ছবিও কথা বলে
এক
ক্যালকাটা নাইট রাইডার্সের ম্যাচ নিয়ে শাহরুখ খানের প্রেস কনফারেন্স সোনার বাংলায়৷ সেখানে যাব বলে অফিস থেকে বের হচ্ছি, এমন সময় ফুল্লরার ফোন, ‘এই, একটা খারাপ খবর আছে৷ নপরাজিতবাবু সুইসাইড করেছেন৷’
শুনে চমকে উঠলাম৷ গলফ গ্রিনে আমাদের হাউসিং কমপ্লেক্সেরই বাসিন্দা নপরাজিতবাবু৷ উইং কমান্ডার নপরাজিত লাহিড়ী৷ এয়ারফোর্স থেকে বহু বছর আগে অবসর নিয়েছেন৷ ভদ্রলোকের চেহারাটা চোখের সামনে ভেসে উঠল৷ প্রায় ছ’ফুটের উপর লম্বা, ঋজু শরীর৷ এতটুকু মেদ নেই৷ একেবারে দিলখোলা টাইপের মানুষ৷ কথায় কথায় হাহা করে হাসতেন৷ একমাত্র মেয়ে থাকেন মুম্বাইয়ে৷ নপরাজিতবাবু বিপত্নীক, একাই থাকতেন ওঁর ফ্ল্যাটে৷ কী এমন হল, উনি সুইসাইড করলেন?
মুখ দিয়ে প্রশ্ন বেরিয়ে গেছিল৷ শুনে ওদিক থেকে ফুল্লরা বলল, ‘সবাই তো সন্দেহ করছে, সেই ব্যাপারটা৷ তুমি অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর টুবি-র মিসেস সেন আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন৷ তোমার খুব খোঁজ করছিলেন৷ আমাকে বলে গেলেন, ‘বউমা, কালকেতুকে বলো, কেসটা হাতে নিতে৷ আসল ব্যাপারটা তাহলে জানা যাবে৷’
শুনে একটু বিরক্তই হলাম৷ এই মিসেস সেন মহিলাটিকে আমি মোটেই পছন্দ করি না৷ সবসময় পরচর্চা করে বেড়ান৷ কিছুদিন আগে একটা খবর উনি হাউসিংয়ে রটিয়েছেন৷ নপরাজিতবাবু নাকি মোটেই সুবিধের লোক নন৷ প্রায়ই ওঁর বাড়িতে মাঝবয়সি এক মহিলা আসেন৷ তাঁর সঙ্গে নাকি অবৈধ সম্পর্ক৷ ওই মহিলাকে নিয়ে নপরাজিতবাবুর পরিবারে খুব অশান্তি৷ ওঁর মেয়ে নাকি প্রায়ই মুম্বাই থেকে ফোন করে, এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেন মিসেস সেনের কাছে৷
বৃদ্ধ বয়েসে কোনো মহিলাঘটিত কেলেংকারিতে নপরাজিতবাবু জড়িয়ে পড়বেন এবং সেই কারণে সুইসাইড করবেন, আমার তা মনে হয় না৷ তাই প্রেস কনফারেন্সে যাওয়ার তাড়ায়, দু-একটা কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিলাম৷ কিন্তু ঘটনাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলাম না৷ গাড়ি করে ইস্টার্ন বাইপাসের দিকে যাওয়ার সময় নপরাজিতবাবুর বুদ্ধিদীপ্ত মুখটাই বারবার মনে পড়তে লাগল৷ সকালে গলফ ক্লাবে খেলতে যাওয়ার সময় প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা হত৷ সেই সময় উনিও মর্নিংওয়াক করতে বেরোতেন৷ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু-চার মিনিট কথা বলতেন৷ বেশির ভাগ কথাই হাউসিংয়ের ভালোমন্দ সম্পর্কে৷ সাংবাদিকতা করি বলে তো বটেই, মাঝেমধ্যেই শখের গোয়েন্দাগিরি করি বলেও উনি খুব পছন্দ করতেন আমাকে৷
ভদ্রলোককে সোজাসাপটা ধরনের বলেই মনে হত৷ তবে সর্বদাই মিলিটারি মেজাজ৷ নাকের ডগায় গোঁসা৷ মাঝেমধ্যে এমন এমন ঘটনায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেন, যা ওঁর বয়সের সঙ্গে খাপ খেত না৷ একবার তো ওঁকে বাঁচানোর জন্য আমাকেও মাঠে নামতে হয়েছিল৷ সেইসময় আমাদের হাউসিংয়ে ঢোকার মুখে, বড়ো ফুটপাথের উপর কয়েকটা দোকান গজিয়ে উঠেছিল৷ চা, পান-বিড়ি-সিগারেট, ফাস্ট ফুড-এর দোকানগুলো দিয়েছিল স্থানীয় ছেলেরা৷ কী হয়েছিল কে জানে, হঠাৎ সেই দোকানগুলো উৎখাত করার জন্য নপরাজিতবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন৷ এই নিয়ে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারাত্মক ঝামেলা৷ হাউসিংয়ের কোঅপারেটিভ সোসাইটি দু-ভাগ৷ এক দলের মতে, পাড়ার ছেলেদের চটিয়ে নপরাজিতবাবু ঠিক করেননি৷ অন্য দলের বক্তব্য, ঠিকই করেছেন৷ হাউসিং থেকে বেরোনো অথবা ঢোকার মুখে পাড়ার ছেলেদের অভব্যতা আর সহ্য করা যাচ্ছিল না৷ শেষে আমাকেই মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল৷
আর-একবার…কর্পোরেশন ইলেকশনের সময় ভোট চাইতে এসেছিলেন পার্টির এক নেতা রমেন দে৷ ভোটে প্রথম দাঁড়িয়েছেন৷ নপরাজিতবাবু হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘লেখাপড়া কদ্দূর?’
প্রশ্নটা শুনে রমেনবাবু হকচকিয়ে গেলেন৷ তারপর নিজেকে সামলে বললেন, ‘আজ্ঞে স্যার, মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি৷’
নপরাজিতবাবু তখন বললেন, ‘অত অল্প বিদ্যে নিয়ে কর্পোরেশনে কাজ করবেন কী করে? দু-চারটে চিঠিপত্তর যখন ইংরেজিতে লিখতে হবে, তখন কী করবেন?’
ভোটপ্রার্থীরা এসব প্রশ্ন শুনতে অভ্যস্ত নন৷ তাঁদের চ্যালারা তো আরও এক কাঠি উপরে৷ রাগে তারা তখন ফেটে পড়ার অপেক্ষায়৷ তা দেখেও ভ্রূক্ষেপ নেই নপরাজিতবাবুর৷ এরপরও রমেনবাবুকে উনি প্রশ্ন করেন, ‘দেশসেবার কোনো এক্সপেরিয়েন্স আছে? থাকলে বলুন৷ তারপর ঠিক করব, আপনাকে ভোট দেব কি না?’
আর কোনো কথা না বলে, সেদিন রমেনবাবু হাউসিং ছেড়ে চলে গেছিলেন৷ কিন্তু পরে কাউন্সিলার নির্বাচিত হয়ে আমাদের খুব ক্ষতি করে দিয়েছিলেন৷ হাউসিংয়ে জলের খুব অসুবিধা ছিল৷ তাই গার্ডেনরিচ থেকে কর্পোরেশনের জল আনার চেষ্টা করছিলাম আমরা৷ রমেনবাবু আটকে দিলেন৷ ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম৷ আমাকে বললেন, ‘সরি কালকেতুবাবু, কিছু করতে পারব না৷ আপনাদের হাউসিংয়ে যদ্দিন ওই নপরাজিতবাবু থাকবেন, তদ্দিন আমার কাছে কোনো রিকোয়েস্ট নিয়ে আপনি অন্তত আসবেন না৷’
হাউসিংয়ের অনেকের কাছেই নপরাজিতবাবু ‘গোলমেলে টাইপের’৷ কিন্তু আমার কাছে উনি বরাবরই সাচ্চা মানুষ৷ অনেকেই ওঁকে পছন্দ করতেন না৷ সেটা যে উনি বুঝতেন না, তাও না৷ তবুও কারও সঙ্গে ওঁর শত্রুতা ছিল না৷ আপদে-বিপদে সবার আগে উনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন৷ কথায় কথায় আমাকে একদিন উনি বলেওছিলেন, ‘কালকেতুবাবু, আমার আসল শত্রু কে জানেন? আমার জিভ৷ এই জিভই একদিন আমার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷’
নপরাজিতবাবুর কথা ভাবতে ভাবতেই সোনার বাংলা হোটেলে পৌঁছে গেলাম৷ কিন্তু কনফারেন্স রুমে গিয়ে শাহরুখ খানকে দেখার পর, আইপিএল ক্রিকেট নিয়ে এমন মজে গেলাম, নপরাজিতবাবুর কথা আর মনেই রইল না৷
দুই
লাহোরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের উপর উগ্রপন্থীরা হামলা করেছে৷ টিভিতে এই খবরটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আইপিএল ক্রিকেট হওয়া এবার কঠিন হয়ে যাবে৷ খবরটা কীভাবে করব, তাই ভাবছিলাম, এমন সময় সুদীশের ফোন৷ ‘কালকেতু, তুই বাড়িতে, না হনলুলুতে?’
প্রশ্নটা শুনে হেসে বললাম, ‘তোর কী মনে হয়?’
‘আমার মনে হওয়াতে কী আসে-যায় বল৷ যখনই ফোন করি, শুনি তুই বাড়ি নেই৷ ক্রিকেটের বিশ্বায়ন নিয়ে তোরা রিপোর্টাররা আজকাল ব্যাপক মাথা ঘামাচ্ছিস৷ বলা যায় না, কোনো দিন হয়তো শুনব, হনলুলুতেও টেস্ট ম্যাচ হচ্ছে, আর রানি মুখার্জির সঙ্গে সেই ম্যাচ তুই কভার করতে গেছিস৷’
‘যদি যাই, তোর কোনো অসুবিধে আছে?’
‘আমার আর কী অসুবিধে৷ বলিউডের স্টারদের সঙ্গে তোরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করছিস, ভালোই তো৷ তবে সিকিউরিটি সামলাতে গিয়ে আমাদের হিমসিম খেতে হচ্ছে ভাই…’
প্রায় মাসতিনেক দেখা হয়নি সুদীশের সঙ্গে৷ সুদীশ নাগ৷ ওর সঙ্গে আমার যখন আলাপ হয়, তখন ও লালবাজারে গোয়েন্দা দফতরে ছিল৷ তখন রহস্যভেদে কয়েকটা ব্যাপারে ওকে সাহায্য করেছিলাম৷ সেই থেকে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব৷ এখন প্রমোশন পেয়ে সুদীশ যাদবপুর থানার ওসি৷ ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের পাঁড় সাপোর্টার৷ ফুটবল অন্ত প্রাণ৷ ক্রিকেট খেলাটাকে ও একদম পছন্দ করে না৷ তাই চিমটি কেটে কথা বলছে৷ ওর কথার পিঠে কথা বলতে গেলে হয়তো বলে বসবে, তোরা সব ক্রিকেট কর্তাদের দালাল৷ তাই প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বললাম, ‘আমি এখন বাড়িতে৷ ফোনটা করলি কেন বল৷’
‘তোদের হাউসিংয়ে নপরাজিত লাহিড়ীকে তুই চিনতিস?’
বললাম, ‘কেন চিনব না? ভালোমতোই চিনতাম৷ হ্যাঁরে, ভদ্রলোকের মৃত্যুর কারণটা কী?’
‘বিষক্রিয়া৷ প্রথম দিকে আমার ধারণা হয়েছিল, পারিবারিক ঝামেলার জন্য সুইসাইড কেস৷ কিন্তু নপরাজিতবাবুর মেয়ে মুম্বাই থেকে এসে আমাদের কাছে কমপ্লেন করেছেন, মার্ডার৷ নপরাজিতবাবুর সঙ্গে নাকি ইদানীং এক মাঝবয়সি বিধবা মহিলার ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল৷ রোজই তিনি গলফ গ্রিনের ফ্লাটে যেতেন৷ তিনিই নাকি সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে, নপরাজিতবাবুকে বিষ খাইয়েছেন৷ ভদ্রমহিলাকে ডেকে পাঠিয়েছি৷ ঘণ্টাখানেক পরে থানায় আসবেন৷ তুই কি একবার আমার কাছে আসতে পারবি?’
‘ভদ্রমহিলার সঙ্গে তুই নিজে কথা বলেছিস?’
‘না৷ আইও সুভদ্র কথা বলেছে৷ ভদ্রমহিলার ছেলেকে তুই চিনতে পারবি৷ শুভাশিস বিশ্বাস৷ ময়দানের উঠতি স্ট্রাইকার৷ ছেলেটা নাকি তোর কথা সুভদ্রকে বলেছে৷’
শুভাশিসের নামটা শুনেই চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম৷ সুদীশকে বললাম, ‘মিনিট পনেরোর মধ্যে আমি তোর কাছে আসছি৷’ মনটা খারাপও হয়ে গেল৷ এইরকম একটা বিচ্ছিরি ঘটনার সঙ্গে শুভাশিসের নামটা জড়িয়ে গেলে, ওর কেরিয়ারের ক্ষতি হয়ে যাবে৷ ছেলেটার নাড়িনক্ষত্র আমি জানি৷ ওর বাবা মোটর অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিলেন সল্টলেক স্টেডিয়াম থেকে বড়ো ম্যাচ দেখে ফেরার সময়৷ ওকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন ওর মা৷ ছেলেটা এ সিজনে চিরাগ ইউনাইটেডের হয়ে খেলছে৷ কানাঘুষোয় শুনছি, আগামী বছর মোহনবাগান নাকি ওকে পঁচিশ লাখ টাকা দিতেও রাজি৷ এই সময়…ওর মায়ের যদি কিছু হয়, তাহলে ছেলেটা শেষ হয়ে যাবে৷ যাদবপুর থানার দিকে যেতে যেতে হঠাৎই মনে পড়ল, একদিন কথায় কথায় ও আমায় বলেছিল, ওর এক দাদু পাশে এসে না দাঁড়ালে, ওদের সংসারটা ভেসে যেত৷ সেই দাদুর নামটা শুভাশিস কিছুতেই তখন বলতে চায়নি৷ নাকি বারণ আছে৷ তাহলে কি নপরাজিতবাবুই ওর সেই দাদু? দূর থেকে ওদের সাহায্য করে গিয়েছেন৷ হতেও পারে৷
ফুল্লরা যখন বলেছিল, নপরাজিতবাবুর মৃত্যুরহস্য নিয়ে মাথা ঘামানোর ইচ্ছে হয়নি৷ কিন্তু শুভাশিসের কথা ভেবে মনটাকে তৈরি করে নিলাম৷ দিন দশেক বাদে ছেলেটার দামাস্কাসে খেলতে যাওয়ার কথা৷ জুনিয়র ইন্ডিয়া টিমের হয়ে৷ মার্ডার কেস-এর ঝামেলায় ওর মা জড়িয়ে পড়লে, ওর বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে যাবে৷ নাহ, ছেলেটাকে বাঁচানো দরকার৷ এজন্য দু-একদিন অফিস থেকে ছুটিও নিতে হলেও, নেব৷ যাদবপুর থানায় পৌঁছে সুদীশকে বললাম, ‘তোর আপত্তি না থাকলে কেসটা আমি একটু দেখতে চাই৷ অবশ্যই তোর হেল্প নিয়ে৷ নপরাজিতবাবুর ডেডবডি তুলে আনার সময় তোরা যেসব ছবি তুলেছিস, তার সব কপি দে৷ সেইসঙ্গে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের একটা জেরক্স কপিও৷ সুভদ্রর সঙ্গেও একবার বসব৷ দেখি, আসলে এটা সুইসাইড কেস, নাকি মার্ডার৷ যদি মার্ডার হয়, তাহলে আসল অপরাধীটা কে? আমি এক সপ্তাহের মধ্যে কেসটা সলভ করতে চাই৷’
তিন
সকালেই ফোন করে সুদীশকে বলে রেখেছিলাম, ‘নপরাজিতবাবুর মৃত্যুরহস্য নিয়ে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিস, বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে তাদের সবাইকে ব্যাংকে হাজির থাকতে বলিস৷ খুনি কে, মনে হয় আজ ধরে ফেলতে পারব৷’ শুনে সুদীশ এমন উৎসাহিত হয় যে, চেয়েছিল মিটিংটা থানায় হোক৷ ইচ্ছে করেই আমি রাজি হইনি৷ দশদিন আগে ওই ব্যাংক থেকেই পেনশন-এর টাকা তুলে নপরাজিতবাবু বাড়ি ফিরে যান৷ তার ঘণ্টাখানেক পর, তাঁকে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে কাজের মেয়ে ময়না৷ গত ছ’টা দিন, এই কেস নিয়ে আমি মারাত্মক খেটেছি৷ প্রচুর লোকের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তারপরই আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, সুইসাইড নয়, এটা কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার৷ না, সম্পত্তি হাতানো বা প্রতিপত্তি দেখানোর জন্য নয়৷ নপরাজিতবাবুর খুন হওয়াটা সামাজিক অবক্ষয়ের এক নমুনা৷ যে এই কাজটা করেছে, বলা যায় সে বিকারগ্রস্ত এক মানসিক রোগী৷
আমাদের হাউসিংয়ের কাছেই সেই ব্যাংক৷ বিকেলে সোয়া পাঁচটার সময় ব্যাংকের কনফারেন্স রুমে গিয়ে দেখি, সুভদ্র দশজনকে বসিয়ে রেখেছে৷ শুভাশিসের মা অরুণা বিশ্বাস, শুভাশিস, ব্যাংকের ম্যানেজার সুপ্রতিম সাহা, দুজন কর্মী কুন্তল বসু ও অজয় দে, নপরাজিতবাবুর মেয়ে মল্লিকা ও ল-ইয়ার বাসুদেব লাহা, কাজের মেয়ে ময়না৷ এঁরা ছাড়াও রয়েছেন পার্থপ্রতিমবাবু, প্রতি মাসের সাতাশ তারিখে যাঁর সঙ্গে নপরাজিতবাবু ব্যাংকে যেতেন৷ দুজনেই পেনশন-এর টাকা তুলতেন৷ এই আটজনের প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলেছি বলে, চিনতে পারলাম৷ বাকি দুজন অচেনা৷ পুলিশও হতে পারে৷ এই দশজনের বাইরেও, আমি একজনকে থাকতে বলেছি৷ ডাক্তার অর্ণব ব্যানার্জি৷ তার কথা সুদীশ বা সুভদ্র—কেউ জানে না৷
সাড়ে পাঁচটার সময় সুদীশ বলল, ‘কালকেতু এবার শুরু কর৷’
সামনে বসা দশজনের দিকে আলাদা করে একবার তাকিয়ে আমি বললাম, ‘নপরাজিতবাবুকে আমি দীর্ঘদিন ধরে চিনতাম৷ এমন স্ট্রং পার্সোনালিটির মানুষ খুব কমই দেখেছি৷ উনি যে সুইসাইড করবেন না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম৷ উনি মার্ডার হয়েছেন, এটা ধরে নিয়েই আমি ইনভেস্টিগেশন শুরু করি৷ প্রথমে আমার সন্দেহটা গিয়ে পড়েছিল নপরাজিতবাবুর মেয়ে মল্লিকা ও জামাতা সুধন্যর উপর৷ এঁদের সঙ্গে নপরাজিতবাবুর সম্পর্ক ইদানীং ভালো যাচ্ছিল না৷ ফোনে প্রায় দিনই কথা কাটাকাটি হত৷ মাসচারেক আগে সুধন্য চাকরি থেকে ছাঁটাই হন৷ তারপর থেকে ওঁদের সংসার টেনে যাচ্ছিলেন নপরাজিতবাবু৷ কিন্তু ইদানীং মুম্বাইয়ের পাট গুটিয়ে মল্লিকা কলকাতায় চলে আসতে চাইছিলেন৷ গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটটা ওঁর নামে লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন৷ তাতে নপরাজিতবাবুর সায় ছিল না৷’
আমি এ পর্যন্ত বলার পরই মল্লিকা উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘আপনি এসব কী আজেবাজে কথা বলছেন কালকেতুবাবু? কে এসব আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে?’
কড়া গলায় বললাম, ‘চুপ করুন৷ আমার বলা শেষ হোক৷ তারপর কিছু বলার থাকলে বলবেন৷ হ্যাঁ, যা বলছিলাম…মেয়ে-জামাইয়ের উপর বিরক্ত হয়েই নপরাজিতবাবু একটা চরম সিদ্ধান্ত নেন৷ দু-বছর আগে বাইপাস সার্জারি করার জন্য তিনি নার্সিংহোমে ভরতি হয়েছিলেন৷ দীর্ঘদিন নার্সিংহোমে ছিলেন৷ খবর দেওয়া সত্ত্বেও, সেই সময় মল্লিকা বা সুধন্য—কেউই মুম্বাই থেকে তাঁকে দেখতে আসেননি৷ সেই সময় তাঁর খুব সেবা করেন নার্স অরুণা বিশ্বাস৷ মল্লিকার অভাবটা তিনিই পূরণ করে দেন৷ নপরাজিতবাবু তাঁকে মেয়ের মতোই দেখতেন৷ অরুণা বিশ্বাসের ছেলে শুভাশিসকেও তিনি খুব ভালোবাসতেন৷ গত মাসে ল-ইয়ার বাসুদেববাবুকে ডেকে নপরাজিতবাবু একটা উইল তৈরি করে, তাঁর অবর্তমানে, সব সম্পত্তি অরুণা বিশ্বাসকে দিয়ে যান এবং সেটা তিনি জানিয়েও দেন মল্লিকাকে৷ বলাবাহুল্য, মল্লিকা সেটা পছন্দ করেননি৷ তারপরই মার্ডার৷ সন্দেহটা মল্লিকা-সুধন্যর উপর পড়াটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু নিজেদের দিক থেকে সন্দেহটা ঘোরানোর জন্যই ওঁরা পুলিশের কাছে কমপ্লেন করে বসেন, তাড়াতাড়ি সম্পত্তি হাতানোর লোভে অরুণা বিশ্বাস বিষ খাইয়ে নপরাজিতবাবুকে মেরে ফেলেছেন৷’
একটু থেমে মল্লিকার দিকে তাকালাম৷ মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে৷ অরুণা বিশ্বাস রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছছেন৷ বাসুদেববাবুর মুখে মৃদু হাসি৷ সেটা দেখে আমি নিশ্চিত হলাম, আমি যা বলছি, উনি তা আগে থেকেই জানেন৷ এই সময় সুদীশ জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে কি মল্লিকাই…?’
বললাম, ‘না, উনি নন৷ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, নপরাজিতবাবু যেদিন খুন হন, সেদিন মল্লিকা আর সুধন্য মুম্বাইতেই ছিলেন৷ নপরাজিতবাবুকে ওঁর পরিবার বা হাইসিংয়ের কেউ খুন করেননি৷ খুনের জঘন্য প্লট শুরু হয়েছিল এই ব্যাংকেই৷’
ব্যাংক ম্যানেজার সুপ্রতিমবাবু আঁতকে উঠে বললেন, ‘কী বলছেন আপনি কালকেতুবাবু? কাগজে যদি এসব কথা বের হয়, তাহলে তো আমার ব্যাংকের সর্বনাশ হয়ে যাবে৷’
বললাম, ‘কিছু করার নেই৷ আমার সন্দেহটা হয়, নপরাজিতবাবুর ডেডবডি নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশের তোলা ছবিগুলো দেখে৷ টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন উনি৷ পাশেই পাতা খোলা ব্যাংকের পাসবই৷ টেবিলে চায়ের কাপ বা জলের গ্লাসের কোনো চিহ্ন নেই৷ তাহলে নপরাজিতবাবুর শরীরে বিষ গেল কী করে? ছবিটা খুব ভালো করে দেখার সময় কেন জানি না, আমার মনে হয়, পাসবই খুঁটিয়ে দেখার সময় বিষক্রিয়ায় নপরাজিতবাবু মারা যান৷ তাহলে কি বিষ সংক্রামিত হয়েছিল ওই পাসবই থেকে?
ছবি অনেক সময় কথা বলে৷ সুদীশকে আমি বলি, পরীক্ষার জন্য ওই পাসবইটা ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে৷ হ্যাঁ, আমার অনুমানই সত্যি হয়৷ পাসবইয়ের পাতা থেকে স্প্রিকনিন নামে এক ধরনের গুঁড়ো বিষের নমুনা পাওয়া যায়৷ নপরাজিতবাবুর একটা বদভ্যাস ছিল৷ কোনো কিছু পড়ার সময় পৃষ্ঠা ওলটানোর আগে আঙুলটা উনি জিভে ভিজিয়ে নিতেন৷ আমি নিজেও অনেক সময় লক্ষ করেছি, টাকা গোনার সময়ও উনি এটা করতেন৷ খুনি নিশ্চয়ই ওঁর এই বদভ্যাসের কথাটা জানত৷ তাই পাসবইয়ের শেষ এন্ট্রির পাতায় গুঁড়ো বিষ স্প্রে করে রেখেছিল৷ বাড়িতে ফিরে নপরাজিতবাবু যখন পাসবই খুঁটিয়ে দেখছেন, সেই সময় জিভে আঙুল ঠেকান৷ এবং সঙ্গে সঙ্গে টলে পড়েন৷’
কথাগুলো বলে ফের থামলাম৷ এবার সুপ্রতিমবাবুর মুখটা কালো হয়ে গেছে৷ কোনোরকমে উনি বললেন, ‘কিন্তু আমার এখানে কে এই জঘন্য কাজটা করবে?’
‘তার আগে জানা দরকার, কেন করবে? আপনাকে একটা কথা বলি সুপ্রতিমবাবু, পেনশনাররা যখন আপনার এই ব্যাংকে টাকা তুলতে আসেন, তখন কি কোনোদিন চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে দেখেছেন, আপনার কোনো কোনো সহকর্মী তাঁদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করেন৷ ওই সামান্য টাকাটাই পেনশনারদের শেষ সম্বল৷ বাড়িতে নিয়ে না গেলে হাঁড়ি চড়বে না৷ ওষুধ কেনার সামর্থ্য থাকবে না৷ কেউ কেউ হয়তো অসুস্থ শরীর নিয়েও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন৷ তাঁদের নিয়ে কত রকমের হাসিমশকরা হয়, জানেন? কত ধরনের কটাক্ষ? ওদের কেউ বলে, ঘাটের মড়া, কেউ জিন্দা লাশ৷ কেউ আবার হরর মুভির হিরো৷ এই যে পার্থপ্রতিমবাবু এখানে বসে আছেন, আপনার এক তরুণ সহকর্মী ওঁকে একদিন বলেছিলেন, ‘এখনও বেঁচে আছেন দাদু? পেনশন দিতে দিতে গভর্নমেন্ট যে ফতুর হয়ে যাবে আপনাদের জন্য৷’ প্রাপ্য টাকা নিতে এসেও কত রকমের অবহেলা, অসম্মান! এ নিয়ে একদিন নপরাজিতবাবু আপনার কাছে কমপ্লেনও করেছিলেন৷ আপনার মনে আছে কিনা, কে জানে?’
সুপ্রতিমবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, ‘করেছিলেন নাকি? হবে হয়তো৷’
‘যার বিরুদ্ধে নপরাজিতবাবু কমপ্লেনটা করেছিলেন, ধরা যাক তার নাম মুকুল৷ সে এসডবলিউও অর্থাৎ সিঙ্গল উইনডো অপারেটর৷ পেনশনাররা তার কাউন্টার থেকেই টাকা নিতেন৷ রাগটা মুকুল পুষে রেখেছিল৷ সেটা আরও উসকে দিত অন্য দু-একজন সমবয়সি সহকর্মী৷ মাসের সাতাশ তারিখে নপরাজিতবাবু পেনশন নিতে এলে, তারা খেপাত, ‘‘মুকুল, তোর যম এ মাসেও এসেছে, মরেনি৷’’ এই মুকুল সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার পারিবারিক আবহ খুব একটা ভালো ছিল না৷ তার মা পালিয়ে যান অন্য এক পুরুষের সঙ্গে৷ ছোটোবেলা থেকেই মুকুল কমপ্লেক্স ক্যারেক্টর৷ যাই হোক, অত ডিটেলস-এ আর যাচ্ছি না৷ নপরাজিতবাবুর যখন বাইপাস সার্জারি হল, সেই সময় তিনি মাস দু-এক ব্যাংকে যেতে পারেননি৷ তখন মুকুল অন্যদের সঙ্গে বাজি ধরেছিল, উনি আর ফিরবেন না৷ সুস্থ হয়ে নপরাজিতবাবু ফের পেনশন তুলতে এলেন৷ বাজি হেরে রাগ আরও বেড়ে যায় মুকুলের৷ প্রতি মাসে মুকুল বাজি ধরে, আর হেরে যায়৷ তার ক্রোধের কারণ অদ্ভুত, একজন মানুষ সতেরো-আঠারো বছর ধরে পেনশন তুলবেন কেন? তার চেয়েও বড়ো কথা, বাজি হেরে তার জন্য প্রতি মাসে গচ্চা দিতে হবে কেন? শুনে হয়তো আপনাদের অবিশ্বাস্য লাগছে, তবুও এটাই ঘটনা৷’
সুদীশ বলে উঠল, ‘কী বলছিস রে তুই?’
বললাম, ‘এক বর্ণও বাড়িয়ে বলছি না৷ এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মনস্তত্ত্ব বোঝার ক্ষমতা তোর-আমার নেই রে৷ বেশির ভাগেরই মূল্যবোধের অভাব৷ এরা বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান দিতে জানে না৷ কখনও কখনও নিষ্ঠুর আচরণ করতেও পিছপা হয় না৷ আর এই মুকুল তো ছোটোবেলা থেকেই মেন্টাল ডিসঅর্ডারের পেশেন্ট৷ যার কাছে সে চিকিৎসার জন্য যেত, সেই ডাক্তারকেও আমি এখানে নিয়ে এসেছি৷’
ডাক্তার ব্যানার্জিকে পরিচয় করিয়ে আমি বললাম, ‘সুপ্রতিমবাবু, আপনাকে একটা খবর দিই৷ আপনি হয়তো জানেন না, দুর্ব্যবহার পেতে পেতে কয়েকজন পেনশনার এমনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন যে, আপনাদের ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে তাঁরা গোপনে একটা চিঠি পাঠান৷ যথারীতি নপরাজিতবাবুই লিডিং পার্ট নিয়েছিলেন৷ ইউনিয়ন মারফত সেই খবর মুকুলের কাছে পৌঁছে যায়৷ ফলে তার ক্রোধ আরও বাড়ে৷ খুনের প্লটের এটা বাহ্যিক কারণ৷ কিন্তু তীব্র তাগিদটা আসে অন্য কারণে৷ মাস ছয়েক আগে মুকুলের বাবা মাত্র আটান্ন বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান৷ শ্মশান থেকে ফিরে এসে মুকুলের মনে হয়, ওর বাবার থেকে কুড়ি বছরের বড়ো হওয়া সত্ত্বেও নপরাজিতবাবুর মতো লোক, দিব্যি হেঁটেচলে বেড়াচ্ছেন৷ অথচ ওর বাবা কেন মারা গেলেন? ধীরে ধীরে মুকুলের মনে হতে থাকে, নপরাজিতবাবুর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই৷ এই সিদ্ধান্তটা ক্রমে ক্রমে ওর বিশ্বাসে দাঁড়িয়ে যায়৷ মুকুল ছক কষতে থাকে৷ ওর এক বন্ধু স্টেট ড্রাগ স্টোরে চাকরি করে৷ তার কাছ থেকে মুকুল জোগাড় করে স্প্রিকনিন বিষ৷ তার পরের ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটেছে, সেটা তো আগেই বলেছি৷ অনেকদিন আগে নপরাজিতবাবু আমাকে কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘‘আমার জিভই আমার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷’’ কী ভেবে কথাটা বলেছিলেন, জানি না৷ তবে ওঁর কথাটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল৷’
সুপ্রতিমবাবু বললেন, ‘এই মুকুলের আসল নামটা কী, তা তো বললেন না?’
বললাম, ‘আপনার ঠিক ডানপাশেই যে বসে আছে, হি ইজ দ্য কালপ্রিট৷ আপনার ব্যাংকের এসিডবলিউও কুন্তল বসু৷ গত মাসের সাতাশ তারিখে নপরাজিতবাবু পেনশনের টাকা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরই সে সহকর্মীদের সঙ্গে মোটা টাকার বাজি ধরেছিল, পরের মাস থেকে নপরাজিতবাবু আর পেনশন নিতে আসবেন না৷ সেই সহকর্মীদের একজন, অজয় এখানে আছে৷ যার কথার সূত্র ধরেই প্রথম আমি সন্দেহ করি কুন্তল বসুকে৷’
কুন্তলকে নিয়ে সুদীশ বেরিয়ে যাওয়ার পর, ব্যাংক থেকে বেরিয়ে দেখি, শুভাশিস আর ওর মা আমার জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করছে৷ আমাকে দেখেই শুভাশিস বলল, ‘স্যার, আপনি কেসটা হাতে না নিলে ওঁরা মাকে খুব হ্যারাস করতেন৷ আমারও দামাস্কাস যাওয়া হত না৷’
বললাম, ‘ভাগ্যিস তোমার নামটা সুদীশ আমার কাছে করেছিল! না করলে মাথাই ঘামাতাম না৷ এবার খোলা মনে খেলতে যাও৷ ওখানে কিন্তু তোমাকে হায়েস্ট স্কোরার হতে হবে৷’
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শুভাশিস বলল, ‘চেষ্টা করব স্যার৷’
—