ছায়াঘাতক – ১৫

পনেরো

তিন মিনিট পর ম্যাট্রেস মুড়িয়ে নিল রানা। ভেতরে হাত-পা বাঁধা দুই অ্যাডিক্ট। মুখের ভেতর নোংরা মোজা। পার্সেল ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেবে রানা। মর্ডাকের ব্লেযার দিয়ে মুড়ে নিয়েছে ল্যাপটপ। ওটা রেখে দিল ওর ব্যাগের ভেতর। কিচেন থেকে ন্যাকড়া এনে বসে পড়ল টেবিলের পেছনের টুলে। সাবধানে খুলল ইসার পিস্তলের মুভেবল পার্টস্। ন্যাকড়া ব্যবহার করে নিজের আঙুলের ছাপ মুছে আবারও জোড়া দিল পিস্তল। এখন আর ফিঙ্গার প্রিন্ট পাবে না কেউ।

মোড়ানো ম্যাট্রেস থেকে দু’হাত ও মাথা বেরিয়ে আছে দুই অ্যাডিক্টের। নার্ভাস চোখে দেখছে রানাকে। টুল ছেড়ে উঠে বয়সে বড় তরুণের পাশে থামল রানা। ন্যাকড়া দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে পিস্তলের বাঁট। তরুণের হাত নিয়ে পিস্তলের নানাদিকে আঙুলের ছাপ নিল রানা। বাদ পড়ল না ট্রিগার গার্ড ও স্লাইড। কাজটা শেষ করে আবারও ঢুকল কিচেনে। পিস্তল রেখে দিল মেঝের গর্তের ভেতর। পাশেই থাকল অন্যান্য প্রমাণ। আধখোলা অবস্থায় রাখল ফ্লোরবোর্ড।

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দরজা লক করে চুপচাপ নামল নিচতলায়। রাস্তার আলোয় ধুলোভরা ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছে ড্রাইভার। সিগারেট ফুঁকছে সিটে বসে। ফুর্তিতে আছে, আজ রাতে পেয়েছে লোভনীয় কাজ। আনমনে মৃদু হাসল রানা। একটু পর চমকে যাবে লোকটা।

তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে আবারও দুই মাদকাসক্তের ফ্ল্যাটে ফিরল রানা। আগের মতই থমথম করছে চারপাশ। ঘাড় ফিরিয়ে ওকে দেখল নেশাগ্রস্ত দুই তরুণ। ভয়ে ফ্যাকাসে হয়েছে মুখ। কপালে দপদপ করছে নীল কয়েকটা শিরা। মুড়িয়ে রাখা ম্যাট্রেসের বাঁধন খুলে বয়সে বড় তরুণকে শার্ট ধরে টেনে দাঁড় করাল রানা। কাঁধে নিয়ে সিঁড়ির কাছে বাইরের করিডোরের মেঝেতে ধুপ্ করে নামাল। কাঠের মেঝেতে ঠুকে গেছে তরুণের মাথাটা। মুখের ভেতর মোজা নিয়ে কী যেন বলতে চাইছে। আবারও ফ্ল্যাটের দরজা তালা মারল রানা। ফিরে এসে কাঁধে নিল বদমাস তরুণকে। নরম সুরে বলল, ‘যদি ভেবে থাকো বয়ে নিয়ে যাব, তা হলে মস্তবড় ভুল করছ।’

সিঁড়ির প্রথম ধাপে তাকে শুইয়ে দিল রানা। কষে একটা লাথি দিতেই গড়াতে শুরু করে নেমে যেতে লাগল মাদকাসক্ত তরুণ। কংক্রিটের সিঁড়ির ধাপে মেখে আছে শুকনো প্রস্রাব। চাপা আওয়াজে ফুঁপিয়ে উঠে দুপ-দুপ আওয়াজে ছেঁচা খেতে খেতে নামছে খুনি। মাঝে মাঝে তার শরীর ঘুরিয়ে দিচ্ছে রানা। আবার শুরু হচ্ছে পতন। নিচতলায় নেমে যাওয়ার পর তাকে আবারও কাঁধে তুলল রানা। অন্ধকার রাস্তার চারপাশ দেখে নিল। আশপাশে কেউ নেই। এবার হনহন করে হেঁটে পৌঁছে গেল ট্যাক্সির সামনে। এরই ভেতর সিট ছেড়ে নেমে পড়েছে ড্রাইভার। হাত-পা বাঁধা তরুণকে দেখে চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেছে তার। ‘আপনি এসব কী করছেন, স্যর?’ শুকনো গলায় জানতে চাইল সে।

‘খুনের অপরাধীকে গ্রেফতার করছি,’ ট্যাক্সির বুট খুলে বন্দিকে ধাপ্ শব্দে ভেতরে ফেলল রানা। বারবার ব্যথা পেয়ে পাগল হয়ে গেছে মাদকাসক্ত তরুণ। ছটফট করছে মুক্তির আশায়। ‘বুট খোলা থাকুক। এর সঙ্গে আরেকটা আছে। নিয়ে আসছি।’

কয়েক মিনিট পর বুটের ভেতর গাদাগাদি করে পড়ে থাকল দুই মাদকাসক্ত। ধুপ শব্দে ডালা বন্ধ করল রানা। ভেতর থেকে এল সর্দিভরা কান্নার ফি-ফিঁ আওয়াজ। ব্যথা ও ভয়ে কাঁদছে দু’জনের একজন। চট করে হাতঘড়ি দেখে নিল রানা। রাত তিনটের বেশি। ট্যাক্সি ড্রাইভারের দিকে ফিরে বলল, ‘এবার শেষ ঠিকানা। এরা যাবে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের জেলে।’

মুচকি হেসে মাথা দোলাল ড্রাইভার। সিটে বসে বলল, ‘স্যর, আপনি হয় আস্ত পাগল, নইলে সিনেমাগুলোর নায়কদের বাপ!’

‘এখনও কারও বাপ হইনি,’ বলে পেছনের সিটে চেপে বসল রানা। বন্ধ করে দিল দরজা।

গাড়ির পেছনের দিক একটু ডেবে গেছে। আবারও রওনা হয়ে গেল তুবড়ে যাওয়া মার্সিডিয।

.

পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে সরাসরি মেইন ডেস্কে থামল রানা। ডেকে দিতে বলল মডাক মার্ডারের অফিসার-ইন- চার্জ এমাজউল্লাহকে। এটাও জানিয়ে দিল, অন্য কারও সঙ্গে কথা বলবে না। ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর আলাপ করল অফিসাররা। তারপর একজন গেল ও. সি. এমাজউল্লাহকে ডাকতে। কিছুক্ষণ পর দূরের এক দরজা পেরিয়ে হনহন করে এলেন এক লোক। পরনে গাঢ় সবুজ সুট। যে-কেউ ভাবতে পারে, ছোটখাটো, মোটা, টাকমাথা লোকটা কার্টুনের কোনও চরিত্র।

বেশি কথার ভেতর গেল না রানা। অফিসারকে নিয়ে ট্যাক্সির পেছনে গিয়ে বুট খুলে দেখাল কী এনেছে। সংক্ষেপে জানিয়ে দিল এরা কারা, এবং কী করেছে। প্রমাণ সব রয়েছে এদের অ্যাপার্টমেন্টে। চোখ বড় বড় করে ওর কথা শুনলেন ও. সি. এমাজউল্লাহ্।

তাঁর নির্দেশে কয়েকজন অফিসার গাড়ি থেকে নামাল হাত-পা বাঁধা দুই তরুণকে। টেনেহিঁচড়ে থানার ভেতর নিয়ে তাদেরকে ভরে দেয়া হলো সেলে। আবারও বেরিয়ে এসে ট্যাক্সি ড্রাইভারের হাতে এক তোড়া পাউণ্ড ধরিয়ে দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাল রানা। এটাও বলল, আজ রাতে আর তাকে লাগবে না ওর।

রানার পিছু নিয়ে বেরিয়ে এসেছেন ও. সি. এমাজউল্লাহ্। কৌতূহলী চোখে দেখছেন ওকে। হাতের ইশারা করলেন। ভেতরে গিয়ে রিপোর্ট তৈরির কাজে সাহায্য করতে হবে রানাকে। আবারও সাদা নিয়ন বাতির করিডোরে ফিরল ওরা দু’জন। ও. সি.-র পিছু নিয়ে ছোট একটা অফিসে ঢুকল রানা। ওকে একটা চেয়ার দেখালেন এমাজউল্লাহ্। ফোমের কাপে ঢেলে দিলেন গরম কফি। জিনিসটা স্বাদহীন হলেও চুমুক দিয়ে খুশি হলো রানা। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে ওর শরীর। প্রায় দু’দিন হলো ঘুম নেই চোখে।

নিজের নাম জানাতে দ্বিধা করল না রানা। পাসপোর্ট দেখাল। মিশরে এসে এমন কোনও অপরাধ করেনি, বা আইন ভাঙেনি যে ওকে সতর্ক হতে হবে। কয়েকটা ফর্ম পূরণ শেষে সই করল ও। কাগজপত্র ঠেলে দিল ও. সি.-র দিকে।

‘আরও কয়েকটা প্রশ্ন আছে, ‘ মৃদু হাসলেন এমাজউল্লাহ্।

‘জিজ্ঞেস করুন,’ বলল রানা। ভাল করেই জানে, কঠিন হবে না উত্তর দেয়া। ঠিক নিয়ম মেনে গ্রেফতার করেনি ও। তবে ও. সি. খুশি। অন্য কেউ তার কাজ করে দিলে অখুশি হয় না কেউ। রানার ধারণাই সঠিক হলো। সহজ কয়েকটা প্রশ্ন করে ক্ষান্ত দিলেন তিনি। এমন কী জানতেও চাইলেন না ওর ব্যাগে কী আছে। নিজে থেকে কিছু বলল না রানা। ল্যাপটপ আর ব্লেযারটা দেবে কর্নেল ব্রাউনের হাতে। নাইট ক্লাব মালিক আজিজ খন্দকার পুলিশের ফাঁদে ফেঁসে গেলে, পরে কাটা পড়বে বুড়ো ইসার অন্য কোনও আঙুল। তাই তার বিষয়ে টু শব্দ করল না ও।

স্টেটমেন্ট দেয়ার সময় নোট নিলেন ও. সি.। কয়েকবার কলমের মাথা চিবিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তিনি। আবছা সব জবাব দিল রানা। তাতেই খুশি থাকলেন এমাজউল্লাহ্।

মনে মনে হাসল রানা। দুর্নীতি নেই কোন্ দেশে? কাজে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পেলে ছাড়ে কে?

ভোর সাড়ে চারটের সময় কাগজপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে খুশি মনে ওকে ধন্যবাদ দিলেন ও. সি.। রানাকে বললেন, এরই ভেতর ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে প্রমাণগুলো সংগ্রহ করছে তাঁর লোক। এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, তার অর্ধেক অপরাধ করে থাকলে ওই দুই মাদকাসক্তের জেল হবে অন্তত বিশ থেকে ত্রিশ বছর।

চুপ করে থাকল রানা। ওর জানা আছে, কী চলে মিশরের জেলখানায়। নিয়মিত মারধর খেয়ে বছরের পর বছর অর্ধভুক্ত থাকবে দুই অপরাধী। যথেষ্ট শাস্তি পেয়ে যাচ্ছে তারা। অখুশি হওয়ার কথা নয় কর্নেল ব্রাউনের।

‘তা হলে এবার বিদায় নিতে পারি?’ জানতে চাইল রানা।

‘অবশ্যই। কায়রোর পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আপনাকে আরেকবার ধন্যবাদ দিচ্ছি।’

‘এবার একটা ট্যাক্সি ডাকতে হবে।’

‘কোনও দরকার নেই। আমার লোক আপনাকে পৌঁছে দেবে।’

‘ধন্যবাদ।’ হাতঘড়ি দেখল রানা। সময় এখন চারটে পঁয়ত্রিশ। সত্যিই বড্ড ঘুম পেয়েছে ওর।

‘আপনার হাতে দেখছি দুটো ঘড়ি,’ বিস্ময় নিয়ে বললেন ও. সি.।

‘নানা দেশে যেতে হয়। আলাদা সময়ের জন্যে দুটো ঘড়ি।’

‘তা হলে এমন একটা কিনে নেবেন, যেটায় আলাদা টাইম যোন আছে।’

‘আমি পুরনো মানসিকতার লোক,’ স্মিত হাসল রানা।

ষোলো

কায়রোর ধনীদের এলাকায় নিজ বাড়ির বেডরুমে শুয়ে আছে ইউডন ভাদিম। ঘুমাতে পারেনি সারারাত। অস্থির লাগছে মনটা। আরও কিছুক্ষণ পর উঠে পড়ল সে। ভোর পৌনে পাঁচটা।

দরজা খুলে গিয়ে দাঁড়াল ব্যালকনিতে। ভোরের আগে ধীরে ধীরে ধূসর হচ্ছে আকাশ।

বড্ড ক্লান্ত ভাদিম। ভীষণ চাপের মুখে ভোঁতা হয়েছে বোধ-বুদ্ধি। সেই যে মরুভূমিতে জমির শেখের সঙ্গে দেখা হলো, তারপর থেকেই বারবার মনের ভেতর ঘুরেফিরে আসছে দুটো বিষয়। একে একে মনে পড়ছে গত ক’মাসের সব ঘটনা। একেবারেই এলোমেলো হয়ে গেছে তার সাজানো জীবনটা।

প্রথম সমস্যা, মিশরেই কোথাও আছে বিপুল গুপ্তধন, অথচ ওটার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছে না সে। এটা খুব হতাশাজনক। জমির শেখ কথা দিয়েছে, দশ পার্সেন্ট দেবে ওকে। সেটা হয়তো খুব বেশি নয়। তবে প্রচুর সোনাদানা পেলে বাকি জীবন হয়তো আর কবর লুঠ করতে হবে না ওকে।

খুব ভাল হতো ওই গুপ্তধন পুরোটাই নিজের মুঠোর ভিতর পেলে। মরুভূমিতে সেদিন জমির শেখের সঙ্গে কথা বলার আগে পর্যন্ত নিজেকে সফল মানুষ ভাবত সে। কিন্তু পরে মনেপ্রাণে বুঝে গেছে, আসলে সে খুবই দুঃস্থ, গরিব। এই অনুভূতিটাই খাটো করে দিয়েছে তাকে নিজের কাছে।

দ্বিতীয় সমস্যা, ভয়ঙ্কর এক রক্তপিশাচ এই জমির শেখ। বুকে তৈরি করে ভয়ের কাঁপুনি। ভাদিমের মনের একাংশ যখন ভাবে গুপ্তধনের কথা, ওই একইসময়ে অন্তরের আরেক অংশ বলে: না রে, বোকা, তোর উচিত হয়নি ওই অশুভ লোকটার সঙ্গে যোগ দেয়া। ভাদিম এখন চাইছে লোকটার খপ্পর থেকে বেরোতে।

জমিরকে সে এতই ভয় পায়, বিলাসবহুল রাজকীয় খাটে শুয়েও ঘুম হয় না রাতে। ভাল করেই বুঝতে পারছে, ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে নেতা। বেস্টেট দেবীর মূর্তি বিক্রি করে সুইস ব্যাঙ্কে এক মিলিয়ন ডলার রেখেও তৃপ্তি নেই তার। সে তুলনায় মাত্র ক’ পয়সা পেয়েছে ভাদিম? মাত্র এক লাখ ডলার কোনও টাকা হলো? ক্রমেই তার ওপর রেগে উঠছে লোকটা। এক এক করে পেরোচ্ছে সপ্তাহ, কিন্তু নতুন কোনও সূত্র পাচ্ছে না ভাদিম। ঈশ্বর জানেন, কোথায় আছে লক্ষ-কোটি ডলারের সেই ট্রেয়ার।

চেষ্টার তো কমতি করেনি ভাদিম। নিজে কয়েকবার জমির আর তার লোকদের নিয়ে হাজির হয়েছে পশ্চিমের মরুভূমিতে। ধুলোভরা গরম নরক ওটা। সারাদিন এখানে ওখানে সূত্র খুঁজতে গিয়ে ভাদিমের মনে হয়েছে, খাটুনির চোটে মরেই যাবে সে। গেছে বেদুঈন দুর্গে। দড়ি বেয়ে নেমেছে কূপের ভেতর। ভাঙা কুঠরি ছাড়া ওখানে কিছুই নেই। সোনাদানা আছে অন্য কোথাও। ছবিতে হয়তো নেই ভেবে খোদাই করা পাথরের স্ল্যাব শতবার খুঁটিয়ে দেখেছে। আর কোথাও কোনও হায়ারোগ্লিফের চিহ্ন ছিল না। প্রাচীন দুর্গে গিয়ে খামোকা নষ্ট হয়েছে প্রচুর সময়।

কায়রোয় ফেরার সময় অনেক ভেবেছে ভাদিম। আসলে প্রতিটি পথ রুদ্ধ। গুপ্তধনের ব্যাপারে দুনিয়ার কাউকে বিশ্বাস করে না সে। তবুও মরিয়া হয়ে চোরাই অ্যান্টিকুইটির ছায়াভরা গলিতে খবর ছড়িয়ে দিয়েছে— খুব জরুরি একটা জিনিস খুঁজছে। এরপর থেকেই দাঁত দিয়ে ম্যানিকিউর করা নখ কামড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর।

দিনের পর দিন পেরোচ্ছে, অথচ বাজছে না টেলিফোন। নতুন কোনও খবর দিচ্ছে না কেউ।

এদিকে ভাদিমের জীবনে বাজে এক ক্যান্সারের মত জেঁকে বসেছে জমির শেখ। হাইড পার্কে ভাদিমের রাজসিক বাড়িটা তার পছন্দ হয়েছে। কিছু দিন আগে উঠে এসেছে এখানে। ভাব দেখে মনে হয় বাড়ির মালিক সে। প্যালেস ফন্টেইনব্লা থেকে নিলামে কেনা ভাদিমের শখের আর্মচেয়ারে এখন আয়েস করে বসে থাকে লোকটা। পরনে থাকে ভাদিমের প্রিয় স্যাটিনের রোব। হাতে এক গ্লাস লাল ওয়াইন। কাদা ভরা বুট দিয়ে মাড়িয়ে সর্বনাশ করেছে কাশ্মিরী সিল্কের দামি কার্পেটের। চুরুটের ছাইও ফেলে ওটার ওপর। সবই দেখে ভাদিম, বুক ভেঙে যেতে চায়, কিন্তু সাহস নেই যে কিছু বলবে। জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে গেছে তার।

মন এত খারাপ না থাকলে তিক্ত হাসত ভাদিম। অতি বড়লোকের নিরাপদ এলাকায় বিশাল বাড়ি দখল করে যা খুশি করছে বিদ্রোহী দস্যু জমির আর তার দলের সবাই— ভাবা যায়? কায়রোর বুকে অনায়াসেই নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছে। ভাদিমের বাড়ির মেইন গেটে দু’জন গার্ড। তবে বাড়ির মালিকের ভ্যান যখন তখন আসতে দেখে অভ্যস্ত তারা। ড্রাইভার প্রাইভেট পাস দেখালেই ছেড়ে দেয়। তাদের জানার কথা নয়, গাড়ির পেছনে লুকিয়ে আছে একদল সশস্ত্র জঙ্গি।

জমির আর তার দলের সবার অত্যাচারে রাত-দিন দুঃস্বপ্ন দেখছে ভাদিম। আজকাল নিজের বাড়িতেও টিকে থাকা কঠিন। যেদিকেই যায়, কঠোর চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকে খুনি লোকগুলোর কেউ না কেউ। কাউকে বাড়িতে আনতে পারে না। ভাদিমের মনে হচ্ছে, শত শত বছর সুন্দরী কোনও মেয়ের সঙ্গে…

মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

আসলে বন্দি হয়েছে সে নিজ বাড়িতেই। এখন আর যেতে পারে না কোনও পার্টিতে। আগে বন্ধুরা ফোন করত ভাদিম অসুস্থ কি না জানার জন্যে। কিন্তু একের পর এক অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকে এড়িয়ে যেতে যেতে, এখন আর খোঁজও নেয় না কেউ। মনের কষ্ট ভুলতে গিয়ে আজকাল গিলছে প্রচুর মদ। এ ছাড়া উপায়ই বা কী? খুনিগুলোকে দেখলেই ধড়ফড় করে বুক। একদিন এক বোতল ওয়াইনের জন্যে সেলারে গিয়ে আত্মা চমকে গেছে তার। ওখানে একগাদা অস্ত্র আর গুলির বাক্স। আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক করে মরেই যেত ভাদিম। কিন্তু কাউকে কিছু বলার উপায় নেই।

এভাবে পাঁচ মাস মনোকষ্ট ভোগের পর আট সপ্তাহ আগে বেজে উঠল টেলিফোন। দৌড়ে গিয়ে রিসিভার তুলল ভাদিম। লোকটার নাম আবদুল হাসান। প্রত্নতত্ত্বের ব্যাপারে আগেও নানান খবর দিয়েছে। সেসব বিক্রি করে ভাল মুনাফাও করেছে ভাদিম। আবদুল যখন অ্যান্টিকুইটি চুরির সুযোগ পায় না, কাজ করে টুরিস্ট গাইড হিসেবে। তাকে বিশ্বস্ত লোক বলবে না ভাদিম, তবে ওর চেয়ে খাঁটি আর কেউ নেই চোরাই মার্কেটে।

‘আপনি যেটার কথা বলেছেন, মনে আছে?’ বলল আবদুল। ‘এখনও ওটার ব্যাপারে কিছু জানতে চান? আমার কাছে জরুরি খবর আছে।

শক্ত করে কানের সঙ্গে রিসিভার ধরেছে ভাদিম। ‘হ্যাঁ, আমি আগ্রহী।’

ওই মুহূর্তে দরজায় এসে দাঁড়াল জমির শেখ। ভাদিমের দিকে চেয়ে চুপচাপ শুনতে লাগল সব। কাত করে রেখেছে ঘাড়। সরু হয়েছে দুই চোখ।

ফোনের ওই প্রান্তে হাসল আবদুল হাসান। তা হলে আগে ঠিক করে নিই কত দেবেন আমাকে। বুঝতে পারছি অনেক টাকার মাল। নইলে এত ব্যস্ত হতেন না আপনি, ভাদিম।’

অধৈর্য চোখে জমির শেখকে দেখে নিয়ে বলল ভাদিম, ‘যা পাব, তার পাঁচ পার্সেন্ট দেব। বরাবরের মতই।’

এবার তাতে চলবে না। অন্তত দশ পার্সেন্ট চাই। নইলে বলব না কী শুনেছি।’

দাঁতে দাঁত পিষে বলেছে ভাদিম, ‘ছয়।’

‘আট।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে ভাদিম। ‘ঠিক আছে, আট।’

সন্তুষ্ট হয়ে হেসেছে আবদুল হাসান। ‘মনে হয় না ফোনে শুনতে চাইবেন। আপনি বরং চলে আসুন ক্যাফে রিফাতে। আমার মনে হয় শান্তি পাবেন মনে।’

‘ক্যাফে রিফাত,’ বিড়বিড় করল ভাদিম। ‘আধঘণ্টা পর আসছি।’

কিন্তু তর্জনী তুলে মাথা নাড়ল জমির। ‘ওকে এখানে আসতে বলো।’

হাত দিয়ে রিসিভার চেপে ধরে ভাদিম বলল, ‘বাড়িতে ব্যবসার কাজ করি না। এটা একটা আইন আমার।’

‘ওই আইন ভেঙে গেল,’ ভুরু কুঁচকে ভাদিমকে দেখল জমির।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনে বলল ভাদিম, ‘আবদুল, ওখানে যেতে পারব না। সোজা চলে এসো আমার বাড়িতে। তুমি তো চেনোই। আসতে দেরি কোরো না।’

লাইন কেটে অপেক্ষা করতে লাগল ভাদিম ও জমির। একটু পর পায়চারি শুরু করল জঙ্গি-নেতা। চুপচাপ তাকে দেখছে ভাদিম। পরিবেশ আড়ষ্ট। এক এক করে পেরিয়ে গেল তিরিশ মিনিট। তারপর বাড়ির সামনে নুড়িপাথরে গাড়ির চাকার কুড়মুড় আওয়াজ শুনল ভাদিম। গাড়ি বারান্দায় এসে থামল পুরনো একটা হলদেটে মরিস মাইনর গাড়ি।

ভিলার ভেতরে ঢুকে প্রশংসার চোখে চারপাশ দেখল আবদুল হাসান। ‘দারুণ বাড়ি,’ বলতে গিয়েও থমকে গেল।

মার্বেল করা মেঝেতে তিন পা এগোতে না এগোতেই দু’দিক থেকে ধরে তাকে শূন্যে তুলে নিল জমিরের দুই লোক। ঝুলতে ঝুলতে লিভিংরুমে পৌছে গেল হাসান। ভীষণ ভয় পেয়েছে সে। ধুপ্ করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হলো তাকে। প্রায় ঘিরে ফেলল কয়েকজন জঙ্গি।

‘কী যেন বলার আছে তোমার,’ হাসানকে বলল জমির। তাকে পাশ কাটাল ভাদিম। কষ্ট হচ্ছে রাগ দমিয়ে রাখতে। ‘আমি কথা বলছি ওর সঙ্গে।’ আবদুল হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বলল সে, ‘আসলে কী ঘটছে, তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না, বন্ধু। তবে এটা খুব জরুরি যে সব খুলে বলবে তুমি।’

নিষ্ঠুর চেহারাগুলো দেখল হাসান। মুখ দিয়ে কথা সরছে না। থেমে থেমে বলতে লাগল ওর কাহিনী। চারদিন আগে তাকে ভাড়া করে এক ইংরেজ যুবক। নাম বলেছিল ডক্টর মর্ডাক ব্রাউন। কায়রো থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে আবুসিরের পিরামিডগুলো দেখাতে তাকে নিয়ে যায় হাসান।

সাহিরিতে আছে একাধিক সমাধি, ভেবেছে ভাদিম। আখেনাতেনের আমলের এক হাজার বছর আগে ওখানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল ইজিপ্টের দ্বিতীয় রাজবংশের পঞ্চম সারির রাজাদেরকে। ‘কী কারণে গেল?’ জানতে চাইল ভাদিম। ‘কী চায় ওই ব্রাউন?’

‘জানি না,’ বলল হাসান। ‘আমাকে কিছু বলেনি।’

ওই ইংরেজ সম্পর্কে বলো,’ মাঝ থেকে বলল জমির।

ভীত দৃষ্টিতে আবার লোকগুলোকে দেখল হাসান। হড়বড় করে বলতে লাগল সব। ‘শিক্ষিত লোক। পায়ে মোজা আর স্যাণ্ডেল। পরনে ব্লেয়ার। সাধারণ লোক নয়। হাতে সোনার রোলেক্স। পিরামিড এলাকায় ঢুকে একা কোথায় যেন চলে গেল। মানা করেছি, ওদিকে অনেক সাপ। যাওয়ার আগে বলল, সাপকে ভয় পায় না সে। আমি যেন গাড়িতে অপেক্ষা করি। লোকটাকে একা ছেড়ে দিয়ে কেমন যেন খারাপ লাগল। মরেই যায় কি না, কে জানে! যা-ই হোক, গাড়ির ভেতর গরমে সেদ্ধ হতে চাইলাম না। ছায়া আছে এমন একটা জায়গায় গিয়ে বসলাম। ভাবলাম, বিদেশি গাধাটা পথ হারিয়ে ঘুরে মরলে, বা তাকে সাপে কাটলে, সেটা তার সমস্যা।’

জমির শেখের চেহারায় অধৈর্যের ছাপ দেখছে ভাদিম। তাই বলল, ‘এরপর ঠিক কী হলো, সেটা সংক্ষেপে বলো, আবদুল।’

‘ছায়ার ভেতর একঘণ্টা বসে থাকলাম। তারপর দেখলাম আসছে সে। তবে হেঁটে নয়, দৌড়ে। কাপড়চোপড়ে ধুলো আর মাকড়সার ঝুল। হাঁপিয়ে গেছে। লালচে চেহারা। খুব উত্তেজিত মনে হলো। বাচ্চাদের মত আকাশের দিকে ছুঁড়ল দুই হাত। আমার মনে হলো, পাগল হয়ে গেছে ব্যাটা। বিড়বিড় করে কীসব যেন বলছে নিজেকেই।’

‘বিড়বিড় করে কী বলেছে?’ জানতে চাইল ভাদিম।

‘কথাগুলো ঠিক মনে নেই। তবে পরে আমার মনে পড়ে গেল, আপনি আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন পিরামিডের ব্যাপারে। তাই ফোন করেছি।’

‘লোকটা কী বলেছিল, তা মনে করার চেষ্টা করো,’ জরাগ্রস্ত লোকের মত কাঁপা স্বরে বলল ভাদিম।

‘আমার মনে হয়, বলেছিল আমুন এখন খুশি। আর বলেছে কোথাকার এক ধর্মদ্রোহীর কথা।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল ভাদিমের চেহারা। চাপা স্বরে বলল, আমুন এখন সন্তুষ্ট। নিষিদ্ধ করা হলো আমারনার ধর্মদ্রোহী পাষণ্ডকে। সঠিক স্থানে ফিরিয়ে দেয়া হবে সমস্ত ধনদৌলত।’ এটা বলেছে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক। ওই কথাই বলেছিল লোকটা।’

চিন্তায় পড়ে গেল ভাদিম। ওই লোক এসব জানল কী করে? মুখে বলল, ‘আর কিছু বলেছে?’

‘না।’

‘তুমি পুরো শিয়োর তো, আবদুল? এটা খুব জরুরি।’

‘না, এরপর আর একটা কথাও বলেনি। খালি খালি একটু পর পর হাসছিল। আমার মনে হয়েছিল ব্যাটা পাগল হয়ে গেছে। তারপর তাকে ঝড়ের বেগে পৌঁছে দিলাম কায়রোয়। বারবার ঘড়ি দেখছিল। বলে দিল, যেন তাকে নিয়ে যাই ইজিপশিয়ান মিউযিয়ামে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখি পাঁচ মিনিট আগেই মিউযিয়াম বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে খুব মন খারাপ করতে দেখলাম। আমাকে আর বলেনি কী কারণে গেছে ওখানে।’

‘আচ্ছা। তারপর কী করল?’

‘একটা অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে তাকে নামিয়ে দিলাম। লোকটা বলল, পরে দরকার হলে আমাকে আবারও ফোন দেবে। … ব্যস।’

‘তারপর আর ফোন দেয়নি?’

‘না।’

তোমার মনে আছে কোন্ বাড়িতে নামিয়ে দিয়েছিলে?’ গড়গড় করে ঠিকানা বলে গেল আবদুল হাসান।

দু’হাত বুকের ওপর রেখে ভীত গাইডকে দেখছে জমির। চোখে সাপের মত শীতল দৃষ্টি। পিনপতন নীরবতা নেমেছে ঘরে।

ঝড়ের বেগে চলছে ভাদিমের মগজ। হয় এটা মস্তবড় বিপদ, অথবা নতুন খোলা দুয়ার। সন্দেহ নেই, কিছু জানে ব্রাউন। শিক্ষিত লোক। হয়তো ইতিহাসবিদ বা আর্কিওলজিস্ট। কী করে গুপ্তধনের খবর জানল, তা রহস্যময়। কে জানে, হয়তো ওটার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেছে সে। এ কথা ভাবতে গিয়ে শীতল ঘামে ভিজে গেল ভাদিমের দেহ।

‘আমি মডাক ব্রাউনের সঙ্গে কথা বলতে চাই,’ নীরবতা ভাঙল জমির। হাতের ইশারা করল দলের উদ্দেশে। ‘তাবির, নাজিউল, রহমান, তোমরা ওই লোককে ধরে আনো।’

এই বাড়িটা তোমার না!— চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো ভাদিমের। মুখে বলতে পারল না কিছুই। ঘর ছেড়ে চলে গেল জমিরের তিন লোক।

আবদুল হাসানের দিকে ফিরল জমির। ‘একটা ড্রিঙ্ক চলবে?’

নার্ভাস চোখে ভাদিমকে দেখল হাসান।

আন্তরিক হাসল জমির। ‘নাও, অসুবিধে কী?’ ড্রিঙ্ক কেবিনেটের কাছে গিয়ে দরজাটা খুলল সে। ওখান থেকে নিল ভাদিমের সেরা কাট-ক্রিস্টাল ওয়াইন গ্লাসের একটা।

ভাদিম বাধা দেয়ার আগেই ঘটে গেল সব।

জ্বলজ্বলে চোখে অনুচর পেটমোটা জামিলের দিকে তাকাল জমির। আবদুল হাসানের চেয়ারের পেছনে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আখলাক। তারা দু’জন শক্ত করে চেপে ধরল হাসানের দুই কাঁধ। বেচারার উপায় থাকল না যে চেয়ার ছাড়বে। প্রতিবাদ করার জন্যে হাঁ করল সে। আর তখনই গায়ের জোরে তার মুখে গ্লাসটা ভরে দিল জমির।

প্রাণপণে চেঁচাতে চাইল হাসান। তবে হাতের তালু দিয়ে ঠেলে গ্লাসটা তার মুখের ভেতর ঠুসে দিল জমির। ভীষণ ফুলে গেছে হাসানের দুই গাল। এদিক ওদিকে ঘুরছে আতঙ্কিত দুই চোখ। ছটফট করছে সে, তবে চেয়ারের পিঠে চেপে ধরা হয়েছে তাকে।

গ্লাসটা ছেড়ে দিল জমির। হাসানের হাঁ করা মুখ থেকে আধ ইঞ্চি বেরিয়ে আছে ওটা। দু’দিক থেকে দুই হাতে অসহায় লোকটার মুখে চাপ দিল জমির। পরক্ষণে হাত মুঠো করে প্রচণ্ড দুটো ঘুষি দিল গালে। হাসানের মুখের ভেতর চুরচুর হয়ে গেল গ্লাস। ঠোঁটে আটকে আছে গোল গ্লাসের শেষ অংশ।

কাঁচ ভাঙার আওয়াজ পরিষ্কার শুনেছে ভাদিম। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে আছে জমির। বামহাতে টিপে ধরল হাসানের নাক। শ্বাস নেয়ার উপায় থাকল না বেচারার। ডানহাতের তালু দিয়ে তার চিবুক পেছনে ঠেলল জমির। থু-থু করে কাঁচ ফেলতে চাইলেও ঢোক গিলল হাসান। পেটে চলে গেল ভাঙা কাঁচ। প্রাণপণে চেঁচাতে চাইল অসহায় মানুষটা। গলা থেকে বেরোল চাপা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ। টান দিয়ে গ্লাসের শেষ অংশ খুলে নিল জমির। মুখ দিয়ে গলগল করে বেরুনো তাজা রক্তে ভেসে গেল হাসানের চিবুক ও বুক।

ভীষণ যন্ত্রণায় চিৎকার করে চেয়ার থেকে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল হাসান। ডাঙায় তোলা মাছের মত দাপাচ্ছে বেচারা। রক্তাক্ত কাটা ঠোঁট থেকে বেরোল কান্নার চাপা আওয়াজ।

হাসি ম্লান হয়নি জমির শেখের। কয়েক মুহূর্ত আবদুল হাসানের দিকে চেয়ে রইল সে, তারপর প্যান্টের পেছন থেকে পিস্তলটা নিয়ে স্লাইড টানল। মালটা তাক করল হাসানের কপালের দিকে।

রক্তে ভেজা মুখ তুলে জমিরের দিকে তাকাল হাসান। চোখে ভীষণ ভয়। এক সেকেণ্ড পর তার দুই চোখের মাঝে তৈরি হলো আরেকটা চোখ। ঠাস্ করে মেঝেতে পড়ল মাথা। খুলির পেছনের দিক ফুটো করে বেরিয়ে গেছে বুলেট।

গুলির প্রচণ্ড আওয়াজ ও চোখের সামনে মানুষ খুন হতে দেখে ভীষণ আতঙ্কে অবশ হলো ভাদিম। অবাক চোখে চেয়ে রইল লাশের দিকে। কাশ্মিরী কার্পেট ভিজে যাচ্ছে রক্তে। আচমকা স্বর ফিরে পেয়ে জানতে চাইল ভাদিম, ‘খুন করলে কেন?’

‘অনেক বেশি জানত,’ বলল জমির। ‘সরিয়ে দিলাম। এবার জেনে নেব মডাক কী জানে।’

একঘণ্টা পর আরও দুঃসংবাদ পেল ভাদিম। জমিরের লোক ব্রাউনের অ্যাপার্টমেন্টের কাছে গিয়ে দেখে গিজগিজ করছে পুলিশ। নিচতলায় একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে রাখা হয়েছে রক্তাক্ত লাশ। ওই লাশটা মডাক ব্রাউনের।

ওদের আগেই ওখানে পৌঁছে গিয়েছিল কেউ।

কিন্তু কে সে?

পুলিশ ধারণা করছে, ডাকাতি করতে এসে লোকটাকে খুন করেছে কেউ। কিন্তু এ কথা মানতে রাজি নয় ভাদিম। পরবর্তী ছয় ঘণ্টা ফোনে ব্যস্ত থাকল সে। জোগাড় করল ব্রাউন হত্যার বিষয়ে সব তথ্য। তবে কেউ সঠিক ভাবে জানাতে পারল না, কী কারণে খুন হয়েছে লোকটা। পুলিশ কন্ট্যাক্টও জানে না নতুন কিছু। অনেক টাকা নিলেও কায়রো মিউনিসিপ্যাল পুলিশের সাজেন্ট কবির বরাবর সঠিক তথ্য দিয়েছে। সে-ও কিছু শোনেনি।

আরও গভীর হতাশায় তলিয়ে গেল ভাদিম।

সত্যি যদি ব্রাউনের কাছ থেকে সব খবর জেনে নিয়ে থাকে কেউ?

সে বা তারা যদি আগেই পৌঁছে যায় গুপ্তধনের কাছে?

সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে নিজেও বাঁচবে না ভাদিম। খতম করে দেবে ওকে জমির। যেরকম গরম চোখে আজকাল তাকায় লোকটা!

আজকাল ভীষণ ভয় লাগছে ভাদিমের। বুঝে গেছে, যে- কোনও দিন খুন হবে সে।

.

এসব দু’মাস আগের ঘটনা। তারপর থেকেই যোম্বির মত হয়ে গেছে ভাদিম। সময় যেন থেমে গেছে তার জন্যে। আজকাল টিভির সামনে নিজেকে টেনে নিলেই ভয় লাগে। সংবাদ-পাঠক হয়তো বলছে: এইমাত্র জানা গেছে, আবিষ্কার করা হয়েছে মরুভূমির মধ্যে বড় একটি আর্কিওলজিকাল সাইট। এরই ভেতর আবারও আবুসিরের পিরামিডগুলো ঘুরে এসেছে ভাদিম। জায়গাটা কায়রো থেকে দক্ষিণে। বালি পাথরের সাগর বলা চলে। ওখানে কিছু পেয়েছিল মর্ডাক ব্রাউন। কিন্তু ওখানে তো পাথর আর বালি ছাড়া কিছুই নেই! ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ভেতর ঘুরে বেড়িয়েছে সে। কোনও লাভ হয়নি। জানা যায়নি আসলে কী খুঁজতে হবে।

যখন তখন হাজির হয় জমির আর তার দলের খুনিরা। কখনও থাকে কয়েক দিন। তারপর হয়তো এলই না এক সপ্তাহ। পারতপক্ষে জমিরের সামনে পড়ে না ভাদিম। মন থেকে মুছে ফেলতে চায়, যে-কোনও দিন মরবে খুনিটার হাতে। যতবার দেখে গেট দিয়ে জমিরের ভ্যান ঢুকছে, ভয়ে শিরশির করে মেরুদণ্ড। মনটা বলে, যে-কোনও দিন হাল ছেড়ে দেবে লোকটা। আর তখন চলে যাওয়ার আগে একটা বুলেট গেঁথে দেবে ওর মাথার ভেতর। ভাদিম বুঝে গেছে, ধার করা সময়ে বেঁচে আছে সে। আর এই বেঁচে থাকাটাও যেন মৃত্যুর মতই কষ্টের।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নানান কথা ভাবছে ভাদিম। পুবদিগন্তে উঠল লাল সূর্য। মস্তবড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

বেডসাইড টেবিলে বেজে উঠেছে টেলিফোন। বারান্দা থেকে ধীর পায়ে শোবার ঘরে ঢুকল ক্লান্ত ভাদিম। আস্তে করে ফোনের রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল। ভাবছে, এত ভোরে কে ফোন করল?

ফোন করেছে সার্জেণ্ট কবির।

‘আপনার জানা আছে এখন কয়টা বাজে?’ বিরক্ত সুরে বলল ভাদিম।

‘অপেক্ষা করতে পারলাম না। তথ্যটা হয়তো আপনার কাজে লাগবে।’

চাপা স্বরে বলল ভাদিম, ‘বলুন?’

‘আপনার মনে আছে মর্ডাকের সেই মার্ডার কেসটা?’ ভাদিমের মনে জ্বলে উঠল ছোট্ট একটা আশার প্রদীপ। নিচু গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। বলুন।’ চুপচাপ সাজেন্ট কবিরের কথা শুনতে গিয়ে একটু পর বিস্ফারিত হলো তার দুই চোখ। ‘বলেন কী, দুই অপরাধীকে ধরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দিয়েছে?’

‘হাত-পা বেঁধে,’ বলল সার্জেন্ট কবির। ‘খুনের প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদের ঘরে। দশ মিনিটের ভেতর সব স্বীকার করেছে। নেশাখোর। তবে অবাক ব্যাপারটা জানেন? ওরা ভীষণ ভয় পেয়েছে ওই লোককে। ওদেরকে নাকি মর্ডাকের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে বিদেশি ওই লোক। তারপর পিটিয়ে মুতিয়ে দিয়ে কেড়ে নিয়েছে লুঠ করা সবকিছু।’

‘কে ওই লোক?’

‘পেশাদার কেউ,’ বলল কবির। ‘এমন ভয় দেখিয়েছে যে এখনও কাঁপন থামছে না।’

হঠাৎ করেই উত্তেজনা বোধ করল ভাদিম। নরম সুরে জানতে চাইল, ‘নাম বলতে পারবেন ওই লোকের?’

‘তার চেয়েও ভাল কিছু করতে পারব,’ বলল সার্জেন্ট। ‘পাঁচ মিনিট আগে পুলিশের গাড়িতে চেপে রওনা হয়েছে সে। শুনলাম, উঠেছে মর্ডাক ব্রাউনের সেই একই ফ্ল্যাটে।’

সতেরো

পুলিশের গাড়ির পেছন সিটে বসে ঝিমুতে শুরু করেছে রানা। একটু পর পৌঁছল পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে। ড্রাইভারকে লিফটের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে পড়ল ও। রাস্তার দূরে চলে গেল গাড়ির লাল বাতি। তারপর বাঁক নিয়ে উধাও হলো। একটু পর ভোর হবে। ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত রানা। ধীর পায়ে উঠে এল ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে। দরজা বন্ধ করে বাতি জ্বেলে বসে পড়ল আর্মচেয়ারে। হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেছে সব উৎসাহ।

ধরা পড়েছে মর্ডাকের খুনি ও তার সহযোগী। হয়তো বাকি জীবন পচবে জেলে।

ছেলে খুনের প্রতিশোধ নিতে পেরেছেন কর্নেল ব্রাউন।

এবার কী?

এবার কি ফিরে যাবে ও বাংলাদেশে?

না, অফিস থেকে তো ডাক পড়েনি ওর।

ছুটির পর আবারও যোগ দেবে নরম্যাণ্ডিতে রানা এজেন্সিতে। তারপর হয়তো ওকে যেতে হবে অন্য কোনও দেশের জনবহুল কোনও শহরে। নতুন করে খুলবে রানা এজেন্সির শাখা।

ভারী হয়ে আসছে রানার চোখের পাতা। এবার ঘুমাতে হবে। তবে ওর ইচ্ছে হলো না মর্ডাকের লাশ পড়ে থাকা সেই একই ম্যাট্রেসে ঘুমাতে। লিভিংরুমে সোফা আছে। খুব আরামদায়ক না হলেও চলবে ওর। ওটার চেয়ে অনেক খারাপ জায়গায় বহুবার শুয়েছে।

বাতি নিভিয়ে কোণের ল্যাম্পটা জ্বেলে নিল রানা। নরম আলোয় ভালই লাগল লিভিংরুমে। সোফায় শুয়ে পড়ল। ক্রমেই শিথিল হলো সারাদেহের পেশি। পেরিয়ে গেল পনেরো মিনিট। ঘুম এল না। বুঝে ফেলল, শুয়ে থেকে কোনও লাভ হবে না। খচ খচ করছে মনের ভেতর: জানা দরকার মর্ডাকের কমপিউটারে কী আছে।

উঠে ব্যাগটা এনে সোফার ওপর রাখল। বের করল ল্যাপটপ। এখনও ওটা ব্লেয়ার দিয়ে মোড়ানো। ব্লেযার সরাতেই ওটার পকেট থেকে ঘুরতে ঘুরতে কার্পেটে পড়ল কাগজের একটা টুকরো। সোফার ওপর কমপিউটার নামিয়ে রেখে কাগজটা তুলে নিল রানা। ভাঁজ খুলতেই দেখল, ওটা কায়রোর এক গ্রোসারি স্টোরের রিসিট। ক্যানে ভরা কিছু খাবার আর কয়েক বোতল বিয়ার কিনেছিল মডাক। রসিদের ওপর লেখা কারও ফোন নাম্বার।

তিনবার ওটার ওপর চোখ বোলাল রানা। হঠাৎ বুঝল, – ওই ল্যাণ্ড টেলিফোনের নাম্বারটা ইউকের। এরিয়া কোড ০১৩৩৪। জায়গাটা কোথায় জানে না ও। এরপর নিচে লেখা মূল নাম্বার। তিন ডিজিটের ৪৩৫ এক্সটেনশন নাম্বারটা বোধহয় কোনও অফিসের।

নাম্বারটা জরুরি হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। কাগজটা ভাঁজ করে ব্লেয়ারের পকেটে রাখল রানা। মনে মনে বলল, ওই নাম্বারের কথা জানাতে হবে কর্নেলকে। ব্যাগের ভেতর মুড়িয়ে রেখে দিল ব্লেযার। পাশেই ঠাঁই পেল সোনার রোলেক্স। মেঝেতে ব্যাগ নামিয়ে শুয়ে পড়ল সোফায়। মাথার নিচে দুটো কুশন। ল্যাপটপ কমপিউটার পেটের ওপর। ডালা খুলে পাওয়ার বাটন টিপল। অপেক্ষা করছে প্রোগ্রাম লোড হওয়ার জন্যে। কয়েক মুহূর্ত পর স্ক্রিনে ফুটল বালির ভেতর আর্কিওলজিকাল খননের ছবি। মাই ডকুমেণ্ট আইকনে ক্লিক দিল রানা। তাতে বেরোল সংক্ষিপ্ত লিস্ট। স্ক্রল করে নিচের দিকে নামল ও। একেবারে নিচে একটা ফাইল নেমের ওপর থামল ওর চোখ।

দ্য আখেনাতেন প্রজেক্ট

আবছা ভাবে রানার মনে পড়ল, রাজা আখেনাতেনকে অনেকে বলেন ধর্মদ্রোহী ফেরাউন। খুব অস্থির ছিল তাঁর আমলটা। এর অন্তত এক হাজার বছর পর জন্ম নেন যিশু। মিশরের অর্থনীতি ও নৈতিক অবক্ষয়ের সময় শাসন করতেন আখেনাতেন।

কিন্তু কী নিয়ে রিসার্চ করছিল মর্ডাক?

ওই অখ্যাত ফেরাউনকে বেছে নিল কেন?

ডকুমেন্টের ওপর ক্লিক দিল রানা।

দেখা যাক…

হঠাৎ করেই কালো হলো স্ক্রিন। লাফিয়ে উঠে এল একটা বক্স। ইউযার নেম ও পাসওঅর্ড চাইছে। ওপরে ছোট করে লেখা: ‘অটোমেটিক অ্যাকসেস ডিযএবল। দিস ফাইল ইয স্টোর্ড ইন এ পাসওঅর্ড-প্রোটেকটেড ভল্ট।’

আবারও বক্সে ক্লিক দিল রানা।

ফুটে উঠল: অ্যাকসেস ডিনাইড।

আরেকবার চেষ্টার পর রানা বুঝে গেল, ঢুকতে পারবে না ফাইলে। তাতে কোনও সমস্যা নেই ওর। মর্ডার্ক তার বাবার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করে থাকলে কর্নেল ব্রাউন হয়তো জানেন পাসওঅর্ড। অথবা আঁচ করে নিতে পারবেন। এসব নিয়ে ভাবা আমার কাজ নয়, মস্ত এক হাই তুলে ভাবল রানা। ঠিক করে ফেলেছে, এবার সাঁটিয়ে ঘুম দেবে।

কিন্তু তখনই আবারও মনে পড়ল কর্নেল ব্রাউনের কথা। সুপার ইয়টে বিলাসিতার ভেতর থেকেও হয়তো ঘুমাতে পারছেন না একফোঁটা। মনে মনে আশা করছেন, যে- কোনও সময়ে সুসংবাদ দেবে রানা। পুত্র শোকে পাথর হয়ে গেছেন। প্রতিশোধ নিতে না পারলে হয়তো ভীষণ কষ্ট পাবেন।

রানার মনে পড়ল ফ্ল্যাটের মালিকের একটা কথা। অ্যাপার্টমেন্টে রয়েছে ইন্টারনেট অ্যাকসেস।

আবারও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। হাতের কাজ সেরে নেয়াই ভাল। ল্যাপটপটা নিয়ে ডেস্কের ওপর রাখল ও। ফোনের সকেট থেকে ঝুলছে প্যাঁচ খাওয়া ওয়াএয়ার। ওটার শেষমাথায় প্লাস্টিকের মিনি-কারেক্টর। জিনিসটা ঠিক ভাবে বসে গেল কমপিউটারের পাশের সকেটে। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে রানা পেল ইন্টারনেটের লাইন। নিজের ওয়েবমেইল অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করে ঝড়ের বেগে ছোট একটা মেসেজ লিখল:

আমার কাজ শেষ, কর্নেল ব্রাউন। আগামীকাল ফিরছি। পরে কথা হবে। মর্ডাকের রিসার্চ ফাইল অ্যাটাচ করে দিলাম। ডকুমেন্ট এনক্রিপটেড। আপনি হয়তো খুলতে পারবেন। …রানা।

ওর মেসেজের সঙ্গে দ্য আখেনাতেন প্রজেক্ট ফাইল অ্যাটাচ করল ও। মনে মনে আশা করছে, এতেই কাজ হবে। তা-ই হলো। সেও-এর ওপর ক্লিক দিতেই গ্রাহকের উদ্দেশে রওনা হলো মেসেজ।

আর কিছু করার নেই। সাধ্যমত করেছে রানা।

আবারও হাই তুলে শুয়ে পড়ল সোফায়। অফ করে দিল সাইড লাইট। মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমাতে পারবে। তারপর যেতে হবে এয়ারপোর্টে। একবার স্যান রেমোয় গিয়ে কর্নেলের হাতে দেবে তাঁর ছেলের জিনিসপত্র, তারপর ফিরবে নরম্যাণ্ডিতে, রানা এজেন্সিতে। প্রাণভরে বিশ্রাম নেবে। মাছ ধরবে লেকে, ক্যাম্প করবে পাহাড়ে, ইচ্ছে হলে সারাদিন শুয়ে থাকবে জঙ্গলে। যা খুশি!

তবে আগে কর্নেলের সঙ্গে দেখা করতে হবে। সেসময়ে লিণ্ডার সঙ্গে দেখা না হলেই ভাল। কর্নেল আর ওই মেয়েটার দাম্পত্য জীবনে নাক গলাতে চায় না ও। কর্নেলকে অনুরোধ করবে স্যান রেমোর কোনও বার-এ আসতে। সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ হতেই ওর চোখে নামল ঘুমের গভীর চুমু।

জানালার ওদিকের দিগন্তে মুখ তুলেছে লাল সূর্য। নতুন করে জীবন ফিরে পাচ্ছে কায়রো। শুরু হয়েছে গাড়িঘোড়ার আনাগোনা। বেশিক্ষণ নেই মরুভূমির ওপর আগুন ঢালবে আকাশের সাদা জ্বলন্ত গোলা।

অকাতরে ঘুমাচ্ছে রানা। দুঃস্বপ্নে হাজির হলো তুমুল গুলি ও বিকট আর্তচিৎকার। কালো এক লোক, মুখ দেখা গেল না তার। চোখদুটোয় তীব্র ঘৃণা। হাতে পিস্তল। ওদিকে হাত তুলে রানাকে ডাকছে লিণ্ডা ব্রাউন, মুখে মিষ্টি হাসি। কী যেন বলতে চাইল রানা, কিন্তু তখনই ভেঙে গেল ঘুম।

ফ্ল্যাটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে কারা যেন!

ঝট্ করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা।

লিভিংরুমে ঢুকেছে চারজন লোক, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র!

আঠারো

হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভেঙে কোথায় আছে, ক’মুহূর্ত বুঝল না রানা। তবে বুঝল, এবার বোধহয় বন্দি হতে হবে এই ফ্ল্যাটে। ওর সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই যে লড়বে। কালাশনিকভের সংক্ষিপ্ত সংস্করণ একেএস-৭৪ইউ অ্যাসল্ট অস্ত্র হাতে ওকে ঘিরে ফেলল চারজন লোক। রাশান মিলিটারি সদস্যরা ওই সাবমেশিন গানের ডাকনাম দিয়েছে: ওকুরোক বা সিগারেটের শেষাংশ। সন্ত্রাসীদের প্রিয়। যদিও দীর্ঘ রেঞ্জে লক্ষ্যভেদ প্রায় অসম্ভব। ম্যাগাযিনে শক্তিশালী গুলি। অস্ত্রগুলো দেখেই রানা বুঝে গেছে, ঠাট্টা বা মজা করতে আসেনি এরা। প্রতিটা নড়াচড়া সৈনিকের মত পেশাদারী। আগেও দিয়েছে এ ধরনের রেইড।

কালো দীর্ঘ রেইনকোট পরা একজন নির্দেশ দিল, ‘বাড়ি ভাল করে সার্চ করো।’

এ-ই দলনেতা, জানা হয়ে গেল রানার। অন্য তিনজন অনুগত স্যাঙাৎ। লোকটার চোখে আত্মবিশ্বাস ও প্রচণ্ড রাগের ছাপ’। সামান্য বেচাল দেখলেই অন্যদের আগে কাজে নামবে সে। ৫.৪৫ এমএম হাই-ভেলোসিটি বুলেট ঝাঁঝরা করবে রানাকে। আরও টের পেল, ঘরে সবচেয়ে বিপজ্জনক ওই লোকই।

তবে এরা জানে না, ঘরে তাদের চেয়েও বিপজ্জনক আরেকজন রয়ে গেছে।

সার্চ করা হলো রানাকে। মানিব্যাগ, পাসপোর্ট দেখা শেষে ফেলে দেয়া হলো কার্পেটের ওপর। সর্বক্ষণ রানার ওপর অস্ত্র তাক করে রেখেছে দলনেতা ও দাড়িওয়ালা বিশালদেহী এক লোক। ওদিকে এক ন্যাড়ামাথা আর বয়স্ক আরেকজন তছনছ করছে ফ্ল্যাট। এ কাজে অভ্যস্ত তারা। তবে রানার ব্যাগ ও মর্ডাকের ল্যাপটপ ছাড়া এমন কিছু নেই, যেটার তেমন মূল্য আছে। বয়স্ক জঙ্গি ডেস্কের ওপরে তুলল ব্যাগ ও ল্যাপটপ।

‘হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসো,’ রানাকে নির্দেশ দিল দলনেতা।

‘আমার বসতে ইচ্ছে করছে না,’ গোঁ ধরল রানা। হাতের ইশারা করল দলনেতা। ‘রহমান।’

রানার দিকে এগোল দাড়িওয়ালা বিশালদেহী লোকটা। লম্বায় সে রানার চেয়ে অন্তত পাঁচ ইঞ্চি উঁচু। ওজন কমপক্ষে আড়াই শ’ পাউণ্ড। হাতের ঘুষিটাও খেপা ষাঁড়কে শুইয়ে দেয়ার মত। হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে পড়ল রানা। ওই হামলার জন্যে তৈরি ছিল। তবুও ফুসফুস থেকে বেরিয়ে গেছে সব বাতাস। টলমল করে হাঁটুর ওপর ভর করে উঠে বসল।

‘গুড,’ বলল দলনেতা, ‘এবার বলো কোথায় রেখেছ মর্ডাক ব্রাউনের জিনিসপত্র।’

‘আপনার কথা বুঝতে পারছি না,’ অবাক হওয়ার সুরে বলল রানা।

নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ করল দলনেতা। চোখ গেল ব্যাগের ওপর। কাঁধে একেএস ঝুলিয়ে ঘরের আরেক দিকে গেল সে। টেবিলে রাখা ব্যাগের চেইন খুলে সব ঝেড়ে ফেলল মেঝেতে। ছোট একটা স্তূপ তৈরি করেছে টাকার বাণ্ডিল। ওগুলোর ভেতর থেকে মর্ডাকের কোঁচকানো ব্লেযার নিল লোকটা। চোখে শীতল দৃষ্টি। খুলে দেখল ব্লেযার।

মেঝে থেকে নিল সোনার রোলেক্স। উল্টেপাল্টে দেখে পড়তে লাগল পেছনের ডালার খোদাই করা লেখা। চোখ তুলে বলল, ‘কীসের জন্যে এসব হচ্ছে, তুমি জানো না। অথচ তোমার কাছে মর্ডাকের ঘড়ি। তাই জানতে চাইছি, মর্ডাকের আরও কিছু তোমার কাছে আছে কি না।’

ডেস্কের ওপর ঘড়ি রেখে কর্নেলের সরু ফোল্ডার নিল সে। মলাট খুলে দ্রুত চোখ বোলাল পুলিশ ও করোনারের রিপোর্টের ওপর। কয়েক মুহূর্ত দেখল রক্তাক্ত লাশের ছবি। তারপর ফোল্ডার রেখে খুলল ল্যাপটপের ডালা। কয়েক মুহূর্ত পর চালু হলো মেশিনটা। স্ক্রিনে ফুটল আর্কিওলজিকাল খননের স্ক্রিনসেভার।

ওটা দেখেই ঠোঁট মুচড়ে জটিল হাসি দিল দলনেতা। আঙুল নামিয়ে ক্লিক দিল মাউস প্যাডে। আরও চওড়া হলো হাসিটা। উচ্চারণ করল: ‘দ্য আখেনাতেন প্রজেক্ট। দারুণ তো! দেখা যাক ভেতরে কী।’

ডাবল ক্লিক দিয়ে অপেক্ষা করল সে। তাতে কাজ না, হওয়ায় আবারও ক্লিক দিল। মলিন হয়ে গেল হাসি। ঘুরে কঠোর চোখে দেখল রানাকে। ‘ফাইল দেখছি এনক্রিপ করা।’

‘আমিও তা-ই পেয়েছি,’ বলল রানা। ‘চেষ্টা করে লাভ হবে না।’

শীতল রাগে চেহারা বিকৃত হলো দলনেতার। ‘পাসওঅর্ড দাও।’

‘পাসওঅর্ড জানা নেই,’ বলল রানা, ‘কমপিউটারটা আমার না।’

বিশালদেহী রহমানের দিকে ইশারা দিল দলনেতা। সঙ্গে সঙ্গে পাঁজরে জোরালো লাথি খেয়ে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল রানা। ব্যথায় ছোট ছোট সাদা আর হলুদ নক্ষত্র দেখছে চোখে। হার মেনেছে তা বুঝতে দেবে না, ধীরেসুস্থে আবারও উঠে বসল। চোখ পিটপিট করছে ব্যথা সামলাতে গিয়ে।

রানার সামনে এসে থামল দলনেতা। কাঁধ থেকে একেএস সাবমেশিন গান নিয়ে মাযল ঠেকাল পরাজিত মানুষটার মাথার চাঁদিতে। আরেকবার বলল, ‘পাসওঅর্ড।’

কাশতে শুরু করেছে রানা। আশা করছে কমবে পাঁজরের ব্যথা। ওর মনে হলো না হাড় ভেঙেছে। চাপা স্বরে বলল, ‘আগেই বলেছি, পাসওঅর্ড জানা নেই। জানিও না ফাইলে কী আছে।’

‘তোমার বন্ধু কিছুই বলেনি?’

‘মর্ডাক ব্রাউন আমার বন্ধু ছিল না।’

‘তাই? তো তার জিনিসপত্র তোমার কাছে কেন? একই অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছ। ওই লোকের খুনিদের খুঁজে বের করে ধরিয়ে দিয়েছ পুলিশে। তারপরও বলতে চাও সে তোমার বন্ধু নয়?’

দ্রুত ভাবছে রানা। দগদপ করছে মাথার তালু। ওখানে অস্ত্রের শীতল নল। ভাবছে, এরা কারা? কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘আমাকে পাঠানো হয়েছিল তদন্ত করতে। আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ।’

‘কে পাঠিয়েছে?’

সন্ত্রাসী দলনেতাকে বুদ্ধিমান বলেই মনে হয়েছে রানার। জেনি ব্রাউনের কথা বললেই কর্নেল জন ব্রাউনকে খুঁজে নেবে এরা। কাজেই মিথ্যা বলল ও, ‘ডেবি ব্রাউন। ইংল্যাণ্ডে থাকেন মর্ডাকের মা।’

‘সে এত টাকা দিয়েছে?’

‘বলেছেন, যেন তাঁর ছেলের খুনিদেরকে ধরে পুলিশে দিই। আর ফেরত নিতে হবে ছেলের সব জিনিসপত্র। মহিলা জানেনও না এখানে কী করছিল মডাক। বা কী আছে কমপিউটারের ভেতর। আমারও কোনও আগ্রহ নেই জানার। ছেলের স্মৃতি ভরা জিনিসপত্র ফিরে পেলেই উনি খুশি।’

সাবমেশিন গানের নল সরাল দলনেতা। ‘স্মৃতি ভরা জিনিসপত্র?’ চিন্তিত সুরে প্রতিধ্বনি তুলল সে। চুপ করে বসে আছে রানা। সাপের মত শীতল চোখে ওকে দেখল দলনেতা। ‘আমার নাম জমির শেখ। আমার কাছে স্মৃতি ভরা জিনিসপত্রের কোনও মূল্য নেই।’

চুপ করে তার চোখে চেয়ে রইল রানা।

আবারও ডেস্কের সামনে গিয়ে থামল দলনেতা। অস্ত্র ডেস্কে রেখে ব্যাগের ভেতর ভরল ল্যাপটপ। বাদ পড়ল না ডকুমেন্ট, টাকা ও ব্লেয়ার। কাঁধে ঝুলিয়ে নিল ব্যাগ। কয়েক মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল, তারপর হাতে নিল সোনার রোলেক্স ঘড়ি। কবজিতে পরে আটকাল ক্ল্যাম্প। বিড়বিড় করল, ‘সুন্দর ঘড়ি। দেখল নিজের কবজি। একেএস সাবমেশিন গানটা নিয়ে ভরল রেইনকোটের ভেতর। দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘খুন করো এই হারামজাদাটাকে। বাইরে ভ্যানে অপেক্ষা করছি।’

উনিশ

অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে বেরোবার আগে আরেকবার বিদেশি লোকটার দিকে তাকাল জমির শেখ। হাঁটু গেড়ে বসে আছে লোকটা। চোখে কাতর দৃষ্টি। বুঝে গেছে, এবার মরবে সে। ওই লোকের মত শত শত মানুষকে করুণভাবে মরতে দেখেছে জমির। মানবজীবন শেষ করে দেয়া তার কাছে কিছুই নয়। তেলাপোকা যেভাবে বুটের নিচে চেপ্টা হয়ে মরে, ঠিক সেভাবেই পৃথিবী থেকে বিদায় হয় এসব অপ্রয়োজনীয় জীবন। এরা আসলে জন্মায় কবরের পোকার পেট ভরাতে। আনমনে একবার মাথা দুলিয়ে করিডোরে পা রাখল জমির। শুনতে পেল বিদেশি লোকটার কাকুতি: ‘ভাই! মাফ করে দেন! আমার তিন বউ আর নয়টা ছেলেমেয়ে! সব ক’জন না খেয়ে মরে যাবে! আমাকে মাফ করে দেন, স্যর!’

হাসতে হাসতে দরজা বন্ধ করল জমির। দেখে নিল ডানে-বামে। আশপাশে কেউ নেই। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচতলায়। রাস্তার ওদিকে পার্ক করা হয়েছে ভাদিমের সাদা ভ্যান। এরই ভেতর তপ্ত হতে শুরু করেছে ভোরের কচি লালচে আলো। রাস্তা পেরিয়ে ভ্যানের ক্যাবে উঠল জমির। রেইনকোটের তলা থেকে অস্ত্রটা সরিয়ে রাখল ফুটওয়েলে। হেলান দিয়ে বসল সিটে।

ধুলোভরা উইণ্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে দেখল, নানা কাজে বেরিয়ে পড়েছে পথযাত্রীরা।

নতুন পাওয়া সোনালি চকচকে ঘড়ি দেখল জমির। কাজ শেষ করতে বেশিক্ষণ নেবে না ওর দলের সদস্যরা। তবুও অধৈর্য লাগছে তার। ফেরা উচিত ভাদিমের বাড়িতে। খুলতে হবে ল্যাপটপের ফাইল। আত্মবিশ্বাস আছে, ক্র্যাক করতে পারবে পাসওঅর্ড।

কতই বা কঠিন হবে ওটা?

ফ্রেঞ্চ শালা নিশ্চয়ই একটা না একটা পথ খুঁজে বের করবে। পুরনো আমলের ইতিহাস নিয়ে বেশ ক’বার কথা বলেছে গাধাটা। হাজারো কোটি ডলারের কথা ওসবের ভেতর না থাকলে, এক সেকেণ্ডও শুনত না জমির। ওসব পাওয়ার জন্যেই তো এত কষ্ট!

অধৈর্য লাগলেও নিজেকে সান্ত্বনা দিল জমির। বেশিক্ষণ লাগবে না ভাদিমের বাড়িতে পৌঁছুতে। তার লোক বোধহয় এতক্ষণে খতম করেছে বিদেশি শুয়োরটাকে। রহমান পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হলেই খেলা শেষ। লোকটাকে কঠিন হাতে ধরবে জামিল, আর জবাই করবে নাজিউল। এরপর অ্যাপার্টমেন্টের দরজা বন্ধ করে নেমে আসবে ওরা। একবার হয়তো করিডোরে থামবে সিগারেট ফুঁকে নেয়ার জন্যে। এই ফাঁকে আরেকবার ফাইলটা ঘেঁটে দেখা যেতে পারে।

ব্যাগটা কোলের কাছে তুলল জমির। চেইন খুলে ভেতর থেকে নিল ল্যাপটপ। বাটন টিপতেই চালু হলো ওটা প্রথমে ক্লিক দিল মাই ডকুমেন্টের ওপর। আবারও বের করল দ্য আখেনাতেন প্রজেক্ট ফাইল।

ক্লিক দেয়ায় পাওয়া গেল একই ফলাফল।

সমস্যা নেই, ভাবল জমির। মনে পড়েছে ভাদিমের বলা ইতিহাসের একটা কথা। পাসওঅর্ড বক্সে ক্লিক করে লিখল: আমুন।

জমিরের মনে নেই কে ওই আমুন। হবে বোধহয় কোনও দেবতা-টেবতা। প্রাচীন আমলে তো ওরকম গাদা- গাদা শালা-শালী ছিল। তাতে জমিরের সমস্যা নেই। এখন জরুরি এই ফাইল আনলক করা। ভেতরের লেখা বা ছবি হয়তো ওকে পৌঁছে দেবে গুপ্তধনের কাছে।

ধুর! আমুন দিয়ে কাজ হবে না। অ্যাকসেস ডিনাইড। তাতে কী, দরকার হলে সব শালার দেবতার নাম লিখবে জমির।

এবার লিখল: আমুন এখন সন্তুষ্ট।

না, কাজ হলো না।

মর্, শালারা!

এবার টাইপ করল: ধর্মদ্রোহী।

মহাঝামেলা তো! শালার কমপিউটার বলছে অ্যাকসেস ডিনাইড!

বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দিয়ে ল্যাপটপ শাটডাউন করে ডালা বন্ধ করল জমির। আবারও ঘড়ি দেখল। গনগনে রাগ নিয়ে তাকাল ওপরের ফ্ল্যাটের জানালার দিকে। করছেটা কী শুয়োরগুলো?

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল জমিরের। ফুটওয়েল থেকে সাবমেশিন গান নিয়ে গুঁজল রেইনকোটের নিচে। কাঁধে ঝোলাল ল্যাপটপ ও টাকাভরা ব্যাগ। গাড়ি থেকে নেমে ঝড়ের বেগে গিয়ে ঢুকল বাড়ির ভেতর। উরুর পাশে বাড়ি খাচ্ছে ব্যাগ। নেমে আসছেন বয়স্ক এক লোক, শক্ত করে বামহাতে ধরেছেন ছোট্ট এক ছেলের হাত। বোধহয় ওই ছেলে তাঁর নাতি। কৌতূহলী চোখে জমিরের দিকে তাকাল বাচ্চাটা। চোখে ভয় নিয়ে জঙ্গি-নেতাকে দেখলেন বৃদ্ধ। ওঠার গতি না কমিয়ে ধাক্কা দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দিল জমির। ঘুরেও দেখল না, তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেছেন মানুষটা। কেঁদে উঠেছে বাচ্চাটা। তাতে খুশি হলো জমির। একেকবারে তিন ধাপ টপকে উঠল চারতলায়। পা বাড়িয়ে দেখল দরজা সামান্য খোলা। ভেতরে কারও গলার আওয়াজ নেই। ভুরু কুঁচকে গেল জমিরের। তাকে সতর্ক করছে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। সবসময় ওই ইশারাকে গুরুত্ব দেয় সে।

রেইনকোট থেকে একেএস বের করে কোমরের পাশে ধরল জমির। অফ করেছে সেফটি ক্যাচ। থুতনি সামনে বাড়িয়ে দৃঢ়পায়ে খোলা দরজা দিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতর ঢুকে পড়ল জঙ্গি-নেতা। থামতে হলো ওখানেই। চোখ পিটপিট করে দেখল চারপাশ।

মেঝেতে দলের দু’জন। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে রহমান। রক্তাক্ত, ভাঙা নাকটা ঢুকেছে কপালের নিচে মগজে। ঘরের কোণে স্তূপের মত জামিল। ভেঙে গেছে কণ্ঠনালী। মুখ ভেসে গেছে রক্তে। খানিকটা বেয়ে নেমেছে বাম কানে। খোলা চোখদুটো দেখছে ঘুরন্ত সিলিং ফ্যান। চেয়ারে হেলান দিয়ে ডেস্কে বসে আছে নাজিউল। দেহের নিচে ভাঁজ করা একটা পা। অন্য পা সামনের দিকে হাতদুটো কোলের ওপর। ন্যাড়ামাথাটা পুরোপুরি ঘুরিয়ে সরাসরি চেয়ে আছে জমিরের দিকে!

মাত্র কয়েক মিনিটে লাশ হয়েছে জমির শেখের দলের দক্ষ তিন খুনি!

ঘরে মৃত্যু-শীতল পরিবেশ। বলতে গেলে প্ৰায় কোনও প্রতিরোধ ছাড়াই খুন হয়েছে রহমান, জামিল আর নাজিউল। হাওয়া হয়েছে বিদেশি লোকটার মানিব্যাগ আর পাসপোর্ট।

নিজেও ঘরে নেই বিদেশি হারামজাদা।

মুখ হাঁ হয়ে গেল জমিরের, বিস্মিত। হঠাৎ করেই কেন যেন ভীষণ ভয় লাগল তার।

ওই বিদেশি লোকটা আসলে কে!

কী করে খুন করল সশস্ত্র তিনজন ট্রেইণ্ড সৈনিককে! এখনও হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে জমির, দেহের পাশে ঝুলছে সাবমেশিন গান। এমন সময়ে নিঃশব্দে আটকে গেল পেছনের দরজা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *