেরকে ছুটিয়ে নেবে না তারা।
ঠিক হলো শক্তি প্রয়োগ করা হবে অমানুষগুলোর ওপর।
যেহেতু বাংলাদেশ ও ব্রিটেনের নাগরিকদের আটক করেছে, তাই ইউএন থেকে চাওয়া হলো ওই দুই দেশের আর্মি অফিসার ও সৈনিক।
তোলপাড় শুরু হলো দুই সরকারের ভেতর।
দুই দেশের আর্মির ষোলোজন অফিসার ও সৈনিককে ইউএন থেকে পাঠানো হলো কঙ্গোতে।
সেসময় বাংলাদেশি সোলজারদের নেতৃত্ব দেবার জন্য বিসিআই থেকে মাসুদ রানাকে চেয়ে নিয়েছিল ইউনাইটেড নেশনস।
ব্রিটিশ আর্মির তরফ থেকে দলনেতা দলনেতা ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রাউন।
যেহেতু আগে থেকেই পরস্পরকে চেনে, তাই ধরে নেয়া হয়েছিল সমঝোতা করে কাজ করবে দুই দেশের সৈনিকদল।
কিনশাসা পৌছুবার পর ওরা জানল, বিদ্রোহী মিলিটারি ফোর্সের নেতা তেত্রিশ বছর বয়সী এক মেজর। নাম বাবুনা গুন। তার প্রিয় শখ মানুষের হাত-পা ও মাথা ছোরা দিয়ে কেটে নেয়া। কয়েকটা গ্রামের প্রত্যেককে খুন করেছে স্রেফ মজা পাওয়ার জন্যে। কিভু এলাকায় ড্রাগ অ্যাডিক্ট বানিয়ে নিজেদের দলে আট-দশ বছর বয়সী ছেলেদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে সে। বিবেক বলতে কিছুই নেই কারও। বাচ্চাদের হাতে অটোমেটিক রাইফেল তুলে দিয়ে নির্দেশ দিচ্ছে: এলাকায় বাইরের কাউকে দেখলেই বুক ঝাঁঝরা করে দিবি।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রাউন ও মাসুদ রানার দায়িত্ব ছিল জিম্মিদেরকে নিরাপদে কিনশাসায় পৌঁছে দেয়া এবং বাবুনা গুনকে গ্রেফতার করা। আগে থেকেই এই দুই সৈনিকদলের জন্যে তথ্য সংগ্রহ করছিল এমআইসিক্স। দেড় সপ্তাহ পর জানা গেল, একটা গির্জার কাছে জঙ্গলে আটকে রাখা হয়েছে ডাক্তার ও নার্সদেরকে। আপাতত অন্য এলাকায় লড়তে আর্মির বেশিরভাগ সৈনিক পাঠিয়ে দিয়েছে বাবুনা গুন ও তার সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড ক্যাপ্টেন প্যাট্রিক নানাঙ্গা। গির্জার যাজক ও নানদের খুন করে গির্জায় ঘাঁটি গেড়েছে এখন।
সে সন্ধ্যায় আরএএফ ফোর্সের একটা চিনুক হেলিকপ্টারে চেপে ওই জঙ্গলে নামল রানা ও ব্রাউনের সৈনিকরা। ভীষণ উত্তপ্ত পরিবেশ। ক্যাকাম্যালা ক্রিকে সেই গির্জার কাছে পৌঁছুল ওরা রাত এগারোটার দিকে। প্ল্যান অনুযায়ী ঠিক ছিল, দু’দিক থেকে হামলা করবে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ ফোর্স। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ব্রাউনের দায়িত্ব ছিল জঙ্গলে ডাক্তার ও নার্সদের সরিয়ে নেয়া। আর রানার কাজ ছিল দলের সৈনিকদেরকে নিয়ে গির্জা আক্রমণ করা। মেজর বাবুনা গুন ও ক্যাপ্টেন নানাঙ্গার থাকার কথা ওখানেই।
কিন্তু কিছুক্ষণ পর ব্রাউন ও রানা দু’জনেই বুঝে গেল, সম্পূর্ণ ভুল তথ্য পেয়েছে ওরা। ওই এলাকায় রয়েছে অন্তত কয়েক শ’ বিদ্রোহী সৈনিক। হঠাৎ করেই জঙ্গলের আস্তানা থেকে বেরিয়ে ওরা হামলা শুরু করল ওই ষোলোজন অফিসার ও সৈনিকের ওপর। বুকে ঝুলছে কার্ট্রিজের বেল্ট। কোকেন খেয়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন তারা। একেকজন যেন সাক্ষাৎ ইবলিশ। জঙ্গলের মাঝে ঝলসে উঠতে লাগল মাযল ফ্ল্যাশ। মাত্র কয়েক মিনিটে কোণঠাসা হয়ে পড়ল এসএএস ফোর্স ও বাঙালি সৈনিকরা। গির্জার সামনে প্রতিরোধ গড়তে চাইল তারা। চারপাশে শত শত গুলি। একে একে লুটিয়ে পড়ছে বাংলাদেশি ও ব্রিটিশ সৈনিকরা। তবে হার মানতে রাজি হলো না তারা। বাবুনার দলের সৈনিকদের লাশ জমে স্তূপ হলো উঠানে। তবে বাঙালি ও ব্রিটিশ সৈনিকরা বুঝল, গুলি ফুরিয়ে আসছে বলেই শেষ পর্যন্ত করুণ ভাবে মরবে তারা। এমন উপায় নেই যে জিম্মিদেরকে উদ্ধার করবে, বা নিজেরা প্রাণে বাঁচবে। বড়জোর একঘণ্টার ভেতর এক এক করে জীবিত অফিসার ও সৈনিকদেরকে ম্যাচেটির কোপে টুকরো টুকরো করবে ড্রাগ অ্যাডিক্ট নরপশুর দল।
রানা দেখছে লুটিয়ে পড়ছে দলের সৈনিকরা। রকেট প্রপেল্ড গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে গেল বাংলাদেশ আর্মির সার্জেন্ট মিজান ও এসএএস কর্পোরাল অ্যান্ড্রিউ। রানার পাশে শুয়ে পাল্টা গুলি করছিল রেডিয়ো অপারেটর সার্জেন্ট আসাদ। রানা দেখল, গর্জে উঠছে পুরনো গির্জার একটু দূরের ছাউনিতে রাখা .৫০ ক্যালিবারের মেশিন গান। তখনই একে-৪৭-এর একরাশ গুলিতে ঝাঁঝরা হলো সার্জেন্ট আসাদ। নিজের শেষ গ্রেনেড ছাউনির দিকে ছুঁড়ল রানা। তিন সেকেণ্ড পর বিস্ফোরিত হলো ছাউনি। চারপাশ দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটছে হাজারো গুলি। আসাদের রেডিয়োটা নিয়ে এয়ার সাপোর্ট চাইল রানা। কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেল মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। কারণ, ওর কাঁধে এসে বিঁধল একটা বুলেট। হাত থেকে পড়ে গেল রেডিয়ো। ওটা বামহাতে তুলে পিছাতে চাইল রানা। এরপর থেকেই কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেল ওর স্মৃতি। দাউ-দাউ করে জ্বলছে গির্জা। চারপাশে রণহুঙ্কার। গুলি। আর্তনাদ। একে একে চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ছে ওর প্রিয় সৈনিকরা। দৌড়ে উঠানে ঢুকছে একদল কালো যোদ্ধা, হাতে রাইফেল বা ম্যাচেটি। রান্নার কাছ থেকে মাত্র কয়েক ফুট দূরে কর্পোরাল জসিম। শুয়ে পড়ে গুলি করছে। থরথর করে কাঁপছে ডানকাঁধ। গুলির সঙ্কট। একটা একটা করে গুলি করছে রানা।
কিছুক্ষণ পর শুনল বিকট আওয়াজ। আকাশ চিরে হাজির হয়েছে দুটো নাইট-টু লিংক্স হেলিকপ্টার। জঙ্গলে ফেলেছে স্পটলাইটের আলো। চালু করেছে মিনিগান। শত শত গুলি আসতেই ভীষণ ভয় পেয়ে পালাতে শুরু করল বাবুনা গুনের সৈনিকরা। ধুপধাপ মাটিতে পড়ছে লাশ। জঙ্গল কাঁপছে রোটরের তীব্র হাওয়ায়। একটা ছাউনির টিন উড়ে গেঁথে গেল মোটা এক কালো লোকের ঘাড়ে।
আকাশের দিকে চেয়ে এয়ারক্রাফট দেখল রানা। তখনই পেছন থেকে বিধল আরেকটা গুলি। মুখ থুবড়ে পড়ল ও। আবছা দেখছে চারপাশ। জেদ করে চাইল সচেতন থাকতে। উঠে বসল হাঁটুতে ভর করে। জানতে চাইছে কে গুলি করেছে পেছন থেকে। কুলকুল করে উষ্ণ রক্ত নামছে পিঠ বেয়ে। পড়ে গিয়েও গড়ান দিয়ে চিত হলো রানা। শুনতে পেল খুব কাছে আরেকটা গুলির আওয়াজ। একটু দূরেই ধুলোর ভেতর লুটিয়ে পড়েছে কর্পোরাল জসিম।
ছায়ার ভেতর থেকে এল এক লোক। লকলকে আগুনের কমলা পটভূমিতে তাকে দেখাল রাক্ষসের মত। হাতে পিস্তল। বিহ্বল চোখে তাকে দেখল রানা। আরও কাছে এল লোকটা। পিস্তলের মাযল তাক করেছে ওর মাথা লক্ষ্য করে।
লোকটা শক্ত করে ধরেছে পিস্তলের বাঁট। কালো মুখ। রক্তলাল চোখে ভীষণ ঘৃণা। ওই দৃষ্টি কখনও ভুলবে না রানা। লোকটা যেন বদ্ধউন্মাদ। তারপর গুলির আওয়াজ শুনল ও। আর কিছুই মনে নেই।
ভেবেছিল মরেই গেছে। কিন্তু চোখ মেলতেই দেখল শুয়ে আছে কোনও মিলিটারি হসপিটালের নরম বেড়ে। চোখ সরাতেই দেখল পাশেই বসে আছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রাউন। উদ্বিগ্ন হয়ে ওকেই দেখছেন তিনি। সন্তান অসুস্থ হলে এভাবেই বুঝি চেয়ে থাকেন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা।
সে-রাতে জিম্মিদের উদ্ধার করতে ওরা গিয়েছিল ষোলোজন। ফেরত এসেছে মাত্র দু’জন।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল জন ব্রাউন না থাকলে বডিব্যাগে করে পাঠিয়ে দেয়া হতো রানার লাশ বাংলাদেশে।
একদম শেষতক লড়াই করেছেন ব্রাউন। আজও এসএএস ফোর্সের অফিসার ও সৈনিকরা শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করে তাঁর নাম।
এয়ার ফোর্স জঙ্গলে পৌছে যাওয়ার পর কর্পোরাল কার্ককে খুন করে ক্যাপ্টেন নানাঙ্গা। আহত রানার মাথা গুলি করতে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই ওখানে হাজির হন ব্রাউন। নানাঙ্গার পিস্তলে ছিল একটা মাত্র গুলি, ওটা লাগে তাঁর বাহুতে।
পরের কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে শুয়ে-বসে সবই শুনেছে রানা। দেরিতে এসেছিল রিইনফোর্সমেন্ট। প্যারাট্রুপাররা এল বটে, তবে ততক্ষণে মারা গেছে প্রায় সবাই। অবশ্য নিজেদের কাজ শেষ করেছে রানা ও ব্রাউনের দল। সেই রাতেই হামলা করা হয় বিদ্রোহী মিলিটারি ফোর্সের ওপর। কচুকাটা হয়ে গিয়েছিল তারা। উদ্ধার করা হয় নার্স ও ডাক্তারদেরকে। পাঠিয়ে দেয়া হয় যার যার দেশে।
আর কখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি মেজর বাবুনা গুনের।
বীরের মত লড়াই করেছেন বলে ব্রিটেনের রানির তরফ থেকে পুরস্কৃত করা হয় জন ব্রাউনকে। তাঁকে করে দেয়া হয় ফুল কর্নেল।
নিজে থেকেই তাঁকে কথা দিয়েছিল রানা: আপনি কখনও বিপদে পড়লে শুধু একটিবার খবর দেবেন, বেঁচে থাকলে ঠিকই হাজির হব।
আজ হয়তো সময় হয়েছে সেই ঋণ পরিশোধ করার।
আট
বাস্তবে ফিরল মাসুদ রানা। চট্ করে চোখ মেলে দেখল হাতঘড়ি।
ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেছে একঘণ্টা।
ওর সিদ্ধান্তের জন্যে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছেন কর্নেল ব্রাউন।
আগেই স্থির করেছে রানা, উপেক্ষা করবে না তাঁর অনুরোধ।
এবার শোধ করে দেবে জীবনের সবচেয়ে বড় ঋণ। তবে কর্নেলের কথায় কাউকে খুন করবে কি না, তা নিয়ে দ্বিধা আছে ওর মনে।
বিছানা ছেড়ে রুম লক করে নিচে নামল রানা। লবি ত্যাগ করে বেরিয়ে এল ব্যস্ত রাস্তায়। এ বছরও আসছে শত শত টুরিস্ট। ভিড়ের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল ও। চারপাশে হৈচৈ। পুরনো সব দালান, সরু গলিগুলোতে ছোট্ট দোকান ও ফুলের ডিসপ্লে। ইউরোপে ফুলের জন্যে বিখ্যাত স্যান. রেমো শহর। আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ করেই রানা টের পেল, পৌঁছে গেছে অ্যানি রবার্টসের হোটেলের সামনে।
হাতঘড়ি দেখল ও। মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়েছে দেড়ঘণ্টা আগে। ভাবল, একবার দেখা করে যাই অ্যানির সঙ্গে।
হোটেলটা কমদামি। দেয়ালে কালচে ছাতা পড়া। রিসেপশন ডেস্কের সামনে থামল রানা। বুঝে গেছে, টাকার অভাবে এখানে উঠেছে অ্যানি। আনমনে ভাবল, কতটা চিনি সদ্য পরিচিতা মেয়েটাকে!
ডেস্কের পেছনে বসে খবরের কাগজ পড়ছে বৃদ্ধ এক ক্লার্ক। চোখে ঘোলাটে কাঁচের হাফমুন চশমা। ওটার ওপর দিয়ে রানাকে দেখল সে। ইতালিয়ান ভাষায় বলল, ‘আপনাকে কী ধরনের সাহায্য করতে পারি?’
‘আপনাদের হোটেলে আমার এক বান্ধবী উঠেছে,’ বলল রানা। ‘নাম অ্যানি রবার্ট। ঘরের নম্বর জানি না। আমার হয়ে ওকে একটু ডেকে দেবেন?’
বিরক্তি নিয়ে খবরের কাগজ সরিয়ে রাখল বৃদ্ধ। ডেস্ক থেকে টেনে নিল পুরনো আমলের রেজিস্টার খাতা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চোখ বোলাল নামের তালিকায়। তারপর মুখ তুলে বলল, ‘এই হোটেলে ওই নামে কোনও বোর্ডার নেই।’
চেক আউট করে চলে গেছে?’
‘না, সেনর, রেজিস্টার খাতায় ওই নামে কেউ নেই। ওই নামের কোনও গেস্টও ছিল না।’
‘ঘণ্টা খানেক আগে পৌঁছে দিয়ে গেছি। আপনি কি সেসময়ে ডিউটিতে ছিলেন?’
ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল বৃদ্ধ ক্লার্ক। তিক্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমার মনে হয় আপনি ভুল করে এই হোটেলে চলে এসেছেন, সেনর।’
মাথা নাড়ল রানা। ‘ঠিক জায়গাতেই এসেছি। আমার মনে হয় আপনিই ভুল করছেন।’
হতাশ চেহারা করে কাঁধ ঝাঁকাল বৃদ্ধ। ঘুরিয়ে দিল রেজিস্টার খাতা। ‘নিজেই দেখুন।’
এক এক করে নাম পড়ছে রানা। প্রথম পাতা শেষ করে গেল আগের পাতায়। কয়েক মিনিটে গত এক মাসের সব এন্ট্রি দেখা হয়ে গেল ওর। ঠিকই বলেছে বৃদ্ধ ক্লার্ক। অ্যানি রবার্ট, এ. রবার্ট বা কাছাকাছি নামের কেউ ওঠেনি এই হোটেলে।
‘বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত,’ ক্লার্কের দিকে তাকাল রানা। ‘ভুল করে ফেলেছি।’
একবার ঘোঁৎ করে উঠে নাকের কাছে আবারও দৈনিক পত্রিকা ধরল লোকটা।
দ্বিধা নিয়ে হোটেল থেকে বেরোল রানা। ভাবছে, ঠিক জায়গাতেই এসেছি, তাতে ভুল নেই। হাঁটতে হাঁটতে একবার কাঁধ ঝাঁকাল। অদ্ভুত রহস্যময় • মেয়ে! ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে বোধহয় সতর্ক হয়ে উঠেছে। নকল নাম বলেছে ওকে। বোধহয় বিশ্বাস করে না দুনিয়ার কাউকে!
তার নাম অ্যানি হোক বা ক্যানি, তাতে আমার ভাবল রানা। নিরাপদে থাকলেই হলো। এখন তাকে নিয়ে ভাবা একেবারেই অর্থহীন।
আরেকবার হাতঘড়ি দেখল রানা। রওনা হলো বন্দরের দিকে। সন্ধ্যার পর যাবে কর্নেলের ইয়টে ডিনারের আমন্ত্রণে। বাতাসে হালকা পোড়া গন্ধ। ভাপসা গরম। একবার মুখ তুলে তাকাল রানা। কুচকুচে কালো মেঘে ভরে গেছে আকাশ। আসছে বিদ্যুৎঝড়।
নিজের হোটেলের দিকে চলল রানা। শতখানেক গজ যাওয়ার পর সামনে পড়ল লম্বাটে এক সাদা দালান। ওটা পাশ কাটাতে গিয়েও থেমে গেল ও। চোখ পড়েছে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড বইয়ের দোকানে। সামনের দিকে প্লাস্টিকের ছাউনি। ফুটপাথের একধারে মোটা সব পুরনো বই। হাতে সময় পেলে এ ধরনের পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ দেয় ও। এসব দোকান যেন দুনিয়ার বাইরের কোনও জায়গা। চট্ করে হারিয়ে যেতে পারে বাস্তবতা থেকে। কয়েক পা সরে দোকানে উঁকি দিয়ে চমকে উঠল রানা। ধুলো পড়া বইয়ের তাকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে রাফেলা বার্ড! পরনে খয়েরি সুতির প্যান্ট ও গাঢ় নীল রঙের সিল্ক ব্লাউস।
হঠাৎ করেই ঘুরে তাকাল মেয়েটা।
লিণ্ডা ব্রাউন। যে-কেউ বলবে, সে রাফেলা বার্ডের যমজ বোন।
চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হাসল রানা। টের পেল বুকের গভীরে কেমন যেন কষ্ট। হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটিই যেন ফিরে এসেছে ওর জীবনে!
নরম সুরে বলল রানা, ‘ভাবিনি আপনার সঙ্গে এখানে দেখা হবে।’
‘আমিও অবাক হয়েছি, মিষ্টি হাসল লিণ্ডা ব্রাউন। ‘শহরে এসেছি টুকটাক জিনিসপত্র কিনতে। তখনই মনে হলো, একবার ঢু মেরে যাই বইয়ের দোকান থেকে। এদের কাছে পুরো একটা তাক ভরা নাম করা সব কবির বই।’
হাতের বইটা দেখাল সে। ‘আজই পেয়ে গেলাম। স্যামুয়েল টেইলার কোলেরিজ।’
অস্বস্তি বোধ করছে রানা।
‘আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগল,’ হাসছে লিণ্ডা ব্রাউন।
‘আমারও,’ ছোট্ট করে জবাব দিল রানা। তারপর বলল, ‘সন্ধ্যার পর ইয়টে যাব। কর্নেলের কাজটা হাতে নিচ্ছি। দু’এক দিন পর যাব কায়রোয়।’
মাথা দোলাল মেয়েটা। ‘আপনি ওর কাজটা করে দিলে খুব খুশি হবে জন।’
নীরবতা নামল দু’জনের মাঝে। দীর্ঘ কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যাওয়ার পর বলল রানা, ‘আশা করি সন্ধ্যায় ইয়টে দেখা হবে। রাতে ওখানেই থাকছি। এরপর সকালে চেষ্টা করব কায়রোর প্লেনে উঠতে।’
‘আমার সঙ্গে এক চক্কর ঘুরবেন নাকি গাড়িতে করে?’ হঠাৎ করেই বলল লিণ্ডা। ‘শহরটা ঘুরিয়ে দেখাব। অবশ্য যদি আপনার হাতে সময় থাকে। আমার গাড়িটা আছে বাঁকের ওদিকে।’ গাল থেকে একগোছা চুল সরিয়ে আগ্রহ নিয়ে রানাকে দেখল মেয়েটা।
দ্বিধা কাটিয়ে বলল রানা, ‘না, কোনও আপত্তি নেই।’
বইয়ের দাম শোধ করে দোকান থেকে বেরোল লিণ্ডা ব্রাউন। রানার পাশে হাঁটতে লাগল মোড়ের দিকে। টুকটাক কথা হচ্ছে ওদের ভেতর। রাস্তার বাঁক নিতেই রানা দেখল, দাঁড়িয়ে আছে কালো রঙের দুর্দান্ত সুন্দর এক বিএমডাব্লিউ যেড ফোর রোডস্টার কনভার্টিবল।
আঙুল তুলে ওটা দেখাল লিণ্ডা। হ্যাণ্ডব্যাগ আর বই রাখল ওপেন-টপ গাড়ির পেছনে। ব্লিপার ব্যবহার করতেই খুলে গেল দরজার তালা। মাখনরঙা, নরম লেদার সিটে বসল ওরা। লিণ্ডা ইগনিশনে চাবি মুচড়ে দিতেই গর্জে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। প্রথম গিয়ার দিতে গিয়ে রানার হাতের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল ওর হাত। সামান্য স্পর্শ, তবে লিণ্ডা যেন শক খেল বিদ্যুতের। লাল হলো দুই গাল। বিড়বিড় করে বলল, ‘সরি।
‘না, ঠিক আছে।’ রানার বুকে আবারও জেগে উঠল অস্বস্তি। নিজেকে জিজ্ঞেস করল: হ্যাঁ রে, ব্যাটা, তুই এখানে কী করছিস? ভুলে যাসনে, এই মেয়ে তোর সেই রাফেলা নয়। যে মানুষটা তোর প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সেই কর্নেল- জন ব্রাউনের স্ত্রী।
নানান রাস্তা ধরে চলেছে গাড়ি। মাঝে মাঝে স্যান রেমোর বিখ্যাত আর্কিটেকচারাল বাড়ি দেখাচ্ছে এবং ওটার অতীত জানাচ্ছে লিণ্ডা। চুপচাপ শুনছে রানা। তবে কয়েক মাইল যাওয়ার পরই শহরের প্রান্তে পৌছে গেল ওরা। এরই ভেতর রানা টের পেয়েছে, কারা যেন অনুসরণ করছে ওদেরকে।
নকল মেয়ে অ্যানি রবার্টসের হোটেলের কাছ থেকেই সন্দেহ হয়েছিল ওর, পিছু নেয়া হয়েছে। তারপর বারবার দেখল বড়সড় এক সুযুকি হায়াবিউসা মোটরসাইকেল। সেসময় থেকে নিজেই চারপাশে চোখ রাখছে রানা। আরোহীর পরনে কালো চামড়ার জ্যাকেট। মাথায় ফুল ফেস হেলমেট। টিণ্টেড ভাইসরটা কালো। রানা নিশ্চিত নয়, আরোহী ছেলে না মেয়ে। তারপর লিণ্ডার সঙ্গে গাড়িতে ওঠার পর পুরো তিন কিলোমিটার পিছু নিয়েছে কালচে নীল রঙের এক ফিয়াট গাড়ি। চালক ভাব করেছে কোনও তাড়া নেই তার। উইণ্ডশিল্ডে রোদ ঝিলিক দিচ্ছে বলে রানা দেখতে পায়নি ভেতরের কাউকে। তবে তারা যে দু’জন, তাতে সন্দেহ নেই। তখন থেকে ভাবছে রানা, লিণ্ডা বা ওর কাছ থেকে কী চায় এরা?
চিন্তিত রানাকে ড্রাইভার্স মিররে একটু পর পর দেখছে লিণ্ডা। এবার বলেই ফেলল, ‘কোনও সমস্যা?’
‘হয়তো নয়, আবার হতেও পারে,’ বলল রানা। ‘আমার মনে হচ্ছে কারা যেন পিছু নিয়েছে আমাদের।’
অবাক হয়ে ওকে দেখল লিণ্ডা ব্রাউন। চট করে তাকাল রিয়ার ভিউ মিররে। কুঁচকে গেল ভুরু। ‘আপনি কি পুরোপুরি শিয়োর, রানা?’
‘হ্যাঁ, শিয়োর।’
‘কারা এরা?’
‘তা জানি না।’
‘আমরা এখন কী করব?’
‘আমাদের বোধহয় উচিত গাড়ি থামিয়ে কোনও খাবারের দোকানে গিয়ে বসা। তারপর দেখব কী করে। অথবা, আরেকটা কাজ করা যায়। রেসে হারিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তারা বুঝবে, আমরা জেনে গেছি।’
‘তারা বুঝলেই বা কী?’ বলল লিণ্ডা। ‘চাইলে রেসে হারিয়ে দিতে পারব। একটু পর খুঁজেই পাবে না আমাদেরকে।
‘প্রতিযোগিতায় জিততে পারবেন ভাবছেন?’
‘শক্ত হয়ে বোসো, রানা, ফর্সা চেহারায় উত্তেজনার ছাপ পড়ল লিণ্ডার। জানেও না বদলে গেছে সম্বোধন। নিচু গিয়ার ফেলতেই গর্জে উঠল ইঞ্জিন। লাফিয়ে এগোল দ্রুতগামী গাড়ি। সিটে প্রায় গেঁথে গেল রানা। এঁকেবেঁকে ট্র্যাফিকের ভেতর দিয়ে তীর বেগে চলল স্পোর্টস্কার রোডস্টার। খুশি হয়ে হাসছে লিণ্ডা। সামনে থেকে আসা এক সাদা ভ্যানের ড্রাইভার ভয় পেয়ে হর্ন বাজাল। তবে তার নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল লিণ্ডার গাড়ি। সামনে লাল বাতির সিগনাল। ওটা পাত্তা না দিয়ে গতি আরও বাড়াল মেয়েটা।
রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল রানা। পেছনে হারিয়ে গেছে নীল ফিয়াট। আগেই হার মেনেছে মোটরসাইকেল। ‘কত দিন ধরে ইতালিয়াতে ড্রাইভ করছ,’ ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজের ওপর দিয়ে জানতে চাইল রানা।
‘আমরা তো বেশি দিন কোথাও থাকি না,’ বলল লিণ্ডা। ‘আসলে গোটা দুনিয়া ঘুরে বেড়ায় জন। …হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’
‘তুমি কিন্তু ড্রাইভ করছ ইতালিয়ান ড্রাইভারদের মত করে।’
মুচকি হাসল লিণ্ডা। ‘ধরে নিচ্ছি এটা প্রশংসা। আমি কি ভয় পাইয়ে দিলাম তোমাকে?’
‘তা নয়।’
‘চলো, তোমাকে একটা জায়গা দেখাব,’ বলল লিণ্ডা। ওরা পেছনে ফেলেছে শহর। একদিকে অনেক নিচে সাগর, অন্যদিকে ঢালু হয়ে নেমেছে পাহাড়ি জঙ্গল। মাঝে আঁকাবাঁকা উপকূলীয় সড়ক। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বাঁক ঘুরে ছুটে চলেছে লিণ্ডা। ঠিক জায়গায় ব্রেক কষছে, তারপর মোড় নিয়ে আবারও তুলছে তুমুল গতি। বামে সরু এক রাস্তায় পড়ল রোডস্টার।
‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ জানতে চাইল রানা।
‘নিজেই দেখবে।’
ওপরে গেছে সরু রাস্তা। দু’পাশে সবুজ জঙ্গল। বাতাসে ফুল ও ছোট গাছের গা থেকে আসছে বুনো সুবাস। মাথার ওপর পাকিয়ে উঠছে বিদ্যুৎঝড়।
আরও কয়েকবার বাঁক নেয়ার পর রানা নিশ্চিত হলো, পেছনে যারাই থাকুক, তারা এখন আর পিছু নিচ্ছে না। তবুও বুকে অদ্ভুত এক অস্বস্তি টের পাচ্ছে ও। বারবার মনে হচ্ছে, কর্নেলের যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে এখানে আসা উচিত হয়নি ওর।
রাস্তা থেকে নেমে কাঁচা রাস্তায় চলল লিণ্ডা। একটু পর পৌঁছে গেল ঘাসে ঢাকা উঁচু এক উপত্যকায়। গাড়ি থামাল মেয়েটা।
‘আমরা কি এখানেই থামছি?’ জানতে চাইল রানা।
মাথা দোলাল লিণ্ডা। ‘হ্যাঁ। বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে।’
ওরা দু’জন গাড়ি থেকে নামার পর লিণ্ডার সঙ্গে এঁকেবেঁকে পাহাড়ি পথে উঠতে লাগল রানা। দু’পাশে ঘন জঙ্গল।
ম্লান হাসল লিণ্ডা। ‘বলতে পারো, কারা আমাদের পিছু নিল?’
‘জানি না,’ সত্যি কথাই বলল রানা। আমাদের কথাটা কেন যেন ঝাঁকি দিয়েছে ওকে। যারা পিছু নিয়েছে, তারা চেয়েছিল ওকে— লিণ্ডাকে নয়। মেয়েটাকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইল না ও। তাই নরম সুরে বলল, ‘হয়তো রেস করতে চেয়েছে। আর আমি মনে করেছি, পিছু নিচ্ছে।’
সামনে ফুরিয়ে এল জঙ্গল। হাতের ইশারায় চারপাশ দেখাল লিণ্ডা। ‘এদিকটাই দেখাতে চেয়েছি। দেখার মত, তাই না?’
পাহাড়ি উপত্যকার ওপর থেকে নিচে দেখা যাচ্ছে দূরের উপসাগর। একদিকে তীর, আরেক দিকে আদিগন্ত সুনীল ভূমধ্যসাগর। ধূসর রঙ ধরেছে আকাশ। সব মিলিয়ে চমৎকার দৃশ্যটা শ্বাসরুদ্ধকর।
‘সুযোগ পেলেই এখানে এসে আকাশ-পাহাড়-সাগর দেখি,’ বলল লিণ্ডা। ‘ভাল লাগে একা থাকতে।’ কালচে মেঘের দিকে তাকাল। ‘মনে হয় ঝড়-বৃষ্টি হবে।’
কথাটা মাত্র বলেছে লিণ্ডা, টাস্-টাস্ আওয়াজে বৃষ্টির প্রথম কয়েকটা ফোঁটা পড়ল রানার শার্টে। পরক্ষণে ঝরঝর করে নামল তুমুল বৃষ্টি।
‘চলো, ওখানে ঠাঁই নিতে হবে!’ আঙুল তুলে এক শ’ গজ দূরে অর্ধেক তৈরি এক বাড়ি দেখাল লিণ্ডা। ওটার পেছনে ঘন গাছপালা ও ঝোপ। ‘এসো, দেখি কে আগে পৌঁছুতে পারে!’ উত্তেজনায় চকচক করছে মেয়েটার দুই চোখ। কী যেন ভাবছে। লালচে হয়েছে দুই গাল।
রুক্ষ পাহাড়ি জমিতে হরিণীর বেগে ছুট দিল লিণ্ডা। আরও বেড়েছে বৃষ্টির ধারা। চুপচুপে হয়ে গেল রানার শার্ট। মেয়েটার পিছু নিল না। ধীর তালে চলল অর্ধ নির্মিত বাড়িটার দিকে। দৌড়বিদের মত ছুটে চলেছে লিণ্ডা। লাফিয়ে পেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরের নিচু দেয়াল। একতলার ছাত ও মাত্র কয়েকটা দেয়াল তৈরি করেছিল মালিক। ওখানে ঢুকে গেল লিণ্ডা। কয়েক মিনিট পর পৌঁছুল রানা। ওকে দেখে খিলখিল করে হাসল অপরূপা মেয়েটা। ভেজা, লোভনীয় শরীরে সেঁটে গেছে নীল ব্লাউস। মুখের ওপর থেকে সরাল এক গোছা চুল। ‘কই, হেরে গেলে তো, রানা?’
চারপাশ দেখল রানা। ‘কার বাড়ি এটা?’
‘এমন কেউ, যার ফুরিয়ে গিয়েছিল টাকা। তাই তৈরি করতে পারেনি পুরো বাড়ি। চারপাশ তো দেখছ। বছরের পর বছর কেউ আসে না।’ মুখ আর ঘাড় থেকে বৃষ্টির পানি মুছতে চাইল লিণ্ডা। ‘যাহ্, একদম ভিজে গেছি।’
বাইরে ঝড়ঝঞ্ঝা। বারবার ঝলসে উঠছে নীল বিদ্যুৎশিখা। কড়-কড়াৎ বিকট আওয়াজে পড়ছে বাজ। গুড়গুড় আওয়াজ ছাড়ছে আকাশ।
‘সারাদিন ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে রাগী আকাশটা,’ বলল লিণ্ডা।
কাঁচহীন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। ‘ঝড় ভাল লাগে আমার।’
‘সত্যিই? আমারও! বুঝি না কেন যে মানুষ ভয় পায়!
একদিন তো চলে যেতেই হবে!’
আঁধার আকাশ চিরে ঝিলিক দিল নীল বিদ্যুৎশিখা।
‘একা লাগলে চলে আসি এখানে,’ অনেকটা আনমনে বলল লিণ্ডা।
চুপ করে থাকল রানা।
নীরব ওরা দু’জন।
ছাতে পড়ছে অঝোরে বৃষ্টি। একটু পর নিচু গলায় বলল লিণ্ডা, ‘আমি হয়তো পালিয়ে যেতে চাই ওর কাছ থেকে।’
‘কর্নেলের কাছ থেকে?’ অকপট স্বীকারোক্তি শুনে বিস্মিত হয়েছে রানা।
আস্তে করে মাথা দোলাল লিণ্ডা। সুন্দর দাঁতে কামড়ে ধরল নিচের ঠোঁট। ‘আসলে, রানা, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কের অনেক কিছুই গোপন করেছি।’
ভুরু কুঁচকে উঠতে চাইলেও চেহারা স্বাভাবিক রাখল রানা।
‘একটা কথা, রানা, মনে আছে বইয়ের দোকানে আমাদের দেখা হয়েছিল?’
‘হ্যাঁ,’ বলল রানা।
রক্তিম হলো লিণ্ডার গাল। ‘মিথ্যা বলেছি। বই কিনতে যাইনি। আগে কখনও ওখানে পা রাখিনি। কবিতা ভাল লাগে না। তবে শহরে তোমাকে দেখে ভেবেছি, খুব ভাল লাগবে তোমার সঙ্গ। তাই…’ মুখ নিচু করে নিল মেয়েটা।
অস্বস্তি বোধ করছে রানা।
‘তুমি হোটেলে আছ কি না জানতে ক্লার্কের কাছে গেলাম। যখন শুনলাম তুমি নেই, বেরিয়ে এলাম। একটু দূরেই বইয়ের ওই দোকান। ওই পর্যন্ত গেছি, এমন সময় দেখি তুমি আসছ।’
‘কিন্তু কেন হোটেলে গেলে?’ জানতে চাইল রানা।
‘কারণ, এত কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না।’ কাঁপছে লিণ্ডার গলা। ‘মানসিক যন্ত্রণা তো আছেই, যখন তখন গায়ে হাত তোলে জন। জানি, তালাক দিলে নিঃস্ব হব। প্রথম থেকে শুরু করতে হবে সব। তা-ও ভেবেছি, চলে যাব, এমন সময়ে শুনলাম খুন হয়েছে মডাক। তখন আর জনকে জানাতে পারলাম না আমার সিদ্ধান্ত।’
ঝরঝর ঝরছে বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বজ্রপাত। খুব কাছেই বাজ পড়ল। আকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছিটকে গেল বাঁকা নীল এক তীর। আনমনে মাথা দোলাল লিণ্ডা। ‘জানি, কেমন মেয়ে ভাবছ আমাকে। এমন কেউ, যে কিনা বুড়ো স্বামীতে সন্তুষ্ট নই। কিন্তু না, রানা, তা ভাবলে ভুল হবে। …অবশ্য স্বীকার করব, একবার দেখেই চিরদিনের জন্যে তোমাকে চেয়ে বসেছি। জানতাম না, সত্যিই প্রথমদর্শনে প্রেম হতে পারে। বারবার মনে হয়েছে তোমার হাত ধরে বলতে: প্লিয, ফিরিয়ে দিয়ো না আমাকে।’ মুখ ফিরিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা।
লিণ্ডা দেখতে রাফেলার মত, তবে হতবাক রানা ভুলে যায়নি, মেয়েটা কার স্ত্রী। খচ্-খচ্ করছে ওর মন। সত্যিই কি লিণ্ডার গায়ে হাত তোলেন ব্রাউন? সেটা তো চরম অন্যায়!
শিউরে উঠল লিণ্ডা। চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। কোমল দু’হাতে স্পর্শ করল রানার বাহু। ‘আমাকে এ নরক থেকে বাঁচাও, রানা!’
কয়েক মুহূর্ত দ্বিধায় ভোগার পর রানা বলল, ‘আমাকে বাঁচাতে গিয়ে যুদ্ধের ময়দানে আহত হন কর্নেল। তা ভুলব না, লিণ্ডা। কিছু মনে কোরো না, তাঁর সঙ্গে বেইমানি করব না।’
এ কথা শুনে এক পা পিছিয়ে গেল লিণ্ডা। বিস্ফারিত হয়েছে দু’চোখ। ‘তুমি তো এসব বলোনি আমাকে!’
মন খারাপ হয়ে গেছে রানার।
কমে গেছে বৃষ্টি। দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ঝোড়ো মেঘ। তারই ফাঁকে উঁকি দিয়েছে সূর্যের সোনালি কিরণ।
আরেকবার শিউরে উঠল লিণ্ডা। ওর চেহারা দেখে রানার মনে হলো, খুব প্রিয় কিছু হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
‘ভিজে গেছি, এবার বোধহয় হোটেলে ফেরাই ভাল, বলল গম্ভীর রানা।
নয়
হোটেলে যাওয়ার সময় গাড়ি ড্রাইভ করল রানা। একটা কথাও হলো না ওদের দু’জনের ভেতর। পার্কিংলটে গাড়ি রেখে লিণ্ডাকে নিয়ে দোতলায় নিজের রুমে ঢুকল রানা। বিছানার কিনারায় বসে বলল, ‘তুমি বরং শাওয়ার করে এসো।’
নীরবে টয়লেটে গিয়ে ঢুকল লিণ্ডা। বাথরুমের দরজার দিকে পিঠ দিয়ে চুপ করে বসে থাকল রানা। বড় ক্লান্ত লাগছে ওর। বাথরুমে পানির ঝরঝর আওয়াজ। রানা ভাবছে একটু আগে লিণ্ডার বলা কথাগুলো। মনে পড়ল রাফেলার মিষ্টি মুখ। বুকের কোথায় যেন খোঁচাচ্ছে একটা জখম।
কিছুক্ষণ পর থেমে গেল পানির ঝরঝর আওয়াজ। মৃদু গুঞ্জন তুলল হেয়ারড্রায়ার। খানিক পর দরজা খোলার খুট আওয়াজেও ঘুরে তাকাল না রানা। সাদা বাথরোব পরে বেরিয়ে এসেছে লিণ্ডা। বাথরুমের হিটিং রেইল ব্যবহার করে শুকিয়ে নিয়েছে পোশাক। রোব খুলে নীরবে পরল ওগুলো। চুলে চিরুনী চালিয়ে বলল, ‘এবার শাওয়ারে যেতে পারো।’
ব্যাগ থেকে নতুন শার্ট ও প্যান্ট নিয়ে নীরবে বাথরুমে ঢুকল রানা। স্নান না করে দু’মিনিট পর বেরোল নতুন পোশাক পরে। গুছিয়ে নিল ব্যাগ। নীরবে ওরা নামল লবিতে। চেক আউট করল রানা। বিল মিটিয়ে চলে এল গাড়িটার কাছে। পরস্পরের দিকে তাকাচ্ছে না ওরা। এবার ড্রাইভ করল লিণ্ডা।
পনেরো মিনিট পর জেটিতে গ্যারি স্যাণ্ডার্সের সঙ্গে দেখা হলো ওদের। ঠিক সময়ে লঞ্চ নিয়ে হাজির হয়েছে লোকটা। সন্ধ্যার আঁধার নামছে, এমন সময় ওরা উঠল সেইবার-ইয়টে।
ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন কর্নেল জন ব্রাউন। রানার হাতে ব্যাগ দেখে খুশি হয়ে হেসে ফেললেন।
‘শহরে বইয়ের দোকানে দেখা হয়ে গেল মিস্টার রানার সঙ্গে,’ নিচু গলায় বলল লিণ্ডা। ‘খুব কাকতালীয়, তাই না, জন?’
অস্বস্তি বোধ করছে রানা। বুঝে গেছে, গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে না মেয়েটা। অবশ্য এখন অন্যদিকে মন কর্নেল ব্রাউনের। রানা মিশরে যাবে বলে ভিসা করতে ওর কাছ থেকে চেয়ে নিলেন সবুজ পাসপোর্ট। এরপর একজন ক্রুকে ডেকে বললেন, যেন রানার ব্যাগ পৌঁছে দেয়া হয় কেবিনে।
একটু পর রাজকীয় কেবিনে পা রেখে বিস্মিত হলো রানা। বিলাসবহুল হোটেলের সুইটের মতই কর্নেল ওকে দিয়েছেন তিন রুমের একটা অ্যাপার্টমেন্ট। চিকচিক করছে ওয়ালনাটের প্যানেল। মেঝেতে পারস্যের কার্পেট। আসবাবপত্র সব আসলে অ্যান্টিক। একটু পর ডিনারে দেখা হবে লিণ্ডা আর কর্নেলের সঙ্গে। ওর মনে হলো, আটকা পড়েছে সোনার খাঁচায়। কিছুক্ষণ সোফায় বসে থাকার পর ঠিক করল শাওয়ার নেবে। শেভ করাও জরুরি। ব্যাগ থেকে কালো জিন্সের প্যান্ট ও কালো রোল-নেক সোয়েটার নিয়ে বাথরুমে ঢুকল রানা।
শাওয়ার নিল পুরো পনেরো মিনিট ধরে।
আধঘণ্টা পর কেবিনের দরজায় টোকা দিল কেউ। কবাট খুলে সেই আগের ক্রুকে দেখল রানা। লোকটা জানাল, সার্ভ করা হয়েছে ডিনার।
বিশাল ডাইনিং রুমটা যে-কোনও দামি ক্রু শিপের ডাইনিং রুমের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে। রানাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন ব্রাউন। তাঁর পরনে বুক খোলা শার্ট ও ধূসর ফ্লানেল প্যান্ট। হাত নেড়ে দেখালেন রুমের চারপাশ। ‘বেশি বিলাসবহুল। তবে মিডল ইস্টের অয়েল বিলিয়নেয়ার বা জাপানি টাইকুনরা মুগ্ধ না হলে বন্ধ হয়ে যাবে আমার রুটি-রুজি।’ বার্নিশ করা দীর্ঘ ডাইনিং টেবিলের একমাথায় রাজকীয় চেয়ার দেখালেন। ‘তুমি আজকে সম্মানিত অতিথি। তুমিই ওখানে বসবে, রানা।’
চেয়ারে বসে রুপালি কাটলারি ও ঝকঝকে ক্রিস্টালের গ্লাস দেখছে রানা। খুলে গেল একটা দরজা। ভেতরে ঢুকল লিণ্ডা ব্রাউন। পরনে অপূর্ব সুন্দর দুই কাঁধ খোলা কাশ্মিরী ড্রেস। চুড়ো করে বেঁধেছে চুল। গলায় সোনার নেকলেস। একবারও রানার দিকে না চেয়ে স্খলিত পায়ে হেঁটে এসে স্বামীর মুখোমুখি চেয়ারে বসল মেয়েটা।
প্রথম কোর্সে সি-ফুডের পাস্তার ডিশ দিল স্টাফরা। হাত বাড়িয়ে বরফে ভরা ছোট রুপালি বালতি থেকে পিউলে ফিউমে নিলেন কর্নেল ব্রাউন। দুটো গ্লাসে ওয়াইন ঢেলে রানা ও স্ত্রীর সামনে রাখলেন। নিজের গ্লাসে চুমুক দিয়ে, বললেন, ‘রানা, তুমি সাহায্য করবে শুনে খুব ভাল লাগছে। তুমি কল্পনা করতেও পারবে না, এজন্যে আমি কতটা কৃতজ্ঞ।’
বরফের মত ঠাণ্ডা ওয়াইনে চুমুক দিল রানা।
ওর চোখের দিকে তাকাচ্ছে না লিণ্ডা। আনমনে ঠোঁটে গ্লাস তুলতেই টেবিলক্লথে ছলকে পড়ল ওয়াইন।
‘তোমার শরীর খারাপ নয় তো, ডার্লিং?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন ব্রাউন। ‘মনে হচ্ছে খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছ।’
‘না, ঠিক আছি,’ বলল লিণ্ডা। ‘ঝড়-বৃষ্টির পর সবসময় মাথা-ব্যথা করে।’
অবাক হয়েছেন ব্রাউন। ‘বলো কী; তুমি না ঝড়-বৃষ্টি পছন্দ করো?’
কথাটা শুনে লালচে হলো লিণ্ডার গাল। বিড়বিড় করল, ‘একটু পরেই ব্যথা সেরে যাবে।’
খাওয়ার ফাঁকে চলল টুকটাক কথা। ছেলের কথা তুললেন না ব্রাউন। বলার মত কথা রানারও নেই। চুপচাপ বসে প্লেটে খাবার নাড়ছে লিণ্ডা। মুখে প্রায় কিছুই তুলছে না। প্রথম কোর্স শেষ হতেই রুপালি প্ল্যাটারে এল মেইন কোর্স: স্টেক ওয়েলিংটন।
ওটাও কিছুক্ষণ ঘেঁটে কাঁটা-চামচ ও ছুরি টেবিলে নামিয়ে রাখল লিণ্ডা। ঠোঁটের কোণ মুছল ন্যাপকিন দিয়ে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সরি, আমাকে মাফ করতে হবে। খুব বেড়ে গেছে ব্যথাটা। কেবিনে গিয়ে শুয়ে পড়ব।’
স্ত্রীর শরীর খারাপ বুঝে খাবার রেখে উঠে দাঁড়ালেন জন ব্রাউন। লিণ্ডার বাহু ধরে বললেন, ‘বলবে তো শরীর ভাল নেই, তা হলে আর তোমাকে এত কষ্ট দিতাম না। চলো, গিয়ে শুয়ে পড়বে। পেইন কিলার দিচ্ছি।’
ডাইনিং রুম ছেড়ে লিণ্ডাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। একা হয়ে গেল রানা। বুঝতে পেরেছে, অস্বস্তি বোধ করছে বলেই চলে গেল মেয়েটা। এ-ও টের পেল, রাগী লোক হলেও স্ত্রীকে অন্তর থেকে ভালবাসেন ব্রাউন। মনটা অন্যদিকে সরিয়ে নিল রানা। আগামীকাল সম্ভব হলে পৌঁছুবে কায়রোয়। করবে এমন এক কাজ, যেটা ওর পছন্দ নয়। হয়তো অচেনা এক লোকের ওপর প্রতিশোধ নেবে কর্নেল ব্রাউনের হয়ে। কথাটা ভাবতে গিয়ে ভাল লাগল না রানার।
কয়েক মিনিট পর ফিরলেন জন ব্রাউন। অতিথিকে রেখে গেছেন বলে বারবার দুঃখ প্রকাশ করলেন।
চুপচাপ খাওয়া সেরে নিল ওরা। তারপর রানাকে পাশের লাউঞ্জে আমন্ত্রণ জানালেন কর্নেল।
ওই ঘরে ঢুকে রানা বুঝল, চারপাশ সাজিয়ে নেয়া হয়েছে ভার্সাই-র প্রাসাদের এক স্যালোনের মত করে।
রানাকে ব্র্যাণ্ডি দিয়ে নিজেও নিলেন ব্রাউন। বলতে লাগলেন তাঁর ইয়ট ব্যবসার কথা।
ভদ্রলোকের কথা ফুরিয়ে যাওয়ার পর বলল রানা, ‘আসুন, এবার কায়রোর ব্যাপারে কথা সেরে নিই।’
হাতঘড়ি দেখলেন ব্রাউন। ‘আজ নয়, একটু পরে হেলিকপ্টারে করে আমাকে যেতে হবে মন্যাকোয়। বিযনেস ডিল। ক্লায়েন্ট হলিউডের নাম করা এক নায়ক। তার ধারণা, দুনিয়ার সবার উচিত তার খেদমত করা।’ তিক্ত হাসলেন কর্নেল। ‘সেইবারে তোমার কোনও সমস্যা হবে না, রানা। আগামীকাল সকালে তোমাকে জানিয়ে দেব দরকারি সব বিষয়ে।’
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন কর্নেল ব্রাউন। একটু পর হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজ পেল রানা। কিছুক্ষণ পরে চলেও গেল যান্ত্রিক ফড়িং।
ইয়ট ঘুরে দেখতে গিয়ে নানাদিকের করিডোর ও প্যাসেজের গোলকধাঁধায় ঢুকল রানা। দু’পাশে চকচকে দামি কাঠের দরজা। চারদিকে প্রাচুর্য, তবে পরিবেশটা বদ্ধ। একটু পর নিজের কেবিনে ফিরল রানা। হাতে কোনও কাজ নেই, সোফায় বসে চালু করল টিভি। বারোটা চ্যানেল ঘুরে ভাল কিছু না পেয়ে যোম্বির এক মুভিতে মন দিল। বিরক্ত হয়ে গেল কয়েক মিনিটে। রিমোট কন্ট্রোলের বাটন টিপে টিভি বন্ধ করল। বসে থাকল প্রায় অন্ধকার কেবিনে। ভাবছে, আগামী দু’চার দিনের ভেতর হয়তো মিশরে ওর হাতে খুন হবে অচেনা কেউ। কথাটা ভাবতে গিয়ে ভাল লাগল না রানার। মনে হলো, এই ইয়টে উঠেছে বলেই কর্নেল ব্রাউন ধরে নিয়েছেন, তাঁর হয়ে মানুষ খুন করবে ও। একবার ভাবল, না এলেও পারতাম। পরক্ষণে বুঝল, তা নয়, ঋণ ওকে শোধ করতেই হবে।
হঠাৎ মৃদু খট্-খট্ শব্দে সিধে হয়ে বসল রানা, সতর্ক। কান পাতল। কোথাও নেই অস্বাভাবিক কোনও আওয়াজ। ইয়টের গায়ে লেগে ফিসফিস শব্দে দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ঢেউ। তারপর আবারও শুনল খট আওয়াজ। ওটা আসছে দরজা থেকেই।
‘কে ওখানে?’ নরম সুরে জানতে চাইল রানা।
সামান্য খুলে গেল দরজা। করিডোরের হলদে আলোর সরু রেখা পড়ল কেবিনের মেঝেতে। যে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, তাকে লাগছে ছায়ার মত। দু’সেকেণ্ড পর রানা বুঝল, ওই মেয়ে লিণ্ডা ব্রাউন।
নিঃশব্দে কেবিনে ঢুকে পেছনে দরজা বন্ধ করল মেয়েটা। পোর্টহোল দিয়ে আসা চাঁদের রুপালি আলোয় ধীর পায়ে এল রানার দিকে। পরনে পাতলা নীল নাইটি।
‘তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি,’ খুব নিচু স্বরে বলল রানা। ‘আমি এখন জানি, কর্নেল তোমাকে ভালবাসেন।’
‘হ্যাঁ, তবে ওই ভালবাসা অস্বাভাবিক,’ বলল লিণ্ডা। ‘নইলে এত নির্মম নির্যাতন করত না।’
রানার গা ঘেঁষে সোফায় বসল রূপসী মেয়েটা। ফিসফিস করল, ‘না এসে পারিনি।’ চুলের সুবাস পেল রানা। ‘তোমাকে খুব কাছে চাই, রানা।’
কথা শুনে শুকিয়ে গেল রানার গলা। ধড়ফড় করছে হৃৎপিণ্ড। মনে মনে ধমক দিল নিজেকে: ‘কী রে, তুই কি চোদ্দ বছরের কিশোর হয়ে গেলি?’
‘তুমি চাইলে নাইটি খুলে দেখাব, চাবকে কেমন কালো দাগ ফেলে দিয়েছে পিঠে।’ অপমানে ফুঁপিয়ে উঠল লিণ্ডা। . ‘প্রিয, রানা, আমি মুক্তি চাই। নিয়ে যাও আমাকে এই নরক থেকে। চিরকাল তোমার দাসী হয়ে থাকতেও দ্বিধা করব না।’
মন খারাপ হয়ে গেল রানার। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছু বলার আগেই ফিসফিস করল লিণ্ডা, ‘প্রথমবার তোমাকে দেখেই ভালবেসে ফেলেছি। আর তারপর থেকে প্রতিটা মুহূর্ত শুধু তোমাকেই চেয়েছি।’
আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রানা, ‘তুমি তো এখুনি চাইলে তীরে গিয়ে হোটেলে উঠতে পার। ডিভোর্সও দিতে পারবে আগামীকাল। আমার মনে হয় না কেউ বাধা দেবে।’
মাথা নাড়ল লিণ্ডা। ‘আমিও ভেবেছি। কিন্তু বড় ভয় লাগে। হয়তো আমাকে খুন করবে জন। আর তারপর নিজের ভয়ঙ্কর কোনও ক্ষতি করবে।’
অপরূপা নারীর তপ্ত দেহের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে রানার দেহে।
‘রানা, প্লিয?’ লিণ্ডার ভেজা দুই ঠোঁট স্পর্শ করল ওর ক্লিন শেভড় গাল।
ব্যাপারটা কোন্ দিকে গড়াচ্ছে বুঝতে পেরে হঠাৎ করেই সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। নরম কণ্ঠে বলল, ‘পারিবারিক সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে পারো কর্নেলের সঙ্গে। নিশ্চয়ই কোনও সমাধান বেরোবে।
রানার কথা শুনে দু’হাতে মুখ ঢাকল লিণ্ডা। অসহায় ভাবে একবার ফুঁপিয়ে উঠল।
ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল রানা।
কিছুক্ষণ পর বিড়বিড় করল লিণ্ডা, ‘খুব ভয় লাগছে। তবে আগামীকাল ইয়ট ছেড়ে চলে যাব আমি। যদি বেঁচে থাকি, অপেক্ষা করব তোমার জন্যে। জনের কাজটা করে দেয়ার পর যদি ফেরো, আমাকে পাবে ইতালিতেই।
লিণ্ডার জন্যে সহানুভূতি জাগল রানার মনে। তবুও একটু কঠোর সুরেই বলল, ‘লিণ্ডা, তুমি জানো, আমি কর্নেলের সঙ্গে বেইমানি করতে পারি না।
‘জীবনের পথে চিরকালের জন্যে চাইছি তোমাকে, ‘ ভেজা চোখে রানাকে দেখল লিণ্ডা। গাল ভেসে গেছে অশ্রুজলে। ‘কাউকে ভালবেসে ফেলা কি এতই এতই বড় অপরাধ?’
‘পাত্র উপযুক্ত হলে হয়তো অপরাধ নয়, তবে উপকারী কারও ক্ষতি করবে শুধু অকৃতজ্ঞ কেউ,’ নিচু, দৃঢ়কণ্ঠে বলল রানা। ‘নিজেকে অকৃতজ্ঞ লোক মনে করি না। তোমাদের এ বিষয়ে আমার হাত-পা বাঁধা। কর্নেল আর তোমার সম্পর্ক নষ্ট হলেও আমার পক্ষে তোমাকে গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। তবে, তুমি যদি চাও, আমরা হতে পারি চিরদিনের জন্যে ভাল বন্ধু।’
চাপা অভিমান নিয়ে রানাকে দেখল লিণ্ডা। কী যেন ভেবে আনমনে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। নিচু করে নিয়েছে মুখ। ফিসফিস করল, ‘তুমি হয়তো আগামীকাল আমাকে এখানে দেখবে না। বিদায়, রানা… বিদায়…’ দরজার কাছে চলে গেল মেয়েটা।
‘লিণ্ডা, শোনো, একটু বোঝার চেষ্টা করো…’
‘গুডবাই, মাই লাভ, প্রায় নিঃশব্দে দরজা খুলে করিডোরে বেরোল লিণ্ডা। কোমল হলদে আলোয় রানা দেখল, মেয়েটার চোখে অঝোর বৃষ্টি। ধীরে ধীরে বন্ধ হলো দরজা। প্রায় ছুটে চলেছে লিণ্ডা, মৃদু পায়ের আওয়াজ পেল রানা। মনটা কেন যেন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল ওর।
কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা লক করে বিছানায় শুয়ে পড়ল রানা। সারারাত এপাশ-ওপাশ করে ঘুম এল ভোরের একটু আগে।