ছবি পাহাড়

ছবি পাহাড়

খুব জ্বর হয়েছে বাপ্পার৷ তিনদিন ধরে জ্বর চলছে তো চলছেই৷ ডাক্তারকাকু রোজ দু’বেলা দেখতে আসছেন, ওষুধ দিচ্ছেন, তবু জ্বর কমছে না৷ রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে৷ ম্যালেরিয়া নয়৷ টাইফয়েড নয়৷ তা হলে এটা কিসের অদ্ভুত জ্বর?

বাবা আর মা দু’জনেই খুব চিন্তিত৷ ডাক্তারকাকু বলেছেন, কালকের মধ্যে জ্বর না ছাড়লে বাপ্পাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হবে৷

বাপ্পার হাসপাতালে যেতে একদম ইচ্ছে করে না৷

বাপ্পার বন্ধু টিটোর একবার ডিপথিরিয়া হয়েছিল, তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল৷ টিটোকে দেখতে গিয়েছিল বাপ্পা৷ একটা মস্ত বড় ঘরের মধ্যে অনেকগুলো লোহার খাট, তার একটাতে শুয়েছিল টিটো৷ সেই ঘরে ঢুকেই বাপ্পার মনে হয়েছিল, এটা ঠিক জেলখানার মতন৷ হাসপাতালের গন্ধটাও কেমন যেন!

নিজের অসুখ হলেও ডান দিকে-বাঁ দিকে তাকালে আরও অসুস্থ মানুষ দেখতে কারুর ভালো লাগে? কালকের মধ্যেই জ্বরটা যে-কোনো উপায়ে সারিয়ে ফেলতে হবে৷

বাপ্পার দিদি নেই, বোন নেই, মা-বাবার সে একমাত্র ছেলে৷ মা-বাবা দু’জনেই চাকরি করেন, বাপ্পার অসুখের জন্য মা অবশ্য ছুটি নিয়েছেন৷ মা সব সময় বাপ্পার কাছে কাছে থাকেন, কিন্তু আজ দুপুরে মাকে একবার বিনতামাসির বাড়ি যেতেই হয়েছে৷ বিনতামাসির মেয়ে শান্তাদিদির আজ বিয়ে, মা রাত্তিরে যাবেন না৷ বাপ্পাকে ফেলে কি যাওয়া যায়, তাই দুপুরে শান্তাদিদিকে আশীর্বাদ করতে গেছেন৷ এ বাড়িতে রান্না করে যে ছেলেটি, তার নাম দাসু, তাকে বলে গেছেন বাপ্পাকে দেখতে৷ দাসু খুব ফাঁকিবাজ, দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে সে একবার সারা পাড়া বেড়াতে যাবেই৷

দাসু না থাকলেও ক্ষতি নেই৷ দাসুর সঙ্গে বেশিক্ষণ গল্প করা যায় না৷ বাপ্পা একাই থাকতে পারে৷ একশো তিন ডিগ্রি জ্বর হলেও বাপ্পার এখনো হাঁটাচলা করতে অসুবিধে হয় না, নিজেই যেতে পারে বাথরুমে৷ তবে মাথাটা একটু টলটল করে৷ শুয়ে থাকতেই ভালো লাগে৷

দুপুরবেলা তার ঘুম আসে না৷ বই পড়তে পড়তে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে৷ ভালো বইও আর নেই৷ পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বাপ্পা বই এনে পড়ে৷ এখন কে বই এনে দেবে!

ঝিমঝিম করছে দুপুর৷ সারা বাড়ি নিস্তব্ধ৷ রাস্তায় এ সময় গাড়ি-ঘোড়াও কম চলে৷ ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে৷

বাপ্পাদের ফ্ল্যাটটা তিনতলায়৷ এর ওপরে ছাদ৷ বাপ্পার ঘরের সঙ্গে রয়েছে একটা ছোট্ট বারান্দা, তারপর অনেকখানি আকাশ৷ এদিকে আর কোনো বড় বাড়ি নেই৷ মাঠের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন৷ বারান্দায় দাঁড়ালে এক এক সময় ট্রেন যেতে-আসতে দেখা যায়, কিন্তু অনেকটা দূরে বলে শব্দ শোনা যায় না৷

এই বারান্দাটায় প্রায়ই একটা চিল এসে বসে৷ মাঝে মাঝে একটা বড় ল্যাজওয়ালা পাখিও দেখা যায়, সেটার নাম ইষ্টিকুটুম৷ এখন চিলটাই বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে৷

চিলটা উড়ে চলে গেল৷ তার একটু পরেই বাপ্পা দেখতে পেল সেই বারান্দার রেলিং-এ বসে আছে একটা মেয়ে৷ একটা গাঢ় হলুদ ফ্রক পরা, মাথায় ভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল৷ সে বেশ বিপজ্জনকভাবে দোল খাচ্ছে, তার হাতে একটা সাদা সিল্কের পতাকা৷

image3.jpg

বাপ্পা মনে মনে বলল, ও, আমি স্বপ্ন দেখছি৷ না হলে বারান্দার রেলিং-এর ওপরে একটা মেয়ে এসে বসবে কী করে? এই ঘরের মধ্যে দিয়ে ছাড়া ও বারান্দাতে যাওয়াই যায় না৷

কিন্তু বাপ্পা তো ঘুমোচ্ছে না, তাহলে স্বপ্ন দেখবে কী করে? একদম জেগে জেগে চোখ চেয়ে কি স্বপ্ন দেখা যায়? বাপ্পা নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটল৷ সত্যি সে জেগে আছে৷ আর বারান্দার রেলিং-এ এখনো সে সত্যিই একটা মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে৷

এবারে বাপ্পা মনে মনে বলল, তাহলে আমি চোখে ভুল দেখছি৷

বাপ্পার এগারো বছর বয়েস, সে অনেক কিছু জানে৷ সে জানে, খুব জ্বর হলে মানুষ চোখে ভুল দেখে, ভুল বকে৷ বাপ্পার কি খুব জ্বর বেড়ে গেল?

বিছানা থেকে নেমে পড়ল বাপ্পা৷ মাথা ঘুরছে না, চোখ জ্বালা করছে না৷ দেয়ালের ক্যালেন্ডার, টেবিলের ঘড়ি, বইপত্র, চেয়ার-টেবিল এসবই সে ঠিক ঠিক দেখছে, আর বারান্দার মেয়েটিই শুধু ভুল?

দেখা যাক তো ও কথা বলে কি না!

বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, এই, তুমি কে?

মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে বাপ্পাকে দেখল৷ তারপর রাগ রাগ ভাব করে বলল, তা জেনে তোমার দরকার কী? তুমি তো ভাবছ, আমি তোমার চোখের ভুল দেখা৷ আমি সত্যি না!

বাপ্পা বলল, কী করে ভাব্ব বলো৷ তুমি এখানে কী করে এলে? রেলিং-এ বসে দোল খাবার সাহস কোনো মেয়ের হবে না৷ সত্যি হলে তুমি এতক্ষণে ধপাস করে রাস্তায় পড়ে যেতে!

মেয়েটি বলল, আচ্ছা বেশ, সত্যি নয় তো সত্যি নয়৷ তুমি যাও, ঘুমোও গে!

বাপ্পা বলল, কত আর ঘুমোব৷ তুমি মিথ্যে হলেও তোমার সঙ্গে তো বেশ কথা বলতে পারছি! তোমার নাম কী?

মেয়েটি বলল, আমার নাম ফুলটুসি৷ হিমলাও বলতে পারো৷ কিংবা তুরতুর তুর৷ কিংবা শ্রেয়সী৷ কিংবা লায়লা৷ আমার অনেক নাম৷ যেটা তোমার পছন্দ বেছে নাও৷

বাপ্পা বলল, ফুলটুসিটাই ভালো৷ তুমি কোথায় থাকো?

ফুলটুসি বলল, ছবি পাহাড়ে৷ কিংবা সোনালিবেলায়৷ কিংবা পাঁচ নম্বর শংকর ব্যানার্জি লেনে৷ যেটা তোমার ইচ্ছে ভেবে নাও৷

বাপ্পা বলল, শংকর ব্যানার্জি লেন তো আমাদের পাড়ায়৷ পাঁচ নম্বর বাড়ি? তাহলে তুমি সত্যি-মেয়ে নাকি!

ফুলটুসি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমিই তো মিথ্যে ভাবছ৷ আমি কি বলেছি আমি মিথ্যে?

বাপ্পা বলল, তাহলে কি আমি তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি?

ফুলটুসি তার একটা হাত বাড়িয়ে দিল, তার ওপর বাপ্পা রাখল নিজের হাত৷ সত্যি সত্যি একজনকে ছুঁয়েছে সে৷

এবার বেশ অবাক হয়ে বাপ্পা জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কী করে এলে? কেন রেলিং-এর ওপর বসে আছো?

ফুলটুসি বলল, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই বসে আছি৷ তোমার যদি আপত্তি থাকে, এক্ষুনি চলে যেতে পারি!

বাপ্পা বলল, কী করে চলে যাবে?

ফুলটুসি বলল, এই পতাকাটা নিয়ে আমি ইচ্ছে মতন উড়ে যেতে পারি৷ আমার ডানা লাগে না৷

বাপ্পা অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, যাঃ!

ফুলটুসি বলল, কিচ্ছু না জেনে যাঃ যাঃ বলো না তো! তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানো? এক এক সময় আমি অভিরূপ বসু আর জয়া বসুর মেয়ে, পাঁচ নম্বর বাড়িতে থাকি আর মডার্ন স্কুলে পড়ি৷ আর এক এক সময় আমার বাবা-মা কেউ না, আমি ইস্কুলে যাই না, আমি ছবি পাহাড়ে গিয়ে খেলা করি৷ বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি একলা এরকম নই৷ দেখো দেখো, রাস্তা দিয়ে ওই যে একটা ছেলে পেয়ারার ঝুড়ি মাথায় করে যাচ্ছে, পেয়ারা বিক্রি করে, ও কিন্তু আসলে পেয়ারাওয়ালা নয়৷ এক এক সময়ে ও ছবি পাহাড়ে গিয়ে একটা খরগোশ হয়ে যায়৷

বাপ্পা বলল, কী আবোল-তাবোল বকছ, বুঝতে পারছি না৷ মানুষ আবার খরগোশ হতে পারে নাকি?

ফুলটুসি বলল, অনেক মানুষই আসলে দু’রকম৷ কেউ ধরো এখানে ইস্কুলে যাচ্ছে, পার্কে ক্রিকেট খেলছে, আবার ছবি পাহাড়ে গিয়ে সে একদম বদলে যাচ্ছে৷ সবসময় কি একরকম থাকতে ভালো লাগে? আমার মা-বাবা যখন বাড়িতে থাকে না, তখনই আমি ছবি পাহাড়ে পালিয়ে যাই৷

বাপ্পা বলল, ছবি পাহাড়টা আবার কোথায়?

ফুলটুসি বলল, যেতে চাও?

বাপ্পা বলল, আমাকে নিয়ে যাবে? চলো দেখে আসি৷ আমার মা-বাবাও তো এখন বাড়িতে নেই৷

ফুলটুসি বলল, কিন্তু অবিশ্বাস করলে চলবে না৷ তুমি ভালো করে চোখে-মুখে জল দিয়ে এসে বুঝে নাও, তুমি ঘুমোচ্ছও না, চোখে ভুলও দেখছ না৷ তোমার পকেটে পয়সা-টয়সা নেই তো? তাহলে রেখে এসো৷ পয়সা সঙ্গে নিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না৷

বাপ্পা বাথরুমে গিয়ে চোখে-মুখে জল দিয়ে, ভালো করে মুখ মুছে এসে দেখল, তখনো মেয়েটি সেখানে বসে আছে৷

সে জিজ্ঞেস করল, সেখান থেকে আবার ফিরে আসব তো? কতক্ষণ লাগবে?

ফুলটুসি বলল, সে-সব নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না৷ আমার হাত ধরে থাকো শক্ত করে৷ ভয় পেও না!

একটা ঝাঁকুনি লাগল, তারপরই বাপ্পা দেখল সে হাওয়ায় ভাসছে৷ অনেক নীচে বর্ধমান শহর, রাস্তায় লোকজন, গরু-সাইকেল রিকশা সব যাচ্ছে৷ ফুলটুসির হাত ধরে বাপ্পা উড়ে যাচ্ছে, ঠিক যেন সুপারম্যান কিংবা সুপারগার্লের মতন৷ তাহলে সত্যি এরকম ওড়া যায়?

কী সুন্দর ঠান্ডা ঠান্ডা মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দু’জনে৷ বাবা-মায়ের সঙ্গে একবার দার্জিলিং যাবার সময় প্লেনে চেপেছিল বাপ্পা৷ সেই ওড়া আর এই ওড়ায় কত তফাত৷

অনেক মাঠ, নদী, জঙ্গলের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে এক জায়গায় ওরা নামতে লাগল৷ সামনে একটা পাহাড়৷ এক ধরনের হলুদ রঙের ঘাস রয়েছে সারা পাহাড়টার গায়ে, সেই জন্য পাহাড়টাকে সোনালি মনে হয়৷

পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী৷ বড় বড় রাজহাঁস ভাসছে সেই নদীর জলে৷ ধারে ধারে উইপিং উইলো গাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়েছে৷

বাপ্পা বলল, বাঃ, জায়গাটা বেশ সুন্দর৷ কিন্তু এই পাহাড়টার নাম ছবি পাহাড় কেন?

ফুলটুসি বলল, তার কারণ, এই পাহাড়টা রোজ বদলে যায়৷ আজ সোনালি দেখছ তো, কাল এসে দেখবে হয়তো বেগুনি৷ কোনোদিন শোনা যায় পাহাড়ের ভেতর থেকে টুংটাং করে অনেক ঘণ্টা বাজছে৷ এখানে কোনো কিছুই রোজ একরকম নয়৷ নদীটাও বদলে যায়৷ আজ দেখছ সব সাদা সাদা রাজহাঁস, কাল দেখবে সব কালো কালো পানকৌড়ি৷ এখানে একঘেয়েমি বলে কিছু নেই৷ তোমার নাম বাপ্পা৷ সারা জীবন তুমি বাপ্পাই থেকে যাবে, অন্য কিছু হবে না, এটা কীরকম বিচ্ছিরি না?

বাপ্পা বলল, আমার একটা ভালো নাম আছে৷ ইস্কুলে আমার নাম দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়৷

ফুলটুসি তার লাল টুসটুসে ঠোঁট উল্টে বলল, এমন কিছু ভালো নাম নয়৷ সে যাই হোক, সারা জীবন তো তুমি ওই এক বাবা-মায়ের ছেলেই থাকবে৷ মাঝে মাঝে অন্য কোনো বাড়ির ছেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না?

বাপ্পা বলল, ইচ্ছে করলেই হওয়া যায় নাকি?

ফুলটুসি বলল, হ্যাঁ হওয়া যায়৷ দেখো না, একটু বাদেই আমি একটা পাখি হয়ে যাব!

বাপ্পা বলল, এই না না, পাখি হয়ে যেও না৷ তাহলে তোমাকে আমি চিনতে পারব না৷ তোমার সঙ্গেই আমাকে ফিরতে হবে৷

ফুলটুসি বলল, একটা মজা দেখবে?

পাশেই একটা একতলা বাড়ির সমান উঁচু গাছ, তার ঠিক দুটো ডাল৷ ওপরে কমলা রঙের কাঞ্চন ফুলের মতন ফুল ফুটে আছে৷

সেই গাছটার গায়ে হাত দিয়ে ফুলটুসি জিজ্ঞেস করল, কী গো, তুমি কখন এলে?

গাছটা অমনি অবিকল মানুষের মতন গলায় বলল, এই তো, কুড়ি-পঁচিশ মিনিট আগে৷ তখন থেকে ভাবছি বৃষ্টি হবে৷ একটু বৃষ্টি খেয়ে বাড়ি যাব৷

বাপ্পা প্রথমটায় চমকে গিয়েও সামলে নিয়ে বলল, যাঃ, এটা একেবারে গাঁজাখুরি ব্যাপার৷ গাছ কখনো কথা বলতে পারে নাকি? তুমি কোনো ম্যাজিক শিখেছ!

ফুলটুসি ধমক দিয়ে বলল, মোটেই আমি ম্যাজিক-ফ্যাজিক জানি না৷ সব গাছই কথা বলতে পারে, আমরা শুনতে পাই না৷ সেটা আমাদের দোষ৷

তারপরই ফিক করে হেসে ফেলে বলল, এটা কিন্তু আসলে গাছ নয়!

আবার সে গাছটার গায়ে হাত বুলিয়ে বলল, একবার তুমি তোমার আসল চেহারাটা দেখাও তো!

গাছটা বদলে গেল৷ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পনেরো-ষোলো বছরের ছেলে৷

এবার সত্যিই বাপ্পা দারুণ আশ্চর্য হয়ে গেল৷ ফিস ফিস করে বলল, রতন?

বাপ্পাদের পাড়ায় একটা মস্ত মুদিখানা আছে৷ তার মালিকের নাম হরিদাস, পাড়ার সব লোক তার নাম দিয়েছে ভুঁড়িদাস৷ সে ভুঁড়ি বাগিয়ে কাউন্টারে বসে থাকে, আর তিন-চারটে ছেলে দৌড়োদৌড়ি করে খদ্দেরদের জিনিসপত্র দেয়৷ সেই ছেলেদের মধ্যে একজন এই রতন৷

ফুলটুসি বলল, দোকানের মালিক তো ওকে বড্ড বেশি খাটায়৷ তাই রতন একটু ছুটি পেলেই এখানে বিশ্রাম নিতে আসে৷ চেহারা বদলে ফেলে৷ গাছ হওয়াটাই ওর বেশি পছন্দ৷ তাই না রতন?

রতন হিহি করে হেসে আবার গাছ হয়ে গেল৷

ফুলটুসি বলল, এর পর যেন মুদিখানায় গিয়ে রতনকে এইসব কথা জিজ্ঞেস করো না৷ তখন দেখবে, ওর কিচ্ছু মনে নেই৷

বাপ্পা বলল, বাঃ, বেশ মজা তো৷ যে-কেউ ইচ্ছে করলেই এখানে চলে আসতে পারে?

ফুলটুসি বলল, অত সোজা নয়৷ তা হলেই হয়েছিল আর কি! ওই গাছের গায়ে একটা সাদা ফ্ল্যাগ দেখছ না? আমার কাছে যেমন একটা রয়েছে৷ এই সাদা পতাকা না থাকলে ওড়াও যায় না, চেহারাও বদলানো যায় না৷

বাপ্পা উৎসাহের সঙ্গে বলল, ওই সাদা পতাকা কোথায় পাওয়া যায়?

ফুলটুসি বলল, কোত্থাও পাওয়া যায় না৷ তুমি কি পয়সা দিয়ে কিনবে ভাবছ নাকি? এই পতাকা নিজে নিজে আসে৷ সবার কাছে না, কারুর কারুর কাছে৷ আমি দেখি একদিন আমার পড়ার টেবিলে পড়ে আছে৷ হাতে নিতেই শরীরটা হালকা হয়ে গেল৷ আমি ঘরের মধ্যেই উড়তে শুরু করলাম৷ এরকমই হয় না রতন?

গাছটা হি-হি করে হেসে বলল, ঠিক তাই!

গাছের হাসি শুনলে গা ছমছম করে৷ বাপ্পা সেখান থেকে সরে বসল৷

ফুলটুসি বলল, আমি আর দেরি করতে পারছি না৷ পাখি হতে খুব ইচ্ছে করছে৷ তুমি কিছু হতে চাও তো বলো৷

বাপ্পা বলল, আমিও পাখি হব? না, থাক, উড়তে উড়তেই তো এলাম৷ হরিণ হতে পারি?

ফুলটুসি বলল, হ্যাঁ পারো৷ তাহলে—

বাপ্পা বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও! হরিণ তো খুব জোরে ছোটে৷ আমার জ্বর হয়েছে, আমি তো ছুটতে পারব না৷

ফুলটুসি বলল, দূর পাগল! হরিণের আবার জ্বর হয় নাকি কখনো? এখানে কারুর অসুখ-বিসুখ থাকে না৷

তারপর ফুলটুসি সাদা পতাকাটা বাপ্পার গায়ে ছুঁইয়ে দিতেই কী যে হল ঠিক বোঝা গেল না৷ বাপ্পা দেখল, সে খুব ছুটছে৷ শরীরটা হালকা লাগছে৷ তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে কোনো অসুবিধে নেই৷ ইস্কুলের স্পোর্টসে বাপ্পা একশো মিটার রানে সেকেন্ড হয়েছিল৷ এখন মনে হচ্ছে, সে ফার্স্টের থেকেও অনেক জোরে যাচ্ছে৷

নদীর ধারে ছুটোছুটি করতে লাগল বাপ্পা৷ হরিণ হবার কথাটা তার মনে এসেছে৷ কারণ তার দৌড়োতে খুব ভালো লাগে৷

এক জায়গায় অনেক সবুজ সবুজ লম্বা লম্বা ঘাস হয়ে আছে৷ বাপ্পা তার মধ্যে ঢুকে থমকে দাঁড়াল৷ তারপর ঘাসে মুখ দিতে যেতেই সে ভাবল, আরে আমি কি ঘাস খাবো নাকি! না, না, ঘাস-টাস খেতে পারব না৷ কিন্তু হরিণরা তো ঘাস-পাতাই খায়, তারা তো মাছ-মাংস খেতে জানে না৷ এই তো মুশকিল!

নাঃ, বাপ্পা ভাবল, আমার এখনো খিদে পায়নি৷ সে ছবি পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল৷ এখানকার ঘাস হলুদ, এ ঘাস হরিণ খায় না৷

পাহাড়ে কিসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে৷ খুব মিষ্টি সুর৷ জলতরঙ্গ বাজনার মতন৷ কোনোদিকে একটাও মানুষ নেই৷ আরও কয়েকটা হরিণ আর খরগোশ সে দেখতে পেল৷ ওরা আসল, না বাপ্পারই মতন রূপ বদলেছে? কেউ তার কাছে আসছে না৷

পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত ওঠা যাবে?

বাপ্পা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে৷ এই সময় একটা ল্যাজঝোলা ইষ্টকুটুম পাখি তার কাছে এসে উড়তে উড়তে বলল, তুমি যেমন হরিণ সেজেছ, তেমনি কেউ কেউ কিন্তু বাঘও সাজে৷ এখানে বাঘ আছে৷ কোনো বাঘ যদি তোমাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে কিন্তু তোমায় উদ্ধার করা যাবে না৷

বাপ্পা সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিকে ফিরল৷

পাখিটা বলল, এবার বাড়ি যাবে নাকি?

পাখি আবার ফুলটুসি হল, হরিণ হয়ে গেল বাপ্পা৷ দু’জনে মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে ফিরে এল বারান্দায়৷ ফুলটুসি বলল, আমার মা বোধহয় খোঁজাখুঁজি করবে, আমি চলি!

এখানেই কিন্তু শেষ নয়৷ মা ফিরে এসে দেখলেন, বাপ্পার গায়ে একটুও জ্বর নেই৷ ডাক্তারবাবু সন্ধেবেলা এসে বেশ অবাক হয়ে গেলেন৷ বাপ্পার জ্বর একেবারে সেরে গেছে তো বটেই, চোখেও ছলছলে ভাবটা নেই৷ সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন৷

দু’দিন বাদে বাপ্পা পাড়ার পার্কে গিয়ে খেলার অনুমতি পেল৷

এই দু’দিন বাপ্পা অনবরত শুধু ভেবেছে, ব্যাপারটা কী হল? ছবি পাহাড়ের মতন জায়গা সত্যিই কি কোথাও আছে? যেখানে ইচ্ছে মতন চেহারা বদলানো যায় কিছুক্ষণের জন্য? কেউ কেউ সাদা পতাকা পায়৷ সে পতাকা কোথা থেকে আসে? ফুলটুসি নামে সত্যিই কি একটা মেয়ে আছে? নাকি পুরোটাই দিবাস্বপ্ন? জেগে জেগেও বোধহয় স্বপ্ন দেখা যায়৷ অথবা সবটাই বাপ্পা কল্পনা করেছে?

পার্কে খেলতে যাবার আগে, বিকেলবেলা বাপ্পা বাঁ-দিকের গলিটাতে ঢুকে গেল৷ তার পরের গলিটাই শংকর ব্যানার্জি লেন৷

সেই গলিতে ঢুকে বাপ্পা নম্বর খুঁজতে লাগল৷ হ্যাঁ, পাঁচ নম্বর বাড়িও আছে৷ একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ি৷

বাপ্পার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে৷ এ বাড়িটা সে আগে দেখেনি৷ তবু এই পাঁচ নম্বর বাড়িটার কথা তার মনে এল কী করে?

দরজায় বেল বাজাবার পর একটি মেয়েই দরজা খুলল৷ হলুদ ফ্রক পরা৷ কোঁকড়া চুল৷ ফুলটুসি! হ্যাঁ, এই তো ফুলটুসি! তাহলে মিথ্যে নয়, ফুলটুসি আছে, ফুলটুসি আছে!

মেয়েটি বলল, কী চাই?

বাপ্পা বলল, তুমি…তুমিই তো ফুলটুসি?

মেয়েটি বলল, না তো, আমার নাম শ্রেয়সী৷

হ্যাঁ, এই নামটাও বলেছিল৷ ফুলটুসি বলেছিল, আমার অনেক নাম, যেটা ইচ্ছে বেছে নাও!

বাপ্পা বলল, শ্রেয়সী, তুমি কি মডার্ন স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়?

সে বলল, হ্যাঁ৷ তুমি জানলে কী করে? তুমি কে?

বাপ্পা বলল, সে কি, চিনতে পারছ না? তুমি আমাকে ছবি পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলে৷

মেয়েটি বলল, ছবি পাহাড়? সে আবার কোথায়?

বাপ্পা বলল, তোমার মনে নেই? তুমি আমাকে আগে দেখোনি কখনো?

মেয়েটি দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *