ছবি পাহাড়
খুব জ্বর হয়েছে বাপ্পার। তিন দিন ধরে জ্বর চলছে তো চলছেই। ডাক্তারকাকু রোজ দু’বেলা দেখতে আসছেন, ওষুধ দিচ্ছেন, তবু জ্বর কমছে না। রক্ত পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ম্যালেরিয়া নয়। টাইফয়েড নয়। তা হলে এটা কিসের অদ্ভুত জ্বর?
বাবা আর মা দু’জনেই খুব চিন্তিত। ডাক্তারকাকু বললেন, কালকের মধ্যে জ্বর না ছাড়লে বাপ্পাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হবে।
বাপ্পার হাসপাতালে যেতে একদম ইচ্ছে করে না।
বাপ্পার বন্ধু টিটোর একবার ডিপথিরিয়া হয়েছিল, তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। টিটোকে দেখতে গিয়েছিল বাপ্পা। একটা মস্ত বড় ঘরের মধ্যে অনেকগুলো লোহার খাট, তার একটাতে শুয়ে ছিল টিটো। সেই ঘরে ঢুকেই বাপ্পার মনে হয়েছিল, এটা ঠিক জেলখানার মতন। হাসপাতালের গন্ধটাও কেমন যেন!
নিজের অসুখ হলেও ডান দিকে—বাঁ দিকে তাঁকালে আরও অসুস্থ মানুষ দেখতে কারুর ভালো লাগে? কালকের মধ্যেই জ্বরটা যে—কোনো উপায়ে সারিয়ে ফেলতে হবে।
বাপ্পার দিদি নেই, বোন নেই, মা—বাবার সে একমাত্র ছেলে। মা—বাবা দু’জনেই চাকরি করেন, বাপ্পার অসুখের জন্য মা অবশ্য ছুটি নিয়েছেন। মা সব সময় বাপ্পার কাছে কাছে থাকেন, কিন্তু আজ দুপুরে মাকে একবার বিনতামাসির বাড়ি যেতেই হয়েছে। বিনতামাসির মেয়ে শান্তাদিদির আজ বিয়ে, মা রাত্তিরে যাবেন না। বাপ্পাকে ফেলে কি যাওয়া যায়, তাই দুপুরে শান্তাদিদিকে আশীর্বাদ করতে গেছেন। এ বাড়িতে রান্না করে যে ছেলেটি, তার নাম দাসু তাকে বলে গেছেন বাপ্পাকে দেখতে। দাসু খুব ফাঁকিবাজি, দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে সে একবার সারা পাড়া বেড়াতে যাবেই।
দাসু না থাকলেও ক্ষতি নেই। দাসুর সঙ্গে বেশিক্ষণ গল্প করা যায় না। বাপ্পা একাই থাকতে পারে। একশো তিন ডিগ্রি জ্বর হলেও বাপ্পার এখনো হাঁটাচলা করতে অসুবিধে হয় না, নিজেই যেতে পারে বাথরুমে তবে মাথাটা একটু টলটল করে। শুয়ে থাকতেই ভালো লাগে।
দুপুরবেলা তার ঘুম আসে না। বই পড়তে পড়তে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে। ভালো বইও আর নেই। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বাপ্পা বই এনে পড়ে। এখন কে বই এনে দেবে!
ঝিমঝিম করছে দুপুর। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। রাস্তায় এ সময় গাড়ি—ঘোড়াও কম চলে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে।
বাপ্পাদের ফ্ল্যাটটা তিনতলায়। এর ওপরে ছাদ। বাপ্পার ঘরের সঙ্গে রয়েছে একটা ছোট্ট বারান্দা, তারপর অনেকখানি আকাশ। এদিকে আর কোনো বড় বাড়ি নেই। মাঠের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। বারান্দায় দাঁড়ালে এক এক সময় ট্রেন যেতে আসতে দেখা যায়, কিন্তু অনেকটা দূরে বলে শব্দ শোনা যায় না।
এই বারান্দাটায় প্রায়ই একটা চিল এসে বসে। মাঝে মাঝে একটা বড় ল্যাজওয়ালা পাখিও দেখা যায়, সেটার নাম ইষ্টকুটুম। এখন চিলটাই বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে।
চিলটা উড়ে চলে গেল। তার একটু পরেই বাপ্পা দেখতে পেল সেই বারান্দার রেলিং—এ বসে আছে একটি মেয়ে। একটা গাঢ় হলুদ ফ্রক পরা, মাথায় ভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। সে বেশ বিপজ্জনক ভাবে দোল খাচ্ছে, তার হাতে একটা সাদা সিল্কের পতাকা।
বাপ্পা মনে মনে বললো, ও, আমি স্বপ্ন দেখছি। না হলে বারান্দার রেলিং—এর ওপরে একটা মেয়ে এসে বসবে কী করে? এই ঘরের মধ্যে দিয়ে ছাড়া ও বারান্দাতে যাওয়াই যায় না।
কিন্তু বাপ্পা তো ঘুমোচ্ছে না, তাহলে স্বপ্ন দেখবে কী করে? একদম জেগে জেগে চোখ দিয়ে কি স্বপ্ন দেখা যায়? বাপ্পা নিজের গায়ে একটা চিমটি কাটলো। সত্যি সে জেগে আছে। আর বারান্দার রেলিং—এ এখনো সে সত্যিই একটা মেয়েকে দেখতে পাচ্ছে।
এবারে বাপ্পা মনে মনে বললো, তাহলে আমি চোখে ভুল দেখছি।
বাপ্পার এগারো বছর বয়েস, সে অনেক কিছু জানে। সে জানে, খুব জ্বর হলে মানুষ চোখে ভুল দেখে, ভুল বকে। বাপ্পার কি খুব জ্বর বেড়ে গেল?
বিছানা থেকে নেমে পড়লো বাপ্পা। মাথা ঘুরছে না, চোখ জ্বালা করছে না। দেয়ালের ক্যালেন্ডার টেবিলের ঘড়ি, বইপত্র, চেয়ার—টেবিল এসবই সে ঠিক ঠিক দেখছে, আর বারান্দার মেয়েটিই শুধু ভুল?
দেখা যাক তো ও কথা বলে কিনা!
বারান্দার দরজার কাছে গিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো, এই, তুমি কে?
মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে বাপ্পাকে দেখলো। তারপর রাগ রাগ ভাব করে বললো, তা জেনে তোমার দরকার কী? তুমি তো ভাবছো, আমি তোমার চোখের ভুল দেখা। আমি সত্যি না!
বাপ্পা বললো, কী করে ভাববো বলো। তুমি এখানে কী করে এলে? রেলিং—এ বসে দোল খাবার সাহস কোনো মেয়ের হবে না। সত্যি হলে তুমি এতক্ষণে ধপাস করে রাস্তায় পড়ে যেতে!
মেয়েটি বললো, আচ্ছা বেশ, সত্যি নয় তো সত্যি নয়। তুমি যাও, ঘুমোও গে!
বাপ্পা বললো, কত আর ঘুমোবো। তুমি মিথ্যে হলেও তোমার সঙ্গে তো বেশ কথা বলতে পারিছ! তোমার নাম কী?
মেয়েটি বললো, আমার নাম ফুলটুসি। হিমলাও বলতে পারো। কিংবা তুরতুর তুর। কিংবা শ্রেয়সী। কিংবা লায়লা।
আমার অনেক নাম। যেটা তোমার পছন্দ বেছে নাও।
বাপ্পা বললো, ফুলটুসিই ভালো। তুমি কোথায় থাকো?
ফুলটুসি বললো, ছবি পাহাড়ে কিংবা সোনালিবেলায়। কিংবা পাঁচ নম্বর শংকর ব্যানার্জি লেনে। যেটা তোমার ইচ্ছে ভেবে নাও।
বাপ্পা বললো, শংকর ব্যানার্জি লেন তো আমাদের পাড়ায়। পাঁচ নম্বর বাড়ি? তাহলে তুমি সত্যি—মেয়ে নাকি!
ফুলটুসি মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, তুমিই তো মিথ্যে ভাবছো। আমি কি বলেছি আমি মিথ্যে।
বাপ্পা বললো, তাহলে কি আমি তোমাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারি?
ফুলটুসি তার একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার ওপর বাপ্পা রাখলো নিজের হাত। সত্যি সত্যি একজনকে ছুঁয়েছে সে।
এবার বেশ অবাক হয়ে বাপ্পা জিজ্ঞেস করলো, তুমি এখানে কী করে এলে? কেন রেলিং—এর ওপর বসে আছো?
ফুলটুসি বললো, আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই বসে আছি। তোমার যদি আপত্তি থাকে, এক্ষুণি চলে যেতে পারি!
বাপ্পা বললো, কী করে চলে যাবে?
ফুলটুসি বললো, এই পতাকা নিয়ে আমি ইচ্ছে মতন উড়ে যেতে পারি। আমার ডানা লাগে না।
বাপ্পা অবিশ্বাসের সঙ্গে বললো, যাঃ!
ফুলটুসি বললো, কিচ্ছু না জেনে যাঃ যাঃ বলো না তো! তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানো? এক এক সময় আমি অভিরূপ বসু আর জয়া বসুর মেয়ে, পাঁচ নম্বর বাড়িতে থাকি আর মডার্ন স্কুলে পড়ি। আর এক এক সময় আমার বাবা—মা কেউ না, আমি ইস্কুলে যাই না, আমি ছবি পাহাড়ে গিয়ে খেলা করি। বিশ্বাস হচ্ছে না? আমি একলা এরকম নই। দেখো দেখো, রাস্তা দিয়ে ওই যে একটা ছেলে পেয়ারার ঝুড়ি মাথায় করে যাচ্ছে, পেয়ারা বিক্রি করে, ও কিন্তু আসলে পেয়ারাওয়ালা নয়। এক এক সময় ও ছবি পাহাড়ে গিয়ে একটা খরগোশ হয়ে যায়।
বাপ্পা বললো, কী আবোলতাবোল বকছো, বুঝতে পারছি না। মানুষ আবার খরগোশ হতে পারে নাকি?
ফুলটুসি বললো, অনেক মানুষই আসলে দু’রকম। কেউ ধরো এখানে ইস্কুলে যাচ্ছে, পার্কে ক্রিকেট খেলছে, আবার ছবি পাহাড়ে গিয়ে সে একদম বদলে যাচ্ছে। সবসময় কি একরকম থাকতে ভালো লাগে? আমার মা—বাবা যখন বাড়িতে থাকে না, তখনই আমি ছবি পাহাড়ে পালিয়ে যাই।
বাপ্পা বললো, ছবি পাহাড়টা আবার কোথায়?
ফুলটুসি বললো, যেতে চাও?
বাপ্পা বললো, আমাকে নিয়ে যাবে? চলো দেখে আসি। আমার মা—বাবাও তো এখন বাড়িতে নেই।
ফুলটুসি বললো, কিন্তু অবিশ্বাস করলে চলবে না। তুমি ভালো করে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে বুঝে নাও, তুমি ঘুমোচ্ছোও না, চোখে ভুলও দেখছো না। তোমার পকেটে পয়সা—টয়সা নেই তো? তাহলে রেখে এসো। পয়সা সঙ্গে নিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না।
বাপ্পা বাথরুমে গিয়ে চোখে—মুখে জল দিয়ে, ভালো করে মুখ মুছে এসে দেখলো, তখনো মেয়েটি সেখানে বসে আছে।
সে জিজ্ঞেস করলো, সেখান থেকে আবার ফিরে আসবো তো? কতক্ষণ লাগবে?
ফুলটুসি বললো, সে—সব তোমায় চিন্তা করতে হবে না। আমার হাত ধরে থাকো শক্ত করে। ভয় পেও না!
একটা ঝাঁকুনি লাগলো, তারপরই বাপ্পা দেখলো সে হাওয়ায় ভাসছে। অনেক নিচে বর্ধমান শহর, রাস্তায় লোকজন, গরু—সাইকেল রিকশা সব যাচ্ছে। ফুলটুসির হাত ধরে বাপ্পা উড়ে যাচ্ছে, ঠিক যেন সুপারম্যান কিংবা সুপারগার্লের মতন। তাহলে সত্যি এরকম ওড়া যায়?
কী সুন্দর ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দু’জনে। বাবা—মায়ের সঙ্গে একবার দার্জিলিং যাবার সময় প্লেনে চেপেছিল বাপ্পা। সেই ওড়া আর এই ওড়ায় কত তফাৎ।
অনেক মাঠ, নদী, জঙ্গলের ওপর দিয়ে ভেসে ভেসে এক জায়গায় ওরা নামতে লাগলো। সামনে একটা পাহাড়। এক ধরনের হলুদ রঙের ঘাস রয়েছে সারা পাহাড়টার গায়ে, সেই জন্য পাহাড়াটাকে সোনালি মনে হয়।
পাহাড়ের তলা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। বড় বড় রাজহাঁস ভাসছে সেই নদীর জলে। ধারে ধারে উইপিং উইলো গাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়েছে।
বাপ্পা বললো, বাঃ, জায়গাটা বেশ সুন্দর। কিন্তু এই পাহাড়টার নাম ছবি পাহাড় কেন?
ফুলটুসি বললো, তার কারণ, এই পাহাড়টা রোজ বদলে যায়। আজ সোনালি দেখছো তো, কাল এসে দেখবে হয়তো বেগুনি। কোনোদিন শোনা যায় পাহাড়ের ভেতর থেকে টুংটাং করে অনেক ঘণ্টা বাজছে। এখানে কোনো কিছুই রোজ একরকম নয়। নদীটাও বদলে যায়। আজ দেখছো সব সাদা সাদা রাজহাঁস, কাল দেখবে সব কালো কালো পানকৌড়ি। এখানে একঘেয়েমি বলে কিছু নেই। তোমার নাম বাপ্পা। সারা জীবন তুমি বাপ্পাই থেকে যাবে, অন্য কিছু হবে না, এটা কী রকম বিচ্ছিরি না?
বাপ্পা বললো, আমার একটা ভালো নাম আছে। ইস্কুলে আমার নাম দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
ফুলটুসি তার লাল টুসটুসে ঠোঁট উল্টে বললো, এমন কিছু ভাল নাম নয়। সে যাই হোক, সারা জীবন তো তুমি ওই এক বাবা—মায়ের ছেলেই থাকবে। মাঝে মাঝে অন্য কোনো বাড়ির ছেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না?
বাপ্পা বললো, ইচ্ছে করলেই হওয়া যায় নাকি?
ফুলটুসি বললো, হ্যাঁ হওয়া যায়। দেখো না, একটু বাদেই আমি একটা পাখি হয়ে যাবো!
বাপ্পা বললো, এই না না, পাখি হয়ে যেও না। তাহলে তোমাকে আমি চিনতে পারবো না। তোমার সঙ্গেই আমাকে ফিরতে হবে।
ফুলটুসি বললো, একটা মজা দেখবে?
পাশেই একটা একতলা বাড়ির সমান উঁচু গাছ, আর ঠিক দুটো ডাল। ওপরে কমলা রঙের কাঞ্চন ফুলের মতন ফুল ফুটে আছে।
সেই গাছটার গায়ে হাত দিয়ে ফুলটুসি জিজ্ঞেস করলো, কী গো, তুমি কখন এলে?
গাছটা অমনি অবিকল মানুষের মতন গলায় বললো, এই তো, কুড়ি—পঁচিশ মিনিট আগে। তখন থেকে ভাবছি বৃষ্টি হবে। একটু বৃষ্টি খেয়ে বাড়ি যাবো।
বাপ্পা প্রথমটার চমকে গিয়েও সামলে নিয়ে বললো, যাঃ, এটা একেবারে গাঁজাখুরি ব্যাপার। গাছ কখনো কথা বলতে পারে নাকি? তুমি কোনো ম্যাজিক শিখেছো!
ফুলটুসি ধমক দিয়ে বললো, মোটেই আমি ম্যাজিক—ফ্যাজিক জানি না। সব গাছই কথা বলতে পারে, আমরা শুনতে পাই না। সেটা আমাদের দোষ।
তারপরই ফিক করে হেসে ফেলে বললো, এটা কিন্তু আসলে গাছ নয়!
আবার সে গাছটার গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, একবার তুমি তোমার আসল চেহারাটা দেখাও তো!
গাছটা বদলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি পনেরো—ষোলো বছরের ছেলে।
এবার সত্যিই বাপ্পা দারুণ আশ্চর্য হয়ে গেল। ফিস ফিস করে বললো, রতন?
বাপ্পাদের পাড়ায় একটা মস্ত মুদিখানা আছে। তার মালিকের নাম হরিদাস, পাড়ার সব লোক তার নাম দিয়েছে ভুঁড়িদাস। সে ভুঁড়ি বাগিয়ে কাউন্টারে বসে থাকে, আর তিন—চারটে ছেলে দৌড়োদৌড়ি করে খদ্দেরদের জিনিসপত্র দেয়। সেই ছেলেদের মধ্যে একজন এই রতন।
ফুলটুসি বললো, দোকানের মালিক তো ওকে বড্ড বেশি খাটায়। তাই রতন একটু ছুটি পেলেই এখানে বিশ্রাম নিতে আসে। চেহারা বদলে ফেলে। গাছ হওয়াটাই ওর বেশি পছন্দ। তাই না রতন।
রতন হি হি করে হেসে আবার গাছ হয়ে গেল।
ফুলটুসি বললো, এর পর যেন মুদিখানায় গিয়ে রতনকে এইসব কথা জিজ্ঞেস করো না। তখন দেখবে, ওর কিচ্ছু মনে নেই।
বাপ্পা বললো, বাঃ, বেশ মজা তো। যে—কেউ ইচ্ছে করলেই এখানে চলে আসতে পারে?
ফুলটুসি বললো, এত সোজা নয়। তা হলেই হয়েছিল আর কি! ওই গাছের গায়ে একটা সাদা ফ্ল্যাগ দেখছো না? আমার কাছে যেমন একটা রয়েছে। এই সাদা পতাকা না থাকলে ওড়াও যায় না, চেহারাও বদলানো যায় না।
বাপ্পা উৎসাহের সঙ্গে বললো, ওই সাদা পতাকা কোথায় পাওয়া যায়?
ফুলটুসি বললো, কোত্থাও পাওয়া যায় না। তুমি কি পয়সা দিয়ে কিনবে ভাবছো নাকি? এই পতাকা নিজে নিজে আসে। সবার কাছে না, কারুর কারুর কাছে। আমি দেখি একদিন আমার পড়ার টেবিলে পড়ে আছে। হাতে নিতেই শরীরটা হালকা হয়ে গেল। ঘরের মধ্যেই উড়তে শুরু করলাম। এরকমই হয় না রতন?
গাছটা হি—হি করে হেসে বললো, ঠিক তাই!
গাছের হাসি শুনলে গা ছমছম করে। বাপ্পা সেখান থেকে সরে বসলো।
ফুলটুসি বললো, আমি আর দেরি করতে পারিছ না। পাখি হতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি কিছু হতে চাও তো বলো।
বাপ্পা বললো, আমি পাখি হবো? না, থাক, উড়তে উড়তেই তো এলাম। হরিণ হতে পারি?
ফুলটুসি বললো, হ্যাঁ পারো। তাহলে—
বাপ্পা বললো, দাঁড়াও, দাঁড়াও! হরিণ তো খুব জোরে ছোটে। আমার জ্বর হয়েছে, আমি তো ছুটতে পারবো না।
ফুলটুসি বললো, দুর পাগল! হরিণের আবার জ্বর হয় নাকি কখনো? এখানে কারুর অসুখ—বিসুখ থাকে না।
তারপর ফুলটুসি সাদা পতাকাটা বাপ্পার গায়ে ছুঁইয়ে দিতেই কী যে হলো ঠিক বোঝা গেল না। বাপ্পা দেখলো, সে খুব ছুটছে। শরীরটা হালকা লাগছে। তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে কোনো অসুবিধে নেই। ইস্কুলের স্পোর্টসে বাপ্পা একশো মিটার রানে সেকেন্ড হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে, সে ফার্স্টের থেকেও অনেক জোরে যাচ্ছে।
নদীর ধারে ছুটোছুটি করতে লাগলো বাপ্পা। হরিণ হবার কথাটা তার মনে এসেছে। কারণ তার দৌড়োতে খুব ভালো লাগে।
এক জায়গায় অনেক সবুজ সবুজ লম্বা ঘাস হয়ে আছে। বাপ্পা তার মধ্যে ঢুকে থমকে দাঁড়ালো। তারপর ঘাসে মুখ দিয়ে যেতেই সে ভাবলো, আরে আমি কি ঘাস খাবো নাকি! না, না ঘাসটাস খেতে পারবো না। কিন্তু হরিণরা তো ঘাস—পাতাই খায়, তারা তো মাছ—মাংস খেতে জানে না। এই মুশকিল!
নাঃ, বাপ্পা ভাবলো, আমার এখনো খিদে পায়নি। সে ছবি পাহাড়ের দিকে এগিয়ে গেল। এখানকার ঘাস হলুদ, এ ঘাস হরিণ খায় না।
পাহাড়ে কিসের যেন একটা শব্দ হচ্ছে। খুব মিষ্টি সুর। জলতরঙ্গ বাজনার মতন। কোনোদিকে একটাও মানুষ নেই। আরও কয়েকটা হরিণ আর খরগোশ সে দেখতে পেল। ওরা আসল, না বাপ্পারই মতন রূপ বদলেছে? কেউ তার কাছে আসছে না।
পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত ওঠা যাবে?
বাপ্পা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। এই সময় একটা ল্যাজঝোলা ইষ্টকুটুম পাখি তার কাছে এসে উড়তে উড়তে বললো, তুমি যেমন হরিণ সেজেছো, তেমনি কেউ কেউ কিন্তু বাঘও সাজে। এখানে বাঘ আছে। কোনো বাঘ যদি তোমাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে কিন্তু তোমায় উদ্ধার করা যাবে না।
বাপ্পা সঙ্গে সঙ্গে উল্টো দিকে ফিরলো।
পাখিটা বললো, এবার বাড়ি যাবে নাকি?
পাখি আবার ফুলটুসি হলো, হরিণ হয়ে গেল বাপ্পা। দু’জনে মেঘের ওপর দিয়ে ভেসে ফিলে এলো বারান্দায়। ফুলটুসি বললো, আমার মা বোধহয় খোঁজাখুঁজি করবে, আমি চলি!
এখানেই কিন্তু শেষ নয়। মা ফিরে এসে দেখলেন, বাপ্পার গায়ে একটুও জ্বর নেই। ডাক্তারবাবু সন্ধেবেলা এসে বেশ অবাক হয়ে গেলেন। বাপ্পার জ্বর একেবারে সেরে গেছে তো বটেই, চোখেও ছলছলে ভাবটা নেই। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।
দু’দিন বাদে বাপ্পা পাড়ার পার্কে গিয়ে খেলার অনুমতি পেল।
এই দু’দিন বাপ্পা অনবরত শুধু ভেবেছে, ব্যাপারটা কী হলো? ছবি পাহাড়ের মতন জায়গা সত্যিই কি কোথাও আছে? যেখানে ইচ্ছে মতন চেহারা বদলানো যায় কিছুক্ষণের জন্য? কেউ কেউ সাদা পতাকা পায়। সে পতাকা কোথা থেকে আসে? ফুলটুসি নামে সত্যিই কি একটা মেয়ে আছে? নাকি পুরোটাই দিবাস্বপ্ন? জেগে জেগেও বোধহয় স্বপ্ন দেখা যায়। অথবা সবাটাই বাপ্পা কল্পনা করেছে?
পার্কে খেলতে যাবার আগে, বিকেলবেলা বাপ্পা বাঁ দিকের গলিটাতে ঢুকে গেল। তার পরের গলিটাই শংকর ব্যানার্জি লেন।
সেই গলিতে ঢুকে বাপ্পা নম্বর খুঁজতে লাগলো। হ্যাঁ, পাঁচ নম্বর বাড়িও আছে। একট সাদা রঙের দোতলা বাড়ি।
বাপ্পার বুকের মধ্যে টিপ টিপ করছে। এ বাড়িটা সে আগে দেখেনি। তবু এই পাঁচ নম্বর বাড়িটার কথা তার মনে এলো কী করে?
দরজার বেল বাজাবার পর একটি মেয়েই দরজা খুললো। হলুদ ফ্রক পরা। কোঁকড়া চুল। ফুলটুসি! হ্যাঁ, এই তো ফুলটুসি! তাহলে মিথ্যে নয়, ফুলটুসি আছে, ফুলটুসি আছে!
মেয়েটি বললো, কী চাই?
বাপ্পা বললো, তুমি…তুমিই তো ফুলটুসি?
মেয়েটি বললো, না তো, আমার নাম শ্রেয়সী।
হ্যাঁ, এই নামটাও বলেছিল। ফুলটুসি বলেছিল, আমার অনেক নাম, যেটা ইচ্ছে বেছে নাও!
বাপ্পা বললো, শ্রেয়সী, তুমি মডার্ন স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়?
সে বললো, হ্যাঁ। তুমি জানলে কী করে? তুমি কে?
বাপ্পা বললো, সে কি, চিনতে পারছো না? তুমি আমাকে ছবি পাহাড়ে নিয়ে গিয়েছিলে।
মেয়েটি বললো, ছবি পাহাড়? সে আবার কোথায়?
বাপ্পা বললো, তোমার মনে নেই? তুমি আমাকে আগে দেখোনি কখনো?
মেয়েটি দু’দিকে মাথা নেড়ে বললো, না!