1 of 8

ছাতা

ছাতা

প্রিয় মেঘনাদবাবু,

গত শনিবার রাতে খুব বৃষ্টির সময় আমাদের বাড়ি থেকে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমাদের চাকর পাশের বাড়ি থেকে যে ছাতাটি আপনাকে চেয়ে এনে দিয়েছিল সেই ছাতাটি পাশের বাড়ির ভদ্রলোক আজ চাইতে এসেছিলেন। ভদ্রলোক বললেন, ছাতাটি তিনি তাঁর অফিসের বড়বাবুর কাছ থেকে নিয়ে এসেছিলেন, বড়বাবুকে বড়বাবুর ভায়রাভাই খুব চাপ দিচ্ছেন ছাতাটির জন্যে, কারণ বড়বাবুর ভায়রাভাই যে বন্ধুর কাছ থেকে ছাতাটি আনেন সেই বন্ধুর মামা তাঁর ছাতাটি ফেরত চাইছেন।

দয়া করে মনে কিছু করবেন না। আমাদের নিজের ছাতা না থাকায় পাশের বাড়ি থেকে ছাতাটা ধার করে নিয়ে এসেছিলাম। তাই এই জটিলতার জন্যে আমরা নিজেরাও খুব সংকোচ বোধ করছি। এই সামান্য ব্যাপারে আপনাকে নিশ্চয়ই তাগাদা দিতাম না।

ছাতাটি পত্রবাহকের হাতে ফেরত দিয়ে বাধিত করবেন। আবারো বলছি, মনে কিছু করবেন না। এইমাত্র পাশের বাড়ির ভদ্রলোক আবার তাঁর চাকর পাঠিয়ে তাগাদা দিলেন।

ইতি

আপনাদের ঘনশ্যাম

বলা বাহুল্য, মেঘনাদবাবুর পক্ষে ছাতাটি ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ ওই ছাতা নিয়ে পরের দিন সকালে মেঘনাদবাবুর ছেলে বাজারে যায় এবং ফেরার পথে যখন বৃষ্টি থেমে গেছে, বাজারের পাশের চায়ের স্টলে এক কাপ চা খেতে গিয়ে সেখানে ফেলে আসে। পরে অবশ্য চায়ের দোকানদার ছাতার কথা অস্বীকার করেননি কিন্তু সেদিনই দুপুরে আবার যখন বৃষ্টি আসে তখন দোকানদার মশায় সেটা মাথায় দিয়ে বাড়ি যান ভাত খেতে। বিকেলে সেই ছাতা নিয়ে দোকানদার মশায়ের ভাই খেলার মাঠে যান। খেলার মাঠ থেকে ফেরার পথে ভাইটি তাঁর বান্ধবীর বাড়ি যান। সেখানে ছাতাটি রেখে আসেন কিন্তু এখন সেই বান্ধবীর বাড়িতে ছাতাটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

আমাদের এবারের গল্প ছাতার গল্প। যে তরুণী পাঠিকার সকৌতুক মুখচ্ছবির কথা ভেবে এই সব ছাইপাঁশ, উলটো-পালটা লিখি সেই পাঠিকা-সুন্দরী নিশ্চয়ই এবার এই শুরুতেই খুব ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে পড়েছেন।

তার চেয়ে বরং আমার নিজের ছাতার কথা বলি। প্রথমেই নিজেকে সংশোধন করে নিই, আমার নিজের কোনও ছাতা নেই, কখনওই ছিল না। রোদ-বৃষ্টিতে চিরকাল খালি মাথায় ঘুরে বেরিয়েছি, কোনওদিন ছাতা বা মাথার উপর কোনও আচ্ছাদন দরকার পড়েনি। তা ছাড়া আমাদের পাগলের বংশ, ছোটবেলা থেকে ঠাকুমা-পিসিমারা বলে এসেছেন, ‘সব সময়ে মাথা খোলা রাখবি, যত পারবি মাথায় হাওয়া লাগাবি, কখনও কোনও রকম ঢাকাটুকি দিবি না।’ আমরাও সেই আদেশ মেনে চলি, শুধু ছাতা কেন, টুপি, মাফলার এমনকী লম্বা চুল রাখা পর্যন্ত আমাদের বারণ।

তবু একটা কথা এখানে স্বীকার করে না নিলে গৃহে গঞ্জনা পেতে হবে। আমার বিয়েতে একটা ছাতা পেয়েছিলাম। আমার বিয়ের বরকর্তা ছিলেন আমার এক সরল প্রকৃতির স্বাধীনতা-সংগ্রামী বিপ্লবী মামা। আমার বাবা কেন যে তাঁকে বরকর্তার উচ্চপদে নিযুক্ত করেছিলেন তা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু বিয়ের সামাজিক রীতিনীতি, কলা-কৌশল কিছুই তাঁর জানা ছিল না, কারণ আমার সেই মামার আসল দিনগুলি কেটেছিল কারাগৃহের অন্তরালে। আমাদের সঙ্গে বরপক্ষে যে নাপিত গিয়েছিল সে তাঁকে বুঝিয়েছিল যে বিয়েতে বরের ছাতা নাপিত পায় এবং বরকর্তা মহোদয় সরল বিশ্বাসে ছাতাটি তাকে দিয়ে দেন। ফলে আমার জীবনের সেই এক ও অদ্বিতীয় আপন ছাতাটি আমি চোখেই দেখতে পাইনি।

আমার নিজের কাছে অবশ্য এখন একটি ছাতা আছে কিন্তু সেই ছাতা আমি কিনিনি, কেউ আমাকে দানও করেনি, সেটি আমি অর্জন করেছিলাম।

মেঘলা দিন, রাস্তার মোড়ে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বিলিতি পোশাকে সজ্জিত ভদ্রলোক, সদ্য বিদেশাগত বহুদিন প্রবাসী সফল বাঙালি ভদ্রলোকের যেমন পরিতৃপ্ত চেহারা ও জামাকাপড় হয় ওঁরও তাই। ভদ্রলোকের হাতে ছিল ছয় ইঞ্চি সাইজের গোল চামড়ায় জড়ানো কী একটা পদার্থ।

হঠাৎ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামতে ভদ্রলোক ওই চামড়ার মোড়ক খুলে একটা জিনিস বার করলেন, সেটা একটা কনডেন্সড ছাতা, নীচের দিকে একটা বোতামের মতো, সেটা টিপলেই ছাতাটি হুস করে খুলে যাবে। দুঃখের বিষয়, ভদ্রলোকও বুঝতে পারেনি, আমার তো পারার কথাই নয়, এই কর্কটক্রান্তির দেশে ওই বিলিতি শীতলতার বোতামটি কোনও কারণে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে ছিল। ভদ্রলোক বোতামটি টেপা মাত্র ভেতরের লুকানো স্টিলের বাঁচটি ঘণ্টায় একশো কিলোমিটার বেগে বেরিয়ে এসে, আমি কিংবা সেই ভদ্রলোক কিছু টের পাবার আগে, সজোরে আমার কানের নীচের রগে আঘাত করল। জীবনে এমন প্রচণ্ড চোট আর কখনও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না, ‘কোঁ কোঁ’ করতে করতে মাটিতে পড়ে গেলাম। কয়েকজন পথচারী ছুটে এলেন, একজন কাছের টিউবওয়েল থেকে আঁজলা করে জল এনে চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলেন।

আমি অবশ্য জ্ঞান হারাইনি, তবে কানের নীচে কেটে রক্ত পড়ছিল। উঠে বসে ছাতার মালিক সেই ভদ্রলোককে কোথাও দেখতে পেলাম না। তবে ছাতাটি আমার সামনেই খোলা অবস্থায় গড়াগড়ি যাচ্ছিল। এক ভদ্রলোক ছাতাটি তুলে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, এই সব সাংঘাতিক ছাতা ব্যবহার করে নাকি মশায়, এখনই তো মারা পড়তে বসেছিলেন।’ পাশেই একজন বিজ্ঞদর্শন লোক ছিলেন, তিনি বললেন, ‘এই সব ছাতাই তো বুকে ঠেকিয়ে বোতাম টিপে দিয়ে জাপানিরা আত্মহত্যা করে। আজকাল তো হারাকিরিতে ছোরা ব্যবহার উঠেই গেছে, সবাই ছাতা ব্যবহার করছে।’

যে ভদ্রলোক ছাতাটি আমার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন হঠাৎ হাতলের সেই বোতামের জায়গায় তাঁর হাতের চাপ পড়াতেই বোধহয় ছাতাটি হঠাৎ ফরফর করে উঠল, আসলে ছাতাটি তখনও পূর্ণ বিকশিত হয়নি। সদ্য বিকচোন্মুখ অবস্থায় তাকে ফেলে মালিক পালিয়েছেন, এইবার দ্বিতীয় ভদ্রলোকের কল্যাণে ছাতাটি সহসা পরিপূর্ণ আকার ধারণ করল।

ফরফর শব্দ করে ছাতাটি পুরো খুলে আসতেই যে ভদ্রলোকের হাতে ওটা ধরা ছিল তিনি লাফিয়ে উঠে ছাতাটি ছেড়ে দিলেন, ছাতাটির বিকাশ এবং ছত্রধারীর উল্লম্ফন দেখে বাকি যারা আমার সাহায্যে এসেছিলেন তারা কী এক অজ্ঞাত আশঙ্কায় আর্তনাদ করে সবাই দশ বারো হাত পিছিয়ে গেলেন। মুক্ত বিহঙ্গের মতো খোলা ছাতাটি বাদুলে হাওয়ায় প্রায় উড়তে যাচ্ছিল, আমি খপ করে সেটার হ্যান্ডেল চেপে ধরলাম। এবার আর ছাতাটি কোনও বিরুদ্ধাচরণ করল না। হিসহিস ও মৃদু গুঞ্জন উঠল অদূরবর্তী ভিড়ের মধ্যে, সেখান থেকেই কে একজন বলল, ‘দাদার সাহস আছে বটে!’

যেখানে যাচ্ছিলাম, যাওয়া হল না। বৃষ্টি নেমেছে, জীবনে প্রথমবার ছাতা মাথায় দিয়ে বাড়ি ফিরে এসে কানের নীচে ডেটল লাগালাম।

তবে ছাতাটি বন্ধ করার চেষ্টা করিনি। ওই মুক্ত অবস্থাতেই বাইরের ঘরে আছে। আমার ছেলে বলেছে তাঁর এক সহপাঠিনীর জামাইবাবু নাকি টোকিয়োতে থাকেন। কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতা আসছেন। সেই জামাইবাবু ভদ্রলোককে একদিন নিমন্ত্রণ করে বাসায় এনে তাঁকে দিয়ে ছাতাটা বন্ধ করানোর চেষ্টা করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *