ছলনার মায়াজাল

নৌকার ছইয়ের ভেতরে গঙ্গা কাঁদছে, আর বাইরে গঙ্গা হাসছে। ছোট ছোট ঢেউয়ের বুকে সূর্যচ্ছটায় ঝিকিমিকি। ছোট ছোট ঢেউ নাচছে যেন কচি কচি দামাল শিশুর মতো। হাসি তার ছলছল তালে বাজছে তীর সৈকতে। সে শব্দে মুখরিত গঙ্গাব।

দক্ষিণী হাওয়া বইছে মিঠে মিঠে। ঝিলিমিলি হাওয়া। চোখ বোজানো হাত পা এলিয়ে দেওয়া গোলাপি নেশার মতো রম্য হাওয়া। বৈশাখী দুপুরের গঙ্গা। ভারী মিষ্টি। নৌকার ছইয়ের মধ্যে গঙ্গার মতো। ভানুমতীর মতো, একহারা কিশোরী বালিকা। অনাগত যৌবনের ইশারা তার অঙ্গ ভরে। আষাঢ়ের ঢল নামবে। নিজেকে ছাড়িয়ে উঠবে বেড়ে। রং ফিরবে, রঙে রসে বান ডাকবে। সেই চাঞ্চল্য আর শিহরন তার বুক জুড়ে।

আর এই বৈশাখী গঙ্গা, ভারী সুন্দর। সুন্দর, আবার অতি ভয়ংকর। ভয়ংকর আর সর্বনাশা ভয়াবহ খেলার লীলাস্থল হয়ে উঠতে পারে যে কোনও মুহূর্তে। শুধু দূর ঈশানে ওই কৃষ্ণচূড়া ছাওয়া অগ্নিশিখার মাথায় এক টুকরো কালো মেঘের অপেক্ষামাত্র। হাস্যময়ী হবে রুদ্রাণী। লক্ষ নাগিনী গজাবে আকাশে আর গঙ্গায়। ফুটফুটে হাসি হবে খেপির খলখলানি। মাঝি তাই দেখছে আকাশের এদিকে ওদিকে। মনে ভাবছে এক কথা। অন্য কথায় অন্যমনস্ক। কিন্তু মাঝ গঙ্গায় ঝিলিমিলি হাওয়াই জোর হয়ে উঠছে একটু। নজর তাই আপনি ঘুরছে। বাজপাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখে সন্ধান করছে মেঘের। না, আকাশ বেশ পরিষ্কার, আকাশ নীলাম্বরী নয়, নীলের তলায় সাদা অন্তর্বাস। বৈশাখী রোদজ্বলা আকাশ।

হাওয়াটা কাজে লাগাল মাঝি, পাল তুলে দিল। তারপর নৌকার মোড় ঘুরিয়ে দিল সোজা উত্তরে। কষে হাল ধরে বসল ভাবতে। বামুন দুটো মেয়েটাকে নিয়ে কী করবে, সেই ভাবনা। আরে বাপরে! ছুঁড়ির রূপ কী! কাদের ঘরের মেয়ে, কে জানে।

আর ছইয়ের ভেতরে ভানুকে মাঝে রেখে বসে বসে ঘামছে সর্বেশ্বর আর নন্দন। হাঁটুতে মুখ রেখে বসে আছে ভানুমতী। অঝোরে জল ঝরছে চোখ থেকে। সান্ত্বনায় কান্না মানে না। নিঃশব্দ কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে তার শরীর।

দুই মানুষ-বেশী গুপ্ত যম বসে দৃষ্টি বিনিময় করছে তার দুই পাশে। যম নয়, দুটি সাপ, মুখে এখন তাদের কথা নেই। শিকার যখন মুখে নেওয়া হয়েছে, তখন তাকে গিলতে হবে। পাপীর মনে এখন সেই ভাবনা। পাপের পরেই যে ভয় আসে, সেই ভয়ে এখন তারা নির্বাক। পরস্পরের দিকে দেখছে, আর ঘামছে দরদর করে। কিন্তু প্রথম হাতে-খড়ি নয়। এ বিষয়ে উভয়েরই পাকানো হাত। তবে একেবারে এমনি বিনা পয়সায় লুণ্ঠন, তাও স্বগ্রাম থেকে, এমনটি এই প্রথম। তা ছাড়া বিনি জেলেনির মেয়ে। গণ্ডগোলের আশঙ্কা বড় বেশি।

গঙ্গা পার হতে কতক্ষণ লাগে। কতক্ষণ যাবে এমনি করে। এখুনি প্রশ্ন উঠবে। ছটফট করে উঠবে। মেয়েটা। চিৎকার করবে। মাইল ছয়েক অন্তত পার না হতে পারলে নিস্তার নেই।

পরস্পরকে দেখছে সর্বেশ্বর পাঠক আর নন্দন অধিকারী। জাল ফেলতে হবে, শিকার আওতায় এসেছে, জালে পড়েনি এখনও। নিপুণ শিকারির মতো নিঃশব্দে বিস্তার করতে হবে জাল। মায়াজাল, শিকার যাতে আপনি ধরা দেয়।

কিন্তু বুধে বুদ্ধি জোগাচ্ছে না, বুদ্ধি এলে ফন্দি আসবে। আসলে, সর্বেশ্বর শনি-সাধক। কুচক্রী শনিঠাকুর বুদ্ধি না দিলে এ বৈতরণী পার হওয়া যাবে না। ঘামে পৈতাগাছটি ভিজে লেপটে গেছে। মাথার ঘাম বেয়ে বেয়ে পায়ে পড়ছে, দোহাই শনি, বুদ্ধি দাও।

নন্দন আতঙ্কিত, সে ভাবছে আজকের তিথি নক্ষত্রের কথা। কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে গেছে মাথায়। কিছুতেই সঠিক তিথিটা মনে আসছে না। এলে বুঝতে পারত, যাত্রা ফলবে না বিফলে যাবে।

সর্বেশ্বরের চোখে একটু আলো দেখা দিল। কুঞ্চিত কপালের রেখা একরাশ পুঁয়ে সাপের মতো উঠল কিলবিল করে। এক মুহূর্ত চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রইল নন্দনের দিকে। নন্দন তার অর্থ না বুঝে তাকিয়ে রইল বিমূঢ়ের মতো।

চমকিত গলায় সর্বেশ্বর ডাকল, নন্দন!

 নন্দন স্তিমিত গলায় জবাব দিল, বলো।

কথা বলে, কিন্তু চোখে চোখ থাকে ঠিক। সর্বেশ্বর বলল উৎকণ্ঠিত গলায়, মেয়েটাকে ওপারে নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?

নন্দন সঠিক জবাব দিতে ভুল করল না–কেন বলো তো?

গঙ্গার বাপ তো অপঘাতে মরেছে?

তাই তো।

সর্বেশ্বর গম্ভীর গলায় বলল, অপঘাতে মৃত্যুর মড়ার কাছে কি যেতে আছে? দেখো তো নন্দ, ঘোড়ার লাথিতে মরলে আত্মার কী গতি হয় শাস্ত্রের কথা ভেবে বলল।

পিতৃশোকাতুর ভানু ডাগর চোখ দুটি তুলে ধরল নন্দনের দিকে। করুণ জিজ্ঞাসু চোখ কান্নায় লাল। অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও পরম নির্ভরতা বালিকার চোখে। বাপ তার অপঘাতে মরেছে। সে তো শুনে আসছে। জন্মকাল থেকে, মানুষ মরে এক অদৃশ্য ভয়ংকর জীব হয়ে ওঠে। তখন তার মায়া দয়া থাকে না। নিজের ছেলেমেয়ে জ্ঞান থাকে না। যে মাড়াবে তার অদৃশ্য ছায়া, তারই ঘাড়ে ভর করবে সে, বিশেষ অপঘাতে মরণ। আর বামুনের মনে খটকা লেগেছে, কম কথা নয়।

ভয় জানে না বিনি জেলেনির মেয়ে। ভর দুপুরে সে চুল এলিয়ে বেড়ায় বনে জঙ্গলে। বড় বুকের পাটা। এক গাঁ থেকে আর এক গাঁয়ে যায় ছুটে।

সত্যি, ভয় জানে না। কিন্তু সর্বেশ্বরের কথাগুলি কানে গেল, কান থেকে মনে। থাকলেই বা সাহস। বাপের মরণের সংবাদই প্রথম আঘাত করেছে সাহসের মুখে। দুর্বল করেছে মনকে অনেকখানি। সাহসের চেয়ে তার কুসংস্কার বেশি। তা ছাড়া সরল শিশু হৃদয়। অদৃশ্য জীব-জগতের ভয়াবহ চিত্র আঁকা আছে তার মনের পটে।

সার্থক সর্বেশ্বর। শোকাতুরা বালিকার মনকে অন্যদিকে মোড় ফিরিয়েছে। নন্দন ভিতু কিন্তু অদ্ভুত চতুর। সংস্কৃতচর্চা করেনি জীবনে। কিন্তু চোখ পিটপিট করে অদ্ভুত সব ভাষা আওড়াতে লাগল অর্ধোফুট গলায়। তার মধ্যে অপর্যাপ্ত অনুস্বার ও বিসর্গের ছড়াছড়ি। অর্থাৎ শাস্ত্র ঘেঁটে, মন্ত্র আউড়ে গঙ্গার বাপের গতি আবিষ্কৃত হচ্ছে।

সর্বেশ্বর দেখছে শিকারের গতি। জাল ঠিক পাতা হচ্ছে কি হচ্ছে না, নজর সেই দিকে।

শোকাতুরা বালিকার মনে কৌতূহল ও ভয়ের ছোঁয়া লেগেছে। নন্দনের মন্ত্রপাঠ, সর্বেশ্বরের গাম্ভীর্য, সর্বোপরি অপঘাত মৃত্যুর আত্মার গতি সন্ধান, সব মিলিয়ে একটা থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। শুধু ভানুমতীর চোখেই এই পরিবেশ।

সর্বেশ্বর ডাকল, নন্দন!

নন্দন নিজের পৈতায় হাত রেখে ইশারা করল সর্বেশ্বরকে। সর্বেশ্বর হাত রাখল তার পৈতায়। তারপরে নন্দন তার অদ্ভুত সংস্কৃত ভাষায় কতকগুলি দুর্বোধ্য কথা বলে উঠল।

সর্বেশ্বর কপালে চোখ তুলে বলল, সর্বনাশ! আত্মা এর মধ্যেই প্রেত হয়েছে? কী রকম চেহারা? কালো কুচকুচে ঘোড়ার মতো? মানুষের মতো মুখ? ভয় কার বেশি। আইবুড়ো মেয়ের? তা হলে নৌকা ফেরাতে বলি মাঝিকে?

নন্দন নীরব। উভয়ে আড়চোখে দেখছে ভানুমতীকে। হাঁটু থেকে মুখ তুলেছে ভানু। ভয় পেয়েছে মেয়েটি। এক ফোঁটা মেয়ে। কথা বলে পাকা পাকা। দস্যিপনা করে ঘুরে বেড়ায় সারাদিন। তারই মধ্যে হাত ঘেঁচে, কোমর ভেঙে, জল ফেলে রান্না করে। বাপের কাছে আদর কাড়ায়। রাত হলে গুটিসুটি হয়ে পড়ে ঘুমোয় বাপের কোলের কাছে। মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে চোখ মেলে না অন্ধকারে। হাত দিয়ে বাপকে ছুঁয়ে ঢলে পড়ে আবার ঘুমের কোলে।

সেই মেয়ে। অকপটে বিশ্বাস করল সব কথা। শোকের বেড়া ভেঙে ঢুকল মানুষমুখো অশ্বদেহ প্রেত। অসহায় মেয়ে ভয়ে কথাটি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করতে ভরসা পেল না। গলা শুকিয়ে আসছে। কান্না ঠেলে আসছে আরও বেগে। ভাবনার তার দিকপাশ নেই। যখন যেটুকু মনে আসে, শুধু সেটুকু। তার বাইরে চিন্তা করবার ক্ষমতা নেই।

সম্ভবত সাবালিকা হলেও এই মিথ্যে আতঙ্ক হতে রেহাই পেত না। দেশ, সমাজ ও কালাচার বুঝতে ভুল করেনি কোনওদিন সর্বেশ্বর আর নন্দন। বিশেষ করে সমাজের নিম্নবর্ণ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা তাদের গভীর। উচ্চবর্ণেও কম নয়। সমাজের বুকে লুকানো পাপ ও দুর্বলতাই তাদের একমাত্র মূলধন। কোথায় কী রকম জাল বিস্তার করতে হবে, তারা জানে। তারা জানে নিখুঁত অভিনয়। তারা পারে ভগবানকে ভূত করতে।

আর, এ তো সামান্য বালিকা? এগারো বছর বয়স। তবুও বাপের মৃতদেহ দেখতে যাবে কি যাবে না, এ সংশয়ে অসহায় ভীত চোখে ভানু দেখছেনন্দনকে। দেখছে সর্বেশ্বরকে। আর ভাবছে, সেই নিষ্ঠুর প্রেতমূর্তি যদি তাকে ধরে। তার এগারো বছরের জীবনে সে ইতিহাস বিরল নয় হালিশহর গ্রামে। সহৃদয় বাপ আর নিষ্ঠুর প্রেত, দুয়ে মিলে তোলপাড় ভানুর হৃদয়।

জাল পাতা হয়েছে। জাল তুলতে হবে। ফসকে না বেরিয়ে যায়। আটঘাট বেঁধে তুলতে হবে। চারা পোনা, কিন্তু খাঁটি রুই। আখেরে ফল পাওয়া যাবে ভাল।

নন্দন আবার কথা বলল তার সেই দুর্বোধ্য ভাষায়। কত হাস্যকর কিন্তু ভানুর কাছে কী ভয়ংকর।

সর্বেশ্বর বলল আতঙ্কিত গলায়, বলো কী নন্দন, এর মধ্যেই হালিশহরের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে গঙ্গার বাপ? প্রেতের নজর কার দিকে?

নন্দন বলল, মেয়ের দিকে।

আতঙ্কে অস্ফুট শব্দ করে ভানু ঘেঁষে এল সর্বেশ্বরের কাছে। তার প্রাণ শুকিয়ে গেছে প্রেতের ভয়ে। সুন্দর মুখ সাদা হয়ে উঠল। আর এই অসহায় মুহূর্তে কেউ নেই। কেউ নেই এই দুই ঘুঘু ছাড়া। কিন্তু একফোঁটা মেয়ের জন্যে তাদের প্রাণে নেই এক ছিটে মমতা। তাদের প্রাণে সাফল্যের উল্লাস।

নন্দনকে থামতে ইশারা করে ব্যথিত গলায় বলল সর্বেশ্বর, আহা, একটুখানি মেয়ে। কার কপালে যে কী লেখা থাকে। রাম রাম বল। তুই ডরাসনি গঙ্গা। আমরা তো রয়েছি। শত হলেও বামুন, গলায় পৈতে রয়েছে। এখানে আসতে পারবে না সে। বেহ্মদত্যিই পারে না আসতে, তা আবার তোর বাপ।

নন্দনকে বলল, তা হলে কী করা যায় নন্দন?

নন্দন বিরাগ ভরে বলল, কী আর করবে। শত হলেও পরের মেয়ে। নইলে তোমার কোনও আত্মীয়ের বাড়ি রেখে আসতে পারতে। তবে, হালিশহর গাঁয়ে এখন না যাওয়াই ভাল।

ভয়ে মেয়ে কাঠ। অজান্তে এসেছে চোখে জল। বলল, ঘটক ঠাকুরদা, বকু পিসির বাড়িতে নে চল আমাকে।

সর্বেশ্বর বলল, শুনলি তো, হালিশহরে গেলে সে তোর কাছে আসতে পারে। তবে? সে কার কাছে যাবে? থাকবে কার কাছে! মা নেই। বাপ মরে হল শত্রু। সেই শত্রু ঘুরছে তার পিছে পিছে।

সর্বেশ্বর বলল, চল, দিন সাতেকের জন্যে গুপ্তিপাড়ায় থাকবি। আমার বোনের বাড়ি। তারপর আবার নিয়ে আসব, কেমন? কথায় বলে গুপ্তিপাড়ার মাটির গুণে, দেবের ভাষা মানুষ জানে। হেঁ হেঁ, সাক্ষাৎ ভগবানের থান!

গুপ্তিপাড়া! সে যে অনেক দূর! কোনও জবাব দিল না ভানুমতী। নৌকার পাটাতনে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে ডুকরে চিৎকার করে উঠল।

সর্বেশ্বর চমকে উঠে বলল, কী হল রে!

ভানু বলল, আমার কী হবে তা হলে ঠাকুরদা?

সর্বেশ্বর কপট স্নেহের হাসি হেসে বলল, পাগলি! কী আবার হবে। আমার কাছেই থাকবি। ভয় কী তোর। চল, আমার বোনের বাড়িতে দু দিন থাকবি, আবার চলে আসবি। না হয়, ওখানেই থাকবি। তোর আর রইল কে এখানে? সেখানে তোকে আদর যত্ন করবে, খেতে পরতে দেবে। বেশ থাকবি। তারপর…তারপর আমার বোনের কথা শুনলে দেখিস কত কী দেবে। কত গয়না দেবে। তোর মতো সুন্দর মেয়ে। বোনের আমার কত গয়না আছে, সব–একেবারে সব তোকে দেবে।

কিন্তু কে শোনে! ভানুর কান্না বাধা মানে না। সে গয়না ভালবাসে। সাজতে গুজতে ভালবাসে। এখন সে কথা একটি বার মনেও আসছে না। জীবনে তার শুধু অন্ধকার। অন্ধকার আর জ্বলন্ত প্রেত-চক্ষু।

সর্বেশ্বর বলল, দেখি মাঝিকে বলে আসি।

 কিন্তু মাঝিকে বলার দরকার ছিল না। সে ঠিক চলেছে। গঙ্গায় ভরা জোয়ার, তার উপরে দক্ষিণী হাওয়া মেতেছে আরও। পালে হাওয়া লেগে নৌকা দ্রুত বেগে চলেছে উত্তরে।

কোথায় হালিশহরের ওপার, আর কোথায় এসে পড়েছে নৌকা। সর্বেশ্বর বাইরে এসে দেখল, বংশবাটি ঘেঁষে চলেছে দ্রুতগামী নৌকা। বংশবাটির রাজাদের বিষ্ণুমন্দির রয়েছে এখানে। রয়েছে। রাজাদের হংসেশ্বরীর মন্দির। জাগ্রত মা কালীর থান। মন্দির দেখা যায় না। তবু হংসেশ্বরীর ত্রয়োদশ চুড়োর উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকাল সর্বেশ্বর। হাত ঠেকায় বিষ্ণু ঠাকুরের উদ্দেশে। আর পুবে ওপারে আছে জাগ্রত কেষ্ট রায় ঠাকুর। সর্বেশ্বর সেদিকে হাত-জোড় করে বলল মনে মনে, শেষরক্ষে করো ঠাকুর।

পেছন ফিরে তাকাল সর্বেশ্বর। সাগঞ্জের বাঁক ফিরে হুগলি চুঁচুড়া হারিয়ে গেছে চোখের আড়ালে। আড়াল পড়ে গেছে হালিশহর। না, পেছনে কোনও নৌকা নেই। পেছনে ধাওয়া করেনি কেউ। কোনও বাধা নেই। কোনও ভয় নেই।

চাপা উল্লাসের হাসিতে ভয়ংকর হয়ে উঠল সর্বেশ্বরের মুখ। আবার ফিরে তাকাল সামনে।

নৌকা চলেছে পশ্চিম পাড় ঘেঁষে। ডাইনে কাঁচড়াপাড়া, বাঁয়ে বংশবাটি। তারপরে ত্রিবেণী। বেলা বড়। তবু এর মধ্যেই ঢল খেয়েছে। ত্রিবেণী পার হতেই সন্ধ্যা হবে হয়তো। অথচ যেতে হবে গুপ্তিপাড়া। হুগলি জেলার শেষ সীমান্ত, শান্তিপুরের পরপার। পথ এখনও দীর্ঘ। রাত হয়ে যাবে অনেক।

এদিকে সন্ধ্যার সময়ে ত্রিবেণী আর তার আশপাশটা বিশেষ সুবিধার নয়। শিক্ষিত ভদ্র বামুনদের ডাকাতি করার রেওয়াজ আছে এদিকে। কিছুই নেই। কিন্তু যেটি আছে সেটিকে নিলেই সব গেল।

সর্বেশ্বর মাঝিকে বলল, সন্ধ্যার পরেই পৌঁছনো যাবে? মাঝি বলল, সবই বাতাসের হাত। বাতাস ঠিক থাকলে, পৌঁছে যাব।

সর্বেশ্বর মনে মনে বলল, বাতাস ঠিক আছে। কেবল ডাঙায় ওঠার সময় শিকার গণ্ডগোল করে না বসলেই হয়। এক বার গুপ্তিপাড়ায় নিয়ে তুলতে পারলে হয়। তারপর বোনের বাড়ি? তার অভাব হবে না।

কিন্তু মায়াজাল পাতা হয়েছে, মায়ার ঠাস বুনানি গাঁথা হয়নি। গঙ্গা ভয় পেয়েছে। এবার লোভ দেখাতে হবে। রাজবাড়ি, দাসদাসী, সোনাদানা, শাড়ি। এক বার যখন জ্যান্ত বাপকে মেরে ফেলা গেছে, তখন সুখের ভাতে হাত দিতে আপত্তি করবে না। কচি মেয়ে। পিঠে হাত বুলিয়ে পথে আনতে কতক্ষণ।

সর্বেশ্বর ভেতরে এল। এসে দেখল,নন্দনের পা জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ভানুমতী। হ্যাঁ রূপই বটে। চোখে লেগেছিল এই রূপ চার বছর আগে। সেইদিন প্রথম মনের মধ্যে অঙ্কুরিত হয় এই বাসনা। সে বলল নন্দনকে, খাওয়ার কিছুই নেই নন্দন? আহা, দাও চাড্ডি বেচারিকে।

আগে থাকতেই সব ব্যবস্থা ছিল। নন্দনকে চিড়ে আর মুড়ির পুঁটলিটা বার করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আছে। এনেছিলাম নিজের জন্যে। ভেবেছিলাম, ফিরতে দেরি হলে খাব। নে লো দিদি, নে। খেয়ে নে, কাঁদিসনে। আহা, আমরা তো আছি।

কে খাবে। ছোট্ট প্রাণটুকু বেদনায় ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। তার ক্ষুধা তৃষ্ণা, তার হাসি গান কথা, তার খেলা বেড়ানো, তার অবাধ জীবনের পথ রুদ্ধ হয়েছে চিরতরে। পাষাণ চাপা বালিকা প্রাণে তার কান্না ছাড়া আর কিছু নেই।

ঘনিয়ে এল সন্ধ্যা। গাঁয়ের বউ ঝিয়েরা দল বেঁধে আসছে ঘাটে। বৈশাখের খর দুপুরের পর ছায়াঘন সন্ধ্যা। ঘাটে ঘাটে মেয়েদের হাসির লহরী। বুকে কলসি আটকে জল ছোঁড়াছুড়ি। ঘোমটা তুলে দেখছে। যাত্রী নৌকা। এর মধ্যেও তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা দিতে হবে, বাতি জ্বালতে হবে। বাজাতে হবে শাঁখ।

হালিশহরের ঘাটেও এখন বউ-ঝিদের মেলা বসেছে। ভানুর মন গুমরে উঠল। গাঁয়ে থাকলে সেও এখন জলে নামত। সারাদিনের রোদ-পোড়া শরীর জুড়িয়ে শীতল হত। একলা নয়। সঙ্গিনী থাকত অনেকগুলি। কিন্তু, কী করে যাবে সে। সারা গাঁয়ের আকাশে, গাছে গাছে, পথে পথে দুরন্ত শত্রু রয়েছে ঘাপটি মেরে। ভাবতে গিয়েও বুকের মধ্যে পেঁকির পাড় পড়ছে। সে তো আর এসে ডাকবে না ভানি ভানি বলে। চেঁচিয়ে ডাকবে না, গঙ্গা গঙ্গা। বিশালকায় কালো ঘোড়ার ঘাড়ে মানুষের মুখ। লাথিয়ে ভাঙবে শুধু মাথা। বাবা, আমার বাবাগো!

তবু, তবু ফিরে যেতে মন চাইছে। সে লুকিয়ে থাকবে আঁচল ধরে, বকু পিসির। বুকের মধ্যে তার কে চিৎকার করে উঠল, যাব না, যাব না। মুখ তুলে বলতে গেল, ঠাকুরদা, যাব না।

হুঁশিয়ার সর্বেশ্বর যেন সর্বজ্ঞ। তো এখন বলছে নন্দনকে, নন্দন, রাম নাম করো। হাওয়া বড় সুবিধের নয়।

নন্দন ভাবল, বৈশাখ মাস, ঝড় আসছে। বলল, কেন, মেঘ করেছে?

সর্বেশ্বর দেখছে ভানুকে। বুঝেছে, সন্ধ্যা যত ঘনাচ্ছে, ভানুর মন তত ফিরে যেতে চাইছে। কিন্তু তা আর হবে না। বলল, তোমার মাথা। গঙ্গার বাপ!

শিশু ভানু শিউরে উঠে দু হাতে আঁকড়ে ধরল সর্বেশ্বরের পৈতা।

সর্বেশ্বর তার মাথায় হাত রেখে বলল, সেই ভাল। ডরাসনি। শুয়ে থাক। বলে তির্যক দৃষ্টি হানল নন্দনের দিকে।

নন্দন বলল, রামং রামং রামং।

ঘোর অন্ধকারে মিশে গেল আকাশ ও দুই তটভূমি। হাওয়ায় ভেসে এল শেয়ালের চিৎকার। কুকুরের ক্রুদ্ধ প্রত্যুত্তর। তারপর সমস্ত জগৎ জুড়ে শুধু গঙ্গার ছলছলানি, কলকলানি, গলুইয়ের তলায় ঢেউয়ের ছপছপানি।

গুপ্তিপাড়ায় এসে যখন নৌকা ভিড়ল, তখন সমস্ত গ্রাম ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ। কেবল টিং টিং করে বাজছে ঘণ্টা। হয়তো কোনও মন্দিরে। ভোগের পর দেবতার শয়নপর্ব শুরু হল।