ষষ্ঠ খণ্ড (পরম পূজনীয়া পরিব্রাজিকা প্রজ্ঞা হৃদয়া করকমলে)
সপ্তম খণ্ড (স্নেহের অলোক রায়চৌধুরী ও ইন্দিরাকে)
অষ্টম খণ্ড (ডা: শ্রী বিজয়চাঁদ কুমার ও শ্রীমতী তপতী কুমার শ্রদ্ধাভাজনেষু)
5 of 6

ছাই

ছাই

বার্তা রটি গেল ক্রমে মৈত্র মহাশয় যাবেন সাগরসঙ্গমে। অনেকটা সেই রকম। ভীষণ অসুস্থ সে। গেল গেল অবস্থা। মাঝে-মাঝেই কুম্ভক হয়ে যাচ্ছে। স্বেদ, কম্প। নবদ্বারে লক আউট। ডাক্তার বদ্যি ফেঁড়ে ফেলছে। উকিলমশাই রেডি হয়ে আছেন লাস্ট টেস্টামেন্ট লিখে ফেলার জন্যে।

দিগবিদিক থেকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনরা আসছেন যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে জুতোর গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক চুরি নয়, এ ওরটা পরে চলে যাচ্ছে, ও এরটা। ইনভেরিয়েবলি নতুনগুলোই যাচ্ছে, পুরনোগুলো পড়ে থাকছে। ফলে, একটু অসন্তোষ, মানুষের চরিত্র তুলে কথা।

সবই কানে আসছে। কেউ এসেছেন বাদু থেকে, কেউ এসেছেন বারাসত থেকে, কেউ এসেছেন বেড়াচাঁপা থেকে। আসার কী কষ্ট! সেই সব কথা হচ্ছে। সংসার ছেড়ে বেরনো যায় সহজে! বড়টার পরীক্ষা, ছোটটার হাম, নিজের আবার আক্কেল দাঁত, সাত দিন হয়ে গেল কাজের লোক আসছে না, তার ওপর গ্যাস গেছে, কত কান্ড করে দেখতে আসা।

—কই দেখি, আহা, আহা, বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে গেছে। ক’দিনে কী চেহারা হয়েছে। একটু ভালো করে খাও দেখি চিকেন, টিকেন।

—খেতেই পারছে না!

—পারছে না বললে তো হবে না, খেতে হবে। তোমরা কী করতে আছ? যেভাবে মার খায়, সেই ভাবে খাওয়াবে। সোজা করে বসাবে, জোর করে হাঁ করাবে, আর ঠেলে ঢুকিয়ে দেবে।

—বের করে দেয়।

—আবার ঢুকিয়ে দেবে। খেতে হবে, না খেলে কী করে হবে! চড়া-চড়া সব ওষুধ।

প্রতিবাদীপক্ষ থাকবেই। তাঁদের একজন বললেন, ইচ্ছে না থাকলে জোর করে খাওয়ানো উচিত নয়। উলট ফল হবে! এখন বরং ফলপাকড়ের ওপর রাখাই ভালো। শরীর যখন নিচ্ছে না, তখন জোর করে চিকেন খাওয়ালে টকসিন হয়ে তিন দিনেই টেসে যাবে।

—আরে ফলে কী আছে, ফলের স্ট্রেংথ কতটুকু! এইটটি পার্সেন্ট জল, টোয়েন্টি পার্সেন্ট ভিটামিন সি, সুক্রোজ, ফ্রুকটোজ, গ্লুকোজ। তখন থেকে ফল-ফল করছ। ফলের সুফল ‘নিল’। খালি পেটে ফল খাওয়া মানে সিরোসিস অফ লিভার।

—বাজে বোকো না, সেকালে মুনিঋষিরা কী খেতেন?

—এ মুনিও নয়, ঋষিও নয়। সেকালে পোস্টমর্টেম ছিল না, থাকলে দেখা যেত নাইনটি পার্সেন্ট সিরোসিস অথবা বি হেপাটাইটিস।

—তোমার মাথা, এক একজন মুনি তিনশো-চারশো বছর বাঁচতেন। সব ইচ্ছা মৃত্যু। ইচ্ছে হল, ধপাস করে পড়লেন, মরে গেলেন।

—যাক, অত তর্কে কাজ নেই, এখন এ কী খাবে, সেইটাই হল কথা।

—খিদে না পেলে কিছু খাব না।

—কঙ্কাল হয়ে যাবে যে।

—যাক, মানুষ মরে, কঙ্কাল মরে না। ও যদি ঠিক-ঠিক কঙ্কাল হতে পারে, এ যাত্রা বেঁচে গেল।

টালিগঞ্জ থেকে একজন এলেন, ঘরে ঢুকেই বললেন, যা:, সর্বনাশ হয়ে গেল!

আর একজন আশ্বাস দিলেন, না, না, এখনও হয়নি, জাস্ট ইন টাইম। প্রাণ এখনও লেগে আছে।

—দূর মশাই, এখানে আসতে গিয়ে পিকপকেট হয়ে গেল। ব্যাগে হাজার এক টাকা ছিল। ভেবেছিলুম একটু আঙুর কিনে আনব, সে আর হল না। যথাসর্বস্ব গেল।

—টাকাটা ছিল কোথায়?

—টাকা কোথায় থাকে? আজ ইউজুয়াল ইন এ ব্যাগ।

—অ্যান্ড হোয়ার ওয়াজ দি ব্যাগ!

—ইন দি হিপ পকেট!

—ব্যাস, একটা কথা বলবেন না, নট এ সিংগল ওয়ার্ড। মাছের জন্যে টোপ ফেলবেন, খেয়ে গেলে বুক চাপড়াবেন, ওসব নকশা আমরা অনেক দেখেছি।

কোণের দিকে দর্শনার্থী দুই স্বজনে হুলোর যুদ্ধ চলেছে। চোখ বুজিয়ে মরণাপন্ন রুগি শুনছে। হাতাহাতি হল বলে। পঞ্চানন ঘোষালের ‘পকেটমার’ বইটা পড়ে দেখতে অনুরোধ হয়।

—হু ইজ পঞ্চানন।

—যার এই নলেজ তার পকেটমার হবে না তো, আমার হবে!’

—আপনি কোন নলেজ দেখাচ্ছেন মশাই আমাকে! কোনও নলেজেই পকেটমারের নলেজকে ঠেকানো যাবে না, আন্ডারস্ট্যান্ড!

—অ্যায়, এই কথাটিই বলতে চাই। এই নলেজের আন্ডারে স্ট্যান্ড করুন। টাকা যেখানেই রাখুন মারবেই মারবে।

—রাইট! কিন্তু উপায়! পথ চলতে কড়ি। খালি পকেটে তো আর রাস্তায় বেরনো যাবে না!

—কেন যাবে না! এর তার কাছে ধার করে চালিয়ে দেবেন। যারা ধার নেয়, তাদের কাছেই পাওনাদার আসে। ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বসে থাকবেন, তারা এসে পাওনা বুঝে নিয়ে যাবে। শুনুন মশাই, এই কালটা হল কোকিলের কাল। কাকের বাসায় ডিমটি পেড়ে দিয়ে কেটে পড়ুন। এই যে বিরাট-বিরাট ইন্ডাস্ট্রি, সব পরের পয়সায়। নিজের ইনভেস্টমেন্ট নিল! একটা গান মনে আছে! দম মারো দম। সেইটাকেই একটু মডিফাই করলে এ কালের ন্যাশনাল সং—দাঁও মারো দাঁও।

হঠাৎ মনে পড়েছে, কই হে তোমাদের চা কোথায় গেল! কেউ পেল কেউ পেল না। দ্যাটস ভেরি ব্যাড। একালের মেয়েরা সব ক্যালাস। আমাদের কালে কী সব চোখ ছিল! ছাতে উঠে দেখলে, সেই মোড়ের মাথায় জ্যাঠামশাই আসছে, তর তর করে নেমে গিয়ে কেটলিতে এক কাপ জল ঢেলে দিয়ে এল।

—অসুখবিসুখের বাড়িতে অত খেয়াল থাকে কী? আপনি চা খেতে এসেছেন না রুগি দেখতে?

দুটোই। চা খেয়ে, দু-পাঁচ কথা কয়ে, অ্যাটেন্ডেনস নোট করিয়ে চলে যাওয়া। আমাদের ফর্মালিটি দেখতে আসা, তোমাদের ফর্মালিটি চা। চা তো আর রুগি করবে না, করবে তার বউ।

ইতিমধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ একজন অসুস্থ মানুষটির কপালের দখলদারি পেয়ে গেছেন। কেউ অসুস্থ হলেই কপাল টেপা ইজ এ মাস্ট। কপাল ছোঁয়া মানে চূড়ান্ত দেখা। একেবারে ইনার সার্কলে চলে আসা।

খুব টিপটিপ করছে তো! করবেই। আমার কিছু হলেই ফার্স্ট অ্যাটাক কপালে। গেল-গেল অবস্থা। চোখ বুজোও। জাস্ট রিল্যাক্স। কপাল এখন আমার হাতে।

ভদ্রলোক বাজান সেতার। আঙুলে গুটলে-গুটলে কড়া। সেই আঙুল চোখের তলা দিয়ে পাক মেরে ভুরু ছেঁচে যখন দু-পাশের রগে গিয়ে কাপ মেরে বসেছে, তখন মনে হচ্ছে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কপালের নুন ছাল উঠে যাওয়ার দাখিল। বলা যাবে না। তবু একবার বলা—খুব আরাম পেয়েছি, আর থাক, অনেকক্ষণ টিপলেন, আপনার কষ্ট হবে।

—আমার কষ্ট! সকালে তিন, রাতে পাঁচ, মোট আট ঘণ্টা রেওয়াজ করি। এখনও, এই বয়েসে! দিস ইজ এ শরীর মেড অফত স্টিল। ইচ্ছে করলে এ আমি ঘণ্টা তিনেক চালাতে পারি অক্লেশে।

মানুষ ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তার চেয়ে বড় সমর্পণ অন্যের হাতে নিজের কপাল।

জনৈক মহিলা তাঁর মেয়েকে বলেছেন, চুপ করে বসে না থেকে কাকুর আঙুলগুলো একটু মটমট করে দে-না, তুই তো খুব ভালো পারিস, এই তো সেবার আমার জ্বরের সময় করে দিচ্ছিলিস! আ:, সে কী আরাম।

মরেছে, কপালে বুলডোজার, আঙুলে বাংলা পুলিসের থার্ড ডিগ্রি। অনেকের আঙুল সহজেই মট করে, দুর্ভাগ্য, এর আঙুল জীবনে মট হয়নি। মেয়েটি মহোৎসাহে এক একটি আঙুল ধরছে আর আপ্রাণ চেষ্টা করছে, মটকে শব্দ বের করার।

এদিকে একজন পায়ের দিকে চলে গেছে। ময়দা ঠাসার কায়দায় গপাগপ খাবলে যাচ্ছে। মাঝে-মাঝে পায়ের ডিম দুটো ধনুকের ছিলে টানার কায়দায় টেনেই ছেড়ে দিচ্ছে, তখন সুপুরি টাইট হয়ে বাবারে, মারে অবস্থা!

নড়া চড়া করলেই সমবেত সেবাকারী আর দর্শকরা একযোগে বলে উঠছেন, ‘ওইখানটা, ওইখানটা!’ সঙ্গে-সঙ্গে আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হচ্ছে সেই জায়গাটা। পুরো ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে—সবে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।

এতক্ষণ যাঁরা কুলু-মানালি ভ্রমণের আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের মনে হল, কিছু জিগ্যেস করা উচিত—এর প্রবলেমটা কোথায়?

—ধরা যাচ্ছে না—এক মতে, নন ফাংশানিং কিডনি, গলব্লাডার, হার্নিয়াও হতে পারে, আর এক মতে ভাইরাল জন্ডিস অথবা সিরোসিস।

—সাংঘাতিক ব্যাপার। কলকাতার ট্রাফিক জ্যামের চেয়েও মারাত্মক। বাড়িতে ফেলে রেখেছে কেন?

—রাখেনি তো! কে রাখতে চায়! বাধ্য হয়ে পড়ে আছে। মেয়ের পাত্র খোঁজার মতো নার্সিংহোম খোঁজা হচ্ছে। কে কত পণ চায়। বাজেটের মধ্যে এলেই ট্রান্সফার!

দেখুন, গরুদের কী মজা! সব গরুই এক গরু, এক ভেটিনারি হাসপাতাল। মানুষের কত রকম!

—কোথাও কিছু জোটেনি!

—ওই যে বললুম, চেষ্টা চলেছে।

—আমাদের দিকে একটা আছে, হাফ চার্জ। হাফ হওয়ার একটাই কারণ, খাটগুলো সব পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে আটকে গেছে। হাতল মারলেও ফ্ল্যাট হচ্ছে না। মানিয়ে শুলেই হল। কখনও পা ওপরে মাথা নীচে, কখনও মাথা ওপরে পা নীচে। মৃত্যুকালে পা দুটো ওপরে রাখলেই হল—কথাতেই তো আছে—ঠ্যাং উলটে মারা গেল, কিক দি বাকেট। বলো তো খোঁজপাত করে দেখি!

—আমরা কমসমে একটা পেয়েছি, সেটার বাথরুম নেই। ভাবছি, বাথরুমের তো প্রয়োজনই হবে না। একদিকে নল চলবে, ওদিকে ইউরিন্যাল আর বেডপ্যান!

—তাহলে দুটোরই রেট নেওয়া যাক। যেটা লোয়েস্ট হয়!

—আরে ভাই বিরাট সমস্যা তো অন্যখানে।

—সে টাকাটাও নেই! লোয়েস্টের লো হয়ে আছে?

—বলতে পারো একেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থা।

—যখন খুব লপচপানি ছিল, তখন কত সাবধান করেছি, ওরে অত উড়াস না, অত উড়িস না। ইংরিজি, বাংলা, সংস্কৃত তিনটে ল্যাঙ্গোয়েজেই উপদেশ দিয়েছি, তুমি জানো, আমার পিতামহ শিক্ষক ছিলেন। সেকালের বসুমতীতে তাঁর জীবনী ছাপা হয়েছিল। সেই ব্লাড আমার শরীরে।

—আপনার বাবা তো চাল-ডালের ব্যবস্থা করতেন। মজুতদারি আইনে জেল খেটেছিলেন প্রফুল্ল সেনের আমলে।

—অ্যায়! একেই বলে বাঙালি! কী ঘটে আর কী রটে! বাবা জেলে গিয়েছিলেন বাম রাজনীতি করতেন বলে! অমনি রটে গেল মজুতদার। কিছু বলার নেই ভাই। চরিত্রহননে বাঙালি তুলনাহীন!

—আপনাদের পরিবারকে সেই কারণেই কি সবাই বামাচারী বলে!

—বামাচারী শব্দটা কি খুব ভালো?

—ভালো নয় কেন? সাধনের কথা। তন্ত্রের কথা।

—শোনো ছোকরা, এই সব কথা তোমরা ঈর্ষায় বলো। এক বাঙালি একটু রাইজ করলেই আর এক বাঙালির বক্ষদেশ ফেটে যায়।

—যাক, ওসব কথা থাক, আপনি কী উপদেশ করেছিলেন শোনা যাক, নিজের জীবনে যদি গ্রহণ করতে পারি!

—অনেক দিন থেকেই লক্ষ করছিলুম, ছোকরার-আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। যে গঙ্গার ইলিশে আমরাই হাত দিতে সাহস পাই না, সেই ইলিশ ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছে! জিগ্যেস করলুম, বাঁ হাতের কামাই আছে? বললে, না। আমি বললুম, তাহলে এই আত্মঘাতী কাজটি কেন। শাস্ত্র কী বলছেন জানো! বললে, শাস্ত্র ফাস্ত্র মানি না কাকাবাবু। এ জিনিস চোখে দেখে ছাড়া যায় না।

আমি বললুম, শোনো ইদমেব সুপাণ্ডিত্যং চাতুর্যমিদমেব চ! ইদমেব সুবুদ্ধিত্বমায়া দলপতরো ব্যয়:।।

—খুবই কঠিন উপদেশ, মানেটাই বোঝা গেল না।

—যদি কোনও ব্যক্তি তার যা আয় তার থেকে কম ব্যয় করার কৌশল দেখাতে পারে, তবে তা হবে তার গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয়, সেটাই হবে তার চতুরতার লক্ষণ এবং সেটাই হবে তার উত্তম বুদ্ধির পরিচয়। কারণ আয়ের চেয়ে কম ব্যয় করার কৌশল সকলের জানা নেই। সোজা কথা, কাট ইওর কোট অ্যাকর্ডিং টু ইওর ক্লথ।

—এটা কিন্তু দেবভাষার উপদেশ নয়। বিলিতি। সঞ্চয়ের সাজেশান নেই। যত্র আয় তত্র ব্যয়। সঞ্চয়ের উপদেশ হল, ফুল প্যান্টের রোজগার হলে হাফপ্যান্ট পরো। তাহলে কী হল, বাকি হাফ ব্যাংকে গেল।

—ওটা আবার বাড়াবাড়ি। আসল কথা হল, ওয়েস্ট নট ওয়ান্ট নট। মনে আছে তো সেই কবিতা, যে জন দিবসে মনের হরষে।

—মনে নেই আবার! পুরুষানুক্রমে শুনতে শুনতে রক্তে চলে গেছে। আমার বাবা আমার মাকে বলতেন, আপনার বাবা আপনার মাকে বলতেন। তারপর, ইলেকট্রিক এসে গেল। দিবস কেন, রজনীর প্রথম প্রহর আলোকিত করতেই মাসে হাজার।

—কী আলোচনা হচ্ছে হে তোমাদের! একটু পরেই এক স্পেশালিস্ট আসছেন শুনলুম। আসছেনই যখন, যত কাজ থাক রেজাল্টটা শুনে যাই। এই অভ্যাসটা আমার ক্রিকেট থেকে হয়েছে। ইন্ডিয়া হারবেই, তবু থেবড়ে বসে আছি টিভির সামনে, সব কাজকর্ম ছেড়ে। রেজাল্টটা কী হয়! ওর অবস্থা যা দেখলুম, ভালো মনে হচ্ছে না! ওরা বলছে বটে!

—কীসের স্পেশালিস্ট আসছেন?

—বললে, পেটের স্পেশালিস্ট। দুশো টাকা ভিজিট। আরও দামি আছে, পাঁচশো এক টাকা। তিনি তিন মাসের আগে ডেট দিতে পারছেন না। এরা বলেছিল, তার আগেই যদি রুগি টেসে যায়। ভীষণ মেজাজি তো! শুনলুম, উত্তরে বলেছেন, ওখানে বিধান রায় আছেন, তিনিই দেখে দেবেন। এঁর সম্বন্ধে আরও সব গল্প আছে, একবার এক জুনিয়ার ডাক্তার অনেক বলা কওয়া করে রাজি করালেন স্যার, পরিবারের একমাত্র আর্নিং মেম্বার, হাতেপায়ে ধরছে, কৃপা করুন। ডাক্তার বললেন, কোন চুলোয় যেতে হবে? আজ্ঞে কাছেই, ভেরি নিয়ার। মধুসূদন মিত্তির লেনে ঢুকেই সাতখানা বাড়ির পরে, এইটথ হাউস। জুনিয়ারকে নিয়ে ঢুকলেন গলিতে। এক, দুই, তিন…। দেখা গেল জুনিয়ারের হিসেবে ভুল হয়েছে। ডাক্তার বাড়ি গুণছিলেন, অষ্টম বাড়ির সামনে এসে বললেন, আবার ওদিকে কোথায় এগোচ্ছো! এই বাড়িটা তো! জুনিয়ার বললে, স্যার! একটু ভুল হয়ে গেছে, ওই মোড়ের বাড়িটা। ডাক্তার অ্যাবাউট টার্ন। গেলেন না। বললেন, ইচ্ছাকৃত। আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা। এখন তো রোগের চেয়ে ডাক্তারকেই বেশি ভয়। অনেকে হাসতে-হাসতে শ্মশানে যাবে, তবু বাঘা বাঘা স্পেশালিস্টের কাছে যাবে না। ঠক ঠক করে কাঁপছে। ডাক্তার বলছেন, এ আবার কী! জ্বর নেই কাঁপছে! এ কি কোল্ড কফির মতো কোল্ড ম্যালেরিয়া? আজকাল নার্সিংহোমে রুগির আত্মীয়স্বজনকে বলে, পার্টি। সেই পার্টিদের একজন ডাক্তারবাবুকে বোঝাচ্ছে, আপনার ভয়ে কাঁপছে স্যার। আমি একবার আমার বউয়ের জন্য এক এম এল-এ-র সুপারিশ নিয়ে, সাহসে বুক বেঁধে এক বিরাট ডাক্তারের চেম্বারে গেলুম। বললে, তিনি এখন সায়েবি আমলের এক ক্লাবে আছেন। প্রাণের দায়ে গেলুম সেখানে। অনেক কসরতের পর দেখা। প্রথম কথাই হল, আমার ফি জানেন তো? পাঁচশো। দিতে পারবেন! বললুম, স্যার! চুন, বালি, সিমেন্টের কারবারি, প্রামোটারিতে নেমেছি, বাপ, পিতামোর আশীর্বাদে পাঁচশো কেন পাঁচ হাজারও দিতে পারি। রোজ এক বোতল স্কচ দিয়ে গুড নাইট করি। তিনি একটু নরম হয়ে বললেন, আপনার গাড়িটা পাঠাবেন। জিগ্যেস করলুম, বিলিতি চাপবেন, না দিশি!

তোমার ব্যাবসা, গাড়ি, স্কচ, কী সব বলছ হে!

—কিস্যু নেই।

—তাহলে? কী করলে?

—কিছুই করলুম না। বই পড়ে ঠুকে দিলুম বায়োকেমিক।

—বেঁচে গেল?

—বাঁচবে না! ভাগ্যবানের বউ মরে, অভাগার গরু মরে। তিনি বহাল তবিয়তে রাবড়ি দেবী হয়ে পশুপালন পদ্ধতিতে স্বামী পালন করছেন।

স্পেশালিস্ট এসে গেছেন। সবাই তটস্থ। এইবার একটা এসপার ওসপার হবেই হবে। তিনি বসলেন। ভারী, থমথমে মুখ। সারাদিন যাঁকে যমের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাঁর মুখ ব্ল্যাক ক্যাটের মতো ওই রকম হওয়াই স্বাভাবিক।

রুগির পাশে একটা চেয়ারে বসে বললেন, ‘কই দেখি?’

ঘরের সবাই একবাক্যে বললেন, ‘দাও, দাও, হাতটা এগিয়ে দাও, নাড়ি দেখবেন।’

ডাক্তার বললেন, ‘নাড়ি কে দেখবে! ওসব প্রিমিটিভ পদ্ধতি। কবিরাজি ব্যাপার। বায়ু, পিত্ত, কফ। এখন আর আমাদের রুগিকে ছুঁতে হয় না। যন্ত্রেই সব ধরা পড়ে যায়। একেবারে ডেফিনিট ডায়গনসিস। রিপোর্টগুলো দিন। কী-কী টেস্ট হয়েছে।’

ঢাউস একটা ফাইল, বড়-বড় খাম, সব বেরিয়ে পড়ল। তিন চার রকমের ব্লাড টেস্ট রিপোর্ট, এক্স-রে প্লেট, স্ক্যানিং-এর তিন চার রকম। ছড়াছড়ি ব্যাপার। ডাক্তারবাবুর ঠোঁটের কোণে এই প্রথম একটু হাসি ফুটল।

সেই হাসি দেখে এক শুভানুধ্যায়ী সাহস করে প্রশ্ন করলেন, ‘তেমন সিরিয়াস কিছু নয়, তাই না ডাক্তারবাবু?’

আবার গম্ভীর থমথমে মুখ, কী করে বলব? এই সব টেস্ট কোথা থেকে করিয়েছিলেন? রাবিশ! আবার গোড়া থেকে সব করান, আমি বলে দিচ্ছি কোথা থেকে করাবেন। দেয়ার ইজ ওনলি ওয়ান প্লেস। এগুলো সব ফেলে দিন।

—ডাক্তারবাবু এসব করাতে অনেক টাকা গচ্চা গেছে। প্রবলেমটা কী হয়েছে আপনাকে খুলে বলি, টাকা যে নেই তা নয়, আছে, তবে বেশিরভাগই আছে লং টার্ম ইনভেস্টমেন্টে। কোনওটা দু হাজারে, কোনওটা দু হাজার পাঁচে ম্যাচিওর করবে। এখন ইন্টারেস্টে সংসার চলছে কোনওক্রমে। আগেকার ডাক্তারবাবুদের মতো করুন না।

—সেটা কী?

—এই একটু টেপাটিপি, একটু স্টেথিসকোপ, পেটের ওপর আঙুল রেখে আর একটা হাতের তর্জনি দিয়ে পাঁই পট বাজান, হাঁ করিয়ে গলায় টর্চলাইট ফেলা, সামনে মা কালীর মতো জিভ ঝোলাতে বলা। সেকালের ডাক্তারখানায় ডাক্তারবাবুর পেছনের দেয়ালে জিভ বের করা মা কালীর ছবি থাকত। ওই দেখে রুগির অটোমেটিক জিভ বেরিয়ে আসত। রসিক ডাক্তারবাবু বলতেন, পরমায়ু থাকলে জিভ ঢুকবে নয়ত ঝুলেই থাকবে, আমাদের পাড়ার সত্য ডাক্তারের চেম্বারে লেখা ছিল, মনে করো শেষের সেদিন কী ভয়ংকর, অন্যে সবে কথা কবে তুমি রবে নিরুত্তর।

ডাক্তারবাবু রেগে গিয়ে বললেন, তাহলে আপনারা একজন অ্যান্টিক ডাক্তার ডেকে আনুন, শুধু-শুধু আমার সময় নষ্ট করান কেন!

দত্তপুকুরের দাসবাবু মধ্যস্থতা করলেন, বাজে কথায় কান দেবেন না ডাক্তারবাবু, বাঙালির সবাই উপদেষ্টা। জ্ঞান দিয়ে-দিয়ে জাতটা অজ্ঞান হয়ে গেল। আপনি আপনার সিকসথ সেনস দিয়ে একবার বলুন তো ব্যামোটা কী?

ডাক্তারবাবু হেলা ভরে জিগ্যেস করলেন, আপনার প্রবলেমটা কী? কী হয়?

—আজ্ঞে অনেক কিছু।

—অনেক কিছু থেকে বাছাই করে পেটের দিকটা বলুন, কারণ আমি পেট।

—আজ্ঞে। অতীত বলব না বর্তমান?

—অতীত থেকে বর্তমানে আসুন।

—শৈশব থেকে শুরু করব?

—আজ্ঞে না, পাঁচ, দশ বছর অতীত।

—একবার আলসার হয়েছিল।

—কী করে বুঝলেন? এন্ডোস্কোপি হয়েছিল?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, দুবার। পেপটিক, ডিওডেনাম। যিনি করেছিলেন, তাঁর খুব আনন্দ হয়েছিল। এক আকাশ তারার মতো এক পেট জ্বলন্ত রক্তমুখী আলসার।

—তারপর? চিকিৎসা করিয়েছিলেন?

—করাইনি আবার! নানা রকমের ওষুধ। তার মধ্যে একটা ছিল চুনের মতো। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন পেটের দেয়ালে চুনকাম হচ্ছে। একটা মাথার ওষুধ ছিল। বলেছিলেন মুড়ি আর ভুঁড়ি কানেকটেড। মাথায় একটা স্পট আছে, দুশ্চিন্তা এলেই সেখান থেকে একটা মেসেজ পেটে চলে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে চুঁই-চুঁই করে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড বেরোতে থাকে। একটা ওষুধ দিয়েছিলেন, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড অ্যাবেটার। আর একটা দিয়েছিলেন অ্যান্টি ডিপ্রেসান্ট। আলসার আর ডিপ্রেশান হল হাজব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ।

—ঠান্ডা দুধ খেতে বলেছিলেন?

—একদম না। তবু আমি খেয়েছিলুম। পেট জয়ঢাক। বন্ধ করে দিলুম। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, সব খাবেন, এমন কী মোগলাই পরটা, কষাও খেতে পারেন। তবে ওষুধ খেতে হবে।

—মোস্ট মডার্ন ডাক্তার! কোথায় থাকেন?

—ক্যালিফোর্নিয়ায়।

 —এখানে এলেন কী করে?

—বেড়াতে।

—তা, আলসার থেকে গেলেন কোথায়?

—হাঁপানিতে।

—বা:, বা:, ওপর দিকে উঠছেন। ঊর্ধ্বগতি। কী করলেন?

—দুই স্পেশালিস্টে বুক নিয়ে ঝগড়া বেঁধে গেল। একজন ল্যাঙ্গসের এক্স-রে দেখে বললেন, এ তো দেখছি ধূপধুনো দিয়ে আরতি হচ্ছে, ঘণ্টাটাই কেবল বাজেনি। মাঝে-মাঝে সানাই। অ্যান্টিবায়োটিক চার্জ করতে হবে। আরও বড় বুক স্পেশালিস্ট বললেন, পাগল হয়েছেন? অ্যান্টিবায়োটিক মারলেই সব জড়িয়ে যাবে। এ সারার নয়, একে কন্ট্রোলে রাখতে হবে। সকালে ফ্যাঁসফ্যাঁস, রাতে ফ্যাঁসফ্যাঁস। পকেটে ফ্যাঁসফ্যাঁস।

 ——তার মানে ইনহেলার?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। অনেক দাম। একজন বললেন, এ তো মশাই ডিফেনসিভ খেলা যে কোনও মুহূর্তে গোল খেয়ে যাবেন। চলুন আপনাকে এক বড় কবিরাজমশাইয়ের কাছে নিয়ে যাই। হাঁপানির বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবেন। কলকাতার তাবৎ বিখ্যাত ব্যক্তি তাঁর কৃপায় আজও শ্বাস নিচ্ছেন, নেতারা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আজও গগন ফাটাচ্ছেন।

—সেই ওষুধে ভালো হলেন?

—ওই খেলে একটু কমে, ছাড়লে আবার বেড়ে যায়, তখন আবার সেই ফ্যাঁসফোঁস।

—জানতুম। হবে না ওতে। অ্যালারজেন টেস্ট করান। ধরা পড়ে যাবে কী থেকে হচ্ছে!

—সেটা কী?

—একশো সাঁইত্রিশটা ইনজেকশান দেবে। ঢ্যাঁড়সের রস, বেগুনের রস, ডালের জুস, ছানার একস্ট্র্যাক্ট, বিছানার একস্ট্র্যাক্ট। প্রতিদিন যেসব জিনিসের সংস্পর্শে আসছেন সেই সব জিনিসের নির্যাস।

—একদিনে একশো সাঁইত্রিশটা ইনজেকশান?

—না, না, একদিনে কেন, বেশ কয়েকদিন ধরে। যাক, সে পরে হবে। এই মুহূর্তে সমস্যাটা কী?

—এবার তাহলে একটু নীচের দিকে নামি। উত্থানের পর পতন। প্লাম্বিন কেস।

—মানে?

—ঠিকমতো হচ্ছিল না।

—কী হচ্ছিল না? অত হেঁয়ালি করছেন কেন? আমার আরও সতেরোটা কল আছে।

—ওই পস্ট্রেট হলে যা হয়। কিছুতেই হতে চায় না।

—এ কী, তাহলে আমাকে ডেকেছেন কেন? ইউরোলজিস্টের কাছে যান।

—গিয়েছিলুম। যত রকমের টেস্ট আছে সব করিয়ে নিয়ে গেলুম।

—তা ফিরে এলেন কেন?

—কেস অন্য দিকে বেখাপ্পা ঘুরে গেল।

—এত ঘোরাঘুরি করলে চিকিৎসা করা যায়! যে-কোনও একটা অসুখ সিরিয়াসলি ধরে থাকুন। ঘন-ঘন ট্র্যাক চেঞ্জ করলে অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে। একই রাস্তা ধরে অনেক গাড়ি ছুটছে, লেন ঠিক রাখুন। এর বেশি আর কী অ্যাডভাইস আমি আপনাকে দিতে পারি?

—আজ্ঞে, আমার চেষ্টার তো কোনও ত্রুটি ছিল না, অসুখটা নিজের থেকেই ঘুরে গেল। ছ ফুট লম্বা বলিষ্ঠ সেই বিশেষজ্ঞ হাতে একটা রাবার গ্লাভস পরে মিষ্টি করে বললেন, সামান্য একটু কষ্ট দোবো যে।

—বুঝেছি, পার রেকটাম।

—আজ্ঞে হ্যাঁ। দেখে বললেন, কিস্যু হয়নি, একটা লিভার ফাংসান টেস্ট করিয়ে আনুন, একটা ওষুধেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

—তাহলে? কুঁই-কুঁই করছেন কেন?

—সেইটাই তো বলতে চাইছি, সে যে অনেক কথা।

স্পেশালিস্ট ভুরু কুঁচকে জুনিয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও হে, এ যে রোগের মহাভারত! আমি যদি টাক্সি হতুম ওয়েটিং চার্জ ভাড়ার চেয়ে বেশি হয়ে যেত। এ তো একটা রুগি নয়, দশটা রুগির সমান। রোগের দশানন, রাবণ।

জুনিয়ার বললেন, ওঁর এটাও একটা রোগ। কোন কালে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন, সেই থেকে এই ডিটেলসের কাজ বেড়ে গেছে।

—সেই উপন্যাস তুমি পড়েছ?

—পড়েছি, কারণ আমিও একটু আধটু লিখি যে, বনফুলের ট্র্যাডিশান।

—ডিটেলসের কাজ কাকে বলে!

—অপারেশনের আগে অ্যানেসথেসিয়ার মতো। যেমন ধরুন, এঁর সেই উপন্যাসে নায়ক নায়িকাকে বলবে, রমা মাথাটা ভীষণ ধরেছে। চারটে শব্দ; কিন্তু পুরো দু-পাতা লেগে গেল।

—কী করে লাগল! ব্রাজিলিয়ান ফুটবল! এর পা, ওর পা করতে-করতে—

—নায়ক শঙ্কর মাঝদুপুরে বাড়ি ঢুকছে। গরমকাল। জামার পিঠের দিকটা ভিজে গেছে ঘামে, কালো-কালো দাগ। কেন ভিজেছে। ব্যাখ্যা প্রয়োজন। শঙ্কর সকালেই বেহালায় গিয়েছিল। শঙ্করের একমাত্র বোন বিন্দুর শ্বশুরবাড়ি বেহালায়। শঙ্কর ন-মাসে ছ-মাসে যায়। হঠাৎ ওই দিনই যেতে হল কেন? বিন্দুর স্বামী এক মাস হয়ে গেল নিরুদ্দেশ। কেন নিরুদ্দেশ? লোকটা কী বদস্বভাবের অবশ্যই নয়। আসামের চা বাগানের ম্যানেজার। আসামের চা-বাগান, রাজনীতি, সন্ত্রাসবাদ, উলফা, অগপ, ভারত কোন পথে চলেছে। গৌতম বুদ্ধ, শ্রীচৈতন্যের এই দেশ! ছি, ছি, অক্ষম রাজনীতিকরা দেশটাকে আজ কোথায় নিয়ে যেতে চাইছে! যদুবংশ এইভাবেই ধ্বংস হয়েছিল। শঙ্কর বাসে ফিরেছে। বসার জায়গা পেয়েছিল। ঠেসান দিয়ে বসেছিল। সাধারণত সে সিটের পেছন দিকে পিঠ ঠেকায় না। খাড়া হয়েই বসে, যাতে জামার পেছন দিকে বিশ্রী দাগ না লেগে যায়। এমন সচেতন মানুষ কেন এমন ধেসকে গেল! মনটা ভালো ছিল না। জীবনের কোনও দাম আছে বন্ধু! জামা-সচেতন হয়ে লাভটা কী!

—তোমাকে ঠাস করে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছে।

—শিবরামবাবুর গল্পের নায়ক ঠিক এই কাজই করেছিল।

—কত ফ্যাঁকড়া বেরোবে আর?

—আমার দিক থেকে লাস্ট। ইংরেজ আমলের দোতলা বাস। দেশ জুড়ে ঘোর স্বদেশি আন্দোলন চলেছে। সেই সময় এক নিরীহ, ভেতো বাঙালি যাত্রী, এক মেমসাহেব সহযাত্রীকে সপাটে গালে এক চড় কষিয়ে বসল। পুলিশ থেকে আদালতে। জজ সায়েব আসামিকে জিগ্যেস করছেন, যা হয়েছে সব খোলাখুলি বলো। আসামি বললে, ধর্মাবতার খোলাখুলিই বলব। মেমসাহেব বসেছিলেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ঠিক পাশের সিটে। কন্ডাকটার টিকিট চাইলেন। মেমসাহেব তখন হাতব্যাগ খুলে মানিব্যাগটা বের করে হাতব্যাগটা বন্ধ করলেন। তারপর ভাড়ার পয়সা বের করে মানিব্যাগটা বন্ধ করে হাতব্যাগটা বন্ধ করলেন। ইতিমধ্যে কন্ডাকটার ভেতর দিকে চলে গেছেন। তখন মেমসাহেব হাতব্যাগটা খুলে মানিব্যাগটা বের করে হাতব্যাগটা বন্ধ করলেন। এইবার মানিব্যাগে পয়সা রেখে মানিব্যাগ বন্ধ করে হাতব্যাগটা খুললেন। মানিব্যাগ রেখে হাতব্যাগ বন্ধ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাকটার মহিলার সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেমসাহেব তখন হাত ব্যাগ খুলে মানিব্যাগটা বের করে হাতব্যাগ বন্ধ করলেন। তারপর মানিব্যাগ খুলে পয়সা বের করে মানিব্যাগ বন্ধ করলেন। কন্ডাকটার ততক্ষণে দোতলায় উঠতে শুরু করেছেন। মেমসাহেব মানিব্যাগ খুলে পয়সা রেখে মানিব্যাগ বন্ধ করে হাতব্যাগ খুলে মানিব্যাগটা রেখে হাতব্যাগ বন্ধ করলেন। হঠাৎ কন্ডাকটার মাঝ সিঁড়ি থেকে নেমে এলেন। মেমসাহেব তখন হাতব্যাগ খুলে মানিব্যাগ বের করে হাতব্যাগ বন্ধ করে মানিব্যাগটা খুললেন…জজসাহেব উঠে এসে আসামির গালে ঠাস করে চড়। অভিযুক্ত বললেন, ধর্মাবতার! এর বেশি আমি কিছু করিনি। আপনি শুনে যা করলেন, আমি তা দেখে করেছি। তখন আসামি বেকসুর খালাস পেলেন।

স্পেশালিস্টের কৌতূহল জেগেছে। জিগ্যেস করলেন, শেষ পর্যন্ত ভাড়া কি দেওয়া হয়েছিল?

—সেটি আর শিবরামবাবু লেখেননি।

—নাও, এক কাপ চা বলো। আজ আমার সব গেল।

রুগির বাড়িতে বিরাট স্পেশালিস্ট চা খেতে চেয়েছেন। সাংঘাতিক ব্যাপার। এর অর্থ রুগি ব্রাত্য শ্রেণি থেকে জাতে উঠল। এবার ঠিক-ঠিক আন্তরিক চিকিৎসা বেরোবে। ‘আপ দি স্লিভস’ অনেক কিছু থাকে, ‘ট্রেড সিক্রেট,’ এইবার সেই সব বেরিয়ে আসবে।

চায়ে চুমুক দিয়ে ডাক্তারবাবু জিগ্যেস করলেন, এঁর নায়কের মাথা ধরার কেসটা কত দূর গড়াল?

—সাবেক আমলের বাড়ি। নায়ক ঢুকছে। সদর দরজা সারাদিন খোলাই থাকে। নীচের তলায় একঘর বিহারি বহু দিন ভাড়া আছে। বাইরে একটা বেওয়ারিশ রক। সেই রকে একটা কুকুর শুয়েছিল। ঘুম নয়, জাস্ট শুয়ে থাকায় কুকুরটা নায়ককে দেখে পটাপট লেজ নাড়তে লাগল। কেন? ব্যাখার প্রয়োজন। একটা প্যারা। নায়ক শঙ্কর কুকুরটাকে রোজ সুযোগমতো বিস্কুট খাওয়ায়।

এইবার এল জীবনদর্শন। মানুষ আর কুকুরের তুলনামূলক সমীক্ষা। মানুষ। শ্রেষ্ঠ, না কুকুর শ্রেষ্ঠ! আর হাজার বছর পরে যে কুকুর আসবে, স্বভাব চরিত্রে সব একইরকম থাকবে। কোনও কুকুর কখনও বলবে না, কুকুররা সব যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে। মানুষের সমাজের জেনারেশান গ্যাপ কুকুরদের মধ্যে আসবে না। বেড়াল পাখি, হাতি এমনকী শূয়োরের বাচ্চাদের মধ্যেও দেখা যাবে না। কিন্তু মানুষ হামেশাই শূয়োরের বাচ্চা, কী বাঁদরের বাচ্চা হয়ে যেতে পারে। মানুষের মানবিকতা চলে যাচ্ছে কুকুরের কাকবিকতা যাচ্ছে না। পাখির পাখবতা ঠিকই আছে।

—কাকবতা, পাখবতা, শব্দগুলো?

—অ্যায়! জিগ্যেস করেছিলুম আমিও। নতুন শব্দের সমন্বয়, নিউ কয়নেজ। মানব থেকে যেমন মানবতা।

—কুকুর থেকে কুকুরতা হলেই তো হত?

—না, এটা পশুর পথে গেছে। পশু থেকে পাশব থেকে পাশবিকতা সেই রকম…

—তাহলে কুকুর থেকে কাকব থেকে কাকবিকতা, থাক ব্যাকরণে দরকার নেই, ফুটনোট দিলেই হবে।

—উপন্যাসে ফুটনোট চলে না।

—প্রবন্ধোপন্যাসে চলে। আজকাল তো গল্প থাকে না, ফ্যাটলেস বাটার, ক্রিমলেস মিল্কের মতো গল্পলেস উপন্যাস। হ্যাঁ, তারপর, শঙ্করের কুকুরদর্শনের পর!

—শঙ্কর করুণ মুখে কুকুরটাকে বললে, সরি! এখন কিছু নেই রে! পরে দোব। কুকুরের লেজ স্থির হয়ে গেল। একটা হাই তুলল। শঙ্কর তাদের সেই সাবেক কালের পুরনো বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠছে আর ভাবছে, পঞ্চাশ বছর আগে এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতেন এক বিখ্যাত, জাঁদরেল ব্যক্তি, রায়বাহাদুর গিরীন্দ্রশেখর। লাটসাহেবের সঙ্গে ভোজ খেতেন। চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট। কোটের ওয়াচ পকেটে সোনার ঘড়ি, সোনার চেন বুকের কাছে দুলছে। সিংহের মতো দাপট। আবার নদের নিমাই পালা শুনতে-শুনতে কেঁদে ফেলতেন। কান্না নয়, প্রেমাশ্রু বিসর্জন করতেন। আর আজ। হাতির বংশধর ছুঁচো!

—খুব বোরিং লাগছে।

—উপায় নেই, আধুনিক উপন্যাসের বুনোট। স্বাদু নয় পুষ্টিকর। শঙ্কর ঘরে ঢুকে দেখলে স্ত্রী ঘুমোচ্ছে। যৌবনের শেষবেলার আলোয় এখনও ছমছমে। কাছে যেতে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। শঙ্করের মনে হল, একটু কাতুকুতু দিলে কেমন হয়!

—এই জায়গাটা ভালো লাগছে।

—একটু পরেই খারাপ লাগবে। কারণ শঙ্করের মাথা ধরেছে। প্রায়ই ধরে। ডাক্তারের সন্দেহ মাইগ্রেন।

—যা:, মাইগ্রেন হলেই হল! কোন ডাক্তার! ইরেসপনসিবল কথাবার্তা! মাইগ্রেন জেনেটিক ফ্যাক্টার। রায়বাহাদুরের মাইগ্রেন ছিল? রায়বাহাদুরানীর মাইগ্রেন ছিল?

—না।

—সব পেট থেকে হচ্ছে। হাইপার অ্যাসিডিটি। এন্ডোস্কোপি করে দেখতে হবে আলসার আছে কি না! মাথা ধরলেই মাইগ্রেন? বমি করে, অ্যাটেস্ট্রেচ তিন চার দিন মাথা ধরা থাকে! মাইগ্রেন হলে স্ত্রীকে কাতুকুতু দেবার ইচ্ছে করত না, খামচা-খামচা করে মাথার চুল ছেঁড়ার ইচ্ছে করত।

—জামা খুলে হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রেখে শঙ্কর বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নীচেই রাস্তা। আইসক্রিমঅলা গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। শঙ্করের মনে হল ছেলেবেলায় একটা আইসক্রিমের জন্যে কত লালায়িত হত। এখন সে একশোটা আইসক্রিম কিনতে পারে বলে একটাও কিনবে না। প্রাচুর্যের চেয়ে অভাবই ভালো।

—নো, দ্যাটস এ রং ফিলজফি। অভাব ভালো নয়। বাট সংযম ইজ গুড। বেহিসেবি হওয়াটা ইজ ব্যাড। মধ্যবিত্তের উপন্যাসে এই সব নেগেটিভ সার্মন থাকে। সেভিংস অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার। আমি রাখব, আমি খাব। তুমি তো জান আইসক্রিম অ্যান্টাসিড। তবে হ্যাঁ, হাই ফ্যাট, হাই ক্যালোরি। কোলেস্ট্রাল না থাকলে একটা খাওয়া যায়; কিন্তু রাস্তার আইসক্রিম নয়, ফ্রম এ গুড শপ অপকোর্স, কটা বাজল?

—প্রায় একটা।

—তাহলে আর তো সময় নেই। আমাকে চেম্বারে যেতে হবে, সব লাইন দিয়ে হা পিত্যেশ করে বসে আছে।

—মাথাধরাটা শুনবেন না?

 —ওটা মাইগ্রেন নয়, আই অ্যাম সেন্ট পার্সেন্ট সিওর।

এইবার রুগির দিকে তাকিয়ে স্পেশালিস্ট বললেন, একদিন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে চলে আসুন একটা এন্ডোস্কোপি করে ভেতরটা দেখেনি। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আলসার আছে। এ একেবারে বনেদি অম্বুলে চেহারা, সেকালের বিধবা পিসিমাদের মতো। হাজারখানেকে হয়ে যাবে।

—এই দেখুন, গুলিয়ে ফেলেছেন, ওটা উপন্যাসের অসুখ, আর আপনি এসেছেন লেখকের অসুখ দেখতে।

—কিস্যু গুলোইনি। লেখকের অসুখই তো উপন্যাসের অসুখ হয়। সৃষ্টির ব্যাধি মানেই স্রষ্টার ব্যাধি। ঈশ্বরের আচার খাওয়ার ইচ্ছে হয় বলেই না সৃষ্টিতে আচার এসেছে। সব ওইখান থেকে আসছে, কাটলেট, ক্যাবারে, মোগলাই, কষা, ডাক্তার, খুনি। মুরগিও যার মুর্গমসল্লমও তার।

—কিন্তু দেশলাই দর্শনটা না শুনলে কিছুই শোনা হল না।

—দেশলাই দর্শনটা কী?

—শঙ্কর বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করছে। মাথা ধরাটাকে যদি একটু বাগে আনা যায়!

—কী করে যাবে? টোব্যাকোয় আরও বাড়বে।

—ইতিমধ্যে সে এটা ভেবেছে। সতর্কবাণীটাও তার মনে ভেসে উঠেছে, সিগারেট স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ। পরক্ষণেই তার একটা সংস্কৃত শ্লোক স্মরণে এসেছে। পুরাকালে ইন্দ্র একদিন পদ্মযোনি ব্রহ্মাকে জিগ্যেস করেছিলেন, আপনার সৃষ্টি পৃথিবীতে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বস্তু কোনটি? উত্তরে ব্রহ্মার চারটি মুখই চারবারে একটি বাক্যই উচ্চারণ করল, তামাকু, তামাকু, তামাকু, তামাকু। শ্লোক আমি মুখস্থ করে ফেলেছি, ভাবছি কোনও সিগারেট কোম্পানিকে দিয়ে দোব!

—শ্লোকটা শুনি। পারলে আমিও মুখস্থ করে আমার বউকে বলব। মেরে ধরে আমাকে সিগারেট ছাড়িয়েছে। তুমি জানো, আই ওয়াজ এ চেন স্মোকার। একসময় এমনও ভেবেছিলুম, সিগারেটের বদলে বউকে ছেড়ে দিলে কেমন হয়! তারপর একদিন কলকাতার এক বিখ্যাত ক্লাবে আমার সঙ্গে ডিনার খেতে গিয়ে দেখলে মেয়েরা ফসফস করে সিগারেট টানছে। ছেলেরা যত না টানছে মেয়েরা তার চেয়ে বেশি টানছে। তখন আমাকে সারা দিনে এক প্যাকেট স্যাংশান করেছে। শ্লোকটা । ওটা শুনিয়ে আর এক প্যাকেট যদি আদায় হয়।

—বাংলাটা তো বললুম!

—আরে ধুর, সংস্কৃতে না বললে বিশ্বাস করবে না, শ্রদ্ধাও আসবে না।

—তাহলে শুনুন, বড়ৌজা: পুরা পৃষ্টবান পদ্মযোনিং/ধরিত্রীতলে সারভূতং কিমস্তি!/ চতুর্ভিমুখৈরিত্যা বোচদ্বিরিঞ্চিস্তমাখু স্তমাখু স্তমাখু স্তমাখু:।।

—কাগজে লিখে দাও।

—আপনাকে বইটাই দোব। পড়ে দেখবেন, উপন্যাস কাকে বলে, শামুকের মতো চলন। কান্না পেয়ে যাবে।

—কেন, দু:খে?

—না, না, যন্ত্রণায়। অ্যানেসথেসিয়া ছাড়া গলব্লাডার অপারেশানের মতো।

—তুমি তো আচ্ছা ঠোঁট কাটা, লেখকের সামনে তার লেখার সমালোচনা করছ!

—কেন করব না! লেখকদের মস্ত সুবিধে লিখেই খালাস। নিজের লেখা ফিরে আর পড়তে হয় না। যে কোনও একটা লেখা মলাট ছিঁড়ে পড়তে দিলে এই মন্তব্যই করবে। পর-পর সাতটা দেশলাই কাঠি জ্বলল আর নিবল, সিগারেট কিন্তু ধরল না। এরই ফাঁকে এক লাইন রবীন্দ্রসংগীত হয়ে গেল, যতবার আলো জ্বালাতে চাই। এর মধ্যেই তৈরি হল দর্শন, কোন কাঠি যে জ্বলবে কখন? গোটা ভারতবর্ষটাই স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেছে ভিজে বারুদের মতো, একমাত্র টেররিস্টদের বারুদই শুকনো আছে। স্বামীর গদিতে স্ত্রী। একটা বাছুরের আঠাশটা বাচ্চা। প্রধানমন্ত্রীকে বুবু করছে নিজের দলের মেম্বাররা। একটা স্টেটে ছিয়াত্তরটা মন্ত্রী। এত বড় বিজ্ঞাপন, ওয়ান স্ট্রাইক ম্যাচ, কাঠি কিন্তু জ্বলে না।

—এগুলো সব তোমার কথা।

—ওই আর কী। শঙ্কর সিগারেট ফেলে দিয়ে ঘরে এসে বউকে জাগিয়ে বললে, মাথাটা ভীষণ ধরেছে। বউ বললে, আমার পাশে শুয়ে পড়ো লক্ষ্মী ছেলের মতো।

—অ্যায়, ঠিক দাওয়াই। আচ্ছা, আমি তাহলে উঠি।

রুগি অসহায়ের মতো বললে, আমাকে তো কিছুই দেখলেন না।

—সারা শহরের এত বড়-বড় স্পেশালিস্ট আপনাকে দেখেছে, যে আমার আর দেখার কিছু নেই। আপনার সব দেখাই হয়ে গেছে কেবল পাকা দেখাটাই বাকি।

—আচ্ছা, এই যে শুনছি, আমার লাম্বার পাংচার করা হবে।

—লাম্বার পাংচার! সে আবার কী! ম্যানেনজাইটিস হয়েছে না কী!

—না বলছে, ওখান থেকে ফ্লুইড নিয়ে কী একটা স্পেশ্যাল টেস্ট করবে।

—টেস্ট করে কী দেখবে?

—বিশ বছর আগে আমাকে একবার কুকুরে কামড়েছিল।

—এর মধ্যে আবার কুকুর ঢুকে গেল! বাড়ির না রাস্তার!

—বাড়ির।

—ইনজেকশান দেওয়া ছিল?

—না। আবার সাত বছর বয়েসের সময় বাঁদরে কামড়েছিল।

—কোনও সময় অ্যান্টির‌্যাবিস নিয়েছিলেন?

—না।

—এত বছর যখন কিছু হয়নি, তখন আর কিছু হবে না।

—না, ওঁরা বলছেন, র‌্যাবিজ এমন একটা ব্যাপার যে পরের জন্মেও হতে পারে।

—অ, বিয়ের মতো, একই বউ জন্ম জন্মান্তরে ঘুরে-ঘুরে আসছে! শুনুন, আমি বলি কী, ভালো একটা নার্সিং হোমে ভরতি হয়ে থরো টেস্ট করিয়ে রোগটা আগে ধরুন। তা না হলে কোনও চিকিৎসাই হবে না।

ওপাশে দাঁড়িয়েছিল ছেলে। সে বললে, নার্সিং হোমেই তো ছিল। জামিনে খালাস আছে। রিপোর্ট করার কথা। কিছুতেই যেতে চাইছে না। বলছে, বাড়িতে হোমলি পরিবেশে মরতে চাই। এটা কোনও কথা হল। দু-মাস হয়ে গেল। আজ এটা, তো কাল ওটা। জোরে টিভি চালাবার জো নেই। রাস্তায় বেরলেই সমালোচনা, বাপ মৃত্যুশয্যায়, ঘণ্টা না বাজিয়ে টিভি চালাচ্ছ! সব কিছুর একটা লিমিট আছে। প্রথম-প্রথম ভালো লাগে, শেষের দিকে আর ধৈর্য থাকে না।

ডাক্তারবাবু বললেন, তা ঠিক, গরু হলে কসাইখানায় পাঠিয়ে দেওয়া যেত; মানুষ হয়েই মুশকিল। এই এজ অফ টেকনোলজি আর ইন্টারনেটের যুগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের নিয়ে মহা সমস্যা। আচ্ছা আজকাল কাগজে শ্মশানের টেলিফোন নম্বর দেয় কেন? পাঁচটা শ্মশানের ফোন নম্বর? অ্যাম্বুলেন্স, নার্সিং হোম, ডাক্তার, হোটেল, রেস্তোরাঁরটা বুঝি, শ্মশানকে ডাকলেও মোবাইল চুল্লি পাঠাবে না। কেরোসিন তেল আর দেশলাই কাঠি ছাড়া বাড়িতে সৎকার সম্ভব হবে না। শ্মশান ভগবানের রেস্তোরাঁ হয় তো, তবে মানুষ সেখানে টেবল বুক করবে না ফোন করে! চিতা বিছানাই, শেষ শয্যা, তবে হোটেলের বিছানা নয়। শ্মশানের ফোন নম্বর দেয় কেন!

জুনিয়ার বললেন—স্যার, একেই বলে দূরদর্শিতা। ধরুন বাবা মারা গেছে। এন আর আই ছেলে বউ নিয়ে আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছে। ফোন করছে, হ্যালো কেওড়াতলা, লাইন ক্লিয়ার! ক-জন? সাতজন! আটটা বুক করলুম। ও. কে। ওই আটে একটা ডামি খাট এসে গেল। চাদর চাপা। ফুলটুল দেওয়া। অ্যাভারেজ এক ঘণ্টা হলে, সাতটা লাশে সাতঘণ্টা। সাতঘণ্টা পরে বাবার লাশ এল আর ঢুকে গেল। বুকিং ফি পাঁচশো। কিছুই না। একজন ব্যাবসাদার এই সাত ঘণ্টায় সাত লাখ কামাই করবে। টাইম ইজ মানি। ইচ্ছে করলে, বেকাররা, যাদের কাছে টাইম ইজ পভার্টি অ্যান্ড সাফারিং তারা জ্যান্ত মড়া হয়ে ঘণ্টা বেসিসে কিছু রোজগার করে নিতে পারে। কেরোসিন তেলের লাইনে টিন, জলের লাইনে বালতি, রেশনের লাইনে ঢিল, পোড়ার লাইনে ডামি। যুগ আরও একটু অ্যাডভান্স করলে কুরিয়ার সার্ভিস। ডেডবডি গেল কুরিয়ার সার্ভিসে, লেবেল সাঁটা দেড় কেজি বাপের কী মায়ের ছাই ফিরে এল ওই কুরিয়ার সার্ভিসে। ডেড লেটারের মতোই ডেডবডি। যখন ছাই এল বাড়িতে কেউ নেই। কাজের প্রাচীনা মহিলাটি বললে—ও মা! কতদিন পরে বাজারে বাসনমাজার ছাই ছেড়েছে গো কোম্পানি! ছাইয়ের মতো জিনিস আছে। বাসন যা পরিষ্কার হয় না! ফুরলে আবার পাওয়া যাবে?

—এ ছাই সে ছাই নয় গো মেয়ে, জীবন ফুরলে তবেই মিলবে এই ছাই। নাও, একটা সই দাও। যা হয় একটা খচাখাঁই মেরে দাও। এটা হল বাবুর বাবার ছাই।

—তিনি তো মারা গেছেন।

—আর কী বলব বলো। মানুষ কী কর্পূর, যে উড়ে যাবে! দেড় কেজি ছাই, পাককা ওজন।

কাজের মহিলা শিউরে উঠল, মড়ার ছাই! বাইরে দরজার কোণে রেখে দাও। কী ওলুক্ষণে জিনিস।

—তোমার, আমার সকলেরই তো ওই এক গতি। নেতা হলে হিলিকপ্টারে উঠত, ধর্মগুরু হলে সমাধি।

ঘর আপাতত খালি। রাত নটা কী সাড়ে নটা। দূর থেকে সানাই ভেসে আসছে। বেহাগে আলাপ চলছে। ওখানে একটা বাড়ি আছে, বিয়ের জন্যে ভাড়া দেয়। শ্রাবণ মাস। আজকাল বিয়ে আর শ্রাদ্ধ বেশিরভাগই বাড়িতে হয় না। শ্রাদ্ধ হয় যে কোনও একটা আশ্রমে।

রুগির তন্দ্রা এসেছে। একটা ঘোরের মতো। কপালে একটা ঠান্ডা কোমল হাত। নব বধূর চুড়ির রিনরিন। জুঁই ফুলের গন্ধ।

—কে?

—আমি রমা।

—তুমি কোথা থেকে এলে! হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা।

—তমসা নদীর তীর থেকে!

—মালা পরেছ বুঝি?

—তুমিই তো পরিয়েছিলে চল্লিশ বছর আগে এই সাত শ্রাবণে। আমার কানের কাছে মুখ এনে গেয়েছিলে পান খাওয়া রাঙা ঠোঁটে—আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে কী এনেছিস বল। মনে পড়ে! আমিও তো তেমনি ছিলুম, উত্তরে গেয়েছিলুম পূব হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি-মরি। হৃদয় নদীর কূলে-কূলে জাগে লহরী।

—কী করতে এলে! যাও, তোমার ওপর আমার অভিমান হয়েছে।

—কেন?

—আগে গেলে, তা যাও। দিন ফুরোলে তুমি আর করবে কী! কিন্তু বলেছিলে, গিয়েই ডেকে নেবে। পাঁচ বছর হয়ে গেল! এখন মালা পরে ঢং করতে এসেছ?

—আমি তো তোমাকে কত বার কত ভাবে ডাকছি! শুনতেই পাও না! কেবল বাঁচার চেষ্টা করছ। আর বেঁচো না, সবাই বিরক্ত হচ্ছে। কর্তব্য করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তিনমাস আগেই মুসৌরি যাওয়ার টিকিট কাটা আছে। বুড়ো। তুমি কিছুই জানো না। তুমি মরবে বলে সবাই দেখতে আসছে দিগবিদিক থেকে। এ যাত্রায় বেঁচে গেলে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না। আমার সঙ্গে ঝগড়া করে তোমার সেই গৃহত্যাগের মতো হাস্যকর হবে। ল্যাম্প পোস্ট পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলে!

—এরা তো করছে খুব!

—আরে ধুত! এ তো কর্তব্য! প্রেম কোথায়! পাঁচতারা হোটেলের পরিবেশন! কেতা আছে হৃদয় নেই। আর থাকে না। এইবার চলে এসো লক্ষ্মীটি। এই শ্রাবণে, আমি একা বসে আছি নদীর তীরে অন্ধকারে! তোমাকে না নিয়ে ওপারে যাই কী করে। সুদূর কোন নদীর পারে, গহন কোন বনের ধারে।

—আমি তো খুব চেষ্টা করছি রমা!

—না, না, তোমার চেষ্টায় খুব ফাঁকি আছে। যেভাবে মানুষ বাঁচার চেষ্টা করে ঠিক সেই ভাবে মরার চেষ্টা করো। ‘সেই প্রাণে মন উঠবে মেতে/মৃত্যু-মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ।’

—দাঁড়াও, তুমি যাচ্ছ কোথায়!

চটকা ভেঙে গেল। অনেক রাত। সানাই আর বাজছে না। কটা কুকুর দূরে চিৎকার করছে। সামনের দেওয়ালে ঝুলছে অদ্ভুত সেই ছবিটা। একটা হাতের ওপর আর একটা হাত। মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ড আগে রমা হাতটা ধরে ভাষাহীন ভাষায় বলতে চেয়েছিল, ‘চলো, চলো। এ জন্মের মতো আর হয়ে গেছে যা হবার।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *