দিলীপকুমার আশ্বিনের “উত্তরা’য় ছন্দ সম্বন্ধে আমার দুই-একটি চিঠির খণ্ড ছাপিয়েছেন। সর্বশেষে যে নোটটুকু দিয়েছেন তার থেকে বোঝা গেল, আমি যে কথা বলতে চেয়েছি এখনো সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয় নি।
তিনি আমারই লেখার নজির তুলে দেখিয়েছেন যে, নিম্নলিখিত কবিতায় আমি “একেকটি’ শব্দটাকে চার মাত্রার ওজন দিয়েছি।
ইচ্ছা করে অবিরত
আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।
এদিকে নীরেনবাবুর রচনায় “একটি কথা এতবার হয় কলুষিত” পদটিতে “একটি’ শব্দটাকে দুই মাত্রায় গণ্য করতে আপত্তি করি নি বলে তিনি দ্বিধা বোধ করছেন। তর্ক না করে দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
একটি কথার লাগি তিনটি রজনী জাগি,
একটুও নাহি মেলে সাড়া।
সখীরা যখন জোটে মুখে তব বন্যা ছোটে,
গোলমালে তোলপাড় পাড়া॥
“একটি’ “তিনটি’ “একটু’ শব্দগুলি হসন্তমধ্য, “গোলমাল’ “তোলপাড়’ও সেই জাতের। অথচ হসন্তে ধ্বনিলাঘবতার অভিযোগে ওদের মাত্রা জরিমানা দিতে হয় নি। তিনমাত্রাও চারমাত্রার গৌরবেই রয়ে গেল। কেউ কেউ বলেন, কেবলমাত্র অক্ষরগণনার দোহাই দিয়েই এরা মান বাঁচিয়েছে, অর্থাৎ যদি যুক্ত অক্ষরের ছাঁদে লেখা যেত তাহলেই ছন্দে ধ্বনির কমতি ধরা পড়ত। আমার বক্তব্য এই যে, চোখ দিয়ে ছন্দ পড়া আর বাইসিক্ল্এর চাকা দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া একই কথা, ওটা হবার জো নেই। বিরুদ্ধ দৃষ্টান্ত দিলে কথাটা বোঝা যাবে।
টোট্কা এই মুষ্টিযোগ লট্কানের ছাল,
সিট্কে মুখ খাবি, জ্বর আট্কে যাবে কাল।
বলে রাখা ভালো এটা ভিষক-ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপ্শন নয়, সাহিত্য-ডাক্তারের বানানো ছড়া, ছন্দ সম্বন্ধে মতসংশয় নিবারণের উদ্দেশে; এর থেকে অন্য কোনো রোগের প্রতিকার কেউ যেন আশা না করেন। আরো একটা–
এক্টি কথা শুনিবারে তিন্টে রাত্রি মাটি,
এর পরে ঝগ্ড়া হবে, শেষে দাঁত্কপাটি॥
অথবা–
এক্টি কথা শোনো, মনে খট্কা নাহি রেখে,
টাট্কা মাছ জুট্ল না তো, শুঁট্কি দেখো চেখে।
শেষের তিনটি ছড়ায় অক্ষর গুনতি করতে গেলে দৃশ্যত পয়ারের সীমা ছাড়িয়ে যায়, কিন্তু তাই বলেই যে পয়ার ছন্দের নির্দিষ্ট ধ্বনি বেড়ে গেল তা নয়। আপাতত মনে হয়, এটা যথেচ্ছাচার। কিন্তু হিসাব করে দেখলেই দেখা যাবে ছন্দের নীতি নষ্ট করা হয় নি। কেননা, তার জো নেই। এ তো রাজত্ব করা নয় কবিত্ব করা, এখানে লক্ষ্য হল মনোরঞ্জন; খামকা একটা জবরদস্তির আইন জারি করে তারপরে পাহারাওয়ালা লাগিয়ে দেওয়া, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। ধ্বনির রাজ্যে গোঁয়ার্তমি করে কেউ জিতে যাবে এমন সাধ্য আছে কার। চব্বিশ ঘন্টা কান রয়েছে সতর্ক।
আমি এই কথাটি বোঝাতে চেষ্টা করছি যে, আক্ষরিক ছন্দ বলে কোনো অদ্ভূত পদার্থ বাংলায় কিম্বা অন্য কোনো ভাষাতেই নেই। অক্ষর ধ্বনির চিহ্নমাত্র। যেমন “জল’ শব্দটাকে দিয়ে “জল’ পদার্থটার প্রতিবাদ চলে না, অক্ষরকে ধ্বনির প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো তেমনি বিড়ম্বনা।
প্রশ্ন উঠবে, তাই যদি হয়, তাহলে খোঁড়া হসন্তবর্ণকে কখনো আধ মাত্রা কখনো পুরোমাত্রার পদবিতে বসানো হয় কেন। উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, স্বয়ং ভাষা যদি নিজেই আসন পেতে দেয় তবে তার উপরে অন্য কোনো আইন চলে না। ভাষাও বর্ণভেদে পঙ্ক্তির ব্যবস্থা নিজের ধ্বনির নিয়ম বাঁচিয়ে তবে করতে পারে। বাংলা ভাষার স্বরবর্ণের ধ্বনিমাত্রা বিকল্পে দীর্ঘ ও হ্রস্ব হয়ে থাকে, ধনুকের ছিলের মতো, টানলে বাড়ে, টান ছেড়ে দিলে কমে। সেটাকে গুণ বলেই গণ্য করি। তাতে ধ্বনিরসের বৈচিত্র্য হয়। আমরা দ্রুত লয়ে বলতে পারি “এই রে’, আবার তাকে টানলে ডবল করে বলতে পারি “এ-ই রে’। তার কারণ আমাদের স্বরবর্ণগুলো জীবধর্মী, ব্যবহারের প্রয়োজনে একটা সীমার মধ্যে তাদের সংকোচন-প্রসারণ চলে। চারটে পাথরের মূর্তি ধরাবার মতো জায়গায় পাঁচটা ধরাতে গেলে মুশকিল বাধে; কিন্তু চারজন প্যাসেঞ্জার বসাবার বেঞ্চিতে পাঁচজন মানুষ বসালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নেই, যদি তারা পরস্পর রাজি থাকে। বাংলা ভাষার স্বরবর্ণগুলিও পাথুরে নয়, নিজের স্থিতিস্থাপকতার গুণে তারা প্রতিবেশীর জন্যে একটূ-আধটু জায়গার ব্যবস্থা করতে সহজেই রাজি থাকে। এইজন্যেই অক্ষরের সংখ্যা গণনা করে ছন্দের ধ্বনিমাত্রা গণনা বাংলায় চলে না। এটা বাঙালির আত্মীয়সভার মতন। সেখানে যতগুলো চৌকি তার চেয়ে মানুষ বেশি থাকা কিছুই অসম্ভব নয়, অথবা পাশে ফাঁক পেলে দুইজনের জায়গা একজনে হাত পা মেলে আরামে দখল করাও এই জনতার অভ্যস্ত। বাংলার প্রাকৃতছন্দ ধরে তার প্রমাণ দেওয়া যাক।
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।
শিবঠাকুরের বিয়ে হবে, তিন কন্যে দান।
এটা তিন মাত্রার ছন্দ। অর্থাৎ চার পোয়ায় সেরওয়ালা এর ওজন নয়, তিন পোয়ায় এর সের। এর প্রত্যেক পা ফেলার লয় হচ্ছে তিনের।
বৃষ্টি । পড়ে- । টাপুর । টুপুর । নদেয় । এল- । বা-ন।
শিবঠা । কুরের । বিয়ে- । হবে- । তিন্ক । ন্নে । দা-ন।
দেখা যাচ্ছে, তিন গণনায় যেখানে যেখানে ফাঁক, পার্শ্ববর্তী স্বরবর্ণগুলি সহজেই ধ্বনি প্রসারিত করে সেই পোড়ো জায়গা দখল করে নিয়েছে। এত সহজে যে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এই ছড়া আউড়েছে, তবু ছন্দের কোনো গর্তে তাদের কারো কণ্ঠ স্খলিত হয় নি। ফাঁকগুলো যদি ঠেসে ভরাতে কেউ ইচ্ছা করেন– দোহাই দিচ্ছি, না করেন যেন– তবে এই রকম দাঁড়াবে–
বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর নদেয় আসছে বন্যা,
শিব ঠাকুরের বিয়ের বাসরে দান হবে তিন কন্যা।
রামপ্রসাদের একটি গান আছে–
মা আমায় ঘুরাবি কত
চোখবাঁধা বলদের মতো।
এটাও তিনমাত্রা লয়ের ছন্দ।
মা-আ । মায় ঘু । রাবি- । কত-।
ফাঁক ভরাট করতে হলে হবে এই চেহারা–
হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই
চক্ষুবদ্ধ বৃষের মতোই।
যাঁরা অক্ষর গণনা করে নিয়ম বাঁধেন তাঁদের জানিয়ে রাখা ভালো যে, স্বরবর্ণে টান দিয়ে মিড় দেবার জন্যেই প্রাকৃত-বাংলা ছন্দে কবিরা বিনা দ্বিধায় ফাঁক রেখে দেন; সেই ফাঁকগুলো ছন্দেরই অঙ্গ, সে সব জায়গায় ধ্বনির রেশ কিছু কাজ করবার অবকাশ পায়।
হারিয়ে ফেলা বাঁশি আমার পালিয়েছিল বুঝি
লুকোচুরির ছলে।
এর মধ্যে প্রায় প্রত্যেক যতিতে ফাঁক আছে।
১ ২ ৩ ৪
হারিয়ে ফেলা- । বাঁশি আমা-র । পালিয়েছিল । বুঝি–।
৫ ৬
লুকোচুরি-র । ছলে- ।
কিছু বৈচিত্র্যও দেখছি। প্রথম দুটি বিভাগে সমান্তরাল ফাঁক। কিন্তু তিনের ভাগে ফাঁক বাদ গিয়ে একেবারে চতুর্থ ভাগের শেষে দীর্ঘ ফাঁক পড়েছে। পাঠক “হারিয়ে ফেলা’র পরেও ফাঁক না দিয়ে একেবারে দ্বিতীয় ভাগের শেষে যদি সেটা পূরণ করে দেন তবে ভালোই শুনতে হবে। কিন্তু যদি বেফাঁক ঠাসবুনানির বিশেষ ফরমাশ থাকে তাহলে সেটাও চেষ্টা করলে মন্দ হবে না।
স্বপ্ন আমার বন্ধনহীন সন্ধ্যাতারার সঙ্গী
মরণযাত্রীদলে,
স্বর্ণবরণ কুজ্ঝটিকায় অস্তশিখর লঙ্ঘি
লুকায় মৌনতলে।
এই কথাটা লক্ষ্য করবার বিষয় যে, হসন্তবর্ণের হ্রস্ব বা দীর্ঘ যে মাত্রাই থাক্ পাঠ করতে বাঙালি পাঠকের একটুও বাধে না, ছন্দের ঝোঁক আপনিই অবিলম্বে তাকে ঠিকমতো চালনা করে।
পাৎলা করিয়া কাটো কাৎলা মাছেরে,
উৎসুক নাৎনি যে চাহিয়া আছে রে।
এই ছড়াটা পড়তে গেলে বাঙালি নিঃসংশয়ে স্বতই খণ্ড ৎ-এর পূর্ববর্তী স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করে পড়বে। আবার যেমনি নিম্নের ছড়াটি সামনে ধর–
পাৎলা করি কাটো, প্রিয়ে, কাৎলা মাছটিরে;
টাট্কা তেলে ফেলে দাও সরষে আর জিরে;
ভেট্কি যদি জোটে তাহে মাখো লঙ্কাবাঁটা,
যত্ন করে বেছে ফেলো টুক্রো যত কাঁটা।
অমনি প্রাক্হসন্ত স্বরগুলিকে ঠেসে দিতে এক মুহূর্তও দেরি হবে না। এই যে বাংলা স্বরবর্ণের সজীবতা, একে কোনো কড়া নিয়মের চাপে আড়ষ্ট করে তাকে সর্বত্র সমানভাবে ব্যবহারযোগ্য করা উচিত– এ মত চালালে বাংলাভাষাকে ফাঁকি দেওয়া হবে। শুকনো আমসত্ত্বের মধ্যেই সাম্য, কিন্তু সরস আমের মধ্যে বৈচিত্র্য, ভোজে কোন্টার দাম বেশি তা নিয়ে তর্ক অনাবশ্যক।
বাংলা-প্রাকৃত ভাষার কাব্যে স্বরধ্বনির যে প্রাণবান্ স্বচ্ছন্দতা আছে সংস্কৃত-বাংলা ভাষা, যাকে আমরা সাধুভাষা বলি, তার মধ্যে পড়ে সে কেন জেনানা মেয়ের মতো দেয়ালে আটকে পড়ে গেল। তার কারণ, সংস্কৃত-বাংলা কৃত্রিম ভাষা, ওখানে বাইরের নিয়মের প্রাধান্য, তার আপন নিয়ম অনেক জায়গায় কুণ্ঠিত। সভাস্থলে একটি আসনে একটি মানুষের স্থান নির্দিষ্ট; কারো বা দেহ ক্ষীণ, আসনে ফাঁক থেকে যায়; কারো বা স্থূল দেহ, আসনে ঠেসে বসতে হয়; কিন্তু গোনাগণ্তি চৌকি, সীমা নির্দিষ্ট। যদি ফরাশে বসতে হত তাহলে কলেবরের তারতম্য ধরে পরস্পরের আসনের সীমানায় কমিবেশি স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটত। কিন্তু সভ্যতার মর্যাদার দিকে দৃষ্টি রেখে স্বভাবের নিয়মকে বাঁধানিয়মে পাকা করে দিতে হয়। তাতে কিছু পীড়ন ঘটলেও গাম্ভীর্যের পক্ষে তার একটা সার্থকতা আছে। সেইজন্যেই সভার রীতি ও ঘরের রীতিতে কিছু ভেদ থাকেই। শকুন্তলার বাকল দেখে দুষ্যন্ত বলেছিলেন : কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম্। কিন্তু যখন তাঁকে রাজান্তঃপুরে নিয়েছিলেন তখন তাঁকে নিশ্চয়ই বাকল পরান নি। তখন শকুন্তলার স্বাভাবিক শোভাকে অলংকৃত করেছিলেন, সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্যে নয়, মর্যাদারক্ষার জন্যে। রাজরানীর সৌন্দর্য ব্যক্তি-বিশেষে বিচিত্র, কিন্তু তাঁর মর্যাদার আদর্শ সকল রাজরানীর মধ্যে এক। ওটা প্রকৃতির হাতে তৈরি নয়, রাজসমাজের দ্বারা নির্দিষ্ট। অর্থাৎ, ওটা প্রাকৃত নয়, সংস্কৃত। তাই দুষ্যন্ত স্বীকার করেছিলেন বটে বনলতার দ্বারা উদ্যানলতা পরাভূত, তবু উদ্যানকে বনের আদর্শে রমণীয় করে তুলতে নিশ্চয় তাঁর সাহস হয় নি। তাই, আমি নিজে আকন্দফুল ভালোবাসি, কিন্তু আমার সাধুসমাজের মালি ঐ গাছের অঙ্গুর দেখবামাত্র উপড়ে ফেলে। সে যদি কবি হত, সাধুভাষায় ছাড়া কবিতা লিখত না। সাধুভাষার ছন্দের বাঁধারীতি যে-জাতীয় ছন্দে চলে এবং শোভা পায় সে হচ্ছে পয়ারজাতীয় ছন্দ। এখানে ফাঁক-ফাঁক নির্দিষ্ট আসনের উপর নানা ওজনেরই ধ্বনিকে চড়ানো নিরাপদ্। এখানে ঠিক চোদ্দটা অক্ষরকে বাহন করে যুগ্ম-অযুগ্ম নানারকমের ধ্বনিই একত্র সভা জমাতে পারে।
কাব্যলীলা একদিন যখন শুরু করেছিলেম তখন বাংলাসাহিত্যে সাধুভাষারই ছিল একাধিপত্য। অর্থাৎ, তখন ছিল কাটা-কাটা পিঁড়িতে ভাগ-করা ছন্দ। এই আইনের অধীনে যতক্ষণ পয়ারের এলাকায় থাকি ততক্ষণ আসনপীড়া ঘটে না। কিন্তু, তিনমাত্রামূলক ছন্দের দিকে আমার কলমের একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। ঐ ছন্দে প্রত্যেক অক্ষরে স্বতন্ত্র-আরূঢ় সকল ওজনের ধ্বনিকেই সমান দরের একক বলে ধরে নিতে বারম্বার কানে বাজত। সেইজন্যে যুক্ত-অক্ষর অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি বর্জন করবার একটা দুর্বল অভ্যাস আমাকে ক্রমেই পেয়ে বসেছিল। ঠোকর খাবার ভয়ে পদগুলোকে একেবারে সমতল করে যাচ্ছিলুম। সব জায়গায় পেরে উঠি নি, কিন্তু মোটের উপর চেষ্টা ছিল। “ছবি ও গান’এ “রাহুর প্রেম’ কবিতা পড়লে দেখা যাবে, যুক্ত-অক্ষর ঝেঁটিয়ে দেবার প্রয়াস আছে তবু তারা পাথরের টুকরোর মতো রাস্তার মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে রইল। তাই যখন লিখেছিলুম–
কঠিন বাঁধনে চরণ বেড়িয়া
লৌহশৃঙ্খলের ডোর–
মনে খটকা লেগেছিল, কান প্রসন্ন হয় নি। কিন্তু, তখন কলম ছিল অপটু এবং অলস মন ছিল অসতর্ক। কেননা, পাঠকদের তরফ থেকে বিপদের আশঙ্কা ছিল না। তখন ছন্দের সদর রাস্তাও গ্রাম্য রাস্তার মতো এবড়ো-খেবড়ো থাকত, অভ্যাসের গতিকে কেউ সেটাকে নিন্দনীয় বলে মনেও করে নি।
অক্ষরের দাসত্বে বন্দী বলে প্রবোধচন্দ্র বাঙালি কবিদেরকে যে দোষ দিয়েছেন সেটা এই সময়কার পক্ষে কিছু অংশে খাটে। অর্থাৎ, অক্ষরের মাপ সমান রেখে ধ্বনির মাপে ইতরবিশেষ করা তখনকার শৈথিল্যের দিনে চলত, এখন চলে না। তখন পয়ারের রীতি সকল ছন্দেরই সাধারণ রীতি বলে সাহিত্যসমাজে চলে গিয়েছিল। তার প্রধান কারণ পয়ারজাতীয় ছন্দই তখন প্রধান, অন্যজাতীয় অর্থাৎ ত্রৈমাত্রিক ছন্দের ব্যবহার তখন অতি অল্পই। তাই এই মাইনরিটির স্বতন্ত্র দাবি সেদিন বিধিবদ্ধ হয় নি।
তারপরে “মানসী’ লেখার সময় এল। তখন ছন্দের কান আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। এ কথা তখন নিশ্চিত বুঝেছি যে, ছন্দের প্রধান সম্পদ যুগ্মধ্বনি; অথচ এটাও জানছি যে, পয়ারসম্প্রদায়ের বাইরে নির্বিচারে যুগ্মধ্বনির পরিবেশন চলে না।
রয়েছি পড়িয়া শৃঙ্খলে বাঁধা
এ লাইন বেচারাকে পয়ারের বাঁধাপ্রথাটা শৃঙ্খল হয়েই বেঁধেছে, তিনমাত্রার স্কন্ধকে চারমাত্রার বোঝা বইতে হচ্ছে। সেই “মানসী’ লেখবার বয়সে আমি যুগ্মধ্বনিকে দুইমাত্রার মূল্য দিয়ে ছন্দরচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি। প্রথম প্রথম পয়ারেও সেই নিয়ম প্রয়োগ করেছিলুম। অনতিকাল পরেই দেখা গেল, তার প্রয়োজন নেই। পয়ারে যুগ্মধ্বনির উপযুক্ত ফাঁক যথেষ্ট আছে। এই প্রবন্ধে আমি ত্রিপদী প্রভৃতি পয়ারজাতীয় সমস্ত দ্বৈমাত্রিক ছন্দকেই “পয়ার’ নাম দিচ্ছি।
পয়ারে ধ্বনিবিন্যাসের এই যে স্বচ্ছন্দতা, দুই মাত্রার লয় তার একমাত্র কারণ নয়। পয়ারের পদগুলিকে তার ধ্বনিভাগের বৈচিত্র্য একটা মস্ত কথা। সাধারণ ভাগ হচ্চে ৩+৩+২+৩+৩, যথা–
নিখিল আকাশভরা আলোর মহিমা
তৃণের শিশির মাঝে লভিল প্রতিমা।
অন্য রকম, যথা–
তপনের পানে চেয়ে সাগরের ঢেউ
বলে ওই পুতলিরে এনে দে না কেউ।
অথবা–
রাখি যাহা তার বোঝা কাঁধে চেপে রহে,
দিই যাহা তার ভার চরাচর বহে।
অথবা–
সারা দিবসের হায় যত কিছু আশা
রজনীর কারাগারে হারাবে কি ভাষা।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে পয়ারের প্রবর্তন হয়েছে এই কারণেই। সে কোনো কোনো আদিম জীবের মতো বহুগ্রন্থিল, তাকে নষ্ট না করেও যেখানে-সেখানে ছিন্ন করা যায়। এই ছেদের বৈচিত্র্য থাকাতেই প্রয়োজন হলে সে পদ্য হলেও পদ্যের অবন্ধ গতি অনেকটা অনুকরণ করতে পারে। সে গ্রামের মেয়ের মতো; যদিও থাকে অন্তঃপুরে, তবুও হাটে-ঘাটে তার চলাফেরার বাধা নেই।
উপরের দৃষ্টান্তগুলিতে ধ্বনির বোঝা হালকা। যুগ্মবর্ণের ভার চাপানো যাক।–
সুরাঙ্গনা নন্দনের নিকুঞ্জপ্রাঙ্গণে
মন্দারমঞ্জরি তোলে চঞ্চলকঙ্কণে।
বেণীবন্ধতরঙ্গিত কোন্ ছন্দ নিয়া,
স্বর্গবীণা গুঞ্জরিছে তাই সন্ধানিয়া।
আধুনিক বাংলা ছন্দে সবচেয়ে দীর্ঘ পয়ার আঠারো অক্ষরে গাঁথা। তার প্রথম যতি পদের মাঝখানে আট অক্ষরের পরে, শেষ যতি দশ অক্ষরের পরে পদের শেষে। এতেও নানাপ্রকারের ভাগ চলে। তাই অমিত্রাক্ষরের লাইন-ডিঙোনো চালে এর ধ্বনিশ্রেণীকে নানারকমে কুচকাওয়াজ করানো যায়।
হিমাদ্রির ধ্যানে যাহা। স্তব্ধ হয়ে ছিল রাত্রিদিন
সপ্তর্ষির দৃষ্টিতলে । বাক্যহীন স্তব্ধতায় লীন
সেই নির্ঝরিণীধারা । রবিকরস্পর্শে উচ্ছ্বসিতা
দিগি্দগন্তে প্রচারিছে । অন্তহীন আনন্দের গীতা।
বাংলায় এই আরেকটি গুরুভারবহ ছন্দ। এরা সবাই মহাকাব্য বা আখ্যান বা চিন্তাগর্ভ বড়ো বড়ো কথার বাহন। ছোটো পয়ার আর এই বড়ো পয়ার, বাংলা কাব্যে এরা যেন ইন্দ্রের উচ্চৈঃশ্রবা আর ঐরাবত। অন্তত, এই বড়ো পয়ারকে গীতিকাব্যের কাজে খাটাতে গেলে বেমানান হয়। এর নিজের গড়নের মধ্যেই একটা সমারোহ আছে, সেইজন্যে এর প্রয়োজন সমারোহসূচক ব্যাপারে।
ছোটো পয়ারকে চেঁচে-ছুলে হালকা কাজে লাগানো যায়, যেমন বাঁশের কঞ্চিকে ছিপ করা চলে। পয়ারের দেহসংস্থানেই গুরুর সঙ্গে লঘুর যোগ আছে। তার প্রথম অংশে আট, দ্বিতীয় অংশে ছয়; অর্থাৎ, হালের দিকে সে চওড়া কিন্তু দাঁড়ের দিকে সরু; তাকে নিয়ে মাল-বওয়ানোও যায়, বাচ-খেলানোও চলে। বড়ো পয়ারের দেহসংস্থান এর উলটো; তার প্রথমভাগে আট, শেষভাগে দশ; তার গৌরবটা ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। ছোটো পয়ারের ছিব্লেমির একটা পরিচয় দেওয়া যাক।
খুব তার বোল্চাল, সাজ ফিট্ফাট,
তক্রার হলে আর নাই মিট্মাট।
চশ্মায় চমকায় আড়ে চায় চোখ।
কোনো ঠাঁই ঠেকে নাই কোনো বড়ো লোক।
এর ভাগগুলোকে কাটা-কাটা ছোটো-ছোটো করে হ্রস্বস্বরে হসন্তবর্ণে ঘনঘন ঝোঁক দিয়ে এর চটুলতা বাড়িয়ে দেওয়া গেছে। এখানে এটা পাতলা কিরিচের মতো। একেই আবার যুগ্মধ্বনির যোগে মজবুত করে খাড়া করে তোলা যায়।
বাক্য তার অনর্গল মল্লসজ্জাশালী,
তর্কযুদ্ধে উগ্র তেজ, শেষ যুক্তি গালি।
ভ্রূকুটিপ্রচ্ছন্ন চক্ষু কটাক্ষিয়া চায়,
কুত্রাপিও মহত্ত্বের চিহ্ন নাহি পায়।
যেখানে-সেখানে নানাপ্রকার অসমান ভার নিয়েও পয়ারের পদস্খলন হয় না, এই তত্ত্বটির মধ্যে অসামান্যতা আছে। অন্য কোনো ভাষার কোনো ছন্দে এরকম স্বচ্ছন্দতা এতটা পরিমাণে আছে বলে আমি তো জানি নে।
এর কৌশলটা কোন্খানে যখন ভেবে দেখা যায় তখন দেখি, পয়ারে প্রত্যেক পদের মাঝখানে ও শেষে যে-দুটো হাঁফ ছাড়বার যতি আছে সেইখানেই তার ভারসামঞ্জস্য হয়ে থাকে।
নিঃস্বতাসংকোচে দিন । অবসন্ন হলে
নিভৃতে নিঃশব্দ সন্ধ্যা । নেয় তার কোলে।
গণনা করে দেখলে ধরা পড়ে, এই পয়ারের দুই লাইনে ধ্বনিভারের সাম্য নেই। তবু যে টলমল করতে করতে ছন্দটা কাত হয়ে পড়ে না, তার কারণ ডাইনে-বাঁয়ে যতির লগির ঠেকা দিয়ে দিয়ে তাকে চালিয়ে নেওয়া হয়। চতুষ্পদ জন্তু যেমন তার ভারী দেহটাকে দুইজোড়া পায়ের দ্বারা দুইদিকে ঠেকাতে ঠেকাতে চলে সেইরকম। পয়ারের প্রকৃত রূপ চোদ্দটা অক্ষরে নয়, সেটা প্রথম অংশের আট অক্ষর ও দ্বিতীয় অংশের ছয় অক্ষরের পরবর্তী দুই যতিতে। অজগর সমস্ত দেহটা নিয়ে চলে। তার দেহে মুণ্ড এবং ধড়ের মধ্যে ভাগ নেই। ঘোড়ার দেহে সেই ভাগ আছে। তার মুণ্ডটার পরে যেখানে গলা সেখানে একটা যতি, ধড়ের শেষ ভাগে যেখানে ক্ষীণ কটি সেখানেও আর-একটা। এই বিভক্তভারের দেহকে সামলিয়ে নিয়ে সে চার পা ফেলে চলে। পয়ারেরও সেইরকম বিশেষভাবে বিভক্ত দেহ এবং চার পা ফেলতে ফেলতে চলা। চতুষ্পদ জন্তুর দুই পায়ের সমান বিন্যাস। যদি এমন হত যে, কোনো জানোয়ারের পা দুটো বাঁয়ের চেয়ে ডাইনে এক ফুট বেশি লম্বা তাহলে তার চলনে স্থিতির চেয়ে অস্থিতিই বেশি হত; সুতরাং তার পিঠে সওয়ার চাপালে কোনো পক্ষেই আরাম থাকত না। ছন্দে তার একটা দৃষ্টান্ত দিই–
তরণী বেয়ে শেষে । এসেছি ভাঙা ঘাটে,
স্থলে না মেলে ঠাঁই । জলে না দিন কাটে।
এ ছড়ায় প্রত্যেক লাইনে চোদ্দ অক্ষর, এবং মাঝে আর শেষে দুই যতিও আছে। তবু ওকে পয়ার বলবার জো নেই। ওর পা-ফেলার ভাগ অসমান।
তরণী । বেয়ে শেষে ॥ এসেছি । ভাঙা ঘাটে।
এক পায়ে তিন মাত্রা, আর-এক পায়ে চার। সাত মাত্রার পরে একটা করে যতি আছে, কিন্তু বিজোড় অঙ্কের অসাম্য ঐ যতিকে পুরো বিরাম পায় না। সেইজন্যে সমস্ত পদটার মধ্যে নিয়তই একটা অস্থিরতা থাকে, যে পর্যন্ত না পদের শেষে এসে একটা সম্পূর্ণ স্থিতি ঘটে। এই অস্থিরতাই এরকম ছন্দের স্বভাব, অর্থাৎ পয়ারের ঠিক বিপরীত। এই অস্থিরতার সৌন্দর্যকে ব্যবহার করবার জন্যেই এইরকম ছন্দের রচনা। এর পিঠের উপর যেমন-তেমন করে যুগ্মধ্বনির সওয়ার চাপালে অস্বস্তি ঘটে। যদি লেখা যায়
সায়াহ্ন-অন্ধকারে এসেছি ভগ্ন ঘাটে
তাহলে ছন্দটার কোমর ভেঙে যাবে। তবুও যদি যুগ্মবর্ণ দেওয়াই মত হয় তাহলে তার জন্যে বিশেষভাবে জায়গা করে দিতে হবে। পয়ারের মতো উদারভাবে যেমন খুশি ভার চাপিয়ে দিলেই হল না।
অন্ধরাতে যবে । বন্ধ হল দ্বার,
ঝঞ্ঝাবাতে ওঠে । উচ্চ হাহাকার।
মনে রাখা দরকার, এই শ্লোক অবিকৃত রেখেও এর ভাগের যদি পরিবর্তন করে পড়া যায়, দুই ভাগের বদলে প্রত্যেক লাইনে যদি তিন ভাগ বসানো যায়, তাহলে এটা আর-এক ছন্দ হয়ে যাবে। একে নিম্নলিখিত-রকম ভাগ করে পড়া যাক–
অন্ধরাতে । যবে বন্ধ । হল দ্বার,
ঝঞ্ঝাবাতে । ওঠে উচ্চ । হাহাকার।
পশুপক্ষীদের চলন সমান মাত্রার দুই বা চার পায়ের উপর। এই পা’কে কেবল যে চলতে হয় তা নয়, দেহভার বইতে হয়। পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই বিরাম আছে বলে বোঝা সামলিয়ে চলা সম্ভব। আজ পর্যন্ত জীবলোকে জুড়িওয়ালা পায়ের পরিবর্তে চাকার উদ্ভব কোথাও হল না। কেননা চাকা না থেমে গড়িয়ে চলে, চলার সঙ্গে থামার সামঞ্জস্য তার মধ্যে নেই। দুইমূলক সমমাত্রায় দুই পায়ের চাল, তিনমূলক অসমমাত্রায় চাকার চাল। দুই-পা-ওয়ালা জীব উঁচুনিচু পথের বাধা ডিঙিয়ে চলে যায়, পয়ারের সেই শক্তি। চাকা বাধায় ঠেকলে ধাক্কা খায়, ত্রৈমাত্রিক ছন্দের সেই দশা। তার পথে যুগ্মস্বর যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সেই চেষ্টা করতে হবে।
অধীর বাতাস এল সকালে,
বনেরে বৃথাই শুধু বকালে।
দিনশেষে দেখি চেয়ে,
ঝরা ফুলে মাটি ছেয়ে–
লতারে কাঙাল ক’রে ঠকালে।
এ ছন্দ পয়ারজাতীয়, টেনিস-খেলোয়াড়ের আধা-পায়জামার মতো বহরটা নিচের দিকে ছাঁটা। এ ছন্দে তাই যুগ্মস্বর যেমন খুশি চলে।
নবারুণচন্দনের তিলকে
দিক্ললাট এঁকে আজি দিল কে।
বরণের পাত্র হাতে
উষা এল সুপ্রভাতে,
জয়শঙ্খ বেজে ওঠে ত্রিলোকে।
কিন্তু–
শরতে শিশিরবাতাস লেগে
জল ভ’রে আসে উদাসী মেঘে।
বরষন তবু হয় না কেন,
ব্যথা নিয়ে চেয়ে রয়েছে যেন।
এখানে তিনমাত্রার ছন্দ গড়িয়ে চলেছে। চাকার চাল, পা-ফেলার চাল নয়; তাই যুগ্মবর্ণের স্বেচ্ছচারিতা এর সইবে না।
চাষের সময়ে যদিও করি নি হেলা,
ভুলিয়াছিলাম ফসল-কাটার বেলা।
পয়ারের মতোই চোদ্দটা অক্ষরে পদ, কিন্তু জাত আলাদা। তিনমাত্রার চাকায় চলেছে। পদাতিকের সঙ্গে চক্রীর মেলে না।
শ্যামলঘন । বকুলবন । ছায়ে ছায়ে
যেন কী সুর । বাজে মধুর । পায়ে পায়ে।
এখানেও চোদ্দ অক্ষর। কিন্তু এর চালে পয়ারের মতো সমমাত্রার পদচারণের শান্তি নেই বলে বিষমমাত্রার ভাগগুলি যতির মধ্যেও গতির ঝোঁক রেখে দেয়। খোঁড়া মানুষের চলার মতো, যতক্ষণ না লক্ষ্যস্থানে গিয়ে বসে পড়ে থেমেও ভালো করে থামতে পারে না।
বাংলা চলতি ভাষার মূল সংস্কৃত শব্দের অনেকগুলি স্বরবর্ণই কোনোটা-আধখানা কোনোটা পুরোপুরি ক্ষয়ে যাওয়াতে ব্যঞ্জনগুলো তাল পাকিয়ে অত্যন্ত পরস্পরের গায়ে-পড়া হয়ে গেছে। স্বরের ধ্বনিই ব্যঞ্জনের ধ্বনিকে অবকাশ দেয়, তার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে; সেগুলো সরে গেলেই ব্যঞ্জনধ্বনি পিণ্ডীভূত হয়ে পড়ে। চলিত এবং চল্তি, ঘৃণা এবং ঘেন্না, বসতি এবং বস্তি, শব্দগুলো তুলনা করে দেখলেই বোঝা যাবে। সংস্কৃত ভাষায় স্বরধ্বনির দাক্ষিণ্য, আর প্রাকৃত-বাংলায় তার কার্পণ্য, এইটেই হল দুটো ভাষার ধ্বনিগত মূল পার্থক্য। স্বরবর্ণবহুল ধ্বনিসংগীত এবং স্বরবর্ণবিরল ধ্বনিসংগীতে প্রভূত প্রভেদ। এই দুইয়েরই বিশেষ মূল্য আছে। বাঙালি কবি তাঁদের কাব্যে যথাস্থানে দুটোরই সুযোগ নিতে চান। তাঁরা ধ্বনিরসিক বলেই কোনোটাকেই বাদ দিতে ইচ্ছা করেন না।
প্রাকৃত-বাংলার ধ্বনির বিশেষত্ববশত দেখতে পাই, তার ছন্দ তিন মাত্রার দিকেই বেশি ঝুঁকেছে। অর্থাৎ, তার তালটা স্বভাবতই একতালাজাতীয়, কাওয়ালিজাতীয় নয়। সংস্কৃত ভাষায় এই “তাল’ শব্দটা দুই সিলেব্ল্এর; বাংলায় “ল’ আপন অন্তিম অকার খসিয়ে ফেলেছে, তার জায়গায় টি বা টা যোগ করে শব্দটাকে পুষ্ট করবার দিকে তার ঝোঁক। টি টা-এর ব্যবধান যদি না থাকে তবে ঐ নিঃস্বর ধ্বনিটি প্রতিবেশী যে-কোনো ব্যঞ্জন বা স্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পূর্ণতা পেতে চায়।
রূপসাগরের তলে ডুব দিনু আমি
এটা সংস্কৃত-বাংলার ছাঁদে লেখা। এখানে শব্দগুলো পরস্পর গা-ঘেঁষা নয়। বাংলা প্রাকৃতের অনিবার্য নিয়মে এই পদের যে শব্দগুলি হসন্ত, তারা আপনারই স্বরধ্বনিকে প্রসারিত করে ফাঁক ভরতি করে নিয়েছে। “রূপ’ এবং “ডুব’ আপন উকারধ্বনিকে টেনে বাড়িয়ে দিলে। “সাগরের’ শব্দ আপন একারকে পরবর্তী হসন্ত র-এর পঙ্গুতাচাপা দিতে লাগিয়েছে। এই উপায়ে ঐ পদটার প্রত্যেক শব্দ নিজের মধ্যেই নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে চলেছে। অর্থাৎ এ ছন্দে ডিমক্রেসির প্রভাব নেই। এই-রকমের ছন্দে দুই মাত্রার ধ্বনি আপন পদক্ষেপের প্রত্যেক পর্যায়ে যে অবকাশ পায় তা নিয়ে তার গৌরব। বস্তুত, এই অবকাশের সুযোগ গ্রহণ করে তার ধ্বনিসমারোহ বাড়িয়ে তুললে এ ছন্দের সার্থকতা। যথা–
চৈতন্য নিমগ্ন হল রূপসিন্ধুতলে।
প্রাকৃত-বাংলা দেখা যাক।
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা ক’রে
এখানে “রূপ’ আপন হসন্ত “প’এর ঝোঁকে “সাগরে’র “সা’টাকে টেনে আপন করে নিয়েছে, মাঝে ব্যবধান থাকতে দেয় নি। “রূপ-সা’ তাই আপনিই তিনমাত্রা হয়ে গেল। “সাগরে’র বাকি টুকরো রইল “গরে’। সে আপন ওজন বাঁচাবার জন্যে “রে’টাকে দিলে লম্বা করে, তিন মাত্রা পুরল। “ডুব’ আপনার হসন্তর টানে “দিয়েছি’র “দি’টাকে করলে আত্মসাৎ। এমনি করে আগাগোড়া তিন মাত্রা জমে উঠল। হসন্ত-প্রধান ভাষা সহজেই তিন মাত্রার দানা পাকায়, এটা দেখেছি। এমন কি যেখানে হসন্তের ভিড় নেই সেখানেও তার ঐ একই চাল। এটা যেন তার অভ্যস্ত হয়ে মজ্জাগত হয়ে গেছে। যেমন–
অচে- । তনে- । ছিলেম । ভালো-।
আমায় । চেতন । করলি । কেনে-।
প্রাকৃত-বাংলার এই তিন মাত্রার ভঙ্গি চণ্ডীদাস জ্ঞানদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিরা সাধুভাষাতেও গ্রহণ করেছেন। যেমন–
হাসিয়া হাসিয়া মুখ নিরখিয়া
মধুর কথাটি কয়।
ছায়ার সহিতে ছায়া মিশাইতে
পথের নিকটে রয়।
কিন্তু প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ নিয়ে একটু ভাববার বিষয় আছে।
মত্তরোষে বীরভদ্র ছুট্ল ঊর্ধ্বশ্বাসে,
ঘূর্ণিবেগে উড়্ল ধুলো রক্ত সন্ধ্যাকাশে।
কিম্বা–
ছুট্ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর,
টুট্ল কেন উর্বশীর মঞ্জীরের ডোর।
বৈকালে বৈশাখী এল আকাশলুণ্ঠনে,
শুক্লরাতি ঢাক্ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে।
এদের সম্বন্ধে কী বলা যাবে।
প্রধানত ক্রিয়াপদেরই বিশেষ রূপটাতে প্রাকৃত-বাংলার চেহারা ধরা পড়ে। উপরের ছড়াগুলিতে “উড়্ল’ “ছুট্ল’ “টুট্ল’ “ঢাক্ল’ প্রভৃতি প্রয়োগ নিয়ে তর্কটা ছন্দের তর্ক নয়, ভাষারীতির। এইরকম ক্রিয়াপদ যদি ব্যবহার করি তবে ধরে নিতে হবে ঐ ছড়াগুলি প্রাকৃত-বাংলাতেই লেখা হচ্ছে। আমি যে প্রবন্ধ লিখছি এও প্রাকৃত-বাংলার ঠাটে। যদি আমাকে কারো সঙ্গে মুখে মুখে আলোচনা করতে হত তাহলে এই লেখার সঙ্গে আমার মুখের কথার কোনো তফাত থাকত না। মাঝে মাঝে অভ্যাসদোষে হয়তো ইংরেজি শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত, কিন্তু কখনোই “করিয়াছিল’ “গিয়াছে’ ধরনের ক্রিয়াপদ ভুলেও ব্যবহার করতে পারতুম না। আবার প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ সংস্কৃত-বাংলায় ব্যবহার করাও চলে না। প্রবোধচন্দ্র “বিচিত্রা’য় লিখেছেন যে, বাঙালি কবিরা সাহস করে কবিতায় “করিব’ “চলিব’ প্রভৃতি প্রয়োগ না করে কেন “করব’ “চলব’ প্রয়োগ না করেন। যদি প্রশ্নটার অর্থ এই হয় যে, অযথাস্থানে কেন করি নে তবে তার উত্তর দেওয়া অনাবশ্যক। যদি বলেন, যথাস্থানেও কেন করি নে, তবে তার উত্তরে বলব, যথাস্থানে করে থাকি।
যে তর্ক নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেম সেটাতে ফিরে আসা যাক। বাংলায় হসন্তমধ্য শব্দগুলোয় কয় মাত্রা গণনা করা হবে, তাই নিয়ে সংশয় উঠেছে।
যেগুলি ক্রিয়াপদ নয় সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এ প্রবন্ধের গোড়াতেই আলোচনা করেছি। বলেছি, নিয়মের বিকল্প চলে; কেননা, বাঙালির কান সাধারণ ব্যবহারে সেই বিকল্প মঞ্জুর করেছে। এ ক্ষেত্রে হিসাবে একটা মাত্রার কমিবেশি নিয়ে তর্ক ওঠে না।
চিম্নি ভেঙে গেছে দেখে গিন্নি রেগে খুন;
ঝি বলে, আমার দোষ নেই ঠাকরুন।
অন্তত “চিমনি’কে দুই মাত্রা করায় কবির দোষ হয় নি। আবার
চিমনি ফেটেছে দেখে গৃহিণী সরোষে;
ঝি বলে, ঠাক্রুন মোর নাই কোনো দোষ।
এ রকম বিপর্যয়ও চলে। একই ছড়ায় “চিম্নি’কে একমাত্রা গ্রেস মার্কা দেওয়া হয়েছে, অথচ “ঠাক্রুন’কে খর্ব করে তিনমাত্রায় নামানো গেল। অপরাধ ঘটেছে বলে মনে করি নি।
কুস্তির আখড়ায় ভিস্তিকে ধরে
জল ছিটাইয়া দাও, ধুলা যাক মরে।
অপর পক্ষে–
রাস্তা দিয়ে কুস্তিগির চলে ঘেঁষাঘেঁষি,
এক্টা নয় দুটো নয় একশোর বেশি।
প্রয়োজনমতো এটাও চলে, ওটাও চলে। নিখতির মাপে বিচার করতে গেলে বিশুদ্ধ ওজনের পয়ার হচ্ছে–
পালোয়ানে পালোয়ানে চলে ঘেঁষাঘেষি।
তাতে প্রত্যেক অক্ষর নিখুঁত একমাত্রা, সবসুদ্ধ চোদ্দটা। “রাস্তা’ “কুস্তি’ প্রভৃতি শব্দে ওজন বেড়ে যায়, তবুও বহুসহিষ্ণু পয়ারকে কাবু করতে পারে না।
প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ক্রিয়াপদেই তার আপন চেহারা। ঐটুকু ছাড়া তাঁর আর কোনো উপসর্গ নেই বললেই চলে। বাংলা-সংস্কৃত ভাষার মতো সে শুচিবায়ুগ্রস্ত নয়। ভোজে বসে গেছে ব্রাহ্মণ, তাকে পরিবেশনকর্তা জিজ্ঞাসা করলে, নিরামিষ না আমিষ। সে বললে, দ্বৌ কর্তব্যৌ। তেমনি শব্দবাছাই নিয়ে যদি প্রাকৃত-বাংলাকে প্রশ্ন করা যায় “কী চাই, প্রাকৃত শব্দ না সংস্কৃত শব্দ’ সে বলবে, দ্বৌ কর্তব্যৌ। তার জাতবচার নেই বললেই হয়। পছন্দ হবামাত্র ইংরেজি পারসি সব শব্দই সে আত্মসাৎ করে। আবার অমরকোষবিহারী বড়ো বড়ো বহরওয়ালা সংস্কৃত শব্দকে ওদেরই ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে নেয়। সংস্কৃত ভাষার প্রতি সম্ভ্রমবশত তার মুখে বাঁধবে না।–
রূপযৌবন উপঢৌকন দেবেন কন্যা তাহারে,
তাই পরেছেন চীনাংশুকের পট্টবসন বাহারে।
নন-কো-অপরেশনের দিনেও ইংরেজি শব্দ চালিয়ে দিতে পিকেটিঙের ভয় নেই। যথা–
আইডিয়াল নিয়ে থাকে, নাহি চড়ে হাঁড়ি,
প্রাক্টিক্যাল লোকে বলে, এ যে বাড়াবাড়ি।
শিবনেত্র হল বুঝি, এইবার মোলো,
অক্সিজেন নাকে দিয়ে চাঙ্গা করে তোলো।
কিন্তু সংস্কৃত-বাংলায় বাছবিচার খুব কড়া। আধুনিকদের হাতে পড়ে ম্লেচ্ছপনা কিছু-কিছু সয়ে গেছে; কিন্তু সেটুকু বড়োজোর বাইরের রোয়াকে, ভিতরমহলে রীতরক্ষা সম্বন্ধে কষাকষি।
কর্ণে দিলা ঝুম্কাফুল, নাসিকায় নথ,
অঙ্গসজ্জাসমাধানে ভূরি মেহন্নৎ।
এটাকে প্রহসন বলে পাঠক হয়তো মাপ করতে পারেন, কিন্তু প্রাকৃত বাংলায় এইরকম ভিন্নপর্যায়ের শব্দগুলো যখন কাছাকাছি বসানো যায় তাদের আওয়াজের মধ্যে অত্যন্ত বেশি বেমিল হয় না। আমার এই গদ্যপ্রবন্ধ পড়ে দেখলে পাঠকেরা সেটা লক্ষ্য করতে পারবেন। কিন্তু এটাও দেখে থাকবেন, এটার মধ্যে “করিব’ “করিয়াছে’ “করিয়াছিল’ প্রভৃতি ক্রিয়ারূপ কলমের কোনো ভুলে ঢুকে পড়বার কোনো সম্ভাবনা নেই। সেইজন্যে আমরা বাংলায় সংস্কৃতে ও প্রাকৃতে দুই ভিন্ন নিয়মেই চলি, তার অন্যথা করা অসম্ভব। তাই বাংলাকাব্যে এই দুই ভাষার ধারায় ছন্দের রীতি যদি দুই ভিন্ন পথ নিয়ে থাকে তবে সেই আপত্তিতে শুদ্ধির গোময়লেপনে সমস্ত একাকার করবার পক্ষপাতী আমি নই। আমি বলি, দ্বৌ কর্তব্যৌ। কারণ, ছন্দের এই দ্বিবিধ রসেই আমার রসনার লোভ।
মাঘ, ১৩৩৮