পঁয়ত্রিশ
ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে ব্রিটিশ জেট বিমান। বিযনেস-ক্লাস আর্মচেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছে রানা। নিচে সারি সারি মেঘ। সেগুলোর আড়াল থেকে উঁকি দিল ভোরের সূর্য।
রানা ও কেন্সিংটনের কপাল ভাল, রাতেই পেয়েছে মিশরগামী বিমান। সকাল হতে না হতেই পৌছে যাবে কায়রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।
ক্লান্ত ও দুর্বল বোধ করছে রানা। ঘুম নেই। জ্বলছে দুই চোখ। মাঝে মাঝে মনে পড়ছে লিণ্ডার কথা। শেষপর্যন্ত মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবে কি না, জানে না।
বামের সিটে উইলিয়াম কেন্সিংটন। জেগেই আছে। কানে গুঁজে রেখেছে ইয়ারফোন। সমস্ত মনোযোগ ইন-ফ্লাইট মুভিতে। একটু পর পর থলথলে ডানহাত ঢুকছে পটেটো চিপসের প্যাকেটের ভেতর। একগাদা চিপ্স্ মুখে ফেলে আওয়াজ করে চিবুচ্ছে সে।
আবারও জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা। চুমুক দিল গরম কফির কাপে। মনের চোখে ভেসে উঠল কঙ্গোতে মৃত বাংলাদেশি সৈনিকদের মুখ। পরক্ষণে যেন সামনে দেখল, ডেস্কের ওপর রাখা লিসা স্মিথ, রাফায়েল ফক্স ও জ্যাক রনসনের তিনটে কাটা মুণ্ড। বিড়বিড় করল রানা, ‘তোমাকে দেখে নেব আমি, জন ব্রাউন। দুনিয়ার কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারবে না।’
এতই পরিশ্রান্ত, কফি শেষ করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল রানা। স্বপ্নে ফিরে গেল কঙ্গোর কিভু এলাকায়। চলছে যুদ্ধ। কিন্তু সেখানে হাজির হলো উইলিয়াম কেন্সিংটন। কী যেন বলছে উঁচু গলায়। ‘রানা….’
‘কী?’ ঘুমের ঘোরে জানতে চাইল রানা।
‘জানতে চেয়েছি, আপনি কত দিন সৈনিক জীবনে ছিলেন।’
‘এটা জানতে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে হবে?’ মহাবিরক্তি বোধ করছে রানা।
‘বুঝলেন, আমার বাবা চেয়েছিল আমিও যেন তার মত সেনাবাহিনীতে যোগ দিই। কিন্তু রাজি হইনি। মডাক আর আমার ভেতর এদিক থেকে অনেক মিল।’
‘বাবাকে ঘৃণা করতেন আপনারা দু’জনই?’
নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে আওয়াজ তুলল কেন্সিংটন।
একটা ব্যাপার বুঝিনি,’ বলল রানা। ‘বাবাকে যদি পছন্দই না করে মর্ডাক, তা হলে এত কথা তাকে বলতে গেল কেন?’
‘ভাল-মন্দ মিলিয়ে অদ্ভুত অনুভূতি ছিল ওর মনে,’ বলল কেন্সিংটন। ‘কখনওই ওর মনে হয়নি বাবার মত ডাঁট মেরে ঘুরে বেড়াতে হবে। আবার মনের আরেকটা অংশ চাইত, বাবাকে দেখিয়ে দিতে, দেখো, আমিও দারুণ কিছু করে দেখাতে পারি। এক রাতে ইয়টে গেল বাবার সঙ্গে দেখা করতে। ওখানে উপস্থিত ছিল জন ব্রাউনের সুন্দরী দ্বিতীয় স্ত্রী। একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলেছিল মডাক। ভড়ভড় করে বলে ফেলল অনেক কিছুই। পরে আমাকে বলেছিল, ওর একদম উচিত হয়নি মুখ খোলা। তবে যা করেছে, তা তো করেই ফেলেছে।’
চুপ করে থাকল রানা।
‘ভীষণ ভয় পেল মডাক,’ বলে চলল কেন্সিংটন। ‘ওর মনে হলো, ওই গুপ্তধনের খোঁজে এবার মাঠে নামবে জন ব্রাউন। সেজন্যেই সেদিন বলেছিল, ওর খারাপ কিছু হলে যেন লোকটার সঙ্গে আখেনাতেন প্রজেক্ট নিয়ে কথা না বলি।’
‘ভাল সিদ্ধান্ত।’
রানার দিকে তাকাল কেন্সিংটন। ‘কেমন লাগে?’
‘বুঝলাম না।
‘সৈনিক জীবন?’
‘পরে কখনও বলব। আগে একটু ঘুমিয়ে নিই।’
‘ও।’
কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল রানা। কিন্তু হঠাৎ করেই বাহুতে ধাক্কা খেয়ে আবার সচেতন হলো। ওর মনে হলো, তিন সেকেণ্ডও ঘুমাতে পারেনি। প্রায় রানার গায়ে চেপে বসে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে কেন্সিংটন। ‘আমরা নেমে পড়েছি! এবার উঠে পড়ুন!’
‘নেমেই আবার অত ওঠা কীসের,’ বিড়বিড় করল রানা। মনে পড়ল গত কয়েক দিনের ভেতর দ্বিতীয়বার পা রাখছে কায়রো শহরে। তবে এবার হাতে মাত্র কয়েকটি দিন। সফল না হলে খুন হবে লিণ্ডা। জন ব্রাউনকে আরেকটু হলে বলে বসত রানা, আমি তোমার স্ত্রীর প্রতি দুর্বল নই। সুতরাং বোকার মত তাকে ব্যবহার করতে চেয়ে লাভ নেই। ব্ল্যাকমেইল করতে পারবে না। অবশ্য তখনই গুপ্তধনের কথা উঁকি দিল মনে। ওই মুহূর্তে আরেকটা কথা ভেবেছে রানা: বিশ্বাসঘাতকতার কারণে লিণ্ডাকে হয়তো খুন করবে চরম বেইমান ব্রাউন। কাজেই উপায় থাকলে ওর উচিত সেটা ঠেকানো।
ইমিগ্রেশন ও কাস্টম পেরিয়ে কেন্সিংটনকে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্টের কার হায়ার সেন্টারে গেল রানা। বেছে নিল কালো রঙের ফোর-হুইল-ড্রাইভ মিটসুবিশি ল্যাণ্ড রোভার। কাগজপত্র সই করে বিলটা দিল জন ব্রাউনের দেয়া টাকা থেকে। ওরা গাড়িতে উঠবে, এমন সময় বেজে উঠল রানার মোবাইল ফোন। কল রিসিভ করতেই ওদিক থেকে এল জন ব্রাউনের আনন্দিত কণ্ঠ: ‘ভাবছি কতটা এগোলে। আশা করি ভালই করছ। নইলে… জানোই তো।’
গাড়ি থেকে একটু সরে গেল রানা। কেন্সিংটনকে জিপে উঠতে ইশারা করে চাপা স্বরে বলল, ‘তুমি যে ফোন করবে, সেটা জানতাম।’
‘এখন কোথায় আছ, রানা?’
‘মিশরে,’ বলল রানা। ‘লিণ্ডা কোথায়?’
‘কাছেই আছে,’ বলল ব্রাউন। ‘চোখের আড়াল করছি না। তবে যতই চেষ্টা করো, খুঁজে বের করতে পারবে না।
‘আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাই।’
‘ভুলে যেয়ো না, নিয়ম কিন্তু তুমি তৈরি করছ না।’
‘ও বেঁচে আছে কি না তা না জেনে খামোকা খাটাখাটনি করতে যাব কেন? কিডন্যাপ ও র্যানসামের ক্ষেত্রে প্রথম শর্তই হচ্ছে, জিম্মির সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে। নইলে কোনও ধরনের চুক্তি টিকবে না। সেক্ষেত্রে আমার প্রথম কাজ হবে তোমাকে খুঁজে বের করে খুন করা। বুঝতে পেরেছ?’
নীরব হয়ে গেছে লাইন। কয়েক সেকেণ্ড পর চাপা গোঙানির আওয়াজ পেল রানা। ধমক দিল কেউ। ডেকের কাঠের ওপর দিয়ে ছেঁচড়ে আনা হলো কাউকে। ফোন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে তার হাতে।
‘রানা?’ আতঙ্কিত ও উদ্বেগে ভরা কণ্ঠ লিণ্ডার।
‘ভয় নেই, লি…’ বলতে শুরু করেছিল রানা। তবে ফোন কেড়ে নেয়া হয়েছে মেয়েটার কানের কাছ থেকে।
‘শুনলে তো। খুশি? বেঁচে আছে। এবার কাজে নামো। নইলে লিণ্ডার মাথাটা কেটে পৌঁছে দেব তোমার কাছে। আরও পুরো ছয় দিন হাতে পাচ্ছ।’
লোকটা লাইন কেটে দেয়ার আগেই বলল রানা, ‘একমিনিট, ব্রাউন। তোমার সঙ্গে জরুরি কিছু কথা আছে।’
.
সকাল নয়টায় নির্ধারিত জায়গায় পৌছুল রানা ও কেন্সিংটন। একটু দূরেই ইজিপশিয়ান মিউযিয়াম। প্রধান সড়কে সগর্জনে চলছে শত শত গাড়ি। ব্যস্ত এলাকা। চারপাশে ক্যাফে ও দোকান। হাজার মানুষের ব্যস্ততা। একটা ল্যাম্প পোস্টের পাশে থেমে হাতঘড়ি দেখল রানা। জন ব্রাউন তার কথা রাখলে যে-কোনও সময়ে ওদেরকে গাড়িতে তুলে নেবে হারামি লোকটার পরিচিত কন্ট্যাক্ট।
বারবার রানাকে দেখছে কেন্সিংটন। ভয় লাগছে বলে জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলবে না তো?’
‘একদিন তো মরতেই হয়,’ উদাস সুরে বলল রানা।
প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল কেন্সিংটন। ‘একবার ভেবে দেখেছেন, কী পরিমাণ ধোঁয়া চারপাশে? শত্রুরা খুন না করলেও তো আমরা মারা যাব।’
‘না এলেও পারতেন, আমিও নিজের ব্যবস্থা করে নিতাম,’ বলল রানা। ‘এই শহরে যত বায়ু-দূষণ, তাতে প্রতিদিন ত্রিশটা সিগারেট খেলে যতটা ‘ক্ষতি হয়, সেই পরিমাণ বিষ ফুসফুসে টেনে নিচ্ছে সবাই।’
‘আমার ভাল লাগছে না,’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন। ‘এরা কারা? আমাদেরকে কোথায় নেবে? আমি তো জানতাম জন ব্রাউন আপনার শত্রু।’
‘চাইলে ফিরে যেতে পারেন নিজের দেশে,’ বলল রানা। ‘কেন্সিংটন ম্যানরে।’
মাথা নাড়ল ইতিহাসবিদ। ‘ভাল করেই জানেন, সেটা করতে পারব না।’
‘তো দেশে ফিরে উঠুন ভাল কোনও হোটেলে। কেউ জানবে না আপনি ওখানে আছেন।’
‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল কেন্সিংটন। ‘নিজেকে নিয়ে ভাবুন।’
‘বেশ। ধরে নিলাম আপনি আমার সঙ্গে নেই।’
গোমড়া চেহারা করে দূরে চেয়ে রইল কেন্সিংটন।
নয়টা পাঁচ মিনিটে সারি সারি গাড়ির মিছিল থেকে বেরিয়ে সামনের মোড়ে থামল বড় একটা এসইউভি। গাড়িটা কুচকুচে কালো। জানালার কাঁচও অস্বচ্ছ। খুলে গেল গাড়ির পেছনের দরজা। ভেতরে তিনজন লোককে দেখল রানা। তাদের দু’জনের মাথার চুল কালো। মিশরীয়। তৃতীয় লোকটা ইউরোপিয়ান… সোনালি। কারও মুখে হাসি নেই।
‘উঠে আসুন,’ আরবিতে রানাকে বলল ইউরোপিয়ান।
যে সুরে কথা বলেছে, রানার ধারণা হলো লোকটা ইতালিয়ান।
এসইউভি-এর ভেতর তিন সারি সিট। পেছনের সিটে উঠল রানা ও কেন্সিংটন। ধুপ্ শব্দে দরজা বন্ধ করল ইউরোপিয়ান। দেরি না করে রওনা হলো গাড়ি। মিশে গেল হাজার গাড়ির ভিড়ে। রানা ও কেন্সিংটনের হাতে একটা করে কালো হুড দিল ইউরোপিয়ান। ‘এগুলো পরে নিন।’
ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল ইতিহাসবিদের মুখ। ‘কেন পরতে হবে? আমি বাবা পরতে পারব না। ওই জিনিস পরিয়ে দেয়া হয় শুধু ফাঁসি দেয়ার আগে।’
‘পরে নিন,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘আর, বকবক বন্ধ করুন। নইলে আমি নিজেই আপনাকে…’
রানা পরার আগেই বস্তার মত জিনিসটা পরল কেন্সিংটন।
দীর্ঘক্ষণ চলল গাড়ি। টু শব্দ করছে না কেউ। যাত্রার পর থেকে প্রতিটি বাঁক ও মোড় মনে রাখতে চেষ্টা করেছে রানা। কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই হারিয়ে ফেলেছে দিক। সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে। টের পাচ্ছে, ভীষণ আতঙ্কে মৃদু কাঁপছে ইতিহাসবিদ। আবারও বামে বাঁক নিল ওরা। একটু লাফিয়ে উঠে একটা র্যাম্প বেয়ে নেমে গেল এসইউভি। কয়েক সেকেণ্ড পর থামল। বাইরে কয়েকজনের গলার আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। রানা বুঝে গেল, বদ্ধ কোনও জায়গায় থেমেছে ওরা। খটাং-খটাং আওয়াজে নামল স্টিলের সিকিউরিটি শাটার। খুলে দেয়া হয়েছে এসইউভির দরজা। থলের মত হুড কারা যেন খুলে নিল রানা ও কেন্সিংটনের মাথা থেকে।
কয়েকবার চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকাল রানা।
‘গাড়ি থেকে নামুন,’ নির্দেশ দিল ইউরোপিয়ান।
এসইউভি থেকে রানা ও কেন্সিংটন নামতেই ওদেরকে ঘিরে ধরল বেশ কয়েকজন।
ওরা আছে বিশাল এক পরিত্যক্ত ভবনের নিচে। গ্যারাজের মত জায়গাটায় অন্য কোনও গাড়ি নেই। ভবনের দেয়াল ও মেঝে কংক্রিটের তৈরি। মাথার ওপর ভারী স্টিলের গার্ডার। ছাত থেকে ঝুলন্ত শেকলের শেষে জ্বলছে টিউবের মত ফ্লুরেসেন্ট বাতি। প্রকাণ্ড ঘরের আরেক দিকে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সব শেলফ।
গাড়ির তিনজন তো আছেই, রানা ও কেন্সিংটনকে ঘিরে ধরেছে আরও তিনজন। সবার হাতে পিস্তল বা সাবমেশিন গান। রানার মনে হলো, আক্রমণ এলে গুলি করতে দেরি করবে না এরা। ওর সম্পর্কে ভাল ভাবেই সতর্ক করেছে জন ব্রাউন।
ওর বামে ছয় গজ দূরে লম্বা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ওঅর্কবেঞ্চ। ওটার ওপর নানান ধরনের পিস্তল ও সাবমেশিন গান।
লোকগুলোর দিকে ভয় নিয়ে চেয়ে আছে কেন্সিংটন। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল অস্ত্রের সমারোহ। ফিসফিস বলল, ‘বাপরে! এত অস্ত্র!’
চোখের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলল রানা। লোকগুলোকে পাশ কাটিয়ে বেঞ্চের কাছে গিয়ে থামল। শীতল হাসি ফুটে উঠল ইতালিয়ানের পাতলা ঠোঁটে। নিজের সংগ্রহ দেখাতে পেরে খুশি।
জন ব্রাউনের এসব স্যাঙাৎ তার বেআইনী অস্ত্রের ব্যবসায় চুনোপুঁটি হলেও সংগ্রহ করেছে ভাল জিনিস। নানান ধরনের অস্ত্র। পিস্তল, সাবমেশিন গান, প্রমাণ আকারের অ্যাসল্ট রাইফেল থেকে শুরু করে আরপিজি লঞ্চার— বাদ পড়েনি কিছু। প্রতিটি জিনিস নতুন। তেল দেয়া। চকচক করছে উজ্জ্বল বাতির আলোয়। বেঞ্চের আরেক দিকে খোলা- কয়েক সারি ক্রেট। ভেতরে নানান অ্যামিউনিশন। শেষের ক্রেটের ভেতর একগাদা ৪০ এমএম গ্রেনেড। মেঝেতে মুখ খোলা বড় এক ক্যানভাস হোল্ডঅল।
‘যা দেখছেন, ভাল লাগছে?’ জানতে চাইল ইতালিয়ান।
জবাব দিল না রানা। জন ব্রাউনের মনে আছে কোন্ পিস্তল ওর প্রিয়। বেঞ্চে ওয়ালথার পি.পি. দেখে ওটা দেখাল রানা।
গুপ্তধন পাওয়ার জন্যে মুখিয়ে আছে জমির শেখ। তার লোকদের যেমন দেখেছে, তাতে শুধু পিস্তলে চলবে না ওর।
বেঞ্চের পাশ দিয়ে হাঁটতে শুরু করে অস্ত্র দেখছে রানা। জরুরি ফায়ার পাওয়ার চাইলেও কায়রোর জনবহুল এলাকায় সঙ্গে রাখতে পারবে না ফুল সাইযের মিলিটারি রাইফেল।
কয়েক সেকেণ্ড পর রানার চোখে পড়ল পছন্দমত অস্ত্ৰ। ওটার দিকে রানা চেয়ে আছে দেখে ইতালিয়ান গুণ্ডা বলল, ‘এফএন এফ২০০০ অ্যাসল্ট রাইফেল। ভাল অস্ত্র। ৫.৫৬ ন্যাটো। হাই-ক্যাপাসিটি ম্যাগাযিন। আল্ট্রা-কমপ্যাক্ট বুলপাপ ডিযাইন। ইনবিল্ট স্কোপ ও অন-বোর্ড ফায়ার সিস্টেম কমপিউটার। সঙ্গে লেযার রেঞ্জফাইণ্ডার। ব্যারেলের নিচে ৪০ এমএম গ্রেনেড লঞ্চার।’
‘আমাকে গাইড করতে হবে না,’ বলল রানা।
চুপ হয়ে গেল ইতালিয়ান।
বেঁটে-খাটো অ্যাসল্ট রাইফেলটা হাতে তুলল রানা। স্পেস এজ ডিযাইন। নানান জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে প্লাস্টিক। দেখতে যেমন ভয়ঙ্কর, কাজেও তার চেয়ে কম নয়। এই ধরনের জিনিসই খুঁজছিল রানা। ওর হাত থেকে অস্ত্রটা নিয়ে হোল্ডঅলে পিস্তলের পাশে রাখল এক মিশরীয়।
‘কাজ শেষ?’ জানতে চাইল কেন্সিংটন। কাঁপছে গলা। ‘এবার আমরা যেতে পারি?’
‘একটু দেরি হবে,’ বলল রানা। বেঞ্চের একমাথা থেকে ছোট, বেঁটে একটা .৩৮ রিভলভার নিল ও। অস্ত্রটা ধরিয়ে দিল ইতিহাসবিদের হাতে।
‘আমার অস্ত্র চাই না,’ চোখ বড় বড় করে আপত্তি তুলল লোকটা। ‘আমি এসব পছন্দ করি না।’
‘একটা অস্ত্র নিতেই হবে,’ বলল রানা। ‘ভুলে গেলেন, আমরা টিমমেট? আপনার জন্যে বেছে নিয়েছি রিভলভার। সহজে নিজের পা ফুটো করতে বা আমার গায়ে গুলি বেঁধাতে পারবেন না। বাচ্চারাও পারবে ওটা চালাতে।’
নীরবে ঠোঁট বাঁকা করে হাসছে কয়েকজন আর্মস্ ডিলার। কেন্সিংটনের হাত থেকে নিয়ে পাশের লোকটার হাতে রিভলভার দিল রানা। অস্ত্রটা গেল হোল্ডঅলে।
‘পিস্তল ও রিভলভারের জন্যে পঞ্চাশটা করে বুলেট,’ ইতালিয়ানকে বলল রানা। ‘রাইফেলের জন্যে দু’শ’। আর ৪০ এমএম গ্রেনেড নেব দশটা।’
‘আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি ভাবছেন ছোটখাটো একটা যুদ্ধ বাধাবেন।’
‘সম্ভাবনা খুব বেশি।’
‘আরও কিছু লাগবে?’ কপট সরলতার সঙ্গে জানতে চাইল ইতালিয়ান আর্মস ডিলার।
‘আপাতত আর কিছু না,’ বলল রানা। ‘আপনি তো আগে থেকেই জানেন, কার কাছে বিল চাইতে হবে। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কর্নেল (অব.) জন ব্রাউন।’
.
সাত মিনিট পর আবারও হুড পরিয়ে এসইউভিতে তোলা হলো রানা ও কেন্সিংটনকে। কায়রোর দিকে চলল গাড়ি। ওদের দু’জনের মাঝে পায়ের কাছে পড়ে আছে অস্ত্রের হোল্ডঅল।
আধঘণ্টা পর থেমে গেল এসইউভি। ওদের মাথা থেকে খুলে ফেলা হলো হুড। চারপাশে চেয়ে রানা দেখল, ওদেরকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে ইজিপশিয়ান মিউযিয়ামের কাছে।
ওরা নেমে পড়তেই গাড়ি ছেড়ে দিল ড্রাইভার। আর্মস্ ডিলারদেরকে নিয়ে মিলিয়ে গেল ভারী ট্রাফিকের ভেতর।
‘চমৎকার অভিজ্ঞতার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ তিক্ত সুরে বলল কেন্সিংটন। ‘খুব ভাল লেগেছে। মাথা ঢেকে রেখেছে বস্তা দিয়ে। সবার সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র। আর এখন সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকছে নানান জাতের পিস্তল আর রাইফেল। কিন্তু, রানা, আসলে কি এসবের কোনও প্রয়োজন ছিল?’
ভারী হোল্ডঅল কাঁধে তুলল রানা। ভাড়া নেয়া ফোর- হুইল-ড্রাইভ গাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘স্বাগতম আমার দুনিয়ায়, কেন্সিংটন।’
ছত্রিশ
দুপুর বারোটা।
কায়রো শহর ত্যাগ করে নীল নদের পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণে চলেছে রানার শক্তিশালী, দ্রুতগামী ফোর-হুইল- ড্রাইভ। হাজার হাজার বছর ধরে মিশরের কৃষি ও পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এই নীল নদ। একপাশে সতেরো কিলোমিটার দীর্ঘ সরু বেল্টের মত সবুজ বনানী।
রানাকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম কেন্সিংটন। ডানে বাঁক নিয়ে একটু এগোতেই ফুরিয়ে গেল পাকা সড়ক। সামনে বালিময় ধূ-ধূ মরুভূমি। কয়েক শ’ গজ যেতেই প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের কাছে পৌঁছুল রানা ও কেন্সিংটন।
‘ব্যস, পৌঁছে গেছি সাহিরির পিরামিড কমপ্লেক্স আর মন্দিরের কাছে,’ বলল কেন্সিংটন। ‘দ্বিতীয় সূত্র থাকার কথা এখানে।’
হঠাৎ করে ল্যাণ্ড রোভার থামতেই চারপাশ থেকে ওটাকে ঘিরে ধরল উড়ন্ত বালি। গাড়ির ভেতরের শীতল এয়ার কণ্ডিশণ্ড পরিবেশ থেকে মাঝ দুপুরের আগুনে নেমে চমকে গেল কেন্সিংটন। কপালের ওপর হাত রেখে জ্বলজ্বলে বালির প্রান্তর ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ দেখল রানা।
চারপাশে ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো। একটু দূরে ধসে পড়া চারটে প্রাচীন পিরামিড যেন পাথর-বালির স্তূপ। ওগুলোর তুলনায় জ্যামিতিক ভাবে নিখুঁত গিযার পিরামিড হাজার গুণ সুন্দর। ভাবাই যায় না, একসময়ে এখানেও ছিল ঝকঝকে নতুন পিরামিড ও মন্দির। এগুলো দেখতে আসে না টুরিস্টরা। আশপাশে কেউ নেই। পশ্চিমে বুনো মরুভূমি গিয়ে মিশেছে লিবিয়া, আলজেরিয়া এবং শেষে সাহারার বালিময় পশ্চিম প্রান্তরে।
‘একজন টুরিস্টও নেই!’ মন্তব্য করল কেন্সিংটন। ‘সবাই যায় স্ফিঙ্কস্ দেখতে। ভাল। কেউ বিরক্ত করবে না। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুরে বেড়াতে পারব।’
‘আমরা কী খুঁজছি?’ জানতে চাইল রানা।
‘সম্পদ ও খ্যাতি,’ জবাবে বলল কেন্সিংটন। ‘আপনার জন্যে সম্পদ, আর আমার খ্যাতি।’
ল্যাণ্ড রোভার থেকে হোল্ডঅল নামিয়ে ওয়ালথার পি. পি. বের করল রানা। পিস্তলের ভেতর ম্যাগাযিন পুরল। অস্ত্রটা কক ও লক করে গুঁজে নিল জিন্সের প্যান্টের কোমরে।
‘ব্যাগে থাকলেই ভাল হতো না?’ বলল কেন্সিংটন। ‘এসব বাজে জিনিস দেখলেই নার্ভাস লাগে।’
‘পথ দেখান,’ বলল রানা।
ভাঙা পাথরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা। পেছনে নীল নদের তীরে সবুজ গাছপালা। মাথার ওপর নীল আকাশ। আগুন ঢালছে জ্বলন্ত, সাদা সূর্য। হঠাৎ করে চারপাশ দেখলে মনে হবে রুক্ষ জায়গাটা চাঁদের অংশ। শত শত গজ জুড়ে পাথরের খণ্ড। জায়গায় জায়গায় প্রকৃতির অত্যাচারে ক্ষয়ে যাওয়া খোদাই করা হাজার হাজার বছরের একটা-দুটো পিলার।
পিরামিডগুলোর দিকে আঙুল তাক করল কেন্সিংটন। ‘প্রতিটার ভেতর আছে সমাধি। এদিকেরটা নিউসেরের পিরামিড। ওদিকেরটা নেফেরিরকেয়ারের। তবে আমরা যাব উত্তর দিকের পিরামিডের কাছে। ওটাই সবচেয়ে পুরনো। ভেতরে রয়েছে সাহিরির সমাধি। মনে নেই, ওই যে: ‘সে এমন কেউ, যে কিনা রে-এর খুব কাছে।’ আমার গভীর বিশ্বাস, ওখানে আজ জরুরি কিছু পাব।’
পাথর খণ্ডের তৈরি সাগরে সাহিরির পিরামিডের দিকে চলল ওরা। প্রাচীন এক উঁচু রাস্তা ধরে খানিক যেতেই সামনে দু’পাশে পড়ল দাবার নৌকার মত দেখতে বৃত্তাকার দুই কলাম। রানা বুঝল, একসময় ও-দুটো ছিল সুন্দর কোনও খিলানের অংশ। ধ্বংসস্তূপের ভেতর প্রায় বোঝাই যায় না কোথায় ছিল বাড়িগুলো।
কাছে যেতেই পিরামিডটা যেন ঝুঁকে এল ওদের দিকে। রানার মনে হলো, ওটার আলগা পাথরগুলো যে-কোনও সময়ে খসে পড়বে। হাজার হাজার টন পাথরের ধস নামলে সেটা হয়তো দেখতে হবে এই পিরামিডের মতই। বালির মাঝ দিয়ে এগিয়ে ওটার কাছে চলে গেছে কেন্সিংটন। চেহারায় চিন্তার ছাপ। হাতের ইশারায় চারদিক দেখাল। ‘একসময়ে এই কমপ্লেক্সে ছিল সারি সারি ঘর, চেম্বার ও বিশাল দরবার। চারপাশে রঙিন পাথরের টাইল্স্ দিয়ে তৈরি ছবি: শিকার করছেন সাহিরি, বা মাছ ধরছেন। ওই যে, ওদিকে মন্দির।’ পায়ের কাছ থেকে একটা পাথর তুলল সে। ‘লাইমস্টোন। বোধহয় ছাত থেকে পড়েছে।’ কয়েক গজ বামে সরল কেন্সিংটন। ওখানে মেঝে লাল গ্র্যানেটের। ‘আর এখানে ছিল উৎসর্গ বা নৈবেদ্যের কক্ষ।’
কেন্সিংটন হাত দিয়ে যতই ঘর, চেম্বার বা দরবার দেখিয়ে বেড়াক, রানা শুধু দেখছে ভাঙাচোরা পাথর ও চারপাশের শূন্যতা।
ওই যে, ওখানে বিশাল নকল দরজা,’ উৎসাহের সঙ্গে বলে চলেছে কেন্সিংটন। ‘প্রাচীন মিশরীয়রা ভাবত, তাঁর জন্যে রাখা খাবার খেতে ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন রাজা। সোনা দিয়ে মোড়া থাকত প্রতিটা বাটি বা বাসন। তবে বহু কাল আগেই সব চুরি করে নিয়ে গেছে লুঠেরার দল।’
প্রতিটা মুহূর্তে রানা বুঝছে, নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সময়। যথেষ্ট বিরক্তি মনে জমতেই অধৈর্য স্বরে বলল, ‘দরকারি কিছুই নেই এখানে। ভাঙা পিরামিড দেখে মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে বাগদাদের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে প্রেসিডেন্ট বুশের আমেরিকান এয়ারফোর্স।’
ওর কথা শুনতেই পায়নি কেন্সিংটন। গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দেখছে চারপাশ। কয়েক মুহূর্ত পর বিড়বিড় করল, ‘ওটা এখানেই থাকবে। মডাক এখানেই পেয়েছে।’ দুই ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখল সে। রানার মনে হলো, গোপন কিছু বলবে ভাবছে লোকটা। ‘আমাদের বোধহয় সাহিরির পিরামিডের ভেতর ঢোকা উচিত। তারটা একমাত্র পিরামিড, যেটার গোপন কক্ষে এখনও পা রাখা যায়নি।’
কেন্সিংটনের পিছু নিয়ে পিরামিডের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগল রানা। একটু পর ওরা পৌঁছে গেল প্রায় ধসে পড়া একটা এন্ট্রান্সের সামনে। ধাপ বেয়ে উঠতে শুরু করে হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসল ইতিহাসবিদ। পরক্ষণে রানাকে অবাক করে দিয়ে হামাগুড়ির ভঙ্গি করল। ঢুকবে পিরামিডের সরু প্যাসেজের ভেতর।
‘এদিকে কিন্তু প্রচুর সাপ আছে,’ সতর্ক করল রানা।
‘বাজে কথা বাদ দিন,’ বলল কেন্সিংটন।
‘কাঁকড়া বিছেও কম নেই।’
‘আপনি আবার কবে এত ভিতু হলেন?’
‘সতর্কতা সবসময় জরুরি।’
‘গুড। কিন্তু আমি ভাল করেই জানি, এদিকে কোনও সাপ নেই।’
চুপ থাকল রানা। সরু প্যাসেজে ঢুকে পড়ল কেন্সিংটন। একটা মাঝারি বোল্ডারে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা। থমথম করছে চারপাশ। আগুন ঝরাচ্ছে সূর্য। একফোঁটা বাতাস নেই। ইতিহাসবিদের জন্যে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকল রানা। বিশ মিনিট পর ফোঁস ফোঁস আওয়াজ পেয়ে পিরামিডের মাঝের ফাটলের দিকে তাকাল ও। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে কেন্সিংটন। পোশাক ও সারাশরীরে ধুলো ও ঝুল। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরের বামদিক চেপে ধরল লোকটা। স্বাভাবিক করতে চাইছে শ্বাস।
‘কী পেলেন?’ জানতে চাইল রানা।
‘শালার কিছুই নেই,’ বিরক্ত সুরে বলল কেন্সিংটন। ‘পেলাম শুধু কোমরে ব্যথা।’
ঘুরে নিথর মরুভূমি ও ধ্বংসাবশেষ দেখল রানা। ধারণা করেছিল কিছুই পাবে না কেন্সিংটন, তবুও কেমন দমে গেল ওর মন। এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে জরুরি মুহূর্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ির দিকে পা বাড়াল ও।
‘কোথায় চললেন?’ পেছন থেকে ডাকল কেন্সিংটন।
‘এখানে কিছু পাব বলে মনে হচ্ছে না, তাই ফিরব কায়রোয়,’ হাঁটার গতি কমাল না রানা।
প্রাচীন রাস্তার উঁচু অংশে পৌছুতেই প্রায় ছুটে এসে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল কেন্সিংটন। আপত্তির সুরে বলল, ‘ফিরে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। সূত্রটা এখানেই আছে। আমি জানি। এখানেই সূত্র পেয়েছিল মডাক। আমরাও সময় দিলে পেয়ে যাব।
দুই পিলারের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। ওখানে থমকে দাঁড়িয়ে ইতিহাসবিদের মুখোমুখি হলো রানা। ‘আপনি তো এটাও জানেন না যে, কী খুঁজতে হবে। এমনও হতে পারে, জরুরি কিছু পেয়েছে বলে ভেবেছে মডাক। অথবা, হয়তো সত্যি কিছুই পায়নি।’
বাম পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে কপাল থেকে ঘাম মুছল কেন্সিংটন। ‘হায়, ঈশ্বর! এত গরম! মনে হচ্ছে নরকে পড়েছি!’
‘একদম নড়বেন না,’ সতর্ক সুরে বলল রানা।
বিস্মিত চোখে ওকে দেখল কেন্সিংটন। ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘একতিল সরবেন না।’
‘সৈনিকদের প্র্যাকটিকাল কোনও জোক্ করছেন আমার সঙ্গে?’ রাগে লালচে হলো ইতিহাসবিদের মুখ।
পিলারের গোড়া পেঁচিয়ে বালির সঙ্গে গা মিশিয়ে পড়ে আছে বড় একটা সাপ। ভীত হয়ে উঠেছে চারপাশের কম্পনে। ওই জাতটাকে ভাল করেই চেনে রানা। ত্রিকোণ মাথা, দু’পাশে ছোট দুটো কালো চোখ। চোখের ওপরে দুটো শিং। হর্নড় ভাইপার বা শিংযুক্ত ভাইপার। আরব এলাকা এবং আফ্রিকার সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ। ওটা দৈর্ঘ্যে অন্তত ছয় ফুট। পিলার থেকে পাক খুলে সরসর করে চলেছে কেন্সিংটনের পায়ের ওপর দিয়ে।
পায়ের ওপর দিয়ে ভারী কী যেন যাচ্ছে বুঝে নিচে তাকাল ইতিহাসবিদ। সাপটাকে দেখেই ভীষণ আতঙ্কে বিস্ফারিত হলো দুই চোখ। লালচে মুখ মুহূর্তে হলো মড়ার মুখের মত ফ্যাকাসে।
‘একদম নড়বেন না,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘চলে যাবে। বিরক্ত না করলে আক্রমণ করে না এই সাপ।’
কিন্তু এরই ভেতর পাগলা কুর্দন জুড়েছে কেন্সিংটন। হয়তো ভাবছে বুট দিয়ে মাড়িয়ে মেরে ফেলবে ছয় ফুটি সাপ!
হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে ফোঁস্ করে ফণা তুলল ভাইপার। হামলা করবে। পিছিয়ে গেল ত্রিকোণ মাথা। বেরিয়ে এসেছে বাঁকা, দীর্ঘ দুটো বিষদাঁত। ছোবল দেবে এখুনি।
কিন্তু কেন্সিংটনকে ছোবল দিল না সাপটা। ঝড়ের বেগে কোমর থেকে ওয়ালথার নিয়েই সাবলীল ভঙ্গিতে গুলি করল রানা। ভাইপারের মাথাটা বিস্ফোরিত হতেই বালির ওপর থপ করে পড়ল দেহটা। ছটফট করছে মুণ্ডহীন সাপ। এদিকে টানা করুণ আর্তনাদ জুড়েছে কেন্সিংটন। উদ্দাম নেচে চলেছে নরকের কোনও শ্বেতাঙ্গ পিশাচের মত। ধ্বংসাবশেষে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলছে গুলির আওয়াজ।
‘না, এখানে সাপ নেই,’ প্রাণীটাকে হত্যা করে বিরক্ত বোধ করছে রানা। নিথর দেহটা তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলবে, তাই ঝুঁকল। আর তখনই ওর চোখে পড়ল গুলির আঘাতে চটে গেছে কেন্সিংটনের পেছনের পাথুরে কলাম। পাথরের পাতলা স্তরের ভেতরে কিছু চিহ্ন। বোধহয় প্রাচীন ইতিহাসের অংশ।
মরা সাপ হাতে উঠে দাঁড়াল রানা। পরক্ষণে হাত থেকে মৃত সাপ ফেলে আবারও ঝুঁকে গেল পিলারের দিকে।
‘আমি তো মরেই গেছি! আপনি আবার কী করছেন?’ রানার দিকে তাকাল কেন্সিংটন।
জবাব না দিয়ে বয়সে ভারাক্রান্ত পাথরে হাত বোলাল রানা। গুলির আঘাতে কলামের নিচে যেসব কারুকাজ করা চিহ্ন দেখা যাচ্ছে, সেগুলো একেবারেই অন্যরকম।
‘আমার মনে হয় এটা আপনার দেখা উচিত,’ কেন্সিংটনকে বলল রানা।
‘কী দেখব?’
পাথরের দিকে আঙুল তাক করল রানা।
‘ও, ওটা,’ বলেই থমকে গেল কেন্সিংটন। পরক্ষণে বলল, ‘কিন্তু এটা তো…’
‘ওপরের দিকেরগুলো না,’ বলল রানা। ‘আরও নিচে। ভিত্তির কাছে।’
কয়েক সেকেণ্ড পর ওই জায়গায় চোখ পড়ল কেন্সিংটনের।
‘স্কটল্যাণ্ডের পাব-এ আপনার দেখানো সেই সিল,’ বলল রানা। ‘মন্দির ঘিরে রাখা পাম গাছ। ছাতের ওপর মুকুট পরা দাঁড়কাক।’
হাঁটু গেড়ে বসল কেন্সিংটন। ‘আরেহ্, তাই তো!’ আঙুল দিয়ে পিলারের ভিত্তির ওপর জমে থাকা বালু সরাল সে। পাথরের গায়ে চিহ্নগুলো দেখেই ঘুরে তাকাল রানার দিকে। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। ভুলে গেছে সাপের কথা। ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, রানা! এটাই মানকাউয়ার সিল। এখানে এসেছিলেন তিনি। নিশ্চয়ই এটাই খুঁজে পায় মডাক।’
‘সিলের নিচে চিহ্নগুলো কীসের?’ জানতে চাইল রানা। পিলারের কাছে নাক নিল কেন্সিংটন। ‘হাজার হাজার বছর আগের পাথর। ক্ষয়ে গেছে। তবে মনে তো হচ্ছে হায়ারোগ্লি।’ আরও ভাল ভাবে দেখার জন্যে মোটা শরীরটা বালির ওপর থপ্ করে ফেলল সে। আঙুল বোলাল চিহ্নগুলোর ওপর। কী যেন দেখছে। কয়েক মুহূর্ত পর মুখ তুলে রানাকে দেখল। ‘এই গ্লিফ দিয়ে বোঝানো হয়েছে উঁচু আসন বা চেয়ার। কিন্তু চেয়ার দিয়ে কী বোঝাচ্ছে?’
‘আমার কাছে জানতে চাইছেন কেন,’ বলল রানা। ‘আপনি না এসবে এক্সপার্ট?’
এই জিনিস আরও থাকবে,’ বলল কেন্সিংটন। ‘আমাদের উচিত পুরো এলাকা তল্লাশী করা।’
‘আমার তো ধারণা সেই কাজই করছিলেন,’ বলল রানা। ‘এবার চলুন, ফেরা যাক। এখানে থেকে সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না।’
‘কিন্তু…’
‘চলুন। শহরে ফিরব। আপনি যেহেতু এক্সপার্ট, আবিষ্কার করে নেবেন চেয়ার বা আসন দিয়ে কী বুঝিয়েছে।
রানার পিছু নিয়ে বিমর্ষ চেহারায় গাড়ির কাছে ফিরল কেন্সিংটন। কড়া রোদে ভীষণ গরম হয়েছে চামড়ার সিট। ওখানে বসেই দুই হাতে পশ্চাদ্দেশ ধরে হাউমাউ করে উঠল সে। জ্বলুনি সহ্য না করে উপায় নেই। গম্ভীর চেহারায় ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল রানা। বালির প্রান্তর পার করে পাকা সড়কে উঠতেই ঝড়ের বেগে চলল কায়রোর দিকে। দু’পাশে সবুজ মাঠ। একটু দূরেই নীল নদ।
‘আসন বা চেয়ার আসলে রূপক,’ বলল কেন্সিংটন।
‘তা-ই?’
‘এটা না হয়েই যায় না! সিম্বলের মাধ্যমে তথ্য দিতে চেয়েছেন মানকাউয়া। আর সেটা বুঝলেই যেতে হবে নির্দিষ্ট কোনও জায়গায়। আসন। চেয়ার।’ ভুরু কুঁচকে মাথার চাঁদিতে হাত বোলাচ্ছে ইতিহাসবিদ। ‘বুঝতে পেরেছি। ওই সিম্বল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে কর্তৃত্ব। যেমন সিট থাকে এমপি বা মন্ত্রীদের, তেমন।’
‘আন্দাজে খড়ের গাদায় সুঁই খুঁজছেন,’ মন্থর গতির একটা ট্রাক ওভারটেক করে বলল রানা। আবারও গতি তুলছে।
‘এর চেয়ে ভাল কোনও আইডিয়া আছে আপনার কাছে?’
‘আপাতত না। আপনি নিজেও খুব সুবিধা করতে পারছেন না। আমার অজানা ছিল যে প্রাচীন আমলের মিশরীয়রা রূপক ব্যবহার করত।’
‘ওরা রূপক ব্যবহার করত, সেটা এখনও জানে না অ্যাকাডেমিকরা,’ বলল কেন্সিংটন। ‘তবে আমি বুঝে গেছি। রূপক ছাড়া এটা আর কিছুই নয়। আমরা জানি, মানকাউয়া ছিলেন প্রধান পুরোহিত। ক্ষমতাশালী মানুষ। আখেনাতেন ক্ষমতায় বসে ধর্মের বারোটা বাজাতে শুরু করার আগে তিনি ছিলেন প্রায় রাজার মতই প্রভাবশালী। থিবসের কাছে ছিল তাঁর এস্টেট। আজকাল যে শহরের নাম দিয়েছে মানুষ লাক্সর। আমার ধারণা, মডাকও এটা জানত। আর সেজন্যেই ওখানে যেতে চেয়েছিল।’
‘আপনি কি বলতে চাইছেন, আমাদেরও যাওয়া উচিত ওখানে?’ জানতে চাইল রানা।
‘এ ছাড়া উপায় কী? ঘুরে দেখা দরকার মানকাউয়ার এস্টেট। বা যতটুকু আছে। ওখানে নিশ্চয়ই পাব পথের নির্দেশনা।’
‘সেটা কী ধরনের হতে পারে?
‘ওখানে না পৌঁছে কিছুই বলা অনুচিত, গম্ভীর কণ্ঠে বলল কেন্সিংটন।
‘আসন বা চেয়ার,’ বিড়বিড় করল রানা। তুমুল বেড়ে চলেছে গাড়ি। তবে হঠাৎ করেই কড়া ব্রেক কষল ও। কাত হয়ে পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিল ল্যাণ্ড রোভার। সিটবেল্ট বেঁধে না রাখলে সামনের দিকে ছিটকে পড়ত ইতিহাসবিদ। ফাঁকা রাস্তার মাঝে থেমে গেছে ওরা।
‘এ ধরনের পাগলামির মানেটা কী?’ খেপে গিয়ে জানতে চাইল কেন্সিংটন।
‘ওই সিম্বল দিয়ে জমি বা এস্টেট বোঝাতে যায়নি,’ বলল রানা। ‘জায়গার কথা উল্লেখ করেনি। ওটা আসলে কোনও রূপক নয়।’
‘তা হলে কী?’
‘সহজ অর্থকে জটিল করে তুলছেন আপনি। উত্তর খুব সহজ।’
‘তা হলে বলে ফেলুন না।’
‘একটা আসন। সত্যিকারের। সেটা চেয়ার বা রাজ সিংহাসনও হতে পারে।’
কয়েক মুহূর্ত কড়া চোখে রানাকে দেখল কেন্সিংটন, তারপর হো-হো করে হেসে ফেলল। ‘রাজ সিংহাসন? মানে যেগুলোতে বসত রাজারা? আপনি ভাবছেন চরম শত্রু, পাষণ্ড আখেনাতেনের সিংহাসনের ভেতর গোপন সূত্র রেখেছেন মানকাউয়া? এটা তো কোনও পাগলও ভাবতে পারবে না। অথচ, আপনি ভেবেছেন।
‘আরে, গাধা, তার নিজের আসনের কথা ভাবুন,’ বলল বিরক্ত রানা। ‘তিনি ছিলেন উচ্চপর্যায়ের পুরোহিত। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। ইতিহাসে পড়েননি, ক্ষমতাশালী লোক বড় সব চেয়ারে বসতেন? নিজের চেয়ারে পছন্দমত জিনিস খোদাই করে নেয়ার জন্যে বহুত সময় পেয়েছেন মানকাউয়া। আমাদের এখন গিয়ে দেখা উচিত, কোন্ মন্দিরে পাত পেড়ে ভক্তদেরকে ঠকাতেন। বড়সড় আকারের চেয়ার হবে।’
থুতনি চুলকাতে শুরু করে ভাবছে উইলিয়াম কেন্সিংটন। কয়েক মুহূর্ত পর আনমনে বলল, ‘এখন তো মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক! দেখা দরকার ব্যাপারটা।’ রানার দিকে তাকাল সে। ‘তা হলে আমরা এখন কোথায় যাব?’
আবারও রওনা হলো রানা। ‘এমন এক জায়গায়, যেখানে ডাঁই দিয়ে রেখেছে পুরনো সব চেয়ার।’
সাঁইত্রিশ
বিকেল তিনটে।
দুপুরের খাবার সেরেই সময় নষ্ট না করে মিশরের প্রকাণ্ড মিউযিয়ামে হাজির হয়েছে রানা ও কেন্সিংটন।
এ দেশের আর্টিফ্যাক্টের সবচেয়ে বড় কালেকশন আছে এখানেই। নিয়ো-ক্লাসিকাল ফ্যাসেড পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় চওড়া এন্ট্রান্সে। বাইরে ভীষণ রোদে পাম গাছ পুড়লেও ভবনের ভেতর শীতল পরিবেশ। মসজিদ, মন্দির বা চার্চের মতই নিস্তরঙ্গ, হৈ-হট্টগোলহীন।
এইট্রিয়ামে প্রতিধ্বনি তুলল রানা ও কেন্সিংটনের বুট জুতো। উঁচু ছাত পর্যন্ত প্রায় পৌঁছে গেছে দানবীয় সব মূর্তি। চারপাশে ইজিপ্টের প্রাচীন ঐতিহ্যের অদ্ভুত বিশাল প্রদর্শনী।
‘বহু দিন এখানে পা রাখিনি,’ চারপাশে চেয়ে ফিসফিস করল কেন্সিংটন। ‘ভুলেই গিয়েছি কী সুন্দর মিউযিয়াম এটা।’
কেন্সিংটনের কথা ঠিক, মনে মনে সায় দিল রানা। তখনই বুকের ভেতর কে যেন বলল, এখন এসব দেখার সময় নেই। তুই ব্যর্থ হলেই ভয়ঙ্কর ভাবে খুন হবে একজন।
মেইন ডেস্কে থামল রানা। ওদিকে বসে আছেন শান্ত চেহারার চিকন, মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। টাক পড়ছে মাথায়। রানাকে বিদেশি ধরে নিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কি কোনও সাহায্যে আসতে পারি?’
‘আমি আসলে প্রাচীন সব আনুষ্ঠানিক চেয়ারের ব্যাপারে আগ্রহী,’ বলল রানা। ‘যেমন রাজ সিংহাসন। আপনাদের এখানে সে ধরনের বিশেষ কোনও প্রদর্শনী আছে?’
অদ্ভুত অনুরোধ শুনে ঠোঁট মুড়ে ভাবতে লাগলেন অ্যাটেণ্ডেণ্ট। কয়েক মুহূর্ত পর বললেন, ‘আমাদের মিউযিয়ামে সব মিলে আছে এক লাখ বিশ হাজার আর্টিফ্যাক্ট। সেগুলোর ভেতর আছে অনেক রাজ সিংহাসন আর আনুষ্ঠানিক চেয়ার। ওপরতলায় রয়েছে তুতেনখামেনের প্রদর্শনী। ওটা পাবেন পুব আর উত্তরের উইঙে। সেখানেই আছে তাঁর রাজ সিংহাসন। আপনার হয়তো ভাল লাগবে।’
‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। তবে তুতেনখামেন নয়,
আমি খুঁজছি আরও কিছু বছর আগে এক প্রধান পুরোহিতের আসন। তাঁর নাম ছিল মানকাউয়া।
আবারও কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন অ্যাটেন্ডেন্ট। ‘এখানে আছে রানি হেতেফেয়ারেসের প্রায় সব আসবাবপত্র এবং রাজ সিংহাসন।’
‘সেটাও ঠিক খুঁজছি না।’
‘তা হলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমার পক্ষে আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়, একটু রেগে গিয়েই বললেন ভদ্রলোক। ‘আপনি যেটা খুঁজছেন, ওটা হয়তো আছে অন্য কোথাও।
ডেস্কের কাছ থেকে সরে এল রানা।
কিছুটা দূরে ঘাড় কাত করে উত্তেজিত চেহারায় নানান নিদর্শন দেখছে উইলিয়াম কেন্সিংটন।
তাকে রেখে মিউযিয়ামের নিচতলা ঘুরে দেখতে লাগল রানা। চিন্তিত। আর্কিওলজিকাল আর্টিফ্যাক্টের দিকে খেয়াল নেই।
এবার কোথায় যাবে?
হাতে মাত্র একটা সূত্র, কিন্তু ওটা নিয়ে এগোবার কোনও পথ খোলা নেই!
ঘরের পেছনে পৌঁছে হঠাৎ করেই রানা বুঝল, ও দাঁড়িয়ে আছে আখেনাতেনের সেই শাসনকালের আমারনা থেকে সংগৃহীত সব নিদর্শনের মধ্যে। সামনেই পাষণ্ড ‘ফেরাউনের পাথুরে মূর্তি। বাঁকা ‘ দুই চোখ। ঝুঁকে পড়া দীর্ঘ মুখ। অস্বাভাবিক লম্বা খুলি। যেন এলিয়েনদের করোটি। কেন্সিংটনের কথা মনে পড়ল রানার। রাজার দৈহিক গড়ন ছিল অস্বাভাবিক ও বিকৃত। মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন, বা কীভাবে এত মানুষের ঘৃণা ও ভয় অর্জন করেছেন, তা সম্পর্কে *খুব কম তথ্যই দিতে পেরেছে ইতিহাসবিদরা। তাঁর দেশের মানুষই চেয়েছে ইতিহাসের বই থেকে তাঁকে উপড়ে ফেলতে। অদ্ভুত মূর্তি আরও ভালভাবে দেখতে গিয়ে রানা খেয়াল করেনি, পেছনে এসে থেমেছে আরেক মিউযিয়াম অ্যাটেণ্ডেন্ট। এর বয়স বড়জোর ত্রিশ। মুখে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি।
‘এক্সকিউয মি, স্যর, আমার কলিগের সঙ্গে আপনার কথাগুলো কানে এসেছে। তাই ভাবলাম, আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারব।’
ঘুরে মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘আমি খুঁজছি আখেনাতেনের আমলের প্রধান পুরোহিত মানকাউয়ার আসন।
দুঃখজনক যে আমাদের কালেকশনে নেই ওটা,’ বলল অ্যাটেন্ডেন্ট। ‘ঠিকই বলেছেন আমার কলিগ। তবে মিশর, ইউরোপ আর আমেরিকায় রয়েছেন শত শত প্রাইভেট কালেক্টর। আপনি যেটা খুঁজছেন, ওটা হয়তো আছে তাঁদের কারও কাছে।’
‘এ ধরনের কালেক্টরদের ডিরেক্টরি আছে না আপনাদের কাছে? অথবা দিতে পারবেন কোনও লিস্ট, কী ধরনের জিনিস আছে তাঁদের কার হাতে?
‘কিউরেটরের সঙ্গে আলাপ করে দেখতে পারি,’ বলল অ্যাটেণ্ডেণ্ট। ‘তবে তিনি ব্যস্ত মানুষ। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে সময় লাগবে। অবশ্য আমার মনে হচ্ছে, এসবের ভেতর না গিয়ে অনেক কম ঝামেলায় জবাব পেয়ে যাবেন। আমি এক ভদ্রলোককে চিনি, তিনি বোধহয় জানাতে পারবেন এ ধরনের তথ্য। তিনি এমন এক মানুষ, যিনি জানেন না এমন কোনও অ্যান্টিকুইটি পৃথিবীতে নেই। তিনি হয়তো বলে দিতে পারবেন কোথায় আছে সেই আসন।’
ক্ষীণ আশা জেগে উঠল রানার মনে। ‘নাম কী তাঁর?’
‘তাঁর নাম ইউডন ভাদিম,’ জানাল অ্যাটেণ্ডেণ্ট।
‘বলতে পারেন কোথায় পাব তাঁকে? মানকাউয়ার আসনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া আমার জন্যে খুব জরুরি।’
মৃদু হাসল অ্যাটেণ্ডেণ্ট। ‘আমার সঙ্গে আসুন। আমার অফিসে তাঁর ফোন নাম্বার আছে।’
.
যখন তখন খুন হবে ভাবতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে ইউডন ভাদিম। এখন চুপ করে বসে আছে ডেস্কের পেছনে। আপাতত আর কেউ নেই ভিলায়। আট পেগ ব্র্যাণ্ডি খাওয়ার পরেও মন থেকে দুশ্চিন্তা দূর করতে পারছে না ভাদিম। যে- কোনও দিন আবারও হাজির হবে জমির শেখ। আর তারপর হয়তো খুব কষ্ট দিয়ে মারবে ওকে। হঠাৎ সচেতন হলো সে। ডেস্কের কোণে থরথর করে কাঁপছে সাইলেন্ট করা মোবাইল ফোনটা।
কল রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না ভাদিমের।
পালিশ করা ডেস্ক থেকে পড়ে যাক মোবাইল ফোন! চুরমার হয়ে যাক!
যে হারামজাদা ফোন করেছে, সে যে জমির শেখ, তাতে সন্দেহ নেই!
আর কারও ঠেকা পড়েনি ওকে কল করবে।
ভাদিমের আজকাল মনে হয়, একসময়ে যে দুর্দান্ত ব্যবসা ছিল, সেসব বোধহয় সুদূর অতীতের কল্পনা। প্রতি দিন আসত দারুণ সব সুসংবাদ।
আর আজ?
বহু দিন মন ভরে দেখে না নীল আকাশ।
দেখা হয়ে ওঠে না সূর্যোদয়।
কত হাজার বছর আগে শেষবার দেখেছিল চমৎকার কোনও শিল্প?
আর অপেরায় গিয়ে মধুর বাজনা শোনা?
সেসব তো ভুলেই গেছে সে!
কত দিন হলো সুন্দরী কোনও মেয়ের কাছে যায়নি সে?
কতকাল হলো ঘুমাতে পারে না?
ক্রমাগত আতঙ্কের ভেতর বাস করতে গিয়ে বেঁচে থেকেও যেন মরে গেছে সে।
আসলে মরে যাওয়াও এর চেয়ে ভাল ছিল!
আবারও মোবাইল ফোন থরথর করে কাঁপছে দেখে হঠাৎ মনে পড়ল ভাদিমের, এই লোক জমির শেখ হতে পারে না। ওই হারামজাদা বলে গেছে, জরুরি ব্যবসার কাজে কয়েক দিনের জন্যে কায়রোর বাইরে যাচ্ছে। গোপনে কী যেন করছে হিংস্র পশুটা। নিশ্চয়ই সর্বনাশ করবে একদল মানুষের। জানোয়ারটা কী করবে, সেটা জানতেও চায়নি ভাদিম।
আজকাল মনে হয়, ওকে জোর করে মরুভূমিতে ধরে নিয়ে যাবে জমির।
ওর মাথার ভেতর একটা বুলেট গেঁথে দিয়ে চলে যাবে নিজের কাজে।
শকুন ছিঁড়ে খাবে ওর লাশ!
পলকের জন্যে ভাবল ভাদিম, লোকটা কি ওকে সহজ কোনও মৃত্যু দিতে পারে না?
সেটাও বোধহয় তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মরার চেয়ে ভাল!
নীরবে থরথর করে কাঁপছে মোবাইল ফোন
হঠাৎ করেই মনের কোণে একতিল কৌতূহল জাগল ভাদিমের। হাত বাড়িয়ে তুলে নিল যন্ত্রটা। রিসিভ বাটন টিপে কানে ঠেকিয়ে বলল, ‘হ্যালো?’
‘আপনি কি ইউডন ভাদিম?’ ওদিক থেকে জানতে চাইল পুরুষকণ্ঠ।
এই লোক অপরিচিত। চোখ সরু করে বলল ভাদিম, ‘হ্যাঁ, বলছি। আপনি কে?
‘আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার নাম মাসুদ রানা। আপনি বিরক্ত না হলে কিছু কথা বলতাম।’
মাসুদ রানার নাম শুনে মনে মনে হোঁচট খেয়েছে ভাদিম। এই লোকই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল জমির শেখকে। তারপর থেকে ভীষণ খেপে আছে জঙ্গি-নেতা। মাসুদ রানা অচেনা সেই বিদেশি, যে কিনা বহু কিছু জানে মর্ডাক ব্রাউনের প্রজেক্টের ব্যাপারে। আশার আলো দেখছে ভাদিম। বিস্ময় লুকিয়ে নকল ভদ্রতা দেখাল। ‘না-না, বিরক্তির কী আছে। নিশ্চয়ই সময় নেবেন। বলুন, আপনাকে কী ভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘আমি একজন অখ্যাত লেখক। রিসার্চ করছি বই লেখার জন্যে। আমাকে বলা হয়েছে, ইজিপশিয়ান অ্যান্টিকুইটির বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে যেন আপনার সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করি।’
ঠিক কী খুঁজছে খুলে বলল অখ্যাত লেখক।
মাসুদ রানার মিথ্যা বক্তব্য শুনতে শুনতে বহু দিন পর হাসল ভাদিম। আনমনে ভাবল: প্রায় অচেনা এক প্ৰধান পুরোহিতের আসন নিয়ে এত উঠে পড়ে লেগেছে কেন এই লোক? আরও তথ্য চাই। নইলে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! ‘সম্ভব হলে অবশ্যই সাহায্য করব। আপনি চলে আসুন আমার বাড়িতে। দেখা যাক কাজে লাগতে পারি কি না। …জী, হ্যাঁ, আমি এখন ফ্রি আছি। বলে দিচ্ছি কীভাবে পৌছুতে হবে। আপনি ঠিকানা লিখে নিন।’
.
ফুলেল বাগানঘেরা বিশাল ভিলা। সামনেই ক্লাসিকাল ফ্যাসেড। উঠানে কারুকাজ করা ফোয়ারা থেকে ছিটকে উঠছে জল। একটু দূরে রোদের ভেতর ঝলমল করছে লাল একটা ফেরারি স্পোর্টস্কার।
নুড়িপাথরে কড়মড় আওয়াজ তুলে থেমে গেল ল্যাণ্ড রোভারের চওড়া চার চাকা। গাড়ি থেকে নামার আগে একবার রানার দিকে তাকাল কেন্সিংটন। বিড়বিড় করল, ‘দারুণ সুন্দর বাড়ি!’
‘ওই লোক বোধহয় শুধু অ্যান্টিকুইটির এক্সপার্ট নন, ওসবের ডিলার,’ বলল রানা।
গাড়ির আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে অভিজাত চেহারার লম্বা এক লোক। মুখটা রোদে পোড়া হলেও তাকে ইউরোপিয়ান বলেই মনে হলো রানার। তার পরনে বেইজ চিনো ও গাঢ় নীল সিল্কের শার্ট। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে সাবলীল ভঙ্গিতে। হাসিটা আন্তরিক। রানা ও কেন্সিংটন গাড়ি থেকে নেমে পড়তেই হাত বাড়িয়ে দিল রানার দিকে। ‘আপনিই বোধহয় মিস্টার রানা? আমি ইউডন ভাদিম। খুশি হলাম পরিচিত হয়ে।
করমর্দন করল রানা ও ভাদিম।
‘আর ইনি আমার রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট উইলিয়াম কেন্সিংটন,’ বলল রানা।
‘ইয়ে… হ্যাঁ… ডক্টর উইলিয়াম কেন্সিংটন,’ চট্ করে রানাকে একবার দেখে নিল ইতিহাসবিদ।
ভদ্রতা দেখিয়ে হাতের ইশারায় রানা ও কেন্সিংটনকে বিলাসবহুল রিসেপশন রুমে নিল ভাদিম। দেরি হলো না ড্রিঙ্ক হাজির করতে। দামি হোয়াইট ওয়াইনে চুমুক দিয়ে মিশরীয় অ্যান্টিকুইটির সমঝদার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার কাজে নামল রানা। মুখ সামান্য হাঁ করে ওর ডাহা মিথ্যা বোলচাল শুনতে লাগল কেন্সিংটন।
কিছুক্ষণ শোনার পর মিষ্টি হেসে ভাদিম বলল, ‘মিস্টার রানা, লেখার জন্যে যে সাবজেক্ট বেছে নিয়েছেন, আমার তো মনে হচ্ছে দারুণ কাটতি হবে আপনার বইয়ের!’
কেন মানকাউয়ার ওপর রিসার্চ করছে, তা নিয়ে গম্ভীর চেহারায় আরও সব মিথ্যা বলতে লাগল রানা। শেষে যোগ করল, ‘আমার কেন যেন মনে হয়েছে, সেই আমলের ইতিহাসকে ঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। আর সেজন্যেই আমার বইয়ে ফুটিয়ে তুলতে চাই সত্যিকারের সেই পরিবেশ। একগাদা মিথ্যা বলে মনে মনে জিভ কাটল রানা। ভাবছে, ব্যাটা আবার চাপাবাজি ধরে ফেলল না তো?
নাহ্, মনে হচ্ছে গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে।
বরফের মত ঠাণ্ডা ওয়াইনে রানার গ্লাস ভরে দিল ভাদিম। কিছুক্ষণ চিন্তিত চেহারায় মাথা দোলাবার পর জানাল, কাদের কাছে রানা পাবে আখেনাতেনের আমলের আর্টিফ্যাক্ট। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রতিষ্ঠিত কালেক্টর।
‘আপনার সময় আর নষ্ট করব না,’ বলল রানা। ‘আপনার কি জানা আছে কার কাছে আছে মানকাউয়ার আসন?’
জবাব দিতে গিয়ে রানার খালি গ্লাসের ওপর চোখ পড়ল ভাদিমের। বলল, ‘কী দুঃখজনক! আপনাকে যে আরেকটু ওয়াইন দেব, সে-উপায় নেই। ফুরিয়ে গেছে। একটু অপেক্ষা করুন। ফ্লোর থেকে নিয়ে আসি।’
‘ধন্যবাদ,’ বলতে গিয়েও মাথা নাড়ল রানা। ‘না-না, আর লাগবে না।’
এই গরমে ভাল লাগবে,’ আন্তরিক স্বরে বলল ভাদিম। ‘প্লিয, নিন। আমি খুশি হব। পাঁচ মিনিটের ভেতর ফিরছি।’
ইউডন ভাদিম ঘর ছেড়ে যেতেই রানার কানের কাছে মুখ নিল কেন্সিংটন, ‘ভাল লোক বলেই তো মনে হচ্ছে।’
জবাব দিল না রানা।
পাঁচ মিনিট পর আবারও দরজায় হাজির হলো ভাদিম। হাতে ওয়াইনের বোতল নেই, বদলে আছে একেএস অটোমেটিক ওয়েপন!
আটত্রিশ
এ মুহূর্তে লিবিয়ার ট্রিপোলি শহরে জরুরি মিটিঙে ব্যস্ত জঙ্গি- নেতা জমির শেখ। হলদে রঙ করা এক ঘরে বসে আছে সে। টেবিলের ওদিকে তিন ইউরোপিয়ান লোক। তবে তাদের কাউকেই চেনে না জমির। এমন এক সুরে ইংরেজি বলে এরা, যা আগে শোনেনি সে। বুঝতে দেরি হয়নি, ভয়ঙ্কর সাপের মতই বিপজ্জনক এরা।
এদের ভেতর যার বয়স বেশি, সে-ই দলনেতা। চওড়া কাঁধ। পরনে দামি সুট। মাথাভরা সাদা চুল। মুখ কঠোর। বোতামের মত ছোট চোখদুটো দেখেছে ভয়ানক সব দৃশ্য। তার চাহনিতে যে কঠোরতা, জীবনে প্রথমবারের মত চোখ নিচু করে নিয়েছে জমির। দলনেতার সামনে পড়ে আছে বন্ধ একটা ফোল্ডার।
এখানে এসে তাচ্ছিল্যের পাত্র হয়ে এখন নিজেকে ঘৃণা করছে জমির। অন্য কোথাও কেউ এমন বাড়াবাড়ি করলে সঙ্গে সঙ্গে খুন করত। কিন্তু এদেরকে চটিয়ে দিতে পারবে না। এদের সঙ্গে একবার দেখা করবে বলে বহু দিন অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করেছে সে। আজই নির্ধারিত হবে কোন্ পথে চলবে তার জীবন। হয়তো এজন্যে চিরকালের জন্যে কুখ্যাত বা বিখ্যাত হয়ে উঠবে। বদলে যাবে সব।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার ফাঁকে উপযুক্ত সম্মান দেখিয়ে চলেছে জমির। তার সঙ্গে দেখা করতেই বহু দূর থেকে এসেছে এরা। চাইলেই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা অসম্ভব। মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য সবার হয় না। তবে দেখা হলেই নিতে হবে ভয়ঙ্কর ঝুঁকি। যে-কোনও সময়ে আসবে মৃত্যু।
সব বুঝেই এই পথ বেছে নিয়েছে জমির।
‘কোথায় টাকা,’ বলল দলনেতা। বাড়তি কথার লোক নয় সে। গলার আওয়াজ ভারী। গুমগুম করে ওঠে।
‘আপাতত দিতে পারব এক মিলিয়ন আমেরিকান ডলার,’ বলল জমির। ‘ক্যাশ বা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। আপনারা যেটা চান।’
‘আমরা চেয়েছি পঁচিশ মিলিয়ন ডলার, ‘ ডানদিকের লোকটা জানাল। কুঁচকে গেছে ভুরু। চিকন গড়নের লোক সে। বয়স কম। করোটির সঙ্গে সেঁটে আছে তেল দেয়া চুল। ডান চোখের চারপাশ ক্ষত-বিক্ষত। হয়তো তারকাঁটা দিয়ে চোখ উপড়ে নিতে চেয়েছিল কেউ। ‘নগদ ডলার চাই না। আমার তো ধারণা ছিল, আগেই এসব কথা বলা হয়েছে আপনাকে।’
‘আমার মনে হচ্ছে আমাদের সময় নষ্ট করতে এসেছেন আপনি, মিস্টার শেখ,’ বামের লোকটা জানাল। টোকা দিল টেবিলের ওপর রাখা ব্রিফকেসে।
চুপচাপ তীব্র দৃষ্টিতে জমিরকে দেখছে দলনেতা। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখল কড়া ভরা দুই হাতের আঙুল।
চোখ সরিয়ে নিল জমির। ‘টাকার ব্যবস্থা হবে।’
‘কখন?’
এই প্রশ্নের জবাব জানা নেই জমিরের। ক্রমেই আরও চিন্তিত হয়ে উঠছে সে। মাসের পর মাস পেরিয়ে গেছে, এখনও পাওয়া গেল না গুপ্তধন। শুয়োরের বাচ্চা ইউডন ভাদিম এজন্যে খুব কষ্ট পেয়ে মরবে।
‘কিছু দিনের ভেতর,’ বলল জমির। ‘বড়জোর একমাস।’
‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমরা এভাবে ব্যবসা করি না?’ ডানদিকের লোকটা বলল। ‘দেরিতে পাওনা পরিশোধ করা হলে জরিমানা দিতে হয়। সেটা আরও পাঁচ মিলিয়ন ডলার। নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর চাহিদা মত টাকা না দিলে পরে এক পয়সাও ফেরত দেয়া হয় না। মনে আছে চুক্তির শর্তগুলো?’
সবই মনে আছে জমিরের। নগদ টাকা নয়, ঠিক সময়ে চুক্তিমত সুইস ব্যাঙ্কের নাম্বার্ড অ্যাকাউন্টে টাকা পৌছে না দিলে আর কখনও বিক্রেতার দেখা পাবে না। সবই জেনে এক মিলিয়ন ডলার হারাবার ঝুঁকি নিয়েছে জমির। এ মুহূর্তে সামনে একটা ফোল্ডার। ভেতরের জিনিসটা দেখিয়ে শর্ত নমনীয় করতে পারবে বলেই মনে হয়েছে তার।
ফোল্ডার থেকে ডকুমেন্ট নিয়ে সেদিকে তাকাল জমির শেখ। সাদা-কালো ছবি। সঙ্গে রয়েছে এ-ফোর কাগজে সোভিয়েত আমলের পাঁচটা পারমাণবিক রকেট ও ওঅরহেডের টেকনিকাল স্পেসিফিকেশন। দেশ ভেঙে গেলে রাশান মিলিটারি ওই পাঁচটা বোমা খুঁজে পায়নি কাযাকস্তানে।
ছবির দিকে চেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল জমির শেখ। পারমাণবিক বোমাবাহী আন্তঃমহাদেশীয় মিসাইল হাতে পেলে চালু হবে ওর কার্যক্রম। প্রথমেই ধ্বংস করবে ও সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ। রিয়াদ বিধ্বস্ত হলে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা… যুদ্ধ লেগে যাবে ইরানের সঙ্গে। জড়িয়ে পড়বে বন্ধু আমেরিকা ও ইজরায়েল। ঠিক তখনই বোমা ফাটবে ওয়াশিংটন ডিসি ও তেল আবিবে। কোনও সন্দেহ নেই, দোষ পড়বে ইরানেরই ঘাড়ে। কিন্তু ওরা কিছু করার আগেই তেহরান উড়িয়ে দেবে সে। ইংল্যাণ্ড এবার আমেরিকার দিকে বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত। ঠিক তখনই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে লণ্ডন শহর।
‘বুঝতেই পারছেন, আমরাও কোথাও না কোথাও বাস করি। কাজেই মিসাইল নিয়ে কী করবেন, তা খুলে বলতে হবে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল দলনেতা। ঠোঁটে ফুটে উঠল এক টুকরো নিষ্ঠুর হাসি।
‘আপনার কথা বুঝতে পেরেছি,’ বলল জমির শেখ। ‘নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনাদের কারও সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কোনও শত্রুতা নেই।’
‘তা হলে আপনার টার্গেট কারা?’
মুচকি হেসে ফেলল জমির। ‘রকেট ফেলব রিয়াদ, ওয়াশিংটন, তেল আবিব, তেহরান ও লণ্ডনে।’ জ্যাকেটের ভেতর পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে দলনেতার দিকে এগিয়ে দিল। বুক পকেট থেকে পুরু কাঁচের চশমা বের করে নাকের ওপর বসিয়ে নিল বয়স্ক লোকটা। গম্ভীর চেহারায় পড়তে লাগল বোল্ড করে ছাপা কালো রঙের অক্ষরগুলো।
কাগজে সহজ একটা তালিকা।
পাঁচটা শহরের নাম।
ঊনচল্লিশ
কায়রো। ধনীদের এলাকা হাইড পার্ক।
শান্ত বিকেলে থমথম করছে চারপাশ।
বাড়ির ভেতর আওয়াজ বলতে শুধু ইউডন ভাদিমের পদশব্দ। ধীরে ধীরে রানা ও কেন্সিংটনের দিকে আসছে সে। হাতে অ্যাসল্ট ওয়েপন। ‘দয়া করে সিট থেকে উঠবেন না। তা হলে বাধ্য হব গুলি করতে।’
এদিক ওদিক নড়ছে অস্ত্রের নল, রানা বুঝে গেল এই লোক গোলাগুলিতে অভ্যস্ত নয়। তবে সে থেমেছে অন্তত দশ ফুট দূরে। চাইলেই হাই-পাওয়ারের অ্যাসল্ট রাইফেলটা ছোঁ দিয়ে কেড়ে নিতে পারবে না রানা।
ভীষণ ভয় পেয়ে চেয়ারের হাতল খামচে ধরেছে কেন্সিংটন। ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ।
আরেক পা সামনে বেড়ে রানার দিকে তাকাল ভাদিম। ‘মিস্টার রানা, জানেন না, আপনি কে তা ভাল করেই জানি আমি।’
‘তা-ই বুঝি?’ বলল রানা।
‘জমির শেখ নামে একজন আপনার সম্পর্কে সবই বলেছে আমাকে।’
নীরব হলো ঘর। কী করবে ভাবতে গিয়ে রানা বুঝল, আপাতত কিছু করার নেই ওর। ভাদিম আরও পাঁচ পা এগোলে আর্মচেয়ার থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার ওপর। হয়তো সরিয়ে দেয়া যেত অস্ত্রের নল। সেক্ষেত্রে মেঝেতে ভাদিমকে ফেলে কাবু করতে পারত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আর একটুও এগোচ্ছে না লোকটা।
এত দূর থেকে ঝাঁপ দেয়া মানেই আত্মহত্যা করা।
‘তো এখন কী করতে চান?’ জানতে চাইল রানা। ‘খুন করতে চাইলে অনেক আগেই সেটা করতেন। এটা থেকে বুঝতে পারছি, অন্য কোনও মতলব আছে আপনার।’
‘আমি হয়তো চাই না আসবাবপত্রে রক্ত লেগে যাক?’ বলল ভাদিম।
সেক্ষেত্রে এখানে আমাদেরকে আনতেনই না। বেছে নিতেন উপযুক্ত কোনও জায়গা। সেখানে গুলির আওয়াজ শুনত না প্রতিবেশীরা। …কাজেই বলে ফেলুন, আসলে কী চান আপনি।’
চুপ করে কী যেন ভাবছে ভাদিম। তার চোখে চিন্তার ছাপ দেখছে রানা। ওর মনে হলো লোকটা নিজেই আছে ভীষণ চাপের ভেতর। যে-কোনও সময় ভেঙে পড়বে। থরথর করে কাঁপছে এএকেএস রাইফেলের নল। অস্ত্রের ওজনের কারণে এমন হওয়ার কথা নয়।
রানার বুক বরাবর রাইফেলের মাযল তাক করে অদ্ভুত কাণ্ড করল ভাদিম। বড় করে শ্বাস নিয়ে করুণ সুরে বলল, ‘প্লিয, আমাকে সাহায্য করুন, মিস্টার রানা।’
আবারও নীরবতা নামল ঘরে।
হতভম্ব রানা ও কেন্সিংটনকে পালা করে দেখছে ভাদিম।
রাইফেল দেখাল রানা। ‘সাহায্য চাওয়ার দারুণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন মনে হচ্ছে!’
‘নামিয়ে রেখে দেব,’ বলল ভাদিম। ‘তবে ভয় লাগছে আপনি আবার কী না কী করে বসেন।’
‘আপনার ধারণা, অস্ত্র রেখে দিলেই আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব?’
‘হতেও তো পারে।’
‘ভুল ভাবছেন। আপনি আমাকে কৌতূহলী করে তুলেছেন। খুন করলেও আগে জেনে নিতাম কী বলার আছে আপনার।’
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে দ্বিধা করছে ভাদিম। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘আমি চাই আমার হয়ে জমির শেখকে আপনি সরিয়ে দেবেন।’
‘পৃথিবী থেকে?’
‘তা হলে খুব ভাল হয়।’
এই অদ্ভুত অনুরোধের কারণটা কী?’
‘আমার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছে সে। খুলে বললে সবই বুঝতে পারবেন।
‘আপনার হাতে অস্ত্র। যা খুশি তাই বলতে পারেন।’
‘রাইফেল নামিয়ে রাখলে খুশি হবেন?’
‘সাধারণত তা-ই হওয়ার কথা।’
‘কোনও চালাকি করবেন না তো?’
‘মনে হয় না।’
রাইফেলটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখল ভাদিম।
‘আমি হলে আগে সেফটি ক্যাচটা অন করতাম,’ পরামর্শ দিল রানা। ‘ডানহাতের বুড়ো আঙুলের কাছে স্টিলের ছোট্ট লিভার। ওটা টিপে দিলে ক্লিক আওয়াজ হবে।’
কাজটা শেষ করে দ্বিধা নিয়ে আবারও মেঝেতে অস্ত্র নামিয়ে রাখল ইউডন ভাদিম।
‘এবার বলুন কী বলবেন,’ বলল রানা।
পরের দশ মিনিটে পেটের সব কথা উগরে দিল ভাদিম। রানা ও কেন্সিংটন জানল, মরুভূমিতে প্রথমবারের মত জমির শেখের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে কীভাবে মুঠোর ভেতর প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছে সে। বিপুল ধনরত্ন পেলে তাকে কোটি ডলার দেবে, সেই লোভ দেখিয়েছে জমির।
‘সত্যিই, কাছেই ছিল অল্পকিছু গুপ্তধন,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ভাদিম। ‘পালিয়ে যাওয়ার আগে ধরা পড়ার ভয়ে ওগুলো লুকিয়ে রেখেছিল মানকাউয়া।’ দুঃখ নিয়ে মাথা নাড়ল সে। ‘পশ্চিম মরুভূমিতে কপাল জোরে ওটা পেয়েছিল জমির। তখনই বুঝে যায়, কোটি কোটি ডলারের গুপ্তধন লুকিয়ে রাখা হয়েছে অন্য কোথাও।’ কী করে জমিরের সঙ্গে জড়িয়ে গেল, সেটা আরও বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করল ভাদিম। ‘ভয়ঙ্কর খুনি। বেপরোয়া। খুন করতে পারলে খুশি হয়। আমার জীবন নিয়ে খেলছে সে। আর কাউকে কখনও তার মত এতটা ঘৃণা করিনি। ভয়ও পাই ভীষণ। ভাল করেই জানি, যে-কোনও দিন খুন হব তার হাতে।’
‘কে এই লোক?’
‘জানি না,’ বলল ভাদিম। ‘তবে এটা জেনেছি, সে চরমপন্থী মুসলিম। টেরোরিস্ট। জমির শেখ আর তার দলের লোক আমার ওয়াইন সেলারে রেখেছে গাদাগাদা অস্ত্র আর গুলি। সঙ্গে আছে কয়েক বাক্স ভরা পিপি-০১।’ মেঝের রাইফেল দেখাল সে। ‘বুঝলেন না, কোথা থেকে এনেছি? নইলে আমার বাড়িতে এসব থাকত? মারাত্মক কী যেন করবে বলে, পরিকল্পনা করেছে। মাঝে মাঝে দলের লোকদের সঙ্গে বসে আলাপ করে। কিন্তু বড় কিছু করতে হলে অনেক টাকা চাই। সেজন্যেই ওর দরকার ওই গুপ্তধন।’
মর্ডাকের ফ্ল্যাটে জমির শেখের বলা কথাগুলো মনে পড়ল রানার। ‘শীঘ্রিই সব জানবে,’ বলেছিল লোকটা, ‘সবাই জানবে। সময় ঘনিয়ে এসেছে।’
‘কী ধরনের পরিকল্পনা?’ জানতে চাইল রানা।
মাথা নাড়ল ভাদিম। ‘আমাকে কিছু খুলে বলেনি। তবে আড়াল থেকে যা শুনেছি, দলের লোকদের বলেছিল হামলা করবে তারা। ভীষণ খারাপ কিছু।
‘সেজন্যে আপনি চান আমি যেন আপনাকে সাহায্য করি? জানতে চাইল রানা।
‘সেটা তো আছেই,’ বলল ভাদিম। ‘তবে তার চেয়েও বড় কথা, আবারও স্বাধীন মানুষের মত বাঁচতে চাই। ওই লোকটা ক্যান্সারের মত। তার কারণে মনে মনে মরে যাচ্ছি। এর চেয়ে খুন হওয়াও ভাল ছিল।’
কয়েক মুহূর্ত ভাবার পর বলল রানা, ‘বুঝতে পারছি আপনার অবস্থা। আমি নিজেও আছি বেশ চাপের মুখে। কিন্তু কী কারণে এত ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে বাঁচাতে যাব?’
কপাল থেকে ঘাম মুছল ভাদিম। ‘সাহায্য করবেন, কারণ জমির শেখের মত ওই একই জিনিস খুঁজছেন আপনিও। তা ছাড়া, মানকাউয়ার ওই চেয়ার খুঁজতে আপনাকে সাহায্য করতে পারব। আমি জানি ওটা কোথায় আছে।’
‘এটা তো দারুণ সুসংবাদ,’ বলে উঠল কেন্সিংটন।
তাকে পাত্তা দিল না রানা। ‘কী কারণে আমাকে সাহায্য করবেন, ভাদিম? আমি তো আপনার প্রতিপক্ষ। আপনি নিজেও তো খুঁজছেন ওই গুপ্তধন।’
‘এখন আর ওই গুপ্তধন চাই না। ছারখার হয়ে গেছে আমার জীবন। কোটি ডলার দিয়ে কী হবে, যদি মনেই কোনও শান্তি না থাকে? কয়েক মাস আগেও চমৎকার ব্যবসা ছিল। কোনও চিন্তা ছিল না মনে। তারপর জমির শেখের পাল্লায় পড়ে পলে পলে মরতে লাগলাম। আমি আর ওই গুপ্তধন চাই না। শুধু এটাই চাই, যেন স্বাভাবিক হয় আমার জীবন। সেজন্যেই সাহায্য চেয়েছি আপনার কাছে। পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিন জমির শেখকে। আপনি রাজি হলে চুক্তি করব আমরা। মুক্ত করে দেবেন আমাকে, আর তখন আমি বলে দেব কোথায় আছে পুরোহিতের সেই চেয়ার।’ সরাসরি রানার চোখে তাকাল ভাদিম। দৃষ্টিতে আকুতি। ‘বলুন, রানা, সাহায্য করবেন না আমাকে? কাজটা তো সহজেই করতে পারেন আপনি।’
‘মানে খুন করব লোকটাকে?’
অস্বস্তি নিয়ে মাথা দোলাল ভাদিম।
‘সাহায্য করতে আপত্তি নেই,’ বলল রানা। ‘তবে আগে সদিচ্ছার নিদর্শন হিসাবে আমাকে সাহায্য করতে হবে মানকাউয়ার চেয়ার খুঁজে বের করার কাজে।
কয়েকবার মাথা দোলাল ভাদিম। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখ-মুখ। রানার মনে হলো, অন্তত পাঁচ বছর কমে গেছে লোকটার বয়স। ‘তা হলে চুক্তি হয়ে যাক?’
‘আমার কোনও আপত্তি নেই,’ বলল রানা। ‘তবে আমার হাতে সময় খুব কম। দেরি না করে বলে ফেলুন কোথায় আছে ওই চেয়ার।
‘ওটা আছে জিম স্প্যাডেরো নামের এক লোকের কাছে। আগে কখনও শুনেছেন তার নাম?’
‘না। কে সে? কোথায় তাকে পাব?’
‘খুঁজে নেয়া সহজ,’ বলল ভাদিম, ‘ওই লোক ইউএস অ্যাম্বাসেডর। কায়রোতেই তার বাসভবন। মিলিয়নেয়ার। সুযোগ পেলেই প্রাচীন আমলের আর্টিফ্যাক্ট সংগ্রহ করে।’
‘আপনি জানলেন কী করে যে ওই চেয়ার তার কাছেই আছে?’
‘কারণ, তার বাড়িতে দেখেছি আমি ওটা। এম্বেসিতে তার ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে রেখেছে নিজের কালেকশন। সেগুলোর ভেতর আছে ওই চেয়ার। এ-ও জানি, আজ রাতে বড় পার্টি দিচ্ছে সে। চাইলে হয়তো কৌশলে ঢুকে পড়তে পারবেন ওখানে।’
‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ভাল করেই চেনেন জিম স্প্যাডেরোকে,’ বলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে ফোন করে বলে দিন, যেন এম্বেসির পার্টিতে আমরা যেতে পারি।’
দুঃখ ভরে মাথা নাড়ল ইউডন ভাদিম। ‘আসলে তাকে চিনি না। চিনি তার স্ত্রীকে। একটু বেশি করেই। আর সেজন্যেই স্প্যাডেরোর সঙ্গে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারব না। ওই লোকই ওর বউয়ের সঙ্গে আমাকে বিছানায় ধরে ফেলেছিল। তারপর শালা যে নিষ্ঠুর খচ্চরে লাথি দিয়েছিল, এখনও হাড় কাঁপানো শীতের ভোরে ডান কোমরে টনটনে ব্যথা হয়। কাজেই বুঝতে পারছেন, ওই বাড়ির ধারে কাছে গেলে আমার দুই টেংরি ভেঙে দেবে সে। তার ওখানে যাওয়া মানেই আমার ভয়াবহ, করুণ মৃত্যু।’
‘পা থাকুক বা না থাকুক, আমি ওই পার্টিতে যাব,’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল রানা।
‘কী করে?’ চিন্তিত চোখে ওকে দেখল কেন্সিংটন। ‘আমরা অচেনা মানুষ। চাইলেই তো আর এম্বেসির পার্টিতে হাজির হতে পারব না। দূরে থাক মহামূল্যবান চেয়ার খুঁটিয়ে দেখা।’
‘ঠিক করে ফেলেছি কী করব,’ বলল রানা। ‘হনহন করে হেঁটে সদর দরজা দিয়ে ঢুকব ভেতরে। সেজন্যে কারও অনুমতিও নেব না।’
‘আপনি কি পাগল হলেন?’ বলল কেন্সিংটন। ‘আপনার কি অসুখ হয়েছে? প্রলাপ বকছেন? এম্বেসির পার্টিতে ঢুকে পড়া কি এতই সহজ কাজ? চারপাশে থাকবে কঠোর সিকিউরিটি।’
‘সেটাই তো চাই,’ বলে ভাদিমের দিকে তাকাল রানা। ‘এম্বেসি ভবনের একটা প্ল্যান জোগাড় করে দিতে পারবেন?’
‘আমি ভাল করেই চিনি কোথায় যেতে হবে,’ জবাবে বলল ভাদিম। ‘প্রতি সপ্তাহে অন্তত দু’বার ওই পথে গিয়ে দেখা করতাম সুন্দরী ইলা স্প্যাডেরোর সঙ্গে।’
‘গুড,’ গম্ভীর চেহারায় বলল রানা। ‘তা হলে, ভাদিম, আপনার সঙ্গে এখানে থাকুক কেন্সিংটন। আমি যাচ্ছি কিছু ব্যবস্থা নিতে।’
‘কী করবেন?’ ভুরু কপালে তুলল কেন্সিংটন।
‘যা করব, সেটা আপাতত কাউকে জানাব না,’ বলল রানা। ‘তবে চলে যাওয়ার আগে একবার যাব ভাদিমের সেলারে।
সন্দেহ নিয়ে ওকে দেখল ভাদিম। ‘ওখানে কী করবেন? আরও ওয়াইন লাগবে?’
‘আপনার কাছে খুব ভাল ওয়াইন আছে, ভাদিম,’ বলল রানা। ‘তবে আমার চাই তার চেয়ে আরও বেশি দরকারি জিনিস— পিপি-০১।’