ছাই চাপা স্বপ্ন
যতদূর চোখ যায়, পেনফেল্ড নদীর নীল পানিতে ভেসে থাকা জাহাজগুলো ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। আকাশে এলোমেলোভাবে উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা গাংচিল। বেশ দূরে ব্রেস্ট বন্দর। ফ্রেঞ্চ নৌবাহিনীর সদর দপ্তর। ফ্রেঞ্চ অ্যাডমিরাল জাহাজের রেলিঙে হেলান দিয়ে পেনফেল্ড নদীর নীল পানির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। নদীর পানিতে তার লম্বা ছায়া পড়েছে।
পেছনে দাঁড়িয়ে ফিরোজ। দিনটা তার কাছে দুটো কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, তিনি বারো বছর পরে আজ দেশে ফিরে যাবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি এই প্রথম এডমিরালের সামনে কোন সামরিক পোষাক ছাড়া দাঁড়িয়ে আছেন। তার গায়ে নীল জিন্সের হাফহাতা শার্ট। পরনে অফ হোয়াইট গ্যাবার্ডিনের ট্রাউজার। নরম রোদে তরুন ফিরোজের কালো চুলগুলো চিকচিক করছে।
অ্যাডমিরাল ফিরোজের দিকে না তকিয়েই বললেন, “তোমার এই দেশে অনেক চমৎকার একটা ভবিষ্যত ছিল হক। জানি না তুমি কেন দেশে ফিরে যাচ্ছ। তোমার দেশের মানুষরা শুনেছি খানিকটা লুনাটিক হয়। তাদের কাছে মেধার থেকে অর্থের দাম বেশি। সত্যি?”
“লুনাটিক হলে আর দেশে ফিরতাম না স্যার। এখানেই থেকে যেতাম।” ফিরোজ একটু হেসে উত্তর দিল।
“কেন দেশে যাচ্ছ বল তো? তুমি নিজেও হয়ত জানো না তুমি কত কঠিন কঠিন পরীক্ষায় অবলীলায় উতরে গিয়েছ। তুমি তোমার দেশের মানুষদের থেকে আলাদা, হক। আগে আমি তোমার দেশ সম্পর্কে তেমন একটা জানতাম না। তোমাকে দেখেই তোমার দেশকে নিয়ে আগ্রহ বোধ করেছি। তারপর তোমার দেশের ইতিহাস যতদূর পড়েছি, তোমার দেশের মানুষ আজীবন শাসিত হয়েছে। আফগান, মারাঠি থেকে শুরু করে ইংলিশরা পর্যন্ত তোমাদেরকে চাকর বানিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, পৃথিবীতে যতগুলো চাকর জাতি আছে, তাদের ভেতর তোমার জাতি একটা। কিন্তু তোমার ভেতরে আমি সেই দাসত্ব দেখিনি। তোমার ভেতরে ‘মেনে নেওয়া বা মানিয়ে নেওয়া’ জিনিসটা নেই। তুমি অবশ্যই তোমার লোকদের থেকে আলাদা।”
“আলাদা বলেই ফিরে যাচ্ছি স্যার। আজীবন দাস হয়ে কাটানো জাতিটার আমাকে ভীষণ দরকার। আমি সেরকমই মনে করি। তাছাড়া….”
“তাছাড়া?”
“দাস হওয়াটাও মাঝে মাঝে প্রয়োজন।”
“কিভাবে?”
“নেতৃত্ব দিতে গেলে আগে অনুসরণ করা শিখতে হয়। এটা জরুরী।”
“তারমানে তুমি মনে কর তোমার দেশের লোকেরা অনুকরণ করা শিখছে? একদিন তোমার দেশ অন্যদেরকে শাসন করবে বলছ?”
“নেতৃত্ব দেওয়া আর শাসন করা আলাদা জিনিস বলে আমি মনে করি। আমরা জাতি হিসেবে হয়ত নেতৃত্ব দিতে পারি। কিন্তু শাসন আর শোষণ করাটা আমাদের রক্তে মনে হয় সত্যিই নেই। আমরা জানি শাসিত হওয়ার কি জ্বালা।”
অ্যাডমিরাল এবার ফিরোজের দিকে তাকালেন। তারপর দূরে সারি সারি জাহাজগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো কিসের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে জানো ফিরোজ? ফিরোজ ইচ্ছা করেই বললেন, “না স্যার।” অ্যাডমিরাল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “এগুলো শুধুমাত্র জ্ঞানের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। তুমি যত বেশি পড়াশোনা করবে, মানুষকে তত বেশী বুঝতে পারবে। আর যত মানুষকে বুঝতে পারবে তত তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।” ফিরোজ মাথা নাড়ালো।”তুমি এই জাহাজ টাহাজ সব দখল করে নিতে পারবে। কিন্তু জ্ঞান দখল করে নেওয়া যায় না। হয় অর্জন কর, নয়ত ধ্বংস করে দাও। অশিক্ষিত মানুষদেরকে সহজেই শাসন করা যায় ফিরোজ। মানে, নিয়ন্ত্রণ করা যায় আর কি। কারণ তাদের ভেতরে জ্ঞান নেই। তাদেরকে ধর্ম দিয়ে কেনা যায়, রাজনীতির মিষ্টি কথা দিয়ে কেনা যায়, তাদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে ধর্মের নামে আর ক্ষমতার নামে ইচ্ছা মত ব্যবহার করা যায়-আমার অভিজ্ঞতা সেটাই বলে। কিন্তু এটা ধ্রুব সত্য যে, জ্ঞান জ্ঞানের জন্ম দেয় হক। আর অস্ত্র জন্ম দেয় রক্তের।”
কথাগুলো থেমে থেমে অনেক সময় নিয়ে বললেন অ্যাডমিরাল। তার কথা বলা থামতেই মাথার ওপরে উড়তে থাকা শঙ্খচিলগুলো ডেকে গেল।
ফিরোজ মাথা নেড়ে মুচকি হেসে বললেন, “আমি পড়াশোনা করব স্যার। আপনার মত হয়ত সপ্তাহে একটা বই শেষ করতে পারব না, তবে তার কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করব। আমার দেশে ফেরার উদ্দেশ্যগুলোর এটাও একটা।
“শেষ দিনে এসে দর্শন নিয়ে কথা বলছি বলে বিরক্ত লাগছে না তো হক?” অ্যাডমিরাল মুচকি হেসে বললেন।
ফিরোজ বললেন, “না স্যার। একদম না। আজ আপনার আশেপাশে কোন গার্ড দেখছি না স্যার?”
অ্যাডমিরাল হাসতে হাসতে বললেন, “তুমি অনেক আলাদা। তাই ভাবলাম তোমার সামনে আমিও আজ একটু আলাদা হয়েই যাই। তুমি তোমার দেশকে অনেক কিছু দেবে হক। আমি জানি সেটা।” তারপর পকেট থেকে একটা খাম বের করে ফিরোজের দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। একটা হালকা হলুদ রঙের খাম। ফিরোজ খামটা হাত বাড়িয়ে নিলেন। অ্যাডমিরাল বললেন, “এটা আমার ব্যক্তিগত উপহার। একটা ছোট্ট চিঠি আছে।”
ফিরোজ একটা স্যালুট দিল। তারপর খামটা নিল।
অ্যাডমিরাল বললেন, “আশা করি এই খামটা দরকারের সময় তোমাকে সাহায্য করবে হক। আর রিসিপশনে তোমার জন্য একটা বই রেখে দিয়েছি। জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘অন লিবার্টি”। মনে করে নিয়ে যেও।”
ফিরোজ হেসে বলল, “শিওর স্যার।” অ্যাডমিরাল ফিরোজের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “চল। আজ আমার সাথে লাঞ্চ করবে।”
ফিরোজ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে নিজের ছায়াটা এডমিরালের পায়ে স্পর্শ করালো।
***
দরজায় নক করার শব্দে মেজর জেনারেল ফিরোজের ধ্যান ভাঙল।
সামনের দেয়ালে ঝোলানো টিভিতে সিসিটিভির অনেকগুলো বর্গ দেখা যাচ্ছে। তারই একটায় ফিরোজ দেখলেন, নাসরিন সুলতানা। তার অফিস অ্যাসিট্যান্ট।”আসো” ফিরোজ চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন।
দরজা ঠেলে নাসরিন ঢুকল। রোগা গড়নের একটা মেয়ে। শরীরের চেয়ে মাথাটা যথেষ্ট বড়। কোঁকড়া কোঁকড়া চুলে সেই মাথা আরও বড় লাগছে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। নাসরিন বাম হাতে ধরা ফাইলগুলো টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, “স্যার, সন্ধ্যা সাতটায় আশফাক স্যারের বাসায় মিটিং আছে। রাসেলকে গাড়ি আনতে বলব স্যার?”
আশফাক চৌধুরী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
নাসরিনের মনে হল, মেজর জেনারেল যেন ভেতরে ভেতরে অনেক ভেঙে পড়েছেন। চেয়ারের পেছনে অগোছালভাবে স্যুটটা ঝুলছে। রুমটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তারপরও মেজর ফিরোজের কপালে ঘাম। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তিনি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন।
“হ্যাঁ মনে আছে।” ফিরোজ বললেন।”রাসেলকে গাড়ি আনতে হবে না। আমি ড্রাইভ করব।”
“আচ্ছা স্যার।” নাসরিন মাথা নাড়ল। আজ আট বছর নাসরিন এই মানুষটার সাথে কাজ করছে। এত ভেঙে পড়তে কখনও দেখা যায়নি তাকে।
নাসরিন টেবিলের বাম দিকে রাখা কয়েকটা ফাইল উলটে পালটে দেখল। তারপর সেগুলো গুছিয়ে হাতে নিয়ে বলল, “কিছু লাগবে স্যার?”
ফিরোজ বললেন, “আমি জানি না জেনারেল আর আশফাক চৌধুরী এই প্রকল্পের ব্যাপারে কিভাবে জানলেন? এই প্রকল্পটার ব্যাপারে সব থেকে বেশি গোপনীয়তা বজায় রাখা হয়েছিল। আমাদের এজেন্সীর ভেতরে কি তাহলে কেউ তথ্য পাচার করছে নাসরিন?”
নাসরিন কিছুই বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
“আমি চাই তুমি টিকটিকিটাকে খুঁজে বের কর নাসরিন। আজ জেনারেল জানতে পেরেছেন, কাল যে কোন মিডিয়া জানবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।”
নাসরিন মাথা নেড়ে বলল, “জী আচ্ছা স্যার।”
ফিরোজ কফি মেকারের কেতলি থেকে মগে কফি ঢাললেন। নাসরিন তখনও ফাইল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিরোজ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, “তুমি এখন আসতে পারো নাসরিন।”
নাসরিন চলে গেল।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই বদ্ধ রুমে এসির চাপা শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এটা রাজধানীর একটা চারতলা বাড়ির বেজমেন্ট। অফিসিয়াল কাজগুলো হয় তৃতীয় আর চতুর্থ তলায়। মিলিটারি রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস ইউনিটের (MRAU) অস্থায়ী সদর দপ্তর। বাইরে একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানীর সাইনবোর্ড লাগানো আছে। আছে কয়েকটা কোচিং সেন্টারের ব্যানার। যেখানে ইচ্ছা করেই অনেকগুলো বানান ভুল করে রাখা হয়েছে। জং ধরা বন্ধ গেটের বাইরে আবর্জনার স্তূপ। প্রথম প্রথম ইচ্ছে করেই আবর্জনা এনে স্তুপ করে রাখা হত। এখন আশেপাশের মানুষই রোজ এখানে আবর্জনা ফেলে যায়। বাইরে থেকে আর আবর্জনা আনতে হয় না। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কি হয়।
আজ থেকে আট বছর আগে ফিরোজ অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই সংস্থাটা গড়ে তোলেন। সংস্থাটি গড়ে তুলতে ফিরোজকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে প্রথম দিকে। জেনারেল তাকে প্রথমে সহযোগিতা করেননি।
একদিন গলফ ক্লাবে গলফ খেলতে খেলতেই ফিরোজ কথাটা তুলেছিলেন। জেনারেল প্রথমে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। পরে বললেন, “তুমি এক কাজ করো না। একটা স্কুল দাও? না হলে কোন বিজনেস করো? আমি ইনভেস্ট করব। সেনাবাহিনীর এখন তো সবাই দেশ রক্ষা বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে, স্কুল খুলছে, টিভি চ্যানেল খুলছে। তুমিও সেরকম কিছু একটা করো না। সিকিউরিটি সার্ভিস খুব কমপ্লিকেটেড একটা ব্যাপার ফিরোজ। দক্ষ লোক লাগে। অনেক টাকা লাগে। তুমি ওসব করতে যেয়ো না।”
“আমি একটা স্বপ্ন নিয়ে এদেশে এসেছি জেনারেল।” ফিরোজ আবার সেই স্বপ্নের কথাটা বললেন। গোয়েন্দাগিরি বা অন্যের গোপনীয়তায় নাক গলানোর জন্য না, শুধুমাত্র গবেষণার জন্যই একটা ইন্টেলিজেন্স মেজর জেনারেল ফিরোজের স্বপ্ন।
যখন জেনারেল শুনেছিলেন যে ফিরোজ সরকারি সাহায্য চান তখন আরও বেঁকে বসলেন। অবসরে যাওয়া অনেক সামরিক কর্মকর্তারা নিজ উদ্যেগে প্রাইভেট সিকিউরিটি সার্ভিস খোলে – এটা স্বাভাবিক। কিন্তু চাকরিরত অবস্থায় কেউ একটা সিক্রেট সিকিউরিটি এজেন্সি খুলতে চাইবে, তাও আবার সরকারি উদ্যোগে- এটা একেবারেই মামা বাড়ির আবদারের শ্রেণীতে পড়ে যায়।
জেনারেলকে রাজি করাতে ছয় মাস লেগেছিল ফিরোজের। জেনারেলকে তাও রাজি করানো গিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মহোদয় সৈয়দ তফিসুল বারীকে একা পাওয়াটা ছিল আরেক ঝামেলা। আরও দু’মাস অপেক্ষার পরে এক সন্ধ্যায় তফিসুল বারীর সাথে কথা বলার সুযোগ পেলেন ফিরোজ। সঙ্গে জেনারেলও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ তফিসুল বারী রাশভারী মানুষ। এক সময় নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। তার বারো বছরের রাজনীতি জীবন রহস্যময়। শিক্ষকতা ছেড়ে যোগ দেন ন্যাশনাল লিবারেল ফ্রন্টে। পার্টির প্রধান নির্বাচনে এগিয়ে থাকা প্রণয়সিংহ কর্মকারের রহস্যময় মৃত্যুর পরে তফিসুলই হন পার্টির প্রধান এবং পরে প্রধানমন্ত্রী। তার নামে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন মামলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কোনটাই প্রমাণ করা যায়নি। তাছাড়া জনসাধারণের কাছে তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে। মেজর জেনারেল ফিরোজের প্রস্তাবে তিনি বললেন, “আপনি বেসরকারি সিকিউরিটি সার্ভিস কেন খুলছেন না? “
“আমি দেশকে নিয়ে কাজ করতে চাই স্যার। সেই জন্যই দেশে ফিরে আসা। তাছাড়া সিকিউরিটি এজেন্সি খোলাও আমার উদ্দেশ্য না। একটা মিলিটারি রিসার্চ ইন্সটিটিউট খুলতে চাচ্ছি।”
“দেশ আর সরকার তো এক না মেজর জেনারেল। আপনি একটা বেসরকারি সিকিউরিটি এজেন্সি খুললে সেখানেও গবেষণা করতে পারেন। তাছাড়া সরকারিভাবে আমাদের একটা সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স তো আছেই।”
“আমি সরকারি সিক্রেট ইন্টেলিজেন্সের কথা বলছি না স্যার। আমি এমন একটা ইন্টেলিজেন্সের কথা বলছি যেখানে গবেষণার ওপরে জোর দেওয়া হবে। আমি শুধু আপনার সাহায্য আর সমর্থন চাচ্ছি। বাকিটা আমিই পারব।”
“কি ধরণের সাহায্য?”
“তথ্য, স্যাম্পল, আরও ভালোভাবে বলতে গেলে রিসোর্স। আপনি সাহায্য করলে আমরা যেকোন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারব স্যার। আর এই গবেষণাগুলো থেকে দেশের মানুষই বেশি উপকৃত হবে।”
“মেজর জেনারেল, আপনাকে একটা কথা বলি। গরীব দেশের প্রাইভেসি বলে কিছু থাকে না। আমাদেরকে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সামনেই গোসল করতে হয়। এতটুকু গোপনীয়তার গন্ধ পেলে প্রতিবেশী দেশগুলো সেই গন্ধের উৎস খুঁজতে শুরু করে। একটা সিক্রেট এজেন্সী খোলা হবে আর প্রতিবেশী দেশগুলো চুপচাপ বসে থাকবে- এমনটা হয় না। আপনি একটা টিনের ছাপড়া ঘরে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি আনলে সেই গাড়ির সাথে সাথে আরও অনেক প্রশ্নও আসবে। গরীব মানুষের গোপনীয় কিছু থাকে না মেজর জেনারেল। আপনার উদ্দেশ্যটা আমি বুঝেছি। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল করার সময় এখনও আসেনি। আমি জানি না জেনারেল কিভাবে এটাকে অ্যাপ্রুভ করলেন, কিন্তু আমি এই অনিশ্চিয়তার সাথে সরকারকে জড়াতে চাচ্ছি না। আর সব তথ্য দেওয়ার নিয়ম নেই, আপনি তো জানেনই।”
“ভবিষ্যত অনিশ্চিত স্যার। আমার ওপরে একবার ভরসা করেন। আমি এই স্বপ্নটা নিয়েই দেশে এসেছি।”
কথা আর বেশিদূর গড়াল না। প্রধানমন্ত্রী ‘আশ্বাস’ দিয়ে সেদিন উঠে চলে গেলেন। চলে গেলেন জেনারেলও।
এইসব সিক্রেট সিকিউরিটি সার্ভিস থেকেই পরে ক্যু হয়। গবেষণা টবেষণা ওসব বাহানা। এগুলা বেয়াড়া সৈন্য তৈরির কারখানা। আজ অনুমতি দিলে কাল এই ইন্টেলিজেন্সই যে তার বিপক্ষে দাঁড়াবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তিনি ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন তৈরি করবেন না। অনুমতি দেওয়া যাবে না। ইয়ার্কি নাকি! প্রধানমন্ত্রী মহোদয় তফিসুল সাহেব এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আর ভাবেননি।
মেজর জেনারেলকে সেদিন সাহায্য করেছিল ফ্রেঞ্চ এডমিরালের সেই চিঠি। কি লেখা ছিল চিঠিতে ফিরোজ পড়ে দেখেননি কখনও। কিন্তু পরদিন প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিটা দেখানোর পরেই প্রধানমন্ত্রী এজেন্সীটার ব্যাপারে রাজি হয়ে যান।
রাজি হন কয়েকটা শর্তে, এজেন্সীর সাথে সরকারের প্রত্যক্ষ কোন সম্পর্ক বাইরে প্রকাশ করা যাবে না। এজেন্সীর প্রতিষ্ঠাতা যে মেজর ফিরোজ এটাও গোপন রাখতে হবে। এজেন্সীর কোন ধরণের কাজে সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে জড়ানো চলবে না। আর প্রতি সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট করতে হবে- কি নিয়ে কাজ চলছে, কারা কাজ করছে, কয়জন লোক নিয়োগ করা হল। তাদের বেতন শীট, তাদের ঠিকানা থেকে শুরু করে অতীতের কোন বিশেষ তথ্য- সব কিছু। আর যেকোন প্রজেক্ট বা মিশন হাতে নেওয়ার জন্য অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে।
আট বছরে ফিরোজ কখনও সরকারকে জড়াননি। নিজের অর্থায়নেই প্রথম তিন বছর টেনে নিয়ে গিয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানটাকে। দেশ বিদেশের অনেক গবেষককে উনি এখানে গবেষণা করার সুযোগ করে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন মেধাবী ছেলে মেয়েদেরকে তিনি কাজের জন্য সব রকম সুযোগ করে দিয়েছেন। ফিরোজ জানতেন, কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। একটা পকেটমারকেও ঘষে মেজে অনেক বড় বড় কাজ করিয়ে নেওয়া যায়।
কয়েকটা প্রজেক্ট সফল হলে প্রধানমন্ত্রী খুশি হয়ে কিছু বার্ষিক অনুদান দিতে রাজি হন। পুলিশ বাহিনীর বম্ব স্কোয়াডের জন্য বেশ কয়েকটা গবেষণা আশাতীত ফলপ্রসূ হয়। সফলতা পায় স্পেশাল পুলিশ ফোর্সের ইউনিফর্ম বিষয়ক একটা গবেষণাও। কিন্তু সবগুলোই হয় ভীষণ গোপনে। কয়েক বছরেই ফিরোজ প্রধানমন্ত্রীর অনেক কাছের একজন মানুষ হয়ে যান। ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজনীয়তাও কমে যেতে থাকে। নিজের কাছে জবাবদিহিতা থাকলে অন্য কারও কাছে জবাবদিহিতার প্রয়োজন পড়ে না এটা স্বাভাবিক। ফিরোজ সেটা প্রমাণ করলেন। দেশের সবথেকে মেধাবী ছেলেমেয়েরা MRAU তে এসে গবেষণা করছে। চমৎকার চমৎকার সেইসব গবেষণা এই দেশটাকে সারা বিশ্বে তুলে ধরছে- নিজের স্বপ্নটা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের ভেতরেও ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন ফিরোজ।
কিন্তু সামান্য একটা প্রজেক্ট আজ তাকে এবং তার তিলতিল করে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠানকে শেষ করে দিতে চলেছে। প্রায়শ্চিত্ত প্রকল্প। এই প্রকল্পের জন্য তিনি লাশের ওপর দিয়ে হেঁটে এতদূর এসেছেন। তার পক্ষে পেছন ফেরা আর সম্ভব না। যা কিছু হোক। তিনি সামনেই এগিয়ে যাবেন। তার স্বপ্নটাকে বাঁচানোর জন্য তিনি কি কি করতে পারেন- তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ফিরোজকে কেউ কখনও থামাতে পারেনি। মেজর জেনারেল ফিরোজ যে আগুন ভেতরে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই আগুনে সবাই শেষ হয়ে যাবে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও এই আগুন নেভানোর সাহস করবেন না।
আজ সন্ধ্যায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আশফাক চৌধুরীর বাড়িতে ডাকা মিটিংয়ে তার এবং তার প্রতিষ্ঠানের ভাগ্য নির্ধারন হবে।
মেজর জেনারেল ফিরোজ কফির কাপটা নামিয়ে সামরিক পোষাক পরলেন। বাইরে তখন মেঘলা বিকাল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।
বিকাল পাঁচটায় একটা ল্যান্ডরোভার বেরিয়ে গেল MRAU এর অস্থায়ী এবং একই সাথে অনিশ্চিত সদর দপ্তর থেকে। ঠিক একই সময় বহরমপুর সদর থানা থেকে বেরিয়ে গেল একটা পুলিশ ভ্যান।
প্রথমটা একটা নিরপরাধ মানুষের লাশ হয়ে যাওয়ার কারণ, পরেরটা তার ফলাফল।