ছানা

ছানা

বোলপুর-দূর্গাপুর লাইনের বাস। চলেছে দুর্গাপুরের দিকে।

বাসে ভিড় বেশ। ছাদের অর্ধেকটা প্রায় ভর্তি। খোলের ভিতরে বসার আসন একটিও খালি নেই। অনেক প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়ে। ধরে দাঁড়াবার লম্বা হাতল দুটো পাশাপাশি মুঠোয় হাউসফুল। গায়ে গায়ে ঠেসে দুই লাইনে পিঠোপিঠি খাড়া যাত্রীদল। সিটের কোণা খামচে দাঁড়াবার উপায়গুলিও প্রায় বুক্ড

শরতের শুরু। সকাল দশটা নাগাদ। রোদ দিব্যি চড়া।

বড়ো মোট-ঘাট সঙ্গে থাকলে যাত্রীদের ব্যবস্থা বাসের ছাদে। তখন তারা আর পাশের দরজা দিয়ে বাসের পেটে সেঁধুবার চেষ্টাই করে না। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে সোজা উঠে যায়। উপরের টানে ও নীচের ঠেলায় মানুষসমেত হরেকরকম মাল পাচার হয় বাসের মাথায়।

বাস এগোয়। ভিড় ও গরম বাড়ে। যাত্রীদের অস্বস্তি ও মেজাজ চড়ে।

এক নিরীহদর্শন ধুতি ও শার্ট গায়ে বছর চল্লিশের অফিসযাত্রী আপত্তি তোলেন— ‘ও মশাই, পা-টা সরান। আমার চটির ওপর আপনার জুতো।’

—‘সরি, নো উপায়! ভিড়ের বাসে অমনি হয়।’— কানঢাকা হাপ বাবরিচুলো ঝুলো গোঁফ, পরনে নীলচে চোঙা প্যান্ট, লাল হলুদ ডোরা কাটা স্পোর্টস গেঞ্জি এবং ছুঁচলো কালো জুতোর মালিক মাস্তান টাইপ যুবকটি উত্তর দেয়।

মনে দপ করে ওঠা আঁচ সবটা বাইরে প্রকাশে তেমন ভরসা হয় না। তবু অভিযোগকারী ক্ষুব্ধস্বরে জানালেন, ‘ভিড় বলে কি যা খুশি করবেন? মাথায় পা রাখবেন?’

—‘আপনার মাথাটা ওখানে থাকলে তাই রাখতে হত’, নিস্পৃহ জবাব যুবকের। ‘আর আপনার ছাতাটা যে দুবার আমার পাঁজরে খোঁচা মারল? নেহাত ভিড় বলে বলিনি কিছু। তা সরাচ্ছি পা। কিন্তু যদি আপনার ছাতা ফের গায়ে ঠেকে, ওটাকে ছুড়ে ফেলে দেব বাইরে।’

ছত্রধারী আর কথা বাড়াননি বেশি লোকসানের ভয়ে। বরং ছাতাটা একটু আঁকড়ে টেনে নেন কাছে। মাস্তান টাইপ ইঞ্চিখানেক জুতো সরায় কৃপাবশে।

পানাগড় এল। এখানে বাস মিনিট দশেক জিরোয়।

প্যাসেঞ্জারদের কিছু ওঠানামা হয়। বসার জায়গা খালি থাকে না। তবে হাত-পা মেলে দাঁড়াবার কিঞ্চিৎ সুবিধে মিলল।

একজন লোক বাসের সামনের দরজার কাছে হাজির হল মাথায় একটা টিন বয়ে। সে নামাল টিনটা। ধপ করে মাটিতে রাখল। শব্দে মালুম হল ভিতরে ভারী কিছু রয়েছে।

লোকটি মাঝবয়সি। জোয়ান। পরনে হাতওলা গেঞ্জি ও খাটো ধুতি। কাঁধের গামছা দিয়ে সে মুখের ঘাম মুছতে থাকে।

টিনটা কেরোসিনের। চকচকে গা। টিনের দুপাশে দুটো লোহার শিকের হাতল ঝালাই করে লাগানো। টিনের মাথায় একখণ্ড ঈষৎ হলদেটে মোটা কাপড় টান করে পাতা।

বাসের কন্ডাক্টার টিনটা ভালোমতন দেখে নিয়ে বলল— ‘ছানা?’

—‘হ্যাঁ।’ লোকটি ঘাড় নাড়ে।

—‘মালের ভাড়া লাগবে।’ কন্ডাক্টারের ঘোষণা।

ছানাওলা অনুনয়ের দৃষ্টি হানে কন্ডাক্টারের মন ভেজাবার আশায়। যদি ভাড়াটা কমে বা মাপ হয়। তবে সে মুখে কোনো কথা বলে না।

কন্ডাক্টার কিন্তু তার দিকে আর ভ্রূক্ষেপ না করে বিড়ি ধরায়।

ছানাওলা এবার দুহাতে টিনের দুই হাতল পাকড়ে টেনে টিনটা তুলল সামনের দরজার পাদানিতে। অনুরোধ জানায় প্যাসেঞ্জারদের— ‘দাদা একটু সরে। দরজাটা ছেড়ে দিন।’

—‘এখানে মাল কেন? ছাদে যাও।’ আপত্তি ওঠে।

—‘এই একটু বাদেই নেবে যাবে।’ ছানাওলা সাফাই গায়।

—‘ছানা ছলকাবে।’ আরেক যাত্রী সন্ত্রস্ত।

—‘না স্যার। ঠাসা মাল।’ ছানাওলা অভয় দেয়।

ছানাওলা টিনটা টেনেটুনে নিয়ে গিয়ে রাখল ড্রাইভারের পেছনে কাঠের পার্টিশানের গায়ে। নিজে দাঁড়ায় পাশে।

ছানাওলার ভাগ্য ভালো। হঠাৎ কাছে এক সিটেবসা যাত্রী জানলা দিয়ে একটা বাসকে আসতে দেখে— ‘আরে এক্সপ্রেস এসে গেছে’— বলেই তড়াক করে উঠে দুদ্দাড় করে নেমে গেল বাস থেকে। ছানাওলা তার শূন্য সিট দখল করল।

বারকয়েক জোরে জোরে হর্ন মেরে বাস ছাড়ল।

শেষ সময়ে দু-তিনজন যাত্রী উঠল। তারা অবশ্য বসতে পেল না। তাদের একজন দাঁড়াল ছানাওলার ঠিক সামনে। ফলে ছানার টিন মালিকের একটু চোখের আড়াল হয়ে গেল।

পরের স্টপেজে বাসে উঠলেন এক বৃদ্ধ।

বৃদ্ধ নেহাতই বেঁটে ও ক্ষীণকায়। তার গায়ে ঢোলাহাতা আধময়লা পাঞ্জাবি ও ধুতি। পায়ে চপ্পল। শুকনো নারকেলের মতন মুখখানা। আদ্যিকালের গোল ফ্রেমের চশমাটা নাকের ডগায় ঝুলছে। তাঁর হাতে একটা বড়োসড়ো পুঁটলি। বাইরে থেকে দেখে মনে হল পুঁটলিতে পেয়ারা জাতীয় কোনো ফল রয়েছে।

বৃদ্ধ বাসে উঠে মুশকিলে পড়লেন।

প্রথমে তিনি উঁকি মেরে মেরে খোঁজ নিলেন— ‘একটু বসার জায়গা হবে?’ সিটে বসা প্যাসেঞ্জার সবারই অন্যমনস্ক ভাব। কেউ যেন শুনতেই পেল না সেই আবেদন।

বৃদ্ধ বুঝলেন যে বসার আশা নেই।

দাঁড়িয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে বেশ অসুবিধে। এক হাতে ভারী পুঁটলিটা। খাটো মানুষটির পক্ষে রোগা অপর হাতে রড আঁকড়ে সোজা হয়ে থাকা বিলক্ষণ কঠিন কাজ। রড ভালো মতো নাগালই পাচ্ছেন না।

লোকাল বাস ঘন ঘন থামছে চলছে। হঠাৎ ঘ্যাঁচ— ব্রেক। আবার হ্যাঁচকা মেরে এগোয়। ফের থামে। এই অনবরত ঝাঁকুনির মধ্যে শক্ত মুঠোয় কিছু না ধরে খাড়া থাকা একমাত্র কন্ডাক্টারদের পক্ষেই সম্ভব। প্যাসেঞ্জার হলে টাল খাবেই।

বৃদ্ধ বারকয়েক রড ফসকে অন্য প্যাসেঞ্জারদের গায়ে গোত্তা খেলেন।

বিরক্তিসূচক মন্তব্য শোনা যায়—‘আঃ দাদু সোজা হয়ে দাঁড়ান।’

—’ওঃ পুঁটলি সামলে।’

বৃদ্ধ অসহায় চোখে তাকান। হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল ড্রাইভারের পেছনে পার্টিশানের গায়ে একটি নিরাপদ আশ্রয়।

যেখানে ছানার টিন রাখা হয়েছে তার এক পাশে প্যাসেঞ্জারদের সিটের দিকে পার্টিশানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একজন যাত্রী। তিনি বোধহয় টিনটির পরিচয় জানেন। বলেছে বটে, ঠাসা মাল, ছলকাবে না। তবু ভরসা কী? তাই লোকটি টিন থেকে একটু তফাতেই রয়েছেন।

টিনের অপর পাশে, ড্রাইভারের সিটে যাবার পথের দিকে, পার্টিশানে সামান্য একটু জায়গা খালি। বৃদ্ধটি গুটিগুটি গিয়ে সেই বিঘতখানেক ফাঁকা পার্টিশানে কোমর ঠেস দিয়ে হাঁপ ছাড়লেন।

ব্যাপারটা পুরোপুরি আরামদায়ক নয় যদিও। বাসের ঝাঁকুনিতে কখনো কখনো বৃদ্ধের হাঁটুর কাছে টিনের ধারটা ঘসা খাচ্ছে। তবু অন্যদের কটু মন্তব্য শুনতে হবে না, এই বাঁচোয়া।

পায়ের কাছে একটা কেরোসিনের টিন। ঝাঁকুনিতেও নটনড়নচড়ন। বৃদ্ধের নজর মাঝে মাঝেই টিনটার ওপর যায়।

ওপরে মোটামুটি পরিষ্কার একটি টানটান ন্যাকড়া পাতা। তারপর নীচে টিনটা মাথাওলা না মাথাকাটা বোঝার উপায় নেই। বৃদ্ধ একবার তাঁর হাতের পুঁটুলিটা টিনের ওপর কাপড়ে রাখতে গিয়েও রাখলেন না। তাঁর মাথায় অন্য এক ইচ্ছের উদয় হল।

বৃদ্ধ নীচু হয়ে টিনের পাশটায় টিপেটুপে ঠেলে দেখলেন। মনে হল, ভতরের বস্তুটি বেশ জমাট ওজনদার। তরল হালকা কিছু নয়।

বৃদ্ধ মন স্থির করে ফেললেন। ভিড়ের বাসে উপরের শক্তপোক্ত মালের ওপর বসা কিছু অপরাধ নয়। সুতরাং তিনি টিনে পাতা কাপড়ের ওপর জুত করে চেপে বসে পড়লেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পশ্চাদ্ভাগ ভুস করে ঢুকে গেল টিনের ভেতর ছানা ভেদ করে অনেকখানি, একেবারে খাপে খাপে আটকে গেলেন টিনে।

—‘অ্যাক!’

বৃদ্ধের গলা থেকে আর্তনাদটা বেরুনো মাত্র অন্য প্যাসেঞ্জারদের চোখ পড়ল তাঁর ওপর। পরক্ষণেই হৈ হৈ কাণ্ড।

ছানাওলা সামনের লোকটির আড়াল কাটিয়ে গলা বাড়িয়েই লাফিয়ে উঠল— ‘হায় হায়, সর্বনাশ হয়ে গেল।’

—‘চোপ।’ বহুকণ্ঠ একসঙ্গে ধমকে ওঠে।

—’ওঠানোর সময় খেয়াল ছিল না?’

—‘এই কন্ডাক্টার, এখানে ছানা রাখতে দিয়েছ কেন?’

ছানাওলা ও কন্ডাক্টারের মুখ চুন।

ফাঁদে পড়া বৃদ্ধ তখন মরিয়া হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন টিন থেকে। কিন্তু পারছেন না।

তাঁর কোমর অবধি টিনে আটকা। পা দুটো লগবগ করে ঝুলছে। হাতের পুঁটুলিটা অবশ্য ছাড়েননি। অন্য হাতের চাড়ে টিন থেকে ওঠার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছেন বারবার। তাতে যেন আরও সেঁটে বসে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে প্রায় খসে পড়া চশমাটা নাকের ওপর ঠেলে তুলে দিচ্ছেন। কাতর চোখে চাইছেন সবার পানে বুঝি বা সাহায্যের আশায়। টিনের গা বেয়ে উপচে পড়া ঘন ছানা গড়িয়ে নামছে

দু-তিনজন প্যাসেঞ্জার বৃদ্ধের হাত ও কাঁধ ধরে টান দিলেন তবে কাজ হল না। টিনসুদ্ধু বৃদ্ধ একটু সরলেন মাত্র।

—‘দেখি দেখি মোসাই সরুন। সব এলেম বোঝা গেছে। এই সামান্য প্রবলেম’— এগিয়ে আসে সেই চোঙা প্যান্ট, ডোরা গেঞ্জি, ছুঁচোল জুতোধারী মস্তান টাইপ যুবক। সে ইতিমধ্যে একটা সিটে বসতে পেয়েছিল। বসে বসে দেখছিল কেসটা। এবার নিজের হিম্মত দেখাতে এল।

চোঙাপ্যান্ট গম্ভীরভাবে টিনের একধারে ডান পা চাপিয়ে বৃদ্ধের দু বগলের ভেতর দিয়ে দু হাত গলিয়ে মারল এক হাঁচকা টান।

ব্যাস, টিনমুক্ত হয়ে উঠে এলেন বৃদ্ধ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন বিপর্যয় টিনের কানায় ভর দেওয়া উদ্ধারকর্তার জুতো গেল হড়কে। ফলে তার পাটা ডেবে গেল টিনের ভেতর ছানায়।

বৃদ্ধ উদ্ধারের আনন্দরোল জাগতে-না-জাগতেই প্রায় বিষম খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় গোটা বাস। সব্বাই থ।

মুখ ভেটকে সন্তর্পণে পা-খানা টিন থেকে বের করে আনে যুবক। ডান পা হাঁটু অবধি ছানায় মাখামাখি। প্যান্টের ফাঁকে, জুতোর খাঁজে ঢুকেছে ছানা। নীল প্যান্ট ও কালো জুতোয় ছোপ ছোপ ধবধবে ছানা লেগে দারুণ খোলতাই হয়েছে। এমনকী সেই ছানায় ডোবা বৃদ্ধ অবধি নিজের দুর্দশা ভুলে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। কাঁচা ছানার গন্ধে ভুরভুর করছে বাস।

যুবক ছানামাখা পা-খানা যথাসম্ভব দূরে রাখে নিজের বাকি দেহ থেকে। অন্য প্যাসেঞ্জাররাও যতটা পারে তফাতে সরে যায়। ওই পায়ের ছোঁয়া বাঁচিয়ে।

—‘এঃহে’– ছানাওলার গলা দিয়ে জোর আক্ষেপটা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই বেরিয়ে যায়।

মাস্তানটি আওয়াজ লক্ষ্য করে ঘাড় ঘুরিয়ে ছানাওলাকে দেখেই গর্জে ওঠে— ‘সাট আপ।’

ছানাওলা অমনি মুখ নীচু করে চুপ।

তার পাশের যাত্রীটি সহানুভূতির সুরে চাপা গলায় বলল, ‘ইস কী হয়ে গেল!’

ছানাওলা ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীচুস্বরে বিড়বিড় করে, ‘আরও যে কী আছে হায় বরাতে?’

হট্টগোল শুরু হতেই বাস থেমে গিছল। ড্রাইভার ফিরে বসে মন দিয়ে দেখছিল ব্যাপারখানা। এবার সে জিজ্ঞেস করল, ‘ছানা নামবে কোথায়?’

উত্তর হল— ‘মুচিপাড়া।’

বাস স্টার্ট দিল এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। বোধহয় চটপট মুচিপাড়া পৌঁছনোর তাগিদে। ওই আপদটাকে যত তাড়াতাড়ি বিদেয় করা যায়।

ছানামাখা যুবক দু পা ফাঁক করে রড আঁকড়ে সেইখানে খাড়া দাঁড়িয়ে। জানলার পাশে নিজের ফেলে আসা সিটের দিকে বারকতক চাইল বটে কিন্তু ফিরে গেল না। কারণ বোধহয় ভেবে দেখল যে তাহলে পায়ে পায়ে ঠেকিয়ে বসতে হবে। ফলে অন্য পায়ের প্যান্টটারও দফারফা নিশ্চিত।

ফাঁকা সিটটা আর এক যাত্রী তখন সসংকোচে দখল নিল।

ছানার টিনে আটকা পড়া বৃদ্ধ এতক্ষণ পার্টিশানের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়েছিলেন। কী কারণে, বোধহয় কতদূর এলেন দেখার উদ্দেশ্যে উল্টোমুখো হবার চেষ্টা করতেই অন্য প্যাসেঞ্জাররা হাঁ হাঁ করে উঠল— ‘একদম পেছনে ফিরবেন না দাদু। ঘুরে যান। ঘুরে যান।’

বৃদ্ধ ঘাবড়ে গিয়ে তক্ষুনি আগের ভঙ্গিতে বহাল হলেন।

প্যাসেঞ্জারদের আপত্তি করার বিলক্ষণ কারণ ছিল। বৃদ্ধের পেছন দিকে ধুতি ও পাঞ্জাবির অনেকখানি পিঠের আধাআধি থেকে প্রায় হাঁটু অবধি ছানা লেপা। সুতরাং তার পিছন দিকের স্পর্শ বিপজ্জনক বৈকি।

—‘খুক খুক’– চাপা হাসির আওয়াজ যেন?

ছানামাখা-পা যুবক ফিরে দেখল লেডিজ সিটে বসা দুই তরুণী তারই পানে চেয়ে মুখে আঁচল দিয়ে ফুলে ফুলে উঠছে। মাস্তানটির ক্রুদ্ধ দৃষ্টি পড়তেই তারা গোটা মুখ কাপড়ে ঢেকে ফেলে।

যুবক ঘাড় ফেরাল। মেয়ে দুটিকে কিছু বলল না। তবে আশেপাশের পুরুষ প্যাসেঞ্জারদের মুখে কটমটিয়ে নজর বোলায় একবার। ভাবখানা যেন— লেডিজদের ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু বেটাছেলে কেউ দাঁত বেরক করুক, বুঝবে ঠেলা।

পুরুষরা অবশ্য কেউ তেমন আস্পর্ধা দেখাল না। বেশির ভাগেরই বিমূঢ় ভাব তখনও কাটেনি। মজা উপভোগের মতন মনের অবস্থা নয়।

কিছুক্ষণ বাদে ফের সেই সন্দেহজনক খুক খুক শব্দ

এবার যুবক আর ঘাড় ফেরায় না মেয়ে দুটির পানে। তবে সে আর এক প্রস্থ কড়া চোখে জরিপ করে নেয় পুরুষ যাত্রীদের হাবভাব

ড্রাইভারের পাশে তিন সিটের ডগায় যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তিনি ছানামাখা-পা যুবককে জিজ্ঞেস করলেন ডেকে, ‘কদ্দূর যাবেন?’

উত্তর হয়— ‘স্টেশন।’

—‘আমার জায়গায় বসুন ভাই, অসুবিধে হবে না। আমি একটু পরেই নেবে যাব।’ ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।

প্রস্তাবটি যুবকের মনে ধরল। সে দু পায়ের মধ্যে ফাঁক রেখে ডান পা টেনে টেনে গিয়ে বসল ওই সিটে। বাঁ পা মুড়ে ছানামাখা ঠ্যাংখানা ছড়িয়ে দিল। অতঃপর গম্ভীর বদনে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল সিধে।

সিটের অন্য দুই যাত্রী পেছিয়ে গেল যতটা সম্ভব। আর ড্রাইভার ছানার গন্ধে একবার নাক কুঁচকালো বটে তবে আপত্তি জানাল না।

মুচিপাড়া এসে পড়ল।

নামল ছানার টিন। ছানায় পড়া সেই বৃদ্ধও নামলেন সেখানে। অতি সাবধানে। সবার গা বাঁচিয়ে।

—‘ছানাটা নষ্ট হয়ে গেল তো?’ লেডিজ সিটের জানলা দিয়ে একটা বউ সমবেদনা জানাল।

—‘নাঃ, নষ্ট হবে কেন? তবে পোয়া তিনেক মাল লোকসান হল।’ ছানাওলা জবাব দেয়।

—‘ও ছানা দিয়ে কী হবে?’ বউটি কৌতূহলী।

উত্তর এল— ‘রসগোল্লা।’

—‘অ্যা সেকী!’

—‘আজ্ঞে হ্যাঁ। গরম রসে পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ একগাল হেসে জানায় ছানাওলা।

শারদীয়া ১৩৯৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *