ছয়ে ঋতু

ছয়ে ঋতু

৯ মার্চ সকালবেলা দিল্লির নিগমবোধ শ্মশান ঘাটের বাইরে এবং ভিতরে কড়া নিরাপত্তা। ইলেকট্রিক চুল্লিতে জ্বলছে বসন্ত রাঠির মৃতদেহ। বসন্ত আইএএস অফিসার ছিলেন, কাজ করতেন প্রতিরক্ষা দপ্তরে। অবসর নেওয়ার পরে গ্রেটার কৈলাশে থাকতেন। আজ সকালেই মারা গেছেন।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ চিতা থেকে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে যমুনার জলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। মার্চের গোড়ায় ভালোই গরম পড়লেও রঞ্জিতের পরনে স্যুট। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল প্রথমা। বলল, ‘এখানে ডাকলেন কেন? আগামীকাল আপনার দপ্তরে কথা বলা যেত না?’

রঞ্জিতের পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাড়ে ছ’ফুট লম্বা দুই জাঠ দেহরক্ষী। পরনে স্টিল গ্রে রঙের সাফারি। তারা নির্লিপ্তভাবে প্রথমাকে দেখে চোখ সরিয়ে নিল। ওরা জানে, ম্যাডাম উঁচুদরের আমলা। ওরা যেটা জানে না, সেটা হল, প্রথমা ভারত সরকারের এলিট ইনটেলিজেন্স উইং ‘কাইমেরা’-র সদস্য। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রঞ্জিত গগৈ, প্রধানমন্ত্রী হরভজন সিং এবং রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জি—এই তিনজনের বাইরে কাইমেরার খবর জানেন আঙুলে গোনা কয়েকজন আমলা। প্রথমার রিপোর্টিং অথরিটি রঞ্জিত।

রঞ্জিত বললেন, ‘প্র্যাট, আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেত না। তুই কাল সুবর্ণভূমি বেরিয়ে যাচ্ছিস। কবে ফিরবি ঠিক নেই। সিবিআই আমাকে একটা ফাইল পাঠিয়েছে। সেটা পড়ে আর ওয়েট করতে পারলাম না।’

‘ফাইলে কী আছে?’ ডানদিকে তাকাল প্রথমা। রাষ্ট্রপতি অরুণ চ্যাটার্জিও শ্মশানে এসেছেন। বসন্ত তাঁর বন্ধু ছিলেন।

‘ফাইল বলছে যে গত কয়েক মাসে তিনজন অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার, একজন মন্ত্রী এবং একজন…’ খুকখুক করে কাশেন রঞ্জিত, ‘দেশপ্রেমিকের মৃত্যু হয়েছে।’

দেশপ্রেমিক মানে গুপ্তচর। জেমস বন্ডের মতো স্পাই বাস্তবেও আছে। প্রথমাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র সুবর্ণভূমি যাচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি করতে।

‘অবসরপ্রাপ্ত মানে সিনিয়ার সিটিজেন,’ বলল প্রথমা, ‘বয়স্ক মানুষেরা মারা যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক।’

‘ঠিক। কিন্তু ফাইলে যা আছে, সেটা পড়লে একটু অন্যরকম লাগে। তুই পৌষালী সেনগুপ্তকে চিনতিস?’

‘দীর্ঘদিন ওয়ারিস্তানে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।’

‘রিটায়ার করার পরে পৌষালী কলকাতায় শিফট করেছিলেন। গত ২৫ ডিসেম্বর কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। এই ঘটনার দু’মাস আগে, ২২ অক্টোবর, হরিয়ানার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সিং মারা গেছেন গাড়ি দুর্ঘটনায়। মুসৌরি যাওয়ার সময়ে গাড়ি খাদে পড়ে গিয়েছিল।’

‘আজকের ডেথ কীভাবে হয়েছে?’ চিতার দিকে তাকায় প্রথমা।

‘বসন্ত রাঠি রিটায়ার করার পরে ডিপ্রেশানে ভুগছিলেন। সাইকায়াট্রিস্ট দেখিয়ে একগাদা ওষুধ খেতেন। তার মধ্যে ঘুমের ওষুধও ছিল। বসন্তের বাড়ির লোক বলেছে ওঁর ডেডবডির পাশে গোটা দশেক ওষুধের খালি স্ট্রিপ পড়েছিল। পোস্ট মর্টেমের করার সময়ে স্টম্যাকে প্রচুর ট্যাবলেট পাওয়া গেছে।’

চিতা নিবে গেছে। রাষ্ট্রপতি গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন। রঞ্জিত প্রথমাকে বললেন, ‘তুই সুবর্ণভূমি থেকে ফিরলে দু’জনে মিলে ফাইলটা নিয়ে বসব।’

যমুনার জলে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে প্রথমা বলল, ‘আচ্ছা।’

ব্যাগ গোছানো কমপ্লিট। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টে চোখ বোলাচ্ছে আব্রাহাম। ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স। সব একদম ঠিকঠাক। জিয়া চৌধুরী সব ডকুমেন্ট নিখুঁত ভাবে জাল করে পাঠিয়ে দিয়েছে।

আব্রাহাম। ওয়ারিস্তানের এই মাথামোটা, নিরক্ষর, ভারতবিদ্বেষী ভাবাদর্শে ডুবে থাকা যুবকটিকে লালন করেছে ওয়ারিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেত্রী জিয়া চৌধুরী এবং তার স্বামী রকি চৌধুরী।

রকি অতীতে ওয়ারিস্তানের আর্মি চিফ ছিল। পরিস্থিতির চাপে সে হয়ে যায় ওয়ারিস্তানের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড পারসন’। দীর্ঘদিন বাহামায় আত্মগোপন করে থাকার পরে, এক বছর আগে বেনামে দেশে ফিরেছে। জিয়া অতীতে কিছুদিনের জন্যে ওয়ারিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল। পরে ক্ষমতাচ্যুত হয়। স্বামী-স্ত্রীর এখন একটাই মিশন। প্রতিশোধ! যে ভারতীয়রা তাদের এই অবস্থার জন্যে দায়ী, তাদের এক এক করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে না দিলে শান্তি নেই। দু’জনে মিলে চক আউট করেছে—কবে, কোথায়, কার ওপরে, কী ভাবে হামলা চালাতে হবে। কাজ হয়েছে ধাপে ধাপে। পাঁচবার রকি বেনামে ভারতে ঢুকে কাজ সেরে ফেরত এসেছে। রইল বাকি এক। আজ ৬ মে। আগামী ৮ মে অন্তিম মিশন। সেই মিশন সফল করতে রকি আর ইন্ডিয়ায় যাবে না। যাবে আব্রাহাম।

আব্রাহামের জন্ম কলকাতা শহরে। ঝাড়ুদার বাবা আর অশিক্ষিত মায়ের সপ্তম সন্তান। কলকাতা শহরে টাকা নেই। বেশি উপার্জনের জন্যে বাবা চলে গেল ওয়ারিস্তানে। কয়েক বছর বাদে নিয়ে গেল আব্রাহাম সহ ছয় ভাইবোন আর তাদের মাকে। কলকাতার বাঙালি পাড়ায় জন্ম বলে আব্রাহাম নিখুঁত বাংলা বুঝতে, বলতে এবং পড়তে পারে। লিখতে পারে না। সে ভারতে যাচ্ছে ছদ্ম পরিচয়ে। মনোজ চৌধুরী নামে দিল্লি এয়ারপোর্টে নামবে। তারপর ঋতুপর্ণ বিশ্বাস হয়ে যাবে।

ঋতুপর্ণ বিশ্বাস অতীতে দিল্লিতে থাকতেন। এখন আমেরিকার বাসিন্দা। ইংরিজি ভাষায় একাধিক কবিতার বই আছে। রবি ঠাকুরকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে বাংলায় একটি দীর্ঘ কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। ‘শ্যামসমান’ নামের বইটি একাধিক পুরষ্কার পেয়েছে। সতেরোটি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।

উত্তর ওয়ারিস্তানের আওয়ারাবাদ শহরের ফ্ল্যাট থেকে বেরোল আব্রাহাম। ফ্ল্যাটের বাইরে ছোট্ট চারচাকা রাখা রয়েছে। আব্রাহাম গাড়িতে ওঠার পরে জিয়ার বিশ্বস্ত ড্রাইভার গাড়ি ছোটাল। এক ঘণ্টা জার্নির শেষে এয়ারপোর্ট। গাড়ি থেকে নেমে চেক ইন কাউন্টারের দিকে এগোল আব্রাহাম। হ্যান্ডব্যাগ ছাড়া তার কাছে কিছু নেই।

প্লেন ছাড়ল সকাল সাড়ে ন’টায়। মাত্র দু’ঘণ্টার ফ্লাইট। বিমানবালার দেওয়া প্রাতঃরাশ সারতে না সারতেই পাইলটের ঘোষণা শোনা গেল। প্লেন আর কিছুক্ষণের মধ্যে দিল্লি এয়ারপোর্টে টাচ ডাউন করবে।

আব্রাহামের গন্তব্য পাহাড়গঞ্জের ‘হোটেল ডেলাইট’। এই হোটেলটি বাছার প্রথম কারণ, এখানে নজরদারি ক্যামেরা নেই। দ্বিতীয় কারণ, এখান থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে পাঁচতারা হোটেল, দিল্লি শেরাকন। যেখানে আজ সকালে ঋতুপর্ণ বিশ্বাস চেক ইন করেছেন।

৬ মে দুপুরেই প্রথমার সঙ্গে করমর্দন করে রঞ্জিত বললেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশানস প্র্যাট! সুবর্ণভূমির কেসটা তুই যেভাবে উতরে দিলি, আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইয়ু।’

‘ছাড়ুন তো!’ ক্যাজুয়ালি শ্রাগ করে প্রথমা, ‘এদিককার কী খবর?’

‘খবর বলতে পরশু রাষ্ট্রপতি ভবনে সাহিত্য সম্মেলন। আমাদের রাষ্ট্রপতি রবি ঠাকুরের ভক্ত। টিভি এবং খবরের কাগজের কল্যাণে সারা পৃথিবীর লোক এখন জানে, প্রতি বছর পঁচিশে বৈশাখ রাষ্ট্রপতি ভবনে একটি কবি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিরা সেখানে রবি ঠাকুরের কবিতার অনুবাদ পাঠ করেন। কবিতা পাঠের শেষে রাষ্ট্রপতি কবিদের গীতাঞ্জলির কপি উপহার দেন। এরপরে কবিদের সঙ্গে করমর্দন। শেষে চা চক্র। এই নিয়ম বদলায় না।’

‘বাঙালিদের নিয়ে এই হল বিপদ। সব সময় কালচারের পোকা কুটকুট করে।’ টিপ্পনি কাটে প্রথমা।

রঞ্জিত বললেন, ‘এইবারে কবিতা পড়তে আসছেন সিংহদ্বীপের প্রকাশ জয়সূর্য, আমেরিকার ঋতুপর্ণ বিশ্বাস, শ্যামলদেশের গুলশান খাতুন, মালব্যনগরের সানি কৈরালা, ওয়ারিস্তানের বাবুল বিশ্বাস, ভোটল্যান্ডের তপন ব্রহ্ম। এ সব কথা ছাড়। সেই ফাইলটা নিয়ে তোর সঙ্গে কথা আছে।’

‘বসন্ত রাঠি, পৌষালী সেনগুপ্ত, আর হেমন্ত সিং-এর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ফাইল। বাকি নামদুটো তুমি বলোনি।’

‘দেশপ্রেমিক শারদ ধিলোঁ আমাদের হয়ে ওয়ারিস্তানে কাজ করতেন। আশিকানা প্রাসাদের মিউজিশিয়ান ছিলেন। ওয়ারিস্তানে ক্যু হওয়ার পরে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে আসেন। ওয়ারিস্তানে আর ফিরে যাননি। ২৮ আগস্ট উনি খুন হয়েছেন। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি। পেশাদারি কাজ। রাষ্ট্রপতির নির্দেশে ওঁর বাড়ির লোক মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন।’

প্রথমা বলল, ‘আর একজন বাকি আছেন।’

‘বারিশ তেন্ডুলকার। মহারাষ্ট্র ক্যাডারের মেয়ে। আইএফএস ছিলেন। মিনিস্ট্রি অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স বা বৈদেশিক মন্ত্রণালয় থেকে অবসর গ্রহণের পরে লোনাভালায় নিজের ফার্ম হাউজে থাকতেন। বিয়ে করেননি।’ ফাইলের পাতা উল্টে রঞ্জিত বলেন, ‘গত ২৪ জুন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কামওয়ালি বাই সকাল ন’টার সময়ে বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে যে মালকিন ঝুলছেন। সেই পুলিশ আর পড়শিদের খবর দিয়েছিল।’

প্রথমা ফাইল উল্টোচ্ছে। ‘এটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর কো-ইনসিডেন্স নয়। এটা সিরিয়াল কিলিং। খুনের তারিখগুলো হল ২৪ জুন, ২৮ আগস্ট, ২২ অক্টোবর, ২৫ ডিসেম্বর, ৯ মার্চ। ক্রোনোলজিক্যালি খুন হয়েছেন বারিশ, শারদ, হেমন্ত, পৌষালি, বসন্ত। অর্থাৎ বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত আর বসন্ত। ছয় ঋতুর মধ্যে পাঁচটি খতম। বাকি রইল গ্রীষ্মকাল। আমরা জানি যে সিরিয়াল কিলিং-এর মধ্যে প্যাটার্ন থাকে। আর সেই প্যাটার্নের মধ্যে খুনির মানসিকতা বা মোটিভ লুকিয়ে থাকে। প্যাটার্ন ধরতে পারলে খুনিকে ধরা যায়। এটা বোঝা যাচ্ছে, যিনি খুন হবেন, তাঁর নামে গ্রীষ্মের অনুষঙ্গ থাকবে। আর, ঘটনাটা ঘটবে কয়েকদিনের মধ্যে। কিন্তু আমরা কি পুরো প্যাটার্নটা ধরতে পারলাম?’

রঞ্জিত বললেন, ‘তার থেকেও বড় কথা, খুনগুলোর মোটিভ কী?’

আজ ৮ মে। গতকাল রাত্তিরে তোফা ঘুম হয়েছে। সকালে ভরপেট ব্রেকফাস্ট সারল মনোজ চৌধুরি। তার পরনে সাদা টিশার্ট আর নীল জিনস। পায়ে স্নিকার্স, কাঁধে ব্যাকপ্যাক। সকাল আটটার সময় ‘হোটেল ডিলাইট’ থেকে চেক আউট করল মনোজ। অটো ধরে চলে এল কনট প্লেস। সেখানে এক ছোকরা মনোজের হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে কেটে পড়ল।

এই ছোকরা ওয়ারিস্তানের এজেন্ট। ওয়ারিস্তানের হয়ে টুকটাক কাজ করে টাকা পায়। এইরকম অনেক এজেন্ট সারা ভারতে ছড়ানো রয়েছে।

কনট প্লেস থেকে অটো ধরে মনোজ চলে এল দিল্লি শেরাকনের সামনে। সে জানে, এই হোটেলে ঢোকার চারটে রাস্তা আছে। প্রথম দুটো অতিথিদের এন্ট্রান্স ও এক্সিট। যেখানে সিকিয়োরিটির মারাত্মক কড়াকড়ি। গায়ে মেটাল ডিটেক্টর বোলানো, ফ্রিস্কিং, গাড়ির ডিকি খুলে দেখা, গাড়ির তলায় আয়না দিয়ে উঁকি মারা কী নয়! কাজেই ওই দুই পথ বাদ। মালপত্রের গাড়ি ঢোকার জন্যে হোটেলের পিছনের দিকে একটা রাস্তা আছে। গাড়ি পৌঁছয় বেসমেন্টের কার পার্কিং-এ। বেসমেন্টে গাদাগাদা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। সেটাও চলবে না।

মনোজের পছন্দ কর্মচারীদের ঢোকা-বেরনোর জন্যে একটি পুঁচকে দরজা, যেটি হোটেলের লন্ড্রির পাশ দিয়ে গিয়ে কিচেনে পৌঁছেছে। সে জানে, পাঁচতারা হোটেলে সিসিটিভির ক্যামেরা থেকে নিজেকে লুকোনো যায় না। সে নিজেকে লুকোতে চাইছেও না। সে চাইছে, আগামী চব্বিশ ঘণ্টা কেউ যেন তার সিসিটিভি ফুটেজ না দেখে। তার মধ্যেই সে কাজ সেরে সবার নাগালের বাইরে চলে যাবে।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল মনোজ। লন্ড্রির দরজার হাতল ঠেলল। বিশাল বড় বড় ওয়াশিং মেশিনে কাপড়জামা ধোওয়ার কাজ চলছে। সাদা ওভারল পরা কর্মচারীরা ঘোরাঘুরি করছে। মাথায় টুপি এবং মুখে মাস্ক। তাদের টপকে কোনের দিকে গেল মনোজ। এইখানে, ছোট ছোট লকারে হোটেলের স্টাফেদের ইউনিফর্ম রাখা থাকে। তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে এইসব তথ্য সরবরাহ করেছে হোটেল শেরাকনের এক ওয়ারিস্তানপ্রেমী কর্মচারী। মনোজ তাকে চেনে না।

পুরনো পোশাক ব্যাকপ্যাকে ঢোকাল মনোজ। ব্যাকপ্যাক কাঁধে ঝুলিয়ে তার ওপরে রুম সার্ভিসের পোশাক চড়াল। গ্লাভস পরে সদ্য কাচা বেড লিনেনের ট্রে হাতে লন্ড্রি রুম থেকে বেরোল। কিচেনের পাশ দিয়ে হেঁটে ঢুকে পড়ল হোটেলের করিডোরে। এইখানে যে লিফটটি আছে সেটি শুধুমাত্র হোটেলের কর্মচারীদের জন্যে।

ফাঁকা লিফটে উঠে বোতাম টিপল মনোজ। সে জানে, ঋতুপর্ণ বিশ্বাস গতকাল সকালে সাততলার ৭১৮ নম্বর রুমে উঠেছেন। ৭১৭ নম্বরে ওঠার কথা প্রকাশ জয়সূর্যর। ৭১৯ থেকে ৭২২ নম্বর রুম বরাদ্দ আছে গুলশান খাতুন, সানি কৈরালা, বাবুল বিশ্বাস এবং তপন ব্রহ্মর জন্যে।

৭১৮ নম্বর রুমের দরজায় নক করে মনোজ। ‘রুম সার্ভিস। মে আই কাম ইন?’

‘ডু কাম ইন!’ খুশিয়াল চিৎকার শোনা গেল। সন্তর্পণে গ্লাভস পরা হাতে দরজার নব ঘোরাল মনোজ।

টিভিতে ভারত বনাম ওয়ারিস্তানের ফুটবল ম্যাচ চলছে। এখনও পর্যন্ত খেলা গোলশূন্য। এইরকম সময়ে ভারত একটা পেনাল্টি কিকের সুযোগ পেয়েছে। ঋতুপর্ণ মন দিয়ে খেলা দেখছেন।

বেড লিনেনের ট্রে টেবিলে রেখে পিছন থেকে হাত বাড়িয়ে ঋতুপর্ণর নাকমুখ চেপে ধরল মনোজ। মিনিট দুয়েকের ধস্তাধস্তির পরে ঋতুপর্ণ মারা গেলেন।

ঋতুপর্ণর মৃতদেহ বেড লিনেনে মুড়ে আলমারিতে ঢুকিয়ে দিল মনোজ। লাশের পচন শুরু হওয়ার পরে সেই গন্ধ রুমের বাইরে যেতে ঘণ্টা আটেক সময় লাগবে। ততক্ষণে মনোজের কাজ শেষ হয়ে যাবে।

রুম সার্ভিসের ইউনিফর্ম খুলে লন্ড্রি বাস্কেটে রেখে দিল মনোজ। নিজের ব্যাকপ্যাক খুলে দেখল কনট প্লেসের ছোকরার দেওয়া প্যাকেটে কী আছে।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মেক আপ কিট এবং প্রস্থেসিস। হলিউড এবং বলিউডে এখন এইসব জিনিস ব্যবহার করা হয়। আয়নার সামনে বসে মনোজ নিজেকে ঋতুপর্ণয় বদলে নিতে লাগল। এগারোটা বাজে। রেডি হতে চার ঘণ্টা লাগবে।

তিনটের মধ্যে মেক আপ শেষ। কনট প্লেসের ছোকরার দেওয়া প্যাকেট থেকে মনোজ বার করল একটি বেল্ট। সেটি কোমরে বেঁধে নিয়ে ঋতুপর্ণর ব্যাগ ঘেঁটে কুর্তা, পাঞ্জাবি আর কোলাপুরি চপ্পল বার করল। সেগুলো পরে নেওয়ার পরে কাঁধে নিল ঋতুপর্ণর ট্রেড মার্ক—ঝোলাব্যাগ।

ব্যস! মনোজ থেকে ঋতুপর্ণয় বদল সম্পূর্ণ।

৭১৮ নম্বর রুম থেকে বেরোলেন ঋতুপর্ণ। বাকি পাঁচ কবি হোটেলের ফয়্যারে অপেক্ষা করছিলেন। একগাদা সিসি ক্যামেরাকে সাক্ষী রেখে ঋতুপর্ণ হোটেল শেরাকন থেকে বেরিয়ে সরকারি গাড়ি চেপে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে রওনা হলেন।

আব্রাহাম পেশাদার খুনি নয় বলে সে দুটো ভুল করল। এক নম্বর, সে ভুলে গিয়েছিল যে ঋতুপর্ণ রুমে বসে বিয়ার খাচ্ছিলেন। খালি বিয়ারের বোতল এবং মাগ ফেরত নিতে একটু পরেই রুম সার্ভিসের আসার কথা।

দ্বিতীয় ভুল, সে ফ্রন্ট ডেস্কে রুমের চাবি জমা করল না।

আব্রাহাম বেরিয়ে যাওয়ার পনেরো মিনিট পরে ৭১৮ নম্বর ঘরে রুম সার্ভিসের ফোন এল। কেউ ফোন ধরল না। পাঁচ মিনিট বাদে আবার ফোন এল। আবারও কেউ ফোন ধরল না। রুম সার্ভিস এবার স্টাফ পাঠাল। স্টাফ দেখল, রুম বাইরে থেকে লক করা। এই তথ্য জেনে ফ্রন্ট ডেস্ক বলল, ঋতুপর্ণ রুমের চাবি ফ্রন্ট ডেস্কে জমা রেখে যাননি।

এই খবর শুনে হোটেলের সিকিয়োরিটি অফিসার শ্রীবাস্তব সিসি ক্যামেরা চেক করলেন। দেখা গেল ঋতুপর্ণ রুম থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠছেন। একতলায় নেমে বাকি অতিথিদের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

শ্রীবাস্তবের মন খচখচ করছে। তিনি রুম সার্ভিসের পোশাক গলিয়ে মাস্টার কি দিয়ে ৭১৮ নম্বর রুমের দরজা খুললেন। বিয়ারের বোতল আর মাগ উঠনোর ফাঁকে রুম ছানবিন করে নিলেন। আলমারির দরজা খুলতেই ঋতুপর্ণর লাশ বেরিয়ে এল।

এরপরের ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল দ্রুত গতিতে। পুলিশ এল। রুটিন কাজ নিমেষের মধ্যে শেষ করে বডি ময়না তদন্তের জন্যে সফদরজং হাসপাতালে পাঠিয়ে দিল। অটপসি সার্জন প্রাথমিক রিপোর্টে বললেন, ‘গলা টিপে মৃত্যু। ডেথ বাই স্ট্র্যাঙ্গুলেশান।’

এতক্ষণ অবধি সব ঠিক ছিল। রুটিন ক্রাইম। রুটিন প্রসিডিয়োর। খুনিকে সিসিটিভি ক্যামেরায় একাধিক বার দেখা গেছে। এবার পাকড়াও করার পালা।

এই সময় আসল বোমাটি ছুড়ল ফ্রন্ট ডেস্কের কর্মী। সে পুলিশকে জানাল, ঋতুপর্ণ আমেরিকার নাগরিক এবং ভারত সরকারের অতিথি। সরকারি গাড়ি চেপে তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে গেছেন।

এবং এইখানে আব্রাহামের গল্পে ঢুকে পড়লেন রঞ্জিত।

রাষ্ট্রপতি ভবনের কালচারাল সেন্টারে সাজো সাজো রব। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী। অনুষ্ঠানের শেষে চা পানের আসর।

বিশাল বড় হলঘর আলোয় ঝলমল করছে। মাথার উপরে পেল্লায় ঝাড়বাতি। দেওয়ালে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিদের তৈলচিত্র টাঙানো। সাদা মখমলে মোড়া গোল টেবিল ঘিরে সাজানো চেয়ার। আমন্ত্রিত অতিথিরা চেয়ারে বসে নিচু গলায় কথা বলছেন। অতিথিদের সামনে একটি ডায়াস। ডায়াসের একপ্রান্তে একটি চেয়ার এবং একটি ওক কাঠের টেবিল রাখা রয়েছে। এখানে রাষ্ট্রপতি বসবেন। অন্যপ্রান্তে রয়েছে একটি পোডিয়াম এবং মাইক্রোফোন। এখানে কবিরা কবিতা পাঠ করবেন। ডায়াস এবং অতিথিদের আসনের মাঝখানে কবিদের বসার জন্যে চেয়ার রাখা রয়েছে। প্রতিটি চেয়ারে কবির নাম লেখা। ছয় কবি আসন গ্রহণ করলেন।

প্রথমার সাহিত্যে রুচি নেই। সে আসতে চাইছিল না। তাকে জোর করে টেনে এনেছেন রঞ্জিত। ‘আমার সঙ্গে থাক। সিরিয়াল কিলিং নিয়ে ভাব। প্রতি ঋতুতে খুন করা ছাড়া সিরিয়াল কিলিং-এর আর কী যোগসূত্র পাচ্ছিস বল।’

কালচারাল সেন্টারের পাশের ঘর বা অ্যান্টে চেম্বারে বসে রঞ্জিতের দেওয়া ফাইল উল্টোচ্ছে প্রথমা। তার সামনে বসে রয়েছেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি অরুণ এবং তাঁর স্ত্রী চন্দ্রিমা। সব অতিথি আসন গ্রহণ করার পরে ওঁরা সেন্টারে ঢুকবেন।

ভাইব্রেশান মোডে থাকা রঞ্জিতের মোবাইল থিরথির করে কাঁপছে। নম্বর দেখে ফোন ধরলেন তিনি। স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আমলাকে নিচু গলায় বললেন, ‘কী ব্যাপার?’

আমলা যা বললেন, সেটা শুনে রঞ্জিতের ভুরু কুঁচকে গেছে। তিনি ফিশফিশ করে প্রথমাকে বললেন, ‘পোয়েট ঋতুপর্ণ বিশ্বাস আজ দুপুরে দিল্লি শেরাকন হোটেলে খুন হয়েছেন। এখানে যে লোকটা ঋতুপর্ণ সেজে বসে রয়েছে, সে-ই খুনি!’

‘মানে?’ প্রথমা অবাক! ‘রাষ্ট্রপতি ভবনে উটকো লোক এইভাবে ঢুকে পড়তে পারে নাকি? সিকিয়োরিটি চেকিং আছে…’

ঠিক এই সময়ে পোডিয়ামের মাইকের সামনে দাঁড়ালেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, বাঙালি আমলা অর্ক রায়। বললেন, ‘আজ ২৫ বৈশাখ। রবি ঠাকুরের জন্মদিন।’

আজ ২৫ বৈশাখ! আজ ৮ মে! প্রথমার শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে যায়। তড়াক করে চেয়ার থেকে উঠে সে চন্দ্রিমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ম্যাডাম, আপনি ইংরিজি ক্যালেন্ডার থেকে বাংলা ক্যালেন্ডারে তর্জমা করতে পারেন?’

‘পারি।’ গম্ভীর মুখে বলেন চন্দ্রিমা।

‘২৪ জুন, ২৮ আগস্ট, ২২ অক্টোবর ২৫ ডিসেম্বর, ৯ মার্চ। বাংলা ক্যালেন্ডারে এগুলো কোন কোন তারিখ?’

চন্দ্রিমা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘১০ আষাঢ়, ১৩ ভাদ্র, ৭ কার্তিক, ১১ পৌষ এবং ২৫ ফাল্গুন।’

প্রথমা রঞ্জিতের দিকে ফিরে বলল, ‘আষাঢ়, ভাদ্র, কার্তিক, পৌষ, ফাল্গুন। বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত—এই পাঁচ ঋতুর প্রথম মাসে খুনগুলো হয়েছে। সিরিয়াল কিলিং-এর দ্বিতীয় সূত্র পাওয়া গেল। এখন গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ মাস শেষ হতে আর পাঁচ দিন বাকি। শেষ খুনটা এই ক’দিনের মধ্যে হবে। এমন সময়ে এখানে খুনির উপস্থিতি মোটেই কো-ইনসিডেন্স নয়। খুনটা আজ হবে। এবং এখনই হবে। আমি সিয়োর!’

‘কিন্তু কে খুন হবেন?’ ঘাড় ঝাঁকান রঞ্জিত, ‘এবং কীভাবে হবেন?’

প্রথমা বলল, ‘এমন একজন এখন খুন হবেন, যাঁর নামের সঙ্গে গ্রীষ্মকাল জড়িয়ে আছে।’

রঞ্জিত বললেন, ‘এখানে এই মুহূর্তে একাধিক কবি রয়েছেন যাঁদের নামের সঙ্গে গ্রীষ্মকাল জুড়ে দেওয়া যায়। জয়সূর্য, সানি, তপন। এমন কি, অর্ক মানেও সূর্য!’

প্রথমা বলল, ‘এইভাবে হবে না। ভাইটাল সময় নষ্ট হচ্ছে আর আমরা গেস ওয়ার্কের ছেলেমানুষি করছি। আরও কোনও কমন থ্রেড আছে এই খুনগুলোর মধ্যে, যা আমি জানি না। দেয়ার মাস্ট বি সামথিং এলস! কেউ কিছু একটা লুকোচ্ছেন। কেউ একজন। কে তিনি?’

অরুণের মাথা নিচু। প্রথমা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এই পাঁচজন কেন খুন হলেন? এঁদের মধ্যে কমন লিঙ্ক কী? আমার ধারণা, আপনি জানেন।’

মাথা নিচু করে অরুণ বললেন, ‘যে কথাটা বলতে চাইছিলাম না, সেটা এবার বলতেই হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনের জন্যে ছয় সদস্যের এক বিশেষজ্ঞ কমিটি মিলে ঠিক করে যে কাইমেরা নামে একটা এলিট ইনটেলিজেন্ট উইং খোলা হবে। যে উইং-এর টিম লিড তুমি।’

প্রথমা বলে, ‘সেই কমিটিতে কে কে ছিলেন?’

‘বসন্ত রাঠি, পৌষালী সেনগুপ্ত, হেমন্ত সিং, শারদ ধিলোঁ, বারিশ তেন্ডুলকার আর আমি।’

প্রথমা বলল, ‘অরুণ! মানে সূর্য!’

রঞ্জিত চুপ। চন্দ্রিমা স্বামীর কনুই চেপে ধরে বললেন, ‘তুমি এখন কালচারাল সেন্টার যাবে না।’

‘এত লোকের মধ্যে আমাকে টার্গেট করা মুখের কথা নাকি? ওই লোকটা আমাকে গুলি করার জন্যে পকেটে থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বার করার চেষ্টা করলেই আমার বডিগার্ডরা ওকে মেরে দেবে। অকারণে চিন্তা কোরো না।’ অরুণ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন।

পোডিয়াম থেকে অর্ক বললেন, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান। প্লিজ রাইজ। অনারেবল প্রেসিডেন্ট অ্যারাইভস।’

সকলে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কালচারাল সেন্টার এখন নিস্তব্ধ। একটু পরে, চারজন বডিগার্ড সহ সেন্টারে প্রবেশ করলেন অরুণ। সবাইকে হাত জোড় করে নমষ্কার করে চেয়ারে বসলেন। তাঁর তিনদিক ঘিরে দাঁড়াল বডিগার্ড। অর্ক বললেন, ‘আজকের আনন্দ সন্ধ্যায় সবাইকে স্বাগতম। অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রথমে আমি মঞ্চে ডেকে নিচ্ছি শ্যামলদেশের কবি গুলশানকে।’

গুলশান আবৃত্তি করলেন রবি ঠাকুরের ‘আফ্রিকা।’ আবৃত্তি শেষ হতে অরুণ তার হাতে তুলে দিলেন ‘গীতাঞ্জলি।’ অরুণের সঙ্গে করমর্দন করে গুলশান মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। অর্ক মঞ্চে ডেকে নিলেন ওয়ারিস্তানের কবি বাবুল বিশ্বাসকে।

জিয়া আর রকি ওয়ারিস্তানে বসে যখন ঠিক করে যে কাইমেরা যাঁদের ব্রেন চাইল্ড, তাঁদের একে একে শেষ করবে, তখন রকিই প্রথম নামের মিলটা খেয়াল করে। সেই সময়েই ভাবা ছিল, শেষ টার্গেট কে হবেন। কবে এবং কীভাবে তাঁকে খুন করা হবে।

ওয়ারিস্তানে লুনার ক্যালেন্ডার চালু আছে। ছয় ঋতু এবং বারোটি বাংলা মাস সম্পর্কে সেখানকার মানুষ ওয়াকিবহাল নয়। শত্রুদেশের সমস্ত তথ্য নখদর্পণে রাখতে হয় বলেই জিয়া আর রকি বাংলা ক্যালেন্ডার সম্পর্কে জানে।

জিয়া রকিকে বলে, ‘মার্ডারগুলো ঋতুর প্রথম মাসে সেরে ফেলা হোক। সিরিয়াল কিলিং যে শিল্প—এটা পুলিশ বা পাবলিক না জানুক, আমরা জানব!’

মানুষ খুনে অভ্যস্ত রকি জিয়ার কথা মেনে নেয়। মার্ডার করা রুটিন কাজ। যে কাজ রোজ করতে হয়, তাতে শিল্পের ছোঁয়া থাকে না। ঋতুহননের মধ্যে দিয়ে রকি নিজের শিল্পসত্ত্বাকে পুনরাবিষ্কার করেছে। এবং ইন্ডিয়ার আর-এক শিল্পীর সাহায্যে অরুণের জীবনের শেষ মুহূর্তটি বেছে নিয়েছে।

রবি ঠাকুর অরুণের জীবনের ধ্রুবতারা। পঁচিশে বৈশাখে রাষ্ট্রপতি ভবনের কবি সম্মেলনের রুটিন ঘিরে শেষ খুনের ছক কষেছিল জিয়া আর রকি। আমন্ত্রিত অতিথির তালিকা প্রকাশ হওয়ার পরে ঋতুপর্ণর কাছাকাছি চেহারার আব্রাহামকে বেছে নেয় তারা। আব্রাহামকে বারবার ঋতুপর্ণর ইন্টারভিউয়ের ভিডিয়ো দেখিয়ে তাঁর সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। আধুনিক মেকআপ কিট এবং প্রস্থেসিসের ব্যবহার শেখানো হয়েছে। পঁচিশে বৈশাখে রাষ্ট্রপতি ভবনের কবি সম্মেলনের ভিডিয়ো দেখানো হয়েছে। রবি ঠাকুরের একাধিক কবিতা মুখস্থ করানো হয়েছে। পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে কী করতে হবে…

বাবুল পাঠ করলেন, ‘দেবতার গ্রাস।’ অরুণ তাঁর হাতে তুলে দিলেন অনূদিত গীতাঞ্জলি। বাবুল আর অরুণ আলিঙ্গন করলেন। কালচারাল সেন্টারের অতিথিরা হাততালি দিলেন। ওয়ারিস্তান এবং ভারতের দুই নাগরিক আলিঙ্গন করছেন এই দৃশ্য অত্যন্ত বিরল।

বাবুল নিজের আসনে গিয়ে বসলেন। অর্ক বললেন, ‘এবার আমি ঋতুপর্ণ বিশ্বাসকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি।’

আব্রাহাম চেয়ার থেকে উঠল। রঞ্জিতের হাতে উঠে এল আগ্নেয়াস্ত্র, ওয়ালথার পিপিকে।

প্রথমা মোবাইলে আব্রাহামের ছবি তুলল। ডেটা কর্ডের মাধ্যমে নিজের ল্যাপটপে ছবি ট্রান্সফার করল। পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ক্রিমিনালদের যে ইমেজ গ্যালারি আছে, সেখানে ‘ইমেজ সার্চ’ দিল।

ল্যাপটপ কাজ শুরু করেছে। মিনিট পাঁচেক সময় লাগবে।

আব্রাহাম পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার খুব প্রিয় একটি কবিতা আপনাদের শোনাই।’ সামান্য কেশে, সুরেলা কণ্ঠে বলল,

‘মরণ রে,

তুঁহু মম শ্যামসমান।

মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট,

রক্ত কমল কর, রক্ত অধর-পুট,

তাপ-বিমোচন করুণ কোর তব

মৃত্যু-অমৃত করে দান।

তুঁহু মম শ্যামসমান।’

ল্যাপটপের ইমেজ সার্চ শেষ। লোকটার কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই।

প্রথমার ভুরু কুঁচকে গেছে। লোকটা আজ, একটু আগেই একটা খুন করেছে। আর একটা খুন করতে চলেছে। এইরকম হার্ডকোর ক্রিমিনালের কোনও রেকর্ড থাকবে না? লোকটা জানে যে সে মার্ডার করার পরে এখান থেকে পালাতে পারবে না। লোকটার কি প্রাণের ভয় নেই?

আব্রাহাম বলছে,

‘তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর,
তুঁহু মম তাপ ঘুচাও,
মরণ, তু আও রে আও।’

বুলশিট! কপাল চাপড়ায় প্রথমা। এতক্ষণ এই সরল সত্যটা তার মাথায় আসেনি কেন? লোকটা মার্ডার করার পরে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফিরতে চায় না। লোকটা সুইসাইড বোম্বার!

প্রথমা রঞ্জিতকে বলল, ‘কিল হিম। হি ইজ আ সুইসাইড বোম্বার।’

রঞ্জিত দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘ওকে মারলে সারা পৃথিবীতে বদনাম হয়ে যাবে। আমি বরং স্যারকে ওখান থেকে সরিয়ে নিই।’ ওয়াকিটকিতে সে অরুণের বডিগার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করল।

আব্রাহাম বলছে,

‘ভানুসিংহ কহে—ছিয়ে ছিয়ে রাধা,
চঞ্চল হৃদয় তোহারি,
মাধব পহু মম, পিয় স মরণসে
অব তুঁহু দেখ বিচারি।’

আবৃত্তি শেষ। কালচারাল সেন্টারের অতিথিরা হাততালি দিচ্ছেন। ওয়াকিটকির মাধ্যমে রঞ্জিত বডি গার্ডকে বললেন, ‘স্যারকে বলুন, স্টেজের লোকটা সুইসাইড বোম্বার। স্যার যেন ওখান থেকে সরে যান। এক্ষুনি।’

টেবিলে রাখা বইয়ের স্তুপ থেকে ‘সং অফারিংস’-এর কপি তুলে নিলেন অরুণ। আব্রাহাম তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে।

বডিগার্ড অরুণের কানে কিছু বলল।

চন্দ্রিমা বিড়বিড় করে বলছেন, ‘চলে এসো! প্লিজ! চলে এসো…’

রঞ্জিতের ওয়ালথার পিপিকের নিশানায় আব্রাহাম।

অরুণ উঠে দাঁড়ালেন। আব্রাহাম এগিয়ে আসছে।

অরুণ হঠাৎ বললেন, ‘ঋতুপর্ণ, আপনি আর একটি কবিতা শোনান।’

আব্রাহাম থমকাল। এক পা এগোতে গিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল। সামান্য ভেবে আবার পোডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি শোনাচ্ছি, ‘কথা ও কাহিনি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি কবিতা।’

অরুণ বললেন, ‘ঋতুপর্ণ, আপনি নিজের লেখা কবিতা শোনান। রবি ঠাকুরকে নিয়ে যে দীর্ঘ কবিতাটি লিখেছিলেন, সেই বইটির কিছুটা শোনান। কী যেন নাম বইটার…’

আব্রাহাম চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শ্রোতার আসনে বসে থাকা পাঁচ কবি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করছে। ঋতুপর্ণ নিজের বইয়ের নাম বলতে পারছেন না!

প্রোটোকল ভেঙে বাবুল বললেন, ‘আপকো আপনা কিতাব কা নাম ইয়াদ নেহি হ্যায়?’

আব্রাহাম বিড়বিড় করে বলল, ‘মেরা বদনসিব! কিতাব কা নাম ইয়াদ নেহি আ রাহা হ্যায়!’

বাবুল মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনার হিন্দি আগের থেকে ইমপ্রূভ করেছে। এক মাস আগে আয়ওয়ার লিটারারি মিটে যখন আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন আপনি বলেছিলেন, হিন্দি জানেন না।’

‘আয়ওয়া থেকে ফেরার পরে টিচার রেখে হিন্দি শিখছি।’ নিখুঁত হিন্দিতে জবাব দিয়ে পোডিয়াম থেকে নামে আব্রাহাম। অরুণের দিকে এগোয়।

প্রোটোকল ভুলে গিয়ে বাবুল চিৎকার করেন, ‘প্রেসিডেন্ট স্যার! ঋতুপর্ণ আয়ওয়ায় যাননি। ওঁর শরীর খারাপ ছিল। এই লোকটা ঋতুপর্ণ নয়! ইয়ে হমারি মুল্ক কা আদমি হ্যায়।’ তারপর পোডিয়ামের দিকে দৌড়লেন।

প্রথমা প্রোটোকল ভুলে গিয়ে চিতার ক্ষিপ্রতায় কালচারাল সেন্টারে ঢুকে অরুণকে জড়িয়ে ধরে ওক কাঠের মোটা টেবিলের তলায় ঝাঁপ মারল। দেখল, আব্রাহাম তার দিকে ধেয়ে আসছে।

চন্দ্রিমা হাত জোড় করে ঈশ্বরের নাম জপছেন। রঞ্জিত ওয়ালথার পিপিকে-র ট্রিগার টিপলেন।

আগ্নেয়াস্ত্রের গুলি আগে আব্রাহামকে ছুঁল, না বাবুল আগে জড়িয়ে ধরলেন আব্রাহামকে—বোঝা গেল না। কেন না আব্রাহামকে জড়িয়ে ধরা মাত্র বিস্ফোরণের শব্দে কালচারাল সেন্টার কেঁপে উঠল। আব্রাহাম এবং বাবুল—দু’জনেই ততক্ষণাৎ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বডিগার্ডদের পোশাকে আগুন লেগে গেছে। কিন্তু তারা নিজের জায়গা থেকে নড়েনি। জ্বলতে জ্বলতে ওক কাঠের টেবিল গার্ড করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

যাতে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতির গায়ে আঁচড় না লাগে।

বাবুল বিশ্বাসের কফিন নিয়ে ওয়ারিস্তানের দিকে উড়ে যাচ্ছে ফ্লাইট। ঠিক সেই সময়ে দিল্লির নিগমবোধ ঘাটের শ্মশানে দুটি চিতা পাশাপাশি জ্বলছে। একটিতে দাহ হচ্ছে ঋতুপর্ণ বিশ্বাসের মৃতদেহ। চিতার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ঋতুপর্ণর স্ত্রী। স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তিনি আমেরিকা থেকে উড়ে এসেছেন।

দ্বিতীয় চিতার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রথমা এবং রঞ্জিত। প্রথমা বলল, ‘ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি ভবনে ওয়ারিস্তানের সব চেয়ে বড় কবির বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে। এত বড় ঘটনা নিয়ে ভারত এবং ওয়ারিস্তানের মিডিয়ায় একটি শব্দ বা ‘বাইট’ খরচ করা হয়নি। আমাদের রাষ্ট্রপতির ‘অনুরোধ’ ভারতবর্ষের মিডিয়া মেনে নিয়েছে। সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু বাবুল বিশ্বাসের মৃত্যু নিয়ে ওয়ারিস্তান সরকার বা সে দেশের মিডিয়া মুখ খুলছে না কেন?’

রঞ্জিত বললেন, ‘সৎকারের জন্যে আব্রাহামের মৃতদেহ আমরা ওয়ারিস্তানে পাঠাতে চেয়েছিলাম। সিসিটিভি ফুটেজ এবং সমস্ত ডকুমেন্ট দেখার পরে ওরা বডি নিতে অস্বীকার করেছে। বলেছে, আব্রাহাম ওয়ারিস্তানের নাগরিক নয়। এই সুইসাইড বোম্বারকে তারা চেনে না।’

বহতা যমুনার দিকে তাকিয়ে প্রথমা বলল, ‘মরার আগে লোকটা আবৃত্তি করল, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান।’ রবি ঠাকুর খুব ইন্টারেস্টিং পোয়েট! স্যারের কাছ থেকে গীতাঞ্জলির একটা কপি নিতে হবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *