ছাতা আছে মাথা নেই
আমরা আর বেঁচে নেই। বেঁচে আছে একটি মাত্র প্রশ্ন—কী হবে? ছাত্রের প্রশ্ন, লেখাপড়া করে কী হবে? সময়ের অপচয়, অর্থের শ্রাদ্ধ। চাকরি মিলবে না। এ দেশে একটিমাত্র জীবিকায় সোনা ফলবে, সেটি হল গুন্ডামি। যদ্দিন বাঁচবে সুখে বাঁচবে, দাপটে বাঁচবে। মিউ মিউ করতে হবে না। সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক কর। সিমেন্ট ব্ল্যাক কর। ওয়াগন ভেঙে ফাঁক কর। নির্বাচনের সময় বুথ দখল কর। ‘টেরারে’র ব্যবসায় ভালো কামাই। পাড়ার মানুষ দাদা বলে ভয় ভক্তি করবে। দাদার দাদারা বাড়ির সামনে গাড়ি থামাবে। দোকানদার ছুটে এসে পায়ের ধুলো নেবে। শেয়ানার দেশে শেয়ানে শেয়ানেই কোলাকুলি হয়। অনর্থক শেলী, বায়রন, কীটস, শেকসপীয়র, কান্ট, হেগেল, হিউম, নিৎসেকে নিয়ে ধ্বস্তাধস্তি করে কী হবে! জিও, পিও ফুস, ফিনিশ।
গৃহীর প্রশ্ন, কী হবে বেঁচে! শুধু-শুধু জায়গা জুড়ে বসে থাকা। র্যাশানের বোগড়া আলোচাল ধ্বংস করা। দিনগত পাপক্ষয় ছাড়া আর কী হবে?
শিক্ষকের প্রশ্ন, কী শেখাব? কে শিখবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন রণক্ষেত্র। রুটিন অতি চমৎকার। প্রথম ঘণ্টায় শিক্ষকদের পক্ষাবলম্বী ছাত্রে-ছাত্রে সঙ্ঘর্ষ। অন্তে ঘণ্টাবাদন, কুরুক্ষেত্রে দিবসের শান্তি। দেয়াল লিখন আর পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। গেটে ছাত্রদের জমায়েত। জ্বালাময়ী ভাষণ। বিশেষ আকর্ষণ, বোমা বিস্ফোরণ। নিজেদের সমস্যা তো আছেই, গোদের ওপর বিষফোঁড়া, আন্তর্জাতিক সমস্যা—কম্বোডিয়া, কামপুচিয়া, ইরাক, ইরান, ফকল্যান্ড আইল্যান্ড।
তালগোল পাকান একটা দেশ। কয়েক বছর আগে কলকাতার অফিসপাড়ার এক রাস্তা ধরে হাঁটছি। প্রায় সন্ধ্যা। হঠাৎ এক অফিসবাড়ির দোতলায় সিঁড়ি বেয়ে ধোপদুরস্ত দুই বাবু জড়াজড়ি, কোস্তাকুস্তি করতে-করতে, দুম করে একেবারে রাস্তায় আমার পাশে এসে পড়লেন, যেন যমজ সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। রাস্তায় শুয়ে-শুয়ে দু-জনে দু-জনকে খুব খানিক লাথালাথি করলেন, তারপর ধুলোটুলো ঝেড়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। প্রবেশপথ থেকেই ধাপে-ধাপে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলার রহস্যলোকে। সুন্দর চেহারার, হৃষ্টপুষ্ট দুই বঙ্গপুঙ্গব প্রদোষের ম্লান আলোকে সেই ভুতুড়ে সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেলেন। পরস্পর পরস্পরের ওপর অনর্গল বৃষ্টিধারার মতো কটু বাক্য বর্ষণ করে চলেছেন। সাদা পোশাকে রাস্তার ধুলো জড়িয়ে আছে। আমাকে অবাক হতে দেখে ফুটপাথের এক বিক্রেতা বললেন, ‘অবাক হবার কিছু নেই, দোতলায় অমুক মিলের বোর্ড অফ ডিরেক্টার্সের অ্যানুয়েল জেনারেল মিটিং হচ্ছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ান। দেখবেন, জোড়ায়-জোড়ায় বাঙালি ওইভাবে লড়ালড়ি করতে-করতে নিচে এসে পড়ছে, আবার ধুলো মেখে ওপরে উঠে যাচ্ছে।’ বাঙালির সেই বিখ্যাত মিলটি অবশ্য লাটে উঠে গেছে। সেকালের জমিদাররা মাঝে-মাঝে বাইরে যেতেন। নায়েবরা বলত, বাবু লাটে গেছেন। অর্থাৎ জমিদারী দেখতে গেছেন। লাটে যাওয়া এক জিনিস আর লাটে ওঠা আর এক জিনিস। সারা দেশ জুড়ে এখন বোর্ড অফ ডিরেক্টার্সের মিটিং চলেছে। আর জড়াজড়ি, গলাগলি করে ভদ্র বঙ্গসন্তান রাস্তায় এসে পড়েছে। লাটে ওঠার পূর্ব লক্ষণ।
সেই বীরভূমের শ্রাদ্ধ। কৃষকের পিতা পরলোকে গেলেন। শ্রাদ্ধ হবে। পুরোহিত কৃষকবধূকে বলে গেলেন, উঠনের কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে রাখবে, কাল সকালে শ্রাদ্ধ হবে। কৃষকবধূ পুরোহিতের নির্দেশমত বাড়ির সামনের কিছুটা জায়গা নিকিয়ে, পরিষ্কার করে রাখলে; শ্রাদ্ধ হবে। যথাসময়ে পুরোহিত এলেন। নিখুঁত আয়োজন। সামনে কাছাগলায় যজমান। পুজো-আচ্চার নিয়মকানুন কিছুই জানা নেই। পুরোহিত ছিলেন তোতলা। তিনি প্রথমেই বললেন, ‘ব ব বল ব্যা ব্যাটা তো তোর বা বাপের নাম বল।’
কৃষক অমনি বললেন, ‘ব ব বল ব্যা ব্যাটা তো তোর বা বাপের নাম বল।’
পুরোহিত বললেন, ‘উ উ উ লয়, বা বা বাপের নাম।’
কৃষক বললে, ‘উ উ উ লয় বা বা বাপের নাম।’
পুরোহিত মশাই ভাবলেন, যজমান ব্যঙ্গ করছে। মারলেন এক চড়।
কৃষকও পুরোহিতের গালে কষিয়ে দিল এক চড়। শুরু হয়ে গেল কোস্তাকুস্তি, ধ্বস্তাধ্বস্তি। দুজনে ঝটাপটি করতে-করতে গড়াতে-গড়াতে পাশের নর্দমায়।
কৃষকবধূ দাওয়ায় বসে সব দেখছিল। শ্বশুরের শ্রাদ্ধ খুব জমেছে। দু-জনকে নর্দমায় গড়িয়ে পড়তে দেখে আপন মনে বলে উঠল, ‘আই বাপ, অ্যাদদুর গড়াবে জানলেক আর একটু লিকিয়ে রাখতুম।’
বীরভূমের ওই শ্রাদ্ধের মতো বাঙালির শ্রাদ্ধ কতদূর গড়াবে কে জানে? প্রস্তুত হয়েই থাকা ভালো। যতটা পারা যায় ভেতরটাকে নিকিয়ে রাখাই উচিত। প্রাচীন সংস্কার, আদর্শ মনের গোশালায় গোবরের মতো জমে আছে। সেই আবর্জনায় জন্মাচ্ছে নতুন আদর্শের শূক কীট। ঝাঁক-ঝাঁক অস্বস্তির মশা বিবেকে হুল ফোটাচ্ছে। চিন্তার সঞ্চয়ে শ্রেষ্ঠ বলে যা তোলা আছে তার কোনও মূল্য নেই? যা শিখে এলুম সব ভুল? শাশ্বতের ধারণা পাল্টাতে হবে! যাঁদের মহাপুরুষ বলে জেনে এসেছি, এ যুগের চোখে তাঁরা কাপুরুষ। জ্ঞান, সৎকর্ম, শান্তি, অহিংসা, আদর্শ, সত্য এ সবই হল মধ্যযুগীয় কুয়াশা, কুআশা। পশুজগতের নিয়মই মানুষের আদর্শ। ধরো আর মার। মেরে খাও। এর মার, তার মার, পকেট মার। আবরণ মানুষের, অন্তর পশুর। বড় সংশয়। বড় বিস্ময়। মানুষ তো আশা নিয়েই বাঁচতে চায়! উপনিষদের চরৈবেতি মানে সামনে চলা, না পেছনে চলা!
প্রশ্নের উত্তর পেলাম স্বামী সত্যানন্দের কাছে : হতাশ হয়ো না। প্রত্যেক মানুষের ঠিকমত চলতে-চলতে বেচাল ইচ্ছে করে। পশুদের দেখা যায় হঠাৎ একদিকে দৌড় দেয়। বিচারশীলতা নিয়ে মন ঠিক চলছে হঠাৎ চঞ্চলতা নিয়ে এক দৌড় দেয়। এ হচ্ছে Erraticism of Soul। ব্রহ্মও একদিন সমরসে থাকতে-থাকতে এমনই বিসম হয়ে গেলেন। খুব নিয়মে চলেও হঠাৎ ইচ্ছে করে বেনিয়মে চলবার। আবার আমরা বহু জন্ম পশু ছিলাম। কাজেই পশুত্বের Erratic nature—বিচারহীনতা—হঠাৎ জেগে ওঠে। সেই Erratic ভাবগুলোকে অবশ্য দমন করা উচিত। দার্শনিক কান্ট তাই ‘Moral ought’, উচিত বোধকে বড় করে স্থান দিয়েছেন।
একক মানুষ হয়তো এগতে চায়। ঘরে-ঘরে আদর্শের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। পূর্বপুরুষের ছবির সামনে আনত হবার মতো মাথা হয়তো এখনও ধড় থেকে এক কোপে নামিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি। সাধনহীন, আদর্শহীন হয়ে পড়েছে মানুষের সঙ্ঘ, সংগঠন, Organisation of Man, যে হাত মানুষকে সামনে ঠেলবে, সেই হাত পেছনে ঠেলছে। মুকুট আছে, রাজা নেই। মর্কট লাফাচ্ছে সিংহাসনে।