ছন্দে হসন্ত

                   তব চিত্তগগনের দূর দিক্‌সীমা
                   বেদনার রাঙা মেঘে পেয়েছে মহিমা।

এখানে “দিক্‌’ শব্দের ক্‌ হসন্ত হওয়া সত্ত্বেও তাকে একমাত্রার পদবি দেওয়া গেল। নিশ্চিত জানি, পাঠক সেই পদবির সম্মান স্বতই রক্ষা করে চলবেন।

                   মনের আকাশে তার দিক্‌সীমানা বেয়ে
                   বিবাগী স্বপনপাখি চলিয়াছে ধেয়ে।

অথবা–

                   দিগ্‌বলয়ে নবশশিলেখা
                   টুক্‌রো যেন মানিকের রেখা।

এতেও কানের সম্মতি আছে।

                   দিক্‌প্রান্তে ওই চাঁদ বুঝি
                   দিক্‌ভ্রান্ত মরে পথ খুঁজি।

আপত্তির বিশেষ কারণ নেই।

                   দিক্‌প্রান্তের ধূমকেতু উন্মত্তের প্রলাপের মতো
                   নক্ষত্রের আঙিনায় টলিয়া পড়িল অসংগত।

এও চলে। একের নজিরে অন্যের প্রামাণ্য ঘোচে না।

কিন্তু, যাঁরা এ নিয়ে আলোচনা করছেন তাঁরা একটা কথা বোধ হয় সম্পূর্ণ মনে রাখছেন না যে, সব দৃষ্টান্তগুলিই পয়ারজাতীয় ছন্দের। আর এ কথা বলাই বাহুল্য যে, এই ছন্দ যুক্তধ্বনি ও অযুক্তধ্বনি উভয়কেই বিনা পক্ষপাতে একমাত্রারূপে ব্যবহার করবার সনাতন অধিকার পেয়েছে। আবার যুক্তধ্বনিকে দুই ভাগে বিশ্লিষ্ট করে তাকে দুই মাত্রায় ব্যবহার করার স্বাধীনতা সে যে দাবি করতে পারে না তাও নয়।

যাকে আমি অসম বা বিষমমাত্রার ছন্দ বলি যুক্তধ্বনির বাছবিচার তাদেরই এলাকায়।

                             হৃৎ-ঘটে সুধারস ভরি

কিম্বা–

                             হৃৎ-ঘটে অমৃতরস ভরি
                             তৃষা মোর হরিলে, সুন্দরী।

এ ছন্দে দুইই চলবে। কিন্তু,

                   অমৃতনির্ঝরে হৃৎপাত্রটি ভরি
                   কারে সমর্পণ করিলে সুন্দরী।

অগ্রাহ্য, অন্তত আধুনিক কালের কানে। অসমমাত্রার ছন্দে এরকম যুক্তধ্বনির বন্ধুরতা আবার একদিন ফিরে আসতেও পারে, কিন্তু আজ এটার চল নেই।

এই উপলক্ষ্যে একটা কথা বলে রাখি, সেটা আইনের কথা নয়, কানের অভিরুচির কথা।–

                             হৃৎপটে আঁকা ছবিখানি

ব্যবহার করা আমার পক্ষে সহজ, কিন্তু–

                             হৃৎপত্রে আঁকা ছবিখানি

অল্প একটু বাধে। তার কারণ খণ্ড ৎ-কে পূর্ণ ত-এর জাতে তুলতে হলে তার পূর্ববর্তী স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করতে হয়; এই চুরিটুকুতে পীড়াবোধ হয় না যদি পরবর্তী স্বরটা হ্রস্ব থাকে। কিন্তু, পরবর্তী স্বরটাও যদি দীর্ঘ হয় তাহলে শব্দটার পায়াভারি হয়ে পড়ে।

হৃৎপত্রে এঁকেছি ছবিখানি

আমি সহজে মঞ্জুর করি, কারণ এখানে “হৃৎ’ শব্দের স্বরটি ছোটো ও “পত্র’ শব্দের স্বরটি বড়ো। রসনা “হৃৎ’ শব্দ দ্রুত পেরিয়ে “পত্র’ শব্দে পুরো ঝোঁক দিতে পারে। এই কারণেই “দিক্‌সীমা’ শব্দকে চার মাত্রার আসন দিতে কুণ্ঠিত হই নে, কিন্তু “দিক্‌প্রান্ত’ শব্দের বেলা ঈষৎ একটু দ্বিধা হয়। শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, দরিদ্রান্‌ ভর কৌন্তেয়। “দিক্‌সীমা’ কথাটি দরিদ্র, “দিক্‌প্রান্ত’ কথাটি পরিপুষ্ট।

                             এ অসীম গগনের তীরে
                             মৃৎকণা জানি ধরণীরে।

“মৃৎকণা’ না বলে যদি “মৃৎপিণ্ড’ বলা যায় তবে তাকে চালিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু একটু যেন ঠেলতে হয়, তবেই চলে।

                             মৃৎ-ভবনে এ কী সুধা
                             রাখিয়াছ হে বসুধা।

কানে বাধে না। কিন্তু–

                             মৃৎ-ভাণ্ডেতে এ কী সুধা
                             ভরিয়াছ হে বসুধা।

কিছু পীড়া দেয় না যে তা বলতে পারি নে। কিন্তু, অক্ষর গন্‌তি করে যদি বল ওটা ইন্‌ভীডিয়স্‌ ডিস্‌টিঙ্ক্‌শন, তাহলে চুপ করে যাব। কারণ, কান-বেচারা প্রিমিটিভ্‌ ইন্দ্রিয়, তর্কবিদ্যায় অপটু।

কার্তিক, ১৩৩৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *