ছায়াঘাতক – ৩০

ত্রিশ

রানা এজেন্সির সেফ হাউসের পাতাল গ্যারাজ থেকে ঝড়ের বেগে মিনি কুপার চালিয়ে পনেরো মাইল দূরের প্যারিস রইসি এয়ারপোর্টে পৌছুতে লাগল বারো মিনিট। আধঘণ্টা পর চেপে বসল এডিনবার্গগামী প্রথম বিমানে।

সংক্ষিপ্ত যাত্রা, বেশিক্ষণ লাগল না স্কটল্যাণ্ডের এয়ারপোর্টে নামতে। টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে রানা টের পেল, প্যারিসের চেয়ে শীতল এডিনবার্গ। তবে পরিবেশ বোঝার সময় নেই ওর। এলভিস কার রেন্টাল আউটলেট থেকে মার্সিডিয এসএলকে টু সিটার স্পোর্টস্ কার ভাড়া নিয়ে রওনা হলো অ্যান্ড্রিউ ইউনিভার্সিটি লক্ষ্য করে।

পথ দেখাচ্ছে স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশন সিস্টেম। তুমুল বেগে চলেছে রানা। মাঝে মাঝে দেখছে রিয়ার ভিউ মিরর। বিশাল সাসপেনশন ব্রিজ থেকে নেমে বাঁক নিয়ে চলল ইস্ট কোস্টের উত্তরমুখী আঁকাবাঁকা পথে। সামনেই পড়বে সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউ ইউনিভার্সিটির এলাকা।

ব্রিটিশ নাম করা এক থ্রিলার বইয়ে রানা পড়েছে, এই ইউনিভার্সিটির পুরনো টাওয়ার একসময়ে ছিল স্কটল্যাণ্ডের ধর্মীয় রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু। সেখান থেকেই পাঠানো হত সন্ত-সাধুদেরকে নির্যাতন বা জবাই করার নির্দেশ। গির্জা বা পোপের বিরুদ্ধে কথা বললে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হতো। এখন নির্জন রাস্তা দেখলে ভাবা যায় না, অতীতে রক্তের হোলিখেলা হয়েছে এখানে। আইভি লতা ভরা ইউনিভার্সিটির দালান, ক্যাফে ও হোটেল পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছে রানা। হিস্ট্রির ফ্যাকাল্টির কাছে পৌঁছুতে খুব সময় নিল না ও।

পার্কিং লটে গাড়ি রেখে হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট লক্ষ্য করে চলল রানা। উঁচু ফুটপাথ থেকে পরিষ্কার দেখছে সাগর। পেছনে মেডিইভেল আমলের ক্যাথেড্রালের ধ্বংসাবশেষ। কাছেই সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউ ক্যাসল। বাঁক নিয়ে বহু দূরে হারিয়ে গেছে উপকূল। তাজা নোনা বাতাসে বুক ভরে নিল রানা। হঠাৎ করেই মনে পড়ল লিণ্ডার কথা। বেচারি এখন কোথায়? চেহারার কী অদ্ভুত মিল রাফেলা বার্ডের সঙ্গে। হায়, আজ কোথায় রাফেলা! ও কি মনে রেখেছে রানাকে? ও কি জানতে পেরেছিল রানার আসল পরিচয়?

অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরোল রানার বুক চিরে।

বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে পৌছে গেল পাথরের চমৎকার বাড়িটার সামনে।

ফ্যাকাল্টি অভ হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের লোহার গেট পার হতেই সামনে পড়ল ছোট্ট পার্কিং লট। ওটা পিছনে রেখে পৌঁছুল বাড়ির সামনের এন্ট্রান্স-এ। ওদিকে বিশাল *রিসেপশন এরিয়া। তবে ডেস্কে কেউ নেই। চারপাশ দেখল রানা। কয়েক সারিতে কিছু চেয়ার। দেয়ালের ফ্রেমে ঝুলছে হিস্ট্রিকাল প্রিন্ট। চওড়া স্টেয়ারকেস ঘুরে উঠেছে ওপরে। নিচের সিঁড়ির পাশে অ্যাকাডেমিক স্টাফদের নাম ও তাঁরা কোন্ ঘরে আছেন, তার নাম্বার। প্রতিটি নামের পাশে ছোট পুশ-বাটন লেড বাতি দেখাচ্ছে, কারা এখন উপস্থিত। নিচের সারিতে কেন্সিংটনের নাম ও রুম নাম্বার পেল রানা। অফিস তেত্রিশ নাম্বার ঘরে। ছোট বাতি বলে দিচ্ছে, আপাতত ওখানেই আছে লোকটা।

একেকবারে দুটো করে ধাপ টপকে উঠছে রানা। ওপর থেকে নেমে এল কয়েকজন ছাত্র ও ছাত্রী। হাতে বই বা ফোল্ডার। আলাপ করছে নিজেদের ভেতর। রানার দিকে অবাক চোখে দেখল কেউ কেউ। তবে তাদের কাউকে পাত্তা না দিয়ে ওপরতলায় উঠে এল ও। ডানদিকে একটা সাইনে লেখা: ওদিকে একুশ থেকে শুরু করে পঁয়তাল্লিশ নম্বর ঘর।

একটা ফায়ার ডোর পার হয়ে সরু এক করিডোরে পা রাখল রানা। ছাতে জ্বলছে সাদা নিয়ন বাতি। তেত্রিশ নম্বর ঘরের সামনে থেমে একবার দেখে নিল দরজার নেম প্লেট। হ্যাঁ, ঠিক আছে। উইলিয়াম কেন্সিংটন।

নক না করেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল রানা। বেশ বড় ঘর। মস্ত ডেস্কের ওপর স্তূপ করে রাখা বই, কাগজ ও গার্ডিয়ান পত্রিকার পুরনো সংখ্যা। মেঝেরও একই হাল। ঘরের পেছনে ধুলোভরা জানালা। ওটা আর ডেস্কের মাঝে উদ্‌ভ্রান্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। ইন্টারনেটের ছবির কল্যাণে চট্ করে তাকে চিনল রানা। হুম, উইলিয়াম কেন্সিংটনই!

হাত থেকে বই ফেলে দিয়েছে লোকটা। ডেস্কের ওদিক থেকে এক গাদা বই ও পত্রিকার ফাঁকে ফাঁকে পা ফেলে রানার দিকে এল। পরনে পুরনো, সুতো ওঠা প্যান্ট। টুইড স্পোর্টস্ জ্যাকেটের তলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে শার্টের নিচের অংশ। উচ্চতার তুলনায় একটু বেশি ভারী সে। থপ-থপ করে এসে রানার সামনে থামল। বেশ চড়া গলায় জানতে চাইল, ‘আপনি আবার কে?’ নার্ভাস চোখে আপাদমস্তক দেখল রানাকে।

‘আমি ফোনে কথা বলেছি, মনে নেই?’ বলল রানা। দরজা খুলে যাওয়ায় বাতাসে ডেস্ক থেকে ভেসে নিচে পড়েছে কিছু কাগজ। ওগুলো একে একে তুলল রানা। ওপরের কাগজটা কার ইন্সুরেন্স রিনিউয়াল। ওটার ওপরে লেখা কেন্সিংটনের নাম ও বাড়ির ঠিকানা। বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলল রানা, ‘এগুলো পড়ে গিয়েছিল।’ বুঝে গেছে, ওর উপস্থিতির কারণে নার্ভাস হয়ে উঠেছে লোকটা। তাকে আরও ঘাবড়ে দিতে চাইল না ও। কাগজগুলো ডেস্কে রেখে মৃদু হাসল।

‘আমি এখনই বেরিয়ে যাব,’ কাঁপা গলায় বলল ডক্টর কেন্সিংটন।

‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

‘আগেই বলেছি, আমার বলার মত কিছুই নেই,’ লালচে হয়ে গেল লোকটার মুখ। ‘আপনি বিদায় হলে খুশি হব।’

‘আপনার সঙ্গে আলাপ করতে বহু দূর থেকে এসেছি, ডক্টর কেন্সিংটন। মাত্র কয়েকটা মিনিট নেব। তারপর আর কখনও আমাকে দেখবেন না।

‘আমি সিকিউরিটির লোক ডাকছি,’ ডেস্কে কাগজের স্তূপের নিচে অর্ধেক চাপা পড়া টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল ডক্টর কেন্সিংটন।

‘দয়া করে কাজটা করবেন না,’ নরম সুরে বলল রানা।

ফোনের কয়েক ইঞ্চি দূরে পৌঁছে থেমে গেল লোকটার হাত। বিস্ফারিত হয়েছে দুই চোখ। ‘আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন?’

‘মোটেও না,’ বলল রানা। ‘আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। আমি আসলে এসেছি মডাক ব্রাউন আর আখেনাতেন প্রজেক্ট সম্পর্কে কিছু কথা জানতে। আপনি ওসব বলে দিলেই বিদায় হব।’

‘মর্ডাক মারা গেছে,’ বলল উইলিয়াম কেন্সিংটন।

‘তা জানি। যখন মারা যায়, তার ব্লেয়ারের পকেটে ছিল আপনার ফোন নাম্বার। আপনারা দু’জন কি একইসঙ্গে কোনও রিসার্চ করছিলেন?’

মস্ত ঢোক গিলল ইতিহাসবিদ। ‘নিশ্চয়ই ওর বাবা আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে, তাই না?’

জন ব্রাউনের কথা শুনে লিণ্ডার অসহায় মুখটা ভেসে উঠল রানার মনে। টের পেল, রেগে উঠছে। যদিও সহজ সুরেই বলল, ‘না। আমি মর্ডাকের বাবার হয়ে কাজ করি না। দু’দিন আগেও ভাবতাম সে আমার প্রিয় একজন মানুষ। তবে এখন আর সে-কথা বলতে পারব না। মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক, আপনার সাহায্য আমার খুব প্রয়োজন।’

‘কে আপনি?’

‘আমার নাম মাসুদ রানা। আপনার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন।’

দ্বিধার ভেতর পড়ল কেন্সিংটন। কেন যেন চমকে গেছে।

‘প্লিয, ডক্টর,’ নরম সুরে বলল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড ওকে দেখল উইলিয়াম কেন্সিংটন, তারপর হঠাৎ করেই টিপে দিল ফোনের কি-প্যাডের একটা বাটন। ‘সিকিউরিটি? ডক্টর কেন্সিংটন বলছি। আমার ঘরে হঠাৎ করে এক অচেনা লোক ঢুকে পড়েছে!’

অপ্রস্তুত রানার কিছুই করার ছিল না। আর এখন ফোন কেড়ে নিয়েও লাভ নেই। তা ছাড়া, জোরাজুরি করে এর মুখ খোলাতে পারবে না। সেই সময় আসলে নেই। তবে সিকিউরিটির লোক আসার আগে হয়তো কয়েকটা মিনিট পাবে। কাজেই দেরি না করে বলল, ‘আমি জানি, মডাক গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছিল। আমাকে জানতে হবে ওটা কোথায় আছে।’

‘তাতে আর সন্দেহ কী!’

এখন আপনাকে ব্যাখ্যা দেয়ার সময় নেই,’ বলল রানা। ‘কিছু জানা থাকলে দয়া করে বলুন।’

ডক্টর কেন্সিংটন জবাব দেয়ার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল সিকিউরিটির দুই লোক। বয়স্ক লোকটার চেহারা কঠোর। মাথার চুল সাদা। নাকটা পাকা করমচার মত লাল। কপালে তিরতির করে কাঁপছে কয়েকটা নীল রগ। রানা ধারণা করল, এই লোক আগে মুষ্টিযোদ্ধা ছিল। তার সঙ্গীর বয়স বড়জোর বিশ। পরনে পাট ভাঙা ইউনিফর্ম। লড়াইয়ের জন্যে মুখিয়ে আছে। ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

‘এই লোক আমার অফিসে ঢুকেই হুমকি দিতে শুরু করেছে,’ আঙুল তুলে রানাকে দেখাল ডক্টর কেন্সিংটন। কণ্ঠে অভিযোগ। ‘আমি চাই একে যেন এখান থেকে বিদায় করে দেয়া হয়।

‘বাছা, চলো, নিচে যাওয়া যাক,’ রানার বাহু ধরতে হাত বাড়াল বয়স্ক গার্ড। ‘আমি কোনও ঝামেলা চাই না।’

‘একটা জরুরি বিষয় জানতে ডক্টর কেন্সিংটনের কাছে এসেছি, কোনও ঝামেলা করতে আসিনি,’ বলল রানা।

ডেস্কের পাশ থেকে ব্রিফকেস তুলল উইলিয়াম কেন্সিংটন। ‘ঠিক আছে, আপনারা এর ব্যবস্থা করুন।’ একবার রানার চোখে চোখ রেখে নিচু হয়ে গেল তার দৃষ্টি। দ্রুত দরজা পেরিয়ে চলে গেল করিডোরে। দূরে চলে যাচ্ছে তার পদশব্দ।

‘আমাদের সঙ্গে আসতে হবে,’ রানাকে বলল কঠোর চেহারার গার্ড। ‘আমরা লিখে নেব নাম-ধাম।’

‘আমি কিছুই করিনি, কাজেই আপনাদের কাছে কোনও ব্যাখ্যাও দেব না,’ বলল রানা।

বুকে দুই হাত ভাঁজ করল যুবক গার্ড। ‘ডক্টর কেন্সিংটন কিন্তু অন্য কথা বলে গেছেন।’

‘যা খুশি বললেই তা সত্যি হয়ে যায় না,’ বলল রানা। ‘আমি চলে যাচ্ছি। কোনও গণ্ডগোল করছি না।’

‘এখন ওসব বলে লাভ হবে না,’ টিটকারির হাসি দিল যুবক। ‘সোজা যাবেন আমাদের সঙ্গে নিচের অফিসে। পুলিশ ডাকব। তারা এসে বুঝুক কী করবে।’

রানা দরজার দিকে পা বাড়াতেই খপ করে ওর কবজি চেপে ধরল যুবক। ‘খবরদার! সাবধান করে দিচ্ছি! আমি কিন্তু আইকিডোর ব্ল্যাক বেল্ট! আপনাকে ব্যথা দিতে চাই না, তবে তেড়িবেড়ি দেখলে….’

ঘাড়ে কারাতের কঠিন এক কোপ খেয়ে কার্পেটে লুটিয়ে পড়ার আগেই জ্ঞান হারাল দুর্ধর্ষ ব্ল্যাক বেল্ট হোল্ডার।

বয়স্ক গার্ডের দিকে ফিরল রানা। ‘গোলমাল এড়াতে চাই। কাজেই আপনিও তা করবেন না।’ আঙুল তুলে কেন্সিংটনের চেয়ার দেখিয়ে দিল রানা। ওখানে গিয়ে বসল গার্ড। ভীষণ রেগে গেছে। তবে বুদ্ধি হারায়নি। চুপ করে বসে থাকল আরামদায়ক সিটে।

‘আপনি বুদ্ধিমান,’ বলল রানা। ‘এবার আপনার রেডিয়ো আর মোবাইল ফোন আমার কাছে দিন।’

নীরবে ডেস্কের ওপর দিয়ে জিনিসদুটো ঠেলে দিল বয়স্ক গার্ড। দুই গার্ডের রেডিয়ো আর মোবাইল ফোন সংগ্রহ করে প্যান্টের পকেটে রাখল রানা। সহজ সুরে বলল, ‘এবার বিদায় নিচ্ছি। চুপ করে বসে থাকুন।’ হ্যাঁচকা টান দিয়ে ল্যাণ্ড ফোনের তার ছিঁড়ে দিল রানা। দরজায় থেমে একবার ঘুরে দেখল বয়স্ক গার্ডকে। চোখে হুঁশিয়ারি। বেরিয়ে গিয়ে দরজার তালায় চাবি দেখে মুচড়ে দিল ওটা। ফুটোর ভেতরেই থাকল চাবি। করিডোর ধরে হাঁটতে শুরু করে দেখে নিল হাতঘড়ি। খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে সময়!

হিস্ট্রি ফ্যাকাল্টির রিসেপশনে দুই গার্ডের রেডিয়ো আর মোবাইল রেখে, দ্রুত হেঁটে কিছুক্ষণের ভেতর গাড়ির সামনে পৌঁছুল রানা। আগেই নিজের মোবাইল ফোনে দেখে নিয়েছে গুগল ম্যাপ। কেন্সিংটনের অফিসে পাওয়া কার ইন্সুরেন্স রিনিউয়ালের পোস্টকোড ব্যবহার করে জেনে গেছে, লোকটার ঠিকানা হচ্ছে কেন্সিংটন ম্যানর। জায়গাটা সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউয়ের পশ্চিমে নয় মাইল দূরে।

মার্সিডিয়ে চেপে স্যাটেলাইট ন্যাভিগেশনে তথ্য দিল রানা। গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে ভাবল, একটু চাপ দিয়ে খোলাতে হবে ডক্টর উইলিয়াম কেন্সিংটনের মুখ।

একত্রিশ

তরুণ বয়স থেকেই বাজে ড্রাইভার উইলিয়াম কেন্সিংটন। কথাটা সে নিজেও জানে। বেশ ক’বার গাড়ি তুলে দিয়েছে ফুটপাথে। কপাল ভাল, গাড়ি চাপা পড়ে আহত বা নিহত হয়নি কেউ। আর আজ দুশ্চিন্তার কারণে আরও বেশি অমনোযোগী গাড়ি চালনায়। বারবার হোঁচট ও ঝাঁকি খেতে খেতে তার পুরনো বাড়ির দিকে চলেছে কমলা স্মার্ট কার। মাসুদ রানার কথা ভাবতে ভাবতে নয় মাইলের অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে উইলিয়াম।

কী চায় লোকটা?

জানল কী করে মর্ডাকের গুপ্তধনের কথা?

এর চেয়েও বড় কথা, সে জানল কী করে, ও কে বা কোথায় আছে?

নিশ্চয়ই ঘনিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর বিপদ!

গাড়িতে বসার পর থেকেই ভয়ের কারণে পেটটা কেমন যেন ভুটভাট করছে তার। চাপ অবশ্য তেমন নয়, নইলে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলত। বেশ কিছুক্ষণ পর দুই সারি গাছের নিচে পাথরখণ্ড দিয়ে বিছানো রাস্তায় পড়ল স্মার্ট কার। একটু দূরেই কেন্সিংটন ম্যানর। উইলিয়াম ভাবছে, এত বড় ঝুঁকি নেয়া ঠিক হচ্ছে না। উচিত ইউনিভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে উধাও হয়ে যাওয়া। ছুটিও পাওনা আছে তার। যাওয়ার কথা ছিল মিশরে। কিন্তু মডাক হত্যার খবর কানে আসতেই ভুলেও আর কায়রো যাওয়ার কথা মুখে আনেনি।

পাথরের বিশাল ম্যানরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ওক কাঠের ভারী দরজার সামনে থামল উইলিয়াম। পকেট থেকে চাবি নিয়ে তালা খুলে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতর। দরজা বন্ধ করে পা রাখল পাথরের প্রকাণ্ড এন্ট্রান্স হলে। বিরক্তিতে কুঁচকে গেল ভুরু। দুনিয়ার বাজে জিনিস জোগাড় করত তার বাবা। দেয়ালে দেয়ালে হরিণের স্টাফ করা মাথার ট্রফি। দেখলেই গা ছমছম করে। সারাক্ষণ, ও যেদিকেই যাক না কেন, ড্যাবড্যাব করে দেখছে ওকে মরা জন্তুগুলো। রাতে শিংগুলো তৈরি করে ভুতুড়ে সব বিশ্রী ছায়া। রীতিমত ভয় লাগে এখানে থাকতে। কারুকাজ করা কাঠের প্যানেলে ধুলোর ভেতর ক্রস করে রাখা দুটো সেইবার আর কয়েকটা মাস্কেট। ওগুলোও উইলিয়ামের অপছন্দ। ফায়ারপ্লেসের ওপরে রাখা বিছানো ভেলভেটের ওপর ভয়ঙ্কর চেহারার দুই আনুষ্ঠানিক কুকরি ছোরা। যৌবনে গুর্খা রেজিমেন্টের ডাঁটিয়াল অফিসার ছিল তার বাবা। বদমেজাজি লোক। ভদ্রলোক চেয়েছিল ছেলেও সামরিক বাহিনীতে যোগ দিক। কিন্তু তরুণ বয়সেই বেঁকে বসল সে। পড়বে ইতিহাস।

বাবার হাজার ধমক খেয়েও নিজের পথ থেকে সরেনি উইলিয়াম। খেপা বুড়োটার আরেকটা আবদার ছিল, সে মরে গেলে কখনও যেন বিক্রি না করা হয় ম্যানরের মূল্যবান সব জিনিসপত্র। বুড়ো তো মরেছে। তার কথা এখন শুনবে কে? উইলিয়াম স্থির করেছে, এসবই বিক্রি করে শহরে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ওখানে গিয়ে উঠবে। ব্যস, ঝামেলা শেষ!

প্যাসেজের মেঝেতে ধুপ করে ব্রিফকেস রেখে কিচেনে ঢুকল সে। পাঁচ মিনিটের ভেতর তৈরি করল এক মগ ইন্সট্যান্ট ডিক্যাফ কফি। ম্যানরের বেশ কয়েকটা রিসেপশন রুমের একটায় ঢুকল। এই ঘরটাই আজকাল ব্যবহার করছে। জানালা দিয়ে চোখ যেতেই দেখল বাড়ির পেছনে বুনো ঝোপঝাড়ে ভরা উঠান। পাথরের দেয়ালের ওদিকে সারি সারি গাছের মাঝ দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওদের পরিত্যক্ত খামারবাড়ি। একসময় ওটা চালু ছিল। কিন্তু বুড়ো হাবড়া বাপটা অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই সব যেন চিত্তিছান হয়ে গেল। গোলাঘরে এখানে ওখানে কালো হয়ে যাওয়া খড়ের স্তূপ। আবর্জনা ও পায়খানার থকথকে কূপে বোধহয় আস্তানা গেড়েছে ইঁদুরের পাল। স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে জায়গাটা। আনমনে মাথা নাড়ল উইলিয়াম কেন্সিংটন। হ্যাঁ, ঠিক, এবার ও বিক্রি করে দেবে জঘন্য এই ম্যানর।

কথাটা মাত্র ভেবেছে উইলিয়াম, এমন সময় টের পেল কারও উপস্থিতি। কে যেন ঢুকেছে ঘরে!

চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল সে।

হনহন করে তার দিকেই এগিয়ে আসছে দুই লোক! হাতে পিস্তল! মাযল তাক করেছে ওরই কপালে!

করুণ এক সংক্ষিপ্ত আর্তনাদ ছাড়ল সে, হাত থেকে ফস্কে পড়ে গেল কফির মগ। ভীষণ ভয়ে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল উইলিয়াম। বুকের খাঁচার ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে অস্থির হৃৎপিণ্ড।

একটা কথাও না বলে উইলিয়ামের দুই হাত ধরল দুই লোক। হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিল। পিঠে ঠেলা দিয়ে নিয়ে চলল প্যাসেজের দিকে। নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইল উইলিয়াম। করুণ সুরে বলল, ‘আপনারা আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন, ভাই?’ প্যাসেজে পড়ার আগে দেখল, ফায়ারপ্লেসের সেই ভেলভেটের ওপর ভয়ঙ্কর চেহারার দুই আনুষ্ঠানিক কুকরি ছোরার একটা নেই!

মনে মনে আঁৎকে উঠল উইলিয়াম। হায়, ঈশ্বর, আমার মাথা কেটে নেবে এরা!

বেসুরো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমাকে মেরে ফেলবেন কেন, ভাই? আমি কী করেছি?’

ওকে পাত্তা না দিয়ে টেনেহিঁচড়ে সদর দরজার কাছে নিল দুই লোক। কবাট খুলে যেতেই উইলিয়াম দেখল, একটু দূরে পার্ক করা হয়েছে সাদা রঙের এক সুযুকি মিনি-ভ্যান। ওটার পেছনের দরজা খোলা। ওদিকেই উইলিয়ামকে নিয়ে গেল তারা।

‘আমাকে কোথায় নিয়ে যান, ভাই? ভাইরে, আমি কী করেছি?’

জবাব নেই।

থরথর করে কাঁপছে দুই হাঁটু, শরীরের সব শক্তি হারিয়ে গেল উইলিয়ামের। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে তুলে দেয়া হলো মিনি-ভ্যানের পেছনে মালপত্র রাখার বুটে। পা পিছলে মেঝেতে পড়ল সে। ধুম্ আওয়াজে নামিয়ে দেয়া হলো গাড়ির বুট। প্রাণের ভয়ে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে খটাস্ করে ঢাকনার সঙ্গে ঠুকে গেল মাথা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বন্দি হলো ইতিহাসবিদ।

ভ্যানের ক্যাবের পাশে গেল দুই কিডন্যাপার। দরজা খুলে গাড়িতে উঠল তারা। কয়েক মুহূর্ত ব্যয় করল পিস্তলের সেফটি ক্যাচ অন করে জ্যাকেটের ভেতরে ট্যাকটিকাল হোলস্টারে অস্ত্র রাখতে। একটা কথাও হলো না তাদের ভেতর। তবে চেহারায় সন্তুষ্টি। নিজেদের কাজ ভাল ভাবেই শেষ করেছে। এবার সময় হয়েছে এই অপদার্থটাকে গ্লাসগোয় ওদের সেফ হাউসে ডেলিভারি দেয়া। কী কারণে ভিতু লোকটাকে ধরা হয়েছে, তাদের জানা নেই। তবে এটা জানে, গতকাল দূরের কোনও দেশ থেকে ফোন এসেছিল। ওই লোক বোধহয় তাদের বসেরও বস। এককথায় রাজি হয়েছে আলি হোসেন। তাদেরকে বলে দিয়েছে, কোনও ভুল যেন না হয়। নইলে শাস্তি হবে চরম।

ইগনিশনে চাবি মুচড়ে দিল ড্রাইভার।

নীরব থাকল ইঞ্জিন।

‘…..!’ আরবিতে খারাপ একটা গালি দিল লোকটা।

‘আবার কী হলো?’ প্যাসেঞ্জার সিট থেকে জানতে চাইল তার সঙ্গী। ‘একটু আগেও তো ঠিক ছিল।’

ভ্যানের মাকে আরও জঘন্য একটা আরবি গালি দিয়ে ড্যাশ বোর্ডের নিচে ঝুঁকল ড্রাইভার। বনেট রিলিফের দণ্ড পেয়ে টান দিতেই ভোঁতা ভুম আওয়াজে আধ ইঞ্চি খুলল গাড়ির নাকের ডালা। লাথি মেরে দরজা খুলে ভ্যান থেকে লাফিয়ে নামল ড্রাইভার। গাড়ির কোনা ঘুরে চলে গেল সামনে।

উইণ্ডস্ক্রিন দিয়ে দেখছে তার সঙ্গী। তবে বনেট ওপরে তুলতেই আড়াল হলো ড্রাইভার। খুটখাট কিছু আওয়াজ পেল প্যাসেঞ্জার-সিটে বসা কিডন্যাপার। তারপর আর কোনও শব্দ নেই। জানালা দিয়ে মাথা বের করল সে। ধমকে উঠল, ‘আরে, শালা, তাড়াতাড়ি কর্!’

জোরালো ধুম-ক্ল্যাং আওয়াজে বন্ধ হলো বনেট। থরথর করে কেঁপে উঠেছে গোটা ভ্যান। সামনে তাকাল কিডন্যাপার। ভাবছে, এখুনি উঠে দাঁড়িয়ে ময়লা কাপড় দিয়ে হাত মুছতে মুছতে হাসবে সঙ্গী। বলবে, ‘কাজ শেষ!’

কিন্তু ভ্যানের সামনে কেউ উঠে দাঁড়াল না।

ভুরু কুঁচকে গেল লোকটার। দরজা খুলে নেমে পড়ল নিচে। পাথরের খণ্ডে কুড়মুড় আওয়াজ তুলছে তার বুট। বাম দিকের উইং ঘুরে গাড়ির সামনে গেল সে। ভ্যানের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে সঙ্গীর দুই পা। নিশ্চয়ই কিছু মেরামত করছে।

‘উসমান? কী করিস, শালার পো?’

কথাটা মাত্র বলেছে লোকটা, তখনই দেখল গাড়ির নিচে ভয়ানক ভাবে নড়ে উঠল সঙ্গীর দুই পা।

পরিষ্কার দেখতে পেল, টকটকে লাল রক্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে পাথরের ছোট ছোট টুকরোগুলোকে!

কয়েক সেকেণ্ড পর চিরকালের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ল দ্বিতীয় কিডন্যাপারও।

বত্রিশ

টকটকে লাল রক্তের ছিটকে ওঠা ফোয়ারা এড়াতে একটু দূরে সরে গেছে রানা। এইমাত্র তীক্ষ্ণধার কুকরির এক পৌঁচে ফাঁক করে দিয়েছে ও লোকটার গলা। জবাই করা মুরগির মত মাটিতে ছটফট করছে সে।

একমিনিট পর দুই লাশের পাশে নুড়িপাথরে দীর্ঘ, বাঁকা ছোরা রাখল রানা। সার্চ করে দেখল তাদের সঙ্গে আইডি আছে কি না। নেই। দশ মিনিট আগে রানা ছিল মোটাসোটা এক গাছের আড়ালে। ভ্যান থেকে আরব লোকদু’জনকে নেমে ম্যানরের দিকে এগোতে দেখেই বুঝতে পেরেছে, তাদের কে পাঠিয়েছে।

মর্ডাকের ব্লেয়ারের পকেটে কাগজ পেয়ে ওর মতই জমির শেখ জেনেছে, ফোন নাম্বারটা কার। এরপর নেমে পড়েছে কাজে।

ভ্যানের পেছনে বাক্সের মত জায়গা থেকে এল ধুপ-ধাপ আওয়াজ। সেই সঙ্গে বেসুরো কন্ঠের কাতর অনুনয়। গাড়ির পেছনে গিয়ে ড্রাইভারের চাবি দিয়ে তালা খুলল রানা। বুটের ঢাকনা সরাতেই পাগলাটে চোখে ওকে দেখল ইতিহাসবিদ। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। বিরাট ঢোক গিলে বলল, ‘আবারও সেই আপনি! কী চান আপনি বলুন তো?’

‘একটু খোশ গল্পের জন্যে থেমেছি,’ বলল রানা। ‘দু’চার কথা বলব, এমন সময় দেখি আপনাকে নিয়ে এদিকেই আসছেন দুই জেন্টেলম্যান। ভাবলাম, আড়াল থেকে দেখি এবার কী হয়।’

‘আপনি আসলে কে?’

‘ধরে নিন, আপাতত এ দুনিয়ায় আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু,’ বলল রানা। ‘কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন।’

ছেঁচড়ে ভ্যানের বুট থেকে নামল উইলিয়াম কেন্সিংটন। গাড়ির পাশে দাঁড়াতেই ওর চোখে পড়ল একটা লাশ। বরফের মূর্তি হলো সে। আর্তচিৎকার ঠেকাতে দু’হাতে চেপে ধরল নিজের মুখ। ক’সেকেণ্ড পর বলল, ‘হায়, ঈশ্বর! আপনি ওদেরকে মেরে ফেলেছেন!’

‘উপায় কী,’ সহজ সুরে বলল রানা। ‘আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ওদের সঙ্গে আমার যোগ দেয়াই উচিত ছিল। তিনজন মিলে ভাল কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারতাম।’

‘আসলে হচ্ছেটা কী?’ হাঁপানি রোগীর মত হাঁসফাঁস করছে উইলিয়াম কেন্সিংটন।

‘কী হচ্ছে, সেটা আপনি ভাল করেই জানেন। আমার হয়তো উচিত ছিল ওই দুই কিডন্যাপারের সঙ্গে চুক্তি করা। তাতে লাভবান হতাম দু’পক্ষই।’

‘আমি পুলিশ ডাকছি,’ টলতে টলতে বাড়ির দিকে পা বাড়াল ইতিহাসবিদ।

তবে ডাক দিয়ে তাকে থামাল রানা। ‘ওই কাজ করলে স্রেফ খুন হয়ে যাবেন।’

‘বুঝলাম না কী বলতে চাইছেন।’

‘পুলিশ ডাকলে এখুনি আমি বিদায় নেব। এরপর এই দুই কিডন্যাপার না ফিরলে আবারও লোক পাঠাবে তাদের বস্। ফলে প্রচণ্ড নির্যাতন করে খুন করা হবে আপনাকে। পুলিশ বাঁচাতে পারবে না। চাইলে ৯৯৯ নাম্বারে যোগাযোগ করুন। সেক্ষেত্রে সময় নষ্ট না করে চলে যাব আমি।’

পিঠ বেঁকে গেল ইতিহাসবিদের। কাঁপা গলায় বলল, ‘মরতে চাই না। কিন্তু বুঝতে পারছি না এখন কী করা উচিত। আপনি কোনও পরামর্শ দিন।’

‘আপনার খামারবাড়িতে ঠেলাগাড়ি বা হুইলব্যারো আছে? যদি থাকে, তো ওই জিনিসে চাপিয়ে লাশদুটো নিয়ে ফেলে দেব নোংরা ওই পায়খানার কূপে। ওখানে ডুব দিয়ে খুঁজতে যাবে না কেউ।’

ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ তোলা ঠেলাগাড়ি আনতে লাগল দশ মিনিট। ওটাতে লাশদুটো চাপিয়ে দুই শ’ গজ দূরে খামারবাড়ির সেই দুর্গন্ধময় কূপের দিকে চলল রানা। থকথকে ময়লা ও পায়খানার কূপের বিশ গজের মধ্যে যেতেই পেটের নাড়ি উল্টে এল ওর। দশ গজের মধ্যে পৌছে রেগেই গেল। ব্যাটা উইলিয়াম কেন্সিংটন কী খায় যে এমন…

কূপের পাঁচ গজে পৌঁছে রানা বুঝল, মাত্র কয়েক সেকেণ্ড শ্বাস নেয়ার পর অজ্ঞান হবে দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ। দম আটকে কূপের ঢাকনির ছিটকিনি খুলল ও। লাথি মেরে ডালা সরিয়ে দিল। নিচে দেখল কেঁচো ও তেলাপোকা ভরা হলদে- লালচে-বাদামি সব জিনিসে প্রায় ভরে আছে কূপ। একটু পর দম নেয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠবে ফুসফুস। ওদিকে শেষ করতে পারেনি কাজ। ঠেলাগাড়ি থেকে লাথি মেরে প্রথম লাশ কূপে ফেলল রানা। ওর আরেক লাথিতে সঙ্গীর সঙ্গে দেখা করতে গেল দ্বিতীয় লাশ। ঝপাৎ-ঘুলুপ্ শব্দে বাদামি তরলে পড়েই হারিয়ে গেছে দুই মৃত কিডন্যাপার। ওখানে উঠল বেশ কিছু বড় বুদ্বুদ। কিছু দিনের ভেতর হাড় ছাড়া ওই দুই লাশের আর কিছুই থাকবে না। কূপে রক্তমাখা কুকরিটা ফেলল রানা। ঢাকনি আটকে ছিটকিনি লাগিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল গোলাবাড়ির দিকে। ওকেও তো বাঁচতে হবে!

পুরনো গোলাঘরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম কেন্সিংটন। চোখে-মুখে ভয় এবং দ্বিধা। রানা পৌঁছুতেই বলল, ‘এবার কী?’

‘রওনা হতে হবে,’ বলল রানা। ‘তবে আপনারটা নয়, আমরা ব্যবহার করব আমার গাড়ি।’

বাড়ির আড়ালে গাছের ওদিকে মার্সিডিয এসএলকে গাড়ি পার্ক করেছে রানা। দ্রুত উইলিয়াম কেন্সিংটনকে সঙ্গে নিয়ে ওখানে পৌঁছে গেল। উঠে পড়ল গাড়িতে।

প্যাসেঞ্জার সিটে গা এলিয়ে দিয়েই গুঙিয়ে উঠল ইতিহাসবিদ, ‘ওহ্! খুব অসুস্থ লাগছে।’

জবাব না দিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল রানা। দরজা বন্ধ করে রওনা হলো। দ্রুত গতির জন্যে সিটে ডেবে বসল ওদের পিঠ। ম্যানরের পাথুরে রাস্তা পার হয়ে সরু সড়কে উঠল ওরা। চারপাশে গ্রাম্য পরিবেশ। গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাড়া চারপাশে নীরবতা। কোথায় চলেছে জানা নেই রানার। তবে এটা জানে, ওই ম্যানর থেকে সরে যেতে হবে। থামবে এমন কোথাও, যেখানে আলাপ সেরে নিতে পারবে কেন্সিংটনের সঙ্গে।

আঁকাবাঁকা উপকূলীয় পথে তুমুল বেগে চলেছে রানা। দু’পাশে সবুজ মাঠ। চরে বেড়াচ্ছে শত শত ভেড়া ও সেগুলোর শাবক। দূরে দূরে একটা-দুটো সাদা কটেজ বা ফার্মহাউস। অস্তের দিকে চলেছে সূর্য। সাগরের বুকে বিলিয়ে দিচ্ছে লালচে আলো। কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল রানার। ফুরিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে আরও একটা দিন। আর কখনও ফিরবে না।

‘আপনার কি এত জোরে গাড়ি চালাতেই হবে?’ আপত্তির সুরে বলল কেন্সিংটন।

‘আসুন, জরুরি কথা সেরে নিই,’ বলল রানা।

‘আগে গাড়ি থামান,’ চাপা স্বরে বলল ইতিহাসবিদ। রাস্তার ওপর থেকে চোখ তুলে তাকে দেখল রানা। মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়েছে লোকটার মুখ। দু’হাতে চেপে ধরেছে পেট। দুর্বল স্বরে বলল, ‘বমি করে দেব।’

ঘাসে ছাওয়া এক মাঠের শেষে কাঠের বেড়া, ওটার পাশে কড়া ব্রেক কষে থামল রানা। দরজা খুলে টলতে টলতে গিয়ে কাঠের একটা খুঁটি একহাতে ধরল উইলিয়াম কেন্সিংটন। অন্যহাত পেটের ওপর। দুই সেকেণ্ড পর প্রায় দুই ভাঁজ হলো সে। গলগল করে মুখ দিয়ে বেরোল বাদামি বমি। ছিটিয়ে পড়ছে ঘাসের বুকে।

লোকটাকে পুরো তিন মিনিট সময় দেয়ার পর গাড়ি থেকে নামল রানা। কাছে গিয়ে বলল, ‘অতিরিক্ত উত্তেজনা। তাই শরীর খারাপ লাগছে। এখন কেমন বোধ করছেন?’

‘খুন হয়ে গেছি,’ বলল উইলিয়াম। ‘তবে গায়ে বাতাস লাগলে ভাল লাগবে।’ রাস্তার পাশে ঢালু পাথুরে জমি নেমেছে সাগর-সৈকতে। বড় একটা পাথরের বোল্ডারে কনুই রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

তার পাশে গিয়ে থামল রানা। বুঝতে পারছে, অযথা নষ্ট হচ্ছে সময়। অথচ, ওটার খুব অভাব ওর এখন। ফিরতে হবে মিশরে। খুঁজে বের করতে হবে সেই গুপ্তধন। তারপর চেষ্টা করবে ওগুলোর বদলে লিণ্ডাকে ছুটিয়ে নিতে। কাজটা শেষ করে দেখে নেবে ও জন ব্রাউনকে। পৃথিবীতে থাকবে হয় ও, নইলে ওই লোক। কিন্তু প্রথমে উইলিয়াম কেন্সিংটনের কাছ থেকে জরুরি তথ্য না জানলে এগোতে পারবে না কোনও দিকেই।

বেশ ক’বার বড় করে শ্বাস নিল কেন্সিংটন। কাঁপা হাত বোলাল মুখের ওপর। তারপর বিড়বিড় করল, ‘হায়, ঈশ্বর! কী করে এসবে জড়িয়ে গেলাম?, ওই ওরাই কি মেরে ফেলেছে মডাককে?

‘ব্যাখ্যা দিতে গেলে অনেক সময় লাগবে,’ বলল রানা। ‘সেই সময় এখন আমার হাতে নেই।’

‘কিন্তু এসব না জেনে কিছুই বলব না আমি।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘বেশ। ব্যাখ্যা হয়তো আপনার প্রাপ্য।’ মিশরে ডাকাতি, মর্ডাকের মৃত্যু, জমির শেখ, জন ব্রাউন ও লিণ্ডার বিষয়ে সংক্ষেপে খুলে বলল ও।

‘ওই লোক আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করছে?’ অবিশ্বাস নিয়ে বলল কেন্সিংটন।

‘তা নয়,’ বলল রানা। ‘সে ভাবছে তা-ই করছে। তবে আমার নিজেরও আগ্রহ আছে ওই গুপ্তধনের ব্যাপারে। সুযোগ পেলে উদ্ধার করব। এরপর, লিণ্ডা মেয়েটাকে উদ্ধার করব ব্রাউনের খপ্পর থেকে। তবে গুপ্তধন আবিষ্কার করার জন্যে সময় পাব মাত্র সাত দিন। আজ ফুরিয়ে যাচ্ছে প্রথম দিন। …এবার বলুন, জরুরি কোনও তথ্য দিতে পারবেন আপনি?’

‘বড় অবাক লাগছে,’ বলল ইতিহাসবিদ। ‘জন ব্রাউনের নাকি অতি আগ্রহ ছিল গুপ্তধনের ব্যাপারে। তাই তাকে ওটার ব্যাপারে বলতে অনিচ্ছুক ছিল মর্ডাক।’

‘খুলে বলুন মডাক আর আপনি এসবে কীভাবে জড়িয়ে গেলেন,’ বলল রানা।

‘মর্ডাক আমার পুরনো বন্ধু,’ বিড়বিড় করল কেন্সিংটন, ‘পড়াশোনাও করেছি একই ইউনিভার্সিটিতে।’

‘আপনারা দু’জন যৌথভাবে কাজ করছিলেন ওই প্রজেক্টে।’

‘গুপ্তধনের ব্যাপারটা আবিষ্কার করে মর্ডাকই। করেই আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করে। তখন ঠিক হয়, সাহায্য করার জন্যে মিশরে যাব ওর ওখানে। তৈরি হচ্ছি, এমন সময় শুনলাম ও খুন হয়ে গেছে। ভীষণ ভয় পেলাম। গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। বারবার মনে হয়েছে, যে-কোনও দিন এসে আমাকে শেষ করবে খুনিগুলো।’ রানার দিকে তাকাল সে। ‘আপনি কী করে জানলেন আমার নাম?’

‘আগেই বলেছি আপনাকে। আপনার ফোন নাম্বার ছিল মর্ডাকের ব্লেয়ারের পকেটে একটা কাগজে।’

‘কপাল মন্দ আমার,’ বলল কেন্সিংটন। ‘ল্যাংকেস্টার ইউনিভার্সিটি ছেড়ে এখানে চাকরি নিচ্ছি, তখন ফোন দিই মর্ডাকের মোবাইল ফোনে। যেন তুলে নিতে পারে নতুন ফোন নাম্বার। সেসময় বোধহয় হাতের কাছে কাগজটা পেয়ে ওখানেই লিখে রেখেছিল।’

এবার বলুন গুপ্তধনের বিষয়ে কতটা জানেন।

‘বলব। তবে আগে একটু গলা ভিজিয়ে নিতে চাই। খুব দুর্বল লাগছে।’

তেত্রিশ

উঁচু, আঁকাবাঁকা সড়ক থেকে নেমে একটু পর সামনেই পড়ল উপকূলবর্তী জেলে গ্রাম। কোবল পাথরে ছাওয়া সরু পথ ধরে এগোতেই দেখা গেল ছোট একটা বন্দর। সাগরের তীরে পাথরের তৈরি পুরনো এক ডকের তিনদিকে ঠুক-ঠাক আওয়াজে পরস্পর বাড়ি খেয়ে দুলছে কিছু নৌকা। সৈকতের কাছে পিয়ারে শুকানো হচ্ছে লবস্টার রাখার বাস্কেট ও লবণ ভরা জাল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কটেজগুলোর জানালা দিয়ে গিয়ে সাগরের বুকে পড়েছে হলদেটে আলো। গাড়ি রেখে নেমে পড়ল রানা ও উইলিয়াম। সাগরতীরে লম্বাটে এক পাব দেখে ওখানে ঢুকল ওরা। রানার মনে হলো, মুহূর্তে ওরা পৌঁছে গেছে কয়েক শ’ বছর আগের পৃথিবীতে।

কাঠের ভারী বারকাউন্টারটা হাজারো আঁচড় ও দাগে ভরা। এখানে ওখানে কয়েকটা অমসৃণ বেঞ্চ ও টেবিল। ওগুলোর বয়স অন্তত দেড় শ’ বছর হবে। টেবিলে টিশ্য বা টেবিল ক্লথ নেই। রুক্ষ দেয়ালে চকবোর্ডের মেন্যু নেই। রানা বুঝে গেল, এখানে যারা আসে, তাদের প্রধান কাজ মদ্যপান করা। আপাতত ভিড় নেই। মেঝেতে করাত দিয়ে কাটা গাছের ঝুরঝুরে গুঁড়ো। বার-এর টুলে স্থানীয় ক’জন জেলে। নিজেদের ভেতর আলাপ করছিল, রানা ও কেন্সিংটনকে ঢুকতে দেখে ঘুরে তাকাল। তবে সেটা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। আবারও নিজেদের আলাপে ডুবে গেল মানুষগুলো।

ফায়ারপ্লেসে ফুলকি তুলে ফুট-ফুট আওয়াজে পুড়ছে চেরাই করা গাছের গুঁড়ির শুকনো খণ্ড। জায়গাটা বারকাউন্টার থেকে বেশ দূরে। ওখানে কোনও টেবিল নেবে ঠিক করল রানা। ওদিকে উইলিয়ামকে পাঠিয়ে নিজে

নিজে গেল বারকাউন্টারে। বিয়ার কিনলে চার-পাঁচটা বোতল শেষ না করে মুখ খুলবে না লোকটা, তাই রানা নিল দুই গ্লাসে ডাবল উইস্কি। ইতিহাসবিদ ওটা পছন্দ করে কি না জানা নেই ওর। জানার ইচ্ছেও নেই। তার সামনে একটা গ্লাস রেখে উল্টো দিকের বেঞ্চে বসল রানা। হাতে সময় খুব কম। পকেট থেকে কয়েকটা কয়েন নিয়ে ফেলল জুকবক্সের ভেতর। বেছে নিল কর্কশ আওয়াজের রক মিউষিক। ওরা আলাপ করলে কান পেতেও কিছু শুনতে পাবে না কেউ। ‘শুরু করা যাক আখেনাতেন প্রজেক্ট বিষয়ে। তত্ত্ব, তথ্য, পরিসংখ্যান কিছুই বাদ দেবেন না।’

হাতে গ্লাস নিয়ে সোনালি তরল দেখল কেন্সিংটন। মনে হলো আপত্তি তুলবে। কিন্তু সাহস আর পেল না। চোখদুটো বুজে ঢক করে গিলল উইস্কি। বাচ্চারা যেমন তিতে ওষুধ খেতে বাধ্য হলে মুখ বিকৃত করে, তার অবস্থাও তেমনই। ঠক্ করে টেবিলে রাখল গ্লাস। ফ্যাকাসে গালে ফিরছে রক্ত। আস্তিন দিয়ে মুছে নিল মুখ। তারপর বলল, ‘প্রথমে আপনার জেনে নিতে হবে এসবের ইতিহাস। নইলে কিছুই বুঝতে পারবেন না।’

‘ঠিক আছে, তবে সংক্ষেপে বলবেন।’

‘আখেনাতেন ছিলেন একজন ফেরাউন,’ বলল কেন্সিংটন, ‘আঠারোতম রাজবংশের রাজা। সময়টা তখন খ্রিস্টপূর্ব ১৩৫৩ থেকে ১৩৩৬। তাঁর আসল নাম ছিল….

‘আমেনহোটেপ চতুর্থ, আর্কিওলজিকাল ম্যাগাযিন থেকে সংগ্রহ করা জ্ঞান ঝেড়ে দিল রানা।

ভুরু ওপরে তুলে বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখল কেন্সিংটন। ‘ভাবতেও পারিনি আপনি একজন ইজিপটোলজিস্ট।

‘তা নই। টুকটাক কিছু তথ্য পড়েছি তার ব্যাপারে।’

কাঁধ ঝাঁকাল কেন্সিংটন। ‘বেশ, কী যেন বলছিলাম?’

‘আখেনাতেন।’

‘হ্যাঁ, ঠিক। তা হলে আপনি হয়তো এ-ও জানেন, আখেনাতেন স্বাভাবিক রাজা ছিলেন না। তাঁর মত আর কাউকে দেখা যায়নি প্রাচীন মিশরের রাজবংশে।’

‘এটা জানি, তিনিই মিশরে প্রথম ফেরাউন, যিনি বিশ্বাস করতেন এক স্রষ্টার ওপরে।’

মাথা দোলাল কেন্সিংটন। সহজ হয়ে উঠছে উইস্কির প্রভাবে। ‘আতেন। অনেকে বলেন সূর্য-দেবতা তিনি। তাঁর নাম মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে আখেনাতেনের আমলে জাতীয় প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হতো সোনালি সূর্যের প্রতিমা। আখেনাতেন যুদ্ধ ঘোষণা করেন বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে। হাজার হাজার বছরের দেব-দেবীকে মুছে দিতে চান। তিনিই চালু করেন নতুন একেশ্বরবাদী ধর্ম। প্রচার করেন, তিনি মেনে চলেন শুধু আতেনকে। অনেক পরে আমরা ওই ধর্মবাদের নাম দিয়েছি আতেনিযম। ইতিহাসবিদদের ভেতর অনেকে মনে করেন আখেনাতেন যিশুর অগ্রদূত। অন্যরা বলেন র‍্যাডিক্যাল ক্র্যাকপট।’ গ্লাস তুলে ভেতরে উইস্কি নেই দেখে হতাশ চোখে রানাকে দেখল সে। ‘আরেকটা ড্রিঙ্ক পেলে ভাল হতো।’

‘আপাতত আমারটা নিন,’ নিজের গ্লাসটা ইতিহাসবিদের নাকের কাছে ধরল রানা। ‘পরে এনে নেব।’

‘অনেক ধন্যবাদ। জিনিসটা দরকার ছিল।’

‘সরাসরি মূল প্রসঙ্গে আসুন। আতেনিযম সম্পর্কে জানি। এ-ও অজানা নয়, সমাজে ধর্মীয় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন বলে আখেনাতেনকে অনেকেই বলতেন ধর্মদ্রোহী পাষণ্ড রাজা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে মর্ডাকের গুপ্তধন বিষয়ক রিসার্চের কী সম্পর্ক?’

রানার গ্লাসটা নিল কেন্সিংটন। ‘আমাকে বলতে দিন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো না বললে কিছুই বুঝবেন না। আর তখন প্রথম থেকে সব বলতে হবে আবার।’

‘আপনি বলুন।’ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ওর মনে সন্দেহ ঢুকেছে, লোকটা দুই পেগ গিলেই মাতাল হয়ে গেল কি না।

‘ওই ফেরাউন যখন তরুণ, সেসময়ে মারা যান তাঁর বাবা আমেনহোটেপ তৃতীয়,’ বলতে লাগল কেন্সিংটন। ‘ক্ষমতা পাওয়ার আগে থেকেই আখেনাতেন অস্বাভাবিক মানসিকতার মানুষ। দৈহিক দিক থেকেও বিকৃত অঙ্গের। সবাই আড়ালে তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। কিন্তু মসনদে বসে তিনি করলেন অকল্পনীয় এক কাজ। সিংহাসনে আসীন হওয়ার পাঁচ বছর পর নিজের নাম পাল্টে করলেন আখেনাতেন। যার আক্ষরিক অর্থ: আতেনের মহিমান্বিত চেতনা। এই নাম নেয়ায় পর শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। শাসনকালের নবম বছরে দেব-দেবী পূজারীদের প্রায় সবাইকে পাঠিয়ে দিলেন নির্বাসনে। ভয়ঙ্কর ঝাঁকি খেল সে আমলের প্রাচীন সমাজ। শেয়াল-মাথা আনুবিস, অধোলোকের শাসক ওসাইরিস আর দেবতাদের দেবতা আমুনকে পুরোপুরি অবজ্ঞা করে উড়িয়ে দিলেন আখেনাতেন।’ মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করল কেন্সিংটন। ‘এত দিনের ধর্ম যেন উবে গেল অস্ত্রের হুমকির মুখে। বেশিরভাগ মানুষ মেনে নিল, দেশের জাতীয় ধর্ম হবে আতেনিযম। বিশ্বস্ত অনুচর বা ভক্তদেরকে নিয়ে থিসের রাজধানী ত্যাগ করে নতুন এক শহরের পত্তন করলেন আখেনাতেন। ওটার নাম হলো আখেতাতেন। অর্থাৎ: আতেনের দিগন্ত। অবশ্য ওটা আরও ভালভাবে পরিচিত আমারনা হিসেবে।’ রানার দেয়া গ্লাসের উইস্কি ঢক করে গিলল সে। যে দৃষ্টিতে তাকাল, তাতে রানা বুঝল লোকটা চাইছে যেন আরও উইস্কি এনে দেয়া হয় তাকে।

‘আবারও ডাবল উইস্কি?’ খালি গ্লাস দেখাল রানা।

‘কেন নয়?’ মাথা দোলাল কেন্সিংটন।

উঠে গিয়ে আরও দুই গ্লাস ডাবল উইস্কি আনল রানা। একটা গ্লাস ইতিহাসবিদের সামনে রেখে উল্টোদিকের বেঞ্চে বসল। ‘বলতে থাকুন।

কী বলছিল মনে করতে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড নিল কেন্সিংটন, তারপর বলতে লাগল, ‘এবার বলব এই কাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাগলা ফেরাউন যখন নিজের তৈরি স্বর্গে ভক্তদের মাঝে আরাম করে জীবন পার করছে, ওই একই সময়ে ধসে পড়ছে দেশের অর্থনীতি। চারপাশে কুকুরের মত কামড়া-কামড়ি করছে সাধারণ মানুষ। এমন কী দেশের নিরাপত্তার দিকেও খেয়াল নেই আখেনাতেনের। দেশের সর্বনাশ হচ্ছে। হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছে ঐতিহ্যময় প্রাচীন মিশর।’ এক ঢোক

এক ঢোক উইস্কি গিলল কেন্সিংটন। গোলাপের মত লালচে হয়েছে দু’গাল। জ্বলজ্বলে বাতির মত জ্বলছে চোখ। ‘আশা করি বুঝতে পারছেন, আখেনাতেনের ওপর মহাবিরক্ত হয়ে উঠল লাখ লাখ মানুষ। সেই আমলের মন্দিরগুলোর পুরোহিতদের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল অর্থনীতি ও সমাজের ওপর। অথচ, সেই মন্দির ধ্বংস করতে লাগলেন আখেনাতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নাযিরা যেমন কঠোর আচরণ করেছে সবার সঙ্গে, মিশরে তখন সেই একই হাল। পুরনো দেব-দেবীর সোনা-রুপা দিয়ে তৈরি মূর্তি থেকে শুরু করে ছোটবড় সব ঐতিহ্যময় সম্পদ ধ্বংস করে দিচ্ছেন আখেনাতেন। সোনা-রুপা গলিয়ে তৈরি করা হচ্ছে আতেনের মূর্তি। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে সব মন্দির। হঠাৎ করেই মানা করে দেয়া হয়েছে শিল্পী, রাজমিস্ত্রি, ভাস্কর, লেখকদের, যাতে তারা আর কখনও দেব-দেবী সংক্রান্ত কোনও কাজে হাত না দেয়। কাজ বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে গেল মানুষগুলো। অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠলেন মন্দিরের উচ্চ পর্যায়ের পুরোহিতরা। এককথায় সমাজে ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি করলেন আখেনাতেন। যাদের ক্ষতি করলেন, খেপে গেল তারা। প্রচার করতে লাগল, দেশে বিচার নেই। পাষণ্ড এক অত্যাচারী বর্বর এসে চেপে বসেছে মসনদে।’

কয়েক মুহূর্ত থেমে কী যেন ভাবল উইলিয়াম কেন্সিংটন। তারপর আবারও বলতে লাগল: ‘এবার আসছি একটা কিংবদন্তির বিষয়ে। ওই শ্ৰুতি অনুযায়ী, সেসময়ে আখেনাতেনের সৈনিক ও গুপ্তচরদের কাছ থেকে বাঁচাবার জন্যে বিপুল পরিমাণের ধর্মীয় আর্টিফ্যাক্ট বা সম্পদ সরিয়ে নেন বিশেষ কেউ বা একাধিক ক্ষমতাশালী লোক। যদিও কথাটা মিথ্যাও হতে পারে।’

‘সত্যি হয়ে থাকলে কে বা কারা সেটা করে?’

‘পরিষ্কার ভাবে কিছু জানা যায় না বলেই ওই ঘটনাকে ধরে নেয়া হয়েছে লোককাহিনী হিসেবে। হাজার বছর ধরেই গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়নি বিষয়টি। শীতের রাতে আগুন পোহাতে বসে নাতি-পুতিদেরকে এ গল্প শোনাতেন বৃদ্ধ- বৃদ্ধারা।’

গভীর সন্দেহে দুলে উঠল রানার মন। ‘তার মানে, এসব মিথ্যাও হতে পারে। বাস্তবে হয়তো নেই সেই গুপ্তধন?’ ওর মনে হচ্ছে, এখানে এসে অযথা সময় নষ্ট করছে। বোধহয় উচিত ছিল প্যারিসে জন ব্রাউনকে খুঁজতে শুরু করা।

ওর মন খারাপ ভাবটা টের পেয়েছে উইলিয়াম কেন্সিংটন। ‘এত হতাশ হবেন না। শেষ হয়নি আমার কথা। এখন যা বলব, তাতে চমকে যাবেন।’

‘বলুন,’ বলল রানা।

‘লোককাহিনী বলা শেষ, এবার বলছি বাস্তবতা। কপালের জোরে তুরস্কের অ্যান্টাকিয়ায় প্রাচীন এক নিদর্শন আবিষ্কার করে মডাক। ওটা ছিল হাজার বছর আগের সিরিয়ার নাম করা শহর অ্যান্টিওক-এ।

রানার মনে পড়ল, প্রথমবারের মত যিশুর অনুসারীদেরকে খ্রিস্টান নামে ডাকা শুরু হয় ওই শহরে। শত শত বছর ধরে যুদ্ধ চলেছে ওখানে। অবরোধের নগরী। সংঘটিত হয়েছিল ক্রুসেড। অনেকে বলে ভূমিকম্পের শহর অ্যান্টিওক। বারবার হাত বদল হয়েছে। দখল করেছে মিশরীয়রা, গ্রিকরা এবং শেষে রোমানরা। তবে এসব থেকে জানার উপায় নেই, কোথায় আছে গুপ্তধন বা ওটা বাস্তবে আছে কি না।

‘দু’বছর আগে মডাক ছুটিতে গিয়েছিল অ্যান্টিওকে, বলল কেন্সিংটন। ‘সুযোগ পেলেই ছোট সব অ্যান্টিক দোকান বা রাস্তার দোকানে ঢু মারত। যা পেত, তার বেশিরভাগই ছিল নকল জিনিসপত্র। প্রাচীন প্যাপাইরাস কিনে দেখা যেত জিনিসটা আসলে গত বছরের কলাগাছের পাতা। একটু রঙ করে দেয়া হয়েছে মাত্র। বা কিনল হয়তো প্রাচীন এক কারুকাজ করা হাড়। পরে জানল জিনিসটা টার্কি মুরগির গিলে ফেলা কোনও ছোট জন্তুর হাড়। পেটের অ্যাসিডের কারণে দেখতে হয়েছে প্রাচীন আমলের দামি আর্টিফ্যাক্টের মত। কিন্তু ছুটি শেষ হওয়ার ঠিক আগের দিন অন্য কিছু পেল মডাক।

‘জিনিসটা কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘খুব ছোট এক কৌটা,’ বলল কেন্সিংটন। ‘ক্ষয়ে গেছে সময়ের সঙ্গে। বিক্রেতা বলেছিল, ওটা খুঁড়ে তোলা হয়েছে অ্যান্টিওক শহরের ধ্বংসাবশেষের তলা থেকে। লোকটা ভেবেছিল, ওটা বাজে ফালতু কৌটা। দেরি না করে কৌটা কিনে হোটেলে ফেরে মডাক। ইংল্যাণ্ডে আসার পর অর্ধেক রাত লেগেছিল ওটা খুলতে। ভেতরে ছিল প্যাপাইরাস।’

‘গত বছরের কলাগাছের পাতা নয়?’

‘না। সত্যিকারের জিনিস। হায়ারাটিক স্ক্রিপ্ট। আগের আমলে যেমন করে হায়ারোগ্লিফ ব্যবহার করে চিঠি লেখা হতো, অনেকটা তেমনই। তবে আরও সহজ ভাষায় লেখা।’

‘হায়ারাটিক স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে জানি, আপনি বলুন,’ বলল রানা।

‘ওটা ছিল একটা অসমাপ্ত চিঠি। যিশুর জন্মের ১৩৩৪ বছর আগে লেখা হয়েছিল অ্যান্টিওক শহরের কাউকে। মোটামুটি ওই সময়েই মারা যান ফেরাউন আখেনাতেন। যিনি চিঠি দেন, নিজের নাম ও পরিচয় জানাতে গিয়ে লেখেন: আমি হেরাক্লেয়ার ওটচিগিন। খুব অসুস্থ, বয়স্ক মানুষ ছিলেন তিনি। জরুরি কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন।’

‘গল্প না বাড়িয়ে সংক্ষেপে বলুন, আমার হাতে সময় কম,’ বলল রানা।

তর্জনী তুলে নিষেধ করল কেন্সিংটন। ‘একটু ধৈর্য ধরুন। সবই বুঝবেন। ওই চিঠি লেখা হয় থিবসের জাজেরি নামের হাই-প্রিস্টের কাছে। ওটচিগিন প্রকাশ করেন অকল্পনীয় এক সত্য। স্বীকার করেন যে তিনি মিশরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যময় সব সম্পদ সরিয়ে নেন অন্য কোথাও। কিন্তু সেজন্যে কোনও পরিতাপ ছিল না তাঁর। সেজন্যে শাস্তিও হয়নি। তবে চিঠি শেষ করে প্রাপকের কাছে পাঠাতে পারলে, দেরি না করে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো মিশরে। সবচেয়ে বড় স্কয়্যারে হিরো হিসেবে সংবর্ধনা পেতেন। এবার শুনুন, কেন এ কথা বলেছি।’

চুপ করে অপেক্ষা করছে রানা। দেখা যাক কেন্সিংটন ওকে আগ্রহী করে তুলতে পারে কি না।

‘এবার আপনাকে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েক বছর, বলল কেন্সিংটন। ‘সেসময়ে ওটচিগিন নামে পরিচিত ছিলেন না পত্রলেখক। তাঁর আসল নাম ছিল মানকাউয়া। জাতিতে ইজিপশিয়ান।

জন্মেছেন থিবসে। শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রধান পুরোহিত ছিলেন। সেসময়ে তাঁর অনুগত শিষ্য ছিলেন তরুণ জাজেরি। যিশুর জন্মের ১৩৪৩ বছর আগে মানকাউয়া তাঁর চিঠিতে লেখেন, তাঁদের ধর্ম ও দেশ বাঁচাতে হবে। সবার সর্বনাশ করে দিচ্ছে আখেনাতেন, তাই তাঁর দুই শিষ্য মানুরি ও কিপাটুকে নিয়ে কাজে নামতে মনস্থ করেন তিনি।’

‘কী করেন তিনি?’ জানতে চাইল রানা।

‘একবার কল্পনা করুন কী ভয়াবহ পরিবেশ চলছে মিশরে। সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে, তাদের রাজা আসলে বদ্ধ উন্মাদ। ধ্বংস করছে জাতীয় ঐতিহ্যবাহী সব শিল্প ও সম্পদ। অন্ধের মত সূর্য-পূজা নিয়ে আখেনাতেন এতই ব্যস্ত, ক’দিন পর হয়তো দেশই থাকবে না। কিন্তু নিজে থেকে তো আপনা-আপনি ভাল হবে না পরিস্থিতি। এবার বলুন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে আপনি নিজে কী করতেন?’

জবাবটা মুহূর্তে পেয়ে গেছে রানা।

ওর চেহারা দেখে মুচকি হাসল কেন্সিংটন। ‘ঠিক। আপনিও চাইতেন যেন চিরকালের জন্যে বিদায় হয় অত্যাচারী শাসক। ষড়যন্ত্র করলেন মানকাউয়া। কিন্তু আখেনাতেনকে খুন করা সহজ নয়। তার চারপাশে বিশ্বস্ত সৈনিক, ছড়িয়ে রেখেছেন গুপ্তচরদের জাল। কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না আর কাউকে। বাধ্য হয়ে মানকাউয়া ধৈর্য ধরলেন। ভাল করেই জানতেন, আজ হোক বা কাল…. মরবেন আখেনাতেন। তখন স্বাভাবিক হবে রাজনৈতিক ও ‘সামাজিক পরিবেশ।

মিয়ানমারের মতই মগের মুল্লুক তৈরি করেছিল আখেনাতেন, ভাবল রানা। ‘মানকাউয়া ঠিক করলেন, আপাতত লুকিয়ে ফেলবেন মূল্যবান সব সম্পদ। একদিন সবই ফিরিয়ে দেবেন মন্দিরগুলোতে।’

বারকয়েক মাথা দুলিয়ে ঢক্ করে উইস্কি গিলল কেন্সিংটন। ‘মানকাউয়া, মানুরি ও কিপাটু নিজেদের জন্যে চাননি এসব সম্পদ। তাঁরা দায়িত্ব নেন বিশ্বস্ত বাহকের। নিজের ক্ষমতা ও সুনাম ব্যবহার করে কয়েক মাস বা কয়েক বছরের ভেতর বিপুল সম্পদ জোগাড় করে গোপনে লুকিয়ে ফেললেন থি নগরীর কোথাও। ওখান থেকে কিছু কিছু করে সরিয়ে নেয়া হলো বহু দূরে। সাধারণ মানুষ কিছুই জানল না। কাজটা ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। রাজার লোকের হাতে ধরা পড়লে নির্ঘাৎ মৃত্যু। যাই হোক, পরে তথ্য পাচারকারীদের কারণে আখেনাতেনের কানে গেল ওই সম্পদের কথা। ভয়ানক নির্যাতন করে মেরে ফেলা হলো অনেক মানুষকে। পুরোহিতরা হয়ে গেলেন চিহ্নিত গোষ্ঠী। তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন হলো মরুভূমির কোথাও শেষের কিছু সম্পদ সরিয়ে নেয়া। মানকাউয়া বর্ণনা দিয়েছেন, কী করে গোপনে থিস্‌ থেকে বেরিয়ে ব্যবসায়ীর বেশ ধরে চেপে বসেন বাণিজ্য তরীতে। পরে শুনলেন কী হয়েছিল মানুরি ও কিপাটুর। নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের মুখ থেকে সবই বের করবেন আখেনাতেন, তাই বিষ পান করে আত্মহত্যা করে তারা।’

‘মানকাউয়া পালিয়ে গেলেন সিরিয়ায়?’

‘মাথা পরিষ্কার ছিল তাঁর। ওখানে পৌঁছে ধনী এক লোকের ছেলের ব্যক্তিগত শিক্ষকের কাজ নিলেন। নিজের নাম বললেন ওটচিগিন। পেরোতে লাগল বছর। তারপর একদিন শুনলেন, মারা গেছেন আখেনাতেন। জানা গেল না আততায়ীর হাতে খুন হয়েছেন, নাকি স্বাভাবিক মৃত্যু। তিনি নেই বলে নতুন করে আবারও চালু হলো পুরনো ধর্মের চর্চা। ধুলোয় মিশে গেল আখেনাতেনের ধর্ম। এতদিন অত্যাচার করেছে তাঁর অনুসারীরা, এবার তারাই পড়ল বিপদে। পরের রাজা তুতেনখামেন জাতীয় ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন আগের ধর্মকে। আবারও দেবতাদের রাজা হলেন আমুন। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মানকাউয়ার। কিন্তু ততদিনে তিনি বৃদ্ধ এবং অসুস্থ। বুঝে গেছেন, আর দেরি করলে গুপ্তধনের কথা তাঁর সঙ্গেই কবরে যাবে। সময় নষ্ট না করে চিঠি লিখতে বসলেন তিনি। কিন্তু দুঃখের কথা, বা বলা চলে আমাদের ভালর জন্যেই, অসুস্থতার কারণে চিঠি শেষ করে মিশরে আর ওটা পাঠাতে পারলেন না। হয়তো আগেই মারা যান। অথবা, ভেবেছিলেন এসব কাউকে না জানানোই ভাল। আসলে কী হয়েছিল, আমরা জানি না। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, ওই চিঠি আমাদের হাতে পড়ল হাজার হাজার বছর পর। আমরা জেনে গেলাম, কোথাও রয়ে গেছে সেই বিপুল সম্পদ বা গুপ্তধন।’

উইলিয়াম কেন্সিংটনের কথা শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল রানা। তারপর জানতে চাইল, ‘আপনার কি মনে হয় বাস্তবেই আছে ওই গুপ্তধন? ওটার ওপর নির্ভর করছে লিার জীবন-মৃত্যু।’

‘ওই গুপ্তধন যে আছে, সেটা নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই,’ বলল কেন্সিংটন। ‘মর্ডাক আর আমি মিলে প্রায় এক মাস ধরে অনুবাদ করেছি প্যাপারাইস।’

‘ওটা এখন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘লণ্ডনে, একটা ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোযিট বক্সে। মর্ডাক মারা যাওয়ায় আমি একমাত্র মানুষ, যে ওটার কথা জানি।’

ভুরু কুঁচকে তাকে দেখল রানা। ‘জানবেন কী করে যে ওই প্যাপাইরাসে সত্যিকারের তথ্য আছে? জানার তো উপায় নেই ওটচিগিন আসলে মানকাউয়া।’

‘জানার উপায় আছে। কারণ চিঠির শুরুতে নিজের ব্যক্তিগত সিল দিয়েছেন তিনি। ওরকম সিল ব্যবহার করত সেই আমলের প্রধান পুরোহিতেরা। খুব কম মানুষই দেখতে পেয়েছে ওই সিলমোহর। কর্তৃপক্ষ দেখলেই বুঝে যেত, প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী প্রধান পুরোহিতের সিল ওটা। আমি দেখাতে পারব আপনাকে।’ জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে কলম নিয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকল সে। একটু পর রানা দেখল, একটা বৃত্ত তৈরি করেছে লোকটা। মাঝে ছোট্ট একটা মন্দির। ওটাকে ঘিরে রেখেছে পাম গাছ। মন্দিরের ছাতে মুকুট পরা একটা দাঁড়কাক।

কয়েক মুহূর্ত ছবিটা ঝুঁকে দেখল রানা, তারপর বলল, ‘এত গুরুত্বপূর্ণ হলে এটা নিয়ে শোরগোল তোলেনি কেন ইজিপটোলজিস্টরা?’

নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে আওয়াজ করল কেন্সিংটন। ‘ইজিপটোলজিস্টদের বেশিরভাগই আসলে রামছাগল। নাম করা বেশ কয়েকজন প্রফেসরের এক প্যানেল তো বলে দিল, পুরনো লোককাহিনীর পেছনে দৌড়ে বোকার মত সময় নষ্ট করছি আমরা। আমাদের অনুচিত হবে আখেনাতেনের গুপ্তধনের ব্যাপারে পেপার তৈরি করা। জ্যোতিষশাস্ত্রের বই লেখাও এর চেয়ে ভাল।’

‘হয়তো ঠিকই বলেছেন।’

এক ঢোক উইস্কি গিলল কেন্সিংটন। ‘তা-ই? তবে এটা ভুলবেন না, এসব গাধার পাছারাই একসময়ে বলেছে ইমহোটেপ স্রেফ পৌরাণিক কাহিনী। কিন্তু তারপর উনিশ শত ছাব্বিশ সালে প্রমাণ হলো, সত্যিই ছিল সেই ফেরাউন। তখন মুখ আর পাছা লাল হয়ে গেল নোংরা শুয়োরগুলোর। মর্ডাক আর আমি বুঝে গেলাম, আরেকবার মস্ত গাধামি করছে তারা। লজ্জা তাদেরকে পেতেই হবে। এতে মনে কোনও সন্দেহ রাখবেন না।’

‘আপনি কি ভাবছেন ওই সিল থেকেই বুঝে যাবেন গুপ্তধন কোথায় আছে?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল উইলিয়াম কেন্সিংটন। ‘না, তা নয়। ব্যাপারটা অত সহজ নয়। মডাক আর আমি ভেবেছিলাম, কাজ শুরু করার পর যে-কোনও সময়ে নাক গলাবে জন ব্রাউন। তবে সিনেমা বা বইয়ে যেমন ম্যাপ এঁকে কোথাও একটা এক্স বসিয়ে দেয়া হয়, ব্যাপারটা অমন সহজ হলে বহু আগেই ওই গুপ্তধন পাওয়া যেত। বুদ্ধিমান এবং খুব সতর্ক মানুষ ছিলেন মানকাউয়া। আগামী বেশ কয়েক বছর পর কী হবে, আগেই আঁচ করে নিয়েছিলেন। চিঠিতে লিখেছেন কীভাবে পালিয়ে গেছেন মিশর থেকে সিরিয়ায়। আখেনাতেনের লোকদের নাকের কাছেই রেখেছিলেন বেশ কিছু সূত্র, যেগুলো সমাধান করলে মিলবে সেই বিপুল গুপ্তধন।’ মৃদু হেসে ঝুঁকে বসল ইতিহাসবিদ।

‘আপনি জানেন ওসব সূত্র কী?’ জানতে চাইল রানা।

ম্লান হয়ে মিলিয়ে গেল কেন্সিংটনের হাসি। ‘না, জানি না। তবে প্যাপাইরাসের চিঠিতে তিনি দিয়েছেন প্রথম সূত্র। ওটা সমাধান করলে পাবেন দ্বিতীয় সূত্র। ওটা সমাধান হলে পাবেন তৃতীয় সূত্র। এভাবে এক এক করে সূত্র খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে যাবেন গুপ্তধনের কাছে। আমাদের কাছে আছে মাত্র প্রথম সূত্রটা, যেটা পৌঁছে দেবে দ্বিতীয়টার কাছে।’

‘প্রথম সূত্র কী ধরনের?’

‘লিখেছেন, এমন এক সমাধির ভেতর রয়েছে সে: ‘সে এমন কেউ, যে কি না রে-এর খুব কাছে।’

‘স্পষ্ট করে কিছুই বলা হয়নি,’ বলল রানা। ‘প্রাচীন আমলে রে ছিল মিশরের গুরুত্বপূর্ণ কেউ। অনেকেই মনে করত, সে দেবতার খুব ঘনিষ্ঠ। মিশরের অর্ধেক সমাধি খুঁড়েও হয়তো দরকারি কিছুই পাবেন না।’

‘ঠিক। আর সেজন্যেই কায়রোয় গিয়ে গবেষণা করছিল মডাক।’

‘তারপর ওই সূত্র সমাধান করল মর্ডাক?’

‘জরুরি কিছু যে পেয়েছিল, সন্দেহ নেই,’ বলে চুপ হয়ে গেল কেন্সিংটন। একটু পর বলল, ‘কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ওটা যে কী ছিল, সেটা জানা নেই। মডাক যখন কায়রোয়, সেসময়ে একদিন বাড়িতে ফিরে ওর ফোন মেসেজ পেলাম। খুব উত্তেজিত ছিল। বলেছিল, প্রথম সূত্রের সমাধান করেছে। এবার খুঁজবে দ্বিতীয় সূত্র। আগামীকাল যাবে একটা জায়গায়। আর এর ফলে পাবে পরবর্তী সূত্র। আমাকে বলেছিল যেন পরে ফোন দিই ওকে। পরদিন কল দিলাম, কিন্তু বন্ধ ছিল ওর মোবাইল। দু’এক দিন পর জানলাম খুন হয়েছে। চুরি করে নিয়ে গেছে সব রিসার্চ নোট। ওখানে নতুন কিছু যোগ করে থাকলেও, সেসব আর জানার উপায় নেই।’

‘তা বোধহয় নয়,’ পকেট থেকে নীল মোবাইল হার্ড ডিস্ক বের করে টেবিলে রাখল রানা। ‘মর্ডাকের ল্যাপটপ থেকে নেয়া হয়েছে ওর ফাইল। এটার ভেতর আছে ওটা।’

ছোঁ দিয়ে মোবাইল ডিস্ক নিল কেন্সিংটন। ‘কী করে পেলেন এই জিনিস? না-না, ঠিক আছে, জানতেও চাই না।’ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিনিসটা দেখছে সে। ‘ভেতরে কী আছে জানার জন্যে মনটা অস্থির লাগছে।’

‘আপনি একা নন, ফাইলের ভেতরের তথ্য জানতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে একদল ভয়ানক ডাকাত।’

‘কিন্তু এটা তো আর পাবে না, বাঁকা হাসল কেন্সিংটন। ‘মরে গেলেও এটা হাতছাড়া করব না। তা ছাড়া, মর্ডাক আর আমি মিলে তৈরি করেছি দুনিয়ার সবচেয়ে জটিল ক্র্যাকপ্রুফ এনক্রিপশন। ওটা ছিল আমাদের গোপন সম্পদ।’

‘এবার কমপিউটার লাগবে,’ বলল রানা। ‘আপনার বাড়িতে যেতে পারব না।’

‘তা ঠিক। তবে অফিসে তো যেতে পারি?’

চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। একঘণ্টার বেশি পাব-এ বসে আছে ওরা। বাইরে রাত নেমে গেছে। ‘ঠিক আছে, চলুন। দেরি না করাই ভাল।’

চৌত্রিশ

সেইণ্ট অ্যান্ড্রিউ ইউনিভার্সিটির পার্কিং লটের ল্যাম্প পোস্টের নিচে মার্সিডিয রেখে নেমে পড়ল রানা ও কেন্সিংটন। ফ্যাকাল্টি অভ হিস্ট্রি ভবনের গেটের সামনে পৌছে দেখল, ওটা বন্ধ।

‘সমস্যা নেই,’ বলল ইতিহাসবিদ। ‘ছুটির পরেও কাজ থাকতে পারে, তাই সবাইকে দেয়া হয়েছে স্পেয়ার চাবি।’

তালা খুলে ক্র্যাচ্ আওয়াজে সাইড গেট খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা। ভবনের দরজা খুলছে কেন্সিংটন, সেই সুযোগে রাস্তার এদিক ওদিক দেখল রানা। আশপাশে কেউ নেই। রিসেপশনে ঢুকেই কেন্সিংটন বাতি জ্বালার সুইচের দিকে হাত বাড়াতেই খপ করে ওটা ধরল রানা। ‘অফিস অন্ধকার থাকুক।’

জানালা দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার আলোয় সিঁড়ি বেয়ে উঠল ওরা। অন্ধকার করিডোর ধরে পৌঁছে গেল কেন্সিংটনের অফিসের সামনে। দরজা খুলে অন্ধকারে ঢোকার পর জানালার ব্লাইও টেনে দিল রানা। এদিকে ডেস্কে ল্যাপটপ চালু করেছে ইতিহাসবিদ। মোবাইল হার্ড ডিস্ক গুঁজে দিল কমপিউটারের স্লটে। কয়েক সেকেণ্ড পর জেগে উঠল স্ক্রিন। অন্ধকারে কেন্সিংটনের মুখে পড়ল নীলচে আভা। ‘হার্ডওয়্যার চিনে নিয়েছে নতুন ডিস্ক। এবার দেখা যাক।’ মাউস নেড়ে কয়েকটা কমাণ্ড দিল সে। ‘এবার দেব পাসওঅর্ড। যুম্বা ড্যান্সার জেসিকা গ্রিন।’

‘যুম্বা ড্যান্সার জেসিকা গ্রিন?’ জানতে চাইল রানা।

চোখ তুলে ওকে দেখল কেন্সিংটন। ‘ডারহ্যামের মানগ্রেড-এ যখন পড়ি, সেসময়ে ছিল জুনিয়ার এক টিচার। হাঁ করে দেখতাম তাকে। এমন সুন্দরী আর কাউকে দোখান। যুম্বা ড্যান্স করত। মর্ডাকেরও মনে ছিল তাকে। পাসওঅর্ড লেখার সময় আমরা ঠিক করলাম, পাসওঅর্ড যখন দেবই, তো জেসিকা গ্রিন নয় কেন? একটু যোগ করে পাসওঅর্ড তৈরি করলাম, যুম্বা ড্যান্সার জেসিকা গ্রিন। একেই বলে ক্র্যাকপ্রুফ এনক্রিপশন।

উইলিয়াম কেন্সিংটনের কলার মত মোটা আঙুলগুলো নাচতে লাগল কিবোর্ডে। পাসওঅর্ড দিতেই আনলক হলো ফাইল।

‘দেখা যাক আখেনাতেন প্রজেক্ট রিসার্চ ফাইলের ভেতর কী,’ গর্বের সঙ্গে বলল কেন্সিংটন। স্ক্রল করে ঝড়ের বেগে ডকুমেন্টের নিচের দিকে গেল সে। কিছুই বুঝছে না রানা। কয়েক মুহূর্ত পর ইতিহাসবিদ বিড়বিড় করে বলল, ‘কিন্তু নতুন কিছুই তো দেখছি না।’ একটা ইমেজ ফুটে আছে স্ক্রিনে। উঁকি দিয়ে ওটা দেখল রানা। ওর মনে হলো জিনিসটা প্রাচীন কোনও ডকুমেণ্ট। অক্ষরগুলো চিনল না।

‘এটা মানকাউয়ার প্যাপাইরাসের হাই-রেযোলিউশন স্ক্যান,’ বলল উইলিয়াম কেন্সিংটন। ‘দেখতেই পাচ্ছেন, কতটা পুরনো। অনেক সময় লেগেছে ডিসাইফার করতে।’ কয়েক মুহূর্ত ডকুমেন্টটা দেখল সে। তারপর আবারও স্ক্রল করে নামতে লাগল। স্ক্রিনে আটকে আছে চোখ।

ডেস্ক থেকে সরে জানালার কাছে গেল রানা। ব্লাইও সামান্য সরিয়ে নিচে তাকাল। রাস্তায় কেউ নেই।

টাকরা দিয়ে বারকয়েক আওয়াজ তুলল কেন্সিংটন। মাথা নেড়ে বলল, ‘এসবই আছে আমার কাছে। নতুন কিছু নয়। জানতে হবে ডকুমেন্টের নিচে মডাক নতুন কিছু লিখেছে কি না। দেখা যাক …

চুপ হয়ে গেল সে। সামনের দিকে ঝুঁকে গেছে ঘাড়। ‘হায়, ঈশ্বর!’

‘কী দেখলেন?’ ডেস্কের কাছে ফিরল রানা।

‘বিশ্বাস করতে পারছি না।’

‘কী বিশ্বাস করতে পারছেন না?’

স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে শ্বাস আটকে বলল কেন্সিংটন, ‘সাহিরি। তা হলে সাহিরি? তা-ই হবে। কী গাধা আমি, নইলে আগেই বুঝে যেতাম।’

‘সাহিরি কী?’ জানতে চাইল রানা।

‘কখনও বাইবেল পড়েননি?

‘পড়লেও সাহিরির কথা কিছু মনে নেই।’

খিকখিক করে হাসতে শুরু করেছে কেন্সিংটন। দু’হাত মুঠো করে আকাশের দিকে ছুঁড়ল। ‘সত্যিই, দুর্দান্ত জিনিয়াস এই মডাক।’

‘খুলে বলবেন, নাকি পিটিয়ে মুখ খোলাতে হবে?’ বিরক্ত রানার মনে হচ্ছে লোকটার কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে টেবিলের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়।

হাসি থামিয়ে গম্ভীর হলো ইতিহাসবিদ। আবারও তাকাল স্ক্রিনের দিকে। ‘এটা দেখুন। শেষ এন্ট্রি। ডকুমেন্টের শেষে। প্রথম সূত্রের সমাধান করেছিল মর্ডাক।’

‘ব্যাখ্যা করে বলুন,’ বলল রানা।

‘সেই সূত্র আপনার মনে আছে, আমি বলেছিলাম: ‘লিখেছেন, এমন এক সমাধির ভেতর রয়েছে সে: ‘সে এমন কেউ, যে কি না রে-এর খুব কাছে,’’ বলল কেন্সিংটন। ‘প্রাচীন মিশরে পঞ্চম রাজবংশের দ্বিতীয় ফেরাউন সাহিরিকে সবাই এক নামে চিনত রে হিসেবে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪৮৭ থেকে ১৪৭৫ সাল পর্যন্ত শাসন করেছেন। তাঁর পিরামিড আছে আবুসির-এ। কায়রোর দক্ষিণের মরুভূমিতে। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, ওখানেই দ্বিতীয় সূত্র পায় মডাক।

‘হয়তো পেয়েছে।’

চকচক করে উঠল কেন্সিংটনের দুই চোখ। ‘হ্যাঁ, তাতে সন্দেহ নেই।’ স্ক্রিনের দিকে আঙুল তাক করল সে। ‘আরও দুই লাইন নিচেই মর্ডাকের নোট। সাহিরি নাকি মানকাউয়ার পূর্বপুরুষ। একসময়ে মানকাউয়া ছিল হাই-প্রিস্ট জাজেরির গুরু। তার কাছেই চিঠি দিতে চেয়েছিল মানকাউয়া। জাজেরি চিঠি পেলেই চট করে বুঝে যেত সূত্রগুলো কী ধরনের। এখন বুঝতে পেরেছেন? আমরা ঠিক পথেই আছি।’

‘হয়তো,’ বলল রানা।

‘আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বলে এখন ভাল লাগছে না?’

‘খুশিতে মনে মনে যুম্বা ড্যান্স করছি।’

চওড়া হাসি দিল কেন্সিংটন। ‘নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমরা দুর্দান্ত একটা টিম হতে পারি? আমি প্রতিভাবান, তুখোড় ব্রেন। আর আপনার আছে সাহস ও দৈহিক শক্তি কাজেই আমাদের সময় লাগবে না গুপ্তধন হাতের মুঠোয় পেতে।’

কেন্সিংটনকে দেখল রানা। ‘একমিনিট। আমরাটা আসছে কোথা থেকে?’

মাথা দোলাল কেন্সিংটন। ‘আমরা দু’জনে যাব মিশরে। বুঝতেই পারছেন, আমাকে ছাড়া কিছুই করতে পারবেন না।’

‘আপনাকে সঙ্গে নিতে রাজি নই আমি,’ বলল রানা।

মহাশূন্য থেকে পড়েছে, এমন দৃষ্টিতে তাকাল কেন্সিংটন। ‘কিন্তু কেন?’

‘অনেক কারণ আছে। তবে সেগুলোর ভেতর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আপনি মিশরে গেলেই ভয়ঙ্কর সব বিপদে পড়বেন।

‘নিজের দেশেও তো কম বিপদ হচ্ছে না,’ আপত্তি তুলল ইতিহাসবিদ। উত্তেজনায় লালচে গাল আরও লাল হয়েছে। হঠাৎ করেই যেন আদালত থেকে তাকে শুনিয়ে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ডের কথা। ‘বাড়িতেও তো ফিরতে পারব না।’

‘কাজেই আপনি আমার সঙ্গে যেতে চান?’

‘আপনি শক্তপোক্ত লোক। মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করেন না। মডাক আর আমার এমনই কাউকে দরকার ছিল। আপনাকে যেমন দরকার আমার। আপনারও দরকার আমাকে। আমরা ভাল একটা টিম হতে পারি।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘আপনাকে আগলে রেখে গোটা মিশর ঘুরতে পারব না।’

‘তা হলে তো আর কিছুই খুঁজে পাবেন না,’ খোঁচা দিয়ে বলল কেন্সিংটন। ‘আপনি কি হায়ারোগ্লিস্ পড়তে পারেন? ডিসাইফার করতে পারেন হাজার বছর আগের সূত্র? না, তা পারেন না। কিন্তু আমি পারি।’

চুপ করে আছে রানা।

‘মূল কথা হচ্ছে, ওই গুপ্তধন পেতে হলে আমার সাহায্য নিতেই হবে,’ বলল কেন্সিংটন। ‘আমি না গেলে কিছুই বুঝবেন না।

‘গুপ্তধন পেলেও সেটা কিন্তু আপনাকে দিতে পারব না,’ বলল রানা।

‘অ্যাকাডেমিক হিসেবে খ্যাতি পেলেই আমি খুশি,’ বলল কেন্সিংটন। ‘বড়জোর একটা দুটো অ্যান্টিক নেব, যাতে অন্য অ্যাকাডেমিক মেনে নিতে বাধ্য হয়, মডাক আর আমি তাদের চেয়ে বড় স্কলার। এর বেশি কিছু চাইছি না। গাধার পাছাগুলোকে বলে দেব, আগেই সমাধিতে পৌঁছে গিয়েছিল ডাকাতের দল। তাতে আরও বোকা বনবে নিরেট মূর্খগুলো। রাজি হয়ে যান আপনি, রানা। এ ছাড়া উপায় নেই।’

‘আপনার পাসপোর্টের কী হবে? ভিসার জন্যে দিনের পর দিন বসে থাকতে পারব না।’

হাসল কেন্সিংটন। ‘ভাববেন না। ভিসা করা আছে। আমার দরকারি সব কাগজপত্র এই অফিসেই রাখি।’ তর্জনী তাক করে একপাশের স্টিলের ফাইলিং কেবিনেট দেখাল সে। ‘বাড়িতে সব হারিয়ে যায়। তাই সব ওই কেবিনেটেই থাকে।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল রানা। পুরো একমিনিট পর সিদ্ধান্ত নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, কেন্সিংটন। আমরা মিশরে যাচ্ছি। এডিনবার্গে গিয়ে দেখব কায়রোর দিকে যায় কি না কোনও প্লেন। সেক্ষেত্রে কাল সকালেই পৌছে যাব ওখানে।’

‘এতক্ষণে কাজের কথা বলেছেন,’ বলল কেন্সিংটন।

‘কিন্তু আমার কিছু শর্ত আছে। ওখানে পৌঁছুবার পর আমার প্রতিটা কথা মেনে চলবেন। দেরি করিয়ে দেবেন না। খুব দ্রুত কাজ সেরে নেব। কোনও ধরনের ঝামেলা করলে আপনাকে তুলে দেব ব্রিটেনগামী প্রথম বিমানে।’

ঝলমল করছে উইলিয়াম কেন্সিংটনের মুখ। আপনি জানবেনই না যে আমি সঙ্গে আছি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *