ছাগলের বোধোদয়
হঠাৎ মনে হল, আমি একটা ছাগল। শুধু ছাগল নই, পাঁঠা ছাগল। শেয়ালদা স্টেশন থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছি। গায়ে-গায়ে, ঘাড়ে-ঘাড়ে , কাঁধে-কাঁধে, পায়ে-পায়ে, লাফিয়ে-লাফিয়ে, ঠেলা খেতে-খেতে, ঠেলতে-ঠেলতে। সব মিলে যাচ্ছে। মিলছে না কেবল ব্যা-ব্যা ডাকটা। পেছন থেকে দৃশ্যত কেউ ছড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে না তবে অদৃশ্য একটা তাড়া আছে, যেমন করেই হোক দশটার অফিস দশটাতেই পৌঁছোতে হবে।
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ধরে ঠিক ওই সময়েই শ’তিনেক ছাগল চলেছে। জলস্রোতের মতো এগিয়ে আসছে ফুটপাত ধরে। জুতো পালিসওয়ালা ছেলেটা ভেসে গেল। তিনজন মহিলা ছাগল স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে গিয়ে ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়লেন। মৃত্যুভয়ে ভীত শিশু-ছাগল উচ্চবর্ণের মহিলাদের দামি শাড়ির আঁচলে আশ্রয় খুঁজতে গিয়ে প্রথমে শুনল ইংরেজি গালাগাল, পায়ে ধরতে গিয়ে খেল চাঁট, কচি কচি শিং-এতে শাড়িতে জীবন্ত চোরকাটার অবস্থা। অবশেষে পাটনাই যমদূত থুতু ছিটোতে-ছিটোতে এসে ছপটি দিয়ে ছাগল ছাড়িয়ে উত্তর দিকে চলে গেল—প্রাোটিনের পাল নিয়ে। আমার মধ্যে দিয়েই গেল। পাশ দিয়ে গেল, পায়ের ফাঁক দিয়ে গেল, চোখ উলটে ভ্যাভ্যা করতে-করতে বলে গেল—জন্মিলে মরিতে হবে, প্রাোটিন হয়ে ঝুলাতে হবে, কোর্মা হবে, কাবাব হবে, হালকা মতো ঝোল হবে, ভুগতে হবে, ভাগতে হবে, পরের সেবায় জবাই হবে।
ছুটন্ত আমির তখনই মনে হল—এই এক ছাগল। পেটে পালং শাকের ঘণ্ট, তাহার ওপর আলুলায়িত মসুর ডাল, একপাশে সুইসাইড করে পড়ে আছে একটি নিরীহ মাছের পোনা। একটি ভিটামিন ক্যাপসুলের বহিরাবরণ দু-খণ্ড হয়ে কর্পোরেশনের বিশুদ্ধ জলে নৌকোর মতো ভাসছে। কণ্ঠনালি দিয়ে নেমেছে পানের রক্তিম রস। ব্যা করছে না বটে কিন্তু পাকা শিং নেড়ে-নেড়ে ছাগল ছুটছে অফিসে। পশ্চাদ্দেশে পাটনাই ‘সাপ্লায়ারে’র ছপটির আস্ফালন নেই বটে, জীবন আছে। জন্মেই মরেছ তুমি, এখন দেহের দাসত্ব করো। লোহারই বাঁধনে বেঁধেছে সংসারে দাসখত লিখে নিয়েছে হায়।
ছাগল, কিন্তু বুদ্ধিমান ছাগল। রিয়েল ছাগলের বোঝার ক্ষমতা নেই যে, সে ব্যাটা ছাগল। আমি কিন্তু আমার ছাগুলে স্বভাবটা বেশ বুঝতে পারি। সংসারের জাবনায় যা ঘাসপাতা থাকে, তাই পরমানন্দে চিবোই। কিছুক্ষণ মৌজ করে চোখ বুজিয়ে জাবর কাটি। ভাবি, আহা কী সুখের জীবন। তারপরই ঘড়ি দেখে ‘ব্যা’ করে লাফিয়ে উঠি। আমার দুধ নেই, আমার গোবর নেই, সামান্য একটু ব্রেন আছে, অখাদ্য, কিন্তু দাসত্বের পক্ষে যথেষ্ট। সেটিকে ব্রহ্মতালুর তলায় রেখে আমি এক ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’, তির বেগে ছুটতে থাকি।
‘ব্ল্যাক বেঙ্গলটা’ কী? আমিও জানতুম না, সম্প্রতি ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে শিখেছি। সেখানে ব্যাঙ্কের টাকায় ব্ল্যাক বেঙ্গলের চাষ হচ্ছে। দিশি ছাগল। আকারে ছোট। বংশবৃদ্ধিতে ওস্তাদ। খায় কম, আবার চরে খায়। প্রতিপালনের তেমন ল্যাঠা নেই। বেশ আয় দেয়। সুস্বাদু। শেষ গুণটি ছাড়া বাকি সব কোয়ালিটিজই আমার মধ্যে আছে। ভেবে দেখেছি, যেকোনও ছাগলকে আমি চ্যালেঞ্জ করতে পারি।
না, পারেন না। ডক্টর সোম পেটে খোঁচা মারতে-মারতে বললেন—কিছুতেই পারেন না, কারণ মৃত্যুর পর আপনার কোনও মূল্য নেই। জীবৎকালে গোলামি করে হয়তো কিছু রোজগার করেছেন, তাও সবই উড়ে-পুড়ে যাবে, মৃত্যুর পর আপনি এক মুঠো ছাই। কারুর কাছে ওই বস্তুর সামান্য ‘সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু’ থাকলেও পৃথিবীর বিচারে আপনি মহাশূন্য হইতে উদ্ভূত একটি মহাশূন্য। আগেও নেই, পরেও নেই, মাঝখানে সামান্য ব্যাব্যাক্কার। ব্যয় করতে-করতে, খরচ করতে-করতে হাওয়া হয়ে যাওয়া।
যেমন ধরুন, আপনার ওজন মাত্র বাহান্ন কেজি। সুখে প্রতিপালিত যেকোনও বিলিতি শূকরের ওজন আপনার চেয়ে বেশি। অবশ্য দিশি অভুক্ত ছাগলের চেয়ে আপনার ওজন কিছু বেশিই। নাড়িভুঁড়ি বাদ দিলে ‘নেট ওয়েট’ হবে চল্লিশ কেজি। এইবার চল্লিশ কেজি একটা ছাগল কেটে ঝোলালে কত দাম হয় হিসেব করুন। চল্লিশ ইনটু ষোলো। ছশো চল্লিশ টাকা। পাল্লাটাকে একটু এদিক-ওদিক করতে পারলে আরও বেশি। তারপর ধরুন। এই-যে লিভারটি বানিয়েছেন, প্রস্থে পিঠের দিকে গেছে, দৈর্ঘ্যে ঝুলওয়ালা জামার মতো হাঁটু ছুঁতে চলেছে, এটি আপনার একটি শরীরে ‘লায়াবিলিটি’, ছাগলের শরীরে ‘অ্যাসেট’, বাইশ থেকে চব্বিশ টাকা কেজি। এখুনি আপনাকে একটি লিভারের প্রেসক্রিপসান ছাড়ব, ঝপাত করে তিরিশ-বত্রিশ টাকা বেরিয়ে যাবে এবং এইভাবে বেরোতেই থাকবে। ছাগল হওয়া অত সহজ নয়, মশাই। ছাগলের ছাল ‘গ্লেজ কিড’। ‘এক্সপোর্ট মার্কেটে’ ‘ গ্লেজ কিড’ জুতোর দাম জানেন! আপনি ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’ নন ‘ব্ল্যাক বেঙ্গলি’।
তাহলে আমি কে? কৈশোরে ভাবতুম আমি সব কিছু। কল্পনায় কখন কলম্বাস, কখন শেক্সপিয়ার। শিক্ষকরা নির্দ্বিধায় বলতেন, এটি একটি নির্ভেজাল বোকা পাঁঠা। তিন মাসেও শেখাতে পারলুম না : ত্রিভুজের দুই কোণের বহি:সমদ্বিখণ্ডক এবং তৃতীয় কোণের অন্ত:সমদ্বিখণ্ডক সমবিন্দু। এ গাধাটা এমনই গাধা যে, ‘লতা’ শব্দের প্রথমার একবচনে একটি বিসর্গ বসাবেই। আনম্যানেজেবল রাসকেল। চাটুজ্যেমশাই, একে দিয়ে হাল চাষ করান। এ পাঁঠাকে মানুষ করে কার বাপের সাধ্য।
নিজের ‘ক্রিয়েশান’-কে কে পাঁঠা ভাবতে পারে! তোমার সেই গল্পটা মনে পড়ে কি? এক মূর্খ। কিছুতেই তার কিছু হয় না। মনের দু:খে নদীর ধারে বসে আছে। হঠাৎ চোখ পড়ল পাথরের ধাপে একটি মানানসই গর্ত। কী করে হল? এক মহিলা এলেন স্নানে। কোমরের কলসিতে জল ভরে রাখলেন, ওই ক্ষয়ে-যাওয়া জায়গাটিতে। ও, আই সি। মূর্খ লাফিয়ে উঠল, ঘর্ষণে পাথরও ক্ষয়, তবে? পালিশে-পালিশে মোটা মাথা কেন ঝকঝকে হবে না? নিশ্চয় হবে। চেষ্টা করো। চেষ্টা করো। রবার্ট বুস! মনে পড়ে? সেই মাকড়সার গল্প! এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার কী হবে? আজ্ঞে, এ স্কোয়ার প্লাস বি স্কোয়ার প্লাস সি স্কোয়ার প্লাস…। হ্যাঁ হ্যাঁ বেশ হচ্ছে, বেশ হচ্ছে, থামলি কেন চালিয়ে যা, চালিয়ে যা, জেড পর্যন্ত সোজা রাস্তা খোলা, ওরে আমার ‘ডানস’, গাধা, নিরেট নীরেন!
ফ্যামিলিতে কে কী হয়েছে! শিক্ষক হয়েছে, আইনজীবী হয়েছে, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে, একজন ডাক্তার হলে মন্দ হয় না। ‘অল কমপ্টি ফ্যামিলি’। আর যেসব ছাগল আসবে, প্রথমেই তারা শিক্ষকের জিম্মায় চলে যাবে। বাড়ি ভাঙলে ইঞ্জিনিয়ার, প্রতিবেশীকে হুলো দেবে আইনজীবী, কেবল খাবি খেলে একজন দেখার লোকের বড় অভাব। ওহে চেষ্টা করো, চেষ্টা করো আমরা একটি ডাক্তার ছাগল চাই। ব্যাঙ্ক ‘ইনভেস্ট’ করবে না, আমরাই ফ্যামিলি ফান্ড থেকে ঢেলে যাই। পরে সুদে-আসলে মিটিয়ে দিও। খাও, খেয়ে যাও রোজ একপো দুধ, একটি ডিম্ব। পারলে ভালো হত কিন্তু পারব না, আশু মুকুজ্যে রোজ একথালা সন্দেশ খেতে-খেতে হাইকোর্ট থেকে বাড়ি ফিরতেন, তাই না তিনি বেঙ্গল টাইগার হয়েছিলেন। ঠিক হ্যায়, বেঙ্গল টাইগার হতে না পারো, বেঙ্গল জ্যাকল হও।
আরে, ডাক্তার করবে? এ কী তোমার ইচ্ছেয় হবে, না আমার ইচ্ছেয় হবে? ‘মিডিঅকার মেরিটের’ ছেলে। কমপিটিটিভ পরীক্ষায় দাঁড়াতেই পারবে না, ধেড়িয়ে বসে থাকবে। তেমন পয়সার জোর থাকলে অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখা যেত। তা যখন নেই—মনে তাই তো ভাবি, কেউ কখনও খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি।
তাহলে এই ছাগলটিকে কেমন ছাগল করা যায়? বা:, ছবি আঁকার হাতটি তো মন্দ নয়। কেমন গান্ধীজি এঁকেছে দ্যাখো? দি একে আর্ট স্কুলে ভরতি করে। আরে না না, অমন কাজটি কোরো না। ওসব বড়লোকের লাইন। বাপের ‘ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স’ থাকলে তবেই ও-লাইনে যাওয়া উচিত। খাবে কি? কলার সাধনায় কাঁচকলাই খেতে হবে। জেনারেল লাইনেই দাও। ঘষটাতে ঘষটাতে গ্র্যাজুয়েটটা হলেই তদবির করে, দাও কোনও অফিসে ঢুকিয়ে। সরকারি হলে তো কথাই নেই, পাকা ‘পেনসানেবল সার্ভিস, ও কাজ করলেও মাস-মাইনে, না করলেও মাস-মাইনে।’
আরে ছি ছি, এ কি করলে তুমি? কৈশোরের কিশলয় গোলামে পরিণত হয়। স্রেফ ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে আর ছাতে উঠে ঘুড়িলাটাই নিয়ে ভোমমারা, ভোমমারা করে করে ‘কেরিয়ারটা’ উড়িয়ে দিলে। তোমার মধ্যে সব ছিল, ডাক্তার ছিল, ইঞ্জিনিয়ার ছিল, জজ ছিল, অ্যাডমির্যাল ছিল, ফুয়েরার ছিল। ড্যাংগুলির চোটে সব ধামাচাপা পড়ে গেল। শৈশবটিকে ঠিকমতো পেটাতে পারলে যৌবনে কালোয়াত হওয়া যায়। নিদেন একটা কালোয়ারও যদি হতে পারতে ‘হনি’ তাহলে ছাপ্পর ফুঁড়ে ‘মানি’। ‘প্যালেসিয়াল বিলডিং’, গোটাকতক ‘মটরকার’। গুলি খেলেই সব গুলিয়ে ফেললে চাঁদ। একবারও বুঝলে না, ‘লতা’ শব্দের প্রথমায় বিসর্গ হয় না। ব্যাকরণ কৌমুদীর ভেতর দস্যু মোহন।
আচ্ছা, এটাকে ইনসিওরেনসের দালাল করে দিলে কেমন হয়। ওই তো গোলগাল, লাল টুকটুকে হরিচরণ কেমন কালো ব্যাগটি হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটেই তিনতলা তুলে ফেললে। আরে না না, দেখছ না, তোমাদের এ বস্তুটি একেবারেই ম্যাদা মারা। মুখ দিয়ে কথাই বেরোয় না। তো তো করে। চেহারা দেখলেই ‘ক্লায়েন্ট’ পালাবে। পহলে দর্শনধারী না হলে রিপ্রেজেন্টটেভি হওয়া যায় না। বরং দ্যাখো দুলে-দুলে, পড়ে পড়ে কোনওরকমে যদি একটা কমপিটিটিভ পরীক্ষা পাশ করতে পারে, ডাব্লু বি সি এস জুনিয়ারটাতেও যদি বেরোতে পারে, তাহলেও একটা হিল্লে হবে। তবে ও যেরকম ‘অ্যাস’, সন্দেহ আছে।
তাহলে সন্ন্যাসী হয়ে যাক। তবু বলা যাবে, না, ‘ফ্যামিলি’র একটা ছেলে অন্তত বকরীয়ানন্দ হয়েছে। চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে। সামনে একটি নেয়াপাতি ভুঁড়ি, মুখে স্মিত হাসি, চোখে বিশ্বসংসারের প্রতি কৌতুকের দৃষ্টি, পায়ের কাছে হামা দিচ্ছে ধেড়ে ধেড়ে ব্যাবসাদার, জজ, ব্যারিস্টার। সমস্ত প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে বুড়ো আঙুলটি তুলে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা আমার।
কি যে বলো তুমি, এ কি সন্ন্যাসী হওয়ার মাল। চোখ দেখেছ, কুটিল, কুলসর্বস্ব। চুলের আলবোট দেখেছ, যেন রমণীমোহন। কান দেখেছ, যেন ইঁদুরের মতো। হাত দেখেছ? তবলা বাজায়। পা দেখেছ? ধাঙড়ের পা। সন্ন্যাসীর শরীর লক্ষণ জানো না! স্বামীজির ছবিটা দ্যাখো। শিবনেত্র, বর্হিমুখী। আজানুলম্বিত বাহু। ডঙ্কামারা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুক। ছ-ফুট লম্বা। সারা শরীরে জ্যোতি। এ বস্তু তো তমোগুণী। ঘুমোলে উঠতে চায় না। বসলে নড়তে চায় না। সাত হাত নোলা। লোভী, হিংসুটে, ঝগড়াকুটে, ‘চিকেনহার্টেড’ ইনি হবেন সন্ন্যাসী! স্বামী মর্কটানন্দ। পৈতেটাই ফেলে দিয়েছে। গায়ত্রী জপতে বললে বারকতক ভুরভুর করে ঢোঁক গেলে। মানে তো দূরের কথা ওঁ নমো বিবস্ততে বলতে বিবস্ত্র হয়ে যায়। বেদান্তের পথে যাওয়ার মালই নয়। বড় জোর তন্ত্রের দিকে ঠেলতে পারো, তারপর পঞ্চ ‘ম’কারে লাট খেতে-খেতে হয় যক্ষ্মা হবে, না হয় পাগল হবে। তোমার বংশধর তখন বড় রাস্তায় উদোম হয়ে ঘুরবে।
বরং যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগটা শিখেছে, ‘এ স্লাই ফকস মেট এ হেন’ অবধি বিদ্যে পৌঁছেছে, সাড়ে সাত টাকার পোস্টাল অর্ডার জুড়ে পি এস সি-তে একটি জয় মা বলে দরখাস্ত ঠুকে দাও। তারপর ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে।
ঠিকই তো। যে পাঁঠার যেমন ভাগ্য। সেই দৃশ্যটা বারে-বারে মনে পড়ে। মানতের একটি কচিপাঁঠা, বেশ চানটান করেছে। লোটা লোটা ভিজে কান দুটো দুপাশে ঝুলছে। শীতের সকাল। মানতকারীর হাতে গলায় বাঁধা দড়িটি ধরা। জিভ বের করে মা জগদম্বা সামনে দাঁড়িয়ে। দুজনেই বসে। পাঁঠাটি মায়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ঠান্ডা বাতাসে শরীরটা থিরথির করে কাঁপছে। ওদিকে মন্দিরের পুরোহিত পরম উৎসাহে হাঁড়িকাঠে সিঁদুর মাখাচ্ছেন। আর একজন বেশ প্রমাণ সাইজের একটি খাঁড়া একমনে পালিশ করে চলেছে।
নিজেই নিজের জীবনের দড়িটি হাতে ধরে সংসারের চাতালে বসে আছি স্থির হয়ে। দুটো জিনিসই দেখতে পাচ্ছি, হাঁড়িকাঠও পাচ্ছি, খাঁড়াটিও পাচ্ছি। সবাই এসে ঘাড়ে একটু করে তেল মাখিয়ে যাচ্ছে। ওরে কত্তার গলাটি নরম রাখো, তা না হলে কোপ বেধে যাবে।
জ্ঞানী সলোমানরা বলেছিলেন—ওহে পাঁঠা, পাঁঠি জুটিয়ে জীবনটাকে বরবাদ করার আগে ‘থিঙ্ক টোয়াইস’। জ্ঞানের কথা শুনবে কে? যৌবনে খৈয়াম :
Oh, come with old Khayyam and
leave the wise
To talk; one thing is certain.
That life flies ;
One thing is certain and the Rest is lies;
The flower that once has blown for
ever dies.
তেলিয়ে-তেলিয়ে বেঁচে থাকা। ভবিষ্যৎ তোর অনিশ্চয়তার খাঁড়ায় শান দিচ্ছে। পরিস্থিতির হাত-ঘড়িটিকে বেশ মোলায়েম করে দিচ্ছে। জগৎ সংসারে আমার বহুবিধ ভূমিকা। কখনও চাটুকার, কখনও উমেদার, কখনও চালাক, কখনও বোকা, কখনও ভক্ষক, কখনও রক্ষক, কখনও পালক, কখনও পালিত। যার কাছে যেমনটি হলে আখেরে সুবিধে হয়, তার কাছে আমি তেমন। অফিসের বড়কত্তা ফাইলটা নাকের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন—মাথায় কিছু আছে? সঙ্গে-সঙ্গে বিনীত জবাব—আজ্ঞে না। পিতৃদেবও ওই কথা বলতেন।
সারা অফিসটা ছাগলে ভরে গেছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
আমিও এক ছাগল।
ভাগ্যিস হ্যাঁ বলে ফেলিনি। ‘ইয়েস’ আর ‘নো’র ব্যবহারটি ঠিক মতো রপ্ত করতে না পারলে প্রতিবেশীর বাগানে চরে খেতে হবে। তাড়া খেয়ে বেড়ায় পা আটকে ব্যাব্যা। আপনি কেন ছাগল হবেন স্যার? আপনি ‘ম্যান’, ‘সুপারম্যান’, ছাগলদের প্রতিপালক। তবে সঙ্গদোষেই ভুজঙ্গ।
শিশুর দাঁত উঠলে কামড়াতে চায়। ছাগলের কচি শিং উঠলে গুঁতোতে চায়। শিং যত পাকা হয়, বুদ্ধি যত ঝানু হয় তখনই সে বুঝতে পারে—যতই শিং সুড়সুড় করুক, সব জায়গায় ঢুঁ মোরো না। ঢুঁ-এর ‘কাউন্টার’ ঢুঁ সামলাতে পারবে কিনা বিচার কোরো। স্ত্রী-পুত্রকে মাঝে-সাঝে গুঁতিয়ে দেখতে পারো। তবে যুগ পালটেছে। সেখানেও কি সুবিধে হবে। মাঝে-সাঝে হুঙ্কার দিয়ে, আমি, আমি, হামি হামি করে দেখতে দোষ নেই। এ তো কর্মস্থল নয় যে, তোমরা আমিটাকে ‘পাংচার’ করে দেবে। এ তো রাস্তা বা যানবাহন নয় যে, আর—একটা তাগড়া-আমি থাবড়া মেরে বলবে, প্রমাণ কর, ব্যাটা, তোর আমির জোর।
বরং এই ভালো। রোববার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলুম—গোলগাল গেঞ্জি আর আপ টু-ডেট একটি লুঙ্গি পরে বাইরের ঘরে বসে আছেন কত্তা। চোখের সামনে কাগজ। চশমার চটাওঠা খাপটি সামনের টেবিলে। একপাশে একটি শুকনো চায়ের কাপ। নীল মতো একটা মাছি একবার করে কাপে বসছে তারপরই উড়ে এসে হাতের বড় বড় লোমে বসছে। কত্তার কর্মটি খালি হাত নেড়ে-নেড়ে মাছি তাড়ানো। ইনি রেশান কার্ডে বাড়ির কত্তা। ইলেকট্রিক বিলে কত্তা। ছেলেমেয়ের খাতায় কত্তা। বাকি সবেতেই কর্ম। বাজারের ব্যাগটি নামিয়ে কাগজ খুলছেন। আরও বারকতক বাজার-দোকান হবে। আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে মিউমিউ করে বলবেন—এখন এই চলছে না কি রে? হ্যাঁ, এইটাই তো লেটেস্ট। ঘাড় থেকে পা এখন এই কাট।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাববেন, গজ-কতক ব্যান্ডেজের কাপড় কিনে কোমরের ওপর দিকটায় অন্তত জড়িয়ে দিতে পারলে হত। এতটা ‘একসপোজার’ ভালো কি? পুরোনো আমলের ক্যামেরায় নাকি বেশি একসপোজার দিতে হত, এখন বুঝি ‘অবজেক্টে’ বেশি দিতে হয়। তা দাও। তবে বিবাহের আগে অনেক চোখের ক্যামেরা সামলাতে হবে!
বিকেলের দিকে চওড়া-পাড় শাড়ি পরে গিন্নি বলবেন, চলো, একটু ‘অ্যামিউজমেন্ট’ করে আসি। বেশ দগদগে, রগরগে বোম্বাই ছবি। মুখে জোড়া পান, তার ওপর জর্দা। দেখি, তুমি ডান পাশটায় এসো, আমি বাঁ-দিকে যাই পিচ ফেলতে-ফেলতে। কি ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছ চার পাশ, পা চালিয়ে চল না।
আর তখনই মনে হয়, আমার গলায় একটা দড়ি বাঁধা, অসহায় ছাগল, টানতে-টানতে নিয়ে চলেছে। ইচ্ছে নেই। পায়ে-পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। ‘যাচ্ছি তো চলো না।’ ছাগলের ভাষায় অনুবাদ করলে—ভ্যা-অ্যা।